বেণী। কি বললি রে হারামজাদা?
সনাতন। দুটো মাথা কারো থাকে না বড়বাবু, সেই কথাই বলেচি,—আর কিছু নয়।
[গোবিন্দ গাঙ্গুলীর প্রবেশ]
গোবিন্দ। তোদের বুকের পাটা শুধু দেখচি আমরা। মায়ের প্রসাদ পেতেও কেউ তোরা এলিনে, বলি, কেন বল ত রে?
সনাতন। (হাসিয়া) আর বুকের পাটা? যা করবার সে ত আমার করেচেন। সে যাক। কিন্তু মায়ের প্রসাদই বলুন আর যাই বলুন, কোন কৈবর্তই আর বামুনবাড়িতে পাত পাতবে না। এত পাপ যে মা বসুমাতা কেমন করে সইচেন, তাই আমরা কেবল বলাবলি করি। (নিশ্বাস ফেলিয়া রমার প্রতি চাহিয়া) একটু সাবধানে থেকো দিদিঠাকরুন, পীরপুরের ছোঁড়ার দলটা একেবারে ক্ষেপে রয়েচে। এর মধ্যেই দু’তিনবার তারা বড়বাবুর বাড়ির চারপাশে ঘুরে গেছে—সামনে পায়নি তাই রক্ষে। (বেণীর প্রতি) একটু সামলে-সুমলে থাকবেন বড়বাবু, রাতবিরেতে বার হবেন না।
[বেণী কি-একটা বলিতে গেল কিন্তু ভয়ে তাহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না]
রমা। (স্নেহার্দ্র-কণ্ঠে) সনাতন, ছোটবাবুর জন্যেই বুঝি তোমাদের সব রাগ এত?
সনাতন। মিথ্যে বোলে আর নরকে যাব না দিদিঠাকরুন, তাই বটে। তবে, পীরপুরের লোকগুলোর রাগটাই সবচেয়ে বেশি। তারা ছোটবাবুকে দেব্তা মনে করে।
রমা। (আনন্দোজ্জ্বল মুখে) তাই নাকি সনাতন?
বেণী। (সনাতনের হাত চাপিয়া ধরিয়া) তোকে একবার দারোগার কাছে গিয়ে বলতে হবে সনাতন। তুই যা চাইবি তাই দেব। তোর সেই সাবেক দু’বিঘে জমি ছাড়িয়ে নিতে চাস ত তাই পাবি। ঠাকুরঘরে বসে দিব্বি করচি সনাতন, বামুনের কথাটা রাখ।
সনাতন। সে দিনকাল আর নেই বড়বাবু,—সে দিনকাল আর নেই। ছোটবাবু সব উল্টে দিয়ে গেছেন।
গোবিন্দ। বামুনের কথা তা হলে রাখবি নে বল?
সনাতন। (মাথা নাড়িয়া) না। বললে তুমি রাগ করবে গাঙ্গুলীমশাই, কিন্তু সেদিন পীরপুরের নূতন ইস্কুলঘরে ছোটবাবু বলেছিলেন, গলায় গাছকতক সুতো ঝোলানো থাকলেই বামুন হয় না। আমি ত আজকের নই ঠাকুর, সব জানি। যা কোরে তোমরা বেড়াও সে কি বামুনের কাজ? তোমাকেই জিজ্ঞেসা করচি দিদিঠাকরুন, তুমিই বল দিকি?
[রমা নিরুত্তরে মাথা হেঁট করিল]
সনাতন। (মনের আক্রোশ মিটাইয়া বলিতে লাগিল) বিশেষ কোরে ছোঁড়াদের দল। এই দুটো গাঁয়ের যত ছোকরা সন্ধ্যের পরে সবাই গিয়ে জোটে মোড়লের বাড়িতে। তারা ত স্পষ্ট বলে বেড়াচ্চে জমিদার’ত ছোটবাবু! আর সব চোর-ডাকাত। তা ছাড়া খাজনা দিয়ে বাস করব, ভয় কারুকে করব না। আর বামুনের মত থাকে ত বামুন, নইলে, আমরাও যা তারাও তাই।
বেণী। (আতঙ্কে পরিপূর্ণ হইয়া) সনাতন, আমার ওপরেই কেন এত রাগ বলতে পারিস?
