- বইয়ের নামঃ ষোড়শী
- লেখকের নামঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মুঠোবই
- বিভাগসমূহঃ নাটকের বই
ষোড়শী – ১.১
নাট্যোল্লিখিত ব্যক্তিগণ
পুরুষ
জীবানন্দ চৌধুরী: চণ্ডীগড়ের জমিদার
প্রফুল্ল রায়: জীবানন্দের সেক্রেটারি
এককড়ি নন্দী: ঐ গোমস্তা
জনার্দন রায়: মহাজন
নির্মল বসু: ঐ জামাতা ও ব্যারিস্টার
শিরোমণি: ব্রাহ্মণ পণ্ডিত
তারাদাস চক্রবর্তী: ষোড়শীর পিতা
সাগর সর্দার: ষোড়শীর অনুচর
পূজারী, ম্যাজিস্ট্রেট, ইন্স্পেক্টার, সাব-ইন্স্পেক্টার, বল্লভ ডাক্তার, ফকির, হরিহর, বিশ্বম্ভর, ভিক্ষুকদ্বয়, মহাবীর, বেহারা, ভৃত্য, পথিক, গাড়োয়ান, পাইকগণ ইত্যাদি।
স্ত্রী
ষোড়শী: গড়চণ্ডীর ভৈরবী
হৈমবতী: জনার্দনের কন্যা ও নির্মলের স্ত্রী
ভিক্ষুক-কন্যা, নারীগণ ইত্যাদি।
প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
চণ্ডীগড়—গ্রাম্যপথ
[বেলা অপরাহ্নপ্রায়। চণ্ডীগড়ের সঙ্কীর্ণ গ্রাম্যপথের পরে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া নামিয়া আসিতেছে। অদূরে বীজগাঁ’র জমিদারী কাছারিবাটীর ফটকের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে। জন-দুই পথিক দ্রুতপদে চলিয়া গেল, তাঁহাদেরই পিছনে একজন কৃষক মাঠের কর্ম শেষ করিয়া গৃহে ফিরিতেছিল, তাহার বাঁ-কাঁধে লাঙ্গল, ডান হাতে ছড়ি, অগ্রবর্তী অদৃশ্য বলদযুগলের উদ্দেশে হাঁকিয়া বলিতে বলিতে গেল, “ধলা, সিধে চ’ বাবা, সিধে চল! কেলো, আবার আবার! আবার পরের গাছপালায় মুখ দেয়!”
কাছারির গোমস্তা এককড়ি নন্দী ধীরে ধীরে প্রবেশ করিল এবং উৎকণ্ঠিত শঙ্কায় পথের একদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় গলা বাড়াইয়া কিছু একটা দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। তাহার পিছনের পথ দিয়া দ্রুতপথে বিশ্বম্ভর প্রবেশ করিল। সে কাছারির বড় পিয়াদা, তাগাদায় গিয়াছিল, অকস্মাৎ সংবাদ পাইয়াছে বীরগাঁ’র নবীন জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী চণ্ডীগড়ে আসিতেছেন। ক্রোশ-দুই দূরে তাঁহার পালকি নামাইয়া বাহকেরা ক্ষণকালের জন্য বিশ্রাম লইতেছিল, আসিয়া পড়িল বলিয়া]
বিশ্বম্ভর। নন্দীমশাই, দাঁড়িয়ে করতেছ কি? হুজুর আসছেন যে!
এককড়ি। (চমকিয়া মুখ ফিরাইল। এ দুঃসংবাদ ঘণ্টা-খানেক পূর্বে তাহার কানে পৌঁছিয়াছে। উদাস-কণ্ঠে কহিল) হুঁ।
বিশ্বম্ভর। হুঁ কি গো? স্বয়ং হুজুর আসছেন যে!
এককড়ি। (বিকৃত-স্বরে) আসছেন ত আমি করব কি? খবর নেই, এত্তালা নেই—হুজুর আসছেন। হুজুর বলে ত আর মাথা কেটে নিতে পারবে না!
বিশ্বম্ভর। (এই আকস্মিক উত্তেজনার অর্থ উপলব্ধি না করিতে পারিয়া একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া শুধু কহিল) আরে, তুমি কি মরিয়া হয়ে গেলে নাকি?
এককড়ি। মরিয়া কিসের! মামার বিষয় পেয়েছে বৈ ত কেউ আর বাপের বিষয় বলবে না! তুই জানিস বিশু, কালীমোহনবাবু ওকে দূর করে দিয়েছিল, বাড়ি ঢুকতে পর্যন্ত দিত না। তেজ্যপুত্তুরের সমস্ত ঠিকঠাক, হঠাৎ খামকা মরে গেল বলেই ত জমিদার! নইলে থাকতেন আজ কোথায়? আমি জানি নে কি?
বিশ্বম্ভর। কিন্তু জেনে সুবিধেটা কি হচ্চে শুনি? এ মামা নয়, ভাগ্নে। ও-কথা ঘুণাগ্রে কানে গেলে ভিটেয় তোমার সন্ধ্যে দিতেও কাউকে বাকি রাখবে না। ধরবে আর দুম করে গুলি করে মারবে। এমন কত গণ্ডা এরই মধ্যে মেরে পুঁতে ফেলেছে জানো? ভয়ে কেউ কথাটি পর্যন্ত কয় না।
এককড়ি। হাঁ:—কথা কয় না! মগের মুল্লুক কিনা!
বিশ্বম্ভর। আরে মাতাল যে! তার কি হুঁশ পবন আছে, না দয়া-মায়া আছে! বন্দুক-পিস্তল-ছুরি-ছোরা ছাড়া এক পা কোথাও ফেলে না। মেরে ফেললে তখন করবে কি শুনি?
এককড়ি। তুই ত সেদিন সদরে গিয়েছিলি—দেখেচিস তাকে?
বিশ্বম্ভর। না, ঠিক দেখিনি বটে, তবে সে দেখাই। ইয়া গালপাট্টা, ইয়া গোঁফ, ইয়া বুকের ছাতি, জবাফুলের মত চোখ ভাঁটার মত বন্বন্ করে ঘুরচে—
এককড়ি। বিশু, তবে পালাই চ’।
বিশ্বম্ভর। আরে পালিয়ে ক’দিন তার কাছে বাঁচবে নন্দীমশাই? চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে এনে খাল খুঁড়ে পুঁতে ফেলবে।
এককড়ি। কি তবে হবে বল? মাতালটা যদি বলে বসে শান্তিকুঞ্জেই থাকব?
বিশ্বম্ভর। কতবার ত বলেছি নন্দীমশাই, এ কাজ করো না, করো না, করো না। বছরের পর বছর খাতায় কেবল শান্তিকুঞ্জের মিথ্যে মেরামতি খরচই লিখে গেলে, গরীবের কথায় ত আর কান দিলে না।
এককড়ি। তুইও ত কাছারির বড় সর্দার, তুইও ত—
বিশ্বম্ভর। দেখ, ও-সব শয়তানি ফন্দি করো না বলচি! আমার ওপর দোষ চাপিয়েছ কি—ওগো, ওই যে একটা পালকি দেখা যায়! [নেপথ্যে বাহকদিগের কণ্ঠধ্বনি শুনা গেল। বিশ্বম্ভর পলায়নোদ্যত এককড়ির হাতটা ধরিয়া ফেলিতেই সে নিজেকে মুক্ত করিবার চেষ্টা করিতে করিতে]
এককড়ি। ছাড়্না হারামজাদা।
বিশ্বম্ভর। (অনুচ্চ চাপাকণ্ঠে) পালাচ্চো কোথায়? ধরলে গুলি করে মারবে যে!
[এমনি সময় পালকি সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইতে উভয়ে স্থির হইয়া দাঁড়াইল। পালকির অভ্যন্তরে জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী বসিয়াছিলেন, তিনি ঈষৎ একটুখানি মুখ বাহির করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন]
জীবানন্দ। ওহে, এ গ্রামে জমিদারের কাছারি বাড়িটা কোথায় তোমরা কেউ বলে দিতে পার?
এককড়ি। (করজোড়ে) সমস্তই ত হুজুরের রাজ্য।
জীবানন্দ। রাজ্যের খবর জানতে চাইনি। কাছারিটার খবর জানো?
এককড়ি। জানি হুজুর। ওই যে।
জীবানন্দ। তুমি কে?
[এককড়ি ও বিশ্বম্ভর উভয়ে হাঁটু গাড়িয়া ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল]
এককড়ি। হুজুরের নফর এককড়ি নন্দী।
জীবানন্দ। ওহো, তুমিই এককড়ি—চণ্ডীগড়-সাম্রাজ্যের বড়কর্তা? কিন্তু দেখ এককড়ি, একটা কথা বলে রাখি তোমাকে। চাটুবাক্য অপছন্দ করিনে সত্যি, কিন্তু তার একটা কাণ্ডজ্ঞান থাকাটাও পছন্দ করি! এটা ভুলো না। তোমার কাছারির তসিল কত?
এককড়ি। আজ্ঞে, চণ্ডীগড় তালুকের আয় প্রায় হাজার-পাঁচেক টাকা।
জীবানন্দ। হাজার-পাঁচেক?—বেশ।
[বাহকেরা পালকি নীচে নামাইল। জীবানন্দ অবতরণ করিলেন না, শুধু পা-দুটা বাহির করিয়া ভূমিতলে রাখিয়া সোজা হইয়া বসিয়া কহিলেন]
বেশ। আমি এখানে দিন পাঁচ-ছয় আছি, কিন্তু এরই মধ্যে আমার হাজার-দশেক টাকা চাই এককড়ি। তুমি সমস্ত প্রজাদের খবর দাও যেন কাল তারা এসে কাছারিতে হাজির হয়।
এককড়ি। যে আজ্ঞে। হুজুরের আদেশে কেউ গরহাজির থাকবে না।
জীবানন্দ। এ গাঁয়ে দুষ্টু বজ্জাত প্রজা কেউ আছে জানো?
এককড়ি। আজ্ঞে, না তা এমন কেউ—শুধু তারাদাস চক্কোত্তি—তা সে আবার হুজুরের প্রজা নয়।
জীবানন্দ। তারাদাসটা কে?
এককড়ি। গড়চণ্ডীর সেবায়েত।
জীবানন্দ। এই লোকটাই কি বছর-দুই পূর্বে একটা প্রজা-উৎখাতের মামলায় মামার বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছিল?
এককড়ি। (মাথা নাড়িয়া) হুজুরের নজর থেকে কিছুই এড়ায় না। আজ্ঞে, এই সেই তারাদাস।
জীবানন্দ। হুঁ। সেবার অনেক টাকার ফেরে ফেলে দিয়েছিল। এ কতখানি জমি ভোগ করে?
এককড়ি। (মনে মনে হিসাব করিয়া) ষাট-সত্তর বিঘের কম নয়।
জীবানন্দ। একে তুমি আজই কাছারিতে ডেকে আনিয়ে জানিয়ে দাও যে, বিঘেপ্রতি আমার দশ টাকা নজর চাই।
এককড়ি। (সঙ্কুচিত হইয়া) আজ্ঞে, সে যে নিষ্কর দেবোত্তর, হুজুর।
জীবানন্দ। না, দেবোত্তর এ গাঁয়ে একফোঁটা নেই। সেলামি না পেলে সমস্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।
এককড়ি। আজই তাকে হুকুম জানাচ্ছি।
জীবানন্দ। শুধু হুকুম জানানো নয়, টাকা তাকে দু’দিনের মধ্যে দিতে হবে।
এককড়ি। কিন্তু হুজুর—
জীবানন্দ। কিন্তু থাক এককড়ি। এই সোজা বারুইয়ের তীরে আমার শান্তিকুঞ্জ, না? —মহাবীর, পালকি তুলতে বল।
[বাহকেরা পালকি লইয়া প্রস্থান করিল
এককড়ি। যা ভেবেচি তাই যে ঘটল রে বিশু! এ যে গিয়ে সোজা শান্তিকুঞ্জেই ঢুকতে চায়।
বিশ্বম্ভর। নয় ত কি তোমার কাছারির খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকতে চাইবে?
এককড়ি। সেখানে হয়ত ঢোকবার পথ নেই। হয়ত দোর-জানালা সব চোরে চুরি করে নিয়ে গেছে, হয়ত বা ঘরে ঘরে বাঘ-ভালুকে বসবাস করে আছে—সেখানে কি যে আছে আর কি যে নেই, কিছুই যে জানিনে বিশ্বম্ভর।
বিশ্বম্ভর। আমি কি জানি নাকি তোমার দোর-জানালার খবর? আর বাঘ-ভালুকের কাছে ত আমি খাজনা আদায়ে যাইনি গো!
এককড়ি। এই রাত্তিরে কোথায় আলো, কোথায় লোকজন, কোথায় খাবার-দাবার—
বিশ্বম্ভর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদলে লোকজন জুটতে পারে, কিন্তু আলো আর খাবার-দাবার—
এককড়ি। তোর কি! তুই ত বলবিই রে নচ্ছার পাজী ব্যাটা হারামজাদা—
[প্রস্থান
ষোড়শী – ১.২
দ্বিতীয় দৃশ্য
শান্তিকুঞ্জ
[বারুই নদীতীরে বীজগাঁ’র জমিদার ৺রাধামোহনের নির্মিত বিলাসভবন ‘শান্তিকুঞ্জ’। সংস্কারের অভাবে আজ তাহা জীর্ণ, শ্রীহীন, ভগ্নপ্রায়। তাহারই একটা কক্ষে তক্তপোশের উপর বিছানা, বিছানায় চাদরের অভাবে একটা বহুমূল্য শাল পাতা; শিয়রের দিকে একটা গোল টেবিল, তাহাতে মোটা বাঁধানো একখানা বইয়ের উপর আধপোড়া একটা মোমবাতি। তাহারই পাশে একটা পিস্তল। হাতের কাছে একটা টুল, তাহাতে সোডার বোতল, সুরাপূর্ণ গ্লাস ও মদের বোতল। বোতলটা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। পার্শ্বে দামী একটা সোনার ঘড়ি—ঘড়িটা ছাইয়ের আধারস্বরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে—আধপোড়া একটা চুরুট হইতে তখনও ধূমের রেখা উঠিতেছে। সম্মুখের দেওয়ালে গোটা-দুই নেপালী কুকরী টাঙ্গানো, কোণে একটা বন্দুক ঠেস দিয়া রাখা, তাহারই অদূরে মেঝের উপর একটা শৃগালের মৃতদেহ হইতে রক্তের ধারা বহিয়া শুকাইয়া গিয়াছে। ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কয়েকটা শূন্য মদের বোতল; একটা ডিসে উচ্ছিষ্ট ভুক্তাবশেষ তখনও পরিষ্কৃত হয় নাই, সন্নিকটে একখানা দামী ঢাকাই চাদরে হাত মুছিয়া ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে—সেটা মেঝেতে লুটাইতেছে। জীবানন্দ চৌধুরী বিছানায় আড় হইয়া পড়িয়া। পায়ের দিকের জানালাটা ভাঙ্গা, তাহার ফাঁক দিয়া বাহিরের একটা গাছের ডালের খানিকটা ভিতরে ঢুকিয়াছে। দুইদিকে দুইটি দরজা—দরজা ঠেলিয়া জীবানন্দের সেক্রেটারি প্রফুল্ল প্রবেশ করিল]
প্রফুল্ল। সেই লোকটা এখানেও এসেছিল দাদা।
জীবানন্দ। কে বল ত?
প্রফুল্ল। সেই মাদ্রাজী সাহেবের কর্মচারী, যিনি আখের চাষ আর চিনির কারখানার জন্যে সমস্ত দক্ষিণের মাঠটা কিনতে চান। সত্যই কি ওটা বিক্রি করে দেবেন?
জীবানন্দ। নিশ্চয়। আমার এখন ভয়ানক টাকার দরকার।
প্রফুল্ল। কিন্তু অনেক প্রজার সর্বনাশ হবে।
জীবানন্দ। তা হবে, কিন্তু আমার সর্বনাশটা বাঁচবে।
প্রফুল্ল। আর একটি লোক বাইরে বসে আছেন, তাঁর নাম জনার্দন রায়। আসতে বলব?
জীবানন্দ। না ভায়া, এখন থাক। সাধু-সন্দর্শন যখন-তখন করতে নেই—শাস্ত্রের নিষেধ আছে।
প্রফুল্ল। (হাসিয়া) লোকটা শুনেছি খুব ধনী।
জীবানন্দ। শুধু ধনী নয়, গুণী। চিঠা, খত, তমসুক, দলিল, যথা-ইচ্ছা ইনি প্রস্তুত করে দিতে পারেন—নকল নয়, অনুকরণ নয়, একেবারে অভিনব, অপূর্ব, যাকে বলে সৃষ্টি। মহাপুরুষ ব্যক্তি।
প্রফুল্ল। এ-সব লোককে প্রশ্রয় দেবেন না দাদা।
জীবানন্দ। তার প্রয়োজন নেই প্রফুল্ল, ইনি নিজের প্রতিভায় যে উচ্চে বিচরণ করেন, আমার প্রশ্রয় সেখানে নাগাল পাবে না।
প্রফুল্ল। শুনলাম সমস্ত মাঠটা আপনার একার নয়, দাদা। এ সম্বন্ধে—
জীবানন্দ। না। প্রফুল্ল, এ সম্বন্ধে তোমাকে আমি কথা কইতে দেব না। দেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে আছি, এর পরে তোমার সৎ-অসতের ভূত ঘাড়ে চাপলে আর রসাতলে তলিয়ে যাবার দেরি হবে না।
[একপাত্র মদ পান করিয়া]
জীবানন্দ। তুমি ভাবচ রসাতলের দেরিই বা কত? দেরি নেই সে আমি জানি। আরও একটা কথা তোমার চেয়ে বেশি জানি প্রফুল্ল, এর কূল-কিনারাও নেই।
[প্রফুল্ল নিঃশব্দে মুখ তুলিয়া চাহিল]
জীবানন্দ। ওই তোমার মস্ত দোষ প্রফুল্ল, শেষ হওয়া জিনিসটাও নিঃশেষ হচ্ছে শুনলে তোমার চোখ ছলছল করে আসে। যাও ত ভায়া, এককড়িকে পাঠিয়ে দাও ত। আর দেখ, তোমাকে একবার সদরে গিয়ে মাদ্রাজী সাহেবের সঙ্গে পাকা কথা কইতে হবে। বুঝলে?
প্রফুল্ল। (মাথা নাড়িয়া) তা হলে এখনো ত বেলা আছে। আজই ত যেতে পারি। সাহেবের সঙ্গে গাড়ি আছে।
জীবানন্দ। বেশ, তা হলে এঁর গাড়িতেই যাও।
[প্রফুল্লর প্রস্থান ও এককড়ির প্রবেশ]
জীবানন্দ। টাকা আদায় হচ্চে এককড়ি?
এককড়ি। হচ্চে হুজুর।
জীবানন্দ। তারাদাস টাকা দিলে?
এককড়ি। সহজে দিতে চায়নি। শেষে কান ধরে ঘোড়দৌড়, ব্যাঙের নাচ নাচাবার প্রস্তাব করতেই দিতে রাজি হয়ে বাড়ি গেছে। আজ দেবার কথা ছিল।
জীবানন্দ। তার পরে?
এককড়ি। মহাবীর সিংকে সঙ্গে দিয়ে হুজুরের পালকি বেহারাদের পাঠিয়েছি তাকে ধরে আনতে।
জীবানন্দ। (মদ্যপান করিয়া) ঠিক হয়েছে। তোমাদের এখানে বোধ করি বিলিতি মদের দোকান নেই। তা না থাক, যা আমার সঙ্গে আছে তাতেই এ ক’টা দিন চলে যাবে। কিন্তু আরও একটা কথা আছে এককড়ি।
এককড়ি। আজ্ঞে করুন।
জীবানন্দ। দেখ এককড়ি, আমি বিবাহ—হাঁ—বিবাহ আমি করিনি—বোধ হয় কখনো করবও না। (একটু পরে) কিন্তু তাই বলে আমি ভীষ্মদেব—বলি মহাভারত পড়েচ ত? তার ভীষ্মদেব সেজেও বসিনি—শুকদেব হয়েও উঠিনি—বলি কথাটা বুঝলে ত এককড়ি? ওটা চাই।
[এককড়ি লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া একটুখানি ঘাড় নাড়িল]
জীবানন্দ। অপর সকলের মত যাকে-তাকে দিয়ে এ-সব কথা বলাতে আমি ভালোবাসি নে, তাতে ঠকতে হয়। আচ্ছা এখন যাও।
এককড়ি। আমি তারাদাসকে দেখি গে। সে এর মধ্যে প্রজা বিগড়ে না দেয়। (যাইতেছিল)
জীবানন্দ। প্রজা বিগড়ে দেবে? আমি উপস্থিত থাকতে?
এককড়ি। হুজুর, পারে ওরা।
জীবানন্দ। তারাদাসকেই ত জানি, আবার ‘ওরা’ এল কারা?
এককড়ি। চক্কোত্তির মেয়ে ভৈরবী। নইলে চক্কোত্তিমশাই নিজে তত লোক মন্দ নয়, কিন্তু মেয়েটাই হচ্চে আসল সর্বনাশী। দেশের যত বোম্বেটে বদমাশগুলো হয়েছে যেন একেবারে তার গোলাম।
জীবানন্দ। বটে! কত বয়স? দেখতে কেমন?
[ঘরের মধ্যে ক্রমশঃ সন্ধ্যার আবছায়া ঘনাইয়া আসিতে লাগিল]
এককড়ি। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হতে পারে। আর রূপের কথা যদি বলেন হুজুর ত সে যেন এক কাটখোট্টা সিপাই! না আছে মেয়েলি ছিরি, না আছে মেয়েলি ছাঁদ। যেন চূয়াড়, যেন হাতিয়ার বেঁধে লড়াই করতে চলেছে। তাতেই ত দেশের ছোটলোকগুলো মনে করে গড়ের উনিই হচ্চেন সাক্ষাৎ চণ্ডী।
জীবানন্দ। (উৎসাহ ও কৌতূহলে সোজা উঠিয়া বসিয়া) বল কি এককড়ি? ভৈরবীর ব্যাপারটা কি খুলে বল ত শুনি?
এককড়ি। ভৈরবী ত কারু নাম নয় হুজুর। গড়চণ্ডীর প্রধান সেবিকাদের ওই হলো উপাধি। বর্তমান ভৈরবীর নাম ষোড়শী, এর আগে যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল মাতঙ্গিনী। মার আদেশে তাঁর সেবায়েত কখনো পুরুষ হতে পারে না, চিরদিন মেয়েরাই হয়ে আসছে।
জীবানন্দ। তাই নাকি? এ ত কখনো শুনিনি।
এককড়ি। মায়ের আদেশে বিয়ের তেরাত্রি পরে স্বামীকে আর ভৈরবীর স্পর্শ করবারও জো নেই। তাই দূরদেশ থেকে দুঃখী গরীবদের একটা ছেলে ধরে এনে বিয়ে দিয়ে পরের দিনই টাকাকড়ি দিয়ে সেই যে বিদায় করা হয়, আর কখনো কেউ তার ছায়াও দেখতে পায় না। এই নিয়ম, এই-ই চিরকাল ধরে হয়ে আসচে।
জীবানন্দ। (সহাস্যে) বল কি এককড়ি, একেবারে দেশান্তর? ভৈরবী মানুষ, রাত্রে নিরিবিলি একপাত্র সুধা ঢেলে দেওয়া—গরমমশলা দিয়ে চারটি মহাপ্রসাদ রেঁধে খাওয়ানো—একেবারে কিছুই করতে পায় না?
এককড়ি। (মাথা নাড়িয়া) না হুজুর, মায়ের ভৈরবীকে স্বামী স্পর্শ করতে নেই, কিন্তু তাই বলে কি স্বামী ছাড়া গাঁয়ে আর পুরুষ নেই? মাতু ভৈরবীকেও দেখেচি, ষোড়শী ভৈরবীকেও দেখছি। লোকগুলো কি আর খামকা—তার সাক্ষী দেখুন না—কথায় কথায় হুজুরের সঙ্গে মামলা-মকর্দমা বাধিয়ে দেয়!
জীবানন্দ। মেয়ে-মোহন্ত আর কি! তাতে দোষ নেই। এককড়ি আলোটা জ্বালো ত।
এক কড়ি। (আলো জ্বালিয়া) এখন আসি হুজুর।
জীবানন্দ। আচ্ছা যাও। বইখানা দিয়ে যাও ত।
[বই দিয়া প্রণাম করিয়া এককড়ি প্রস্থান করিল
[জীবানন্দ শুইয়া পুস্তকে মনোনিবেশ করিলেন। একটু পরে বাহিরে কাহার পায়ের শব্দ হইল।]
জীবানন্দ। কে?
সর্দার। (ষোড়শীকে লইয়া প্রবেশ করিয়া কহিল) শালা তারাদাস ভাগ্ গিয়া। হুজুর, উস্কো বেটীকো পাকড় লায়া।
জীবানন্দ। (বই ফেলিয়া ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বিস্মিতভাবে) কাকে? ভৈরবীকে? (কিছুক্ষণ পরে) ঠিক হয়েছে। আচ্ছা যা।
[সর্দার অনুচর পাইকদের লইয়া প্রস্থান করিল
জীবানন্দ। তোমাদের আজ টাকা দেবার কথা। টাকা এনেচ? (ষোড়শীর কণ্ঠস্বর ফুটিল না) আনো নি জানি। কিন্তু কেন?
ষোড়শী। আমাদের নেই।
জীবানন্দ। না থাকলে সমস্ত রাত্রি তোমাকে পাইকদের ঘরে আটকে থাকতে হবে। তার মানে জানো।
[ষোড়শী দ্বারের চৌকাঠটা দুই হাতে সবলে চাপিয়া ধরিয়া চোখ বুজিয়া মূর্ছা হইতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতে লাগিল; এই ভয়ানক বিবর্ণ মুখের চেহারা জীবানন্দের চোখে পড়িল, মিনিট-খানেক সে কেমন যেন আচ্ছন্নের ন্যায় বসিয়া রহিল। তারপরে বাতির আলোটা হঠাৎ হাতে তুলিয়া লইয়া ষোড়শীর কাছে গেল। আলোটা তাহার মুখের সম্মুখে ধরিয়া একদৃষ্টে ষোড়শীর গৈরিক বস্ত্র, তাহার এলায়িত রুক্ষ কেশভার, তাহার পাণ্ডুর ওষ্ঠাধর, তাহার সবল সুস্থ ঋজু দেহ, সমস্তই সে যেন দুই বিস্ফারিত চক্ষু দিয়া নিঃশব্দে গিলিতে লাগিল। এই ভাবে কিছুক্ষণ কাটিয়া গেলে পর]
জীবানন্দ। (ফিরিয়া গিয়া আলোটা রাখিয়া দিয়া মদের বোতল হইতে কয়েক পাত্র উপর্যুপরি পান করিয়া) তোমার নাম ষোড়শী, না? (ষোড়শী নীরব) তোমার বয়স কত? (কোন উত্তর না পাইয়া কঠিন-স্বরে) চুপ করে থেকে বিশেষ কোন লাভ হবে না, জবাব দাও।
ষোড়শী। (মৃদু-স্বরে) আমার বয়স আটাশ।
জীবানন্দ। বেশ। তা হলে খবর যদি সত্যি হয় ত, এই উনিশ-কুড়ি বৎসর ধরে তুমি ভৈরবীগিরি করচ; খুব সম্ভব অনেক টাকা জমিয়েছ। দিতে পারবে না কেন?
ষোড়শী। আপনাকে আগেই ত জানিয়েছি আমার টাকা নেই।
জীবানন্দ। না থাকলে আরও দশজনে যা করছে তাই কর। যাদের টাকা আছে তাদের কাছে জমি বাঁধা দিয়ে হোক, বিক্রি করে হোক দাও গে।
ষোড়শী। তারা পারে, জমি তাদের। কিন্তু দেবতার সম্পত্তি বাঁধা দেবার, বিক্রি করবার ত আমার অধিকার নেই।
জীবানন্দ। (হঠাৎ হাসিয়া) নেবার অধিকার কি ছাই আমারই আছে? এক কপর্দকও না। তবুও নিচ্চি, কেন না আমার চাই। এই চাওয়াটাই হচ্ছে সংসারের খাঁটি অধিকার, তোমারও যখন দেওয়া চাই-ই, তখন—বুঝলে? (কিছু পরে) যাক, এত রাত্রে কি একা বাড়ি যেতে পারবে? যাদের সঙ্গে তুমি এসেছিলে তাদের আর সঙ্গে দিতে চাইনে।
ষোড়শী। (সবিনয়ে) আপনার হুকুম হলেই যেতে পারি।
জীবানন্দ। (সবিস্ময়ে) একলা? এই অন্ধকার রাত্রে? ভারি কষ্ট হবে যে! (হাসিতে লাগিল)
ষোড়শী। না, আমাকে এখুনি যেতেই হবে।
জীবানন্দ। (সহাস্যে) বেশ ত, টাকা না হয় নাই দেবে ষোড়শী। তা ছাড়া আরো অনেক রকমের সুবিধে—
ষোড়শী। আপনার টাকা, আপনার সুবিধা আপনারই থাক, আমাকে যেতে দিন।
[কয়েক পা অগ্রসর হইয়া সেই পাইকদের সম্মুখে কিছুদূরে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া আপনিই থমকিয়া দাঁড়াইল]
জীবানন্দ। (মুখ অন্ধকার করিয়া কঠিন-স্বরে) তুমি মদ খাও?
ষোড়শী। না।
জীবানন্দ। তোমার কয়েকজন পুরুষ বন্ধু আছে শুনেছি। সত্যি?
ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না, মিছে কথা।
জীবানন্দ। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) তোমার পূর্বেকার সকল ভৈরবীই মদ খেতেন—সত্যি? মাতঙ্গী ভৈরবীর চরিত্র ভাল ছিল না—এখনো তার সাক্ষী আছে। সত্যি, না মিছে?
ষোড়শী। (লজ্জিত মৃদুকণ্ঠে) সত্যি বলেই শুনেছি।
জীবানন্দ। শুনেছ? ভালো। তবে হঠাৎ তুমিই বা এমন দলছাড়া, গোত্রছাড়া ভাল হতে গেলে কেন? (হঠাৎ সোজা উঠিয়া বসিয়া পুরুষ-কণ্ঠস্বরে) মেয়েমানুষের সঙ্গে তর্কও আমি করিনে, তাদের মতামতও কখনো জানতে চাইনে। তুমি ভাল কি মন্দ, চুল-চিরে তার বিচার করবারও আমার সময় নেই। আমি বলি, চণ্ডীগড়ের সাবেক ভৈরবীদের যেভাবে কেটেছে তোমারও তেমনিভাবে কেটে গেলেই যথেষ্ট। আজ তুমি এই বাড়িতেই থাকবে।
[হুকুম শুনিয়া ষোড়শী বজ্রাহতের ন্যায় একেবারে কাঠ হইয়া গেল]
জীবানন্দ। তোমার সম্বন্ধে কি করে যে এতটা সহ্য করেচি জানিনে; আর কেউ এ বেয়াদপি করলে এতক্ষণ তাকে পাইকদের ঘরে পাঠিয়ে দিতুম। এমন অনেককে দিয়েচি।
ষোড়শী। (অকস্মাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া, গলায় আঁচল দিয়া করজোড়ে) আমার যা-কিছু আছে সব নিয়ে আজ আমাকে ছেড়ে দিন।
জীবানন্দ। কেন বল ত? এরকম কান্নাও নতুন নয়, এরকম ভিক্ষেও এই নতুন শুনচি নে! কিন্তু তাদের সব স্বামী-পুত্র ছিল—কতকটা না হয় বুঝতেও পারি। (ষোড়শী শিহরিয়া উঠিয়া) কিন্তু তোমার ত সে বালাই নেই। পনের-ষোল বছরের মধ্যে তোমার স্বামীকে তুমি ত চোখেও দেখনি। তা ছাড়া তোমাদের ত এতে দোষই নেই।
ষোড়শী। (করজোড়ে অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে) স্বামীকে আমার ভালো মনে নেই সত্যি, কিন্তু তিনি ত আছেন! যথার্থ বলচি আপনাকে, কখনো কোন অন্যায়ই আমি আজ পর্যন্ত করিনি। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন—
জীবানন্দ। (হাঁক দিয়া) মহাবীর—
ষোড়শী। (আতঙ্কে কাঁদিয়া) আমাকে আপনি মেরে ফেলতে পারবেন, কিন্তু—
জীবানন্দ। আচ্ছা, ও বাহাদুরি কর গে ওদের ঘরে গিয়ে। মহাবীর—
ষোড়শী। (মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া) কারও সাধ্য নেই আমার প্রাণ থাকতে নিয়ে যেতে পারে। আমার যা কিছু দুর্দশা—যত অত্যাচার আপনার সামনেই হোক—আপনি আজও ব্রাহ্মণ, আপনি আজও ভদ্রলোক!
জীবানন্দ। (কঠিন নিষ্ঠুর হাস্য করিল) তোমার কথাগুলো শুনতে মন্দ নয়, কিন্তু কান্না দেখে আমার দয়া হয় না। আমি অনেক শুনি। মেয়েমানুষের উপর আমার এতটুকু লোভ নেই—ভাল না লাগলেই চাকরদের দিয়ে দিই। তোমাকেও দিয়ে দিতুম, শুধু এই বোধ হয় আজ প্রথম একটু মোহ জন্মেছে। ঠিক জানিনে—নেশা না কাটলে ঠাওর পাচ্ছিনে।
মহাবীর। (দ্বারপ্রান্তে আসিয়া) হুজুর!
জীবানন্দ। (সম্মুখের কবাটটায় অঙ্গুলি-নির্দেশ করিয়া) একে আজ রাত্রের মত ও-ঘরে বন্ধ করে রেখে দে। কাল আবার দেখা যাবে।
ষোড়শী। (গলদশ্রুলোচনে) আমার সর্বনাশটা একবার ভেবে দেখুন হুজুর! কাল যে আমি আর মুখ দেখাতে পারব না।
জীবানন্দ। দু’একদিন! তার পরে পারবে। সেই লিভারের ব্যথাটা আজ সকাল থেকেই টের পাচ্ছিলাম। এখন হঠাৎ ভারী বেড়ে উঠল—আর বেশী বিরক্ত করো না—যাও—
মহাবীর। (তাড়া দিয়া) আরে, উঠ্না মাগী—চোল্!
জীবানন্দ। (ভয়ানক ধমক দিয়া) খবরদার, শুয়োরের বাচ্ছা, ভালো করে কথা বল্! ফের যদি কখনো আমার হুকুম ছাড়া কোন মেয়েমানুষকে ধরে আনিস ত গুলি করে মেরে ফেলব। (মাথার বালিশটা পেটের কাছে টানিয়া লইয়া উপুড় হইয়া শুইয়া যাতনায় অস্ফুট আর্তনাদ করিয়া) আজকের মত ও-ঘরে বন্ধ থাকো, কাল তোমার সতীপনার বোঝাপড়া হবে। আঃ—এই, যা’না আমার সুমুখ থেকে একে সরিয়ে নিয়ে।
মহাবীর। (আস্তে আস্তে বলিল) চলিয়ে—
[ষোড়শী নির্দেশমত নিরুত্তরে পাশের অন্ধকার ঘরে যাইতেছিল]
জীবানন্দ। ষোড়শী, একটু দাঁড়াও, প্রফুল্ল নেই, সে সদরে গেছে—তুমি পড়তে জানো, না?
ষোড়শী। জানি।
জীবানন্দ। তা হলে একটু কাজ করে যাও। ওই যে বাক্সটা, ওর মধ্যে আর একটা কাগজের বাক্স পাবে। কয়েকটা ছোট-বড় শিশি আছে, যার গায়ে বাঙলায় ‘মরফিয়া’ লেখা তার থেকে একটুখানি ঘুমের ওষুধ দিয়ে যাও। কিন্তু খুব সাবধান, এ ভয়ানক বিষ। মহাবীর, আলোটা ধর।
[মহাবীর আলো ধরিল]
ষোড়শী। (বাতির আলোকে কম্পিত-হস্তে শিশিটা বাহির করিয়া) কতটুকু দিতে হবে?
