[এই বলিয়া রমেশ চলিয়া যাইতেছিল, রমা ফিরিয়া ডাকিল]
রমা। শুনুন। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে যত অপমান করলেন, আমি তার একটারও জবাব দেব না। কিন্তু এ কাজ আপনি কিছুতেই করবার চেষ্টা করবেন না।
রমেশ। কেন?
রমা। কারণ, এত অপমানের পরেও আমার আপনার সঙ্গে বিবাদ করতে ইচ্ছে করে না। আর—
রমেশ। আর কি?
রমা। আর, আর—হয়ত, আকবর-সর্দারের দল এসে পড়েচে।
রমেশ। কারা তোমার আকবর-সর্দারের দল আমি জানিনে—জানতেও চাইনে। কলহ-বিবাদের অভিরুচি আমারও নেই, কিন্তু, তোমার সদ্ভাবের মূল্যও আর আমার কাছে কিছুমাত্র নেই।
[দ্রুতপদে প্রস্থান]
[মাসীর প্রবেশ]
মাসী। কে অমন কোরে হাঁকাহাঁকি করছিল রে রমা, যেন চেনা-গলা?
রমা। কেউ না।
মাসী। না বললেই শুনব? সন্ধ্যেটি দিয়ে আহ্নিক করতে বসেচি, যেন ষাঁড়-চেঁচানো চেঁচাচ্ছে। আহ্নিক ফেলে রেখে উঠে আসতে হোল।
রমা। সে চলে গেছে। তুমি ফিরে গিয়ে আবার আহ্নিকে বসো গে। কুমুদা!
[দাসীর প্রবেশ]
কুমুদা। কেন দিদি?
রমা। একবার জ্যাঠাইমার ওখানে যাব, আমার সঙ্গে চলো।
মাসী। সেখানে আবার কিসের জন্যে?
রমা। দেখ মাসি, সব কথাই তোমাকে জানতে হবে তার মানে নেই। চল্ কুমুদা।
কুমুদা। চল দিদি।
[উভয়ের প্রস্থান]
মাসী। বাপ্রে! যেন মারমুখী! তবু যদি না লোকে তারকেশ্বরের কথা শুনত! আমি তাই লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে মরি!
[প্রস্থান]
[বেণী, গোবিন্দ, আহত আকবর ও তাহার
দুই পুত্র গহর ও ওস্মানের প্রবেশ]
আকবর। (খুঁটি ঠেস দিয়া বসিয়া পড়িল। তাহার সমস্ত মুখ রক্তে ভাসিতেছে) আল্লা!
গহর। (নিজের রক্তধারা হাত দিয়া মুছিয়া ফেলিয়া) বাপজান্, দরদ কি বেশি মালুম হচ্চে?
আকবর। আল্লা!
বেণী। কথা শোন্ আকবর। থানায় চল্। সাত বছর যদি না তাকে দিতে পারি ত ঘোষাল-বংশের ছেলে নই আমি।
[রমার প্রবেশ]
রমা। অ্যাঁ! এমনধারা কে করলে তোমাদের আকবর?(এই বলিয়া সে অদূরে বসিয়া পড়িল)
আকবর। (আকাশের প্রতি হাত তুলিয়া) আল্লা!
বেণী। আল্লা! আল্লা! এখানে বসে আল্লা আল্লা করলে হবে কি? বলচি থানায় চল্। যদি না এর শোধ দশ বচ্ছর ঠেলতে পারি ত,—রমা, তুমি চুপ করে রইলে কেন? বল না একবার থানায় যেতে।
রমা। কে তোমাকে এমন কোরে জখম করলে আকবর?
আকবর। ছোটবাবু দিদিঠাকরুন।
রমা। এ কি কখনো হতে পারে আকবর? ছোটবাবু একলা তোমাদের তিন বাপ-ব্যাটাকে জখম কোরে দিলে? এ যে তিনশো জনে পারে না!
আকবর। তাই ত হোলো দিদিঠাকরান! সাবাস! মায়ের দুধ খেয়েছিল বটে! লাঠি ধরলে বটে!
গোবিন্দ। সেই কথাই ত থানায় গিয়ে বলতে বলচি রে ব্যাটা! কার লাঠিতে তুই জখম হলি? ছোটবাবুর, না সেই হারামজাদা ভোজোর?
