রাও বিলের প্রস্তাবিত একপত্নীক বিবাহের বিরুদ্ধ মত এ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। কারণ, আইনে যাই হোক, সমাজে আধুনিক হিন্দু বিবাহ মোটের উপর একপত্নীক অর্থাৎ আমাদের, প্ৰায় সকলের মনের সম্মতি এক পত্নীকে বিবাহের আদর্শের দিকেই বহু বিবাহ আইনে নিষিদ্ধ করলে অন্য দেশে ও সমাজে মাঝে মাঝে যেসব অসুবিধা ঘটে তা আমাদের মধ্যেও ঘটবে। কিন্তু তার কুফলের পরিমাণ বহু বিবাহের কুফলের তুলনায় অনেক কম। মানুষের কোনও নিয়ম সম্পূর্ণ দোষমুক্ত করা যায় না। যেটা মোটের উপর ভাল তাকেই বেছে নিতে হয়।
রাও বিলে বিবাহ ভঙ্গের যে সব বিধিনিষেধ আছে, তার একটা প্ৰধান প্রয়োজন হয়েছে। এই একপত্নীক বিবাহের আইনত প্রবর্তনে!! পরের প্রবন্ধে রাও বিলের প্রস্তাবিত বিবাহ ভঙ্গবিধির আলোচনা করা যাবে।
৫
হিন্দু বিবাহের অনুষ্ঠানে বর বধূকে বলে ‘যদস্তি হৃদয়ং মম তদস্তু হৃদয়ং তব। যদস্তি হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম’—আমার এই যে হৃদয় তা তোমার হোক, তোমার যে হৃদয় তা আমার হোক। অর্থাৎ বিবাহের ফলে বর বধুর হৃদয়ের যোগ হোক অতি নিবিড়। মন্ত্রের আর যে শক্তিই থাকুক, নরনারীর দুই হৃদয়কে এক করার ক্ষমতা নেই। ও মন্ত্রের উদ্দেশ্য নব বিবাহিত দম্পতির সামনে দাম্পত্য জীবন ও প্রেমের একটি আদর্শ ধরা ও প্রার্থনা করা যে দম্পতির জীবনে এ আদর্শ সফল হোক। কিন্তু এ সফলতা কদাচিৎ ঘটে। বেশির ভাগ দম্পতির জীবনে নরনারী পরস্পরের প্রতি স্বাভাবিক যৌন আকর্ষণে প্রথমে আকৃষ্ট হয়। তারপর দৈনিক জীবনের সাহচর্যে, সন্তানের প্রতি স্নেহ, সংসারের নানা ঘাতপ্ৰতিঘাত একসঙ্গে সহ্য কুরে মােটের উপর সুখে দুঃখে গাৰ্হস্থ জীবন এক রকম কেটে যায়। স্বামী স্ত্রীর একাত্মতা দুর্লভ বলেই কাব্যে ও উপন্যাসে তার উজ্জ্বল চিত্রে মানুষ মুগ্ধ হয়; আর যদি বাস্তব জীবনে সে একাত্মতা কাচিৎ দেখা যায়, তবে মানুষ তাতে কাব্য পাঠের আনন্দ পায়। অর্থাৎ দুর্লভ বলে এই রকম একাত্মতাকে মানুষ অলৌকিক মনে করে। কিন্তু কখনও কখনও অদৃষ্টের নিষ্ঠুর অভিশাপে, কি স্বামী বা স্ত্রীর কৃতকর্মের ফলে সাধারণ রাগ-বিরাগের ও সুখ-দুঃখের গাৰ্হস্থ্য জীবনও স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে যাপন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই ভয়ংকব অবস্থা থেকে স্বামী ও স্ত্রীকে মুক্তি দেবার জন্যই প্ৰায় সভ্য-সমাজে বিবাহের বন্ধন ছেদনের ব্যবস্থা করতে হয়।
বিবাহ বন্ধন অচ্ছেদ্য, কি তা ছেদন করা অত্যন্ত কঠিন, সমাজ ও আইনের এই রকম ব্যবস্থা নরনারীকে অনেক দুঃখ-কষ্ট অত্যাচার সহ্য করেও পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার অনুকুল মনোভাব সৃষ্টি করে। এই মনোভাবের অভাবে শিথিল বিবাহ-বন্ধন সভ্য-সমাজে বহু বন্ধনকেই শিথিল করে দেয়। সেই জন্য অনেক সভ্য-সমাজেই বিবাহের বন্ধন ছেদনকে যথাসম্ভব কষ্টসাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু এরও একটি সীমা আছে। অবস্থা এমন হতে পারে যে, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যজীবন