রমেশ। এতে ছেলেদের কাছে আপনার সম্মানহানি হয় না?
বনমালী। না, এই দেশাচার। তা ছাড়া ছেলেরা আমাকে বাঘের মত ভয় করে। বিতিয়ে পিঠ লাল করে দিই।
রমেশ। দেবার কথাই। আর সব মাস্টারের মাইনে কত?
বনমালী। তেইশ টাকা।
রমেশ। তেইশ! একজনের না তিনজনের?
বনমালী। তিনজনের। ন’টাকা, আট টাকা আর ছ’টাকা। এও বেণীবাবু দিতে নারাজ। তিনি বলেন, আট টাকাটা সাত টাকা হলেই হয় ভাল।
রমেশ। সে ঠিক। কর্তা বুঝি তিনিই?
বনমালী। হাঁ, তিনিই সেক্রেটারি। কিন্তু কখনো একটি পয়সাও দেন না। যদু মুখুয্যেমশায়ের কন্যা রমা,―সতীলক্ষ্মী তিনি―তাঁর দয়া না থাকলে ইস্কুল অনেক দিন পূর্বেই বন্ধ হয়ে যেত।
রমেশ। বলেন কি? এ ত শুনিনি।
বনমালী। হাঁ, শুধু তাঁর দয়াতেই ইস্কুল চলে ছোটবাবু, আর কারো নয়। একটি ভাইও তাঁর এই ইস্কুলে পড়ে। এ-বছর তিনিই চাল ছাইয়ে দেবেন বলেছিলেন, কিন্তু কেন যে দিলেন না বলতে পারিনে। হয়ত কেউ ভাঙ্চি দিয়েছে।
রমেশ। তাও হয় নাকি? আচ্ছা, আজ আপনি যান, আপনার বেলা হয়ে যাছে, কাল আপনাদের ইস্কুল আমি দেখতে যাব।
বনমালী। যে আজ্ঞে। আপনার দয়া হলে আর আমাদের ভাবনা কি?
[এই বলিয়া সে আর একবার হেঁট হইয়া প্রণাম করিয়া প্রস্থান করিল,
এবং অন্য পথ দিয়া গোপাল সরকার ও ভজুয়া দ্রুতপদে প্রবেশ করিল]
রমেশ। হঠাৎ আপনি এমন ব্যস্ত হয়ে যে সরকারমশাই?
গোপাল। বেণীবাবু ত অত্যন্ত অত্যাচার শুরু করে দিলেন। প্রত্যহ এ ত সহা যায় না ছোটবাবু।
রমেশ। ব্যাপার কি?
গোপাল। কাপাসডাঙার বাইশ-বিঘের বন্দটা এখনো ভাগ হয়নি, মুখুয্যেদের সঙ্গে যৌথ আছে। এক অংশ তাঁদের, এক অংশ বেণীবাবুর, আর এক অংশ আমাদের। সেদিন পাড়ের অতবড় তেঁতুলগাছটা কাটিয়ে তাঁরা দু’ অংশে ভাগ কোরে নিলেন, আমাদের একটা টুকরো পর্যন্ত দিলেন না। আপনাকে জানালাম, আপনি বললেন তুচ্ছ একটু কাঠের জন্যে ত আর ঝগড়া করা যায় না!
রমেশ। বাস্তবিক, এত সামান্য জিনিসের জন্যে কি বড়দার সঙ্গে ঝগড়া করা যায় সরকারমশাই?
গোপাল। সেই জোরে আজ বেণীবাবু জোর করে গড়পুকুরের মাছ ধরে নিয়ে গেছেন। বোধ করি মুখুয্যেবাড়িতে এতক্ষণ তার অংশ ভাগ হচ্চে।
রমেশ। কিন্তু ঠিক জানেন এতে আমাদের অংশ আছে?
গোপাল। তবে কি মিছেই এ কাজে মাথার চুল পাকালাম ছোটবাবু?
রমেশ। কিন্তু সবাই যে বলে রমা বড় ধর্মনিষ্ঠ মেয়ে! তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করে পাঠালেন না কেন?
গোপাল। শুনলাম তিনি নাকি হেসে বলেচেন, ছোটবাবুকে বোলো বিষয় তাঁর হাতে দিয়ে একটা মাস-হারা নিয়ে যেখানকার মানুষ সেখানে চলে যেতে। জমিদারি রক্ষে করা ভীতু লোকের কাজ নয়।
রমেশ। তবে বুঝি চুরি করাটাই সে মস্ত সাহসের কাজ বলে ঠাউরেচে? ভজুয়া সঙ্গে তোর লাঠি আছে?
