বেণী। এখন যাই, সময় মত আর একবার দেখা করব। বাইরে বোধ করি এতক্ষণে গোবিন্দখুড়ো এসে বসে আছে।
রমা। আমিও এখন যাই বড়দা।
[উভয়ের প্রস্থান ]
[রমেশের প্রবেশ]
রমেশ। রাধা, রাধা!
[দাসীর প্রবেশ]
রাধা। কেন ছোটবাবু?
রমেশ। জ্যাঠাইমা কি পূজোর ঘর থেকে বেরিয়েচেন? তখন একটা কথা তাঁকে বলতে ভুলেছিলাম।
রাধা। এখনো বেরোন নি। ডেকে দেব?
রমেশ। না না, থাক। বিকেলে আসবো তাঁকে বোলো।
রাধা। আচ্ছা।
[দাসীর প্রস্থান]
[দ্রুতপদে গোপাল সরকারের প্রবেশ]
রমেশ। আপনি এখানে যে?
গোপাল। অপেক্ষা করবার সময় নেই ছোটবাবু, আপনাকে চতুর্দিকে খুঁজে বেড়াচ্চি। শুনেচেন ভৈরব আচায্যির কাণ্ড? শুনেচেন, কি সর্বনাশ আমাদের সে করেচে?
রমেশ। কে না।
গোপাল। কর্তা স্বর্গীয় হলেন, শোকে-দুঃখে ভাবলাম আর না, এবারে শান্তি হব। কিন্তু হোতে দিলে না। আপনি কিন্তু আমাকে বাধা দিতে পারবেন না ছোটবাবু, আচায্যিকে আমি শাস্তি দেবো, দেবো, দেবো! এর প্রতিশোধ নেবো, নেবো, নেবো! আমি আজই যাচ্চি সদরে।
রমেশ। ব্যাপার কি সরকারমশাই? আপনার মত শান্ত মানুষে এতখানি উতলা হয়ে উঠেচে, কি করলেন আচায্যিমশাই?
গোপাল। কি করলেন? নেমকহারাম, শয়তান! তখনি মনে হয়েছিল, যাক ওর ভিটেমাটি বিক্রি হয়ে, আমরা এতে মাথা দেব না। কিন্তু তখনি ভয় হোলো কর্তা হয়ত স্বর্গে থেকে দুঃখ পাবেন। জানি ত তাঁর স্বভাব। তাই আপনাকে নিষেধ করতে পারলাম না।
রমেশ। তবুও যে কিছুই বুঝলাম না সরকারমশাই?
গোপাল। সেদিন আপনার আদেশ-মত সদরে গিয়ে ওর ডিক্রির টাকাটা জমা দিয়ে মকদ্দমার সমস্ত ব্যবস্থা স্থির কোরে এলাম, আর আজ এইমাত্র খবর পেলাম—পরশু ভৈরব আচায্যি নিজে গিয়ে দরখাস্ত কোরে মামলা তুলে নিয়েছে। দেনা স্বীকার করেচে।
রমেশ। তার মানে?
গোপাল। তার মানে জমা দেওয়া অতগুলো টাকা আমাদের গেল। আমাদের মাথায় কাঁটাল ভেঙ্গে তিনজনে এখন বখরা করে খাবে। গোবিন্দ গাঙ্গুলী, বড়বাবু, আর ও নিজে। শোনেন নি সকাল থেকে আচায্যিবাড়িতে রোশনচৌকির সানাইয়ের বাদ্যি? ঘটা কোরে হবে দৌহিত্রের অন্নপ্রাশন, ওই টাকায় দেশসুদ্ধ বামুনের দল ফলার করে বাঁচবে। অথচ আপনার স্থান নেই,—স্থান হয়েচে গোবিন্দ গাঙ্গুলীদের। আপনাকে করেছে তারা ‘ একঘরে’।
রমেশ। ভৈরব আচায্যি? পারলে করতে সে?
গোপাল। পারলে বৈ কি। পাড়াগাঁয়ের লোকে পারে না কি তাই শুধু আমার জানতে বাকী। আমি চললাম। ৬০
রমেশ। যান। আমি শুধু ভাবি, এ মহাপাতকের প্রায়শ্চিত্ত হবে কিসে?
