৫
শাস্ত্রীয় ও লৌকিক প্ৰভেদ যদি আইনে রাখতেও হয়, এবং শাস্ত্রীয় বিবাহে যদি অসবর্ণ বিবাহ নিষিদ্ধই থাকে। তবুও সে বিবাহে গোত্র-প্রবারের বাধা দূর করে বৈধ বিবাহের ক্ষেত্রের আরও প্রসার করা আজ অত্যন্ত প্রয়োজন। বিবাহযোগ্যা কন্যার পিতামাতা মাত্রই জানেন হিন্দু-সমাজের সংকীর্ণ বিবাহক্ষেত্ৰ কত বড় বিপত্তি। অথচ সগোত্র সমানপ্রবারের বাধা আজ সম্পূর্ণ অর্থহীন। থিয়োরি হচ্ছে যে, জমদগ্নি প্রভৃতি কয়েকজন ব্ৰাহ্মণ সকল ব্ৰাহ্মণের আদিপুরুষ। এই কয়জনের নামই গোত্ৰনাম। সুতরাং যে ব্ৰাহ্মণের বংশপরম্পরা যে গোত্র প্রসিদ্ধ ধরতে হবে তিনি সেই নামের আদিপুরুষ ব্ৰাহ্মণের বংশধর। ‘প্রবরে’র ব্যাপার আরও একটু ঘোরালো। প্রতি গোত্রে অনেকগুলি করে প্রবর আছে। সেগুলিও ব্যক্তিবিশেষের নাম। একটা প্ৰসিদ্ধি এই যে, ‘প্রবর’ প্রবর্তক ঋষিরা ‘গোত্ৰ’ প্রবর্তক ঋষিদের পুত্রপৌত্র। সুতরাং সগোত্র ও সমান প্রবর লোকেরা যত দূরের সম্পর্কই হোক এক বংশের লোক। এবং যাদের প্রবর এক তাদের সম্পর্কটা ওরই মধ্যে একটু নিকট। কিন্তু মুশকিল। এই যে, ভিন্ন গোত্রেও এক প্রবারের নাম আছে। যেমন উপমনু গোত্রের এক প্রবর বিশিষ্ট, আবার পরাশর গোত্রেরও এক প্রবর বিশিষ্ট। অর্থাৎ ভিন্ন গোত্রের লোক এক প্রবর হতে পারে। আমরা সবাই জানি সেই জন্যই সমানপ্রবারের বাধা বিবাহে সগোত্রের অতিরিক্ত আর এক বাধা। সুতরাং মেধাতিথি মনুভাষ্যে প্রশ্ন তুলেছেন যে, প্রস্তাবিত বরকন্যা যদি ভিন্নগোত্রের হয় তবে কি করে তাঁরা এক ঋষির সন্তান গণ্যে সমানপ্রবর হতে পারে। এবং মীমাংসা করেছেন যে, স্মৃতি যখন বলছেন হতে পারে তখন তাই স্বীকার করতে হবে। কারণ গোত্রপ্রবর জিনিসটি সম্পূর্ণ শ্রুতি-স্মৃতির এলাকার অর্থাৎ অলৌকিক বস্তু। লৌকিক যুক্তিতে ওর ব্যাখ্যা করা যাবে না। প্রকৃত কথা এই যে, ভাষ্যকার ও নিবন্ধকারদের সময়ে প্রবারের যথার্থ অর্থের স্মৃতিও লোপ হয়েছিল। এবং নানা পরস্পরবিরোধী কল্পনা তার স্থান পূরণ করছিল। পাঠক যদি রঘুনন্দনের উদ্ধাহতত্ত্বে ধৃত মাধবাচার্যের প্রবারের ব্যাখ্যার সঙ্গে, অসপিণ্ডী চ যা মাতুরসগোত্ৰ চা পিতুঃ’-এই মনু বচনের মেধাতিথির ভাষ্য মিলিয়ে দেখেন তবেই এ সত্য হৃদয়ঙ্গম হবে। গোত্র-প্রবারের যথাৰ্থ ব্যাখ্যা যাই হোক সকলেই একমত যে, এক ব্ৰাহ্মণ ভিন্ন অন্য কোনও বর্ণের বংশগত গোত্র-প্রবার সম্ভব নয়, কারণ গোত্ৰ-প্রবর প্রবর্তক ঋষিরা ছিলেন সবাই ব্ৰাহ্মণ। