পড়বে, যাঁরা মধ্যপন্থী তারাই হবে নির্বাচিত তাদের নিরাশ হতে দেরি হবে না। রাগ দ্বেষ যখন প্রবল থাকে তখন ও রকম ভোট ভাগাভাগি বেশি হয় না। তখন হিন্দুয়ানির ডাকে হিন্দু দেবে হিন্দুকে ভোট, মোসলেমের ডাকে মুসলমান দেবে মুসলমানকে ভোট। যাঁরা উৎকট মুসলমান ও উৎকট হিন্দু তারাই যেতে পারবে প্রতিনিধি হয়ে, আপোষ্যপন্থী কাফের ও অনাৰ্য হবে একঘরে। খাঁটি হিন্দু ও খাঁটি মুসলমানের এই মিশ্র নির্বাচনের এমন পরিণতি হতে পারে যে বাঙালি হিন্দুকে ছুটতে হবে ইংরেজের দরবারে ডেমোক্রেটিক কুত্তা বলিয়ে নেবার আর্জি পেশ করতে।
৫
বাঙালি হিন্দু মুসলমানের ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রিক দল গড়ার স্পষ্টাৰ্থ দু’ পক্ষের পাল্লা দিয়ে ইংরেজের আনুগত্য করা। আমরা হিন্দু কারও অহিত করতে চাই না, শুধু চাই নিজেদের ন্যায্য স্বাৰ্থ রক্ষা করতে; আমরা মুসলমান কারও অনিষ্ট চিন্তা করি না, কেবল নিজেদের ন্যায়সঙ্গত দাবির পূরণ চাই এ বুলিতে সত্য উলটে যায় না। সে সত্য হচ্ছে ধর্মমতের তফাত রাষ্ট্রীয় কাজে অবাস্তর। যেখানে পরাধীন দেশে সেই ভেদকে করতে হয়। স্বতন্ত্র অধিকারের ন্যায় অন্যায়ের বাটখারা সেখানে এই বিরুদ্ধ স্বার্থের ‘ব্যালান্স’ রক্ষার ভার যাবেই যাবে তৃতীয় পক্ষের হাতে। সে তৃতীয় পক্ষ নিরাসক্ত মধ্যস্থ নয়। নিজের দিকে পাল্লা ভারী করতে এমনকী মাপ সমান রাখতে তাকে খুশি করতে হবে। তার দাম আছে। শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু যদি সে দাম দিতে রাজি থাকে চেষ্টা করে দেখতে পারে। সে দাম হচ্ছে ভারতবর্ষের বর্তমান জাতীয় আন্দোলন থেকে সরে দাড়াতে হবে। কথায় না হোক কাজে হতে হবে তার পরিপন্থী। এ দেশে ইংরেজের যে শক্তি ও সুবিধা আছে তাকে বহাল রাখতে, এবং বর্তমানে তার যেটুকু লাঘব হয়েছে তার পূরণে ইংরেজের পুরো সহায় হতে হবে।
বাঙালি হিন্দুর বুদ্ধির উপরে ইংবেজের কিঞ্চিৎ আস্থা আছে। দ্বিতীয়বার ভারতবর্ষ বিজয়ে তার এই সাহায্য ইংরেজ স্বীকার করলেও করতে পারে। এবং তার বিনিময়ে ছোট বড় চাকরি ও আনুষঙ্গিক প্রভাব প্রতিপত্তির আর্জি হয়তো মঞ্জুর হবে। বাঙালি হিন্দুর স্বতন্ত্র স্বাের্থ রক্ষায় হিন্দুর একজোট হওয়ার যে ডাক সে এই পথে চলার ডাক। কিছু কাজ আরম্ভ হলেই তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে ভারতবর্ষে মহারাষ্ট্রের স্বপ্ন বাঙালি হিন্দু দেখেছে ও ভারতবাসীদিগকে দেখিয়েছে। সে আদর্শের অনুকরণে মৃত্যুপণ তার নিকট অতীতের ইতিহাস। সে আদর্শ ও ইতিহাসকে অস্বীকার করে খণ্ড খণ্ড স্বার্থের রক্ষায় বিদেশির চির প্রভুত্বই কি সে বরণ করবে? গোয়ালন্দের পদ্মা কি হরিদ্বারের ঘাটে ফিরে যাবে, মহাতীর্থের পুণ্যলোভে? আমাদের যৌবনে স্বদেশীয় যুগে আমরা একটি গান গেয়েছি, যার ভাবাৰ্থ মার দিয়ে দেশকে ভুলাবে আমরা দেশের তেমন ছেলে নই। হাতের মারে আমরা দেশকে ভুলি নাই, ভাতের মারের ভয়ে ভুলি কিনা তার পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে।
বাঙালি হিন্দু পাশ না ফেল?
