Site icon BnBoi.Com

দারোগার দপ্তর – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

দারোগার দপ্তর - প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

খুন না চুরি

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। হাতের কাজ শেষ করিয়া অফিস–ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময়ে পশ্চিমদেশীয় একজন ভদ্র লোক আমার সম্মুখে আসিয়া নমস্কার করতঃ একখানি পত্ৰ দিলেন। পত্ৰখানি গ্ৰহণ করিয়া দেখিলাম, উহা আমারই উপরিতন কৰ্ম্মচারীর লেখা। খুলিয়া পাঠ করিলাম। ভবানীপুর পদ্মপুকুর রোডে খুন হইয়াছে, আমাকে তখনই পত্রবাহকের সহিত তাহার তদ্বির করিতে যাইতে হইবে।

কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি দাঁড়াইয়া উঠিলাম। আগন্তুক আমার অভিপ্ৰায় বুঝতে পারিয়া পরম আপ্যায়িত হইয়া বলিলেন, আসুন মহাশয়! আমি ধনে প্রাণে মারা গেলাম। সকল কথা গাড়ীতেই শুনিতে পাইবেন।

দ্বিরুক্তি না করিয়া আমি তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাহির হইলাম। ফটকের সন্মুখেই তাঁহার গাড়ী ছিল, উভয়েই সেই গাড়ীতে উঠিলাম। কোচমান শকট চালনা করিল।

লোকটীর বয়স প্ৰায় পয়ত্ৰিশ বৎসর, দেখিতে অতি সুপুরুষ। বেশ হৃষ্ট–পুষ্ট দেহ। তাঁহার পরিধানে একখানি পাতলা দেশী কালাপেড়ে ধুতি, একটা আদ্ধির পিরাণ, একখানি মান্দ্ৰাজী জরিপেড়ে উড়ানি, মস্তকে একটা ফিরোজা রঙের পাগড়ী, গলায় গিনি সোণার মোটা হার, কৰ্ণে হীরাবসান ফুল, হস্তে হীরার আংটী, পায়ে বাৰ্ণিশ করা জুতা।

কিছুদূর যাইতে না যাইতে তিনি অতি বিমৰ্ষভাবে বলিলেন, মহাশয়, আমার সাৰ্ব্বনাশ হইয়াছে। আমার ভাবী–পত্নীকে কে খুন করিয়াছে।

ভাবী পত্নীর কথা শুনিয়া আমি বিস্মিত হইলাম, তাহার মুখের দিকে একদৃষ্টি চাহিয়া রহিলাম। তিনি আমার মনোগত ভাব বুঝিয়া বলিলেন, দুই বৎসর হইল আমার প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তাঁহার মৃত্যুর পরে আমার একমাত্র পুত্রও মারা পড়ে। মনে করিয়াছিলাম, আর সংসারে লিপ্ত হইব না; কিন্তু বিধিলিপি অখণ্ডনীয়। ভবানীপুর পদ্মপুকুর রোডে শোভন সিং নামে আমার এক বন্ধু বাস করিতেন। আমি প্রায়ই তাঁহার বাড়ীতে যাতায়াত কিরিতাম। শোভন সিংএর অবস্থা বড় ভাল ছিল না। তাঁহার একটী কন্যা ছিল। মেয়েটার বিবাহের বয়স উৰ্ত্তীর্ণ হইলেও অর্থঅভাবে তিনি বিবাহ দিতে পারেন নাই। কন্যার নাম রূপসী। তাহার বয়স প্ৰায় চৌদ্দ বৎসর, দেখিতে বেশ সুন্দরী। একদিন কথায় কথায় শোভন সিং কন্যার বিবাহের কথা উত্থাপন করেন এবং আমাকে বিবাহ করিবার জন্য অত্যন্ত অনুরোধ করেন। উদ্ধাপসী সুন্দরী যুবতী, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার, দু–পয়সার সঙ্গতিও আছে। আমিও পিতার একমাত্র সন্তান, বিবাহ না করিলেন বংশ লোপ হইবে, এই আশঙ্কায় বিবাহে সন্মত হইলাম। কিন্তু তাহার পর হইতে শোভন সিং আর বিবাহের কথা উত্থাপন করেন না দেখিয়া আমি তাঁহাকে বিবাহের দিন স্থির করিতে বলি। শোভন সিং আমার কথায় যেন বিরক্ত হইলেন। বলিলেন, পাঁচশত টাকা না দিলে আমি রূপসীকে দান করিতে পারিব না।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, শোভন সিং কি পূৰ্ব্বে টাকার কথা বলেন নাই?

তিনি ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না, টাকার নামও করেন নাই। টাকা দিতে হইবে শুনিয়া আমার কেমন সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, হয় ত তিনি আর কোথাও পাত্র ঠিক করিয়াছেন। এখন টাকা চাহিয়া আমাকে তাড়াইবার চেষ্টায় আছেন। আমার তখন বিবাহে ইচ্ছা হইয়াছে। রূপসীও জানিতে পারিয়াছে যে, তাহার সহিত আমার বিবাহ হইবে। পূর্বের মত সে ও আর আমার কাছে অসিত না। কাজেই আমি সন্মত হইলাম। বলিলাম, আমি টাকা দিতে প্রস্তুত আছি। আপনি বিবাহের দিন স্থির করুন। তখনই একজন দৈবজ্ঞকে ডাকা হইল। তিনি আসিয়া আমাদের বিবাহের দিন ধাৰ্য্য করিয়া দিলেন। কিন্তু দুরদৃষ্ট বশতঃ সে লগ্নে আমাদের বিবাহ হইল না।

আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কেন?

তিনি বলিলেন, বিবাহের দুই দিন পূর্বে শোভন সিংএর এক জ্ঞাতি বিয়োগ হয়। কালাশৌচ, কাজেই বিবাহ হইল না। অশৌচান্তে আবার দিন স্থির হইল। কিন্তু সেবারও বিবাহ হইল না। রূপসীর সাংঘাতিক জর হইল। প্ৰায় তিন মাস ভুগিয়া রূপসী আরোগ্যলাড করিল। এইরূপে আরও তিন চারিবার দিন ধার্য্য হইল, কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে তখনও বিবাহ হইল না। কোন না কোনো অছিলা করিয়া শোভন সিং বিবাহের দিন ক্রমাগত পিছাইয়া দিতে লাগিলেন। প্ৰায় আট মাস কাল এইরূপে অতিবাহিত হইল। পরে একদিন শোভন সিং বলিলেন যে, রূপসী ও বাড়ীর অন্যান্য লোকের চিকিৎসায় তাহার অনেক অর্থব্যয় হইয়া গিয়াছে। যদি আমি আরও তিন শত টাকা দিই, তাহা হইলে আমাদের শীঘ্রই বিবাহ হইতে পারে। আমি তখন অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছি। কাজেই শোভন সিংএর প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। বোধ হয় তিনি ভাবিয়াছিলেন, আমি আর অধিক টাকা দিতে স্বীকৃত হইব না। কিন্তু যখন আমি তাহাতেও সম্মত হইলাম, তখন তিনি আন্তরিক বিরক্ত হইলেন। মুখে বলিলেন, সমস্ত টাকা অগ্রিম দিলেই বিবাহ হইবে। আমিও নাছোড় বান্দা, পরদিনই আটশত টাকা আনিয়া শোভন সিংএর হস্তে দিলাম। তিনি আনন্দিত মনে উহা গ্রহণ করিলেন, কিন্তু কোন রসিদ দিলেন না, আমিও চক্ষু লজ্জায় পড়িয়া কোন রসিদ চাহিলাম না। তবে যখন টাকা, দিই, সেই সময়ে সেখানে তিন চারিজন লোক ছিলেন। তাঁহারাই সাক্ষী স্বরূপ ছিলেন। সে যাহা হউক, টাকা পাইয়া শোভন সিং আবার বিবাহের দিন স্থির করিলেন। আজই সেই দিন। বেলা পাঁচটার সময় আমি কয়েকজন মাত্র বরযাত্ৰ লইয়া কন্যার গৃহে উপস্থিত হইলাম। বাড়ীতে প্ৰবেশ করিবামাত্র একটা ভয়ানক গোলযোগ আমার কর্ণগোচর হইল। ক্ৰমে চীৎকার, ক্ৰন্দনধ্বনিও শুনিতে পাইলাম। মনে একটা কেমন আতঙ্ক উপস্থিত হইল। আমার সঙ্গীগণ দেখিয়া শুনিয়া অবাক হইলেন। বর বা বরযাত্র বসিবার স্থান পৰ্য্যন্ত করা হয় নাই। কি করিব, কোথায় বসিব ভাবিতেছি, এমন সময়ে শোভন সিং কাঁদিতে কাঁদিতে আমাদের নিকটে আসিলেন। বলিলেন, রূপসীকে কে খুন করিয়াছে। ক্ৰন্দনের শব্দ শুনিয়া প্রতিবেশিগণ ছুটিয়া আসিল, বাড়ীতে লোকে লোকারণ্য হইল। রূপসীর মৃত্যু–সংবাদে দুঃখ হওয়া দূরে থাক, আমার অত্যন্ত ক্ৰোধ হইল। আমি অতি কৰ্কশ স্বরে বলিলাম, চলুন–আমি মৃতদেহ দেখিতে চাই। কেমন করিয়া কেই বা রূপসীকে খুন করিল, আপনিই বা এখনও থানায় এ সংবাদ দেন নাই কেন? আমি বড় ভাল বুঝিতেছি না। ইহার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনরূপ ষড়যন্ত্র আছে। রূপসী যদি সত্য সত্যই খুন হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমি আপনাকে সহজে ছাড়িব না। এই দণ্ডে আমার আটশত টাকা চাই।

আমার কথায় শোভন সিং কাতর হইলেন। বলিলেন, আমার কন্যার মৃতদেহ পৰ্যন্ত পাইতেছি না। অগ্ৰে তাহার সন্ধান না করিয়া কেমন করিয়া থানায় সংবাদ দিব। যদি আপনার ইচ্ছা হয়, আপনি এখনই সংবাদ দিতে পারেন। আমি এক কোনদিক দেখিব?

কথা শুনিয়া আমার সন্দেহ আরও বৃদ্ধি পাইল। আমি তখনই সেখান হইতে বিদায় লইলাম এবং তৎক্ষণাৎ বরবেশ ত্যাগ করিয়া আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। এখন আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। রূপসীকে পাই ভালই, নচেৎ আমার আটশত টুকো ফিরাইয়া চাই। আপনাকে ঐ টাকা আদায় করিয়া দিতে হইবে।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার নিবাস কোথায়? নামই বা কি?

তিনি বলিলেন, আমার নাম লাল সিং, বাড়ি শিয়ালদহের নিকট।

লালসিং–এর টাকার কথায় আমি কোন উত্তর করিলাম না দেখিয়া, তিনি পুনরায় ঐ কথা তুলিলেন। আমি বলিলাম, টাকা আদায় করিবার ক্ষমতা আমাদের নাই। আমি কেবল খুনের তদ্বির করিতে পারিব।

এই কথা শেষ হইতে না হইতে গাড়ীখানি একটী ক্ষুদ্র অট্টালিকার সম্মুখে থামিল। লালসিং অগ্ৰে গাড়ী হইতে অবতরণ করিলেন। আমিওঁ নামিয়া তাঁহার সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

কিছুদূর অগ্রসর হইয়া আমরা একটী ক্ষুদ্র প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বিবাহোৎসব সম্পন্ন করিবার জন্য বাড়ীখানি বেশ সাজানো হইয়াছে। চারিদিকে বেলোয়ারি ঝাড় ঝুলিতেছে, একখানি চাঁদোয়া দ্বারা সমস্ত প্রাঙ্গন আচ্ছাদিত রহিয়াছে। তাহারই নিম্নে একটা ঢালা বিছানা পাড়া ছিল। সেই বিছানার এক পার্শ্বে পাত্রের বসিবার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে। কিন্তু একজন লোককে ও সেই শয্যার উপর দেখিতে পাইলাম না। অন্দর হইতে রমণীদিগের রোদনশব্দ আমার কর্ণগোচর হইতে লাগিল। কিন্তু শোভনসিংকে দেখিতে পাইলাম না।

কিছুক্ষণ প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময় লালসিং অঙ্গুলি নির্দেশ দ্বারা একজনকে দেখাইয়া বলিলেন, ইনিই শোভন সিং আমার ভাবী শ্বশুর।

শোভন সিং আমাকে দেখিয়া স্তম্ভিত হলেন। কিন্তু তখনই আত্মসংবরণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনিই কি আমার কন্যার মৃতদেহ দেখিতে আসিয়াছেন?

আমি লালসিংকে দেখাইয়া বলিলাম, ইনি বলেন, আপনার কন্যা খুন হইয়াছে। কিন্তু আপনি ইঁহাকে তাহার মৃতদেহ দেখাইতেছেন না। আমি ইঁহার মুখে সমস্তই শুনিয়াছি। এখন লাস কোথায় বলুন?

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

আমার কথা শুনিয়া শোভন সিং চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। পরে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, মহাশয়। আমার একমাত্ৰ সন্তান–ঐ কন্যা ভিন্ন আমার আর কোন সন্তানাদি হয় নাই। তাহার বিয়োগে আমি যে অত্যন্ত কাতর হইয়াছি এ কথা বলাই বাহুল্য।

শোভন সিংএর অবস্থা দেখিয়া এবং তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়া আমার কেমন সন্দেহ হইল। তাহার বয়স প্ৰায় বিয়াল্লিশ বৎসর; কিন্তু এই বয়সেই তাহার দেহের মাংস শিথিল হইয়াছে, সম্মুখের, উপর–পাটীর দুইটী দাঁত পড়িয়া গিয়াছে। গোঁপ শ্মশ্রু ও মস্তকের কেশ পাক ধরিয়াছে। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ, তাঁহার দেহ দীর্ঘ ও শীর্ণ, হস্ত প্ৰায় আজানুলম্বিত, চক্ষু ক্ষুদ্র ও কোটরগ্ৰস্ত নাসিক উন্নত এবং ললাট প্রশস্ত। মুখ দেখিয়াই কেমন ক্রূর প্ৰকৃতি বলিয়া বোধ হইল।

অপর কথায় সময় নষ্ট করিতেছেন দেখিয়া আমি বিরক্ত হইলাম। বলিলাম,–আমি আপনার দুঃখের কথা শুনিতে আসি নাই। কন্যাবিয়োগে আপনি যে কাতর হইবেন, ইহাতে আর আশ্চর্য্য কি? এখন আমি যাহা জিজ্ঞাসা করি, তাহার উত্তর দিন; আপনার কন্যার লাস কোথায় বলুন?

আত্ম সংবরণ করিয়া শোভন সিং বলিলেন,–সেই কথাই বলিতেছি,–রূপসীর লাস পাওয়া যাইতেছে না।

আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–সে কি! লাস পাওয়া যাইতেছে না কি?

কাঁদ কাঁদ হইয়া শোভন সিং বলিলেন,–এখান হইতে কিছু দূরে আমার এক আত্মীয় বাস করেন, রূপসী আজি প্রাতে তাঁহাদের বাড়ীতে গিয়াছিল। বাছা আমার সেই অবধি আর ফিরে নাই।

তবে খুন হইয়াছে বলিতেছেন কেন? আপনার কন্যা নিরুদেশ হইয়াছে। হয় সে নিজে পলায়ন করিয়াছে, নচেৎ কোন লোক তাহাকে লইয়া পলায়ন করিয়াছে।

না মহাশয়! সকল কথা শুনিলে বুঝিতে পরিবেন। রূপসী আর এ জগতে নাই।

এই বলিয়া শোভন সিং আবার চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। কন্যাবিয়োগে তিনি বড়ই কাতর হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণ পরে শান্ত হইয়া আবার বলিতে লাগিলেন,–প্ৰাতে রূপসী একজন সঙ্গিনী লইয়া এ বাড়ী হইতে বাহির হয়। পথে এক বৃদ্ধা তাহার সহিত আলাপ করে এবং উভয়কেই ভুলাইয়া লইয়া যায়। যে রূপসীর সঙ্গে গিয়াছিল, অনেকক্ষণ পরে সে ফিরিয়া আসিয়াছে, কিন্তু রূপসী আর ফিরে নাই। গৌরীর মুখে যাহা যাহা এখন শুনিতেছি, তাহা বড়ই ভয়ানক।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–গৌরী কে?

