[প্রস্থান
[ধর্মদাস, গোবিন্দ ও পরাণ হালদারের প্রবেশ]
গোবিন্দ। (রমেশের প্রতি) বাবা, এই পরাণ-মামাকে ধরে নিয়ে এলাম। আসতে কি চায়! কিন্তু আমিও ছাড়নে-বালা নই! বলি, বেণীই জমিদার আর আমার ভাগ্নে রমেশ নয়? (উপরের দিকে মুখ তুলিয়া) তারিণীদা, স্বর্গে বসে সমস্তই দেখচো শুনচো, কিন্তু এই তোমার কাছে প্রতিজ্ঞে করচি আমি, এই উঠোনের ওপর বেণীর যদি না এমনি করে নাক রগড়াতে পারি ত আমার নামই গোবিন্দ গাঙ্গুলী নয়।
ধর্মদাস। আহা, তুই থাম না গোবিন্দ। (কাশিতে কাশিতে) সে আমি ঠিক করে নেব।
[অকস্মাৎ বেণী ঘোষাল প্রবেশ করিল]
বেণী। এই যে রমেশ, একবার এলাম—বড় জরুরী কাজ—মা এসেচেন নাকি?
গোবিন্দ। আসবে বৈ কি বাবা, একশ’বার আসবে। এ ত তোমারই বাড়ি। তাই ত আমি রমেশ বাবাজীকে সকাল থেকে বলচি, রমেশ, ঝগড়া-বিবাদ তারিণীদার সঙ্গেই যাক—আর কেন? তোমরা দু’ভাই এক হও, আমরা দেখে চোখ জুড়োই! তা ছাড়া বড় গিন্নীঠাকরুন যখন স্বয়ং এসে উপস্থিত হয়েচেন, তখন—
বেণী। মা এসেচেন?
গোবিন্দ। শুধু আসা কেন, ভাঁড়ার-টাঁড়ার, করা-কর্ম যা-কিছু তিনিই ত করচেন। আর তিনি না করলে করবেই বা কে?
[সকলেই নীরব হইয়া রহিল]
গোবিন্দ। (নিশ্বাস ফেলিয়া) নাঃ—গাঁয়ের মধ্যে বড়-গিন্নীঠাক্রুনের মত মানুষ কি আর আছে? না, হবে? না বেণীবাবু, সামনে বললে খোশামোদ করা হবে, কিন্তু যে যাই বলুক, গাঁয়ে যদি লক্ষ্মী থাকেন ত সে তোমার মা। এমন মা কারু হয়?
[এই বলিয়া পুনশ্চ একটা নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন]
বেণী। আচ্ছা—
গোবিন্দ। শুধু আচ্ছা নয় বেণীবাবু। আসতে হবে, করতে হবে, সমস্ত ভার তোমার ওপর। ভাল কথা, সবাই আপনারা ত উপস্থিত আছেন, নেমন্তন্নটা কিরকম হবে একটা ফর্দ করে ফেলা হোক। কি বল রমেশ বাবাজী? ঠিক কি না হালদার মামা? ধর্মদাসদা চুপ করে থাকলে হবে না,—কাকে বলতে হবে, কাকে বাদ দিতে হবে জান ত সব।
রমেশ। বড়দা, একবার পায়ের ধুলো যদি দিতে পারেন—
বেণী। মা যখন এসেচেন তখন আমার আসা না-আসা—কি বলো গোবিন্দ খুড়ো?
রমেশ। আপনাকে আমি পীড়াপীড়ি করতে চাইনে বড়দা, যদি অসুবিধে না হয় ত একবার দেখে-শুনে যাবেন।
বেণী। সে ত ঠিক। আমার মা যখন এসেচেন তখন আমার আসা না-আসা—কি বল হালদার-মামা? তা মাকে একটু শিগগির যেতে বোলো রমেশ, বিশেষ দরকারী কাজ, আমারও এখন দাঁড়াবার জো নেই—প্রজারা সব—
[বলিতে বলিতে বেণীর দ্রুতপদে প্রস্থান
গোবিন্দ। (নেপথ্যে গলা বাড়াইয়া দেখিয়া লইয়া) আরে, বেণী ঘোষাল! তুই পাতায়-পাতায় বেড়াস ত আমি তার শিরে-শিরে ফিরি। আমার নাম গোবিন্দ গাঙ্গুলী। নিজের চোখে দেখতে এসেচে মা এসেচে কিনা! বুঝি না বটে! (রমেশের প্রতি) আর দেখলে বাবা রমেশ, কেমন তোফা মিষ্টি মোলায়েম কথাগুলি শুনিয়ে দিলাম! যেন মিছরির ছুরি! আর বলবার জো নেই যে কর্মবাড়িতে গিয়ে খাতির পাইনি। লোকের কাছে যে বলে বেড়াবে, রমেশ না হয় ছেলেমানুষ, কিন্তু তার মামা গোবিন্দ গাঙ্গুলী ত উপস্থিত ছিল। বৃহৎ কাজেকর্মে কর্মকর্তা হয়ে থাকা সহজ ব্যাপার নয় বাবা, এক-একটা চাল ভাবতে মাথা ঘুরে যায়!