জীবানন্দ। (তীব্র বেদনায় অব্যক্ত ধ্বনি করিয়া) ঐ ত বললুম খুব একটুখানি। আমি উঠতেও পারচি নে, আমার হাতেরও ঠিক নেই, চোখেরও ঠিক নেই। ওতেই একটা কাঁচের ঝিনুক আছে, তার অর্ধেকেরও কম। একটু বেশি হয়ে গেলে এ ঘুম তোমার চণ্ডীর বাবা এসেও ভাঙ্গাতে পারবে না।
[পরিমাণ স্থির করিতে ষোড়শীর হাত কাঁপিতে লাগিল, অবশেষে অনেক যত্নে অনেক সাবধানে নির্দেশমত ঔষধ লইয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল]
জীবানন্দ। (হাত বাড়াইয়া সেই বিষ লইয়া চোখ বুজিয়া মুখে ফেলিয়া দিল) খুব কমই দিয়েচ—ফল হবে না হয়ত। আচ্ছা এই থাক।
[ষোড়শী পাশের ঘরে পা বাড়াইয়াছে, এমন সময় এককড়ি নিতান্ত ব্যস্ত ও ব্যাকুলভাবে প্রবেশ করিয়া ও এদিক-ওদিক চাহিয়া জীবানন্দের কানের কাছে চুপি চুপি কি বলিতে লাগিল। জীবানন্দের মুখের ভাবে বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেল। ষোড়শী দ্বারপ্রান্তে স্তম্ভিতের মত দাঁড়াইয়া রহিল]
জীবানন্দ। (হাত নাড়িয়া ষোড়শীকে) তোমার ভয় নেই, কাছে এসো, (ষোড়শী আসিলে) পুলিশের লোক বাড়ি ঘিরে ফেলেছে—ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব গেটের মধ্যে ঢুকেছেন—এলেন বলে। (ষোড়শী চমকিয়া উঠিল) জেলার ম্যাজিস্ট্রেট টুরে বেরিয়ে ক্রোশ-খানেক দূরে তাঁবু ফেলেছিলেন, তোমার বাবা এই রাত্রেই তাঁর কাছে গিয়ে সমস্ত জানিয়েছেন। কেবল তাতেই এতটা হতো না, কে-সাহেবের নিজেরই আমার উপর ভারী রাগ। গত বৎসর দু’বার ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি—আজ একেবারে হাতে হাতে ধরে ফেলেচে—(একটু হাসিল)
এককড়ি। (মুখ চুন করিয়া) হুজুর, এবার বোধ হয় আমাদেরও আর রক্ষা নেই।
জীবানন্দ। সম্ভব বটে। (ষোড়শীকে) শোধ নিতে চাও ত এই-ই সময়। আমাকে জেলে দিতেও পার।
ষোড়শী। এতে জেল হবে কেন?
জীবানন্দ। আইন। তা ছাড়া, কে-সাহেবের হাতে পড়েচি। বাদুড়বাগানের মেসে থাকতে এরই কাছে একবার দিন-কুড়ি হাজতবাসও হয়ে গেছে। কিছুতে জামিন দিলে না—আর জামিনই বা তখন হতো কে!
ষোড়শী। (উৎসুক-কণ্ঠে) আপনি কি কখনো বাদুড়বাগানের মেসে ছিলেন?
জীবানন্দ। হাঁ। ওই সময়ে একটা প্রণয়কাণ্ডের বৃন্দে হয়েছিলুম—ব্যাটা আয়ান ঘোষ কিছুতে ছাড়লে না—পুলিশে দিলে। যাক, সে অনেক কথা। কে আমাকে ভোলেনি, বেশ চিনে। আজও পালাতে পারতুম, কিন্তু ব্যথায় শয্যাগত হয়ে পড়েচি, নড়বার জো নেই।
ষোড়শী। (কোমল-কণ্ঠে) ব্যথাটা কি আপনার কমচে না?
জীবানন্দ। না, তা ছাড়া এ সারবার ব্যথাও নয়।
ষোড়শী। (কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া) আমাকে কি করতে হবে?
জীবানন্দ। শুধু বলতে হবে তুমি নিজের ইচ্ছায় এসেচ, নিজের ইচ্ছায় এখানে আছ। তার বদলে তোমাকে সমস্ত দেবোত্তর ছেড়ে দেব, হাজার টাকা নগদ দেব, আর নজরের টাকার ত কথাই নেই।
[এককড়ি কি বলিতে যাইয়া ষোড়শীর মুখের পানে চাহিয়া থামিয়া গেল]
ষোড়শী। (সোজা হাসিয়া) এ কথা স্বীকার করার অর্থ বোঝেন? তার পরেও কি আমার জমিতে, টাকাকড়িতে প্রয়োজন থাকতে পারে বলে আপনি বিশ্বাস করেন?
জীবানন্দ। (বিবর্ণমুখে) তাই বটে ষোড়শী, তাই বটে। জীবনে আজও ত তুমি পাপ করোনি—ও তুমি পারবে না সত্যি। (একটু হাসিয়া) টাকাকড়ির বদলে যে সম্ভ্রম বেচা যায় না—ও যেন আমি ভুলেই গেছি। তাই হোক, যা সত্যি তাই তুমি বলো—জমিদারের তরফ থেকে আর কোনো উপদ্রব তোমার ওপর হবে না।
[এককড়ি ব্যাকুল হইয়া আবার কি বলিতে গেল, কিন্তু রুদ্ধদ্বারে পুনঃ পুনঃ করাঘাতের শব্দ শুনিয়া বিবর্ণমুখে থামিয়া গেল]
জীবানন্দ। (সাড়া দিয়া) খোলা আছে, ভিতরে আসুন।
[দরজা উন্মুক্ত হইল। ম্যাজিস্ট্রেট, ইন্স্পেক্টার, কয়েকজন কনেস্টবল ও তারাদাস চক্রবর্তী প্রবেশ করিলেন]
তারাদাস। (ভিতরে ঢুকিয়াই কাঁদিয়া) ধর্মাবতার, হুজুর! এই আমার মেয়ে, মা-চণ্ডীর ভৈরবী। আপনার দয়া না হলে আজ ওকে টাকার জন্যে খুন করে ফেলত ধর্মাবতার।
ম্যাজিস্ট্রেট। (ষোড়শীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া) তোমারই নাম ষোড়শী? তোমাকেই বাড়ি থেকে ধরে এনে উনি বন্ধ করে রেখেছেন?
ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না, আমি নিজের ইচ্ছায় এসেচি। কেউ আমার গায়ে হাত দেয়নি।
তারাদাস। (চেঁচামেচি করিয়া উঠিল) না হুজুর, ভয়ানক মিথ্যে কথা, গ্রামসুদ্ধ সাক্ষী আছে। মা আমার ভাত রাঁধছিল, আটজন পাইক গিয়ে তাকে বাড়ি থেকে মারতে মারতে টেনে এনেছে।
ম্যাজিস্ট্রেট। (জীবানন্দের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া ষোড়শীকে কহিলেন) তোমার কোন ভয় নেই, তুমি সত্য কথা বল। তোমাকে বাড়ি থেকে ধরে এনেছে?
ষোড়শী। না, আমি আপনি এসেচি।
ম্যাজিস্ট্রেট। এখানে তোমার কি প্রয়োজন?
ষোড়শী। আমার কাজ ছিল।
ম্যাজিস্ট্রেট। এত রাত্রেও বাড়ি ফিরে যেতে দেরি হচ্ছিল!
তারাদাস। (চেঁচাইয়া) না হুজুর, সমস্ত মিছে—সমস্ত বানানো, আগাগোড়া শিখানো কথা।
ম্যাজিস্ট্রেট। (তাহার প্রতি লক্ষ্য না করিয়া শুধু মুখ টিপিয়া হাসিলেন এবং শিস্ দিতে দিতে প্রথমে বন্দুকটা এবং পরে পিস্তলটা তুলিয়া লইয়া জীবানন্দকে কেবল বলিলেন) I hope you have permission for this.
[ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন
ম্যাজিস্ট্রেট। (নেপথ্যে) হামারা ঘোড়া লাও!
[ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল। তারাদাস হতজ্ঞানের ন্যায় স্তব্ধ অভিভূতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া]
তারাদাস। (অকস্মাৎ বুকফাটা ক্রন্দনে সকলকে সচকিত করিয়া পুলিশ-কর্মচারীর পায়ের নীচে পড়িয়া কাঁদিয়া) বাবুমশায়, আমার কি হবে! আমাকে যে এবার জমিদারের লোক জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে।
ইন্স্পেক্টার। (তিনি বয়সে প্রবীণ, শশব্যস্ত হইয়া তাহাকে চেষ্টা করিয়া হাত ধরিয়া তুলিয়া সদয়কণ্ঠে) ভয় কি ঠাকুর, তুমি যেমন ছিলে তেমনি থাকো গে। স্বয়ং ম্যজিস্ট্রেট সাহেব তোমার সহায় রইলেন—আর কেউ তোমাকে জুলুম করবে না। (কটাক্ষে জীবানন্দের দিকে চাহিলেন)
তারাদাস। (চোখ মুছিতে মুছিতে) সাহেব যে রাগ করে চলে গেলেন বাবু!
ইন্স্পেক্টার। (মুচকি হাসিয়া) না ঠাকুর, রাগ করেন নি, তবে আজকের এই ঠাট্টাটুকু তিনি সহজে ভুলতে পারবেন, এমন মনে হয় না। তা ছাড়া আমরাও মরিনি, থানাও যা হোক একটা আছে। (আড়চোখে জীবানন্দের দিকে চাহিয়া, কিছু পরে) এখন চল ঠাকুর, যাওয়া যাক। এই রাত্তিরে যেতেও ত হবে অনেকটা।
সাব-ইন্স্পেক্টার। (বয়সে তরুণ, অল্প হাসিয়া) মেয়েটি রেখে ঠাকুরটি কি তবে একাই যাবেন নাকি?
[কথাটায় সবাই হাসিল—কনস্টেবলগুলা পর্যন্ত। এককড়ি কড়িকাঠের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিল। তারাদাসের চোখের অশ্রু চোখের পলকে অগ্নিশিখায় রূপান্তরিত হইয়া গেল]
তারাদাস। (ষোড়শীর প্রতি কঠোর দৃষ্টিপাত করিয়া সগর্জনে) যেতে হয় আমি একাই যাব। আবার ওর মুখ দেখব—আবার ওকে বাড়িতে ঢুকতে দেব আপনারা ভেবেচেন?
ইন্স্পেক্টার। (সহাস্যে) মুখ তুমি না দেখতে পার কেউ মাথার দিব্যি দেবে না ঠাকুর! কিন্তু যার বাড়ি, তাকে বাড়ি ঢুকতে না দিয়ে আর যেন নতুন ফ্যাসাদে পোড়ো না।
তারাদাস। (আস্ফালন করিয়া) বাড়ি কার? বাড়ি আমার। আমিই ভৈরবী করেচি, আমিই ওকে দূর করে তাড়াব। কলকাঠি এই তারা চক্কোত্তির হাতে। (সজোরে নিজের বুক ঠুকিয়া) নইলে কে ও জানেন? শুনবেন ওর মায়ের—
ইন্স্পেক্টার। (থামাইয়া দিয়া) থামো ঠাকুর, থামো, রাগের মাথায় পুলিশের কাছে সব কথা বলে ফেলতে নেই—তাতে বিপদে পড়তে হয়। (ষোড়শীর প্রতি) তুমি যেতে চাও ত আমরা তোমাকে নিরাপদে ঘরে পৌঁছে দিতে পারি। চল, আর দেরি করো না।
[ষোড়শী অধোমুখে নিঃশব্দে দাঁড়াইয়াছিল, ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না]
সাব-ইন্স্পেক্টার। (মুখ টিপিয়া হাসিয়া) যাবার বিলম্ব আছে বুঝি?
ষোড়শী। (মুখ তুলিয়া চাহিয়া ইন্স্পেক্টারের প্রতি) আপনারা যান, আমার যেতে এখনো দেরি আছে।
তারাদাস। (উন্মত্তের মত) দেরি আছে! হারামজাদী, তোকে যদি না খুন করি ত আমি মনোহর চক্কোত্তির ছেলে নই! (লাফাইয়া উঠিয়া ষোড়শীকে আঘাত করিতে গেল)
ইন্স্পেক্টার। (তাহাকে ধরিয়া ফেলিয়া ধমক দিয়া) ফের যদি বাড়াবাড়ি কর ত তোমাকে থানায় ধরে নিয়ে যাব। চল, ভালমানুষের মত ঘরে চল।
[তারাদাসকে টানিয়া লইয়া তিনি ও সব পুলিশ-কর্মচারী প্রস্থান করিল, এককড়িও পা টিপিয়া বাহির হইয়া গেল। দূর হইতে তারাদাসের গর্জন ও গালাগালি ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর শোনা যাইতে লাগিল]
জীবানন্দ। (ইঙ্গিতে ষোড়শীকে আরো একটু কাছে ডাকিয়া) তুমি এঁদের সঙ্গে গেলে না কেন?
ষোড়শী। এঁদের সঙ্গে ত আমি আসিনি।
জীবানন্দ। (কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকিয়া) তোমার বিষয়ের ছাড় লিখে দিতে দু’চারদিন দেরি হবে, কিন্তু টাকাটা কি তুমি আজই নিয়ে যাবে?
ষোড়শী। তাই দিন।
জীবানন্দ। (বিছানার তলা থেকে একতাড়া নোট বাহির করিল। সেইগুলা গণনা করিতে করিতে ষোড়শীর মুখের প্রতি বার বার চাহিয়া দেখিয়া একটু হাসিয়া বলিল) আমার কিছুতেই লজ্জা করে না, কিন্তু আমারও এগুলো তোমার হাতে তুলে দিতে বাধ-বাধ ঠেকছে।
ষোড়শী। (শান্ত নম্রকণ্ঠে) কিন্তু তাই ত দেবার কথা ছিল।
জীবানন্দ। কথা যাই থাক ষোড়শী, আমাকে বাঁচাতে তুমি যা খোয়ালে, তার দাম টাকায় ধার্য করচি, এ মনে করার চেয়ে বরঞ্চ আমার না বাঁচাই ছিল ভালো।
ষোড়শী। (তার মুখে স্থিরদৃষ্টে চাহিয়া) কিন্তু মেয়েমানুষের দাম ত আপনি এই দিয়েই চিরদিন ধার্য করে এসেছেন। (জীবানন্দ নিরুত্তর—কিছু পরে) বেশ, আজ যদি আপনার সে মত বদলে থাকে, টাকা না হয় রেখেই দিন, আপনাকে কিছুই দিতে হবে না। কিন্তু আমাকে কি সত্যিই এখনো চিনতে পারেন নি? ভালো করে চেয়ে দেখুন দিকি?
জীবানন্দ। (নীরবে বহুক্ষণ নিষ্পলক চাহিয়া থাকিয়া, ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া) বোধ হয় পেরেচি। ছেলেবেলায় তোমার নাম অলকা ছিল না?
ষোড়শী। (তাহার সমস্ত মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল) আমার নাম ষোড়শী। ভৈরবী দশমহাবিদ্যার নাম ছাড়া আর কোন নাম থাকে না। কিন্তু অলকাকে আপনার মনে আছে?
জীবানন্দ। (নিরুৎসুক-কণ্ঠে) কিছু কিছু মনে আছে বৈ কি! তোমার মায়ের হোটেলে মাঝে মাঝে খেতে যেতাম। তখন তুমি ছোট ছিলে। কিন্তু আমাকে ত তুমি অনায়াসে চিনতে পেরেচ!
ষোড়শী। অনায়াসে না হলেও পেরেচি। অলকার মাকে মনে পড়ে?
জীবানন্দ। পড়ে। তিনি বেঁচে আছেন?
ষোড়শী। না—বছর-দশেক আগে তাঁর কাশীলাভ হয়েছে। আপনাকে তিনি বড় ভালোবাসতেন, না?
জীবানন্দ। (উদ্বেগে) হাঁ—একবার বিপদে পড়ে তাঁর কাছে একশ’ টাকা ধার নিয়েছিলাম, সেটা বোধ হয় আর শোধ দেওয়া হয়নি।
ষোড়শী। না, কিন্তু আপনি সেজন্য মনে কোন ক্ষোভ রাখবেন না। কারণ অলকার মা সে টাকা ধার বলে আপনাকে দেননি, জামাইকে যৌতুক বলে দিয়েছিলেন। (ক্ষণকাল চুপ করিয়া) চেষ্টা করলে এটুকু মনেও পড়তে পারে যে, সে দিনটাও ঠিক এমনি দুর্দিন ছিল। আজ ষোড়শীর ঋণটাই খুব ভারী বোধ হচ্চে, কিন্তু সেদিন ছোট্ট অলকার কুলটা মায়ের ঋণটাও কম ভারী ছিল না চৌধুরীমশাই।
জীবানন্দ। তাই মনে করতে পারতাম যদি না তিনি ঐ ক’টা টাকার জন্যে তাঁর মেয়েকে বিবাহ করতে আমাকে বাধ্য করতেন।
ষোড়শী। বিবাহ করতে তিনি বাধ্য করেন নি, বরঞ্চ করেছিলেন আপনি নিজে। কিন্তু, যাক ও-সব বিশ্রী আলোচনা। বিবাহ আপনি করেন নি, করেছিলেন শুধু একটু তামাশা। সম্প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই সেই যে নিরুদ্দেশ হলেন, এই বোধ হয় তার পরে আজ প্রথম দেখা।
জীবানন্দ। কিন্তু তার পরে ত তোমার সত্যিকারের বিবাহই হয়েচে শুনেচি।
ষোড়শী। তার মানে আর একজনের সঙ্গে? এই না? কিন্তু নিরুপায় বালিকার ভাগ্যে এ বিড়ম্বনা যদি ঘটেই থাকে, তবু ত আপনার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।
জীবানন্দ। নাই থাক, কিন্তু তোমার মা জানতেন শুধু কেবল তোমাকে তোমার বাবার হাত থেকে আলাদা রাখবার জন্যেই তিনি যা হোক একটা—
ষোড়শী। বিবাহের গণ্ডী টেনে দিয়েছিলেন? তা হবেও বা। অলকার মাও বেঁচে নেই এবং আমিই অলকা কিনা, এতকাল পরে তা নিয়েও দুশ্চিন্তা করবার আপনার দরকার নেই।
জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ নীরবে নতমুখে থাকিয়া) কিন্তু, ধর, আসল কথা যদি তুমি প্রকাশ করে বল, তা হলে—
ষোড়শী। আসল কথাটা কি? বিবাহের কথা? কিন্তু সেই ত মিথ্যে। তা ছাড়া সে সমস্যা অলকার, আমার নয়। সারারাত এখানে কাটিয়ে গিয়ে ও-গল্প করলে ষোড়শীর সর্বনাশের পরিমাণ তাতে এতটুকু কমবে না।
জীবানন্দ। (কয়েক-মুহূর্ত নীরব থাকিয়া) ষোড়শী, আজ আমি এত নীচে নেবে গেছি যে, গৃহস্থের কুলবধূর দোহাই দিলেও তুমি মনে মনে হাসবে, কিন্তু সেদিন অলকাকে বিবাহ করে বীজগাঁ’র জমিদার বংশের বধূ বলে সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটাই কি ভাল কাজ হতো?
ষোড়শী। সে ঠিক জানিনে, কিন্তু সত্যি কাজ হতো এ জানি। কিন্তু আমি মিথ্যে বকচি, এখন এ-সব আর আপনার কাছে বলা নিষ্ফল। আমি চললাম—আপনি কোন কিছু দেবার চেষ্টা করে আর আমাকে অপমান করবেন না।
[এককড়ির প্রবেশ]
জীবানন্দ। (এককড়ি প্রবেশ করিতেই তাহাকে) এককড়ি, তোমাদের এখানে কোন ডাক্তার আছেন? একবার খবর দিয়ে আনতে পার? তিনি যা চাবেন আমি তাই দেব।
এককড়ি। ডাক্তার আছে বৈ কি হুজুর—আমাদের বল্লভ ডাক্তারের খাসা হাতযশ। (ষোড়শীর দিকে চাহিল)
জীবানন্দ। (ব্যগ্রকণ্ঠে) তাঁকেই আনতে পাঠাও এককড়ি, আর এক মিনিট দেরি করো না।
এককড়ি। আমি নিজেই যাচ্চি। কিন্তু হুজুরকে একলা—
জীবানন্দ। (দুঃসহ বেদনায় মুহূর্তে বিবর্ণ ও উপুড় হইয়া পড়িয়া) উঃ—আর আমি পারিনে।
ষোড়শী। তুমি বল্লভ ডাক্তারকে ডেকে আনো গে এককড়ি, এখানে যা করবার আমি করব এখন।
[এককড়ি ব্যস্তভাবে চলিয়া গেল
জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ উপুড় হইয়া থাকিয়া মুখ তুলিয়া) ডাক্তার আসেনি? কতদূর থাকেন জানো?
ষোড়শী। কাছেই থাকেন, কিন্তু তাই বলে তিন-চার মিনিটেই কি আসা যায়?
জীবানন্দ। সবে তিন-চার মিনিট? আমি ভেবেচি আধ-ঘণ্টা—কি আরও কতক্ষণ যেন এককড়ি তাকে আনতে গেছে। (উপুড় হইয়া শুইয়া পড়িল) হয়ত তিনিও ভয়ে এখানে আসবেন না অলকা! (তাহার কণ্ঠস্বরে ও চোখের দৃষ্টিতে নিরাশ্বাসের অবধি রহিল না)
ষোড়শী। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া স্নিগ্ধস্বরে) ডাক্তার আসবেন বৈ কি!
জীবানন্দ। বোধ করি আমি বাঁচব না। আমার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্চে, মনে হচ্চে, পৃথিবীতে আর বুঝি হাওয়া নেই।
ষোড়শী। আপনার কি বড্ড কষ্ট হচ্চে?
জীবানন্দ। হুঁ। অলকা, আমাকে তুমি মাপ কর। (একটু থামিয়া) আমি ঠাকুর-দেবতা মানিনে, দরকারও হয় না। কিন্তু একটু আগেই মনে মনে ডাকছিলাম। জীবনে অনেক পাপ করেচি, তার আর আদি-অন্ত নেই। আজ থেকে থেকে কেবলি মনে হচ্ছে বুঝি সব দেনা মাথায় নিয়ে যেতে হবে। (ক্ষণেক থামিয়া) মানুষ অমর নয়, মৃত্যুর বয়সও কেউ দাগ দিয়ে রাখেনি—কিন্তু এই যন্ত্রণা আর সইতে পারচি নে—উঃ—মা গো! (ব্যথার তীব্রতায় সর্বশরীর যেন আকুঞ্চিত হইয়া উঠিল)
[ষোড়শী একটু ইতস্ততঃ করিয়া শয্যাপার্শ্বে বসিয়া আঁচল দিয়া ললাটের ঘাম মুছাইয়া দিয়া, পাখার অভাবে আঁচল দিয়া বাতাস করিতে লাগিল। জীবানন্দ কোন কথা কহিল না, কেবল তাহার ডান হাতটা ধীরে ধীরে কোলের উপর টানিয়া লইল]
জীবানন্দ। (ক্ষণেক পরে) অলকা—
ষোড়শী। আপনি আমায় ষোড়শী বলে ডাকবেন।
জীবানন্দ। আর কি অলকা হতে পার না?
ষোড়শী। না।
জীবানন্দ। কোনদিন কোন কারণেই কি—
ষোড়শী। আপনি অন্য কথা বলুন। (জীবানন্দ নীরবে রহিল, ক্ষণেক পরে) কষ্টটা কি কিছুই কমেনি?
জীবানন্দ। (ঘাড় নাড়িয়া) বোধ হয় একটু কমেছে। আচ্ছা যদি বাঁচি, তোমার কি কোন উপকার করতে পারিনে?
ষোড়শী। না, আমি সন্ন্যাসিনী—আমার নিজের কোন উপকার করা কারো সম্ভব নয়।
জীবানন্দ। আচ্ছা এমন কিছুই কি নেই, যাতে সন্ন্যাসিনীও খুশি হয়?
ষোড়শী। তা হয়ত আছে, কিন্তু সেজন্যে কেন আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন?
জীবানন্দ। (একটু ক্ষীণ হাসিয়া) আমার ঢের দোষ আছে, কিন্তু পরের উপকার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এ দোষ আজও কেউ দেয়নি। তা ছাড়া এখন বলচি বলেই যে ভালো হয়েও বলব, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই—এমনিই বটে! সারাজীবনে এ ছাড়া আর আমার কিছুই বোধ হয় নেই।
[ষোড়শী নীরবে তাহার কপালের ঘাম মুছাইয়া দিল]
জীবানন্দ। (হঠাৎ সেই হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া) সন্ন্যাসিনীর কি সুখ-দুঃখ নেই? সে খুশি হয়, পৃথিবীতে এমন কি কিছুই নেই?
ষোড়শী। কিন্তু সে ত আপনার হাতের মধ্যে নয়।
জীবানন্দ। যা মানুষের হাতের মধ্যে? তেমন কিছু?
ষোড়শী। তাও আছে, কিন্তু ভালো হয়ে যদি কখনো জিজ্ঞাসা করেন তখনই জানাব।
জীবানন্দ। (তাহার হাতটাকে বুকের কাছে টানিয়া) না, না, আর ভালো হয়ে নয়—এই কঠিন অসুখের মধ্যেই আমাকে বল! মানুষকে অনেক দুঃখ দিয়েচি, আজ নিজের ব্যথার মধ্যে পরের ব্যথা, পরের আশার কথাটা একটু শুনে নিই। নিজের দুঃখের একটা সদ্গতি হোক।
[বাহিরে পদশব্দ শোনা গেল। ষোড়শী নিজের হাতটাকে ধীরে ধীরে মুক্ত করিয়া লইল]
ষোড়শী। ডাক্তারবাবু বোধ হয় এলেন।
[ডাক্তার ও এককড়ি প্রবেশ করিল। ডাক্তার ষোড়শীকে এখানে দেখিয়া একেবারে আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কিন্তু কিছু না বলিয়া নীরবে শয্যাপ্রান্তে আসিয়া রোগ পরীক্ষা করিতে নিযুক্ত হইলেন; ষোড়শী এই সময়ে প্রস্থান করিল]
এককড়ি। যদি ভালো করতে পারেন ডাক্তারবাবু, বকশিশের কথা ছেড়েই দিন—আমরা সবাই আপনার কেনা হয়ে থাকব।
ডাক্তার। (পরীক্ষা শেষ করিয়া) অত্যাচার করে রোগ জন্মেছে। সাবধান না হলে পিলে কি লিভার পাকা অসম্ভব নয়, এবং তাতে ভয়ের কথা আছে। তবে সাবধান হলে নাও পাকতে পারে এবং তাতে ভয়ের কথাও কম। তবে এ কথা নিশ্চয় যে ওষুধ খাওয়া আবশ্যক।
জীবানন্দ। এ অবস্থায় কলকাতায় যাওয়া সম্ভব কিনা তা বলতে পারেন?
ডাক্তার। যদি যেতে পারেন তা হলেই সম্ভব, নইলে কিছুতেই সম্ভব নয়।
জীবানন্দ। এখানে থাকলে ভালো হবে কিনা বলতে পারেন?
ডাক্তার। (বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িয়া) আজ্ঞে না হুজুর, তা বলতে পারিনে। তবে এ কথা নিশ্চয় যে এখানে থাকলেও ভালো হতে পারেন, আবার কলকাতা গিয়ে ভালো নাও হতে পারেন।
এককড়ি। হুজুরের ব্যথাটা—
ডাক্তার। এরকম ব্যথা হঠাৎ বাড়ে, আবার হঠাৎ কমে যায়। কাল সকালেই হুজুর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। তবে এ কথা নিশ্চয় যে, আমাকে আবার আসতে হবে।
[এককড়ির কাছ থেকে ভিজিট লইয়া ডাক্তার প্রস্থান করিলেন জীবানন্দ। কি হবে এককড়ি?
এককড়ি। ভয় কি হুজুর, ওষুধ এল বলে! বল্লভ ডাক্তারের একশিশি মিক্চার খেলেই সব ভালো হয়ে যাবে!
জীবানন্দ। (ষোড়শী যে-দ্বারপথে একটু আগে বাহির হইয়া গেছে সেইদিকে উৎসুক-চোখে চাহিয়া) ওঁকে একবার ডেকে দিয়ে—
[এককড়ি বাহিরে গিয়া ক্ষণেক পরে পুনরায় প্রবেশ করিল]
এককড়ি। তিনি নেই, বাড়ি চলে গেছেন হুজুর। ভোর হয়ে এসেচে।
জীবানন্দ। (ব্যগ্র ব্যাকুল-কণ্ঠে) আমাকে না জানিয়ে চলে যাবেন, না। এমন হতেই পারে না এককড়ি!
এককড়ি। হাঁ হুজুর, তিনি ডাক্তারবাবু আসবার পরেই চলে গেছেন। বাইরে সর্দার বসে আছে, সে দেখেছে ভৈরবী-ঠাকরুন সোজা চলে গেলেন।
জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ চোখের দিকে সোজা তাকাইয়া থাকিয়া) তা হলে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে তুমিও যাও এককড়ি, আমি একটু ঘুমুব।
[এককড়ি আলো নিভাইয়া দিল। জীবানন্দ বেদনা-ম্লানমুখে পাশ ফিরিয়া শুইলেন। আলো নিভাইতেই অতি প্রত্যুষের আবছায়া আভা জানালা দিয়া ঘরে ছড়াইয়া পড়িল]
ষোড়শী – ১.৩
তৃতীয় দৃশ্য
৺চণ্ডী-মন্দিরের পথ। বেলা—পূর্বাহ্ন
[জনৈক ভিক্ষুক ও তাহার কন্যার প্রবেশ]
কন্যা। আর যে চলতে পারিনে বাবা, মায়ের মন্দির আর কত দূরে?
ভিক্ষুক। ঐ যে আগে কত লোক চলে যাচ্ছে মা, বোধ হয় আর বেশী দূরে নয়।
কন্যা। কে গান গাইতে গাইতে আসচে বাবা, ওকে শুধোও না?
[গান গাহিতে গাহিতে দ্বিতীয় ভিক্ষুকের প্রবেশ]
তোর পাওয়ার সময় ছিল যখন, ওরে অবোধ মন,
মরণ-খেলার নেশায় মেতে রইলি অচেতন।
প্রথম ভিক্ষুক। মায়ের মন্দির আর কত দূরে বাবা?
দ্বিতীয় ভিক্ষুক। ঐ যে—
তখন ছিল মণি, ছিল মাণিক
পথের ধারে ধারে—
এখন ডুবলো তারা দিনের শেষে
বিষম অন্ধকারে।
প্রথম ভিক্ষুক। হাঁ গা—
দ্বিতীয় ভিক্ষুক। কি গো কি?
প্রথম ভিক্ষুক। বিষ্ণু গাঁ থেকে আসছি বাবা, পথ যেন আর ফুরোয় না। শুনি যে জনার্দন রায়মশায়ের নাতির কল্যাণে আজ মায়ের পূজো। বামুন বোষ্টম ভিখারী যে যা চাইবে তাই নাকি রায়মশায়—
দ্বিতীয় ভিক্ষুক। রায়মশায় নয়, রায়মশায় নয়, তার জামাই। পশ্চিম মুল্লুকের ব্যারিস্টার—রাজা বললেই হয়। দু’ সরা চিঁড়ে মুড়কি, এক সরা সন্দেশ, আর আট-গণ্ডা পয়সা নগদ—
ভিক্ষুক-কন্যা। (পিতার প্রতি) হাঁ বাবা, তুমি যে বলেছিলে মেয়েদের একখানা করে রাঙ্গা-পেড়ে কাপড় দেবে?
দ্বিতীয় ভিক্ষুক। দেবে, দেবে। যে যা চাইবে। রায়মশায়ের মেয়ে হৈমবতী কাউকে না বলতে জানে না।
আজ মিথ্যে রে তোর খোঁজা-খুঁজি
মিথ্যে চোখের জল,
তারে কোথায় পাবি বল,
(তোর) অতল তলে তলিয়ে গেল
শেষ-সাধনার ধন।
ভিক্ষুক-কন্যা। বাবা, চাইলে হয়ত তুমিও পাবে একখানা কাপড়, না?
দ্বিতীয় ভিক্ষুক। পাবে পাবে, একটু পা চালিয়ে এসো।
তোর পাওয়ার সময় ছিল যখন,
ওরে অবোধ মন,
মরণ-খেলার নেশায় মেতে রইলি অচেতন।
[সকলের প্রস্থান
[কথা কহিতে কহিতে ষোড়শী ও ফকিরসাহেব প্রবেশ করিলেন]
ফকির। যে-সব কথা আমার কানে গেছে মা, চুপ করে থাকতে পারলাম না, চলে এলাম। কিন্তু আমি ত কিছুতেই ভেবে পাইনে ষোড়শী, সেদিন কিসের জন্য ও লোকটাকে তুমি এমন করে বাঁচিয়ে দিলে।
ষোড়শী। ঐ পীড়িত লোকটিকে জেলে পাঠানই কি উচিত হতো ফকিরসাহেব?
ফকির। সে বিবেচনার ভার ত তোমার ছিল না মা, ছিল রাজার, তাই তাঁর জেলের মধ্যেও হাসপাতাল আছে, পীড়িত অপরাধীরও তিনি চিকিৎসা করেন। কিন্তু শুধু এই যদি কারণ হয়ে থাকে ত তুমি অন্যায় করেছ বলতে হবে।
[ষোড়শী নিঃশব্দে তাঁর মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল]
ফকির। যা হবার হয়ে গেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে এ ত্রুটি তোমাকে শুধরে নিতে হবে ষোড়শী।
ষোড়শী। তার অর্থ?
ফকির। ওই লোকটার অপরাধ ও অত্যাচারের অন্ত নেই এ তুমি জানো। শাস্তি হওয়া উচিত।
ষোড়শী। (ক্ষণেক স্তব্ধ থাকিয়া) আমি সমস্ত জানি। তাঁকে শাস্তি দেওয়াই হয়ত আপনাদের কর্তব্য, কিন্তু আমার কথা কাউকে বলবার নয়। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আমি কোনদিন পারব না।
ফকির। সেদিন পারো নি সত্য, কিন্তু ভবিষ্যতেও কি পারবে না?
ষোড়শী। না।
ফকির। আত্মরক্ষার জন্যেও না!
ষোড়শী। না, আত্মরক্ষার জন্যেও না।
ফকির। আশ্চর্য! (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) তুমি ত এখন মন্দিরে যাচ্চ ষোড়শী, আমি তা হলে চললেম।
[ষোড়শী হেঁট হইয়া নমস্কার করিল; ফকির প্রস্থান করিলেন। অন্যমনস্কের ন্যায় ষোড়শী চলিবার উপক্রম করিতেই সাগর দ্রুতবেগে আসিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইল]
সাগর। হাঁ মা, তোমার বাবা তারাদাস ঠাকুর নাকি ঘরে ঘরে তালা বন্ধ করে তোমাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে? তারা সবাই মিলে নাকি মতলব করেচে, তোমাকে চণ্ডীমন্দির থেকে বিদায় করে আবার নতুন ভৈরবী আনবে? সে হবে না, সাগর সর্দার বেঁচে থাকতে তা হবে না বলে দিচ্চি।
ষোড়শী। এ খবর তুই কোথায় শুনলি সাগর?