ভজুয়া। (লাঠি আস্ফালন করিয়া) হুজুর।
রমেশ। সমস্ত মাছ গিয়ে কেড়ে নিয়ে আয়। একা পারবি ত?
ভজুয়া। (মাথা নত করিয়া) সির্ফ হুকুমকা নোকর হুজুর!
[এই বলিয়া প্রস্থানোদ্যত হইল]
গোপাল। (অকস্মাৎ অত্যন্ত ভয় পাইয়া) এ যে সত্যি সত্যিই ফৌজদারি বেধে যাবে ছোটবাবু।
রমেশ। উপায় কি?
গোপাল। হঠাৎ একটা কাজ করে ফেলা কি ভাল হবে ছোটবাবু?
রমেশ। তবে কি আপনি করতে বলেন?
গোপাল। আমি বলি,—আমি বলি,—থানায় একটা ডাইরি কোরে,—না হয়, ভাল কোরে একবার জিজ্ঞেসা কোরে—
রমেশ। তবে সেই ভাল সরকারমশাই। আমার মত ভীতু লোকের এর বেশী কিছু করা উচিতও নয়। ও-বাড়ির মাইজীকে চিনিস ত ভজুয়া? চিনিস! বেশ, তাঁকে গিয়ে জিজ্ঞেসা করে আয় গড়পুকুরের মাছে আমার অংশ আছে কিনা। যদি বলেন—আছে, নিয়ে আসিস। যদি বলেন—নেই, শুধু চলে আসবি। আমার নিশ্চয় বিশ্বাস, সরকারমশাই, সামান্য দুটো মাছের জন্যে রমা মিছে কথা বলবে না।
[ভজুয়ার দ্রুতপদে প্রস্থান]
পঞ্চম দৃশ্য
[বেণী ঘোষালের বাটীর অন্তঃপুরে বিশ্বেশ্বরীর গৃহ।
রমা প্রবেশ করিয়া সম্মুখের দাসীকে দেখিতে পাইল]
রমা। জ্যাঠাইমা কোথায় নন্দর মা?
দাসী। পূজোর ঘর থেকে এখনো বার হয়নি। ডেকে দেব দিদি?
রমা। তাঁর পূজোর ব্যাঘাত করে? না না, আমি বসচি। তিনি বেরুলে তাঁকে খবর দিয়ো যে আমি এসেচি।
দাসী। আচ্ছা দিদি।
[দাসী প্রস্থান করিল, এবং পরক্ষণে অতি
সন্তর্পণে পা টিপিয়া যতীন প্রবেশ করিল]
যতীন। দিদি!
রমা। (চমকিয়া মুখ ফিরাইয়া) অ্যাঁ, তুই কোথা থেকে রে?
যতীন। তোমার পেছনে পেছনে এসেচি, তুমি দেখতে পাওনি!
[এই বলিয়া সে রমাকে জড়াইয়া ধরিল]
রমা। কি দুষ্টু ছেলে রে তুই! বেলা হল ইস্কুলে যাবিনে?
যতীন। আমাদের যে আজ ছুটি দিদি।
রমা। ছুটি কিসের রে? আজ ত সবে বুধবার।
যতীন। হলই বা বুধবার! বুধ, বেস্পতি, শুক্কুর, শনি, রবি—এক্কেবারে পাঁচ দিন ছুটি।
রমা। কেন রে যতীন?
যতীন। আমাদের ইস্কুলের চাল ছাওয়া হচ্ছে যে। তার পর চুনকাম হবে, কত বই আসবে,—চার-পাঁচটা চেয়ার-টেবিল এসেচে,—একটা আলমারি, একটা বড় ঘড়ি এসেচে, একদিন তুমি গিয়ে দেখে এসো না দিদি।
রমা। বলিস কিরে?
যতীন। সত্যি দিদি। রমেশবাবু এসেচেন না!—তিনি সব করে দিচ্ছেন। আরও কত কি তিনি করে দেবেন বলেছেন। রোজ দু’ঘণ্টা করে এসে আমাদের পড়িয়ে যান।
রমা। হাঁ রে যতীন। তোকে তিনি চিনতে পারেন?
যতীন। হাঁ—
রমা। কি বলে তাঁকে তুই ডাকিস?
যতীন। ডাকি? আমরা ছোটবাবু বলি।
রমা। (ভাইটিকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া) ছোটবাবু কি রে, তিনি যে তোর দাদা হন।