[দীনুর মেয়ে অন্তরালে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া]
দীনুর মেয়ে। কেন, ঐ যে হচ্চে বাবা—
[বাকি ছেলে-মেয়েরা নাকে কাঁদিতে কাঁদিতে
আসিয়া ধর্মদাসকে ঘিরিয়া ধরিল]
ছেলে-মেয়েরা। আঁমরাও দাঁদামশাই—
রমেশ। (অগ্রসর হইয়া) বেশ ত, বেশ ত, ও আচার্যিমশাই, বিকেলবেলায় ছেলেরা সব বাড়ি থেকে বেরিয়েচে, খেয়ে ত আসেনি। (অন্তরালবর্তী ময়রার উদ্দেশে) ওহে ও, কি নাম তোমার? নিয়ে এস ত ঐ থালাটা এদিকে। আচার্যিমশাই, দেখুন ত যেন দেরি না হয়।
[ভৈরব আচার্য ভিতরে চলিয়া গেল এবং ক্ষণকাল পরেই ময়রা সন্দেশের থালা আনিতেই ছেলেরা উপুড় হইয়া পড়িল—বাঁটিয়া দিবার অবকাশ দেয় না এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিল। ছেলেদের খাওয়া দেখিতে দেখিতে দীননাথের শুষ্কদৃষ্টি সজল ও তীব্র হইয়া উঠিল]
দীনু। ওরে ও খেঁদি, খাচ্ছিস ত খুব, সন্দেশ হয়েছে কেমন বল দিকি?
খেঁদি। বেশ বাবা—
[এই বলিয়া সে চিবাইতে লাগিল]
দীনু। (মৃদু হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া) হাঁ:—তোদের আবার পছন্দ! মিষ্টি হলেই হল। হাঁ হে কারিকর, এ কড়াটা কেমন নাবালে? কি বল গোবিন্দভায়া, এখনো রোদ একটু আছে বলে মনে হচ্চে না?
ময়রা। আজ্ঞে, আছে বৈ কি। এখনো ঢের বেলা আছে, এখনো সন্ধ্যে-আহ্নিকের—
দীনু। তবে কৈ দাও দিকি গোবিন্দভায়াকে একটা, চেকে দেখুক কেমন কলকাতার কারিকর তোমরা—
[ময়রা গোবিন্দ ও দীনু উভয়কেই সন্দেশ দিতে গেল]
দীনু। না না, আমাকে আবার কেন? তবে, আধখানা—আধখানার বেশী নয়। (হুঁকা রাখিয়া দিয়া) ওরে, ও ষষ্ঠীচরণ, একটু জল আন দিকি বাবা, হাতটা ধুয়ে ফেলি।
রমেশ। (ভিতরের দিকে চাহিয়া) ওরে, অমনি ভিতর থেকে গোটা-চারেক রেকাবী নিয়ে আসিস ষষ্ঠী।
গোবিন্দ। সন্দেশের চেহারা দেখেই বোধ হচ্চে হয়েছে ভাল। কি হে, ময়রার পো, পাকটা একটু নরমই রাখলে বুঝি?
ময়রা। আজ্ঞে হাঁ, এ কড়াটা একটু নরমই রেখেচি।
গোবিন্দ। (হাস্য করিয়া) আমরা বুঝি কিনা! তাকালেই ধরে দিতে পারি কোন্টা কেমন।
ময়রা। আজ্ঞে, আপনারা বুঝবেন না ত বুঝবে কারা!
[ষষ্ঠীচরণ ও আর একজন ভৃত্য রেকাবী, জলের গ্লাস প্রভৃতি আনিয়া উপস্থিত করিল, ময়রা সন্দেশের থালাটা সম্মুখে আনিয়া রাখিল, এবং ব্রাহ্মণদিগের পাত্রে তুলিয়া দিতে লাগিল। কাহারও মুখে কথা নাই, ছেলে-মেয়েরা এবং ধর্মদাস, গোবিন্দ ও দীনু গোগ্রাসে গিলিতেছে এবং দেখিতে দেখিতে সমস্ত থালাটাই নিঃশেষিত হইয়া গেল]
দীনু। হাঁ, কলকাতার কারিকর বটে! কি বল ধর্মদাসদা?
[ধর্মদাসের কণ্ঠস্বর সন্দেশের তাল ভেদ করিয়া বেশ স্পষ্ট
বাহির হইল না, কিন্তু বুঝা গেল মতের অনৈক্য নাই]
গোবিন্দ। (নিশ্বাস ফেলিয়া) হাঁ, ওস্তাদি হাত বটে!