সাগর। শুনেছি মা, এইমাত্র শুনতে পেয়ে তোমার কাছে জানতে ছুটে এসেছি। তুমি মেয়েমানুষ, তোমাকে একলা পেয়ে যদি জমিদারের লোক বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে থাকে সে কি তোমার অপরাধ? অপরাধ সমস্ত গ্রামের। অপরাধ এই সাগরের, যে কুটুম-বাড়িতে গিয়ে আমোদে মেতেছিল—মায়ের খবর রাখতে পারেনি। অপরাধ তার খুড়ো হরিহর সর্দারের, যে গাঁয়ের মধ্যে উপস্থিত থেকেও এতবড় অপমানের শোধ নিতে পারেনি।
ষোড়শী। কিন্তু এই যদি সত্যি হয়ে থাকে সাগর, তোরা দুজন খুড়ো-ভাইপোতে উপস্থিত থাকলেই বা কি করতিস বল ত? জমিদারের কত লোকজন একবার ভেবে দেখ দিকি!
সাগর। তাও দেখেচি মা। তাঁর ঢের লোক, ঢের পাইক-পিয়াদা। গরীব বলে আমাদের দুঃখ দিতেও তারা কম করে না। কিন্তু দিক আমাদের দুঃখ, আমরা ছোটলোক বৈ ত না। কিন্তু তোমার হুকুম পেলে মা, ভৈরবীর গায়ে হাত দেবার একবার শোধ দিতে পারি। গলায় দড়ি বেঁধে টেনে এনে ওই হুজুরকেই রাতারাতি মায়ের স্থানে বলি দিতে পারি মা, কোন শালা আটকাতে পারবে না।
ষোড়শী। (শিহরিয়া) বলিস কি সাগর, তোরা কি এত নিষ্ঠুর, এমন ভয়ঙ্কর হতে পারিস? এইটুকুর জন্যে একটা মানুষ খুন করবার ইচ্ছে হয় তোদের?
সাগর। এইটুকু? তোমার গায়ে হাত দেওয়াকে তুমি এইটুকু বল মা? তারাদাস ঠাকুরকেও আমরা মাপ করতে পারি, জনার্দন রায়কেও হয়ত পারি, কিন্তু সুবিধে পেলে জমিদারকে আমরা সহজে ছাড়ব না। (ক্ষণেক থামিয়া) কিন্তু ওরা যে সব বলাবলি করে মা, তুমি নাকি ওঁকেই সে-রাত্রে হাকিমের হাত থেকে রক্ষে করেছ? নাকি বলেছ, তোমাকে ধরে নিয়ে কেউ যায় নি, নিজে ইচ্ছে করেই গিয়েছিলে?
ষোড়শী। এমন ত হতে পারে সাগর, আমি সত্য কথাই বলেছিলাম।
সাগর। তাই ত বিষম খটকা লেগেছে মা, তোমার মুখ দিয়ে ত কখনো মিছে কথা বার হয় না। তবে এ কি! কিন্তু সে যাই হোক, যাই কেন না গ্রামসুদ্ধ লোকে বলে বেড়াক, আমরা ক’ ঘর ছোটজাত তোমার ভূমিজ প্রজারা তোমাকেই মা বলে জেনেছি; যদি চণ্ডীগড় ছেড়ে চলে যাও মা, আমরাও তোমার সঙ্গে যাব, কিন্তু যাবার আগে একবার জানিয়ে দিয়ে যাব যে কারা গেল!
[দ্রুতপদে প্রস্থান
ষোড়শী। সাগর! একটা কথা তোকে বলতে পারলেম না বাবা, তোদের দায়িত্ব হয়ত আর বইতে পারব না।
[এককড়ির প্রবেশ]
ষোড়শী। কে, এককড়ি?
এককড়ি। (সসম্ভ্রমে) আপনার কাছেই এলাম। হুজুর একবার আপনাকে স্মরণ করেছেন।
ষোড়শী। কোথায়?
এককড়ি। কাছারিতে বসে প্রজাদের নালিশ শুনছেন। যদি অনুমতি করেন ত পালকি আনতে পাঠাই।
ষোড়শী। পালকি? এটি তাঁর প্রস্তাব, না তোমার সুবিবেচনা এককড়ি?
এককড়ি। আজ্ঞে, আমি ত চাকর, এ স্বয়ং হুজুরের আদেশ।
ষোড়শী। (হাসিয়া) তোমার হুজুরের বিবেচনা আছে তা মানি, কিন্তু সম্প্রতি পালকি চড়বার আমার ফুরসত নেই
এককড়ি। হুজুরকে বলো আমার অনেক কাজ।
এককড়ি। ও-বেলায় কিংবা কাল সকালেও কি সময় হবে না?
ষোড়শী। না।
এককড়ি। কিন্তু হলে ভাল হতো। আরও দশজন প্রজার নালিশ আছে কিনা।
ষোড়শী। (কঠোর-স্বরে) তাঁকে বলো এককড়ি, বিচার করার মত বুদ্ধি থাকে ত তাঁর নিজের প্রজাদের করুন গে। আমি তাঁর প্রজা নই, আমার বিচার করবার জন্যে রাজার আদালত আছে।
[ষোড়শী দ্রুতপদে প্রস্থান করিল এবং এককড়ি কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। অপর দিক দিয়া হৈম ও নির্মল প্রবেশ করিল। হৈমর হাতে পূজার উপকরণ]
হৈম। যে দয়ালু লোকটি তোমাকে সেদিন অন্ধকার রাতে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন, সত্যি বল ত তিনি কে? তাঁকে আমি চিনেছি।
নির্মল। চিনেছ? কে বল ত তিনি?
হৈম। আমাদের ভৈরবী। কিন্তু তুমি তাঁকে পেলে কোথায়, তাই শুধু আমি ঠাউরে উঠতে পারিনি!
নির্মল। পারোনি? পেয়েছিলাম তাঁকে অনেক দূরে। তোমাদের ফকিরসাহেবের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য কথা শুনে ভারী কৌতূহল হয়েছিল তাঁকে দেখবার। খুঁজে খুঁজে চলে গেলাম। নদীর পারে তাঁর আশ্রম, সেখানে গিয়ে দেখি তোমাদের ভৈরবী আছেন বসে।
হৈম। তার কারণ, ফকিরকে তিনি গুরুর মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু সত্যিই কি তোমাকে একেবারে হাত ধরে অন্ধকারে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলেন?
নির্মল। সত্যিই তাই। যে মুহূর্তে তিনি নিশ্চয় বুঝলেন প্রচণ্ড ঝড়জলের মধ্যে ভয়ঙ্কর অন্ধকার অজানা পথে আমি অন্ধের সমান, নারী হয়েও তিনি অসঙ্কোচে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার হাত ধরে আসুন। কিন্তু পরের জন্য এ কাজ তুমি পারতে না হৈম।
হৈম। না।
নির্মল। তা জানি। (ক্ষণেক থামিয়া) দেখ হৈম, তোমাদের দেবীর এই ভৈরবীটিকে আমি চিনতে পারিনি সত্যি, কিন্তু এটুকু নিশ্চয় বুঝেচি এঁর সম্বন্ধে বিচার করার ঠিক সাধারণ নিয়ম খাটে না। হয়, সতীত্ব জিনিসটা এঁর কাছে নিতান্তই বাহুল্য বস্তু—তোমাদের মত তার যথার্থ রূপটা ইনি চেনেন না, না হয় সুনাম-দুর্নাম এঁকে স্পর্শ পর্যন্তও করতে পারে না।
হৈম। তুমি কি সেইদিনের জমিদারের ঘটনা মনে করেই এই-সব বলচ?
নির্মল। আশ্চর্য নয়। শাস্ত্রে বলে সাত পা একসঙ্গে গেলেই বন্ধুত্ব হয়। অতবড় পথটায় ওই দুর্ভেদ্য আঁধারে একমাত্র তাঁকেই আশ্রয় করে অনেক পা গুটিগুটি একসঙ্গে গেলাম, একটি একটি করে অনেক প্রশ্নই তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু পূর্বেও যে রহস্যে ঢাকা ছিলেন পরেও ঠিক তেমনি রহস্যেই গা ঢাকা দিয়ে মিলিয়ে গেলেন—কিছুই তাঁর হদিস পেলাম না।
হৈম। তোমার জেরাও মানলেন না, বন্ধুত্বও স্বীকার করলেন না?
নির্মল। না গো, না, কোনটাই না।
হৈম। (হাসিয়া ফেলিল) একটুও না? তোমার দিক থেকেও না?
নির্মল। এতবড় কথাটা কেবল ফাঁকি দিয়েই বার করে নিতে চাও নাকি? কিন্তু নিজেকে জানতেও যে দেরি লাগে হৈম।
হৈম। দেরি লাগুক তবু পুরুষের হয়। কিন্তু মেয়েমানুষের এমনি অভিশাপ, আমরণ নিজের অদৃষ্ট বুঝতেই তার কেটে যায়।
নির্মল। (হৈমর হাত ধরিয়া) তুমি কি পাগল হয়েছ হৈম? চল, আমরা একটু তাড়াতাড়ি যাই, হয়ত পূজোর বিলম্ব হয়ে যাবে।
[উভয়ের প্রস্থান
ষোড়শী – ১.৪
চতুর্থ দৃশ্য
নাটমন্দির
[গড়চণ্ডীর মন্দির ও সংলগ্ন প্রশস্ত অলিন্দ। সম্মুখে দীর্ঘ প্রাকারবেষ্টিত বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণে নাটমন্দিরের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে। মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত। দক্ষিণদিকে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিবার পথ। সকালে কাঁচা রোদের আলো চারিদিকে পড়িয়াছে; মন্দিরের অলিন্দে ও প্রাঙ্গণে উপস্থিত জনার্দন রায়, শিরোমণি ঠাকুর, নির্মল বসু, ষোড়শী, হৈম এবং আরও কয়েকজন নরনারী]
শিরোমণি। (ষোড়শীকে) আজ হৈমবতী তাঁর পুত্রের কল্যাণে যে পূজা দিতেছেন তাতে তোমার কোন অধিকার থাকবে না, তাঁর এই সঙ্কল্প তিনি আমাদের জানিয়েছেন। তাঁর আশঙ্কা তোমাকে দিয়ে তাঁর কার্য সুসিদ্ধ হবে না।
ষোড়শী। (পাণ্ডুর-মুখে) বেশ, তাঁর কাজ যাতে সুসিদ্ধ হয় তিনি তাই করুন।
শিরোমণি। কেবল এইটুকুই ত নয়! আমরা গ্রামস্থ ভদ্রমণ্ডলী আজ স্থির-সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েচি যে, দেবীর কাজ আর তোমাকে দিয়ে হবে না। মায়ের ভৈরবী তোমাকে রাখলে আর চলবে না। কে আছ, একবার তারাদাস ঠাকুরকে ডাক ত।
[একজন ডাকিতে গেল
ষোড়শী। কেন চলবে না?
জনৈক ব্যক্তি। সে তোমার বাবার মুখেই শুনতে পাবে।
জনার্দন। আগামী চৈত্রসংক্রান্তিতে নতুন ভৈরবীর অভিষেক হবে, আমরা স্থির করেছি।
[তারাদাস একটি দশ বছরের মেয়ে সঙ্গে করিয়া প্রবেশ করিল]
হৈম। (তারাদাসের দিকে চাহিয়া) যা সমস্ত শুনচি বাবা, তাতে কি ওঁর কথাই সত্যি বলে মেনে নিতে হবে?
জনার্দন। নয়ই বা কেন শুনি?
হৈম। (ছোট মেয়েটিকে দেখাইয়া) ঐটিকে যখন উনি যোগাড় করে এনেছেন তখন মিথ্যে বলা কি ওঁর এতই অসম্ভব? তা ছাড়া সত্যি মিথ্যে ত যাচাই করতে হয় বাবা, ও ত একতরফা রায় দেওয়া চলে না।
[সকলেই বিস্মিত হইল]
শিরোমণি। (স্মিতহাস্যে) বেটী কৌঁসুলীর গিন্নী কিনা, তাই জেরা ধরেচে! আচ্ছা, আমি দিচ্চি থামিয়ে, (হৈমকে) এটা দেবীর মন্দির—পীঠস্থান! বলি এটা ত মানিস?
হৈম। (ঘাড় নাড়িয়া) মানি বৈ কি!
শিরোমণি। তা যদি হয়, তা হলে তারাদাস বামুনের ছেলে হয়ে কি দেবমন্দিরে দাঁড়িয়ে মিছে কথা কইচে পাগলী? (প্রবল হাস্য করিলেন)
হৈম। আপনি নিজেও ত তাই শিরোমণিমশাই! অথচ এই দেবমন্দিরে দাঁড়িয়েই ত মিছে কথার বৃষ্টি করে গেলেন। আমি ত একবারও বলিনি ওঁকে দিয়ে কাজ করালে আমার সিদ্ধ হবে না।
[শিরোমণি হতবুদ্ধির মত হইলেন]
জনার্দন। (কুপিত হইয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে) বলনি কি রকম?
হৈম। না বাবা বলিনি। বলা দূরে থাক, ও-কথা আমি মনেও করিনে। বরঞ্চ ওঁকে দিয়েই আমি পূজো করাব, এতে ছেলের আমার কল্যাণই হোক, আর অকল্যাণই হোক। (ষোড়শীর প্রতি) চলুন মন্দিরের মধ্যে—আমাদের সময় বয়ে যাচ্চে।
জনার্দন। (ধৈর্য হারাইয়া অকস্মাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া ভীষণ-কণ্ঠে) কখখনো না, আমি বেঁচে থাকতে ওকে কিছুতেই মন্দিরে ঢুকতে দেব না। তারাদাস, বল ত ওর মায়ের কথাটা! একবার শুনুক সবাই।
শিরোমণি। (সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়াইয়া উঠিয়া) না তারাদাস থাক। ওর কথা আপনার মেয়ে হয়ত বিশ্বাস করবে না রায়মশায়। ও-ই বলুক। চণ্ডীর দিকে মুখ করে ও-ই নিজের মায়ের কথা নিজে বলে যাক। কি বল চাটুয্যে? তুমি কি বল হে যোগেন ভট্চায? কেমন? ও-ই নিজে বলুক।
[ষোড়শীর মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল]
হৈম। আপনারা ওঁর বিচার করতে চান নিজেরাই করুন, কিন্তু ওঁর মায়ের কথা ওঁর নিজের মুখ দিয়ে কবুল করিয়ে নেবেন, এতবড় অন্যায় আমি কোনমতে হতে দেব না। (ষোড়শীর প্রতি) চলুন আপনি আমার সঙ্গে মন্দিরের মধ্যে—
ষোড়শী। না বোন, আমি পূজো করিনে, যিনি এ কাজ নিত্য করেন তিনিই করুন, আমি কেবল এইখানে দাঁড়িয়ে তোমার ছেলেকে আশীর্বাদ করি, সে যেন দীর্ঘজীবী হয়, নীরোগ হয়, মানুষ হয়! (পূজারীর প্রতি) কিন্তু—ছোট্ঠাকুরমশাই, তুমি ইতস্ততঃ করচ কিসের জন্যে? আমার আদেশ রইল দেবীর পূজা যথারীতি সেরে তুমি নিজের প্রাপ্য নিয়ো। বাকী মন্দিরের ভাঁড়ারে বন্ধ করে চাবি আমাকে পাঠিয়ে দিয়ো। (হৈমর প্রতি) আমি আবার আশীর্বাদ করে যাচ্চি, এতেই তোমার ছেলের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হবে।
[ষোড়শী প্রাঙ্গণ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল এবং পুরোহিত পূজার জন্য মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন]
জনার্দন। (নির্মল ও হৈমর প্রতি) যাও মা তোমরাও পূজারী ঠাকুরের সঙ্গে যাও—পূজোটি যাতে সুসম্পন্ন হয় দেখো গে।
[নির্মল ও হৈম মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন]
জনার্দন। যাক বাঁচা গেছে শিরোমণিমশায়, ষোড়শী আপনিই চলে গেল। ছুঁড়ি জিদ করে যে আমার নাতির মানস-পূজাটি পণ্ড করে দিলে না এই ঢের।
শিরোমণি। এ যে হতেই হবে ভায়া, মা মহামায়ার মায়া কি কেউ রোধ করতে পারে? এ যে ওঁরই ইচ্ছে। (এই বলিয়া তিনি যুক্তকরে মন্দিরের উদ্দেশে প্রণাম করিলেন)
যোগেন ভট্চায। (গলা বাড়াইয়া দেখিয়া) অ্যাঁ, এ যে স্বয়ং হুজুর আসছেন।
[সকলেই ত্রস্ত এবং চকিত হইয়া উঠিল, জীবানন্দ ও তাঁহার পশ্চাতে কয়েকজন পাইক ও ভৃত্য প্রভৃতি প্রবেশ করিল]
শিরোমণি ও জনার্দন। আসুন, আসুন, আসুন।
[কেহ নমস্কার করিল, অনেকেই প্রণাম করিল]
জনার্দন। আমার পরম সৌভাগ্য যে আপনি এসেছেন। আজ আমার দৌহিত্রের কল্যাণে মায়ের পূজা দেওয়া হচ্চে।
জীবানন্দ। বটে? তাই বুঝি বাইরে এত জন-সমাগম?
[জনার্দন সবিনয়ে মুখ নত করিলেন]
শিরোমণি। হুজুরের দেহটি ভাল আছে?
জীবানন্দ। দেহ? (হাসিয়া) হাঁ, ভালই আছে। তাই ত আজ হঠাৎ বেরিয়ে পড়লাম। দেখি, বহুলোকে ভিড় করে এইদিকে আসচে। সঙ্গ নিলাম। অদৃষ্ট প্রসন্ন ছিল, দেবতা ব্রাহ্মণ এবং সাধু-সঙ্গ তিনটেই বরাতে জুটে গেল। কিন্তু রায়মশায়কে জানি, আপনাকে ত বেশ চিনতে পারলাম না ঠাকুর?
জনার্দন। ইনি সর্বেশ্বর শিরোমণি। প্রাচীন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। গ্রামের মাথা বললেই হয়।
জীবানন্দ। বটে? বেশ, বেশ, বড় আনন্দ লাভ করলাম। তা এইখানেই একটু বসা যাক না কেন।
[বসিতে উদ্যত হইলে সকলেই ব্যস্ত হইয়া উঠিল]
শিরোমণি। (চিৎকার করিয়া) আসন, আসন, বসবার একটা আসন নিয়ে এস কেউ—
জীবানন্দ। ব্যস্ত হবেন না শিরোমণিমশাই, আমি অতিশয় বিনয়ী লোক, সময়বিশেষে রাস্তায় শুয়ে পড়তেও অভিমান বোধ করিনে—এ ত ঠাকুরবাড়ি। বেশ বসা যাবে।
[জীবানন্দ উপবেশন করিলেন]
জনার্দন। একটা গুরুতর কার্যোপলক্ষে আমরা সবাই আপনার কাছে যাব স্থির করেছিলাম, শুধু আপনি পীড়িত মনে করেই যেতে পারিনি।
জীবানন্দ। গুরুতর কার্যোপলক্ষে?
শিরোমণি। হাঁ হুজুর, গুরুতর বৈ কি। ষোড়শী ভৈরবীকে আমরা কেউ চাইনে।
জীবানন্দ। চান না?
শিরোমণি। না, হুজুর।
জীবানন্দ। একটুখানি জনশ্রুতি আমার কানেতেও পৌঁছেচে। ভৈরবীর বিরুদ্ধে আপনাদের নালিশটা কি শুনি?
[সকলেই নীরব রহিল]
জীবানন্দ। বলতে কি আপনাদের করুণা বোধ হচ্ছে?
জনার্দন। হুজুর সর্বজ্ঞ, আমাদের অভিযোগ—
জীবানন্দ। কি অভিযোগ?
জনার্দন। আমরা গ্রামস্থ ষোল-আনা ইতর-ভদ্র একত্র হয়ে—
জীবানন্দ। (একটু হাসিল) তা দেখতে পাচ্ছি। (অঙ্গুলি-নির্দেশ করিয়া) ওইটি কি সেই ভৈরবীর বাপ তারাদাস ঠাকুর নয়?
[তারাদাস সাড়া দিল না, মাটিতে দৃষ্টি-নিবদ্ধ করিল]
শিরোমণি। (সবিনয়ে) রাজার কাছে প্রজা সন্তান-তুল্য, তা সে দোষ করলেও সন্তান, না করলেও সন্তান। আর কথাটা একরকম ওরই। ওর কন্যা ষোড়শীকে আমরা নিশ্চয় স্থির করেছি, তাকে আর মহাদেবীর ভৈরবী রাখা যেতে পারে না। আমার নিবেদন, হুজুর তাকে সেবায়েতের কাজ থেকে অব্যাহতি দেবার আদেশ করুন।
জীবানন্দ। (চকিত) কেন? তার অপরাধ?
দু’তিনজন ব্যক্তি। (সমস্বরে) অপরাধ অতিশয় গুরুতর।
জীবানন্দ। তিনি হঠাৎ এমন কি ভয়ানক দোষ করেছেন রায়মশায়, যার জন্যে তাঁকে তাড়ানো আবশ্যক!
[জনার্দন শিরোমণিকে বলিতে চোখের ইঙ্গিত করিল]
জীবানন্দ। না, না, উনি অনেক পরিশ্রম করেছেন, বুড়ো মানুষকে আর কষ্ট দিয়ে কাজ নেই, ব্যাপারটা আপনিই ব্যক্ত করুন।
জনার্দন। (চোখে ও মুখে দ্বিধা ও সঙ্কোচের ভাব আনিয়া) ব্রাহ্মণ-কন্যা—এ আদেশ আমাকে করবেন না।
জীবানন্দ। গো-ব্রাহ্মণে আপনার অচলা ভক্তির কথা এদিকে কারও অবিদিত নেই। কিন্তু এতগুলি ইতর-ভদ্রকে নিয়ে আপনি নিজে যখন উঠেপড়ে লেগেছেন, তখন ব্যাপার যে অতিশয় গুরুতর তা আমার বিশ্বাস হয়েছে। কিন্তু সেটা আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।
জনার্দন। (শিরোমণির প্রতি ক্রুদ্ধদৃষ্টি হানিয়া) হুজুর যখন নিজে শুনতে চাচ্ছেন তখন আর ভয় কি ঠাকুর? নির্ভয়ে জানিয়ে দিন না।
শিরোমণি। (ব্যস্ত হইয়া) সত্যি কথায় ভয় কিসের জনার্দন? তারাদাসের মেয়েকে আর আমরা কেউ রাখব না হুজুর! তার স্বভাব-চরিত্র ভারী মন্দ হয়ে গেছে—এই আপনাকে আমরা জানিয়ে দিচ্ছি।
[জীবানন্দের পরিহাস-দীপ্ত প্রফুল্ল মুখ অকস্মাৎ গম্ভীর ও কঠিন হইয়া উঠিল]
জীবানন্দ। তাঁর স্বভাব-চরিত্র মন্দ হবার খবর আপনারা নিশ্চয় জেনেছেন?
[সকলে ঘাড় নাড়িল]
জীবানন্দ। তাই সুবিচারের আশায় বেছে বেছে একেবারে ভীষ্মদেবের শরণাপন্ন হয়েছেন রায়মশায়?
শিরোমণি। আপনি দেশের রাজা—সুবিচার বলুন, অবিচার বলুন, আপনাকেই করতে হবে। আমাদেরও তাই মাথা পেতে নিতে হবে। সমস্ত চণ্ডীগড় ত আপনারই।
জীবানন্দ। (মৃদু হাসিয়া) দেখুন শিরোমণিমশায়, অতি-বিনয়ে আপনাদেরও খুব হেঁট হয়ে কাজ নেই, অতি-গৌরবে আমাকেও আকাশে তোলবার প্রয়োজন নেই। আমি শুধু জানতে চাই, এ অভিযোগ কি সত্য?
[অনেকেই উত্তেজনায় চঞ্চল হইয়া উঠিল]
শিরোমণি। অভিযোগ? সত্য কিনা!—আচ্ছা, আমরা না হয় পর, কিন্তু তারাদাস, তুমিই বল ত। রাজদ্বার, যথাধর্ম বলো—
[তারাদাস একবার পাংশু একবার রাঙ্গা হইয়া উঠিতে লাগিল। জনার্দনের ক্রুদ্ধ একাগ্র দৃষ্টি খোঁচা মারিয়া যেন তাহাকে বারংবার তাড়না করিতে লাগিল। সে একবার ঢোঁক গিলিয়া একবার কণ্ঠের জড়িমা সাফ করিয়া অবশেষে মরিয়ার মত বলিয়া উঠিল]
তারাদাস। হুজুর—
জীবানন্দ। (হাত তুলিয়া তাহাকে থামাইয়া দিয়া) ওর মুখ থেকে ওর নিজের মেয়ের কলঙ্কের কথা আমি যথাধর্ম বললেও শুনব না। বরঞ্চ আপনাদের কেউ পারেন ত যথাধর্ম বলুন।
[ভৃত্য অন্তরালে ছিল, সে টম্ব্লার ভরিয়া হুইস্কি সোডা প্রভুর হাতে আনিয়া দিল। তিনি এক নিশ্বাসে পান করিয়া বেয়ারার হাতে ফিরাইয়া দিলেন]
জীবানন্দ। আঃ—বাঁচলাম। আপনাদের অজস্র বাক্য-সুধা পান করে তেষ্টায় বুক পর্যন্ত কাঠ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চুপচাপ যে! কি হলো আপনাদের যথাধর্মের?
[শিরোমণি নাকে কাপড় দিয়াছিলেন]
জীবানন্দ। (সহাস্যে) শিরোমণিমশায় কি ঘ্রাণে অর্ধভোজনের কাজটা সেরে নিলেন নাকি?
[অনেকেই হাসিয়া মুখ ফিরাইল]
শিরোমণি। (হতবুদ্ধি হইয়া) এই যে বলি হুজুর। আমি যথাধর্মই বলব।
জীবানন্দ। (ঘাড় নাড়িয়া) সম্ভব বটে। আপনি শাস্ত্রজ্ঞ প্রবীণ ব্রাহ্মণ, কিন্তু একজন স্ত্রীলোকের নষ্ট-চরিত্রের কাহিনী তার অসাক্ষাতে বলার মধ্যে আপনার যথাটা যদিই বা থাকে, ধর্মটা থাকবে কি? আমার নিজের কোন বিশেষ আপত্তি নেই—ধর্মাধর্মের বালাই আমার বহুদিন ঘুচে গেছে—তবু আমি বলি, ওতে কাজ নেই। বরঞ্চ আমি যা জিজ্ঞাসা করি তার জবাব দিন। বর্তমান ভৈরবীকে আপনারা তাড়াতে চান—এই না?
সকলে। (মাথা নাড়িয়া) হাঁ, হাঁ।
জীবানন্দ। এঁকে নিয়ে আর সুবিধা হচ্ছে না?
জনার্দন। (প্রতিবাদের ভঙ্গীতে মাথা তুলিয়া) সুবিধে-অসুবিধে কি হুজুর, গ্রামের ভালর জন্যেই প্রয়োজন।
জীবানন্দ। (হাসিয়া ফেলিয়া) অর্থাৎ গ্রামের ভালমন্দের আলোচনা না তুলেও এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, আপনার ভালমন্দ কিছু একটা আছেই। তাড়াবার আমার ক্ষমতা আছে কিনা জানিনে, কিন্তু আপত্তি বিশেষ নেই। কিন্তু আর কোন একটা অজুহাত তৈরি করা যায় না? দেখুন না চেষ্টা করে। বরঞ্চ আমাদের এককড়িটিকেও না হয় সঙ্গে নিন, এ বিষয়ে তার বেশ একটু হাতযশ আছে।
[সকলে অবাক হইয়া রহিল]
জীবানন্দ। এঁদের সতীপনার কাহিনী অত্যন্ত প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ; সুতরাং তাকে আর নাড়াচাড়া করে কাজ নেই। ভৈরবী থাকলেই ভৈরব এসে জোটে এবং ভৈরবদেরও ভৈরবী নইলে চলে না, এ অতি সনাতন প্রথা—সহজে টলানো যাবে না। দেশসুদ্ধ ভক্তের দল চটে যাবে, হয়ত বা দেবী নিজেও খুশী হবেন না—একটা হাঙ্গামা বাধবে।মাতঙ্গী ভৈরবীর গোটা-পাঁচেক ভৈরব ছিল, এবং তাঁর পূর্বে যিনি ছিলেন তাঁর নাকি হাতে গোনা যেত না। কি বলেন, শিরোমণিমশাই, আপনি ত এ অঞ্চলের প্রাচীন ব্যক্তি, জানেন ত সব?
শিরোমণি। (শুষ্কমুখে জনান্তিকে) কি জানি, শুনেছি নাকি?
[প্রফুল্ল প্রবেশ করিল, তার হাতে ইংরিজি-বাংলা কয়েকখানা সংবাদপত্র ও কতকগুলো খোলা চিঠিপত্র]
জীবানন্দ। কিহে প্রফুল্ল, এখানেও ডাকঘর আছে নাকি? আঃ—কবে এইগুলো সব উঠে যাবে?
প্রফুল্ল। (ঘাড় নাড়িয়া) সে ঠিক। গেলে আপনার সুবিধে হতো। কিন্তু সে যখন হয়নি তখন এগুলো দেখবার কি এখন সময় হবে? অত্যন্ত জরুরি।
জীবানন্দ। তা বুঝেছি, নইলে এখানে আনবে কেন? কিন্তু দেখবার সময় আমার এখনও হবে না, অন্য সময়েও হবে না। কিন্তু ব্যাপারটা বাইরে থেকেই উপলব্ধি হচ্ছে। ওই যে হীরালাল-মোহনলালের দোকানের ছাপ। পত্রখানি তাঁর উকিলের, না একেবারে আদালতের হে? ও খামখানা ত দেখচি সলোমন সাহেবের। বাবা, বিলিতি সুধার গন্ধ যেন কাগজ ফুঁড়ে বার হচ্চে। কি বলেন সাহেব? ডিক্রি জারি করবেন, না এই রাজবপুখানি নিয়ে টানা-হেঁচড়া করবেন—জানাচ্চেন? আঃ—সেকালের ব্রাহ্মণ্যতেজ যদি কিছু বাকী থাকত ত এই ইহুদি ব্যাটাকে একেবারে ভস্ম করে দিতাম। মদের দেনা আর শুধতে হতো না।
প্রফুল্ল। (ব্যাকুল হইয়া) কি বলচেন দাদা? থাক, থাক, আর একসময়ে হবে। (ফিরিতে উদ্যত হইল)
জীবানন্দ। (সহাস্যে) আরে লজ্জা কি ভায়া, এঁরা সব আপনার লোক, জ্ঞাতগোষ্ঠী, এমন কি মণিমাণিক্যের এপিঠ-ওপিঠ বললেও অত্যুক্তি হয় না! তা ছাড়া তোমার দাদাটি যে কস্তুরী-মৃগ; সুগন্ধ আর কতকাল চেপে রাখবে ভাই? প্রফুল্ল, রাগ করো না ভায়া, আপনার বলতে আর কাউকে বড় বাকী রাখিনি, কিন্তু এই চল্লিশটা বছরের অভ্যাস ছাড়তে পারব বলেও ভরসা নেই, তার চেয়ে বরঞ্চ নোট-টোট জাল করতে পারে এমন যদি কাউকে যোগাড় করে আনতে পারতে হে—
প্রফুল্ল। (অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াও হাসিয়া ফেলিয়া) দেখুন, সবাই আপনার কথা বুঝবে না। সত্য ভেবে যদি কেউ—
জীবানন্দ। (গম্ভীর হইয়া) সন্ধান করে নিয়ে আসেন? তা হলে ত বেঁচে যাই প্রফুল্ল। রায়মশায়, আপনি ত শুনি অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনার জানাশুনা কি এমন কেউ—
জনার্দন। (ম্লানমুখে উঠিয়া) বেলা হলো যদি অনুমতি করেন ত—
জীবানন্দ। বসুন, বসুন, নইলে প্রফুল্লর জাঁক বেড়ে যাবে। তা ছাড়া ভৈরবীর কথাটা শেষ হয়ে যাক। কিন্তু আমি যাও বললেই কি সে যাবে?
জনার্দন। সে ভার আমাদের।
জীবানন্দ। কিন্তু আর কাউকে ত বাহাল করা চাই। ও ত খালি থাকতে পারে না।
অনেকে। সে ভারও আমাদের।
জীবানন্দ। যাক বাঁচা গেল, তবে সে যাবেই। এতগুলো মানুষের বিশ্বাসের ভার একা ভৈরবী কেন, স্বয়ং মা-চণ্ডীও সামলাতে পারেন না। আপনাদের লাভ-লোকসান আপনারাই জানেন, কিন্তু আমার এমন অবস্থা যে, টাকা পেলে আমার কিছুতেই আপত্তি নেই। নতুন বন্দোবস্তে আমার কিছু পাওয়া চাই। ভালো কথা, কেউ দেখ্ ত রে এককড়ি আছে না গেছে? কিন্তু গলাটা এদিকে যে মরুভূমি হয়ে গেল।
বেয়ারা। (প্রবেশ করিয়া প্রভুর ব্যগ্র-ব্যাকুল হস্তে পূর্ণপাত্র দিয়া) তিনি রান্নাবাড়ার ঘরগুলো দেখচেন।
জীবানন্দ। এর মধ্যেই? ডাক্ তাকে। (মদ্যপান)
[ইহার পর হইতে পূজার্থীরা মন্দিরে প্রবেশ করিতে লাগিল ও পূজা শেষ করিয়া বাহির হইয়া যাইতে লাগিল—তাদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়িতে লাগিল। এককড়ি প্রবেশ করিল]
জীবানন্দ। আজ যে ভৈরবীকে তলব করেছিলাম, কেউ তাঁকে খবর দিয়েছিল?
এককড়ি। আমি নিজে গিয়েছিলাম।
জীবানন্দ। তিনি এসেছিলেন?
এককড়ি। আজ্ঞে না।
জীবানন্দ। না কেন? (এককড়ি অধোমুখে নীরব) তিনি কখন আসবেন, জানিয়েছেন?
এককড়ি। (তেমনি অধোমুখে) এত লোকের সামনে আমি সে কথা হুজুরে পেশ করতে পারব না।
জীবানন্দ। এককড়ি তোমার গোমস্তাগিরি কায়দাটা একটু ছাড়। তিনি আসবেন না,—না?
এককড়ি। না।
জীবানন্দ। কেন?
এককড়ি। তিনি আসতে পারবেন না। তিনি বললেন, তোমার হুজুরকে বলো এককড়ি, তাঁর বিচার করবার মত বিদ্যে-বুদ্ধি থাকে ত নিজের প্রজাদের করুন গে—আমার বিচার করবার জন্যে আদালত খোলা আছে।
জীবানন্দ। (অন্ধকার-মুখে) হুঁ। আচ্ছা তুমি যাও।
[এককড়ির প্রস্থান
জীবানন্দ। প্রফুল্ল, সেই যে চিনির কোম্পানির সঙ্গে হাজার বিঘে জমি বিক্রির কথা হয়েছিল, তার দলিল লেখা হয়েছে?
প্রফুল্ল। আজ্ঞে হয়েছে।
জীবানন্দ। এক্ষুণি তুমি গিয়ে সেটা পাকাপাকি কর গে। লিখে দাও জমি তারা পাবে।
প্রফুল্ল। তাই হবে।
[পূজার্থী ও পূজার্থিনীরা যাইতেছে আসিতেছে]
জীবানন্দ। আজ যে পূজার বড় ভিড় দেখছি। না, রোজই এইরকম?
জনার্দন। আজকের একটু বিশেষ আয়োজন ত আছেই, তা ছাড়া এই চড়কের সময়টায় কিছুদিন ধরে এমনিই হয়। লোকজনের ভিড় এখন বাড়তেই থাকবে।
জীবানন্দ। তাই নাকি? বেলা হলো এখন তা হলে আসি। (হাসিয়া) একটা মজা দেখেছেন রায়মশায়, চণ্ডীগড়ের লোকগুলো প্রায়ই ভুলে যায় যে, জমিদার এখন কালীমোহন নয়—জীবানন্দ চৌধুরী। অনেক প্রভেদ, না?