গৌরী আমার ভাগিনেয়ী, রূপসীর বিবাহ উপলক্ষে এখানে আসিয়াছে। গৌরীই রূপসীর সহিত প্ৰাতে আমার আত্মীয়ের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়াছিল।

আ। সে কি বলে?

শো। আমি তাহাকে ডাকিয়া আনিতেছি, আপনি তাহার মুখেই সকল কথা শুনুন। এমন ইংরাজ রাজত্বে এখনও যে এই লোমহর্ষণ কাণ্ড ঘটিতে পারে, আমার এমন ধারণা ছিল না।

এই বলিয়া আমার উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া তিনি অন্দরে প্ৰবেশ করিলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই এক খৰ্বীকৃতি বালিকার হস্তধারণ করিয়া পুনরায় তথায় উপস্থিত হইলেন। পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন–এই বালিকার নাম গৌরী, আপনি ইহার মুখেই সমস্ত শুনতে পারবেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, গৌরী যখন ফিরিয়া আইসে, তখন তাহার কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না। সে যেন পাগলের মত হইয়া গিয়াছিল।

গৌরীকে দেখিতে খৰ্ব্বাকৃতি হইলেও আমার অনুমানে তাহার বয়স অন্ততঃ পনের বৎসর বলিয়া বোধ হইল। তাহার দেহ শীর্ণ কিন্তু তাহাতে যৌবনের চিহ্নগুলি ক্ৰমেই ফুটিয়া উঠিতেছে। গৌরীর আয়ত চক্ষু সদাই চঞ্চল, মুখখানি কাঁদ কাঁদ।

গৌরীর মুখের দিকে চাহিয়া আমি বলিলাম,–বল মা! কি জান বল?

কাঁদ কাঁদ হইয়া গৌরী উত্তর করিল—খুব ভোরে আমরা এখান হইতে বাহির হই। পথে লোক ছিল না বলিলেও অমন বাহির হইলাম বটে, কিন্তু দু-জনেরই গা কেমন ছমছম করিতে লাগিল। যখন আমরা পদ্মপুকুরের ধারে গিয়া উপস্থিত হই, দেখিলাম, এক বুড়ী যেন আমাদেরই দিকে আসিতেছে। কাছে অসিলে দেখিলাম, সে আমাদেরই দিকে কটমট করিয়া চাহিয়া রহিয়াছে। চারি চক্ষু মিলিত হইবা মাত্ৰ বুড়ী এক গাল হাসিয়া আমাদের নিকটে আসিল এবং নিমেষ মধ্যে দুই হাতে দুইটি জবা বাহির করিয়া আমাদের উভয়ের নাসিকার নিকট ধরিয়া বলিল,–দেখ দেখি, জবায় কেমন গোলাপ-গন্ধ? আর কখন এমন জবা দেখেছ কি?

সত্যসত্যই গোলাপের গন্ধ পাইলাম, জবাফুলে গোলাপ–গন্ধ পাইয়া কেমন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। তখন উভয়েই সমস্ত কথু ভুলিয়া গেলাম। রূপসীর বিবাহের কথা ভুলিলাম, কোথায় যাইতেছিলাম ভুললাম, বাড়ী ভূলিলাম, এমন কি, আপনাদের অস্তিত্ব পৰ্য্যন্ত ভুলিলাম। রহিল কেবল সেই বৃদ্ধ। আমরা তাহার হাতের খেলনা স্বরূপ হইলাম। সে আমাদিগকে যাহা বলিতে লাগিল, আমরা অনায়াসে তাহা করিতে লাগিলাম। প্ৰথমে সে আমাদিগকে কিছুদূরে লইয়া গেল। সেখানে একখানি গাড়ী ছিল। আমরা তিনজনে গাড়ীতে উঠিলাম। কতক্ষণ পরে বনের ভিতর একটা ভাঙ্গা বাড়ীর দরজায় আসিয়া গাড়ী থামিয়া গেল। আমরা সকলেই গাড়ী হইতে নামিয়া সেই বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, একটা প্ৰকাণ্ড ঘরের মধ্যে তিনজন সন্ন্যাসী একদৃষ্টি সম্মুখের প্রজ্জলিত অগ্নির দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। সন্ন্যাসী তিনজনের মধ্যে একজনকে দেখিতে অতি ভয়ানক, অপর দুইজনকে তাহার শিষ্য বলিয়াই বোধ হইল।

আমাদের পায়ের শব্দে সেই ভয়ানক সন্ন্যাসী উপরদিকে চাহিল এবং বুড়ীকে দেখিয়া ঈষৎ হাসিয়া নিকটস্থ দুইখানি কুশাসন ইঙ্গিত করিয়া দেখাইয়া দিল। বৃদ্ধাও তাহার সঙ্কেত বুঝিতে পারিয়া আমাদের দুইজনকে সেই দুইখানি আসনে বসিতে বলিয়া স্বয়ং নিকটে দাঁড়াইয়া রহিল।

কতক্ষণ এইরূপে কাটিল বলিতে পারি না। কিন্তু কিছু পরেই অপর দুই সন্ন্যাসী রূপসীর হাত ধরিয়া সেখান হইতে লইখা গেল, আমি চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলাম, কিন্তু আমার চীৎকারে কেহ ভ্রূক্ষেপও করিল না। আর ও কিছুক্ষণ এইরূপে অতিবাহিত হইল। তাহার পরে দেখিলাম, রূপসীর অচেতন দেহ সেই অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করিল। পরক্ষণেই বুড়ী আমার হাত ধরিয়া ঘর হইতে বাহিরে আনিল এবং কত পথ ঘুরাইয়া একটা বাগানের নিকট আমায় ছাড়িয়া দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।

আমিও চীৎকার করিতে লাগিলাম, কিন্তু যে স্থানে সেই বৃদ্ধ অ্যামকে ছাড়িয়া দিয়াছিল, সেখানে লোকজন নাই বলিলে ও চলে; এত চীৎকার করিলাম, এত কাঁদিলাম, কেহই আমার সাহায্যের জন্য আসিল না। এই সময় হইতে আমার আর কিছুই মনে নাই। আমি তাহার পর কি করিলাম, কেমন করিয়া এখানে ফিরিয়া আসিলাম, এখানে আসিয়াই বা কি করিলাম, কিছুই জানি না। যখন রাত্ৰি হইল, বর আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন আমার জ্ঞান হইল; তখন আমি সমস্ত কথা প্ৰকাশ করিলাম।

এই বলিয়া গৌরী স্থির হইল এবং একদৃষ্টি আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি তাহাকে কোন কথা  জিজ্ঞাসা না করিয়া শোভন সিংকে জিজ্ঞাসা করিলাম,–আপনার কন্যার গাত্রে কোন অলঙ্কার ছিল কি?

শো। আজ্ঞে হ্যাঁ, প্ৰায়; দুই সহস্র টাকার অলঙ্কার রূপসীর গাত্রে ছিল।

আ। আপনার ভাবী জামাতার মুখে শুনিলাম, আপনার আর্থিক অবস্থা বড় ভাল নহে। আপনি এত টাকার গহনা কোথায় পাইলেন?

শো। আমার ভাবী জামাতা সত্য সত্যই বলিয়াছেন। আমি অত্যন্ত দরিদ্র। কিন্তু বিবাহের দুই দিন পূর্বে আমার আত্মীয়গণ এখানে আসিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই ধন্যবানের পত্নী। তাঁহারাই জোর করিয়া তাহদের অলঙ্কারগুলি রূপসীকে পরাইয়া দিয়াছিল। আমি এখন ধনে প্ৰাণে মারা গেলাম।

আ। এ অঞ্চলে আপনার কেহ শত্ৰু আছে কি?

শোভন সিং কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন,  আমারই এক আত্মীয় আমার ঘোর শত্রু ছিলেন। তাঁহারও নিবাস এই গ্রামে ছিল। কিন্তু এক বৎসর হইল, ভজন সিং কোথায় নিরুদেশ হইয়া গিয়াছেন। শুনিয়াছিলাম, তিনি না কি সন্ন্যাসী হইয়া দেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন।।

আ। তাহা হইলে যে সন্ন্যাসী রূপসীকে খুন করিয়াছে সেই হয় তা ভজন সিং–আপনার পুর্ব শত্ৰু। এতদিন কোনরূপ সুবিধা করিতে না পারায় আপনার উপর কোনরূপ প্ৰতিহিংসা লইতে পারে নাই। আজ আপনার কন্যার গাত্রে অনেক টাকা গহনা দেখিয়া কৌশলে সেই বুড়িকে পাঠাইয়া দিয়াছিল।

শো। আপনার অনুমান সত্য হইলেও হইতে পারে।

আ। আপনার আর কোন আত্মীয় আছে?

শো। আত্মীয়ের মধ্যে ভগ্নী—গৌরি তাহারই কন্যা।

আ। গহনাগুলিও কি তাঁহারই?

শো। আজ্ঞে না—সেও আমার মত দরিদ্রা, অত টাকা গহনা সে কোথায় পাইবে?

আ। তাঁহার নিবাস কোথায়?

শো। শিয়ালদহ ষ্টেশন হইতে কিছু দূরে।

আ। সধবা না বিধবা?

শো। আজ্ঞে সধবা–এই যে আমার ভগ্নিপতি আপনার সম্মুখেই দণ্ডায়মান।

এই বলিয়া শোভন সিং একজন বলিষ্ঠ যুবককে দেখাইয়া দিলেন।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

শোভন সিংকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি গৌরীকে বলিলাম, মা, আমাকে সেই ভাঙ্গা বাড়ীতে নিয়ে যেতে পার?

কিছুক্ষণ ভাবিয়া গৌরী বলিল, না–কোন রাস্তা দিয়ে যে সেই বুড়ি আমাদের দুজনকে নিয়ে গিয়েছিল, সে কথা আমার কিছুই মনে নাই। তা ছাড়া, তখন আমরা যে যে কার্য্য করেছি, যেন অজ্ঞান হয়েই করেছি।

আ। তুমি ত বলেছিলে, গাড়ী করে গিয়েছিলে?

গৌ। আজ্ঞে হাঁ–গাড়ী ক’রেই গিয়েছিলাম।

আ। কোচমানকে চেন?

গৌ। দেখলে চিনতে পারি।

আ। গাড়ীখানা কোথাকার?

গৌরী বিরক্ত হইয়া বলিল, সে কথা আমি কি জানি?

গৌরীকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। ভাবিলাম, তাহার দ্বারা আমার কোন সাহায্য হইবে না। পদ্মপুকুর আমার জানা ছিল। সেখান হইতে কিছুদূরে আজ কাল যেখানে জণ্ড বাবুর বাজার সেখানে একটা ঠিকা গাড়ীর আস্তাবলও ছিল। সেই আস্তাবলে গিয়া সন্ধান লইবার ইচ্ছা হইল।

আমি তখন লাল সিংকে আশ্বাস দিয়া তাহার নিকট বিদায় লাইলাম এবং শোভন সিং এর বাটী হইতে বাহির হইবার উদযোগ করতেছি, এমন সময়ে শোভন সিং কাঁদিতে কাঁদিতে আমার কাছে আসিয়া বলিলেন, আমি ধনে প্ৰাণে মারা গেলাম। এই দুঃসময়ে লাল সিং আমাকে অন্যায় করিয়া যৎপরোনাস্তি অপমান করিতেছে। কিন্তু সে যাহাই হউক, আপনি আমার একটা উপকার করুন।–মে ব্যক্তি রূপসীকে খুন করিয়াছে তাহাকে ফাঁসী দিন। এখন আমার বেশ মনে পড়িতেছে যে, আমার সেই পূৰ্ব্বশত্রুই রূপসীকে খুন করিয়া তাহার গাত্রের অলঙ্কার গুলি আত্মসাৎ করিয়াছে। কিন্তু সে আপনাদিগের হস্ত হইতে পলায়ন করিতে পরিবে না, আপনাদের চক্ষে ধূলি দিতে পরিবে না। আজই হউক বা কালই হউক, সে নিশ্চয়ই ধরা পড়িবে। আপনি তাহাকে ফাঁসী দিয়া আমার অন্তরের জালা নিবারণ করুন। এই বলিয়া চিৎকার করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। অনেক সান্ত্বনার পর তিনি কিছু সুস্থ হইলে আমি সেখান হইতে বাহির হইলাম।

রাত্রি দশটা বাজিয়া গেল। যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন ভবানীপুর সহর হয় নাই। এখনকার মত এত লোকেরও বাস ছিল না। পথের দুই পার্থে তৈলের আলো মিটু মিটু করিয়া জ্বলিতেছিল, দুই একটা কুকুর পথের আবর্জনারাশির নিকট দাঁড়াইয়া আহারের দ্রব্য অন্বেষণ করিতেছিল; আর মধ্যে মধ্যে চীৎকার করিয়া পরস্পর বিবাদ করিতেছিল।

অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমি আস্তাবলে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দুই তিন ব্যক্তি তখনই আমার নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমার গাড়ীর প্রয়োজন আছে বি না?–আমারও গাড়ীর আবশ্যক ছিল, সেই মত উত্তর দিয়া একজনকে বলিলাম, তোমাদের মধ্যে কেহ কি আজ প্রাতে দুইটা বালিকা ও একজন বৃদ্ধাকে এখান হইতে কোথাও লইয়া গিয়াছিলে?

আমার প্রশ্ন শুনিয়া কিছুক্ষণ কেহ কোন কথা কহিল না; পরস্পর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কিছু পরে একজন উত্তর করিল, কই, না মহাশয়!

তাহার কথা আমার বিশ্বাস হইল না। আমি তাহার মুখ দেখিয়াই বুঝিতে পারিলাম যে, সে মিথ্যা কথা বলিয়াছে। বলিলাম,–কেন বাপু মিথ্যা কথা বলিতেছ? ভাড়া পাইয়াছ, লইয়া গিয়াছ, কোন অন্যায় কাজ কর নাই, লুকাইবার প্রয়োজন কি?

আমার কথায় আশ্বস্ত হইয়া একজন বলিয়া উঠিল,–আজ্ঞে সলামত কোচমান সে সওয়ারি নিয়ে গিয়েছিল। এখনও গাড়ী ফিরে আসে নি।

এই কথা শেষ হইতে না হইতে গাড়ীর শব্দ শোনা গেল। কিছুক্ষণ পরেই একখানা সেকেওক্লাস গাড়ী লইয়া সলামত উপস্থিত। তাহাকে দেখিয়া পূৰ্ব্বোক্ত ব্যক্তি বলিয়া উঠিল, ইহারই নাম সলামত।

আমার পোষাক দেখিয়া ও তাহার নাম শুনিয়া সলামতের ভয় হইল। সে লাগামটী গাড়ীর চালে বাঁধিয়া নামিয়া পড়িল। পরে আমার নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল,–কেন মশায়? আমাকে কি দরকার?

