এর পর যে দুটি বিখ্যাত শ্লোক যাজ্ঞবল্ক্য নির্দেশ করেছেন, কোন কোন স্বেপার্জিত সম্পত্তি উপাৰ্জনকারী নিজে রাখতে পারবেন, পরিবারের সকলের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে না। তার টীকার এক জায়গায় মিতাক্ষরাকার লিখেছেন যে, এই প্রকরণের বাচনগুলি প্রায়ই যা লোক-প্রসিদ্ধ ব্যবহার তারই অনুবাদ মাত্র অর্থাৎ শাস্ত্রের বিধি নয়।
‘অস্মিন প্রকরণে’ ‘এই প্রকরণে’ যে প্রকরণের কথা মিতাক্ষরাকার বলেছেন, সে হচ্ছেদায়বিভাগ প্রকরণ। সুতরাং মিতাক্ষরাকারের মনে কোনও সন্দেহ ছিল না যে, যাজ্ঞবল্ক্যের ব্যবহার অধ্যায়ের দায়ভাগ প্রকরণের বিধিগুলি বেদমূল নয়, অর্থাৎ হিন্দু রিলিজিয়নের অঙ্গ নয়, লোক-প্ৰসিদ্ধ ও লোক-ব্যবহার সে বিধির স্রষ্টা। মিতাক্ষরার অনেক পরবর্তী গ্ৰন্থ ‘বীর মিত্ৰোদয়’ সোজাসুজি বলেছেন, ‘প্ৰায়েণ ব্যবহার-স্মৃতীনাং লোকসিদ্ধার্থনুবাদকত্বমিতি সকল নিবন্ধু ভিরভিধানাং’, অর্থাৎ ব্যবহার স্মৃতির প্রায় বচনগুলি যা লোকসিদ্ধ তারই অনুবাদক–এই কথা সকল নিবন্ধকার বলেছেন।
যাঁরা আপত্তি তুলেছেন যে, হিন্দু দায়াধিকার বিধি পরিবর্তন করলে হিন্দুধর্মে আঘাত লাগবে, ধর্মশূন্ত্রকারগণ ধর্ম বলতে কি বুঝতেন, তার কােনও খবর তাঁরা রাখেন না। রাষ্ট্র বা সমাজে কোর্সও কিছু পরিচালনের দায়িত্ব আমাদের নেই বলে সব কিছুতেই ধৰ্ম গেল। রব তোলা সম্ভব হয়েছে। সে দায়িত্ববোধ থাকলে সময়ের প্রয়োজন অনুসারে দায়বিভাগের প্রচলিত বিধির পরিবর্তনে ধৰ্মহানির কথা কখনও উঠতে পারত না।
দায়ভাগ যে ধর্মের অঙ্গ–এই ভুল বিশ্বাস বাঙালির মনে হওয়ার একটা অতিরিক্ত কারণ আছে। বাঙালি হিন্দু জীমূতবাহনের দায়ভাগদ্বারা শাসিত। জীমূতবাহন অন্যত্র প্ৰচলিত দায়বিভাগক্রমকে পরিবর্তন করেছিলেন। সেই পরিবর্তনের জন্য তিনি একটা তর্ক আশ্রয় করেছিলেন। সে তর্ক হচ্ছে এই পার্বণ–শ্রাদ্ধে পিণ্ডদান করে যে যত বেশি উপকার করে, সম্পত্তির উত্তরাধিকারে তার দাবি তত বেশি। পাৰ্বণ শ্রাদ্ধে পিণ্ডদান হিন্দুর আচারধর্মের অন্তর্গত। সুতরাং মনে হতে পারে যে, দায়ভাগের দায়াধিকার বিধি হিন্দুধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দায়ভাগ গ্রন্থ যিনি পাঠ করেছেন, তিনিই জানেন যে, এই তর্কটা হিন্দুধৰ্ম অর্থাৎ রিলিজিয়নের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে জীমূতবাহন আদৌ মনে করেননি। এই তর্কটা জীমূতবাহন নিয়েছিলেন উদ্যোত নামা একজন পূর্বাচার্যের কাছ থেকে। উদ্যোতের কোনও গ্রন্থ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। দায়ভাগ থেকে যতদূর বোঝা যায়, কি উদ্যোত, কি জীমূতবাহন— দুজনেই এই তর্কটিকে ন্যায়ের যুক্তি বলেছেন, ধর্মের অনুশাসন বলেননি। জীমূতবাহন। এই কথা বলে তার বিচার শেষ করেছেন, ‘তদর্জিত ধনস্য চ তদুপকারতারতম্যেন তদৰ্থ্য সম্পাদনস্য ন্যায্যত্বাৎ উপকারকুত্বনৈব ধনসম্বন্ধো ন্যায়প্ৰাপ্তে মম্বাদীনামভিমতমিতি মন্যতে। অর্থাত্রাপরিতেষোবিদুষাং বাচনিক এবায়মৰ্থঃ।’ অর্থাৎ যার ধন পিণ্ড দানের তারতম্যে তার উপকারের তারতম্য হয়। সুতরাং বেশি উপকারীর ধনের উত্তরাধিকার দাবি ন্যায্য ও ন্যায়প্রাপ্ত–যাজ্ঞবল্ক্য মনু প্রভৃতির এইরূপ অভিমত— ইহাই আমি মনে করি। এতেও অর্থাৎ এইরূপ তর্কেও যদি পণ্ডিতেরা তুষ্ট না হন, তা হলে বলি যে, মনু প্ৰভৃতির বচন থেকেও আমি যে উত্তরাধিকার ক্রম স্থাপন করেছি, তা পাওয়া যায়। এর টীকায় দায়ভাগের টীকাকার শ্ৰীকৃষ্ণ তর্কলংকার বলেছেন, ‘যতো ন্যায়মূলত্বে বিদুষামসন্তোেষঃ ততো বাচনিক এবাৰ্থ ইতি’ অর্থাৎ য়দি ন্যায়মূলক এই তর্কে পণ্ডিতেরা সন্তুষ্ট না হন, তবু জীমূতবাহনের মত ঋষিদের বচন থেকেও পাওয়া যায়। এটা সুস্পষ্ট যে জীমূতবাহন তার দায়ক্রম বিধিকে বেদমূল বলেননি, বলেছেন ন্যায়প্রাপ্ত অর্থাৎ ন্যায়মূল। দায়ভাগের উত্তরাধিকারবিধি জীমূতবাহন হিন্দুধর্ম অর্থাৎ রিলিজিয়নের উপর প্রতিষ্ঠা করেননি, করেছেন ন্যায়ের বা যুক্তির উপর।
অনেকে জানেন বাংলা ভিন্ন সমস্ত ভারতবর্ষে যেখানে মোটামুটি মিতাক্ষরা দ্বারা লোকে শাসিত, পার্বণশ্রাদ্ধে পিণ্ডের উপর দায়াধিকার নির্ভর করে না, নির্ভর করে রক্ত সম্পর্কের উপর। রক্ত সম্পর্কে যে যত নিকট মিতাক্ষরার মতে সে তত নিকট উত্তরাধিকারী। আশা করা যায়, রক্ত সম্পর্কের মধ্যে ধর্মের বীজ কেহ খুঁজে বের করবেন না।
হিন্দুর দায়বিভাগ যে হিন্দুর ধর্মের অঙ্গ, এটা হিন্দু সভ্যতাকে খাটো করার জন্য পশ্চিম দেশে কোনও কোনও লেখক প্রচার করেছিলেন। আমরা সেই প্রচারকে প্রশংসাবাক্য জ্ঞানে মাথায় করে নিয়েছি। হিন্দু শাস্ত্রকর্তাগণ প্রকৃত কি বলেছেন, তা জািনবার জন্য আমাদের কোনও মাথা ব্যথা নেই। যে অনড় অবস্থায় আমরা অভ্যস্ত হয়েছি, যা তার অনুকূলে তাই হিন্দু-শাস্ত্রের বিধি-তাতে অনেকেই সন্দেহ করে না। কারণ, অনেক মানুষই—যা বিশ্বাস করলে মন খুশি হয়, তাই বিশ্বাস করে। সে বিশ্বাস যে সম্পূর্ণ অমূলক হতে পারে, তা তাঁরা মনে করতে চায় না। কেউ প্রমাণ করে দেখালে তার উপর বিরক্ত হয় ও গালাগালি করে।
8