[জনার্দন কি যে জবাব দিবে ভাবিয়া পাইল না। শুধু তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল]
জীবানন্দ। এখানে বীজগাঁ’র প্রজা নয় এমন একটা প্রাণীও নেই। ঠিক না শিরোমণিমশায়?
শিরোমণি। তাতে আর সন্দেহ কি হুজুর!
জীবানন্দ। না, আমার সন্দেহ নেই, তবে আর কারও না সন্দেহ থাকে। আচ্ছা, নমস্কার শিরোমণিমশায়, চললাম। (হাসিয়া) কিন্তু ভৈরবী-বিদায়ের পালাটা শেষ করা চাই। প্রফুল্ল, যাওয়া যাক।
[প্রস্থান
শিরোমণি। (জমিদার সত্যই গেল কিনা উঁকি মারিয়া দেখিয়া) জনার্দন, কিরূপ মনে হয় ভায়া?
জনার্দন। মনে ত অনেক কিছুই হয়।
শিরোমণি। মহাপাপিষ্ঠ—লজ্জা-শরম আদৌ নেই।
জনার্দন। (গম্ভীরমুখে) না।
শিরোমণি। ভারী দুর্মুখ। মানীর মান-মর্যাদার জ্ঞান নেই।
জনার্দন। না।
শিরোমণি। কিন্তু দেখলে ভায়া কথার ভঙ্গী? সোজা না বাঁকা, সত্য না মিথ্যা, তামাশা না তিরস্কার, ভেবে পাওয়াই দায়। অর্ধেক কথা ত বোঝাই গেল না, যেন হেঁয়ালি। পাষণ্ড সত্যি বললে, না আমাদের বাঁদর নাচালে ঠিক ঠাহর করা গেল না। জানে সব, কি বল?
[জনার্দন নিরুত্তর]
শিরোমণি। যা ভাবা গিয়েছিল ব্যাটা হাবা-গোবা নয়—বিশেষ সুবিধে হবে না বলেই যেন শঙ্কা হচ্চে, না?
জনার্দন। মায়ের অভিরুচি।
শিরোমণি। তার আর কথা কি! কিন্তু ব্যাপারটা যেন খিচুড়ি পাকিয়ে গেল। না গেল একে ধরা, না গেল তাকে মারা। তোমার কি ভায়া, পয়সার জোর আছে, ছুঁড়ী যক্ষের মত আগলে আছে, গেলে সুমুখের বাগান-বেড়াটা তোমার টানা দিয়ে চৌকোস হতে পারবে।কিন্তু বাঘের গর্তের মুখে ফাঁদ পাততে গিয়ে না শেষে আমি মারা পড়ি।
জনার্দন। আপনি কি ভয় পেয়ে গেলেন নাকি?
শিরোমণি। না না, ভয় নয়,—কিন্তু তুমিও যে খুব ভরসা পেলে তা ত তোমারও মুখ দেখে অনুভব হচ্ছে না। হুজুরটি ত কানকাটা সেপাই—কথাও যেমন হেঁয়ালি, কাজও তেমনি অদ্ভুত। ও যে ধরে গলা টিপে মদ খাইয়ে দেয়নি এই আশ্চর্য। এককড়ির মুখে ভৈরবী ঠাকরুনের হুমকিও ত শুনলে? তোমরা চুপ করে ছিলে, আমিই মেলা কথা কয়েছি—ভাল করিনি। কি জানি, এককোড়ে ব্যাটা ভেতরে ভেতরে সব বলে দেয় নাকি। দুয়ের মাঝখানে পড়ে শেষকালে না বেড়াজালে ধরা পড়ি।
জনার্দন। (উদাস-কণ্ঠে) সকলই চণ্ডীর ইচ্ছে। বেলা হলো, সন্ধ্যের পর একবার আসবেন।
শিরোমণি। তা আসব। কিন্তু ঐ যে আবার এঁরা ফিরে আসচেন হে!
[মন্দির-প্রাঙ্গণের একটা দ্বার দিয়া ষোড়শী ও তাহার পশ্চাতে সাগর ও তাহার সঙ্গী প্রবেশ করিল। অন্য দ্বার দিয়া জীবানন্দ, প্রফুল্ল, ভৃত্য ও কয়েকজন পাইক প্রবেশ করিল]
জীবানন্দ। চলে যাচ্ছিলাম, শুধু তোমাকে আসতে দেখে ফিরে এলাম। এককড়িকে দিয়ে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম এবং তারই মুখে তোমার জবাবও শুনলাম। তোমার বিরুদ্ধে রাজার আদালতে গিয়ে দাঁড়াবার বুদ্ধি আমার নেই, কিন্তু নিজের প্রজাদের শাসনে রাখবার বিদ্যেও জানি। সমস্ত গ্রামের প্রার্থনা-মত তোমার সম্বন্ধে কি আদেশ করেছি শুনেছ?
ষোড়শী। না।
জীবানন্দ। তোমাকে বিদায় করা হয়েছে। নতুন ভৈরবী করে, তাকে মন্দিরের ভার দেওয়া হবে। অভিষেকের দিনও স্থির হয়ে গেছে। তুমি রায়মশায় প্রভৃতির হাতে দেবীর সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে আমার গোমস্তার হাতে সিন্দুকের চাবি দেবে। এ বিষয়ে তোমার কিছু বলবার আছে?
ষোড়শী। আমার বক্তব্যে আপনার কি কিছু প্রয়োজন আছে?
জীবানন্দ। না, নেই। তবে আজ সন্ধ্যার পরে এইখানেই একটা সভা হবে। ইচ্ছে কর ত দশের সামনে তোমার দুঃখ জানাতে পার। ভালো কথা, শুনতে পেলাম আমার বিরুদ্ধে আমার প্রজাদের নাকি তুমি বিদ্রোহী করে তোলবার চেষ্টা করচ?
ষোড়শী। তা জানিনে। তবে আমার নিজের প্রজাদের আপনার উপদ্রব থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি।
জীবানন্দ। (অধর দংশন করিয়া) পারবে?
ষোড়শী। পারা না পারা মা-চণ্ডীর হাতে।
জীবানন্দ। তারা মরবে।
ষোড়শী। মানুষ অমর নয় সে তারা জানে।
[ক্রোধে ও অপমানে সকলের চোখ-মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল। এককড়ি এমন ভাব দেখাইতে লাগিল যে সে কষ্টে আপনাকে সংযত করিয়া রাখিয়াছে]
জীবানন্দ। (একমুহূর্ত স্তব্ধ থাকিয়া) তোমার নিজের প্রজা আজ কেউ নাই। তারা যাঁর প্রজা তিনি নিজে দস্তখত করে দিয়েছেন। তাঁকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।
ষোড়শী। (মুখ তুলিয়া) আপনার আর কোন হুকুম আছে? নেই? তা হলে দয়া করে এইবার আমার কথাটা শুনুন।
জীবানন্দ। বল।
ষোড়শী। আজ দেবীর অস্থাবর সম্পত্তির বুঝিয়ে দেবার সময় আমার নেই, এই সন্ধ্যায় মন্দিরের কোথাও সভা-সমিতির স্থানও হবে না। এগুলো এখন বন্ধ রাখতে হবে।
শিরোমণি। (সহসা চিৎকার করিয়া) কখনো না! কিছুতেই নয়! এ-সব চালাকি আমাদের কাছে খাটবে না বলে দিচ্চি—
[জীবানন্দ ছাড়া সকলেই ইহার প্রতিধ্বনি করিয়া উঠিল]
জনার্দন। (উষ্মার সহিত) তোমার সময় এবং মন্দিরের ভেতর জায়গা কেন হবে না শুনি ঠাকরুন?
ষোড়শী। (বিনীত-কণ্ঠে) আপনি ত জানেন রায়মশাই, এখন চড়কের উৎসব। যাত্রীর ভিড়, সন্ন্যাসীর ভিড়, আমারই বা সময় কোথায়, তাদেরই বা সরাই কোথায়?
জনার্দন। (আত্মবিস্মৃত হইয়া সগর্জনে) হতেই হবে! আমি বলচি হতে হবে!
ষোড়শী। (জীবানন্দকে) ঝগড়া করতে আমার ঘৃণা বোধ হয়। তবে ও-সব করবার এখন সুযোগ হবে না, এই কথাটা আপনার অনুচরদের বুঝিয়ে বলে দেবেন। আমার সময় অল্প; আপনাদের কাজ মিটে থাকে ত আমি চললাম।
জীবানন্দ। (তপ্তস্বরে) কিন্তু আমি হুকুম দিয়ে যাচ্ছি, আজই এ-সব হতে হবে এবং হওয়াই চাই।
ষোড়শী। জোর করে?
জীবানন্দ। হাঁ, জোর করে।
ষোড়শী। সুবিধে-অসুবিধে যাই-ই হোক?
জীবানন্দ। হাঁ, সুবিধে-অসুবিধে যাই-ই হোক।
ষোড়শী। (পিছনে চাহিয়া ভিড়ের মধ্যে সাগরকে অঙ্গুলি-সঙ্কেতে আহ্বান করিয়া) সাগর, তোদের সমস্ত ঠিক আছে?
সাগর। (সবিনয়ে) আছে মা, তোমার আশীর্বাদে অভাব কিছুই নেই।
ষোড়শী। বেশ। জমিদারের লোক আজ একটা হাঙ্গামা বাধাতে চায়, কিন্তু আমি তা চাইনে। এই গাজনের সময়টায় রক্তপাত হয় আমার ইচ্ছে নয়, কিন্তু দরকার হলে করতেই হবে। এই লোকগুলোকে তোরা দেখে রাখ্, এঁদের কেউ যেন আমার মন্দিরের ত্রিসীমানায় না আসতে পারে। হঠাৎ মারিস্ নে—শুধু বার করে দিবি।
[প্রস্থান
ষোড়শী – ২.১
দ্বিতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
ষোড়শীর কুটীর
[সন্ধ্যা এইমাত্র উত্তীর্ণ হইয়াছে। গৃহের অভ্যন্তরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। বাহিরে ষোড়শী উপবিষ্ট। এমনি সময়ে নির্মল ও হৈম প্রবেশ করিল। পিছনে ভৃত্য]
ষোড়শী। এস, এস, কিন্তু এ কি কাণ্ড! তোমাদের যে আজ দুপুরের গাড়িতে যাবার কথা ছিল?
[নির্মল ও হৈম নিকটে উপবেশন করিল]
হৈম। কথা ছিল, কিন্তু যাইনি। এঁকেও যেতে দিইনি। দিদির এই নতুন ঘরখানি চোখে দেখে না গেলে দুঃখ করতে হতো।
নির্মল। চোখে দেখে গিয়েও দুঃখ কম করতে হবে মনে হয় না।
হৈম। সে ঠিক। হয়ত চোখে না দেখলেই ছিল ভালো। এ ঘরের আর যা দোষ থাক, অপব্যয়ের অপবাদ শিরোমণিমশায় কেন, বোধ হয় আমার বাবাও দিতে পারেন না। কিন্তু এ পাগলামি কেন করতে গেলে দিদি, এ ঘরে ত তুমি থাকতে পারবে না!
ষোড়শী। এর চেয়েও কত খারাপ ঘরে কত মানুষকে ত থাকতে হয় ভাই।
হৈম। তা হলে সত্যিই কি তুমি সব ছেড়ে দেবে?
নির্মল। তা ছাড়া কি উপায় আছে বলতে পার? সমস্ত গ্রামের সঙ্গে ত একজন অসহায় স্ত্রীলোক দিবানিশি বিবাদ করে টিকতে পারে না।
হৈম। আমরা সমস্তই শুনেছি। তুমি সন্ন্যাসিনী, সবই তোমার সইবে, কিন্তু এর সঙ্গে যে মিথ্যে দুর্নাম লেগে রইল সেও কি সইবে দিদি?
ষোড়শী। দুর্নাম যদি মিথ্যেই হয় সইবে না কেন? হৈম, সংসারে মিথ্যে কথার অভাব নেই, কিন্তু সেই মিথ্যে কথার সঙ্গে ঝগড়া করে মিথ্যে কাজের সৃষ্টি করতে আমার লজ্জা করে বোন।
হৈম। দিদি, তুমি সন্ন্যাসিনী, তোমার সব কথা আমরা বুঝতে পারিনে, কিন্তু তোমাকে দেখে কি আমার মনে হয় জানো? আমার শ্বশুরকে কোন্ এক রাজা একখানি তলোয়ার খিলাত দিয়েছিলেন। খাপখানা তার ধূলো-বালিতে মলিন হয়ে গেছে, কিন্তু আসল জিনিসে কোথাও এতটুকু ময়লা ধরেনি। সে যেমন সোজা, তেমন খাঁটি, তেমনি কঠিন। তার কথা আমার তোমার পানে চাইলেই মনে পড়ে। মনে হয় দেশসুদ্ধ লোকে সবাই ভুল করেছে, আসল কথা কেউ কিছুই জানে না।
ষোড়শী। (হৈমর হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া) আজ তোমাদের কেন যাওয়া হলো না হৈম? বোধ হয় কাল যাওয়া হবে, না?
হৈম। আমার ছেলের কথা তুললেই রাগ কর, সে আর বলব না, কিন্তু ভয়ঙ্কর দুর্যোগের রাতে আমার এই অন্ধ মানুষটিকে যিনি হাতে ধরে নদী পার করে এনে নিঃশব্দে দিয়ে গেছেন, তাঁর পায়ের ধূলো না নিয়েই বা আমরা যাই কি করে? কিন্তু যাবার আগে এই কথাটি আজ দাও দিদি, আপনার লোকের যদি কখনো দরকার হয়, এই প্রবাসী বোনটিকে তখন ভুলো না।
হৈম। (ষোড়শীকে নীরব দেখিয়া) কথা দিতে বুঝি চাও না দিদি?
ষোড়শী। কথা দিলাম, ভুলব না। ভুলিওনি হৈম। আঘাত পেয়ে আজই তোমাকে একখানা চিঠি লিখছিলাম, ভেবেছিলাম, তুমি চলে গেলে সেখানা তোমাকে ডাকে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু শেষ করতে পারলাম না, হঠাৎ মনে পড়ল এর জন্যে হয়ত তোমার বাবার সঙ্গেই শেষ পর্যন্ত বিবাদ বেধে যাবে।
হৈম। যেতেও পারে। কিন্তু আরও যে একটা মস্ত কথা আছে দিদি। আমার এই অন্ধ মানুষটিকে তুমি রক্ষে করেছ, তার চেয়ে বড় সংসারে ত আমার কিছুই নেই।
ষোড়শী। সত্যিই কিছু নেই হৈম?
হৈম। না, নেই। আর এই সত্যি কথাটিই বলে যাব বলে আজ যেতে পারিনি।
ষোড়শী। (হাসিয়া) কিন্তু এই ছোট্ট কথাটুকুর জন্যে ত একজনই যথেষ্ট ছিল ভাই, নির্মলবাবুকে ত অনায়াসে যেতে দিতে পারতে?
হৈম। এঁকে? একলা? হায়, হায়, দিদি, বাইরে থেকে তোমরা ভাব প্রচণ্ড ব্যারিস্টার, মস্তলোক। কিন্তু আমিই জানি শুধু এই বিনি-মাইনের দাসীটিকে পেয়েছিলেন বলেই উনি জগতে টিকে গেলেন। বাস্তবিক দিদি, পুরুষমানুষদের এই এক আশ্চর্য ব্যাপার। বাইরের দিকে যিনি যত বড়, যত দুর্দম, যত শক্তিমান, ভিতরের দিকে তিনি তেমনি অক্ষম, তেমনি দুর্বল, তেমনি অপটু। দরকারের সময় কোথায় হারাবে এঁদের কাগজপত্র, বার হবার সময়ে কোথায় যাবে জামা-কাপড়-পোশাক, রাস্তায় বেরিয়ে কোথায় ফেলবে পকেটের টাকাকড়ি—কোন্ ভরসায় একলা ছেড়ে দিই বল ত? (সহাস্যে) একটুখানি চোখের আড়াল করেছিলাম বলেই ত সেদিন অমন বিভ্রাট বাধিয়েছিলেন। ভাগ্যে তুমি ছিলে!
ভৃত্য। মা, কালকের মত আজও ঝড়-জল হতে পারে—মেঘ উঠেচে।
হৈম। আজ তা হলে উঠি। মেঘের জন্যে নয় দিদি, তোমার কাছ থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কাল সকালেই যাত্রা করতে হবে—আজ যেন আর কাজের অন্ত নেই। এঁকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি, লুকিয়ে বাড়ি ঢুকতে হবে—বাবা না দেখতে পান। এতক্ষণে খোকা হয়ত ঘুম ভেঙ্গে বসে কাঁদচে, তাকে আবার দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে হবে, এঁর খাওয়া-দাওয়া আমি ছাড়া আর কেউ বোঝে না, আড়ালে থেকে সে ব্যবস্থা করতে হবে—তার পরে রেলগাড়িতে দীর্ঘ পথের সমস্ত আয়োজনই আমাকে নিজের হাতে করে নিতে হবে। কারও উপর নির্ভর করবার জো নেই। স্বামী, পুত্র, চাকর-বাকর—তার কত ঝঞ্ঝাট, কত ভার—আমার নিঃশ্বাস ফেলবারও সময় নেই দিদি।
ষোড়শী। এতে ত তোমার কষ্ট হয় বোন?
হৈম। (হাসিমুখে) তা হয়। তবু এই আশীর্বাদ আমাকে কর তুমি, যেন এই কষ্ট মাথায় নিয়েই একদিন যেতে পারি। আর ফিরে যদি আবার জন্ম নিতেই হয়, যেন এমনি কষ্টই বিধাতা আমার অদৃষ্টে লিখে দেন। সেদিনও যেন এমনি নিঃশ্বাস ফেলবারও অবকাশ না পাই।
ষোড়শী। তোমার কথাটা আমি বুঝেচি হৈম। এ যেন তোমার আনন্দের মধুচক্র। ভার যতই বাড়চে ততই এর রন্ধ্র মধুতে ভরে ভরে উঠচে। তাই হোক, এই আশীর্বাদই তোমাকে আজ করি।
হৈম। (সহসা পদধূলি লইয়া) তাই কর দিদি, মেয়েমানুষের জীবনের এর বড় আশীর্বাদ কি আছে!
নির্মল। আঃ, কি বকে যাচ্চো বল ত? আজ তোমার হলো কি?
হৈম। কি যে হয়েছে তুমি তার জানবে কি?
ষোড়শী। জানার শক্তিই আছে নাকি আপনাদের?
নির্মল। আপনাদের অর্থাৎ পুরুষদের ত? না, এতবড় কঠিন তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করবার সাধ্য নেই আমাদের সে কথা মানি, কিন্তু আপনিই বা এ সত্য জানলেন কি করে?
হৈম। কেন? দেবীর ভৈরবী বলে? কিন্তু ভৈরবী কি নারী নয়? ওগো মশায়, এ তত্ত্ব আমাদের চেষ্টা করে শিখতে হয় না। আমাদের জন্মকালে বিধাতা স্বহস্তে তাঁর দুই হাত পূর্ণ করে আমাদের বুকের মধ্যে ঢেলে দেন। সে সম্পদের কাছে ইন্দ্রাণীর ঐশ্বর্যও কামনা করিনে এ কি সত্যি নয় দিদি?
ষোড়শী। সত্যি বৈ কি ভাই!
ভৃত্য। মা, মেঘ যে বেড়েই আসচে?
হৈম। এই যে উঠি বাবা। অনেক বাচালতা করে গেলাম দিদি, মাপ করো।
নির্মল। হৈমকে যে চিঠিখানা লিখেছিলেন তাঁর হাতে দিলে সময়ও বাঁচত, খরচও বাঁচত।
ষোড়শী। (হাসিয়া) না দিলেও বাঁচবে। হয়ত আর তার প্রয়োজনই হবে না।
নির্মল। ঈশ্বর করুন নাই যেন হয়, কিন্তু হলে আপনার প্রবাসী ভক্ত-দুটিকে বিস্মৃত হবেন না।
হৈম। আসি দিদি। (পদধূলি লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল) তোমার মুখের পানে চেয়ে আজ কত-কি যেন মনে হচ্চে দিদি! মনে হচ্চে, এমন যেন তোমাকে আর কখনো দেখিনি—যেন সহসা কোথায় কত দূরেই চলে গিয়েছ।
নির্মল। নমস্কার। প্রয়োজনে যেন ডাক পাই।
[সকলের প্রস্থান
ষোড়শী। হৈম, তুমি যেন আজ আমার কত যুগের চোখের ঠুলি খুলে দিয়ে গেলে বোন।—কে?
[সাগরের প্রবেশ]
সাগর। আমি সাগর।
ষোড়শী। তোদের আর সবাই? কাল যারা দল বেঁধে এসেছিল?
সাগর। আজও তারা তেমনি দল বেঁধেই গেছে হুজুরের কাছারি-বাড়িতে। আর বোধ হয় তোমারই বিরুদ্ধে—
ষোড়শী। বলিস কি সাগর? আমারই বিরুদ্ধে?
সাগর। আশ্চর্য হবার ত কিছু নেই মা! সর্বপ্রকার আপদে বিপদে চিরকাল তোমার কাছে এসে দাঁড়ানই সকলের অভ্যাস। প্রথমটা সেই অভ্যাসটাই বোধ হয় তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু আজ জমিদারের একটা চোখ-রাঙ্গানিতেই তাদের হুঁশ হয়েছে।
ষোড়শী। ভালো। কিন্তু সভাটা যে শুনেছিলাম মন্দিরে হবার কথা ছিল?
সাগর। কথাও ছিল, হুজুরের ভোজপুরীগুলোর ইচ্ছেও ছিল। কিন্তু গ্রামের কেউ রাজী হলেন না। তাঁরা ত এদিককার মানুষ—আমাদের খুড়ো-ভাইপোকে হয়ত চেনেন।
ষোড়শী। কি স্থির হলো সভাতে?
সাগর। তা সব ভালো। এই মঙ্গলবারেই মেয়েটার অভিষেক শেষ হবে। তোমারও ভাবনা নাই—কাশীবাসের বাবদে প্রার্থনা জানালে শ’খানেক টাকা পেতে পারবে।
ষোড়শী। প্রার্থনা জানাতে হবে বোধ করি হুজুরের কাছে?
সাগর। বোধ হয় তাই।
ষোড়শী। আচ্ছা, জমিজমা যাদের সমস্ত গেল, তাদের উপায় কি স্থির হলো?
সাগর। ভয় নেই মা, চিরকাল ধরে যা হয়ে আসচে তার অন্যথা হবে না।
ষোড়শী। আর তোদের?
সাগর। আমাদের খুড়ো-ভাইপোর? (একটু হাসিয়া) সে ব্যবস্থাও রায়মশায় করেছেন, নিতান্ত চুপ করে বসেছিলেন না। পাকা লোক, দারোগা পুলিশ মুঠোর মধ্যে, কোশ-দশেকের মধ্যে একটা ডাকাতি হতে যা দেরি।
ষোড়শী। (ভয় পাইয়া) হাঁরে, একি তোরা সত্যি বলে মনে করিস?
সাগর। মনে করি? এ ত চোখের উপর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মা। আমাদের জেলের বাইরে রাখতে পারে এ সাধ্য আর কারও নেই। (একটু থামিয়া) তা বলে যাদের জেল হবে না তাদের দুর্ভাগ্য কিছু কম নয় মা।
ষোড়শী। কেন রে?
সাগর। তাদের অবস্থা আমাদের চেয়েও মন্দ। জেলের মধ্যে খেতে দেয়, যা হোক আমরা দুটো খেতে পাব, কিন্তু এরা তাও পাবে না। রায়মশায়ের কাছে ধার করে জমিদারের সেলামি জুগিয়েছে, সেই খতগুলো সব ডিক্রি হতে যা বিলম্ব, তার পরে তাঁর নিজ জোতে জন খেটে দুমুঠো জোটে ভালো, না হয়—
ষোড়শী। না হয় কি?
সাগর। না হয় আসামের চা-বাগান আছেই। কেন মা, তোমারই কি মনে পড়ে না ওই বেলডাঙাটায় আগে আমাদের কত ঘর ভূমিজ বাউরির বস্তি ছিল?
ষোড়শী। (ঘাড় নাড়িয়া) পড়ে!
সাগর। আজ তারা কোথায়? কতক গেল কয়লা খুঁড়তে, কতক গেল চালান হয়ে চা-বাগানে। কিন্তু আমি দেখেচি ছেলেবেলায় তাদের জমিজমা, হাল-বলদ দু’মুঠো ধানের সংস্থান তাদের সবাইয়ের ছিল। আজ তাদের অর্ধেক এককড়ি নন্দীর, অর্ধেক রায়মশায়ের।
ষোড়শী। (স্তব্ধ থাকিয়া) আচ্ছা, সাগর, এ-সব তুই শুনলি কার মুখে?
সাগর। স্বয়ং হুজুরের মুখেই।
ষোড়শী। তা হলে এ-সকল তাঁরই মতলব?
সাগর। (চিন্তা করিয়া) কি জানি মা, কিন্তু মনে হয় রায়মশায়ও আছেন।
ষোড়শী। এ ত গেল তাদের কথা সাগর। কিন্তু আমি ত একা। জমিদার ইচ্ছে করলে ত আমারও প্রতি অত্যাচার করতে পারেন?
সাগর। তা জানিনে মা, শুধু জানি তুমি একা নও। (ক্ষণকাল নিঃশব্দে থাকিয়া) মা, আমাদের নিজের পরিচয় নিজে দিতে নেই, গুরুর নিষেধ আছে (বংশদণ্ড সজোরে মুষ্টিবদ্ধ করিয়া)—হরিহর সর্দারের ভাইপো সাগরের নাম দশ-বিশ ক্রোশের লোকে জানে—তোমার উপর অত্যাচার করবার মানুষ ত মা পঞ্চাশখানা গ্রামে কেউ খুঁজে পাবে না।
ষোড়শী। (দুই চক্ষু অকস্মাৎ জ্বলিয়া উঠিল) সাগর, এ কি সত্যি?
সাগর। (তৎক্ষণাৎ হেঁট হইয়া হাতের লাঠি ষোড়শীর পায়ের কাছে রাখিয়া) বেশ ত মা, সেই আশীর্বাদই কর না, যেন কথা আমার মিথ্যে না হয়।
ষোড়শী। (চোখের দৃষ্টি একবার একটুখানি কোমল হইয়া আবার তেমনি জ্বলিতে লাগিল) আচ্ছা সাগর, আমি ত শুনেচি তোদের প্রাণের ভয় করতে নেই?
সাগর। (সহাস্যে) মিথ্যে শুনেচ তাও ত আমি বলচি নে মা।
ষোড়শী। কেবল প্রাণ দিতেই পারিস, আর নিতে পারিস নে?
সাগর। পারিনে? এই আদেশের জন্য কত ভিক্ষেই না চাইলাম, কিন্তু কিছুতেই যে হুকুমটুকু তোমার মুখ থেকে বার করতে পারলাম না মা।
ষোড়শী। না সাগর, না। অমন কথা তোরা মুখেও আনিস নে বাবা।
সাগর। কিন্তু মন থেকে যে কথাটা তাড়াতে পারচি নে মা!
[পূজারী প্রবেশ করিল]
পূজারী। মন্দিরের দোর বন্ধ করে এলাম মা।
ষোড়শী। চাবি?
পূজারী। এই যে মা। (চাবির গোছা হাতে দিয়া) রাত হলো এখন তা হলে আসি?
ষোড়শী। এস, বাবা।
[পূজারীর প্রস্থান
ষোড়শী। সাগর, ফকিরসাহেব চলে গেছেন। তিনি কোথায় আছেন, খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাতে পারিস বাবা?
সাগর। কেন মা?
ষোড়শী। তাঁকে আমার বড় প্রয়োজন। তোরা ছাড়া তাঁর চেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী আমার কেউ নেই।
সাগর। কিন্তু তোমার কাছেই ত কতবার শুনেছি তিনি সাধুপুরুষ। যেখানেই থাকুন তাঁকে যথার্থ মন দিয়ে ডাকলেই এসে উপস্থিত হন।
ষোড়শী। (চমকিয়া) তাই ত সাগর, এতবড় কথাটা আমি কি করে ভুলেছিলাম! আর আমার চিন্তা নেই, আমার এতবড় দুঃসময়ে তিনি না এসে কিছুতেই পারবেন না।
সাগর। আমারও বিশ্বাস তাই। কিন্তু কথায় কথায় রাত্রি অনেক হলো মা, তুমি বিশ্রাম কর, আসি?
ষোড়শী। এসো।
সাগর। (ঈষৎ হাসিয়া) ভয় নেই মা, সাগর তোমাকে একলা রেখে কোথাও বেশীক্ষণ থাকবে না।
[প্রস্থান
[তখন পর্যন্ত ষোড়শীর আহ্নিক প্রভৃতি নিত্যকার্য সমাধা হয় নাই, সে এই আয়োজনে ব্যাপৃত থাকিয়া]
ষোড়শী। সাগর আমাকে কতবড় কথাই না স্মরণ করিয়ে দিলে। ফকির-সাহেব! যেখানে থাকুন, এ বিপদে আপনার দেখা আমি পাবোই পাব।
নেপথ্যে। আসতে পারি কি?
ষোড়শী। (সচকিত উঠিয়া দাঁড়াইয়া ব্যাকুল-কণ্ঠে) আসুন, আসুন—আমি যে সমস্ত মন দিয়ে শুধু আপনাকেই ডাকছিলাম!
[জীবানন্দ প্রবেশ করিলেন]
জীবানন্দ। এতবড় পতিভক্তি কলিকালে দুর্লভ। আমার পাদ্য অর্ঘ্য আসনাদি কৈ?
ষোড়শী। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া, সভয়ে) আপনি? আপনি এসেছেন কেন?
জীবানন্দ। তোমাকে দেখতে। একটু ভয় পেয়েছ বোধ হচ্ছে। পাবারই কথা। কিন্তু চেঁচিও না। সঙ্গে পিস্তল আছে, তোমার ডাকাতের দল শুধু মারাই পড়বে, আর বিশেষ কিছু করতে পারবে না।
[ষোড়শী নির্বাক হইয়া রহিল]
জীবানন্দ। তবু, দোরটা বন্ধ করে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া যাক। কি বল?
[এই বলিয়া জীবানন্দ অগ্রসর হইয়া দ্বার অর্গলবদ্ধ করিয়া দিলেন]
ষোড়শী। (ভয়ে কণ্ঠস্বর তাহার কাঁপিতেছিল) সাগর নেই—
জীবানন্দ। নেই? ব্যাটা গেল কোথায়?
ষোড়শী। আপনারা জানেন বলেই ত—
জীবানন্দ। জানি বলে? কিন্তু আপনারা কারা? আমি ত বাষ্পও জানতাম না।
ষোড়শী। নিরাশ্রয় বলেই ত লোক নিয়ে আমার প্রতি অত্যাচার করতে এসেছেন? কিন্তু আপনার কি করেছি আমি?
জীবানন্দ। লোক নিয়ে অত্যাচার করতে এসেছি? তোমার প্রতি? মাইরি না! বরঞ্চ মন কেমন করছিল বলে ছুটে দেখতে এসেছি।
[ষোড়শীর চোখে জল আসিতেছিল, এই উপহাসে তাহা একেবারে শুকাইয়া গেল। জীবানন্দ অদূরে বসিয়া তাহার আনত মুখের প্রতি লুব্ধ তৃষিত চক্ষে চাহিয়া রহিলেন]
জীবানন্দ। অলকা?
ষোড়শী। বলুন।
জীবানন্দ। তোমার এখানে তামাক-টামাকের ব্যবস্থা নেই বুঝি?
[ষোড়শী একবার মুখ তুলিয়াই অধোমুখে স্থির হইয়া রহিল]
জীবানন্দ। (দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া) ব্রজেশ্বরের কপাল ভাল ছিল। দেবীরানী তাকে ধরিয়ে আনিয়েছিল সত্যি, কিন্তু অম্বুরী তামাকও খাইয়েছিল, এবং ভোজনান্তে দক্ষিণাও দিয়েছিল। বিদায়ের পালাটা আর তুলব না, বলি বঙ্কিমবাবুর বইখানা পড়েছ ত?
ষোড়শী। আপনাকে ধরে আনলে সেইমত ব্যবস্থাও থাকত—অনুযোগ করতে হত না।
জীবানন্দ। (হাসিয়া) তা বটে। টানা-হেঁচড়া দড়িদড়ার বাঁধাবাঁধিই মানুষের নজরে পড়ে। ভোজপুরী পেয়াদা পাঠিয়ে ধরে আনাটাই পাড়াসুদ্ধ সকলেই দেখে; কিন্তু যে পেয়াদাটিকে চোখে দেখা যায় না—হাঁ অলকা, তোমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে তাঁকে কি বলে? অতনু, না? বেশ তিনি। (ক্ষণেক নীরব থাকিয়া) যৎসামান্য অনুরোধ ছিল; কিন্তু আজ উঠি। তোমার অনুচরগুলো সন্ধান পেলেই জামাই আদর করবে না। এমন কি শ্বশুরবাড়ি এসেছি বলে হয়ত বিশ্বাস করতেই চাইবে না—ভাববে প্রাণের দায়ে বুঝি মিথ্যেই বলচি।
[লজ্জায় ষোড়শী আরও অবনত হইল]
জীবানন্দ। তামাকের ধুঁয়া আপাততঃ পেটে না গেলেও চলত, কিন্তু ধুঁয়া নয় এমন কিছু একটা পেটে না গেলে আর ত দাঁড়াতে পারিনে। বাস্তবিক, নেই কিছু অলকা?
ষোড়শী। কিছু কি? মদ?
জীবানন্দ। (হাসিয়া মাথা নাড়িয়া) এবারে ভুল হলো। ওর জন্যে অন্য লোক আছে, সে তুমি নয়। তোমাকে বুঝতে পারার যথেষ্ট সুবিধে দিয়েছ—আর যা অপবাদ দিই, অস্পষ্টতার অপবাদ দিতে পারব না। অতএব তোমার কাছে যদি চাইতেই হয়, চাই এমন কিছু যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, মরণের পথে ঠেলে দেয় না। ডাল, ভাত, মেঠাইমণ্ডা, চিঁড়ে, মুড়ি যা হোক দাও, আমি খেয়ে বাঁচি। নেই?
[ষোড়শী নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া রহিল]
জীবানন্দ। আজ সকালে মন ভাল ছিল না। শরীরের কথা তোলা বিড়ম্বনা, কারণ সুস্থদেহ যে কি আমি জানিনে। সকালে হঠাৎ নদীর তীরে বেরিয়ে পড়লাম, কত যে হাঁটলাম বলতে পারিনে—ফিরতে ইচ্ছেও হলো না। সূর্যদেব অস্ত গেলেন, একলা জলের ধারে দাঁড়িয়ে কি যে ভাল লাগল বলতে পারিনে। কেবল তোমাকে মনে পড়তে লাগল। মনে পড়ল আমার কাছারি-বাড়িতে এতক্ষণে লোক জমেছে—তোমাকে নির্বাসনে পাঠাবার ব্যবস্থাটা আজ শেষ করাই চাই। ফিরে এসে সভায় যোগ দিলাম, কিন্তু টিকতে পারলাম না। একটা ছুতো করে পালিয়ে এসে দাঁড়ালাম ওই মনসা গাছটার পিছনে।
ষোড়শী। তার পরে?
