Site icon BnBoi.Com

বিজয়া – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বিজয়া - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

 বিজয়া – ১.১

বিজয়া

নাট্যোল্লিখিত ব্যক্তিগণ

পুরুষ

রাসবিহারী : মৃত বনমালীর বন্ধু ও বিজয়ার অভিভাবক
বিলাসবিহারী : রাসবিহারীর পুত্র
নরেন : বনমালী ও রাসবিহারীর বন্ধু মৃত জগদীশের পুত্র
দয়াল : বিজয়ার মন্দিরের আচার্য
পূর্ণ গাঙ্গুলী : নরেনের মাতুল
কালীপদ : বিজয়ার ভৃত্য
পরেশ : ঐ বালক-ভৃত্য
কানাই সিং: ঐ দরোয়ান

গ্রামবাসিগণ, নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকগণ, কর্মচারিগণ ইত্যাদি।

স্ত্রী

বিজয়া : বনমালীর কন্যা
নলিনী : দয়ালের ভাগিনেয়ী
পরেশের মা : বিজয়ার দাসী

দয়ালের স্ত্রী, নিমন্ত্রিতা মহিলাগণ, গ্রামবাসিনীগণ ইত্যাদি।

প্রথম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

বিজয়ার বসিবার ঘর

বিজয়া। জগদীশ মুখুয্যে কি সত্যিই ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন?

বিলাস। তাতে সন্দেহ আছে নাকি? মদমত্ত অবস্থায় উড়তে গিয়েছিলেন।

বিজয়া। কি দুঃখের ব্যাপার!

বিলাস। দুঃখের কেন? অপঘাত-মৃত্যু ওর হবে না ত হবে কার? জগদীশবাবু শুধু আপনার স্বর্গীয় পিতা বনমালীবাবুরই সহপাঠী বন্ধু নয়, আমার বাবারও ছেলেবেলার বন্ধু। কিন্তু বাবা তার মুখও দেখতেন না। টাকা ধার করতে দু’বার এসেছিল—বাবা চাকর দিয়ে বার করে দিয়েছিলেন। বাবা সর্বদাই বলেন, এই-সব অসচ্চরিত্র লোকগুলোকে প্রশ্রয় দিলে মঙ্গলময় ভগবানের কাছে অপরাধ করা হয়।

বিজয়া। এ কথা সত্যি।

বিলাস। বন্ধুই হন আর যেই হন। দুর্বলতাবশতঃ কোনমতেই সমাজের চরম আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করা উচিত নয়। জগদীশের সমস্ত সম্পত্তি এখন ন্যায়তঃ আমাদের। তা ছেলে পিতৃঋণ শোধ করতে পারে, ভাল, না পারে আমাদের এই দণ্ডেই সমস্ত হাতে নেওয়া উচিত। বস্তুতঃ ছেড়ে দেবার আমাদের অধিকার নেই। কারণ, এই টাকায় আমরা অনেক সৎকার্য করতে পারি, সমাজের কোন ছেলেকে বিলেত পর্যন্ত পাঠাতে পারি—ধর্মপ্রচারে ব্যয় করতে পারি—কত কি করতে পারি—কেন তা না করব বলুন? আপনার সম্মতি পেলেই বাবা সব ঠিক করে ফেলবেন।

[বিজয়া একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিল]

বিলাস। না, না, আপনাকে ইতস্ততঃ করতে আমি কিছুতেই দেব না। দ্বিধা দুর্বলতা পাপ, শুধু পাপ কেন মহাপাপ। আমি মনে মনে সঙ্কল্প করেছি, আপনার নাম করে—যা কোথাও নেই, কোথাও হয়নি—আমি তাই করব। এই পাড়াগাঁয়ের মধ্যে ব্রহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করে, দেশের হতভাগ্য মূর্খ লোকগুলোকে ধর্মশিক্ষা দেব। আপনি একবার ভেবে দেখুন দেখি, এদের অজ্ঞতার জ্বালায় বিপন্ন হয়ে আপনার পিতৃদেব দেশ ছেড়েছিলেন কি না? তাঁর কন্যা হয়ে আপনার কি উচিত নয়, এই নোব্‌ল প্রতিশোধ নিয়ে তাদের এই চরম উপকার করা? বলুন, আপনিই এ কথার উত্তর দিন। (বিজয়া নিরুত্তর) সমস্ত দেশের মধ্যে একটা কত বড় নাম, কত বড় সাড়া পড়ে যাবে ভাবুন দেখি? সর্বসাধারণকে স্বীকার করতেই হবে—সে ভার আমার—সে আমাদের সমাজে মানুষ আছে, হৃদয় আছে, স্বার্থত্যাগ আছে। যাকে তারা নির্যাতন করে দেশছাড়া করেছিল, সেই মহাত্মার মহীয়সী কন্যা, শুধু তাদের জন্যই এই বিপুল স্বার্থত্যাগ করেছেন। সমস্ত ভারতময় কি moral effect হবে ভাবুন দেখি?

বিজয়া। তা বটে, কিন্তু মনে হয় বাবার ঠিক এই ইচ্ছা ছিল না। জগদীশবাবুকে তিনি চিরদিন মনে মনে ভালবাসতেন।

বিলাস। এমন হতেই পারে না। সেই দুষ্ক্রিয়াসক্ত মাতালটাকে তিনি ভালবাসতেন এ বিশ্বাস আমি করতে পারি না।

বিজয়া। বাবার সঙ্গে এ নিয়ে আমিও তর্ক করেছি। তাঁর কাছেই শুনেছি, তিনি, আপনার বাবা ও জগদীশবাবু এই তিনজনে—শুধু সতীর্থ নয়, পরস্পরের পরম বন্ধু ছিলেন। জগদীশবাবুই ছিলেন সবার চেয়ে মেধাবী ছাত্র, কিন্তু যেমন দুর্বল, তেমনি দরিদ্র। বড় হয়ে বাবা ও আপনার বাবা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেন, কিন্তু জগদীশবাবু পারলেন না। গ্রামের মধ্যে নির্যাতন শুরু হল। আপনার বাবা অত্যাচার সয়ে গ্রামেই রইলেন, কিন্তু বাবা পারলেন না, সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির ভার আপনার বাবার উপর দিয়ে, মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন, আর জগদীশবাবু স্ত্রী নিয়ে ওকালতি করতে পশ্চিমে চলে গেলেন।

বিলাস। এ-সব আমিও জানি।

বিজয়া। জানবার কথাই ত। পশ্চিমে তিনি বড় উকিল হয়েছিলেন। কোন দোষই ছিল না, শুধু স্ত্রী মারা যাবার পর থেকেই তাঁর দুর্গতি শুরু হ’ল।

বিলাস। অমার্জনীয় অপরাধ।

বিজয়া। তা বটে, কিন্তু এর অনেক পরে আমার নিজের মা মারা গেলে বাবা একদিন কথায় কথায় হঠাৎ বলেছিলেন, কেন যে জগদীশ মদ ধরেছিল সে যেন বুঝতে পারি বিজয়া।

বিলাস। বলেন কি? তাঁর মুখে মদ খাবার justification?

বিজয়া। আপনি কি যে বলেন বিলাসবাবু! justification নয়—বাল্যবন্ধুর ব্যথার পরিমাণটাই বাবা ইঙ্গিত করেছিলেন। সম্ভ্রম গেল, স্বাস্থ্য গেল, উপার্জন গেল, সমস্ত নষ্ট করে তিনি দেশে ফিরে এলেন।

বিলাস। বড় কীর্তিই করেছিলেন!

বিজয়া। সব গেল, শুধু গেল না বোধ হয় আমার বাবার বন্ধু-স্নেহ। তাই যখনই জগদীশবাবু টাকা চেয়েছেন তিনি না বলতে পারেন নি।

বিলাস। তা হলে ঋণ না দিয়ে দান করলেই ত পারতেন।

বিজয়া। তা জানিনে বিলাসবাবু। হয়ত দান করে বন্ধুর শেষ আত্মসম্মানবোধটুকু বাবা নিঃশেষ করতে চাননি।

বিলাস। দেখুন, এ-সব আপনার কবিরে কথা, নইলে ঋণ ছেড়ে দেবার উপদেশ তিনি আপনাকেও দিয়ে যেতে পারতেন। কিসের জন্য তা করেন নি?

বিজয়া। তা জানিনে। কোন আদেশ দিয়েই তিনি আমাকে আবদ্ধ করে যাননি। বরঞ্চ, কথা উঠলে বাবা এই কথা বলতেন, মা, তোমার ধর্মবুদ্ধি দিয়েই তোমার কর্তব্য নিরূপণ করো। আমার ইচ্ছের শাসনে তোমাকে আমি বেঁধে রেখে যাব না। কিন্তু পিতৃঋণের দায়ে পুত্রকে গৃহহীন করার সঙ্কল্প বোধ হয় তাঁর ছিল না। তাঁর ছেলের নাম শুনেছি নরেন্দ্র! তিনি কোথায় আছেন জানেন?

বিলাস। জানি। মাতাল বাপের শ্রাদ্ধ শেষ করে সে নাকি বাড়িতেই আছে। পিতৃঋণ যে শোধ করে না সে কুপুত্র। তাকে দয়া করা অপরাধ।

বিজয়া। আপনার সঙ্গে বোধ হয় তাঁর আলাপ আছে?

বিলাস। আলাপ! ছিঃ—আপনি আমায় কি মনে করেন বলুন ত? আমি ত ভাবতেই পারিনে যে, জগদীশ মুখুয্যের ছেলের সঙ্গে আমি আলাপ করেছি| তবে সেদিন রাস্তায় হঠাৎ পাগলের মত একটা নতুন লোক দেখে আশ্চর্য হয়েছিলুম—শুনলাম সেই-ই নাকি নরেন মুখুয্যে।

বিজয়া। পাগলের মত? কিন্তু শুনেছি নাকি ডাক্তার?

বিলাস। ডাক্তার! আমি বিশ্বাস করিনে। যেমন আকৃতি তেমনি প্রকৃতি; একটা অপদার্থ লোফার!

বিজয়া। আচ্ছা বিলাসবাবু, জগদীশবাবুর বাড়িটা যদি সত্যিই আমরা দখল করে নিই, গ্রামের মধ্যে কি একটা বিশ্রী গোলমাল উঠবে না?

বিলাস। একেবারে না। আপনি পাঁচ-সাতখানা গ্রামের মধ্যে একজনও পাবেন না এই মাতালটার ওপর যার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি ছিল। আহা বলে এমন লোক এ অঞ্চলে নেই। তাও যদি না হত আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত সে চিন্তা আপনার মনে আনা উচিত নয়।

[ভৃত্য আসিয়া চা দিয়া গেল। ক্ষণেক পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল]

কালীপদ (ভৃত্য)। একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান।

বিজয়া। এইখানে নিয়ে এস।

[ভৃত্যের প্রস্থান]

বিজয়া। আর পারিনে। লোকের আসা-যাওয়ার আর বিরাম নেই। এর চেয়ে বরং কলকাতায় ছিলুম ভাল।

[নরেনের প্রবেশ]

নরেন। আমার মামা পূর্ণ গাঙ্গুলীমশাই আপনার প্রতিবেশী—ওই পাশের বাড়িটা তাঁর। আমি শুনে অবাক হয়ে গেছি যে, তাঁর পিতৃপিতামহ-কালের দুর্গাপূজা নাকি আপনি এবার বন্ধ করে দিতে চান? একি সত্যি? (এই বলিয়া একটা চেয়ার টানিয়া উপবেশন করিল)

বিলাস। আপনি তাই মামার হয়ে ঝগড়া করতে এসেছেন নাকি? কিন্তু কার সঙ্গে কথা কচ্ছেন ভুলে যাবেন না।

নরেন। না সে আমি ভুলিনি, আর ঝগড়া করতেও আমি আসিনি। বরঞ্চ, কথাটা বিশ্বাস হয়নি বলেই জেনে যেতে এসেছি।

বিলাস। বিশ্বাস না হবার কারণ?

নরেন। কেমন করে হবে? নিরর্থক নিজের প্রতিবেশীর ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করবেন, এ বিশ্বাস না হওয়াই ত স্বাভাবিক।

বিলাস। আপনার কাছে নিরর্থক বোধ হলেই যে কারো কাছে তার অর্থ থাকবে না, কিংবা আপনি ধর্ম বললেই যে অপরে তা শিরোধার্য করে নেবে এর কোনো হেতু নেই। পুতুলপূজো আমাদের কাছে ধর্ম নয় এবং তার নিষেধ করাটাও আমরা অন্যায় মনে করিনে।

নরেন। (বিজয়ার প্রতি) আপনিও কি তাই বলেন?

বিজয়া। আমি? আমার কাছে কি আপনি এর বিরুদ্ধে-মন্তব্য শোনবার আশা করে এসেছেন?

বিলাস। কিন্তু উনি ত বিদেশী লোক। খুব সম্ভব আমাদের কিছুই জানেন না।

নরেন। (বিজয়ার প্রতি) আমি বিদেশী না হলেও গ্রামের লোক নয়, সে কথা ঠিক। তবুও আমি সত্যিই আপনার কাছে এ আশা করিনি। পুতুলপূজো কথাটা আপনার মুখ থেকে বার না হলেও সাকার-নিরাকারের পুরোনো ঝগড়া আমি এখানে তুলব না। আপনারা যে অন্য সমাজের তাও আমি জানি, কিন্তু এ ত সে কথা নয়। গ্রামের মধ্যে মাত্র এই একটি পূজো। সমস্ত লোক সারা বৎসর এই তিনটি দিনের আশায় পথ চেয়ে আছে। আপনার প্রজারা আপনার ছেলেমেয়ের মত। আপনার আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের আনন্দ-উৎসব শতগুণে বেড়ে যাবে এই আশাই ত সকলে করে। কিন্তু তা না হয়ে এত বড় দুঃখ, এত বড় নিরানন্দ আপনার দুঃখী প্রজাদের মাথায় নিজে তুলে দেবেন এ বিশ্বাস করা কি সহজ? আমি ত কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি।

বিলাস। আপনি অনেক কথাই বলছেন। সাকার-নিরাকারের তর্ক আপনার সঙ্গে করব এত অপর্যাপ্ত সময় আমাদের নেই। তা সে চুলোয় যাক। আপনার মামা একটা কেন, একশোটা পুতুল গড়িয়ে ঘরে বসে পূজো করতে পারেন তাতে কোন আপত্তি নেই, শুধু কতকগুলো ঢাক, ঢোল, কাঁসি অহোরাত্র ওঁর কানের কাছে পিটে ওঁকে অসুস্থ করে তোলাতেই আমাদের আপত্তি।

নরেন। অহোরাত্র ত বাজে না। তা সকল উৎসবেই একটু হৈচৈ গণ্ডগোল হয়। অসুবিধে কিছু না হয় হলই। আপনারা মায়ের জাত, এদের আনন্দের অত্যাচার আপনি সইবেন না ত কে সইবে?

বিলাস। আপনি ত কাজ আদায়ের ফন্দিতে মা ও ছেলের উপমা দিলেন, শুনতেও মন্দ লাগল না। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, আপনার মামার কানের কাছে মহরমের বাজনা শুরু করে দিলে, তাঁর সেটা ভাল বোধ হত কি? তা সে যাই হোক, বকাবকি করবার সময় নেই আমাদের। বাবা যে হুকুম দিয়েছেন তাই হবে।

নরেন। আপনার বাবা কে, আর তাঁর নিষেধ করবার কি অধিকার তা আমার জানা নেই। কিন্তু আপনি মহরমের যে অদ্ভুত উপমা দিলেন, কিন্তু এটা রোশনচৌকি না হয়ে কাড়া-নাকড়ার বাদ্য হলে কি করতেন শুনি, এ ত শুধু নিরীহ স্বজাতির প্রতি অত্যাচার বৈ ত নয়!

বিলাস। বাবার সম্বন্ধে তুমি সাবধান হয়ে কথা কও বলে দিচ্ছি, নইলে এখুনি অন্য উপায়ে শিখিয়ে দেব তিনি কে এবং তাঁর নিষেধ করার কি অধিকার।

নরেন। (বিলাসকে উপেক্ষা করিয়া বিজয়ার প্রতি) আমার মামা বড়লোক নন। তাঁর পূজোর আয়োজন সামান্যই। তবুও এইটেই একমাত্র আপনার দরিদ্র প্রজাদের সমস্ত বছরের আনন্দোৎসব। হয়ত আপনার কিছু অসুবিধে হবে, কিন্তু তাদের মুখ চেয়ে কি আপনি এইটুকু সহ্য করতে পারবেন না?

বিলাস। (টেবিলের উপর প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত করিয়া) না পারবেন না, একশোবার পারবেন না। কতকগুলো মূর্খ লোকের পাগলামি সহ্য করবার জন্য কেউ জমিদারি করে না। তোমার আর কিছু বলবার না থাকে তুমি যাও, মিথ্যে আমাদের সময় নষ্ট করো না।

বিজয়া। (বিলাসের প্রতি) আপনার বাবা আমাকে মেয়ের মত ভালবাসেন বলেই এঁদের পূজো নিষেধ করেছেন, কিন্তু আমি বলি হলোই বা তিন-চারদিন একটু গোলমাল।

বিলাস। ওঃ—সে অসহ্য গোলমাল। আপনি জানেন না বলেই—

বিজয়া। জানি বৈ কি। তা হোক গে গোলমাল—তিনদিন বৈ ত নয়। আর আপনি আমার অসুবিধের কথা ভাবছেন, কিন্তু কলকাতা হলে কি করতেন বলুন ত? সেখানে অষ্টপ্রহর কেউ কানের কাছে তোপ দাগতে থাকলেও ত চুপ করে সইতে হতো? (নরেনের প্রতি) আপনার মামাকে জানাবেন, তিনি প্রতি বৎসর যেমন করেন, এবারেও তেমনি করুন, আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। আপনি তবে এখন আসুন, নমস্কার।

নরেন। ধন্যবাদ—নমস্কার।

[উভয়কে নমস্কার করিয়া প্রস্থান

বিজয়া। আমাদের কথাটাই ত শেষ হতে পেলে না। তা হলে তালুকটা নেওয়াই কি আপনার বাবার মত?

বিলাস। হুঁ।

বিজয়া। কিন্তু এর মধ্যে কোনরকম গোলমাল নেই ত?

বিলাস। না।

বিজয়া। আজ কি তিনি ওবেলা এদিকে আসবেন?

বিলাস। বলতে পারি না।

বিজয়া। আপনি রাগ করলেন নাকি?

বিলাস। রাগ না করলেও পিতার অপমানে পুত্রের ক্ষুণ্ণ হওয়া বোধ করি অসঙ্গত নয়।

বিজয়া। কিন্তু এতে তাঁর অপমান হয়েছে এ ভুল ধারণা আপনার কোত্থেকে জন্মালো? তিনি স্নেহবশে মনে করেছেন আমার কষ্ট হবে। কিন্তু কষ্ট হবে না এইটাই শুধু ভদ্রলোককে জানিয়ে দিলুম। এতে মান-অপমানের ত কিছুই নেই বিলাসবাবু!

বিলাস। ওটা কথাই নয়! বেশ, আপনার স্টেটের দায়িত্ব নিজে নিতে চান নিন। কিন্তু এর পরে বাবাকে আমার সাবধান করে দিতেই হবে। নইলে পুত্রের কর্তব্যে আমার ত্রুটি হবে।

বিজয়া। এই সামান্য বিষয়টাকে যে আপনি এমন করে নিয়ে এ রকম গুরুতর করে তুলবেন এ আমি মনেও করিনি। ভাল, আমার বোঝবার ভুলে যদি অন্যায়ই হয়ে গিয়ে থাকে আমি অপরাধ স্বীকার করছি। ভবিষ্যতে আর হবে না।

বিলাস। তা হলে পূর্ণ গাঙ্গুলীকে জানিয়ে পাঠান যে, রাসবিহারীবাবু যে হুকুম দিয়েছেন তা অন্যথা করা আপনার সাধ্য নয়।

বিজয়া। সেটা কি ঢের বেশী অন্যায় হবে না? আচ্ছা আমি নিজেই চিঠি লিখে আপনার বাবার অনুমতি নিচ্ছি।

বিলাস। এখন অনুমতি নেওয়া না-নেওয়া দুই-ই সমান। আপনি যদি বাবাকে সমস্ত দেশের কাছে উপহাসের পাত্র করে তুলতে চান, আমাকেও তা হলে অত্যন্ত অপ্রিয় কর্তব্য পালন করতে হবে।

বিজয়া। (আত্মসংযম করিয়া) এই অপ্রিয় কর্তব্যটা কি শুনি?

বিলাস। আপনার জমিদারি শাসনের মধ্যে তিনি যেন আর হাত না দেন।

বিজয়া। আপনার নিষেধ তিনি শুনবেন মনে করেন?

বিলাস। অন্ততঃ, সেই চেষ্টাই আমাকে করতে হবে।

বিজয়া। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) বেশ! আপনি যা পারেন করবেন, কিন্তু অপরের ধর্মেকর্মে আমি বাধা দিতে পারব না।

বিলাস। আপনার বাবা কিন্তু এ কথা বলতে সাহস পেতেন না।

বিজয়া। (ঈষৎ রুক্ষস্বরে) বাবার কথা আপনার চেয়ে আমি ঢের বেশী জানি বিলাসবাবু। কিন্তু সে নিয়ে তর্ক করে ফল নেই—আমার স্নানের বেলা হলো, আমি উঠলুম। (গমনোদ্যত)

বিলাস। মেয়েমানুষ জাতটা এমনই নেমকহারাম।

[বিজয়া পা বাড়াইয়াছিল। বিদ্যুৎবেগে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া পলকমাত্র বিলাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া নিঃশব্দে ঘর হইতে চলিয়া গেল। এমনি সময় বৃদ্ধ রাসবিহারী ধীরে ধীরে প্রবেশ করিতেই পুত্র বিলাসবিহারী লাফাইয়া উঠিল]

বিলাস। বাবা, শুনেছ এইমাত্র কি ব্যাপার ঘটলো? পূর্ণ গাঙ্গুলী এবারও ঢাক ঢোল কাঁসি বাজিয়ে দুর্গাপূজা করবে, বারণ করা চলবে না। এইমাত্র তার কে একজন ভাগনে এসেছিল প্রতিবাদ করতে, বিজয়া তাকে হুকুম দিলেন পূজো হোক।

রাসবিহারী। তা তুমি এত অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলে কেন?

বিলাস। হব না? তোমার হুকুমের বিরুদ্ধে হুকুম দেবে বিজয়া? এবং আমার আপত্তি করা সত্ত্বেও?

রাস। কিন্তু এই নিয়ে তার সঙ্গে রাগারাগি করলে নাকি?

বিলাস। কিন্তু উপায় কি? আত্মসম্মান বজায় রাখতে—

রাস। দেখ বাপু, তোমার এই আত্মসম্মানবোধটা দিনকতক খাটো কর, নইলে আমি ত আর পেরে উঠিনে। বিয়েটা হয়ে যাক, বিষয়টা হাতে আসুক, তখন ইচ্ছে মত আত্মসম্মান বাড়িয়ে দিও, আমি নিষেধ করব না।

[বিজয়ার প্রবেশ]

রাসবিহারী। এই যে মা বিজয়া!

বিজয়া। আপনাকে আসতে দেখে আমি ফিরে এলুম কাকাবাবু। শুনে হয়ত আপনি রাগ করবেন, কিন্তু মোটে তিনদিন বৈ ত নয়, হোক গে গোলমাল—আমি অনায়াসে সইতে পারব, কিন্তু গাঙ্গুলীমশায়ের দুর্গাপূজায় বাধা দিয়ে কাজ নেই। আমি অনুমতি দিয়েছি।

রাস। সে কথাই বিলাস আমাকে বোঝাচ্ছিলেন! বুড়োমানুষ, শুনে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলুম যে ভবিষ্যতে এ রকম পুনর্বার ঘটলে ত চলবে না। তখন আত্মসম্মান বজায় রাখতে তোমার বিষয় থেকে নিজেকে তফাত করতেই হবে। কিন্তু বিলাসের কথায় রাগ গেছে মা; বুঝেচি, অজ্ঞান ওরা—করুক পূজো। বরং পরের জন্য দুঃখ সওয়াটাই মহত্ত্ব! আশ্চর্য প্রকৃতি এই বিলাসের। ওর বাক্য ও কর্মের দৃঢ়তা দেখলে হঠাৎ বোঝা যায় না যে হৃদয় ওর এত কোমল। তা সে যাক, কিন্তু জগদীশের দরুন বাড়িটা যখন তুমি সমাজকেই দান করলে মা, তখন আর বিলম্ব না করে, এই ছুটির মধ্যেই এর সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলতে হবে। কি বল?

বিজয়া। আপনি যা ভাল বুঝবেন তাই হবে। টাকা পরিশোধের মেয়াদ ত তাদের শেষ হয়ে গেছে?

রাস। অনেকদিন। শর্ত ছিল, আট বৎসরের, কিন্তু এটা নয় বৎসর চলছে।

বিজয়া। শুনতে পাই তাঁর ছেলে নাকি এখানে আছেন। তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে আরও কিছুদিনের সময় দিলে হয় না? যদি কোন উপায় করতে পারেন?

রাস। (মাথা নাড়িতে নাড়িতে) পারবে না—পারবে না—পারলে—

বিলাস। পারলেই বা আমরা দেব কেন? টাকা নেবার সময় সে মাতালটার হুঁশ ছিল না কি শর্ত করেছি? এ শোধ দেব কি করে?

বিজয়া। (বিলাসের প্রতি মাত্র একবার দৃষ্টিপাত করিল। রাসবিহারীর মুখের দিকে চাহিয়া শান্ত-দৃঢ়কণ্ঠে কহিল) তিনি বাবার বন্ধু ছিলেন, তাঁর সম্বন্ধে সসম্মানে কথা কইতে বাবা আমাকে আদেশ করে গেছেন।

বিলাস। (সগর্জনে) হাজার আদেশ করলেও সে যে একটা—

রাস। আহা চুপ কর না বিলাস। পাপের প্রতি তোমার আন্তরিক ঘৃণা যেন না পাপীর ওপর গিয়ে পড়ে। এইখানেই যে আত্মসংযমের সবচেয়ে প্রয়োজন বাবা।

বিলাস। না বাবা, এই-সব বাজে sentiment আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারিনে তা সে কেউ রাগই করুক আর যাই করুক। আমি সত্য কথা কইতে ভয় পাইনে, সত্য কাজ করতে পেছিয়ে দাঁড়াই নে।

রাস। তা বটে, তা বটে। তোমাকেই বা দোষ দেব কি। আমাদের বংশের এই স্বভাবটা যে বুড়ো বয়স পর্যন্ত আমারই গেল না! অন্যায় অধর্ম দেখলেই যেন জ্বলে উঠি। বুঝলে না মা বিজয়া, আমি আর তোমার বাবা এই জন্যই সমস্ত দেশের বিরুদ্ধে সত্যধর্ম গ্রহণ করতে ভয় পাইনি। জগদীশ্বর তুমিই সত্য। (এই বলিয়া দুই হাত কপালে ঠেকাইয়া উদ্দেশে নমস্কার করিলেন)

রাস। কিন্তু দেখো মা, আমি যাই হই তবু তৃতীয় ব্যক্তি। তোমাদের উভয়ের মতভেদের মধ্যে আমার কথা কওয়া উচিত নয়। কারণ, কিসে তোমাদের ভাল সে আজ নয় কাল তোমরাই স্থির করে নিতে পারবে। এ বুড়োর মতামতের আবশ্যক হবে না। কিন্তু কথা যদি বলতেই হয় ত বলতেই হবে যে, এক্ষেত্রে তোমারই ভুল হচ্চে। জমিদারি চালাবার কাজে আমাকেও বিলাসের কাছে হার মানতে হয়, এ আমি বহুবার দেখেছি। আচ্ছা তুমিই বল দেখি কার গরজ বেশি? আমাদের না জগদীশের ছেলের? ঋণ পরিশোধের সাধ্যই যদি থাকত, একবার নিজে এসে কি চেষ্টা করে দেখত না? সে ত জানে তুমি এসেছ? এখন আমরাই যদি উপযাচক হয়ে ডাকিয়ে পাঠাই, সে নিশ্চয়ই একটা বড়রকমের সময় নেবে। তাতে ফল শুধু এই হবে যে, দেনাও শোধ হবে না, আর তোমাদের সমাজ-প্রতিষ্ঠার সঙ্কল্পও চিরদিনের মত ডুবে যাবে। বেশ করে ভেবে দেখ দিকি মা, এই কি ঠিক নয়? আর তার অগোচরেও ত কিছু হতে পারবে না। তখন নিজে যদি সে সময় চায় তখন না হয় বিবেচনা করে দেখা যাবে। কি বল মা?

বিজয়া। (অপ্রসন্ন-মুখে) আচ্ছা। কাকাবাবু, আমার বড় দেরি হয়ে গেল, এখন কি যেতে পারি?

রাস। যাও মা যাও, আমিও চললাম।

[বিজয়ার প্রস্থান]

বিলাস। (সক্রোধে) সে যদি দশ বছরের সময় চায় ত বিবেচনা করতে হবে নাকি?

রাস। (ক্রুদ্ধ চাপাকণ্ঠে) হবে না ত কি সমস্ত খোয়াতে হবে? মন্দির-প্রতিষ্ঠা! দেখ বিলাস, এই মেয়েটির বয়স বেশি নয়, কিন্তু সে বেশ জানে যে সেই তার বাপের সমস্ত সম্পত্তির মালিক, আর কেউ নয়। মন্দির-স্থাপনা না হলেও চলবে, কিন্তু আমার কথাটা ভুললে চলবে না।

[প্রস্থান]

[কালীপদর প্রবেশ]

কালী। মা জিজ্ঞাসা করলেন আপনাকে কি আর চা পাঠিয়ে দেবেন?

বিলাস। না।

কালী। শরবত কিংবা—

বিলাস। না দরকার নেই।

কালী। ফল কিংবা কিছু মিষ্টি?

বিলাস। আঃ দরকার নেই বলচি না? তাকে বলে দিও আমি বাড়ি চললুম।

[প্রস্থান]

কালী। বলতে হবে না, তিনি গেলেই জানতে পারবেন।

[প্রস্থান]

বিজয়া – ১.২

দ্বিতীয় দৃশ্য

গ্রাম্যপথ

[পূর্ণ গাঙ্গুলী ও দুই-তিনজন গ্রামবাসীর প্রবেশ]

১ম ব্রাহ্মণ। হাঁ পূর্ণখুড়ো, শুনচি নাকি পূজো করবার হুকুম পাওয়া গেছে?

পূর্ণ। হাঁ বাবা, জগদম্বা মুখ তুলে চেয়েছেন। জমিদারবাড়ি থেকে হুকুম পাওয়া গেছে, পূজোয় তাঁর আপত্তি নেই।

১ম ব্রাহ্মণ। শুনে পর্যন্ত দুশ্চিন্তার অবধি ছিল না খুড়ো। সবাই ভাবছিল তোমাদের এতকালের পূজোটা বুঝি এবার বন্ধ হয়ে যায়। হুকুম দিলে কে?

পূর্ণ। জমিদারকন্যা স্বয়ং। এ-সব ব্যাপারের তিনি নিজে কিছুই জানতেন না। আমাদের নরেন গিয়ে বলতেই আশ্চর্য হয়ে বললেন, সে কি কথা। আপনার মামাকে জানাবেন তিনি যথারীতি মায়ের পূজো করুন, আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। এ-সমস্তই ওই দু ব্যাটা বজ্জাত বাপ-ব্যাটার কারসাজি! আমার ওপর ওদের জাতক্রোধ।

১ম ব্রাহ্মণ। মেয়েটি ত তা হলে ভাল?

২য় ব্রাহ্মণ। হুঁ ভাল! ম্লেচ্ছ, বিধর্মী, বলি খোঁজ রেখেছ কিছু?

পূর্ণ। হোক ম্লেচ্ছ। বাবা, তবুও রায়বংশের মেয়ে-হরি রায়ের নাতনী! শুনলুম ঐ বিলেস ছোঁড়াটা অনেক চেষ্টা করেছিল বন্ধ করতে, কিন্তু তিনি কোন কথায় কান দেননি। স্পষ্ট বলে দিলেন, হাজার অসুবিধে হলেও আমি পরের ধর্মকর্মে হাত দিতে পারব না। এ কি সহজ কথা!

১ম ব্রাহ্মণ। বল কি খুড়ো? প্রথম যেদিন জুতোমোজা পরে ফেটিং চড়ে ও দেশেতে এলো লোক ত ভয়ে মরে। গুজব রটে গেল এরই সঙ্গে হবে নাকি বিলাসবাবুর বিয়ে, তাই এসেছে দেশে। সবাই ভাবলে, একা রামে রক্ষে নেই সুগ্রীব দোসর-আর কাউকে বাঁচাতে হবে না, দেড়েল ব্যাটা এবার গ্রামসুদ্ধ সবাইকে ধরে ধরে ফাঁসি দেবে। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা দেখলে যেন মনে ভরসা হয়। না খুড়ো?

পূর্ণ। হাঁ বাবা, হয়। আমি বলছি তোমরা পরে দেখো, এই মেয়েটির দয়াধর্ম আছে। কাউকে সহজে দুঃখ দেবে না।

২য় ব্রাহ্মণ। বাজে-বাজে-সব বাজে কথা। আরে বিধর্মী যে! শাস্তরে বলেচে ম্লেচ্ছ; তার আবার দয়া! তার আবার ধর্ম!
১ম ব্রাহ্মণ। তা বটে, শাস্তর-বাক্য সহজে মিথ্যে হয় না সত্যি, কিন্তু খুড়োর পূজোটি ত মা-লক্ষ্মী নিজের জোরে চালিয়ে দিলেন! বাপ-ব্যাটায় হাজার চেষ্টা করেও ত বন্ধ করতে পারলে না।

২য় ব্রাহ্মণ। (মাথা নাড়িয়া) কিন্তু তোমরা পরে দেখো ঐ জুতোমোজা-পরা মেলেচ্ছ মেয়ে গাঁ জ্বালিয়ে খাক করে ছাড়বে। আমি চেয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

পূর্ণ। কি জানি বাবা, আমাদের নরেন ত সাহস দিয়ে বললে, ভয় নেই, উনি কাউকে কষ্ট দেবেন না। মহামায়া কপালে যা লিখেছেন তা হবেই। কিন্তু এইটি দেখো বাবা, তোমরা সকলে মিলে যেন আমার কাজটি উদ্ধার করে দিতে পার।

২য় ব্রাহ্মণ। দেবো খুড়ো, দেবো, আমরা সবাই মিলে তোমার কাজে গিয়ে লাগব—কোনদিকে তোমার চাইতে হবে না।

১ম ব্রাহ্মণ। মায়ের পূজোটি ভালয় ভালয় চুকে যাক, কিন্তু বাবা তোমাকেও আমাদের একটু সাহায্য করতে হবে। তোমাকে আর নরেনকে সঙ্গে নিয়ে সময় বুঝে একদিন আমরা দল বেঁধে গিয়ে পড়ব। বলব—মা, গ্রাম্যদেবতা সিদ্ধেশ্বরীর পুকুরটি আপনি খালাস দিন। বুড়ো ব্যাটা ভয় দেখিয়ে জোর করে খাস করে নিলে; কিন্তু বছর অন্তর যে একশ টাকার মাছ বিক্রি হয়, তার ক’টা টাকা সরকারী তবিলে জমা পড়ে একবার খোঁজ করে দেখুন। আমি খবর রাখি বাবা, যে এই ছ-সাত বছর একটা পয়সাও জমা পড়েনি। তখন দেখব বুড়ো তার কি কৈফিয়ত দেয়।

২য় ব্রাহ্মণ। বুড়ো তখন বলবে, ও-কথা মিথ্যে। মাছ বিক্রি হয় না।

১ম ব্রাহ্মণ। তাই বলুক একবার। গরিটীর ঝোড়ো-জেলেকে আমি চিনি, তার পুরুতের সঙ্গে আমার খুব ভাব। তাকে দিয়ে প্রমাণ করিয়ে দেব আমাদের কথা মিথ্যে নয়। ঐ ঝোড়ো-জেলেই বুড়োর হাতে একশ’ টাকা জমা দিয়ে বছর-বছর কলকাতায় মাছ চালান দেয়।

পূর্ণ। আমায় কিন্তু টেনো না বাবা, ঘরের পাশে ঘর, গরীব মানুষ—আমি তা হলে মারা যাব।

১ম ব্রাহ্মণ। কিন্তু তোমার ভাগনে নরেন্দ্র কখনো ভয় পাবে না বলতে পারি। তাকে পাঠাব, সঙ্গে থাকব আমরা। দিঘ্‌ড়ার এত লোকের সে এত কাজ করে, আর আমাদের এই উপকারটি করে দেবে না ভাবো? নিশ্চয় দেবে।

২য় ব্রাহ্মণ। তা হলে অমনি আমার বড় জামাইয়ের বাবলার মাঠের খবরটাও তাকে শুনিয়ে দিও না ভাই—কম নয় সাড়ে-তিন বিঘে জায়গা। জামাই মারা গেল, দেখবার শোনবার কেউ নেই, মেয়েটি আমার কাছে এসে পড়ল, তিন-চার বছরের খাজনা বাকী পড়ে গেল, তারপর কবে যে ক্রোক দিলে, কবে যে নিলেম হলো, তা কেউ জানলে না। তারপর যখন জানা গেল তখন কত গিয়ে ধরাধরি করলুম, কিন্তু এত বড় বজ্জাত—কিছুতেই ছাড়লে না।

পূর্ণ। বাবুর বাড়ির উত্তর দিকের সেই নতুন কলমের বাগানটা নয়?

২য় ব্রাহ্মণ। হাঁ বাবা সেইটে। এখন হয়েছে বুড়োর শখের আমবাগান।

পূর্ণ। কিন্তু নীলেম-খরিদ জায়গা, এ ত আর কেউ ছেড়ে দিতে পারবে না বাবা।

২য় ব্রাহ্মণ। না পারুক সে আশা আমি করিনে, কিন্তু বুড়ো ব্যাটা দুদিন বাদে শ্বশুর হবে কিনা—তাই বলি সময় থাকতে শ্বশুরের গুণাগুণ মা-লক্ষ্মী একটু শুনে রাখুন।

১ম ব্রাহ্মণ। জগদীশ মুখুয্যের বাড়িটাও নাকি বুড়ো দখল করে নিতে চায়।

পূর্ণ। কানাঘুষা তাই ত শুনছি বাবা।

২য় ব্রাহ্মণ। এমন কেউ থাকে বুড়ো বজ্জাতের দাড়িটা চড়চড় করে একটানে ছিঁড়ে নিতে পারে তবে গায়ের জ্বালা মেটে।

পূর্ণ। থাক থাক বাবা। পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ও-সব কথায় কাজ নেই। কে কোথায় শুনতে পাবে,, কে কোথায় বলে দেবে। তা হলে আর রক্ষে থাকবে না।

২য় ব্রাহ্মণ। না খুড়ো, শুনবে আর কে? এই ত আমরা তিনজন। থাক গে ও-সব কথা, বেলা হলো। চল ঘরে যাওয়া যাক।

পূর্ণ। তাই চল বাবা। সুধীর, সন্ধ্যার পর আমার ওখানে একবার এসো। আর সময় নেই—তোমাদের সঙ্গে একটা পরামর্শ করতে হবে।

১ম ব্রাহ্মণ। সন্ধ্যার পরেই যাব খুড়ো। চল, এখন বাড়ি যাওয়া যাক।

[সকলের প্রস্থান

বিজয়া – ১.৩

তৃতীয় দৃশ্য

সরস্বতী নদীতীর

[শরৎ অন্তে শীর্ণ সঙ্কীর্ণ সরস্বতী নদী। এ-তটে বিস্তীর্ণ মাঠ, ও-তটে লতাগুল্ম-পরিব্যাপ্ত ঘন বন। বনান্তরালে দিঘ্‌ড়া গ্রাম। নদীর উভয় তীর ক্ষুদ্র বাঁশের সেতু দিয়া সংযুক্ত। একটা পায়ে-হাঁটা সঙ্কীর্ণ পথ বনের মধ্য দিয়া দিঘ্‌ড়া গ্রামে গিয়া প্রবেশ করিয়াছে। এই সকলের অন্তরালে নরেনের বৃহৎ অট্টালিকার কিছু কিছু দেখা যায় মাত্র। নদীর তীরে বসিয়া নরেন ছিপে মাছ ধরিতেছিল। বিজয়া ও কানাই সিং প্রবেশ করিল।]

বিজয়া। এই নদীর পারেই দিঘ্‌ড়া, না কানাই সিং?

কানাই। হাঁ মা-জী।

বিজয়া। এই গাঁয়েই জগদীশবাবুর বাড়ি, না?

কানাই। হাঁ মা-জী, বহুৎ বড়া বাড়ি।

বিজয়া। এই পুল পেরিয়ে বুঝি ঐ গাঁয়ে যেতে হয়?

[বিজয়া পুলের কাছে অগ্রসর হইতে নরেন্দ্র তাহাকে দেখিয়া]

নরেন। এই যে—নমস্কার! বিকেলবেলা একটুখানি বেড়াবার পক্ষে নদীর ধারটি মন্দ জায়গা নয় বটে, কিন্তু এ সময় ম্যালেরিয়ার ভয়ও ত বড় কম নয়। এ বুঝি আপনাকে কেউ সাবধান করে দেয়নি?

বিজয়া। না, কিন্তু ম্যালেরিয়া ত লোক চিনে ধরে না। আমি ত বরং না জেনে এসেছি, আপনি যে জেনেশুনে জলের ধারে বসে আছেন? কৈ দেখি কি মাছ ধরলেন?

নরেন। (পুলের অপর প্রান্ত হইতে) পুঁটি মাছ। কিন্তু দু ঘণ্টায় মাত্র দুটি পেয়েছি, মজুরি পোষায় নি। সময়টা ত কোনমতে কাটাতে হবে?

