কিন্তু বায়লজি’ কি এ প্রস্তাবের বিরোধী নয়? হিন্দুসমাজে এই যে উচ্চ জাতি নিচু জাতির ভেদ একি কতকগুলি বিশেষ শ্রেষ্ঠ গুণকে রক্ত মিশ্রণে লোপের আশঙ্কা থেকে বঁচিয়ে চিরকালের জন্য রক্ষা করার ব্যবস্থা না? এ ভেদ তুলে দিয়ে একাকার করলে কি বহুকালের গুণের পুঁজি তছরূপ হবে না? বাঙালি ব্ৰাহ্মণ ও বাঙালি শূদ্রের দিকে তাকিয়ে, ও শিক্ষা সমান পেলেও তাদের বুদ্ধির তারতম্যে, যাঁরা জাতির তফাত দেখতে ও ধরতে পারেন, তাঁরা নিশ্চয় অসামান্য লোক! বাঙালি ব্ৰাহ্মণের ফরসা চামড়া, কটা চামড়া, কাককৃষ্ণ চামড়া; উচু নাক, খাদা নাকি; লম্বা মাথা, গোল মাথা সব দেখেও তাদের রক্তের বিশুদ্ধতায় যাঁরা বিশ্বাস হারান না, তাদের বৈজ্ঞানিক মতের দৃঢ়তাও অসাধারণ। মানুষে মানুষে ভেদ আছে, বুদ্ধির শক্তির, নানা পটুতার যা জন্মগত; কোনও শিক্ষার বলে সে ভেদ লোপ করা যায় না। এর চেয়ে স্পষ্ট সত্য আর কী আছে! কিন্তু যাঁরা প্রমাণ করতে চান যে হিন্দুর জাতিভেদ মানুষে মানুষে এই স্বাভাবিক প্রভেদের রেখা ধরে নিজের গণ্ডি এঁকেছে৷ তাঁরা ‘বায়লজি’র নাম নেন বৃথা। বায়লজি’ কেবল প্রমাণ করবে যে এই কল্পনার সঙ্গে পরীক্ষিত সত্যের, সুতরাং বিজ্ঞানের কোনও সম্বন্ধ নেই। জাতিভেদ তুলে দিলে হিন্দু সমাজ একাকার হবে না। অন্য আর সব সমাজের মতো নানা স্বাভাবিক ভেদ বজায় থাকবেই। যেমন শিক্ষিত পরিবারের সঙ্গে অশিক্ষিত পরিবারের বিবাহ সম্বন্ধ ঘটবে কদাচিৎ।
এবং শিক্ষিত হবার সামৰ্থই প্রমাণ দুই পরিবারের জন্মগত গুণের অমিশ্রেয় প্রভেদ কিছু বর্তমান নেই।
প্রাচীন হিন্দু আচার্যেরা জাতিভেদের গুহাস্থিত এই ‘বায়লজির তত্ত্ব অবশ্য অবগত ছিলেন না। মনুর ‘ভাষ্যে’ মেধাতিথি প্রশ্ন তুলেছেন ব্ৰাহ্মণ জাতি ও শূদ্র জাতির এই যে ভেদ এ কেমন ভেদ? একি গোজাতি ও অশ্বজাতির যে দৃষ্ট ভেদ, তাকিয়ে দেখলেই দেখা যায়, সেই রকম ভেদ, অবশ্য নয়; কারণ দেখে কেউ বলতে পারবে না কে ব্ৰাহ্মণ কে শূদ্ৰ। সুতরাং এ ভেদ অদৃষ্ট শাস্ত্রীয় ভেদ, লৌকিক জ্ঞান দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু এ কালের সনাতন পন্থীরা মীমাংসকদের লৌকিক অলৌকিক জ্ঞানের তফাত মানে না। হিন্দুধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় সুবিধা পেলেই তাঁরা রাজি। প্রাচীন ঋষিদের অভ্রান্ত জ্ঞানের উপর তাদের অগাধ ভক্তি, এবং আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের জড়বাদের উপর তাদের অসীম অবজ্ঞা। কিন্তু ও বিজ্ঞানের কোনও কিছু তাদের সনাতন মতের সমর্থন মনে হলেই তৎক্ষণাৎ তা লুফে নেন। কিছু আশ্চর্য নয়। তাঁরা আঁকড়ে থাকতে চান তাদের সংস্কারগুলিকে, বিনা বিচারে ও বিশ্লেষণে। যদি ঋষিবাক্য পাওয়া যায় ভালই। আর যদি জড়বাদী, ম্লেচ্ছ বৈজ্ঞানিকের সমর্থন পাওয়া যায় সেভি আচ্ছা।