জীবানন্দ। দেখি দাঁড়িয়ে সাগর সর্দার এবং তুমি। আলাপ-আলোচনা সমস্তই কানে গেল, তাৎপর্য গ্রহণ করতেও বিলম্ব হলো না। ভাবলাম, আমাদের মত সাধু ব্যক্তিরা যে এ-হেন নির্বোধ ভৈরবীকে দূর করে দিতে চেয়েছে সে ঠিকই হয়েছে। সে-রাত্রি বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ পেয়াদা হাতকড়া নিয়ে হাজির, সামান্য একটা মুখের কথার জন্য স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পর্যন্ত কি পীড়াপীড়ি—আর তুমি বললে কিনা আমি নিজের ইচ্ছায় এসেছি। আর ছোট্ট একটুখানি হুকুমের জন্যে সাগরচাঁদের কত অনুনয়-বিনয়, কি সাধাসাধি—আর তুমি বলে বসলে কিনা অমন কথা মুখেও আনিস নে বাবা। অভিমানে বাবাজীবন মুখখানি ম্লান করে চলে গেলেন সে ত স্বচক্ষেই দেখলাম। মনে মনে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বললাম, জয় মা চণ্ডীগড়ের চণ্ডী! তোমার এই অধম সন্তানের প্রতি এত কৃপা না থাকলে কি আর এই মেয়েমানুষটির বার বার এমন করে বুদ্ধি লোপ কর! এখন একবার একে বিদায় করে আমাকে তক্তে বসাও মা, জনার্দন আর এককড়ি, এই দুই তাল-বেতালকে সঙ্গে নিয়ে আমি এমনি সেবা তোমার শুরু করে দেব যে, একদিনের পূজোর চোটে তোমার মাটির মূর্তি আহ্লাদে একেবারে পাথর হয়ে যাবে। কিন্তু ভক্তি-তত্ত্বের এ-সব বড় বড় কথা না হয় পরে ভাবা যাবে, কিন্তু এখন ক্ষিদের জ্বালায় যে আর দাঁড়াতে পারিনে। বাস্তবিক নেই কিছু অলকা?
ষোড়শী। কিন্তু বাড়ি গিয়ে ত অনায়াসে খেতে পারবেন।
জীবানন্দ। অর্থাৎ, আমার বাড়ির খবর আমার চেয়ে তুমি বেশি জানো। (এই বলিয়া সে একটুখানি হাসিল)
ষোড়শী। আপনি সারাদিন খাননি, আর বাড়িতে আপনার খাবার ব্যবস্থা নেই, এ কি কখনো হতে পারে?
জীবানন্দ। না পারবে কেন? আমি খাইনি বলে আর একজন উপোস করে থালা সাজিয়ে পথ চেয়ে থাকবে এ ব্যবস্থা ত করে রাখিনি। আজ খামকা রাগ করলে চলবে কেন অলকা? (বলিয়া সে তেমনি মৃদু হাসিল) আমার যে শান্তিময় জীবনযাত্রা সেদিন চোখে দেখে এসেছ সে বোধ হয় ভুলে গেছ। আজ তা হলে আসি?
ষোড়শী। (ব্যাকুল-কণ্ঠে) দেবীর সামান্য একটু প্রসাদ আছে, কিন্তু সে কি আপনি খেতে পারবেন?
জীবানন্দ। খুব পারব। কিন্তু সামান্য একটু প্রসাদ। কিন্তু সে ত নিশ্চয় তোমার নিজের জন্যে আনা অলকা?
ষোড়শী। নইলে কি আপনার জন্যে রেখেছি এই আপনি মনে করেন?
জীবানন্দ। (হাসিমুখে) না, তা করিনে, কিন্তু ভাবচি, তোমাকে ত বঞ্চিত করা হবে।
ষোড়শী। সে ভাবনার প্রয়োজন নেই। আমাকে বঞ্চিত করায় আপনার নূতন অপরাধ কিছু হবে না।
জীবানন্দ। না, অপরাধ আর আমার হয় না। একেবারে তার নাগালের বাইরে চলে গেছি। কিন্তু হঠাৎ একটা অদ্ভুত খেয়াল মনে উঠেছে অলকা, যদি না হাসো ত তোমাকে বলি।
ষোড়শী। বলুন।
জীবানন্দ। কি জানো, মনে হয়, হয়ত আজও বাঁচতে পারি, হয়ত আজও মানুষের মত—কিন্তু এমন কেউ নেই যে আমার—কিন্তু তুমিই পারো শুধু এই পাপিষ্ঠের ভার নিতে—নেবে অলকা?
ষোড়শী। কি বলচেন?
জীবানন্দ। (আত্মসমর্পণের আশ্চর্য কণ্ঠস্বরে) বলচি আমার সমস্ত ভার তুমি নাও অলকা।
ষোড়শী। (চমকিয়া, একমুহূর্ত থামিয়া) অর্থাৎ আমার যে কলঙ্কের বিচার করছেন, আমাকে দিয়ে তাকেই প্রতিষ্ঠিত করিয়ে নিতে চান। আমার মাকে ঠকাতে পেরেছিলেন, কিন্তু আমাকে পারবেন না।
জীবানন্দ। কিন্তু সে চেষ্টা ত আমি করিনি। তোমার বিচার করেচি, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। কেবলি মনে হয়েছে, এই কঠোর আশ্চর্য রমণীকে অভিভূত করেছেন সে মানুষটি কে?
ষোড়শী। (আশ্চর্য হইয়া) তারা আপনার কাছে তার নাম বলেনি?
জীবানন্দ। না। আমি বার বার জিজ্ঞাসা করেচি, তারা বার বার চুপ করে গেছে। যাক, এবার আমি যাই; কি বল?
ষোড়শী। কিন্তু আপনার যে কি কাজের কথা ছিল?
জীবানন্দ। কাজের কথা? কিন্তু কি যে ছিল আমার আর মনে পড়চে না। শুধু এই কথাই মনে পড়চে, তোমার সঙ্গে কথা কহাই আমার কাজ। অলকা, তোমার কি সত্যিই আবার বিয়ে হয়েছিল?
ষোড়শী। আবার কিরকম? সত্যি বিয়ে আমার একবার মাত্রই হয়েছে।
জীবানন্দ। আর তোমার মা যে তোমাকে আমাকে দিয়েছিলেন সেটাই কি সত্যি নয়?
ষোড়শী। না, সে সত্যি নয়। মা আমার সঙ্গে যে টাকাটা দিয়েছিলেন আপনি তাই শুধু নিয়েছিলেন, আমাকে নেননি। ঠকানো ছাড়া তার মধ্যে লেশমাত্র সত্য কোথাও ছিল না।
জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্নের মত বসিয়া; যেন কতদূর হইতে কথা কহিল) অলকা, এ কথা তোমার সত্য নয়।
ষোড়শী। কোন্ কথা?
জীবানন্দ। তুমি যা জেনে রেখেচ। ভেবেছিলাম সে কাহিনী কখনো কাউকে বলব না, কিন্তু সেই কাউকের মধ্যে আজ তোমাকে ফেলতে পারচি নে! তোমার মাকে ঠকিয়েছিলাম, কিন্তু ভগবান তোমাকে ঠকাবার সুযোগ আমাকে দেননি। আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
ষোড়শী। বলুন?
জীবানন্দ। আমি সত্যবাদী নই; কিন্তু আজকের কথা আমার তুমি বিশ্বাস কর। তোমার মাকে আমি জানতাম, তাঁর মেয়েকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করবার মতলব আমার ছিল না—ছিল কেবল তাঁর টাকাটাই লক্ষ্য। কিন্তু সে রাত্রে হাতে হাতে তোমাকে যখন পেলাম, তখন না বলে ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেও আর হলো না।।
ষোড়শী। তবে কি ইচ্ছে হলো?
জীবানন্দ। থাক, সে তুমি আর শুনতে চেয়ো না। হয়ত শেষ পর্যন্ত শুনলে আপনিই বুঝবে, এবং সে বোঝায় ক্ষতি বৈ লাভ আমার হবে না। কিন্তু এরা তোমাকে যা বুঝিয়েছিল তা তাই নয়, আমি তোমাকে ফেলে পালাই নি।
ষোড়শী। আপনার না পালানোর ইতিবৃত্ত এখন ব্যক্ত করুন।
জীবানন্দ। আমি নির্বোধ নই, যদি ব্যক্তই করি, তার সমস্ত ফলাফল জেনেই করব। তোমার মায়ের এতবড় ভয়ানক প্রস্তাবেও কেন রাজি হয়েছিলাম জানো? একজন স্ত্রীলোকের হার আমি চুরি করি; ভেবেছিলাম টাকা দিয়ে তাকে শান্ত করব। সে শান্ত হলো, কিন্তু পুলিশের ওয়ারেন্ট শান্ত হলো না। ছ’মাস জেলে গেলাম—সেই যে শেষ রাত্রে বার হয়েছিলাম, আর ফেরবার অবকাশ হলো না।
ষোড়শী। (রুদ্ধ-নিশ্বাসে) তার পরে?
জীবানন্দ। (মৃদু হাসিয়া) তার পরেও মন্দ নয়। জীবানন্দবাবুর নামে আরও একটা ওয়ারেন্ট ছিল। মাস-কয়েক পূর্বে রেলগাড়িতে একজন বন্ধু সহযাত্রীর ব্যাগ নিয়ে তিনি অন্তর্হিত হন। অতএব আরও দেড় বৎসর। একুনে বছর-দুই নিরুদ্দেশের পর বীজগাঁয়ের ভাবী জমিদারবাবু যখন রঙ্গমঞ্চে পুনঃপ্রবেশ করলেন, তখন কোথায় বা অলকা আর কোথার বা তার মা! (দু’জনেই ক্ষণিক নিস্তব্ধ হইয়া রহিল) আর একবার সভায় যেতে হবে। অলকা, আসি তা হলে!
ষোড়শী। সভায় আপনার অনেক কাজ, না গেলেই নয়। কিন্তু কিছু না খেয়েও ত যেতে পারবেন না।
জীবানন্দ। পারব না? তা হলে আনো। কিন্তু মস্ত বদ অভ্যেস আমার, খেয়ে আর নড়তে পারিনে।
ষোড়শী। না পারেন এখানেই বিশ্রাম করবেন।
জীবানন্দ। বিশ্রাম করব! যদি ঘুমিয়ে পড়ি অলকা?
ষোড়শী। (হাসিয়া) সে সম্ভাবনা ত রইলই। কিন্তু পালাবেন না যেন! আমি খাবার নিয়ে আসি।
[প্রস্থান
[গৃহকোণে একখানা পত্রের খণ্ডাংশ পড়িয়া ছিল, জীবানন্দের দৃষ্টি পড়িতেই তাহা সে তুলিয়া লইয়া দীপালোকে পড়িয়া ফেলিল। তাহার মুহূর্তকাল পূর্বের সরস ও প্রফুল্ল মুখের চেহারা গম্ভীর ও অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিল। ষোড়শী খাবারের পাত্র লইয়া প্রবেশ করিল। তাহার মনে পড়িল ঠাঁই করা হয় নাই, তাই সে পাত্রটি তাড়াতাড়ি একধারে রাখিয়া আসনের অভাবে কম্বলই পুরু করিয়া পাতিল এবং নিজের একখানি বস্ত্র পাট করিয়া দিতেছিল, এমনি সময়ে জীবানন্দ কথা কহিলেন।]
জীবানন্দ। ও কি হচ্ছে?
ষোড়শী। আপনার ঠাঁই করচি। শুধু কম্বলটা ফুটবে।
জীবানন্দ। ফুটবে, কিন্তু আতিশয্যটা ঢের বেশী ফুটবে। যত্ন জিনিসটায় মিষ্টি আছে সত্যি, কিন্তু তার ভান করাটায় না আছে মধু, না আছে স্বাদ। ওটা বরঞ্চ আর কাউকে দিয়ো।
[কথা শুনিয়া ষোড়শী বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল]
জীবানন্দ। (হাতের কাগজ দেখাইয়া) ছেঁড়া চিঠি—সবটুকু নেই। যাঁকে লিখেছিলে তাঁর নামটি শুনতে পাইনে?
ষোড়শী। কার নাম?
জীবানন্দ। যিনি দৈত্য-বধের জন্য চণ্ডীগড়ে অবতীর্ণ হবেন, যিনি দ্রৌপদীর সখা—আর বলবো?
[এই ব্যঙ্গোক্তির ষোড়শী উত্তর দিতে পারিল না, কিন্তু তাহার চোখের উপর হইতে ক্ষণকাল পূর্বের মোহের যবনিকা খানখান হইয়া ছিঁড়িয়া গেল]
জীবানন্দ। এই আহ্বান-লিপির প্রতি ছত্রটি যাঁর কর্ণে অমৃত বর্ষণ করবে তাঁর নামটি?
ষোড়শী। (আপনাকে সংযত করিয়া লইয়া) তাঁর নামে আপনার প্রয়োজন?
জীবানন্দ। প্রয়োজন আছে বৈ কি। পূর্বাহ্নে জানতে পারলে হয়ত আত্মরক্ষার একটা উপায় করতে পারি।
ষোড়শী। আত্মরক্ষার প্রয়োজন ত একা আপনারই নয় চৌধুরীমশায়। আমারও ত থাকতে পারে।
জীবানন্দ। পারে বৈ কি!
ষোড়শী। তা হলে সে নাম আপনি শুনতে পাবেন না। কারণ, আমার ও আপনার একই সঙ্গে রক্ষা পাবার উপায় নেই।
জীবানন্দ। বেশ, তা যদি না থাকে রক্ষা পাওয়াটা আমারই দরকার এবং তাতে লেশমাত্র ত্রুটি হবে না জেনো। (ষোড়শী নিরুত্তর) তুমি জবাব না দিতে পারো, কিন্তু তোমার এই বীরপুরুষটির নাম যে আমি জানিনে তা নয়।
ষোড়শী। জানবেন বৈ কি। পৃথিবীর বীরপুরুষদের মধ্যে পরিচয় থাকবারই ত কথা।
জীবানন্দ। সে ঠিক। কিন্তু এই কাপুরুষকে বার বার অপমান করার ভারটা তোমার বীরপুরুষটি সইতে পারলে হয়। যাক, এ চিঠি ছিঁড়লে কেন?
ষোড়শী। এর জবাব আমি দেব না। জীবানন্দ। কিন্তু সোজা নির্মল সাহেবকে না লিখে তাঁর স্ত্রীকে লেখা কেন? এ শব্দভেদী বাণ কি তাঁরই শেখানো নাকি?
ষোড়শী। তার পরে?
জীবানন্দ। তার পরে আজ আমার সন্দেহ গেল। বন্ধুর সংবাদ আমি অপরের কাছে শুনেচি, কিন্তু রায়মশায়কে যতই প্রশ্ন করেচি, ততই তিনি চুপ করে গেলেন। আজ বোঝা গেল তাঁর আক্রোশটাই সবচেয়ে কেন বেশি।
ষোড়শী। (সচকিত) নির্মলের সম্বন্ধে আপনি কি শুনেছেন?
জীবানন্দ। সমস্তই। তোমার চমক আর গলার মিঠে আওয়াজে আমার হাসি পাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হাসতে পারলাম না—আমার আনন্দ করবার এ কথা নয়। সেই ঝড়-জল অন্ধকার রাত্রে একাকী তার হাত ধরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া মনে পড়ে? তার সাক্ষী আছে। সাক্ষী ব্যাটারা যে কোথায় লুকিয়ে থাকে আগে থেকে কিছুই জানবার জো নেই। আমি যখন গাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে পালাই, ভেবেছিলাম কেউ দেখেনি।
ষোড়শী। যদি সত্যই তাই করে থাকি সে কি এতবড় দোষের?
জীবানন্দ। কিন্তু গোপন করার চেষ্টাটা? এই চিঠির টুকরোটা? নিজেই একবার পড়ে দেখ ত কি মনে হয়? আমার মত ইনিও একবার তোমার বিচার করতে বসেছিলেন না?
দেখচি, তোমার বিচার করবার বিপদ আছে। (এই বলিয়া জীবানন্দ মুচকিয়া হাসিল। ষোড়শী নিরুত্তর) এ আমি সঙ্গে নিয়ে চললাম, আবশ্যক হলে যথাস্থানে পৌঁছে দেবার ত্রুটি হবে না। এই ক’টা ছত্র আমার পুরুষের চোখকেই যখন ফাঁকি দিতে পারেনি, তখন আশা করি হৈমকেও ঠকাতে পারবে না।
[ষোড়শী নিরুত্তর]
জীবানন্দ। কেমন, অনেক কথাই জানি?
ষোড়শী। হাঁ।
জীবানন্দ। এ-সব তবে সত্যি বল?
ষোড়শী। হাঁ, সত্যি।
জীবানন্দ। (আহত হইয়া) ওঃ—সত্যি! (স্তিমিত দীপশিখাটা উজ্জ্বল করিয়া দিয়া ষোড়শীর মুখের প্রতি তীক্ষ্ণচক্ষে চাহিয়া) এখন তাহলে তুমি কি করবে মনে কর?
ষোড়শী। কি আমাকে আপনি করতে বলেন?
জীবানন্দ। তোমাকে? (ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া, দীপশিখা পুনরায় উজ্জ্বল করিয়া দিয়া) তা হলে এঁরা সকলে যে তোমাকে অসতী বলে—
ষোড়শী। এঁদের বিরুদ্ধে আপনার কাছে ত আমি নালিশ জানাই নি। আমাকে কি করতে হবে তাই বলুন। কারণ দেখাবার প্রয়োজন নেই।
জীবানন্দ। তা বটে। কিন্তু সবাই মিথ্যা কথা বলে, আর তুমি একাই সত্যবাদী এই কি আমাকে তুমি বোঝাতে চাও অলকা?
[ষোড়শী নিরুত্তর]
জীবানন্দ। একটা উত্তর দিতেও চাও না?
ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না।
জীবানন্দ। অর্থাৎ আমার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার চেয়ে দুর্নামও ভালো। বেশ, সমস্তই স্পষ্ট বোঝা গেছে! (এই বলিয়া তিনি ব্যঙ্গ করিয়া হাসিলেন)
ষোড়শী। স্পষ্ট বোঝা যাবার পরে কি করতে হবে তাই শুধু বলুন!
[তাহার এই উত্তরে জীবানন্দের ক্রোধ ও অধৈর্য শতগুণে বাড়িয়া গেল]
জীবানন্দ। কি করতে হবে সে তুমি জানো, কিন্তু আমাকে দেবমন্দিরের পবিত্রতা বাঁচাতেই হবে। এর যথার্থ অভিভাবক তুমি নয়, আমি। পূর্বে কি হতো জানিনে, কিন্তু এখন থেকে ভৈরবীকে ভৈরবীর মতই থাকতে হবে, না হয় তাকে যেতে হবে।
ষোড়শী। বেশ তাই হবে। যথার্থ অভিভাবক কে সে নিয়ে আমি বিবাদ করব না। আপনারা যদি মনে করেন আমি গেলে মন্দিরের ভালো হবে আমি যাব।
জীবানন্দ। তুমি যে যাবে সে ঠিক। কারণ, যাতে যাও সে আমি দেখব।
ষোড়শী। কেন রাগ করচেন, আমি ত সত্যিই যেতে চাচ্চি। কিন্তু আপনার ওপর এই ভার রইল যেন মন্দিরের যথার্থই ভাল হয়।
জীবানন্দ। কবে যাবে?
ষোড়শী। যখনই আদেশ করবেন। কাল, আজ, এখন—
জীবানন্দ। কিন্তু নির্মলবাবু? জামাইসাহেব?
ষোড়শী। (কাতর-কণ্ঠে) তাঁর নাম আর করবেন না।
জীবানন্দ। আমার মুখে তাঁর নামটা পর্যন্ত তোমার সহ্য হয় না। ভাল। কিন্তু কি তোমাকে দিতে হবে?
ষোড়শী। কিছুই না।
জীবানন্দ। এ ঘরখানা পর্যন্ত ছাড়তে হবে জানো? এও দেবীর।
ষোড়শী। জানি। যদি পারি, কালই ছেড়ে দেব।
জীবানন্দ। কোথায় যাবে ঠিক করেছ?
ষোড়শী। এখানে থাকব না, এর বেশি কিছুই ঠিক করিনি। একদিন কিছু না জেনেই আমি ভৈরবী হয়েছিলাম, আজ বিদায় নেওয়ার বেলাতেও এর বেশি ভাবব না। আপনি দেশের জমিদার, চণ্ডীগড়ের ভালোমন্দের ভার আপনার পরে রেখে যেতে শেষ সময়ে আর আমি দ্বিধা করব না। কিন্তু আমার বাবা ভারী দুর্বল, তাঁর উপরে নির্ভর করে যেন আপনি নিশ্চিন্ত হবেন না।
জীবানন্দ। তুমি কি সত্যিই চলে যেতে চাও নাকি?
ষোড়শী। আর আমার দুঃখী দরিদ্র ভূমিজ প্রজারা। একদিন তাদের সমস্তই ছিল—আজ তাদের মত নিঃস্ব নিরুপায় আর কেউ নেই। ডাকাত বলে বিনাদোষে লোকে তাদের জেল দিয়েছে। এদের সুখ-দুঃখের ভারও আমি আপনাকেই দিয়ে গেলাম।
জীবানন্দ। আচ্ছা, তা হবে হবে। কি তারা চায় বল ত?
ষোড়শী। সে তারাই আপনাকে জানাবে।
[এই বলিয়া সে সহসা জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দড়ির আলনা হইতে গামছা ও কাপড় হাতে লইল]
ষোড়শী। আমার স্নান করতে যাবার সময় হলো।
জীবানন্দ। স্নানের সময়? এই রাত্রে?
ষোড়শী। রাত আর নেই—এবার আপনি বাড়ি যান। (এই বলিয়া সে যাইতে উদ্যত হইল)
জীবানন্দ। (ব্যগ্রকণ্ঠে) কিন্তু আমার সকল কথাই যে বাকী রয়ে গেল?
ষোড়শী। থাক, আপনি বাড়ি যান।
জীবানন্দ। না। কোথায় যেন আমার মস্ত ভুল হয়ে গেছে অলকা, কথা আমার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি—
ষোড়শী। না সে হবে না, আপনি বাড়ি যান। আমার বহু ক্ষতিই করেছেন, এ জীবনের শেষ সর্বনাশ করতে আর আপনাকে দেব না।
জীবানন্দ। আচ্ছা, আমি চললাম অলকা।
[প্রস্থান]
ষোড়শী – ২.২
দ্বিতীয় দৃশ্য
চণ্ডীগড় গ্রাম—গাজনের সঙ
গীত (১)
বড় প্যাঁচে পড়েছে এবার ভোলা দিগম্বর।
অভিমানী উমারানী বলেনি তায় প্রাণেশ্বর।।
অনেকদিনের পরে এবার এল শ্বশুরবাড়ি।
ভেবেছিল আসবে গৌরী পরে পাটের শাড়ী।।
চাঁদ-বদনে কইবে কথা
ঘুচবে ভোলার প্রাণের ব্যথা
কোন কথা না বলে সে পালিয়ে এল ছেড়ে ঘর।
ভাবের ঘোরে ছিল অচেতন
ভেবে চিন্তে পেল নাকো হলো এ কেমন—
এবার শান্ত-শিষ্ট গৃহবাসী
করবে তোমায় হে সন্ন্যাসী
জটা বাকল ছাড়িয়ে নিয়ে সাজিয়ে দেবে প্রেমের বর।।
গীত (২)
বৌ নিতে এসেছে এবার আপনি মহেশ্বর।
তুই নাকি সই বলেছিলি
করবি না আর স্বামীর ঘর।।
পাঁচ বছরে করে পঞ্চতপা
তোর হাতে তোর মা-জননী সঁপেছেন ক্ষ্যাপা,
বাঁধতে যদি পারিস নি তায়,
তাই বলে কি হবে সে পর?
(তাই বলে পর হয়ে কি যায়)
একবার নাকি গিয়েছিল কুচুনী পাড়ায়
সত্যি কথা তোর কাছে সই যদিই সে ভাঁড়ায়।
ফেলার জিনিস নয় ত সে তোর বোন
ধুয়ে পুঁছে তুল গে যা তারে ঘর।।
ষোড়শী – ২.৩
তৃতীয় দৃশ্য
ষোড়শীর কুটীর
[নির্মলের প্রবেশ]
ষোড়শী। এ কি, এই রাত্রে শেষে অকস্মাৎ আপনি যে নিমর্লবাবু?
[নির্মল নিরুত্তর]
(হাসিয়া) ওঃ—বুঝেচি। যাবার পূর্বে লুকিয়ে বুঝি একবার দেখে যেতে এলেন?
নির্মল। আপনি কি অন্তর্যামী?
ষোড়শী। তা নইলে কি ভৈরবীগিরি করা যায় নির্মলবাবু? কিন্তু এখানটায় তেমন আলো নেই, আসুন, আমার ঘরের মধ্যে গিয়ে বসবেন চলুন।
নির্মল। রাত্রে একাকী আমাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে যেতে চান, আপনার সাহস ত কম নয়?
ষোড়শী। আর সে-রাত্রে অন্ধকারে যখন হাত ধরে নদী পার করে এনেছিলাম তখনি কি ভয়ের লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন নাকি? সেদিনও ত এমনি একাকী।
নির্মল। সত্যই আপনার সাহসের অবধি নেই।
ষোড়শী। অবধি থাকবে কি করে নির্মলবাবু, ভৈরবী যে! আসুন ঘরে।
নির্মল। না, ঘরে আর যাব না, আমাকে এখনি ফিরতে হবে।
ষোড়শী। তবে এইখানেই বসুন।
[উভয়ের উপবেশন]
ষোড়শী। আজ তা হলে চলে যাওয়াই স্থির?
নির্মল। না, আজ যাওয়া স্থগিত রইল। রাত্রে ফিরে গিয়ে শুনতে পেলাম আজ সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরের মধ্যে আপনার বিচার হবে। সে সভায় আমি উপস্থিত থাকতে চাই।
ষোড়শী। কিসের জন্যে? নিছক কৌতূহল, না আমাকে রক্ষে করতে চান?
নির্মল। প্রাণপণে চেষ্টা করব বটে।
ষোড়শী। যদি ক্ষতি হয়, কষ্ট হয়, শ্বশুরের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়, তবুও?
নির্মল। হাঁ, তবুও।
[ষোড়শী হাসিয়া ফেলিল]
(হাসিমুখে) আপনি হাসলেন যে বড়? বিশ্বাস হয় না?
ষোড়শী। হয়। কিন্তু হাসচি আর একটা কথা ভেবে। শুনি, আগেকার দিনে ভৈরবীরা নাকি বিদেশী মানুষদের ভেড়া বানিয়ে রাখত, আচ্ছা, ভেড়া নিয়ে তারা কি করত নির্মলবাবু? চরিয়ে বেড়াত, না লড়াই বাধিয়ে দিয়ে তামাশা দেখত? (বলিতে বলিতে ছেলেমানুষের মত উচ্ছ্বসিত হইয়া হাসিতে লাগিল)
নির্মল। (পরিহাসে যোগ দিয়া, নিজেও হাসিয়া) হয়ত বা মাঝে মাঝে মায়ের স্থানে বলি দিয়ে খেতো।
ষোড়শী। সে ত ভয়ের কথা নির্মলবাবু।
নির্মল। (সহাস্যে মাথা নাড়িয়া) ভয় একটু আছে বৈ কি!
ষোড়শী। একটু থাকা ভালো। হৈমকে সাবধান করে দেওয়া উচিত।
নির্মল। তার মানে?
ষোড়শী। মানে কি সব কথারই থাকে নাকি? (হাসিয়া) কুটুমের অভ্যর্থনা ত হলো। অবশ্য হাসি-খুশী দিয়ে যতটুকু পারি ততটুকু, —তার বেশী ত সম্বল নেই ভাই—এখন আসুন দুটো কাজের কথা কওয়া যাক।
নির্মল। বলুন।
ষোড়শী। (গম্ভীর হইয়া) দুটি লোক দেবতাকে বঞ্চিত করতে চায়। একটি রায়মশায় আর একটি জমিদার—
নির্মল। আর একটি আপনার বাবা।
ষোড়শী। বাবা? হাঁ, তিনিও বটে!
নির্মল। আমার শ্বশুরের কথা বুঝি, আপনার বাবার কথাও কতক বুঝতে পারি, কিন্তু পারিনে এই জমিদার প্রভুটিকে বুঝতে। তিনি কিসের জন্য আপনার শত্রুতা করচেন?
ষোড়শী। দেবীর অনেকখানি জমি তিনি নিজের বলে বিক্রি করে ফেলতে চান। কিন্তু আমি থাকতে ত কোনমতেই হবার জো নেই।
নির্মল। (সহাস্যে) সে আমি সামলাতে পারব।
ষোড়শী। কিন্তু আরও অনেক জিনিস আছে, যা আপনিও হয়ত সামলাতে পারবেন না।
নির্মল। কি সে-সব? একটা ত আপনার মিথ্যে দুর্নাম?
ষোড়শী। (শান্তস্বরে) সে আমি ভাবিনে। দুর্নাম সত্য হোক মিথ্যে হোক, তাই নিয়েই ত ভৈরবীর জীবন নির্মলবাবু। আমি এই কথাটাই তাঁদের বলতে চাই।
নির্মল। (সবিস্ময়ে) নিজের মুখ দিয়ে এ কথা যে স্বীকার করার সমান!
ষোড়শী। তা হবে।
নির্মল। কিন্তু ওরা যে বলে—অনেকেই বলে সে সময়ে, অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেটের আসার রাত্রে আপনার কোলের উপরেই নাকি—
ষোড়শী। তারা কি দেখেছিল নাকি? তা হবে, আমার ঠিক মনে নেই; যদি দেখে থাকে সে সত্যি। তাঁর সেদিন ভারী অসুখ, আমার কোলে মাথা রেখেই তিনি শুয়েছিলেন।
নির্মল। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) তার পরে?
ষোড়শী। কোনমতে দিন কেটে যাচ্ছে, কিন্তু সেদিন থেকেই কিছুতে আর মন বসাতে পারিনে, সবই যেন মিথ্যে বলে ঠেকেছে।
নির্মল। কি মিথ্যে?
ষোড়শী। সব। ধর্ম, কর্ম, ব্রত, উপবাস, দেবসেবা, এতদিনের যা-কিছু সমস্তই—
নির্মল। তবে কিসের জন্যে ভৈরবীর আসন রাখতে চান?
ষোড়শী। এমনিই। আর আপনি যদি বলেন এতে কাজ নেই—
নির্মল। না না, আমি কিছুই বলিনে। কিন্তু এখন আমি উঠলাম। আপনার হয়ত কত কাজ নষ্ট করলাম।
ষোড়শী। কুটুম্বের অভ্যর্থনা, বন্ধুর মর্যাদা রক্ষা করা, এ কি কাজ নয় নির্মলবাবু?
নির্মল। সকাল হলো, এখন আসি?
ষোড়শী। আসুন। আমারও স্নানের সময় উত্তীর্ণ হয়ে যায়, আমিও চললাম।
[উভয়ের প্রস্থান
[সাগর সর্দার ও ফকিরসাহেবের প্রবেশ]
সাগর। না, এ চলবে না—কোনমতেই চলবে না ফকিরসাহেব। মা নাকি বলেচেন সমস্ত ত্যাগ করে যাবেন। আপনাকে বলচি এ চলবে না।
ফকির। কেন চলবে না সাগর?
সাগর। তা জানিনে। কিন্তু যাওয়া চলবে না। গেলে আমরা তাঁর দীন-দুঃখী প্রজারা সব থাকব কোথায়? বাঁচব কি করে?
ফকির। কিন্তু তোমরা কি শোননি ষোড়শী কত বড় লজ্জা এবং ঘৃণায় সমস্ত ত্যাগ করে যাচ্ছেন?
সাগর। শুনেচি। তাই আরও দশজনের মত আমরাও ভেবে পাইনি কিসের জন্য মা সাহেবের হাত থেকে সে রাত্রে জমিদারকে বাঁচাতে গেলেন। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) ভেবে নাই পেলাম ফকিরসাহেব, কিন্তু এটুকু ত ভেবে পেয়েছি, যাঁকে মা বলে ডেকেছি সন্তান হয়ে আমরা তাঁর বিচার করতে যাব না।
ফকির। তোমরা জন-কতক বিচার না করলেই কি চণ্ডীগড়ে তার বিচার করবার মানুষের অভাব হবে সাগর?
সাগর। কিন্তু তারাই কি মানুষ? আমরা তাঁর ছেলে—আমাদের অন্তরের বিশ্বাসের চেয়ে কি তাদের বাইরের বিচারটাই বড় হবে ফকিরসাহেব? তাদের কি আমরা চিনিনে? একদিন যখন আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিলে তারা, সেও যেমন সত্যি-পাওনার দাবীতে, আবার জেলে যখন দিলে সেও তেমনি সত্যি-সাক্ষীর জোরে।
ফকির। সে আমি জানি।
সাগর। কিন্তু সব কথা ত জানো না। খুড়ো-ভাইপোয় জেল খেটে ফিরে এসে দাঁড়ালাম। বললাম, মা, আমরা যে মরি। মা রাগ করে বললেন, তোরা ডাকাত, তোদের মরাই ভালো। অভিমানে ঘরে ফিরে গেলাম। খুড়ো বললে, ভগবান! গরীবকে বিশ্বাস করতে কেউ নেই। পরের দিন সকালবেলা মা আমাদের ডেকে পাঠিয়ে বললেন, তোদের কাছে আমি মস্ত অপরাধ করেছি বাবা, আমাকে তোরা ক্ষমা কর্। তোদের কেউ বিশ্বাস না করুক আমি বিশ্বাস করব। এখনো বিঘে-কুড়ি জমি আমার আছে, তাই তোরা ভাগ করে নে। চণ্ডীর খাজনা তোরা যা ইচ্ছে দিস, কিন্তু অসৎ পথে কখনো পা দিবিনে, এই আমার শর্ত।
ফকির। কিন্তু লোকে যে বলে—
সাগর। বলুক। কিন্তু মা জানলেই হলো সে বিশ্বাস আমরা কখনো ভাঙ্গিনি। জানো ফকিরসাহেব, আমাদের জন্যেই এককড়ি তাঁর শত্রু, আমাদের জন্যেই রায়মশায় তাঁর দুশমন। অথচ, তারা জানেও না কার দয়ায় আজও তারা বেঁচে আছে।
ফকির। কিন্তু আমাকে তোরা ধরে আনলি কেন?
সাগর। কেন? শুনেছি, মুসলমান হয়েও তুমি তাঁর গুরুর চেয়ে বড়, তোমার নিষেধ ছাড়া মাকে কেউ আটকাতে পারবে না।
ফকির। কিন্তু এতবড় অন্যায় নিষেধ আমি কিসের জন্যে করব সাগর?
সাগর। করবে মানুষের ভালর জন্যে।
ফকির। কিন্তু ষোড়শী ঘরে নেই। বেলা যায়, আমিও ত আর অপেক্ষা করতে পারি নে। এখন আমি চললুম।
সাগর। পারবে না থাকতে? করবে না নিষেধ? কিন্তু ফল তার ভাল হবে না।
ফকির। এ-সব কথা মুখেও এনো না সাগর।
সাগর। মা-ও বলেন ও-কথা মুখে আনিস নে সাগর। বেশ মুখে আর আনব না—আমাদের মনের মধ্যেই থাক।
[ফকিরের প্রস্থান
সাগর। সন্ন্যাসী ফকির তুমি, জানো না ডাকাতের বুকের জ্বালা। আমাদের সব গেছে, এর ওপর মা-ও যদি ছেড়ে যায় আমরা বাকী কিছুই রাখব না।
[প্রস্থান
[নির্মল ও ষোড়শীর প্রবেশ]
ষোড়শী। ডেকে নিয়ে এলাম সাধে! ছি, ছি, কি দাঁড়িয়ে যা তা শুনছিলেন বলুন ত! দেবীর মন্দিরে, তার উঠানের মাঝখানে জটলা করে কতকগুলো কাপুরুষ মিলে বিচারের ছলনায় দুজন অসহায় স্ত্রীলোকের কুৎসা রটনা করচে, —তাও আবার একজন মৃত, আর একজন অনুপস্থিত। আসুন আমার ঘরে।
[দুয়ারে আসন পাতা ছিল, নির্মলকে সমাদর করিয়া তাহাতে বসাইয়া ষোড়শী নিজে অদূরে উপবেশন করিল]
ষোড়শী। আপনি নাকি বলেছেন আমার মামলা-মকদ্দমার সমস্ত ভার নেবেন। এ কি সত্যি?
নির্মল। হাঁ, সত্যি।
ষোড়শী। কিন্তু কেন নেবেন?
