বিশ্বেশ্বরী। (হাসিয়া) ওরা অমন বলে। তাই দে না বাপু সারিয়ে। তোর দাদামশায়ের ত ঢের টাকা পেয়েচিস।
রমেশ। (রাগিয়া উঠিয়া) কিন্তু কেন দেবো? আমার ভারী দুঃখ হচ্চে যে, না বুঝে অনেকগুলো টাকা এদের ইস্কুলের জন্যে খরচ করে ফেলেচি। এ-গাঁয়ের কারও জন্যে কিছু করতে নেই। এরা এত নীচ যে এদের দান করলে এরা বোকা মনে করে। ভাল করলে গরজ ঠাওরায়। এদের ক্ষমা করাও অপরাধ। ভাবে, ভয়ে ছেড়ে দিলে।
[শুনিয়া বিশ্বেশ্বরী হাসিতে লাগিলেন]
রমেশ। হাসচ যে জ্যাঠাইমা?
বিশ্বেশ্বরী। না হেসে কি করি বল ত বাছা ? হাঁ রে, রাগ করে তুই এই লোকগুলোকেই ছেড়ে যেতে চাস? আহা, এরা যে কত দুঃখী, কত দুর্বল, কত অবোধ তা যদি জানতিস রমেশ, এদের ওপর অভিমান করতে তোর আপনিই লজ্জা হোতো। (রমার প্রতি) তুমি যে সেই থেকে ঘাড় হেঁট করে বসে আছ মা,—হাঁ রমেশ, তোরা দুই ভাই-বোনে কি কথা-কোসনে?
রমা। (তেমনি অধোমুখে) আমি ত বিরোধ রাখতে চাইনি জ্যাঠাইমা। রমেশদা—
রমেশ ৷ (চমকিয়া) এ কে, রমা নাকি। একলা এসেচেন না সঙ্গে মাসিটিকেও এনেচেন?
বিশ্বেশ্বরী। এ তোর কি কথা রমেশ? তোদের ভাল করে চেনাশুনা নেই বলেই—
রমেশ। রক্ষে কর জ্যাঠাইমা, এর বেশী চেনাশোনার আশীর্বাদ আর কোরো না। বাড়ি গিয়ে মাসীটিকে যদি পাঠিয়ে দেন ত তোমাকে আমাকে দু’জনকেই চিবিয়ে খেয়ে তিনি ঘরে ফিরবেন! বাপরে, পালাই—
বিশ্বেশ্বরী। যাসনে রমেশ, শুনে যা!
রমেশ। (থমকিয়া দাঁড়াইয়া) না জ্যাঠাইমা, আমি সমস্ত শুনেচি। যারা অহঙ্কারের স্পর্ধায় তোমাকে পর্যন্ত মাড়িয়ে চলতে চায় তাদের হয়ে তুমি একটা কথাও বোলো না। তোমাকে অপমান করা আমার সইবে না।
[দ্রুতপদে প্রস্থান]
রমা। (বিশ্বেশ্বরীর মুখের প্রতি চাহিয়া সহসা কাঁদিয়া ফেলিল) তোমাকে অপমান করতে আমি মাসীকে পাঠিয়ে দি, এ কলঙ্ক আমার কেন জ্যাঠাইমা?
বিশ্বেশ্বরী। (রমাকে কাছে টানিয়া লইয়া) তোমাকে ও ভুল বুঝেচে মা, যা সত্যি সে ও একদিন জানবেই জানবে।
রমা – ২.১
দ্বিতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
[তারকেশ্বরের গ্রাম্য পথ। প্রভাতবেলায় এই মাত্র সূর্যোদয় হইয়াছে। রমা নিকটস্থ কোন একটা পুষ্করিণী হইতে স্নান সারিয়া আর্দ্র-বস্ত্রে গৃহে ফিরিতেছিল, রমেশের সহিত তাহার একেবারে মুখোমুখি দেখা হইয়া গেল। একবার সে মাথায় আঁচল টানিয়া দিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু ভিজা কাপড় টানা গেল না। তখন তাড়াতাড়ি হাতের জলপূর্ণ ঘটিটি নামাইয়া রাখিয়া সিক্ত বসনতলে দুই বাহু বুকের উপর জড় করিয়া হেঁট হইয়া দাঁড়াইল]
রমা। আপনি এখানে যে?
রমেশ। (একপাশে সরিয়া দাঁড়াইয়া) আপনি কি আমাকে চেনেন?
