যে আশ্চর্য ভ্রাতৃত্বে ভাইয়ের স্পর্শ অশুচি, তার হাতের অন্ন অমেধ্য, তার সঙ্গে সামাজিক সম্বন্ধ পাতিত্য আনে সেই আধ্যাত্মিক ভ্ৰাতৃত্ব নিয়ে কোনও রকম ব্যাবহারিক একত্ব বন্ধন সম্ভব নয়। অস্পৃশ্যতা বর্জন, মন্দিরের দ্বার মোচন, হাতের জল চল এ সব উপসর্গের চিকিৎসা, রোগকে রহাল রেখে। রোগ থাকতে উপসৰ্গ দমন করা যাবে কিনা সন্দেহ। আর যদি যায়। তবে সে রোগ যে অন্য উপসর্গের আকারে অচিরেই আত্মপ্ৰকাশ করবে তা নিঃসন্দেহ। হিন্দু সমাজের সেই মূল রোগ হচ্ছে জাতি ভেদের গণ্ডি। ওর অভেদ্য খোলার আবরণ সমস্ত সমাজে এক নাড়ির যোগ স্থাপন অসম্ভব করেছে। হিন্দু সংগঠন যদি প্রকৃতই সে কাজ করতে চায়। তবে ওই গণ্ডি তুলতে হবে, ওই খোলা ভাঙতে হবে। জাতির খোপ খোপ যেমন আছে তেমনি থাকবে, শুধু ভাই বলে ডাক শুনে সমস্ত হিন্দুর হবে এক মন, এক প্ৰাণ–এ আশা নিজেকে বঞ্চনা করা, পরকে ফাকি দেওয়া। সামাজিক অসম্বন্ধের গভীর পরিখার যে ভেদ সুস্পষ্ট নামের জোরে সে ভেদ অভেদ প্রমাণ হবে না, কলিতে নামের মাহাত্ম্য যতই প্রবল হোক। আর এ সব বর্জন মোচন আন্দোলনের মধ্যে যে মনুমেন্ট স্পশী দম্ভ রয়েছে। কেবল শুনে শুনে গা সওয়া হয়েছে বলেই আমরা তাতে লজ্জা পাইনে। আমাদের স্পর্শ পেলে নিম্ন হিন্দু কৃতাৰ্থ হবে এ রামচন্দ্ৰত্বের অভিনয় উচ্চবর্ণের হিন্দু করে কোন লজ্জায়! আমাদের দেব মন্দিরে ঢোকার অধিকারে চণ্ডাল হবে। ধন্য দেবতার এ অপমান তাঁরা করে কোন সাহসে যাঁরা গর্ব করে বলে হিন্দুর ‘সৰ্ব্বং খন্বিদং ব্ৰহ্ম’।
৮
এ প্রস্তাবে তর্ক উঠবে জানি ইতিহাস, বিজ্ঞান, শাস্ত্রের তর্ক। এমন কােনও প্রস্তাব আছে পণ্ডিত লোকে যাকে গ্রাহ্য অগ্রাহ্য দুই প্রমাণ করতে না পারে।
অতি বুদ্ধিমান লোক বলে হিন্দু সমাজে উচু জাত যে তার নিচু জাতের হাতে ভাত খায় না, তাদের মধ্যে বিবাহ সম্বন্ধ যে নিষেধ, তার মধ্যে ঘূণা অবজ্ঞার লেশ নেই। ওটা শুধু আচার, যেমন অনেক বিধবা মা ছেলের হাতের ছোয়া খান না। তফাত কেবল এই শূদ্রের উপর ব্ৰাহ্মণের মনোভাব ছেলের উপর মায়ের মেহ নয়, অন্তত শূদ্র তার কোনও প্রমাণ পায় না। অন্য সমস্ত গুণ দোষ নিরপেক্ষ কেবল জন্মের ফলে একদল লোকের শ্রেষ্ঠত্ব ও অন্যদলের হীনত্ব জাতি ভেদের ভিত্তি। মনু বলেছেন বটে যে ব্ৰাহ্মণের শাস্ত্রোক্ত গুণ নেই সে হচ্ছে তেমনি ব্ৰাহ্মণ যেমন কাঠের হাতি ও হাতি। কিন্তু সেই পুতুল ব্ৰাহ্মণেরও শূদ্রের মেয়ে বিয়ে করলে জাত যায়, সে শূদ্রের যতই ব্ৰাহ্মণোচিত গুণ থাকুক না কেন। নিজের শ্রেষ্ঠত্ববোধ ও অন্যের হীনত্বের ধারণা এক বস্তুর দুই পিঠ। একটি ছেড়ে অন্যটি থাকে না। জাত অল্প নিচু হলে তার উপর অবজ্ঞা, আর বেশি নিচু হলে তার উপর ঘূণা এর অবশ্যম্ভাবী ফল। অবশ্য এই অবজ্ঞা ও ঘূণা যখন দু’পক্ষের একান্ত অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন যে ঘূণা করে তার সে মনোভাবে কোনও তীক্ষতা থাকে না, যে ঘূণা পায় তারও অপমানের বোধ থাকে না। ব্যাপারটা দু’ পক্ষের রোদ বাতাসের মতো স্বাভাবিক মনে হয়। দাসত্বের ইতিহাসে বার বার তা প্রমাণ হয়েছে। এটা ঘূণার অভাব নয়, ঘূণার চরম ও ভয়ংকর পরিণতি। যাক এ মনস্তত্ত্বের তর্কে লাভ নেই। যাদের বাঁচিয়ে আচার’ তাঁরা একে অপমান বলে মনে করতে আরম্ভ করেছে। শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যা তাদের মধ্যে যত বাড়বে এ অপমানের বোধ তত বেশি হবে, এবং জাতের দেয়াল আঁকড়ে থাকলে উচ্চবর্ণের হিন্দুর সঙ্গে তাদের বিচ্ছেদ হবে অনতিক্রমণীয়। এর লক্ষণ চার দিকে দেখা যাচ্ছে ‘হিন্দু সংগঠনে’ যাঁরা উদ্যোগী একে উপেক্ষা করার তাদের উপায় নেই।
ইতিহাসের তর্ক কম নয়। এ জাতিভেদ তো হিন্দু সমাজে হাজার হাজার বছর রয়েছে। আর হিন্দু সভ্যতা আজও টিকে আছে। কোথায় অন্য সব প্রাচীন সভ্যতা! হিন্দু সভ্যতা যে টিকে আছে, অর্থ তার যাই হোক, আর এককালে যে সে সভ্যতা গৌরবের ছিল সেটা জাতিভেদের ফল নয়, জাতিভেদ সত্ত্বেও অন্য গুণে এবং পারিপার্শ্বিকের অনুকুলতায়। বাইরের আঘাত যেই প্রবল হয়েছে অমনি ওই দুর্বলতা তাকে আচ্ছন্ন করেছে। শরীরে অনেক রোগের বীজ থাকে। তা সত্ত্বেও মানুষ বেঁচে থাকে মোটামুটি সুস্থ অবস্থায়, শরীরের অন্য শক্তি যতদিন রোগের বীজ চেপে রাখতে পারে, এবং পারিপার্শ্বিক যতদিন বীজ থেকে রোগ প্রকাশের অনুকুল ক্ষেত্র তৈরি না করে। যখন যা ঘটে তখন জীবনযাত্রার প্রণালী বদলাতে হয়, রোগ প্ৰতিষেধের বিশেষ উপায় করতে হয়। সহজ কথা অবস্থা বদলেছে, বাঁচতে হলে ব্যবস্থা বদলাতে হবে। সেইজন্য হিন্দুর ‘স্মৃতি’ বার বার বদল হয়েছে, এক এক মুনির সঙ্গে অন্য মুনির মতের মিল নেই।
তর্কটা যখন পণ্ডিত লোকেই তোলে তখন দু-একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া অবান্তর নয়। হিন্দুর জাতিভেদের আজ যে চেহারা, ভাতের হাঁড়ির শুচিতা, ও বিবাহে পাথরের বেড়া, হিন্দু সভ্যতার গৌরবের দিনে তার এমন আকার ছিল না। আপস্তম্বের স্মৃতিতে দেখি পাকটা ছিল আৰ্যাশ্রিত শূদ্রের কাজ, কেবল নামটা দেওয়া হয়েছিল। পাকযজ্ঞ। অনুলোম বিবাহ হিন্দু সভ্যতার গৌরবের শেষ যুগ পর্যন্ত চলতি ছিল; স্মৃতি গ্রন্থের পাতায় নয়, সামাজিক ব্যবহারে। একটা দৃষ্টান্ত দিই বাণভট্ট মহারাজ হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক; হিন্দু সভ্যতার গৌরবের শেষ যুগ, অনেকের মতে সবচেয়ে গৌরবের যুগ যখন সে সভ্যতা এশিয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত হয়েছিল। বাণভট্টের বংশ বেদজ্ঞ ব্ৰাহ্মণের বংশ। যার পরিচয়ে তিনি ‘কাদম্বরী’র প্রস্তাবনা শ্লোকে বলেছেন যে, অনেক গুপ্ত রাজারা তার পূর্ব-পুরুষের পাদপল্লব অৰ্চনা করেছেন। তাদের বাড়ির পোষা শুকপক্ষীও ক্রমাগত তন শুনে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করত। সেই বাণভট্ট ‘হর্ষচরিতে’ বিনা দ্বিধায় লিখেছেন যে, তিনি তার পিতার ব্ৰাহ্মণী পত্নীর পুত্র, কিন্তু তাঁর আর দুটি ভাই আছে যাঁরা তাঁর পিতার শূদ্র স্ত্রীর সন্তান; তাদের নামও তিনি দিয়েছেন। সেদিনকার উচ্চ ব্ৰাহ্মণ সমাজে যদি এমন বিবাহে বিন্দুমাত্রও দোষ বর্ণনা থাকত, বাণভট্ট সে কাহিনি কখনই লিখতেন না।