- বইয়ের নামঃ সমাজ ও বিবাহ
- লেখকের নামঃ অতুলচন্দ্র গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
বাঙালি হিন্দু
বাঙালি হিন্দু সমাজের ইংরেজি শিক্ষিত উপরের স্তর চঞ্চল হয়ে উঠেছে। এ চাঞ্চলের কারণ বাইরের আঘাত, সুতরাং ও অংশের সজীবতার প্রমাণ।
ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসন আমলে সে বিদেশি শাসন তার অধীন দেশের লোককে যতটা সুযোগ দিয়েছিল তার ষোলো আনা সুবিধা নিয়েছিল বাঙালি হিন্দু। রাজার দেশের ভাষা শিখে, এবং মোগল শাসন ও স্বদেশের রাষ্ট্ৰীয় ব্যবস্থা মিশিয়ে কর আদায় ও শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় যে প্ৰকাণ্ড ও জটিল শাসন যন্ত্র ইংরেজ এ-দেশে আমদানি করেছে তার মোটা কলকব্জাগুলো চালাবার বিদ্যা আয়ত্ত করে তার প্রতিষ্ঠা ও চলার কাজে সে কম সাহায্য করেনি। এই মিস্ত্ৰিগিরির মজুরি সে যা পেয়েছে তাই হচ্ছে উচ্চশ্রেণি বাঙালি হিন্দুর এ দেশে প্রতিপত্তি ও নেতৃত্বের বাস্তব ভিত্তি। বাঙালি হিন্দু যে নতুন ভাষা ও বিদ্যায় সহজেই নিজেকে রপ্ত করে তুলেছিল তার এক কারণ তার মনে অতীত গৌরবের এমন কোনও স্মৃতি ছিল না। যার অভিমান এর বাধা জন্মাতে পারে।
ব্রিটেনের রাজতত্তঙ্গ দখল সে সানন্দেই বরণ করেছিল। যার ফলে পাটনা থেকে পেশোয়ার, কটক থেকে মধ্যভারত ইংরেজের বিজয় নিশানের পিছু পিছু সে ছুটেছিল হাতে কলম, বগলে ইংরেজি বিদ্যা শিখবার পুথি। বিজিত দেশে নব শাসন রীতি চলতি করতে, আর সে বিদ্যায় সে দেশের লোকের হাতে খড়ি দিতে। কেরানিগিরি গুরুগিরির এই একচেটি ব্যবসায় উত্তরা পথ জুড়ে বাঙালি হিন্দু বহুদিন কায়েম ছিল। আজও সেখানকার বড় বড় শহরে তার ধবংসাবশেষ আমাদের আপশোস ও আস্ফালনের খোরাক জোগাচ্ছে। স্বভাবতই এ মনপালি’ ছিল সাময়িক; আর তা না হলে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হতাশ হতে হত। যে মাস্টার আশা করে ছেলেরা স্কুলের বিদ্যা শেষ করে নিজেরা কখনও মাস্টার হবে না, নিরাশ তাকে হতেই হয়।
কিন্তু এইটুকুই পুরো সত্য নয়। রাজ শাসনের সঙ্গে সঙ্গে নব ইউরোপের যে সব ভাব ও বিদ্যা ইংরেজ এ-দেশে এনেছিল, সাংসারিক সুবিধার উপায় স্বরূপে ছাড়াও বাঙালি হিন্দুর তা মনে হয়েছিল। পরম উপাদেয়। কারণ যাই হোক হিন্দু বাঙালির মনে এমন কিছু ছিল যা এদের অনুকুল।
সেই জন্য রামমোহন রায়ের মতো আশ্চর্য মানুষের বাংলায় আবির্ভাব হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের মতো প্ৰাচীন শিক্ষায় শিক্ষিত পণ্ডিত এ নব বিদ্যা ও ভাব প্রচারের অগ্ৰণী হয়ে ছিলেন। এবং প্রথম প্লাবন কেটে গেলে দেখা গেল যে বাঙালির মন এ বন্যায় ডুবে মরেনি, উর্বর হয়েছে।
ফলে ইংরেজ যুগের বাংলা সাহিত্য যা আধুনিক ইউরোপের প্রধান সাহিত্যগুলির তুলনায় নানাদিকে ছোট, কিন্তু কেবল সেই তুলনাতেই ছোট। কারণ ভারতবর্ষ কি এশিয়ার আর কোথাও এর তুল্য মূল্য আধুনিক সাহিত্য আজ নেই। এ সাহিত্যের একটি প্রধান বাণী নব ইউরোপের মুক্তির-বাণী মনে, সমাজে, রাষ্ট্রে। বাংলায় এই মুক্তির বাণী প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে সমস্ত ভারতবর্ষের চিন্তা ও কর্মকে উদ্ধৃদ্ধ করেছে। আর এই বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাঙালি হিন্দু ভারতবর্ষের জাতীয়তা ও রাষ্ট্ৰীয় ঐক্যের যে বার্তা প্রচার করেছে, বৃহৎ রাষ্ট্ৰীয চেষ্টার দুরূহ। পথে সাহস, নিষ্ঠা ও ত্যাগের যে আদর্শ দেখিয়েছে রাষ্ট্ৰীয় চিন্তা ও কর্মে তা ভারতবর্ষের নবজন্ম। ব্রিটিশ শাসনের কলের মজুরি কেমন করে করতে হয় বাঙালি হিন্দু অর্ধেক ভারতবর্ষকে তা শিখিয়ে ছিল, ভারতবাসীকে মানুষের মতো বাঁচতে ও মরতে হলে ও কলের যে বদল দরকার এ জ্ঞানও বাঙালি হিন্দু ভারতবর্ষকে দীক্ষা দিয়েছে। প্রথম গুরুগিরির পুরস্কার সে ইংরেজের হাতে পেয়েছে। দ্বিতীয় গুরুগিরির দণ্ড ও হাতে না পেলে প্রমাণ হত যে গুরুগিরি নিষ্ফল হয়েছে।
