বেণী। (রমেশকে আলিঙ্গন করিয়া) রমেশ, ভাই রে, নাড়ীর টান যে এমন টান এবার তা টের পেয়েচি। রমা যে আচায্যি হারামজাদাকে হাত কোরে এত শত্রুতা করবে, লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে নিজে এসে মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে এত দুঃখ দেবে, সে কথা জেনেও যে জানিনি, ভগবান তার শাস্তি আমাকে দিয়েচেন। জেলের মধ্যে তুই বরং ছিলি ভাল ভাই, বাইরে থেকে এই ক’টা মাস আমি যে তুষের আগুনে জ্বলে-পুড়ে গেছি।
[রমেশ হতবুদ্ধির মত কি যে করিবে ভাবিয়া পাইল না।
বনমালী ও ছেলেরা অগ্রসর হইয়া তাহার পায়ের ধূলা লইল]
বেণী। (কাঁদিয়া ফেলিয়া) দাদার ওপর অভিমান রাখিস নে ভাই, বাড়ি চল্। মা কেঁদে কেঁদে দু’চক্ষু অন্ধ করবার যোগাড় করেচেন। আমরা শুধু প্রাণে বেঁচে আছি রমেশ।
রমেশ। (বেণীর মাথার ব্যান্ডেজটা হাত দিয়া দেখাইয়া) এ কি বড়দা, মাথা ভাঙলো কি করে?
বেণী। শুনে আর কি হবে ভাই, আমি কাউকে দোষ দিইনে। এ আমার নিজেরই কর্মফল,—আমারই পাপের শাস্তি।—জানিস ত রমেশ, এই আমার জন্মগত দোষ যে মনে এক, মুখে আর কিছুতে করতে পারিনে। মনের ভাব আর পাঁচজনের মত ঢেকে রাখতে পারিনে বলে কত শাস্তিই যে ভোগ করতে হয়,—কিন্তু তবু ত আমার চৈতন্য হয় না। দোষের মধ্যে সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বলে ফেলেছিলাম, রমা, আমরা তোর কাছে কি অপরাধ করেচি যে ভাইকে আমার জেলে দিলি! জেল হয়েচে শুনলে মা যে একেবারে প্রাণ বিসর্জন করবেন। আমরা ভায়ে ভায়ে সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া করি, যা করি, তবু ত সে আমার ভাই। তুই একটি আঘাতে আমার ভাইকে মারলি,—আমার মাকে মারলি!—রমেশ, সেদিন রমার সে উগ্রমূর্তি মনে হলে আজও হৃদ্কম্প হয়। বললে, রমেশের বাপ আমার বাপকে জেলে দিতে যায়নি? পারলে ছেড়ে দিত বুঝি?
রমেশ। হাঁ, রমার মাসীর মুখেও একথা শুনছিলাম।
বেণী। এই হোলো তার জাতক্রোধ। কিন্তু মেয়েমানুষের এত দর্প আমারও সহ্য হল না। আমিও রেগে বলে ফেললাম, আচ্ছা, ফিরে আসুক সে, তার পরে এর বিচার হবে। কিন্তু খুন করা যে তার অভ্যেস ভাই। তোমাকে খুন করতে আকবর লেঠেলকে পাঠিয়েছিল মনে নেই? কিন্তু তোমার কাছে ত চালাকি খাটেনি—তুমিই উলটে শিখিয়ে দিয়েছিলে! কিন্তু আমাকে খুন করা আর শক্ত কি?
রমেশ। তার পরে?
বেণী। তার পরে কি আর মনে আছে ভাই? কে কিসে করে যে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, সেখানে কি হল, কে দেখলে কিছুই জানিনে। এ যাত্রা যে রক্ষে পেয়েচি সে কেবল মায়ের পুণ্যে। এমন মা কি আর আছে রমেশ!
[রমেশের মুখে ও মনের মধ্যে কত কি যে হইতে লাগিল
তাহার নির্দেশ নাই,—কিন্তু সে একটা কথাও কহিল না]
বেণী। গাড়ি তৈরি ভাই। আর দেরি নয়,—বাড়ি চল্। মায়ের কাছে তোরে একবার পৌঁছে দিয়ে আমি বাঁচি।
রমেশ। চলুন। জেলের মধ্যেই শুনেছিলাম রমা নাকি বড় পীড়িত?
