রাজার রোগটা বড়ই আজব। তিনি চোখে দেখেন না। না, তার মানে এই না যে তিনি অন্ধ। তাঁর সমস্যাটা হলো যে তিনি হুট করেই চোখে ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। বিষয়টা এত অদ্ভুত, বলার মতো না। রাজা তাঁর নিয়মমত একদিন ঘুমোতে গেলেন তাঁর চার রাণীকে নিয়ে, ঘুম থেকে উঠে দেখলেন যে তিনি চোখে ঠিকমতো আর দেখতে পারছেন না।
রাজ্যময় হৈচৈ পড়ে গেল, রাজার কী হলো কী হলো রব। হাজারো বৈদ্য বৃথা গেল, অনেকে আবার শূলেও চড়লো দাওয়াই না বের করতে পেরে। অবশেষে রাজা পেলেন এক বৃদ্ধ সাধুর দেখা। এই সাধু নাকি পৃথিবীর যাবতীয় রোগের উপশম করতে পারেন। সব শুনে তো রাজা বড় খুশি, এবার বুঝি তাঁর চোখটা বেঁচেই গেল! তিনি খোঁজ লাগাতে বললেন, যেখান থেকে পারে, সাধুকে যেন প্রাসাদে তুলে নিয়ে আসে! সাধু এলেন। রাজাকে একনজর দেখলেন। দেখেই বলে বসলেন, এ রাজার চোখে বিচিত্র এক রোগ আছে। এ রোগের দাওয়াই একটাই! সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলো, বললো, কি দাওয়াই, সাধুমশাই? বলুন না একটিবার?
সাধু বলে দিলেন সেই মহৌষধ। আসলে, সেটাকে ওষুধ না বলে বরং বলা উচিত কৌশল। তিনি রাজাকে বললেন বেশি বেশি করে লাল রং দেখতে। রাজা যতো লাল দেখবেন, তার চোখ ততো পরিষ্কার হবে। সে যুগে তো আর ফটোশপের বায়না নেই, প্রযুক্তির ছোঁয়া আসে নি সেখানে। রাজামশাই ঘোষণা দিলেন, এখন থেকে তাঁর চারপাশের সবকিছু যেন লাল রং করে দেয়া হয়। দেয়াল লাল, প্রাসাদ লাল, রাণীর প্রসাধণী লাল, বাঈজির নাচের জামা লাল, প্রহরীর শিরস্ত্রাণ লাল- সবকিছু যেন লালে লাল হয়ে গেল! রাজামশাই দিব্যি খুশি। একগাদা লালের মাঝে বসে তিনি আবার আগের মত ঝকঝকে দেখতে পান সবাইকে।
একদিন সাধুর খুব শখ হলো, রাজামশাই কেমন আছেন, সেটা দেখার। তিনি হাজির হলের প্রাসাদে। প্রহরীসহ সবাই তাঁকে চিনে গেছে এতোদিনে, হাজার হোক রাজার অসুখ সারানোর বদ্যি পুরো দেশে আর একজনও তো নেই! প্রহরীরা তাঁকে ভেতরে নিয়ে গেল বটে, তবে আসার আগে তাকে লাল রং দিয়ে গোসলই করে দেয়া হলো! এটা সাধুর ঠিক পছন্দ হলো না।
রাজার মহাসভা। সবাই উপস্থিত। রাজা তো সাধুকে দেখে মহাখুশি, বললেন আসুন আসুন সাধুবাবা, আপনার দিব্যিতেই আমি চোখ ফিরে পেয়েছি, বলুন আপনি কী চান!
সাধু কিছুই বললেন না। একটু পর উঠে রাজার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, পুরো দেশটাকে লাল রং করে ফেলার থেকে আপনি নিজেই একটা লাল কাঁচের চশমা পরে নিলে কি হতো না? নিজের জন্যে পুরো দেশকে লাল করে দেয়ার কী দরকার ছিল, রাজামশাই?
