দয়াল। হিন্দুবিবাহ কি বিবাহ নয় মা? কিন্তু সাম্প্রদায়িক মতবাদ মানুষকে এমনি বোকা করে আনে যে, কাল সমস্ত বিকেলটা ভেবে ভেবেও এই তুচ্ছ কথাটার কূল-কিনারা খুঁজে পাইনি। কিন্তু নলিনী আমাকে একটি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিলে। বললে, তাঁর বাবা তাঁকে যাঁর হাতে দিয়ে গেছেন তোমরা তাঁর হাতেই তাঁকে দাও। নইলে ছল করে যদি অপাত্রে দান করো, তোমাদের অধর্মের সীমা থাকবে না। আর মনের মিলনই ত সত্যিকার বিবাহ, নইলে বিয়ের মন্ত্র বাংলা হবে কি সংস্কৃত হবে, ভটচায্যিমশাই পড়াবেন কি আচার্য্যমশাই পড়াবেন তাতে কি আসে-যায় মা? এত বড় জটিল সমস্যাটা যেন একেবারে জল হয়ে গেল বিজয়া, মনে মনে বললুম, ভগবান! তোমার ত কিছু অগোচর নেই, এদের বিবাহ আমি যেকোন মতেই দিই না তোমার কাছে অপরাধী হব না আমি নিশ্চয় জানি।
জনৈক ভদ্রলোক। নিশ্চয় নিশ্চয়। অতি সত্য কথা।
[ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া]
দয়াল। তুমি জানো না মা, নরেন তোমাকে কত ভালবাসে। তবু সে এমন ছেলে যে তোমার মাথায় অসত্যের বোঝা তুলে দিয়ে তোমাকেও গ্রহণ করতে রাজী হতো না। একবার আগাগোড়া তার কাজগুলো মনে করে দেখ দিকি বিজয়া।
[বিজয়া নিঃশব্দে নতমুখে স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিল।
নলিনী ছুটিয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিল]
নলিনী। বাঃ আমি এতক্ষণ খবর পাইনি! কাজের ভিড়ে কিছু জানতেই পারিনি। ওপরে চল ভাই, তোমাকে সাজাবার ভার পড়েছে আজ আমার ওপর। চল শিগগির।
[এই বলিয়া সে বিজয়াকে টানিয়া লইয়া ভিতরে চলিয়া গেল। সঙ্গে গেল
পরেশ, পরেশের মা ও কালীপদ। নেপথ্যে শঙ্খ বাজিয়া উঠিল,
ভট্টাচার্যমহাশয় প্রবেশ করিলেন]
ভট্টাচার্য। লগ্ন সমুপস্থিত। আপনারা অনুমতি করুন শুভকার্যে ব্রতী হই।
সকলে। (সমস্বরে) আমরা সর্বান্তঃকরণে সম্মতি দিই ভটচায্যিমশাই, শুভকর্ম অবিলম্বে আরম্ভ করুন।
[যে আজ্ঞে, বলিয়া ভট্টাচার্যমহাশয় প্রস্থান করিলেন। গ্রামের চাষাভূষা নানা লোক নানা কাজে আসা-যাওয়া করিতেছে এবং ভিতর হইতে কলরব শুনা যাইতেছে]
দয়াল। আমারও সংশয় এসেছিল। একটা বড় কথা আছে যে, বিজয়া তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নলিনী বললে, বড় কথা নয় মামাবাবু। বিজয়ার অন্তর্যামী সায় দেয়নি। তবু তার হৃদয়ের সত্যকে লঙ্ঘন করে তার মুখের বলাটাকেই বড় করে তুলবে? শুনে অবাক হয়ে চেয়ে রইলুম। ও বলতে লাগল, কেবল মুখ দিয়ে বার হয়েছে বলেই কোন জিনিস কখনো সত্য হয়ে ওঠে না। তবু তাকেই জোর করে যারা সকলের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে তারা সত্যকে ভালবাসে বলে করে না, তারা সত্য-ভাষণের দম্ভটাকে ভালবাসে বলে করে। আপনারা সকলে হয়ত জানেন না যে, এই ভটচায্যিমশায়ের পিতা-পিতামহ ছিলেন রায়বংশের কুল-পুরোহিত! আবার বহুদিন পরে সেই বংশেরই একজনকে যে এ-বিবাহে পৌরোহিত্য বরণ করতে পেলুম এ আমার বড় সান্ত্বনা। সকলের আশীর্বাদে এ বিবাহ কল্যাণময় হোক, নির্বিঘ্নে হোক এই আপনাদের কাছে আমার প্রার্থনা।
সকলে। আমরা আশীর্বাদ করি বর-কন্যার মঙ্গল হোক!
