প্রচলিত হিন্দু বিবাহে সগোত্র ও সমান প্রবারের বাধার মতো অর্থশূন্য বাধা আর কল্পনা করা যায় না। গোত্র কাকে বলে? থিয়োরি হচ্ছে, জমদগ্নি প্রভৃতি কয়েকজন ব্ৰাহ্মণ সকল ব্ৰাহ্মণের আদিপুরুষ। এই কয়েকজনের নামই গোত্র নাম। সুতরাং যে ব্ৰাহ্মণের বংশপরম্পরা যে গোত্র প্রসিদ্ধ, ধরতে হবে তিনি সেই নামের আদি পুরুষ ব্ৰাহ্মণের বংশধর। যদি স্বীকার করা যায় এ থিয়োরি সত্য এবং বহু শত পুরুষ পূর্বে সগোত্ৰ স্ত্রীপুরুষ ব্ৰাহ্মণের এক পূর্বপুরুষ ছিল, কোন যুক্তিতে সেটা বিবাহে বাধা হতে পারে? সপিণ্ড বরকন্যার বিবাহে নিষেধের ব্যাখ্যায় শাস্ত্রকারেরা বলেছেন যে, তারাই সপিণ্ড-এক দেহ থেকে যাঁরা উদ্ভূত—’সপিণ্ডতাতু এক শরীরাবয়বান্বয়েন ভবতি’ (মিতাক্ষরা)। এই অনাদি সংসারে সকলের মধ্যেই এই রকম সপিণ্ডতা সম্ভব। কিন্তু সেটা অতি প্রসঙ্গ। কারণ তা হলে কোনও বিবাহই সম্ভব হয় না।-’তচ্চ সর্বত্র সর্বস্য যথা কথঞ্চিদ নাদেী সংসারে ভবতাতি প্ৰসঙ্গঃ’ (মিতাক্ষরা)। সুতরাং সপিণ্ড শব্দের অর্থকে নিতে হবে কাটছাট করে একটা নিয়মিত কার্যকরী গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখে। ‘পঙ্কজ’ শব্দের অর্থ যেমন করা হয়
‘অতশ্চায়ম সপিণ্ড শব্দোহ বয়বশক্ত্যা সর্বত্র প্রবর্তমানেতি নির্মস্থা পঙ্কজাদি শব্দবন্নিয়ত বিষয় এব’ (মিতাক্ষবা)। এজন্য বিবাহের সপিণ্ডতা মাতার বংশে পাঁচ পুরুষ ও পিতার বংশে সাত পুরুষেই শেষ হয়। হিন্দু বিবাহে সগোত্র নিষেধের বিরুদ্ধে হিন্দু শাস্ত্রকারদের এই যুক্তির সুষ্ঠতর প্রয়োগের ক্ষেত্র আর নেই। যেখানে রক্তের সম্বন্ধ পরিজ্ঞাত, সপিণ্ড সম্বন্ধে সীমার বাহিরে হলেও তার সঙ্গে বিবাহ চলে, আর সেই সীমার মধ্যেও কন্যা ত্ৰিগোত্রান্তরিতা হলে তাকে বিবাহ করা যায়। কিন্তু যেখানে রক্ত সম্বন্ধের কোনও ইতিহাস নেই, কেবলমাত্র বংশপরম্পরাগত একটা নাম সাম্যই বিবাহের অলঙঘনীয় বাধা, এই রকম নিয়ম, যাঁরা কোনও কিছু বোঝাকেই ঘাড় ভেঙে গেলেও ঘাড় থেকে নামাতে ভরসা পায় না, তাঁরা ছাড়া আর কেউ সমর্থন করবে না। তা ছাড়া কল্পিত পূর্বপুরুষ সম্বন্ধ কেবল তো আছে ব্ৰাহ্মণের। সুতরাং শাস্ত্ৰমতে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের প্রকৃত কোনও গোত্র থাকতে পারে না। পুরোহিতের গোত্র থেকেই তাদের গোত্র কল্পনা করা হয় এবং শূদ্রের বিবাহে কল্পিত সগোত্রও কোনও বাধা নয় : ‘প্রাগুক্ত মনু শাতাতব বচনে দ্বিজাতি গ্রহণং সগোত্র বর্জনে শূদ্ৰাদ্যাবৃতাৰ্থম’ (উদ্বাহতত্ত্ব)।