আমি বলিলাম,–আজি প্ৰাতে তুমি দুইটী বালিকা ও এক বৃদ্ধাকে যেখানে লইয়া গিয়াছিলে আমাকে এখনই সেখানে লইয়া চল।

সলামত প্রথমে কোন উত্তর করিল না। সে একমনে কি ভাবিতে লাগিল। আমি বললাম,–তোমার ঘোড়া যদি ক্লান্ত হইয়া থাকে আর দুইটী ঘোড়া ভাড়া কর। আমি ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া দিব।

তবুও সলামত উত্তর করিল না। সে কেবল আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–কথার উত্তর–দিতেছি না কেন? সহজে না রাজী হও অন্য উপায় দেখিব।

অনেক কষ্টে সলামত উত্তর করল,–সে জায়গাটা আমার ঠিক মনে নাই।

আমার রাগ হইল। আমি কর্কশ স্বরে বললাম,–দেখ সলামত! এই কাজ অনেকদিন থেকে করছি। তোমার মত অনেক লোক দেখেছি। তুমি একজন প্ৰবীণ লোক হ’য়ে মিথ্যা ক’রে বল, যে জায়গাটা মনে নাই? বিশেষ তুমি একজন পাকা কোচমান। একবার যে স্থান দেখবে সে আর জন্মে ভুলবে না।

আমার তোষামোদপূর্ণ কথায় সলামত ভুলিয়া গেল। বলিল, হুজুর, আমি মিছা বলি নি। যে পথ দিয়ে বুড়ী আমাকে নিয়ে গেল, সে পথ আমি আগে দেখি নি। এখনও যে আপনাকে সহজে নিয়ে যেতে পারবো এমন বোধ হয় না। চলুন, আমার ঘোড়া আজি বড় বেশী খাটে নাই, পাঁচটার সময় ঘোড়া বদল করেছি।

আমি দ্বিরুক্তি না করিয়া সলামতের গাড়ীতে উঠিলাম। বাসায় যাইবার জন্য যে গাড়ী ঠিক করিতেছিলাম, তাহার কোচমান ভাড়া না পাওয়ায় অতিরিক্ত বিরক্ত হইল, গাড়ী ঘুরাইয়া লইয়া সলামত অশ্বে কশাঘাত করিল। সেই রাত্রে বাসা ছাড়িয়া অন্যত্র যাইতে পক্ষীরাজদ্বয়ের ইচ্ছা ছিল না; তাহারা দু-একবার অনিচ্ছা প্ৰকাশ করিল। কিন্তু উপযুপরি কশাঘাতে অগত্যা দৌড়িতে বাধ্য হইল।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

নকুলেশ্বর-তলা পার হইয়া গাড়ী ক্ৰমাগত দক্ষিণমুখেই যাইতে লাগিল। পূৰ্ব্বে দুই একটা আলোক দেখিতে পাইতেছিলাম, কিন্তু ক্ৰমে আর তাহাও দেখা গেল না। পথটা অতি সঙ্কীর্ণ, দুইপাৰ্থে বাগান বা বন। বড় বড় বৃক্ষ গুলিতে খদ্যোতকুল আশ্ৰয় লইয়াছিল। দূর হইতে সেগুলিকে অতি মনোরম দেখাইতেছিল।

একে রাত্রি দশটা বাজিয়া গিয়াছিল, তাহার উপর আকাশে চন্দ্র নাই। চারদিক ভয়ানক অন্ধকারে আচ্ছন্ন। পথে জনপ্রাণীর সাড়া-শব্দ নাই, কোথাও একটীও আলোক নাই। কোচমান অতি কষ্টে গাড়ীর আলোকে শকট-চালনা করিতেছিল।

কিছুদূর এইরূপে গমন করিয়া কোচমান সহসা গাড়ী থামাইল। আমি ভাবিলাম, বুঝি সে যথাস্থানে আসিয়া পড়িয়াছে এবং সেই মনে করিয়া গাড়ী হইতে অবতরণ করিতে উদ্যত হইয়াছি, এমন সময় কোচমান বলিল, বাবু! পথ ভুলে অন্যদিকে এসে পড়েছি। সে বাগান খানি এদিকে নয়। আমরা পূৰ্ব্বদিকে যে গলিটা ছেড়ে এসেছি, বোধ হয়। সেই পথেই আমাদিগকে যেতে হবে।

একে রাত্রি অধিক, তাহার উপর সেই ঘোর অন্ধকার, তাহতে আবার আমি ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, কোচমানের কথায় আমার সৰ্ব্বাঙ্গ জলিয়া উঠিল। ক্ৰোধে কাঁপিতে কাঁপিতে আমি কর্কশাস্বরে বলিলাম, তুমি কি মনে করিয়াছ যে, আমার চক্ষে ধূলি দিয়া পলায়ন করিবে? আমি বহুদিন হইতে এই কাৰ্য্য করিতেছি। চোর, ডাকাত, দসু্যাদিগের সহিত আমার চির বিবাদ, বদ–মায়েসগণ আমার নাম শুনিলে থর থর বিকম্পিত হয়! আর তুমি একজন সামান্য কোচমান হষ্টয়া আমার সহিত চাতুরী করিতেছ? ধন্য তোমার সাহস! কিন্তু তুমি মনে করিও না যে, আমি তোমার কথায় ভুলিব না। যদি ভালো চাও, এখনই সেইস্থানে লইয়া চল।

আমাকে অত্যন্ত রাগান্বিত দেখিয়া কোচমান গাড়ি হইতে অবতরণ করিল এবং আমার পদতলে বসিয়া জোড়হাত করিয়া বলিল, হুজুর! আমার এমন সাহস নাই যে, আমি পুলিসের বাবুকে প্ৰবঞ্চনা করবো। আল্লার দোহাই, আমি সত্য সত্যই পথ ভুলে গিয়েছি। একে____ তে এই ঘোর অন্ধকার, আমি রাস্তা চিনতে পাচ্চি না। আপনি একটু এই গাড়ীতে বসুন, আমি একবার দেখে আসি।

এই বলিয়া উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই সে সেখান হইতে চলিয়া গেল। আমি সেই ভয়ানক তমসাচ্ছন্ন নিশীথে একাকী সেই অপরিচিত স্থানে বসিয়া রহিলাম। একবার মনে হইল, লোকটা যদি দলবল লইয়া হঠাৎ আমায় আক্ৰমণ করে, তাহা হইলেই আমার সর্বনাশ! এক দুই জনের বিরুদ্ধেও আত্মরক্ষা করিতে পারা যায়, কিন্তু যদি তিন চারিজন বা ততোধিক লোকে একেবারে চারিদিক হইতে আক্রমণ করে, তাহা হুইলে কি করিব? লোকটাকে ছাড়িয়া দিয়া ভাল করি নাই। সে ত স্বচ্ছন্দে গাড়ী লইয়া পথ অন্বেষণ করিতে পারিত! গাড়ীর সহিত আমাকে এখানে রাখিয়া গেল কেন? নিশ্চয়ই তাহার মনে কোন দুরক্তিসন্ধি আছে।

এই প্ৰকার চিন্তা করিয়া আমি পকেট হইতে ক্ষুদ্র পিস্তলটি বাহির করিলাম এবং গাড়ী হইতে নামিয়া নিকটস্থ একটা প্ৰকাণ্ড বৃক্ষের তলে গিয়া প্রচ্ছন্নভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম। ভাবিলাম, যদি কোচমান এক আইসে, তাহা হইলে কোন কথাই নাই। কিন্তু যদি লোক জন লইয়া আইসে, তাহা হইলে তাহার অভিপ্ৰায় নিশ্চয়ই মন্দ।

কিছুক্ষণ পরে অদূরে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলাম। আমি পিস্তলটী ঠিক করিয়া ধরিলাম। কিন্তু আমার অনুমান মিথ্যা হইল। কোচমান একাই ফিরিয়া আসিয়া একেবারে গাড়ীর নিকটে গেল এবং দরজার নিকট দাঁড়াইয়া বলিল, হুজুর! পথ ঠিক করিয়াছি। আর কোন ভয় নাই।

কোচমানের কথায় আন্তরিক প্রীত হইলাম এবং ধীরে ধীরে আসিয়া পুনরায় গাড়ীতে উঠিয়া বসিলাম। কোচমান ভাবিল, আমি বুঝি প্রস্রাব করিতে গিয়াছিলাম। সেই ভাবিয়া সে বলিল, বাবু, প্রস্রাব করতে কতদূরে গিয়েছিলেন, এই অন্ধকারে কে আপনাকে দেখতে পেত, পেলেই বা আপনার কি করতো?

আমি সে কথার কোন উত্তর করিলাম না, বলিলাম, যদি ঠিক সন্ধান পাইয়া থাক, তবে একটু শীঘ্ৰ লইয়া চল। রাত্ৰি অনেক হইয়া গিয়াছে। এমন সময় সেখানে গিয়া যে আজ কাৰ্য্য সিদ্ধ করিতে পারি, এমন ত বোধ হয় না।

কোচমান কোন উত্তর না দিয়া অশ্বে কশাঘাত করিল। অশ্বদ্বয় উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়িল। প্ৰায় আধঘণ্টা পরে একটি প্ৰকাণ্ড বাগানের ভাঙ্গা ফটকের নিকট গাড়ী থামাইয়া কোচমান বলিল, হুজুর, এই সেই বাগান। এই বাগানের ভিতর একখানা ভাঙ্গা বাড়ী আছে। বুড়ী মেয়ে দুটিকে নিয়ে সেই বাড়ীতে গিয়েছিল। তার পর কি হ’ল আমি জানি না।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, বাগানখানি কার? কো।

কো। আজ্ঞে সে কথা বলতে পারলাম না। এদিকে আমি কখনও আসি নাই।

আ। নিকটে কোন বাড়ী আছে?

কো। আজ্ঞে না। চারদিকেই বাগান।

আ। বাগান থাকিলে নিশ্চয়ই মালি আছে, তাহাঁদের বাস করিবার ঘরও আছে। সকালে কোন মালীর সহিত তোমার দেখা হইয়াছিল?

কো। অজ্ঞে না–জন প্ৰাণী না।

আ। এইখান হইতে ফাঁড়ী করদূর?

কো। প্ৰায় এক ক্ৰোশ।

আ। তোমাকে বলিষ্ট বলিয়া বোধ হইতেছে, চল দেখি, উভয়ে বাগানের ভিতর যাই। প্রয়োজন হইলে তোমাকে আমার সাহায্য করিতে হইবে। পরিবে?

কো। হুজুর–খুব পারিব। আমি একাই তিনজনকে রাখবো।

ঈষৎ হাসিয়া কোচমানকে সঙ্গে লইলাম এবং অতি সন্তর্পণে সেই অন্ধকারের ভিতর দিয়া বাগানে প্ৰবেশ করিলাম। আমার পকেটে চোরা লণ্ঠন ছিল, বাহির করিয়া জ্বলিয়া ফেলিলাম এবং সেই আলোকের সাহায্যে অতি ধীরে ধীরে একটা ভগ্ন অট্টালিকার দ্বারে উপনীত হইলাম। দেখিলাম, দরজা খোলা। কোচমানকে সঙ্গে লইয়া আনি সেই দ্বার অতিক্ৰম করিলাম এবং অতি সন্তৰ্পণে ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

বাহিরেও যেমন অন্ধকার, ভিতরেও ততোধিক, যতক্ষণ বাহিরে ছিলাম, চোরা লণ্ঠনটি হাতে ছিল, তাহারই মৃদু আলোকে কিছু? কিছু দেখিতে পাইতেছিলাম না। কিন্তু ভিতরে যাইয়া লণ্ঠনটীপকেটে রাখিলাম। ভাবিলাম, যদি কেহ দেখিতে পায়, এখনই পলায়ন করিবে, তাহা হইলে সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে কাহকেও খুঁজিয়া বাহির করা বড় সহজ হইবে না।

কিছুদূর অগ্রসর হইয়া একটা প্ৰকাণ্ড ঘরের দরজার সম্মুখে আসিলাম। বাহির হইতে দেখিলাম, ভিতরে তিনজন প্ৰশান্তমূৰ্ত্তি সন্ন্যাসী একমনে ধ্যানে নিমগ্ন। সকলেরই চক্ষু মুদিত; সকলেই নাভীর নিম্নে করন্থয় মিলিত করিয়া একাগ্ৰচিত্তে ঈশ্বরোপাসনায় নিযুক্ত। সম্মুখে প্ৰজ্বলিত অগ্নি ধুধু শব্দে জ্বলিতেছিল।

তাহাদের গভীর ও প্ৰশান্ত মূৰ্ত্তি দেখিয়া আমার ভক্তির উদ্রেক হইল। যে কাৰ্য্যে গিয়াছিলাম, সহসা তাহা করিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, এমন শান্তমূৰ্ত্তি যাহাঁদের, তাহারা নারীহত্যা করিবে কেন? কিন্তু পরিক্ষণেই দেখিলাম, তিনজনের ললাটদেশে সিন্দুরের দীর্ঘফোটা, গলে রুদ্রাক্ষ মালা, হস্তেও অনেকগুলি রুদ্রাক্ষ, পরিধানে রক্তবর্ণ পট্টবাস, গলে যজ্ঞোপবীত। বেশ দেখিয়াই বোধ হইল, তাহারা কাপালিক। শক্তি–উপাসক। শুনিয়াছি, কাপালিকগণ  সিদ্ধ হইবার জন্য নরহত্যা করিতেও পশ্চাৎপদ হয় না। এরূপ ঘটনা অনেক শোনা গিয়াছিল। কিন্তু তাহদের দ্বারা নারীহত্য এক প্রকার অসম্ভব বলিয়া বোধ হইল। যে শক্তির উপাসনার জন্য তাহারা সেই কঠোর নিয়ম প্ৰতিপালন করিতেছে, ইচ্ছা! করিয়া কেন তাহারা সেই শক্তিকে খুন করিবে, বুঝলাম না।

যাহাই হউক, দ্বার সমীপে গিয়া যখন দেখিলাম, তিনজন মাত্র সন্ন্যাসী—আর কোন লোক নাই, তখন আমার সাহস হইল। আমি বাহির হইতে জুতার শব্দ করিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, সে শব্দে তাহাদের ধ্যান ভঙ্গ হইবে। কিন্তু আমার অনুমান মিথ্যা হইল। তাহাদের কেহই চক্ষু উল্মীলন করিল না, সকলেই পূর্বের মত ধ্যানে নিমগ্ন রহিল।

আমি আর বিলম্ব করিতে পারিলাম না। কোচমানকে ৰাহিরে রাখিয়া আনি একাই ভিতরে যাইলাম এবং চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলাম। অনেক ডাকাডাকির পর সর্বাপেক্ষা কনিষ্ঠ চক্ষু চাহিল, কিন্তু সম্মুখে আমাকে দেখিয়া পুনরায় চক্ষু মুদিত করিল। আমি বিষম ফাপরে পড়িলাম। কাহারও নাম জানি না. সুতরাং কি বলিয়া ডাকিব স্থির করিতে না পারিয়া, পুনরায় চিৎকার করিতে লাগিলাম। প্ৰায় আধা ঘণ্টা পরে বয়োজ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসী চক্ষু উন্মীলন করিল, আমাকে পরিষ্কার বাঙ্গালা ভাষায় জিজ্ঞাসা করিল, কেন বাপু! এখানে এত গোলযোগ করিতেছি? গোলমালের ভয়ে আমরা লোকালয় ছাড়িয়া এই নির্জন বনের মধ্যে আশ্ৰয় লইয়াছি। আর তুমি কি না। স্বচ্ছন্দে এখানে আসিয়া আমাদের ধ্যান ভঙ্গ করিতেছ। আকৃতি দেখিয়া তোমায় জ্ঞানবান বলিয়া বোধ হইতেছে, কিন্তু এ কি কাজ তোমার!

গৌরীর মুখে যাহা শুনিয়াছিলাম, তাহাতে তাহদের উপর কিছুমাত্র ভক্তির উদ্রেক হয় নাই। বরং তাহার মুখে ঐ কথা শুনিয়া আমার ক্ৰোধ হইল। রাগ সম্বরণ করিয়া ঈষৎ কর্কশ স্বরে বলিলাম, আর তোমার সাধুগিরিতে কাজ নাই। এখন ওঠ, আমার সঙ্গে থানায় চল।

থানার নাম শুনিয়া সন্ন্যাসীর কিছুমাত্র ভয় হইল না। সে হাসিয়া উঠিল, পরে বলিল, চল, আমাদিগকে যেখানে লইয়া যাইবে সেইখানেই যাইব। কিন্তু সেখানে যেন একটু নির্জন স্থান পাই, আমরা যেন নির্বিবাদে ধ্যান করিতে পারি।

আমি হাসিয়া উঠিলাম। হাসিতে হাসিতে বলিলাম, এখন বুজরুকি রাখ ঠাকুর! সকালে যে কাণ্ড করেছ, তাহাতে শীঘ্রই চিরধ্যানে নিমগ্ন হতে হবে। আগে উঠ, পরে এই দুই জনকে নিয়ে শীঘ্র আমার সঙ্গে এস।

সন্ন্যাসী গম্ভীরভাবে বলিল, সত্যই কি আমাদিগকে তোমার সহিত যাইতে হইবে? সকালে কি কাণ্ড করেছি বাবা?

আ। এখনও বলিতেছি, বুজরুকি রাখ, সকালে কি করেছ জান না কি?

স। ধৰ্ম্মই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। আমি সেই ধৰ্ম্মের দোহাই দিয়ে বলিতেছি যে, সত্যই আমি তোমার কথা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।

আমি বিস্মত হইলাম। বলিলাম, সে কি! শোভন সিংহের কন্যাকে খুন করিয়া আবার মিথ্যা কথা বলিতেছ? তুমি কেমন সন্ন্যাসী? শক্তির উপাসক হইয়া শক্তিকে খুন?