বিজয়া। কিন্তু মামার পূজোবাড়িতে এসে তাঁকে সাহায্য না করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন যে বড়ো? গুটি-দুই পুঁটি মাছ দিয়ে ত তাঁর সাহায্য হবে না!

নরেন। (হাসিয়া) না, কিন্তু প্রথমতঃ, মামার বাড়িতে আমি আসিনি, দ্বিতীয়তঃ, তাঁকে সাহায্য করবার বহুলোক আছে। আমার প্রয়োজন নেই।

বিজয়া। মামার বাড়ি আসেন নি? এখানে তবে আছেন কোথায়?

নরেন। বাড়ি আমার ঐ দিঘ্‌ড়া গ্রামে। এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে যেতে হয়।

বিজয়া। দিঘ্‌ড়ায়? তা হলে নরেনবাবুকে তো আপনি চেনেন? তিনি কি রকম লোক বলতে পারেন?

নরেন। ও—নরেন? তার বাড়িটা ত আপনি দেনার দায়ে কিনে নিয়েছেন? এখন তার সম্বন্ধে অনুসন্ধানে আর ফল কি? যে উদ্দেশ্যে নিলেন সে কথাও এ অঞ্চলের সবাই শুনেছে।

বিজয়া। একেবারে নেওয়া হয়ে গেছে এই বুঝি এদিকে রাষ্ট্র হয়েছে?

নরেন। হবারই কথা। জগদীশবাবুর সর্বস্ব আপনার বাবার কাছে বিক্রি-কবলায় বাঁধা ছিলো, তাঁর ছেলের সাধ্য নেই তত টাকা শোধ করে। মেয়াদও শেষ হয়েছে—এ খবর সবাই জানে কিনা!

বিজয়া। আপনি নিজেই যখন গ্রামের লোক তখন খবর জানবেন বৈ কি। আচ্ছা, শুনেছি নরেনবাবু বিলেত থেকে ভাল করেই ডাক্তারি পাস করে এসেছেন। কোন ভাল জায়গায় practice আরম্ভ করে আরও কিছুদিন সময় নিয়ে কি বাপের ঋণটা শোধ করতে পারেন না?

নরেন। সম্ভব নয়। শুনেছি practice করাই নাকি তার সঙ্কল্প নয়।

বিজয়া। তবে তাঁর সঙ্কল্পটাই বা কি? এত খরচপত্র করে বিলেত গিয়ে কষ্ট করে ডাক্তারি শেখবার ফলটাই বা কি হতে পারে? একেবারে অপদার্থ।

নরেন। অপদার্থ? (হাসিয়া) ঠিক ধরেছেন। এইটেই বোধ হয় তার আসল রোগ। তবে শুনতে পাই নাকি সে নিজে চিকিৎসা করার চেয়ে এমন একটা-কিছু বার করে যেতে চায়, যাতে বহুলোকের উপকার হবে। খবর পাই এ নিয়ে সে পরিশ্রমও খুব করে।

বিজয়া। সত্যি হলে ত এ খুব বড় কথা। কিন্তু বাড়িঘর গেলে কি করে এ-সব করবেন? তখন ত রোজগার করা চাই। আচ্ছা আপনি ত নিশ্চয়ই বলতে পারেন বিলেত যাবার জন্যে এখানকার লোক তাঁকে একঘরে করে রেখেছে কিনা।

নরেন। সে ত নিশ্চয়ই। আমার মামা পূর্ণবাবু তারও একপ্রকার আত্মীয়, তবুও পূজোর কদিন বাড়িতে ডাকতে সাহস করেন নি। কিন্তু তাতে তার ক্ষতি হয়নি। নিজের কাজকর্ম নিয়ে থাকে, সময় পেলে ছবি আঁকে। বাড়ি থেকে বড় বারই হয় না।

কানাই। মা-জী, সন্‌ঝা হয়ে আসলে; বাড়ি ফিরতে রাত হবে।

নরেন। হাঁ, কথায় কথায় সন্ধ্যা হয়ে এলো।

বিজয়া। তা হলে বাড়িটা গেলে কোনও আত্মীয়-কুটুম্বের ঘরেও তাঁর আশ্রয় পাবার ভরসা নেই বলুন?

নরেন। একেবারেই না।

বিজয়া। (মুহূর্তকাল নীরব থাকিয়া) তিনি যে কারও কাছেই যেতে চান না—নইলে এই মাসের শেষেই ত তাঁকে বাড়ি ছেড়ে দেবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে—আর কেউ হলে অন্ততঃ আমাদের সঙ্গেও একবার দেখা করবার চেষ্টা করতেন।

নরেন। হয়ত তার দরকার নেই, নয়, ভাবে লাভ কি? আপনি ত সত্যিই তাকে বাড়িতে থাকতে দিতে পারেন না।

বিজয়া। চিরকাল না পারলেও আর কিছুকাল থাকতে দেওয়া ত যায়। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে তাঁর বিশেষ পরিচয় আছে। কি বলেন সত্যি না?

নরেন। কিন্তু এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে যে।

বিজয়া। আসুক।

নরেন। আসুক? অর্থাৎ, দেশের প্রতি আপনার সত্যিকার টান আছে।

বিজয়া। (গম্ভীর হইয়া) তার মানে?

নরেন। মানে এই যে সন্ধ্যাবেলায় এখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেশের ম্যালেরিয়াটা পর্যন্ত না নিলে আপনার চলছে না।

বিজয়া। (হাসিয়া) ওঃ, এই কথা! কিন্তু দেশ ত আপনারও। ওটা আপনারও নেওয়া হয়ে গেছে বোধ হয়? কিন্তু মুখ দেখে ত মনে হয় না।

নরেন। ডাক্তারদের একটু সবুর করে নিতে হয়।

বিজয়া। আপনিও কি ডাক্তার নাকি?

নরেন। হাঁ ডাক্তার বটে কিন্তু খুব ছোট্ট ডাক্তার।

বিজয়া। তা হলে আপনি শুধু প্রতিবেশী নন,—তাঁর বন্ধু। তাঁর সম্বন্ধে যে-সব কথা আমি বলেচি, হয়ত গিয়ে তাঁকেই গল্প করবেন—না?

নরেন। (হাসিয়া) কি গল্প করব, বলেছেন একটা অপদার্থ হতভাগা লোক, এই ত? আপনার চিন্তা নেই, এ অত্যন্ত পুরোনো কথা, এ তাকে সবাই বলে। নতুন করে বলবার দরকার নেই। তবে, বললে হয়ত সে কোনদিন আপনার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারে।

বিজয়া। আমার সঙ্গে দেখা করে তাঁর লাভ কি? কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে ত ঠিক ও-রকম কথা আপনাকে আমি বলিনি।

নরেন। না বলে থাকলেও বলা উচিত ছিল।

বিজয়া। উচিত ছিল? কেন?

নরেন। ঋণের দায়ে যার বাস করবার গৃহ, যার সর্বস্ব বিক্রি হয়ে যায়, তাকে সবাই হতভাগ্য বলে। আমরাও বলি। সুমুখে না পারলেও আড়ালে বলতে বাধা কি?

বিজয়া। (হাসিয়া) আপনি ত তাঁর চমৎকার বন্ধু!

নরেন। (ঘাড় নাড়িয়া) হ্যাঁ, অভেদ্য বললেও চলে। এমন কি তার হয়ে আমি নিজে গিয়েই আপনাকে ধরতুম, যদি না জানতুম সৎ উদ্দেশ্যেই তার বাড়িখানি আপনি গ্রহণ করছেন।

বিজয়া। আচ্ছা, আপনার বন্ধুকে একবার রাসবিহারীবাবুর কাছে যেতে বলতে পারেন না?

নরেন। কিন্তু তাঁর কাছে কেন?

বিজয়া। তিনি বাবার বিষয়-সম্পত্তি দেখেন কিনা।

নরেন। সে আমি জানি; কিন্তু তাঁর কাছে গিয়ে লাভ নেই। সন্ধ্যা হয়—আসি তবে,—নমস্কার।

[নরেন পুল পার হইয়া বনের ভিতর অদৃশ্য হইয়া গেল। বিজয়া সেইদিকে চাহিয়া রহিল।]

কানাই। এ বাবুটি কে মা-জী?

বিজয়া। (চমকিয়া আপন মনে কহিল) কে তা ত জানিনে। ঐ যাঁদের বাড়িতে পূজো হচ্ছে তাঁদের ভাগনে।

[রাসবিহারীর প্রবেশ]

রাস। তোমাকে খুঁজছিলাম মা। খবর পেলুম তুমি নদীর দিকে একটু বেড়াতে এসেছ। ভাল কথা—তাকে আমরা নোটিশ দিয়েছি, আবার আমরা যদি রদ করতে যাই, আর পাঁচজন প্রজার কাছে সেটা কি-রকম দেখাবে ভেবে দেখ দিকি।

বিজয়া। একখানা চিঠি লিখে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিন না। আমার নিশ্চয়ই বোধ হচ্ছে তিনি শুধু অপমানের ভয়েই এখানে আসতে সাহস করেন না।

রাস। (বিদ্রূপের ভাবে) মহামানী লোক দেখছি! তাই অপমানটা ঘাড়ে নিয়ে আমাদেরই উপযাচক হয়ে তাঁকে থাকবার জন্যে চিঠি লিখতে হবে?

বিজয়া। (কাতর হইয়া) তাতে দোষ নেই কাকাবাবু—অযাচিত দয়া করার মধ্যে লজ্জা নেই।

রাস।(ঈষৎ হাসিয়া) মা, তোমার জিনিস তুমি দান করবে, আমি বাদ সাধব কেন? আমি শুধু এইটুকুই দেখাতে চেয়েছিলুম যে, বিলাস যা করতে চেয়েছিল, তা স্বার্থের জন্যও নয়, রাগের জন্যেও নয়—শুধু কর্তব্য বলেই করতে চেয়েছিল। একদিন আমার বিষয় তোমার বাবার বিষয় সব এক হয়েই তোমাদের দুজনের হাতে পড়বে। সেদিন বুদ্ধি দেবার জন্যে এ বুড়োটাকে খুঁজে পাবে না মা।

[বিলাসের প্রবেশ—পরনে বিলাতী পোশাক, হাতে ছোট ব্যাগ, অত্যন্ত ব্যস্তভাবে]

বিলাস। এই যে তোমরা। বাবা, এখনো বাড়ি যাবার সময় পাইনি, কলকাতা থেকে ফিরেই শুনলুম তোমরা এসেছ নদীর তীরে বেড়াতে। বেড়ানো! বিরাট কার্যভার মাথায় নিয়ে কি করে যে মানুষ আলস্যে সময় কাটাতে পারে আমি তাই শুধু ভাবি। বাবা, একরকম সমস্ত কাজই প্রায় শেষ করে এলুম। কাদের আহ্বান করতে হবে, কাদের ওপর সেদিনের ভার দিতে হবে, কি কি করতে হবে,—সমস্ত।

রাস। সমস্ত? বল কি? এর মধ্যে করলে কি করে?

বিলাস। হ্যাঁ, সমস্ত। আমার কি আর নাওয়া-খাওয়া ছিল! বিজয়া, তুমি নিশ্চয়ই ভাবচ এই ক’টা দিন আমি রাগ করে আসিনি। যদিও রাগ আমি করিনি, কিন্তু করলেও সেটা কিছুমাএ অন্যায় হতো না।

রাস। কানাই সিং, চলো ত বাবা একটু এগিয়ে দু পা ঘুরে আসি গে। অনেকদিন নদীর এ দিকটায় আসতে পারিনি।

কানাই সিং। চলিয়ে হুজুর।

[রাসবিহারী ও কানাই সিং-এর প্রস্থান

বিলাস। তুমি স্বচ্ছন্দে চুপ করে থাকতে পার, কিন্তু আমি পারিনে। আমার দায়িত্ববোধ আছে। একটা বিরাট কার্যভার ঘাড়ে নিয়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারিনে। আমাদের মন্দির-প্রতিষ্ঠা এই বড়দিনের ছুটিতেই হবে। সমস্ত স্থির হয়ে গেল। এমন কি নিমন্ত্রণ করা পর্যন্ত বাকী রেখে আসিনি। উঃ—কাল সকাল থেকে কি ঘোরাটাই না আমাকে ঘুরতে হয়েছে। যাক, ওদিকের সম্বন্ধে একরকম নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, কারা কারা আসবেন তাও নোট করে এনেছি, পড়ে দ্যাখো অনেককেই চিনতে পারবে।
[সে ব্যাগ খুলিয়া হাতড়াইয়া, কাগজখানা বাহির করিয়া ধরিল। বিজয়া গ্রহণ করিল বটে, কিন্তু তার মুখ দেখিয়া মনে হইল বিতৃষ্ণার সীমা নাই]

বিলাস। ব্যাপার কি? এমন চুপচাপ যে?

বিজয়া। আমি ভাবছি, আপনি যে তাঁদের নিমন্ত্রণ করে এলেন এখন তাঁদের কি বলা যায়?

বিলাস। তার মানে?

বিজয়া। মন্দির-প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে আমি এখনও কিছু স্থির করে উঠতে পারিনি।

বিলাস। (সুতীব্র বিস্ময়ে ও ততোধিক ক্রোধে বিলাসের মুখ ভীষণ হইয়া উঠিল। কিন্তু কণ্ঠস্বর তাহার পক্ষে যতটা সম্ভব সংযত করিয়া কহিল) তার মানে কি? তুমি কি ভেবেচ আসছে ছুটির মধ্যে না করতে পারলে আর কখনো করা যাবে? তারা ত কেউ তোমার—ইয়ে নন যে তোমার যখন সুবিধে হবে তখনই তাঁরা ছুটে এসে হাজির হবেন। মন স্থির হয়নি তার অর্থ কি শুনি?

বিজয়া। (মৃদুকণ্ঠে) এখানে ব্রহ্মমন্দির-প্রতিষ্ঠার কোন সার্থকতা নেই। সে হবে না।

বিলাস। (কিছুক্ষণ স্তম্ভিত থাকিয়া) আমি জানতে চাই তুমি যথার্থই ব্রাহ্মমহিলা কিনা।

বিজয়া। (তাহার মুখের দিকে নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া) আপনি বাড়ি থেকে শান্ত হয়ে ফিরে না এলে আপনার সঙ্গে আলোচনা হতে পারবে না। এ কথা এখন থাক।

বিলাস। আমরা তোমার সংস্রব পরিত্যাগ করতে পারি জানো?

বিজয়া। সে আলোচনা আমি কাকাবাবুর সঙ্গে করব, আপনার সঙ্গে নয়।

বিলাস। আমরা তোমার সংস্পর্শ ত্যাগ করলে কি হয় জানো?

বিজয়া। না, কিন্তু আপনার দায়িত্ববোধ যখন এত বেশি তখন আমার অনিচ্ছায় যাঁদের নিমন্ত্রণ করে অপদস্থ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তাঁদের ভার নিজেই বহন করুন। আমাকে অংশ নিতে অনুরোধ করবেন না।

বিলাস। আমি কাজের লোক, কাজই ভালবাসি, খেলা ভালবাসি নে তা মনে রেখো বিজয়া।

বিজয়া। (শান্তস্বরে) আচ্ছা আমি ভুলবো না।

বিলাস। (প্রায় চীৎকার করিয়া) হাঁ—যাতে না ভোলো সে আমি দেখব।

[বিজয়া কোন কথা না বলিয়া যাইবার উদ্যোগ করিল]

বিলাস। আচ্ছা, এত বড় বাড়ি তবে কি কাজে লাগবে শুনি? এ ত আর শুধু শুধু ফেলে রাখা যেতে পারবে না?

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া দৃঢ়ভাবে) কিন্তু এ বাড়ি যে নিতেই হবে সে ত এখনও স্থির হয়নি!

বিলাস। (রাগিয়া সজোরে মাটিতে পা ঠুকিয়া) হয়েছে একশো বার স্থির হয়েছে। আমি সমাজের মান্য ব্যক্তিদের আহ্বান করে এনে অপমান করতে পারব না। এ বাড়ি আমাদের চাই-ই, এ আমি করে তবে ছাড়ব। এই তোমাকে আমি জানিয়ে দিলুম।

[রাসবিহারী ফিরিয়া আসিলেন।]

বিলাস। শুনছো বাবা, বিজয়া বলছেন, এ এখন হবে না—এ অপমান—

রাস। হবে না? কি হবে না? কে বলেচে হবে না?

বিলাস। (আঙুল দিয়া দেখাইয়া) উনি বলচেন মন্দির-প্রতিষ্ঠা এখন হতে পারবে না।

রাস। বিজয়া বলচেন হবে না? বল কি? আচ্ছা স্থির হও বাবা, স্থির হও। কোন অবস্থাতেই উতলা হতে নেই। আগে শুনি সব। নিমন্ত্রণ হয়ে গেছে? হয়েছে। বেশ, সে ত আর প্রত্যাহার করা যায় না—অসম্ভব। এদিকে দিনও বেশি নেই, করতে হলে এর মধ্যেই সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করা চাই। এতে ত সন্দেহ নেই মা।

বিজয়া। কিন্তু তিনি স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে না গেলে ত কিছুতেই হতে পারে না কাকাবাবু!

রাস। কার স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ার কথা বলছ মা, জগদীশের ছেলের? সে ত বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে—শোননি?

[বিজয়া বিলাসের দিক হইতে ফিরিয়া দাঁড়াইল। তাহার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল। নিজেকে সংযত করিয়া]

বিজয়া। না শুনিনি। কিন্তু তাঁর জিনিসপত্র কি হলো? সমস্ত নিয়ে গেছেন?

বিলাস। (হাসির ভঙ্গীতে) শুনেচি থাকবার মধ্যে ছিল নাকি একটা ভাঙ্গা খাট—তার ওপরই বোধ করি তাঁর শয়ন চলত। আমি সেটা বাইরে গাছতলায় টেনে ফেলে দেবার হুকুম দিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলুম। আজ স্টেশনে নেবেই দরোয়ানের মুখে খবর পেলুম সেগুলো নেবার জন্যে আজ সকালে নাকি সে আবার এসেছে। যা কিছু তার আছে নিয়ে যাক, আমার কোন আপত্তি নেই।

রাস। তোমার দোষ বিলাস। মানুষ যেমন অপরাধীই হোক, ভগবান তাকে যত দণ্ডই দিন, তার দুঃখে আমাদের দুঃখিত হওয়া, সমবেদনা প্রকাশ করা উচিত। আমি বলছি নে যে অন্তরে তুমি তার জন্যে কষ্ট পাও না, কিন্তু বাইরেও সেটা প্রকাশ করা কর্তব্য। তাকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বললে না কেন? দেখতুম—যদি কিছু—

বিলাস। তাঁর সঙ্গে দেখা করে নিমন্ত্রণ করা ছাড়া আমার ত আর কাজ ছিল না বাবা! তুমি কি যে বল তার ঠিক নেই। তা ছাড়া আমার পৌঁছুবার আগেই ত ডাক্তারসাহেব তাঁর তোরঙ্গ-পেটরা যন্ত্রপাতি গুটিয়ে নিয়ে সরে পড়েছেন। বিলাতের ডাক্তার! একটা অপদার্থ humbug কোথাকার!

রাস। না বিলাস, তোমার এরকম কথাবার্তা আমি মার্জনা করতে পারিনে। নিজের ব্যবহারে তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত—অনুতাপ করা উচিত।

বিলাস। কি জন্যে শুনি? পরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া, পরের ক্লেশ নিবারণ করার শিক্ষা আমার আছে, কিন্তু যে দাম্ভিক বাড়ি বয়ে অপমান করে যায়—তাকে আমি মাপ করিনে। অত ভণ্ডামি আমার নেই।

রাস। কে আবার তোমাকে বাড়ি বয়ে অপমান করে গেল? কার কথা তুমি বলছ?

বিলাস। জগদীশবাবুর সুপুত্র নরেনবাবুর কথাই বলছি বাবা। তিনি একদিন ওঁর ঘরে বসেই আমাকে অপমান করে গিয়েছিলেন। তখন তাকে চিনতুম না তাই—(বিজয়াকে দেখাইয়া) নইলে ওঁকেও অপমান করে যেতে সে বাকী রাখেনি। তোমরা জান সে কথা? (বিজয়ার প্রতি) পূর্ণবাবুর ভাগনে বলে নিজের পরিচয় দিয়ে যে তোমাকে পর্যন্ত সেদিন অপমান করে গিয়েছিল সে কে? তখন যে তাকে ভারী প্রশ্রয় দিলে! সেই নরেন। তখন নিজের যথার্থ পরিচয় দিতে যদি সে পারত—তবেই বলতে পারতুম সে পুরুষমানুষ। ভণ্ড কোথাকার!

বিজয়া। তিনিই নরেনবাবু! দরোয়ান পাঠিয়ে তাঁকেই বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছেন? আমারই নাম করে?
আমারই দেনার দায়ে?

[ক্রোধ ও ক্ষোভে সে যেন ছুটিয়া চলিয়া গেল]

রাস। (হতবুদ্ধিভাবে) এ আবার কি?

বিলাস। আমি তার কি জানি!

রাস। যদি জানো না ত অত কথা দম্ভ করে বলতেই বা গেলে কেন? গোড়া থেকে শুনচ জগদীশের ছেলের ওপর ও জোর-জবরদস্তি চায় না, তবুও—

বিলাস। অত ভণ্ডামি আমি পারিনে। আমি সোজা পথে চলতে ভালবাসি।

রাস। তাই বেসো। সোজা পথ ও-ই একদিন তোমাকে আশ মিটিয়ে দেখিয়ে দেবে’খন। সোজা পথ! সোজা পথ!

[বলিতে বলিতে তিনি দ্রুতপদে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন]

বিজয়া – ২.১

দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

বিজয়ার বসিবার ঘর

[বিজয়া বাহিরে কাহার প্রতি যেন একদৃষ্টে চাহিয়াছিল—পরে উঠিয়া জানালার কাছে গিয়া তাহাকে ইঙ্গিতে আহ্বান করিতে একটি বালক প্রবেশ করিল—-খালি গা, কোঁচড়ে মুড়ি তখনও চিবানো শেষ হয় নাই]

পরেশ। ডাকছিলে কেন মা-ঠাকরুন?

বিজয়া। কি করছিলি রে?

পরেশ। মুড়ি খাচ্ছিনু।

বিজয়া। এ কাপড়খানা তোকে কে কিনে দিলে পরেশ? নতুন দেখছি যে!

পরেশ। হুঁ নতুন। মা কিনে দিয়েছে।

বিজয়া। এই কাপড় কিনে দিয়েছে! ছি ছি, কি বিশ্রী পাড় রে! (নিজের শাড়ীর চওড়া সুন্দর পাড়খানি দেখাইয়া) এমনধারা পাড় নইলে কি তোকে মানায়?

পরেশ। (ঘাড় নাড়িয়া সায় দিয়া) মা কিচ্ছু কিনতে জানে না। তোমাকে কে কিনে দিলে?

বিজয়া। আমি আপনি কিনেছি।

পরেশ। আপনি? দামটা কত পড়ল শুনি?

বিজয়া। তোর তাতে কি রে? কিন্তু দ্যাখ আমি তোকে এমনি একখানা কাপড় কিনে দিই যদি তুই—

পরেশ। কখন কিনে দেবে?

বিজয়া। কিনে দিই যদি তুই একটা কথা শুনিস। কিন্তু তোর মা কি আর কেউ যেন না জানতে পারে।

পরেশ। মা জানবে ক্যাম্‌নে? তুমি বলো না—আমি এক্ষুনি শুনব।

বিজয়া। তুই দিঘ্‌ড়া চিনিস?

পরেশ। ওই ত হোথা। গুটিপোকা খুঁজতে কতদিন ত দিঘ্‌ড়ে যাই।

বিজয়া। ওখানে সবচেয়ে কাদের বড়ো বাড়ি তুই জানিস?

পরেশ। হিঁ—বামুনদের গো! সেই যে আর বছর রস খেয়ে যে ছাত থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তেনাদের। এই যেন হেথায় গোবিন্দর মুড়ি-বাতাসার দোকান, আর ওই হোথা তেনাদের কোটা। গোবিন্দ কি বলে জানো মা-ঠাকরুন! বলে সব মাগ্যি-গোণ্ডা—আধ-পয়সায় আর আড়াই গোণ্ডা বাতাসা মিলবে না, এখন মোটে দু’ গোণ্ডা! কিন্তু তুমি যদি একসঙ্গে গোটা পয়সার আনতে দাও ত আমি পাঁচ গোণ্ডা আনতে পারি।

বিজয়া। তুই দু’পয়সার বাতাসা কিনে আনতে পারিস?

পরেশ। হিঁ, এ হাতে এক পয়সার পাঁচ গোণ্ডা গুণে নিয়ে বলব—দোকানী, এ হাতে আরো পাঁচ গোণ্ডা গুণে দাও। দিলে বলব—মা-ঠান বলে দে’ছে দুটো ফাউ দিতে—না? তবে পয়সা দুটো দেব—না?

বিজয়া। (হাসিয়া) হাঁ, তবে পয়সা দুটো হাতে দিবি। আর অমনি দোকানীকে জিজ্ঞেস করবি—ওই যে বড়ো বাড়িতে নরেনবাবু থাকত—সে কোথায় গেছে? কি রে পারবি ত?

পরেশ। (মাথা নাড়িয়া) আচ্ছা পয়সা দুটো দাও না তুমি—আমি ছুট্টে গিয়ে নিয়ে আসি।

বিজয়া। (তাহার হাতে পয়সা দিয়া) বাতাসা হাতে পেয়ে ভুলে যাবিনে ত?

পরেশ। নাঃ—(বলিয়াই দৌড় দিল। বিজয়া ফিরিয়া আসিয়া একটা চৌকিতে বসিতেই পরেশের মা প্রবেশ করিল)

পরেশের মা। পরেশকে বুঝি কোথাও পাঠালে দিদিমণি? ঊর্ধ্বমুখে ছুটেছে। ডাকলুম সাড়া দিলে না।

বিজয়া। (হাসিয়া) ও—পরেশ ছুটেছে বুঝি? তবে নিশ্চয় দিঘ্‌ড়ায় বাতাসা কিনতে দৌড়েছে। হঠাৎ আমার কাছে দুটো পয়সা পেলে কিনা।

পরেশের মা। কিন্তু বাতাসা ত কাছেই মেলে—সেখানে কেন?

বিজয়া। কি জানি সেখানে কে এক গোবিন্দ দোকানী আছে সে নাকি একটু বেশি দেয়।

পরেশের মা। বইগুলো যে গুছিয়ে তোলবার কথা ছিল—তুলবে না?

বিজয়া। এখন থাক গে পরেশের মা!

পরেশের মা। একটা কথা তোমায় বলতে চাই দিদিমণি, ভয়ে বলতে পারিনি।

বিজয়া। কেন তোমার ভয়টা কিসের? কি কথা?

পরেশের মা। কালীপদ বলছিল সে ত আর টিকতে পারে না। ছোটবাবু তাকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না। যখন তখন ধমকানি। ও ছিল কর্তাবাবুর খানসামা—অভ্যেস ছিল কলকাতায় থাকার। কাল নাকি ছোটবাবু তাকে হুকুম দিয়েছেন তার এখানে কাজ কম, উড়ে মালীর সঙ্গে বাগানে খাটতে হবে, নইলে জবাব দেওয়া হবে। বয়েস হয়েছে পারবে কেন বাগানে গিয়ে কোদাল পাড়তে দিদি?

বিজয়া। (দৃঢ়কণ্ঠে) না, তাকে কোদাল পাড়তে হবে না। ছোটবাবুকে আমি বলে দেবো।

পরেশের মা। আমাদের যদু ঘোষ গোমস্তা-মশাই বলছিল যে—

বিজয়া। এখন থাক পরেশের মা। আমার একখানি দরকারী চিঠি লেখবার আছে, পরে শুনব। এখন তুমি যাও।

পরেশের মা। আচ্ছা যাচ্ছি দিদিমণি।

[পরেশের মা চলিয়া গেলে বিজয়া জানালার কাছে গিয়া বাহিরে উঁকি মারিয়া দেখিল কিন্তু পরক্ষণেই ফিরিয়া আসিয়া একটা চিঠির কাগজ টানিয়া লইয়া লিখিতে বসিল। কালীপদ দ্বারের কাছে মুখ বাড়াইয়া ডাকিল—]

কালীপদ। মা!

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া) পরেশের মাকে ত বলতে বলে দিয়েছি কালীপদ, বাগানে গিয়ে তোমাকে কাজ করতে হবে না।

কালী। কিন্তু ছোটবাবু—

বিজয়া। সে তাঁকে আমি বলে দেব, তোমার ভয় নেই। আচ্ছা যাও এখন।

কালী। যে কাপড়গুলো রোদে দেওয়া হয়েছে সে যে—

বিজয়া। এখন থাক কালীপদ। এই দরকারী চিঠিটা শেষ না করে আমি উঠতে পারব না।

[কালীপদ প্রস্থান করিলে বিজয়া উঠিয়া আর একবার জানালাটা ঘুরিয়া আসিয়া বসিল। চিঠির কাগজটা ঠেলিয়া দিয়া খবরের কাগজ টানিয়া লইল। ভাবে বোধ হয় অতিশয় চঞ্চল, কিছুতেই মন দিতে পারে না।]

যদু। (নেপথ্য হইতে ডাকিল) মা!

বিজয়া। কে?

যদু। (দরজার নিকট হইতে) আমি যদু। একবার আসতে পারি কি?

বিজয়া। না যদুবাবু, এখন আমার সময় নেই। আপনি আর কোন সময়ে আসবেন।

যদু। আচ্ছা মা!

[প্রস্থান]

[বিজয়া কাগজ পড়িতেছিল। অন্য ধার দিয়া অত্যন্ত সন্তর্পণে পরেশ প্রবেশ করিল। বিজয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া অত্যন্ত ব্যগ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করিল]

বিজয়া। দোকানী কি বললে পরেশ?

পরেশ। (বস্ত্রাঞ্চলে লুকানো বাতাসার প্রতি ইঙ্গিত করিয়া।) বাতাসা ত? পয়সার ছ’গণ্ডা করে।

বিজয়া। আরে না, না,—সে নরেনবাবুর কথা কি বললে বল না?

পরেশ। (মাথা নাড়িয়া) জানিনে। দোকানী পয়সায় ছ’গণ্ডার কথা কাউকে বলতে মানা করে দেছে। বলে কি জান মা-ঠাকরুন—

বিজয়া। তুই নরেনবাবুর কথা কি জেনে এলি তাই বল না?

পরেশ। সে হোথা নেই—কোথায় চলে গেছে। গোবিন্দ বলে কি জানো মা-ঠান? বলে বারো গণ্ডার—

বিজয়া। (রুক্ষস্বরে) নিয়ে যা তোর বারো গণ্ডা বাতাসা আমার সুমুখ থেকে।

[বিজয়া জানালার কাছে সরিয়া গিয়া দাঁড়াইল]

পরেশ। (ঠোঙা দুইটা হাতে করিয়া) এর বেশি যে দেয় না মা-ঠান!

বিজয়া। (একটু পরে মুখ ফিরাইয়া কহিল) পরেশ ওগুলো তুই খেগে যা।

[বলিয়া পুনরায় জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিল]

পরেশ। (সভয়ে) সব খাবো?

বিজয়া। (মুখ না ফিরাইয়া) হাঁ, সব খেগে যা। ওতে আমার কাজ নেই।

পরেশ। এর বেশি দিলে না যে মা-ঠান! কত তারে বলনু।

বিজয়া। না দিক গে। আমি রাগ করিনি পরেশ, বাতাসা তুই নিয়ে যা—খেগে।

পরেশ। সব একলা খাব? (একটু চুপ করিয়া) কানা ভট্‌চায্যিমশায়ের কাছে গিয়ে জেনে আসব মা-ঠান?

বিজয়া। কে কানা ভট্‌চায্যিমশাই রে? কি জেনে আসবি?

পরেশ। জেনে আসব কোথায় গেছে নরেনবাবু?

[মুখ ফিরাইতেই দেখিল নরেন ঘরে প্রবেশ করিতেছে, তাহার হাতে একটি চামড়ার বাক্স। নীচে সেটা রাখিয়া দিয়া হাত তুলিয়া বিজয়াকে নমস্কার করিল]

বিজয়া। (লজ্জিত হইয়া) যা যা আর জিজ্ঞাসা করবার দরকার নেই। তুই যা!

পরেশ। (ক্ষুণ্ণস্বরে) কানা ভট্‌চায্যিমশাই তেনাদের পাশের বাড়িতেই থাকে কিনা। গোবিন্দ দোকানী বললে, নরেন্দরবাবুর খবর তিনিই জানে।

বিজয়া।(শুষ্ক হাসিয়া) আসুন বসুন। (পরেশের প্রতি) তুই এখন যা না পরেশ। ভারী তো কথা—তার আবার—সে আরেকদিন তখন জেনে আসিস না হয়। এখন যা—

[পরেশ কিছু না বুঝিয়া চলিয়া গেল]

নরেন। আপনি নরেনবাবুর খবর জানতে চান? তিনি কোথায় আছেন এই?

বিজয়া। (একটু ইতস্ততঃ করিয়া) হাঁ, তা সে একদিন জানলেই হবে।

নরেন। কেন? কোন দরকার আছে?

বিজয়া। দরকার ছাড়া কি কেউ কারো খবর রাখতে চায় না?

নরেন। কেউ কি করে না করে সে ছেড়ে দিন। কিন্তু আপনার সঙ্গে ত তার সমস্ত সম্বন্ধ চুকে গেছে। আবার কেন তার সন্ধান নিচ্ছেন? ঋণ কি এখনো সব শোধ হয়নি? (বিজয়া নীরব রহিল) যদি আরও কিছু দেনা বার হয়ে থাকে, তা হলেও আমি যতদূর জানি, তার এমন কিছু আর নেই যা থেকে সেই বাকী টাকা শোধ হতে পারে। এখন আর তার খোঁজ করা বৃথা।

বিজয়া। কে আপনাকে বললে, আমি দেনার জন্যেই তাঁর সন্ধান করছি?

নরেন। তা ছাড়া আর যে কি হতে পারে, আমি ত ভাবতে পারিনে। তিনিও আপনাকে চেনেন না, আপনিও তাঁকে চেনেন না।

বিজয়া। তিনিও আমাকে চেনেন, আমিও তাঁকে চিনি!

নরেন। তিনি আপনাকে চেনেন এ কথা সত্যি, কিন্তু আপনি তাঁকে চেনেন না।

বিজয়া। কে বললে আমি তাঁকে চিনি না?

নরেন। আমি জানি। ধরুন, আমিই যদি বলি আমার নাম নরেন, তাতেও ত আপনি না বলতে পারবেন না।

বিজয়া। না বলতে সত্যিই পারব না, এবং আপনাকেও বলব এই সত্যি কথাটা আপনারও অনেক পূর্বেই আমাকে বলা উচিত ছিল। (নরেন মলিন মুখে নীরব হইয়া রহিল) অন্য পরিচয়ে নিজের আলোচনা শোনা, আর লুকিয়ে আড়ি পেতে শোনা, দুটোই কি আপনার সমান বলে মনে হয় না নরেনবাবু? আমার ত হয়। তবে কিনা আমরা ব্রাহ্ম-সমাজের, আর আপনারা হিন্দু এই যা প্রভেদ।

নরেন। (একটুখানি মৌন থাকিয়া) আপনার সঙ্গে অনেক রকম আলোচনার মধ্যে নিজের আলোচনাও ছিল বটে, কিন্তু তাতে মন্দ অভিপ্রায় কিছুই ছিল না। শেষ দিনটায় পরিচয় দেব মনেও করেছিলাম, কিন্তু কি জানি, কেন হয়ে উঠল না। কিন্তু এতে ত আপনার কোন ক্ষতি হয়নি!

বিজয়া। ক্ষতি একজনের ত কত রকমেই হতে পারে নরেনবাবু। আর যদি হয়ে থাকে সে হয়েই গেছে। আপনি এখন আর তার উপায় করতে পারবেন না। সে থাক, কিন্তু এখন যদি সত্যিই আপনার নিজের সম্বন্ধে কোন কথা জানতে চাই তা হলে কি—
নরেন। রাগ করব? না—না—না।

[প্রশান্ত নির্মলহাস্যে তাহার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল]

বিজয়া। আপনি এখন আছেন কোথায়?

নরেন। গ্রামান্তরে আমার দূর-সম্পর্কের এক পিসী এখনো বেঁচে আছেন, তাঁর বাড়িতেই গিয়েছি।

বিজয়া। কিন্তু আপনার সম্বন্ধে যে সামাজিক গোলযোগ আছে তা কি সে গ্রামের লোকেরা জানে না?

নরেন। জানে বৈ কি!

বিজয়া। তবে?

নরেন। (একটুখানি ভাবিয়া) তাঁদের যে ঘরটায় আছি সেটাকে ঠিক বাড়ির মধ্যে বলাও যায় না। আর আমার অবস্থা শুনেও বোধ করি সামান্য কিছুদিনের জন্যে তাঁর ছেলেরা আপত্তি করেনি। তবে বেশীদিন বাড়িতে থেকে তাঁদের বিব্রত করা চলবে না সে ঠিক। (একটু চুপ করিয়া) আচ্ছা সত্যি কথা বলুন ত, কেন এ-সব খোঁজ নিচ্ছিলেন? বাবার কি আরও কিছু দেনা বেরিয়েছে? (বিজয়া চেষ্টা করিয়াও কোন কথা কহিতে পারিল না) পিতৃঋণ কে না শোধ করতে চায়? কিন্তু সত্যি বলছি আপনাকে স্বনামে বেনামে এমন কিছু আমার নেই যা বেচে টাকা দিতে পারি। শুধু এই microscope-টা আছে। এটা কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছি, যদি কোথাও বেচে অন্যত্র যাবার খরচ যোগাড় করতে পারি। পিসীমার অবস্থাও খুব খারাপ। এমন কি খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত—(বিজয়া মুখ ফিরাইয়া আর একদিকে চাহিয়া রহিল) তবে যদি দয়া করে কিছু সময় দেন, তাহলে বাবার দেনা যতই হোক—আমি নিজের নামে লিখে দিয়ে যেতে পারি। ভবিষ্যতে শোধ দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করব। আপনি রাসবিহারীবাবুকে একটু বললেই তিনি এ বিষয়ে এখন আর আমাকে পীড়াপীড়ি করবেন না।

বিজয়া। বেলা প্রায় তিনটা বাজে, আপনার খাওয়া হয়েছে?

নরেন। হাঁ, হয়েছে একরকম। কলকাতা যাব বলেই বেরিয়েছি কিনা; পথে ভাবলুম একবার দেখা করে যাই। তাই হঠাৎ এসে পড়লুম।

বিজয়া। কিন্তু, আপনার মুখ দেখে মনে হয় যেন খাওয়া এখনও হয়নি।

নরেন। (সহাস্যে) গরীব-দুঃখীদের মুখের চেহারাই এইরকম—খাওয়ার ছবিটা সহজে ফুটতে চায় না। আপনাদের সঙ্গে আমাদের তফাত ঐখানে।

বিজয়া। তা জানি। আচ্ছা আপনার microscope-দাম কত?

নরেন। কিনতে আমার পাঁচশো টাকার বেশি লেগেছিল, এখন আড়াইশো টাকা—দুশো টাকা পেলেও আমি দিই। একেবারে নতুন আছে বললেও হয়।

বিজয়া। এত কমে দেবেন? আপনার কি ওর সব কাজ শেষ হয়ে গেছে?

নরেন।কাজ? কিছুই হয়নি।

বিজয়া। আমার নিজের একটা অনেকদিন থেকে কেনবার শখ আছে—কিন্তু হয়ে ওঠেনি। আর কিনেই বা কি হবে? কলকাতা ছেড়ে চলে এসেছি; এখানে শিখবোই বা কি করে?

নরেন। আমি সমস্ত শিখিয়ে দিয়ে যাব। দেখবেন? (বিজয়ার সম্মতির অপেক্ষা না করিয়াই microscope-টা বাহির করিয়া একটি ছোট টিপায়ার উপর রাখিয়া যন্ত্রটা দেখিবার মত করিয়া লইল) আপনি ঐ চেয়ারটায় বসুন। আমি এক্ষুনি সমস্ত দেখিয়ে দিচ্ছি। অণুবীক্ষণ-যন্ত্রটির সঙ্গে যাদের সাক্ষাৎ পরিচয় নেই, তারা ভাবতেও পারে না, কতবড় বিস্ময় এই ছোট জিনিসটার ভিতর লুকোনো আছে। এই slide-টা ভারী স্পষ্ট। জীবজগতের কতবড় বিস্ময়ই না এইটুকুর মধ্যে রয়েছে। এই দেখুন—(বিজয়া যন্ত্রটায় চোখ রাখিয়া দেখিতে লাগিল) কেমন, দেখতে পাচ্ছেন ত?

বিজয়া। হাঁ পাচ্ছি। ঝাপসা ধোঁয়ায় সব একাকার দেখাচ্ছে।

নরেন। ধোঁয়া? দাঁড়ান—দাঁড়ান—বোধ হয়—(কলকব্জা কিছু কিছু ঘুরাইয়া নিজে দেখিয়া লইয়া মুখ তুলিয়া) এইবার দেখুন। ঐ যে ছোট্ট একটুখানি—কেমন আর ত ঝাপসা নেই?

বিজয়া। না। এবার ঝাপসার বদলে ধোঁয়া খুব গাঢ় হয়েছে।

নরেন। গাঢ় হয়েছে? তা কি করে হবে?

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া) সে আমি কি করে জানব? ধোঁয়া দেখলে কি আগুন দেখছি বলব?

নরেন। তাই কি আমি বলছি? এই স্ক্রুটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের চোখের মত করে নিন না? এতে শক্তটা আছে কোন্‌খানে?

