রমা। তোমার সঙ্গে তর্ক করচি নে জ্যাঠাইমা, কিন্তু এই যদি সত্যি হয়, তবে রমেশদা কোন্ পাপে এ দুঃখ ভোগ করচেন? আমরা যা কোরে তাঁকে জেলে দিয়েছি এ কথা ত কারও অগোচর নেই।
বিশ্বেশ্বরী। নেই বলেই ত বেণী আজ হাসপাতালে। আর তোমার—কি জানিস মা, কোন কাজই কোনদিন শুধু শুধু শূন্যে মিলিয়ে যায় না। তার শক্তি কোথাও-না-কোথাও গিয়ে কাজ করেই। কিন্তু কি কোরে করে তা সকল সময় ধরা পড়ে না বলেই আজ পর্যন্ত এ সমস্যার মীমাংসা হোলো না, কেন একের পাপে অন্যে প্রায়শ্চিত্ত করে। কিন্তু করতে যে হয় রমা, তাতে ত সংশয় নেই।
[রমা নীরবে দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল]
বিশ্বেশ্বরী। এর থেকে আমারও চোখ ফুটেচে মা, ভাল করব বললেই সংসারে ভাল করা যায় না। গোড়ার ছোট—বড় অনেকগুলো সিঁড়ি উত্তীর্ণ হবার ধৈর্য থাকা চাই। একদিন রমেশ হতাশ হয়ে যখন চলে যেতে চেয়েছিল তখন আমিই যেন তাকে যেতে দিইনি। তাই তার জেলের খবর শুনে মনে হয়েছিল আমিই যেন তাকে জেলে পাঠালাম। তখন ত জানিনি মা,—বাইরে থেকে ছুটে এসে ভাল করতে যাওয়ার বিড়ম্বনা এত। সে কাজ এত কঠিন।
রমা। কেন জ্যাঠাইমা?
বিশ্বেশ্বরী। আগে যে দেশের সঙ্গে এক হয়ে মিলতে হয়, সে কথা ত তখনও মনেও ভাবিনি। প্রথম থেকেই সে তার মস্ত জোর, মস্ত প্রাণ নিয়ে এতই উঁচুতে এসে দাঁড়াল যে কেউ তার নাগালই পেলে না। কিন্তু এখন ভাবি তাকে নাবিয়ে এনে ভগবান মঙ্গল করেছেন।
রমা। ভগবান নয় জ্যাঠাইমা—আমরা। কিন্তু আমাদের অধর্ম তাঁকে কেন নাবিয়ে আনবে?
বিশ্বেশ্বরী। আনবে বৈ কি মা, নইলে পাপ আর এত ভয়ঙ্কর কেন? উপকারের প্রত্যুপকার কেউ যদি না-ই করে, এমন কি উলটে অপকার করে, তাতেই বা কি আসে-যায় মা, মানুষের কৃতঘ্নতায় যদি না দাতাকে নাবিয়ে আনে। তুই বলচিস রমা, কিন্তু তোদের গ্রাম কি আর রমেশকে ঠিক তেমনিটি ফিরে পাবে? তোরা স্পষ্ট দেখতে পাবি, সে যে হাত দিয়ে দশের কল্যাণ করে বেড়াত, তার সেই হাতটাই ভৈরব আচায্যি—আর একা ভৈরব কেন, তোদের সবাই মিলে মুচড়ে ভেঙ্গে দিয়েচে। কে জানে, হয়ত ভালই হয়েচে। তার বলিষ্ঠ সমগ্র হাতের অপর্যাপ্ত দান গ্রহণ করবার শক্তি যখন লোকের ছিল না, তখন এই ভাঙ্গা হাতটাই তাদের সত্যিকার কাজে লাগবে।
[এই বলিয়া তিনি গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। তাঁহার হাতখানি
রমা নীরবে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করিয়া নিজেও দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল]
রমা। জ্যাঠাইমা?
বিশ্বেশ্বরী। কেন মা?
রমা। লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আর আমার গায়ে লাগে না, মা। মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে যেদিন তাঁকে জেলে দিয়েচি, সেদিন থেকে জগতে সমস্ত ব্যথা কেবল পরিহাস হয়ে গেছে।
বিশ্বেশ্বরী। এমনিই হয় মা।
রমা। সকলে বলতে লাগলেন শত্রুকে যেমন কোরে হোক নিপাত করতে দোষ নেই। তাঁরা তাই করেচেন। কিন্তু, আমার ত সে কৈফিয়ত নেই জ্যাঠাইমা!