আমার কথা শুনিয়া সন্ন্যাসী হাসিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পরে বলিল, বাবা! তোমার ভুল হইয়াছে। কোথায় আসিতে কোথায় আসিয়াছ, আমরা শোভন সিংএর কন্যাকে আজ দেখিও নাই।

আ। আজ দেখ নাই, তবে কি আর কখনও দেখিয়াছিলে?

স। সে অনেক দিনের কথা।

আ। তবে তুমি শোভন সিংকে চেন?

স। বেশ চিনি, আমারই এক আত্মীয়ের নাম শোভন সিং। রূপসী নামে তার এক কন্যা ছিল। কিন্তু জানি না, সে এখন ও জীবিত কাছে কি না?

আ। তোমার আত্মীয়ের নিবাস কোথায়?

স। নিকটেই–এই ভবানীপুরেই তাহার বাড়ী।

আ। আর তোমার?

স। তাহারই বাড়ীর নিকটে ছিল; কিন্তু এখন আর নাই। এখন _____ সেই আমার বাড়ী।

আ। কত দিন হইল তুমি এই বেশ ধরিয়াছ?

স। প্ৰায় দুই বৎসর হইল।

আ। সংসার ত্যাগ করিলে কেন?

স। সে অনেক কথা।

আ। শোভন সিং কি তোমার শত্রু।

স। না–এ জগতে আমার শত্রু ও কেহ নাই, মিত্ৰও কেহ নাই।

সন্ন্যাসীর কথা শুনিয়া আমার সন্দেহ বৃদ্ধি হইল। ভাবিলাম, সে নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলিতেছে। পাছে শোভন সিংকে শক্ৰ বলিয়া প্ৰকাশ করিলে আমার মনে সন্দেহ হয়, এই মনে করিয়া সে বোধ হয় কথাটা লুকাইল। এইরূপ চিন্তা করিয়া বলিলাম, আজি প্ৰাতে কি কোন বৃদ্ধা তোমার নিকট দুইজন বালিকা আনিয়া ছিল?

স। কেমন করিয়া জানিব? সমস্ত দিনের পর এই আমি চক্ষু চাহিতেছি।

দআ। বৃদ্ধ যে দুইটী বালিকাকে এখানে আনিয়াছিল তাহার সাক্ষী আছে। যে গাড়ীতে করিয়া তাহারা তোমার নিকট আসিয়া ছিল, সেই গাড়ীর কোচমান আমার সঙ্গেই আছে।

স। হইতে পারে—আপনার কথা যথার্থ হইতে পারে। কিন্তু আমি আজ সমস্ত দিনই ধ্যানে নিমগ্ন।

কথায় কথায় রাত্রি অনেক হইয়া গেল দেখিয়া, আমি তাহাকে বলিলাম, বিচার পরে হইলে, এখন তোমরা তিনজন আমাদের সঙ্গে আইস।

দ্বিরুক্তি না করিয়া সেই সন্ন্যাসী অপর দুইজনের ধ্যান ভঙ্গ করিল। তখন তিনজনে মিলিয়া আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাহির হইল এবং বাগান পার হইয়া সেই ভাঙ্গা ফটকের নিকট উপস্থিত হইল। ফটকের সম্মুখেই গাড়ী ছিল। আমি সন্ন্যাসী তিনজনকে তাহাতে উঠিতে বলিলাম। সকলে গাড়ীতে উঠিলে, কোচমান শকট চালনা করিল।

বাসায় ফিরিতে রাত্রি একটা বাজিয়া গেল। তখন সন্ন্যাসী তিনজনকে আটক করিতে বলিয়া আমি বিশ্ৰাম লাভ করিলাম।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পরদিন প্ৰাতঃকালে সমস্ত কাৰ্য্য ত্যাগ করিয়া অগ্ৰে সেই সন্ন্যাসীত্রিয়কে দেখিতে গেলাম। যে ঘরে তাহাদিগকে আবদ্ধ করিয়া রাখিতে বলিয়ছিলাম, তাহার দ্বারে দুইজন প্রহরী ছিল। সন্ন্যাসীদিগের কাৰ্য্য লক্ষ্য করিতে এবং তাহদের কথোপকথন শুনিবার জন্য আমি তাহাদিগকে পূর্ব রাত্রে নিযুক্ত করিয়াছিলাম। প্রহরীদ্বয়ের মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে তাহাদিগের উপর কোনরূপ সন্দেহ করা যায় না। তাহারা বলিল, সন্ন্যাসীগণ কোন কথা কহে নাই, যেখানে বসিতে বলা হইয়াছিল সমস্ত রাত্রি সেই–স্থানে চক্ষু মুদিত করিয়া বসিয়াছিল। ঘরে এক সামান্য আলোক দেয়া হইয়াছিল কিন্তু একমুহূর্ত্তের জন্যেও চক্ষু উন্মীলন করে নাই, কথা কহা দূরে থাক, কেহ একটী শব্দও করে নাই। অথচ গৌরীর মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে ত তাহাদিগের উপরই ভয়ানক সন্দেহ হয়। এ কি রহস্য!

একজন সন্ন্যাসীর মুখে শুনিলাম, শোভন সিং তাহার পরিচিত। শোভন সিং বলিয়াছিলেন, ঐ সন্ন্যাসী তাহার পরম শক্রি। এত দিন সুবিধা পায় নাই বলিয়া কোন অপকার করিতে পারে নাই। সন্ন্যাসী। কিন্তু সে কথা স্বীকার করিল না। তবে কি সন্ন্যাসীত্রয় নির্দোষী? আমি কি অন্যায় সন্দেহ করিয়া তাহাদিগকে অবরুদ্ধ করিয়াছি। যদি তাঁহাই হয়, তাহা হইলে আমার যথেষ্ট পাপ সঞ্চয় হইল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু গৌরীর কথাই বা কেমন করিয়া মিথ্যা বলি। গৌরীর বয়স চৌদ্দ–পনের বৎসরের অধিক হইবে না। এ বয়সে সে যদি এত মিথ্যা কথা সাজাইয়া বলিতে পারে, তাহা হইলে বড় হইলে সে কি করিবে বলা যায় না। এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি সন্ন্যাসীদিগের নিকট গমন করিলাম। দেখিলাম, তখনও তাঁহাদের চক্ষু মুদিত। একবার তাহাদের জিনিষপত্রগুলি দেখিবার ইচ্ছা হইল। কিন্তু সন্ন্যাসীদিগের আবার কি জিনিষ থাকিবে? যাহারা সংসার ত্যাগ করিয়াছে, যাহারা মন হইতে বাসনা দূর করিয়াছে, তাহারা আবার সঞ্চয় করিবে কি? তবে যদি ভণ্ড হয়, তাহা হইলে কিছু পাইলেও পাইতে পারি। এই ভাবিয়া আমি তাহদের পরিচ্ছদ, কমণ্ডলু প্রভৃতি দ্রব্য গুলি অন্বেষণ করিতে আদেশ করিলাম।

যে দুইজন কনষ্টেবল প্রহরী ছিল, তাহারা তখনই আমার আদেশ পালন করিল, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সফল হইল না। ভাবিয়াছিলাম, যদি দুই একখানা গহনা বাহির করিতে পারি, তাহা হইলে তাহারা নিশ্চয়ই রূপসীকে খুন করিয়াছে। কিন্তু সেরূপ কোন? নিদর্শন পাওয়া গেল না।

এইরূপ গোলযোগে সন্ন্যাসীগণের ধ্যান ভঙ্গ হইল। আমি তখন অপর সকলকে সেখান হইতে দূর করিয়া। গত রাত্রে যাহার সাহিত কথা কহিয়াছিলাম, তাহাকে বললাম, শোভন সিং তোমার নামে যে দোষারোপ করিয়াছেন, তাহাতে তোমাকে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। যদি নিজের মঙ্গল চাও, তাহা হইলে যাহা জানি সত্য করিয়া প্ৰকাশ কর। শোভন সিং বলেন যে, তুমি তাহার পরম শত্রু এবং আর কোন উপায়ে প্ৰতিশোধ লইতে না পারিয়া অবশেষে তাহার এক কাত্ৰ কন্যাকে হত্যা করতঃ তাহার গাত্রের প্ৰায় দুই সহস্র টাকার অলঙ্কার অপহরণ করিয়াছ। শোভন সিংএর মুখে শুনিয়াছিলাম, সেই সন্ন্যাসীর নাম ভজন সিং। সত্য মিথ্যা জানিবার জন্য আমি সন্ন্যাসীকে নাম জিজ্ঞাসা করিলাম। সন্ন্যাসী উত্তর করিল, সত্যই তার নার নাম ভজন সিং।

আমার কথা শুনিয়া ভজন সিং হাসিয়া উঠিল। বলিল, আমি তাহার শত্রু? না মহাশয়, সংসার-বিরাগী সন্ন্যাসী কাহারও শত্রুতাচরণ করে না। এ জগতে আমারও শত্রু কেহ নাই, আমিও কাহার শত্রু নয়। যেরূপ করিলে আপনার বিশ্বাস হয়, আপনি স্বচ্ছন্দে তাঁহাই করুন, আমার তাহাতে কোন প্ৰকার ক্ষতি বৃদ্ধি হইবে না। জীবন ক্ষণস্থায়ী, আজ হউক বা দুদিন পরেই হউক, কোন না কোন দিন আমাকে মরিতেই হইবে।

আ। আমি শুনিয়াছি, তুমি অতি অল্পদিনেই বিবাগী হইয়াছ, এখনকার কথা বলিতেছি না, পূর্বে যখন তুমি সংসারাশ্রমে ছিলে, তখনকার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি। শোভন সিংএর সহিত  তোমার কিরূপ সম্পর্ক আছে? কেনই বা তুমি সংসার ছাড়িয়া সন্ন্যাসী হইলে?

স। সমস্তই বলিতেছি—যদি একান্তই শুনিতে চান, শুনুন। পূৰ্বেই বলিয়াছি, আমার নাম ভজন সিং, আমি পিতার একমাত্র পুত্র। অল্প বয়সেই মাতৃহীন হওয়ায় আমি পিতার বড় আদরের সামগ্ৰী ছিলাম। আমার এক জ্ঞাতি ভগ্নী ছিল, পিতৃমাতৃহীন হওয়ায় সে আমাদের বাড়ীতেই প্ৰতিপালিতা। তাহার সহিত শোভন সিংহের বিবাহ হয়। শোভন সিং সম্পর্কে ভগ্নীপতি। ভগ্নীপতি হইলেও শোভন সিং আমাকে দেখিতে পারিত না। আমিও তাতার সহিত মিশিতাম না। ক্ৰমে এই মনোবিধাদের বুদ্ধি হইতে লাগিল, আমি তাহার ছায়াও স্পর্শ করিতাম না। শোভন সিং কিন্তু আমার অপকারের চেষ্টা করিতে লাগিল। সুবিধা পাইলেই আমার অনিষ্ট করিতে লাগিল। এই সময়ে হঠাৎ হৃদরোগে আমার পিতার মৃত্যু হয়। যখন আমি তাহার সমম্ভ সম্পত্তির অধিকারী হইলাম, তখন হইতে শোভন সিংহের মতিগতি ফিরিতে লাগিল। উপযাচক হইয়া আমার সহিত দেখা করিল, কত মিষ্ট কথায় আমাকে সান্ত্বনা করিল, আপনার অসদাচরণের জন্যবারম্বার ক্ষমা প্রার্থনা করিল। শোভন সিংহের তৎকালীন অবস্থা ও কথাবাৰ্ত্তা শুনিয়া আমার মনে কেমন বিশ্বাস হইল। আমি তাহার বশীভূত হইলাম। ক্রমে ঘনিষ্টতা হইল। উভয়ে মিলিয়া জুয়ার দলে মিশিলাম। তাহার পর যাহা ঘটিল তাহা আর বলিবার নয়। অল্প দিনের মধ্যে আমি নিঃসম্বল হইয়া পড়িলাম। পিতার বহু কষ্টে সঞ্চিত প্ৰায় লক্ষাধিক টাকা জুয়া খেলিয়া জলে ফেলিয়া দিলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহার অধিকাংশই শোভন সিংএর উদর পূর্ণ করিয়াছিল। আমাকে নিঃস্ব করিয়াও শোভন সিংএর তৃপ্তি হইল না, সে আমাকে চোর বলিয়া ধরাইয়া দিল। সৌভাগ্যক্রমে দুইজন, ভদ্রলোক সাক্ষী ছিলেন বলিয়াই সে যাত্ৰা অব্যাহিত পাই। এইরূপে নানা কারণে মনে কেমন বৈরাগ্য উপস্থিত হইল, আমি সংসার ছাড়িয়া গুরুর নিকট যাইলাম। সেখানে দীক্ষা লইয়া সেই নির্জন বনে সাধনা করিতে থাকি। কিছুদিন হইল, এই দুইজনের ইচ্ছায় আমাকে এখানে আসিতে হইয়াছে। কিন্তু এখানেও নিস্তার নাই—শোভন সিং আমাকে প্ৰাণে মারিবার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু তাহাতে সন্ন্যাসীর কি করিবে?

এই বলিয়া সন্ন্যাসী স্থির হইল। সে যে ভাবে কথা গুলি বলিল, তাহাতে তাহার কথা অবিশ্বাস করিতে পারিলাম না। তাহার কথাবার্ত্তায় তাহাকে বিদ্বান ও মহাশয় ব্যক্তি বলিয়া বোধ হইল এবং এতক্ষণ যে তাহার প্রতি উপযুক্ত সন্মান প্ৰদৰ্শন করা হয় নাই, তজ্জন্য অনুতপ্ত হইলাম। আমি তখন অতি বিনীতভাবে বলিলাম—শোভন সিং আপনাকেই তাঁহার কন্যার হত্যাকারী বলিয়া সন্দেহ করিয়াছে এবং তাঁহারই কথামত আমি আপনাদিগকে গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইয়াছি। এখন আপনার মুখে যে সকল কথা শুনিলাম, তাহাতে আমার অবিশ্বাস নাই। কিন্তু তাহা হইলেও আমি এখন আপনাকে মুক্তি দিতে পারিব না। যতদিন না। আপনার বিচার হয়, ততদিন এরূপে থাকিতে হইবে। শোভন সিংয়ের ভাগীনেয়ী আপনাকে দেখিয়াছিল। আমি এখনই তাহাকে এখানে ডাকিয়া আনাইতেছি। যদি সে সনাক্ত করে, তাহা হইলে বিচারে কি হয় বলা যায় না।

সন্যাসী ভজন সিং ঈষৎ হাসিয়া বলিল—মৃত্যুর জন্য ভয় করি না–যদি অদৃষ্ট থাকে তবে আমার এই অপঘাত মৃত্যুও কেহ রোধ করিতে পরিবে না। কিন্তু দেখিতেছি, আপনি ব্ৰাহ্মণ সন্তান। দেখিবেন, যেন ভ্ৰমক্রমে একজন নিরীহ ব্ৰাহ্মণের মৃত্যুর উপলক্ষ না হন।

আমি সাগ্রহে উত্তর করিলাম,–আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব। যাহাতে প্ৰকৃত দোষীকে গ্রেপ্তার করিয়া আপনাকে মুক্ত করিতে পারি, তজ্জন্য প্ৰাণপণে চেষ্টা করিব। তবে ভবিতব্যের কথা বলিতে পারি, এমন ক্ষমতা আমার নাই।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

সন্ন্যাসী ভজন সিংএর নিকট বিদায় লইয়া আমি তখনই একজন লোককে শোভন সিংএর বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলাম, দুইজন উপযুক্ত লোককে সন্ন্যাসীদিগের আড্ডায় গিয়া সেই ঘরটি বিশেষ করিয়া অন্বেষণ করিতে আদেশ করিলাম এবং অপর একজনকে লাল সিংএর নিকট প্রেরণ করিলাম।

সন্ন্যাসী গ্ৰেপ্তার হইয়াছে শুনিয়া, শোভন সিং ভাগিনেয়ীকে লইয়া কিছুক্ষণ পরেই আমার নিকটে আসিলেন। আমি গৌরীকে সেই সন্ন্যাসিদিগের নিকট লইয়া গেলাম। গৌরী তাহাদিগকে দেখিয়াই চীৎকার করিয়া সেখান হইতে পলায়ন করতঃ শোভন সিংএর পশ্চাতে গমন করিল। তাঁহার ভাব-গতিক দেখিয়া অমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, সে ঐ সন্ন্যাসী তিনজনকেই দেখিয়াছিল।

শোভন সিং আমার নিকট যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিলেন। এক রাত্রের মধ্যে হত্যাকারীকে গ্ৰেপ্তার করিয়াছি বলিয়া আমার যথেষ্ট সুখ্যাতি করিলেন। কিন্তু আমার সে সকল বড় ভাল বোধ হইল না। আমিও মিষ্ট কথায় তাহাকে বিদায় দিয়া বলিলাম, প্ৰয়োজন হইলে সংবাদ দিব।

শোভন সিং চলিয়া গেলেন। প্ৰায় একঘণ্টা পরে যে দুইজন লোককে সন্ন্যাসীর সেই বাসস্থানে অন্বেষণ করিতে পাঠাইয়াছিলাম, তাহারাও ফিরিয়া আসিল এবং একছড়া স্বৰ্ণ-হার আমার হস্তে দিয়া বলিল যে, তাহারা সেই ঘরাটী তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিয়াছে কিন্তু ঐ একছড়া হার ভিন্ন আর কোন গহনা দেখিতে পায় নাই।

হারছড়া পরে একমনে ঐ সকল বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, সন্ন্যাসীর কথা কোনরূপেই অবিশ্বাস করা যায় না। তিনি শোভন সিং সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহাও সত্য বলিয়া বোধ হইল। লোকটা তাহাকে উৎপীড়ন করিতে প্ৰাণপণে চেষ্টা করিয়াছে এবং এখনও যে করিবে, তাহাতে আর আশ্চৰ্য্য কি? কিন্তু এই হারছড়া কোথা হইতে আসিল? গত রাত্রে আমি স্বয়ং অন্বেষণ করিয়াছিলাম। কিন্তু কই, তখন ত কিছুই দেখিতে পাই নাই। অতি সামান্য সময়ের মধ্যেই যখন হারছড়া খুঁজিয়া পাইয়াছে, তখন ইহা বিশেষ লুকান ছিল এমন বোধ হয় না। একি রহস্য? তবে কি সত্যসত্যই সন্ন্যাসী হইয়া বালিকা হত্যা করিল?

