এ কাজ কঠিন। এ পথ চড়াই উতরাই-এর বিষম পথ; যার মোড়ে মোড়ে বিপদ। এ পথে প্রকাশ্য ও গোপন মুসলমান ও হিন্দু শত্রুর অবধি থাকবে না। স্বর্থনাশের যাদের আশঙ্কা। যাদের মধ্যে কাজ এবং যাদের জন্য কাজ তারাই সন্দেহ করবে ও মারমুখ হবে। তাদের উত্তেজিত করার লোকের অভাব হবে না। কমুনিস্ট বলে পুলিশ লেলিয়ে দেবার কমুন্যালিস্ট জুটবে অনেক। এ কাজের উপায় মানুষের বুদ্ধিকে জাগান, অন্ধ সংস্কারকে উসকান নয়। সবচেয়ে কঠিন কাজ। বিশেষ সে মানুষের দলের অধিকাংশ যখন নিরক্ষর অজ্ঞান। এ কাজের যাঁরা কমী তাদের চেতন ও অবচেতন মনকে করতে হবে সকল রকম সাম্প্রদায়িক রাগ দ্বেষের কলুষমুক্ত। এবং আচার ব্যবহারে যাঁরা ভিন্ন তাদের সঙ্গে শক্রিতায় ক্রোধ ও ঘূণার যে তীব্র মাদকতা তাতে মাতাল হওয়ার আনন্দ এতে নেই। বহু শ্ৰমে ফল ফলবে অল্প, বহু ডাকে সাড়া দেবে অল্প লোক। আশা ভঙ্গ হবে পদে পদে। তবু এই পথই পথ, আর সব অন্ধগলি।
এ পথেও সিদ্ধ যে অবশ্যম্ভাবী তা নয়। জাতির এমন দুর্দিন আসে, যখন ক্ষুদ্র স্বাৰ্থ, ক্ষুদ্র লোভ অন্ধ বিদ্বেষকে দূর করে তার শুভবুদ্ধি কিছুতেই জাগে না। ভারতবর্ষ ও বাংলার যদি এমন দুর্ভাগাই হয়, যদি জাতীয়তার কোনও মন্ত্রেই সাম্প্রদায়িক বিষ ধ্বংস না হয় তবে মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার পালটায়, তার আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা হয়তো অনিবাৰ্য হবে। কিন্তু তাতে উৎসাহের কিছু নেই; সে আমাদের পরাজয়। এমন প্রাণী আছে পারিপার্শ্বিক যখন তাদের স্বাভাবিক জীবনলীলার প্রতিকূল হয় উচুস্তরের প্রাণীর উপযোগী শরীরের যন্ত্রপাতি লোপ হয়ে তাঁরা ধাপে ধাপে নেমে যায় আদিম ভ্ৰাণের পিণ্ডাকার অবস্থায় শুভ দিনের অপেক্ষায়। তবুও বেঁচে থাকে। সে বাঁচা জীবস্মৃত্যু, হিন্দু স্মৃতিকারেরা যাকে বলেছেন জীবন্ত শব। জীবিত এব। শব্বাস্তে তস্মাৎপািরশবা স্মৃতাঃ। জাতির পারিশবত্ব প্ৰাপ্তি জয়ধ্বনির কারণ নয়।
কমুন্যাল সমস্যা মীমাংসার অন্য উপায় যে কল্পনা করা যায় না তা নয়। ভারতবর্ষের বাইশ কোটি হিন্দু আট কোটি মুসলমানকে দমিয়ে ইংরেজকে তাড়ালে, অথবা আট কোটি মুসলমান বাইশ কোটি হিন্দুকে দাবিয়ে ইংরেজকে খেদালে এ সমস্যার অবশ্য মীমাংসা হয়। হিন্দু মহাসভার ভীষ্ম দ্রোণেরা ও মোসলেম লিগের সিংহ ব্যাঘ্ররা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তবে যে শক্তিতে সম্ভব চাকরির ভাগাভাগির উৎসাহে তার সৃষ্টি হয় না। ভাতেব চুল্লির আগুনে ড্রেড নট চলে না।
৭
উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দুর চাকরি ও প্রতিষ্ঠার উপর মুসলমানের সাম্প্রদায়িক অভিযানের একটা সুফল ফলেছে। উচ্চ হিন্দু যে বাঙালি হিন্দু সমাজের ক্ষুদ্র অংশ সে চেতনার শুরু হয়েছে। ভাব ও চিন্তার প্রচার অল্প লোকে করা যায়, তার সৃষ্টি করে আরও অল্প লোক, চাকরি ও প্রতিপত্তি প্রার্থী লোক অনেক হলে বিপদ কিন্তু সংখ্যার চাপ যেখানে প্রয়োজন সেখানে দল বড় না হলে কাজ হয় না। বাঙালি হিন্দুর এই সংখ্যা আছে উচ্চবর্ণের হিন্দুর মধ্যে নয়, নিচু জাতি হিন্দু পল্লির ভিতরে। সুতরাং উচ্চবর্ণের হিন্দু মুখে এনেছে যে উঁচু নিচু সব হিন্দু আমরা পরস্পরের ভাই। আমরা ভিন্ন নই, আমরা এক।
এই নিম্ন শ্রেণি হিন্দুর প্রাণশক্তি যে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে, অর্থহীন ও আত্মঘাতী আচারের নাগপাশে যে তাদের হৃৎপিণ্ড বন্ধ হবার উপক্রম, জীবনকে পঙ্গু করে। মৃত্যুকে ঘনিয়ে আনার যত রকম ফন্দি দিনের পর দিন যে তাঁরা আবিষ্কার করে চলেছে সে দিকেও দৃষ্টি পড়েছে। এরা যে কত দুর্বল, নিজের শক্তিতে কত আস্থাহীন, যেখানে এরা সংখ্যায় অল্প এবং যেখানে এরা সংখ্যায় বেশি প্রতিবেশী দুর্দান্ত মুসলমানের অত্যাচার যে এরা বিনা প্ৰতিকারে সহ্য করে, স্ত্রী কন্যার সম্মান রক্ষায় হাত তুলতে ভরসা করে না সে বার্তাও আমাদের বিচলিত করতে আরম্ভ করেছে। এ সব ব্যাপার নতুন নয়, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের পর থেকে এদের আরম্ভ হয়নি। দু-চারটি সন্ন্যাসী গোছের প্রতিষ্ঠান ছাড়া উচ্চ হিন্দুর ব্যাপক দৃষ্টি এতদিন এদিকে যায়নি। আজ যাচ্ছে নিষ্কাম প্রীতিতে নয়, নিজের গরজে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। কোন আঘাতে চৈতন্য এল সেটা মুখ্য নয়, আশার কথা যে ঘুম ভাঙছে।
এর প্রতিকারের যে উপায় উচ্চবর্ণের হিন্দু ব্যবস্থা করছে তার নাম ‘হিন্দু-সংগঠন’।
হিন্দুর সঙ্গে হিন্দুর, উচ্চ শ্রেণির সঙ্গে নিম্ন শ্রেণির হিন্দুর নডির যোগ এমন দৃঢ় করতে হবে যে এক অঙ্গের আঘাতে সমস্ত শরীর ব্যথা পাবে এবং প্রতিবিধানে তৎপর হবে।
অসহায় নিম্ন শ্রেণির হিন্দুকে ভরসা দিতে হবে, কথায় ও কাজে, যে তাঁরা অসহায় নয়, উচ্চ শ্রেণির শিক্ষিত হিন্দু, যাদের অর্থ আছে, বুদ্ধি আছে, বল আছে, তাঁরা তাদের ভাই, আপদ বিপদে সহায়, সুখ দুঃখের ভাগী। এবং আশা করা অন্যায় হবে না যে এতে নিম্ন শ্রেণির হিন্দু ও উচ্চবর্ণের হিন্দুর আপদ বিপদ নিজেদের আপদ বিপদ মনে করবে, সব কাজে তাদের অনুবতী হবে, সংখ্যার প্রয়োজনে নিজেদের সংখ্যা দিয়ে বাঙালি হিন্দুর অখণ্ড সংখ্যা বাড়াতে দ্বিধা করবে না।
যে সংগঠন’ বাঙালি হিন্দুকে বড় ছোট অভেদে এক গোষ্ঠী করে গডতে চায় তার প্রেরণা যে অবস্থার ফেরেই এসে থাকুক না কেন জাতির পক্ষে তা পরম মঙ্গলের। কিন্তু প্ৰথম উৎসাহের উত্তেজনার ফেনা প্ৰশমন হলেই দেখা যাবে যে এ সংগঠনের যে সব পেটেন্ট মাল মশলার বিজ্ঞাপনে দেশের মনের দেয়াল ভর্তি, গড়নের কাজ তা দিয়ে বেশি দূর এগোয় না। কারণ তাতে আর যাই থাকুক চুন সুবকি নেই। ইট সাজান যায়। কিন্তু তাদের জোড়া লাগান যায় না।