গোবিন্দ। ঘরে যাও না ভটচায। যে জন্যে ছুটে এলে, গুষ্টিবর্গ মিলে খেলে, বাঁধলে—আর কেন? ক্ষীরমোহন পরশু খেয়ো, আজ বাড়ি যাও, আমাদের ঢের কাজ।
রমেশ। আপনার হল কি গাঙ্গুলীমশাই? যাকে-তাকে এমন খামোকা অপমান করচেন কেন?
[ধমক খাইয়া গোবিন্দ লজ্জিত হইল। পরে শুষ্কহাস্য করিয়া]
গোবিন্দ। অপমান আবার কাকে করলাম বাবাজী। ভাল, ওকেই জিজ্ঞাসা করে দেখ না ঠিক সত্যি কথাটি বলেচি কিনা? ও ডালে-ডালে বেড়ায় যদি, আমি পাতায়-পাতায় ঘুরি যে। দেখলে ধর্মদাসদা, দীনে বামনার আস্পর্ধা? আচ্ছা রমেশ। আচ্ছা কি?
দীনু। (রমেশের প্রতি) না বাবা, গোবিন্দ সত্য কথাই বলেচেন। আমি বড় গরীব সে এদিকের সবাই জানে। ওঁদের মত আমার জমি-জমা চাষ-বাস কিছুই নেই, একরকম চেয়েচিন্তে ভিক্ষে-শিক্ষে করেই আমাদের দিন চলে।—ভাল জিনিস ছেলেপিলেদের কিনে খাওয়াবার ক্ষমতা ত ভগবান দেননি, তাই বড়ঘরে কাজকর্ম হলে ওরা খেয়ে বাঁচে। কিছু মনে কোরো না বাবা, তারিণীদাদা বেঁচে থাকতে আমাদের তিনি খাওয়াতে বড় ভালবাসতেন।
[দীনুর দু’চক্ষু জলে ভরিয়া টপটপ করিয়া দু’ফোঁটা অশ্রু সকলের সম্মুখেই
ঝরিয়া পড়িল। দীনু মলিন ও ছিন্ন উত্তরীয়-প্রান্তে তাহা মুছিয়া ফেলিল]
গোবিন্দ। আহা! তারিণীদাদা শুধু তোমাকে খাওয়াতেই ভালবাসতেন। শুনলে ধর্মদাসদা, শুনলে কথা?
দীনু। আমি কি তাই বলচি গোবিন্দ? আমার মত গরীব-দুঃখী কেউ কখনো তারিণীদার কাছ থেকে খালি হাতে ফেরেনি।
রমেশ। ভটচায্যিমশাই, এই দুটো দিন আমার ওপরে একটু দয়া রাখবেন। আর যদি খাঁদুর মা এ-বাড়িতে একবার পায়ের ধুলো দিতে পারেন ত ভাগ্য বলে মানব।
দীনু। আমি বড় গরীব বাবা, আমি বড় দুঃখী। আমাকে এমন করে বললে যে আমি লজ্জায় মরে যাই—
[ভৃত্যের প্রবেশ]
ভৃত্য। বাবু, গিন্নি-মা একবার বাড়ির ভেতরে ডাকচেন।
রমেশ। যাই।
দীনু। বাবা, আমরা তা হলে এখন আসি।
রমেশ। আসুন, কিন্তু আমার প্রার্থনা যেন ভুলে যাবেন না।
দীনু। না বাবা, প্রার্থনা বলচ কেন, এ তোমার দয়া।
[ছেলেদের লইয়া দীনুর প্রস্থান]
গোবিন্দ। বাবা রমেশ, আমিও এখন তাহলে আসি। সন্ধ্যে-আহ্নিক, ঠাকুরের শীতল দেওয়া—রমেশ। কিন্তু গাঙ্গুলীমশাই—
গোবিন্দ। কিছু বলতে হবে না বাবা, এ আমার আপনার কাজ। তুমি না ডাকলেও আমাকে নিজে এসে সমস্ত করতে হতো। কাল সক্কালেই তোমার মামীকে পাঠিয়ে দিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হতে পারব।
ধর্মদাস। তুই বড় বাজে বকিস গোবিন্দ।
গোবিন্দ। কোন ভাবনা নেই রমেশ, ভাঁড়ার-টাড়ার যা কিছু—
ধর্মদাস। ভাঁড়ারের জন্যে তোর এত মাথাব্যথা কেন বল ত?