যাঁরা বলেন জাতিভেদ হিন্দু ধর্মের অত্যাজ্য অঙ্গ, ওকে না মানলে ধর্ম হানি হয়, এবং ঐহিকের সুবিধার জন্য পািরত্রিক ক্ষতি মুর্খতা তাদের কোনও তর্কই নেই। বাংলাদেশে ও ভারতবর্ষে হিন্দু বঁচুক কি মরুক সেটা বড় কথা নয়, জাতিভেদের শুচিত রক্ষা তার চেয়ে অনেক বড় কথা। তাঁরা সে শুচিত সযত্নে রক্ষা করুন। তাদের অশূদ্ৰস্পষ্ট স্বর্গের দরজা কেউ অববোধ করবে না।
৯
এত কালের অভ্যস্ত প্ৰথা বর্জন করতে বহু তর্ক ও বহু আন্দোলনের ফলেও সমস্ত বাঙালি হিন্দু একমত হবে সে আশা কেউ করে না। এবং এখানে ওখানে দু-চার জন ন্যায় ও ধর্ম বোধে জাতি বর্জন করলে তাঁরা একঘরে হওয়া ছাড়া বাঙালি হিন্দু সমাজের উপরে তার অন্য ফল আর কিছু ফলবে না। বাঙালি হিন্দুর মধ্যে এ সংস্কার আনার পথ ওকে জাতীয় আন্দোলনের অংশ করা। যাঁরা মনে করে এবং আন্দোলন আলোচনার কালে মনে করবে: ও-ভেদের লোপ জাতির জীবন ও সৃষ্টির জন্য আজ একান্ত প্রয়োজন তাদের দল বেঁধে ওকে বর্জন করতে হবে। হিন্দু থেকে ও হিন্দু সমাজের মধ্যে থেকে জাতিভেদকে অগ্রাহ্য করতে হবে। প্রথম থেকেই সে দল ছোট হবে না, এবং তাকে একঘরে করার চেষ্টা হবে অর্থহীন। দলাদলি অবশ্যই আরম্ভে থাকবে কিন্তু মনে হয় বেশি দিন নয়। ও সংস্কারের মধ্যে সত্যের ও মনুষ্যত্বের যে ভিত্তি এবং প্রয়োজনের যে তাগিদ আছে তাতে অল্প দিনের মধ্যে বিরোধীরাই হবে একঘরে। এবং ফল দেখে চোখের তুলি একবার খুললে স্বাভাবিককেই মনে হবে স্বাভাবিক।
এ কাজ অবশ্য আরম্ভ করতে হবে উচ্চ শ্রেণির হিন্দুর। জাতের গণ্ডি তাঁরা না তুললে শুধু তাদের উপদেশ নিম্নশ্রেণির হিন্দু নিজেদের সব অদ্ভুত ভেদ তুলে দেবে এ মনে করা মূঢ়তা। উচ্চ শ্রেণির হিন্দু অনুকরণেই বাঙালি নিম্ন বর্ণের হিন্দুর মধ্যে জাতির বিভাগ হচ্ছে আদিম cell এর মতো। এক হচ্ছে দুই, দুই হচ্ছে চার। এবং বিবাহের ক্ষেত্র সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে বহু শ্রেণির হিন্দু চলেছে লোপের মুখে। উপদেশ বৃথা। নিজের জাত তুলে দিয়ে জাত যে তোলা যায় তা দেখাতে হবে। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখায়।’ জাতিভেদের উচ্ছেদে বাঙালি হিন্দু যে কেবল নিজেদের যথার্থ এক মনে করে গাঢ়ভাবে সংঘবদ্ধ হবে তা নয়। ওই সংস্কারের চেষ্টায় ও ফলে তার মধ্যে যে শক্তি আজ রুদ্ধ আছে তা প্রকাশের পথ পাবে। এবং তাতে বাঙালি হিন্দুর হবে নবজন্ম, নবশক্তি ও নবদৃষ্টি নিয়ে। বাঙালি হিন্দু আধুনিক ভারতবর্ষকে ভাব ও আদর্শ কম দান করেনি। তার এ চেষ্টা সফল হলে ভারতবর্ষের সমস্ত হিন্দুর উপর তার ফল ফলতে দেরি হবে না।