বাঁড়ুয্যে। কাল রাত্তিরে এলাম। তামাক খা’দিকি মধু।
[এই বলিয়া গাড়ু রাখিয়া হাতের কুচো চিংড়ি মেলিয়া ধরিলেন]
বাঁড়ুয্যে। সৈরুবী জেলেনীর আক্কেল দেখলি মধু, খপ করে হাতটা আমার ধরে ফেললে হে! কালে কালে কি হল বল দিকি রে, এই কি এক পয়সার চিংড়ি? বামুনকে ঠকিয়ে ক’ কাল খাবি মাগী, উচ্ছন্ন যেতে হবে না?
মধু। হাত ধরে ফেললে আপনার?
বাঁড়ুয্যে। আড়াইটি পয়সা শুধু বাকি, তাই বলে খামকা বাজারসুদ্ধ লোকের সামনে হাত ধরবে আমার! কে না দেখলে বল! মাঠ থেকে বসে এসে গাড়ুটি মেজে, নদীতে হাত-পা ধুয়ে মনে করলাম বাজারটা একবার ঘুরে যাই। মাগী এক চুবড়ি মাছ নিয়ে বসে—স্বচ্ছন্দে বললে কিনা কিচ্ছু নেই ঠাকুর, যা ছিল সব উঠে গেছে। আরে, আমার চোখে ধুলো দিতে পারিস? ডালাটা ফস কোরে তুলে ফেলতেই দেখি না,—অমনি খপ কোরে হাতটা চেপে ধরে ফেললে! তোর সাবেক আড়াইটা আর আজকের একটা—এই সাড়ে-তিনটে পয়সা নিয়ে আমি গাঁ ছেড়ে পালাব? কি বলিস মধু?
মধু। তাও কি হয়!
বাঁড়ুয্যে। তবে তাই বল্ না। গাঁয়ে কি শাসন আছে? নইলে ষষ্ঠে-জেলের ধোপা-নাপতে বন্ধ কোরে চাল কেটে তুলে দেওয়া যায় না? (হঠাৎ রমেশের প্রতি চাহিয়া) বাবুটি কে মধু?.
মধু। আমাদের ছোটবাবু যে! শ্রাদ্ধের দরুন দশটি টাকা বাকি ছিল বলে বাড়ি বয়ে দিতে এসেচেন।
বাঁড়ুয্যে। অ্যাঁ, রমেশ বাবাজী? বেঁচে থাকো বাবা, হাঁ, এসে শুনলাম একটা কাজের মত কাজ করেচ বটে। এমন খাওয়া-দাওয়া এ-অঞ্চলে কখনো হয়নি। কিন্তু বড় দুঃখ রইলো চোখে দেখতে পেলাম না। পাঁচ শালার ধাপ্পায় পড়ে কলকাতায় চাকরি করতে গিয়ে হাড়ীর হাল। আরে ছি, সেখানে মানুষ থাকতে পারে!
মধু। (তামাক সাজিয়া হুঁকা তাঁহার হাতে দিল) তার পরে? একটা চাকরি-বাকরি হয়েছিল ত?
বাঁড়ুয্যে। হবে না? এ কি ধান দিয়ে লেখাপড়া শেখা আমার? কিন্তু হলে কি হবে। যেমন ধোঁয়া, তেমনি কাদা। বাইরে বেরিয়ে গাড়িচাপা না পড়ে যদি ঘরে ফিরতে পারিস ত জানবি তোর বাপের পুণ্যি। কখনো গিয়েছিলি সেখানে?
মধু। আজ্ঞে না। মেদিনীপুর শহরটা একবার দেখেছি—।
বাঁড়ুয্যে। আরে দূর ব্যাটা পাড়াগেঁয়ে ভুত। কিসে আর কিসে! তোর রমেশবাবুকে জিজ্ঞেস কর্ না সত্যি না মিছে।—না মধু, খেতে না পাই ছেলেপুলের হাত ধরে ভিক্ষে করব,—বামুনের ছেলের তাতে কিছু আর লজ্জা নেই,—কিন্তু বিদেশ যাবার নামটি যেন না কেউ আমার কাছে করে। বললে বিশ্বেস করবি নে,সেখানে শুষনি কলমি চালতা আমড়া থোড় মোচা পর্যন্ত কিনে খেতে হয়। পারবি খেতে?—এই একটি মাস না খেয়ে খেয়ে যেন রোগা ইঁদুরটি হয়ে গেছি।
[এই বলিয়া তিনি হুঁকাটা মধুর হাতে দিয়া উঠিয়া গিয়া মধুর তেলের ভাঁড় হইতে খানিকটা তেল বাঁ হাতের তেলোয় লইয়া অর্ধেকটা দুই নাক ও দুই কানের গর্তে ঢালিয়া দিয়া বাকিটা মাথায় মাখিয়া ফেলিলেন]
বাঁড়ূয্যে। বেলা হল, অমনি ডুবটা দিয়ে একেবারে ঘরে যাই। এক পয়সার নুন দে দিকি মধু, পয়সাটা বিকেলবেলা দিয়ে যাব।
মধু। আবার বিকেলবেলা!
