মাসী । কি বললি লা?
রমা। কিছু না। বলি, রান্নাবান্না কি আজ হবে না? যাও না ডুবটা দিয়ে এসো না।
[পুষ্করিণীর উদ্দেশে রমার দ্রুতপদে প্রস্থান]
বেণী। ব্যাপার কি মাসী?
মাসী । কি করে জানবো বাছা? ও রাজরানীর মেজাজ বোঝা কি আমাদের মত দাসীবাঁদীর কর্ম?
[প্রস্থান
[গোবিন্দ গাঙ্গুলীর প্রবেশ]
গোবিন্দ। ভ্যালা যা হোক। সকাল থেকে সারা গাঁ-টা খুঁজে বেড়াচ্চি বেণীবাবু গেল কোথায়! বলি শুনেচ খবরটা? বাবাজী কাল ঘরে পা দিয়েই ছুটেছিলেন নন্দীদের ওখানে।
এ যদি না দু’দিনে উচ্ছন্ন যায় ত আমার গোবিন্দ গাঙ্গুলী নাম তোমরা বদলে রেখো। নবাবী কাণ্ড-কারখানার ফর্দ শোন ত অবাক হয়ে যাবে। তারিণী ঘোষাল সিকি পয়সা রেখে মরেনি তা জানি, তবে এত কেন? হাতে থাকে কর্, না থাকে বিষয় বন্ধক দিয়ে কে কবে ঘটা করে বাপের শ্রাদ্ধ করে তা ত কখনো শুনিনি বাবা। আমি তোমাকে নিশ্চয় বলচি বেণীমাধববাবু, এ ছোঁড়া নন্দীদের গদী থেকে অন্ততঃ পাঁচটি হাজার টাকা দেনা করেচে।
বেণী। বল কি! তা হলে কথাটা ত বার করে নিতে হচ্ছে গোবিন্দখুড়ো?
গোবিন্দ। (মৃদু হাস্য করিয়া) সবুর করো না বাবাজী, একবার ভাল করে ঢুকতেই দাও না। তার পরে নাড়ীর খবর ফেড়ে বার করে আনবো—তখন বুঝবে গোবিন্দ গাঙ্গুলীকে। এর মধ্যে অনেক কথাই শুনতে পাবে বাবাজী, অনেক শালাই লাগিয়ে যাবে,—কিন্তু চেনো ত খুড়োকে? সেইটুকু মনে মনে বুঝো, এখন আর কিছু ফাঁস করচি নে।
বেণী। রমার কাছে এসেছিলাম।
গোবিন্দ। তা জানি। কি বলে সে?
বেণী। তারা ত নয়ই, তাদের সম্পর্কে যে যেখানে আছে তারা পর্যন্ত নয়।
গোবিন্দ। ব্যস্! ব্যস্! আর দেখতে হবে না।
বেণী। কিন্তু তোমরা যে—
গোবিন্দ। উতলা হও কেন বাবাজী, আগে ঢুকি। উদ্যোগ আয়োজনটা একটু ভাল করে করাই, তখন না,—ছাদ্দ-গড়ানো কাকে বলে একবার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখো!
বেণী। তবে যে শুনি—
গোবিন্দ। অমন ঢের শুনবে বাবাজী, অনেক ব্যাটা এসে অনেক রকম করে লাগাবে। কিন্তু গোবিন্দখুড়োকে চেনো ত? ব্যস্! ব্যস্!