[বিজয়া কলে চোখ পাতিয়া হাত দিয়া স্ক্রু ঘুরাইতেছিল—নরেন ব্যস্ত হইয়া]

নরেন। আহা-হা করেন কি? কত ঘুরোচ্ছেন,—এ কি চরকা? দাঁড়ান, আমি ঠিক করে দিই। এইবার দেখুন (বিজয়া পুনরায় দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল) কেমন, পেলেন দেখতে?

বিজয়া। না।

নরেন। না কেন? বেশ ত দেখা যাচ্ছে—পেলেন দেখতে?

বিজয়া। না।

নরেন। আপনার পেয়েও কাজ নেই। এমন মোটাবুদ্ধি আমি জন্মে দেখিনি।

বিজয়া। মোটাবুদ্ধি আমার, না আপনি দেখাতে জানেন না?

নরেন। (অনুতপ্ত-কণ্ঠে) আর কি করে দেখাব বলুন। আপনার বুদ্ধি কিছু আর সত্যিই মোটা নয়, কিন্তু আমার নিশ্চয় বোধ হচ্ছে আপনি মন দিচ্ছেন না। আমি বকে মরছি, আর আপনি মিছিমিছি ওটাতে চোখ রেখে মুখ নীচু করে হাসছেন।

বিজয়া। কে বললে আমি হাসছি?

নরেন। আমি বলছি।

বিজয়া। আপনার ভুল।

নরেন। আমার ভুল? আচ্ছা বেশ। যন্ত্রটা ত আর ভুল নয়, তবে কেন দেখতে পেলেন না?

বিজয়া। যন্ত্রটা আপনার খারাপ।

নরেন। (বিস্ময়ে) খারাপ! আপনি জানেন এরকম powerful microscope এখানে বেশী লোকের নেই? এমন বড় এবং স্পষ্ট দেখাতে—

[বলিয়া স্বচক্ষে একবার যাচাই করিয়া লইবার অতি ব্যগ্রতায়
ঝুঁকিতে গিয়া দু’জনের মাথা ঠুকিয়া গেল]

বিজয়া। উঃ। (মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে) মাথা ঠুকে দিলে কি হয় জানেন? শিং বেরোয়।

নরেন। শিং বেরুলে আপনার মাথা থেকেই বেরুনো উচিত।

বিজয়া। তা বৈ কি! এই পুরানো ভাঙ্গা microscope-কে ভাল বলিনি বলে—আমার মাথাটা শিং বেরুবার মত মাথা।

নরেন। (শুষ্ক হাসি হাসিয়া) আপনাকে সত্যি বলছি এটা ভাঙ্গা নয়। আমার কিছু নেই বলেই আপনার সন্দেহ হচ্ছে—আমি ঠকিয়ে টাকা নেবার চেষ্টা করছি, কিন্তু আপনি পরে দেখবেন।

বিজয়া। পরে দেখে আর কি করব বলুন? তখন আপনাকে আমি পাব কোথায়?

নরেন। (তিক্তস্বরে) তবে কেন বললেন আপনি নেবেন? কেন এতক্ষণ মিথ্যে কষ্ট দিলেন? আমার কলকাতা যাওয়া আজ আর হলো না।

বিজয়া। (গম্ভীরভাবে) আপনিই বা কেন না বললেন এটা ভাঙ্গা!

নরেন। (মহাবিরক্ত হইয়া) একশোবার বলছি ভাঙ্গা নয়, তবু বলবেন ভাঙ্গা? (ক্রোধ সংবরণ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া) আচ্ছা তাই ভালো! আমি আর তর্ক করতে চাইনে। এটা ভাঙ্গাই বটে। কিন্তু সবাই আপনার মত অন্ধ নয়। আচ্ছা চললুম।

[যন্ত্রটা বাক্সের মধ্যে পুরিবার উপক্রম করিল]

বিজয়া। (গম্ভীরভাবে) এখুনি যাবেন কি করে? আপনাকে যে খেয়ে যেতে হবে!

নরেন। না তার দরকার নেই।

বিজয়া। কে বললে নেই?

নরেন। কে বললে? আপনি মনে মনে হাসছেন? আমাকে কি উপহাস করছেন?

বিজয়া। আপনাকে কিন্তু নিশ্চয় খেয়ে যেতে হবে। একটু বসুন আমি এখুনি আসছি। (বিজয়া বাহির হইয়া গেল। নরেন microscope-টা বাক্সের মধ্যে পুরিয়া টিপয় হইতে নামাইয়া রাখিল। বিজয়া স্বহস্তে খাবারের থালা এবং কালীপদর হাতে চায়ের সরঞ্জাম দিয়া ফিরিয়া আসিল।) এর মধ্যেই ওটা বন্ধ করে ফেলেছেন? আপনার রাগ ত কম নয়!

নরেন। (উদাসকণ্ঠে) আপনি নেবেন না তাতে রাগ কিসের? শুধু খানিকক্ষণ বকে মরলুম এই যা।

বিজয়া। (থালাটা টেবিলের উপর রাখিয়া) তা হতে পারে। কিন্তু যেটুকু বকেছেন, সেটুকু নিছক নিজের জন্যে। একটা ভাঙ্গা জিনিস গছিয়ে দেবার মতলবে। আচ্ছা, খেতে বসুন আমি চা তৈরি করে দিই। (নরেন সোজা বসিয়া রহিল) আচ্ছা। আমিই না হয় নেব, আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে না। আপনি খেতে আরম্ভ করুন।

নরেন। আপনাকে দয়া করতে ত আমি অনুরোধ করিনি।

বিজয়া। সেদিন কিন্তু করেছিলেন। যেদিন মামার হয়ে পূজোর সুপারিশ করতে এসেছিলেন।

নরেন। সে পরের জন্যে, নিজের জন্যে নয়। এ অভ্যাস আমার নেই।

বিজয়া। তা সে যাই হোক, ওটা কিন্তু আর আপনার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া চলবে না। এখানেই থাকবে। এবার খেতে বসুন।

নরেন। এ কথার মানে?

বিজয়া। মানে একটা কিছু আছে বৈ কি?

নরেন। (ক্রুদ্ধ হইয়া) সেইটে কি তাই আমি আপনার কাছে শুনতে চাইছি। আপনি কি ওটি আটকে রাখতে চান? এও কি বাবা আপনার কাছে বাঁধা রেখেছিলেন? আপনি ত দেখছি তা হলে আমাকেও আটকাতে পারেন, বলতে পারেন বাবা আমাকেও আপনার কাছে বাঁধা দিয়ে গেছেন?

বিজয়া। (আরক্তমুখে ঘাড় ফিরাইয়া) কালীপদ, তুই দাঁড়িয়ে কি করছিস? পান নিয়ে আয়। (কালীপদ চায়ের সরঞ্জাম টেবিলে রাখিয়া চলিয়া গেল) নিন আর ঝগড়া করবেন না—এবার খেয়ে নিন।

[নরেন নিঃশব্দে গম্ভীরমুখে আহার করিতে লাগিল]

নরেন। শুনুন।

বিজয়া। শুনব পরে। আগে পেট ভরে খান।

নরেন। অনেক ত খেলুম।

বিজয়া। আরও অনেক যে পড়ে রইল।

নরেন। তা বলে আমি কি করব? আর আমি পারব না।

বিজয়া। তা জানি, আপনার কোন কিছু পারবারই শক্তি নেই। আচ্ছা microscope দেখতে শিখে আমার কি লাভ হবে?

নরেন। (সবিস্ময়ে) দেখতে শিখে কি লাভ হবে?

বিজয়া। হাঁ, তাই ত। এ শেখায় লাভ যদি আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারেন আমি খুশী হয়ে ওটা কিনব, তা যতই কেননা ভাঙ্গা হোক।

নরেন। কিনতে হবে না আপনাকে।

বিজয়া। বেশ ত বুঝিয়েই দিন না।

নরেন। দেখুন, আপনাকে দেখাতে চেয়েছিলুম—জীবাণুর গঠন। খালি চোখে ওদের দেখা যায় না—যেন অস্তিত্বই নেই। ওদের ধরা যায় শুধু ঐ যন্ত্রটার মধ্য দিয়ে। সৃষ্টি ও প্রলয়ের কত বড় শক্তি নিয়ে যে ওরা পৃথিবীময় ব্যাপ্ত হয়ে আছে—ওদের সেই জীবন-ইতিহাস—কিন্তু আপনি ত কিছুই শুনছেন না।

বিজয়া। শুনছি বৈ কি।

নরেন। কি শুনলেন, বলুন ত?

বিজয়া। বাঃ, একদিনেই নাকি শুনে শেখা যায়? আপনিই বুঝি একদিনে শিখেছিলেন?

নরেন। (হোহো করিয়া হাসিয়া) কিন্তু আপনার যে একশো বছরেও হবে না। তা ছাড়া এ-সব আপনাকে শেখাবেই বা কে?

বিজয়া। (মুখ টিপিয়া হাসিয়া) কেন আপনি। নইলে এই ভাঙ্গা কলটা আমি ছাড়া আর কে নেবে?

নরেন। আপনার নিয়েও কাজ নেই, আমি শেখাতেও পারব না।

বিজয়া। পারতেই হবে আপনাকে। জিনিস বিক্রি করে যাবেন আপনি, আর শেখাতে আসবে আর একজন? না হয় ত আর এক কাজ করুন। শুনেছি আপনি ভাল ছবি আঁকতে পারেন। তাই আমাকে শিখিয়ে দিন। এ ত শিখতে পারব।

নরেন। (উত্তেজিত হইয়া) তাও না। যে-বিষয়ে মানুষের নাওয়া-খাওয়া জ্ঞান থাকে না—তাতেই যখন মন দিতে পারলেন না—মন দেবেন ছবি আঁকতে? কিছুতেই না।

বিজয়া। তা হলে ছবি আঁকতেও শিখতে পারবো না?

নরেন। না, আপনি যে কিছুই মন দিয়ে শোনেন না!

বিজয়া। (ছদ্ম-গাম্ভীর্যের সহিত) কিছুই না শিখতে পারলে কিন্তু সত্যিই মাথায় শিং বেরোবে।

নরেন। (উচ্চহাস্য করিয়া) সেই হবে আপনার উচিত শাস্তি।

বিজয়া। (মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিয়া) তা বৈ কি! আপনার শেখবার ক্ষমতা নেই তাই কেন বলুন না। কিন্তু চাকরেরা কি করছে? আলো দেয় না কেন? একটু বসুন, আমি আলো দিতে বলে আসি।

[বিজয়া দ্রুতপদে উঠিয়া দ্বারের পর্দা সরাইয়া অকস্মাৎ যেন ভূত দেখিয়া পিছাইয়া
আসিল। পিতা-পুত্র রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী প্রবেশ করিয়া হাতের কাছে
দু’খানা চেয়ার অধিকার করিয়া বসিলেন। বিলাসের মুখের
উপর যেন এক ছোপ কালি মাখানো, এমনি বিশ্রী চেহারা।
বিজয়া আপনাকে সংবরণ করিয়া]

বিজয়া। আপনি কখন এলেন কাকাবাবু!

রাস। (শুষ্কহাস্যে) প্রায় আধঘণ্টা হলো এসে ঐ সামনের বারান্দায় বসে। কিন্তু তুমি কথাবার্তায় বড় ব্যস্ত বলে আর ডাকলাম না। ঐ বুঝি সেই জগদীশের ছেলে? কি চায় ও?

বিজয়া। (মৃদুস্বরে) একটা microscope বিক্রি করে উনি চলে যেতে চান। তাই দেখাচ্ছিলেন।

বিলাস। (গর্জন করিয়া) microscope! ঠকাবার জায়গা পেলে না বুঝি!

[নরেন ধীরে ধীরে অন্য দ্বার দিয়া বাহির হইয়া গেল]

রাস। আহা, ও-কথা বলো কেন? তার উদ্দেশ্য ত আমরা জানিনে। ভালও ত হতে পারে। অবশ্য জোর করে কিছুই বলা যায় না—সেও ঠিক। তা সে যাই হোক গে ওতে আমাদের আবশ্যক কি? দূরবীন হলেও না হয় কখনো কালেভদ্রে দূরেটুরে দেখতে কাজে লাগতে পারে।

[আলো হাতে করিয়া কালীপদ প্রবেশ করিল]

রাস। কালীপদ, সেই বাবুটি বোধ করি ওদিকে কোথাও বসে অপেক্ষা করছে, তাকে বলে দাওগে—ঐ যন্ত্রটা আমরা কিনতে পারব না—আমাদের দরকার নেই। এসে নিয়ে চলে যাক।

বিজয়া। (ভয়ে ভয়ে) তাঁকে বলেছি আমি নেব।

রাস। (আশ্চর্য হইয়া) নেবে? কেন, ওতে প্রয়োজন কি?

[বিজয়া নীরব]

রাস। উনি দাম কত চান?

বিজয়া। দুশো টাকা।

রাস। দুশো? দুশো টাকা চায়? বিলাস ত তাহলে নেহাত—কি বল বিলাস? কলেজে তোমাদের F. A.class-এ Chemistry তে এ-সব অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেছ, দুশো টাকা একটা microscope এর দাম? এ ত কেউ কখনো শোনেনি। কালীপদ, যা ওকে নিয়ে যেতে বলে আয়। এ-সব ফন্দি এখানে খাটবে না।

বিজয়া। কালীপদ, তুমি তোমার কাজে যাও। তাঁকে যা বলবার আমি নিজেই বলব।

[কালীপদর প্রস্থান

বিলাস।(শ্লেষ করিয়া) কেন বাবা তুমি মিথ্যে অপমান হতে গেলে? ওঁর হয়ত এখনো কিছু দেখিয়ে নিতে বাকী আছে। (রাসবিহারী নীরব) আমরাও অনেক রকম microscope দেখেছি বাবা, কিন্তু হোহো করে হাসবার বিষয় কোনটার মধ্যে পাইনি।

[বিজয়া তাহার দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরিয়া রাসবিহারীকে]

বিজয়া। আমার সঙ্গে কি আপনার কোন বিশেষ কথা আছে কাকাবাবু?

রাস। (অলক্ষ্যে পুত্রের প্রতি ক্রুদ্ধ কটাক্ষ করিয়া ধীরভাবে) কথা আছে বৈ কি মা। কিন্তু কিনবে বলে কি ওকে সত্যিই কথা দিয়ে ফেলেছ? সে যদি হয়ে থাকে ত নিতেই হবে। দাম ওর যাই হোক তবু নিতে হবে। সংসারে ঠকা-জেতাটাই বড় কথা নয় বিজয়া, সত্যটাই বড়। সত্যভ্রষ্ট হতে ত তোমাকে আমি বলতে পারব না।

বিলাস। তাই বলে ঠকিয়ে নিয়ে যাবে?

রাস। যাক। নিক ও ঠকিয়ে। জগদীশের ছেলের কাছে এর বেশি প্রত্যাশা করো না বিলাস। কালীপদ গিয়ে বলে আসুক কাল এসে যেন কাছারি থেকে টাকাটা নিয়ে যায়।

বিজয়া। যা বলবার আমিই তাঁকে বলব। আর কারো বলার আবশ্যক নেই কাকাবাবু।

রাস। বেশ বেশ তাই বলো মা। বলে দিও ওর কোন ভয় নেই, দুশো টাকাই যেন নিয়ে যায়।

বিজয়া । রাত হয়ে যাচ্ছে, ওঁকে অনেক দূর যেতে হবে। কাল কি আপনার সঙ্গে কথা হতে পারে না কাকাবাবু?

রাস। বেশ ত মা কালই হবে। (প্রস্থানোদ্যম—সহসা ফিরিয়া) কিন্তু শুনেছ বোধ হয় তোমার মন্দিরের ভাবী আচার্য দয়ালবাবু আজ সকালেই এসে পড়েছেন—মন্দির-গৃহেই আছেন—আবার কাল সকালে আমাদের সমাজের মান্যব্যক্তি যাঁরা—যাঁদের সসম্মানে আমরা আমন্ত্রণ করেছি—তাঁরা আসবেন। তোমাদের উভয়কে তাঁদের কাছে আমি পরিচিত করিয়ে দেব। আর ক’টা দিনই বা বাঁচবো মা!

বিজয়া। (সবিস্ময়ে) তাঁরা সব কালই আসবেন? কৈ আমি ত কিছুই শুনিনি!

রাস। (সবিস্ময়ে) শোনোনি? তা হলে তাড়াতাড়িতে বলতে বোধ হয় ভুলে গেছি মা।
বুড়ো বয়সের দোষই এই।

বিজয়া। কিন্তু বড়দিনের ছুটির ত এখনো অনেক বিলম্ব কাকাবাবু!

রাস। বিলম্ব বলেই ভাবলাম শুভকর্মে দেরি আর করব না। বাড়িটা ত তাঁর মন্দিরের জন্যে মনে মনে তোমরা উৎসর্গই করেছ, শুধু অনুষ্ঠানই বাকী। যত শীঘ্র পারা যায় কর্তব্য সমাপন করাই উচিত। তাঁরাও যখন আসতে রাজী হলেন তখন পুণ্যকার্য ফেলে রাখতে মন চাইলে না। বল দিকি মা, এ কি ভাল করিনি?

বিজয়া। নরেনবাবুর বড় রাত হয়ে যাচ্চে কাকাবাবু।

রাস। ও হাঁ। বেশ, ওকে ডেকে পাঠিয়ে তাই বলে দাও, দুশো টাকাই দেওয়া হবে।

বিলাস। টাকা কি খোলামকুচি? একজনের খেয়াল চরিতার্থ করতে দুশো টাকা নষ্ট করতে হবে? তুমি তাতেই রাজি হচ্চো?

রাস। বিলাস, ক্ষুণ্ণ হ’য়ো না বাবা। তোমাদের অনেক আছে—যাক দুশো। নিয়ে যাক ও দুশো টাকা। মা বিজয়া আমার দয়াময়ী, দুঃখীকে সামান্য ক’টা টাকা যদি সাহায্য করতেই চান বিরক্ত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আর নয় বাবা, অন্ধকার হয়ে আসছে, চল। কাল সকালে অনেক কাজ অনেক ঝঞ্ঝাট পোহাতে হবে। চল যাই। আসি মা বিজয়া।

[রাসবিহারী নিষ্ক্রান্ত হইলেন। বিলাস বিজয়ার প্রতি একটা ক্রুদ্ধ
কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া পিতার অনুসরণ করিল]

বিজয়া। (ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া) কালীপদ?

[নেপথ্যে ‛যাই মা’ বলিয়া কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ, নরেনবাবু বোধ হয় বাইরে কোথাও বসে আছেন। তাঁকে ডেকে নিয়ে এসো।

[কালীপদ মাথা নাড়িয়া প্রস্থান করিল

নরেন। (প্রবেশ করিয়া) এটা আমি সঙ্গে নিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু আজকের দিনটা আপনার বড় খারাপ গেল। অনেক অপ্রিয় কথা আমি নিজেও আপনাকে বলেছি। ওঁরাও বলে গেলেন। কি জানি কার মুখ দেখে আজ আপনার প্রভাত হয়েছিল!

বিজয়া। তার মুখ দেখেই যেন আমার প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গে নরেনবাবু! বাইরে দাঁড়িয়ে আপনি সমস্ত কথা নিজেই শুনতে পেয়েছেন বলেই বলছি যে, আপনার সম্বন্ধে তাঁরা যে সব অসম্মানের কথা বলে গেলেন সে তাঁদের অনধিকার-চর্চা। কাল আমি সে কথা তাঁদের বুঝিয়ে দেব।

নরেন। তার আবশ্যক কি? এ-সব জিনিসের ধারণা নেই বলেই তাঁদের আমার উপর সন্দেহ জন্মেছে—নইলে আমাকে অপমান করায় তাঁদের লাভ নেই কিছু। কিন্তু রাত হয়ে যাচ্ছে, আমি যাই এবার।

বিজয়া। কাল কি পরশু একবার আসতে পারবেন না?

নরেন। কাল কি পরশু? কিন্তু তার ত আর সময় হবে না। কাল আমাকে কলকাতায় যেতে হবে। সেখানে দু’-তিনদিন থেকেই এটা বিক্রি করে আমি চলে যাব। আর বোধ করি দেখা হবে না।

[বিজয়ার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া গেল, সে না পারিল
মুখ তুলিতে, না পারিল কথা কহিতে।]

নরেন। (একটু হাসিয়া) আপনি নিজে এত হাসাতে পারেন, আর আপনারই এত সামান্য কথায় রাগ হয়! আমিই বরঞ্চ একবার রেগে উঠে আপনাকে মোটাবুদ্ধি প্রভৃতি কত কি বলে ফেলেছি। কিন্তু তাতে ত রাগ করেন নি, বরঞ্চ মুখ টিপে হাসছিলেন দেখে আমার আরও রাগ হচ্ছিল। কিন্তু দেখা যদি আর আমাদের নাও হয় আপনাকে আমার সর্বদা মনে পড়বে।

[বিজয়া মুখ ফিরাইয়া অশ্রু মুছিতে গিয়া নরেনের চোখে পড়িয়া
গেল, সে ক্ষণকাল সবিস্ময়ে নিরীক্ষণ করিয়া]

নরেন। একি! আপনি কাঁদছেন যে! না—না, এটা নিতে পারলেন না বলে কোনো দুঃখ করবেন না। কলকাতায় আমি সত্যিই বেচতে পারব, আপনি ভাববেন না।

[এই বলিয়া সে বাক্সটি ধীরে ধীরে হাতে তুলিয়া লইল।]

বিজয়া। না আমি দেব না, ওটা আমার। রেখে দিন।

[কান্না চাপিতে না পারিয়া টেবিলের উপর মাইক্রস্কোপটির উপর মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া
কাঁদিতে লাগিল। নরেন হতবুদ্ধিভাবে একটু দাঁড়াইয়া
ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।]

বিজয়া – ২.২

দ্বিতীয় দৃশ্য

গ্রাম্যপথ

[আমন্ত্রিত পুরুষ ও মহিলারা বিজয়ার গৃহ কৃষ্ণপুর গ্রামের অভিমুখে ধীরে ধীরে গল্প করিতে করিতে চলিয়াছেন। রঙ্গমঞ্চে সকলেই একত্রে প্রবেশ করিবেন না, দুইজনে প্রবেশ করিয়া বাহির হইয়া গেলে আবার দুই-তিনজন প্রবেশ করিবেন]

১ম। দয়ালবাবুই আচার্য হবেন, এ কি স্থির হয়েছে?

২য়। হাঁ স্থির বৈ কি। তিনি কালই এসে পৌঁচেছেন শুনতে পেলাম।

১ম। কিন্তু তাঁর উপাসনা ত শুনেছি তেমন হৃদয়গ্রাহী নয়। ঢাকার যোগেশবাবুর পিতৃশ্রাদ্ধে সান্ধ্য-উপাসনাটা তাই আমাকেই করতে হলো। শরীর অসুস্থ, সর্দিতে গলা ভাঙ্গা, বার বার অস্বীকার করলাম, কিন্তু কেহ ছাড়লেন না। কিন্তু করুণাময়ের কি অপার করুণা! এই দীনহীনের উপাসনা শুনে সেদিন উপস্থিত সকলকেই ঘন ঘন অশ্রুপাত করতে হলো। মহিলাদের ত কথাই নেই। ভাবাবেশে তাঁরা প্রায় বিহ্বল হয়ে পড়লেন।

২য়। তাতে সন্দেহ কি? আপনার উপাসনা যে এক স্বর্গীয় বস্তু!

১ম। কিন্তু ত্রিশ টাকার কমে ত দয়ালবাবুর সংসারযাত্রা নির্বাহ হতে পারে না।

২য়। ত্রিশ টাকা কি বলছেন প্রভাতবাবু? বনমালীবাবুর এস্টেটে তাঁকে সামান্য কি একটু কাজও করতে হবে, শুনেছি সত্তর টাকা করে দেওয়া হবে। বাড়িভাড়া ত লাগবেই না।

১ম। বলেন কি? সত্তর টাকা! ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করুন!

২য়। তা ছাড়া বনমালীবাবুর মেয়েটি শুনেছি যেমন সুশীলা তেমনি দয়াবতী। প্রসন্ন হলে একশো টাকা হওয়াও বিচিত্র নয়।

১ম। এক—শো! পল্লীগ্রামে ত কোন খরচই নেই! একশো! ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করুন। বড় সুসংবাদ। একটু দ্রুত চলুন। তাঁর প্রাতঃকালীন উপাসনায় যেন যোগ দিতে পারি।

[প্রস্থান]

[৩য়, ৪র্থ ও ৫ম ভদ্রব্যক্তির প্রবেশ। সঙ্গে জন-দুই মহিলা]

৩য়। এ বিবাহ যদি ঘটে বনমালীবাবুর কন্যা ভাগ্যবতী—এ কথা বলতেই হবে। বিলাসবিহারী অতি সুপাত্র। যেমন বলবান, তেমনি উদ্যমশীল। যেমন ভগবদ্ভক্তি, তেমনি স্বধর্মনিষ্ঠা। সমাজের উদীয়মান স্তম্ভস্বরূপ বললেও অত্যুক্তি হয় না। আধুনিক কালের শিথিল-বিশ্বাস ভ্রষ্টাচারী বহু যুবকের তিনি দৃষ্টান্তস্থল।

৪র্থ। বনমালীবাবুর সম্পত্তি কি বেশ বড়?

৩য়। বড়! অগাধ। যেমন জমিদারি তেমনি নগদ টাকা। একমাত্র কন্যার জন্যে বনমালী প্রভূত ঐশ্বর্য রেখে গেছেন। বিলাসের হাতে তা বহুগুণিত হবে আমি বললেম।

৫ম। কিন্তু শুনেচি যুবকটি একটু রূঢ়ভাষী।

৩য়। রূঢ়ভাষী নয়, স্পষ্টভাষী। সত্যের আদর তিনি জানেন। (১ম মহিলাটিকে ইঙ্গিতে দেখাইয়া) আমার স্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ে বনমালীর কন্যা বিজয়াকে দিয়ে তিনি একশো টাকা সাহায্য করিয়েছিলেন। তাদের পুরস্কার-বিতরণের জন্যে আরও একশো টাকা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

১ম মহিলা। আহা, পথের মধ্যে ও-সব কথা কেন?

৪র্থ। তা হলে বালিকা বিদ্যালয়ের দিকে ত তাঁদের বেশ ঝোঁক আছে?

৩য়। ঝোঁক? মুক্তহস্ত।

৪র্থ। মুক্তহস্ত? বেশ বেশ, মঙ্গলময় তাঁদের মঙ্গল-বিধান করুন।

[প্রস্থান।

[৬ষ্ঠ ও ৭ম ব্যক্তিদ্বয়ের প্রবেশ]

৬ষ্ঠ। না আর দূর নেই, আমরা এসে পড়েছি। হাঁ স্বর্গীয় বনমালীবাবুর সম্পত্তির সমস্ত ভার তাঁর বাল্যবন্ধু রাসবিহারীবাবুর পরেই। শুধু এখন নয়, বরাবরই এই ব্যবস্থা। বনমালীবাবু সেই যে দেশ ছেড়ে কলকাতায় এসেছিলেন আর ত কখনো ফিরে যাননি।

৭ম। তাঁর কন্যার সঙ্গে রাসবিহারীবাবুর পুত্রের বিবাহ কি স্থির হয়ে গেছে?

৬ষ্ঠ। স্থির বৈ কি। সম্বন্ধ কন্যার পিতা নিজেই করে যান, হঠাৎ মৃত্যু না হলে বিবাহ তিনিই দিয়ে যেতেন।

৭ম। এ বিবাহ কি গ্রামেই হবে?

৬ষ্ঠ। এই কথাই তো রাসবিহারীবাবু সেদিন নিজেই বললেন। শুধু তাই নয়, বিয়ের পর ছেলে-বৌ দেশেই বাস করবে, শহরের নানা প্রলোভনের মধ্যে তাদের পাঠাবেন না এই তাঁর সঙ্কল্প। অন্ততঃ, যতদিন বেঁচে আছেন। বিশেষতঃ, এত বড় সম্পত্তি দূর থেকে দেখাশোনা যায় না, নষ্ট হবার ভয় থাকে। নিজের জীবিতকালেই সমস্ত কাজকর্ম ছেলেকে শিখিয়ে দিয়ে যাবেন।

৭ম। অতিশয় সৎ বিবেচনা। বিবাহ হবে কবে।?

৬ষ্ঠ। ইচ্ছা যত শীঘ্র সম্ভব। মন্দির-প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই কথাবার্তা বোধ করি আপনাদের সম্মুখেই পাকা হয়ে যাবে। এ বড় সুখের বিবাহ অবিনাশবাবু। বর-বধূর পরে ভগবান তাঁর শুভহস্ত প্রসারিত করুন আমরা এই প্রার্থনা করি। চলুন, এই বাগানটার শেষেই বনমালীবাবুর বাড়ি।

৭ম। আপনি কি পূর্বে এখানে এসেছিলেন?

৬ষ্ঠ। (সহাস্যে) বহুবার। রাসবিহারীবাবু আমার অনেককালের বন্ধু। তিনি পত্রে জানিয়েছেন, নূতন মন্দির-গৃহটি আছে নদীর ওপারে—একটু দূরে। আমাদের থাকার জায়গাও সেইখানেই নির্দিষ্ট হয়েছে, কিন্তু বিজয়ার ইচ্ছে আজ সকালেই একটি ছোট অনুষ্ঠান তাঁর গৃহেই সম্পন্ন হয় এবং পরে সে-বাড়িতে যাই।

৭ম। উওম প্রস্তাব। চলুন, আমাদের হয়ত বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে।

[প্রস্থান

বিজয়া – ২.৩

তৃতীয় দৃশ্য

বিজয়ার বাড়ির নীচে হলঘর

[বেলা পূর্বাহ্ন। বিজয়ার অট্টালিকার নীচের বড় ঘরটি ফুল-লতা-পাতা দিয়া কিছু কিছু সাজানো হইয়াছে, মাঝখানে দাঁড়াইয়া রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী এই-সকল পরীক্ষা করিতেছিলেন, এমন সময়ে সদ্যসমাগত অতিথিগণ একে একে প্রবেশ করিলেন]

রাসবিহারী। (বদ্ধাঞ্জলিপূর্বক) স্বাগতম্‌! স্বাগতম্‌! আজ শুধু এই গৃহ নয়, আজ আমাদের সমস্ত গ্রামখানি আপনাদের চরণধূলিতে চরিতার্থ হলো। আজ আমি ধন্য। আপনার আসন গ্রহণ করুন।

১ম। আমরাও তেমনি ধন্য হয়েছি রাসবিহারীবাবু, এমন পুণ্যকর্মে আমন্ত্রিত হয়ে যোগ দিতে পারা জীবনের সৌভাগ্য।

রাস। পথে কোন ক্লেশ হয়নি ত?

সকলে। না না, কিছুমাএ না। কোন ক্লেশ হয়নি।

রাস। হবার কথাও নয় যে। এ যে তাঁর সেবা তাঁর কর্ম নিয়েই আপনাদের আগমন,—মানবজাতির পরম কল্যাণের জন্যই ত সকলে সমবেত হয়েছি।

১ম ব্যক্তি। ওঁ স্বস্তি! ওঁ স্বস্তি! ওঁ স্বস্তি!

রাস। স্বর্গগত বনমালীর কন্যা বিজয়া এবং তাঁর ভাবী জামাতা বিলাসবিহারী—এ মঙ্গল অনুষ্ঠান তাঁদেরই। আমি কেউ নয়—কিছুই নয়। শুধু চোখে দেখে পুণ্য সঞ্চয় করে যাব এই আমার একমাত্র বাসনা। বাবা বিলাস, মা বিজয়া বুঝি এখনও খবর পাননি। কালীপদকে ডেকে বলে দাও পূজনীয় অতিথিরা পৌঁচেছেন।

বিলাস। কিন্তু খবর পাওয়া তাঁর উচিত ছিল।

[বিলাসের প্রস্থান

২য় ব্যক্তি। শুনেছি দয়ালবাবু ইতিপূর্বেই এসেচেন, কৈ তাঁকে ত—

রাস। দুর্ভাগ্যক্রমে এসেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আজ ভাল আছেন। তিনি এলেন বলে।

১ম ব্যক্তি। আচার্যের কাজ ত?—

রাস। হাঁ তিনিই সম্পাদন করবেন স্থির হয়েছে—এই যে নাম করতেই তিনি—আসুন, আসুন, দয়ালবাবু আসুন। দেহটা সুস্থ হয়েছে?

[দয়ালচন্দ্রের প্রবেশ ও সকলকে অভিবাদন]

শরীর দুর্বল, নিজে গিয়ে সংবাদ নিতে পারিনি, কিন্তু ওঁর কাছে (ঊর্ধ্বমুখে চাহিয়া) নিরন্তর প্রার্থনা করছি আপনি শীঘ্র নিরাময় হন, শুভকর্মে যেন বিঘ্ন না ঘটে।

[ইহার পরে কিয়ৎকাল ধরিয়া সকলের কুশল-প্রশ্নাদি ও প্রীতিসম্ভাষণ
চলিল। সকলে পুনরায় উপবেশন করিলে]

রাস। আমার আবাল্য সুহৃদ বনমালী আজ স্বর্গগত। ভগবান তাঁকে অসময়ে আহ্বান করে নিলেন—তাঁর মঙ্গল ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার নালিশ নেই, কিন্তু তিনি যে আমাকে কি করে রেখে গেছেন আমার বাইরে দেখে সে আপনারা অনুমান করতে পারবেন না। আমাদের উভয়ের সাক্ষাতের ক্ষণটি যে প্রতিদিন নিকটবর্তী হয়ে আসছে সে আভাস আমি প্রতিমুহূর্তেই পাই। তবুও সেই পরমব্রহ্মপদে এই প্রার্থনা আমার, সেই দিনটিকে যেন তিনি আরও সন্নিকটবর্তী করে দেন। (রাসবিহারী জামার হাতায় চোখটা মুছিয়া আত্মসমাহিতভাবে রহিলেন। উপস্থিত অভ্যাগতরাও তদ্রূপ করিলেন। আবার কিছুকাল চুপ করিয়া থাকিয়া) বনমালী আমাদের মধ্যে আজ নেই—তিনি চলে গেছেন; কিন্তু আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই, ওই তিনি মৃদু মৃদু হাস্য করছেন। (সকলেই চোখ বুজিলেন। এই সময় বিজয়া ও বিলাস প্রবেশ করিলেন। বিজয়ার মুখের উপর বিষাদ ও বেদনার চিহ্ন ঘনীভূত হইয়া উঠিয়াছে তাহা স্পষ্ট দেখা যায়) ওই তাঁর একমাত্র কন্যা বিজয়া, পিতার সর্বগুণের অধিকারিণী! আর ঐ আমার পুত্র বিলাসবিহারী, কর্তব্যে কঠোর, সত্যে নির্ভীক। এঁরা বাইরে এখনো আলাদা হলেও অন্তরে—হাঁ আরও একটি শুভদিন আসন্ন হয়ে আসছে, যেদিন আবার আপনাদের পদধূলির কল্যাণে এঁদের সম্মিলিত নবীন জীবন ধন্য হবে।

দয়াল। (অস্ফুটস্বরে) ওঁ স্বস্তি!

রাস। মা বিজয়া, ইনিই তোমার মন্দিরের ভাবী আচার্য দয়ালচন্দ্র, এঁকে নমস্কার কর। আর এঁরা তোমার সম্মানিত পূজনীয় অতিথিগণ, এঁরা বহু ক্লেশ স্বীকার করে তোমাদের পুণ্যকার্যে যোগ দিতে এসেছেন,—এঁদের সকলকে নমস্কার কর।

[বিজয়া হাত তুলিয়া নমস্কার করিল। বৃদ্ধ দয়াল বিজয়ার
কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন। হাত ধরিয়া বলিলেন।]

দয়াল। এসো মা, এসো। মুখখানি দেখলেই মনে হয় যেন মা আমাদের কতকালের চেনা!

[এই বলিয়া টানিয়া নিজের পাশে বসাইলেন—অনেকে মুখ টিপিয়া হাসিল]

রাস। দয়ালবাবু, আমার সহোদরের অধিক স্বর্গীয় বনমালীর এই শুভকর্ম—একমাত্র কন্যার বিবাহ—চোখে দেখে যাবার বড় সাধ ছিল, শুধু আমার অপরাধেই তা পূর্ণ হতে পারেনি। (কিছুকাল নীরব থাকিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) কিন্তু এবার আমার চৈতন্য হয়েছে, তাই নিজের শরীরের দিকে চেয়ে এই আগামী অঘ্রাণের বেশি আর বিলম্ব করবার সাহস হয় না। কি জানি আমিও না পাছে চোখে দেখে যেতে পারি।

দয়াল। (অস্ফুটস্বরে) ওঁ শান্তি! ওঁ শান্তি!
রাস। (বিজয়ার প্রতি) মা, তোমার বাবা, তোমার জননী সাধ্বী সতী বহু পূর্বেই স্বর্গারোহণ করেছেন, নইলে এ কথা আজ আমার তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে হতো না। লজ্জা করো না মা, বল আজ এইখানেই আমাদের এই পূজনীয় অতিথিগণকে আগামী অঘ্রাণ মাসেই আবার একবার পদধূলি দানের আমন্ত্রণ করে রাখি।

বিজয়া। (অব্যক্ত-কণ্ঠে) বাবার মৃত্যুর এক বৎসরের মধ্যেই কি—(কথা বাধিয়া গেল)

রাস। ওহো—ঠিক ত মা, ঠিক ত। এ যে আমার স্মরণ ছিল না। কিন্তু তুমি আমার মা কিনা, তাই এ বুড়ো ছেলের ভুল ধরিয়ে দিলে। (বিজয়া আঁচলে চোখ মুছিল) তাই হবে। কিন্তু তারও ত আর বিলম্ব নেই। (সকলের দিকে চাহিয়া) বেশ আগামী বৈশাখেই শুভকর্ম সম্পন্ন হবে। আপনাদের কাছে এই আমাদের পাকা কথা রইল। বিলাসবিহারী, বাবা বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে, এঁদের ও-বাড়িতে যাবার ব্যবস্থা করে দাও। আসুন আপনারা।

[বিজয়া ব্যতীত সকলেই প্রস্থান করিলেন,
দয়াল ক্ষণকাল পরেই ফিরিয়া আসিলেন]

দয়াল। মা বিজয়া!

বিজয়া। (চমকিত হইয়া নিজেকে সংবরণ করিয়া) আসুন।

দয়াল। এঁরা সবাই দিঘ্‌ড়ার বাড়িতে চলে গেলেন। বিলাসবাবু তাঁদের ব্যবস্থা করে দিয়ে তাঁর আফিসঘরে গিয়ে ঢুকলেন। আমাকেও সঙ্গে যেতে বলেছিলেন, কিন্তু যেতে আমার ইচ্ছে হলো না—ভাবলুম এই অবসরে মা বিজয়ার সঙ্গে দুটো কথা কয়ে নিই। (এই বলিয়া নিজে একটা চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন) দাঁড়িয়ে কেন মা, তুমিও বসো।

বিজয়া। (সম্মুখের আসনে উপবেশন করিয়া শঙ্কিত-কণ্ঠে কহিল) আপনি গেলেন না কেন? আপনার ত বেলা হয়ে যাবে!

দয়াল। তা যাক। একটু বেলাতে আর আমার ক্ষতি হবে না। তোমার সঙ্গে দু’দণ্ড কথা কইবার লোভ সামলাতে পারলুম না। অনেক দেখেছি, কিন্তু তোমার মত অল্প বয়সে ধর্মের প্রতি এমন নিষ্ঠা আমি দেখিনি। ভগবানের আশীর্বাদে তোমাদের মহৎ উদ্দেশ্য দিনে দিনে শ্রীবৃদ্ধি লাভ করুক। কিন্তু মা, তোমার মুখ দেখে মনে হলো যেন মনে তোমার আজ সুখ নেই। কেমন মা?

বিজয়া। কি করে জানলেন?

দয়াল। (মৃদু হাসিয়া) তার কারণ আমি যে বুড়ো হয়েছি মা! ছেলেমেয়ে অসুখী থাকলে বুড়োরা টের পায়।

বিজয়া। কিন্তু সকলেই ত টের পায় না দয়ালবাবু।

দয়াল। তা জানিনে মা। কিন্তু আমার ত তাই মনে হলো। এর জন্যেই চলে যেতে পারলুম না। আবার ফিরে এলুম।

বিজয়া। ভালই করেছেন দয়ালবাবু।

দয়াল। কিন্তু একটা বিষয়ে সাবধান করে দিই। বুড়োরা বকতে বড় ভালবাসে—ইচ্ছে করে তোমার কাছে বসে খুব খানিকটা বকে নিই, কিন্তু ভয় হয় পাছে বিরক্ত করে তুলি।

বিজয়া। না—না, বিরক্ত হব কেন? আপনার যা ইচ্ছে হয় বলুন না—শুনতে আমার ভালই লাগছে।

দয়াল। কিন্তু তাই বলে বুড়োদের অত প্রশ্রয়ও দিয়ো না মা। থামাতে পারবে না। আরও একটা হেতু আছে। আমার একটি মেয়ে হয়ে অল্প বয়সেই মারা যায়—বেঁচে থাকলে সে তোমার বয়সই পেতো। তোমাকে দেখে পর্যন্ত কেবল আমার তাকেই আজ মনে পড়ছে।

বিজয়া। আপনার বুঝি আর মেয়ে নেই?

দয়াল। মেয়েও নেই, ছেলেও নেই, শুধু বুড়ো-বুড়ী বেঁচে আছি। একটি ভাগনীকে মানুষ করেছিলুম, তার নাম নলিনী। কলেজের ছুটি হয়েছে বলে সেও আমার সঙ্গে এসেছে। একটু অসুস্থ নইলে—

[সহসা বিলাস প্রবেশ করিল]

বিলাস। (বিজয়ার প্রতি কঠিনভাবে) তাঁরা চলে গেলেন, তুমি একটা খোঁজ পর্যন্ত নিলে না? একে বলে কর্তব্যে অবহেলা। এ আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি। (দয়ালের প্রতি ততোধিক কঠোরভাবে) আপনাকে বলেছিলুম ওঁদের সঙ্গে যেতে। না গিয়ে এখানে বসে গল্প করচেন কেন?