কিছুক্ষণ এইরূপ চিন্তা করিয়া স্থির করিলাম, সন্ন্যাসী নিশ্চয়ই সত্য বলিয়াছেন। শোভন সিং লাল সিংএর সহিত যেমন ব্যবহার করিয়াছে, তাহাতে তাহাকেই শঠ ও প্রতারক বলিয়া বোধ হইতেছে। এরূপ অনেক দেখা গিয়াছে যে, প্ৰকৃত দোষী অপরের স্কন্ধে দোষারোপ করিবার জন্য অনেক প্রকার উপায় অবলম্বন করিয়াছে। শোভন সিং যেরূপ প্রকৃতির লোক, তাহাতে তাহার পক্ষে উহা নিতান্ত অসম্ভব নহে।

এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে লাল সিং সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমি তাহাকে সমস্ত কথা প্ৰকাশ করিলাম। তিনি শুনিয়া অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। বলিলেন,–আপনি যাহা অনুমান করিয়াছেন, তাহাই সম্পূর্ণ সত্য। শোভন সিং অত্যন্ত চতুর—তিনি না পারেন এমন কাজ অতি অল্প। সেই গত রাত্রে আপনার ফিরিয়া আসিবার পর কোনরূপে ঐ হারছাড়াটী সেখানে রাখিয়া আসিয়াছে। যদি তাহা না হইবে, তাহা হইলে আপনি কালই রাত্রে ঐ হার পাইতেন।

আ। যদিও আমি ভালরূপ অন্বেষণ করিবার অবকাশ পাই নাই, তত্রাপি যখন দুই ব্যক্তি এত অল্প সময়ের মধ্যে এই হার বাহির করিতে পারিল, তখন আমি যে একেবারেই উহা দেখিতে পাইলাম না, ইহাও বিশ্বাসযোগ্য নহে। হারছড়া নিশ্চয়ই তখন সেখানে ছিল না, পরে রক্ষিত হইয়াছিল।

লা। ঠিক বলিয়াছেন–আমার বিশ্বাস রূপসী এখনও জীবিত আছে। কেবল আমাকে ফাঁকি দিবার জন্যই ঐ মিথ্যা কথা রাষ্ট্র করিয়াছে। বিবাহ না দিলে পাছে আমার টাকা ফেরৎ দিতে হয়, এই ভয়ে আপনার কন্যার মৃত্যু সংবাদ রাষ্ট্র করিয়াছে।

আ। আমারও সেইরূপ মনে হয়। কিন্তু যে বৃদ্ধ গৌরী ও রূপসীকে ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছিল, সে কে? তাহাকে ধরিতে না পারিলে এ রহস্য ভেদ করা অতীব দুরূহ হইবে। আপনি সে বুড়ীকে চেনেন? কোন প্রকার অনুমান করিতে পারেন?

লাল সিং কিছুকাল কোন উত্তর করিলেন না; একমনে কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। পরে ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন,–রূপবতী পত্নী সত্ত্বেও, শুনিয়াছি, শোভন সিং অপর এক বেশ্যার প্রেমে মুগ্ধ হইয়াছিল। সে তাহারই সমবয়স্ক, দেখিতে নিতান্ত মন্দ নহে, কিন্তু তাঁহার স্ত্রীর সহিত কোন বিষয়েই তাহার তুলনা হয় না। এ ছাড়া, আমি আর কোন রমণীর সহিত শোভন সিংএর ঘনিষ্টতা আছে কি না জানি না। একে বেশ্য, তাহাতে বয়স হইয়াছে, তাহার উপর তাহার অবস্থাও এখন হীন হইয়া পড়িয়াছে। সুতরাং তাহাকে যে বুড়ীর মত দেখাইবে, আশ্চর্য্য কি? কিম্বা সে হয় ত বৃদ্ধার ছদ্মবেশ করিয়া থাকিবে। কেন না, গোপনে বালিকা ভুলাইয়া লইয়া যাওয়া বড় সহজ ব্যাপার নহে। যে সে লোকের উপর এমন কাজের ভার দেওয়া যায় না। আমার বোধ হয়, সেই মাগীরই এই কাজ।

অ্যা। আপনি তাহার বাড়ী জানেন?

লা। চেষ্টা করিয়া বাহির করিব। শুনিয়াছিলাম, মেছুয়া বাজারে তাহার বাসা। তাহার নাম কামিনী।

আমি সন্তুষ্ট হইলাম। তাঁহাকে কামিনীর সন্ধান করিতে বলিলাম। লাল সিং তখনই বিদায় লইলেন।

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

বেলা প্ৰায় চারিটার সময় লাল সিং পুনরায় আমার নিকট আগমন করিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়াই আমি বুঝতে পারিলাম যে, তিনি কাৰ্য্যে সফল হইয়াছেন।

লাল সিং আমার নিকটে বসিয়া বলিলেন, তিনি কামিনীর সন্ধান পাইয়াছেন। বয়স অধিক না হইলেও বাতে তাহাকে বৃদ্ধা করিয়াছে। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি কামিনীর পরিচিত কি না? লাল সিং বলিলেন, বহুদিন পূর্বে একবার মাত্র তিনি কামিনীর বাড়ীতে গিয়াছিলেন। সেই অবধি আর তাহাদের সাক্ষাৎ হয় নাই।

লাল সিংএর কথা শুনিয়া আমি তখনই ছদ্মবেশ পরিধান করিলাম এবং তাঁহাকে লইয়া একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ীতে আহোরণ করিয়া, কামিনীর বাসা হইতে কিছুদূরে আমরা গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম এবং ধীরে ধীরে সেইদিকে যাইতে লাগিলাম।

যখন বাড়ীর নিকট উপস্থিত হইলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা। সেদিন শনিবার। আমি বেশ বাবু সাজিয়া গিয়াছিলাম। একে শনিবার সন্ধ্যাকাল, তাহার উপর আমি একজন নব্য বাবু, তাহাতে আবার আমি অতি ধীরে ধীরে একটী বাড়ীর বারান্দার দিকে দেখিতে দেখিতে যাইতেছি। এতগুলি কারণ যখন একত্রিত হইল, তখন কাৰ্য্য না হইয়া আর যায় কোথায়? একজন আধা বাবুগোচ লোক তখনই আমাদের নিকট আগমন করিয়া বলিল,–বাবু! ঐ বাড়ীতে যাবেন? আমি নিয়ে যাচ্ছি, আসুন, আমার সঙ্গে আসুন।

আন্তরিক সন্তুষ্ট হইয়া আমি হাসিয়া বলিলাম,–ও বাড়ীতে মানুষের মত কে আছে? ঐ ত সব বসে আছে?

আগন্তক ঠকিবার পাত্র নয়। সেও হাসিয়া বলিল,–আপনি রসিক বটে। কিন্তু এই সাঁঝের আঁধারে এতদূর থেকে কি ভাল দেখা যায়? বাড়ীর ভিতর চলুন।

আমি বুঝিলাম, আগন্তুক দালাল। কিছু পাইবার প্রত্যাশায় আমাকে লইয়া যাইতে চায়। বাড়ীর ভিতর যাওয়া যুক্তিসিদ্ধ নহে মনে করিয়া আমি বাহিরেই কামিনী সহ দেখা করিতে ইচ্ছা করিলাম। লোকটাকে বলিলাম,–বাপু, তুমি আমাকে যা মনে ক’রেছ, আমি তা নয়। তবে যখন আমার কাছে এসেছ, তখন যদি আমার একটা কাজ করা, আমি তোমায় সন্তুষ্ট করিব।

শশব্যস্তে সে বলিয়া উঠিল,–কি কাজ বলুন?

আমি বলিলাম, ঐ বাড়ীতে কামিনী নামে একটা মেয়েমানুষ আছে জান?

সে যেন মুখ বিকৃত করিল। কিন্তু তখনই আত্মসংবরণ করিয়া বলিল, আজ্ঞে হাঁ, জানি বই কি। আগে ছিল ভাল—এখন বাতে পক্ষু।

আমি বলিলাম, কামিনীকে কোনরূপে আমার কাছে আনিতে পার? আমি বাড়ীর ভিতর গিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিতে পারিব না।

লোকটা কিছু কালা, আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পরে বলিল, কি বলিয়া ডাকিয়া আনিব? আপনাকে সে কি চেনে?

আ। আমাকে সে চেনে না, কোন রকম কৌশল করিয়া তাহাকে আনিতে হইবে।

লো। কোথা দেখা করিবেন? এই রাস্তায়?

আ। না, তাহারও উপায় তোমায় করিতে হইবে।

লো। কি উপায় করি?

আ। তোমাদের কোন ঘর এখানে নাই?

লো। আছে, কিন্তু সেখানে নিয়ে গেলে সকলকে অংশ দিতে হইবে। আমরা চারিজনে ঘরটী ভাড়া লইয়াছি।

আ। ভাল, আমি তাহাদিগকেও স্বতন্ত্র দিব, তুমি কামিনীকে সেইখানে লইয়া যাইও। আপাততঃ সেই ঘরটা আমাদিগকে দেখাইয়া দাও।

তাহাদের আড্ডা নিকটেই ছিল। লাল সিংকে লইয়া আমি সেই ঘরের ভিতর বসিলাম। যাহার সহিত আমার দেখা হইয়াছিল, তাঁহাকেই কৰ্ত্তা বলিয়া বোধ হইল। সে সকলকে চুপি চুপি আমাদের সেখানে যাইবার কারণ বুঝাইয়া দিল–পুরষ্কারের কথাও ভুলিল না। লাভের আশা পাইয়া সকলেই আনন্দিত হইল এবং আমাদিগকে যথেষ্ট সম্মান প্ৰদৰ্শন করিতে লাগিল।

অৰ্দ্ধ ঘণ্টা মধ্যেই কামিনীকে লইয়া পূৰ্ব্বোক্ত ব্যক্তি ফিরিয়া আসিল। তখন অপরাপর লোক সকল এক একটী অছিল করিয়া সেখান হইতে বিদায় লইল। অবশেষে যে কামিনীকে আনিয়াছিল, সেও তামাক আনিবার নাম করিয়া সরিয়া পড়িল।

আমি দেখিলাম, কামিনীর বয়স প্ৰায় চল্লিস বৎসর হইলে ও তাহাকে বৃদ্ধ বলা যায়। যে কারণেই হউক, সে সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারে না। কোমর বঁকিয়া শরীরের উপরদ্ধি নত কারিয়াছে। তাহার মাথার চুল অধিকাংশ কটা। শরীরের মাংস শিথিল হইয়া পড়িয়াছে, চক্ষু কোটরে প্রবেশ করিয়াছে।

অনেক কষ্টে আমার দিকে মুখ তুলিয়া কামিনী জিজ্ঞাসা করিল, কি বাবা, তুমিই ডেকে পাঠিয়েছিলে?

আমি বলিলাম, ছেলে মেয়ে ধরা ব্যবসা কবে থেকে আরম্ভ করেছ?

কামিনী চমকিয়া উঠিল। অনেক কষ্টে আত্ম সম্বরণ করিয়া চীৎকার করতঃ বলিল, কি বলছে বাবা! আমি কানে একটু কম শুনি বাবা!

আমি চীৎকার করিয়া পূনর্ব্বার ঐ কথা বলিলাম। এবার সে তখনই কাঁদকাঁদ সুরে উত্তর করিল, কোন ভালখাকি আমার নামে লাগিয়েছে? তার সর্বনাশ হ’ক।

অনেক কষ্টে হাস্য সম্বরণ করিয়া আমি বলিলাম আমি স্বচক্ষে দেখেছি! কেহই আমাকে তোমার নামে কোন কথা বলে নাই। কেন বৃথা গালাগালি দিতেছ বাছা!

কামিনী আমার কথায় যেন সিহরিয়া উঠিল। কিন্তু সেবারও আত্ম সম্বরণ করিয়া হাসিতে হাসিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিল, ও সকল কথা নিয়া কি তামাসা ভাল দেখায়? তুমি না হয় ভাল মানুষের ছেলে, কোন কথা বলিবে না, কিন্তু কথায় কথায় পাঁচ কাণ হইলে ত সৰ্ব্বনাশ! কার মনে কি আছে কেমন করিয়া জানিব। ও সকল কথা ছেড়ে দাও—এখন যে জন্য ডেকেছ বল?

আমি কমিনীকে নিকটে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিলাম, আমাকে বড় সহজ লোক মনে করো না। আমাকে এখনো কি চিনতে পার নাই? যদি বাঁচবার ইচ্ছা থাকে, সকল কথা প্ৰকাশ কর। তা না হলে তোমাকে জেলে দিব। মেয়েমানুষ বলে ছেড়ে দিব না।

কামিনীর মুখ শুকাইয়া গেল। ভয়ে তাহার সর্বশরীর কাঁপিতে লাগিল, কিছুক্ষণ তাহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল। সে আর দাঁড়াইতে না পারিয়া আমার পদতলে বসিয়া পড়িল।

আমি তখন বলিলাম, যখন কাজটা করেছিলে, তখন কি এ সকল কথা ভেবেছিলে? জান না কি, ইংরেজ রাজত্বে দোষ করিলে শাস্তি পাইতেই হইবে, কিছুতেই নিষ্কৃতি পাইবে না।

আমার কথায় কামিনী কাঁদিয়া উঠিল। পরে হাত জোড় করিয়া বলিল, দোহাই বাবা! আমার বেশী দোষ নয় বাবা। পেটের দায়ে একটা হতভাগা সন্ন্যাসীর কথায় আমি মেয়ে দুটীকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছিলুম। কে জানে এমন হবে?

আমি ধমক দিয়া বলিলাম, এখন কান্না রাখ, আমি যাহা বলি, তাহার উত্তর দাও। দুটী বালিকাকে নিয়ে গিয়েছিলে বটে, কিন্তু একটী ত ফিরে এসেছে। অপরটা কি হ’লো?

কা। কেমন করে বলি? আমি মেয়ে দুটীকে তার কাছে দিয়ে চলে এসেছিলেম।

আ। কত টাকা পেয়েছিলে?