নির্মল। বোধ হয় আপনার প্রতি অত্যাচার হচ্চে বলে।
ষোড়শী। কিন্তু আর কিছু বোধ করেন না ত? (এই বলিয়া সে মুচকিয়া হাসিল) থাক, সব কথার যে জবাব দিতেই হবে এমন কিছু শাস্ত্রের অনুশাসন নেই। বিশেষ করে এই কূট-কচালে শাস্ত্রের, না? আচ্ছা সে যাক। মকদ্দমার ভার যেন নিলেন, কিন্তু যদি হারি তখন ভার কে নেবে? তখন পেছোবেন না ত?
নির্মল। না, তখনও না।
ষোড়শী। ইস! পরোপকারের কি ঘটা! (হাসিয়া) আমি কিন্তু হৈম হলে এইসব পরোপকার-বৃত্তি ঘুচিয়ে দিতাম। অত ভালমানুষই নই—আমার কাছে ফাঁকি চলত না। রাত্রি-দিন চোখে চোখে রেখে দিতাম।
নির্মল। (বিস্ময়ে, ভয়ে, আনন্দে) চোখে চোখে রাখলেই কি রাখা যায় ষোড়শী? এর বাঁধন যেখানে শুরু হয় চোখের দৃষ্টি যে সেখানে পৌঁছায় না, এ কথা কি আজও জানতে পারনি তুমি।
ষোড়শী। পেরেছি বৈ কি। (হাসিল; বাহিরের শব্দ শুনিয়া গলা বাড়াইয়া চাহিয়া) এই যে ইনি এসেছেন।
নির্মল। কে? ফকিরসাহেব?
ষোড়শী। না, জমিদারবাবু। বলেছিলাম সভা ভাঙলে যাবার পথে আমার কুঁড়েতে একবার একটু পদধূলি দিতে। তাই দিতেই বোধ হয় আসচেন।
নির্মল। (বিরক্তি ও সঙ্কোচে আড়ষ্ট হইয়া) তা হলে আপনি আমাকে এ কথা বলেন নি কেন?
ষোড়শী। বেশ! একবার ‘তুমি’ একবার ‘আপনি’! (হাসিয়া) ভয় নেই, উনি ভারী ভদ্রলোক; লড়াই করেন না। তা ছাড়া আপনাদের পরিচয় নেই; সেটাও একটা লাভ। (দ্বারের নিকটে অগ্রসর হইয়া অভ্যর্থনা করিয়া) আসুন।
জীবানন্দ। (প্রবেশ করিয়াই থমকিয়া দাঁড়াইয়া) ইনি? নির্মলবাবু বোধ হয়।
ষোড়শী। হাঁ, আপনার বন্ধু বলে পরিচয় দিলে খুব সম্ভব অতিশয়োক্তি হবে না।
জীবানন্দ। (হাসিয়া) বিলক্ষণ! বন্ধু নয় ত কি? ওঁদের কৃপাতেই ত টিকে আছি, নইলে মামার জমিদারি পাওয়া পর্যন্ত যে-সব কীর্তি করা গেছে তাতে চণ্ডীগড়ের শান্তিকুঞ্জের বদলে ত এতদিন আন্দামানের শ্রীঘরে গিয়ে বসবাস করতে হতো।
ষোড়শী। চৌধুরীমশাই, উকিল-ব্যারিস্টার বড়লোক বলে বাহবাটা কি একা ওঁরাই পাবেন। আন্দামান প্রভৃতি বড় ব্যাপারে না হোক, কিন্তু ছোটো বলে এদেশের শ্রীঘরগুলোও ত মনোরম স্থান নয়—দুঃখী বলে ভৈরবীরা কি একটু ধন্যবাদ পেতেও পারে না?
জীবানন্দ। (অপ্রস্তুত হইয়া) ধন্যবাদ পাবার সময় হলেই পাবে।
ষোড়শী। (হাসিয়া) এই যেমন সভায় দাঁড়িয়ে এইমাত্র এক দফা দিয়ে এলেন?
[জীবানন্দ স্তব্ধ হইয়া রহিল]
ষোড়শী। নির্মলবাবু না থাকলে আজ আপনার সঙ্গে আমি ভারী ঝগড়া করতাম। ছি—এ কি কোন পুরুষের পক্ষেই সাজে? তা ছাড়া কি প্রয়োজন ছিল বলুন ত? সেদিন এই ঘরে বসেই ত আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আমাকে যা আদেশ করবেন আমি পালন করব। আপনিও আপনার হুকুম স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন। এই নিন সিন্দুকের চাবি এবং নিন হিসাবের খাতা। (অঞ্চল হইতে সিন্দুকের চাবি খুলিয়া এবং তাকের উপর হইতে একখানা খেরো-বাঁধানো মোটা খাতা পাড়িয়া জীবানন্দের পায়ের কাছে রাখিয়া দিল) মায়ের যা-কিছু অলঙ্কার, যত-কিছু দলিলপত্র সিন্দুকের ভিতরেই পাবেন, এবং আর একখানা কাগজ ঐ খাতার মধ্যে পাবেন, যাতে ভৈরবীর সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য ত্যাগ করে আমি সই করে দিয়েছি।
জীবানন্দ। (অবিশ্বাস করিয়া) বল কি! কিন্তু ত্যাগ করলে কার কাছে?
ষোড়শী। তাতেই লেখা আছে দেখতে পাবেন।
জীবানন্দ। তাই যদি হয় ত এই চাবিগুলো তাঁকেই দিলে না কেন?
ষোড়শী। তাঁকেই যে দিলাম।
জীবানন্দ। (মলিন-মুখে ও সন্দিগ্ধ-কণ্ঠে) কিন্তু এ ত আমি নিতে পারিনে ষোড়শী। খাতায় লেখা নামগুলোর সঙ্গে সিন্দুকে রাখা জিনিসগুলোও যে এক হবে, সে আমি কি করে বিশ্বাস করব? তোমার আবশ্যক থাকে তুমি পাঁচজনের কাছে বুঝিয়ে দিয়ো।
ষোড়শী। (ঘাড় নাড়িয়া) আমার সে আবশ্যক নেই। কিন্তু চৌধুরীমশায়, আপনার এ অজুহাতও অচল। চোখ বুজে যার হাত থেকে বিষ নিয়ে খাবার ভরসা হয়েছিল, তার হাত থেকে আজ চাবিটুকু নেবার সাহস নেই, এ আমি মানিনে। নিন, ধরুন। (খাতা ও চাবি তুলিয়া জীবানন্দের হাতের মধ্যে একরকম জোর করিয়া গুঁজিয়া দিল) আজ আমি বাঁচলাম। (কোমল কণ্ঠস্বরে) আর একটিমাত্র ভার আপনাকে দিয়ে যাব, সে আমার গরীব-দুঃখী প্রজাদের ভবিষ্যৎ। আমি শত ইচ্ছে করেও তাদের ভাল করতে পারিনি—আপনি অনায়াসে পারবেন। (নির্মলের প্রতি) আমার কথাবার্তা শুনে আপনি আশ্চর্য হয়ে গেছেন, না নির্মলবাবু?
নির্মল। (মাথা নাড়িয়া) শুধু আশ্চর্য নয়, আমি প্রায় অভিভূত হয়ে পড়েছি। ভৈরবীর আসন ত্যাগ করে যে আপনি ইতিমধ্যে ছাড়পত্র পর্যন্ত সই করে রেখেছেন, এ খবর ত আমাকে ঘুণাগ্রে জানান নি?
ষোড়শী। আমার অনেক কথাই আপনাকে জানানো হয়নি, কিন্তু একদিন হয়ত সমস্তই জানতে পারবেন। কেবল একটিমাত্র মানুষ সংসারে আছেন যাঁকে সকল কথাই জানিয়েছি, সে আমার ফকিরসাহেব।
নির্মল। এ-সকল পরামর্শ বোধ হয় তিনিই দিয়েছেন?
ষোড়শী। না, তিনি এখন পর্যন্ত কিছুই জানেন নি, এবং ওই যাকে ছাড়পত্র বলচেন সে আমার একটু আগের রচনা। যিনি এ কাজে আমাকে প্রবৃত্তি দিয়েছেন, শুধু তাঁর নামটিই আমি সংসারে সকলের কাছে গোপন রাখব।
জীবানন্দ। মনে হচ্ছে যেন ডেকে এনে আমার সঙ্গে কি একটা প্রকাণ্ড তামাশা করচ ষোড়শী। এ বিশ্বাস করা যেন সেই ‘মরফিয়া’ খাওয়ার চেয়েও শক্ত ঠেকচে।
নির্মল। (হাসিয়া জীবানন্দের প্রতি চাহিয়া) আপনি তবু এই কয়েক পা মাত্র হেঁটে এসে তামাশা দেখচেন, কিন্তু আমাকে কাজকর্ম, বাড়ি-ঘর ফেলে রেখে এই তামাশা দেখতে হচ্ছে।
আর এ যদি সত্য হয় ত আপনি যা চেয়েছিলেন সেটা অন্ততঃ পেয়ে গেলেন কিন্তু আমার ভাগ্যে ষোল আনাই লোকসান। (ষোড়শীকে) বাস্তবিক এ সকল ত আপনার পরিহাস নয়?
ষোড়শী। না নির্মলবাবু, আমার এবং আমার মায়ের কুৎসায় দেশ ছেয়ে গেল, এই কি আমার হাসি-তামাশার সময়? আমি সত্য সত্যই অবসর নিলাম।
নির্মল। তা হলে বড় দুঃখে পড়েই এ কাজ আপনাকে করতে হলো। আমি আপনাকে বাঁচাতেও হয়ত পারতাম, কিন্তু কেন যে তা হতে দিলেন না তা আমি বুঝেছি। বিষয় রক্ষা হতো, কিন্তু কুৎসার ঢেউ তাতে উত্তাল হয়ে উঠত। সে থামাবার সাধ্য আমার ছিল না। (এই বলিয়া সে কটাক্ষে জীবানন্দের প্রতি চাহিল)
নির্মল। এখন তা হলে কি করবেন স্থির করেছেন?
ষোড়শী। সে আপনাকে আমি পরে জানাব।
নির্মল। কোথায় থাকবেন?
ষোড়শী। এ খবরও আপনাকে আমি পরে দেব।
নির্মল। (হাতঘড়ি দেখিয়া) রাত প্রায় দশটা। আচ্ছা, এখন আমি তা হলে, —আমাকে আর বোধ হয় কোন আবশ্যক নেই?
ষোড়শী। এতবড় অহঙ্কারের কথা কি বলতে পারি নির্মলবাবু? তবে মন্দির নিয়ে আর বোধ হয় আমার কখনো আপনাকে দুঃখ দেবার প্রয়োজন হবে না।
নির্মল। আমাদের শীঘ্র ভুলে যাবেন না আশা করি?
ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না।
নির্মল। হৈম আপনাকে বড় ভালবাসে। যদি অবকাশ পান মাঝে মাঝে একটা খবর দেবেন।
[নির্মল প্রস্থান করিল
জীবানন্দ। ভদ্রলোকটিকে ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ষোড়শী। না পারলেও আপনার ক্ষতি হবে না।
জীবানন্দ। আমার না হোক তোমার ত হতে পারে। মনে রাখবার জন্যে কি ব্যাকুল প্রার্থনাই জানিয়ে গেলেন।
ষোড়শী। সে শুনেছি। কিন্তু আমি তাঁকে যতখানি জানি তার অর্ধেকও আমাকে জানলে আজ এতবড় বাহুল্য আবেদন তাঁর করতে হতো না।
জীবানন্দ। অর্থাৎ?
ষোড়শী। অর্থাৎ এই যে চণ্ডীগড়ের ভৈরবী-পদ অনায়াসে জীর্ণবস্ত্রের মত ত্যাগ করে যাচ্ছি সে শিক্ষা কোথায় পেলাম জানেন? ওঁদের কাছে। মেয়েমানুষের কাছে এ যে কত ফাঁকি, কত মিথ্যে, সে বুঝেছি কেবল হৈমকে দেখে। অথচ এর বাষ্পও কোনদিন তাঁরা জানতে পারবেন না।
জীবানন্দ। তথাপি এ হেঁয়ালি হেঁয়ালিই রয়ে গেল অলকা। একটা কথা স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করতে আমার ভারী লজ্জা করে; কিন্তু যদি পারতাম, তুমি কি তার সত্য জবাব দিতে পারতে?
ষোড়শী। (সহাস্যে) আপনি যদি কোন একটা আশ্চর্য কাজ করতে পারতেন, তখন আমিও তেমনি কোন একটা অদ্ভুত কাজ করতে পারতাম কিনা, এ আমি জানিনে—কিন্তু আশ্চর্য কাজ করবার আপনার প্রয়োজন নেই—আমি বুঝেছি। অপবাদ সকলে মিলে দিয়েছে বলেই তাকে সত্য করে তুলতে হবে তার অর্থ নেই। আমি কিছুর জন্যেই কখনো কারও আশ্রয় গ্রহণ করব না। আমার স্বামী আছেন, কোন লোভেই সে কথা আমি ভুলতে পারব না। এই ভয়ানক প্রশ্নটাই না আপনাকে লজ্জা দিচ্ছিল চৌধুরীমশাই?
জীবানন্দ। তুমি আমাকে চৌধুরীমশাই বল কেন?
ষোড়শী। তবে কি বলব? হুজুর?
জীবানন্দ। না। অনেকে যা বলে ডাকে—জীবানন্দবাবু।
ষোড়শী। বেশ, ভবিষ্যতে হবে। কিন্তু রাত্রি হয়ে যাচ্চে আপনি বাড়ি গেলেন না? আপনার লোকজন কৈ?
জীবানন্দ। আমি তাদের পাঠিয়ে দিয়েচি।
ষোড়শী। একলা বাড়ি যেতে আপনার ভয় করবে না?
জীবানন্দ। না, আমার পিস্তল আছে।
ষোড়শী। তবে তাই নিয়ে বাড়ি যান, আমার ঢের কাজ আছে।
জীবানন্দ। তোমার থাকতে পারে, কিন্তু আমার নেই। আমি এখন যাব না।
ষোড়শী। (প্রখর চোখে, অথচ শান্তস্বরে) আমি লোক ডেকে আপনার সঙ্গে দিচ্চি, তারা বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে।
জীবানন্দ। (অপ্রতিভ হইয়া) ডাকতে কাউকে হবে না, আমি আপনিই যাচ্ছি। যেতে আমার ইচ্ছে হয় না। তাই শুধু আমি বলছিলাম। তুমি কি সত্যই চণ্ডীগড় ছেড়ে চলে যাবে অলকা?
ষোড়শী। (ঘাড় নাড়িয়া) হাঁ।
জীবানন্দ। কবে যাবে?
ষোড়শী। কি জানি, হয়ত কালই যেতে পারি।
জীবানন্দ। কাল? কালই যেতে পার? (একান্ত স্তব্ধ রহিয়া) আশ্চর্য! মানুষের নিজের মন বুঝতেই কি ভুল হয়! যাতে তুমি যাও সেই চেষ্টাই প্রাণপণে করেছি—অথচ, তুমি চলে যাবে শুনে চোখের সামনে সমস্ত দুনিয়াটা যেন শুকনো হয়ে গেল। তোমাকে তাড়াতে পারলে, ওই যে জমিটা দেনার দায়ে বিক্রি করেছি সে নিয়ে আর গোলমাল হবে না—কতকগুলো নগদ টাকাও হাতে এসে পড়বে, আর, —আর তোমাকে যা হুকুম করব তাই তুমি করতে বাধ্য হবে, এই দিকটাই কেবল দেখতে পেয়েছি। কিন্তু আরও যে একটা দিক আছে, স্বেচ্ছায় তুমি সমস্ত ত্যাগ করে আমার মাথাতেই বোঝা চাপিয়ে দিলে সে ভার বইতে পারব কিনা, এ কথা আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি। আচ্ছা অলকা, এমন ত হতে পারে আমার মত তোমারও ভুল হচ্ছে, —তুমিও নিজের মনের ঠিক খবরটি পাওনি! জবাব দাও না যে?
ষোড়শী। জবাব খুঁজে পাইনে। হঠাৎ বিস্ময় লাগে এ কি আপনার কথা!
জীবানন্দ। তবে এই কথাটা বল, সেখানে তোমার চলবে কি করে?
ষোড়শী। অত্যন্ত অনাবশ্যক কৌতূহল চৌধুরীমশায়।
জীবানন্দ। তাই বটে, অলকা তাই বটে। আজ আমার আবশ্যক-অনাবশ্যক তোমাকে বোঝাব আমি কি দিয়ে!
[বাহিরে পূজারীর কাশি ও পায়ের শব্দ শুনা গেল। অতঃপর তিনি প্রবেশ করিলেন]
পূজারী। মা, সকলের সম্মুখে মন্দিরের চাবিটা আমি তারাদাস ঠাকুরের হাতেই দিলাম। রায়মশায়, শিরোমণি—এঁরা উপস্থিত ছিলেন।
ষোড়শী। ঠিকই হয়েছে। তুমি একটু দাঁড়াও, আমি সাগরের ওখানে একবার যাব।
জীবানন্দ। এগুলোও তা হলে তুমি রায়মশায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ো।
ষোড়শী। না, সিন্দুকের চাবি আর কারও হাতে দিয়ে আমার বিশ্বাস হবে না।
জীবানন্দ। তবে কি বিশ্বাস হবে শুধু আমাকেই?
[ষোড়শী কোন উত্তর না দিয়া জীবানন্দের পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া বিস্ময়ে অভিভূত পূজারীকে কহিল]
ষোড়শী। চল বাবা, আর দেরি করো না।
পূজারী। চল, মা চল।
[পূজারী ও ষোড়শী প্রস্থান করিলে একাকী জীবানন্দ সেই জনহীন কুটীর-অঙ্গনে স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল]
ষোড়শী – ৩.১
তৃতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
নাটমন্দির
[চণ্ডীর প্রাঙ্গণস্থিত নাটমন্দিরের একাংশ। সময়—অপরাহ্ন। উপস্থিত—শিরোমণি, জনার্দন রায় এবং আরও দুই-চারিজন গ্রামের ভদ্রব্যক্তি]
শিরোমণি। (আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ডান হাত তুলিয়া জনার্দনের প্রতি) আশীর্বাদ করি দীর্ঘজীবী হও, ভায়া, সংসারে এসে বুদ্ধি ধরেছিলে বটে।
জনার্দন। (হেঁট হইয়া পদধূলি লইয়া) আজ এই নিয়ে নির্মলকে দুটো তিরস্কার করতে হলো, শিরোমণিমশাই, মনটা তেমন ভালো নেই।
শিরোমণি। না থাকবারই কথা। কিন্তু এ একপ্রকার ভালই হলো ভায়া। এখন বাবাজীর চৈতন্যোদয় হবে যে, শ্বশুর এবং পিতৃব্যস্থানীয়দের বিরুদ্ধাচরণ করার প্রত্যবায় আছে। আর, এ যে হতেই হবে। সর্বমঙ্গলময়ী চণ্ডীমাতার ইচ্ছা কিনা!
প্রথম ভদ্রলোক। সমস্তই মায়ের ইচ্ছা। তা নইলে কি ষোড়শী ভৈরবী বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যেতে চায়!
শিরোমণি। নিঃসন্দেহ। মন্দিরের চাবিটা ত পূজারীর কাছ থেকে কৌশলে আদায় হয়েছে, কিন্তু আসল চাবিটা শুনচি নাকি গিয়ে পড়েছে জমিদারের হাতে। ব্যাটা পাঁড় মাতাল, দেখো ভায়া, শেষকালে মায়ের সিন্দুকের সোনারূপো না ঢুকে যায় শুঁড়ির সিন্দুকে। পাপের আর অবধি থাকবে না।
জনার্দন। ঐটে খেয়াল করা হয়নি।
শিরোমণি। না, এখন সহজে দিলে হয়। দশদিন পরে হয়ত বলে বসবে, কৈ, কিছুই ত সিন্দুকে ছিল না! কিন্তু আমরা সবাই জানি ভায়া, ষোড়শী আর যাই কেন না করুক, মায়ের সম্পত্তি অপহরণ করবে না—একটি পাই-পয়সা না।
[অনেকেই এ কথা স্বীকার করিল]
দ্বিতীয় ভদ্রলোক। এর চেয়ে বরঞ্চ সে-ই ছিল ভাল।
শিরোমণি। চাবিটা অবিলম্বে উদ্ধার করা চাই।
অনেকে। চাই চাই—অবিলম্বে চাই।
প্রথম ভদ্রলোক। আমি বলি, চলুন, আমরা দল বেঁধে যাই জমিদারের কাছে। বলি গে, চাবিটা দিন, কি আছে না আছে মিলিয়ে দেখি গে।
দ্বিতীয় ভদ্রলোক। আমিও তাই বলি।
প্রথম ভদ্রলোক। আজ বেলা তৃতীয় প্রহরে—হুজুর ঘুমটি থেকে উঠে মদ খেতে বসেছেন, মেজাজ খুশ্ আছে—ঠিক এমনি সময়টিতে।
অনেকে। ঠিক ঠিক, এই ঠিক মতলব।
শিরোমণি। (সভয়ে) কিন্তু অত্যন্ত মদ্যপান করে থাকলে যাওয়া সঙ্গত হবে না। কি বল জনার্দন?
[অকস্মাৎ ইঁহাদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। কে একজন কহিল, ‘স্বয়ং হুজুর আসচেন যে!’ পরক্ষণেই জীবানন্দ ও প্রফুল্ল প্রবেশ করিলেন। যাহারা বসিয়াছিল অভ্যর্থনা করিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। জীবানন্দ নাটমন্দিরে উঠিবার সিঁড়ির উপরে বসিতে যাইতেছিলেন, সকলে সমস্বরে বলিয়া উঠিল, ‘আসন, আসন, শীঘ্র একটা আসন নিয়ে এস’]
জীবানন্দ। (উপবেশন করিয়া) আসনের প্রয়োজন নেই।—দেবীর মন্দির, এর সর্বত্রই ত আসন বিছানো।
জনার্দন। তাতে আর সন্দেহ কি! কিন্তু এ আপনারই যোগ্য কথা।
[প্রফুল্ল সিঁড়ির একাংশে গিয়া বসিল, এবং হাতে তাহার যে খবরের কাগজখানা ছিল তাহাই খুলিয়া নিঃশব্দে পড়িতে লাগিল]
শিরোমণি। যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী। মেঘ না চাইতে জল। আজই দ্বিপ্রহরে আমরা হুজুরের কাছে যাব স্থির করেছিলাম, কিন্তু পাছে নিদ্রার ব্যাঘাত হয় এইজন্যেই—
জীবানন্দ। যাননি? কিন্তু হুজুর ত দিনের বেলা নিদ্রা দেন না।
শিরোমণি। কিন্তু আমরা যে শুনি হুজুর—
জীবানন্দ। শোনেন? তা আপনারা অনেক কথা শোনেন, যা সত্য নয় এবং অনেক কথা বলেন, যা মিথ্যা। এই যেমন, আমার সম্বন্ধে ভৈরবীর কথাটা—
[এই বলিয়া বক্তা হাস্য করিলেন, কিন্তু শ্রোতার দল থতমত খাইয়া একেবারে মুষড়িয়া গেল]
জনার্দন। মন্দির-সংক্রান্ত গোলযোগ যে এত সহজে নিষ্পত্তি করতে পারা যাবে তা আশা ছিল না। নির্মল যে-রকম বেঁকে দাঁড়িয়েছিল—
জীবানন্দ। তিনি সোজা হলেন কি প্রকারে?
শিরোমণি। (খুশী হইয়া সদর্পে) সমস্তই মায়ের ইচ্ছা হুজুর, সোজা যে হতেই হবে। পাপের ভার তিনি আর বইতে পারছিলেন না।
জীবানন্দ। তাই হবে। তার পরে?
শিরোমণি। কিন্তু পাপ ত দূর হলো, এখন,—বল না জনার্দন, হুজুরকে সমস্ত বুঝিয়ে বল না।
জনার্দন। (চকিত হইয়া) মন্দিরের চাবি ত আমরা দাঁড়িয়ে থেকেই তারাদাস ঠাকুরকে দিইয়েচি। আজ তিনি সকালে মায়ের দোর খুলেছেন, কিন্তু সিন্দুকের চাবিটা শুনতে পেলাম, ষোড়শী হুজুরের হাতে সমর্পণ করেছে।
জীবানন্দ। তা করেছে। জমা-খরচের খাতাও একখানা দিয়েছে।
শিরোমণি। বেটী এখনও আছে, কিন্তু কখন কোথায় চলে যায় সে ত বলা যায় না।
জীবানন্দ। (মুহূর্তকাল বৃদ্ধের মুখের প্রতি চাহিয়া) কিন্তু সেজন্য আপনাদের উদ্বেগ কিসের? তাকে তাড়ানও ত চাই। কি বলেন রায়মশায়?
জনার্দন। দলিলপত্র, মূল্যবান তৈজসাদি, দেবীর অলঙ্কার প্রভৃতি যা-কিছু আছে গ্রামের প্রাচীন ব্যক্তিরা সমস্তই জানেন। শিরোমণিমশায় বলেছেন যে, ষোড়শী থাকতে থাকতেই সেগুলো সব মিলিয়ে দেখলে ভালো হয়। হয়ত—
জীবানন্দ। হয়ত নেই? এই না? কিন্তু না থাকলেই বা আপনারা আদায় করবেন কি করে?
জনার্দন। (হঠাৎ উত্তর খুঁজিয়া পাইলেন না। শেষে বলিলেন) কি জানেন, তবু ত জানা যাবে হুজুর।
জীবানন্দ। ত যাবে। কিন্তু শুধু শুধু জানা গিয়ে আর লাভ কি?
শিরোমণি। (প্রথম ভদ্রলোকের প্রতি অলক্ষ্যে) সেরেছে!
জনার্দন। কিন্তু কোনদিন ত জানতেই হবে হুজুর।
জীবানন্দ। তা হবে। কিন্তু আজ আর আমার সময় নেই রায়মশাই।
শিরোমণি। (ব্যগ্র হইয়া) আমাদের সময় আছে হুজুর। চাবিটা জনার্দন ভায়ার হাতে দিলেই সন্ধ্যার পরে আমরা সমস্ত মিলিয়ে দেখতে পারি। হুজুরেরও কোনও দায়িত্ব থাকে না—কি আছে না আছে সে পালাবার আগেই সব জানা যায়। কি বল ভায়া? কি বল হে তোমরা? ঠিক বলেছি কিনা?
[সকলেই এ প্রস্তাবে সম্মতি দিল, দিল না শুধু যাহার হাতে চাবি]
জীবানন্দ। (ঈষৎ হাসিয়া) ব্যস্ত কি শিরোমণিমশায়, যদি কিছু নষ্ট হয়েই থাকে ত ভিখিরীর কাছ থেকে আর আদায় হবে না। আজ থাক, যেদিন আমার অবসর হবে আপনাদের খবর দেব।
[মনে মনে সকলেই ক্রুদ্ধ হইল]
জনার্দন। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) কিন্তু দায়িত্ব একটা—
জীবানন্দ। সে ত ঠিক কথা রায়মশায়। দায়িত্ব একটা আমার রইল বৈ কি।
[সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল। চলিতে চলিতে জমিদারের শ্রুতিপথের বাইরে আসিয়া]
শিরোমণি। (জনার্দনের গা টিপিয়া) দেখলে ভায়া, ব্যাটা মাতালের ভাব বোঝাই ভার। গুয়োটা কথা কয় যেন হেঁয়ালি। মদে চুর হয়ে আছে। বাঁচবে না বেশিদিন।
জনার্দন। হুঁ। যা ভয় করা গেল তাই হলো দেখচি।
শিরোমণি। এবারে গেল সব শুঁড়ির দোকানে। বেটী যাবার সময় আচ্ছা জব্দ করে গেল।
প্রথম ভদ্রলোক। হুজুর আর দিচ্চেন না।
শিরোমণি। আবার? এবার চাইতে গেলে গলা টিপে মদ খাইয়ে দিয়ে তবে ছাড়বে। (কথাটা উচ্চারণ করিয়াই তাঁহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল)
[সকলের প্রস্থান
প্রফুল্ল। (খবরের কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া) দাদা, আবার একটা নূতন হাঙ্গামা জড়ালেন কেন? চাবিটা ওদের দিয়ে দিলেই ত হতো।
জীবানন্দ। হতো না প্রফুল্ল, হলে দিতাম। পাছে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলেই সে কাল রাতে আমার হাতে চাবি দিয়েছে।
প্রফুল্ল। সিন্দুকে আছে কি?
জীবানন্দ। (হাসিয়া) কি আছে? আজ সকালে তাই আমি খাতাখানা পড়ে দেখলাম। আছে মোহর, টাকা, হীরে, পান্না, মুক্তোর মালা, মুকুট, নানা রকমের জড়োয়া গয়না, কত কি দলিলপত্র, তা ছাড়া সোনা-রূপার বাসন-কোসনও কম নয়। কতকাল ধরে জমা হয়ে এই ছোট্ট চণ্ডীগড়ের ঠাকুরের যে এত সম্পত্তি সঞ্চিত আছে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। চুরি-ডাকাতের ভয়ে ভৈরবীরা বোধ করি কাউকে জানতেও দিত না।
প্রফুল্ল। (সভয়ে) বলেন কি! তার চাবি আপনার কাছে? একমাত্র পুত্র-সমর্পণ ডাইনীর হাতে?
জীবানন্দ। নিতান্ত মিথ্যে বলনি ভায়া, এত টাকা দিয়ে আমি নিজেকেও বিশ্বাস করতে পারতাম না অথচ এ আমি চাইনি। যতই তাকে পীড়াপীড়ি করলাম, জনার্দনকে দিতে, ততই সে অস্বীকার করে আমার হাতে গুঁজে দিলে।
প্রফুল্ল। এর কারণ?
জীবানন্দ। বোধ হয় সে ভেবেছিল এ দুর্নামের ওপর আবার চুরির কলঙ্ক চাপালে তার আর সইবে না। এদের সে চিনেছিল।
প্রফুল্ল। কিন্তু আপনাকে সে চিনতে পারেনি।
জীবানন্দ। (হাসিল, কিন্তু সে হাসিতে আনন্দ ছিল না) সে দোষ তার, আমার নয়। তার সম্বন্ধে অপরাধ আর যত দিকেই করে থাকি প্রফুল্ল, আমাকে চিনতে না দেওয়ার অপরাধ করিনি। কিন্তু আশ্চর্য এই পৃথিবী, এবং তার চেয়েও আশ্চর্য এর মানুষের মন। এ যে কি থেকে কি স্থির করে নেয় কিছুই বলবার জো নেই। এর যুক্তিটা কি জানো ভায়া, সেই যে তার হাত থেকে একদিন মরফিয়া চেয়ে নিয়ে চোখ বুজে খেয়েছিলাম, সেই হলো তার সকল তর্কের বড় তর্ক—সকল বিশ্বাসের বড় বিশ্বাস। কিন্তু সে রাত্রে আর যে কোন উপায় ছিল না—সে ছাড়া যে আর কারও পানে চাইবার কোথাও কেউ ছিল না—এ-সব ষোড়শী একেবারে ভুলে গেছে। কেবল একটি কথা তার মনে জেগে আছে—যে নিজের প্রাণটা অসংশয়ে তার হাতে দিতে পেরেছিল তাকে আবার অবিশ্বাস করা যায় কি করে! ব্যস্ যা কিছু ছিল চোখ বুজে দিলে আমার হাতে তুলে। প্রফুল্ল, দুনিয়ায় ভয়ানক চালাক লোকেও মাঝে মাঝে মারাত্মক ভুল করে বসে, নইলে সংসারটা একেবারে মরুভূমি হয়ে যেত, কোথাও রসের বাষ্পটুকু জমবারও ঠাঁই পেত না।
প্রফুল্ল। অতিশয় খাঁটি কথা দাদা! অতএব অবিলম্বে খাতাখানা পুড়িয়ে ফেলে তারাদাস ঠাকুরকে ডেকে ধমক দিন—জমানো মোহরগুলোয় যদি সলোমন সাহেবের দেনাটা শোধ যায় ত শুধু রসের বাষ্প কেন, মুষলধারে বর্ষণ শুরু হতে পারবে।
জীবানন্দ। প্রফুল্ল, এই জন্যেই তোমাকে এত পছন্দ করি।
প্রফুল্ল। (হাত জোড় করিয়া) এই পছন্দটা এইবার একটু খাটো করতে হবে দাদা। রসের উৎস আপনার অফুরন্ত হোক, কিন্তু মোসাহেবি করে এ অধীনের গলার চুঙ্গিটা পর্যন্ত কাঠ হয়ে গেছে। এইবার একবার বাইরে গিয়ে দুটো ডালভাতের যোগাড় করতে হবে। কাল-পরশু আমি বিদায় নিলাম।
জীবানন্দ। (সহাস্যে) একেবারে নিলে? কিন্তু এইবার নিয়ে ক’বার নেওয়া হলো প্রফুল্ল?
প্রফুল্ল। বার-চারেক। (হাসিয়া ফেলিয়া) ভগবান মুখটা দিয়েছিলেন, তা বড়লোকের প্রসাদ খেয়েই দিন গেল; দুটো বড় কথাও যদি না মাঝে মাঝে বার করতে পারি ত নিতান্তই এর জাত যায়। নেহাত অপরাধও নেই দাদা। বহুকাল ধরে আপনাদের জলকে কখনো উঁচু কখনো নীচু বলে এ দেহটায় মেদ-মাংসই কেবল পরিপূর্ণ করেছি, সত্যিকারের রক্ত বলতে আর ছিটেফোঁটাও বাকী রাখিনি। আজ ভাবচি এক কাজ করব। সন্ধ্যার আবছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে গিয়ে খপ করে ভৈরবীঠাক্রুনের এক খামচা পায়ের ধূলো নিয়ে ফেলব। আপনার অনেক ভালো-মন্দ দ্রব্যই ত আজ পর্যন্ত উদরস্থ করেচি, এ নইলে সেগুলো আর হজম হবে না, পেটে লোহার মত ফুটবে।
জীবানন্দ। (হাসিবার চেষ্টা করিয়া) আজ উচ্ছ্বাসের কিছু বাড়াবাড়ি হচ্চে প্রফুল্ল।
প্রফুল্ল। (যুক্তহস্তে) তা হলে বসুন দাদা, এটা শেষ করি। মোসাহেবির পেন্সন বলে সেদিন যে উইলখানায় হাজার-পাঁচেক টাকা লিখে রেখেছেন, সেটার ওপরে দয়া করে একটা কলমের আঁচড় দিয়ে রাখবেন—চণ্ডীর টাকাটা হাতে এলে মোসাহেবের অভাব হবে না কিন্তু আমাকে দান করে অতগুলো টাকার আর দুর্গতি করবেন না।
জীবানন্দ। তা হলে এবার আমাকে তুমি সত্যিই ছাড়লে
প্রফুল্ল। আশীর্বাদ করুন এই সুমতিটুকু যেন শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে। কিন্তু কবে যাচ্চেন তিনি
জীবানন্দ। জানিনে।
প্রফুল্ল। কোথায় যাচ্চেন তিনি
জীবানন্দ। তাও জানিনে।
প্রফুল্ল। জেনেও কোন লাভ নেই দাদা। বাপ রে মেয়েমানুষ ত নয় যেন পুরুষের বাবা। মন্দিরে দাঁড়িয়ে সেদিন অনেকক্ষণ চেয়েছিলাম মনে হলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন পাথরে গড়া। ঘা মেরে গুঁড়ো করা যাবে কিন্তু আগুনে গলিয়ে ইচ্ছে মত ছাঁচে ঢেলে গড়বেন সে বস্তুই নয়। পারেন ত ও মতলবটা পরিত্যাগ করবেন।
জীবানন্দ। বিদ্রূপের স্বরে তা হলে প্রফুল্ল এবার নিতান্তই যাচ্চো
প্রফুল্ল। গুরুজনের আশীর্বাদের জোর থাকে ত মনস্কামনা সিদ্ধ হবে বৈ কি।
জীবানন্দ। তা হতে পারে। আচ্ছা ষোড়শী সত্যই চলে যাবে তোমার মনে হয়
প্রফুল্ল। হয়। কারণ সংসারে সবাই প্রফুল্ল নয়। ভালো কথা দাদা একটা খবর দিতে আপনাকে ভুলেছিলাম। কাল রাত্রে নদীর ধারে বেড়াচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি সেই ফকিরসাহেব। আপনাকে যিনি একদিন তাঁর বটগাছে ঘুঘু শিকার করতে দেননি—বন্দুক কেড়ে নিয়েছিলেন—তিনি। কুর্নিশ করে কুশল প্রশ্ন করলাম ইচ্ছে ছিল মুখরোচক দুটো খোশামোদ টোশামোদ করে যদি একটা কোন ভালরকমের ওষুধ টষুধ বার করে নিতে পারি ত আপনাকে ধরে পেটেন্ট নিয়ে বেচে দু’পয়সা রোজগার করব। কিন্তু ব্যাটা ভারী চালাক, সেদিক দিয়েই গেল না। কথায় কথায় শুনলাম তাঁর ভৈরবী মাকে দেখতে এসেছিলেন, এখন চলে যাচ্চেন। ভৈরবী যে সমস্ত ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্চেন তাঁর কাছেই শুনতে পেলাম।
জীবানন্দ। এঁর সদুপদেশের ফলেই বোধ হয়?