দয়াল। (অপ্রতিভভাবে) মা’র সঙ্গে দুটো কথা কইবার জন্যে—আচ্ছা, আমি তা হলে যাই এখন।

বিজয়া। না, আপনি বসুন। বেলা হয়ে গেছে, এখানে খেয়ে তবে যেতে পাবেন। (বিলাসের প্রতি) উনি সঙ্গে গেলে তাঁদের কি বেশী সুবিধে হতো?

বিলাস। তাঁদের দেখাশুনা করতে পারতেন।

বিজয়া। সে ওঁর কাজ নয়। তাঁদের মত দয়ালবাবুও আমার অতিথি।

বিলাস। না, ওঁকে অতিথি বলা চলে না। এখন উনি এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত। ওঁকে মাইনে দিতে হবে।

বিজয়া। (ক্রোধে মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল কিন্তু শান্ত-কঠিনকণ্ঠে কহিল) দয়ালবাবু আমাদের মন্দিরের আচার্য। ওঁর সে সম্মান ভুলে যাওয়া অত্যন্ত ক্ষোভের ব্যাপার বিলাসবাবু।

বিলাস। (কটুকণ্ঠে) সে সম্মানবোধ আমার আছে, তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। কিন্তু দয়ালবাবু শুধু আচার্যই নন, ওঁর অন্য কাজও আছে। সে স্বীকার করেই উনি এসেছেন।

দয়াল। (ব্যস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়া) মা, আমার অপরাধ হয়ে গেছে, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

বিজয়া। না, আপনি বসুন, আপনাকে খেয়ে যেতে হবে। আর মাইনে ত উনি দেন না, দিই আমি। আমার সঙ্গে দু’দণ্ড গল্প করাটাকে আমি যদি অকাজ না মনে করি, তবে বুঝতে হবে আপনার কর্তব্যে ত্রুটি হয়নি। বিলাসবাবুর কর্তব্যের ধারণা যাই কেন না হোক।

বিলাস। না, কর্তব্যের ধারণা আমাদের এক নয়। এবং তোমাকে বলতে আমি বাধ্য যে তোমার ধারণা ভুল।

বিজয়া। তা হলে সেই ভুল ধারণাটাই আমার এখানে চলবে বিলাসবাবু।

বিলাস। তোমার ভুলটাকেই আমায় স্বীকার করে নিতে হবে নাকি?

বিজয়া। স্বীকার করে নিতে ত আমি বলিনি, আমি বলেচি সেইটেই এখানে চলবে।

বিলাস। তুমি জানো এতে আমার অসম্মান হয়।

বিজয়া। (অল্প হাসিয়া) সম্মানটা কি কেবল একলা আপনার দিকেই থাকবে নাকি?

দয়াল। (ব্যস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়া) মা, এখন আমি যাই, দেখি গে তাঁদের কোন অসুবিধা হচ্ছে নাকি।

বিজয়া। না, সে হবে না। আমাদের গল্প এখনও শেষ হয়নি। আপনি বসুন।(একটু উচ্চকণ্ঠে) কালীপদ!

কালীপদ। (দ্বারের কাছে মুখ বাড়াইয়া সাড়া দিল) কি মা?

বিজয়া। পরেশের মাকে বলো গে দয়ালবাবু এখানে খাবেন। আমার শোবার ঘরের বারান্দায় তাঁর ঠাঁই করে দিতে বলে দাও। চলুন দয়ালবাবু, আমরা ওপরে গিয়ে বসি গে।

[বিজয়া ও তাহার পিছনে দয়ালবাবু সভয়-মন্থরপদে প্রস্থান করিলেন। বিলাস সেইদিকে
ক্ষণকাল আরক্তনেত্রে চাহিয়া বাহির হইয়া গেল]

বিজয়া – ২.৪

চতুর্থ দৃশ্য

বাটীর একাংশের ঢাকা বারান্দা

[নরেন প্রবেশ করিল। পরনে সাহেবী পোশাক, টুপি খুলিয়া সেটা বগলে চাপিয়া হাতের লাঠিটা একধারে ঠেস দিয়া রাখিল]

নরেন। (এদিকে-ওদিকে চাহিয়া) উঃ—কোথাও একফোঁটা হাওয়া নেই। আর এই বিজাতীয় পোশাকে যেন আরও ব্যাকুল করে তুলেছে। এদিকে কি কেউ নেই নাকি? এই যে কালীপদ—

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

নরেন। কালীপদ, তোমার মা-ঠাকরুনকে একটা খবর দিতে পার?

কালীপদ। দিতে হবে না, মা নিজেই নেমে আসচেন। ভেতরে গিয়ে বসবেন না বাবু?

নরেন। না বাপু, ঘরে ঢুকে আর দম আটকাতে চাইনে,—এখান থেকেই কাজ সেরে পালাব। বারোটার ট্রেনেই ফিরতে হবে।

কালীপদ। হাঁ বাবু, আজ বড় গরম, কোথাও বাতাস নেই। তবে এখানেই একটা চেয়ার এনে দিই বসুন।

[কালীপদ চেয়ার আনিয়া দিল, নরেন বসিয়া টুপিটা
পায়ের কাছে রাখিয়া মুখ তুলিয়া কহিল]

নরেন। আর সুমুখের ঐ জানালাটা একবার খুলে দাও, নিশ্বেস ফেলে বাঁচি।

কালীপদ। ওটা খোলা যায় না। এখন মিস্ত্রী কোথায় পাব বাবু?

নরেন। মিস্ত্রী কি হে? দোর-জানালা কি তোমরা মিস্ত্রী দিয়ে খোলাও, আর রাত্তিরে পেরেক ঠুকে বন্ধ করো?

কালীপদ। আজ্ঞে না, কেবল এইটেই কিছুতে খোলা যায় না। মা ক’দিন ধরে মিস্ত্রী ডাকতে বলছিলেন।

নরেন। এমন কথাও ত শুনিনি। কৈ দেখি, (নিকটে গিয়া টানিয়া খুলিয়া ফেলিয়া) একটুখানি চেপে বসেছিল। তোমার মা-ঠাকরুনকে একবার ডাক।

কালীপদ। এই যে আসচেন।

[বিজয়া প্রবেশ করিতেই নরেন সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়া চাহিল]

নরেন। নমস্কার। বাঃ—কি চমৎকার দেখাচ্ছে আপনাকে। যে কেউ ছবি আঁকতে জানে—আপনাকে দেখে তারই আজ লোভ হবে।

বিজয়া। কালীপদ, আমাকে বসবার একটা জায়গা এনে দাও। আর বল গে বাবুর জন্যে চা করতে। এখনও চা খাওয়া হয়নি বোধ হয়?

নরেন। না, কলকাতা থেকে সকালেই বেরিয়ে পড়েছিলুম। স্টেশন থেকে সোজা আসচি।

[কালীপদ চলিয়া গেল

বিজয়া। আপনাকে কি আমার ছবি আঁকবার বায়না নিতে ডেকেছি যে আমাকে ও-রকম অপদস্থ করলেন?

নরেন। অপদস্থ করলুম কোথায়?

বিজয়া। চাকরদের সামনে কি ঐরকম বলে? কাণ্ডজ্ঞান কি একেবারে নেই?

নরেন। (লজ্জিতমুখে) হাঁ, তা বটে। দোষ হয়ে গেচে সত্যি।

বিজয়া। আর যেন কখনো না হয়।

[কালীপদ চেয়ার লইয়া প্রবেশ করিল]

কালীপদ। বলে এলুম মা। অমনি কিছু খাবার করতেও বলে আসব?

বিজয়া। হাঁ, বলগে। (জানালার প্রতি চোখ পড়ায়) এই যে তবু একটা কথা শুনেছিস কালীপদ। কাকে দিয়ে জানালাটা খোলালি?

কালীপদ। (ইঙ্গিতে দেখাইয়া) উনি খুলে দিলেন।

[এই বলিয়া সে বাহিরে গিয়া একটা ছোট টিপয় আনিয়া নরেনের পাশে রাখিয়া চলিয়া গেল]

বিজয়া। আপনি? কি করে খুললেন?

নরেন। হাত দিয়ে টেনে।

বিজয়া। শুধু হাতে টেনে খুলেছেন? অথচ ওরা সবাই বলে মিস্ত্রী ছাড়া খুলবে না। আপনার হাতটা কি লোহার নাকি?

নরেন। (সহাস্যে) হাঁ, আমার আঙুলগুলো একটু শক্ত।

বিজয়া। (হাসি চাপিয়া) আপনার মাথাটাই কি কম শক্ত? ঢুঁ মারলে যে-কোন লোকের মাথাটা ফেটে যায়।

নরেন। (উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল, তারপরে পকেট হইতে নোট বাহির করিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া) এই নিন আপনার দুশো টাকা। দিন, আমার সেই ভাঙ্গা যন্ত্রটা। (একটু হাসিয়া) আমি জোচ্চোর, ঠক, আরও কত কি গালাগালি ওই ক’টা টাকার জন্যে আমাকে বলে পাঠিয়েছিলেন। নিন, আপনার টাকা,—দিন আমার জিনিস।

বিজয়া। ঠক, জোচ্চোর কাকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলুম?

নরেন। যাকে দিয়ে টাকা পাঠিয়েছিলেন সেই ত ও-সব বলেছিল।

বিজয়া। তাকে দিয়ে আর কি বলে পাঠিয়েছিলুম মনে আছে?

নরেন। না, আমার মনে নেই। কিন্তু সেটা আনতে বলে দিন, আমি দুপুরের ট্রেনেই কলকাতা ফিরে যাব। ভালো কথা, আমি কলকাতাতেই একটা চাকরি পেয়ে গেছি। বেশী দূরে আর যেতে হয়নি।

বিজয়া। (মুখ উজ্জ্বল করিয়া) আপনার ভাগ্য ভালো। টাকা কি তারাই দিলে?

নরেন। হাঁ, কিন্তু microscope-টা আমার আনতে বলে দিন। আমার বেশী সময় নেই।

বিজয়া। কিন্তু এই শর্ত কি আপনার সঙ্গে হয়েছিল যে, দয়া করে আপনি টাকা এনেছেন বলেই তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিতে হবে?

নরেন। (সলজ্জে) না, না—তা ঠিক নয়। তবে কিনা ওটা ত আপনার কাজে লাগল না, তাই ভেবেছিলুম টাকা দিলেই আপনি ফিরিয়ে দিতে রাজী হবেন।

বিজয়া। না, আমি রাজী নই, যাচাই করে দেখিয়েচি ওটা অনায়াসে চারশো টাকায় বিক্রি করতে পারি। দুশো টাকায় দেব কেন?

নরেন। (সোজা হইয়া উঠিয়া বসিয়া) বেশ, তবে তাই করুন গে। আমার দরকার নেই। যে দু’শো টাকায় দু’দিন পরেই চারশো টাকা চায় তাকে আমি কিছুই বলতে চাইনে।

[বিজয়া মুখ নিচু করিয়া অতিকষ্টে হাসি দমন করিল]

নরেন। আপনি যে একটি ‘সাইলক’ তা জানলে আসতুম না।

বিজয়া। সাইলক? কিন্তু দেনার দায়ে যখন আপনার বাড়িঘর, আপনার যথাসর্বস্ব আত্মসাৎ করে নিয়েছিলুম, তখন কি ভাবেন নি আমি সাইলক?

নরেন। না ভাবিনি, কেননা তাতে আপনার হাত ছিল না। সে কাজ আপনার বাবা এবং আমার বাবা দু’জনে করে গিয়েছিলেন। আমরা কেউ তার জন্যে অপরাধী নই। আচ্ছা আমি চললুম।

বিজয়া। যাবেন কি রকম? আপনার জন্যে চা করতে গেছে না?

নরেন। চা খেতে আমি আসিনি।

বিজয়া। কিন্তু যেজন্যে এসেছিলেন সে ত আর সত্যিই হতে পারে না। চারশো টাকার জিনিস আপনাকে দুশো টাকায় দেবে কে? আপনার লজ্জাবোধ করা উচিত।

নরেন। আমার লজ্জাবোধ করা উচিত? উঃ—আচ্ছা মানুষ ত আপনি?

বিজয়া। হাঁ, চিনে রাখুন। ভবিষ্যতে আর কখনো ঠকাবার চেষ্টা করবেন না।

নরেন। ঠকানো আমার পেশা নয়।

বিজয়া। তবে কি পেশা? ডাক্তারি? হাত দেখতে জানেন? (এই বলিয়া হঠাৎ হাসিয়া ফেলিল)

নরেন। আমি কি আপনার উপহাসের পাত্র? টাকা আপনার ঢের থাকতে পারে—কিন্তু সে জোরে ও-অধিকার জন্মায় না তা জানবেন। আপনি একটু হিসেব করে কথা কইবেন।

[নরেন উঠিয়া দাঁড়াইয়া হাতে লাঠি তুলিয়া লইল]

বিজয়া। নইলে কি বলুন না? আপনার গায়ে জোর আছে এবং হাতে লাঠি আছে এই ত?

নরেন। (লাঠিটা ফেলিয়া হতাশভাবে বসিয়া) ছিঃ ছিঃ—আপনি মুখে যা আসে তাই বলেন। আপনার সঙ্গে আর পারি না।

বিজয়া। এ কথা মনে থাকে যেন। কিন্তু আপনার জন্যেই যখন আমার দেরি হয়ে গেল, বেরোনো হলো না— তখন আপনারও চলে যাওয়া হবে না। কিন্তু আপনি নিশ্চয় হাত দেখতে জানেন!

নরেন। জানি। কিন্তু কার দেখতে হবে? আপনার?

বিজয়া। (সহসা নিজের হাত বাড়াইয়া দিয়া) দেখুন ত, আমার জ্বর হয়েছে কিনা।

নরেন। (হাত ধরিয়া) সত্যিই ত আপনার জ্বর! ব্যাপার কি?

বিজয়া। কাল রাত্তিরে একটু জ্বর হয়েছিল। কিন্তু ও কিছুই নয়। আমার জন্যে বলিনে, কিন্তু সেই পরেশ ছেলেটাকে ত আপনি জানেন—তিন দিন থেকে তার খুব জ্বর। এখানে ভাল ডাক্তার নেই। কালীপদ!

[কালীপদর প্রবেশ]

পরেশের মাকে বল ত পরেশকে এখানে নিয়ে আসুক।

নরেন। না, আনবার দরকার নেই। কালীপদ, চল ত পরেশ কোথায় শুয়ে আছে আমাকে নিয়ে যাবে।

কালীপদ। চলুন।

[নরেন ও কালীপদ প্রস্থান করিলে নলিনী প্রবেশ করিল]

নলিনী। নমস্কার! আমার নাম নলিনী। দয়ালবাবু আমার মামা হন।

বিজয়া। ও আপনি? বসুন, সেদিন মন্দির-প্রতিষ্ঠার দিন আপনি অসুস্থ ছিলেন, তাই পরিচয় করার জন্যে আপনাকে আর বিরক্ত করিনি। তারপরেই শুনলুম আপনি চলে গেছেন আপনার মামীমা পীড়িত বলে। কিন্তু মনে হচ্ছে কোথায় যেন এর আগে আপনাকে দেখছি,—আচ্ছা আপনি কি বেথুনে পড়তেন?

নলিনী। হাঁ, কিন্তু আমার ত মনে পড়ছে না!

বিজয়া। না পড়লেও দোষ নেই, কেবলি কামাই করতুম, শেষে সব সাবজেক্ট ফেল করে পড়া ছেড়ে দিলুম, আই. এ. দেওয়া আর হলো না—আপনি এবার B. Sc. দিচ্ছেন শুনলুম।

নলিনী। হাঁ, আমার মনে পড়েছে। আপনি মস্ত একটা গাড়ি করে কলেজে আসতেন।

বিজয়া। চোখে পড়বার মত ত আর কিছু নেই, তাই গাড়ি দিয়ে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতুম। ওটা মার্জনা করা উচিত।

নলিনী। ও কথা বলবেন না। দৃষ্টি পড়বার মত আপনারও যদি কিছু না থাকে তবে জগতের অল্প লোকেরই আছে। কিন্তু Dr. Mukherjee গেলেন কোথায়?

বিজয়া। গেছেন রোগী দেখতে, এলেন বলে। কিন্তু তিনি এসেছেন আপনি জানলেন কেমন করে মিস দাস?

[নরেন প্রবেশ করিল]

নলিনী। এই যে Dr. Mukherjee (বিজয়ার প্রতি) আমরা এক গাড়িতেই যে কলকাতা থেকে এলুম। স্টেশনে এসে দেখি Dr. Mukherjee দাঁড়িয়ে—সেদিন রাত্রে মন্দিরে ওঁর সঙ্গে দৈবাৎ আলাপ।কি কয়েকটা তাঁর জিনিস পড়েছিল তাই নিতে এসেছিলেন। আজ আবার হাওড়া স্টেশনেও দৈবাৎ ওঁর দেখা পেয়ে গেলুম। উনিও বললেন, থাকবার জো নেই, এই বারোটার গাড়িতেই ফিরতে হবে। আমারও তাই—ফিরতেই হবে কলকাতায়।

বিজয়া। (সহাস্যে) আপনাদের শুধু দৈবাৎ আলাপ এবং দৈবাৎ এক গাড়িতে আসাই নয়, আবার দৈবাৎ এক গাড়িতেই ফিরতে হবে। এমন দৈবাতের সমাবেশ একসঙ্গে সংসারে দেখা যায় না।

নরেন। এর মানে?

বিজয়া। (নলিনীর প্রতি) এর মানে দেবেন ত ওঁকে গাড়িতে বুঝিয়ে, মিস দাস।

নলিনী। (নরেনকে) আপনার এখানকার কাজ সারা হলো?

বিজয়া। না, সারতে পারেন নি। গৃহস্থ এখানে সজাগ ছিল। কিন্তু তার বদলে একটি রুগী পেয়েছেন—ভরাডুবির মুষ্টিলাভ!

নরেন। (রাগিয়া) আপনার যত ইচ্ছে আমাকে উপহাস করুন, কিন্তু সজাগ গৃহস্থকেও একদিন ঠকতে হয় এও জেনে রাখবেন। আপনাকে চারশো টাকাই এনে দেব, কিন্তু এ অন্যায় একদিন আপনাকে বিঁধবে। কিন্তু আর না—দেরি হয়ে যাচ্ছে, মিস দাস চলুন এবার আমরা যাই।

বিজয়া। পরেশকে কেমন দেখলেন, বললেন না?

নরেন। বিশেষ ভাল না। ওর খুব বেশী জ্বর, পিঠে গলায় বেদনা, এদিকে বসন্ত হচ্ছে, মনে হয় পরেশেরও বসন্ত হতে পারে।

বিজয়া। (সভয়ে) বসন্ত হবে কেন?

নরেন। হবে কেন সে অনেক কথা। কিন্তু ওর লক্ষণ দেখলে ওই মনে হয়। যাই হোক, ওর মাকে একটু সাবধান হতে বলবেন, আমি কাল কিংবা পরশু টাকা নিয়ে আসব, অবশ্য যদি পাই। তখন ওকে দেখে যাব।

বিজয়া। (ব্যাকুল বিবর্ণমুখে) নইলে আসবেন না? আমারও নিশ্চয় বসন্ত হবে নরেনবাবু। কাল রাত্তিরে আমারও খুব জ্বর—আমারও গায়ে ভয়ানক ব্যথা।

নরেন। (হাসিয়া) ব্যথা ভয়ানক নয়। ভয়ানক হয়েছে সে আপনার ভয়। বেশ ত জ্বরই যদি একটু হয়ে থাকে তাতেই বা কি? এদিকে বসন্ত দেখা দিয়েছে বলেই যে গ্রামসুদ্ধ সকলেরই হবে তার মানে নেই।

বিজয়া। হলেই বা আমার কে আছে? আমাকে দেখবে কে?

নরেন। দেখবার লোক অনেক পাবেন সে ভাবনা নেই, কিন্তু কিছু হবে না আপনার।

বিজয়া। না হলেই ভালো, কিন্তু সত্যিই আমি বড় অসুস্থ। তবু সকালে উঠে সব জোর করে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে একটু বাইরে যাচ্ছিলুম।

নরেন। না, আজ কোথাও যাওয়া চলবে না, চুপ করে শুয়ে থাকুন গে। কাল আবার আসব।

বিজয়া। টাকা না পেলেও আসবেন ত?

নরেন। না পেলেও আসবো।

বিজয়া। ভুলে যাবেন না?

নরেন। না। আমি অন্যমনস্ক প্রকৃতির লোক হলেও আপনার অসুখের কথাটা ভুলব না নিশ্চয়।

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। মা, খাবার দেওয়া হয়েছে।

বিজয়া। (নলিনীকে দেখাইয়া) এঁরও দেওয়া হয়েছে?

কালীপদ। হাঁ, মা, দু’জনেরই।

বিজয়া। আমি দেখি গে কি দিলে। আর যদি কখনো সময় না পাই আজ কাছে বসে আপনাদের দু’জনের আমি খাওয়া দেখব।

নলিনী। মিস রায়, এ কি বলছেন? ভয় কিসের?

বিজয়া। কি জানি আজ আমার কেবলি ভয় করচে। মনে হচ্ছে অসুখ আমার খুব বেশী বেড়ে উঠবে। নরেনবাবু, আজকের দিনটা থাকুন না আপনি?

নরেন। বেশ, আমি রাত্রের ট্রেনেই যাব, কিন্তু আমার কথা শুনতে হবে। নড়াচড়া করতে পাবেন না, এখুনি গিয়ে শুয়ে পড়া চাই।

বিজয়া। না সে আমি শুনব না। আপনাদের খাওয়া আজ আমি দেখবই। তারপরে গিয়ে শোবো।

[প্রস্থান। সঙ্গে সঙ্গে কালীপদও চলিয়া গেল

নলিনী। কি ব্যাকুল মিনতি! ডক্টর মুখার্জী, আমি যাব, কিন্তু আপনি আজ থাকুন। যাবেন না।

নরেন। এবেলা আছি। মামার বাড়ি থেকে যাবার আগে সন্ধ্যাবেলায় আর একবার দেখে যাব। জ্বরটা বেশী, ভয় হয় ভোগাবে।

নলিনী। ভোগাবে? তবে তো বড় মুশকিল?

নরেন। তাই ত মনে হচ্চে।

নলিনী। চমৎকার মেয়েটি। আপনার প্রতি ওর কি বিশ্বাস! মনে হয় না যে এ আপনাকে ঘরছাড়া করতে পারে।

নরেন। (হাসিয়া) পেরেছে ত দেখা গেল। বড়লোকের মেয়ে, গরীবের কথা বড় ভাবে না। বাড়ি ত গেলই, শেষ সম্বল microscope-টি যখন দায়ে পড়ে বেচতে হলো তখন সিকি দামে দুশো টাকা মাত্র দিয়ে স্বচ্ছন্দে কিনে নিলেন—সঙ্গে উপরি বকশিশ দিলেন ঠক জোচ্চোর প্রভৃতি বিশেষণ। আজ সেইটেই যখন দুশো টাকা দিয়ে ফিরিয়ে নিতে চাইলুম, অনায়াসে বললেন অত কমে হবে না—যাচাই করিয়ে দেখেছেন দাম চারশো টাকার কম নয়—সুতরাং আরও দুশো চাই। দয়া-মায়া আছে তা মানতেই হবে।

নলিনী। বিশ্বাস হয় না ডক্টর মুখার্জী—কোথাও হয়ত মস্ত ভুল আছে।

নরেন। ভুল আছে? না, কোথাও নেই মিস নলিনী—সমস্ত জলের মত পরিষ্কার।

নলিনী। (মাথা নাড়িয়া) এমন কিন্তু হতেই পারে না ডক্টর মুখার্জী। মেয়েরা এত বড় মিনতি তাকে করতেই পারে না—এমন করে তার পানে যে তারা চাইতেই পারে না।

নরেন। তা হবে। মেয়েদের কথা আপনিই ভাল জানেন, কিন্তু আমি যেটুকু জানতে পেলুম তা ভারী কঠোর, ভারী কঠিন।

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। চলুন। মা ডেকে পাঠালেন, আপনাদের খাবার দেওয়া হয়েছে।

নরেন। চলো যাই।

[সকলের প্রস্থান

[দয়াল ও রাসবিহারীর কথা কহিতে কহিতে প্রবেশ]

রাস। হাঁ, এই মন্দির-প্রতিষ্ঠা নিয়ে, অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে, বিলাস যে এতটা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল তা কেউ বুঝতে পারেনি। সেদিন তার চেহারা দেখে ভয় পেয়ে বললুম, বিলাস হয়েছে কি? এমন করচ কেন? ও বললে, বাবা, আজ আমি অন্যায় করেছি—দয়ালবাবুকে কঠিন কথা বলেছি। বিজয়াকেও বলেছি।—সেও আমাকে বলেছে—কিন্তু সেজন্যে নয়, দয়ালবাবুকে আমি কি বলতে কি বলে ফেলেছি, হয়ত রাগ করে তিনি আর আমাদের আচার্যের কাজ করবেন না। এই বলে তার দু’চোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। আমি বললুম ভয় নেই বাবা, অপরাধ যদি হয়েই থাকে তবে এই অনুতাপের অশ্রুতেই সমস্ত ধুয়ে গেল। (এই বলিয়া তিনি ক্ষণকাল মুদিতনেত্রে অধোমুখে থাকিয়া) আর তাই ত হলো দয়ালবাবু, আপনার উদারতার কথা বুঝতে পেরে বিলাস আজ আমায় বললে, বাবা, সেদিন তুমি সত্যিই বলেছিলে দয়ালবাবুর সমস্ত চিত্ত ভগবৎপ্রেমে পরিপূর্ণ, হৃদয় করুণায় মমতায় বিশ্বাসে ভরা, সেখানে আমাদের মত ছেলেমানুষের কথা প্রবেশ করতে পারে না।

দয়াল। সেদিনের কথা আমি সত্যিই কিছু মনে রাখিনি আপনি বলবেন বিলাসবাবুকে।

রাস। বাবু নয়। বাবু নয়। আপনার কাছে শুধু সে বিলাস—বিলাসবিহারী। কে যায় ওখানে? কালীপদ?

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

রাস। মা বিজয়া এখন কি তাঁর লাইব্রেরি-ঘরে?

কালীপদ। না, তিনি শোবার ঘরে শুয়ে পড়েছেন—তাঁর জ্বর।

রাস। জ্বর? জ্বর বললে কে?

কালীপদ। ডাক্তারবাবু।

রাস। কে ডাক্তারবাবু?

কালীপদ। নরেনবাবু এসেছিলেন, তিনিই হাত দেখে বললেন জ্বর—বললেন চুপ করে শুয়ে থাকতে।

রাস। নরেন? সে কি জন্যে এসেছিল? কখন এসেছিল? কালীপদ, মাকে একবার খবর দাও যে আমি একবার দেখতে যাব।

দয়াল। আমিও যে মাকে একবার দেখতে চাই কালীপদ। জ্বর শুনে যে বড় ভাবনা হলো।

কালীপদ। কিন্তু মা আমাকে বারণ করে দিয়েছেন তিনি নিজে না ডাকলে কেউ যেন না তাঁকে ডাকে। আমি গেলে হয়ত রাগ করবেন।

রাস। রাগ করবে? সে কি কথা? জ্বর যে! সমস্ত ভার, সমস্ত দায়িত্ব যে আমার মাথায়! বিলাসকে কেউ ছুটে গিয়ে খবর দিয়ে আসুক। আজ তারও শরীর ভাল নয়, বাড়িতেই আছে। কিন্তু সে বললে কি হবে—শিগগির এসে একটা ব্যবস্থা করুক। শহরে গাড়ি পাঠিয়ে আমাদের অকিঞ্চনবাবুকে একটা কল্‌ দিক। না হয় কলকাতায়—আমাদের প্রেমাঙ্কুর ডাক্তার—চলুন চলুন দয়ালবাবু, যাই আমরা, সময় যেন না নষ্ট হয়।

দয়াল। ব্যস্ত হবেন না রাসবিহারীবাবু, জগদীশ্বরের কৃপায় ভয় কিছু নেই। নরেন নিজে যখন দেখে গেছে—ভাবনার বিষয় হলে সে নিশ্চয়ই আপনাকে একটা সংবাদ দিতে বলে দিত।

রাস। নরেন দেখে গেছে? কি জানে সেটা?

[বলিতে বলিতে তিনি দ্রুতবেগে প্রস্থান করিলেন।
পিছনে পিছনে গেলেন দয়াল এবং কালীপদ

বিজয়া – ২.৫

পঞ্চম দৃশ্য

বিজয়ার শয়নকক্ষ

[অসুস্থ বিজয়া বিছানায় শুইয়া, অনতিদূরে উপবিষ্ট পিতা-পুত্র রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী। ঘরে অন্য আসন নাই, রোগীর প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যই নিকটে রক্ষিত, ব্যস্ত পদক্ষেপে নরেন প্রবেশ করিল—তাহার মুখে উৎকণ্ঠার চিহ্ন]

নরেন। কি ব্যাপার? কালীপদর মুখে শুনলাম জ্বর নাকি একটু বেড়েচে। তা হোক—কেমন আছেন এখন?

বিলাস। আপনি সকালে এসে নাকি ওঁকে বসন্তের ভয় দেখিয়ে গেছেন?

বিজয়া। (ক্ষীণস্বরে দুই বাহু বাড়াইয়া) বসুন। (নরেন অগত্যা বিছানার একাংশে বসিল) কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? কেন এত দেরি করে এলেন? আমি যে সমস্তক্ষণ শুধু আপনার পথ চেয়ে ছিলুম। (বিলাসের মুখের অবস্থা ভীষণ হইয়া উঠিল। নরেনের হাতখানা বুকের উপর টানিয়া লইয়া) কিন্তু আমি ভাল না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাবেন না বলুন। আপনি চলে গেলে হয়ত আমি বাঁচব না। (নরেন হতবুদ্ধি হইয়া, মুখ তুলিতেই দুইজোড়া ভীষণ চক্ষুর সহিত তাহার চোখাচোখি হইল—কালীপদ একবার পর্দার ফাঁক হইতে উঁকি মারিতেই বিলাস গর্জিয়া উঠিল)

বিলাস। এই শূয়ার, এই জানোয়ার—একটা চেয়ার আন্‌।

[কালীপদ ভয়ে হতবুদ্ধি হইয়া রহিল]

রাসবিহারী। (গম্ভীর স্বরে) ওঘর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এস কালীপদ। বাবুকে বসতে দাও (নরেন উঠিয়া পড়িল। শান্তকণ্ঠে বিলাসের প্রতি) রোগী মানুষের ঘর—অমন hasty হয়ো না বিলাস। Temper lose করা কোনও ভদ্রলোকের পক্ষেই শোভা পায় না।

[কালীপদ চেয়ার লইয়া প্রবেশ করিল]

বিলাস। মানুষ এতে temper lose করে না ত করে কিসে শুনি? হারামজাদা চাকর, বলা নেই, কওয়া নেই, এমন একটা অসভ্য লোককে ঘরে এনে ঢোকালে যে ভদ্রমহিলার সম্মান পর্যন্ত রাখতে জানে না।

[বিজয়ার জ্বরের ঘোরটা হঠাৎ ঘুচিয়া গেল। নরেনের হাত ছাড়িয়া
সে দেওয়ালের দিকে মুখ করিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল]

রাস। আমি সবই বুঝি বিলাস, এ-ক্ষেত্রে তোমার রাগ হওয়াটা যে অস্বাভাবিক নয়—বরঞ্চ খুবই স্বাভাবিক তাও মানি, কিন্তু এটা তোমার ভাবা উচিত ছিল যে, সবাই ইচ্ছা করে অপরাধ করে না। সকলেই যদি ভদ্র রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার জানত—তা হলে ভাবনা ছিল কি? সেইজন্য রাগ না করে শান্তভাবে মানুষের দোষত্রুটি সংশোধন করে দিতে হয়।

বিলাস। না বাবা! এরকম impertinence সহ্য হয় না। তা ছাড়া আমার এ বাড়ির চাকরগুলো হয়েছে যেমন হতভাগা—তেমনি বজ্জাত। কালই আমি ব্যাটাদের সব দূর করে তবে ছাড়ব।

রাস। এর মন খারাপ হয়ে থাকলে যে কি বলে তার ঠিকানাই নাই। আর ছেলেকেই বা দোষ দোব কি, আমি বুড়োমানুষ, আমি পর্যন্ত অসুখ শুনে কি রকম চঞ্চল হয়ে উঠেছিলুম। বাড়িতেই হলো একজনের বসন্ত—তার ওপর উনি ভয় দেখিয়ে গেলেন।

নরেন। না, আমি কোনরকম ভয় দেখিয়ে যাইনি।

বিলাস। আলবত ভয় দেখিয়ে গেছেন। কালীপদ তার সাক্ষী আছে।

নরেন। কালীপদ ভুল শুনেছে।

[বিলাস ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিবে এমন সময়ে]

রাস। আঃ কর কি বিলাস! উনি যখন অস্বীকার করছেন তখন কি কালীপদকে বিশ্বাস করতে হবে? নিশ্চয়ই ওঁর কথা সত্যি।

বিলাস। তুমি বুঝছ না বাবা—(বিলাস বাধা দিতে চাহিল)

রাস। এই সামান্য অসুখেই মাথা হারিয়ো না বিলাস। স্থির হও! মঙ্গলময় জগদীশ্বর যে শুধু আমাদের পরীক্ষা করবার জন্যই বিপদ পাঠিয়ে দেন, বিপদে পড়লে তোমরা সকলের আগে এই কথাটাই কেন ভুলে যাও—আমি ত ভেবে পাইনে। (একটু স্থির থাকিয়া) আর তাই যদি একটা ভুল অসুখের কথা বলেই থাকেন, তাতেই বা কি? কত পাস-করা ভাল ভাল, বিচক্ষণ ডাক্তারেরও যে ভ্রম হয়, ইনি ত ছেলেমানুষ। যাক। (নরেনের প্রতি) জ্বর ত তা হলে অতি সামান্যই আপনি বলছেন। চিন্তা করবার কোনই কারণ নেই—এই ত আপনার মত।

নরেন। আমার মতামতে কি আসে-যায় রাসবিহারীবাবু? আমার ওপর ত নির্ভর করছেন না। বরং তার চেয়ে কোন ভাল পাস-করা বিচক্ষণ ডাক্তার দেখিয়ে তাঁর অভিমত নিন।

বিলাস। (চেঁচাইয়া উঠিয়া) তুমি কার সঙ্গে কথা কইছ, মনে করে কথা কয়ো বলে দিচ্ছি। এ-ঘর না হয়ে, আর কোথাও হলে তোমার বিদ্রূপ করা—

[বিজয়া মুখ ফিরাইয়া ব্যথিত সুরে]

বিজয়া। আমি যতদিন বাঁচব নরেনবাবু, আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব। কিন্তু এঁরা যখন অন্য ডাক্তার দিয়ে আমার চিকিৎসা করা স্থির করেছেন, তখন আর আপনি অনর্থক অপমান সইবেন না।

[পুনরায় মুখ ফিরাইয়া শুইল]

রাস। (ব্যস্ত হইয়া) বিলক্ষণ, যাঁকে তুমি ডেকে পাঠিয়েছ তাঁকে অপমান করে কার সাধ্য মা? (ক্ষণকাল পরে) এ কথাও সত্যি বিলাস! এই অসংযত ব্যবহারের জন্য তোমার অনুতপ্ত হওয়া উচিত। মানি, সমস্তই মানি যে মা বিজয়ার অসুখের গুরুত্ব কল্পনা করেই তোমার মানসিক চঞ্চলতা শতগুণে বেড়ে গেছে, তবু—স্থির ত তোমাকে হতেই হবে। সমস্ত ভাল-মন্দ সমস্ত দায়িত্ব ত শুধু তোমারই মাথায় বাবা! মঙ্গলময়ের ইচ্ছায় যে গুরুভার একদিন তোমাকেই শুধু বহন করতে হবে—এ ত শুধু তারই পরীক্ষার সূচনা—(নরেন নিঃশব্দে লাঠি ও ছোট ব্যাগটি তুলিয়া লইল) নরেনবাবু, আপনার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আলোচনা করবার আছে—চলুন।

[রাসবিহারী নরেনকে লইয়া রঙ্গমঞ্চের সম্মুখের দিকে আসিতেই মধ্যের পর্দা পড়িয়া রোগীর কক্ষটিকে সম্পূর্ণ আবৃত করিয়া দিল। উভয়ে মুখোমুখি দুইখানি চৌকিতে উপবেশন করিল]

রাস। পাঁচজনের সামনে তোমায় বাবুই বলি, আর যাই বলি, বাবা, এটা কিন্তু ভুলতে পারিনে, তুমি আমাদের সেই জগদীশের ছেলে। নইলে তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলুম এ কথা তোমার মুখের ওপর বলে তোমাকে ক্লেশ দিতুম না।

নরেন। যা সত্য তাই বলেছেন—এতে দুঃখ করবার কিছু নেই।

রাস। না না, ও কথা বলো না নরেন। কঠোর কথা মনে বাজে বৈ কি! যে শোনে তার ত বাজেই, যে বলে তারও বড় কম বাজে না বাবা। জগদীশ্বর! কিন্তু তুমি, বাবা, বিলাসের মনের অবস্থা বুঝে মনের মধ্যে কোনও ক্ষোভ রাখতে পারবে না। আর একটা অনুরোধ আমার এই রইল, এদের বিবাহ ত সামনের বৈশাখেই হবে, যদি কলকাতাতেই থাকো বাবা, শুভকর্মে যোগ দিতে হবে। না বললে চলবে না।

নরেন। আচ্ছা। কিন্তু—

রাস। না, কোন কিন্তু নয় বাবা, সে আমি শুনব না। ভাল কথা, কলকাতাতেই কি এখন থাকা হবে? একটু সুবিধে-টুবিধে—

নরেন। আজ্ঞে হাঁ। একটা বিলিতী ওষুধের দোকানে সামান্য একটা কাজ পেয়েছি।

রাস। বেশ, বেশ, ওষুধের দোকানে কাঁচা পয়সা! টিকে থাকতে পারলে আখেরে গুছিয়ে নিতে পারবে নরেন।

নরেন। আজ্ঞে।

রাস। তা হলে মাইনেটা কি রকম?

নরেন। পরে কিছু বেশী দিতে পারে। এখন চারশো টাকা মাত্র দেয়।

রাস। (বিবর্ণমুখে চোখ কপালে তুলিয়া) চারশো! আহা বেশ—বেশ! শুনে বড় সুখী হলুম।

নরেন। সেই পরেশ ছেলেটি কেমন আছে বলতে পারেন?

রাস। তাকে একটু আগেই তাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নরেন। গ্রামটা কি দূরে?

রাস। তা জানিনে বাবা।

নরেন। (ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) তা হলে আর উপায় কি। সে কথা যাক, কিন্তু আমার হয়ে বিলাসবাবুকে আপনি একটা কথা জানাবেন। বলবেন—প্রবল জ্বরে মানুষের আবেগ নিতান্ত সামান্য কারণে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারে। বিজয়ার সম্বন্ধে ডাক্তারের মুখের এই কথাটা তিনি যেন অবিশ্বাস না করেন।

রাস। অবিশ্বাস করবে কি নরেন, এ কি আমরা জানিনে? বাপ হয়ে এ কথা বলতে আমার মুখে বাধে, কিন্তু তুমি আপনার জন বলেই বলি, দুজনের কি গভীর ভালবাসার চিহ্নই যে মাঝে মাঝে আমার চোখে পড়ে সে প্রকাশ করিবার আমার ভাষা নেই। মনে হয় ভগবান যেন সঙ্কল্প করেই পরস্পরের জন্যে এদের সৃজন করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাঁকে প্রণাম করি, আর ভাবি সার্থক এদের মিলন, সার্থক এদের জীবন।

নরেন। এই বৈশাখেই বুঝি এঁদের বিবাহ হবে?

রাস। হাঁ নরেন। সেদিন কিন্তু তোমাকে আসতে হবে, উপস্থিত থেকে নব-দম্পতিকে আশীর্বাদ করতে হবে। তাড়াতাড়ি করার আমার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু সকলেই পুনঃ পুনঃ বলচেন অন্তরের আত্মা যাঁদের এমন করে এক হয়েছে বাইরে তাদের পৃথক করে রাখা অপরাধ। আমি বললুম, তাই হোক। তোমাদের সকলের ইচ্ছেই আমার ভগবানের ইচ্ছে। এই বৈশাখেই এক হয়ে এরা সংসার-সমুদ্রে জীবন-তরণী ভাসাক। জগদীশ্বর! আমার দিন শেষ হয়েছে, কিন্তু তুমি এদের দেখো—তোমার চরণেই এদের সমর্পণ করলুম। (যুক্তকর ললাটে স্পর্শ করিয়া হেঁট হইয়া তিনি প্রণাম করিলেন) কিন্তু তোমার যে রাত হয়ে যাচ্ছে বাবা, আজই কি কলকাতায় ফিরে না গেলেই নয়?

নরেন। না আমাকে যেতেই হবে। সাড়ে-আটটার ট্রেনেই যাব।

রাস। জিদ করতে পারিনে নরেন, নতুন চাকরি, কামাই হওয়া ভাল নয়—মনিব রাগ করতে পারে। আজকের দিনটাও ত তোমার বৃথায় নষ্ট হ’লো। কিন্তু কি জন্যে আজ এসেছিলে বাবা, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?

নরেন। দিনটা নষ্ট হলো সত্যি, কিন্তু সকালে এসেছিলুম এই আশা করে যদি টাকাটা দিয়ে সেই মাইক্রস্‌কোপটা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

রাস। টাকাটা দিয়ে? বেশ ত, বেশ ত—নিয়ে গেলে না কেন?