[উভয়ের প্রস্থান]
রমা – ১.২
দ্বিতীয় দৃশ্য
[রমেশের বহির্বাটী। চণ্ডীমণ্ডপের বারান্দার একধারে ভৈরব আচার্য থান ফাড়িয়া কাপড় পাট করিয়া গাদা দিতেছে। চণ্ডীমণ্ডপের অভ্যন্তরে বসিয়া গোবিন্দ গাঙ্গুলী ধূমপান করিতেছে এবং আড়চোখে চাহিয়া বস্ত্ররাশির মনে মনে সংখ্যা-নিরূপণ করিতেছে। কর্মবাড়ি। আসন্ন শ্রাদ্ধকৃত্যের বহুবিধ আয়োজন চারিদিকে বিক্ষিপ্ত। নানা লোক নানা কাজে ব্যস্ত। সময় অপরাহ্ণ]
[রমেশের প্রবেশ]
রমেশ। (গোবিন্দ গাঙ্গুলীর প্রতি সবিনয়ে) এই যে আপনি এসেচেন।
গোবিন্দ। আসবো বৈ কি বাবা, আসবো বৈ কি! এ যে আমার আপনার কাজ রমেশ।
[নেপথ্যে কাশির শব্দ। কাশিতে কাশিতে চার-পাঁচটি ছেলেমেয়ে লইয়া ধর্মদাস চাটুয্যের প্রবেশ। তাঁহার কাঁধের উপর মলিন উত্তরীয়, নাকের উপর একজোড়া ভাঁটার মত মস্ত চশমা পিছনে দড়ি দিয়া বাঁধা। সাদা চুল, সাদা গোঁফ তামাকের ধূঁয়ায় তাম্রবর্ণ। অগ্রসর হইয়া রমেশের মুখের প্রতি ক্ষণকাল চাহিয়া কোন কথা না কহিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন। রমেশ চিনিল না ইনি কে। কিন্তু যেই হোন, ব্যস্ত হইয়া হাত ধরিতেই—]
ধর্মদাস। (কাঁদিয়া) না বাবা রমেশ, তারিণী যে এমন করে ফাঁকি দিয়ে পালাবে তা স্বপ্নেও জানিনে। কিন্তু আমারও এমন চাটুয্যে-বংশে জন্ম নয় যে কারু ভয়ে মুখ দিয়ে মিথ্যে কথা বেরুবে। আসবার সময় তোমার আপন জাঠতুতো ভাই বেণী ঘোষালের মুখের উপর কি বলে এলাম জানো? বললাম, রমেশ যেমন শ্রাদ্ধের আয়োজন করচে, এমন করা চুলোয় যাক, এ-অঞ্চলে কেউ চোখেও দেখেনি। আমার নামে অনেক শালা অনেক রকম তোমার কাছে লাগিয়ে যাবে বাবা, কিন্তু এটা নিশ্চয় জেনো, এই ধর্মেরই শুধু ধর্মেরই দাস, আর কারও নয়।
[এই বলিয়া গোবিন্দর হস্ত হইতে হুঁকোটা ছিনাইয়া লইয়া
এক টান্ দিয়াই প্রবল বেগে কাশিয়া ফেলিলেন]
রমেশ। না না, বলেন কি, বলেন কি—
[প্রত্যুত্তরে ধর্মদাস ঘড়ঘড় করিয়া কত কি বলিলেন, কিন্তু কাশির ধমকে তাহার একটা বর্ণও বুঝা গেল না। গোবিন্দ সর্বাগ্রে আসিয়াছিলেন, সুতরাং এই নবীন জমিদারটিকে ভাল ভাল কথা বলিবার সুযোগ তাঁহারই ছিল, অথচ নষ্ট হইতেছে বুঝিয়া তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইলেন]
গোবিন্দ। কাল সকালে, বুঝলে ধর্মদাসদা, এখানে আসবো বলে বেরিয়েও আসা হল না। বেণীর ডাকাডাকি—গোবিন্দখুড়ো তামাক খেয়ে যাও। একবার ভাবলেম কাজ নেই,—তার পরে মনে হল ভাবখানা বেণীর দেখেই যাইনে। বেণী কি বললে জানো বাবা রমেশ, বলে খুড়ো, তোমরা ত দেখচি হয়েচ রমেশের মুরুব্বি, বলি লোকজন খাবে-টাবে ত? আমিই বা ছাড়ি কেন,—তুমি বড়লোক আছো না-আছো, আমার রমেশও কারো চেয়ে খাটো নয়। তোমার ঘরে ত একমুঠো চিঁড়ের পিত্যেশ কারু নেই। বললাম, বেণীবাবু, এই ত পথ—দাঁড়িয়ে একবার কাঙ্গালী-বিদেয়ের ঘটাটা দেখো। কালকের ছেলে রমেশ, কিন্তু বুকের পাটা ত বলি একে। কিন্তু তাও বলি ধর্মদাসদা, আমাদের সাধ্যই বা কি! যাঁর কাজ তিনিই ওপরে থেকে করাচ্চেন। তারিণীদা শাপভ্রষ্ট দিকপাল ছিলেন বৈ ত নয়।
[ধর্মদাসের কিছুতেই কাশি থামে না, আর তাহারই সম্মুখে গোবিন্দ বেশ বেশ কথাগুলি এই অপরিপক্ক তরুণ জমিদারটিকে বলিয়া যাইতেছে দেখিয়া আরও ভাল বলিবার চেষ্টায় ধর্মদাস যেন আকুলি-বিকুলি করিতে লাগিল]