আকবর। সেই বেঁটে হিন্দুস্থানীটার? লাঠির সে জানে কি? কি বলিস রে গহর, তোর পয়লা চোটেই সে বসেছিল, না রে?
[গহর কথা কহিল না, মাথা নাড়িয়া সায় দিল]
আকবর। মোর হাতের চোট পেলে সে বাঁচত না। গহরের লাঠিতেই বাপ কোরে সে বসে পড়লে দিদিঠাকরান।
আকবর। তখন ছোটবাবু তার লাঠি তুলে নিয়ে বাঁধ এট্কে দাঁড়াল দিদিঠাকরান, তিন বাপ-ব্যাটায় মোরা হটাতে নারলাম। আঁধারে বাঘের মত তেনার চোখ জ্বলতে লাগল। কইলেন, আকবর, বুড়োমানুষ তুই সরে যা। বাঁধ কেটে না দিলে সারা গাঁয়ের লোক মারা পড়বে, তাই কেট্তেই হবে। তুইও ত রে চাষী, তোর আপন গাঁয়েও ত জমিজমা আছে, সমঝে দেখ্ রে, সব বরবাদ হয়ে গেলে তোর ক্যামন লাগে? মুই সেলাম কোরে কইলাম, আল্লার কিরে ছোটবাবু, তুমি একটিবার পথ ছাড়। দিদিঠাকরান পেঠিয়েছে মোদের, মোরা জান কবুল দিইচি। তিনি চমকে উঠে কইলেন, তোদের রমা পাঠিয়েছে আকবর, আমারে মারতে? মুই কইলাম, তবে বাঁধ এট্কো না ছোটবাবু, ঘরকে যাও। তোমার আড়ালে দেঁড়িয়ে ঐ যে কয় সুম্মুন্দি মুয়ে কাপড় জড়ায়ে ঝপাঝপ্ কোদাল মারচে ওদের শিরগুলো ফাঁক কোরে দিয়ে যাই।
বেণী। বেইমান ব্যাটারা,—তাকে সেলাম বাজিয়ে এসে এখানে চালাকি মারা হচ্চে।
আকবর। (তিন বাপ-ব্যাটায় প্রতিবাদের ভঙ্গীতে হাত তুলিয়া) খবরদার বড়বাবু! বেইমান কোয়ো না। মোরা মোছলমানের ছ্যালে সব সইতে পারি,—ও পারি না।—(হাত দিয়া কতকটা রক্ত মুছিয়া ফেলিয়া) অ্যারে বেইমান কয় দিদি? ঘরের মধ্যি বসি বেইমান কইচো বড়বাবু, চোখে দ্যেখলি জানতে পারতে ছোটবাবু কি!
বেণী। (মুখ বিকৃত করিয়া) ছোটবাবু কি! তাই থানায় গিয়ে জানিয়ে আয় না? বলবি, তোরা বাঁধ পাহারা দিচ্ছিলি, ছোটবাবু চড়াও হয়ে তোদের মেরেচে।
আকবর। (জিভ কাটিয়া) তোবা! তোবা! দিনকে রাত করতি বল বড়বাবু?
বেণী। না হয় আর কিছু বলবি। আজ রাত্তিরে গিয়ে জখম দেখিয়ে আয় না,—কাল ওয়ারেন্ট বার কোরে একেবারে হাজতে পুরবো। রমা, তুমি ভাল কোরে একবার বুঝিয়ে বল না? এমন সুবিধা যে আর কখনো পাওয়া যাবে না!
[রমা নীরবে একবার আকবরের মুখের প্রতি চাহিল]
আকবর।(মাথা নাড়িয়া) না দিদিঠাকরান, ও পারব না।
বেণী।(ধমক দিয়া) পারবি নে কেন শুনি?
আকবর।(ক্রুদ্ধকণ্ঠে) কি কও বড়বাবু, সরম নেই মোর? পাঁচখানা গাঁয়ের লোকে মোরে সর্দার কয় না? দিদিঠাকরান, তুমি হুকুম দিলে আসামী হয়ে জ্যাল যাতি পারি, ফৈরিদি হব কোন্ কালামুয়ে?
রমা। সত্যিই পারবে না আকবর?
আকবর। না, দিদিঠাকরান, আর সব পারি, সদরে গিয়ে গায়ের চোট দেখাতে না পারি। ওঠ্ রে গহর, এইবার ঘরকে যাই। মোরা নালিশ করতি পারব না।