নরেন। বিজয়া দিলেন না। বললেন, তার দাম চারশো টাকা—এর এক পয়সা কমে হবে না।

রাস। সে কি কথা নরেন? দুশো টাকার বদলে চারশো টাকা! বিশেষতঃ তাতে যখন তোমার এত দরকার অথচ তাঁর কোন প্রয়োজন নেই।

নরেন। ভেবেছি তাঁকে চারশো টাকা দিয়েই আমি নিয়ে যাব।

রাস। না, সে কোনমতেই হতে পারে না। এত বড় অধর্ম আমি সইতে পারব না। ও আমার ভাবী পুত্রবধূ, এ অন্যায় যে আমাকে পর্যন্ত স্পর্শ করবে নরেন। (ক্ষণকাল অধোমুখে নিঃশব্দে থাকিয়া) একটা কথা আমি বার বার ভেবে দেখেচি। তোমার সঙ্গে ওর কথাবার্তায়, বাইরের আচরণে আমি দোষ দেখতে পাইনে কিন্তু অন্তরে কেন তোমার প্রতি বিজয়ার এতবড় ক্রোধ! কেবল যে তোমার ঐ বাড়িটার ব্যাপারেই দেখতে পেলাম তাই নয় এই microscope-টার ব্যাপারেও ঢের বেশী চোখে পড়ল! ওটা নিতে আমার নিজেরই আপত্তি ছিল শুধু যে দরকার নেই বলেই তা নয়—ওতে তোমার নিজেরই অনেক বেশী প্রয়োজন বলে। কিন্তু যখনি টের পেলাম তোমার টাকার প্রয়োজন, যখনি কানে এল তোমাকে কথা দেওয়া হয়েছে, তখনি সঙ্কল্প আমার স্থির হয়ে গেল। ভাবলাম, দাম ওর যাই হোক কিন্তু টাকা দিতেই হবে, কিছুতে অন্যথা করা চলবে না। মনে মনে বললাম, বিজয়ার যখন ইচ্ছে, যতদিনে ইচ্ছে আমাকে টাকা শোধ দিন, কিন্তু আমি বিলম্ব করতে পারব না। তাই তোমাকে দুশো টাকা সকালেই পাঠিয়ে দিলাম। এ যে আমার কর্তব্য—সত্যরক্ষা আমাকে যে করতেই হবে।

নরেন। সামান্য দুশো টাকা দেবারও বুঝি ওঁর ইচ্ছে ছিল না? বিশ্বাস ছিল ঠকিয়ে নিয়ে যাচ্চি?

রাস। (জিভ কাটিয়া) না না না। কিন্তু সে বিচারে আর ত প্রয়োজন নেই নরেন। কিন্তু তাই বলে এ কি অসঙ্গত প্রস্তাব! এ কি অন্যায়! দুশোর বদলে চারশো! না বাবা, এ তাঁকে আমি কোনমতে করতে দেব না, তুমি দুশো টাকা দিয়েই তোমার জিনিস ফিরিয়ে নিয়ে যেও।

নরেন। না রাসবিহারীবাবু, আমার হয়ে আপনি তাঁকে অনুরোধ করবেন না। তিনি ভাল হলে জানাবেন তাঁকে চারশো টাকাই এনে দেব—তাঁর এতটুকু অনুগ্রহও আমি গ্রহণ করব না। বিলাসবাবুকে বলবেন তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন—এত কথা আমি কিছুই জানতুম না। কিন্তু আর না—আমার গাড়ির সময় হয়ে আসছে আমি চললুম।

[প্রস্থান

বিজয়া – ৩.১

তৃতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

বিজয়ার বসিবার ঘর

[বিজয়া সুস্থ হইয়াছে, তবে শরীর এখনও দুর্বল। কালীপদর প্রবেশ]

কালী। (অশ্রুবিকৃত-স্বরে) মা, এতদিন তোমার অসুখের জন্যেই বলতে পারিনি, কিন্তু এখন আর না বললেই নয়। ছোটবাবু আমাকে জবাব দিয়েছেন।

বিজয়া। কেন?

কালী। কর্তাবাবু স্বর্গে গেছেন—তাঁর কাছে কখনো মন্দ শুনিনি, কিন্তু ছোটবাবু আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না—দিনরাত গালাগালি করেন। কোন দোষ করিনে তবু—(চোখ মুছিয়া ফেলিয়া) সেদিন কেন তাঁকে জানাই নি, কেন নরেনবাবুকে তোমার ঘরে ডেকে এনেছিলুম,—তাই জবাব দিয়েছেন।

বিজয়া। (কঠিনস্বরে) তিনি কোথায়?

কালী। কাছারিঘরে বসে কাগজ দেখছেন।

বিজয়া। হুঁ। আচ্ছা দরকার নেই—এখন তুই কাজ করগে যা।

[কালীপদর প্রস্থান

[দয়াল প্রবেশ করিলেন]

দয়াল। তোমার কাছেই আসছিলাম মা!

বিজয়া। আসুন দয়ালবাবু, আপনার স্ত্রী ভাল আছেন ত?

দয়াল। আজ ভাল আছেন। নরেনবাবুকে চিঠি লিখতে, কাল বিকেলে এসে তিনি ওষুধ দিয়ে গেছেন। কি অদ্ভুত চিকিৎসা মা, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পীড়া যেন বারো আনা আরোগ্য হয়ে গেছে।

বিজয়া। ভাল হবে না! আপনাদের সকলের কি সোজা বিশ্বাস ওঁর উপর!

দয়াল। সে কথা সত্যি। কিন্তু বিশ্বাস ত শুধু শুধু হয় না মা! আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি কিনা, মনে হয় ঘরে পা দিলেই সমস্ত ভাল হয়ে যাবে।

বিজয়া। তা হবে!

দয়াল। একটা কথা বলব মা—রাগ করতে পাবে না কিন্তু। তিনি ছেলেমানুষ সত্যি, কিন্তু যে-সব নামজাদা বিজ্ঞ চিকিৎসকের দল তোমার মিথ্যে চিকিৎসা করে টাকা আর সময় নষ্ট করলে, তাদের চেয়ে তিনি ঢের বেশী বিজ্ঞ—এ আমি শপথ করে বলতে পারি। আর একটা কথা মা, নরেনবাবু শুধু ওঁরই চিকিৎসা করে যাননি—আরও একজনের ব্যবস্থা করে গেছেন। (টেবিলের উপর একটুকরা কাগজ মেলিয়া) তোমাকে কিন্তু উপেক্ষা করতে দেব না, ওষুধটা একবার পরীক্ষা করে দেখতেই হবে বলে দিচ্চি।

বিজয়া। কিন্তু এ যে অন্ধকারে ঢিল ফেলা দয়ালবাবু—রুগী না দেখে prescription লেখা।

দয়াল। ইস, তাই বুঝি! কাল যখন তুমি তোমাদের বাগানের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলে—তখন ঠিক তোমার সুমুখের পথ দিয়েই যে তিনি হেঁটে গেছেন। তোমাকে ভাল করেই দেখে গেছেন—বোধ হয় অন্যমনস্ক ছিলে বলেই—

বিজয়া। তাঁর কি পরনে সাহেবী-পোশাক ছিল?

দয়াল। ঠিক তাই। দূর থেকে দেখলে ভুল হয়, বাঙালী বলে হঠাৎ চেনাই যায় না।

বিজয়া। (হাসিয়া) ওটা আপনার অত্যুক্তি দয়ালবাবু—স্নেহের বাড়াবাড়ি।

দয়াল। স্নেহ করি—খুবই করি সত্যি। তবু কথাটা আমার বাড়াবাড়ি নয় মা। অতবড় পণ্ডিত লোক, কিন্তু কথাগুলি যেমন মিষ্টি তেমনি শিশুর মত সরল। কিছুতে যেতে দিতে ইচ্ছে করে না, মনে হয় আরও কিছুক্ষণ ধরে রেখে দিই।

বিজয়া। ধরে রেখে দেন না কেন?

দয়াল। (হাসিয়া) সে কি হয় মা, তাঁর কত কাজ, কত পরিশ্রম তাঁকে করতে হয়। তবু গরীব বলে আমাদের ওপর কত দয়া। স্ত্রী রুগ্ন, তাঁকে দেখতে প্রায় ওঁকে আসতে হয়।

[বিলাস প্রবেশ করিল]

বিলাস। (বিজয়ার প্রতি) কেমন আছ আজ?

বিজয়া। ভালো আছি।

বিলাস। ভালো ত তেমন দেখায় না। (দয়ালের প্রতি) আপনি এখানে করছেন কি?

দয়াল। মাকে একবার দেখতে এলাম।

বিলাস। (টেবিলের উপর prescription-টার প্রতি দৃষ্টি পড়ায় হাতে তুলিয়ে লইয়া) prescription দেখচি যে। কার? (পরীক্ষা করিয়া) নরেনের নাম দেখচি যে! স্বয়ং ডাক্তারসাহেবের। কিন্তু এটা এল কি করে? (বিজয়া ও দয়াল উভয়েই নীরব)

বিলাস। শুনি না এল কি করে? ডাকে নাকি? হুঁ। ডাক্তার ত নরেন ডাক্তার? তাই বুঝি এদের ওষুধ খাওয়া হয় না; শিশির ওষুধ শিশিতেই পচে, তারপর ফেলে দেওয়া হয়? তা না হয় হলো—কিন্তু এই কলির ধন্বন্তরীটি কাগজখানি পাঠালেন কি করে? কার মারফতে? কথাটা আমার শোনা দরকার। (দয়ালের প্রতি) আপনি ত এতক্ষণ খুব lecture দিচ্ছিলেন—সিঁড়ি থেকেই গলা শোনা যাচ্ছিল—বলি, আপনি কিছু জানেন? একেবারে যে ভিজে বেড়ালটি হয়ে গেলেন। বলি জানেন কিছু?

দয়াল। আজ্ঞে হাঁ।

বিলাস। ওঃ—তাই বটে! কোথায় পেলেন সেটাকে?

দয়াল। আজ্ঞে তিনি আমার স্ত্রীকে দেখতে আসেন কিনা—আর বেশ সুন্দর চিকিৎসা করেন—তাই আমি বলেছিলুম, মা বিজয়ার জন্যে যদি একটা—

বিলাস। তাই বুঝি এই ব্যবস্থাপত্র? আপনি দাঁড়িয়েছেন মুরুব্বি? হুঁ। (একমুহূর্ত পরে) আপনাকে গেল বছরের হিসাবটা সারতে বলেছিলুম,—সেটা সারা হয়েছে?

দয়াল। আজ্ঞে, দু’দিনের মধ্যেই সেরে ফেলব।

বিলাস। হয়নি কেন?

দয়াল। বাড়িতে ভারী বিপদ যাচ্ছিল—নিজ হাতে রাঁধতে হতো—আসতেই পারিনি।

বিলাস। (বিদ্রূপ করিয়া) আসতেই পারিনি! তবে আর কি—আমাকে রাজা করেছেন। আমি তখনই বাবাকে বলেছিলুম—এ-সব বুড়ো-হাবড়া নিয়ে আমার কাজ চলবে না। এদের আমি চাইনে।

বিজয়া। (অনুচ্চ কঠিন-স্বরে) দয়ালবাবুকে এখানে কে এনেছে জানেন? আপনার বাবা নন—এনেচি আমি।

বিলাস। যেই আনুক, আমার জানবার দরকার নেই। আমি কাজ চাই—কাজের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ।

বিজয়া। যাঁর বাড়িতে বিপদ, তিনি কি করে কাজ করতে আসবেন?

বিলাস। অমন সবাই বিপদের দোহাই পাড়ে, কিন্তু সে শুনতে গেলে আমার চলে না। আমি দরকারী কাজ সেরে রাখতে হুকুম দিয়েছিলুম, হয়নি কেন, সেই কৈফিয়ত চাই। বিপদের খবর জানতে চাইনে।

বিজয়া। দয়ালবাবু, আপনি তা হলে এখন আসুন। নমস্কার।

[দয়ালের প্রস্থান

দয়ালবাবু গেছেন, এখন বলুন কি বলছিলেন?

বিলাস। বলছিলুম, আমি দরকারী কাজ সেরে রাখবার হুকুম দিয়েছিলুম, হয়নি কেন তার কৈফিয়ত চাই; বিপদের খবর জানতে চাইনে।

বিজয়া। দেখুন বিলাসবাবু, জগতের সবাই মিথ্যাবাদী নয়। সবাই মিথ্যা বিপদের দোহাই দেয় না, অন্ততঃ মন্দিরের আচার্য দেন না। সে যাক, কিন্তু আপনাকে জিজ্ঞাসা করি আমি, যখন জানেন দরকারী কাজ হওয়া চাই-ই তখন নিজে কেন সেরে রাখেন নি? আপনি কেন চারদিন কাজ কামাই করলেন? কি বিপদ আপনার হয়েছিল শুনি?

বিলাস। (হতবুদ্ধি হইয়া) আমি নিজে খাতা সেরে রাখব! আমি কামাই করলুম কেন?

বিজয়া। হাঁ আমি তাই জানতে চাই। মাসে মাসে দুশো টাকা মাইনে আপনি নেন। সে টাকা ত আমি শুধু শুধু আপনাকে দিইনে,—কাজ করবার জন্যই দিই।

বিলাস। আমি চাকর? আমি তোমার আমলা?

বিজয়া। কাজ করবার জন্যে যাকে মাইনে দিতে হয়, তাকে ও ছাড়া আর কি বলে? আপনার অসংখ্য অত্যাচার আমি নিঃশব্দে সয়ে এসেছি। কিন্তু যত সহ্য করেচি, অন্যায়-উপদ্রব ততই বেড়ে গেছে। যান, নীচে যান। প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধ ছাড়া আজ থেকে আপনার সঙ্গে আর আমার কোন সম্বন্ধ থাকবে না। যে নিয়মে আমার অপর কর্মচারীরা কাজ করে, ঠিক সেই নিয়মে কাজ করতে পারেন করবেন, নইলে আপনাকে আমি জবাব দিলুম, আমার কাছারিতে আর ঢোকবার চেষ্টা করবেন না।

বিলাস। (লাফাইয়া উঠিয়া—দক্ষিণ হস্তের তর্জনী কম্পিত করিতে করিতে) তোমার এত দুঃসাহস?

বিজয়া। দুঃসাহস আমার নয়, আপনার। আমার এস্টেটেই চাকরি করবেন, আর আমার উপরেই জুলুম করবেন! আমাকে ‘তুমি’ বলবার অধিকার কে আপনাকে দিয়েছে? আমার চাকরকে আমারই বাড়িতে জবাব দেবার—আমার অতিথিকে আমারই চোখের সামনে অপমান করবার—এ-সকল স্পর্ধা আপনার কোথা থেকে জন্মাল?

বিলাস। (ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়া) অতিথির বাপের পুণ্য যে সেদিন তার একটা হাত ভেঙ্গে দিইনি! নচ্ছার, বদমাইশ, জোচ্চোর, লোফার কোথাকার! আর কখনো যদি তার দেখা পাই—

[চিৎকার-শব্দে ভীত হইয়া কানাই সিং প্রভৃতি দরজায় আসিয়া উঁকি মারিয়া
দেখিতে লাগিল—বিজয়া লজ্জিত হইয়া কণ্ঠস্বর সংযত এবং স্বাভাবিক
করিয়া লইল]

বিজয়া। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি, সেটা আপনারই কত বড় সৌভাগ্য যে, তাঁর গায়ে হাত দেবার অতি-সাহস আপনার হয়নি। তিনি উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোক। সেদিন তাঁর গায়ে হাত দিলেও হয়ত তিনি একজন পীড়িত স্ত্রীলোকের ঘরের মধ্যে বিবাদ না করে সহ্য করেই চলে যেতেন। কিন্তু এই উপদেশটা আমার ভুলবেন না যে, ভবিষ্যতে তাঁর গায়ে হাত দেবার ইচ্ছা যদি আপনার থাকে ত পিছন থেকে দেবেন, সুমুখে এসে দেবার দুঃসাহস করবেন না। কিন্তু অনেক চেঁচামেচি হয়ে গেছে—আর না। নীচে থেকে চাকর-বাকর, দরোয়ান পর্যন্ত ভয় পেয়ে উপরে উঠে এসেছে—যান নীচে যান।

[বিলাস ক্রোধে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। তাহার অনলবর্ষী দৃষ্টি বিজয়ার গমনপথের
দিকে দৃঢ়-নিবদ্ধ রহিল। ব্যস্ত হইয়া রাসবিহারী প্রবেশ করিলেন]

রাস। ব্যাপার কি বিলাস? এত চেঁচামেচি কিসের? বিজয়া কোথায়?

বিলাস। জানো বাবা, বিজয়া আমায় বললে আমি তার মাইনের চাকর। অন্য চাকরের মত মনিবের মন যুগিয়ে না চললে আমাকে ডিসমিস করবে।

রাস। কেন? কেন? হঠাৎ এ কথা কেন? কি বলেছিলে তাকে?

বিলাস। বলব আবার কি? কালীপদকে জবাব দিয়েছিলুম—এই হলো প্রথম অপরাধ।

রাস। বল কি? তা এত শীঘ্র তাকে জবাব দিতেই বা গেলে কেন? এই ত সেদিন নরেনকে খামকা অপমান করলে—জানো ত তার প্রতি বিজয়ার—

বিলাস। ওই ত হচ্ছে আসল রোগ। সেই জোচ্চোর লোফারটার জন্যেই ত এত কাণ্ড। জানো বাবা, বিজয়া বলে কিনা, চাকর হয়ে আমি তার অতিথিকে—সেই নরেনটাকে—অপমান করি কোন্‌ সাহসে—

রাস। অ্যাঁ, আর কি সে বললে? নাঃ, আমি যতই গুছিয়ে-গাছিয়ে আনি—তুমি কি ততই একটা -না-একটা বিভ্রাট বাধিয়ে তুলবে!

বিলাস। বিভ্রাট কিসের? ঐ ব্যাটা কালীপদকে তাড়াব না ত কি তাকে বাড়িতে রাখতে হবে? বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ সেই একটা অসভ্য জানোয়ারকে নিয়ে এসে বিজয়ার ঘরে বিছানার ওপরই বসালে—আর ঐ বুড়ো দয়ালটাও জুটেছে তেমনি!

রাস। আবার তাঁকেও কিছু বলেছ নাকি? সর্বনাশ বাধালে দেখছি!

বিলাস। বলব না? একশো বার বলব। নরেন ডাক্তারের ওপর তাঁর বড় টান। সেটাকে দিলাম সেদিন ঘর থেকে বার করে—আর উনি কিনা লুকিয়ে এসেছেন তারই দালালি করতে, একটা prescription পর্যন্ত এনে হাজির—বিজয়ার চিকিৎসা হবে। এদিকে স্ত্রীর অসুখের ছুতো করে বুড়ো চারদিন ডুব মেরে রইল, একবার কাছারিতে পর্যন্ত এল না; worthless, old fool!

[রাসবিহারী ক্রোধে ও ক্ষোভে নির্বাক স্তব্ধভাবে চাহিয়া রহিলেন]

বিলাস। বিজয়া আজ তোমাকে পর্যন্ত অপমান করতে ছাড়লে না।

রাস। তাতে তোমার কি?

বিলাস। আমার কি? আমার মুখের ওপর বলবে দয়ালবাবুকে রাসবিহারীবাবু আনেন নি, এনেছি আমি! বলবে, দয়াল কাজ করুন না করুন তাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না! ও আমাকে বলে আমলা! বলে, যে নিয়মে আমার অপর কর্মচারীরা কাজ করে সেই নিয়মে কাজ করুন, নইলে চলে যান!

রাস। সে ত শুধু তোমাকে চলে যেতে বলেছে, আমার ইচ্ছে হচ্চে তোমার গলায় ধাক্কা মেরে বার করে দিই!

বিলাস। অ্যাঁ!

রাস। ছোট জাত ত আর মিছে কথা নয়! হাজার হোক সেই চাষার ছেলে ত! বামুন-কায়েতের ছেলে হলে ভদ্রতাও শিখতিস, নিজের ভাল-মন্দও বুঝতিস, হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞানও জন্মাত। যাও, এখন মাঠে মাঠে হাল-গরু নিয়ে কুলকর্ম করে বেড়াও গে! উঠতে-বসতে তোকে পাখিপড়া করে শেখালাম যে, ভালোয় ভালোয় কাজটা একবার হয়ে যাক, তারপরে যা ইচ্ছে হয় করিস; তোর সবুর সইল না, তুই গেলি তাকে ঘাঁটাতে! সে হলো রায়-বংশের মেয়ে। ডাকসাইটে হরি রায়ের নাতনী। তুই হাত বাড়িয়ে গেছিস তার নাকে দড়ি পরাতে—মুখ্য কোথাকার! মান-ইজ্জত সব গেল, এত বড় জমিদারির আশা-ভরসা গেল, মাসে মাসে দু-দুশো টাকা মাইনে বলে আদায় হচ্ছিল সে গেল—যাও এখন চাষার ছেলে লাঙ্গল ধর গে। আবার আমার কাছে এসেছেন—চোখ রাঙ্গিয়ে তার নামে নালিশ করতে! দূর হঃ!—তোর আর মুখদর্শন করব না!

[বলিয়া রাসবিহারী নিজেই দ্রুতবেগে চলিয়া গেলেন, পিছনে পিছনে বিলাসও বিহ্বলের
ন্যায় ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। ধীরে ধীরে বিজয়া প্রবেশ
করিয়া টেবিলে মাথা নত করিয়া বসিল। দয়ালের প্রবেশ]

দয়াল। এ কি কাণ্ড করে বসলে মা! আর তা-ও আমার মত একটা হতভাগ্যের জন্যে! আমি যে লজ্জায়, সঙ্কোচে, অনুতাপে মরে যাচ্চি।

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া চোখ মুছিয়া) আপনি কি বাড়ি চলে যাননি?

দয়াল। যেতে পারলাম না মা। পা থরথর করে কাঁপতে লাগল, বারান্দার ওধারে একটা টুলের ওপর বসে পড়লাম। অনেক কথাই কানে এল।

বিজয়া। না এলেই ভাল হতো, কিন্তু আমি অন্যায় কিছু করিনি। আপনাকে অপমান করার তাঁর কোন অধিকার ছিল না।

দয়াল। ছিল বৈ কি মা। যে কাজ আমার করা উচিত ছিল করিনি, একটা চিঠি লিখে তাঁর কাছে ছুটি পর্যন্ত নিইনি—এ-সব কি আমার অপরাধ নয়? রাগ কি এতে মনিবের হয় না?

বিজয়া। কে মনিব, বিলাসবাবু? নিজেকে কর্ত্রী বলতে আমার লজ্জা করে দয়ালবাবু, কিন্তু ও দাবী যদি কারো থাকে সে আমারই। আর কারো নয়।

দয়াল। ও কথা বলতে নেই মা, রাগ করেও না। আমাদের মনিব যেমন তুমি তেমনি বিলাসবাবু। এই ত আমরা সবাই জানি।

বিজয়া। সে জানা ভুল। আমি ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ মনিব নেই।

দয়াল। শান্ত হও মা, শান্ত হও। বিলাসবাবু একটু ক্রোধী, অল্পেই চঞ্চল হয়ে পড়েন এই তাঁর দোষ, কিন্তু মানুষ ত সর্বগুণান্বিত হয় না, কোথাও একটু ত্রুটি থাকেই। এইখানে নলিনীর সঙ্গে আমার মেলে না। সেদিন রোগে তুমি শয্যাগত, তোমার ঘরের মধ্যে নরেনকে অপমান করার কথা শুনে নলিনী রাগে জ্বলতে লাগল। বললে, এর আসল কারণ বিলাসবাবুর বিদ্বেষ। নিছক হিংসা আর বিদ্বেষ।

বিজয়া। বিদ্বেষ কিসের জন্যে দয়ালবাবু?

দয়াল। কি জানি, কেমন করে যেন নলিনীর মনে হয়েছে নরেনকে তুমি মনে মনে—করুণা—করো। এইটেই বিলাসবাবু কিছুতে সইতে পারচেন না।

বিজয়া। কিন্তু করুণা ত তাঁকে আমি করিনি। আমার একটা কাজেও ত তাঁর প্রতি করুণা প্রকাশ পায়নি দয়ালবাবু।

দয়াল। আমিও ত তাই বলি। বলি, তেমন করুণা ত বিজয়া সকলকেই করেন। আমাকেই কি তিনি কম দয়া করছেন!

বিজয়া। দয়ার কথা ইচ্ছে হলে আপনারা বলতেও পারেন, কিন্তু নরেনবাবু পারেন না। বরঞ্চ, বার বার যা পেয়েছেন সে আমার নিষ্ঠুরতারই পরিচয়। সত্যি কিনা বলুন?

দয়াল। (সলজ্জে) না না, সত্যি নয়—সত্যি নয়—তবে নরেন নিজে কতকটা তাই ভাবে বটে। সেদিন কালীপদকে দিয়ে তুমি আমার ওখানে তার microscope-টা পাঠিয়ে দিলে, নরেন জিজ্ঞাসা করলে, কত টাকা দিতে বলেচেন? কালীপদ বললে, টাকার কথা বলে দেননি—এমনি। এমনি কি রে? কালীপদ বললে, হাঁ, এমনি নিয়ে যান, টাকা বোধহয় দিতে হবে না। সত্যি ত আর এ বিশ্বাস করা যায় না—নিশ্চয় কালীপদর ভুল হয়েছে—এতেই নরেন রেগে উঠে বললে, তাঁকে বল্‌ গে যা, আমাকে দান করার দরকার নেই, ঠাট্টা করবারও দরকার নেই। যা, ফিরিয়ে নিয়ে যা।

বিজয়া। শুনেছি আমি কালীপদর মুখে।

দয়াল। কিন্তু নলিনী তাঁকে বারণ করেছিল। ওর ধারণা নরেনের হয়ত কাজ আটকাচ্চে ভেবেই বিজয়া পাঠিয়ে দিয়েছেন, নইলে উপহার বলেও নয়, বিদ্রূপ করার জন্যেও নয়। ভেবেচেন হাতে হাতে টাকা না নিয়ে যেদিন হোক পরে নিলেই হবে। আমারও তাই মনে হয়। বল ত মা সত্যি নয় কি?

বিজয়া। জানিনে দয়ালবাবু। অসুখের মধ্যে পাঠিয়েছিলুম, ঠিক মনে করতে পারিনে তখন কি ভেবেছিলুম।

দয়াল। কিন্তু নলিনী বলে নিশ্চয় এই। বললে, নরেনের মত ভদ্র, আত্মভোলা, নিঃস্বার্থপর মানুষকে কেউ কখনো অপমান করতে পারে না এক বিলাসবাবু ছাড়া। কিন্তু নরেন নিজে কোনমতেই এ কথা বিশ্বাস করতে পারলে না, বললে, যে লোক আমার পরম দুর্গতির দিনে ওটা দুশো টাকা দিয়ে কিনে দুদিন পরেই নিজের মুখে চারশো টাকা চায় তার কিছুই অসম্ভব নয়। ওরা বড়লোক, ওদের অনেক ঐশ্বর্য—তাই আমাদের মত নিঃস্বদের উপহাস করতেই ওরা আনন্দ পায়। কিন্তু যাক গে এ-সব কথা মা! তোমাদের উভয়কেই ভালবাসি, ভাবলে আমার ক্লেশ বোধ হয়। (একটুখানি মৌন থাকিয়া) নরেন কিন্তু তোমার বিলাসকে অকপটে ক্ষমা করেছে। এমনি অন্যমনস্ক, নিঃসঙ্গ লোক ও, যে সবাই যখন শুনেচে তোমাদের বিবাহ স্থির হয়ে গেছে, তখনো শোনেনি কেবল ও-ই! তোমার ঘর থেকে বার করে এনে রাসবিহারীবাবু যখন খবরটা তাকে দিলেন তখন শুনে যেন ও চমকে গেল। বিলাসবাবুর রাগের কারণটা বুঝতে পেরে তাঁকে তখনি ক্ষমা করলে। শুধু এইটুকুই সে আজো ভেবে পায় না যে, তার মত দরিদ্র গৃহহীন দুর্ভাগাকে বিলাসবাবু সন্দেহের চোখে দেখলেন কি ভেবে। এত বড় ভ্রম তাঁর হলো কি করে? আমিও ঠিক তাই ভাবি, শুধু নলিনীই ঘাড় নাড়ে—সমস্ত কথাই সে শুনেচে।

বিজয়া। শুনেচেন? শুনে কি বলেন নলিনী?

দয়াল। বলে না কিছুই, শুধু মুখ টিপে হাসে।

বিজয়া। তিনি কি চলে গেছেন?

দয়াল। না, আজ যাবে। বলেছিল যাবার পথে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাবে। কিন্তু তিনটে বাজল বোধ হয়, এল বলে। কিংবা হয়ত নরেনের জন্যে অপেক্ষা করে আছে।

বিজয়া। কলকাতা থেকে আজ বুঝি তাঁর আসার কথা আছে?

দয়াল। হাঁ। আমার স্ত্রীকে দেখতে আসবেন। কিন্তু আমারই হবে সবচেয়ে মুশকিল মা, নরেন যদি কলকাতা থেকে চলে যায়।

বিজয়া। যাবার কথা আছে নাকি?

দয়াল। আছে বৈ কি। পরশুই ত বলছিল এখানে থাকার আর ইচ্ছে নেই, South Africa-র কোথায় নাকি কাজের সম্ভাবনা আছে—খবর পেলেই রওনা হবে।

বিজয়া। অত দূরে?

দয়াল। আমরাও তাই বলছিলাম। কিন্তু ও বলে, আমার দূরই বা কি, আর কাছেই বা কি? দেশই বা কি, আর বিদেশই বা কি? সবই ত সমান। শুনে ভাবলাম, সত্যিই ত। কি-ই বা আছে এখানে যা ওকে টেনে রাখবে। কিন্তু ভাবলেও চোখে যেন জল এসে পড়ে। কিন্তু আর না মা, আমি উঠি, একটু কাজ আছে সেরে নিই গে।

বিজয়া। কিন্তু বাড়ি যাবার আগে আর একবার দেখা করে যাবেন। এমনি চলে যাবেন না।

[ কালীপদ প্রবেশ করিল ]

কালীপদ। (দয়ালের প্রতি) ডাক্তারসাহেব একবার দেখা করতে চান।

দয়াল। কে ডাক্তার, আমাদের নরেন? আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়? এখানে এসে?

কালীপদ। নীচের ঘরে বসাব, না চলে যেতে বলে দেব?

বিজয়া। চলে যেতে বলবি? কেন? যা আমার এই ঘরে তাঁকে ডেকে নিয়ে আয়।

[মাথা নাড়িয়া কালীপদ প্রস্থান করিল

দয়াল। এখানে ডেকে আনা কি ভালো হবে মা?

বিজয়া। আমার বাড়িতে ভাল-মন্দ বিচারের ভার আমার উপরেই থাক দয়ালবাবু।

দয়াল। না না, তা আমি বলিনি, কিন্তু বিলাসবাবু শুনতে পেলে কি—

বিজয়া। শুনতে পাওয়াই তাঁর দরকার মনে করি। নিজের যথাযোগ্য স্থানটার সম্বন্ধে ধারণা তাতে পাকা হয়।

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। ডাক্তারসাহেব এলেন না, চলে গেলেন।

দয়াল। চলে গেলেন? কেন?

কালীপদ। জিজ্ঞেসা করলেন, মিস দাস আছেন। বললুম, না। বললেন, তাহলে আবশ্যক নেই, ও-বাড়িতেই দেখা হবে। এই বলেই চলে গেলেন।

দয়াল। মা ডেকেছিলেন, বলেছিলে তাঁকে?

কালীপদ। বলেছিলুম বৈ কি। বললেন, আজ সময় নেই, ছ’টার গাড়িতে ফিরে যেতে হবে। যদি সময় পান আর একদিন এসে দেখা করে যাবেন।

দয়াল। (সলজ্জে) কি জানি এ রকম ত তার প্রকৃতি নয় মা। বোধ হয় সত্যিই খুব তাড়াতাড়ি।

বিজয়ী। (কালীপদর প্রতি) আচ্ছা তুই যা এখান থেকে।

[যাওয়ার মুখে কালীপদ হঠাৎ ব্যস্ত হইয়া উঠিল, বলিল, কর্তাবাবু
আসছেন এবং সসঙ্কোচে অন্য দ্বার দিয়া বাহির হইয়া গেল।
মন্থরপদে রাসবিহারীবাবু প্রবেশ করিলেন]

রাস। এই যে মা বিজয়া। দয়ালবাবুও রয়েছেন দেখছি। বসো মা বসো বসো।

[দয়াল সসম্ভ্রমে নমস্কার করিলেন, বিজয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। রাসবিহারী
আসন গ্রহণ করিলে বিজয়া পুনরায় উপবেশন করিল]

রাস। এ ভালোই হলো যে দুজনের সঙ্গে একত্রেই দেখা হলো। আরও আগেই আসতে পারতাম কিন্তু বিলাসের হঠাৎ সর্দিগর্মির মত হয়ে—মাথায়-মুখে জল দিয়ে, বাতাস করে সে একটু সুস্থ হলে তবে আসতে পারলাম—তার মুখে সবই শুনতে পেলাম দয়ালবাবু। (দয়াল কি একটা বলিবার চেষ্টা করিতেই হাত নাড়িয়া তাঁহাকে বাধা দিয়া) না না না—তার দোষ-স্খালনের চেষ্টা করবেন না দয়ালবাবু। যে আপনার মত সাধু ভগবৎ-প্রাণ ব্যক্তিকেও অসম্মান করতে পারে তার সপক্ষে কিছুই বলবার নেই। আপনার কর্মে শৈথিল্য প্রকাশ পেয়েছে,—কিন্তু তাতে কি? সাহেবরা বিলাসের কর্তব্যনিষ্ঠা, তার কর্মময় জীবনের শত প্রশংসা করুক, কিন্তু আমরা ত সাহেব নয়, কর্মই ত আমাদের জীবনের সবখানি অধিকার করে নেই! কিন্তু ও শাস্তি পেলে কার কাছে? দেখেছেন দয়ালবাবু করুণাময়ের করুণা—ও শাস্তি পেলে তারই কাছে যে তার ধর্মসঙ্গিনী, আত্মা যাদের পৃথক নয়! দীর্ঘজীবী হও মা, এই ত চাই! এই ত তোমার কাছে আশা করি! (ক্ষণকাল পরে) কিন্তু এই কথাটা আমি কোনমতে ভেবে পাইনে বিজয়া, বিলাস আমার মত খোলাভোলা সংসার-উদাসী লোকের ছেলে হয়ে এতবড় কর্মপটু পাকা বিষয়ী হয়ে উঠল কি করে? কি যে তাঁর খেলা, কি যে সংসারের রহস্য কিছুই বোঝবার জো নেই মা!

দয়াল। তাঁর দোষ নেই রাসবিহারীবাবু, আমারই ভারী অন্যায় হয়ে গেছে। এই তরুণ বয়সেই কি যে তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা, কি যে তাঁর চিত্তের দৃঢ়তা তা বলতে পারিনে। আমাকে তিনি উচিত কথাই বলেছেন।

রাস। উচিত কথা? এবার আমি সত্যিই দুঃখ পাব দয়ালবাবু। আপনি ভক্তিমান, জ্ঞানবান, কিন্তু বয়সে আমি বড়। এ আমি জানি, সংসারে অত্যন্ত বস্তুটা কিছুরই ভালো নয়। এও জানি, বিলাসের কর্ম-অন্ত প্রাণ, এখানে সে অন্ধ, কিন্তু তাই বলে কি মানীর মান রাখতেও হবে না? না না, আমি বুড়োমানুষ, সে তেজও নেই, জোরও নেই—এ আমি ভালো বলতে পারব না। নিজের ছেলে বলে ত এ-মুখ দিয়ে মিথ্যে বার হবে না দয়ালবাবু!

দয়াল। সাধু! সাধু!

রাস। এ ভালই হয়েছে মা। আমি অপার আনন্দ লাভ করেচি যে, বিলাস তার সর্বোত্তম শিক্ষাটি আজ তোমার হাত থেকেই পাবার সুযোগ পেলে। কিন্তু কি ভ্রম দেখেছেন দয়ালবাবু, আনন্দে এমনি আত্মহারা হয়েছি যে, আমার মাকেই বোঝাতে যাচ্চি। যেন আমার চেয়ে তিনি তার কম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণী। আজ এত আনন্দ ত শুধু এইজন্যেই যে তোমার কাজ তুমি নিজের হাতে করেচ। তার সমস্ত শুভ যে শুধু তোমার হাতেই নির্ভর করচে। তার শক্তি, তোমার বুদ্ধি। সে ভার বহন করে চলবে, তুমি পথ দেখাবে। জগদীশ্বর! (চোখ তুলিয়া) ইস! চারটে বাজে যে! অনেক কাজ এখনো বাকী, আসি মা বিজয়া! আসি দয়ালবাবু। (প্রস্থানোদ্যম)

দয়াল। চলুন আমিও যাই।

রাস। কিন্তু আসল কথাটাই যে এখনো বলা হয়নি। (ফিরিয়া আসিয়া উপবেশন করিলেন) তোমার এই বুড়ো কাকাবাবুর একটি অনুরোধ তোমাকে রাখতে হবে। বলো রাখবে?

বিজয়া। বলুন, কি?

রাস। লজ্জায়, ব্যথায়, অনুতাপে সে দগ্ধ হয়ে যাচ্চে। কিন্তু এক্ষেত্রে তোমাকে একটু কঠিন হতে হবে। সে এসে ক্ষমা চাইলেই যে ভুলে যাবে সে হবে না। শাস্তি তার পূর্ণ হওয়া চাই। অন্ততঃ একটা দিনও এই দুঃখ সে ভোগ করুক এই আমার অনুরোধ।

বিজয়া। বিলাসবাবু কি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?

রাস। না, সে আমি বলব না,—সে কিছু নয়—ও-কথা শুনে তোমার কাজ নেই।

বিজয়া। কালীপদ?

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। আজ্ঞে—

বিজয়া। বিলাসবাবু আফিসঘরে আছেন, একবার তাঁকে ডেকে আনো।

কালীপদ। সে আজ্ঞে—

[কালীপদ চলিয়া গেল

রাস। (সস্নেহ মৃদু ভর্ৎসনার সুরে) ছি মা! শুনে পারলে না থাকতে? এখুনি ডেকে পাঠালে? (হাসিয়া দয়ালের প্রতি) ঠিক এই ভয়টিই করেছিলুম দয়ালবাবু। সে ব্যথা পাচ্চে শুনলে বিজয়া সইতে পারবে না—তাই বলতে চাইনি—কি করে হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল—কিন্তু আমি বাধা দেব কি করে? মা যে আমার করুণাময়ী! এ যে সংসারে সবাই জেনেছে। আসুন দয়ালবাবু—

দয়াল। চলুন যাই।

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। ছোটবাবু বাড়ি চলে গেছেন, তাঁকে ডেকে আনতে লোক গেল।

রাস। লোক গেল? আজ তাকে না ডাকলেই ভালো হতো মা। কিন্তু—ওঃ! গোলেমালে একটা মস্ত কাজ যে আমরা ভুলে যাচ্ছি। দয়ালবাবু, আজ যে বছরের প্রথম দিন! আমাদের যে অনেক দিনের কল্পনা আজকের শুভদিনে বিশেষ করে মাকে আমরা আশীর্বাদ করব! তবে, ভালোই হয়েছে, আমরা না চাইতেই বিলাসকে ডেকে আনতে লোক গেছে। এ-ও সেই করুণাময়ের নির্দেশ। আসুন দয়ালবাবু, আর বিলম্ব করব না—সামান্য আয়োজন সম্পূর্ণ করে নিই—বিলাস এসে পড়লেই আমরা ফিরে এসে বিজয়াকে আমাদের সমস্ত কল্যাণ-কামনা উজাড় করে ঢেলে দিয়ে যাব। আসুন।

[উভয়ের প্রস্থান। বিজয়া যাইবার পূর্বে টেবিলের চিঠিপত্রগুলা গুছাইয়া
রাখিতেছিল, কালীপদ মুখ বাড়াইয়া বলিল]

কালীপদ। মা, ডাক্তারসাহেব—
[বলিয়াই অদৃশ্য হইল। নরেন প্রবেশ করিয়া
hat ও ছড়িটা একপাশে রাখিতে রাখিতে]

নরেন। নমস্কার! পথ থেকে ফিরে এলুম, ভাবলুম, যে বদ্‌রাগী লোক আপনি, না এলে হয়ত ভয়ানক রাগ করবেন।

বিজয়া। ভয়ানক রেগে আপনার করতে পারি কি?

নরেন। কি করতে পারেন সেটা ত প্রশ্ন নয়, কি না করতে পারেন সেটাই আসল কথা। কিন্তু বাঃ! আমার ওষুধে দেখছি চমৎকার ফল হয়েছে।

বিজয়া। আপনার ওষুধে কি করে জানলেন? আমাকে দেখে, না কারো কাছে শুনে!

নরেন। শুনে। কেন, আপনি কি দয়ালবাবুর কাছে শোনেন নি যে আমার ওষুধ খেতে পর্যন্ত হয় না, শুধু প্রেস্‌ক্রিপশনটার ওপর চোখ বুলিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিলেও অর্ধেক কাজ হয়! হাঃ—হাঃ—হাঃ—

বিজয়া। (হাসিয়া ফেলিয়া) তাই বুঝি বাকী অর্ধেকটা সারাবার জন্যে পথ থেকে ফিরে এলেন? কিন্তু ওদিকে নলিনী বেচারা যে আপনার অপেক্ষা করে পথ চেয়ে রইল?

নরেন। তা বটে। দয়ালবাবুর স্ত্রীকে গিয়ে একবার দেখে আসতে হবে। কিন্তু আমাকে নিয়ে আচ্ছা কাণ্ড করলেন ত বিলাসবাবুর সঙ্গে! ছি ছি ছি ছি—হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ—

বিজয়া। এর মধ্যে বললে কে আপনাকে?