ময়রা। যদি কষ্টই করলেন ঠাকুরমশাই, তা হলে মিহিদানাটাও অমনি পরখ করে দিন।
দীনু। মিহিদানা। কৈ আনো দিকি বাপু।
ময়রা। এই যে আনি।
[এই বলিয়া সে চক্ষের পলকে একথালা মিহিদানা আনিয়া হাজির করিল এবং ব্রাহ্মণদিগের পাত্রে উজাড় করিয়া দিল। মিহিদানা শেষ হইয়া আসিতে বিলম্ব হইল না]
দীনু। (হাত বাড়াইয়া মেয়ের প্রতি) ওরে ও খেঁদি, ধর দিকি মা, এই দুটো মিহিদানা।
খেঁদি। আমি আর খেতে পারবো না বাবা।
দীনু। পারবি পারবি। এক ঢোঁক জল খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নে দিকি, মুখ মেরে গেছে বৈ ত না। না পারিস আঁচলে একটা গেরো দিয়ে রাখ, কাল সকালে উঠে খাস।
[এই বলিয়া মেয়ের হাতে গুজিয়া দিল]
দীনু। (ময়রার প্রতি) হাঁ বাপু, খাওয়ালে বটে। যেন অমৃত। তা বেশ হয়েছে, মিষ্টি বুঝি দু’রকম করলে বাবাজী?
ময়রা। আজ্ঞে না, রসগোল্লা, ক্ষীরমোহন—
দীনু। অ্যাঁ, ক্ষীরমোহন? কৈ, সে ত বার করলে না বাপু? (বিস্মিত রমেশের মুখের প্রতি চাহিয়া) হাঁ খেয়েছিলাম বটে রাধানগরের বোসেদের বাড়ি, আজও যেন মুখে লেগে রয়েচে। বললে বিশ্বাস করবে না বাবাজী, ক্ষীরমোহন খেতে আমি বড্ড ভালবাসি।
রমেশ। (হাসিয়া) আজ্ঞে না, অবিশ্বাস করবার কোন কারণ নেই। ওরে ষষ্ঠী, ভেতরে বোধ করি আচায্যিমশাই আছেন, যা ত কিছু ক্ষীরমোহন তাঁকে আনতে বলে আয় দিকি।
[ষষ্ঠীচরণের প্রস্থান]
গোবিন্দ। (উদ্বিগ্নকণ্ঠে) অ্যাঁ? মিষ্টি কি সব বাইরে পড়ে নাকি! না না, এ ত ভাল না।
ধর্মদাস। চাবি? চাবি? ভাঁড়ারের চাবি কার কাছে?
গোবিন্দ। বলি, ভৈরো আচায্যির হাতে নয় ত?
[ষষ্ঠীচরণের প্রবেশ]
ষষ্ঠী। এখন আর ভাঁড়ার-ঘর খোলা হবে না বাবু, ক্ষীরমোহন বার হবে না।
রমেশ। আঃ, বল গে যা আমি আনতে বলচি।
গোবিন্দ। দেখলে ধর্মদাসদা, আচায্যির আক্কেল। এ যে দেখি মায়ের চেয়ে মাসীর বেশী দরদ। সে জন্যেই আমি বলি—
ষষ্ঠী। আচায্যিমশায়ের দোষ কি? ও-বাড়ি থেকে গিন্নি-মা এসে ভাঁড়ার বন্ধ করে ফেলেচেন। এ তাঁরই হুকুম।
ধর্মদাস ও গোবিন্দ। কে? বেণীবাবুর মা? ও-বাড়ির বড়-গিন্নিঠাকরুন?
রমেশ। জ্যাঠাইমা এসেচেন নাকি?
ষষ্ঠী। হাঁ বাবু। তিনি এসেই ছোট-বড় দুটো ভাঁড়ারই তালা-বন্ধ করে ফেলেচেন। চাবি তাঁরই আঁচলে।
গোবিন্দ। দেখলে ধর্মদাসদা ব্যাপারখানা? বলি মতলবটা বুঝলে ত?
দীনু। এ মতলব বোঝা আর শক্ত কি ভায়া! তালা-বন্ধ করে চাবি নিজের কাছে রেখেচেন, তার মানে ভাঁড়ার আর কারো না হাতে পড়ে। তিনি সমস্তই ত জানেন।
গোবিন্দ। বোঝ না সোঝ না তুমি কথা কও কেন বল ত? তুমি এ-সব ব্যাপারের কি জানো যে হঠাৎ মানে করতে এসেচ?’
দীনু। আরে, এতে বোঝা-বুঝিটা আছে কোন্খানে? শুনচো না গিন্নী-মা স্বয়ং এসে তালা-বন্ধ করেছেন? এতে কথা কইবে আবার কে?