দ্বিতীয় রকমের আপত্তির সুর অতটা চড়াগ্রামে চড়ান নয়। সে আপত্তি হচ্ছে:
এবং বর্তমানের আইনসভাগুলি তার উপযুক্ত স্থান নয়। এ আপত্তিকে বলা যায়। ‘আভি নেহি’ আপত্তি। হিন্দু মহাসভার গত বিলাসপুর অধিবেশনে রাও বিল সম্বন্ধে যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে, সে প্রস্তাব এই আপত্তির একটা ভাল উদাহরণ। হিন্দু মহাসভা এ প্রস্তাবে বলেছেন যে, চলতি হিন্দু আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন নাই, একথা তাঁরা বলেন না। পরিবর্তনের প্রয়োজন তাঁরা স্বীকার করেন। তবে বর্তমান আইনসভাগুলি হিন্দু জনসাধারণের প্রকৃত প্রতিনিধি নয়। যখন প্রকৃত ডেমোক্ৰেটিক উপায়ে নির্বাচিত হয়ে আইনসভাগুলি জনসাধারণের যথার্থ প্রতিনিধি স্থানীয় হবে, তখন সে প্রতিনিধি সভা বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে হিন্দু আইনের পরিবর্তন সাধন করবেন। তার পূর্বে পরিবর্তন হতে দেওয়া উচিত নয়।
হিন্দু মহাসভা যখন বলেছেন তখন লোকে মেনে নিতে বাধ্য যে, এই প্রস্তাব হিন্দু মহাসভার সভ্যদের আন্তরিক অভিপ্ৰায় প্রকাশ করছে, ও প্ৰস্তাব অশুভস্য কালাহরণের ফিকির নয়, অথবা স্বীকার কি অস্বীকার এ দুয়ের দায় থেকে আপাতত মুক্তি পাওয়ার একটা উপায় মাত্র নয়। কিন্তু মনের এ সন্দেহ দূর করা কঠিন। কারণ বলছি : মহাসভার এই অধিবেশনেই হিন্দুস্থানের ভাবী রাষ্ট্রতন্ত্র ও শাসনতন্ত্র কী রকম হওয়া উচিত তার এক খসড়ার অনুমোদন করে প্রস্তাব গ্রহণ হয়েছে। হিন্দু মহাসভা অবশ্য মনে করেন যে ওই খসড়া অনুসারে বিলাতের পার্লামেন্ট এখনই আইন পাশ করবেন অথবা ইংরেজের সম্মতি নিরপেক্ষ ভারতবর্ষের লোকেরা ওই খসড়া অনুযায়ী এখনই হিন্দুস্থানে রাষ্ট্রতন্ত্র প্রবর্তিত করবে। এ সত্ত্বেও এ প্রস্তাব গ্রহণ করে হিন্দু মহাসভা তাঁর কর্তব্য কাৰ্যই করেছেন। কারণ ভারতবর্ষের ভাবী শাসনতন্ত্রের আকার কি হবে সে সম্বন্ধে দেশবাসীর মনকে প্ৰস্তুত করা সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য। প্রতিষ্ঠান তার নিজের কল্পনা দেশের লোকের সামনে উপস্থিত করবার অধিকারী যাতে সেই অনুসারে দেশের লোকের মত গঠিত হয়। চলতি হিন্দু আইনের যদি পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে সে কী রকম পরিবর্তন সে সম্বন্ধে হিন্দু মহাসভার কর্তব্য ছিল দেশের লোককে উপদেশ করা এবং সেজন্য জনমত গঠন করা। হিন্দু মহাসভা বিলাসপুরের অধিবেশনে যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন তাতে এ কর্তব্য করা হয় নাই। ভারতবর্ষের হিন্দুর অধিকাংশ যদি প্রচলিত হিন্দু আইনের কোনও পরিবর্তন চায়। তবে বর্তমান অবস্থাতেও সেই অনুসারে আইন বিধিবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা, হিন্দু মহাসভার খসড়া অনুসারে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রতন্ত্র বাস্তবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে অনেক বেশি।