তাদের নিজেদের পক্ষেও শুধু মহাক্লেশকর নয়, সমাজের পক্ষে অমঙ্গলকর। তেমন জায়গায় বিবাহকে ভঙ্গ হতে দেওয়াই ব্যক্তিগত ও সমাজগত প্রয়োজন। প্রাচীন হিন্দু আইনে এই কারণে অনেক স্থলে স্বামীর স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার এবং স্ত্রীর স্বামীকে পরিত্যাগ করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল। কোন অবস্থায় বিবাহকে ভঙ্গ হতে দেওয়া হবে এবং কখন হবে না। এই বিধিনিষেধ প্রণয়ন সব সময়েই কঠিন। কারণ ব্যক্তির প্রয়োজন ও সমাজের প্রয়োজন এই দুই দিক বিবেচনা করে তবেই এর নিয়ম প্রণয়ন করা যায়। বিবাহবন্ধন যাতে স্বভাবতই অশিথিল থাকে, কিন্তু স্বামী কি স্ত্রীর জীবন একান্ত দুর্বহনা হয়—এই দুই দিকে সমান দৃষ্টি রাখলে তবেই বিবাহভঙ্গের বিধি গ্রহণযোগ্য হয়। রাও কমিটির প্রস্তাবগুলি এতে কতদূর সফল হয়েছে, সেটাই বিচাৰ্য বিষয়।
অন্য নানা দেশের বিবাহভঙ্গের আইন অনুসরণ করে রাও কমিটি বিবাহ ভঙ্গের বিধিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এক —কতকগুলি অবস্থায় স্বামী কিংবা স্ত্রীর আবেদনে আদালত প্রচার করতে পারবেন যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈধ ও আইনসঙ্গত কোনও বিবাহ আদৌ হয় নাই। দুই—অন্য কতকগুলি অবস্থায় স্বামী কি স্ত্রীর আবেদনে আদালত বৈধ বিবাহকে আদেশের তারিখ থেকে ভঙ্গ হল বলে নির্ধারণ করতে পারবেন। আন্দেী সিদ্ধ বিবাহ হয় নাই–এই প্রচারের মোটামুটি কারণগুলি এই –(১) যদি বিবাহের সময় ও আদালতে আবেদনের সময় স্বামী কি স্ত্রীর পুরুষত্ব কি স্ত্রীত্ব না থেকে থাকে; (২) যদি স্বামী-স্ত্রী এই রকম সম্পর্কিত হয় যাদের মধ্যে আইনত বিবাহ নিষিদ্ধ, (৩) যদি বিবাহের সময় স্বামী কি স্ত্রী উন্মাদ বা জড়বুদ্ধি থাকে; (৪) যদি বিবাহের সময় স্বামী কি স্ত্রীর পূর্ব বিবাহের স্ত্রী কি স্বামী জীবিত থাকে এবং সেই পূর্ব বিবাহ বলবৎ থেকে থাকে; (৫) যদি স্বামী কি স্ত্রীর বিবাহে সম্মতি, অথবা যেখানে তাদের অভিভাবকদের সম্মতি বিবাহে প্রয়োজন, সেরূপ সম্মতি বলে কি ছলে বিবাহের অপর পক্ষ নিয়ে থাকে।
সিদ্ধ বিবাহ ভঙ্গের কারণগুলি মোটামুটি এই-(১) যদি স্বামী বা স্ত্রী বিকৃতমনা হয় বা চিকিৎসার অতীত এবং বিবাহভঙ্গের আবেদনের পূর্বে যদি ক্ৰমান্বয়ে সাত বৎসর এই রকম বিকৃতমনা থেকে থাকে; (২) যদি স্বামী কি স্ত্রী অচিকিৎস্য মহাকুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত হয় যে ব্যাধি আবেদনকারী কি আবেদনকারিণীর ছোয়াচ থেকে উৎপন্ন হয়নি; (৩) যদি স্বামী কি স্ত্রী বিনা কারণে স্ত্রী কি স্বামীকে সাত বৎসর পর্যন্ত ত্যাগ করে থেকে থাকে; (৪) যদি স্বামী কি স্ত্রী অন্য ধর্মাবলম্বনের ফলে আর হিন্দু না থেকে থাকে; (৫) যদি স্বামী কি স্ত্রী সাত বৎসর পর্যন্ত সংক্ৰামক যৌনব্যাধিগ্রস্ত থেকে থাকে যে ব্যাধি আবেদনকারী কি আবেদনকারিণীর ছোয়াচ থেকে উৎপন্ন নয় এবং (৬) যদি অন্য কোনও স্ত্রীলোক স্বামীর রক্ষিতা হয়ে থাকে অথবা বারবনিতার জীবনযাপন করে।