দয়াল। কন্যা সম্প্রদান করতে বসেছেন তাঁর দূর-সম্পর্কের এক পিসী—
জনৈক ভদ্রলোক। কে—কে? ঈশ্বরকালী ঘোষালের বিধবা?
দয়াল। হাঁ তিনিই। ক্লেশের সঙ্গে মনে হয় আজ বনমালীবাবু যদি জীবিত থাকতেন | তাঁর একমাত্র কন্যা বিজয়াকে নরেন্দ্রনাথের হাতে সমর্পণ করবেন বলেই নরেনকে তিনি মানুষ করে তুলেছিলেন। দয়াময়ের আশীর্বাদে সে মানুষ হয়ে উঠেছে। তাঁর সেই মানুষ-করা ধনের হাতেই তাঁর কন্যাকে আমরা অর্পণ করলুম। বনমালীর অভিলাষ আজ পূর্ণ হলো।
সকলে। আমরা আবার আশীর্বাদ করি তারা সুখী হোক।
[অন্তঃপুর হইতে শঙ্খধ্বনি ও আনন্দ-কলরোল শুনা গেল]
দয়াল। (চোখ বুজিয়া) আমিও ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি আপনাদের শুভ ইচ্ছা সফল হয় যেন।
জনৈক বৃদ্ধ। আমরা আপনাকেও আশীর্বাদ করি দয়ালবাবু। শুনেছিলুম রাসবিহারীর ছেলে বিলাসের সঙ্গে হবে বিজয়ার বিবাহ। আমরা প্রজা, শুনে ভয়ে মরে যাই। সে যে কিরূপ পাষণ্ড—
দয়াল। (সলজ্জে হাত তুলিয়া) না না না,—অমন কথা বলবেন না মজুমদারমশাই। প্রার্থনা করি তাঁরও মঙ্গল হোক।
বৃদ্ধ। মঙ্গল হবে? ছাই হবে। গোল্লায় যাবে। আমার পুকুরটার—
দয়াল। না না না না,—ও-কথা বলতে নেই—বলতে নেই—কারো সম্বন্ধে না। করুণাময় যেন সকলেরই মঙ্গল করেন।
বৃদ্ধ। কিন্তু ঐ যে বুড়ো দেড়ে—
[ধীরে গম্ভীরপদে রাসবিহারী প্রবেশ করিতেই
সকলে চক্ষের পলকে উঠিয়া দাঁড়াইয়া—]
সকলে। আসুন, আসুন, আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক রাসবিহারীবাবু। আমরা সকলেই আপনার শুভাগমনের প্রতীক্ষা করছিলুম।
রাস। (কটাক্ষে চাহিয়া, দয়ালের প্রতি) আজ ব্যাপারটা কি বল ত দয়াল? দোরগোড়ায় কলাগাছ পুঁতেছ, ঘট বসিয়েছ, বাড়ির ভেতরে শাঁকের আওয়াজ শুনতে পেলুম,—আয়োজন মন্দ করোনি—কিন্তু কিসের শুনি?
দয়াল। (সভয়ে ও সবিনয়ে) আজ যে বিজয়ার বিবাহ ভাই!
রাস। মতলবটা কে দিলে শুনি?
দয়াল। কেউ নয় ভাই, করুণাময়ের—
রাস। হুঁ—করুণাময়ের! পাত্রটি কে? জগদীশের ছেলে সেই নরেন?
দয়াল। তুমি ত—আপনি ত জানেন বনমালীবাবু চিরদিনের ইচ্ছে ছিল—
রাস। হুঁ, জানি বৈ কি। বনমালীর মেয়ের বিয়ে কি শেষকালে হিন্দুমতেই দিলে নাকি?
দয়াল। আপনি ত জানেন, আসলে সব বিবাহ-অনুষ্ঠানই এক।
রাস। ওর বাপকে যে হিঁদুরা দেশ থেকে তাড়িয়েছিল মেয়েটা তা-ও ভুললো নাকি!