৩
ব্রিটিশ যুগের প্রথম আমলে পশ্চিমের নুতন ভাব ও বিদ্যার দিকে বাঙালি হিন্দুর মতো বাঙালি মুসলমান বুকে পড়েনি। কতকটা রােজ্যাপহারী ইংরেজের উপর আক্রোশে, কতকটা সংস্কারান্ধ মৌলভি মৌলানার বিরোধিতায়। ফলে আধুনিকতার যে নদীতে বাঙালি হিন্দু স্নান করেছে, বাঙালি মুসলমান তখন তার জলে নামেনি। প্রচলিত ধর্ম ও সংস্কারকে বাঙালি হিন্দু যেমন যুক্তির বিচারে যাচাই করতে সাহস করেছে, বাঙালি মুসলমান তা পারেনি। মুসলমান রামমোহন কি মুসলমান বিদ্যাসাগর বাংলাদেশে সম্ভব হয় নাই। এই আধুনিকতার বিরোধী, ইংরেজি শিক্ষা পরাঘুখ সম্প্রদায়ে আর্থিক সুতরাং সামাজিক বিপ্লব ঘটল। যখন ইংরেজের আপিস আদালতে ফারসির বদলে প্ৰচলন হল ইংরেজি ভাষার। মুনশি মৌলভির হাতের কাজ চলে গেল। ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দুর হাতে। তাদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একটা বড় মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠল। যাদের যে শিক্ষা আনলো হাতে অর্থ, সেই শিক্ষায় করল। মনকে সজীব। মুসলমান হয়ে পড়ল দরিদ্র এবং মনে অচল। আধুনিক কালে যখন বাঙালি মুসলমানের চেতনা হল, এবং নব শিক্ষায় তাঁরা শিক্ষা পেতে লাগল। তখন রাজ দরবার ও রাজ সরকারের দেশি লোকের জায়গায় হিন্দুর দখলে এবং ইংরেজি বিদ্যায় উপার্জনের আর যে সব পথ খুলেছে সেখানে হিন্দুর ঠাসাঠাসি ভিড়। নব ব্ৰতী মুসলমানের ওস্তাদ হিন্দুর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মাথা গলান কঠিন।
বাঙালি মুসলমান সমাজের এই অবস্থায় রিফর্মের শেষ চালের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়নি। নব শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা বাঙালি হিন্দুর তুলনায় এখনও অতি অল্প। যদি হিন্দুর সঙ্গে বিনা প্রতিযোগিতায় কেবল মুসলমানের খাতিরে, শিক্ষিতের সংখ্যার অনুপাতে নয় মুসলমান সমাজের নিরক্ষরত্বের পরিমাণে শিক্ষাসাপেক্ষ সরকারি চাকরি ও সরকার অনুগৃহীত অর্থাগমের অন্যান্য উপায় মুসলমানের হাতে আসে। তবে এই অল্প সংখ্যক শিক্ষিত মুসলমানের দারিদ্র্য কমে, শিক্ষিত মুসলমানের সন্তান সন্ততিদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ জীবনোপায়ের পথ হয়, দেশে বাঙালি মুসলমানের প্রতিপত্তি ও সম্মান বাড়ে। শুধু যোগ্যতার জোরে যে মুসলমান দোতলা উঠতে পারে না। সাম্প্রদায়িক লিফটে সে অনায়াসে তেতলা উঠে যায়। এ লোভ কম লোভ নয়। সুতরাং বাংলার রাষ্ট্রসভায় যে ইংরেজরা রয়েছেন প্ৰাপ্যের বহু সংখ্যায় রিফর্মের ‘পলিসি’ ইমপ্লিমেন্ট করতে তাদের আওতায় মুসলমান সভ্যদের যেই কিঞ্চিৎ আধিপত্য হয়েছে অমনি চড়াসুর উঠেছে মুসলমানের বিশেষ স্বার্থের। স্থানে এবং অস্থানে মুসলমান ধর্মে ধাৰ্মিকের সংখ্যার অনুপাতে ভাগ বাটোয়ারায় দাবি চলেছে, যা কখনও করুণ কখনও কমিক। এর যুক্তি এক সময় বাঙালি মুসলমানের শিক্ষার দৈন্য যাকে অমুসলমানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ফেলা অন্যায়, অন্য সময় বাঙালি মুসলমানের পৌরুষ যা রাজার জাতিতেই কেবল দেখা যায়। কখনও মুসলমানের ব্রিটিশ রাজভক্তির কাহিনি, কখনও আরবদের বিশ্বজয়ের ইতিহাস। কাজেই সাম্প্রদায়িক ভাগকে আঁকড়ে থাকতে হবে প্ৰাণপণে, এবং সবখানে চাই তার প্রসারমন্ত্রীগিরি থেকে পেয়াদাগিরি পর্যন্ত। এবং এই ভাগাভাগির মূল মালিক ইংরেজকে রাখতে হবে হাতে, কখনও চোখ রাঙিয়ে কখনও চোখ নামিয়ে; এবং সবচেয়ে বড় কথা তার স্বার্থে ঘা না দিয়ে। তার খোদার মেহেরবানিতে এমন দিনও আসতে পারে, যখন বাংলাদেশের চাকরি-বাকরি মুসলমানের হবে একচেট, যেমন এককালে বাঙালি হিন্দুর ছিল। মোট কথা বাঙালি মুসলমান চাকরি চাই–চাকরি আরও চাকরি।
8
উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দু যে ক্ষোভ ও আশঙ্কায় চঞ্চল হয়ে উঠবে তাতে বিচিত্র কী! যে ইংরেজিশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাঙালি হিন্দুর মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্ক এই চাকরি তাদের প্রাণস্য প্ৰাণঃ। সরকারি চাকরি, আধা-সরকারি চাকরি, সরকারকে যাঁরা চালায় এবং সরকার যাদের জন্য চলে, সেই ইংরেজ সওদাগরের চাকরি। এ শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে এই চাকরিতে, চাকরিতেই তা বেঁচে আছে, এই চাকরির লোপে তার বিলোপের ভয়। যার এ চাকরি যখন অন্ন তখন বাঙালি হিন্দুর মন ও আনন্দ যে আধুনিক কালচারের ফুল ফুটিয়েছে তার রসও আসছে সেখান থেকেই। সে ‘কালচারের ভালমন্দ যাই থাকুক ভারতবর্ষে তা অদ্বিতীয়। এ সব চাকরির উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন হলেও তার কতকগুলি বিদ্যা ও বুদ্ধিকে প্রয়োগ করে সার্থক করায় সুযোগ, সুতরাং আত্মতৃপ্তির মূল, এবং সম্মান ও প্রতিপত্তির হেতু। এই চাকরির যা এখন বাঙালি হিন্দুর হাতে আছে তার অধিকাংশ অন্যের হাতে যাবার সম্ভাবনার উদ্বেগ ও আশঙ্কা স্বাভাবিক। এবং এমন লোকের হাতে যদি যায় তুলনায় যাদের বিদ্যাবুদ্ধি ও যোগ্যতা কম তাতে ক্ষোভের কারণও আছে যথেষ্ট।
সুতরাং এর প্রতিকারের ডাকে ইংরেজিশিক্ষিত হিন্দু বাঙালির বড় রকম সাড়া পাওয়া যাবে। সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগি বন্ধ করতে হবে। সব অনিষ্টের মূল কারণ সাম্প্রদায়িক নির্বাচন তুলতে হবে। সেজন্য বাঙালি হিন্দুর একজোট হওয়া চাই। জাতীয় কংগ্রেস থেকে সরে দাড়াতে হবে, ‘হিন্দু মহাসভা’র নামে জয়ধ্বনি দিয়ে। ভারতবর্ষের জন্য হিন্দুদের সঙ্গে মিলে সংঘ গড়তে হবে হিন্দুর স্বার্থ রক্ষার জন্য। হিন্দুকে হিন্দু না রাখলে কে রাখবে? মোট কথা ভারতবর্ষ ও বাংলার মুসলমান যেমন হয়েছে কমুন্যাল হিন্দুস্থানের এবং বাঙালি হিন্দুকে হতে হবে তেমনি কমুন্যাল, কথায় না হোক মনে এবং কাজে। মুসলমানের স্বতন্ত্র স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজন যে দেশের হিতের জন্যই মোসলেম লিগের কর্তাদেরও সেই বুলি। বাঙালি হিন্দুর এই নবলব্ধ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি যে মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার প্রতিক্রিয়া তাতে সন্দেহ নেই। সেই জন্য এইসব বক্তৃতায় প্রবল উৎসাহ সঞ্চার হয়, এবং বক্তার নামে ঘন ঘন জয়ধ্বনি ওঠে। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর সব সময় উহ্য থেকে যায় বাংলাদেশে হিন্দুর চেয়ে মুসলমান সংখ্যায় বেশি। বাঙালি হিন্দু যদি বাঙালি মুসলমানের কমুন্যালিজমের আঘাতে ও অনুকরণে তাদের মতোই কমুন্যাল হয় তবে মুসলমানের সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি না কমে অবশ্য বেড়ে যাবে। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ভয়ে মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা দূর হবে এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। ঘাত প্ৰতিঘাতে দু’ পক্ষের সাম্প্রদায়িকতার বৃদ্ধি হবে। দলাদলি করে দলাদলি কমে না, বেড়েই যায়। এমন অবস্থায় যদি কমুন্যাল ইলেক্টোরেটের পরিবর্তে সম্পূর্ণ ডেমোক্রেটিক নির্বাচক মণ্ডলীর ব্যবস্থা হয় তাতে কীসের ভরসা যে মুসলমান নির্বাচিত হবে এখনকার চেয়ে কম সংখ্যায়, বা যাঁরা হবে তাদের কমুন্যাল মনোবৃত্তি হবে বর্তমানের চেয়ে কম। এবং তা না হলে সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগি ও বিশেষ স্বার্থের দাবি কেন দূর হবে, আর হিন্দুর হিত বা দেশের হিত সিদ্ধ হবে কেমন করে! দেশের মন যদি থাকে কম্যুনাল পুরো ডেমোক্রেটিক নির্বাচনের ফলে ঘোর কম্যুনাল রাষ্ট্রসভার সৃষ্টি কিছু অসম্ভব নয়। যাঁরা আশা করেন মিশ্র নির্বাচনের প্রতিযোগিতায় মুসলমানকে কুডুতে হবে হিন্দুর