প্রফুল্ল। না। বরঞ্চ, উপদেশের বিরুদ্ধেই যাচ্চেন।
জীবানন্দ। বল কি হে, ফকির যে শুনি তাঁর গুরু! গুরু-আজ্ঞা লঙ্ঘন?
প্রফুল্ল। এক্ষেত্রে তাই বটে।
জীবানন্দ। কিন্তু এতবড় বিরাগের হেতু?
প্রফুল্ল। হেতু আপনি। কি জানি, এ কথা শোনানো আপনাকে উচিত হবে কিনা, কিন্তু ফকিরের বিশ্বাস আপনাকে তিনি মনে মনে অত্যন্ত ভয় করেন। পাছে কলহবিবাদের মধ্যে দিয়েও আপনার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায়, এই তাঁর সবচেয়ে দুশ্চিন্তা। নইলে ভয় তাঁর মিথ্যা কলঙ্কেও নয়, গ্রামের লোককেও নয়।
[জীবানন্দ বিস্ফারিত চক্ষে নীরবে চাহিয়া রহিলেন]
প্রফুল্ল। দাদা, ভগবান আপনাকেও বুদ্ধি বড় কম দেননি, কিন্তু সর্বস্ব সমর্পণ করে কাল তিনিই মারাত্মক ভুল করলেন, না হাত পেতে নিয়ে আপনিই মারাত্মক ভুল করলেন, সে মীমাংসা আজ বাকী রয়ে গেল। বেঁচে থাকি ত একদিন দেখতে পাব আশা হয়।
[জীবানন্দ নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন। সহসা বেয়ারা পাত্র ভরিয়া মদ লইয়া প্রবেশ করিতেই]
জীবানন্দ। আঃ—এখানেও! যা নিয়ে যা—দরকার নেই।
[বেয়ারা প্রস্থান করিল
প্রফুল্ল। রাগ করেন কেন দাদা, যেমন শিক্ষা। বরঞ্চ কখন দরকার সেইটেই বলে দিন না। অকস্মাৎ অমৃতে অরুচি যে দাদা?
জীবানন্দ। (হাসিয়া) অরুচি নয়, কিন্তু আর খাব না।
প্রফুল্ল। (হাসিয়া) এই নিয়ে ক’বার হলো দাদা?
জীবানন্দ। (হাসিয়া) এই মীমাংসাটাও আজ না হয় বাকী থাক প্রফুল্ল, যদি বেঁচে থাকো ত একদিন দেখতে পাবে আশা করি।
[বেয়ারা পুনরায় প্রবেশ করিল]
বেয়ারা। এই পিস্তলটা ভুলে টেবিলের ওপর ফেলে রেখে এসেছিলেন।
জীবানন্দ। ভুলেই এসেছিলাম বটে, কিন্তু ওতেও আর কাজ নেই, তুই নিয়ে যা।
প্রফুল্ল। কিন্তু রাত প্রায় এগারোটা হলো, বাড়ি চলুন।
জীবানন্দ। না, বাড়ি নয় প্রফুল্ল, এখন একলা অন্ধকারে একটু ঘুরতে বার হবো।
প্রফুল্ল। একলা? নিরস্ত্র? না না, সে হয় না দাদা। অন্ধকার রাত, পথে-ঘাটে আপনার অনেক শত্রু। অন্ততঃ নিত্য-সহচরটিকে সঙ্গে রাখুন। (এই বলিয়া সে ভৃত্যের হাত হইতে পিস্তল লইয়া দিতে গেল)
জীবানন্দ। (পিছাইয়া গিয়া) এ জীবনে ওকে আর আমি ছুঁচ্চিনে প্রফুল্ল। আজ থেকে আমি এমনি একাকী বার হবো, যেন কোথাও কোন শত্রু নেই আমার। আমার থেকেও কারও কোন না ভয় হোক; তার পরে যা হয় তা ঘটুক, আমি কারও কাছে নালিশ করব না।
প্রফুল্ল। হঠাৎ হলো কি? না হয়, পাইকদের কাউকে ডেকে দিই?
জীবানন্দ। না, পাইক-পেয়াদা আর নয়। তোমরা বাড়ি যাও।
প্রফুল্ল। আপনার অবাধ্য হবো না দাদা, আমরা চললাম, কিন্তু আপনিও বেশী বিলম্ব করবেন না আমার অনুরোধ।
[প্রফুল্ল ও বেয়ারা প্রস্থান করিল
[জীবানন্দ ধীরে ধীরে নাটমন্দিরের আর একটা দিকে আসিয়া উপস্থিত হইল। একজন থাম ঠেস দিয়া বসিয়া মৃদুকণ্ঠে নাম-গান করিতেছিল এবং অদূরে চার-পাঁচজন লোক চাদর মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছিল। জীবানন্দ হেঁট হইয়া অন্ধকারে তাহাকে দেখিবার চেষ্টা করিল]
গীত
পূজা করে তোরে তারা
সার যদি হয় নয়নধারা,
শুভঙ্করী নাম তবে মা
ধরিস কেন দুঃখ-হরা।
কি পাপেতে বল্ মা কালী
মাখালি কলঙ্ক-কালি—
এখন ভরসা কেবল কালী
তুই মা বরাভয়-করা।
জীবানন্দ। তুমি কে হে?
পথিক। আজ্ঞে, আমি একজন যাত্রী বাবু।
জীবানন্দ। বাবু বলে আমাকে চিনলে কি করে?
পথিক। আজ্ঞে, তা আর চেনা যায় না? ভদ্দরলোক ছাড়া এমন ধপধপে কাপড় আর কাদের থাকে বাবু?
জীবানন্দ। ওঃ—তাই বটে! কোথা থেকে আসচ? কোথায় যাবে? এরা বুঝি তোমার সঙ্গী?
পথিক। আসচি মানভূম জেলা থেকে বাবু, যাব পুরীধামে। এদের কারও বাড়ি মেদিনীপুরে, কারও বাড়ি আর কোথাও—কোথায় যাবে তাও জানিনে।
জীবানন্দ। আচ্ছা, কত লোক এখানে রোজ আসে? যারা থাকে তারা দু’বেলা খেতে পায়, না?
পথিক। (লজ্জিত হইয়া) কেবল খাবার জন্যেই নয় বাবু! আমার পা কেটে গিয়ে ঘায়ের মত হয়েছে দেখেই মা-ভৈরবী নিজে হুকুম দিয়েছিলেন যত দিন না সারে তুমি থাকো।
জীবানন্দ। তোমাকে যেতে বলিনি ভাই, বেশ ত থাকো না। জায়গার ত আর অভাব নেই।
পথিক। কিন্তু ভৈরবী মা ত আর নেই শুনতে পেলাম।
জীবানন্দ। এরই মধ্যে শুনতে পেয়েছ? তা নাই তিনি থাকলেন, তাঁর হুকুম ত আছে? তোমাকে যেতে বলে কার সাধ্য? বাড়ি কোথায় তোমার ভাই?
পথিক। বাড়ি আমার ছিল বাবু মানভুঁয়ের বংশীতট গাঁয়ে। গাঁয়ে অন্ন নেই, জল নেই, ডাক্তার-বদ্যি নেই—জমিদার থাকেন কলকাতায়, কখনো তাঁকে কেউ দুঃখ জানাতে পারিনে। আছে শুধু গোমস্তা টাকা আদায়ের জন্যে।
[জীবানন্দ নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়া সায় দিল]
পথিক। উপরি উপরি দু’সন বৃষ্টি হলো না, ক্ষেতের ফসল জ্বলে-পুড়ে গেল, এও সয়েছিল বাবু, —কিন্তু— (কান্নায় তাহার গলা বুজিয়া আসিল)
জীবানন্দ। তাই বুঝি তীর্থ-দর্শনে একবার বেরিয়ে পড়লে?
পথিক। (মাথা নাড়িয়া) এই ফাল্গুনে পরিবার মারা গেল, একে একে দুই ছেলে ওলাউঠায় চোখের সামনে মারা গেল বাবু, একফোঁটা ওষুধ কাউকে দিতে পারলাম না।
[বলিতে বলিতে লোকটি উচ্ছ্বসিত শোকে কাঁদিয়া ফেলিল। জীবানন্দ জামার হাতায় চোখ মুছিতে লাগিলেন]
পথিক। মনে মনে বললাম, আর কেন? ভাঙ্গা কুঁড়েখানি বিধবা ভাইঝিকে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম—বাবু, আমার চেয়ে দুঃখী আর সংসারে নেই।
জীবানন্দ। ওরে ভাই, সংসারটা ঢের বড় জায়গা, এর কোথায় কে কিভাবে আছে বলবার জো নেই।
পথিক। কিন্তু আমার মত—
জীবানন্দ। দুঃখী? কিন্তু দুঃখীদেরও কোন আলাদা জাত নেই দাদা, দুঃখেরও কোন বাঁধানো রাস্তা নেই। তা হলে সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে পারত। হুড়মুড় করে যখন ঘাড়ে এসে পড়ে তখনই কেবল মানুষ টের পায়। আমার সব কথা তুমি বুঝবে না ভাই, কিন্তু সংসারে তুমি একলা নও। অন্ততঃ একজন সাথী তোমার বড় কাছেই আছে, তাকে তুমি চিনতেও পারোনি। কিন্তু তুমি মায়ের নাম করছিলে—
[সহসা সাগর ও হরিহর দ্রুতপদে প্রবেশ করিয়া মন্দিরের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। জীবানন্দ উৎকর্ণ হইয়া শুনিতে লাগিল]
হরিহর। আমাদের মায়ের সর্বনাশ যে করেছে তার সর্বনাশ না করে আমরা কিছুতেই ছাড়ব না।
সাগর। মায়ের চৌকাঠ ছুঁয়ে দিব্যি করলাম খুড়ো, ফাঁসি যেতে হয় তাও যাব।
হরিহর। হঃ—আমাদের আবার জেল, আমাদের আবার ফাঁসি! মা আগে যাক—
হরিহর ও সাগর। জয় মা চণ্ডী!
[উভয়ের প্রস্থান
জীবানন্দ। বাস্তবিক, ঠাকুর-দেবতার মত এমন সহৃদয় শ্রোতা আর নেই। হোক না মিথ্যা দম্ভ, তবু তার দাম আছে। দুর্বলের ব্যর্থ পৌরুষ তবু একটু গৌরবের স্বাদ পায়।
পথিক। কি বললেন বাবু?
জীবানন্দ। কিছু না ভাই, মায়ের নাম করছিলে আমি বাধা দিলাম। আবার শুরু কর, আমি চললাম। কাল এমনি সময়ে হয়ত আবার দেখা পাবে।
পথিক। আর ত দেখা হবে না বাবু, আমি পাঁচদিন আছি, কালই সকালে চলে যেতে হবে।
জীবানন্দ। চলে যেতে হবে? কিন্তু এই যে বললে তোমার পা এখনো সারেনি, তুমি হাঁটতে পার না?
পথিক। মায়ের মন্দির এখন রাজাবাবুর। হুজুরের হুকুম তিনদিনের বেশি আর কেউ থাকতে পারবে না।
জীবানন্দ। (হাসিয়া) ভৈরবী এখনও যায়নি, এরই মধ্যে হুজুরের হুকুম জারি হয়ে গেছে? মা-চণ্ডীর কপাল ভালো! আচ্ছা, আজ অতিথিদের সেবা হলো কিরকম? কি খেলে ভাই?
পথিক। যাদের তিনদিনের বেশি হয়নি তারা মায়ের প্রসাদ সবাই পেলে।
জীবানন্দ। আর তুমি? তোমার ত তিনদিনের বেশি হয়ে গেছে?
পথিক। ঠাকুরমশাই কি করবেন, রাজাবাবুর হুকুম নেই কিনা।
জীবানন্দ। তাই হবে। (এই বলিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করিল)
জীবানন্দ। কাল আমি আবার আসব, কিন্তু ভাই, চুপিচুপি চলে যেতে পাবে না।
পথিক। ঠাকুরমশাই যদি কিছু বলে?
জীবানন্দ। বললেই বা। এত দুঃখ সইতে পারলে, আর বামুনের একটা কথা সইতে পারবে না? রাত হলো এখন যাই, কিন্তু মনে থাকে যেন।
[এমনি সময়ে ষোড়শী প্রদীপ-হস্তে ধীরে ধীরে প্রবেশ করিয়া মন্দিরের দ্বারের অভিমুখে অগ্রসর হইতেছিল, জীবানন্দ পিছন হইতে ডাক দিল]
জীবানন্দ। অলকা?
ষোড়শী। (চমকিয়া) আপনি? এত রাত্রে আপনি এখানে কেন?
জীবানন্দ। কি জানি, এমনি এসেছিলাম। তুমি যাত্রার আগে ঠাকুর-প্রণাম করতে যাচ্ছ, না? চল, আমি তোমার সঙ্গে যাই।
ষোড়শী। আমার সঙ্গে যাবার বিপদ আছে সে ত আপনি জানেন!
জীবানন্দ। বিপদ? জানি। কিন্তু আমার পক্ষ থেকে একেবারেই নেই। আজ আমি একা এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। এ জীবনে আর যাই কেন না স্বীকার করি, আমার শত্রু আছে এ আমি একটা দিনও আর মানব না।
ষোড়শী। কিন্তু কি হবে আমার সঙ্গে গিয়ে?
জীবানন্দ। কিছু না। শুধু যতক্ষণ আছ সঙ্গে থাকব, তার পর যখন সময় হবে তোমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আমি বাড়ি চলে যাব। যাবার দিন আজ আর আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো না। আমার আয়ুর দাম জানো, হয়ত আর দেখাও হবে না। আমাকে যে তুমি কতরকমে দয়া করে গেলে, শেষদিন পর্যন্ত আমি সেই কথাই স্মরণ করব।
ষোড়শী। আচ্ছা, আসুন আমার সঙ্গে।
[রুদ্ধ মন্দিরের দ্বারে গিয়া ষোড়শী প্রণাম করিল। জীবানন্দ বলিতে লাগিল]
জীবানন্দ। তোমাকে আমার প্রয়োজন অলকা। দুটো দিনও কি আর তোমার থাকা চলে না?
ষোড়শী। না।
জীবানন্দ। একটা দিন?
ষোড়শী। না।
জীবানন্দ। তবে সকল অপরাধ আমার এইখানে দাঁড়িয়ে আজ ক্ষমা কর!
ষোড়শী। কিন্তু তাতে কি আপনার প্রয়োজন আছে?
জীবানন্দ। এর উত্তর আজ দেবার আমার শক্তি নেই। এখন কেবল এই কথাই আমার সমস্ত মন ছেয়ে আছে অলকা, কি করলে তোমাকে একটা দিনও ধরে রাখতে পারি। উঃ—নিজের মন যার পরের হাতে চলে যায়, সংসারে তার চেয়ে নিরুপায় বুঝি আর কেউ নেই।
[ষোড়শী জীবানন্দের কাছে আসিয়া স্তব্ধ হইয়া নীরবে দাঁড়াইল]
জীবানন্দ। (দাঁড়াইয়া) আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ অলকা, সবাই জানবে আমি শাস্তি দিয়েছি, তুমি সহ্য করেছ, আর নিঃশব্দে চলে গেছ। এতবড় মিথ্যে কলঙ্ক আমি সইব কেমন করে? তাও সয় যদি একটি দিন—শুধু কেবল একটি দিনও তোমাকে কাছে রাখতে পারি।
ষোড়শী। (পিছাইয়া গিয়া) চৌধুরীমশাই, কিসের জন্যে এত অনুনয়-বিনয়? আপনার পাইক-পেয়াদাদের গায়ের জোরের ত আজও অভাব হয়নি। আপনি ত জানেন, আমি কারো কাছে নালিশ করবো না।
জীবানন্দ। (পথ ছাড়িয়া সরিয়া) তা হলে তুমি যাও। অসম্ভবের লোভে আর তোমাকে আমি পীড়ন করব না। পাইক-পেয়াদা সবাই আছে অলকা, তাদের জোরের অভাব হয়নি। কিন্তু যে নিজে ধরা দিলে না, জোর করে ধরে রেখে তার বোঝা বয়ে বেড়াবার জোর আর আমার গায়ে নেই।
ষোড়শী। (গড় হইয়া প্রণাম করিয়া জীবানন্দের পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া) আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ—
জীবানন্দ। কি অনুরোধ অলকা?
[বাহিরে গরুর গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ হইল]
ষোড়শী। দয়া করে একটু সাবধানে থাকবেন।
জীবানন্দ। সাবধানে থাকব! কি জানি, সে বোধ হয় আর পেরে উঠব না। কিছুক্ষণ পূর্বে এই মন্দিরে কে দুজন দেবতার চৌকাঠ ছুঁয়ে প্রাণ পর্যন্ত পণ করে শপথ করে গেল, তাদের মায়ের সর্বনাশ যে করেছে, তার সর্বনাশ না করে তারা বিশ্রাম করবে না,—আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজের কানেই ত সব শুনলাম—দুদিন আগে হলে হয়ত মনে হতো আমিই বুঝি তাদের লক্ষ্য—দুশ্চিন্তার সীমা থাকত না, কিন্তু আজ কিছু মনেই হলো না—কি অলকা? চমকালে কেন?
ষোড়শী। (পাংশু-মুখে) না কিছু না। এইবারে ত আপনার চণ্ডীগড় ছেড়ে বাড়ি যাওয়া উচিত? আর ত এখানে আপনার কাজ নেই।
জীবানন্দ। (অন্যমনস্কতায়) কাজ নেই?
ষোড়শী। কৈ আমি ত আর দেখতে পাইনে। এ গ্রাম আপনার, একে নিষ্পাপ করবার জন্যেই আপনি এসেছিলেন। আমার মত অসতীকে নির্বাসিত করার পরে আর এখানে আপনার কি আবশ্যক আছে আমি ত দেখতে পাইনে।
জীবানন্দ। (চোখ মেলিয়া চাহিয়া রহিয়া) কিন্তু তুমি ত অসতী নও!
[গাড়োয়ানের প্রবেশ]
গাড়োয়ান। মা, আর কি বেশী দেরি হবে?
ষোড়শী। না বাবা, আর বেশী দেরি হবে না।
[গাড়োয়ান প্রস্থান করিল
চণ্ডীগড় থেকে আপনাকে কিন্তু যেতেই হবে তা বলে দিচ্ছি।
জীবানন্দ। কোথায় যাব বল?
ষোড়শী। কেন, আপনার নিজের বাড়িতে। বীজগাঁয়ে।
জীবানন্দ। বেশ, তাই যাব।
ষোড়শী। কিন্তু কালকেই যেতে হবে।
জীবানন্দ। (মুখ তুলিয়া) কালই? কিন্তু কাজ আছে যে। মাঠে জলনিকাশের একটা সাঁকো করা দরকার। এদের জমিগুলো সব ফিরিয়ে দিতে হবে, সে ত তোমারই হুকুম। তা ছাড়া মন্দিরের একটা ভালো বিলি-ব্যবস্থা হওয়া চাই, —অতিথি-অভ্যাগত যারা আসে তাদের ওপর না অত্যাচার হয়—এ-সব না করেই তুমি চলে যেতে বলচ?
ষোড়শী। (মুশকিলে পড়িয়া) এ-সব সাধুসঙ্কল্প কি কাল সকাল পর্যন্ত থাকবে? (জীবানন্দ নীরব রহিল) কিন্তু আবশ্যকের চেয়ে একটা দিনও বেশী থাকবেন না আমাকে কথা দিন। এবং সে-ক’টা দিন আগেকার মত সাবধানে থাকবেন বলুন?
জীবানন্দ। (সে কথায় কান না দিয়া) আমার কৃতকর্মের ফল যদি আমি ভোগ করি সে অভিযোগ আমি কারুর কাছে করব না—কিন্তু যাবার সময় তোমার কাছে আমার শুধু একটিমাত্র দাবী আছে—(পকেট হইতে একখানি পত্র বাহির করিয়া ষোড়শীর হাতে দিয়া) এই চিঠিখানি ফকিরসাহেবকে দিয়ো।
ষোড়শী। দেবো। কিন্তু এ পত্র কি পড়তে পারিনে?
জীবানন্দ। পার, কিন্তু আবশ্যক নেই। এর জবাব দেবার ত প্রয়োজন হবে না। আমাকে দুঃখ থেকে বাঁচাবার জন্যে তার ঢের বেশী দুঃখ তুমি নিজে নিয়েচ। নইলে এমন করে হয়ত আমাকে—কিন্তু যাক সে। আমার শেষ অনুরোধ এতেই লেখা আছে, তা যদি রাখতে পার, তার চেয়ে আনন্দ আর আমার নেই।
ষোড়শী। তা হলে পড়ি?
[ষোড়শী নীরবে চিঠিখানি পড়িল, তাহার মুখে ভাবের একান্ত পরিবর্তন ঘটিল; জীবানন্দকে আড়াল করিয়া তাড়াতাড়ি সজল চক্ষু মুছিয়া ফেলিল]
ষোড়শী। আমি যে কুষ্ঠাশ্রমের দাসী হয়ে যাচ্চি এ খবর তুমি জানলে কি করে?
জীবানন্দ। কুষ্ঠাশ্রমের কথা অনেকেই জানে। আর তোমার কথা? আজই দেবতার স্থানে দাঁড়িয়ে যারা শপথ করে গেল, নিজের কানে শুনেও আমি যাদের চিনতে পারিনি তুমি তাদের চিনলে কি করে?
ষোড়শী। তোমার কি সংসারে আর মন নেই? সমস্ত বিলিয়ে নষ্ট করে দিয়ে কি তুমি সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যেতে চাও নাকি?
জীবানন্দ। (সহসা উত্তেজিত হইয়া) আমি সন্ন্যাসী? মিছে কথা। আমি বাঁচতে চাই—মানুষের মত, আমি মানুষের মত বাঁচতে চাই। বাড়ি চাই, ঘর চাই, স্ত্রী চাই, সন্তান চাই—আর মরণ যেদিন আটকাতে পারব না, সেদিন তাদের চোখের উপর দিয়েই চলে যেতে চাই। কিন্তু এ প্রার্থনা জানাব আমি কার কাছে?
[গাড়োয়ানের প্রবেশ]
গাড়োয়ান। মা, শৈবালদীঘি সাত-আট কোশের পথ, এখন বার না হলে পৌঁছাতে বেলা হয়ে যাবে।
ষোড়শী। চল বাবা, যাচ্চি।
[গাড়োয়ান প্রস্থান করিল। ষোড়শী পুনরায় জীবানন্দকে প্রণাম করিয়া]
আমি চললাম।
জীবানন্দ। এখনি? এত রাত্রে?
ষোড়শী। প্রজারা জানে আমি ভোরবেলায় যাত্রা করব, তারা এসে পড়বার পূর্বেই আমার বিদায় হওয়া চাই।
[প্রস্থান
জীবানন্দ। (একাকী অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া) অলকা! অলকা! একদিন তোমার মা আমার হাতে তোমাকে দিয়েছিলেন; তবু তোমাকে পেলাম না; কিন্তু সেদিন আমাকে যদি কেউ তোমার হাতে সঁপে দিতেন, আজ বোধ হয় তুমি অন্ধকারে আমাকে এমন করে ফেলে যেতে পারতে না।
[বাহির হইতে গরুর গাড়ি চালানোর শব্দ শুনা যাইতে লাগিল]
ষোড়শী – ৪.১
চতুর্থ অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
শান্তিকুঞ্জ
[জমিদারের ‘শান্তিকুঞ্জ’ তিন-চারিদিন হইল ভস্মীভূত হইয়াছে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বহু চিহ্ন তখনও বিদ্যমান। সবই পুড়িয়াছে, মাত্র ভৃত্যদের খান-দুই ঘর রক্ষা পাইয়াছে। ইহার মধ্যেই জীবানন্দ আশ্রয় লইয়াছেন। সম্মুখের খোলা জানালা দিয়া বারুই নদীর জল দেখা যাইতেছে; প্রভাতবেলায় সেইদিকে চোখ মেলিয়া জীবানন্দ নিঃশব্দে বসিয়াছিলেন। মুখে চাঞ্চল্য বা উত্তেজনার কোন প্রকাশ নাই, শুধু সারারাত্রি ধরিয়া উৎকট রোগ-ভোগের একটা অবসন্ন ম্লান ছায়া তাঁহার সর্বদেহে পরিব্যাপ্ত হইয়া আছে]
[প্রফুল্ল প্রবেশ করিল]
প্রফুল্ল। এখন কেমন আছেন দাদা?
জীবানন্দ। ভালো আছি।
প্রফুল্ল। বহুকালের অভ্যাস, ওষুধ বলেও যদি এক-আধ আউন্স—
জীবানন্দ। (সহাস্যে) ওষুধই বটে। না প্রফুল্ল, মদ আমি খাব না।
প্রফুল্ল। রাত্রিটা কাল কি উৎকণ্ঠাতেই আমাদের কেটেছে। যন্ত্রণায় হাত-পা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল।
জীবানন্দ। তাই এই গরম করার প্রস্তাব?
প্রফুল্ল। বল্লভ ডাক্তারের ভয়, হয়ত হঠাৎ হার্টফেল করতে পারে।
জীবানন্দ। হার্ট ত হঠাৎই ফেল করে প্রফুল্ল।
প্রফুল্ল। কিন্তু সেজন্যে ত একটা—
জীবানন্দ। (নিজের হার্ট হাত দিয়া দেখাইয়া) ভায়া, এ বেচারা বহু উপদ্রবেও সমানে চলতে কোনদিন ফেল করেনি। দৈবাৎ একদিন একটা অকাজ যদি করেই বসে ত মাপ করা উচিত।
প্রফুল্ল। কি একগুঁয়ে মানুষ আপনি দাদা। ভাবি, এতবড় জিদ এতকাল কোথায় লুকানো ছিল!
জীবানন্দ। ভালো কথা, তোমার ডালভাতের যোগাড়ে বার হবার যে একটা সাধু প্রস্তাব ছিল তার কতদূর?
প্রফুল্ল। ঘাট হয়েছে দাদা। আপনি ভালো হয়ে উঠুন, ডালভাতের চিন্তা তার পরেই করব।
জীবানন্দ। আমার ভালো হবার পরে ত? যাক তা হলে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
[তারাদাস ও পূজারীর প্রবেশ]
তারাদাস। মন্দিরের খানকয়েক থালা-ঘটি-বাটি পাওয়া যাচ্ছে না।
জীবানন্দ। না গেলে সেগুলো আবার কিনে নিতে হবে।
[ব্যস্ত হইয়া এককড়ির প্রবেশ]
এককড়ি। (ডাক ছাড়িয়া) এ কাজ সাগর সর্দারের। আজ খবর পাওয়া গেল, তাকে আর তার দু’জন সঙ্গীকে সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত এদিকে ঘুরে বেড়াতে লোক দেখেচে। থানায় সংবাদ পাঠিয়েচি, পুলিশ এল বলে। সমস্ত ভূমিজ গুষ্টিকে যদি না আমি এই ব্যাপারে আন্দামানে পাঠাতে পারি ত আমার নামই এককড়ি নন্দী নয়—বৃথাই আমি এতকাল হুজুরের সরকারে গোলামি করে মরচি।
জীবানন্দ। (একটু হাসিয়া) তা হলে তোমাকেও ত এদের সঙ্গে যেতে হয় এককড়ি। জমিদারের গোমস্তাগিরি কাজে তুমি যাদের ঘর জ্বালিয়েছ সে ত আমি জানি। এদের আগুন দিতে কেউ চোখে দেখেনি, কেবল সন্দেহের উপর যদি তাদের শাস্তি ভোগ করতে হয়, জানা-অপরাধের জন্য তোমাকেও ত তার ভাগ নিতে হয়।
এককড়ি। (প্রথমে হতবুদ্ধি হইয়া, পরে শুষ্ক হাস্যের সহিত) হুজুর মা-বাপ। আমাদের সাত-পুরুষ হুজুরের গোলাম। হুজুরের আদেশে শুধু জেল কেন, ফাঁসি যাওয়ায় আমাদের অহঙ্কার।
জীবানন্দ। যা পুড়েছে, সে আর ফিরবে না; কিন্তু এর পর যদি পুলিশের সঙ্গে জুটে নতুন হাঙ্গামা বাধিয়ে দু’পয়সা উপরি রোজগারের চেষ্টা কর, তা হলে হুজুরের লোকসানের মাত্রা ঢের বেড়ে যাবে এককড়ি।
পূজারী। মিস্ত্রী এসেছে হুজুরের কাছে নালিশ জানাতে।
জীবানন্দ। কিসের নালিশ?
পূজারী। মন্দিরের মেরামতি-কাজে ঘটনাচক্রে তার বিশেষ লোকসান হয়ে যায়। মা বলেছিলেন, কাজ শেষ হলে তার ক্ষতিপূরণ করে দেবেন। আমি তখন উপস্থিত ছিলাম হুজুর।
জীবানন্দ। তবে দেওয়া হয় না কেন?
পূজারী। (তারাদাসকে ইঙ্গিত করিয়া) উনি বলেন, যে বলেছিল তার কাছে গিয়ে আদায় করতে।
[জীবানন্দ ক্রুদ্ধ-চক্ষে তারাদাসের প্রতি চাহিতে]
তারাদাস। অনেকগুলো টাকা—
জীবানন্দ। অনেকগুলো টাকাই দেবে ঠাকুর।
তারাদাস। কিন্তু খরচটা ন্যায্য কিনা—
জীবানন্দ। দেখ তারাদাস, ও-সব শয়তানি মতলব তুমি ছাড়ো। ষোড়শীর ন্যায়-অন্যায় বিচারের ভার তোমার ওপরে নেই। যা বলে গেছেন তাই কর গে। (পূজারীর প্রতি) মিস্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে?
পূজারী। আছে হুজুর।
জীবানন্দ। চল, আমি নিজে গিয়ে সমস্ত মিটিয়ে দিচ্ছি।
[জীবানন্দ, প্রফুল্ল, তারাদাস ও পূজারীর প্রস্থান। রহিল শুধু এককড়ি]
[শিরোমণি ও জনার্দন রায়ের প্রবেশ]
জনার্দন। বাবু গেলেন কোথা?
এককড়ি। (তিক্তকণ্ঠে) কে জানে!
জনার্দন। কে জানে কি হে? পুলিশে খবর দেবার কথাটা তাঁকে বলেছিলে?
এককড়ি। পারেন, আপনিই বলুন না।
জনার্দন। ব্যাপার কি এককড়ি?
এককড়ি। কে জানে কি ব্যাপার। না আছে মেজাজের ঠিক, না পাই কোন কথার ঠিকানা। তারা ঠাকুরকে তেড়ে মারতে গেলেন, আমাকে পাঠাতে চাইলেন জেলে—
শিরোমণি। অত্যধিক মদ্যপানের ফল। হুজুর কি এখনি ফিরে আসবেন মনে হয়?
এককড়ি। বুঝলেন রায়মশায়, মিথ্যে সন্দেহ করে সাগর সর্দারের নাম পুলিশে জানানো চলবে না।
জনার্দন। মিথ্যে সন্দেহ কি হে? এ যে একরকম স্পষ্ট চোখে দেখা।
শিরোমণি। একেবারে প্রত্যক্ষ বললেই হয়।
এককড়ি। বেশ, তাই একবার বলে দেখুন না?
জনার্দন। বলবই ত হে। নইলে কি গুষ্টিবর্গ মিলে পুড়ে কয়লা হবো! ষোড়শীকে তাড়ানোর কাজে আমিও ত একজন উদ্যোগী।
শিরোমণি। আমার কথাই না কোন্ তারা শুনেছে!
জনার্দন। যারা এতবড় জমিদারের বাড়িতে আগুন দিতে পারে, তারা পারে না কি?
এককড়ি। আমিও তাই ভাবি।
জনার্দন। ভেবো পরে। এখন শীঘ্র কিছু একটা করো। এখানে যদি প্রশ্রয় পায় ত আমাকে ঘরে শিকল দিয়ে মানকচুর মত সেদ্ধ করে ছাড়বে।
শিরোমণি। ব্যাটারা গুরুর দোহাই মানবে না। ডাকাত কিনা! হয়ত বা ব্রহ্মহত্যাই করে বসবে। (শিহরিয়া উঠিলেন)
জনার্দন। আর শুধু কি কেবল বাড়ি? আমার কত ধানের গোলা, কত খড়ের মাড়, সবসুদ্ধ যদি—
শিরোমণি। দেখ ভায়া, আমি বরঞ্চ দিন-কতক শিষ্যবাড়ি থেকে ঘুরে আসি গে।
জনার্দন। কিন্তু আমার ত শিষ্যবাড়ি নেই? আর থাকলেও ত ধানের গোলা, খড়ের মাড় নিয়ে শিষ্যবাড়ি ওঠা যায় না?
শিরোমণি। না। গেলেও ও সকল ফিরিয়ে আনা কঠিন। আজকালকার শিষ্য-সেবকদের মতিগতিও হয়েছে অন্য প্রকার।
এককড়ি। চারিদিকে কড়া পাহারা মোতায়েন করে রাখুন।
জনার্দন। তা ত রেখেচি, কিন্তু পাহারা কি তোমাদেরই কম ছিল এককড়ি!
এককড়ি। আর একটা কথা শুনেছেন? ভূমিজ প্রজারা গিয়ে কাল আদালতে নালিশ করে এসেছে। শুনচি কান্নাকাটি শুনে স্বয়ং হাকিম আসবেন সরজমিন তদারকে।
জনার্দন। বল কি হে! চণ্ডীগড়ে বাস করে জমিদার আর আমার নামে নালিশ?
শিরোমণি। শিষ্যগণের আহ্বান উপেক্ষা করা আমার কর্তব্য নয় জনার্দন।
এককড়ি। দেখুন আস্পর্ধা! জীবনে বেশীদিন যারা পেটভরে খেতে পায় না, শীতের রাতে যারা বসে কাটায়, মড়কের দিনে যারা কুকুর-বেড়ালের মত মরে—
জনার্দন। আবার আবাদের দিনে একমুঠা বীজের জন্যে আমারই দরজার বাইরে পড়ে হত্যা দেয়—
এককড়ি। সেই নিমকহারাম ব্যাটারা আদালতে দাঁড়াবার টাকা পেলেই বা কোথা? এ দুর্মতি দিলেই বা তাদের কে?
