গোবিন্দ। তুমি ত আমার পর নও বাবা, নিতান্ত আপনার। তোমার মা ছিলেন আমার সাক্ষাৎ পিসতুত বোনের আপনার ভাগ্নী। রাধানগরের বাঁড়ুয্যে বাড়ি,—সে-সব তারিণীদা জানতেন। তাই যে-কোন কাজকর্মে—মামলা-মকর্দমা করতে, সাক্ষী দিতে—ডাক্ গোবিন্দকে—
ধর্মদাস। কেন বাজে বকিস গোবিন্দ? খক্ খক্ খক্—খ—আমি আজকের নই, না জানি কি? সে বছর সাক্ষী দেবার কথায় বললি আমার জুতো নেই, খালিপায়ে যাই কি করে? খক্ খক্—তারিণী অমনি আড়াই টাকা দিয়ে জুতো কিনে দিলে। তুই তাই পায়ে দিয়ে সাক্ষী দিয়ে এলি কিনা বেণীর হয়ে! খক্ খক্ খক—খ—
গোবিন্দ। (চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া) এলুম?
ধর্মদাস। এলিনে?
গোবিন্দ। দূর মিথ্যেবাদী!
ধর্মদাস। মিথ্যেবাদী তোর বাবা।
গোবিন্দ। (ভাঙ্গা ছাতি লইয়া লাফাইয়া উঠিল) তবে রে শালা!
ধর্মদাস। (বাঁশের লাঠি উঁচাইয়া) ও শালার আমি—খক খক খক—খ—ও শালার আমি সম্পর্কে বড়ভাই হই কিনা, তাই শালার আক্কেল দেখ! (কাশি)
গোবিন্দ। ওঃ—শালা আমার বড়ভাই!
[চারিদিকের লোক ছুটিয়া আসিল, ছেলে-মেয়েরা হাঁ করিয়া চাহিয়া
রহিল এবং রমেশ দ্রুতপদে তাহাদের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইল]
রমেশ। এ কি এ! আপনারা উভয়েই প্রাচীন—ব্রাহ্মণ—এ কি কাণ্ড!
ভৈরব। (উঠিয়া আসিয়া রমেশের প্রতি) প্রায় শ’চারেক কাপড় ত হল, আরও চাই কি?
[রমেশ নিরুত্তর]
ভৈরব। ছিঃ গাঙ্গুলীমশাই, বাবু একেবারে অবাক হয়ে গেছেন। আপনি কিছু মনে করবেন না বাবু, এমন ঢের হয়। বৃহৎ কাজকর্মের বাড়িতে কত ঠ্যাঙাঠেঙি রক্তারক্তি পর্যন্ত হয়ে যায়—আবার যে কে সেই হয়। নিন চাটুয্যেমশাই, দেখুন দিকি আরও থান ফাড়বো কি না?
গোবিন্দ। হয়ই ত! হয়ই ত! ঢের হয়। নইলে বিরদ্ কর্ম বলেচে কেন। সে বছর তোমার মনে আছে ভৈরব, যদু মুখুয্যেমশাইয়ের কন্যা রমার গাছ-পিতিষ্ঠের দিন সিধে নিয়ে, রাঘব ভট্চায্যে আর হারান চাটুয্যেতে মাথা ফাটাফাটি হয়ে গেল! কিন্তু আমি বলি ভৈরব ভায়া, বাবাজীর এ কাজটা ভাল হচ্চে না। ছোটলোকদের কাপড় দেওয়া আর ভস্মে ঘি ঢালা এক কথা। তার চেয়ে বামুনদের একজোড়া আর ছেলেদের একখানা করে দিলে নাম হোতো। আমি বলি বাবাজী সেই যুক্তিই করুন, কি বল ধর্মদাসদা?
ধর্মদাস। গোবিন্দ মন্দ যুক্তি বলেনি বাবাজী। ওদের মিছে দেওয়া। নইলে আর শাস্তরে ব্যাটাদের ছোটলোক বলেচে কেন! বুঝলে না বাবা রমেশ?
রমেশ। হাঁ, বুঝেচি বৈ কি।
ভৈরব। তা হলে কি এই কাপড়েই হবে?
