৩
প্ৰস্তাবিত আইনের ‘লৌকিক বিবাহ’ ১৮৭২ সালের প্রসিদ্ধ তিন আইনের ১৯২৩ সালে যে সংস্কার হয়েছে তারই কিছু পরিবর্তিত রূপ। মূল তিন আইন অনুসারে যদি কোনও হিন্দু অসবর্ণ বিবাহ করত। তবে তাকে স্বীকারোক্তি করতে হত যে ধর্মে সে হিন্দু নয়। কারণ ওই আইন অনুসারে বিবাহ কেবল তাদের মধ্যেই হতে পারত যাঁরা খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, মুসলমান, পারসি, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন কোনও ধর্মকেই নিজের ধর্ম বলে স্বীকার করে না। কিন্তু ইংরেজের আদালতে বিচার হল যে এ অস্বীকার কেবল বিবাহাৰ্থ। সুতরাং তিন আইনে অসবর্ণ বিবাহকারী হিন্দু ও তাদের সন্তানদের দায়াধিকারের আইন হিন্দু-আইন। ১৯২৩ সালের সংস্কারে ব্যবস্থা হল যে যাঁরা নিজেদের হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈনধর্মাবলম্বী বলবেন তঁরাও তিন আইন অনুসারে বিবাহ করতে পারবেন। সুতরাং ওই আইন অনুসারে অসবর্ণ বিবাহেছুক হিন্দু ধর্মে হিন্দু পরিচয়েই সে বিবাহ করতে পারবে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হল যে এ রকমে বিবাহিত হিন্দুর দায়াধিকার আইন হিন্দু-আইন থাকবে না, হবে ‘ভারতবষীয় উত্তরাধিকার’ আইনের দায়ভাগবিধি, অর্থাৎ খ্রিস্টানদের দায়াধিকার আইন। এ বিবাহের ফলে হিন্দু তার পরিবার থেকে বিচুত হবে, দেবোত্তরে কোনও স্বত্ব থাকবে না, দত্তকগ্ৰহণ নিষিদ্ধ হবে, তাকে মৃত্যগণ্যে তার পিতা দত্তকগ্ৰহণ করতে পারবে। অর্থাৎ হিন্দু স্বীকারে যখন এ রকম বিবাহ করেছ তখন হিন্দু-আইন আর তোমার প্রতি প্রযোজ্য নয়! হিন্দু-আইন বহাল রাখতে হলে বিবাহের সময় বলতে হবে যে তুমি হিন্দু নও। পূর্বেই বলেছি যে প্রস্তাবিত আইন ১৯২৩ সালের সংস্কারের এই আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত ব্যবস্থাগুলিকে রদ করেছে।
8
তিন আইনের ১৯২৩ সালের এই অদ্ভুত সংস্কারগুলি অকারণ নয়। ওদের উদ্দেশ্য ছিল অসবর্ণ বিবাহের নামে ‘হিন্দুধৰ্ম গেল’ বলে যাঁরা সরব হন তাঁদের আশ্বস্ত করা। করুক না লোকে হিন্দু নাম নিয়েই এ রকম বিবাহ। বিবাহের পর তাঁরা তো আর কোনও অর্থেই হিন্দু থাকছে না। বুরং ইংরেজ আদালতের বিচার উলটে বলা যায় যে, এদের হিন্দুত্ব স্বীকার কেবল বিবাহাৰ্থ। আর বর্জন করে আত্মরক্ষার রীতিতে হিন্দু-সমাজ বহুদিন যে মরণান্ত বীৰ্য দেখিয়ে আসছে। এ বিবাহ স্বীকার হবে তার-ই একটা প্রকাশ। প্রস্তাবিত আইনে যে দুরকম হিন্দুবিবাহের ব্যবস্থা হয়েছে তারও উদ্দেশ্য এই সনাতনীদের আশ্বস্ত করা। শাস্ত্রীয় বিবাহে যখন চলতি নিষেধ সব বহাল থাকল। তখন একটা অশাস্ত্রীয় ‘লৌকিক বিবাহ’ স্বীকারে ক্ষতি কী! কিন্তু এ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। যদি সনাতনীদের তুষ্ট করে এ আইন পাশ করাতে হয় তবে এ আইন পাশ হবে না। কারণ দুরকম বিবাহের ব্যাবহারিক ফল যেখানে এক, অশাস্ত্রীয় লৌকিক বিবাহের পতি-পত্নীর হিন্দুর সমাজ ও ধর্মে সকল দাবি যখন সম্পূর্ণ বহাল থাকবে তখন সনাতনপন্থী তুষ্ট বা আশ্বস্ত