[প্রস্থান]
[ধীরে ধীরে বিশ্বেশ্বরীর প্রবেশ]
বিশ্বেশ্বরী। রমা!
রমা। কেন মা?
বিশ্বেশ্বরী। চুপটি কোরে বসে আছিস মা, কে বলবে মানুষ। ঠিক যেন কে মাটির মূর্তি গড়ে রেখেচে। (ধীরে ধীরে তাহার পাশে আসিয়া বসিলেন) সে হাসি নেই, সে উল্লাস নেই,—যেন কোথায় কোন্ বহুদূরে চলে গেছিস।
রমা। (ঈষৎ হাসিয়া) বাড়ির ভেতরে এতক্ষণ কি করছিলে জ্যাঠাইমা?
বিশ্বেশ্বরী। তোমার যজ্ঞিবাড়িতে ত কাজ কম নেই মা। অন্ন-ব্যঞ্জনের যেন পাহাড় জমিয়ে তুলেচ।
রমা। এবারে কিন্তু সমস্ত মিছে। বোধ করি একজন চাষাও আমার বাড়িতে মায়ের প্রসাদ পেতে আসবে না। কিন্তু অন্যান্য বারের কথা জানো ত জ্যাঠাইমা, এই সপ্তমীর দিনে প্রজাদের ভিড় ঠেলে বাড়িতে ঢুকতে পারা যেত না।
বিশ্বেশ্বরী। এখনো বলা যায় না রমা। হয়ত সন্ধ্যের পরেই সবাই আসবে।
রমা। না, আসবে না জ্যাঠাইমা।
জ্যাঠাইমা। সবাই ওই কথাই বলচে। বেণী, গোবিন্দঠাকুরপো রাগে দাপাদাপি করে বেড়াচ্চে, ভেতরে তোর মাসীর গালাগালির জ্বালায় কান পাতবার জো নেই, কেবল তোর মুখেতেই নালিশ নেই। সে রাগ নেই, অভিমান নেই,—তোর চোখের পানে চাইলে মনে হয় যেন ওর নীচে কান্নার সমুদ্র চাপা আছে। কেমন কোরে এমন বদলে গেলি মা?
রমা। রাগ করব কাদের ওপর জ্যাঠাইমা? প্রজাদের ওপরে? গরীব বলে কি তাদের সম্ভ্রমবোধ নেই? তারা আমার মত পাপিষ্ঠার অন্ন গ্রহণ করবে কেন?
বিশ্বেশ্বরী। তোমাকে পাপিষ্ঠা বলে সাধ্য কার মা?
রমা। বললেও ত অন্যায় হয় না। তারা জানে আমরা তাদের ভালোবাসিনে, আমরা তাদের আপনার জন নই। আমরা ত আদর কোরে আহ্বান করিনে মা, আমরা জোর কোরে হুকুম করি দুটো খেয়ে যাবার জন্যে। তাই তাদের না আসায় আমরা রাগে ক্ষেপে উঠি।—কিন্তু আদর যে কি, সে স্বাদ তারা পেয়েচে, ভালোবাসা যে কি, সে তারা রমেশদার কাছে জেনেচে। তাদের সেই বন্ধুকেই আমরা যখন মিথ্যে মামলায়, মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে জেলে পুরে এলাম, এ দুঃখ তারা ভুলবে কি করে জ্যাঠাইমা?
বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু তুমি ত মিথ্যে সাক্ষী দাওনি মা?
রমা। দিইনি আমি? তাদের বড় আশা ছিল, আর যেই কেননা মিথ্যে বলুক, আমি বলতে পারব না। কিন্তু বলতে ত পারলাম। মুখে ত বাধল না! আচায্যিমশায়ের কত বড় অপরাধ, কত বড় কৃতঘ্নতা যে রমেশদাকে আত্মবিস্মৃত করেছিল, সে ত আমি জানি। আমি ত জানি তাঁর হাতে একটা তৃণ পর্যন্ত ছিল না, তবু আদালতে দাঁড়িয়ে স্মরণ করতেই পারলাম না, হাতে তাঁর ছুরি-ছোরা ছিল কি না!
