মাসী । বলিস কি লো? একেবারে এতো?
বেণী। তা বটে, তা বটে। ছোটখুড়ী ভালমানুষের মেয়ে ছিলেন। তাঁর কথা উঠলে মা আজও চোখের জল ফেলেন। তা সে যাক, কিন্তু এই ত স্থির রইল দিদি, নড়চড় হবে না ত?
রমা। (হাসিয়া) না। বড়দা, বাবা বলতেন আগুনের শেষ, ঋণের শেষ, আর শত্রুর শেষ কখনো রাখিস নে রমা। তারিণী ঘোষাল জ্যান্তে আমাদের কম জ্বালা দেয়নি—বাবাকে পর্যন্ত জেলে দিতে গিয়েছিল। আমি কিছুই ভুলিনি বড়দা, যতদিন বেঁচে থাকবো ভুলবো না। রমেশ সেই শত্রুরই ছেলে। আমরা ত নয়ই—আমাদের সংস্রবে যারা আছে তাদের পর্যন্ত যেতে দেব না।
বেণী। এই ত চাই। এই ত তোমার যোগ্য কথা।
রমা। আচ্ছা বড়দা, এমন করা যায় না যে কোন ব্রাহ্মণ না তার বাড়ি যায়? তা হলে—বেণী। আরে, সেই চেষ্টাই ত করচি বোন। তুই শুধু আমার সহায় থাকিস আর আমি কোন চিন্তা করিনে। রমেশকে এই কুঁয়াপুর থেকে না তাড়াতে পারি ত আমার নামই বেণী ঘোষাল নয়। তারপরে রইলাম আমি আর ঐ আচায্যিব্যাটা। ছোটখুড়ো আর বেঁচে নেই, দেখি তাকে কে রক্ষা করে!
রমা। (হাসিয়া) রক্ষে করবেন বোধ করি রমেশ ঘোষাল। কিন্তু আমি বলে রাখলেম বড়দা, আমাদের শত্রুতা করতে ইনিও কম করবেন না।
বেণী। (এদিক-ওদিক চাহিয়া এবং কণ্ঠস্বর আরও মৃদু করিয়া) রমা, আসল কথা হচ্চে, বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপার সে আজও কিছুই বোঝে না। বাঁশ নুইয়ে ফেলতে চাও ত এই সময়। পেকে উঠলে আর হবে না তা তোমাকে নিশ্চয় বলে দিচ্চি। দিনরাত মনে রাখতে হবে এ তারিণী ঘোষালের ছেলে আর কেউ নয়। চেপে বসলে আর—
[অন্তরাল হইতে গম্ভীর-কণ্ঠের ডাক আসিল,—“রানী কৈ রে?” রমা চকিত হইয়া উঠিল। এবং পরক্ষণেই দ্বারের ভিতর দিয়া রমেশ প্রবেশ করিল। তাহার রুক্ষ মাথা, খালি পা, উত্তরীয়টা মাথায় জড়ান। বেণীর প্রতি দৃষ্টি পড়িতেই—]
রমেশ। এই যে বড়দা এখানে? বেশ, চলুন। আপনি নইলে করবে কে? আমি সারা গাঁ আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্চি। রানী কৈ? বাড়ির মধ্যে দেখি কেউ নেই। ঝি বললে এই দিকে গেছে—
[রমা নতমুখে দাঁড়াইয়া ছিল, সহসা তাহাকে পাইয়া]
রমেশ। আরে এই যে! ইস! কত বড় হয়েচো! ভালো আছো ত? আমাকে চিনতে পারচো না বুঝি? আমি তোমাদের রমেশদা।
রমা। (মুখ তুলিয়া চাহিল না, কিন্তু অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল) আপনি ভাল আছেন?
রমেশ। হাঁ ভাই ভাল আছি। কিন্তু আমাকে ‘আপনি’ কেন রানী? (বেণীর দিকে চাহিয়া) রমার একটি কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারিনি বড়দা। মা যখন মারা গেলেন তখন ত ও ছোট; কিন্তু তখনি আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল, তুমি কেঁদো না রমেশদা, আমার মাকে আমরা দুজনে ভাগ করে নেব। তোমার বোধ হয় মনে পড়ে না, না? আমার মাকে মনে পড়ে ত?