গোপাল। আমার সাক্ষী আছে, আদালত খোলা আছে, আমি তাকে সহজে ছাড়ব না ছোটবাবু।
[প্রস্থান]
রমেশ। জানিনে আইনে কি বলে। জানিনে কৃতঘ্নতার দণ্ড আদালতে হয় কি না। কিন্তু থাক সে! আমি নিলাম আজ নিজের হাতে এই ভার। কেবল সহ্য করে যাওয়াই জগতে পরম ধর্ম নয়।
[প্রস্থান]
রমা – ৩.২
দ্বিতীয় দৃশ্য
[ভৈরব আচার্যের বহির্বাটী। দৌহিত্রের অন্নপ্রাশন-উপলক্ষে দ্বারে মঙ্গলঘট স্থাপিত হইয়াছে। আম্রপল্লবের মালা গাঁথিয়া সম্মুখে ঝুলাইয়া দেওয়া হইয়াছে। প্রাঙ্গণের একপ্রান্তে রোশনচৌকি বাদ্যকরের দল উপবিষ্ট। সম্মুখের বারান্দায় বসিয়া গোবিন্দ গাঙ্গুলী, বেণী ঘোষাল প্রভৃতি ভদ্রলোক। কেহ হাসিতেছে, কেহ ধূমপান করিতেছে। একজন বৈষ্ণব ও তাহার বৈষ্ণবী কীর্তন গাহিতেছিল, এবং তাহাই সকলে পরমানন্দে শ্রবণ করিতেছে। গান শেষ হইলে দীনু ভট্টাচার্য হুঁকা রাখিয়া বাহিরে যাইতেছিল, এমনি সময়ে রমেশ আসিয়া প্রবেশ করিল। দেখিলেই বুঝা যায় সে অতিশয় উত্তেজিত হইয়া আসিয়াছে। তাহার অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে উপস্থিত সকলেই চঞ্চল হইয়া উঠিল]
গান
শ্রীমতী করিছে বেশ।
ভুলাতে নাগর
শ্যাম নটবর
নানা ছাঁদে বাঁধে কেশ।
(আহা) শ্রীমতী করিছে বেশ।
হেরিয়া মুকুরে
চাঁচর চিকুরে
বিনায়ে বিনায়ে বিনোদ গোখুরে
রাধা বাঁধিল কবরী কত
কেহ হল নাক মনোমত (হায় রে),
ফণি–গঞ্জিত বেণী বিনোদিনী
দুলাইয়া দিল শেষ
(আহা) শ্রীমতী করিছে বেশ।
বেণী গেল ছুটি
লঙ্ঘিয়া কটি
পরশি মেখলা নিতম্বে লুটি
চুম্বিলা পাদদেশ।
উজ্জ্বল দু’টি নয়নপ্রান্তে কজ্জল দিল টানি
ফুলধনু জিনি ভ্রূযুগ মাঝে দীপসম টিপখানি।
ভরিয়া দু’ করে স্বর্ণবিন্দু
মার্জিল ধনী বদন ইন্দু
নন্দিতে শ্যামসুন্দর-হৃদি—বন্দিতে কমলেশ।
রমেশ। আচায্যিমশাই কৈ?
দীনু। (কাছে আসিয়া) চল, বাবা চল, বাড়ি ফিরে চল। তুমি যে উপকার আচায্যির করেচো সে ওর বাবা করতো না। কিন্তু উপায় ত নেই। কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে সকলকেই ঘর করতে হয়, তোমাকে নেমন্তন্ন করতে গেলে,—বুঝলে না বাবা,—ভৈরবকে নেহাত দোষ দেওয়াও যায় না। তোমরা সব আজকালকার শহরের ছেলে, জাত-টাত ত তেমন মানো না—তাতেই বুঝলে না বাবা,—দু’দিন পরে ওর ছোট মেয়েটা বছর বারোর হলো ত,—পার করতেও ত হবে,—আমাদের সমাজের ব্যাপার বুঝলে না বাবা—
রমেশ। আজ্ঞে হাঁ বুঝেচি। তিনি কৈ?
দীনু। আছে আছে, বাড়িতেই আছে। কিন্তু বামুনকেই বা দোষ দিই কি করে? (সকলের দিকে চাহিয়া) আমাদের বুড়োমানুষের পরকালের ভয়ও ত একটা—
রমেশ। সে ত ঠিক কথা। কিন্তু ভৈরব কোথায়?
[ভৈরবের প্রবেশ]
ভৈরব। (সবিস্ময়ে বেণীবাবুর উদ্দেশ্যে) দেখুন বড়বাবু, আপনার পাছে কষ্ট হয়—
[অকস্মাৎ সম্মুখে রমেশকে দেখিয়া সে বজ্রাহতের ন্যায় স্তব্ধ হইয়া গেল]
রমেশ। (দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া তাহার একটা হাত সবলে চাপিয়া ধরিয়া) কেন এমন করলেন? আজ আমি—