বেণী। ভগবানের দণ্ড রমেশ—এ যে তাঁরই রাজ্য, এ কি সবাই মনে রাখে? জগদীশ্বর! চল ভাই, ঘরে চল।
[সকলের প্রস্থান]
রমা – ৪.৫
পঞ্চম দৃশ্য
রমার কক্ষ
[রমেশ প্রবেশ করিয়া রমাকে দেখিয়া চমকিয়া গেল]
রমেশ। তোমার এত অসুখ করেচে তা ত আমি ভাবিনি!
[রমা শয্যা হইতে কোনমতে উঠিয়া রমেশের পায়ের কাছে প্রণাম করিল ]
রমেশ। এখন কেমন আছ রানী?
রমা। আমাকে আপনি রমা বলেই ডাকবেন।
রমেশ। বেশ তাই। শুনেছিলাম তুমি অসুস্থ ছিলে। এখন কেমন আছ এই খবরটাই জানতে চাচ্ছিলাম। নইলে, নাম তোমার যাই হোক, সে ধরে ডাকবার আমার ইচ্ছেও নেই, আবশ্যকও নেই।
রমা। এখন আমি ভাল আছি। আমি ডেকে পাঠিয়েচি বলে আপনি হয়ত খুব আশ্চর্য হয়েচেন, কিন্তু—
রমেশ। না, হইনি। তোমার কোন কাজে আশ্চর্য হবার দিন আমার কেটে গেছে। কিন্তু ডেকে পাঠিয়েচ কেন শুনি?
রমা। (ক্ষণকাল অধোমুখে নিরুত্তর হইয়া থাকিয়া) রমেশদা, আজ দুটি কাজের জন্যে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ডেকে এনেচি। কত যে অপরাধ করেচি সে ত জানি, তবুও আমি নিশ্চয় জানতাম তুমি আসবেই। আর আমার এই শেষ অনুরোধ-দুটিও অস্বীকার করবে না।
[বলিতে বলিতে অশ্রুভারে গলা তাহার ভাঙ্গিয়া আসিল]
রমেশ। কি তোমার অনুরোধ?
রমা। (চকিতের ন্যায় মুখ তুলিয়াই পুনরায় আনত করিল) পীরপুরের যে বিষয়টা বড়দা তোমার সাহায্যে দখল করতে চাচ্ছেন সেটা আমার নিজের। বাবা বিশেষ করে আমাকেই সেটা দিয়ে গেছেন। তার পোনর-আনা আমার, এক আনা তোমাদের। সেইটেই তোমাকে আমি দিয়ে যেতে চাই।
রমেশ। তোমার ভয় নেই, বড়দা যাই কেন না আমাকে বলুন, আমি চুরি করতে পূর্বেও কখনো কাউকে সাহায্য করিনি, এখনো করব না। আর যদি দান করতেই চাও, তার জন্যে অন্য লোক আছে। আমি দান গ্রহণ করিনে।
রমা। আমি জানি রমেশদা, তুমি চুরি করতে সাহায্য করবে না। আর নিলেও যে তুমি নিজের জন্যে নেবে না সেও আমি জানি। কিন্তু তা ত নয়। দোষ করলে শাস্তি হয়। আমি যত অপরাধ করেচি, এটা তারই দণ্ড বলে কেন গ্রহণ কর না?
রমেশ। তোমার দ্বিতীয় অনুরোধ?
রমা। আমার যতীনকে আমি তোমার হাতে দিয়ে গেলাম—
রমেশ। দিয়ে গেলাম মানে?
রমা। (রমেশের মুখের প্রতি চাহিয়া) একদিন কোন মানেই তোমার কাছে গোপন থাকবে না রমেশদা,—তাই, আমার যতীনকে আমি তোমাকেই দিয়ে যাব। তাকে তোমার মত করেই মানুষ কোরো। বড় হয়ে সে যেন তোমারি মত স্বার্থত্যাগ করতে পারে। (আঁচলে চোখ মুছিয়া) এ আমার চোখে দেখে যাবার সময় হবে না। কিন্তু শেখালে হয়ত সেও একদিন তোমারি মত মাথা উঁচু কোরে দাঁড়াবে।