৬
তবে এ সাম্প্রদায়িক মহামারী থেকে দেশকে বাঁচাবার কি উপায় নেই? আছে না আছে স্থির করতে এ রোগের নিদান জানা চাই। রোগ জানলেই যে তার ঔষধ আছে এমন নয়, কিন্তু রোগ নির্ণয় না হলে চিকিৎসার চেষ্টাই চলে না হাতুড়ে চিকিৎসা ছাড়া। বর্তমান সাম্প্রদায়িক বোগের ব্যাসিলাই উৎপত্তির প্রধান বীজাণুক্ষেত্র হচ্ছে শিক্ষিত হিন্দু মুসলমানের চাকরির দ্বন্দ্ব, চাকরি এক প্রতিপত্তি, চাকরির ফলে প্রতিপত্তি, প্রতিপত্তির ফলে চাকরি দেশের অশিক্ষিত ও আচাকুরে হিন্দু মুসলমান জনসাধারণ, যাদের নামে এবং ভরসায় এই দ্বন্দ্ব চলে তাঁরা করে এতে লাঠিয়ালি বিনা ভাতায় নিজের খেয়ে। এই লাঠালাঠিতে তাদের নিজের হিত কিছুমাত্র নেই, অহিত আছে। ষোলো আনা, দেশের সকল উন্নতির পথ বন্ধ হয় বা বিপথে চলে। ধর্মের নামে অন্ধ উত্তেজনায় এই অজ্ঞানদের নিজের ভাল মন্দ বোধ লোপ হয়, আর সে উত্তেজনার সৃষ্টি করে শিক্ষিত মুসলমান ও শিক্ষিত হিন্দু নিজেদের শ্রেণির সাংসারিক স্বর্থ ও সাংসারিক ক্ষমতা হাসিল করার অভিসন্ধিতে। কমুনাল রোগের এই নিদান। অন্য সব কারণ এই মূল থেকেই পুষ্টি পেয়ে রোগকে জটিল করে তোলে। সুতরাং এ রোগের চিকিৎসা দেশের জনসাধারণকে মুসলমান চাষি ও হিন্দু চাষিকে, মুসলমান কারিকর ও হিন্দু কারিকরকে, মুসলমান মজুর ও হিন্দু মজুরকে পলিটিকাল দল গড়তে শেখান পলিটিকাল আদর্শ ও উপায়ের ভিত্তিতে। কলমা পড়া ও গায়ত্রী জাপার ভেদ ও সাম্য দলে টানার ফন্দি ও ফাকিতে তাদের সচেতন করা। দেশের হিন্দু মুসলমান জনসাধারণ যেদিন নিজের স্বাৰ্থ মোটামুটিও বুঝবে, যেদিন পলিটিকসে দীন-এর তত্ত্ব ছেড়ে দুনিয়ার তথ্যে চোখ যাবে শিক্ষিত হিন্দু মুসলমানের চাকরি প্রতিপত্তির ঝগড়ার সেই দিন হবে সমাপ্তি। কারণ যে খুঁটির জোরে লড়াই সে আর খুঁটিগিরি করতে রাজি হবে না। কলমা গায়ত্রীর চাকরি ভাগাভাগির দ্বন্দ্ব দেশ তখন বরদাস্ত করবে না। চাকরে হিন্দু মুসলমানের কমুন্যাল বিষ ছড়ান বন্ধ হবে না, যতদিন না। অ-চাকরে জনসাধারণের নিজেদের পলিটিকস সে বিষের থলি উগরে ফেলে। শিক্ষিত হিন্দু মুসলমান অন্যান্যের যুদ্ধ সজ্জার ভয়ে বা যুদ্ধান্তে নিজেরাই চাকরি প্রতিপত্তির একটি রফা নিম্পত্তি করে দেশের বড় কাজে হাত দেবে। সে আশা দুরাশা। চাকরির কামনা চাকরিতে শান্ত হয় না; যত পাওয়া যায় লোভ ততই বাড়ে। হবিষা কৃষ্ণবৰ্ম্মেব ভুয় এবাভি বৰ্দ্ধতে।’ কমুন্যাল রোগের চিকিৎসা দেশের চাকরিপন্থীদের হাত থেকে দেশের পলিটিকসকে ছিনিয়ে নেওয়া।