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের যে গোত্র-প্রবর সে হচ্ছে তাদের পুরোহিতদের গোত্র-প্রবর তাদের আরোপ করে। ‘যদ্যপি রাজন্য বিশাং প্রতিস্বিক গোত্ৰাভাবাৎ প্রবরাভাবঃ তথাহিপি পুরোহিতগোত্রাপ্রবরেী বেদিবেী’ (মিতাক্ষরা)। কিন্তু এই আরোপিত গোত্র-প্রবরই আবার বিবাহে বাধা! শূদ্রের বিবাহাৰ্থ কোনও গোত্র-প্রবর নেই। ‘প্রাগুরু মনুশাতাতপবচনে দ্বিজাতিগ্রহণং সৈগোত্রবর্জনে শূদ্ৰব্যাবৃতাৰ্থম’ (উদ্ধাহতত্ত্ব)। কিন্তু মজা এই যে, যাদের পূৰ্বপুরুষেরা নিজেদের শূদ্র বলতেন এবং যাঁরা এখন নিজেদের দ্বিজ বলে তাঁরা কল্পিত গোত্র-প্রবারের বাস্তব বন্ধনে নিজেদের বাঁধতে বাধ্য হচ্ছেন!
কিন্তু ব্ৰাহ্মণের পক্ষেও এই গোত্র-প্রবারের বাধার স্বরূপ কি? রক্তসম্বন্ধজন্য বিবাহ নিষেধের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। যার সঙ্গে রক্তের সম্বন্ধ সপিণ্ড-সম্বন্ধ সীমার বাইরে হলেই তার সঙ্গে বিবাহ চলে এবং বাংলাদেশে সে সীমার মধ্যেও কন্যা ব্রিগোত্রান্তরিত হলে তাকে বিবাহ করা যায়, কিন্তু যেখানে রক্তসম্বন্ধের কোনও ইতিহাস নেই, কেবলমাত্র বংশ-পরম্পরাগত দুইটি নামসাম্য বিবাহের অলঙ্ঘনীয় বাধা! যদি স্বীকার করা যায় যে একশো পুরুষ পূর্বে সগোত্ৰ স্ত্রীপুরুষের পূর্বপুরুষ এক ছিল, কোন যুক্তিতে সেটা বিবাহে বাধা হতে পারে? সপিণ্ডের সঙ্গে বিবাহ নিষেধ। সপিণ্ড শব্দের অর্থ যাদের পিণ্ড বা দেহ এক, একন্দেহ থেকে যাঁরা উদ্ভূত। সিপিণ্ডতা তু এক শরীরাবয়বান্বয়েন ভবতি’ (মিতাক্ষরা)। কিন্তু এই অনাদি সংসারে সকলের মধ্যেই সকলের এ রকম সপিণ্ডতা সম্ভব, কিন্তু সেটা অতিপ্ৰসঙ্গ, কারণ তা হলে কোনও বিবাহই সম্ভব হয় না। ‘তাচ্চ সর্বত্র সর্বস্য যথাকথাং চিদামাদীে সংসারে ভবতীত্যাতিপ্ৰসংগঃ’ (মিতাক্ষরা)। সুতরাং সপিণ্ড শব্দের অর্থকে নিতে হবে কাট-ছাট করে একটা নিয়মিত কার্যকরী গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখে, পঙ্কজ শব্দের অর্থে যেমন করা হয়। অতশ্চায়ং সপিণ্ডশব্দোহবায়শাক্ত্যা সর্বত্ৰ প্ৰবৰ্ত্তমানেহপি নির্মস্থা পঙ্কজাদি শব্দ বন্নিয়ত বিষয় এব’ (মিতাক্ষরা)। সেই জন্যই বিবাহের সপিণ্ডতা মাতার বংশে পাঁচ পুরুষ ও পিতার বংশে সাত পুরুষেই শেষ হয়। ‘পঞ্চমাৎ সপ্তমাৎ উর্ধাৎ মাতৃতঃ পিতৃতস্তথা’ (যাজ্ঞবল্ক্য)। হিন্দু-বিবাহে সগোত্রপ্রবারের নিষেধ বর্জনের চেয়ে হিন্দু-শাস্ত্রকারদের এ যুক্তির সুষ্ঠুতর প্রয়োগের ক্ষেত্র আর নেই।