নরেন। দয়ালবাবু। এইমাত্র নীচে তাঁর সঙ্গে দেখা—ছি ছি ছি—আপনার ভারী অন্যায়! ভারী অন্যায়! হাঃ হাঃ হাঃ—

বিজয়া। অন্যায় আমার, কিন্তু আপনি এত খুশী হয়ে উঠলেন কেন?

নরেন। (গম্ভীর হইয়া) খুশী হয়ে উঠলুম? একেবারে না। অবশ্য এ কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে পারিনে যে শুনেই প্রথমে একটু আমোদ বোধ করেছিলুম, কিন্তু তারপরে বাস্তবিক দুঃখিত হয়েছি। আপনার মত বিলাসবাবুর মেজাজটাও তেমন ভাল নয়—ভবিষ্যতে আপনারা যে দিনরাত লাঠালাঠি করবেন!

বিজয়া। আপনি ত তাই চান।

নরেন। (জিভ কাটিয়া সলজ্জে) না না না না—ছি ছি, ও-কথা বলবেন না। সত্যিই আমি শুনে বড় ক্ষুণ্ণ হয়েছি। তাঁর মেজাজটা ভালো নয় বটে, কিন্তু আপনি নিজেও যে অসহিষ্ণু হয়ে কতকগুলো অপমানের কথা বলে ফেলবেন সে-ও ভারী অন্যায়। ভেবে দেখুন দিকি কথাটা প্রকাশ পেলে ভবিষ্যতে কি রকম লজ্জার কারণ হবে? বিশেষ করে আমার জন্যে আপনাদের মধ্যে এরূপ একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায়—

বিজয়া। তাই আহ্লাদে হাসি চাপতে পাচ্চেন না?

নরেন। (গম্ভীরমুখে) ছি ছি, কেন আপনি বার বার এ-রকম মনে করচেন? বিশ্বাস করুন যথার্থ-ই আমি বড় দুঃখিত হয়েছি। কিন্তু তখন আমি আপনাদের সম্বন্ধে কিছুই জানতুম না। জ্বরের ঘোরে কি সামান্য একটা কথা আপনি বললেন তাতেই এত! প্রথমে আমি ত হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলুম বিলাসবাবুর উগ্রতা দেখে, তারপরে বাইরে এনে রাসবিহারীবাবু আমাকে যা বুঝিয়ে বললেন তারও সঙ্কেত ঐ ঈর্ষা, এবং মিস নলিনীও স্পষ্ট বললেন ঈর্ষা, আর দয়ালবাবুও তাতেই যেন সায় দিলেন। শুনে লজ্জায় মরে যাই, অথচ সত্যি বলচি আপনাকে, এত লোকের মধ্যে আমার মত একটা নগণ্য লোককে বিলাসবাবুর ঈর্ষা করার কি আছে আমি ত আজও ভেবে পেলুম না। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) আপনারা ত আবশ্যক হলে সকলের সঙ্গে কথা কন, এতে এমনি কি দোষ তিনি দেখতে পেলেন? যাই হোক, আপনারা আমাকে মাপ করবেন—আর ঐ বাংলায় কি যে বলে—অভি—অভিনন্দন—আমিও আপনাকে তাই জানিয়ে যাচ্ছি, আপনারা সুখী হোন।

বিজয়া। (মুখ ফিরাইয়া) অভিনন্দন আজ না জানিয়ে বরঞ্চ সেইদিনই আশীর্বাদ করবেন।

নরেন। সেদিন? কিন্তু ততদিন পারব থাকতে?

বিজয়া। না, সে হবে না। রাসবিহারীবাবুকে কথা দিয়েছেন, আপনাকে থাকতেই হবে।

নরেন। কথা দিইনি বটে, কিন্তু দিতেই ইচ্ছে করে। যদি থাকি আসবই। (বিজয়া অলক্ষ্যে চোখ মুছিয়া ফেলিল) ভাল কথা। আমার আর একটা ক্ষমা চাইবার আছে। সেদিন কালীপদকে দিয়ে হঠাৎ microscope-টা পাঠিয়েছিলেন কেন?

বিজয়া। আপনার জিনিস আপনি নিজেই ত ফিরে চেয়েছিলেন।

নরেন। তা বটে, কিন্তু দামের কথাটা ত বলে পাঠান নি? তা হলে ত—

বিজয়া। আমার ভুল হয়েছিল। কিন্তু সেই ভুলের শাস্তি আপনি ত আমাকে কম দেননি!

নরেন। কিন্তু কালীপদ যে বললে—

বিজয়া। যাই বলুক সে, কিন্তু আপনাকে উপহার দেবার স্পর্ধা আমার থাকতে পারে এমন কথা কেমন করে বিশ্বাস করলেন? আর সত্যিই তাই যদি করে থাকি, কেন নিজের হাতে শাস্তি দিলেন না? কেন চাকরকে দিয়ে আমার অপমান করলেন? আপনার কি করেছিলুম আমি?

[শেষের দিকে তাহার গলা ভাঙ্গিয়া আসিল, সে উঠিয়া গিয়া
জানালার বাহিরে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল]

নরেন। কাজটা আমার যে ভাল হয়নি তা তখনি টের পেয়েছিলুম। তারপরে অনেক ভেবে দেখচি—আর ঐ দেখুন—ঐ ঈর্ষা জিনিসটা যে কত মন্দ তার সীমা নেই। ও যে শুধু নিজের ঝোঁকে বেড়ে চলে তাই নয়, সংক্রামকব্যাধির মত অপরকে আক্রমণ করতেও ছাড়ে না। আজ ত নিশ্চয় জানি আমাকে ঈর্ষা করার মত ভুল বিলাসবাবুর আর নেই, কিন্তু সেদিন নলিনীর মুখের ঐ ঈর্ষা শব্দটা আমার কানের মধ্যে গিয়ে বিঁধে রইল, কিছুতেই যেন আর ভুলতে পারিনে।

বিজয়া। (মুখ না ফিরাইয়া) তারপরে? ভুললেন কি করে?

নরেন। (হাসিয়া) অনেক চেষ্টায়। অনেক দুঃখে। কেবলি মনে হতে লাগল—নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে, নইলে মিছেমিছি কেউ কারুকে হিংসে করে না। আপনাকে আজ আমি সত্যি বলচি তার পরের ক’দিন চব্বিশ ঘণ্টাই শুধু আপনাকে ভাবতুম, আর মনে পড়ত আপনার জ্বরের ঘোরের সেই কথাগুলি। তাই ত বলেছিলুম এ কি ভয়ানক ছোঁয়াচে রোগ। কাজকর্ম চুলোয় গেল—দিবারাত্রি আপনার কথাই শুধু মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। এর কি আবশ্যক ছিল বলুন ত! আর শুধু কি এই? আপনাকে দেখার জন্যেই কেবল দু-তিনদিন এই পথে হেঁটে গেছি। দিনকতক সে এক আচ্ছা পাগলা ভূত আমার কাঁধে চেপেছিল।

[এই বলিয়া সে হাসিতে লাগিল। বিজয়া কোন কথা না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল]

নরেন। (সেইদিকে সবিস্ময়ে চাহিয়া) এ আবার কি হলো! রাগ করবার কথা কি বললুম!

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। আপনি চলে যাবেন না যেন। মা বলে দিলেন আপনি চা খেয়ে যাবেন।

নরেন। না না, তাঁকে বারণ করে দাও গে—আমি দয়ালবাবুর ওখানে চা খাব।

কালীপদ। কিন্তু মা দুঃখ করবেন যে!

নরেন। না, দুঃখ করবেন না। তাঁকে বলো গে আজ আমার সময় নেই।

কালীপদ। বলচি, কিন্তু তিনি কখখনো শুনবেন না।

[কালীপদ প্রস্থান করিল

[অন্য দ্বার দিয়া বিজয়া প্রবেশ করিল]

নরেন। অমন করে হঠাৎ চলে গেলেন যে বড়?

বিজয়া। কেমন করে চলে গেলুম শুনি?

নরেন। যেন রাগ করে।

বিজয়া। আপনার চোখের দৃষ্টিটা খুলচে দেখচি তা হলে! আচ্ছা, সেই ভূতের কাহিনীটি শেষ করুন এবার।

নরেন। কোন্‌ ভূতের কাহিনী?

বিজয়া। সেই যে পাগলা ভূতটা দিন–কতক আপনার কাঁধে চেপেছিল? সে নেবে গেছে ত?

নরেন। (সহাস্যে) ওঃ—তাই? হাঁ সে নেবে গেছে।

বিজয়া। যাক তা হলে বেঁচে গেছেন বলুন। নইলে আরও কতদিন যে আপনাকে এই পথে ঘোড়দৌড় করিয়ে বেড়াত কে জানে।

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। (নরেনকে দেখাইয়া) উনি চা খাবেন না।

বিজয়া। (কালীপদকে) কেন খাবেন না? যা তুই ঠিক করে আনতে বলে দি গে।

[কালীপদ প্রস্থান করিল

নরেন। আমাকে মাপ করবেন, আজ আমি চা খেতে পারব না।

বিজয়া। কেন পারবেন না?—আপনাকে নিশ্চয় খেয়ে যেতে হবে!

নরেন। (মাথা নাড়িয়া) না না, সে ঠিক হবে না। সেদিন তাঁদের কথা দিয়েছিলুম আজ এসে তাঁদের বাড়িতে খাব। না খেলে তাঁরা বড় দুঃখ করবেন।

বিজয়া। তাঁরা কে? দয়ালবাবুর স্ত্রী, না নলিনী?

নরেন। দুজনেই দুঃখ পাবেন। হয়ত আমার জন্যে আয়োজন করে রেখেচেন।

বিজয়া। আয়োজনের কথা থাক, কিন্তু দুঃখ পেতে বুঝি শুধু তাঁরাই আছেন, আর কেউ নেই নাকি?

নরেন। আর কেউ কে, দয়ালবাবু? ( হাসিয়া ) না না, তিনি বড় শান্ত মানুষ—সাদাসিধে নিরীহ লোক। তা ছাড়া তাঁকে ত এ বাড়িতেই দেখলুম। তাঁকে ভয় নেই, কিন্তু ওঁরা বড় রাগ করবেন।

বিজয়া। ওঁরা কারা নরেনবাবু? ওঁরা কেউ নেই—আছেন শুধু নলিনী। এখানে খেয়ে গেলে তিনিই রাগ করবেন। বলুন তাঁকেই আপনার ভয়, বলুন এই কথাই সত্যি।

নরেন। রাগ করতে আপনারা কেউ কম নয়। আপনাকে কথা দিয়ে সেখানে খেয়ে এলে আপনিই কি রাগ কম করতেন নাকি?

বিজয়া। হাঁ, তাই যান। শিগগির যান, আপনার অনেক দেরি হয়ে গেছে, আর আপনাকে আটকাব না।

নরেন। হাঁ, দেরি হয়ে গেছে বটে। ফিরে যাবার সাতটার ট্রেনটা হয়ত আর ধরতে পারব না।

বিজয়া। পারবেন না কেন? এখন থেকে সাতটা পর্যন্ত আপনাকে ধরে বসিয়ে নলিনী খাওয়াবেন নাকি? এখানে ত একটুখানি খেয়েই—না না করতে থাকেন, শত উপরোধেও কথা রাখেন না, উপেক্ষা করে উঠে পড়েন।

নরেন। একেবারে উলটো অভিযোগ? মানুষকে বেশী খাওয়ানোর রোগ আপনার চেয়ে সংসারে কারো আছে নাকি? উপেক্ষা করা? আপনাকে উপেক্ষা করে কারো নিস্তার আছে? ভয়েই ত সারা হয়ে যায়।

বিজয়া। কিন্তু আপনার ত ভয় নেই। এই ত স্বচ্ছন্দে উপেক্ষা করে চলে যাচ্চেন।

নরেন। উপেক্ষা করে নয়, তাঁদের কথা দিয়েছি বলে। আর খাওয়াই শুধু নয়, একটা বইয়ের কতকগুলো জিনিস নলিনীর বেধেছে সেইগুলো তাঁকে বুঝিয়ে দিতে হবে।

বিজয়া। কি বই?

নরেন। একটা ডাক্তারি বই। তাঁর ইচ্ছে বি. এ. পাসের পরে মেডিকেল কলেজে গিয়ে ভর্তি হন। তাই সামান্য যা জানি অল্পস্বল্প তাঁকে সাহায্য করি।

বিজয়া। আপনি কি তাঁর প্রাইভেট টিউটার? মাইনে কি পান?

নরেন। এ বলা আপনার অন্যায়। আপনার কথাবার্তায় আমার প্রায় মনে হয় তাঁর প্রতি আপনি প্রসন্ন নন। কিন্তু তিনি আপনাকে কত যে শ্রদ্ধা করেন জানেন না। এখানে এসে পর্যন্ত যত ভালো কাজ আপনি করেছেন সমস্ত তাঁর মুখে শুনতে পাই। আপনার কত কথা। এক কলেজে পড়তেন আপনারা — আপনি কলেজে আসতেন মস্ত একটা জুড়ি–গাড়ি করে, মেয়েরা সবাই চেয়ে থাকত। নলিনী বলছিলেন, যেমন রূপ তেমনি নম্র আচরণ,—পরিচয় ছিল না, কিন্তু তখন থেকে আমরা সবাই বিজয়াকে মনে মনে ভালবাসতুম। এমনি কত গল্প হয়।

বিজয়া। কেবল গল্পই যদি হয় আপনি পড়ান কখন?

নরেন। পড়াই কখন? আমি কি তাঁর মাস্টার, না পড়ানোর ভার আমার ওপর? আপনার কথাগুলো সব এত বাঁকা যে মনে হয় সোজা কথা বলতে কখনো শেখেন নি।

বিজয়া। শিখব কি করে, মাস্টার ত ছিল না।

নরেন। আবার সেই বাঁকা কথা!

বিজয়া। (হাসিয়া ফেলিয়া) কিন্তু আপনি যাবেন কখন? খাওয়া আজ না হয় না–ই হলো, কিন্তু পড়ানো না হলে যে ভয়ানক ক্ষতি!

নরেন। আবার সেই! চললুম। (টুপিটা হাতে লইয়া কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া দ্বারের নিকটে সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া) একটা কথা বলবার ছিল, কিন্তু ভয় হয় পাছে রাগ করে বসেন।

বিজয়া। রাগই যদি করি তাতে আপনার ভাবনা কি? দেনা শোধ করুন বলে চোখ রাঙ্গাবো সে জো–ও নেই। ভয়টা আপনার কিসের?

নরেন। আবার তেমনি বাঁকা কথা। কিন্তু শুনুন। এখানে এসে পর্যন্ত আপনি বহু সৎকার্য করেছেন। কত দুঃস্থ প্রজার খাজনা মাপ করেছেন, কত দরিদ্রকে দান করেছেন, ধর্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন—

বিজয়া। এ-সব শোনালে কে? নলিনী?

নরেন। হাঁ, তাঁর মুখেই শুনেছি। কত দরিদ্র কত কি পেলে, আমি কি কিচ্ছু পাব না? আমাকে সেই মাইক্রোস্কোপটা আজ উপহার দিন, কাল–পরশু দামটা তার পাঠিয়ে দেব।

বিজয়া। দাম দিয়ে উপহার নেবার বুদ্ধি আপনাকে কে যোগালে? নলিনী?

নরেন। না না, তিনি নয়। তিনি শুধু বলছিলেন সেটা আপনার ত কোন কাজে লাগল না, কিন্তু তিনি পেলে অনেক কিছু শিখতে পারেন—সে শিক্ষা পরে তাঁর অনেক কাজে লাগবে।

বিজয়া। অর্থাৎ, সেটা গিয়ে পৌঁছবে তাঁর হাতে? আমি বেচলে আপনি নিয়ে গিয়ে তাঁকে উপহার দেবেন—এই ত প্রস্তাব?

নরেন। না না, তা নয়। কিন্তু সেটা আপনারও কোন কাজে এল না, অথচ, সকলেরই চক্ষুশূল হয়ে রইল। তাই বলছিলুম—

বিজয়া। বলার কোন দরকার ছিল না নরেনবাবু। আপনার টাকার অভাব নেই, দোকানেও মাইক্রোস্কোপ কিনতে পাওয়া যায়। কিনেই যদি উপহার দিতে হয় তাঁকে বাজার থেকে কিনেই দিবেন। এটা আমার চক্ষুশূল হয়েই আমার কাছে থাক।

নরেন। কিন্তু—

বিজয়া। কিন্তুতে আর কাজ নেই। আপনি নিরর্থক নিজেরও সময় নষ্ট করছেন, আমারও করছেন। আরও ত কাজ আছে।

নরেন। (ক্ষণকাল হতবুদ্ধিভাবে চাহিয়া থাকিয়া) আপনার সুমুখে সব কথা আমি গুছিয়ে বলতে পারিনে, আপনিও রেগে ওঠেন। হয়ত আপনার মনে হয় নিজের অবস্থাকে ডিঙিয়ে আপনাদের সমকক্ষ হয়ে আমি চলতে চাই, কিন্তু তা কখনো সত্যি নয়। আপনার বাড়িতে আসতে কত যে সঙ্কুচিত হই সে আমিই জানি। এসে কি বলতে কি বলি, নিজের ওজন রাখতে পারিনে, আপনি উত্যক্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু সে আমার অন্যমনস্ক প্রকৃতির দোষে, আপনাকে অমর্যাদা করার জন্যে না। কিন্তু আর আপনাকে বিরক্ত করতে আমি আসব না। নমস্কার।

[নরেন ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল

[ব্যগ্রপদে রাসবিহারীর প্রবেশ। তাঁহার পিছনে দয়াল, হাতে রৌপ্যপাত্রে ফুল, চন্দন ও একজোড়া মোটা সোনার বালা। তাঁহার পিছনে দুইজন ভৃত্যের হাতে ফুল, মালা ইত্যাদি এবং তাহাদের পিছনে কর্মচারীর দল। বিজয়া চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল]

রাস। মা বিজয়া, আজ যে নব–বৎসরের প্রথম দিন সে কথা কি তোমার স্মরণ আছে?

বিজয়া। একটু পূর্বেই আপনি বলে গেলেন, নইলে ছিল না।

রাস। (মৃদু হাসিয়া) তুমি ভুলতে পার, কিন্তু আমি ভুলি কি করে? এই যে আমার ধ্যান–জ্ঞান। বনমালী বেঁচে থাকলে আজকের দিনে তিনি কি করতেন মনে পড়ে মা?

বিজয়া। পড়ে বৈ কি। আজকের দিনে বিশেষ করে তিনি আমাকে আশীর্বাদ করতেন।

রাস। বনমালী নেই, কিন্তু আমি আজ আছি। ভেবেছিলাম এই কর্তব্য প্রভাতেই নিষ্পন্ন করব, তোমাদের স্বাস্থ্য, আয়ু, নির্বিঘ্ন–জীবন ভগবানের শ্রীচরণে প্রসাদ ভিক্ষা করে নেব, কিন্তু নানা কারণে তাতে বাধা পড়ল। কিন্তু বাধা ত সত্যি নয়, সে মিথ্যে। তাকে স্বীকার করে নিতে পারিনে ত মা! জানি আজ তোমার মন চঞ্চল, তবু দয়ালকে বললাম, ভাই, আজকের এই পুণ্যদিনটিকে আমি ব্যর্থ যেতে দিতে পারব না, তুমি আয়োজন কর। আয়োজন যত অকিঞ্চনই হোক,—কিন্তু নিজেই যে আমি বড় অকিঞ্চন মা! দয়াল বললেন, সময় কৈ? বেলা যে যায়। সজোরে বললুম, যায়নি বেলা—আছে সময়। কোন বিঘ্নই আজ আমি মানব না। আয়োজনের স্বল্পতায় কি আসে–যায় দয়াল, আড়ম্বরে বাইরের লোককেই শুধু ভোলানো যায়, কিন্তু এ যে বিজয়া! মা যে বুঝবেই এ তার পিতৃকল্প কাকাবাবুর অন্তরের শুভ–কামনা। লোক ছুটল আমার বাড়িতে, বাগানে ছুটল মালী ফুল তুলতে—মাঙ্গলিক যা– কিছু সংগৃহীত হতে বিলম্ব ঘটল না। মুকুট-মালা না-ই বা হলো—এ যে কাকাবাবুর আশীর্বাদ! কিন্তু বিলাস এল না কেন? তখনি স্মরণ হলো সে আসবে কি করে? সে সাহস তার কৈ? ভাবলাম ভালই হয়েছে যে সে লজ্জায় লুকিয়ে আছে। এমনিই হয় মা,—অপরাধের দণ্ড এমনি করেই আসে। জগদীশ্বর! (একমুহূর্ত পরে) তখন কাছারিঘরে ডাক দিয়ে বললাম, তোমরা কে কে আছ এসো আমাদের সঙ্গে। আজকের দিনে তোমাদের কাছেও বিজয়ার চিরদিনের কল্যাণ–ভিক্ষা করে আমি নিতে চাই। এসো ত মা আমার কাছে। (এই বলিয়া তিনি নিজেই অগ্রসর হইয়া গেলেন। বিজয়া উদ্‌ভ্রান্ত–মুখে এতক্ষণ নীরবে চাহিয়াছিল, এইবার ঘাড় হেঁট করিল। রাসবিহারী তাহার কপালে চন্দনের ফোঁটা দিলেন, মাথায় ফুল ছড়াইয়া দিতে দিতে ) সংসারে আনন্দ লাভ কর, স্বাস্থ্য–আয়ু–সম্পদ লাভ কর, ব্রহ্মপদে অবিচলিত শ্রদ্ধা–ভক্তি–বিশ্বাস লাভ কর, আজকের পুণ্যদিনে এই তোমার কাকাবাবুর আশীর্বাদ মা।

[বিজয়া দুই হাত জোড় করিয়া নিজের ললাট স্পর্শ করিয়া নমস্কার
করিল। অনেকের হাতেই ফুল ছিল তাহারা ছড়াইয়া দিল]

রাস। দেখি মা তোমার হাত–দুটি—(এই বলিয়া বিজয়ার হাত টানিয়া লইয়া একে একে সেই সোনার বালা–দুটি পরাইয়া দিলেন) টাকার মূল্যে এ–বালার দাম নয় মা, এ তোমার—(দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া) এ আমার বিলাসের জননীর হাতের ভূষণ। চেয়ে দেখ মা কত ক্ষয়ে গেছে। মৃত্যুকালে তিনি বলেছিলেন এ যেন না কখনো নষ্ট করি, এ যেন শুধু আজকের দিনের জন্যেই—

[রাসবিহারীর বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠস্বর এইবার একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িল]

দয়াল। (আশীর্বাদ করিতে কাছে আসিয়া ব্যস্তভাবে) মা, মুখখানি যে বড় পাণ্ডুর দেখাচ্চে, অসুখ করেনি ত?

বিজয়া। (মাথা নাড়িয়া) না।

দয়াল। সুখী হও, আয়ুষ্মতী হও, জগদীশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি।

[বিজয়া জানু পাতিয়া তাঁহার পায়ের কাছে প্রণাম করিল]

দয়াল। (ব্যস্ত হইয়া) থাক মা থাক—আনন্দময় তোমাকে আনন্দে রাখুন। কিন্তু মুখ দেখে তোমাকে বড় শ্রান্ত মনে হচ্চে। বিশ্রাম করার প্রয়োজন।

রাস। প্রয়োজন বৈ কি দয়াল, একান্ত প্রয়োজন। আজ বনমালীর উল্লেখ করে হয়তো তোমার মনে বড় কষ্ট দিয়েছি, কিন্তু না করেও যে উপায় ছিল না। আজকের শুভদিনে তাঁকে স্মরণ করা যে আমার কর্তব্য। কিন্তু আর কথা কয়ে তোমাকে ক্লান্ত করব না মা, যাও বিশ্রাম কর গে। দয়াল, চল ভাই আমরা যাই। (কর্মচারীদের লক্ষ্য করিয়া) তোমরা সকলেই বয়োজ্যেষ্ঠ, তোমাদের মঙ্গলকামনা কখনো নিষ্ফল হবে না। শুধু দয়াল নয়, তোমাদের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু চল সকলে যাই, মাকে বিশ্রাম করার একটু অবসর দিই।

[সকলের একে একে প্রস্থান

[বিজয়া বালা–জোড়া হাত হইতে খুলিয়া ফেলিল এবং নিঃশব্দে ফিরিয়া আসিয়া টেবিলে মাথা রাখিয়া উপবেশন করিল। ক্ষণেক পরে পরেশ প্রবেশ করিয়া ক্ষণকাল নীরবে চাহিয়া রহিল]

পরেশ। মা গো!

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া) কি রে পরেশ?

পরেশ। তোমার যে বিয়ে হবে গো!

বিজয়া। বিয়ে হবে? কে তোরে বললে?

পরেশ। সবাই বলচে। এই যে আশীর্বাদ হয়ে গেল আমরা সবাই দেখনু।

বিজয়া। কোথা দিয়ে দেখলি?

পরেশ। উই দোরের ফাঁক দিয়ে। আমি, মা, সতুর পিসী—সব্বাই। দু-গণ্ডা পয়সা দাও না মা, একটা ভালো নাটাই কিনব—(জানালার বাহিরে দৃষ্টিপাত করিয়া) উই গো! ডাক্তারবাবু যায় মা। হনহন করে চলেচ ইস্টিসানে—

বিজয়া। (দ্রুতপদে জানালার কাছে আসিয়া বাহিরে চাহিয়া) পরেশ, ধরে আনতে পারিস ওঁকে? তোকে খুব ভালো লাটাই কিনে দেব।

পরেশ। দেবে ত মা?

[পরেশ দৌড় মারিল। পরেশের মা মৃদুপদে প্রবেশ করিল]

পরেশের মা। আজকে কি কিছু খাবে না দিদিমণি? একফোঁটা চা পর্যন্ত যে খাওনি! (টেবিলের কাছে আসিয়া বালা-দুটা হাতে তুলিয়া লইয়া) একি কাণ্ড! আজকের দিনে কি হাত থেকে সরাতে আছে দিদিমণি! তোমার যে ভুলো মন, হয়ত এখানেই ফেলে চলে যাবে, যার চোখে পড়বে সে কি আর দেবে!—তোমার পরেশকে কিন্তু একটা আংটি গড়িয়ে দিতে হবে দিদিমণি, তার কতদিনের শখ।

বিজয়া। আর তোমাকে একটা হার,—না?

পরেশের মা। তামাশা করছ বটে, কিন্তু না নিয়েই কি ছাড়ব ভেবেছ?

বিজয়া। না, ছাড়বে কেন, এই ত তোমাদের পাবার দিন।

পরেশের মা। সত্যি কথাই ত! এসব কাজকর্মে পাব না ত কবে পাব বল ত? পাওনা যাবে না আমাদের, তোলাই আছে, কিন্তু কি খাবে বলত? এক বাটি চা আর কিছু খাবার নিয়ে আসব? না হয় তোমার শোবার ঘরে চল, আমি সেখানেই দিয়ে আসি গে।

বিজয়া। তাই যাও পরেশের মা, আমার শোবার ঘরেই দাও গে।

পরেশের মা। যাই দিদিমণি, বামুনঠাকুরকে দিয়ে খান-কতক গরম লুচি ভাজিয়ে নিই গে।

[পরেশের মা চলিয়া গেল। প্রবেশ করিল পরেশ এবং তাহার পিছনে নরেন]

বিজয়া। এই নে পরেশ একটা টাকা। খুব ভালো লাটাই কিনিস, ঠকিস নে যেন!

পরেশ। না—

[পরেশ নিমিষে অদৃশ্য হইয়া গেল

নরেন। ওঃ—তাই ওর এত গরজ! আমাকে নিশ্বাস নেবার সময় দিতে চায় না। লাটাই কেনার টাকা ঘুষ দেওয়া হলো! কিন্তু কেন? হঠাৎ যে আবার ডাক পড়ল?

বিজয়া। (ক্ষণকাল নরেনের মুখের প্রতি চাহিয়া) মুখ ত শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেচে। কি খেলেন সেখানে?

নরেন। খাইনি। দোরগোড়া পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলুম, ঢুকতে ইচ্ছেই হলো না।

বিজয়া। কেন?

নরেন। কি জানি কেন! মনে হলো কোথাও কারো কাছে আর যাবো না,—এদিকেই আর আসব না।

বিজয়া। আমি মন্দ লোক, মিছিমিছি রাগ করি, আর আপনি ভয়ানক ভালো লোক—না?

নরেন। কে বলেছে আপনাকে মন্দ লোক?

বিজয়া। আপনি বলেছেন। আমাকেই অপমান করলেন, আর আমাকেই শাস্তি দিতে না খেয়ে কলকাতা চলে যাচ্ছেন—কি করেছি আপনার আমি?

[বলিতে বলিতে তাহার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল এবং তাহাই গোপন
করিতে সে জানালার বাহিরে মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল]

নরেন। কি আশ্চর্য! বাসায় ফিরে যাচ্চি তাতেও আমার দোষ!

[কালীপদ প্রবেশ করিল]

কালীপদ। মা, আপনার শোবার ঘরে খাবার দেওয়া হয়েছে!

বিজয়া। (নরেনের প্রতি) চলুন আপনার খাবার দিয়েছে।

নরেন। আমার কি রকম? আমি যে আসব নিজেই ত জানতুম না।

বিজয়া। আমি জানতুম, চলুন।

নরেন। আমার খাবার ব্যবস্থা আপনার শোবার ঘরে? এ কখনো হয়? হাঁ কালীপদ, কার খাবার দেওয়া হয়েছে সত্যি করে বল ত?

কালীপদ। আজ্ঞে মা’র। আজ সারাদিন উনি প্রায় কিছুই খাননি।

নরেন। তাই সেগুলো এখন আমাকে গিলতে হবে? দেখুন, অন্যায় হচ্চে—এতটা জুলুম আমার ‘পরে চালাবেন না।

বিজয়া। কালীপদ, তুই নিজের কাজে যা। যা জানিস নে তাতে কেন কথা বলিস বল ত? (নরেনের প্রতি) চলুন, ওপরের ঘরে।

নরেন। চলুন, কিন্তু ভারী অন্যায় আপনার।

[সকলের প্রস্থান

বিজয়া – ৩.২

দ্বিতীয় দৃশ্য

বিজয়ার শয়ন-কক্ষ

[বিজয়া ও নরেন প্রবেশ করিল। একটা টেবিলের উপর বহুবিধ ভোজ্যবস্তু বিজয়া হাত দিয়া দেখাইয়া]

বিজয়া। খেতে বসুন।

নরেন। (বসিতে বসিতে) এইখানে আপনারও কেন খাবার এনে দিক না। সারাদিন ত খাননি?

বিজয়া। খাইনি বলে এইখানে এনে দেবে? আপনি কে যে আপনার সুমুখে এক টেবিলে বসে আমি খাব! বেশ প্রস্তাব!

নরেন। আমার সব কথাতেই দোষ ধরা যেন আপনার স্বভাব। তা ছাড়া এমনি রূঢ়ভাষী যে আপনার কথাগুলো গায়ে ফোটে। এত শক্ত কথা বলেন কেন?

বিজয়া। শক্ত কথা বুঝি আর কেউ আপনাকে বলে না?

নরেন। না, কেউ না। শুধু আপনি। ভেবে পাইনে কেন এত রাগ?

বিজয়া। সেই ভাঙ্গা মাইক্রোস্‌কোপটা আমাকে ঠকিয়ে বিক্রি করা পর্যন্ত আমার রাগ আর যায় না—আপনাকে দেখলেই মনে পড়ে।

নরেন। মিছে কথা, সম্পূর্ণ মিছে কথা। বেশ জানেন আপনি জিতেছেন।

বিজয়া। বেশ জানি জিতিনি, সম্পূর্ণ ঠকেচি। সে হোক গে—কিন্তু আপনি খেতে বসুন ত। সাতটার ট্রেন ত গেলই ন’টার গাড়িটাও কি ফেল করবেন?

নরেন। না না, ফেল করব না, ঠিক ধরব।

[নরেন আহারে মন দিল। কালীপদ উঁকি মারিল]

কালীপদ। মা, আপনার খাবার জায়গা কি—

বিজয়া। না, এখন না।

[কালীপদ সরিয়া গেল

নরেন। আপনার বাড়িতে চাকরদের মুখের এই ‘মা’ সম্বোধনটি আমার ভারী ভালো লাগে।

বিজয়া। তাদের মুখের আর কোন সম্বোধন আছে নাকি?

নরেন। আছে বৈ কি। মেমসাহেব বলা—

বিজয়া। আপনি ভারী নিন্দুক। কেবল পরচর্চা।

নরেন। যা দেখতে পাই তা বলব না?

বিজয়া। না। আপনার কাজ শুধু মুখ বুজে খাওয়া। কিচ্ছুটি যেন পড়ে থাকতে না পায়।

নরেন। তা হলে মারা যাব। এর মধ্যেই আমার পেট ভরে এসেছে।

বিজয়া। না আসেনি। বরঞ্চ এক কাজ করুন, পরের নিন্দে করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে খান। সমস্ত না খেলে কোনমতে ছুটি পাবেন না।

নরেন। আপনি এতেই বলচেন খাওয়া হলো না,—কিন্তু কলকাতায় আমার রোজকার খাওয়া যদি দেখেন ত অবাক হয়ে যাবেন। দেখছেন না এই ক’মাসের মধ্যেই কি রকম রোগা হয়ে গেছি। আমার বাসায় বামুন ব্যাটা হয়েছে যেমন পাজী, তেমনি বদমাইশ জুটেছে চাকরটা। সাত সকালে রেঁধে রেখে কোথায় যায় তার ঠিকানা নেই। আমার কোনদিন ফিরতে হয় দুটো,—কোনদিন বা চারটে বেজে যায়। সেই ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাত—দুধ কোনদিন বা বেড়ালে খেয়ে যায়, কোনদিন বা জানালা দিয়ে কাক ঢুকে সমস্ত ছড়াছড়ি করে রাখে,—সে দেখলেই ঘৃণা হয়। অর্ধেক দিন ত একেবারেই খাওয়া হয় না।

বিজয়া। এমন সব চাকর-বাকরদের দূর করে দিতে পারেন না? নিজের বাসায় এত টাকা খরচ করেও যদি এত কষ্ট, তবে চাকরি করাই বা কেন?

নরেন। এক হিসাবে আপনার কথা সত্যি। একদিন বাক্স থেকে কে দুশো টাকা চুরি করে নিলে, একদিন নিজেই কোথায় একশো টাকা হারিয়ে ফেললুম, অন্যমনস্ক লোকের পদে পদেই বিপদ কিনা। (একটু থামিয়া) তবে নাকি দুঃখকষ্ট আমার অনেকদিন থেকেই সয়ে গেছে, তাই তেমন গায়ে লাগে না। শুধু অত্যন্ত ক্ষিদের ওপর খাওয়ার কষ্টটা এক-একদিন অসহ্য বোধ হয়।

[বিজয়া আনতমুখে নীরবে শুনিতেছিল]

নরেন। বাস্তবিক, চাকরি আমার ভালোও লাগে না, পারিও নে। অভাব আমার খুবই সামান্য—আপনার মত কোনো বড়লোক দুবেলা দুটি-দুটি খেতে দিত, আর নিজের কাজ নিয়ে থাকতে পারতুম ত আর আমি কিছুই চাইতুম না। কিন্তু সেরকম বড়লোক কি আর আছে! (হঠাৎ হাসিয়া) তারা ভারী সেয়ানা, এক পয়সা বাজে খরচ করতে চায় না।

[এই বলিয়া পুনরায় সে হাসিয়া উঠিল। বিজয়া তেমনি নিরুত্তরে বসিয়া রহিল]

নরেন। কিন্তু আপনার বাবা বেঁচে থাকলে হয়ত এ-সময়ে আমার অনেক উপকার হতে পারত—তিনি নিশ্চয় এই উঞ্ছবৃত্তি থেকে আমাকে রক্ষা করতেন।

বিজয়া। কি করে জানলেন? তাঁকে ত আপনি চিনতেন না।

নরেন। না, আমিও তাঁকে কখনো দেখিনি, তিনিও বোধ হয় কখনো দেখেন নি। কিন্তু তবুও আমাকে খুব ভালবাসতেন। কে আমাকে টাকা দিয়ে বিলেত পাঠিয়েছিল জানেন? তিনিই। আচ্ছা আমাদের ঋণের সম্বন্ধে আপনাকে কি কখনো কিছু তিনি বলে যাননি?

বিজয়া। বলাই ত সম্ভব, কিন্তু আপনি ঠিক কি ইঙ্গিত করছেন তা না বুঝলে ত জবাব দিতে পারিনে।

নরেন। (ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া) থাক গে। এখন এ আলোচনা একেবারে নিষ্প্রয়োজন।

বিজয়া। (ব্যগ্র হইয়া) না, বলুন—বলতেই হবে।—আমি শুনবোই।

নরেন। কিন্তু যা চুকেবুকে শেষ হয়ে গেছে তা আর শুনে কি হবে বলুন?

বিজয়া। না সে হবে না, আপনাকে বলতেই হবে।

নরেন। (হাসিয়া) বলা যে শুধু নিরর্থক তাই নয়—বলতে আমার নিজেরও লজ্জা করে। হয়ত আপনার মনে হবে আমি কৌশলে আপনার সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে—

বিজয়া। (অধীরভাবে) আমি আর খোশামোদ করতে পারিনে আপনাকে—আপনার পায়ে পড়ি বলুন।

নরেন। খাওয়া-দাওয়ার পরে?

বিজয়া। না এখুনি।

নরেন। আচ্ছা, বলচি বলচি। কিন্তু তার পূর্বে একটা কথা জিজ্ঞেসা করি, আমার বাড়িটার ব্যাপারে সত্যিই কি তিনি কোনদিন কোন কথা আপনাকে বলেন নি? (বিজয়া অধিকতর অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল।) আচ্ছা, রাগ করে কাজ নেই, আমি বলচি। যখন বিলেত যাই তখন বাবার মুখে শুনেছিলুম, আপনার বাবাই আমাকে পাঠাচ্চেন। আজ দিন-চারেক আগে দয়ালবাবু আমাকে একতাড়া চিঠি দেন। নীচের যে ঘরটায় ভাঙ্গাচোরা কতকগুলো আসবাব পড়ে আছে তারই একটা ভাঙ্গা দেরাজের মধ্যে চিঠিগুলো ছিল—বাবার জিনিস বলে দয়ালবাবু আমার হাতেই দেন। পড়ে দেখলুম খান-দুই চিঠি আপনার বাবার লেখা। শুনেছেন বোধ হয় শেষ বয়সে বাবা দেনার জ্বালায় জুয়া খেলতে শুরু করেন। বোধ করি সেই ইঙ্গিত একটা চিঠির গোড়ায় ছিল। তারপরে নীচের দিকে এক জায়গায় তিনি উপদেশের ছলে সান্ত্বনা দিয়ে বাবাকে লিখেছেন, বাড়িটার জন্যে ভাবনা নেই—নরেন আমারও ত ছেলে, বাড়িটা তাকেই যৌতুক দিলুম।

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া) তারপরে?

নরেন। তারপরে সব অন্যান্য কথা। তবে, এ পত্র বহুদিন পূর্বের লেখা। খুব সম্ভব, তাঁর এ অভিপ্রায় পরে বদলে গিয়েছিল বলেই কোন কথা আপনাকে বলে যাওয়া তিনি আবশ্যক মনে করেন নি।

বিজয়া। (কয়েক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া) তাহলে বাড়িটা দাবী করবেন বলুন? (হাসিল)

নরেন। (হাসিয়া) করলে আপনাকেই সাক্ষী মানব। আশা করি সত্যি কথাই বলবেন।

বিজয়া। (ঘাড় নাড়িয়া) নিশ্চয়। কিন্তু সাক্ষী মানবেন কেন?

নরেন। নইলে প্রমাণ হবে কিসে? বাড়িটা যে সত্যই আমার সে কথা ত আদালতে প্রতিষ্ঠিত করা চাই।

বিজয়া। অন্য আদালতে দরকার নেই,—বাবার আদেশ আমার আদালত। ও-বাড়ি আপনাকে আমি ফিরিয়ে দেব।

নরেন। (পরিহাসের ভঙ্গীতে) চিঠিটা চোখে না দেখেই বোধ হয় ফিরিয়ে দেবেন!

বিজয়া। না, চিঠি আমি দেখতে চাই। কিন্তু এই এ কথাই যদি থাকে—বাবার হুকুম আমি কোনমতেই অমান্য করব না।

নরেন। তাঁর অভিপ্রায় যে শেষ পর্যন্ত এই ছিল তারই বা প্রমাণ কোথায়?

বিজয়া। ছিল না তারও ত প্রমাণ চাই।

নরেন। কিন্তু আমি যদি না নিই? দাবী না করি?