রমেশ। বোধ হয় হবে না। বলা যায় না কত কাঙ্গালী আসবে, আপনি বরঞ্চ আরও দু’শ কাপড় ঠিক করে রাখুন।
গোবিন্দ। তা নইলে কি হয়? তুমি একা আর কত পারবে ভায়া, চল আমিও যাই।
[বলিতে বলিতে গোবিন্দ বস্ত্ররাশির কাছে অগ্রসর হইয়া গেল, এবং উপবেশন করিয়া কাপড় গুছাইতে লাগিল। ধর্মদাস এই অবকাশে রমেশকে একধারে টানিয়া লইয়া গিয়া কানে কানে বলিতে লাগিল। ওদিকে গোবিন্দ উদ্গ্রীব হইয়া আড়চোখে চাহিয়া দেখিতে লাগিল]
ধর্মদাস। এ-দেশ বড় খারাপ বাবা, ভাঁড়ার-টাঁড়ার কাউকে দিয়ে বিশ্বেস কোরো না। তেল, নুন, ঘি, ময়দা অর্ধেক সরিয়ে ফেলবে। আমি এখুনি গিয়ে তোমার পিসীমাকে পাঠিয়ে দিচ্চি বাবা, একটি কুটো তোমার নষ্ট হবে না।
রমেশ। যে-আজ্ঞে—
[মুণ্ডিত-শ্মশ্রু শীর্ণকায় ও প্রাচীন দীননাথ ভট্টাচার্য প্রবেশ করিলেন। ইঁহার সঙ্গেও দুই-তিনটি ছেলে-মেয়ে। মেয়েটি সকলের বড়, পরনে একখানি শতচ্ছিন্ন ডুরে কাপড়]
দীননাথ। কৈ গো বাবাজী, কোথায় গো?
গোবিন্দ। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া) এস দীনুদা, বোস। বড় ভাগ্যি আমাদের যে আজ তোমার পায়ের ধুলো পড়লো। ছেলেটা একা সারা হয়ে যায় তা তোমরা ত—
[ধর্মদাস কটমট করিয়া তাহার প্রতি চাহিল]
গোবিন্দ। তা তোমরা ত কেউ এদিক মাড়াবে না দাদা।
দীনু। আমি ত ছিলাম না ভায়া, তোমার বৌঠাকরুনকে আনতে তাঁর বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। বাবাজী কোথায়? শুনচি নাকি ভারী আয়োজন হচ্চে। পথে ও-গাঁয়ের হাটে শুনে এলাম খাইয়ে-দাইয়ে ছেলে-বুড়োর হাতে নাকি ষোল পাত লুচি আর চার জোড়া করে সন্দেশ দেওয়া হবে।
গোবিন্দ। (গলা খাটো করিয়া) তা ছাড়া হয়ত একখানা করে কাপড়ও—
[রমেশের প্রবেশ]
দীনুদা, এই আমার রমেশ। তা তোমাদের পাঁচজনের বাপ-মায়ের আশীর্বাদে যোগাড়-সোগাড় ত একরকম করচি, কিন্তু বেণী একেবারে উঠে পড়ে লেগেচে। এই আমার কাছেই দু’বার লোক পাঠিয়েচে। তা আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলে, রমেশের সঙ্গে আমার নাড়ীর টান রয়েচে, কিন্তু এই যে দীনুদা, ধর্মদাসদা, এঁরাই কি বাবা তোমাকে ফেলতে পারবেন? দীনুদা ত পথ থেকে শুনতে পেয়ে ছুটে আসচেন। ওরে ও ষষ্ঠীচরণ, তামাক দে না রে! বাবা রমেশ, একবার এদিকে এসো দিকি, একটা কথা বলে নিই।
[ভৃত্য আসিয়া দীনুর হাতে হুঁকা দিয়া গেল এবং গোবিন্দ
রমেশকে আর একদিকে সরাইয়া লইয়া গিয়া চাপা গলায়]
গোবিন্দ। ভেতরে বুঝি ধর্মদাস-গিন্নি আসচে? খবরদার বাবা, খবরদার—বিট্লে বামুন যতই ফোসলাক, কখনো তার হাতে ভাঁড়ার-টাড়ার দিও না, মাগী অর্ধেক ফাঁক করে দেবে। বলি, তোমার ভাবনা কি বাবা? তোমার যে আপনার মামী রয়েচে। আমি গিয়েই তাকে পাঠিয়ে দিচ্চি, নাড়ীর টানে সে যেমন করবে আর কি কেউ তেমন পারবে? না, কখনো পারে?
[শিশু-দু’টা ছুটিয়া আসিয়া দীনুর কাঁধের উপর ঝুলিয়া পড়িল]
শিশুরা। বাবা, সন্দেশ খাবো।
দীনু। (একবার রমেশ ও একবার গোবিন্দর প্রতি চাহিয়া) সন্দেশ কোথায় পাব রে? সন্দেশ কৈ?