রাজার কাছে সে প্রশ্নের উত্তর আর ছিল না।
গল্পটা এখানেই শেষ। এই গল্পের একটা মোরাল আছে। মোরালটা হলো, নিজের দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে অন্যকে পাল্টাতে না বলে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গিটাই পালটে ফেললেই পৃথিবীটা আরো সুন্দর হয়ে যায়।
গল্পটাকে রূপক ধরা যাক। বাস্তব জীবনে, নিজের সিদ্ধান্ত, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যের উপরে চাপানোর দোষে দুষ্ট কিন্তু অনেকেই। এখানে খুব সোজা। বাংলায় বলতে গেলে, অন্যের কোনকিছুকে জাজ করা বা সেটা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার থেকে দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টিয়ে ফেললেই অনেক ভালো হয় না?
সম্প্রতি দেখলাম একটা ভিডিও আলোড়নে এসেছে, সেখানে বেশ মোটা দাগে ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে, সেটা আবার অনেকে সাপোর্টও করছে! এখানেও সেই দৃষ্টিভঙ্গিরই সমস্যা। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টে দিতে পারলে দেশ এবং পৃথিবী আরো অনেক বেশি ভালো হয়ে যাবে। নিষ্কলঙ্ক সেই পৃথিবীর প্রত্যাশাই করি আমরা, প্রতিনিয়ত।
.
আমার প্রথম পাবলিক পরীক্ষা আর ডোপামিন ইফেক্টের গল্প
আমার তখন এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে। জীবনের প্রথম বড়সড় পাবলিক পরীক্ষা। মনের মধ্যে স্বভাবতই অনেক টেনশন, কী হবে না হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। পরীক্ষা খারাপ হবে কি না সেটা আবার আরেক টেনশন। মোটামুটি বাজে অবস্থা।
এর উপরে আরো দুই ধরণের মানুষের জ্বালাতনে মরে যাই যাই অবস্থা। যে। আত্মীয়দের কস্মিনকালেও আশেপাশে দেখি নি আমিসহ আমাদের বাসার কেউ, সেই মানুষগুলো সমানে ফোন দিয়ে পরীক্ষার খোঁজখবর নিচ্ছে, কথাবার্তা বলছে। চরম বিরক্তিকর বিষয়। তার উপরে আমার কিছু ন্যাকা বন্ধু প্রায়ই ফোন দিয়ে বলছে দোস্ত আমি কিছু পারি না, ফেইল করবো, কী যে হবে! অথচ আমি নিশ্চিত সে এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস চোখ বন্ধ করে পেয়ে যাবে। বিশ্রি অবস্থা।
যাহোক, প্রথম পরীক্ষার দিন। আমার সাথে আমার প্রথম পরীক্ষায় এসেছেন আমার মা। তাঁর সাথে আমার কথোপকথন
মাঃ আয়মান, বাবা পেন্সিল নিয়েছিস?
আমিঃ ক্ষীণ কণ্ঠে* হ্যাঁ, মা।
মাঃ আয়মান, বাবা ইরেজার নিয়েছিস?
আমিঃ *আরো ক্ষীণ কণ্ঠে* হ্যাঁ, মা।
মাঃ আয়মান, বাবা পেন্সিল শার্প করে নিয়েছিস তো?
আমিঃ *শোনা যায় না এমন গলায়* হ্যাঁ, মা।
এবার মা ব্রহ্মাস্ত্র ছাড়লেন। বলে বসলেন, বাবা পেন্সিল বেশি শার্প করিসনি তো?
আমি মোটামুটি যারপরনাই হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম। আর কিছুই বললাম না। মা এবার শুরু করলেন তাঁর ভোঁতা পেন্সিলের কারসাজি। তিনি বললেন, বাবা ও এম আর শিটের জন্যে তুই ভোঁতা পেন্সিল নিয়ে যা। দ্রুত গোলল্টা ভরাট করতে পারবি। আমি চিন্তা করে দেখলাম, ভালোই তো আইডিয়া! যেই বলা সেই কাজ। মা শুরু করে দিলেন তাঁর কাজ। শব এ বরাতে যেমন রুটি আর হালুয়া বানায়, সেই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে মুহূর্তেই আমার দুটো পেন্সিল ভোঁতা হয়ে গেল।