৬
হিন্দু-বিবাহে সপিণ্ডের মধ্যে বিবাহ নিষেধের বিধি নিকট সম্পর্কিত স্ত্রীপুরুষের মধ্যে বিবাহ নিবারণের নিয়ম। এ নিষেধ সকল সমাজের বিবাহরীতিতেই কোনও-না-কোনও রকম আছে। হিন্দু-সমাজের প্রচলিত নিয়মে পিতার বংশে সাত ও মাতার বংশে পাঁচ সিঁড়ি উপরে ও নীচে এই নিষিদ্ধ সীমার গণ্ডি। অনেকে সম্ভব জানেন যে, এ বিষয়ে সকল শাস্ত্রকার একমত ছিলেন না। কোনও কোনও শাস্ত্রকার ওই গণ্ডিকে সংক্ষেপ করে পিতৃপক্ষে পাঁচ ও মাতৃপক্ষে তিন পর্যন্ত মাত্র গণনার বিধি দিতেন। ‘শ্ৰীনতীত্য মাতৃতঃ পঞ্চােতীত্য চ পিতৃতঃ’ (পৈঠনসি)। পরবর্তী কালের ভাষ্য ও নিবন্ধকারেরা পৈঠনসি-প্রমুখদের মতো এই বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন যে, ও দুই সংখ্যার উল্লেখ তার চেয়ে কম সংখ্যার নিষেধের জন্য, সংখ্যা দুটিকে স্থাপনের জন্য নয়, কারণ তা না হলে স্মৃতিবাক্যের পরস্পর বিরোধ হয়। ‘তদপ্যর্বাঙ নিষেধাৰ্থং ন পুনস্তৎপ্রাপ্তার্থমিতি সর্বস্মৃতী নামবিরোধঃ’ (মিতাক্ষরা)। সকল স্মৃতিকার যে সমস্ত বিষয়ে একবিধি দিয়েছেন এটা স্পষ্টতই সত্য নয়, ভাষ্যকারীদের ‘ওয়ার্কিং হাইপথেসিস’ মাত্ৰ–যার উপর নির্ভর করে নিজের মতের বিরুদ্ধ শাস্ত্ৰবাক্যকে যা কিছু একটা দুর্ব্যাখ্যা দিয়ে সরিয়ে রাখা যায়। সাত আর পাঁচ এই সহজ কথা বলা যার অভিপ্ৰায় সে কখনও ব্যাখ্যাকারদের উপর ভরসা রেখে বলতে যায় না পাঁচ। আর তিন। গোলাপচন্দ্ৰ শাস্ত্রী তাঁর ‘হিন্দু আইন’ পুস্তকে বলেছেন যে, বাংলাদেশের ব্ৰাহ্মণদের মধ্যে পৈঠনসির পাঁচ। আর তিন মতবাদই কাৰ্যত চলে। যদিও বাঙালি স্মার্ত রঘুনন্দন সাত আর পাঁচ গণনার জোর পক্ষপাতী। আমার মতে প্ৰস্তাবিত আইনে সপিণ্ডত্বের সীমা পাচ আর তিন নির্দেশ করা উচিত। এ নিয়মের পক্ষে শাস্ত্ৰও আছে, এবং বর্তমান হিন্দু-সামাজিক বোধ ও রুচিরও তা বিরুদ্ধ নয়। এ নিয়মে বিবাহ্য বর ও বিবাহ্য কন্যার ক্ষেত্র বড় হবে, যার সামাজিক প্রয়োজন আছে।