হিন্দু মহাসভা যে বর্তমানের আইন সভাগুলিকে আন-ডিমোক্রেটিক ও নন-রিপ্রেজেন্টেটিভ বলেছেন সে কথা ঠিক। কিন্তু তার উপর একটু বেশি ঝোক দিয়েছেন। প্রথমত হিন্দু মহাসভা যাকে বলেছেন আইন সভাগুলির সম্পূর্ণ ডিমোক্রেটিক গঠন, তার অর্থ যাই হোক, সে রকম গঠন পেতে যে বহু সময যাবে তাতে সন্দেহের অবসর নেই। দ্বিতীয়ত পরিবর্তিত হিন্দু আইন প্রণয়ন সোজাসুজি ডিমোক্রেসির কাজ নয়। কারণ জনসাধারণের তা সাধ্যাতীত। বিশেষ, ভারতবর্ষের হিন্দু জনসাধারণের এখনও শতকরা ৯০ জন নিরক্ষর। এ হচ্ছে তাদের কাজ যাঁরা বুদ্ধি ও বিদ্যায় অগ্ৰণী এবং সমাজতত্ত্বে যাদের দৃষ্টি আছে। এ রকম লোকই পরিবর্তিত হিন্দু আইন কী রকম হবে তার বিচার করে হিন্দু জনসাধারণের মতকে গড়ে তুলতে পারে। কেবলমাত্র ডিমোক্রেসির বিদ্যাবুদ্ধিতে যে হিন্দু সভার ভরসা নেই। ওই প্ৰস্তাবেই তাঁরা তার প্রমাণ দিয়েছেন। তা নইলে সম্পূর্ণ ডিমোক্রেটিক আইন সভার সভ্যদেরও আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের ব্যবস্থা করতেন না। হিন্দু কোড এখন পাশ হোক কি অনেকদিন পরে পাশ হোক যাঁরা মনে করেন যে, প্রচলিত হিন্দু আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন তাদের এখন থেকেই কী রকম পরিবর্তন প্রয়োজন তার আলোচনা করে জনমতকে শিক্ষিত করা ও পরিবর্তনের প্রতি অনুকুল করা উচিত। নইলে এ সন্দেহ কিছুতেই মন থেকে দূর করা যায় না যে তাঁরা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা যে পরিবর্তনের সম্পূর্ণ বিপক্ষে একথা সাহস করে বলতে চান না, কী রকম পরিবর্তন প্রয়োজন সেকথা প্রকাশ করে তাঁরা যে প্রকৃতই পরিবর্তন চান তা বলারও তাদের সাহস নেই। এতে হিন্দু জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই করা হয় না।
রাও বিলের কতকগুলি প্রধান ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমার মত সংক্ষেপে বলেছি। যদি তাতে ও বিলের আলোচনার কোনও সাহায্য হয় তবে শ্রম সার্থক হবে। হিন্দু আইন সংস্কারের প্রস্তাবে প্রধান প্রয়োজন হচ্ছে যুক্তিতর্ক দিয়ে শুভবুদ্ধির বিচার। সভায় একত্র হয়ে না বা হ্যা প্রস্তাব গ্রহণের মূল্য বেশি নয়। ও রকম প্রস্তাব খুব সম্ভব মনের তম বা রজের প্রকাশ মাত্র। সত্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক কম, যে সত্য মনকে আলো করে বস্তুর স্বরূপকে প্রকাশ করে।
সমাজ ও বিবাহ
হিন্দুর প্রচলিত বিবাহ-রীতির আংশিক পরিবর্তন ও পরিবর্তিত রীতিকে বিধিবদ্ধ করার জন্য আইনের এক খসড়া তৈরি হয়ে জনসাধারণের অবগতি ও বিচারের জন্য প্রচার হয়েছে। ইংরেজি ১৯৪১ সালে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্ট যে ‘হিন্দু-আইন কমিটি’ নিয়োগ করেন এ খসড়া সেই কমিটি প্রস্তুত করেছেন। এ কমিটির সভাপতি হচ্ছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি শ্ৰীযুক্ত বেনেগাল নরসিংহ রাও, এবং সভ্য আছেন ওই হাইকোর্টের ভূতপূর্ব বিচারপতি শ্ৰীযুক্ত দ্বারকানাথ মিত্র, বোম্বাই-এর শ্ৰীযুক্ত ঘরপুরী ও শ্ৰীযুক্ত যোশী।