২
নিষ্ফল কিন্তু হয়নি। ভারতবাসীর বর্তমান রাষ্ট্রীয় চেতনা ভারতবর্ষে সর্বময়ত্বের অবসান সূচনা করেছে। ওর পরিপুষ্টিতে তার ধ্বংস। এ চৈতন্যের প্রধান উৎস যে বাঙালি হিন্দু তাতে অবাঙালি ভারতবাসীর মনে যে মোহই থাকুক ইংরেজের মনে কোনও সংশয় নেই। এই উৎসের মুখ বন্ধ করতে সাম্রাজ্যভোগী ব্রিটিশ শাসক সম্প্রদায়ের যে চেষ্টা হবে তা স্বাভাবিক।
এ শতাব্দীর প্রথমে সে চেষ্টা হয়েছিল বাঙালির রাষ্ট্ৰীয় জীবনকে দুভাগ করে। ফল হল উলটো। রুদ্ধ স্রোত বাধাকে ঠেলে ফেলে ভারতবর্ষময় ছাড়িয়ে পড়ল। যার গতিবেগে ভারতবাসীর রাষ্ট্রীয় চিন্তা ও চেষ্টা আজকের খাদে প্রবাহিত হচ্ছে। এইবার চলেছে। দ্বিতীয় চেষ্টা। পূর্ব ও পশ্চিমে পৃথিবীর অবস্থা ও ভবিষ্যতের আশঙ্কা আজ এমন হয়েছে যে ভারতবর্ষের শাসন ও শোষণের পূর্ব রীতির বদল হয়ে উঠেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে
প্রয়োজন। আশা আছে। ওর ভিতরটা বহাল রেখে চেহারাটা বদলে দিলেই এখনকার মতো কাজ চলবে। ব্রিটিশ শাসকেরা যখন এ দেশের রাষ্ট্র ব্যবহার ‘রিফর্মের কথা বলেন তখন সম্ভব তাদের মনে থাকে ধাতুর্থ–ফর্ম’ অর্থাৎ আকারের পরিবর্তন। আর যদি বাধ্য হয়ে
করতে হয় তবে বাকি ভারতবর্ষের মন থেকে বাঙালি হিন্দুর রাষ্ট্ৰীয় চিন্তা ও আদর্শের প্রভাব দূর হলে আপোষ নিষ্পত্তিতে বর্তমান সুবিধার অনেকটাই বজায় থাকবে বলে ইংরেজের বিশ্বাস। বাঙালি হিন্দুর ‘একস্ট্রিমিজম বাদ দিলে বাকি ভারতবর্ষের সুইট ও রিজিনেবল’ হবার আশা আছে। সেইজন্য রিফর্মের শেষ কিস্তিতে বাঙালি হিন্দুকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে বাঙালি মুসলমানের ভোটের চাপে। বাংলাদেশে হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। তার ফলেই বাংলার রাষ্ট্র পরিষদে হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যায় আসবে বেশি, এবং তাতে বাঙালি হিন্দুর রাষ্ট্ৰীয় প্রভাব ও অন্য প্রতিপত্তি ক্ষুন্ন হবে ‘রিফর্ম কর্তারা’ এই ভরসাতেই নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। বাঙালি হিন্দু যে ডেমোক্রেসির বচন আওড়ায় তার পাটিগণিতের মারে তাকে কাবু করে মজা দেখার লোভেও নয়। তাদের মনে এ আশঙ্কা ছিল যে প্রতিনিধি নির্বাচনে হিন্দু মুসলমান মিশিয়ে দিলে হিন্দুয়ানি ও মুসলমানির চেয়ে রাষ্ট্র ব্যাপারে বাঙালি হিন্দু মুসলমানের কাছে বাংলাদেশ বড় হয়ে উঠতে পারে। আর ‘ওয়াইলি’ হিন্দুকে বিশ্বাস কী! সেই জন্য গড়তে হয়েছে ধর্ম সাম্প্রদায়িক নির্বাচন মণ্ডলী। যাতে মুসলমান যে পরিষদে আসবে সে বুঝবে মুসলমান বলেই সে এসেছে। সে মুসলমানের প্রতিনিধি দেশের নয়। আর যাঁরা তাকে পাঠাবে তাঁরাও জানবে রাষ্ট্র ব্যাপারে তাঁরা বাঙালি নয় তাঁরা মুসলমান; প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে এক নয়, যদিও তাদের ভাষা এক এবং রক্তও এক আর দুঃখ সুখের ভোগও এক। এইখানেই শেষ নয়। নষ্ট্রের গোঁড়া গোটা বাঙালি হিন্দু সমাজ নয়, উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দু। সুতরাং প্রয়োজন হয়েছে উচ্চ হিন্দু ও অনুচ্চ হিন্দুর মধ্যে প্রাচীর তোলা যাতে উচ্চবর্ণ বাঙালি হিন্দু বাংলাদেশে এক ঘরে হয়। মহাত্মার উপবাস দৈব সুযোগ; ইংরেজের আর পাঁচটা সৌভাগ্যের মধ্যে একটা সৌভাগ্য।