- বইয়ের নামঃ বিজয়া
- লেখকের নামঃ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মুঠোবই
- বিভাগসমূহঃ নাটকের বই
বিজয়া – ১.১
বিজয়া
নাট্যোল্লিখিত ব্যক্তিগণ
পুরুষ
রাসবিহারী : মৃত বনমালীর বন্ধু ও বিজয়ার অভিভাবক
বিলাসবিহারী : রাসবিহারীর পুত্র
নরেন : বনমালী ও রাসবিহারীর বন্ধু মৃত জগদীশের পুত্র
দয়াল : বিজয়ার মন্দিরের আচার্য
পূর্ণ গাঙ্গুলী : নরেনের মাতুল
কালীপদ : বিজয়ার ভৃত্য
পরেশ : ঐ বালক-ভৃত্য
কানাই সিং: ঐ দরোয়ান
গ্রামবাসিগণ, নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকগণ, কর্মচারিগণ ইত্যাদি।
স্ত্রী
বিজয়া : বনমালীর কন্যা
নলিনী : দয়ালের ভাগিনেয়ী
পরেশের মা : বিজয়ার দাসী
দয়ালের স্ত্রী, নিমন্ত্রিতা মহিলাগণ, গ্রামবাসিনীগণ ইত্যাদি।
প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
বিজয়ার বসিবার ঘর
বিজয়া। জগদীশ মুখুয্যে কি সত্যিই ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন?
বিলাস। তাতে সন্দেহ আছে নাকি? মদমত্ত অবস্থায় উড়তে গিয়েছিলেন।
বিজয়া। কি দুঃখের ব্যাপার!
বিলাস। দুঃখের কেন? অপঘাত-মৃত্যু ওর হবে না ত হবে কার? জগদীশবাবু শুধু আপনার স্বর্গীয় পিতা বনমালীবাবুরই সহপাঠী বন্ধু নয়, আমার বাবারও ছেলেবেলার বন্ধু। কিন্তু বাবা তার মুখও দেখতেন না। টাকা ধার করতে দু’বার এসেছিল—বাবা চাকর দিয়ে বার করে দিয়েছিলেন। বাবা সর্বদাই বলেন, এই-সব অসচ্চরিত্র লোকগুলোকে প্রশ্রয় দিলে মঙ্গলময় ভগবানের কাছে অপরাধ করা হয়।
বিজয়া। এ কথা সত্যি।
বিলাস। বন্ধুই হন আর যেই হন। দুর্বলতাবশতঃ কোনমতেই সমাজের চরম আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করা উচিত নয়। জগদীশের সমস্ত সম্পত্তি এখন ন্যায়তঃ আমাদের। তা ছেলে পিতৃঋণ শোধ করতে পারে, ভাল, না পারে আমাদের এই দণ্ডেই সমস্ত হাতে নেওয়া উচিত। বস্তুতঃ ছেড়ে দেবার আমাদের অধিকার নেই। কারণ, এই টাকায় আমরা অনেক সৎকার্য করতে পারি, সমাজের কোন ছেলেকে বিলেত পর্যন্ত পাঠাতে পারি—ধর্মপ্রচারে ব্যয় করতে পারি—কত কি করতে পারি—কেন তা না করব বলুন? আপনার সম্মতি পেলেই বাবা সব ঠিক করে ফেলবেন।
[বিজয়া একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিল]
বিলাস। না, না, আপনাকে ইতস্ততঃ করতে আমি কিছুতেই দেব না। দ্বিধা দুর্বলতা পাপ, শুধু পাপ কেন মহাপাপ। আমি মনে মনে সঙ্কল্প করেছি, আপনার নাম করে—যা কোথাও নেই, কোথাও হয়নি—আমি তাই করব। এই পাড়াগাঁয়ের মধ্যে ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করে, দেশের হতভাগ্য মূর্খ লোকগুলোকে ধর্মশিক্ষা দেব। আপনি একবার ভেবে দেখুন দেখি, এদের অজ্ঞতার জ্বালায় বিপন্ন হয়ে আপনার পিতৃদেব দেশ ছেড়েছিলেন কি না? তাঁর কন্যা হয়ে আপনার কি উচিত নয়, এই নোব্ল প্রতিশোধ নিয়ে তাদের এই চরম উপকার করা? বলুন, আপনিই এ কথার উত্তর দিন। (বিজয়া নিরুত্তর) সমস্ত দেশের মধ্যে একটা কত বড় নাম, কত বড় সাড়া পড়ে যাবে ভাবুন দেখি? সর্বসাধারণকে স্বীকার করতেই হবে—সে ভার আমার—সে আমাদের সমাজে মানুষ আছে, হৃদয় আছে, স্বার্থত্যাগ আছে। যাকে তারা নির্যাতন করে দেশছাড়া করেছিল, সেই মহাত্মার মহীয়সী কন্যা, শুধু তাদের জন্যই এই বিপুল স্বার্থত্যাগ করেছেন। সমস্ত ভারতময় কি moral effect হবে ভাবুন দেখি?