[মধু অপ্রসন্নমুখে দোকানে উঠিয়া ঠোঙায় করিয়া নুন দিল]
বাঁড়ুয্যে। (নুন হাতে লইয়া) তোরা সব হলি কি মধু? এ যে গালে চড় মেরে পয়সা নিস দেখি। (এই বলিয়া নিজেই এক খামচা নুন ঠোঙায় দিয়া রমেশের প্রতি মৃদু হাসিয়া) ঐ ত একই পথ,- চল না বাবাজী, গল্প করতে করতে যাই।
রমেশ। আমার একটু দেরি আছে।
বাঁড়ুয্যে। তবে থাক।
[এই বলিয়া গাড়ু লইয়া গমনোদ্যত হইলেন]
মধু। বাঁড়ুয্যেমশাই, সেই ময়দার পয়সা পাঁচ আনা কি অমনি—
বাঁড়ুয্যে। হাঁ রে মধু, তোদের কি লজ্জা-শরম, চোখের চামড়া পর্যন্ত নেই? পাঁচ ব্যাটা-বেটীর মতলবে কলকাতা যাওয়া-আসা করতে পাঁচ-পাঁচটা টাকা আমার গলে গেলো, আর, এই কি তোদের তাগাদা করবার সময় হলো? কারো সর্বনাশ, আর কারো পৌষ মাস বটে! দেখলে বাবা রমেশ, এদের ব্যাভারটা একবার দেখলে?
মধু। (লজ্জিত হইয়া) অনেক দিনের—
বাঁড়ুয্যে। হলই বা অনেক দিনের। এমন কোরে সবাই মিলে পিছনে লাগলে ত আর গাঁয়ে বাস করা যায় না।
[এই বলিয়া তিনি একরকম রাগ করিয়াই নিজের জিনিসপত্র লইয়া চলিয়া গেলেন। এবং পরক্ষণে বনমালী পাড়ুই ধীরে ধীরে প্রবেশ করিয়া রমেশের পায়ের কাছে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন]
রমেশ। আপনি কে?
বনমালী। আপনাদের ভৃত্য, বনমালী পাড়ুই। গ্রামের মাইনার ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক।
রমেশ। (সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইয়া) আপনি ইস্কুলের হেডমাস্টার?
বনমালী। আপনার ভৃত্য। দু’দিন আপনাকে প্রণাম জানাতে গিয়েও দেখা হয়নি।
রমেশ। আপনার ইস্কুলের ছাত্রসংখ্যা কত?
বনমালী। বিয়াল্লিশ জন। গড়ে দু’জন পাস হয়। একবার নারাণ বাঁড়ুয্যের সেজছেলে জলপানি পেয়েছিল।
রমেশ। বটে?
বনমালী। আজ্ঞে হাঁ। কিন্তু এ-বছর চাল ছাওয়া না হলে বর্ষার জল আর বাইরে পড়বে না।
রমেশ। সমস্তই আপনাদের মাথায় পড়বে?
বনমালী। আজ্ঞে, হাঁ। কিন্তু সে এখনো দেরি আছে। কিন্তু সম্প্রতি আমরা কেউ তিন মাসের মাইনে পাইনি। মাস্টাররা বলচেন, ঘরের খেয়ে বনের মশা আর বেশীদিন তাড়ানো যাবে না।
রমেশ। আপনার মাইনে কত?
বনমালী। ছাব্বিশ। পাই তেরো টাকা পোনের আনা।
রমেশ। ছাব্বিশ টাকা মাইনে, আর পান তেরো টাকা পোনের আনা, এর মানে?
বনমালী। গভর্নমেন্টের হুকুম কিনা। তাই ছাব্বিশ টাকার রসিদ লিখে সব-ইনস্পেকটারকে দেখাতে হয়। নইলে সরকারী সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়।