যতীন। যাঃ—
রমা। যা কি রে? বেণীবাবুকে যেমন বড়দা বলে ডাকিস, এঁকে তেমনি ছোড়দা বলে ডাকতে পারিস নে?
যতীন। আমার দাদা হন তিনি? সত্যি বলচ দিদি?
রমা। সত্যি বলচি রে, তোর ছোড়দা হন তিনি।
যতীন। এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন দিদি?
রমা। এতদিন লেখাপড়া শিখতে বিদেশে ছিলেন। তুই বড় হলে তোকেও এমনি কোরে বিদেশে গিয়ে থাকতে হবে যতীন, আমাকে ছেড়ে পারবি ত থাকতে?
যতীন। (বার দুই-তিন অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িল) ছোড়দার সমস্ত পড়া শেষ হয়ে গেছে দিদি?
রমা। হাঁ ভাই, তাঁর সব পড়া সাঙ্গ হয়ে গেছে।
যতীন। কি করে তুমি জানলে?
রমা। (ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া) নিজের পড়া শেষ না হলে কি কেউ পরের ছেলের জন্যে এত দিতে পারে? এটুকু বুঝি তুই বুঝতে পারিস নে?
যতীন। (মাথা নাড়িয়া জানাইল সে পারে) আচ্ছা, ছোড়দা কেন আমাদের বাড়ি আসেন না দিদি, বড়দা ত রোজ রোজ যান?
রমা। তুই তাঁকে ডেকে আনতে পারিস নে?
যতীন। এখুনি যাব দিদি?
রমা। (ভয়-ব্যাকুল দুই হাতে তাহাকে বুকে জড়াইয়া) ওরে, কি পাগলা ছেলে রে তুই! খবরদার যতীন, কখখনো এমন কাজ করিস নে ভাই, কখখনো করিস নে।
যতীন। তোমার চোখে জল এলো কেন দিদি? তুমি বারণ করলে ত আমি কখখনো কিছু করিনে।
রমা। (চোখ মুছিয়া ফেলিয়া) তা ত কর না জানি। তুমি আমার লক্ষ্মী মানিক ছোট্ট ভাই কিনা,—তাই।
যতীন। বাড়ি চল না দিদি!
রমা। তুই এখন যা, আমি একটুখানি পরে যাবো ভাই।
[যতীন প্রস্থান করিল
[বিশ্বেশ্বরী প্রবেশ করিলেন]
রমা। আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলে জ্যাঠাইমা?
বিশ্বেশ্বরী। এ-সব তোরা কি করেছিস মা? বেণীর চুরি-করার কাজে তুই কি করে সাহায্য করলি রমা?
রমা। আমি ত এ কাজ করতে তাঁকে বলিনি জ্যাঠাইমা!
বিশ্বেশ্বরী। স্পষ্ট বলনি বটে, তবুও অপরাধ তোমার কম হয়নি রমা।
রমা। কিন্তু তখন যে আর উপায় ছিল না জ্যাঠাইমা। ভজুয়া লাঠি-হাতে বাড়ির মধ্যে গিয়ে যখন দাঁড়ালো তখন মাছ ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বড়দা তাঁর ভাগ নিয়ে চলে আসছিলেন, পাড়ার পাঁচজনেও দুটো-একটা নিয়ে ঘরে ফিরছিলেন।
বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু আসলে মাছ আদায় করতে ভজুয়া যায়নি রমা। রমেশ নিজে মাছ-মাংস ছোঁয় না, এতে তার প্রয়োজন নেই। সে শুধু তোমারই কাছে জানতে পাঠিয়েছিল কাপাসডাঙার গড়পুকুরে তার অংশ আছে কিনা। নেই, এ কথা তুই বললি কি কোরে মা? (রমা অধোমুখে নিরুত্তর)
বিশ্বেশ্বরী। তোমার পরে যে তার কত শ্রদ্ধা, কত বিশ্বাস, সে তুমি জান না বটে, কিন্তু আমি জানি। সেদিন তেঁতুলগাছটা কাটিয়ে তোমরা দু’ঘরে ভাগ কোরে নিলে; গোপাল সরকারের কথাতেও রমেশ কান দিলে না, বললে, আমার ভাগ থাকলে আমি পাবই। রমা কখনো আমাকে ঠকিয়ে নেবে না, কিন্তু কাল যা করেচ মা, তাতে—একটা কথা তোমাকে আজ বলে রাখি মা। বিষয়-সম্পত্তির দাম যত বেশীই হোক, এই মানুষটির প্রাণের দাম তার অনেক বেশী। কারও কথায়, কোন বস্তুর লোভেই, রমা, চারিদিকের আঘাত দিয়ে এ-জিনিসটি তোমরা নষ্ট কোর না। যা হারাবে তা আর কোনদিন পূর্ণ হবে না।
রমেশ।(নেপথ্যে) জ্যাঠাইমা!