কা। দশ টাকা।

আ। কে দিল?

কা। সন্ন্যাসী।

আ। তাহাকে চিনতে পারবে?

কা। দেখলেই চিনতে পারবো।

আ। সকল কথা গোড়া থেকে খুলে বল। কিন্তু সাবধান, মিথা বলিও না। যদি জানিতে পারি যে, মিছা বলছে, তাহলেই তোমায় জেল দিব।

কা। না বাবা, আমি মিছা বলবো না। সন্ন্যাসীর কথায় রাজী হয়ে আমি মেয়ে দুটিকে ধরিবার চেষ্টা করি। দুই দিন তাদের বাড়ীর কাছে কাছে ঘুরেও ধরতে পারি নাই। শেষে একদিন ভোরে দুজনে মিলে বাড়ী থেকে বাহির হয়। আমি পাছু নিই। যখন তাহারা পদ্মপুকুরের ধারে গেল, তখন আমি কৌশলে আরক মিশান দুটী জবাফুল তাদের নাকের কাছে ধরি। ফুলের গন্ধে তারা এক রকম পাগল হয়ে যায়। আমি যা বলি, তারাও তাই করে। এই সুবিধা পেয়ে দ্বিরুক্তি না করে, আমি তাহাদিগকে এক গাড়ীতে করে সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে যাই। তার পর সন্ন্যাসীর নিকট থেকে টাকা নিয়ে ঘরে ফিরে আসি। মেয়ে দুটীর কি হলো জানি না।

আ। দুটি মেয়েকেই কি ধরিবার কথা ছিল?

কা। না—কেবল একজনকে। কিন্তু যখন দুজনে এক সঙ্গে ছিল, তখন দুজনকেই ধরে নিয়ে গেলাম।

আ। মেয়ে দুটী সন্ন্যাসীর কি দরকারে লেগেছিল?

কা। জানি না। তবে শুনেছি, সেই সন্ন্যাসী না কি কাপালিক, অনেক নরহত্যা করেছে।

আ। জেনে শুনে তুমি মেয়ে দুটিকে স্বচ্ছন্দে তার হাতে দিলে?

কা। নিজের পেট কাঁদলে জ্ঞান থাকে না।

আ। আচ্ছা—শোভন সিংকে চেন?

কামিনী চমকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে শোভন সিং? আমি তাকে চিনি না।

আমি লালসিংএর দিকে চাহিলাম। তিনি আমার অভিপ্ৰায় বুঝিয়া কামিনীর দিকে চাহিয়া বলিলেন, দেখ, কামিনী, ইনি তোমার পূর্ব কথা সমস্তই জানেন। তুমি যে এক সময়ে শোভন সিংএর রক্ষিতা ছিলে, ইনি তাহাও শুনিয়াছেন। এখনঈ মিথ্যা বলিতেছ?

কামিনী আমার মুখের দিকে চাহিয়া কি বলিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। আমারও তাহা শুনিবার ইচ্ছা ছিল না। আমি বলিলাম, কামিনীকে এখনই আমার সহিত থানায় যাইতে হইবে।

আমার কথায় কামিনীর ভয় হইল। সে রোদন করিতে লাগিল। আমি মিষ্ট কথায় কামিনীকে সান্ত্বনা করিয়া বলিলাম, তোমার কোন ভয় নাই। যদি দোষ না থাকে, এখনই মুক্তি পাইবে।

কামিনী আমার শ্লেষ বাক্য বুঝিতে পারিল না। আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া লালসিং কর্তৃক আনীত একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ীতে আমরা সকলেই আরোহণ করিলাম। আড্ডার সকল লোককে পুরষ্কার দিয়া সন্তুষ্ট করত কোচমানকে আমাদের থানায় যাইতে আদেশ করিলাম।

থানায় আসিয়া কামিনী ভজনসিংকে সনাক্ত করিল। সে বলিল, তাঁহারই পরামর্শ মত সে দুই জন বালিকাকে ভুলাইয়া তাঁহার নিকট লইয়া যায়; এবং এই কার্য্যের জন্য সন্ন্যাসী তাহাকে দশটী টাকা দিয়াছেন।

সৌভাগ্যক্রমে সন্ন্যাসীত্রয় তখন ধ্যানে নিমগ্ন—কেহই কামিনীর কথা শুনিতে বা বুঝিতে পারিলেন না।

বালিকাদ্বয়কে ভুলাইয়া লইয়া যাইবার জন্য কামিনীকে গ্রেপ্তার করা হইল। যতদিন না বিচার শেষ হয়, ততদিন তাহাকে হাজতে রাখিবার ব্যবস্থা হইল। কামিনী অনেক কান্নাকাটি করিল, অনেক কাকুতি মিনতি করিল, অনেক গালি বর্ষণ করিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না।

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

পূৰ্বোক্ত পরিচ্ছেদে বর্ণিত কাৰ্য্যগুলি শেষ করিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। আমি নির্জনে বসিয়া এই অদ্ভুত রহস্তের বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, তবে কি সত্য সত্যই সন্ন্যাসীগণ রূপসীকে হত্যা করিয়াছে? কামিনী যখন ঐ সন্ন্যাসীকে সনাক্ত করিল, যে ভাবে কামিনী তাহার কথা ব্যক্ত করিল, তাহাতে তাহার কথা মিথ্যা বলা যায় না। অথচ সন্ন্যাসী আমাকে যাহা বলিলেন, তাহাতে তাঁহার কথাতেও অবিশ্বাস হয় না। তবে একজন সাধু সচ্চরিত্ৰ সদাশয় ব্যক্তি, অপর বেশ্যাতিপস্বিনী। কামিনীর কথা মিথ্যা হইতে পারে, কিন্তু সে পুলিসের লোকএর নিকট এমন সাজান কথা বলিয়া পরিত্রাণ পাইবে, তাহা বোধ হয় না। সন্ন্যাসী মিথ্যা বলিবে কেন? সন্ন্যাসীর মৃত্যুরই বা ভয় কি? যাঁহার সংসার-বন্ধন শিথিল হইয়া গিয়াছে, এ জগতে যাঁহার আপন বলিতে কেহ নাই, তিনি সামান্য প্রাণের জন্য, তুচ্ছ জীবনের জন্য পারত্রিক সুখ নষ্ট করিবেন কেন? সন্ন্যাসী নিশ্চয়ই নির্দ্দোষী।

কিন্তু কেমন করিয়া তাঁহাকে নির্দ্দোষী বলিয়া প্রমাণ করিব। শেষে প্রমাণাভাবে কি একজন নিরপরাধ ব্রাহ্মণ-সন্তানকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইয়া দিব। কামিনী নিশ্চয়ই মিথ্যা বলিতেছে। সে যখন শোভন সিংএর রক্ষিতা বেশ্যা ছিল, সে যখন এক-সময়ে শোভন সিংএর পয়সা খাইয়াছে, তখন সে কখনো শোভন সিংএর অনিষ্ট করিতে পারে না। রূপসী শোভনের কন্যা—বাল্যকালে সে যে কামিনীর বাড়ীতে যাইত, তাহা স্পষ্টই জানা যায়। সুতরাং কামিনী যে রূপসীকে ভালবাসিবে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। সে যে রূপসীকে চুরি করিবে, বিশেষতঃ একজন সামান্য সন্ন্যাসীর কথায় রূপসীকে হত্যা করিবার জন্য তাহার হন্তে অৰ্পণ করিবে, ইহা সম্পূর্ণ অসম্ভব। রমণীর প্রতিহিংসা–বৃত্তি ভয়ানক প্রবল। রমণী যদি কাহারও উপর রাগান্বিত হয়, তাহা হইলে সে যে কোন রূপেই হউক, যতদিন পরেই হউক, তাহার উপায় প্ৰতিশোধ লইবেই লইবে। কিন্তু কামিনীর কোন কারণ ঘটে নাই। লাল সিংএর মুখে শুনিলাম কামিনী এখনও শোভনের নিকট হইতে কিছু কিছু পাইয়া থাকে।

এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে হঠাৎ একটা উপায় মনে পড়িল। লাল সিং তখনও থানায় ছিলেন। আমি তাহাকে নিকটে ডাকিলাম। তিনি আসিলে জিজ্ঞাসা করিলাম, শোভনের ভগ্নী ছাড়া ছাড়া আর কোন আত্মীয় আছে কি না? কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া লাল সিং উত্তর করিলেন,–আজ্ঞে না—শোভনের দুইটী ভগ্নী ছিল। একটী ছোট বেলায় মারা পড়ে, অপরটী এখনও বিদ্যমান।

আ। শোভনের এই ভগ্নীর স্বভাব কেমন?

লা। অতি কুৎসিত। তাহার মত খল আর নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। সেই ভগ্নীই যত অনিষ্টের মূল। শোভনের ইচ্ছা থাকিলেও কেবল ঐ ভগ্নীর কথায় সে রূপসীর সহিত আমার বিবাহ দিতে নারাজ ছিলেন।

আ। ভগ্নীর পুত্ৰাদি আছে?

লা। একটী কন্যা ছাড়া আর কোন সন্তান হয় নাই।

আ। বাড়ী কোথায়?

লা। সিয়ালদহের নিকট, আমি সে বাড়ী জানি।

আ। শোভনের ভগ্নী ত এখন তাঁহারই বাড়ীতে আছেন। শুনিয়াছি, রূপসীর বিবাহ উপলক্ষে তিনি ভ্রাতার বাড়ীতে গিয়াছিলেন, সম্ভবতঃ এখনও ফিরিয়া আইসেন নাই।

লাল সিং আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন,–কে বলিল, শোভনের ভগ্নী তাঁহারই বাড়ীতে আছে? আমার বিশ্বাস, তিনি বিবাহের দিন প্ৰাতেই নিজ বাড়ীতে গিয়াছেন।

আমিও বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম,–সে কি! রাত্রে ভাইঝির বিবাহ–আর প্রাতে তিনি নিজ বাড়ীতে ফিরিয়া গেলেন? এ কি নূতন রহস্যের কথা বলিতেছেন?

লা। আজ্ঞে—রহস্যই বটে। তিনি রূপসীর বিবাহ দেখিতে আসিলেন—অথচ বিবাহের দিন প্ৰাতেই নিজ বাড়ীতে ফিরিয়া গেলেন কেন? তাহা বুঝিতে পারিলাম না।

আ। শোভন সিংএর মুখে ত সে কথা শুনিলাম না। তাঁহার ভগ্নী যে সেইদিন প্রাতেই নিজ বাড়ীতে গিয়াছেন, এ কথা ত তিনি বলিলেন না। বরং এমন কথা বলিয়াছিলেন, যাহাতে আমি বুঝিয়াছিলাম যে, তিনি তখনও সেই বাড়ীতে বাস করিতেছেন, এমন কি, তিনি তাহার ভগ্নীপতিকে পৰ্যন্ত দেখাইয়াছিলেন।

লা। তাঁহার ভগ্নীপতি এখনও আছেন বটে কিন্তু ভগ্নী নাই।

আ। কেন তিনি নিজ বাড়ীতে গিয়াছেন, বলিতে পারেন?

লা। আজ্ঞে না। সে কথা বলিতে পরিলাম না।

কিছুক্ষণ চিন্তার পর আমি লাল সিংকে বলিলাম,–আপনাকে এখন একটা কাজ করিতে হইবে। আমি একবার শোভনের ভগ্নীর বাড়ী যাইতে চাই। আপনাকে দূর হইতে বাড়ীখানি দেখাইয়া দিতে হইবে।

লাল সিং সন্মত হইলেন। আমি পুনরায় ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া লাল সিংএর সঙ্গে সঙ্গে সিয়ালদহ অভিমুখে গমন করিলাম। রাত্রি আটটার পর লাল সিং একখানি বাড়ী দেখাইয়া দিলেন। আমি তাহাকে থানায় ফিরিয়া যাইতে আদেশ করিয়া অতি ধীরে ধীরে সেই বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

বাড়ীখানি ক্ষুদ্র হইলেও দ্বিতল। বহির্ব্বাটী বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সদর দরজা পার হইয়া উভয়দিকে দুইটী ঘর দেখিতে পাইলাম। কিন্তু দুইখানি ঘরের দরজাতেই চাবি দেওয়া।

সদর দরজা অতিক্রম করিয়া কিছুদূর গমন ক্রইবার পর আর একটী দরজা দেখিতে পাইলাম। কিন্তু সেটীর ভিতর দিক হইতে আবদ্ধ। ভিতরে প্রবেশ করিতে না পারিয়া আমি সেই দরজার নিকটে দাঁড়াইয়া কড়া নাড়িতে লাগিলাম।

অনেকক্ষণ কেহ কোন সাড়া দিল না, আমি প্ৰায় অৰ্দ্ধঘণ্টা ধরিয়া সেই কড়া নাড়িতে লাগিলাম। অবশেষে বিরক্ত হইয়া চীৎকার করিলাম। কিছুক্ষণ এই প্রকার চীৎকার করিবার পর ভিতর হইতে একজন স্ত্রীলোক উত্তর দিল, কে গো, দরজা যে ভেঙ্গে গেল।

আমার বড় রাগ হইল। আমি বলিলাম, সে কি আমার দোষ—এক ঘণ্টা ডাকাডাকি করেও সাড়া পাই নাই কেন?

আমার কথা শেষ হইতে না হইতে দরজাটী ভিতর হইতে খুলিয়া গেল। একটা বুড়ী দাসী একটা আলোক হস্তে লইয়া আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি চান?

কোন প্ৰকার গৌরচন্দ্ৰিক না করিয়া আমি একেবারে বলিয়া উঠিলাম, রূপসীকে শীঘ্ৰ আমার কাছে এনে দাও। এখানে রাখা ঠিক নয়, পুলিসের লোকে জানতে পারলে বাড়ী শুদ্ধ সকলকে এখনই বেঁধে নিয়ে যাবে। শুনেছি তিনজন সন্ন্যাসী গ্রেপ্তার হয়েছে। যতদিন না বিচার হয়, ততদিন রূপসীকে সাবধানে রাখতে হবে।

আমার কথা শুনিয়া দাসী আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, কোন উত্তর করিল না। রূপালী আছে, কি না, সে বিষয়েও কোন কথা বলিল না। তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বোধ হইল, রূপসী সেখানেই আছে, কিন্তু সে কথা সাহস করিয়া বলিতে পারিতেছে না। আমি নিশ্চয় জানিতাম না যে, রূপসী সেখানেই আছে, আন্দাজ করিয়াছিলাম মাত্র। বিশেষতঃ যখন লাল সিংএর মুখে শুনিলাম যে, বিবাহের দিন প্রাতে শোভন সিংএর ভগ্নী তাহার বাড়ীতে প্রস্থান করিয়াছেন, তখন তিনি রূপসীকে লইয়াই আসিয়াছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। সেই জন্যই আমি রূপসী সেখানে আছে কিনা, জিজ্ঞাসা না করিয়া তাহাকে আমার নিকট অনিয়া দিবার কথা বলিলাম।

দাসীর মনোগত অভিপ্ৰায় বুঝিতে পারিলাম, সে যে আমার উপর অবিশ্বাস করিতেছে, তাহাও জানিতে পারিলাম, আমি যখন তাহার সম্পূর্ণ অপরিচিত, তখন তাহার এরূপ অবিশ্বাস জন্মিতে পারে বিবেচনা করিয়া, পূর্ব হইতেই প্ৰস্তুত ছিলাম। তখনই পকেট হইতে একখানি পত্র বাহির করিয়া বলিলাম, আমার কথায় বিশ্বাস না হয়, এই পত্র লও। শোভন সিং আমাকে এই পত্র দিয়াছেন। যাও, আর বিলম্ব করিও না।

এই বলিয়া পত্ৰখানি দ্বাসীর হন্তে প্ৰদান করিলাম। দাসী উহা গ্ৰহণ করিয়া বলিল, না মহাশয়, আপনাকে আমাদের অবিশ্বাস নাই। তবে কি, এ কাজ খুব গোপনে করাই ভাল। আমি পূর্বে আপনাকে আর কখনও দেখি নাই। সেই জন্যই চিনিতে পারিতেছি না। একজন পরিচিত লোক পাঠান শোভনের উচিত ছিল।

আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, আজ রাত্রেই রূপসীকে কোন গোপনীয় স্থানে সরাইয়া ফেলিতে হইবে। এত তাড়াতাড়ি পরিাচিত বিশ্বাসী লোক কোথায় পাইবেন? আমি যদিও তোমাদের পরিচিত নই বটে কিন্তু শোভন সিং আমাকে বাল্যকাল হইতেই চেনে। আমার মত বিশ্বাসী লোক এত শীঘ্ৰ পাইবেন না বলিয়াই কোন পরিচিত লোককে পাঠাইতে পারেন নাই। সে যাহা হউক, তুমি পত্রখানি ভিতরে লইয়া যাও, ও শোভন সিংএর ভগ্নীর হস্তে প্ৰদান কর। তাঁহার পাঠ হইলে তিনি যেরূপ হুকুম দিবেন, সেই–মত কাৰ্য্য করিব।

দাসী হাসিয়া বলিল, পাঠ করিবেন কেমন করিয়া—তিনি লেখাপড়া জানেন না।

আ। তা আমি জানি। কিন্তু শোভন বলিলেন,–তাঁহার ভগ্নীর চাকর পড়াশুনা জানে এবং সেই তাঁহার ভগ্নীপতির অবৰ্ত্তমানে এ বাড়ীর অনেক চিঠি পত্ৰ পড়িয়া থাকে।

দা। সে চাকরিটা ত তাঁহাদের বাড়ীতেই আছে।

আমি বিষম ফাঁপরে পড়িলাম। মনে হইল, এইবার বুঝি বা ধরা পড়িলাম। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে যাত্রা পরিত্রাণ পাইলাম। তখনই আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া বলিলাম, সে কি! শোভন সিং যে আমার সাক্ষাতে তাহাকে এখানে আসিতে বলিলেন। সে কি এখনও সেখান হইতে ফিরিয়া আইছে নাই?