বিশ্বেশ্বরী। তোমারই বা নেই কেন?
রমা। না মা, নেই।—একটা কথা আজ তোমার কাছে স্বীকার করব জ্যাঠাইমা। মোড়লদের বাড়িতে ছেলেরা জড় হয়ে রমেশদার কথামত সৎ আলোচনাই করত।
বদমাইশের দল ব’লে তাদের পুলিশে ধরিয়ে দেবার একটা মতলব চলছিল। আমি লোক পাঠিয়ে তাদের সাবধান করে দিই। কারণ, পুলিশ ত এই চায়। একবার তাদের হাতে পেলে ত আর রক্ষে রাখত না।
বিশ্বেশ্বরী। (শিহরিয়া) বলিস কি রে? নিজের গ্রামের মধ্যে পুলিশের উৎপাত বেণী মিথ্যে কোরে ডেকে আনতে চেয়েছিল?
রমা। মনে হয় বড়দার এই শাস্তি তারই ফল। আমাকে মাপ করতে পারবে জ্যাঠাইমা?
বিশ্বেশ্বরী। তার মা হয়ে এ যদি না ক্ষমা করতে পারি, কে পারবে রমা? আমি আশীর্বাদ করি এর পুরস্কার ভগবান তোমাকে যেন দেন।
রমা। (হাত দিয়া অশ্রু মুছিয়া ফেলিল) আমার এই একটা সান্ত্বনা, তিনি ফিরে এসে দেখবেন তাঁর আনন্দের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে আছে। যা তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর সেই দেশের দীন-দুঃখীরা এবার ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসেচে। তাঁকে চিনেচে, তাঁকে ভালোবেসেচে। এই ভালবাসার আনন্দে আমার অপরাধ কি তিনি ভুলতে পারবেন না?—জ্যাঠাইমা, শুধু একটি জায়গায় আমরা দূরে যেতে পারিনি। তোমাকে আমরা দু’জনেই ভালোবেসেছিলাম।
[বিশ্বেশ্বরী নিঃশব্দে তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিলেন]
রমা। সেই জোরে একটি দাবী তোমার কাছে আজ রেখে যাব। যখন আমি আর থাকব না, তখনও যদি আমাকে তিনি ক্ষমা করতে না পারেন, শুধু এই কথাটি আমার হয়ে তাঁকে বোলো, যত মন্দ বলে আমাকে তিনি জানতেন, তত মন্দ আমি ছিলাম না। আর যত দুঃখ তাঁকে দিয়েচি, তার অনেক বেশী দুঃখ যে আমি নিজেও সয়েচি,—তোমার মুখের এই কথাটি হয়ত তিনি অবিশ্বাস করবেন না।
বিশ্বেশ্বরী। তবে, চল মা আমরা কোন তীর্থস্থানে গিয়ে থাকি। যেখানে রমেশ নেই, বেণী নেই, যেখানে চোখ তুললেই ভগবানের মন্দিরের চুড়ো চোখে পড়ে, সেইখানেই যাই। আমি সমস্ত বুঝতে পেরেচি রমা। যদি যাবার দিনই তোর এগিয়ে এসে থাকে মা, তবে এ বিষ বুকের মধ্যে নিয়ে আর যাব না—সমস্ত এইখানেই নিঃশেষ করে ফেলে রেখে যাব। কেমন, পারবি ত মা?
রমা। (বিশ্বেশ্বরীর জানুর উপর মুখ লুকাইয়া আকুল হইয়া কাঁদিয়া ফেলিল, কহিল) আমি আর পারিনে জ্যাঠাইমা, আমাকে এখান থেকে তুমি নিয়ে চল।
রমা – ৪.৪
চতুর্থ দৃশ্য
কারা-প্রাচীরের সম্মুখের পথ
[এক দিক দিয়া রমেশ প্রবেশ করিল ও অপর দিক দিয়া বেণী—তাহার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা—স্কুলের হেডমাস্টার বনমালী ও কয়েকজন ছাত্র। পশ্চাতে বেণীর অনুগত আরও দুই—চারিজন লোক]