বিশ্বেশ্বরী। কে, রমেশ? আয় বাবা এই ঘরে আয়।
[রমেশ প্রবেশ করিতেই রমা আনতমুখে ঈষৎ আড় হইয়া বসিল]
বিশ্বেশ্বরী। হঠাৎ এমন দুপুরবেলা যে রে?
রমেশ। দুপুরবেলা না এলে যে তোমার কাছে একটু বসতে পাইনে জ্যাঠাইমা। তোমার কত কাজ। হাসলে যে? আচ্ছা, তোমার মনে পড়ে, ঠিক এমনি দুপুরবেলায় ছেলেবেলায় একদিন চোখের জলে তোমার কাছে বিদায় নিয়েছিলাম। আজও তেমনি নিতে এলাম। কিন্তু এই বোধ হয় শেষ নেওয়া জ্যাঠাইমা!
জ্যাঠাইমা। বালাই, ষাট! ও কি কথা বাবা? আয় আমার কাছে এসে বোস।
[রমেশ তাঁহার কাছে গিয়া বসিয়া একটুখানি হাসিল, কিন্তু জবাব দিল না।
বিশ্বেশ্বরী পরমস্নেহে তাহার মাথায় গায়ে হাত বুলাইয়া দিয়া কহিলেন—]
বিশ্বেশ্বরী। শরীরটা কি এখানে ভাল থাকচে না বাবা?
রমেশ। এ যে খোট্টার দেশের ডাল-রুটির শরীর জ্যাঠাইমা, এ কি এত শীঘ্র খারাপ হয়? তা নয়। তবে, এখানে আমি আর একদিনও টিকতে পারচি নে। আমার সমস্ত প্রাণ যেন কেবলই খাবি খেয়ে উঠচে।
বিশ্বেশ্বরী। শুনে বাঁচলাম বাবা, তোর শরীর খারাপ হয়নি। কিন্তু এই যে তোর জন্মস্থান, এখানে টিকতে পারচিস না কেন বল দেখি?
রমেশ। সে আমি বলবো না। আমি নিশ্চয় জানি, তুমি সমস্তই জান।
বিশ্বেশ্বরী। সব না জানলেও কতক জানি বটে, কিন্তু ঠিক সেই জন্যেই তোকে আমি কোথাও যেতে দেব না রমেশ।
রমেশ। কিন্তু এখানে কেউ আমাকে চায় না জ্যাঠাইমা।
বিশ্বেশ্বরী। চায় না বলেই তোর পালান চলবে না রমেশ। এই যে ডাল-রুটি-খাওয়া দেহের বড়াই করছিলি সে কি শুধু পালানোর জন্যে ! হাঁ রে, গোপাল সরকার বলছিল কি একটা রাস্তা মেরামতের জন্যে তুই চাঁদা তুলছিলি। তার কি হলো?
রমেশ। আচ্ছা, এই একটা কথাই তোমাকে বলি। কোন্ পথটা জান? যেটা পোস্টাফিসের সুমুখ দিয়ে বরাবর স্টেশনে গেছে। বছর-পাঁচেক পূর্বে বৃষ্টিতে ভেঙ্গে এখন একটা প্রকাণ্ড গর্ত হয়ে আছে। লোক পা পিছলে হাত-পা ভেঙ্গে পার হয়, কিন্তু মেরামত করে না। গোটা-কুড়ি টাকা মাত্র খরচ, কিন্তু এর জন্যে আজ আট-দশ দিন ঘুরে ঘুরেও আট-দশটা পয়সা পাইনি। কাল মধুর দোকানের সামনে দিয়ে রাত্রে আসচি, কানে গেল কে একজন আর সকলকে বারণ করে দিয়ে বলচে, তোরা কেউ একটা পয়সাও দিসনে। জুতো পায়ে মসমসিয়ে হাঁটা, দু′ চাকার গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো,—ওরই ত গরজ। কেউ কিছু না দিলে ও আপনিই সারাবে। না করে, ‘বাবু-বাবু’ বলে একটুখানি পিঠে হাত বোলানো। বাস্।