১০
ইউরোপে যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। অনেকে মনে করেন এ যুদ্ধ ক্ৰমে পৃথিবীব্যাপী হবে, এবং ভরসা করেন তার ফলে মানুষের মধ্যে আসবে এক নবযুগ–‘নিউ অর্ডার’। জাতির সঙ্গে জাতির ও দেশের সঙ্গে দেশের অত্যাচারী অত্যাচারিতের সম্পর্ক আর থাকবে না। পৃথিবীর মানুষ হবে এক গোষ্ঠী, সকলের দরদে হবে সকলে দরদি। এমন যদি ঘটে। তবে কথাই নেই। কোথায় থাকবে বাংলাদেশে ও ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া, আর কোথায় থাকবে বাঙালি হিন্দুর জাতিভেদ ও দুর্বলতা। মহাযুদ্ধের মহামাজিকে ও সব ছোটখাটো ব্যাপার কোথায় তলিয়ে যাবে লক্ষই হবে না। বিনা চেষ্টায় আপনা। আপনি হয়ে যাবে তাদের মীমাংসা।
মানুষের বাইরের ও মনের সভ্যতাকে ধাপে ধাপে টেনে তুলতে হয় প্রাণান্ত পরিশ্রমে। কখনও এক ধাপ উঠে আবার নীচে গড়িয়ে পড়ে। পরিশ্রমের শেষ নেই, আশা ভঙ্গেরও অবধি নেই। যুগ-যুগান্তব্যাপী এই সংগ্রাম জয় হয়ে যাবে একটা মাত্র বিরাট হত্যাকাণ্ডেকারনা আকাঙ্ক্ষা যায় বিশ্বাস করতে! মিরাকলে’ বিশ্বাসের তাই তো মূল।
কুরুক্ষেত্রের ফলে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দাম্ভিক দুৰ্যোধনের রাজ্যহানি ও মৃত্যু এবং মিষ্টভাষী যুধিষ্ঠিরের জয় ও রাজ্যলাভ এ ছাড়া সে ধৰ্মরাজ্যের স্বরূপ কী ছিল বেদব্যাস কিছু বলেননি।
রাও বিল
রাও কমিটির প্রস্তাবিত হিন্দু কোড বা সংহিতার প্রধান লক্ষ্য দুইটি–(১) ব্রিটিশ ভারতের হিন্দুরা এখনও যেসব বিষয়ে প্রাচীন হিন্দু আইন দ্বাবা শাসিত সেসব বিষয়ে ব্রিটিশ ভারতবর্ষের সমস্ত হিন্দুর জন্য এক আইনের প্রবর্তন; (২) প্রাচীন হিন্দু আইনের বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী যে সকল সংস্কার বা পরিবর্তন প্রয়োজন, সেই সকল সংস্কার ও পরিবর্তনেব ব্যবস্থা করা। এই লক্ষ্য দুইটির প্রথমটি ব্রিটিশ ভারতের সমস্ত হিন্দুকে এক অখণ্ড হিন্দুজাতিরূপে পরিণত করার একটি বড় উপায়। বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী হিন্দুর মধ্যে বর্তমান অবস্থায় ধর্ম ছাড়াও অন্য যোগসূত্র নিতান্ত প্রয়োজন। দেশের মধ্যে হিন্দু সংগঠনের যে কথা শোনা যায়, সেই সংগঠনের এ একটি প্রধান উপায়। ব্রিটিশ ভারতবর্ষের সমস্ত হিন্দুর জন্য এক আইন প্রবর্তনের উপায়–বিভিন্ন প্রদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনের কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে এক আইনের রূপ দেওয়া।
রাও কমিটির প্রস্তাবিত সংহিতার দ্বিতীয় লক্ষ্যটি এইজন্য প্রয়োজন যে, ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজ্যশাসনের প্রতিষ্ঠার পূর্বে যে উপায়ে হিন্দু আইনের সংস্কার হত সে সব উপায় এখন অসম্ভব হওয়ায় হিন্দু আইনের স্বাভাবিক পরিণতি ও সংস্কারের ধারা বন্ধ হয়েছে। আইনসভায় হিন্দু আইনের সংস্কার না করলে বর্তমান কালোপযোগী তার সংস্কার আর সম্ভব নয়।