দা। কই, এখনও ত আসে নাই।

আ। শীঘ্রই আসিবে বটে কিন্তু আমি ত ততক্ষণ বিলম্ব করিতে পারিব না। কে জানে, হয় তা ইহার মধ্যেই পুলিসের লোক এখানে অসিতে পারে।

দ। এখানে আসিলে কিছু করিতে পরিবে না, তবে যদি—

দাসী আর কোন কথা বলিতে সাহস করিল না দেখিয়া আমি বলিলাম, তবে যদি কি? আমার নিকট কোন কথা বলিতে ভয় করিও না। আমার দ্বারা উপকার ভিন্ন কোন প্ৰকার অপকারের সম্ভাবনা নাই।

দাসী বলিল, আপনাকে কোন অবিশ্বাস নাই, আপনাকে সকল কথাই বলিতে পারি, কিন্তু কি জানি, যদি আর কোন লোক আমাদের এ সকল কথা শোনে, সেই জন্যই সাবধান হইতেছি।

আ। এখানে আপাততঃ আর কোন লোক নাই, তুমি স্বচ্ছন্দে সকল কথাই বলিতে পার। এখন কি বলিতেছিলে বল?

দা। বলছিলাম, যদি রূপসী কোন প্রকার চীৎকার করিয়া পাঁচজনকে জানাইয়া দেয়, তাহা হইলেই সৰ্ব্বনাশ! মেয়েটা বড় দুষ্টু।

আ। কেন?

দা। সে না কি সেই বুড়োকে বিবাহ করতে পাগল হয়েছে।

আ। বুড়ো কে?

দা। কেন—যার সঙ্গে তার বিয়ের কথা।

আ। সে বুড়ো না কি? আমি ত একবার মাত্র তাকে দেখেছিলাম।

দা। দেখতে বুড়ো না হলেও তার বয়স হয়েছে। তাহার প্রথম পক্ষের ছেলেটী থাকলে এতদিন দশ বছরের হত। যার ছেলের বয়স দশ বছর, তার আবার বিয়ে করা কেন?

আ। তাঁহার ছেলেটী এখন কোথায়?

দা। মারা গেছে।

আ। রূপসীয় তবে এ বিবাহে অমত নাই?

দা। না—এত বয়স হ’লো, এখনও বিয়ে হয় না—বাপের চেষ্টাও নাই। কাজেই এখন যার তার সঙ্গে বিয়ে হ’লেই হ’ল।

আন্তরিক সন্তুষ্ট হইয়া আমি বলিলাম, সে কথা পরে হইবে, এখন রূপসীকে নিয়ে এস। আমি তাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। আজই কোন দূরদেশে রওনা না হইলে শোভনের রক্ষা নাই। শুনিয়াছি, সে ভাবী জামাইয়ের নিকট হইতে আট শত টাকা আদায় করিয়াছে।

দাসী আর দ্বিরুক্তি না করিয়া বাড়ীর ভিতর গেল এবং কিছুক্ষণ পরে রূপসীকে লইয়া পুনরায় সেখানে ফিরিয়া আসিল।

পূৰ্বে আমি রূপসীকে দেখি নাই। মনে করিয়াছিলাম, সে বালিকা মাত্র। কিন্তু এখন যাহা দেখিলাম, তাহাতে স্তম্ভিত হইলাম। রূপসীর বয়স প্ৰায় পনের বৎসর বলিয়া বোধ হইল। তাহার শরীরে যৌবনের সমস্ত চিহ্নগুলি পরিস্ফুট হইয়াছে। সে আমার মুখের দিকে সাহস করিয়া চাহিতে পারিল না।

রূপসী সুন্দরী ও যুবতী। তাহার জন্য লাল সিং যে অনায়াসে আটশত টাকা দিবে তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি?

দাসীর সহিত রূপসীকে দেখিয়া আমি বলিলাম, মা! তোমার বাপের ইচ্ছা নয় যে, তুমি আর এখানে থাক। তোমাকে এখনই আমার সঙ্গে যাইতে হইবে।

ভিতর হইতে আর একজন রমণী উত্তর করিলেন, দাদার যেমন বুদ্ধি। আমাদের এখানে থাকিলে কোন প্ৰকার গোলযোগের সম্ভাবনা নাই। কেন তিনি রূপসীকে এখন হইতে সরাইতেছেন বলিতে পারি না। যাহাই হউক, দাদার কথামত রূপসীকে আপনার সঙ্গে পাঠাইলাম। দেখিবেন, যেন কোন প্রকার বিপদে পড়িতে না হয়।

আমিও উদ্দেশে উত্তর করিলাম, আপনি সে ভয় করিবেন না। বিশেষ না জানিয়া শুনিয়া শোভন সিং আমার উপর এ কার্য্যের ভার দেন নাই, বরং রূপসী এখানে থাকিলে আপনাদের বিপদের সম্ভাবনা হইতে পারে, আমার সহিত যাইলে সেরূপ কোন ভয়ের কারণ নাই। আপনি পত্রখানি রাখিয়া দিন। উহাতে আমার নাম ধাম সমস্তই আছে। প্রয়োজন হইলে আমায় সংবাদ দিতে পারিবেন। তবে এই পর্য্যন্ত জানিয়া রাখুন যে, আমি আজই রাত্রি সাড়ে দশটার সময় কলিকাতা ত্যাগ করিব।

রাত্রি নয়টা বাজিয়া গেল। আমি আর বিলম্ব করিতে পারিলাম না। রূপসীকে লইয়া একখানি গাড়ীতে উঠিলাম এবং আধঘণ্টার মধ্যেই থানায় ফিরিয়া আসিলাম।

 

নবম পরিচ্ছেদ

থানায় আসিয়া রূপসীকে একটী ঘরে রাখিলাম। পরে তখনই একজন কনস্টেবলকে শোভন সিংএর বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলাম। বলিয়া দিলাম, সে যেন অবিলম্বে তাহাকে ডাকিয়া আনে।

এক ঘণ্টার মধ্যেই কনষ্টেবল শোভনকে লইয়া ফিরিয়া আসিল। কোন  কথা না বলিয়া তখনই তাহাকে বন্দী করিতে আদেশ করিলাম।

শোভন সিং আমার আদেশ শুনিয়া স্তম্ভিত হইলেন। অত্যন্ত আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন, এ কিরূপ বিচার হইল? একেত আমি ধনে প্রাণে মারা পড়িয়াছি, তাহার উপর আবার আমাকেই বন্দী করিলেন? আমার অপরাধ কি?

আমি গম্ভীরভাবে উত্তর করিলাম, আজ অনেক রাত্রি হইয়াছে, সকল কথা কালই জানিতে পারিবেন।

শো। আমার অপরাধ?

আ। যথেষ্ট—আপনি লালসিংএর নিকট হইতে আটশত টাকা প্রবঞ্চনা করিয়া লইয়াছেন; একজন নিরীহ সন্ন্যাসীর উপর আপনার কন্যার হত্যাপরাধ চাপাইবার মানস করিয়াছেন।

শো। সে কি! আমার কন্যা কোথায়?

আ। আপনি কি বিবেচনা করেন?

শো। সেই সন্ন্যাসী–আমার ঘোর শত্রু ভজন সিং তাহাকে হত্যা করিয়াছে, আমি এই জানি।

আ। এই দেখুন—এখনও মিথ্যা বলিতেছেন। রূপসীকে যে কেহ খুন করে নাই, এ কথা আপনিও অবগত আছে। কিন্তু বলুন দেখি, পরশু রাত্রি হইতে আপনি কি কাণ্ড করিয়াছেন? আপনার রোদন দেখিয়া আমি ভাবিয়াছিলাম, আপনার কন্যা সত্য সত্যই খুন হইয়াছে, কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় এখন সমস্ত রহস্য ভেদ করিয়াছি। আপনি যে কি ভয়ানক লোক, একজন নিরীহ লোকের প্রাণবিনাশ করিবার জন্য কি ভয়ানক ষড়যন্ত্র করিয়াছেন, তাহা কাল প্রাতেই জানিতে পরিবেন। আজ অনেক রাত্রি হইয়া পড়িয়াছে, বিশেষতঃ সমস্ত দিন কঠোর পরিশ্রম করিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি, আজ এই রাত্ৰে আর। সে সকল কথার প্রয়োজন নাই।

এই বলিয়া আমি একজন কনষ্টেবলকে ইঙ্গিত করিলাম। সে আমার সঙ্কেত বুঝিতে পারিল এবং তখনই শোভন সিংকে আমার সম্মুখ হইতে স্থানান্তরিত করিল। শোভন সিং অতি বিমৰ্ষভাবে হাজতে গেল।

পরদিন প্রাতঃকালে লালসিং থানায় আসিলে আমি তখন তাঁহাকে কোন কথা না বলিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিতে বলিলাম। তিনি আমার মুখ দেখিয়া কি বুঝিয়েছিলেন বলিতে পারি না, কিন্তু তাঁহাকে পূর্ব্বাপেক্ষা যেন অধিক আনন্দিত বলিয়া বোধ হইল।

অন্যান্য কাজ শেষ করিয়া আমি শোভন সিং, লাল সিং, কামিনী ও সন্ন্যাসী তিনজনকে একটী ঘরের মধ্যে আনয়ন করিতে বলিলাম। মুহূৰ্ত্ত মধ্যে আমার আদেশমত কাৰ্য্য হইল। আমি তখন সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া শোভন সিংএর দিকে চাহিয়া বলিলাম, আপনার সমস্ত চাতুরী ধরা পড়িয়াছে। রূপসীকে কেহ হত্যা করে নাই, তাহাকে আপনিই কৌশলে আপনার ভগ্নীর বাড়ীতে সরাইয়াছিলেন। রূপসী যখন গৌরীর সহিত পদ্মপুকুরের নিকট দিয়া যাইতেছিল, তখন কামিনী কৌশলে উহাদের উভয়কে ভুলাইয়া গাড়ীতে তুলিয়াছিল এবং অনতিবিলম্বে সন্ন্যাসীগণের নির্জন আশ্রম–সেই ভগ্ন অট্টালিকায় লইয়া গিয়াছিল। সন্ন্যাসীগণ নিশ্চয়ই ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তাঁহারা এ বিষয়ের কিছুই জানিতেন না—এমন কি, সন্দেহও করেন নাই। এই স্থান হইতে রূপসীকে কৌশলে বাহির করিয়া দেওয়া হইয়াছিল; এবং গৌরীকে নানা প্ৰকার ভয় দেখাইয়া কামিনী স্বয়ং বাহির করিয়া আনিয়াছিল। গৌরী স্বচক্ষে রূপসীকে হত্যা করিতে দেখে নাই। সে কামিনীর মুখে শুনিয়াছিল মাত্র এবং সেই শোনা কথা এমন ভাবে রাষ্ট্র করিয়াছিল, যেন সে উহা স্বচক্ষে দেখিয়াছে। আপনি লোক নিযুক্ত করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহারাই রূপসীকে অন্য পথ দিয়া বাহির করিয়া আপনার ভগ্নীর বাড়ীতে লইয়া যায়। এদিকে আপনার ভগ্নীও সেইদিন প্ৰাতঃকালে আপনার বাড়ী ছাড়িয়া নিজ বাড়ীতে গিয়াছিলেন। বিবাহোপলক্ষে তাঁহার আগমন। অথচ বিবাহের দিন প্রাতঃকাল নিজ বাড়ীতে ফিরিয়া যাওয়া বড়ই আশ্চর্য্যের কথা। এখন বলুন, আপনি কি জন্য কন্যার মিথ্যা মৃত্যুর সংবাদ রাষ্ট্র করিতেছেন? কেনই বা নিরপরাধী এই সন্ন্যাসীগণের উপর খুনের দাবী দিয়াছিলেন? আর কেনই বা এই লাল সিংকে প্ৰবঞ্চনা করিতে উদ্ভূত হইয়াছিলেন? আমার প্রত্যেক কথার প্রমাণ আছে। বলেন ত সমক্ষেই তাহারা সাক্ষ্য দিতে প্ৰস্তুত। আমার কথায় অস্বীকার করা বাতুলের কাৰ্য্য।

আমার কথায় শোভন সিংএর মুখ পাংশুবৰ্ণ ধারণ করিল। তিনি আমার কথার ভাবেই বুঝিয়াছিলেন যে, আমি মুখে যাহা বলতেছি, কাজেও তাহা করিব। এই ভাবিয়া তিনি বলিলেন, না—যাহা করিয়াছি এবং যখন ধরা পড়িয়াছি, তখন অস্বীকার করিব কেন? আপনার সমস্ত কথাই ঠিক। আপনি সব করিতে পারেন। নিতান্ত কষ্টে পড়িয়াই লাল সিংএর টাকা নষ্ট করিয়া ফেলিলাম।

আমি বলিলাম, আর আপনার টাকার দরকার নাই। যখন আপনার কাছে রূপসী জীবিত, তখন তাহার সহিত লাল সিংএর বিবাহ দিন। যে প্ৰতিজ্ঞা করিয়া টাকা লইয়াছেন, সেই প্ৰতিজ্ঞা পূর্ণ করুন। আপনার কন্যা এখানেই আছে, আর সে লাল সিংকে বিবাহ করিতে সম্পূর্ণ ইচ্ছুক। আপনি অন্যায় করিয়া মিথ্যা এই বিপদ ঘটাইয়াছেন। কেন না, নিরীহ সন্ন্যাসীগণের উপর মিথ্যা কন্যার খুনের দাবী দিয়া আপনাকে বিষম বিপদে ফেলিয়াছেন। যথেষ্ট অর্থদণ্ড না দিলে নিষ্কৃতি নাই।

শোভন সিং বিবাহের কথা শুনিয়া আন্তরিক রাগান্বিত হইলেন। কিন্তু সাহস করিয়া সে সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে পারিলেন না। কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কেমন করিয়া জানিলেন, রূপসী এ বিবাহে ইচ্ছুক? সে আমার দুধের মেয়ে, এই বুড়ো বরকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিবে কেন?