সনাতন। তা আর পারিনে বড়বাবু? আপনিই যে সকল নষ্টের গোড়া তা কারও জানতে বাকী নেই।
[বেণী চুপ করিয়া রহিল, ভয়ে বুকের ভিতর তাহার টিপটিপ করিতেছিল]
বিশ্বেশ্বরী। গাঙ্গুলী-ঠাকুরপো, ছোটলোকের মুখে এত আস্পর্ধার কথা শুনেও যে বড় চুপ করে আছ?
[বেণী বক্রচক্ষে মায়ের প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করিয়াও নীরব হইয়া রহিল]
গোবিন্দ। হাঁ সনাতন, বিপিন মোড়লের বাড়িতেই তা হলে আড্ডা বল? সেখানে কি করে তারা বলতে পারিস?
সনাতন। কি করে তা জানিনে। কিন্তু ভাল চাও ত ও-মতলব কোরো না ঠাকুর। তারা ছোট-বড় সবাই ভাই-সম্পর্ক পাতিয়েচে। এক মন, এক প্রাণ। ছোটবাবুর জেল হওয়া থেকে সব রাগে বারুদ হয়ে আছে, তার মধ্যে গিয়ে চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালতে যেয়ো না গাঙ্গুলীমশাই। এই তোমাদের সাবধান করে দিয়ে গেলাম।
[প্রস্থান]
[সনাতন প্রস্থান করিলে সকলেই কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া]
বেণী। ব্যাপার শুনলে রমা?
[রমা মুচকিয়া হাসিল, কথা কহিল না। হাসি দেখিয়া বেণীর গা জ্বলিয়া গেল]
বেণী। শালা ভৈরবের জন্যেই এত কাণ্ড। আর তুমি না যাবে সেখানে, না তাকে ছাড়িয়ে দেবে তো এ—সব কিছুই হয় না। খেতো শালা মার,—তোমার কি!
[রমা পুনরায় একটু হাসিল, জবাব দিল না]
বেণী। তুমি ত হাসবেই রমা। মেয়েমানুষ, বাড়ির বার হতে ত হয় না,—কিন্তু আমাদের উপায় কি হবে বল ত? সত্যি সত্যিই যদি একদিন মাথা ফাটিয়ে দেয়? মেয়েমানুষদের সঙ্গে কাজ করতে গেলেই এই দশা হয়।
[রমা বিস্মিত-মুখে শুধু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল]
বেণী। গোবিন্দখুড়ো, চুপ করে বসে থাকলে কি হবে? আমার দরোয়ান আর চাকর দু’জনকে একবার ডেকে পাঠাও না? গোটা দুই আলো যেন সঙ্গে কোরে আনে।
গোবিন্দ। এস না, বাইরে গিয়ে ডাকতে পাঠাই। আর ভয়টা কিসের? না হয়, আমি নিজে গিয়ে তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসব।
[উভয়ের প্রস্থান]
রমা – ৪.২
দ্বিতীয় দৃশ্য
পথ
[জগন্নাথ ও নরোত্তমের প্রবেশ। জগন্নাথের হাতে একগাছা মোটা লাঠি]
নরোত্তম। এই পথ, এইখান দিয়ে যাবে। জগা, এখনো বল, সাহস হবে ত?
জগন্নাথ। সাহস হবে না কি রে! শাস্তি নিতে রাজী হয়েই ত শাস্তি দিতে দাঁড়িয়েচি। অনেক দুঃখু দিয়েচে। মা দুর্গা! শুধু এই করো, আজ যেন একটা কাজের মত কাজ করে যেতে পারি। যেন হাত না কাঁপে।
নরোত্তম। হাত কাঁপবে কি রে?
জগন্নাথ। তা পারে। বাপ-পিতামোর কাল থেকে মার খাওয়াটাই অভ্যাস হয়ে আছে কিনা! তাই শেষ পর্যন্ত হাত যদি না ওঠে ত হাতের দোষ, আমার নয়।
নরোত্তম। তবে লাঠিগাছটা আমার হাতে দিয়ে তুই সরে দাঁড়া। দেখি আমি কি করতে পারি।
জগন্নাথ। অমন কথা তুই বলিস নে নরু। তোর ছেলেপুলে আছে, কিন্তু আমার নেই। এই আমার সময়। ছোটবাবু ফিরে এলে আর হবে না, তিনি হাত চেপে ধরবেন। তাই তাঁর জেল থেকে বেরোবার আগেই তার শোধ নিয়ে আমি জেলে গিয়ে ঢুকবো। তুই ঘরে যা।