জনার্দন। এই সোজা কথাটা ব্যাটারা বোঝে না যে, কেবল জেলে আদালতেই নয় হাইকোর্ট বলেও একটা-কিছু আছে যেখানে জীবানন্দ চৌধুরী, জনার্দন রায়কে ডিঙিয়ে সাগর সর্দার যেতে পারে না।
এককড়ি। নিশ্চয়। টাকা যার মোকদ্দমা তার। আপনার অর্থ আছে, সামর্থ্য আছে, ব্যারিস্টার জামাই আছে, কত উকিল-মোক্তার আছে; নালিশ যদি করেই, আপনার ভাবনা কিসের?
জনার্দন। (চিন্তিতভাবে) না এককড়ি, কেবল জমি বিক্রিই ত নয় (ইঙ্গিত করিয়া) আরো যে-সব কাজ করা গেছে, ফৌজদারী দণ্ডবিধি কেতাবের পাতায় পাতায় তার ফলশ্রুতি ত সহজ নয়!
এককড়ি। তা জানি। কিন্তু এই ছোটলোক চাষার দল হাকিমের কাছে আমল পেলে ত!
জনার্দন। বলা যায় না; এই কথাই আজ তোমার মনিবের কাছে পাড়ো গে। এখন চললাম।
এককড়ি। আসুন। আমিও ইতিমধ্যে একটা কাজ সেরে রাখি গে।
[শিরোমণি, এককড়ি ও জনার্দনের প্রস্থান
[কথা কহিতে কহিতে জীবানন্দ ও প্রফুল্ল প্রবেশ করিলেন]
জীবানন্দ। না প্রফুল্ল, সে হয় না। মাঠের জল-নিকাশী সাঁকো তৈরির পয়সা যদি নায়েবমশায়ের তবিলে না থাকে ত এখানকার বাড়ি মেরামতও বন্ধ থাক।
প্রফুল্ল। বেশ থাক। কিন্তু দেশে ফিরে চলুন।
জীবানন্দ। না।
প্রফুল্ল। না কিরকম? এ বাড়িতে আপনি থাকবেন কি করে?
জীবানন্দ। যেমন করে আছি। এ সহ্য হয়ে যাবে। মানুষের অনেক কিছুই সয় প্রফুল্ল।
প্রফুল্ল। সয় না দাদা, তারও সীমা আছে। শরীরটা যে হঠাৎ ভয়ানক ভেঙ্গে গেল। বর্ষা সুমুখে। এই ভাঙ্গা মন্দিরে কি এই ভাঙ্গা দেহে সে দুর্যোগ সইবে? রক্ষে করুন, এবার বাড়ি চলুন।
জীবানন্দ। (হাসিয়া) এই ভাঙ্গা দেহের দেহ-তত্ত্বের আলোচনা আর একদিন করা যাবে ভায়া, এখন কিন্তু নায়েবকে চিঠি লিখে দাও এ টাকা আমার চাই-ই। প্রজারা বছর বছর টাকা যোগাচ্ছে আর মরচে, এবার তাদের মরণ আটকাতে যদি জমিদারিটা মরে ত মরুক না।
[দ্রুতপদে জনার্দনের প্রবেশ]
জনার্দন। হুজুর কি নিজে—স্বয়ং হুকুম দিয়ে আমার—
জীবানন্দ। কি হুকুম রায়মশায়?
জনার্দন। আমার পুকুরধারের জায়গায় বেড়া ভেঙ্গে মন্দিরের জমির সঙ্গে এক করিয়ে দিয়েছেন?
জীবানন্দ। কোন্ জায়গাটা বলছেন? যেখানে বছর-কুড়ি পূর্বে মন্দিরের গোশালা ছিল?
জনার্দন। আমি ত জানিনে কবে আবার—
জীবানন্দ। অনেকদিন হয়ে গেল কিনা! বোধ হয় নানা কাজের ঝঞ্ঝাটে কথাটা ভুলে গেছেন।
জনার্দন। (দুঃসহ ক্রোধ দমন করিয়া) কিন্তু এ-সব করার আগে হুজুর ত আমার কাছে একটা খবর পাঠাতে পারতেন।
জীবানন্দ। খবর পৌঁছোবেই জানি। দু’দণ্ড আগে আর পরে। কিছু মনে করবেন না।
জনার্দন। কিন্তু আগে জানলে মামলা-মকদ্দমা হয়ত বাধত না।
জীবানন্দ। এতেও বাধা দেওয়া উচিত নয় রায়মশায়। ভৈরবীদের হাতে দেবীর বহু সম্পত্তিই বেহাত হয়ে গেছে। এখন সেগুলো হাত-বদল হওয়া দরকার।
জনার্দন। (শুষ্ক হাস্য করিয়া) তার চেয়ে আর ভালো কথা কি আছে হুজুর। শুনতে পাই সমস্ত গ্রামখানাই একদিন মা-চণ্ডীর ছিল। এখন কিন্তু—
জীবানন্দ। জমিদারের গর্ভে গেছে? তা গেছে। তারও ত্রুটি হবে না রায়মশায়! মন্দিরের দলিল, নকশা, ম্যাপ প্রভৃতি যা-কিছু আছে কলকাতায় এটর্নির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার একলার সাধ্য কি? আপনারা এ-কাজে আমার সহায় থাকবেন।
জনার্দন। থাকব বৈ কি হুজুর। আমরা চিরকাল হুজুর সরকারের চাকর বৈ ত নয়।
[জনার্দন প্রস্থান করিল। জীবানন্দ সকৌতুক হাসিমুখে তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া ক্ষণকাল নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন]
প্রফুল্ল। দাদা কি শেষে একটা লঙ্কাকাণ্ড বাধাবেন নাকি?
জীবানন্দ। যদি বাধে সে ভাগ্যের কথা প্রফুল্ল। তার জন্যে দেবতাদের একদিন তপস্যা করতে হয়েছিল।
প্রফুল্ল। দেবতারা পারেন। লঙ্কার বাইরে বসে তপস্যা করায় পুণ্যও আছে, দুশ্চিন্তাও কম। কিন্তু লঙ্কার ভিতরে যারা বাস করে, লঙ্কাকাণ্ডের ব্যাপারে তাদের ভাগ্যকে ঠিক সৌভাগ্য বলা চলে না। এসে পর্যন্ত গ্রামসুদ্ধ লোকের সঙ্গে বিবাদ করে বেড়ানো আপনার গৌরবেরও নয়, প্রয়োজনও নয়। ইতিমধ্যে নানাপ্রকার কার্যই ত করা গেল, এখন ক্ষান্ত দিয়ে চলুন বাড়ি ফিরে যাওয়া যাক।
জীবানন্দ। সময় হলেই যাব।
প্রফুল্ল। তাই যাবেন। যাই হোক দাদা, আপনার যাবার সময়ের তবু একটা আন্দাজ পাওয়া গেল, কিন্তু আমার যাবার সময় যে কবে আসবে তার কূল-কিনারাও চোখে পড়ে না।
[এককড়ির প্রবেশ]
এককড়ি। মিস্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। পুলের কাজটা কোথা থেকে আরম্ভ হবে জানতে চায়।
জীবানন্দ। চল না প্রফুল্ল, একবার মাঠে গিয়ে তাদের কাজটা দেখিয়ে আসি গে।
প্রফুল্ল। চলুন।
[জীবানন্দ প্রফুল্লকে লইয়া বাহির হইয়া গেলেন। অন্যদিক দিয়া শিরোমণি ও জনার্দন রায় প্রবেশ করিলেন]
জনার্দন। বাবু গেলেন কোথায় এককড়ি?
এককড়ি। মিস্ত্রীকে দেখাতে গেলেন। মাঠে সাঁকো তৈরি হবে।
জনার্দন। পাগলের খেয়াল।
শিরোমণি। মদ্যপান-জনিত বুদ্ধি-বিকৃতি।
এককড়ি। এই শনিবারে হাকিম সরজমিন-তদন্তে আসবেন। ছোটলোক ব্যাটাদের বুদ্ধি এবং টাকা কে যোগাচ্চে ঠিক জানতে পারলাম না, কিন্তু এইটুকু জানতে পারলাম তারা সাক্ষী মানলে হুজুর গোপন কিছুই করবেন না। দলিল তৈরির কথা পর্যন্ত না।
জনার্দন। (সহাস্যে) আমার বয়সটা কত হয়েচে ঠাওরাও এককড়ি? চণ্ডীগড়ের জনার্দন রায়কে ও-ধাপ্পায় কাত করা যাবে না, বাপু, আর কোন মতলব ভেঁজে এসো গো। (একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া) তবে, এ কথা মানি তোমার হাতে গিয়ে একটু পড়েচি। মোচড় দিয়ে দু’পয়সা উপরি রোজগারের সময় এই বটে। কিন্তু তাই বলে যা রয় সয় কর।
এককড়ি। সত্যি বলচি আপনাকে রায়মশায়—
জনার্দন। আহা, সত্যিই ত বলচ! এককড়ি নন্দী আবার মিথ্যে কবে বলেন? সে কথা নয় ভায়া, আমার না হয় শ’খানেক বিঘের টান ধরবে, কিন্তু তাঁর নিজের যাবে কত? সেটা কি তোমার মনিব খতিয়ে দেখেন নি? না দেখে থাকেন ত দেখাও গে চোখে আঙুল দিয়ে। তারপরে না হয় আমাকে প্যাঁচ ক’ষো।
এককড়ি। জায়গা-জমির কথাই হচ্চে না রায়মশাই, কথা হচ্চে দলিলপত্র তৈরি করার। জিজ্ঞাসা করলে সমস্তই বলবেন, কিছুই গোপন করবেন না।
জনার্দন। তার হেতু? শ্রীঘরে যাবার বাসনা ত? কিন্তু একা জনার্দন যাবে না এককড়ি, মহারানী হুজুর বলে রেয়াত করবে না, কথাটা তাঁকে ব’লো।
এককড়ি। (অভিমান-সুরে) বলতে হয় আপনি নিজেই বলবেন।
জনার্দন। বলব বৈ কি হে। ভালো করেই বলব। হাকিমের কাছে কবুল জবাব দিয়ে সাধু সাজা ঠাট্টা-তামাশা নয়। (ইঙ্গিতে দেখাইয়া) হাতকড়ি পড়বে।
এককড়ি। সে-আপনি বুঝবেন আর তিনি বুঝবেন।
জনার্দন। আর তুমি? শ্রীমান এককড়ি নন্দী? বাড়ি যখনি পুড়েছে তখনি জানি কি-একটা ভেতরে হচ্চে। কিন্তু জনার্দনকে অত নরম মাটি ঠাউরো না ভায়া, পস্তাবে। নির্মলকে আটকে রেখেচি, সে-ই তোমাদের বুঝিয়ে দেবে। এককড়ি। আমার ওপরে মিথ্যে রাগ করচেন রায়মশায়, যা জানি তাই শুধু জানিয়েচি। বিশ্বাস না হয়, হুজুর ত এই সামনের মাঠেই আছেন, একটু ঘুরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেই যান না।
জনার্দন। তাই যাব। শিরোমণিমশায়, আসুন ত?
শিরোমণি। চল না ভায়া, ভয় কিসের?
[দুই-এক পা অগ্রসর হইয়া সহসা পিছন ফিরিয়া]
শিরোমণি। (এককড়ির প্রতি) বলি, অত্যধিক মদ্যপান করে নেই ত? তা হলে না হয়—
এককড়ি। মদ তিনি খান না! (হঠাৎ কণ্ঠস্বর সংযত করিয়া) কিন্তু যেতেও আর হবে না। হুজুর নিজেই আসছেন।
[জীবানন্দ ও প্রফুল্ল তর্ক করিতে করিতে প্রবেশ করিলেন]
জনার্দন। (কাছে গিয়া স্বাভাবিক ব্যাকুলতার সহিত) হুজুর, সমস্ত ব্যাপার একবার মনে করে দেখুন।
জীবানন্দ। কিসের রায়মশায়?
জনার্দন। জমি-বিক্রির ব্যাপারে হাকিম নিজে আসছেন তদন্ত করতে। হয়ত ভারী মকদ্দমাই বাধবে। কিন্তু আপনি নাকি—
জীবানন্দ। ওঃ! কিন্তু উপায় কি রায়মশায়? সাহেব জমি ছাড়তে চায় না, সে সস্তায় কিনেচে। মকদ্দমা ত বাধবেই। সুতরাং মামলা জেতা ছাড়া প্রজাদের আর ত পথ দেখিনে।
জনার্দন। (আকুল হইয়া) কিন্তু আমাদের পথ?
জীবানন্দ। (ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া) সে ঠিক, আমাদের পথও খুব দুর্গম মনে হয়।
জনার্দন। (মরিয়া হইয়া) এককড়ি তা হলে সত্যই বলেছে! কিন্তু হুজুর, পথ শুধু দুর্গম নয়—জেল খাটতে হবে, এবং আমরা একা নয়, আপনিও বাদ যাবেন না।
জীবানন্দ। (একটুখানি হাসিয়া) তাই বা কি করা যাবে রায়মশায়! শখ করে যখন গাছ পোঁতা গেছে, ফল তার খেতে হবে বৈ কি!
জনার্দন। (চীৎকার করিয়া) এ আমাদের সর্বনাশ করবে এককড়ি।
[পাগলের মত ঝড়ের বেগে জনার্দন বাহির হইয়া গেল, তাহার পিছনে এককড়ি নিঃশব্দে প্রস্থান করিল, নেপথ্যে কোলাহল]
জীবানন্দ।(ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) কারা যায় প্রফুল্ল?
প্রফুল্ল। বোধ হয় আপনার মাটি-কাটা ধাঙড়-কুলীর দল।
জীবানন্দ। একবার ডাক ত, ডাক ত হে। শুনি আজ বাঁধের কাজ কতখানি করলে।
প্রফুল্ল। (ঈষৎ অগ্রসর হইয়া) ওহে, ও সর্দার? শোন শোন, একবার শুনে যাও।
[স্ত্রী ও পুরুষ কুলীদের প্রবেশ]
সর্দার। কি রে, ডাকচিস্ কেনে?
জীবানন্দ। বাবারা, কোথায় চলেচিস বল্ ত?
সর্দার। ভাত খাবার লাগি রে।
জীবানন্দ। দেখিস বাবারা, আমার বাঁধের কাজ যেন বর্ষার আগেই শেষ হয়।
সকলে। (সমস্বরে) সব হোয়ে যাবে রে, সব হোয়ে যাবে। তুই কিছু ভাবিস্ না। চল্।
[কুলীদের প্রস্থান
[নির্মল প্রবেশ করিল]
জীবানন্দ। (সাদরে) আসুন, আসুন, নির্মলবাবু।
নির্মল। (নমস্কার করিয়া) আপনার সঙ্গে আমার একটু কাজ আছে।
জীবানন্দ। আর একদিন হলে হয় না?
নির্মল। না, আমার বিশেষ প্রয়োজন।
জীবানন্দ। তা বটে। অকাজের বোঝা টানতে যাঁকে আটক থাকতে হয় তাঁর সময় নষ্ট করা চলে না।
নির্মল। অকাজ মানুষে করে বলেই ত সংসারে আমাদের প্রয়োজন চৌধুরীমশাই।
জীবানন্দ। কিন্তু কাজের ধারণা ত সকলের এক নয় নির্মলবাবু। রায়মশায়ের আমি অকল্যাণ কামনা করিনে, এবং আপনার উদ্দেশ্য সফল হলে আমি বাস্তবিকই খুশী হব, কিন্তু আমার কর্তব্যও আমি স্থির করে ফেলেছি, এ থেকে নড়চড় করা আর সম্ভব হবে না।
নির্মল। এ কথা কি সত্য যে আপনি সমস্তই স্বীকার করবেন?
জীবানন্দ। সত্য বৈ কি।
নির্মল। এমন ত হতে পারে আপনার কবুল জবাবে আপনিই শুধু শাস্তি পাবেন, কিন্তু আর সকলে বেঁচে যাবেন।
জীবানন্দ। খুব সম্ভব বটে। কিন্তু সেজন্যে আমার কোন অভিযোগ নেই নির্মলবাবু। নিজের কৃতকর্মের ফল আমি একা ভোগ করলেই যথেষ্ট। নইলে রায়মশায় নিস্তার লাভ করে সুস্থদেহে সংসার-যাত্রা নির্বাহ করতে থাকুন এবং আমার এককড়ি নন্দীমশায়ও আর কোথাও গোমস্তাগিরি-কর্মে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি লাভ করতে থাকুন, কারও প্রতি আমার আক্রোশ নেই।
নির্মল। আত্মরক্ষায় সকলেরই ত অধিকার আছে, অতএব শ্বশুরমশায়কেও করতে হবে। আপনি নিজে জমিদার, আপনার কাছে মামলা-মকদ্দমার বিবরণ দিতে যাওয়া বাহুল্য—শেষ পর্যন্ত হয়ত বা বিষ দিয়ে বিষের চিকিৎসা করতে হবে।
জীবানন্দ। চিকিৎসক কি জাল-করার বিষে খুন করার ব্যবস্থা দেবেন?
নির্মল। (রাগ সংবরণ করিয়া) এমন ত হতে পারে কারও কোন শাস্তিভোগ করারই আবশ্যক হবে না, অথচ ক্ষতিও কাউকে স্বীকার করতে হবে না।
জীবানন্দ। (তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া) বেশ ত পারেন ভালোই। কিন্তু আমি অনেক চিন্তা করে দেখেচি সে হবার নয়। কৃষকেরা তাদের জমি ছাড়বে না। কারণ এ শুধু অন্নবস্ত্রের কথা নয়, তাদের সাত-পুরুষের চাষ-আবাদের মাঠ, এর সঙ্গে তাদের নাড়ীর সম্পর্ক। এ তাদের নিতেই হবে। (একটু চুপ করিয়া) আপনি ভালোই জানেন, অন্য পক্ষ অত্যন্ত প্রবল, তার উপর জোর-জুলুম চলবে না। চলতে পারে কেবল চাষাদের উপর, কিন্তু চিরদিন তাদের প্রতিই অত্যাচার হয়ে আসছে, আর হতে আমি দেব না।
নির্মল। আপনার বিস্তীর্ণ জমিদারি; এই ক’টা চাষার কি আর তাতে স্থান হবে না? কোথাও না কোথাও—
জীবানন্দ। না না, আর কোথাও না—এই চণ্ডীগড়ে। এইখানে আমি জোর করে সেদিন তাদের কাছে অনেক টাকা আদায় করেছি—আর সে টাকা যুগিয়েছেন জনার্দন রায়। এ ঋণ পরিশোধ করতে আমাকে হবেই, এবং আরও যে কতবড় একটা শূল তাদের বিদ্ধ করেছি, সে কথা শুধু আমিই জানি। কিন্তু যাক। অপ্রীতিকর আলোচনায় আর আমার প্রবৃত্তি নেই নির্মলবাবু, আমি মনস্থির করেছি।
[জীবানন্দ প্রস্থান করিলেন।
[সেই দিকে চাহিয়া নির্মল অভিভূতের ন্যায় স্থির হইয়া রহিল। এমনি সময়ে ফকিরসাহেব প্রবেশ করিলেন]
ফকির। জামাইবাবু, সেলাম। বাবু কৈ?
নির্মল। (অভিবাদন করিয়া) জানিনে। ফকিরসাহেব, ষোড়শীকে আমাদের বড় প্রয়োজন। তিনি যেখানেই থাকুন একবার আমাকে দেখা করতেই হবে। বলুন, কোথায় আছেন।
ফকির। আপনাকে জানাতে আমার বাধা নেই। কারণ, একদিন যখন সবাই তাঁর সর্বনাশে উদ্যত হয়েছিল, তখন আপনিই শুধু তাঁকে রক্ষা করতে দাঁড়িয়েছিলেন।
নির্মল। আজ আবার ঠিক সেইটি উলটে দাঁড়িয়েচে ফকিরসাহেব। এখন, কেউ যদি তাঁদের বাঁচাতে পারে ত শুধু তিনিই। কোথায় আছেন এখন?
ফকির। শৈবালদীঘির কুষ্ঠাশ্রমে।
নির্মল। কুষ্ঠাশ্রমে? সেখানে কি সুখে আছেন?
ফকির। (মৃদু হাসিয়া) এই নিন! মেয়েমানুষের সুখে থাকার খবর দেবতারা জানেন না, আমি ত আবার সন্ন্যাসীমানুষ। তবে, মা আমার শান্তিতে আছেন এইটুকুই অনুমান করতে পারি।
নির্মল। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) এখানে আপনি কোথায় এসেছিলেন?
ফকির। জমিদার জীবানন্দের এই চিঠি পেয়ে তাঁরই সঙ্গে একবার দেখা করতে। এই চিঠি আপনাদের পড়া প্রয়োজন। নিন পড়ুন। (চিঠিখানি দিতে গেলেন)
নির্মল। (সসঙ্কোচে) জীবানন্দের লেখা? ও আমি ছোঁব না। প্রয়োজন থাকে আপনিই পড়ুন।
ফকির। প্রয়োজন আছে। নইলে বলতাম না। পত্র আমাকেই লেখা।
[ফকির ধীরে ধীরে চিঠিখানি পড়িতে লাগিলেন এবং নির্মলের মুখের ভাব সংশয় ও বিস্ময়ে কঠিন হইয়া উঠিতে লাগিল]
ফকির। (পত্র পাঠ—)
“ফকির সাহেব,—
ষোড়শীর আসল নাম অলকা। সে আমার স্ত্রী। আপনার কুষ্ঠাশ্রমের কল্যাণ কামনা করি, কিন্তু তাহাকে দিয়া কোন ছোট কাজ করাইবেন না। আশ্রম যেখানে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন সে আমার নয়, কিন্তু তাহার সংলগ্ন শৈবালদীঘি আমার। এই গ্রামের মুনাফা প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা। আপনাকে জানি। কিন্তু আপনার অবর্তমানে পাছে কেহ তাহাকে নিরুপায় মনে করিয়া অমর্যাদা করে, এই ভয়ে আশ্রমের জন্যই গ্রামখানি তাহাকে দিলাম। আপনি নিজে একদিন আইন-ব্যবসায়ী ছিলেন, এই দান পাকা করিয়া লইতে যাহা কিছু প্রয়োজন, করিবেন, সে খরচ আমিই দিব। কাগজপত্র প্রস্তুত করিয়া পাঠাইলে আমি সহি করিয়া রেজেস্টারি করিয়া দিব।
শ্রীজীবানন্দ চৌধুরী”
ফকির। (নির্মলের মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়া) সংসারে কত বিস্ময়ই না আছে!
নির্মল। (দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া, ঘাড় নাড়িয়া) হাঁ। কিন্তু এ যে সত্য তার প্রমাণ কি?
ফকির। সত্য না হলে এ দান নেবার জন্যে ষোড়শীকে কিছুতেই আনতে পারতাম না।
নির্মল। (ব্যগ্রকণ্ঠে) কিন্তু তিনি কি এসেচেন? কোথায় আছেন?
ফকির। আছেন আমার কুটীরে, নদীর পরপারে।
নির্মল। আমার যে এখনি একবার যাওয়া চাই ফকিরসাহেব।
ফকির। চলুন। (হাসিয়া) কিন্তু বেলা পড়ে এল, আবার না তাঁকে হাত ধরে রেখে যেতে হয়।
[উভয়ের প্রস্থান
[সহসা অন্তরাল হইতে কয়েকজনের সতর্ক, চাপা কোলাহলের মধ্য হইতে প্রফুল্লর কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শোনা গেল—“সাবধানে! সাবধানে! দেখো যেন ধাক্কা না লাগে!” এবং পরক্ষণেই তাহারা ধরাধরি করিয়া জীবানন্দকে বহিয়া আনিয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিল। তাঁহার চক্ষু মুদ্রিত। সঙ্গে প্রফুল্ল]
প্রফুল্ল। এখন কেমন মনে হচ্চে দাদা?
জীবানন্দ। ভালো না। আমি অজ্ঞান হয়ে সাঁকো থেকে পড়ে গিয়েছিলাম প্রফুল্ল?
প্রফুল্ল। না দাদা, আমরা ধরে ফেলেছিলাম। কতবার বলছি এ রুগ্নদেহে এত পরিশ্রম সইবে না, কিছুতে কান দিলেন না। কি সর্বনাশ করলেন বলুন ত?
জীবানন্দ। (চক্ষু মেলিয়া) সর্বনাশ কোথায় প্রফুল্ল, এই ত আমার পার হবার পাথেয়। এ ছাড়া এ জীবনে আর সম্বল ছিল কৈ?
[দ্রুতবেগে এককড়ি প্রবেশ করিল, তাহার হাতে একটা কাঁচের শিশি]
এককড়ি। (প্রফুল্লের প্রতি) এখ্খুনি হুজুরকে এটা খাইয়ে দিন। বল্লভ ডাক্তার দৌড়ে আসছে এলো বলে।
প্রফুল্ল। (শিশি হাতে লইয়া জীবানন্দের কাছে গিয়া) দাদা! এই ওষুধটুকু যে খেতে হবে।
জীবানন্দ। (চক্ষু মুদ্রিত) খেতে হবে? দাও। (ঔষধ পান করিয়া) কোথায় যেন ভয়ানক ব্যথা প্রফুল্ল, যেন এ ব্যথার আর সীমা নেই। উঃ—
প্রফুল্ল। (ব্যকুল-কণ্ঠে) এককড়ি, দেখ না একবার ডাক্তার কত দূরে—যাও না আর একবার ছুটে।
এককড়ি। ছুটেই যাচ্চি বাবু—
[দ্রুতপদে প্রস্থান
জীবানন্দ। ছুটোছুটিতে আর কি হবে প্রফুল্ল? মনে হচ্চে যেন আজ আর তোমরা ছুটে আমার নাগাল পাবে না।
প্রফুল্ল। (নিকটে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া) এমন ত কতবার হয়েছে, কতবার সেরে গেছে দাদা। আজ কেন এ-রকম ভাবছেন?
জীবানন্দ। ভাবছি? না প্রফুল্ল, ভাবিনি। (ঈষৎ হাসিয়া) অসুখ বহুবার হয়েছে এবং বহুবার সেরেছে সে ঠিক। কিন্তু এবার যে আর কিছুতেই সারবে না সেও ত এমনিই ঠিক প্রফুল্ল।
[এককড়ি ও বল্লভ ডাক্তারের প্রবেশ]
প্রফুল্ল। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) আসুন ডাক্তারবাবু।
বল্লভ। হুজুরের অসুখ—ছুটতে ছুটতে আসচি। ওষুধটা খাওয়ানো হয়েছে ত?
এককড়ি। হয়েচে ডাক্তারবাবু, তখ্খুনি হয়েছে। ওষুধের শিশি হাতে উঠি ত পড়ি করে ছুটে এসেছি।
[বল্লভ কাছে আসিয়া বসিল। কিছুক্ষণ ধরিয়া নাড়ী পরীক্ষা করিয়া মুখ বিকৃত করিল। মাথা নাড়িয়া প্রফুল্লকে ইঙ্গিতে জানাইল যে অবস্থা ভালো ঠেকিতেছে না]
এককড়ি। (আকুল-কণ্ঠে) কি হবে ডাক্তারবাবু! খুব ভাল জোরালো একটা ওষুধ দিন—আমরা ডবল ভিজিট দেব—যা চাইবেন দেব—
প্রফুল্ল। যা চাইবেন দেব? শুধু এই? সে আর কতটুকু এককড়ি? আমরা তারও অনেক, অনেক বেশি দেব। আমার নিজের প্রাণের দাম বেশি নয়, কিন্তু সে দেওয়াও ত আজ অতি তুচ্ছ মনে হয় ডাক্তারবাবু।
বল্লভ। (উপরের দিকে মুখ তুলিয়া) সমস্তই ওঁর হাতে প্রফুল্লবাবু, নইলে আমার আর কি! নিমিত্তমাত্র। লোকে শুধু মিথ্যে ভাবে বৈ ত না যে, চণ্ডীগড়ের বল্লভ ডাক্তার মরা বাঁচাতে পারে! ওষুধের বাক্স সঙ্গেই এনেছি, এ-সব ভুল আমার হয় না। চলুন নন্দীমশাই, শিগ্গির একটা মিক্চার তৈরি করে দিই।
[এককড়ি ও বল্লভের প্রস্থান
জীবানন্দ। চোখ বুজে শুয়ে কত কি মনে হচ্ছিল প্রফুল্ল। মনে হচ্ছিল, আশ্চর্য এই পৃথিবী। নইলে আমার জন্যে চোখের জল ফেলতে তোমাকে পেয়েছিলাম কি করে?
প্রফুল্ল। আপনি ত জানেন—
জীবানন্দ। জানি বৈ কি প্রফুল্ল! কিন্তু এককড়ি তার কি জানে? সে জানে তারই মত তুমিও শুধু একজন কর্মচারী, এক পাষণ্ড জমিদারের তেমনি অসাধু সঙ্গী। কত যে করেছ, নীরবে কত যে সয়েছ, বাইরের লোকে তার কি খবর রাখে। মাঝে মাঝে যখন অসহ্য হয়েচে দুটো ভাতডাল যোগাড়ের ছল করে ত্যাগ করে যেতে চেয়েছ, কিন্তু যেতে আমি দিইনি। আজ ভাবি ভালোই করেচি। সত্যই ছেড়ে চলে যদি যেতে প্রফুল্ল, আজকের দুঃখ রাখবার জায়গা পেতে কোথায়?
প্রফুল্ল। দাদা—
জীবানন্দ। একটুখানি কাগজ-কলম আনো না প্রফুল্ল, তোমার দাদার স্নেহের দান—
প্রফুল্ল। (পদতলে নতজানু হইয়া বসিয়া) স্নেহ আপনার অনেক পেয়েছি দাদা, সেই শুধু আমার সম্বল হয়ে থাক। আপনি কেবল আমাকে এই আশীর্বাদ করুন, নিজের পরিশ্রমে যা-কিছু পাই এ জীবনে তার বেশি না লোভ করি।
জীবানন্দ। (ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া) বেশ, তাই হোক প্রফুল্ল। দান করে তোমাকে আমি খাটো করে যাব না। কিন্তু লোভী তুমি ত কোনদিনই নও!
[বল্লভ নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া ঔষধের পাত্র প্রফুল্লের হাতে দিয়া তেমনি নিঃশব্দে প্রস্থান করিল]
প্রফুল্ল। দাদা! এই ওষুধটুকু খান।
[প্রফুল্ল কাছে আসিয়া ঔষধ জীবানন্দের মুখে ঢালিয়া দিয়া নিজের কোঁচার খুঁট দিয়া তাঁহার ওষ্ঠপ্রান্ত মুছাইয়া দিল]
জীবানন্দ। কি ভয়ানক অন্ধকার প্রফুল্ল! রাত্রি কত হলো ভাই?
প্রফুল্ল। রাত্রি ত এখনো হয়নি দাদা।
জীবানন্দ। হয়নি? তবে আমার দু’চক্ষে এ নিবিড় আঁধার কিসের প্রফুল্ল?
প্রফুল্ল। অন্ধকার ত নেই দাদা! এখনো যে সূর্যাস্তও হয়নি।
জীবানন্দ। হয়নি? যায়নি সূর্য এখনো ডুবে? তবে খোল, খোল,—আমার সুমুখের জানালা খুলে দাও প্রফুল্ল, একবার দেখি তাঁকে। যাবার আগে আমার শেষ নমস্কার তাঁকে জানিয়ে যাই।
[প্রফুল্ল সম্মুখের বাতায়ন খুলিয়া দিল এবং কাছে আসিয়া জীবানন্দের ইঙ্গিত-মত তাঁহার মাথাটি সযত্নে উঁচু করিয়া দিল। অদূরে বারুইয়ের শীর্ণ জলধারা মন্দবেগে বহিতেছে। পরপারে সূর্য অস্তগমনোম্মুখ। দূরে নীল বনানী আরক্ত আভায় রঞ্জিত। তটে ধূসর বালুকারাশি উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে]
জীবানন্দ। (চোখ মেলিয়া কম্পিত দুই হস্ত যুক্ত করিয়া ললাটে স্পর্শ করাইলেন। ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) বিশ্বদেব! কে বলে তুমি অচেনা? তুমি চির-রহস্যে ঢাকা?
জন্মান্তরের সহস্র পরিচয় যে আজ যাবার দিনে তোমার মুখে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। (একমুহূর্ত নীরব থাকিয়া) ভেবেছিলাম, হয়ত তোমাকে দেখে ভয় হবে—হয়ত এ জীবনের শতেক গ্লানি দীর্ঘ কালো ছায়া মেলে আজ মুখ তোমার ঢেকে দেবে, কিন্তু সে ত হতে দাওনি! বন্ধু, এ-জন্মের শেষ নমস্কার তুমি গ্রহণ কর। (শ্রান্তিতে ঢলিয়া পড়িয়া) উঃ— কি ব্যথা!
প্রফুল্ল। (ব্যাকুল কণ্ঠে) ব্যথা কোথায় দাদা?
জীবানন্দ। কোথায়? মাথায়, বুকে, আমার সর্বাঙ্গে, প্রফুল্ল—উঃ—
[দ্রুতপদে ষোড়শী প্রবেশ করিল। তাহার পশ্চাতে এককড়ি ও বল্লভ ডাক্তার]
ষোড়শী। এ কি কথা এরা সব বলে প্রফুল্ল! (জীবানন্দের পদতলে বসিয়া পড়িল) তোমাকে নিয়ে যাবার জন্যে যে আজ সমস্ত ছেড়ে চলে এসেচি! কিন্তু নিষ্ঠুর—অভিমানে এ কি করলে তুমি!
প্রফুল্ল। দাদা, চেয়ে দেখুন অলকা এসেছেন।
জীবানন্দ। অলকা? এলে তুমি? (ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া) কিন্তু, সময় নেই আর।
ষোড়শী। কিন্তু, এই যে সেদিন বললে, তুমি সংসারে বাঁচতে চাও—মানুষের মাঝখানে মানুষের মত হয়ে। তুমি বাড়ি চাও, ঘর চাও, স্ত্রী চাও, সন্তান চাও—
জীবানন্দ। (মাথা নাড়িয়া) না। আজ ফাঁকি দিয়ে আর কিছুই চাইনে অলকা। চিরদিন কেবল ফাঁকি দিয়ে পেয়ে পেয়েই স্পর্ধা বেড়ে গিয়েছিল, ভেবেছিলাম, এমনিই বুঝি। কিন্তু আজ! তার কৈফিয়ত দেবার দিন এসেছে। সৌভাগ্য এ-জীবনে অর্জন করিনি অলকা, সেই ত ঋণ—সে বোঝা আর যেন আমার না বাড়ে।
[ষোড়শী জীবানন্দের বুকের উপরে মাথা রাখিতে তিনি ধীরে ধীরে তাঁহার অক্ষম হাতখানি ষোড়শীর মাথার পরে রাখিলেন]
জীবানন্দ। অভিমান ছিল বৈ কি একটু। তবু যাবার আগে এই ত তোমাকে পেলাম। এর অধিক পাওয়া সংসারের নিত্য কাজে হয়ত বা কখনো ক্ষুণ্ণ, কখনো বা ম্লান হতো, কিন্তু সে ভয় আর রইল না। এ মিলনের আর বিচ্ছেদ নেই, অলকা, এই ভালো। এই ভালো।
[ষোড়শী কথা কহিতে পারিল না, দুঃসহ রোদনের বেগে তাহার সমস্ত বক্ষ ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল]
জীবানন্দ। উঃ! পৃথিবীতে কি আর হাওয়া নেই প্রফুল্ল?
প্রফুল্ল। কষ্ট কি খুব বেশি হচ্চে দাদা? ডাক্তারকে কি একবার ডাকব?
জীবানন্দ। না না, আর ডাক্তার-বদ্যি নয় প্রফুল্ল, শুধু তুমি আর অলকা। উঃ—কি অন্ধকার! সূর্য কি অস্ত গেল ভাই?
প্রফুল্ল। এইমাত্র গেল দাদা।
জীবানন্দ। তাই। হাওয়া নেই, আলো নেই, বিশ্বদেব! এ-জীবনের শেষ দান কি তবে নিঃশেষ করেই নিলে! উঃ—
ষোড়শী। স্বামী!
প্রফুল্ল। প্রফুল্লকে কি আজ সত্যিই ছুটি দিলে দাদা!