গোবিন্দ। এ আমাদের নিজের কাজ বাবা। আমি আর ধর্মদাসদা—আমরা দু’ভাই তোমার ডাকার অপেক্ষা রাখিনি,—আপনারাই এসে উপস্থিত হয়েচি। হয়েচি কিনা?
ধর্মদাস। বলি শোন রমেশ, আমরা বেণী ঘোষাল নই, আমাদের জন্মের ঠিক আছে।
রমেশ। আঃ—কি বলচেন আপনারা?
[জ্যাঠাইমা অন্তরাল হইতে একটুখানি মুখ বাহির করিয়া]
জ্যাঠাইমা। ওরা অমনিই বলে রমেশ! শিক্ষা আর সঙ্গদোষে জানেও না যে, কি ওরা বললে।
[গোবিন্দ ও ধর্মদাসের দ্রুতপদে প্রস্থান
রমেশ। জ্যাঠাইমা!
জ্যাঠাইমা। হাঁরে আমিই। বলি চিনতে পারিস ত?
[বলিতে বলিতে তিনি সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার বয়স পঞ্চাশের কম নয়, কিন্তু কিছুতেই চল্লিশের বেশী বলিয়া মনে হয় না। মাথার চুলগুলি ছোট করিয়া ছাঁটা, দুই-এক গাছি কুঞ্চিত হইয়া কপোলের উপর পড়িয়াছে। একদিন যে রূপের খ্যাতি এ-অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল, আজিও সেই অনিন্দ্যসৌন্দর্য তাঁহার নিটোল পরিপূর্ণ দেহটিকে বর্জন করিয়া দূরে যাইতে পারে নাই। দেখিয়া আজও মনে হয় তাঁহার সকল অবয়ব যেন শিল্পীর সাধনার ধন]
রমেশ। একদিন যে ছেলেকে তুমি মানুষ করেছিলে, আর একদিন বড় হয়ে ফিরে এসে সে-ই তোমাকে চিনতে পারবে না এই কি তোমার রমেশের কাছে আশা কর জ্যাঠাইমা?
জ্যাঠাইমা। না, সে আশঙ্কা করিনি রমেশ। তবুও ত তোরই মুখ থেকে না শুনে পারিনে বাবা, জ্যাঠাইমাকে তোর মনে আছে।
রমেশ। মনে আছে মা, খুব বড় করেই তোমাকে মনে আছে। কিন্তু যা পারতাম নিজেই করতাম, তুমি কেন আবার এ-বাড়িতে এলে?
জ্যাঠাইমা। তুই ত আমাকে ডেকে আনিস নি বাবা, যে তোর কাছে তার কৈফিয়ত দেব।
রমেশ। ডেকে আনব কি মা, মা বলে যে তোমার কোলেই সকলের আগে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ি নেই বলে ত তুমি দেখা করনি জ্যাঠাইমা!
জ্যাঠাইমা। সেই অভিমানেই বুঝি নিজের বাড়ি থেকে আজ আমাকে বিদায় করতে চাস রমেশ?
রমেশ। অভিমান! যার মা নেই, বাপ নেই, নিজের জন্মভূমিতে যে নিরাশ্রয়, বিদেশী,—বিনাদোষে যাকে প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন বাড়ি থেকে দূর করে দেয় তার অভিমানের দাম কি জ্যাঠাইমা?
জ্যাঠাইমা। আমার কাছেও তার দাম নেই রমেশ?
রমেশ। না নেই। আজ নিজের ছেলেকেই শুধু ছেলে বলে জেনে রেখেচ। কিন্তু আর একটা মা-মরা ছেলেকে যে একদিন ঠিক তেমনি কোরেই মানুষ করতে হয়েছিল সে কথা আজ ভুলে গেছ।
জ্যাঠাইমা। এমনি কোরে শূল বিঁধে তুই কথা বলবি রমেশ? ঘরে-বাইরে এই শাস্তি পাব বলেই কি তোদের দুজনকে মানুষ করেছিলাম রে?
রমেশ। ঘরে-বাইরে! তাই ত বটে! (হঠাৎ পায়ের কাছে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া) আমাকে ক্ষমা করো জ্যাঠাইমা, আমি প্রাণের জ্বালায় তোমার এই দিকটার পানে চেয়ে দেখিনি।
[জ্যাঠাইমা রমেশকে তুলিয়া ডান হাত
দিয়া তাহার চিবুক স্পর্শ করিলেন]