রমা। চিনি। আপনি কখন তারকেশ্বরে এলেন?
রমেশ। এইমাত্র গাড়ি থেকে নেমেচি। আমার মামার বাড়ির মেয়েদের আসবার কথা ছিল, কিন্তু তারা কেউ আসেন নি।
রমা। এখানে কোথায় আছেন?
রমেশ। কোথাও না। পূর্বে কখনো আসিনি, আজকের দিনটা কোনমতে কোথাও কাটাতে হবে। যা হোক একটা আশ্রয় খুঁজে নেবো।
রমা। সঙ্গে ভজুয়া আছে ত?
রমেশ। না, একাই এসেচি।
রমা। বেশ যা হোক! (এই বলিয়া রমা হাসিয়া হঠাৎ মুখ তুলিতেই আবার দু’জনের চোখাচোখি হইল। সে মুখ নীচু করিয়া মনে মনে একটু দ্বিধা করিয়া শেষে বলিল) তবে আমার সঙ্গেই আসুন। (এই বলিয়া সে ঘটিটা তুলিয়া লইয়া অগ্রসর হইতে উদ্যত হইল)
রমেশ ৷ আমি যেতে পারি, কারণ, এতে দোষ থাকলে আপনি কখনই ডাকতেন না। আপনাকে যে আমি চিনি না তাও নয়। কিন্তু কিছুতেই স্মরণ করতে পারচি নে। মনে হচ্ছে কখনো স্বপ্নে দেখে থাকব। আপনার পরিচয় দিন।
রমা। আসুন। পথে যেতে যেতে আমার পরিচয় দেব। স্বপ্ন কবেকার দেখা মনে পড়ে?
রমেশ। না। সঙ্গে আপনার আত্মীয় কেউ নেই?
রমা। না, দাসী আছে, সে বাসায় কাজ করচে, চাকরটা গেছে বাজারে। তা ছাড়া আমি ত প্রায়ই এখানে আসি,—সমস্তই চিনি।
রমেশ। কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্চেন কেন?
রমা। নইলে আপনার খাওয়া-দাওয়ার ভারী কষ্ট হবে।
রমেশ। হলই বা। তাতে আপনার কি?
রমা। পুরুষমানুষকে সব বুঝোন যায়, যায় না শুধু এই কথাটি। আমি রমা!
রমেশ। রমা?
রমা। হাঁ, যার সঙ্গে পরিচয় থাকাও আপনার ঘৃণার বস্তু—সেই।
রমেশ। কিন্তু আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
রমা। আমার বাসায়। সেখানে মাসী নেই, ভয় নেই, আসুন।
[উভয়ের প্রস্থান]
[পরক্ষণে নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণের প্রবেশ। নাপিত ও তাহাকে দ্রুতপদে অনুসরণ করিয়া
অপর এক ব্যক্তি। মুখে প্রচুর দাড়ি-গোঁফ ও মাথায় সুদীর্ঘ কেশ, খানিকটা ক্ষুর দিয়া কামানো। এই লোকটি মানত করিয়া ঠাকুরের কাছে চুল-দাড়ি দিতে আসিয়াছিল]
যাত্রী। (ব্যস্তভাবে) নাপিত, নাপিত, তুমি নাপিত নাকি হে? দাও ত দাদা এইটুকু কামিয়ে। খপ্ কোরে একটা ডুব দিয়ে বাবার পূজোটুকু সেরে দিয়ে আসি। বাবার থান, নইলে দুটো পয়সার মজুরি নয়,—এই সিকিটি নিয়ে দাও দাদা খপ্ করে। সাড়ে বারোটার গাড়ি ধরতে হবে,—ঘরে ছেলেটার আবার দু’দিন জ্বর। দাও দাও, এখানেই বসে যাবো নাকি?
নাপিত। (সিকিটি হাতে লইয়া বেশ করিয়া পরীক্ষা করিয়া পরে ট্যাঁকে গুঁজিয়া বারদুই তাহার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করিয়া) এই যে! দাড়ি-চুল কে এঁটো করে দিয়েচে দেখচি?
যাত্রী। এঁটো? এঁটো কি রকম? দেখচো বাবার দাড়ি-চুল, এ কি আমার? এঁটো কি রকম?
নাপিত। (হাত দিয়া দেখাইয়া) এই ত খাবলে দুই-ই এঁটো করে দিয়েচে।