যাত্রী। এঁটো হয়ে গেল? এক ব্যাটা নাপতে সিকিটি হাতে নিয়ে এইটুকু ক্ষুর বুলিয়ে দিয়ে বলে কর্তার সিকিটি অমনি দাও। বললুম, কর্তা আবার কে? এই তো গদিতে পাঁচ-সিকে জমা দিয়ে হুকুম নিয়ে আসচি। বলে, দেখ গে তবে আর কোথাও। সিকি ত গেছেই, রাগ করে উঠে এলুম। দাও দাদা, তোমার বাপ-মায়ের কল্যাণে—
নাপিত। আর গণ্ডা-আষ্টেক পয়সা বার কর দিকি। তার চার-আনা, কর্তার চার-আনা।
যাত্রী। আবার তার চার-আনা, কর্তার চার-আনা? মানুষ-জনকে কি পাগল করে দেবে নাকি? দাও তবে আমার সিকি ফিরিয়ে, আমি তার কাছে গিয়েই কামাব।
নাপিত। যাবে যাও না। আমি কি তোমাকে ধরে রেখেচি নাকি?
যাত্রী। (রাগতভাবে) সিকি ফিরিয়ে দাও বলচি।
নাপিত। কিসের সিকি শুনি? এতক্ষণ দর-দস্তুর করলি মাগ্না নাকি?
যাত্রী। আবার তুই- তোকারি?
নাপিত। ওঃ—গুরুঠাকুর এসেচেন! এ তারকেশ্বর থান, মনে রাখিস! চোখ রাঙাবি ত গলাধাক্কা খাবি। কোন্ বাবা তোকে কামিয়ে দেয় যা না।
[ছেলের হাত ধরিয়া একটি প্রৌঢ়াগোছের স্ত্রীলোক ও তাহার
আঁচল ধরিয়া মন্দিরের দুইজন কর্মচারীর দ্রুতপদে প্রবেশ]
১ম কর্মচারী। অ্যাঁ! বাবাকে ঠকানো! ঠকানোর আর জায়গা পাসনি মাগী? মোটে পাঁচসিকে মানোত?
প্রৌঢ়া। (কাতর-কণ্ঠে) না বাবা ঠকাই নি। যা মানোত করেছিলুম তাই জমা দিয়েচি।
১ম কর্মচারী। কবে মানোত করেছিলি, বল, বল, শুনি?
প্রৌঢ়া। বছর-তিনেক আগে, সেই বানের সময়। সত্যি বলচি বাবা—
২য় কর্মচারী। সত্যি বলচ? মিথ্যেবাদী কোথাকার। বছর-তিনের মধ্যে ঘরে আর ব্যারাম-স্যারাম হয়নি? আর মানত করবার দরকার হয়নি? কখখনো না। দে মাগী বুকে হাত দে। মনে করে দ্যাখ। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করিস—এ যে-সে দেবতা নয়, স্বয়ং তারকনাথ।
প্রৌঢ়া। (অত্যন্ত ভয় পাইয়া) শাপ-মন্যি দিও না বাবা, এই আর একটি টাকা নিয়ে—
১ম কর্মচারী। (হাত পাতিয়া গ্রহণ করিয়া) একটি টাকা? অন্ততঃ আরো পাঁচটি টাকা মানোত করেছিলি। দ্যাখ ভেবে। বাবার কৃপায় আমরা সব জানতে পারি, আমাদের ঠকান যায় না।
২য় কর্মচারী। দে না মা টাকা ক’টা ফেলে! ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করিস, কেন আর বাবার কোপে পড়বি? তোর ব্যাটার কল্যাণে দে, দিয়ে দে ফেলে।
প্রৌঢ়া। (কাঁদ-কাঁদ হইয়া) টাকা যে আর নেই বাবা। কোথায় পাব টাক।
১ম কর্মচারী। কেন ঐ ত তোর গলায় সোনার কবচ রয়েচে। ওটা পোদ্দারের দোকানে রেখে কি আর পাঁচটা টাকা পাবিনে? সঙ্গে না হয় লোক দিচ্ছি, দোকান দেখিয়ে দেবে, তার পরে একদিন ফিরে এসে খালাস করে নিয়ে যাবি।
[একজন স্ত্রীলোককে ঘিরিয়া পাঁচ-সাত জন ভিখারিণীর প্রবেশ]
১ম ভিখারিণী। দে মা তোর ব্যাটা-বেটীর কল্যাণে—
২য় ভিখারিণী। দে মা একটি পয়সা তোর মেয়ে-জামাইয়ের কল্যাণে—
৩য় ভিখারিণী। দে মা তোর বাপ-মায়ের—
৪র্থ ভিখারিণী। দে মা তোর স্বামী-পুত্তুরের—
[সকলে মহা ঠেলাঠেলি টানাটানি করিতে লাগিল]
চুলওয়ালা যাত্রী। চাইনে দাড়ি-চুল দিতে। চাইনে মানত শোধ করতে।
মানতওয়ালা প্রৌঢ়া। এ যে আমার ইষ্টি-কবচ বাবা! বাঁধা দেব কি করে?