বিজয়া। তা বটে, কিন্তু মনে হয় বাবার ঠিক এই ইচ্ছা ছিল না। জগদীশবাবুকে তিনি চিরদিন মনে মনে ভালবাসতেন।
বিলাস। এমন হতেই পারে না। সেই দুষ্ক্রিয়াসক্ত মাতালটাকে তিনি ভালবাসতেন এ বিশ্বাস আমি করতে পারি না।
বিজয়া। বাবার সঙ্গে এ নিয়ে আমিও তর্ক করেছি। তাঁর কাছেই শুনেছি, তিনি, আপনার বাবা ও জগদীশবাবু এই তিনজনে—শুধু সতীর্থ নয়, পরস্পরের পরম বন্ধু ছিলেন। জগদীশবাবুই ছিলেন সবার চেয়ে মেধাবী ছাত্র, কিন্তু যেমন দুর্বল, তেমনি দরিদ্র। বড় হয়ে বাবা ও আপনার বাবা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেন, কিন্তু জগদীশবাবু পারলেন না। গ্রামের মধ্যে নির্যাতন শুরু হল। আপনার বাবা অত্যাচার সয়ে গ্রামেই রইলেন, কিন্তু বাবা পারলেন না, সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির ভার আপনার বাবার উপর দিয়ে, মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন, আর জগদীশবাবু স্ত্রী নিয়ে ওকালতি করতে পশ্চিমে চলে গেলেন।
বিলাস। এ-সব আমিও জানি।
বিজয়া। জানবার কথাই ত। পশ্চিমে তিনি বড় উকিল হয়েছিলেন। কোন দোষই ছিল না, শুধু স্ত্রী মারা যাবার পর থেকেই তাঁর দুর্গতি শুরু হ’ল।
বিলাস। অমার্জনীয় অপরাধ।
বিজয়া। তা বটে, কিন্তু এর অনেক পরে আমার নিজের মা মারা গেলে বাবা একদিন কথায় কথায় হঠাৎ বলেছিলেন, কেন যে জগদীশ মদ ধরেছিল সে যেন বুঝতে পারি বিজয়া।
বিলাস। বলেন কি? তাঁর মুখে মদ খাবার justification?
বিজয়া। আপনি কি যে বলেন বিলাসবাবু! justification নয়—বাল্যবন্ধুর ব্যথার পরিমাণটাই বাবা ইঙ্গিত করেছিলেন। সম্ভ্রম গেল, স্বাস্থ্য গেল, উপার্জন গেল, সমস্ত নষ্ট করে তিনি দেশে ফিরে এলেন।
বিলাস। বড় কীর্তিই করেছিলেন!
বিজয়া। সব গেল, শুধু গেল না বোধ হয় আমার বাবার বন্ধু-স্নেহ। তাই যখনই জগদীশবাবু টাকা চেয়েছেন তিনি না বলতে পারেন নি।
বিলাস। তা হলে ঋণ না দিয়ে দান করলেই ত পারতেন।
বিজয়া। তা জানিনে বিলাসবাবু। হয়ত দান করে বন্ধুর শেষ আত্মসম্মানবোধটুকু বাবা নিঃশেষ করতে চাননি।
বিলাস। দেখুন, এ-সব আপনার কবিরে কথা, নইলে ঋণ ছেড়ে দেবার উপদেশ তিনি আপনাকেও দিয়ে যেতে পারতেন। কিসের জন্য তা করেন নি?