ধর্মদাস। তুই বড় বাজে বকিস গোবিন্দ! থাম না!
[একদিক দিয়া সুকুমারী ও তাহার মা ক্ষান্ত প্রবেশ করিয়া বাটীর অন্তঃপুরে চলিয়া গেল। পরাণ হালদার কঠিন-চক্ষে তাহাদের নিরীক্ষণ করিলেন। মুহূর্তে ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ প্রবেশ করিল]
পরাণ। ওরা বাড়ির মধ্যে গেল কারা?
ষষ্ঠী। ক্ষান্ত বামুন-ঠাকরুন আর তাঁর মেয়ে।
পরাণ। যা ভেবেচি তাই। ওদের বাড়ি ঢুকতে দিলে কে?
ষষ্ঠী। আচায্যিমশাই ডেকে এনেচেন। দু’দিন ধরে সমস্ত কাজকর্ম করচেন।
পরাণ। ওরা যদি খাদ্যদ্রব্য স্পর্শ করে থাকে ত কোন ব্রাহ্মণই এখানে জলগ্রহণ করতে পারবে না।
[ক্ষান্ত আড়ালে দাঁড়াইয়া বোধ হয় শুনিতেছিল,
তৎক্ষণাৎ বাহির হইয়া আসিল]
ক্ষান্ত। কেন শুনি হালদার-ঠাকুরপো? (রমেশের প্রতি) হাঁ বাবা, তুমিও ত গাঁয়ের একজন জমিদার, বলি সমস্ত দোষই কি এই ক্ষেন্তি বামনীর মেয়ের? মাথার উপর আমাদের কেউ নেই বলে কি যতবার ইচ্ছে শাস্তি দেবে? (গোবিন্দকে দেখাইয়া) ঐ উনি মুখুয্যেবাড়ির গাছ-পিতষ্ঠের সময় জরিমানা বলে দশ টাকা আদায় করেন নি? গাঁয়ের ষোল-আনা মনসা-পূজোর নামে দু’জোড়া পাঁঠার দাম ধরে নেননি? তবে কতবার ঐ এককথা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় শুনি?
গোবিন্দ। যদি আমার নামটাই করলে ক্ষান্তমাসী, তবে সত্যি কথা বলি বাছা, খাতিরে কথা কইবার লোক গোবিন্দ গাঙ্গুলী নয়, সে দেশসুদ্ধ লোকে জানে। তোমার মেয়ের প্রায়শ্চিত্তও হয়েচে, সামাজিক দণ্ডও করেচি,—সব মানি। কিন্তু যজ্ঞিতে কাঠি দিতে ত আমরা হুকুম দিইনি? মরলে ওকে পোড়াতে আমরা কাঁধ দেব, কিন্তু—
ক্ষান্ত। মলে তোমার নিজের মেয়েকে কাঁধে করে পোড়াতে যেয়ো বাছা, আমার মেয়ের ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না। বলি, হাঁ গোবিন্দ, নিজের গায়ে হাত দিয়ে কি কথা কও না? তোমার ছোট-ভাজের কাশীবাসের কথা মনে পড়ে না! হালদার-ঠাকুরপোর বেয়ানের তাঁতী অপবাদ ছিল না? সে-সব বড়লোকের বড় কথা বুঝি?
গোবিন্দ। তবে রে হারামজাদা মাগী—
ক্ষান্ত। (অগ্রসর হইয়া) মারবি নাকি রে? ক্ষেন্তি বামনীকে ঘাঁটালে ঠগ বাছতে গাঁ উজোড় হয়ে যাবে। বলি, এতেই হবে, না আরও বলবো?
[ভৈরব আচার্য দ্রুতপদে প্রবেশ করিয়া]