[রমা নিরুত্তর, লজ্জায় যেন তাহার মাথা আরও হেঁট হইয়া গেল]
রমেশ। কিন্তু আর ত সময় নেই ভাই। যা করবার করে দাও,—যাকে বলে একান্ত নিরাশ্রয় আমি তাই হয়েই আবার তোমাদের দোরগোড়ায় ফিরে এসে দাঁড়িয়েচি। তোমরা না গেলে এতটুকু ব্যবস্থা পর্যন্ত হয়ত হবে না।
মাসী । (কাছে আসিয়া রমেশের মুখের দিকে চাহিয়া) তুমি বাপু তারিণী ঘোষালের ছেলে না?
[রমেশ নিঃশব্দ বিস্ময়ে চাহিয়া রহিল]
মাসী । আগে ত দেখনি, চিনতে পারবে না বাছা,—আমি রমার আপনার মাসী । কিন্তু এমন বেহায়া পুরুষমানুষ তোমার মত আর ত দেখিনি। যেমন বাপ তেমনিই কি ব্যাটা! বলা নেই কহা নেই, একটা গেরস্তর বাড়ির অন্দরে ঢুকে উৎপাত করতে শরম হয় না তোমার?
রমা। কি বকচো মাসী, নাইতে যাও না।
[বেণীর নিঃশব্দে প্রস্থান]
মাসী । নে রমা বকিস নে। যে কাজ করতেই হবে তাতে তোদের মত আমার চক্ষুলজ্জা হয় না। বলি, বেণীর অমন কোরে পালানোর কি দরকার ছিল? বলে গেলেই ত হোত, আমরা বাপু তোমার গোমস্তাও নই, খাস-তালুকের প্রজাও নই যে, তোমার কর্মবাড়িতে জল তুলতে ময়দা মাখতে যাবো। তারিণী মরেচে লোকের হাড় জুড়িয়েছে। এ কথাটা বলার বরাত আমাদের মত দুজন মেয়েমানুষের ওপর না দিয়ে নিজে বলে গেলেই ত পুরুষের মত কাজ হোতো।
[রমেশ নির্বাক পাথরের মূর্তির মত দাঁড়াইয়া রহিল]
মাসী । যাই হোক, বামুনের ছেলেকে আমি চাকর-বাকর দিয়ে অপমান করতে চাইনে, একটু হুঁশ করে কাজ কোরো। কচিখোকাটি নও যে লোকের বাড়িতে ঢুকে আবদার করে বেড়াবে। রানী কি? রানী ওর নাম নাকি? তোমার বাড়িতে আমার রমা কখনো পা ধুতে যেতেও পারবে না। এই তোমাকে আমি বলে দিলাম।
রমেশ। তোমাকে মা বলতেন রানী, ছেলেবেলার সেই ডাকটাই মনে ছিল রমা। আমি ত জানতাম না যে, আমাদের বাড়িতে তুমি যেতেই পারো না। না জেনে যে উপদ্রব করে গেলাম সে আমাকে তুমি ক্ষমা করো রমা।
[রমেশের প্রস্থান ও বেণীর আবির্ভাব]
বেণী। (তাহার সমস্ত মুখ খুশীতে ভরিয়া গিয়াছে) হাঁ, শোনালে বটে মাসী । আমাদের সাধ্যিই ছিল না অমন করে বলা। এ কি চাকর-বাকরদের কাজ রমা? আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলাম কিনা, ছোঁড়া মুখখানা যেন আষাঢ়ের মেঘের মত করে বেরিয়ে গেল। এই ত ঠিক হল।
মাসী । হল ত জানি, কিন্তু মেয়েমানুষের ওপর ভার না দিয়ে, না সরে গিয়ে নিজে বললেই ত আরো ভাল হতো। আর না-ই যদি বলতে পারতে, আমি কি বললাম দাঁড়িয়ে থেকে শুনে গেলে না কেন বাছা?
রমা। দুঃখ কোরো না মাসী, উনি না শুনুন আমরা শুনেচি। যে যতই বলুক না কেন, এতখানি বিষ জিভ দিয়ে ছড়াতে তোমার মত আর কেউ পেরে উঠত না।