নরেন। (ক্ষণকাল একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করিয়া) আপনি রাগ করে যা বলচেন এ ত আমার মত নয়।
বিজয়া। নিশ্চয় এই আপনার সত্যিকার মত।
নরেন। আমাকে পরীক্ষা করলে টের পেতেন এ আমার সত্যিকার মিথ্যেকার কোন মতই নয়। এ ছাড়া নলিনীর কথা নিয়ে কেন আপনি বৃথা কষ্ট পাচ্ছেন? আমি জানি তাঁর মন কোথায় বাঁধা এবং তিনিও নিশ্চয় বুঝবেন কেন আমি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পালাচ্চি। আমার যাওয়া নিয়ে আপনি নিরর্থক উদ্বিগ্ন হবেন না।
বিজয়া। নিরর্থক? তাঁর অমত না হলেই আপনি যেখানে খুশি যেতে পারেন মনে করেন?
নরেন। না তা পারিনে। আপনার অমতেও আমার কোথাও যাওয়া চলে না। কিন্তু আপনি ত আমার সব কথাই জানেন। আমার জীবনের সাধও আপনার অজানা নয়, বিদেশে কোনদিন হয়ত সে সাধ পূর্ণ হতেও পারে, কিন্তু এ-দেশে এত বড় নিষ্কর্মা দীন-দরিদ্রের থাকা-না-থাকা সমান। আমাকে যেতে বাধা দেবেন না।
বিজয়া। আপনি দীন-দরিদ্র ত নন। আপনার সবই আছে, ইচ্ছে করলেই ফিরে নিতে পারেন।
নরেন। ইচ্ছে করলেই পারিনে বটে, কিন্তু আপনি যে দিতে চেয়েছেন সে আমার মনে আছে এবং চিরদিন থাকবে। কিন্তু দেখুন, নেবারও একটা অধিকার থাকা চাই—সে অধিকার আমার নেই।
বিজয়া। (উচ্ছ্বসিত রোদন সংবরণ করিতে করিতে উত্তেজিত-স্বরে) আছে বৈ কি। বিষয় আমার নয়, বাবার। সে আপনি জানেন। নইলে পরিহাসচ্ছলেও তাঁর যথাসর্বস্ব দাবী করার কথা মুখে আনতে পারতেন না। আমি হলে কিন্তু ঐখানেই থামতুম না। তিনি যা দিয়ে গেছেন সমস্ত জোর করে দখল করতুম, তার একতিলও ছেড়ে দিতুম না। (টেবিলে মুখ রাখিয়া কাঁদিতে লাগিল)
নরেন। নলিনী ঠিকই বুঝেছিল বিজয়া, আমি কিন্তু বিশ্বাস করিনি। ভাবতেই পারিনি আমার মত একটা অকেজো অক্ষম লোককে কারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু সত্যিই যদি এই অসঙ্গত খেয়াল তোমার মাথায় ঢুকেছিল শুধু একবার হুকুম করোনি কেন? আমার পক্ষে এর স্বপ্ন দেখাও যে পাগলামি বিজয়া!
[বিজয়া মুখের উপর আঁচল চাপিয়া উচ্ছ্বসিত রোদন সংবরণ করিতে লাগিল। নরেন পিছনে পদশব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখিল দয়াল দাঁড়াইয়া দ্বারের কাছে। তিনি ধীরে ধীরে ঘরে আসিয়া বিজয়ার আসনের একান্তে বসিয়া তাহার মাথায় হাত দিলেন, বলিলেন—]
দয়াল। মা!
[বিজয়া একবার মুখ তুলিয়া দেখিল পুনরায় উপুড় হইয়া পড়িয়া মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল। দয়ালের চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল, সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন—]
দয়াল। শুধু আমার দোষেই এই ভয়ানক অন্যায় হয়ে গেল মা, শুধু আমি এই দুর্ঘটনা ঘটালুম। কাল তোমরা চলে গেলে নলিনীর সঙ্গে আমার এই কথাই হচ্ছিল,—সে সমস্তই জানত। কিন্তু কে ভেবেছে নরেন মনে মনে কেবল তোমাকেই,—কিন্তু নির্বোধ আমি সমস্ত ভুল বুঝে তোমাকে উলটো খবর দিয়ে এই দুঃখ ঘরে ডেকে আনলুম। এখন বুঝি আর কোন প্রতিকার নেই?(তেমনি মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে দিতে) এর কি আর কোন উপায় হতে পারে না বিজয়া?