ভিখারীতাড়িত স্ত্রীলোক। ওগো কি সর্বনাশ! কে আমার আঁচল কেটে নিলে?
ভিখারীর দল। তোর স্বামী-পুত্তুরের কল্যাণে দে একটা পয়সা। দে একটা আধলা—
১ম কর্মচারী। ব্যাটা-বেটী নিয়ে ঘর করিস বাছা! বাবার থান!
নাপিত। কামাবে যে গো?
যাত্রী। কামাবো? রইল তারকনাথ মাথায়। চললুম ঘরে ফিরে।
[প্রস্থান
ভিখারীতাড়িত স্ত্রীলোক। ঘরে ফিরব কি করে গো! কে আঁচল কেটে নিলে।
ভিখারীর দল। দে মা একটা পয়সা। দে মা একটা আধলা।
[বলিতে বলিতে ঠেলিয়া লইয়া গেল]
মানতওয়ালা প্রৌঢ়া। দোহাই বাবা তারকনাথ, আমার ইষ্টি-কবচটি আর নিয়ো না।
[ছেলের হাত ধরিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান]
১ম কর্মচারী। এক টাকার বেশী হোল না আদায়।
২য় কর্মচারী। নেই মাগীর আর কিছু।
[প্রস্থান
নাপিত। যাক চার গণ্ডা পয়সাই কোন্ মাথা খুঁড়লে মেলে?
[প্রস্থান
রমা – ২.২
দ্বিতীয় দৃশ্য
[তারকেশ্বরের বাসাবাটী। সামান্য রকমের একটা বিছানা পাতা, তাহাতে বসিয়া রমেশ। রমা ব্যস্ত হইয়া প্রবেশ করিল]
রমা। বেশ আপনি! রান্নাঘরে যেই গেছি আর একটু তরকারি আনতে, অমনি উঠে হাত-মুখ ধুয়ে
দিব্যি ভালমানুষটির মত বিছানায় এসে বসেচেন! কেন উঠলেন বলুন ত?
রমেশ। ভয়ে।
রমা। ভয়ে! কার ভয়ে! আমার?
[এই বলিয়া সে অদূরে উপবেশন করিল]
রমেশ। সে ভয় ছিলই, তা ছাড়া আর একটা আছে। আজ জ্বরের গত ঠেকচে।
রমা। জ্বরের মত ঠেকচে? এ কথা আগে বললেন না কেন? স্নান করে ভাত খেতে বসলেনই বা কোন্ বুদ্ধিতে?
রমেশ। খুব সহজ বুদ্ধিতে। যে আয়োজন, এবং যে যত্ন করে খেতে দিলে তাকে না বলে ফেরাবোই বা কোন্ সুবিবেচনায়? ভাবলাম, হোক গে জ্বর,—ওষুধ খেলেই সারবে। কিন্তু এ অন্ন না খেয়ে যদি ফাঁকে পড়ি, এ ফাঁক এ জীবনে আর ভরবে না।
রমা। যান এই বিদেশে সত্যিই যদি জ্বর হয়ে পড়ে, বলুন ত সে কত বড় অন্যায়?
রমেশ। অন্যায় ত আছেই। কিন্তু যে-রানীকে এতটুকু দেখে গেছি, তার স্বহস্তের রান্না ত্যাগ করাটাই কি কম অন্যায় হতো?
রমা। তবু ঐ কথা! এ বিদেশে ত কোন আয়োজনই করতে পারিনি।
রমেশ। আয়োজনের কথা কে ভাবচে? ভাবচি শুধু যত্নের কথাটুকু। এ আমি কোথায় পেতাম?
রমা। (সলজ্জে) কেন, আপনাকে যত্ন করবার লোকের কি অভাব আছে নাকি?
রমেশ। কোথায় পাব বল ত? ছেলেবেলায় মা মারা গেলেন, তার পরে জ্যাঠাইমার হাত থেকে গিয়ে পড়লাম বহু দূরে মামার বাড়িতে। মামীমা বেঁচে নেই, সমস্ত বাড়িটাই যেন হোটেল। সেখান থেকে পড়তে গেলাম এলাহাবাদে—সেও হোটেল। তার পরে গেলাম ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে। সেখানে বহুকাল কাটল, কিন্তু ছেলেবেলার সেই হোটেলবাসের দুঃখ আর ঘুচল না। খেতে হয় খাও,—বাধা দেবারও শত্রু নেই, এগিয়ে দেবারও মিত্র নেই।