রাও কমিটির প্রথম খসড়ায় বিবাহকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল-শাস্ত্রীয় বিবাহ ও লৌকিক বিবাহ। প্রচলিত হিন্দু বিবাহে যে সকল বিধি-নিষেধ আছে, শাস্ত্রীয় বিবাহে সে সমস্তই বলবৎ রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ অসবর্ণ, সগোত্র ও সমান প্ৰবাব বর-কন্যার মধ্যে বিবাহকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরিবর্তন কেবলমাত্র এইটুকু ছিল যে, বিবাহ হবে একপত্নীক, অর্থাৎ এক পত্নী বর্তমানে পুরুষের দ্বিতীয়বার বিবাহ করা চলবে না। প্রস্তাবিত লৌকিক বিবাহে অসবর্ণ, সগোত্র ও সমান প্রবর বর-কন্যার বিবাহ বৈধ বিবাহ করা হয়েছিল। কেবল কতকগুলি নিকট সম্পর্কে সম্পর্কিত বর-কন্যার মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। অবশ্য এই বিবাহও ছিল একপত্নীক। এই দুই শ্রেণির বিবাহে ব্যাবহারিক ফল একরকম হবে-এই নির্ধারণ ছিল। অর্থাৎ উভয় প্রকার বিবাহিত স্বামী স্ত্রী ও তাদের সন্তানসন্ততিরা এক হিন্দু দায়াধিকার আইনে শাসিত হবে। লৌকিক বিবাহের ফলে কেহ তার পরিবার থেকে বিচুত হবে না বা দেবোত্তর প্রভৃতির সেবাইতি থেকেও বঞ্চিত হবে না, দত্তক গ্রহণের ক্ষমতা লোপ হবে না এবং লৌকিক বিবাহকারী পুত্ৰকে মৃত্যগণ্যে তার পিতার দত্তক গ্রহণের ক্ষমতা হবে না। হিন্দু বিবাহের এই দুই শ্রেণি ভাগের উদ্দেশ্য ছিল সনাতন-পন্থীদের আশ্বস্ত করা। শাস্ত্রীয় বিবাহে যখন চলতি সব নিষেধ বহাল থাকল। তখন একটা অশাস্ত্রীয় লৌকিক বিবাহ স্বীকারে ক্ষতি কি? কিন্তু এইরকম শ্রেণি ভাগের বিরুদ্ধে দুইটি আপত্তি আছে, প্রথম-এই শ্রেণি ভাগের উদ্দেশ্য কিছুতেই সিদ্ধ হবে না। কারণ সনাতনীদের তুষ্ট করে যদি এ আইন পাশ করাতে হয়, তবে এ আইন পাশ হবে না। কারণ দুই রকম বিবাহের ব্যাবহারিক ফল যেখানে এক, আশাস্ত্রীয় লৌকিক বিবাহে পতি-পত্নীর হিন্দুর সমাজ ও ধর্মে সকল দাবি যখন সম্পূর্ণ বহাল থাকবে, তখন সনাতনপন্থী তুষ্ট বা আশ্বস্ত হবে কীসে? সনাতনপন্থীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এই আইন যদি পাশ হয় তা হবে তাদের মতের জোরে যাঁরা সমগ্ৰ হিন্দু সমাজের যুগোপযোগী পরিবর্তন চায়, সমাজের বিধিবন্ধন থেকে ব্যক্তিবিশেষের মুক্তি মাত্র চায় না। এই শ্রেণি বিভাগের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আপত্তি এবং যা প্রধান আপত্তি তা হচ্ছে—এই শ্রেণি ভাগ হিন্দু বিবাহবিধির সংস্কার নয়, হিন্দুকে হিন্দু বিবাহবিধি অগ্রাহ্য করে বিবাহের স্বাধীনতা দেওয়া। এইরকম ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের যথেষ্ট মূল্য আছে। কিন্তু সমস্ত সমাজের উপর তার ফল গৌণ ফল। হিন্দুর বর্তমান সমাজ এই গৌণ উপায়ে পরিবর্তনের চেষ্টার যুগ ছেড়ে এসেছে। এখন প্রয়োজন, সমস্ত সমাজের হিতে হিন্দুর সামাজিক বিধি ব্যবস্থার উপযুক্ত পরিবর্তন, যার ফলে হিন্দু সমাজ দৃঢ় গড়ন ও নুতন বল পাবে।