বিজয়া।(তেমনি মুখ লুকাইয়া ভগ্নকণ্ঠে) না দয়ালবাবু, মরণ ছাড়া আর আমার নিষ্কৃতির পথ নেই।
দয়াল। ছি মা, এমন কথা বলতে নেই।
বিজয়া। আমি কথা দিয়েছি দয়ালবাবু। তাঁরা সেই কথার নির্ভর করে সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে এনেছেন। এ যদি ভাঙ্গি, সংসারে আমি মুখ দেখাব কেমন করে? শুধু বাকী আছে মরণ—
[বলিতে বলিতে পুনরায় তাহার কণ্ঠরোধ হইল। দয়ালের চোখ দিয়াও
আবার জল গড়াইয়া পড়িল। হাত দিয়া মুছিয়া বলিলেন—]
দয়াল। নলিনী বললে, বিজয়া কথা দিয়েছে, সই করে দিয়েছে—এ ঠিক। কিন্তু কোনটায় তার অন্তর সায় দেয়নি। তার সেই মুখের কথাটাই বড় হবে মামাবাবু, আর হৃদয় যাবে মিথ্যে হয়ে? তার মামী বললে, ওর মা নেই, বাপ নেই,—একলা মেয়ে,—আচার্য হয়ে তুমি এতবড় পাপ করো না। যে দেবতা হৃদয়ে বাদ করেন এ অধর্ম তিনি সইবেন না। সারা রাত চোখে ঘুম এল না, কেবলই মনে হয় নলিনীর কথা—মুখের বাক্যটাই বড় হবে, হৃদয় যাবে ভেসে? ভোর হতেই ছুটলুম কলকাতায়—নরেনের কাছে—
নরেন। আপনি আমার কাছে গিয়েছিলেন?
দয়াল। গিয়ে দেখি তুমি বাসায় নেই, খোঁজ নিয়ে গেলুম তোমার আফিসে, তারাও বললে, তুমি আসনি। ফিরে এলুম বিফল হয়ে, কিন্তু আশা ছাড়লুম না। মনে মনে বললুম, যাব বিজয়ার কাছে, বলব তাকে গিয়ে সব কথা—
[পরেশ গলা বাড়াইয়া দেখা দিল]
পরেশ। মা ঠান, একটা-দুটো বেজে গেল—তুমি না খেলে যে আমরা কেউ খেতে পাচ্চিনে।
[শুনিয়া বিজয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিল]
বিজয়া।(ব্যস্তভাবে) দয়ালবাবু, এখানেই আপনাকে স্নানাহার করতে হবে।
দয়াল। না মা, আজ তোমার আদেশ পালন করতে পারব না। তারা সব পথ চেয়ে আছে। নরেন, তোমাকেও যেতে হবে। কাল না খেয়ে চলে এসেছ, সে দুঃখ ওদের যায়নি, এস আমার সঙ্গে।
[নরেন উঠিয়া দাঁড়াইল। বিজয়া ইঙ্গিতে তাহাকে একপাশে
ডাকিয়া লইয়া দয়ালের অগোচরে মৃদুকণ্ঠে বলিল]
বিজয়া। আমাকে না জানিয়ে কোথাও চলে যাবেন না ত?
নরেন। না। যাবার আগে তোমাকে বলে যাব।
বিজয়া। ভুলে যাবে না?
নরেন। (হাসিয়া) ভুলে যাব? চলুন দয়ালবাবু, আমরা যাই।
দয়াল। চল। আসি মা এখন।
(একদিক দিয়া দয়াল ও নরেন, অন্যদিক দিয়া বিজয়া প্রস্থান করিল
বিজয়া – ৩.৫
পঞ্চম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
বিজয়ার বসিবার ঘর
[পরেশ প্রবেশ করিল। তাহার পরিধানে চওড়া পাড়ের শাড়ী, গায়ে ছিটের জামা, গলায় কোঁচানো চাদর, কিন্তু খালি পা]