প্রববের ব্যাপারটা আরও একটু ঘোরাল। কাকে প্রবব বলে, তার প্রকৃত অৰ্থ বহুদিন থেকেই হিন্দু সমাজে পণ্ডিতদেরও জানা নেই। প্রতি গোত্রে অনেকগুলি করে আছে। সেগুলিও ব্যক্তিবিশেষের নাম। একটা প্ৰসিদ্ধি এই যে, প্রবর প্রবর্তক ঋষিরা গোত্র প্রবর্তক ঋষিদের পুত্র পৌত্র। সুতরাং সগোত্র ও সমান প্রবারের লোকেরা খুব দূর সম্পর্কের হলেও এক বংশের লোক এবং যাদের প্রবর এক তাদের সম্পর্কটা ওরই মধ্যে একটু নিকট। কিন্তু মুশকিল। এই যে, ভিন্ন গোত্রেও এক প্রবারের নাম আছে, যেমন উপমনু গোত্রে এক প্রবর। বশিষ্ট আবার পরাশর গোত্রেরও এক প্রবর। বশিষ্ট অর্থাৎ ভিন্ন গোত্রের লোক এক প্রবর হতে পারে। আমরা সবাই জানি যে, সেজন্যই সমান প্রবারের বাধা বিবাহে সগোত্রের অতিরিক্ত আর এক বাধা। এ কি করে সম্ভব? সেইজন্য মেধাতিথি বলেছেন-স্মৃতি যখন বলেছে তখন তা স্বীকার করতেই হবে। অর্থাৎ ওটি অলৌকিক বস্তু, লৌকিক বুদ্ধিতে কিছুতেই বুঝা যাবে না। প্রকৃত কথা এই যে, ভাষ্যকার ও নিবন্ধকারদের সময় প্রবারের যথার্থ অর্থের স্মৃতিও লোপ হয়েছিল এবং নানা পরস্পরবিরোধী কল্পনা তার স্থান পূরণ করেছিল। যদি পাঠক রঘুনন্দনের উদ্ধাহতত্ত্বে ধৃত মাধবাচার্যের প্রবারের ব্যাখ্যার সঙ্গে ‘অসপিণ্ডাতু যা মাতুঃ সগোত্ৰাচ যা পিতুঃ’ এই মনু বচনের মেধাতিথির ভাষ্য মিলিয়ে দেখেন তবে এ সত্য হৃদয়ঙ্গম হবে, কিন্তু এখনও আমরা এই বহুদিন মৃত প্রবারের বাসি মড়া ঘাড়ে করে কষ্ট পাচ্ছি এবং বিবাহের ক্ষেত্ৰকে অকারণে সংকীর্ণ করে সমাজের অমঙ্গল ডেকে আনছি।
হিন্দু বিবাহে সপিণ্ডের মধ্যে বিবাহ নিষেধের বিধি নিকট সম্পর্কিত স্ত্রী পুরুষের মধ্যে বিবাহ নিবারণের নিয়ম। এই নিষেধ সকল সমাজের বিবাহ-বিধিতেই কোনও-না-কোনও রকমে আছে। হিন্দু সমাজের প্রচলিত নিয়মে পিতার বংশে সাত ও মাতার বংশে পাঁচ সিঁড়ি উপরে ও নীচে এই নিষিদ্ধ সীমার গণ্ডি—’পঞ্চমাৎ সপ্তমাদুর্ধর্ব মাতৃতঃ পিতৃতস্তথা।’ (যাজ্ঞবল্ক্য)। রাও কমিটির শেষ খসড়ায় শাস্ত্রীয় বিবাহে এই নিয়মই বহাল রাখা হয়েছে। অনেকে সম্ভব জানেন যে, এ-বিষয়ে সকল শাস্ত্রকার একমত ছিলেন না। কোনও কোনও শাস্ত্রকার এই গণ্ডিকে সংক্ষেপ করে পিতৃপক্ষ পাঁচ ও মাতৃপক্ষ তিন পর্যন্ত মাত্র গণনার বিধি দিতেন—’শ্ৰীনতীত্য মাতৃতঃ পঞ্চােতীত্য চ পিতৃতঃ’ (পৈঠনসি)। গোলাপচন্দ্ৰ শাস্ত্রী তাঁর হিন্দু আইন পুস্তকে বলেছেন যে, বাংলাদেশের ব্রাহ্মণদের মধ্যে পৈঠনসির পাঁচ। আর তিন মতবাদই কাৰ্যত চলে, যদিও বাঙালি স্মার্ত রঘুনন্দন সাত আর পাঁচ গণনার জোর পক্ষপাতী। শাস্ত্রী গোলাপচন্দ্রের কথা হয়তো একটু অতিরঞ্জিত, কিন্তু বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ব্ৰাহ্মণদের মধ্যেও পৈঠনসির মত কাৰ্যত চলে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আমার নিজের মতে এই প্ৰস্তাবিত আইনে সপিণ্ডত্বের সীমা পাঁচ। আর তিন-এ নির্দেশ করা উচিত। এই নিয়মের পক্ষে শাস্ত্ৰও আছে এবং বর্তমান হিন্দুর সামাজিক বোধ ও রুচিরও তা বিরুদ্ধ নয়। এই নিয়মে বিবাহ্য বর ও বিবাহ্যা কন্যার ক্ষেত্র বড় হবে, যার সামাজিক প্রয়োজন আছে।