হবে কীসে? এ দ্বৈত যে মায়ামাত্র তা বুঝতে বেশি শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসনের দরকার হয় না। আর যদি সনাতনীদের বিরোধ সত্ত্বেও এ আইন পাশ হয় তা হবে তাদের মতের জোরে যাঁরা সমগ্ৰ হিন্দু-সমাজের যুগ-উপযোগী পরিবর্তন চায়, সে সমাজের বিধি-বন্ধন থেকে ব্যক্তিবিশেষের মুক্তিমাত্র চায় না। এ রকম ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের মূল্য যথেষ্ট। কিন্তু সমস্ত সমাজের উপর তার ফল গৌণ ফল। হিন্দুর বর্তমান সমাজ এই গৌণ উপায়ে পরিবর্তনের চেষ্টায় যুগ ছাড়িয়ে এসেছে। এখন প্রয়োজন সমস্ত সমাজের হিতে হিন্দুর সামাজিক বিধি-ব্যবস্থার উপযুক্ত পরিবর্তন, যার ফলে হিন্দু-সমাজ পাবে নুতন দৃঢ় গড়ন ও সে সমাজে আসবে নুতন প্রাণ ও নুতন বল।
প্ৰস্তাবিত আইনে অপরিবর্তিত শাস্ত্রীয় বিবাহ’ বিধির পাশে পরিবর্তিত এক ‘লৌকিক বিবাহ-রীতি দাঁড় করানোর ব্যবস্থা এই কাম্য পরিবর্তনের অনুকুল নয়। এ ব্যবস্থার বাহ্য আকার হচ্ছে সেই সব পূর্ব চেষ্টার অনুরূপ যা হিন্দু-সমাজের চলতি বিধিকে বহাল রেখে তার বন্ধন থেকে মুক্তিকামী লোকদের ছাড়পত্র দিতে চেয়েছে, যদিও এর আন্তরিক উদ্দেশ্য গৌণভাবে সে বিধির বদল ঘটানো। কিন্তু এ আইন পাশ হলেও এই বাহ্যিক আকারেরই জয় হবে, এর আন্তরিক উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। এর ফলে হিন্দু-সমাজের বিবাহ-রীতির কোনও বড় পরিবর্তন ঘটবে না, যেমন ঘটেনি মূল তিন আইনে বা তার পরিবর্তিত রূপে। তার কারণ কিছু নিগূঢ় নয়। যে হিন্দু তার বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থার পরিৱর্তন চায় এ পরিবর্তন আসবে যতটা সম্ভব হিন্দুর আচার ঐতিহ্যকে বজায় রেখে। পরিবর্তনের ফল হবে পরিবর্তিত হিন্দু-সমাজ, পূর্বের সঙ্গে যোগসূত্রহীন সম্পূর্ণ নূতন বস্তু নয়। এই মনোভাবের কাছে পাণিগ্রহণ-মন্ত্ৰ-উচ্চারণে বিবাহ আর রাজকর্মচারীর কাছে রেজিষ্টি করে বিবাহ এক জিনিস নয়। হিন্দু-সমাজ থেকে অসবর্ণ বিবাহের বাধা দূর করার প্রকৃষ্ট উপায় নয় ও বিবাহকে ধর্মানুষ্ঠানে অপাঙক্তেয় করা, যাতে প্রচলিত শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানেও বিবাহ সিদ্ধ হবে না, ওর সিদ্ধির জন্য দরকার হবে প্ৰতিজ্ঞাপত্ৰ স্বাক্ষর ও রেজিষ্ট্রি।
এ আইনের দু’রকম বিবাহ-বিধির প্রস্তাব আরও নিরর্থক, কারণ কি শাস্ত্রীয় কি লৌকিক উভয় বিবাহই করা হয়েছে একপত্নীক; এক স্ত্রী বর্তমানে স্বামীর পুনর্বিবাহ অসিদ্ধ হবে। আশা করা যায়। এ প্রস্তাবে সনাতনীদেরও খুব বেশি আপত্তি হবে না। আইনে যা-ই হোক, সমাজে আধুনিক হিন্দুর বিবাহ মোটের উপর একপত্নীক। অর্থাৎ আমাদের মনের সম্মতি একপত্নীক বিবাহের আদর্শের দিকেই। বহু-বিবাহ আইনে নিষিদ্ধ করলে অন্য দেশে ও সমাজে মাঝে মাঝে যে সব অসুবিধা ঘটে তা আমাদের মধ্যেও ঘটবে। কিন্তু তার কুফলের পরিমাণ বহু-বিবাহের কুফলের তুলনায় অনেক কম। মানুষের কোনও নিয়ম সম্পূর্ণ দোষমুক্ত করা যায় না। যেটা মোটের উপর ভাল তাকেই বেছে নিতে হয়।