বিজয়া। সে আপনার ইচ্ছে। কিন্তু সে-ক্ষেত্রে আপনার পিসীর ছেলেরা আছেন। আমার বিশ্বাস অনুরোধ করলে তাঁরা দাবী করতে অসম্মত হবেন না।

নরেন। (সহাস্যে) তাঁদের ওপর এ বিশ্বাস আমারও আছে। এমন কি হলফ নিয়ে বলতেও রাজী আছি। (বিজয়া এ হাসিতে যোগ দিল না। চুপ করিয়া রহিল) অর্থাৎ, আমি নিই-না-নিই আপনি দেবেনই।

বিজয়া। অর্থাৎ, বাবার দান-করা জিনিস আমি আত্মসাৎ করব না এই আমার পণ।

নরেন। (শান্তস্বরে) ও-বাড়ি যখন সৎকাজে দান করেছেন তখন আমি না নিলেও আপনার আত্মসাৎ করায় অধর্ম হবে না। তা ছাড়া ফিরিয়ে নিয়ে কি করব বলুন? আপনার জন কেউ নেই যে তারা বাস করবে। বাইরে কোথাও কাজ না করলে আমার চলবে না, তার চেয়ে যে ব্যবস্থা হয়েছে সেই ত সবচেয়ে ভালো। আরও এক কথা এই যে, বিলাসবাবুকে কিছুতেই রাজী করাতে পারবেন না।

বিজয়া। নিজের জিনিসে অপরকে রাজী করানোর চেষ্টা করার মত অপর্যাপ্ত সময় আমার নেই। কিন্তু আপনি ত আর এক কাজ করতে পারেন। বাড়ি যখন আপনার দরকার নেই, তখন তার উচিত মূল্য আমার কাছে নিন। তা হলে চাকরিও করতে হবে না, এবং নিজের কাজও স্বচ্ছন্দে করতে পারবেন। আপনি সম্মত হোন নরেনবাবু।

[এই মিনতিপূর্ণ কণ্ঠস্বর নরেনকে মুগ্ধ করিল, চঞ্চল করিল]

নরেন। আপনার কথা শুনলে রাজী হতেই ইচ্ছে করে, কিন্তু সে হয় না। কি জানি কেন আমার বহুবার মনে হয়েছে, বাবার ঋণের দায়ে বাড়িটা নিয়ে মনের মধ্যে আপনি সুখী হতে পারেন নি, তাই কোন একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করে ফিরিয়ে দিতে চান। এ দয়া আমি চিরদিন মনে রাখব, কিন্তু যা আমার প্রাপ্য নয় গরীব বলেই তা ভিক্ষের মত নেব কি করে?

বিজয়া। এ কথায় আমি কত কষ্ট পাই জানেন?

নরেন। মানুষের কথায় মানুষ কষ্ট পায় এ কি কখনো হতে পারে? কেউ বিশ্বাস করবে?

বিজয়া। দেখুন, আপনি খোঁচা দেবার চেষ্টা করবেন না। আপনি কষ্ট পান এমনধারা কথা আমি কোনদিন বলিনি।

নরেন। কিন্তু এই যে বলছিলেন ঠকিয়ে মাইক্রস্‌কোপ বেচে গেছি! অতি শ্রুতিমধুর বাক্য—না?

বিজয়া। (হাসিয়া ফেলিয়া) কিন্তু সেটা যে সত্যি।

নরেন। হাঁ, সত্যি বৈ কি!

বিজয়া। আপনি গরীব হোন, বড়লোক হোন, আমার কি? আমি কেবল বাবার আদেশ পালন করার জন্যেই বাড়িটা আপনাকে ফিরিয়ে দিতে চাচ্চি।

নরেন। এর মধ্যেও একটু মিথ্যে রয়ে গেল—তা থাক। খুব বড় বড় পণ ত করলেন, কিন্তু বাবার হুকুমমত দিতে হলে কত জিনিস দিতে হয় তা জানেন? শুধু ওই বাড়িটাই নয়।

বিজয়া। বেশ, নিন আপনার সম্পত্তি ফিরে।

নরেন। (হাসিয়া মাথা নাড়িতে নাড়িতে) খুব বড় গলায় দাবী করতে আমাকে বলচেন, আমি না করলে আমার পিসীমার ছেলেদের দাবী করতে বলবেন ভয় দেখাচ্চেন, কিন্তু তাঁর আদেশ মত দাবী আমার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে জানেন? শুধু কেবল ওই বাড়িটা আর কয়েক বিঘে জমি নয়—তার ঢের ঢের বেশী।

বিজয়া। বাবা আর কি আপনাকে দিয়েছেন?

নরেন। তাঁর সে চিঠিও আমার কাছে আছে। তাতে যৌতুক শুধু ঐটুকু দিয়েই আমাকে তিনি বিদায় করেন নি। যেখানে যা-কিছু দেখচেন সমস্তই তার মধ্যে। আমি দাবী শুধু ওই বাড়িটা করতে পারি তাই নয়। এ বাড়ি, এই ঘর, ওই সমস্ত টেবিল-চেয়ার-আয়না-দেয়ালগিরি-খাট-পালঙ্ক, বাড়ির দাস-দাসী-আমলা-কর্মচারী, মায় তাদের মনিবটিকে পর্যন্ত দাবী করতে পারি তা জানেন কি? বাবার হুকুম, বাবার হুকুম,—দেবেন এই-সব? (বিজয়া পাথরের মূর্তির মত নীরবে নতমুখে বসিয়া রহিল) কেমন, দিতে পারবেন বলে মনে হয়? বরঞ্চ একবার না হয় বিলাসবাবুর সঙ্গে নিরিবিলি পরামর্শ করবেন। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ— (বিজয়া মুখ তুলিতেই তাহার পাংশু মুখের প্রতি চাহিয়া নরেনের বিকট হাস্য থামিল) (সভয়ে) আপনি পাগল হলেন নাকি? আমি কি সত্যিই এই-সব দাবী করতে যাচ্ছি, না, করলেই পাব? বরঞ্চ, আমাকেই ত ধরে নিয়ে পাগলা-গারদে পুরে দেবে।

বিজয়া। (গম্ভীর মুখে) কৈ, দেখি বাবার চিঠি?

নরেন। কি হবে দেখে?

বিজয়া। না দিন, আমি দেখব।

নরেন। চিঠির তাড়াটা সেদিন থেকে এই কোটের পকেটেই রয়ে গেছে। এই নিন। কিন্তু আত্মসাৎ করবেন না যেন। পড়ে ফেরত দেবেন।

[পকেট হইতে এক বাণ্ডিল চিঠি সে বিজয়ার সম্মুখে ফেলিয়া দিল। বিজয়া দ্রুতহস্তে বাঁধন খুলিয়া একটার পর একটা উলটাইতে উলটাইতে দু’খানা চিঠি বাছিয়া লইয়া]

বিজয়া। এই ত আমার বাবার হাতের লেখা। বাবা! বাবা!

[চিটি দুটা সে মাথায় রাখিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। নরেন অন্য চিঠিগুলি তুলিয়া লইয়া নিঃশব্দে চলিয়া গেল]

বিজয়া – ৩.৩

তৃতীয় দৃশ্য

বিজয়ার অট্টালিকা-সংলগ্ন উদ্যানের একাংশ

[গৃহের কিছু কিছু গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায়। পরেশ কোঁচড়ে মুড়ি-মুড়কি লইয়া আপন মনে চিবাইতে চিবাইতে চলিয়াছিল, পিছনে দ্রুতবেগে রাসবিহারী প্রবেশ করিলেন]

রাস। এই হারামজাদা ব্যাটা! দাঁড়া,—দাঁড়া বলচি।

পরেশ। (থমকিয়া দাঁড়াইয়া চাহিল) এজ্ঞে?

রাস। এজ্ঞে! হারামজাদা শূয়ার! কেন সেই নরেনটাকে তুই বাড়িতে ডেকে এনেছিলি?

পরেশ। মা-ঠাকরুন বললে যে।

রাস। মা-ঠাকরুন বললে যে! কত রাত্তিরে সে ব্যাটা বাড়ি থেকে গেল বল।

পরেশ। আমি ত জানিনে বড়বাবু!

রাস। জানিস নে হারামজাদা! বল তোর মা-ঠাকরুন নরেনকে কি কি কথা বললে?

পরেশ। আমি ছিনু না বড়বাবু! মা-ঠান বললে, এই নে পরেশ একটা টাকা, ভাল দেখে ঘুড়ি-নাটাই কিন গে। আমি ছুট্টে চলে গেনু।

রাস। এখনো সত্যি কথা বল, নইলে পেয়াদা দিয়ে চাবকে তোর পিঠের চামড়া তুলে দেব।

পরেশ। (কাঁদ-কাঁদ হইয়া) সত্যি বলচি জানিনে বড়বাবু। নতুন দরোয়ান তোমাকে মিছে কথা বলেচে! তুমি বরঞ্চ আমার মাকে জিজ্ঞেসা করো গে।

রাস। তোর মা? সে বেটী যত নষ্টের গোড়া। তোকেও দূর করব, তাকেও দূর করব পেয়াদা দিয়ে গলায় ধাক্কা দিতে দিতে। আর ঐ বেটা কালীপদ,—তাকেও তাড়িয়ে তবে আমার কাজ।

পরেশ। আমি কিচ্ছু জানিনে বড়বাবু।

রাস। খবরদার। এ-সব কথা কাউকে বলবি নে। যদি শুনি তোর মা-ঠাকরুনকে একটা কথা বলচিস ত পিছমোড়া করে বেঁধে দরোয়ানকে দিয়ে জলবিছুটি লাগাব। খবরদার বলচি একটা কথা কাউকে বলবি নে। যা—

[রাসবিহারী ও দরোয়ান প্রস্থান করিল। আর একদিকে বিজয়া
প্রবেশ করিয়া পরেশকে ইঙ্গিতে কাছে আহ্বান করিল]

বিজয়া। হাঁ রে পরেশ, বড়বাবু তোরে লাঠি দেখাচ্ছিল কেন রে? কি করেছিস তুই?

পরেশ। বলতে মানা করে দেছে যে। বলে, খবরদার বলচি হারামজাদা শূয়ার, একটা কথা তোর মা-ঠানকে বলবি ত তোরে সেপাই দিয়ে বেঁধে জলবিছুটি লাগাব।

[বলিতে বলিতে সে কাঁদিয়া ফেলিল। বিজয়া সস্নেহে

তাহার পিঠে হাত বুলাইয়া দিয়া বলিল]

বিজয়া। তোর কিচ্ছু ভয় নেই পরেশ, তুই আমার কাছে কাছে থাকবি। কার সাধ্যি তোকে মারে।

পরেশ। (চোখ মুছিয়া) বড়বাবু বলে হারামজাদা শূয়ার, নরেনকে কেন ডেকে এনেছিলি বল। সে ব্যাটা কত রাত্তিরে বাড়ি থেকে গেল বল। তোর মা-ঠাকরুন তারে কি কি কথা বললে বল। তুমি ডাক্তারবাবুরে কি কি বললে আমি কি জানি মা-ঠান? তুমি টাকা দিলে আমি ছুট্টে ঘুড়ি-নাটাই কিনতে গেনু না?

বিজয়া। তাই ত গেলি।

পরেশ। তবে? নতুন দরোয়ানজী কেন বলে আমি সব জানি। বড়বাবু বলে, তোকে আর তোর মাকে গলাধাক্কা দিয়ে দূর করে দেব। আর ঐ কালীপদটাকে,—তাকেও তাড়াব।

বিজয়া। তুই যা পরেশ তোর ভয় নেই। বড়বাবু ডেকে পাঠালে তুই যাসনে।

পরেশ। আচ্ছা মা-ঠান, আমি কখখনো যাব না। দরোয়ান ডাকতে এলে ছুট্টে পালাবো—না?

বিজয়া। হাঁ, তুই ছুটে আমার কাছে পালিয়ে আসিস।

[পরেশ প্রস্থান করিল

[রাসবিহারীর প্রবেশ]

রাস। তুমি মা এখানে। সকালেই বেরিয়েছে? আমি বাড়িতে ঘরে ঘরে খুঁজে দেখি কোথাও বিজয়া নেই।

বিজয়া। আপনি আজ এত সকালেই যে?

রাস। মাথার ওপর যে নানা ভার মা। একটা দুশ্চিন্তায় কাল ভালো করে ঘুমুতেই পারিনি। কিন্তু তোমারও চোখ-দুটি যে রাঙ্গা দেখাচ্ছে। ভাল ঘুম হয়নি বুঝি?

বিজয়া। ঘুম ভালোই হয়েছে।

রাস। তবে ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়?

বিজয়া। না, ভালোই আছি।

রাস। সে বললে শুনব কেন মা? একটা কিছু নিশ্চয় হয়েছে। সাবধান হওয়া ভালো, আজ আর স্নান করো না যেন। একবার উপরে যেতে হবে যে। তোমার শোবার ঘরের লোহার সিন্দুকে যে দলিলগুলো আছে একবার ভালো করে পড়ে দেখতে হবে। শুনচি নাকি চৌধুরীরা ঘোষপাড়ার সীমানা নিয়ে একটা মামলা রুজু করবে।

বিজয়া। তাঁরা মামলা করবেন কে বললে?

রাস। (অল্প হাস্য করিয়া) কেউ বলেনি মা, আমি বাতাসে খবর পাই। তা না হলে কি এতবড় জমিদারিটা এতদিন চালাতে পারতাম!

বিজয়া। তাঁরা কতটা জমি দাবী করচেন?

রাস। তা, হবে বৈ কি—খুব কম হলেও সেটা বিঘে-দুই হবে।

বিজয়া। এই? তা হলে তাঁরাই নিন। এ নিয়ে মামলা-মকদ্দমার দরকার নেই।

রাস। (ক্ষোভের সহিত) এরকম কথা তোমার মত মেয়ের মুখে আমি আশা করিনি মা। আজ বিনা বাধায় যদি দু-বিঘে ছেড়ে দিই, কাল যে আবার দুশো বিঘে ছেড়ে দেতে হবে না তাই বা কে বললে!

বিজয়া। সত্যিই ত তা আর হচ্চে না; আমি বলি সামান্য কারণে মামলা-মকদ্দমার দরকার নেই।

রাস। (বারংবার মাথা নাড়িয়া) না মা, কিছুতেই সে হতে পারে না। তোমার বাবা যখন আমার উপর সমস্ত নির্ভর করে গেছেন এবং কতক্ষণ বেঁচে আছি বিনা আপত্তিতে দু-বিঘে কেন দু-আঙুল জায়গা ছেড়ে দিলেও ঘোর অধর্ম হবে। তা ছাড়া আরও অনেক কারণ আছে, যে-জন্যে পুরনো দলিলগুলো ভাল করে একবার দেখা দরকার। একটু কষ্ট করে ওপরে চল মা,—দেরি হলে ক্ষতি হবে।

বিজয়া। কি ক্ষতি হবে?

রাস। সে অনেক। মুখে মুখে তার কি কৈফিয়ত দেবো বলো ত!

[সরকার মহাশয়ের প্রবেশ]

সরকার। বাইরের ঘর থেকে খাতাগুলো কি নিয়ে যাব মা?

বিজয়া। (লজ্জিত হইয়া) একটুও দেখতে পারিনি সরকারমশাই। আজকের দিনটা থাক, কাল সকালেই আমি নিশ্চয় পাঠিয়ে দেব।

সরকার। যে আজ্ঞে।

[সরকার চলিয়া যাইতেছিল, বিজয়া ফিরিয়া ডাকিল]

বিজয়া। শুনুন সরকারমশাই! কাছারির ঐ নতুন দরোয়ান কতদিন বহাল হয়েছে?

সরকার। মাস-তিনেক হবে বোধ হয়।

বিজয়া। ওকে আর দরকার নেই। এক মাসের মাইনে বেশী দিয়ে আজই ওকে জবাব দেবেন। (একটু থামিয়া) না না, দোষের জন্য নয়, লোকটাকে আমার ভালো লাগে না—তাই।

রাস। বিনাদোষে কারো অন্ন মারাটা কি ভালো মা?

সরকার। তা হলে তাকে কি—

বিজয়া। আমার আদেশ ত শুনলেন সরকারমশাই | আজই বিদায় দেবেন।

রাস। (নিজেকে সামলাইয়া লইয়া) এবার কষ্ট করে একটু চল। পুরনো দলিলগুলো বেশ করে একবার পড়া চাই-ই।

বিজয়া। কেন?

রাস। বললাম কারণ আছে। তবুও বার বার এক কথা বলবার ত আমার সময় নেই বিজয়া!

বিজয়া। কারণ আছে বলেছেন, কিন্তু কারণ ত একটাও দেখান নি!

রাস। না দেখালে তুমি যাবে না? (একটু থামিয়া) তার মানে আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না।

[বিজয়া নিরুত্তর]

রাস। (লাঠিটা মাটিতে ঠুকিয়া) কিসের জন্যে আমাকে তুমি এত বড় অপমান করতে সাহস করো? কিসের জন্যে আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো শুনি?

বিজয়া। (শান্তস্বরে) আমাকেও ত আপনি বিশ্বাস করেন না আমারি টাকায় আমারি ওপর গোয়েন্দা নিযুক্ত করলে মনের ভাব কি হয় আপনি বুঝতে পারেন না? এবং তারপরে আমার সম্পত্তির মূল দলিলপত্র হস্তগত করার তাৎপর্য যদি আমি আর কিছু বলে সন্দেহ করি সে কি অস্বাভাবিক? না, সে আপনাকে অপমান করা?

[রাসবিহারী নির্বাক স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তাঁহার এত বড় পাকা চাল একটা বালিকার কাছে ধরা পড়িবে এ সংশয় তাঁহার পাকা মাথায় স্থান পায় নাই। এবং ইহাই সে অসঙ্কোচে মুখের উপর নালিশ করিবে সে ত স্বপ্নের অগোচর। কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মত স্তব্ধ থাকিয়া এই প্রকৃতির লোকেরা যাহা চরম অস্ত্র তাহাই তূণীর হইতে বাহির করিয়া প্রয়োগ করিলেন]

রাস। বনমালীর মুখ রাখবার জন্যেই এ কাজ করতে হয়েছে। বন্ধুর কর্তব্য বলেই করতে হয়েছে। একটা অজানা-অচেনা হতভাগাকে পথ থেকে শোবার ঘরে ডেকে এনে রাত-দুপুর পর্যন্ত হাসি-তামাশায় কাটালে এর অর্থ কি বুঝতে পারিনে? এতে তোমার লজ্জা হয় না বটে, কিন্তু আমাদের যে ঘরে-বাইরে মুখ পুড়ে গেল। সমাজে কারো সামনে মাথা তোলবার জো রইল না! (রাসবিহারী আড়চোখে চাহিয়া তাঁহার মহামন্ত্রের মহিমা নিরীক্ষণ করিলেন) বলি এগুলো ভালো না, নিবারণ করার চেষ্টা করা আমার কাজ নয়? (বিজয়া নিরুত্তর) (লাঠি ঠুকিয়া) না, চুপ করে থাকলে চলবে না, এ-সব গুরুতর ব্যাপার। তোমাকে জবাব দিতে হবে।

বিজয়া। ব্যাপার যত গুরুতর হোক, মিথ্যে কথার আমি কি উত্তর দিতে পারি!

রাস। মিথ্যে কথা বলে একে উড়োতে চাও নাকি?

বিজয়া। আমি উড়োতে কিছু চাইনে কাকাবাবু। শুধু এ যে মিথ্যে তাই আপনাকে বলতে চাই। এবং মিথ্যে বলে একে আপনি নিজেই সকলের চেয়ে বেশী জানেন তাও এই সঙ্গে আপনাকে জানাতে চাই।

রাস। মিথ্যে বলে আমি নিজেই জানি?

বিজয়া। হাঁ জানেন। কিন্তু আপনি গুরুজন,—এ নিয়ে তর্কবিতর্ক করতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। দলিলপত্র দেখা এখন থাক, মামলা-মকদ্দমারা আবশ্যক বুঝলে আপনাকে ডেকে পাঠাব।

[বিজয়া চলিয়া গেল। রাসবিহারী অভিভূতের মত দাঁড়াইয়া রহিলেন]

 বিজয়া – ৩.৪

চতুর্থ অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

বিজয়ার বাটী-সংলগ্ন উদ্যানের অপর প্রান্ত

[অদূরে সরস্বতী নদীর কিছু কিছু দেখা যাইতেছে, বিজয়া ও কানাই সিং। দয়াল প্রবেশ করিলেন]

দয়াল। তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্চি মা। শুনলাম এইদিকেই এসেছো, ভাবলাম বাড়ি যাবার আগে এদিকটা দেখে যাই যদি দেখা মেলে।

বিজয়া। কেন দয়ালবাবু।

দয়াল। আজ তৃতীয়া, পূর্ণিমা হলো সতেরোই। আর কটা দিন বাকী বলো ত মা?
বিবাহের সমস্ত উদ্যোগ-আয়োজন এই ক’দিনেই সম্পূর্ণ করে নিতে হবে। অথচ রাসবিহারীবাবু সমস্ত দায়িত্ব আমার উপর ফেলে নিশ্চিন্ত হয়েছেন।

বিজয়া। দায়িত্ব নিলেন কেন?

দয়াল। এ যে আনন্দের দায়িত্ব মা,—নেবো না?

বিজয়া। তবে অভিযোগ করচেন কেন?

দয়াল। অভিযোগ করিনি বিজয়া; কিন্তু মুখে বলচি বটে আনন্দের দায়িত্ব, তবু কেন জানিনে, কাজে উৎসাহ পাইনে, মন কেবলি এর থেকে দূরে সরে থাকতে চায়!

বিজয়া। কেন দয়ালবাবু?

দয়াল। তাও ঠিক বুঝিনে। জানি এ-বিবাহে তুমি সম্মতি দিয়েছ, নিজের হাতে নামসই করেছ,—আগামী পূর্ণিমায় বিবাহও হবে, তবু এর মধ্যে যেন রস পাইনে মা। সেদিন আমার অসম্মানে বিরক্ত হয়ে তুমি বিলাসবাবুকে যে তিরস্কার করলে সে সত্যই রূঢ়, সত্যই কঠোর; তবু, কেন জানিনে মনে হয়ে এর মধ্যে কেবল আমার অপমানই নেই, আরও কিছু গোপন আছে যা তোমাকে অহরহ বিঁধচে। (কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া) তোমার কাছে সর্বদা আসিনে বটে, কিন্তু চোখ আছে মা। তোমার মুখে আসন্ন-মিলনের স্বর্গীয় দীপ্তি কৈ,—কৈ সে সূর্যোদয়ের অরুণ আভা? তুমি জানো না মা, কিন্তু কতদিন নিরালায় তোমার ক্লান্ত বিষণ্ণ মুখখানি আমার চোখে পড়েছে। বুকের ভেতর কান্নার ঢেউ উথলে উঠেচে—

বিজয়া। না দয়ালবাবু, ও-সব কিছুই নয়।

দয়াল। আমার মনের ভুল, না মা?

বিজয়া। (ম্লান হাসিয়া) ভুল বৈ কি।

দয়াল। তাই হোক মা, আমার ভুলই যেন হয়। এ-সময়ে বাবার জন্যে বোধ করি মন কেমন করে—না বিজয়া? (বিজয়া নীরবে মাথা নাড়িয়া সায় দিল) (দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া) এমন দিনে তিনি যদি বেঁচে থাকতেন!

বিজয়া। আমাকে কি জন্যে খুঁজছিলেন বললেন না ত দয়ালবাবু?

দয়াল। ওঃ—একেবারেই ভুলেচি। বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র ছাপাতে হবে, তোমার বন্ধুদের সমাদরে আহ্বান করতে হবে, তাঁদের আনবার ব্যবস্থা করতে হবে,—তাই তাঁদের সকলের নামধাম জানতে পারলে—

বিজয়া। নিমন্ত্রণপত্র বোধ করি আমার নামেই ছাপানো হবে?

দয়াল। না মা, তোমার নামে হবে কেন? রাসবিহারীবাবু বর-কন্যা উভয়েরই যখন অভিভাবক তখন তাঁর নামেই নিমন্ত্রণ করা হবে স্থির হয়েছে।

বিজয়া। স্থির কি তিনিই করেছেন?

দয়াল। হাঁ, তিনিই বৈ কি।

বিজয়া। তবে এ-ও তিনিই স্থির করুন। আমার বন্ধু-বান্ধব কেউ নেই।

দয়াল। (সবিস্ময়ে) এ কেমনধারা জবাব হলো মা! এ বললে আমরা কাজের জোর পাব কোথা থেকে?

বিজয়া। হাঁ দয়ালবাবু, সেদিন নরেনবাবুকে কি আপনি একতাড়া চিঠি দিয়েছিলেন?

দয়াল। দিয়েছি মা। সেদিন হঠাৎ দেখি একটা ভাঙ্গা দেরাজের মধ্যে এক বাণ্ডিল পুরানো চিঠি। তাঁর বাবার নাম দেখে তাঁর হাতেই দিলাম। কোন দোষ হয়েছে কি মা?

বিজয়া। না দয়ালবাবু, দোষ হবে কেন? তাঁর বাবার চিঠি তাঁকে দিয়েছেন এ ত ভালোই করেছেন। চিঠিগুলো কি আপনি পড়েছিলেন?

দয়াল। (সবিস্ময়ে) আমি? না, না, পরের চিঠি কি কখনো পড়তে পারি?

বিজয়া। চিঠির সম্বন্ধে আপনাকে তিনি কি কিছু বলেন নি?

দয়াল। একটি কথাও না। কিন্তু কিছু জানবার থাকলে তাঁকে জিজ্ঞেসা করে আমি কালই তোমাকে বলতে পারি।

বিজয়া।কালই বলবেন কি করে? তিনি ত আর এদিকে আসেন না।

দয়াল। আসেন বৈ কি। আমাদের বাড়িতে রোজ আসেন।

বিজয়া। রোজ? আপনার স্ত্রীর অসুখ কি আবার বাড়লো? কৈ, সে কথা ত আপনি একদিনও বলেন নি?

দয়াল। (হাসিয়া) না মা, এখন তিনি বেশ ভালোই আছেন। তাই বলিনি। নরেনের চিকিৎসা এবং ভগবানের দয়া।

[হাতজোড় করিয়া উদ্দেশে নমস্কার করিলেন]

বিজয়া। ভালো আছেন, তবু কেন তাঁকে প্রত্যহ আসতে হয়?

দয়াল। আবশ্যক না থাকলেও জন্মভূমির মায়া কি সহজে কাটে? তা ছাড়া, আজকাল ওঁর কাজকর্ম নেই, সেখানে বন্ধু-বান্ধব বিশেষ কেউ নেই—তাই সন্ধ্যেবেলাটা এখানেই কাটিয়ে যান। আমার স্ত্রী ত তাঁকে ছেলের মত ভালবাসেন। ভালবাসার ছেলেও বটে। এমন নির্মল, এমন স্বভাবতঃ ভদ্রমানুষ আমি কম দেখেচি মা। নলিনীর ইচ্ছে সে বি. এ. পাস করে ডাক্তারি পড়ে। এ বিষয়ে তাকে কত উৎসাহ কত সাহায্য করেন তার সীমা নেই। ওঁর সাহায্যে এরই মধ্যে নলিনী অনেকগুলো বই পড়ে শেষ করেছে। লেখাপড়ায় দু’জনের বড় অনুরাগ।

বিজয়া। তা হোক, কিন্তু আপনি কি আর কিছু সন্দেহ করেন না?

দয়াল। কিসের সন্দেহ মা?

বিজয়া। আমার মনে হয় কি জানেন দয়ালবাবু?

দয়াল। কি মনে হয় মা?

বিজয়া। আমার মনে হয় নলিনীর সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে প্রকাশ করা উচিত।

দয়াল। ও—এই বলচ? সে আমারও মনে হয়েছে মা, কিন্তু তার ত এখনো সময় যায়নি। বরঞ্চ দু’জনের পরিচয় আরো একটু ঘনিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত সহসা কিছু না বলাই উচিত।

বিজয়া। কিন্তু নলিনীর পক্ষে ত ক্ষতিকর হতে পারে। তাঁর মনস্থির করতে হয়ত সময় লাগবে, কিন্তু ইতিমধ্যে নলিনীর—

দয়াল। সত্যি কথা। কিন্তু আমার স্ত্রীর কাছে যতদূর শুনেচি তাতে,—না না নরেনকে আমরা খুব বিশ্বাস করি। তাঁর দ্বারা যে কারো কোন ক্ষতি হতে পারে, তিনি ভুলেও যে কারো প্রতি অন্যায় করতে পারেন, এ আমি ভাবতেই পারিনে। কিন্তু একি, কথায় কথায় যে তুমি অনেক দূর এগিয়ে এসেছ। এতখানিই যদি এলে, চল না মা, তোমার এ বাড়িটাও একবার দেখে আসবে। নলিনীর মামী কত যে খুশী হবে তার সীমা নেই।

বিজয়া। চলুন, কিন্তু ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে যে।

দয়াল। হলোই বা। আমি তার ব্যবস্থা করব। তা ছাড়া সঙ্গে কানাই সিং ত আছেই।

[উভয়ের প্রস্থান

দ্বিতীয় দৃশ্য

দয়ালবাবুর বাটীর নীচের বারান্দা

[নলিনী ও নরেন। টেবিলের দুইদিকে দুইজন বসিয়া, সম্মুখে খোলা বই দোয়াত কলম ইত্যাদি রক্ষিত]

নলিনী। সত্যিই মিস রায়ের বিবাহে আপনি উপস্থিত থাকবেন না? এই ত মাত্র কটা দিন পরে, আর রাসবিহারীবাবু কি অনুরোধই না আপনাকে করেছেন।

নরেন। তিনি করেছেন বটে, কিন্তু যাঁর বিবাহ তিনি নিজে ত একটি মুখের কথাও বলেন নি।

নলিনী। বললে থাকতেন?

নরেন। না। থাকবার জো নেই আমার। যত শীঘ্র সম্ভব নতুন চাকরিতে গিয়ে যোগ দিতে হবে।

নলিনী। কিন্তু আমার বেলায়? সে-ও থাকবেন না?

নরেন। থাকব। নিমন্ত্রণপত্র পাঠাবেন, যদি অসম্ভব না হয় আপনার বিবাহে আমি উপস্থিত হবোই।

নলিনী। কথা দিলেন?

নরেন। হাঁ, দিলুম কথা। হয়ত এমনি কথা বিজয়াকেও দিতুম যদি তিনি নিজে অনুরোধ করতেন। কাজের ক্ষতি হলেও।

নলিনী। দেখুন ডক্টর মুখার্জী, এ বিবাহে বিজয়ার সুখ নেই, আনন্দ নেই এই আমার ঘোরতর সন্দেহ। সেইজন্যেই আপনাকে অনুরোধ করেন নি।

নরেন। কিন্তু তিনি নিজেই ত সম্মতি দিয়েছেন।

নলিনী। দিয়েছেন মুখের সম্মতি—হয়ত বাধ্য হয়ে। কিন্তু অন্তরের সম্মতি কখনো দেননি। আমার মামার মত নিরীহ সরল মানুষ, যিনি সামনে ছাড়া এতটুকু আশেপাশে দেখতে পান না, তাঁরও কেমন যেন সংশয় জেগেছে, বিজয়া যাকে চায় সে লোক ঐ বিলাসবাবু নয়। কালকেই বলছিলেন আমাকে, নলিনী, বিবাহ-আয়োজনের সব ভারটাই এসে পড়েছে আমার ‘পরে, কিন্তু মনে উৎসাহ পাইনে মা, কেবলই ভয় হতে থাকে যেন কি একটা গর্হিত কাজে প্রবৃত্ত হয়েছি। যতই দেখি ওকে ততই মনে হয় দিন দিন শুকিয়ে যেন বিজয়া কালি হয়ে যাচ্চে। কেনই বা এখানে এসেছিলুম, শেষ বয়সে যদি পাপ অর্জন করেই যাই মরণের পরে তাঁর কাছে গিয়ে কি জবাব দেব মা!

নরেন। দেখুন মিস দাস, ও-সব কিছু না। বিজয়া এই সেদিন অসুখ থেকে উঠলেন, এখনো ভালো সেরে উঠতে পারেন নি।

নলিনী। তাই প্রতিদিন শুকিয়ে যাচ্চেন? ডক্টর মুখার্জী, আমার মামা তবু সামনাসামনি দেখতে পান, কিন্তু আপনি তাও পান না। আপনি তাঁর চেয়েও অন্ধ। সেদিনের কথা মনে করে দেখুন, ভালোবাসলে কোন মেয়ে প্রভু-ভৃত্য সম্বন্ধের কথা বিলাসবাবুকে কিছুতে বলতে পারতেন না,—তা যত রাগই হোক।

নরেন। বড়লোক টাকার অহঙ্কারে সব পারে মিস দাস। ওদের মুখে কিছু আটকায় না।

নলিনী। এ বলা আপনার ভারী অন্যায় ডক্টর মুখার্জী। আপনার আগে আমি ওঁকে দেখেচি—আমরা এক কলেজে পড়তুম। ঐশ্বর্য আছে, কিন্তু ঐশ্বর্যের গর্ব কোনদিন কেউ অনুভব করিনি। ওঁর কত দয়া, কত দান, কত পুণ্য অনুষ্ঠান।—মনে নেই আপনার? অপরিচিত আপনি, তবু আপনার কথাতেই পূর্ণবাবুর বাড়ির পূজোর অনুমতি তখনি দিয়ে দিলেন। বিলাসবাবু, রাসবিহারীবাবু শত চেষ্টাতেও তা বন্ধ করতে পারলে না। ভদ্রতা, সহানুভূতি, ন্যায়-অন্যায়বোধ কতটা জাগ্রত থাকলে এ-রকম হতে পারে একবার ভেবে দেখুন দিকি। আমার মামা ত গরীব, কিন্তু কি শ্রদ্ধাই না তাঁকে করেন। এ কি ধনীর দর্পের প্রকাশ ডক্টর মুখার্জী?

নরেন। (কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া) সে সত্যি। কেউ অভুক্ত জানলে না খাইয়ে কিছুতে ছেড়ে দেবে না, যেমন করে হোক খাওয়াবেই। আর সে কি যত্ন!

নলিনী। তবে? এ-সব কি আসে সম্পদের দম্ভ থেকে?

নরেন। আর কি অদ্ভুত অপরিসীম পিতৃভক্তি এই মেয়েটির। এই বাড়িটা নিয়ে পর্যন্ত তাঁর মনে শান্তি ছিল না, নিতে হয়েছিল শুধু বিলাসবাবুর জবরদস্তিতে—

নলিনী। এ কথা আমরা সবাই জানি ডক্টর মুখার্জী।

নরেন। হাঁ অনেকেই জানে। সেদিন ওঁকে একটু বিপদগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যেই বনমালীবাবুর সেই চিঠির উল্লেখ করে বলেছিলুম, আমার বাবা যত ঋণই করে থাকুন, আপনার বাবা কিন্তু এ-বাড়ি আমাকেই যৌতুক দিয়েছিলেন। তবু আপনি কেড়ে নিলেন। শুনে বিজয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, বললেন, সত্যি হলে এ বাড়ি আপনাকে আমি ফিরিয়ে দেব। বললুম, সত্যিই বটে, কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে আমি করব কি? পেটের দায়ে চাকরি করতে নিজে থাকব বাইরে,—বাড়ি হবে বন-জঙ্গল, শিয়াল-কুকুরের বাসা—তার চেয়ে যা হয়েছে সেই ভালো। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, না, সে হবে না,—নিতেই হবে আপনাকে। বাবার আদেশ আমি প্রাণ গেলেও উপেক্ষা করতে পারব না। অন্ততঃ বাড়ির ন্যায্য যা দাম—তাই নিন। বললুম, ভিক্ষে নিতে আমি পারব না। তিনি বললেন, তা হলে বিলিয়ে দেব আপনার দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়দের। বাবা যা দিয়ে গেছেন আমি তা অপহরণ করব না— কোনমতেই না—এই আমার পণ। শুনে, দুষ্টবুদ্ধি মাথায় চেপে গেল, বললুম, ও পণ রাখতে গেলে কি কি দিতে হয় জানেন? শুধু এই বাড়িটাই নয়, এই বাড়ি, এই জমিদারি, দাস-দাসী, আমলা-কর্মচারী, খাট-পালঙ্ক-টেবিল-চেয়ার, মায় তাদের মনিবটিকে পর্যন্ত আমার হাতে তুলে দিতে হবে। দেবেন এই-সব? পারবেন দিতে?

নলিনী। (সবিস্ময়ে) বনমালীবাবুর আছে নাকি এই-সব চিঠি? কৈ আমাদের ত কাউকে বলেন নি!

নরেন। (হাসিয়া) এ তামাশা বলব কাকে? আমি কি পাগল? কিন্তু চিঠির কথা যদি বলেন ত সত্যিই আছে বনমালীবাবুর চিঠি। সত্যি আছে এই-সব লেখা। (আঙুল দিয়া দেখাইয়া) ঐ ঘরটায় ছিল একতাড়া চিঠি একটা ভাঙ্গা দেরাজের মধ্যে—বাবার চিঠি বলে দয়ালবাবু দিলেন আমার হাতে, পড়ে দেখি তাতে এই মজার ব্যাপার। জানেন ত, আমার বাবার বনমালীবাবু ছিলেন অকৃত্রিম বন্ধু। লেখাপড়ার জন্যে আমাকে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন তিনিই।

নলিনী। তারপরে?

নরেন। বিজয়া বললেন, কৈ দেখি বাবার চিঠি। পকেটেই ছিল, ফেলে দিলুম সুমুখে। বাণ্ডিল খুলে ফেলে খুঁজতে লাগল বুভুক্ষু কাঙালের মত—হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল—এই যে আমার বাবার হাতের লেখা। তারপরে চিঠি দুটো নিজের মাথায় চেপে ধরে চক্ষের নিমেষে যেন একেবারে পাথর হয়ে গেল।

নলিনী। তারপরে?

নরেন। মূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেলুম। একেবারে নিঃশব্দ নিশ্চল! হঠাৎ দেখি চাপা কান্নায় তার বুকের পাঁজরগুলো ফুলে ফুলে উঠছে—আর বসে থাকতে সাহস হলো না, নিঃশব্দে বেরিয়ে এলুম।

নলিনী। নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন? আর যাননি তাঁর কাছে?

নরেন। না, সেদিকেই না।

নলিনী। তাঁকে দেখতে ইচ্ছে করে না আপনার?

নরেন। (হাসিয়া) এ কথা জেনে লাভ কি?

নলিনী। না, সে হবে না, আপনাকে বলতেই হবে।

নরেন। বলতে আপনাকেই শুধু পারি। কিন্তু কথা দিন কখনো কাউকে বলবেন না?

নলিনী। কথা আমি দেব না। তবু বলতেই হবে তাঁকে দেখতে ইচ্ছে করে কি না।

নরেন। করে। রাত্রিদিনই করে।

নলিনী। (বাহিরের দিকে চাহিয়া মহা-উল্লাসে) এই যে! আসুন, আসুন। নমস্কার! ভালো আছেন?

[বিজয়া ও দয়ালের প্রবেশ]

বিজয়া। (নরেনের দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরিয়া নলিনীকে) নমস্কার! ভালো আছি কিনা খোঁজ নিতে একদিনও ত আর গেলেন না?

নলিনী। রোজই ভাবি যাই, কিন্তু সংসারের কাজে—

বিজয়া। সংসারের কাজ বুঝি আমাদের নেই?

নলিনী। আছে সত্যি, কিন্তু মামীমার অসুখে—

বিজয়া। একেবারে সময় পান না। না?

নরেন। (সম্মুখে আসিয়া হাসিমুখে বলিল) আর আমি যে রয়েছি, আমাকে বুঝি চিনতেই পারলেন না?

বিজয়া। চিনতে পারলেই চেনা দরকার নাকি? (নলিনীর প্রতি) চলুন মিস দাস, ওপরে গিয়ে মামীমার সঙ্গে একটু আলাপ করে আসি। চলুন!

[নরেনের প্রতি দৃষ্টিপাতমাত্র না করিয়া নলিনীকে
একপ্রকার ঠেলিয়া লইয়া চলিল]

নলিনী। (চলিতে চলিতে) ডক্টর মুখার্জী, চা না খেয়ে আপনি যেন পালাবেন না। আমাদের ফিরতে দেরি হবে না বলে যাচ্চি।

[নলিনী ও বিজয়া চলিয়া গেল

দয়াল।তুমিও চল না বাবা ওপরে। সেখানেই চা খাবে।

নরেন। ওপরে গেলেই দেরি হবে দয়ালবাবু, ছ’টার গাড়ি ধরতে পারব না।

দয়াল। তুমি ত সেই আটটার ট্রেনে যাও, আজ এত তাড়াতাড়ি কেন? চা না হয় এখানেই আনতে বলে দি। কি বল?

নরেন। না দয়ালবাবু, আজ চা খাওয়া থাক। (ঘড়ি দেখিয়া) এই দেখুন পাঁচটা বেজে গেছে—আর আমার সময় নেই। আমি চললুম। মামীমা যেন দুঃখ না করেন।

দয়াল। দুঃখ সে করবেই নরেন।

নরেন। না করবেন না। আর একদিন আমি তাঁকে বুঝিয়ে বলব।

[প্রস্থান

[ভিতরে নলিনী ও বিজয়ার হাসির শব্দ শোনা গেল, এবং
পরক্ষণে তাহারা দয়ালের স্ত্রীকে লইয়া প্রবেশ করিল]

দয়ালের স্ত্রী। (স্বামীর প্রতি) নরেন কোথায় গেল, তাকে দেখচি নে ত?

দয়াল। সে এইমাত্র চলে গেল। কাজ আছে, ছ’টার ট্রেনে আজ তার না ফিরে গেলেই নয়।

দয়ালের স্ত্রী। সে কি কথা! চা খেলে না, খাবার খেলে না,—এমনধারা সে ত কখনো করে না!

[সকলেই নীরব। বিজয়া আর একদিকে চোখ ফিরাইয়া রহিল]

দয়ালের স্ত্রী। (স্বামীর প্রতি) তুমি যেতে দিলে কেন? বললে না কেন আমি ভারী দুঃখ পাব?

