রমেশ। অত্যন্ত প্রয়োজনে আসতে হলো রমা।
রমা। (ঈষৎ হাসিয়া) বেশ আসা! কিন্তু হঠাৎ কেউ যদি দেখে ত ভাববে আমি বুঝি প্রদীপ জ্বেলে আপনাকেই নমস্কার করছিলাম। এমনি কোরে বুঝি দাঁড়ায়?
রমেশ। রমা, আমি শুধু তোমার কাছেই এসেচি।
রমা। (হাসিমুখে) সে আমি জানি। নইলে কি মাসীর কাছে এসেচেন আমি বলচি? (এই বলিয়া সে প্রদীপ হাতে লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল) কি আদেশ বলুন?
রমেশ। তুমি নিশ্চয়ই সব শুনেচ। জল বার করে দেবার জন্যে তোমার মত নিতে এসেচি।
রমা। আমার মত?
রমেশ। হ্যাঁ, তোমার মত নিতেই ছুটে এসেচি রমা। আমি নিশ্চয় জানি দুঃখীদের এত বড় বিপদে তুমি কখনোই না বলতে পারবে না।
রমা। জল বার কোরে দেওয়াই উচিত বটে, কিন্তু কি কোরে হবে রমেশদা, বড়দার যে মত নেই।
[বেণী ও গোবিন্দর প্রবেশ]
বেণী। না, আমার মত নেই। কেন থাকবে? দু-তিনশো টাকার মাছ বেরিয়ে যাবে সে খবরটা রেখেছ কি? এ টাকাটা কি চাষারা দেবে?
রমেশ। চাষারা গরীব, টাকা তারা কোথায় পাবে? কথাটা একবার বুঝে দেখুন বড়দা।
বেণী। তা দেখেচি। কিন্তু নাহক এত টাকা আমরাই বা কেন লোকসান করতে যাব এ কথাটাও ত বুঝে উঠতে পারিনে রমেশ। (গোবিন্দর প্রতি) খুড়ো, এমনি করে ভায়া আমার জমিদারি রাখবেন! ওহে রমেশ, হারামজাদারা সকাল থেকে এতক্ষণ আমার ওখানে পড়েই মড়া-কান্না কাঁদছিল,—আমি জানি সব। বলি, তোমার সদরে কি দারোয়ান নেই? তার পায়ে নাগরা জুতো নেই? যাও ঘরে গিয়ে সেই ব্যবস্থা করগে, জল আপনি নিকেশ হয়ে যাবে।
[এই বলিয়া নিজের রসিকতায় গোবিন্দর সহিত
একযোগে হিঃ হিঃ হাঃ হাঃ—করিয়া হাসিতে লাগিল]
রমেশ। কিন্তু ভেবে দেখুন বড়দা, আমাদের তিন ঘরের দু’শো টাকা মাত্র লোকসান বাঁচাতে গিয়ে গরীবদের সারা বছরের অন্ন মারা যাবে। যেমন করে হোক তাদের পাঁচ-সাত হাজার টাকা ক্ষতি হবেই।
বেণী। হল হলই। তাদের পাঁচ হাজারই যাক আর পঞ্চাশ হাজারই যাক, এই গোটা সদরটা খুঁড়ে ফেললেও ত পাঁচটা পয়সা বার হবে না ভায়া, যে, ও-শালাদের জন্যে দু-দু’শ টাকা উড়িয়ে দিতে হবে?
রমেশ। এরা সারা বছর খাবে কি?
বেণী। (হাসিয়া, মাথা নাড়িয়া, থুথু ফেলিয়া, অবশেষে স্থির হইয়া) খাবে কি? দেখবে ব্যাটারা যে-যার জমি বন্ধক রেখে আমাদের কাছেই টাকা ধার করতে ছুটে আসবে। ভায়া, মাথাটা একটু ঠাণ্ডা কোরে চল। কর্তারা এমনি কোরেই বাড়িয়ে গুছিয়ে এই যে এক-আধ টুকরো উচ্ছিষ্ট ফেলে রেখে গেছেন, এই আমাদের নেড়ে-চেড়ে, গুছিয়ে-গাছিয়ে, খেয়েদেয়ে আবার ছেলেদের জন্যে রেখে যেতে হবে। ওরা খাবে কি? ধার-কর্জ করে খাবে। নইলে আর ব্যাটাদের ছোটলোক বলেচে কেন?
গোবিন্দ। এ যে মুনি-ঋষিদের শাস্ত্রবাক্য বাবাজী, এ ত আর তোমার আমার কথা নয়!