রাও কমিটির প্রস্তাবিত সংহিতা সম্বন্ধে যে সব আন্দোলন ও আলোচনা হয়েছে তার মধ্যে দুইটি বিষয় নিয়েই সচরাচর আলোচনা দেখা যায়–(১) হিন্দু উত্তরাধিকার আইন; (২) হিন্দু বিবাহ সম্বন্ধীয় আইন। হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সম্বন্ধে রাও কমিটির প্রস্তাবের মৰ্ম এই রকম : নিকট সম্পৰ্কীয়গণের উত্তরাধিকারে মোটামুটি দায়ভাগের অনুসরণ এবং দূরসম্পৰ্কীয়গণের উত্তরাধিকারে মোটামুটি মিতাক্ষরার অনুসরণ। কারণ, নিকট সম্পৰ্কীয়গণের উত্তরাধিকারে দায়ভাগের বিধান মানুষের স্বাভাবিক ইচ্ছার অধিকতর অনুরূপ এবং দূরসম্পৰ্কীয়গণের উত্তরাধিকারে মানুষের বিশেষ কোনও স্বাভাবিক ইচ্ছা! থাকে না। সেখানে একটি ন্যায়সম্মত সরল বিধিরই বিশেষ প্রয়োজন এবং মিতাক্ষরার বিধি এইরূপ ন্যায়বিধি ও দায়ভাগের বিধির চেয়ে অনেক সরল।
দ্বিতীয়ত, রাও কমিটির প্রস্তাবে স্ত্রীসম্পৰ্কীয়দের উত্তরাধিকারের স্বত্ব প্রচলিত আইনের তুলনায় বেশি স্বীকার করা হয়েছে। এই স্বীকারের বিরুদ্ধেই বিরুদ্ধমত সবচেয়ে প্রবল। বিশেষত, বাপের সম্পত্তিতে মেয়েকে ছেলের অর্ধেক অংশ দিবার যে প্ৰস্তাব তার বিরুদ্ধেই বিশেষ আপত্তি। আপত্তিকারীগণ বলেন যে, এতে হিন্দুর সম্পত্তি বহুভাগে বিভক্ত হয়ে হিন্দুর আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটবে। এই আপত্তি ও আশঙ্কা ভিত্তিহীন। আপত্তিকারীগণ ভুলে যান যে, সম্পত্তির যাতে ভাগ বেশি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য করেই হিন্দুর উত্তরাধিকার আইন রচিত হয়নি। তা হলে পিতার এক পুত্র অথবা দুই পুত্ৰ মাত্র উত্তরাধিকারসূত্রে পিতার সম্পত্তি পাবে, এইরূপ বিধান হত। সেইরূপ বিধানের অনুবর্তন প্রয়োজন, একথা কোনও আপত্তিকারী এ পর্যন্ত বলেননি। উত্তরাধিকার আইনের একটি প্রধান লক্ষ্য–যাদের উত্তরাধিকার ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয়, তাদের উত্তরাধিকারী করা। অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যই উত্তরাধিকারের একমাত্র, এমনকী প্ৰধান উদ্দেশ্য নয়। বাপের বিষয়ে মেয়ের অংশ ও সে অংশ ছেলের অর্ধেক নির্ধারণ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। যাঁরা এই ব্যবস্থায় হিন্দুর আর্থিক অবনতির আশঙ্কা করেন, তাঁরা সম্ভব ভেবে দেখেননি যে, ভারতবর্ষের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীগণের মধ্যে এবং বহু দেশে ছেলে ও মেয়ের একসঙ্গে উত্তরাধিকার প্রচলিত আছে এবং তাতে তাদের আর্থিক অবস্থা হীন হয়েছে, এর কিছুমাত্র প্রমাণ নেই। কেহ কেহ আপত্তি তুলেছেন, মেয়েরা যখন স্বামীর উত্তরাধিকারিণী তখন তাদের পিতার উত্তরাধিকারিণী করা উচিত নয়। একজনের উত্তরাধিকারিত্ব অপর জনের উত্তরাধিকারিত্বে বাধা হওয়া কোনও ন্যায়ই সমর্থন করে না-যেমন একথা কেহ বলে না যে, ছেলে যখন পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারীতখন তাকে মাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করা উচিত নয়।