দয়াল। বলেছিলুম, কিন্তু থাকতে পারলে না।

দয়ালের স্ত্রী। তবে নিশ্চয় কোন জরুরী কাজ আছে। মিছে কথা সে কখনো বলে না। কি ভদ্র ছেলে মা! যেমন বিদ্বান তেমনি বুদ্ধিমান। আমাকে ত মরা বাঁচালে। রোজ বিকালে নলিনী আর ও বসে বসে পড়াশুনো করে, আমি আড়াল থেকে দেখি। দেখে কি যে ভালো লাগে তা আর বলতে পারিনে। ভগবান ওর মঙ্গল করুন।

বিজয়া। সন্ধ্যা হয়ে গেল, আমি এবার যাই মামীমা।

দয়ালের স্ত্রী। তোমার বিয়েতে আমি উপস্থিত থাকবই। তা যত অসুখই করুক। নরেন বলে, বেশী নড়াচড়া করা উচিত নয়। তা সে বলুক গে,—ওদের সব কথা শুনতে গেলে আর বেঁচে থাকা চলে না। আশীর্বাদ করি সুখী হও, দীর্ঘজীবী হও,—বিলাসবাবুকে চোখে দেখিনি, কিন্তু কর্তার মুখে শুনি খাসা ছেলে। (সহাস্যে) বর পছন্দ হয়েছে ত মা, নিজে বেছে নিয়েছ—

বিজয়া। বেছে নেবার কি আছে মামীমা। মেয়েদের সম্বন্ধে সব পুরুষই সমান। মুখের ভদ্রতায় কেউ বা একটু হুঁশিয়ার, কেউ বা তা নয়। প্রয়োজন হলে দুটো মিষ্টি কথা বলে, প্রয়োজন ফুরোলে উগ্রমূর্তি ধরে। ওর ভালো-মন্দ নেই মামীমা, আমাদের দুঃখের জীবন শেষ পর্যন্ত দুঃখেই কাটে।

নলিনী। এ কথা বলা আপনার উচিত নয় মিস রায়।

বিজয়া। এখন তর্ক করব না, কিন্তু নিজের বিবাহ হলে একদিন স্মরণ করবেন, বিজয়া সত্যি কথাই বলেছিল। কিন্তু আর দেরি নয়, আমি আসি। কানাই সিং—
[নেপথ্যে] —মাইজী—

দয়াল। (ব্যস্তভাবে) অন্ধকার রাত, একটা আলো এনে দিই মা।

বিজয়া। (হাসিয়া) অন্ধকার কোথায় দয়ালবাবু, বাইরে জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে। আমরা বেশ যেতে পারব, আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না। নমস্কার!

[বিজয়া বাহির হইয়া গেল

দয়ালের স্ত্রী। (স্বামীর প্রতি) মেয়েটা কি বললে—শুনলে?

দয়াল। কি?

দয়ালের স্ত্রী। তোমাদের কি কান নেই? এসে পর্যন্ত ওর কথায় যেন একটা কান্নার সুর। যখন হাসছিল তখনও। বিজয়াকে আগে কখনও দেখিনি, কিন্তু ওর মুখ দেখে আজ মনে হলো যেন ধরেবেঁধে ওকে কেউ বলি দিতে নিয়ে যাচ্চে। জিজ্ঞেসা করলুম, বর পছন্দ হয়েছে ত মা? বললে, পছন্দের কি আছে মামীমা, মেয়েদের দুঃখের জীবন শেষ পর্যন্ত দুঃখেই কাটে। এ কি আহ্লাদের বিয়ে? দেখো, কোথায় কি একটা গোলমাল বেধেছে। ওর মা নেই, বাপ নেই,—মুখ দেখলে বড্ড মায়া হয়। না বুঝেসুঝে একটা কাজ করে বসো না।

দয়াল। আমি কি করতে পারি বল? রাসবিহারীবাবুই কর্তা।

দয়ালের স্ত্রী। তাঁর ওপরেও আর একজন কর্তা আছে মনে রেখো। তুমি ওর মন্দিরের আচার্য, ওর টাকায়, ওর বাড়িতে তোমরা খেয়েপরে সুখে আছ,—ওর ভালো-মন্দ সুখ-দুঃখ দেখা কি তোমার কর্তব্য নয়? সমস্ত না ভেবেই কি একটা করে বসবে?

দয়াল। তবে কি করব বল?

দয়ালের স্ত্রী। এ বিয়েতে আচার্যগিরি তুমি করো না। আমি বলচি, তোমাকে একদিন মনস্তাপ পেতে হবে।

দয়াল। (চিন্তান্বিত-মুখে) কিন্তু বিজয়া যে নিজে সম্মতি দিয়েছে। রাসবিহারীবাবুর সুমুখে নিজের হাতে কাগজে সই করে দিয়েছে!

নলিনী। দিক। ওর হাত সই করেছে কিন্তু হৃদয় সই করেনি, ওর জিভ সম্মতি দিয়েছে কিন্তু অন্তর সম্মতি দেয়নি। সেই মুখ আর হাতই বড় হবে মামাবাবু, তার অন্তরের সত্যিকার অসম্মতি যাবে ভেসে?

দয়াল। তুমি এ কথা জানলে কি করে নলিনী?

নলিনী। আমি জানি। আজ যাবার সময় নরেনবাবুর মুখ দেখেও কি তুমি বুঝতে পারনি?

দয়াল ও দয়ালের স্ত্রী। (সমস্বরে) নরেন? আমাদের নরেন?

নলিনী। হাঁ তিনিই।

দয়াল। অসম্ভব! একেবারে অসম্ভব!

নলিনী। (হাসিয়া) অসম্ভব নয় মামাবাবু, সত্যি।

দয়াল। (সজোরে) কিন্তু বিজয়া যে আমাকে নিজে বললেন—

নলিনী। কি বললেন?

দয়াল। বললেন, তোমার আর নরেনের পানে একটু চোখ রাখতে। বললেন, নরেনের উচিত তোমার সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে জানাতে—

নলিনী। (সলজ্জে) ছি ছি, নরেনবাবু যে আমার বড়ভাইয়ের মত মামাবাবু।

দয়ালের স্ত্রী। কি আশ্চর্য কথা! তুমি আমাদের সেই জ্যোতিষকে ভুলে গেলে? তার বিলেত থেকে ফিরতে ত আর দেরি নেই।

দয়াল। জ্যোতিষ? আমাদের সেই জ্যোতিষ?

দয়ালের স্ত্রী। হাঁ হাঁ, আমাদের সেই জ্যোতিষ। (হাসিয়া) এই অন্ধ মানুষটিকে নিয়ে আমার সারাজীবন কাটল!

দয়াল। আমি এখ্‌খুনি যাব নরেনের বাসায়।

দয়ালের স্ত্রী। এত রাত্রে? কেন?

দয়াল। কেন? জিজ্ঞাসা করছ—কেন? আমার কর্তব্য আমি স্থির করে ফেলেচি—সে থেকে কেউ আর আমাকে টলাতে পারবে না।

নলিনী। তুমি শান্ত মানুষ মামাবাবু, কিন্তু কর্তব্য থেকে তোমাকে কে কবে টলাতে পেরেছে! কিন্তু আজ রাত্রে নয়,—তুমি কাল সকালে যেও।

দয়াল। তাই হবে মা, আমি ভোরের গাড়িতেই বেরিয়ে পড়ব।

নলিনী। আমি তোমার চা তৈরি করে রাখব মামাবাবু। কিন্তু ওপরে চল তোমার খাবার সময় হয়েছে।

দয়াল। চল।

[সকলের প্রস্থান

তৃতীয় দৃশ্য

লাইব্রেরি

[বিজয়া চিঠি লিখিতেছিল, পরেশের মা প্রবেশ করিল]

পরেশের মা। রাত্তিরে কিচ্ছু খাওনি, আজ একটু সকাল সকাল খেয়ে নাও না দিদিমণি।

[বিজয়া মুখ তুলিয়া চাহিয়া পুনরায় লেখায় মনঃসংযোগ করিল]

পরেশের মা। খেয়ে নিয়ে তারপরে লিখো। ওঠো—ও-মা, ডাক্তারবাবু আসচেন যে!

[বলিয়াই সরিয়া গেল। পরেশ নরেনকে পৌঁছাইয়া দিয়া চলিয়া গেল। নরেন ঘরে ঢুকিয়া অদূরে একখানা চৌকি টানিয়া বসিল। তাহার মুখ শুষ্ক, চুল এলোমেলো। উদ্বেগ ও অশান্তির চিহ্ন তাহার চোখে-মুখে বিদ্যমান]

নরেন। কাল আমাকে চিনতে চাননি কেন বলুন ত! এখন থেকে চিরদিনের মত অপরিচিত হয়ে গেলুম এই বুঝি ইঙ্গিত?

বিজয়া। আপনার চোখ-মুখ এমন ধারা দেখাচ্চে কেন, অসুখ-বিসুখ করেনি ত? এত সকালে এলেন কি করে? কিছু খাওয়াও হয়নি বোধ করি?

নরেন। স্টেশনে চা খেয়েছি। ভোরে উঠেই বেরিয়ে পড়েছিলুম। কাল খেতে পারিনি, ঘুমোতে পারিনি, সারা রাত কেবল এক কথাই মনে হয়েছে দোর বোধ হয় বন্ধ হলো,— দেখা আর হবে না।

বিজয়া। ও-বাড়ি থেকে কাল না খেয়ে পালিয়ে গেলেন, বাসায় ফিরে গিয়ে খেলেন না শুলেন না, আবার সকালে উঠে স্নান নেই খাওয়া নেই, এতটা পথ হাঁটা,—শরীরটা যাতে ভেঙ্গে পড়ে সেই চেষ্টাই হচ্চে বুঝি? আমাকে কি আপনি এতটুকু শান্তি দেবেন না?
নরেন। আপনি অদ্ভুত মানুষ। পরের বাড়িতে চিনতে চান না, আবার নিজের বাড়িতে এত বেশী চেনেন যে সেও আশ্চর্য ব্যাপার। কালকের কাণ্ড দেখে ভাবলুম খবর দিলে দেখা করবেন না, তাই বিনা সংবাদে পরেশের সঙ্গে এসে আপনাকে ধরেচি। একটু ক্লান্ত হয়েছি মানি, কিন্তু এসে ঠকিনি। (বিজয়া নীরবে চাহিয়া রহিল) কাল ফিরে গিয়ে দেখি সাউথ অ্যাফ্রিকা থেকে কেব্‌ল এসেছে, আমি চাকরি পেয়েছি। চারদিন পরে করাচী থেকে জাহাজ ছাড়বে—আজ আসতে না পারলে হয়ত আর কখনো দেখাই হতো না। আপনার বিবাহের নিমন্ত্রণপত্রও পেলুম। দেখে যাবার সৌভাগ্য হবে না, কিন্তু আমার আশীর্বাদ, আমার অকৃত্রিম শুভকামনা আপনাদের পূর্বাহ্নেই জানিয়ে যাই। আমার কথা অবিশ্বাস করবেন না এই প্রার্থনা।

বিজয়া। এখানকার কাজ ছেড়ে দিয়ে সাউথ অ্যাফ্রিকায় চলে যাবেন? কিন্তু কেন?

নরেন। (হাসিয়া) বেশী মাইনে বলে। আমার কলকাতাও যা, সাউথ অ্যাফ্রিকাও ত তাই।

বিজয়া। তাই বৈ কি! কিন্তু নলিনী কি রাজী হয়েছেন? হলেও বা এত শীঘ্র কি করে যাবেন আমি ত ভেবে পাইনে। তাঁকে সমস্ত খুলে বলেছেন কি? আর এত দূরে যেতেই বা তিনি মত দিলেন কি করে?

নরেন। দাঁড়ান, দাঁড়ান। এখনো কাউকে সমস্ত কথা খুলে বলা হয়নি বটে, কিন্তু—

বিজয়া। কিন্তু কি? না সে কোনমতেই হতে পারবে না। আপনারা কি আমাদের বাক্স-বিছানার সমান মনে করেন যে, ইচ্ছে থাক না থাক দড়ি দিয়ে বেঁধে গাড়িতে তুলে দিলেই সঙ্গে যেতে হবে? সে কিছুতেই হবে না। তাঁর অমতে কোনমতেই অত দূরে যেতে পারবেন না।

নরেন। (কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের ন্যায় স্তব্ধভাবে থাকিয়া) ব্যাপারটা কি আমাকে বুঝিয়ে বলুন ত? পরশু না কবে এই নূতন চাকরির কথাটা দয়ালবাবুকে বলতে তিনিও চমকে উঠে এই ধরনের কি একটা আপত্তি তুললেন আমি বুঝতেই পারলুম না। এত লোকের মধ্যে নলিনীর মতামতের ওপরেই বা আমার যাওয়া-না-যাওয়া কেন নির্ভর করে, আর তিনিই বা কিসের জন্যে বাধা দেবেন,—এ-সব যে ক্রমেই হেঁয়ালি হয়ে উঠচে।কথাটা কি আমাকে খুলে বলুন ত!

বিজয়া। (ক্ষণেক পরে ধীরে ধীরে) তাঁর সঙ্গে একটা বিবাহের প্রস্তাব কি আপনি করেন নি?

নরেন। আমি? না কোনদিন নয়।

বিজয়া। না করে থাকলেও কি করা উচিত ছিল না? আপনার মনোভাব ত কারও কাছে গোপন নেই।

নরেন। (কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া) এ অনিষ্ট কার দ্বারা ঘটেছে আমি তাই শুধু ভাবচি। তাঁর নিজের দ্বারা কদাচ ঘটেনি। দু’জনেই জানি এ অসম্ভব।

বিজয়া। অসম্ভব কেন?

নরেন। সে থাক। একটা কারণ এই যে আমি হিন্দু এবং আমাদের জাতও এক নয়।
বিজয়া। জাত আপনি মানেন?

নরেন। মানি।

বিজয়া। আপনি শিক্ষিত হয়ে একে ভালো বলে মানেন কি করে?

নরেন। ভালো-মন্দর কথা বলিনি, জাত মানি তাই বলেচি।

বিজয়া। আচ্ছা অন্য জাতের কথা থাক, কিন্তু জাত যেখানে এক, সেখানেও কি শুধু আলাদা ধর্মমতের জন্যই বিবাহ অসম্ভব বলতে চান? আপনি কিসের হিন্দু? আপনি ত একঘরে। আপনার কাছেও কি কোন অন্য সমাজের কুমারী বিবাহযোগ্যা নয় মনে করেন? এত অহঙ্কার আপনার কিসের জন্য? আর এই যদি সত্যিকার মত, তবে সে কথা গোড়াতেই বলে দেননি কেন?

[বলিতে বলিতে তাহার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল
এবং ইহাই গোপন করিতে সে মুখ ফিরাইয়া লইল]

নরেন। (ক্ষণকাল একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করিয়া) আপনি রাগ করে যা বলচেন এ ত আমার মত নয়।

বিজয়া। নিশ্চয় এই আপনার সত্যিকার মত।

নরেন। আমাকে পরীক্ষা করলে টের পেতেন এ আমার সত্যিকার মিথ্যেকার কোন মতই নয়। এ ছাড়া নলিনীর কথা নিয়ে কেন আপনি বৃথা কষ্ট পাচ্ছেন? আমি জানি তাঁর মন কোথায় বাঁধা এবং তিনিও নিশ্চয় বুঝবেন কেন আমি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পালাচ্চি। আমার যাওয়া নিয়ে আপনি নিরর্থক উদ্বিগ্ন হবেন না।

বিজয়া। নিরর্থক? তাঁর অমত না হলেই আপনি যেখানে খুশি যেতে পারেন মনে করেন?

নরেন। না তা পারিনে। আপনার অমতেও আমার কোথাও যাওয়া চলে না। কিন্তু আপনি ত আমার সব কথাই জানেন। আমার জীবনের সাধও আপনার অজানা নয়, বিদেশে কোনদিন হয়ত সে সাধ পূর্ণ হতেও পারে, কিন্তু এ-দেশে এত বড় নিষ্কর্মা দীন-দরিদ্রের থাকা-না-থাকা সমান। আমাকে যেতে বাধা দেবেন না।

বিজয়া। আপনি দীন-দরিদ্র ত নন। আপনার সবই আছে, ইচ্ছে করলেই ফিরে নিতে পারেন।

নরেন। ইচ্ছে করলেই পারিনে বটে, কিন্তু আপনি যে দিতে চেয়েছেন সে আমার মনে আছে এবং চিরদিন থাকবে। কিন্তু দেখুন, নেবারও একটা অধিকার থাকা চাই—সে অধিকার আমার নেই।

বিজয়া। (উচ্ছ্বসিত রোদন সংবরণ করিতে করিতে উত্তেজিত-স্বরে) আছে বৈ কি। বিষয় আমার নয়, বাবার। সে আপনি জানেন। নইলে পরিহাসচ্ছলেও তাঁর যথাসর্বস্ব দাবী করার কথা মুখে আনতে পারতেন না। আমি হলে কিন্তু ঐখানেই থামতুম না। তিনি যা দিয়ে গেছেন সমস্ত জোর করে দখল করতুম, তার একতিলও ছেড়ে দিতুম না। (টেবিলে মুখ রাখিয়া কাঁদিতে লাগিল)

নরেন। নলিনী ঠিকই বুঝেছিল বিজয়া, আমি কিন্তু বিশ্বাস করিনি। ভাবতেই পারিনি আমার মত একটা অকেজো অক্ষম লোককে কারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু সত্যিই যদি এই অসঙ্গত খেয়াল তোমার মাথায় ঢুকেছিল শুধু একবার হুকুম করোনি কেন? আমার পক্ষে এর স্বপ্ন দেখাও যে পাগলামি বিজয়া!

[বিজয়া মুখের উপর আঁচল চাপিয়া উচ্ছ্বসিত রোদন সংবরণ করিতে লাগিল। নরেন পিছনে পদশব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখিল দয়াল দাঁড়াইয়া দ্বারের কাছে। তিনি ধীরে ধীরে ঘরে আসিয়া বিজয়ার আসনের একান্তে বসিয়া তাহার মাথায় হাত দিলেন, বলিলেন—]

দয়াল। মা!

[বিজয়া একবার মুখ তুলিয়া দেখিল পুনরায় উপুড় হইয়া পড়িয়া মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল। দয়ালের চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল, সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন—]

দয়াল। শুধু আমার দোষেই এই ভয়ানক অন্যায় হয়ে গেল মা, শুধু আমি এই দুর্ঘটনা ঘটালুম। কাল তোমরা চলে গেলে নলিনীর সঙ্গে আমার এই কথাই হচ্ছিল,—সে সমস্তই জানত। কিন্তু কে ভেবেছে নরেন মনে মনে কেবল তোমাকেই,—কিন্তু নির্বোধ আমি সমস্ত ভুল বুঝে তোমাকে উলটো খবর দিয়ে এই দুঃখ ঘরে ডেকে আনলুম। এখন বুঝি আর কোন প্রতিকার নেই?(তেমনি মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে দিতে) এর কি আর কোন উপায় হতে পারে না বিজয়া?

বিজয়া।(তেমনি মুখ লুকাইয়া ভগ্নকণ্ঠে) না দয়ালবাবু, মরণ ছাড়া আর আমার নিষ্কৃতির পথ নেই।

দয়াল। ছি মা, এমন কথা বলতে নেই।

বিজয়া। আমি কথা দিয়েছি দয়ালবাবু। তাঁরা সেই কথার নির্ভর করে সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে এনেছেন। এ যদি ভাঙ্গি, সংসারে আমি মুখ দেখাব কেমন করে? শুধু বাকী আছে মরণ—

[বলিতে বলিতে পুনরায় তাহার কণ্ঠরোধ হইল। দয়ালের চোখ দিয়াও
আবার জল গড়াইয়া পড়িল। হাত দিয়া মুছিয়া বলিলেন—]

দয়াল। নলিনী বললে, বিজয়া কথা দিয়েছে, সই করে দিয়েছে—এ ঠিক। কিন্তু কোনটায় তার অন্তর সায় দেয়নি। তার সেই মুখের কথাটাই বড় হবে মামাবাবু, আর হৃদয় যাবে মিথ্যে হয়ে? তার মামী বললে, ওর মা নেই, বাপ নেই,—একলা মেয়ে,—আচার্য হয়ে তুমি এতবড় পাপ করো না। যে দেবতা হৃদয়ে বাদ করেন এ অধর্ম তিনি সইবেন না। সারা রাত চোখে ঘুম এল না, কেবলই মনে হয় নলিনীর কথা—মুখের বাক্যটাই বড় হবে, হৃদয় যাবে ভেসে? ভোর হতেই ছুটলুম কলকাতায়—নরেনের কাছে—

নরেন। আপনি আমার কাছে গিয়েছিলেন?

দয়াল। গিয়ে দেখি তুমি বাসায় নেই, খোঁজ নিয়ে গেলুম তোমার আফিসে, তারাও বললে, তুমি আসনি। ফিরে এলুম বিফল হয়ে, কিন্তু আশা ছাড়লুম না। মনে মনে বললুম, যাব বিজয়ার কাছে, বলব তাকে গিয়ে সব কথা—

[পরেশ গলা বাড়াইয়া দেখা দিল]

পরেশ। মা ঠান, একটা-দুটো বেজে গেল—তুমি না খেলে যে আমরা কেউ খেতে পাচ্চিনে।

[শুনিয়া বিজয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিল]

বিজয়া।(ব্যস্তভাবে) দয়ালবাবু, এখানেই আপনাকে স্নানাহার করতে হবে।

দয়াল। না মা, আজ তোমার আদেশ পালন করতে পারব না। তারা সব পথ চেয়ে আছে। নরেন, তোমাকেও যেতে হবে। কাল না খেয়ে চলে এসেছ, সে দুঃখ ওদের যায়নি, এস আমার সঙ্গে।

[নরেন উঠিয়া দাঁড়াইল। বিজয়া ইঙ্গিতে তাহাকে একপাশে
ডাকিয়া লইয়া দয়ালের অগোচরে মৃদুকণ্ঠে বলিল]

বিজয়া। আমাকে না জানিয়ে কোথাও চলে যাবেন না ত?

নরেন। না। যাবার আগে তোমাকে বলে যাব।

বিজয়া। ভুলে যাবে না?

নরেন। (হাসিয়া) ভুলে যাব? চলুন দয়ালবাবু, আমরা যাই।

দয়াল। চল। আসি মা এখন।

(একদিক দিয়া দয়াল ও নরেন, অন্যদিক দিয়া বিজয়া প্রস্থান করিল

বিজয়া – ৩.৫

পঞ্চম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

বিজয়ার বসিবার ঘর

[পরেশ প্রবেশ করিল। তাহার পরিধানে চওড়া পাড়ের শাড়ী, গায়ে ছিটের জামা, গলায় কোঁচানো চাদর, কিন্তু খালি পা]

পরেশ। মা-ঠান, তিনটে-চারটে বেজে গেল পালকি এলো না ত? আমার মা কি বলচে জানো মা-ঠান? বলচে, বুড়ো দয়ালের ভীমরতি হয়েছে, নেমন্তন্ন করে ভুলে গেছে।

বিজয়া। তোর বুঝি বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে পরেশ?

পরেশ।হিঁ—বড্ড খিদে পেয়েছে।

বিজয়া। কিচ্ছু খাসনি এতক্ষণ?

পরেশ। না কেবল সকালে দুটি মুড়ি-মুড়কি খেয়েছিনু, আর মা বললে, পরেশ, নেমন্তন্ন-বাড়িতে বড় বেলা হয়, দুটো ভাত খেয়ে নে। তাই—দেখো মা-ঠান, এই এত্ত ক’টি খেয়েছি।

[এই বলিয়া সে হাত দিয়া পরিমাণ দেখাইয়া দিল। জিজ্ঞাসা করিল—]

পরেশ। তোমার ক্ষিদে পায়নি মা-ঠান?

বিজয়া।(মৃদু হাসিয়া)আমারও ভারী ক্ষিদে পেয়েছে রে।

[পরেশের মা প্রবেশ করিল]

পরেশের মা। পাবে না দিদিমণি, বেলা কি আর আছে! বুড়ো করলে কি বল ত’—ভুলে গেল না ত? লোক পাঠিয়ে খবর নেব?

বিজয়া। ছি ছি, সে করে কাজ নেই পরেশের মা।যদি সত্যিই ভুলে গিয়ে থাকেন ভারী লজ্জা পাবেন।

পরেশের মা। কিন্তু নেমন্তন্ন-বাড়ির আশায় তোমার পরেশ যে পথ চেয়ে চেয়ে সারা হলো। বোধ হয় হাজার বার নদীর ধারে গিয়ে দেখে এসেছে পালকি আসচে কিনা। যা পরেশ, আর একবার দেখ গে। (পরেশ প্রস্থান করিলে পরেশের মা পুনশ্চ কহিল) কিন্তু সত্যিই আশ্চয্যি হচ্চি তাঁর বিবেচনা দেখে। কাল অত বেলায় ত ডাক্তারবাবুকে নিয়ে বাড়ি গেলেন, আবার ঘণ্টা-কয়েক পরেই দেখি বুড়ো লণ্ঠন নিয়ে নিজে এসে হাজির। পরেশের মা, তোমার দিদিমণি কোথায়? বললুম ওপরে নিজের ঘরেই আছেন। কিন্তু এত রাত্রিরে কেন আচায্যিমশাই? বললেন, পরেশের মা, কাল দুপুরে আমাদের ওখানে তোমরা খাবে। তুমি, পরেশ, কালীপদ, আর আমার মা বিজয়া। তাই নেমন্তন্ন করতে এসেছি। জিজ্ঞেসা করলুম, নেমন্তন্ন কিসের আচায্যিমশাই? বললেন, উৎসব আছে। কিসের উৎসব দিদিমণি?

বিজয়া। জানিনে পরেশের মা। আমাকে গিয়ে বললেন, কাল দ্বিপ্রহরে আমার ওখানে খেতে হবে মা। পালকি-বেহারা পাঠিয়ে দেব, হেঁটে যেতে পারবে না। কিন্তু ততক্ষণ কিছু খেয়ো না যেন। জিজ্ঞেসা করলুম, কেন দয়ালবাবু? বললেন, আমার ব্রত আছে। তুমি গিয়ে পা দিলে তবেই সে ব্রত সফল হবে। ভাবলুম মন্দির ত? হয়ত কিছু-একটা করেছেন। কিন্তু এমন কাণ্ড হবে জানলে স্বীকার করতুম না পরেশের মা।

[রাসবিহারী প্রবেশ করিলেন]

রাস। একি কাণ্ড! এখনো যাওনি—চারটে বাজল যে!

পরেশের মা। পালকি পাঠাবার কথা, এখনো আসেনি।

রাস। এমনই তার কাজ। পালকি যদি সে না পেয়েছিল একটা খবর পাঠালে না কেন? আমি যোগাড় করে দিতুম।মধ্যাহ্ন-ভোজন যে সায়াহ্ন করে দিলে। ভারী ঢিলে লোক, এইজন্যেই বিলাস রাগ করে। আবার আমাকেও পীড়াপীড়ি,—সন্ধ্যার পরে যেতেই হবে।

[ছুটিয়া পরেশের প্রবেশ]

পরেশ। পালকি এস্‌তেছে মা-ঠান।

[রাসবিহারীকে দেখিয়াই সে সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল]

রাস।বলিস কি রে? এস্‌তেছে? তোরই মোচ্ছব রে! দেখিস পরেশ, নেমন্তন্ন খেয়ে তোকে না ডুলিতে করে আনতে হয়।(বিজয়ার প্রতি) যাও মা আর দেরী করো না—বেলা আর নেই। গিয়ে পালকিটা পাঠিয়ে দিও,—আমি আবার যাব। না গেলে ত রক্ষে নেই, মান-অভিমানের সীমা থাকবে না। সে এ বোঝে না যে দুদিন বাদে আমার বাড়িতেও উৎসব,—কাজের চাপে নিঃশ্বাস নেবার অবকাশ নেই আমার। কিন্তু কে সে কথা শোনে! রাসবিহারীবাবু পায়ের ধূলো একবার দিতেই হবে! কাজেই না গিয়ে উপায় নেই। রাত হলে কিন্তু যেতে পারব না বলে দিও। যাও তোমরা মা,—আমি ততক্ষণ মিস্ত্রীর কাজের হিসেবটা দেখে রাখি গে। প্রায় ষাট-সত্তর জন উদয়াস্ত খাটছে,—প্রাসাদতুল্য বাড়ি, কাজের কি শেষ আছে! অতিথিরা যাঁরা আসবেন, বলতে না পারেন আয়োজনের কোথাও ত্রুটি আছে।

[এই বলিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন, অন্যান্য সকলেও বাহির হইয়া গেল]

দ্বিতীয় দৃশ্য

দয়ালের বহির্বাটী

[মাঙ্গলিক সজ্জায় নানাভাবে সাজানো। নানা লোকের যাতায়াত, কলরব ইত্যাদির মাঝখানে পালকি-বাহকদের শব্দ শোনা গেল এবং ক্ষণেক পরে বিজয়া প্রবেশ করিল। তাহার পিছনে পরেশ, কালীপদ ও পরেশের মা। দয়াল কোথা হইতে ছুটিয়া আসিলেন]

দয়াল। (মহা-উল্লাসে) এই যে মা আমার এসেছেন!

বিজয়া। (হাসিমুখে) বেশ আপনার-ব্যবস্থা! পালকি পাঠাতে এত দেরি করলেন, আমরা সবাই ক্ষিদেয় মরি। এই বুঝি মধ্যাহ্ন-নেমন্তন্ন?

দয়াল। আজ ত তোমার খেতে নেই মা, কষ্ট একটু হবে বৈ কি। ভটচায্যিমশায়ের শাসন আজ না মানলেই নয়। নরেন ত না খেতে পেয়ে একেবারে নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। কি রে পরেশ, তুই কি বলিস?

[একজন লোক ব্যস্তভাবে প্রবেশ করিল, তাহার
হাতে চেলির জোড় প্রভৃতি মোড়কে বাঁধা]

লোক। (দয়ালের প্রতি) দানসামগ্রী এসে পৌঁছেচে, আমি সাজাতে বলে দিলুম। বর-কন্যার চেলীর জোড় এই এল—নাপিতকে কোঁচাতে দিই।

দয়াল। হাঁ দাও গে। ক’টা বাজল, সন্ধ্যার পরেই ত লগ্ন,—আর বেশী দেরি নেই বোধ করি। (বিজয়ার প্রতি) ভাগ্যক্রমে দিনক্ষণ সমস্ত পাওয়া গেছে,—না পেলেও আজই বিবাহ দিতে হতো, কিছুতে অন্যথা করা যেত না,—তা যাক, সমস্তই ঠিকঠাক মিলে গেছে, তাই ত ভটচায্যিমশাই হেসে বলছিলেন, এ যেন বিজয়ার জন্যেই পাঁজিতে আজকের দিনটি সৃষ্টি হয়েছিল। তোমার যে আজ বিবাহ মা।

বিজয়া। আজ আমার বিবাহ?

দয়াল। তাই ত আজ আমাদের আনন্দ-আয়োজন, মহোৎসবের ঘটা।

বিজয়া। (করুণকণ্ঠে) আপনি কি আমার হিন্দুবিবাহ দেবেন?

দয়াল। হিন্দুবিবাহ কি বিবাহ নয় মা? কিন্তু সাম্প্রদায়িক মতবাদ মানুষকে এমনি বোকা করে আনে যে, কাল সমস্ত বিকেলটা ভেবে ভেবেও এই তুচ্ছ কথাটার কূল-কিনারা খুঁজে পাইনি। কিন্তু নলিনী আমাকে একটি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিলে। বললে, তাঁর বাবা তাঁকে যাঁর হাতে দিয়ে গেছেন তোমরা তাঁর হাতেই তাঁকে দাও। নইলে ছল করে যদি অপাত্রে দান করো, তোমাদের অধর্মের সীমা থাকবে না। আর মনের মিলনই ত সত্যিকার বিবাহ, নইলে বিয়ের মন্ত্র বাংলা হবে কি সংস্কৃত হবে, ভটচায্যিমশাই পড়াবেন কি আচার্য্যমশাই পড়াবেন তাতে কি আসে-যায় মা? এত বড় জটিল সমস্যাটা যেন একেবারে জল হয়ে গেল বিজয়া, মনে মনে বললুম, ভগবান! তোমার ত কিছু অগোচর নেই, এদের বিবাহ আমি যেকোন মতেই দিই না তোমার কাছে অপরাধী হব না আমি নিশ্চয় জানি।

জনৈক ভদ্রলোক। নিশ্চয় নিশ্চয়। অতি সত্য কথা।

[ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া]

দয়াল। তুমি জানো না মা, নরেন তোমাকে কত ভালবাসে। তবু সে এমন ছেলে যে তোমার মাথায় অসত্যের বোঝা তুলে দিয়ে তোমাকেও গ্রহণ করতে রাজী হতো না। একবার আগাগোড়া তার কাজগুলো মনে করে দেখ দিকি বিজয়া।

[বিজয়া নিঃশব্দে নতমুখে স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।
নলিনী ছুটিয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিল]

নলিনী। বাঃ আমি এতক্ষণ খবর পাইনি! কাজের ভিড়ে কিছু জানতেই পারিনি। ওপরে চল ভাই, তোমাকে সাজাবার ভার পড়েছে আজ আমার ওপর। চল শিগগির।

[এই বলিয়া সে বিজয়াকে টানিয়া লইয়া ভিতরে চলিয়া গেল। সঙ্গে গেল
পরেশ, পরেশের মা ও কালীপদ। নেপথ্যে শঙ্খ বাজিয়া উঠিল,
ভট্টাচার্যমহাশয় প্রবেশ করিলেন]

ভট্টাচার্য। লগ্ন সমুপস্থিত। আপনারা অনুমতি করুন শুভকার্যে ব্রতী হই।

সকলে। (সমস্বরে) আমরা সর্বান্তঃকরণে সম্মতি দিই ভটচায্যিমশাই, শুভকর্ম অবিলম্বে আরম্ভ করুন।

[যে আজ্ঞে, বলিয়া ভট্টাচার্যমহাশয় প্রস্থান করিলেন। গ্রামের চাষাভূষা নানা লোক নানা কাজে আসা-যাওয়া করিতেছে এবং ভিতর হইতে কলরব শুনা যাইতেছে]

দয়াল। আমারও সংশয় এসেছিল। একটা বড় কথা আছে যে, বিজয়া তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নলিনী বললে, বড় কথা নয় মামাবাবু। বিজয়ার অন্তর্যামী সায় দেয়নি। তবু তার হৃদয়ের সত্যকে লঙ্ঘন করে তার মুখের বলাটাকেই বড় করে তুলবে? শুনে অবাক হয়ে চেয়ে রইলুম। ও বলতে লাগল, কেবল মুখ দিয়ে বার হয়েছে বলেই কোন জিনিস কখনো সত্য হয়ে ওঠে না। তবু তাকেই জোর করে যারা সকলের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে তারা সত্যকে ভালবাসে বলে করে না, তারা সত্য-ভাষণের দম্ভটাকে ভালবাসে বলে করে। আপনারা সকলে হয়ত জানেন না যে, এই ভটচায্যিমশায়ের পিতা-পিতামহ ছিলেন রায়বংশের কুল-পুরোহিত! আবার বহুদিন পরে সেই বংশেরই একজনকে যে এ-বিবাহে পৌরোহিত্য বরণ করতে পেলুম এ আমার বড় সান্ত্বনা। সকলের আশীর্বাদে এ বিবাহ কল্যাণময় হোক, নির্বিঘ্নে হোক এই আপনাদের কাছে আমার প্রার্থনা।

সকলে। আমরা আশীর্বাদ করি বর-কন্যার মঙ্গল হোক!

দয়াল। কন্যা সম্প্রদান করতে বসেছেন তাঁর দূর-সম্পর্কের এক পিসী—

জনৈক ভদ্রলোক। কে—কে? ঈশ্বরকালী ঘোষালের বিধবা?

দয়াল। হাঁ তিনিই। ক্লেশের সঙ্গে মনে হয় আজ বনমালীবাবু যদি জীবিত থাকতেন | তাঁর একমাত্র কন্যা বিজয়াকে নরেন্দ্রনাথের হাতে সমর্পণ করবেন বলেই নরেনকে তিনি মানুষ করে তুলেছিলেন। দয়াময়ের আশীর্বাদে সে মানুষ হয়ে উঠেছে। তাঁর সেই মানুষ-করা ধনের হাতেই তাঁর কন্যাকে আমরা অর্পণ করলুম। বনমালীর অভিলাষ আজ পূর্ণ হলো।

সকলে। আমরা আবার আশীর্বাদ করি তারা সুখী হোক।

[অন্তঃপুর হইতে শঙ্খধ্বনি ও আনন্দ-কলরোল শুনা গেল]

দয়াল। (চোখ বুজিয়া) আমিও ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি আপনাদের শুভ ইচ্ছা সফল হয় যেন।

জনৈক বৃদ্ধ। আমরা আপনাকেও আশীর্বাদ করি দয়ালবাবু। শুনেছিলুম রাসবিহারীর ছেলে বিলাসের সঙ্গে হবে বিজয়ার বিবাহ। আমরা প্রজা, শুনে ভয়ে মরে যাই। সে যে কিরূপ পাষণ্ড—

দয়াল। (সলজ্জে হাত তুলিয়া) না না না,—অমন কথা বলবেন না মজুমদারমশাই। প্রার্থনা করি তাঁরও মঙ্গল হোক।

বৃদ্ধ। মঙ্গল হবে? ছাই হবে। গোল্লায় যাবে। আমার পুকুরটার—

দয়াল। না না না না,—ও-কথা বলতে নেই—বলতে নেই—কারো সম্বন্ধে না। করুণাময় যেন সকলেরই মঙ্গল করেন।

বৃদ্ধ। কিন্তু ঐ যে বুড়ো দেড়ে—

[ধীরে গম্ভীরপদে রাসবিহারী প্রবেশ করিতেই
সকলে চক্ষের পলকে উঠিয়া দাঁড়াইয়া—]

সকলে। আসুন, আসুন, আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক রাসবিহারীবাবু। আমরা সকলেই আপনার শুভাগমনের প্রতীক্ষা করছিলুম।

রাস। (কটাক্ষে চাহিয়া, দয়ালের প্রতি) আজ ব্যাপারটা কি বল ত দয়াল? দোরগোড়ায় কলাগাছ পুঁতেছ, ঘট বসিয়েছ, বাড়ির ভেতরে শাঁকের আওয়াজ শুনতে পেলুম,—আয়োজন মন্দ করোনি—কিন্তু কিসের শুনি?

দয়াল। (সভয়ে ও সবিনয়ে) আজ যে বিজয়ার বিবাহ ভাই!

রাস। মতলবটা কে দিলে শুনি?

দয়াল। কেউ নয় ভাই, করুণাময়ের—

রাস। হুঁ—করুণাময়ের! পাত্রটি কে? জগদীশের ছেলে সেই নরেন?

দয়াল। তুমি ত—আপনি ত জানেন বনমালীবাবু চিরদিনের ইচ্ছে ছিল—

রাস। হুঁ, জানি বৈ কি। বনমালীর মেয়ের বিয়ে কি শেষকালে হিন্দুমতেই দিলে নাকি?

দয়াল। আপনি ত জানেন, আসলে সব বিবাহ-অনুষ্ঠানই এক।

রাস। ওর বাপকে যে হিঁদুরা দেশ থেকে তাড়িয়েছিল মেয়েটা তা-ও ভুললো নাকি!

[এমনি সময়ে অন্তঃপুরের নানাবিধ কলরব শঙ্খধ্বনি কানে আসিতে লাগিল]

দয়াল। শুভকার্য নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হয়েছে। আজ মনের মধ্যে কোন গ্লানি না রেখে তাদের আশীর্বাদ কর ভাই, তারা যেন সুখী হয়, ধর্মশীল হয়, দীর্ঘায়ুঃ হয়।

রাস। হুঁ। আমাকে বললেই পারতে দয়াল, তা হলে ছল-চাতুরি করতে হতো না। ওতেই আমার সবচেয়ে ঘৃণা।

[এই বলিয়া তিনি গমনোদ্যত হইলেন। নলিনী
কোথায় ছিল ছুটিয়া আসিয়া পড়িল]

নলিনী। (আবদারের সুরে বলিল) বাঃ—আপনি বুঝি বিয়েবাড়ি থেকে শুধু শুধু চলে যাবেন? সে হবে না, আপনাকে খেয়ে যেতে হবে রাসবিহারীমামা। আমি কত কষ্ট করে আপনাকে নেমন্তন্ন করে আনিয়েছি।

রাস। দয়াল, মেয়েটি কে?

দয়াল। আমার ভাগনী নলিনী।

রাস। বড় জ্যাঠা মেয়ে।

[প্রস্থান

দয়াল। (সেইদিকে ক্ষণকাল চাহিয়া) অন্তরে বড় ব্যথা পেয়েছেন। ভগবান ওঁর ক্ষোভ দূর করুন। গাঙ্গুলিমশাই, চলুন আমরা অভ্যাগতদের খাবার ব্যবস্থাটা একবার দেখি গে। আজকের দিনে কোথাও না অপরাধ স্পর্শ করে।

পূর্ণ। প্রজাপতির আশীর্বাদে কোথাও ত্রুটি নেই দয়ালবাবু—সমস্ত ব্যবস্থাই ঠিক আছে।

দয়াল। (ইঙ্গিতে বর-বধূকে দেখাইয়া) নলিনী, এদেরও যা হোক দুটো খেতে দিতে হবে যে মা! যাও তোমার মামীমাকে বল গে।

নলিনী। যাই মামাবাবু—

দয়াল। আমিও যাচ্চি চল—

[প্রস্থান

[ক্ষণকালের জন্য রঙ্গমঞ্চে বর-বধূ ভিন্ন আর কেহ রহিল না]

নরেন। গম্ভীর হয়ে কি ভাবচ বল ত?

বিজয়া। (সহাস্যে) ভাবচি তোমার দুর্গতির কথা। সেই যে ঠকিয়ে microscope বেচেছিলে তার ফল হলো এই। অবশেষে আমাকেই বিয়ে করে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হলো।

নরেন। (গলার মালা দেখাইয়া) তার এই ফল! এই শাস্তি?

বিজয়া। হাঁ তাই ত। শাস্তি কি তোমার কম হলো নাকি!

নরেন। তা হোক, কিন্তু বাইরে এ কথা আর প্রকাশ করো না,—তা হলে রাজ্যিসুদ্ধ লোক তোমাকে microscope বেচতে ছুটে আসবে। (উভয়ের হাস্য)

নলিনী। (প্রবেশ করিয়া) এস ভাই, আসুন Dr. Mukherji, মামীমা আপনাদের খাবার দিয়ে বসে আছেন,—কিন্তু অমন অট্টহাস্য হচ্ছিল কেন!

বিজয়া। (হাসিয়া) সে আর তোমার শুনে কাজ নেই—

Exit mobile version