রমেশ। বড়দা, আপনি যখন কিছুই করবেন না স্থির করেচেন তখন তর্ক কোরে আর লাভ নেই।
বেণী। না নেই। (রমার প্রতি) তোমার পীরপুরের আকবর আলি আর তার ব্যাটাদের খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে রমা। (গোবিন্দর প্রতি) চল খুড়ো, আমরা ও-দিকটা একবার দেখেশুনে আসি গে। সন্ধ্যাও হল।
গোবিন্দ। চল বাবা চল!
[উভয়ের প্রস্থান]
রমেশ। হুকুম দাও রমা, ওঁর একার অমতেই এত বড় অন্যায় হতে পারে না। আমি এখুনি গিয়ে বাঁধ কাটিয়ে দেব।
রমা। কিন্তু মাছ আটকে রাখার কি বন্দোবস্ত করবেন?
রমেশ। এত জলে কোন বন্দোবস্ত হওয়াই সম্ভবপর নয়। এ ক্ষতি আমাদের স্বীকার করতেই হবে। না হলে গ্রাম মারা যায়।
[রমা নীরব]
রমেশ। তা হলে অনুমতি দিলে?
রমা। না। এত টাকা আমি লোকসান করতে পারব না। তা ছাড়া বিষয় আমার ভাইয়ের। আমি অভিভাবক মাত্র।
রমেশ। না, আমি জানি অর্ধেক তোমার।
রমা। শুধু নামে, বাবা নিশ্চয় জানতেন সমস্ত বিষয় যতীনই পাবে। তাই অর্ধেক আমার নামে দিয়ে গেছেন।
রমেশ। (মিনতির কণ্ঠে) রমা, এ ক’টা টাকা? এদিকে তোমাদের অবস্থা সকলের চেয়ে ভাল। তোমার কাছে এ ক্ষতি ক্ষতিই নয়। আমি মিনতি জানাচ্চি, এর জন্যে এত লোককে অন্নহীন কোরো না। যথার্থ বলচি, তুমি যে এত নিষ্ঠুর হতে পার আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
রমা। নিজের ক্ষতি করতে পারিনে বলে যদি নিষ্ঠুর হই, না হয় তাই। ভাল, আপনার যদি এতই দয়া, নিজেই না হয় ক্ষতিপূরণ করে দিন না।
রমেশ। রমা, মানুষ খাঁটি কি না চেনা যায় শুধু টাকার সম্পর্কে। এই জায়গাটায় নাকি ফাঁকি চলে না, তাই এইখানেই মানুষের যথার্থ রূপ ধরা পড়ে। তোমারও আজ তাই পড়েচে। কিন্তু তোমাকে আমি কখনো এমন করে ভাবিনি। ভেবেচি, তুমি এর চেয়ে অনেক, অনেক ওপরে। কিন্তু তুমি তা নও। তোমাকে নিষ্ঠুর বলাও ভুল। তুমি অতি নীচ, অতি ছোটো।
রমা। কি আমি? কি বললেন?
রমেশ। তুমি অত্যন্ত হীন এবং নীচ। আমি যে কত ব্যাকুল হয়ে উঠেচি, সে তুমি টের পেয়েছ বলেই আমার কাছে দুঃখীর মুখের গ্রাসের দাম আদায়ের দাবী করলে। কিন্তু বড়দাও মুখ ফুটে এ কথা বলতে পারেন নি। পুরুষ হয়েও তাঁর মুখে যা বেধেছে, নারী হয়ে তোমার মুখে তা বাধেনি।—একটা কথা তোমাকে আজ বলে যাই রমা। আমি এর চেয়েও ঢের বেশি ক্ষতিপূরণ করতে পারি, কিন্তু সংসারে যত পাপ আছে, মানুষের দয়ার ওপর জুলুম করাটাই সবচেয়ে বড়। আজ তুমি তাই করে আমার কাছে টাকা আদায়ের ফন্দি করেচ।
[রমা বিহ্বল হতবুদ্ধির ন্যায় নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল]
রমেশ। আমার দুর্বলতা কোথায় সে তোমাদের অগোচর নেই বটে, কিন্তু সেখানে পাক দিয়ে আজ একবিন্দু রস পাবে না। কিন্তু কি আমি করব তাও তোমাকে জানিয়ে দিয়ে যাই। এখুনি গিয়ে নিজে জোর করে বাঁধ কাটিয়ে দেব,—তোমরা পার আটকাবার চেষ্টা করো গে।