বিশ্বেশ্বরী। রমা—
রমা। জ্যাঠাইমা, তুমি বলছিলে মিথ্যে ত আমি বলিনি। এখানকার আদালতে হলফ কোরে মিথ্যে হয়ত আমি বলিনি, কিন্তু যে আদালতে হলফ করার বিধি নেই, সেখানে আমি কি জবাব দেবো? উঃ—ভগবান! সত্য-গোপনের যে এতবড় বোঝা এ আমাকে তুমি আগে জানতে দাওনি কেন?
বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু আমি তোমাকে বলচি মা, শাস্তি তার হয়েচে সত্যি, কিন্তু অকল্যাণ তার কখনো হবে না।
রমা। হবে কি কোরে জ্যাঠাইমা, আজ সমস্ত অকল্যাণের ভার এসে পড়েচে যে আমার মাথার ওপর।
বিশ্বেশ্বরী। একলা তোমার মাথায় পড়েনি মা, আমরা সবাই মিলে তাকে ভাগ কোরে নিয়েচি। অসত্যাচারী সমাজের যে কাপুরুষের দল মিথ্যে দুর্নামের ভয় দেখিয়ে তোমাকে ছোট করেচে, এ পাপের ভারে তাদের মাথা আজ পথের ধূলায়। বেণীর মা আমি, আমার মাথা মাটিতে লুটোচ্চে রমা, কখনও আর তুলতে পারব না।
রমা। অমন কথা তুমি বোলো না জ্যাঠাইমা। কিন্তু আমি কি করেছিলাম জানো? জনশূন্য অন্ধকার-পথে একলা দেখা কোরে সেধেছিলাম, রমেশদা, তুমি যাও,—যাও এখান থেকে। বিশ্বাস করলেন না, বললেন, আমি চলে গেলে তোমার লাভ কি? আমার লাভ? হঠাৎ ব্যথার ভারে যেন পাগল হয়ে গেলাম। বললাম, লাভ কিছুই নেই,—কিন্তু না গেলে আমার অনেক ক্ষতি। আমার মহামায়ার পূজোয় কেউ আসবে না, আমার যতীনের উপনয়নে কেউ খাবে না,—তুমি দেশে থেকে আমাকে সকল দিক দিয়ে নষ্ট কোরো না। কিন্তু এতবড় মিথ্যে আমি কোথায় পেলাম জ্যাঠাইমা? রাগ কোরে বললেন, এই? এইমাত্র? না, এর জন্যে আমার কাজ ছেড়ে আমি কোনমতেই যাব না। অভিমানে ভাবলাম, তবে হোক একটা শিক্ষা। বিশ্বাস ছিল, সামান্য কিছু একটা জরিমানা হবে। কিন্তু সে শাস্তি যে এমনি কোরে আসবে,—তাঁর রোগশীর্ণ মুখের পানে চেয়েও বিচারকের দয়া হবে না,—তাঁকে জেলে দেবে এ কথা আমার অতিবড় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি জ্যাঠাইমা।
বিশ্বেশ্বরী। সে জানি মা।
রমা। শুনলাম, আদালতে তিনি কেবল আমার পানেই চেয়েছিলেন। তাঁর গোপাল সরকার চাইলেন আপিল করতে, তিনি বললেন, না। সারা জীবন যদি জেলের মধ্যে বাস করতে হয় সেও ঢের ভাল, কিন্তু আপিল করে খালাস পেতে চাইনে। এ শাস্তি আমার কত বড় বল ত জ্যাঠাইমা?
বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু তার মিয়াদের কালও পূর্ণ হয়ে এলো। মুক্তি পেতে আর বেশী দিন নেই।
রমা। তাঁর মুক্তি হবে, কিন্তু তাঁর সেই নিবিড় ঘৃণা থেকে ইহজীবনে আমার ত মুক্তি নেই মা!
[বৃদ্ধ সনাতন হাজরাকে লইয়া বেণীর প্রবেশ]
বেণী। এই আমাদের তিনপুরুষের প্রজা। সুমুখে দিয়ে যাচ্ছিলেন, ডাকতে তবে বাড়ি ঢুকলেন। হাঁ রে সনাতন, এত অহঙ্কার কবে থেকে হোল রে? বলি, তোদের ঘাড়ে কি আর একটা কোরে মাথা গজিয়েচে রে?
সনাতন। দুটো করে মাথা আর কার থাকে বড়বাবু? আপনাদেরই থাকে না ত আমাদের মত গরীবের!