আ। কেন তাহা জানি না। কিন্তু আপনার কন্যা আমার বাড়ীতে ঐ রূপই বলিয়াছে।

শো। আমার মেয়ে—বালিকা নয়, সে এখন যুবতী। বিশেষ তাহার কোন অপরাধ নাই, কেবল, সাক্ষ্য স্বরূপ তাহাকে এখানে আনা হইয়াছে, সেই জন্য তাহাকে বাহিরে পুলিসের অন্যান্য কর্ম্মচারিদিগের সহিত একত্র রাখিলাম না;–আমার অন্দরেই স্থান দিয়াছি। রূপসী বড় ভাল মেয়ে। তাহার মন বড় সরল।

শোভন সিং আর কোন কথা কহিলেন না। সন্ন্যাসীগণকে তখনই মুক্ত করিয়া দেওয়া হইল। তাঁহারা, বিশেষতঃ ভজন লাল আমায় আশীৰ্বাদ করিতে করিতে প্ৰস্থান করিলেন।

লাল সিং আমার কথায় অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন। আপাততঃ রূপসী তাঁহারই বাড়ীতে গেল। শোভন সিং বিবাহে সন্মতি দিয়াছিলেন। সুতরাং রূপসীকে লাল সিংএর সহিত যাইতে নিষেধ করিলেন না।

কামিনী হাজতেই রহিল। কোন লোক তাহার জামিন হইল না। সৌভাগ্য বশতঃ অধিককাল তাহাকে হাজতে থাকিতে হইল না। সৌভাগ্য বশতঃ অধিককাল তাহাকে হাজতে থাকিলে হইল না। শীঘ্রই বিচার হইয়া গেল। বিচারে শোভন সিংহের পাঁচ শত মুদ্রা এবং কামিনীর দুইশত মুদ্রা অর্থদণ্ড হইল। অর্থ দিতে না পারিলে শোভন সিংকে ছয় মাস এবং কামিনীকে একমাস কাল সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করিতে হইবে।

রূপসীকে লাভ করিয়া লাল সিং এত সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, বিশেষ রূপসী তাঁহাকে বিবাহ করিতে অভিলাষিণী শুনিয়া তিনি এত আনন্দিত হইয়াছিলেন যে, শোভন সিংএর মুক্তির সমস্ত টাকা নিজেই প্ৰদান করিলেন। শোভন মুক্ত হইলেন। কামিনীও দুই শত টাকা দিয়া মুক্তি লাভ করিল।

বাড়ী ফিরিয়াই শোভন সিং কন্যার বিবাহের আয়োজন ক্রিতে লাগিলেন। বিনা বাক্যব্যয়ে লাল সিংকে পাঁচ শত মুদ্রা দিতে দেখিয়া তিনি লাল সিংএর পক্ষপাতী হইয়াছিলেন। রূপসীকে নিজ বাড়ীতে আনিয়া মহা সমারোহে বিবাহ দিলেন। নব দম্পতীকে শোভন প্রাণ খুলিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন।

সমাপ্ত।

 ঘর-পোড়া লোক – ১ম অংশ

ঘর-পোড়া লোক
(দারোগার দপ্তর ৭৪ম সংখ্যা)
ঘর-পোড়া লোক  (অর্থাৎ পুলিসের অসৎ বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত!)
শ্রী প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত। All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। জ্যৈষ্ঠ।
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.

ঘর-পোড়া লোক।
(প্রথম অংশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ।

অদ্য যে বিষয় আমি পাঠকগণকে উপহার দিতে প্রস্তুত হইয়াছি, তাহা অতি ভয়ানক ও লোমহর্ষণ-জনক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার সহিত আমার নিজের কোনরূপ সংস্রব নাই, অর্থাৎ আমি নিজে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করি নাই; কিন্তু এই মোকদ্দমার সহিত যে পুলিস কর্ম্মচারীর সংস্রব ছিল, তিনি আমার পরিচিত। এই ঘটনার মধ্যে যেরূপ অস্বাভাবিক দুবুদ্ধির পরিচয় আছে, তাহা পাঠ করিয়া অনেক পাঠকেই মনে করিতে পারেন যে, এরূপ দুঃসাহসিক কাৰ্য মনুষ্য-বুদ্ধির অগোচর। কিন্তু যখন আমি এই ঘটনার আনুপূর্বিক সমস্ত ব্যাপার জানি, এবং অনুসন্ধানকারী পুলিস কর্ম্মচারীও, আমার পরিচিত, তখন এই ঘটনার সত্যাসত্য সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। পাঠকগণও ইহা সম্পূর্ণ। রূপ সত্য ঘটনা বলিয়া অনায়াসে বিশ্বাস করিতে পারেন।

এই ঘটনা আমাদিগের এই প্রদেশীয় ঘটনা নহে, পশ্চিম দেশীয় ঘটনা। হিন্দু পাঠকগণের মধ্যে সকলেই অবগত আছেন যে, নৈমিষারণ্য নামে একটা স্থান আছে, উহা আমাদিগের একটা প্রধান তীর্থ স্থান। পশ্চিমদেশবাসীগণ সেই স্থানকে নিমরণ কহিয়া থাকে।

কথিত আছে, ভগবান্ বেদব্যাস এই স্থানে বসিয়া ভগবদবাক্য সৰ্ব্বপ্রথমে মর্ত্যলোকে প্রকাশ করেন। যে বেদীর উপর উপবেশন করিয়া তিনি ভগবাক্য পাঠ করিয়াছিলেন, নিবিড় ও নিস্তব্ধ আয় কাননের ভিতর সেই বেদী এখন পর্যন্ত বর্তমান। সেই বেদীর কিছু দূর অন্তরে চক্রপাণি নামক প্রসিদ্ধ স্থান। প্রসিদ্ধি আছে যে, যে সময় ভগবান্ বেদব্যাস ভগব প্রকাশ করিতেন, সেই সময় দেবতাগণ ও ঋষি গণের আবির্ভাব হইত। সেই স্থানে তখন একটা সামান্য স্রোতস্বতী থাকা স্বত্বেও সেই স্থানে যাহারা আগমন করিতেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেককেই অত্যাধিক জল-কষ্ট সহ করিতে হইত। ভগবান্ বিষ্ণু এই ব্যাপার দেখিয়া জল-কষ্ট নিবারণ করিবার মানসে আপনার চক্র দ্বারা পৃথিবী ভেদ করিয়া দেন, সেই স্থান হইতে সতেজে অনবরত জল উখিত হইয়া সকলের জল-কষ্ট নিবারণ করে। সেই সময় পৃথিবী ভেদ করিয়া যে স্থান হইতে জল উঠিয়াছিল, এবং এখন পর্যন্ত যে স্থান হইতে অনবরত জল উখিত হইয়া সন্নিকটবর্তী সেই ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীতে গিয়া মিলিতেছে, সেই স্থানকে চক্রপাণি। কহে। নৈমিষারণ্য তীর্থে যাহারা গমন করিয়া থাকেন, তাহাদিগকে চক্রপাণি জলে স্নান করিতে হয়।

দশ বার বৎসর পূর্বে কোন সরকারী কাৰ্য্য উপলক্ষে আমাকে সেই নৈমিষারণ্যে গমন করিতে হইয়াছিল। যে কাৰ্য্যে আমি গমন করিয়াছিলাম, সেই কাৰ্য শেষ হইবার পর, একদিবস আমি সেই চক্রপাণি জলে স্নান করিতে যাই। সেই স্থানে আমি স্নান করিতেছি, এরূপ সময় একজন লোক আসিয়া স্নান করিবার মানসে সেই চক্রপাণি জলে অবতরণ করেন। কথায় কথায় তাহার সহিত আমার পরিচয় হয়। ইহার নাম আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম। কিন্তু ইহার সহিত আমার কখন চাক্ষুষ আলাপ পরিচয় ছিল না। ইহার নাম শুনিয়াই আমি কহিলাম, আপনি এই প্রদেশীয় পুলিস বিভাগে কর্ম্ম করিতেন না?

উত্তরে তিনি কহিলেন, হাঁ মহাশয়!

তখন আমি তাহার সম্বন্ধে যাহা যাহা অবগত ছিলাম, তাই তাহাকে কহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কেমন মহাশয়! এই অপ রাধের জন্য পুলিস বিভাগ হইতে আপনার চাকরী গিয়াছে না?

উত্তরে তিনি কহিলেন, আপনি এ সকল বিষয় কিরূপে অবগত হইতে পারিলেন?

আমি। আমি যেরূপেই অবগত হইতে পারি না কেন; কিন্তু ইহা প্রকৃত কি না?

যখন অনুসন্ধান করিয়া আমার দোষ সাব্যস্ত হইয়াছিল, এবং সেই দোষের উপর নির্ভর করিয়া সরকারী চাকরী হইতে আমাকে তাড়িত করা হইয়াছে, তখন উহা যে সম্পূর্ণরূপ মিথ্যা কথা, তাহাই বা আমি বলি কি প্রকারে?

আমি। সত্য হউক, আর মিথ্যা হউক, যে অপরাধের নিমিত্ত আপনার চাকরী গিয়াছে, সেই অপরাধ সম্বন্ধে আপনার কোন্ উর্দ্ধতন কর্ম্মচারী অনুসন্ধান করিছিলেন?

যে ইনস্পেক্টারের দ্বারা তাহার অপরাধের অনুসন্ধান করা হইয়াছিল, সেই ইম্পেক্টারের নাম তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরে বলিয়া দিলেন, এবং তিনি আজ কাল যে স্থানে আছেন, তাহাও আমাকে জানাইয়া দিলেন। আমি দেখিলাম, যে সরকারী কার্যের নিমিত্ত আমি সেই প্রদেশে গমন করিয়াছি, তাহার কোন কোন বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাকে তাঁহার নিকট গমন করিতেই হইবে। সুতরাং এই ঘটনার সমস্ত অবস্থা তাঁহার নিকট হইতে অনায়াসেই জানিয়া লইতে পারিব। যে ভূত-পূৰ্ব পুলিস-কর্ম্মচারীর সহিত আমার চক্রপাণিতে সাক্ষাৎ হইল, তিনিও আমার পরিচয় গ্রহণ করিলেন, এবং পরিশেষে তাহার বাসায় গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি বার নিমিত্ত আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন। আমিও তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিলাম; সেই দিবস সন্ধ্যার পূর্বে তাঁহার বাসায় গিয়া আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। সেই রাত্রি তাহার বাসায় অতিবাহিত করিবার নিমিত্ত তিনি আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন; কিন্তু জাতিভেদের প্রতিবন্ধকতা হেতু আমি কোনরূপেই তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিলাম না। তথাপি অনেক রাত্রি পর্যন্ত তাঁহার বাসায় বসিয়া নানারূপ প্রসঙ্গে সময় অতিবাহিত করিলাম। ইহার মধ্যে যতদূর সম্ভব, তাঁহার নিকট হইতে তাহার মোকদ্দমার বিষয় সকল উত্তমরূপে জানিয়া লইলাম।

ইনি অসৎ উপায়ে যে সকল অর্থ উপার্জন করিয়া ছিলেন, তাহার অধিকাংশই প্রায় ব্যয়িত হইয়া গিয়াছে। এই স্থানে বসিয়া এখন তিনি জমিদার-সরকারে যদি কোনরূপ একটী চাকরীর সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন, তাহারই চেষ্টা দেখিতেছেন।

নৈমিষারণ্যে আমার যে সকল অনুসন্ধানকার্য ছিল, তাহা শেষ করিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। দুর্গম ভয়ানক পথ অতিক্রম করিয়া, ও হত্যা-হরণ প্রভৃতি স্থান দর্শন করিয়া, ক্রমে আমি গিয়া সাণ্ডিল। ষ্টেশনে উপস্থিত হইলাম। পরে কয়েকটা ষ্টেশন অতিক্রম করিয়া যে স্থানে সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানকারী ইনস্পেক্টার থাকিতেন, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহার নিকট আমি আমার পরিচয় প্রদান করিলাম, এবং যে সরকারী কার্যের নিমিত্ত আমি তাহার নিকট গমন করিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত ব্যাপার আমি তাঁহার নিকট কহিলাম। তিনি তাঁহার সাধ্যমত আমাকে সাহায্য করিয়া, সেই স্থানের আমার আবশ্যক কাৰ্য্য সকল সম্পন্ন করিয়া দিলেন।

যে সময় তিনি আমার সাহায্যের নিমিত্ত আমার সহিত কার্যে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় একদিবস কথায় কথায় এই মোকদ্দমার বিষয় তাহার নিকট উত্থাপিত করিলাম। তিনিও সবিশেষ যত্নের সহিত ইহার সমস্ত ব্যাপার আমাকে বলিয়া দিলেন, এবং এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের যে সকল কাগজ, পত্র ছিল, তাহাও আমাকে দেখাইতে চাহিলেন। সময়মত আফিস হইতে সমস্ত নথি-পত্ৰ আনিয়া, দেখিবার নিমিত্ত আমার হস্তে প্রদান করিলেন; কিন্তু উহার সমস্তই উর্দ্দূ ভাষায় লিখিত বলিয়া, আমি নিজে তাহা পড়িয়া উঠিতে পারিলাম না। উর্দু ভাষাবিদ একজন মুসির সাহায্যে সেই সকল কাগজপত্রে যাহা লিখিত ছিল, তাহা জানিয়া লইলাম, এবং আবশ্যকমত কতক কৃতক লিখিয়াও লইলাম। এইরূপে

যে সকল বিষয় আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহাই অবলম্বন করিয়া এই বিবরণ লিখিত হইতেছে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

যে গ্রামে রামসেবকের বাড়ী, সেই গ্রামের জমিদার গোফুর খাঁ। গোফুর খাঁ যে একজন খুব বড় জমিদার, তাহা নহে; কিন্তু নিতান্ত ক্ষুদ্র জমিদার ও নহেন। ইহার জমি দারীর আয়, সালিয়ানা পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা হইবে। গোফুর খাঁ জমিদার, কিন্তু জমিদার-পুত্র নহেন। তাঁহার পিতা একজন মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ছিলেন। তিনি যাহা কিছু উপার্জন করিতেন, তাহার দ্বারা কোন গতিতে পরিবার প্রতিপালন করিতেন মাত্র; কিন্তু তাহা হইতে একটা কপর্দকও সঞ্চয় করিয়া রাখিতে পারিতেন না। গোফুর খাঁ তাঁহার পিতার প্রথম বা একমাত্র পুত্র। যে সময় তাঁহার পিতা পরলোক গমন করেন, সেই সময় গোফুরের বয়ঃক্রম পনর বৎসরের অধিক ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর অনন্যোপায় হইয়া গোফুর সামান্য চাকরীর উমেদারীতে প্রবৃত্ত হন, এবং আপন দেশ ছাড়িয়া কানপুরে গমন করেন। সেই সময় কানপুরে একজন মুসলমান বাস করিতেন। চামড়ার দালালী করিয়া তিনি শটাকার সংস্থান করিয়াছিলেন, এবং দেশের মধ্যে মান-সম ও একটু সবিশেষ প্রতিপত্তি স্থাপন করিতে পারিয়াছিলেন। গোফুর খাঁ কানপুরে জাসিয়া প্রথমে তাহারই আশ্রয় গ্রহণ করেন, এবং তাহারই নিকট অতি সামান্য বেতনে একটা চাকরী সংগ্রহ করিয়া লন। গোফুর খাঁ অতিশয় বুদ্ধিমান ও সবিশেষ কার্যক্ষম ছিলেন। সুতরাং অতি অল্পদিবসের মধ্যেই তিনি আপন মনিবের প্রিয়পাত্র হইয়া পড়েন, এবং ক্রমে তিনি তাঁহার মনিবের কাৰ্য্যে সবিশেষরূপে সাহায্য করিতে সমর্থ হন্। দিন দিন যেমন তিনি তাঁহার মনিবের প্রিয়পাত্র হইতে ছিলেন, সেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বেতনও ক্রমে বর্ধিত হইতেছিল।

সে যাহা হউক, যে সকল কাৰ্য্য করিয়া তাহার মনিব সেই দেশের মধ্যে প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, পরিশেষে সেই সমস্ত কাৰ্য গোফুর খাঁ নিজে সম্পাদন করিতে লাগিলেন। ইদানীং তাঁহার মনিবকে আর কোন কাৰ্যই দেখিতে হইত না, সকল কাৰ্য গোফুরের উপরেই নির্ভর করিত। গোফুরও প্রাণপণে এরূপ ভাবে কার্য সম্পন্ন করিয়া আসিতে লাগি লেন যে, তাহার মনিবের কার্য পূর্ব অপেক্ষা আরও অতি উত্তমরূপে চলিতে লাগিল। সৰ্বসাধারণে গোফুয়ের মনিবকে যেরূপ ভাবে বিশ্বাস করিতেন, গোফুরকে তাহা অপেক্ষা আরও অধিক বিশ্বাস করিতে লাগিলেন। এমন কি, সেই সময় গোফুরের মনিবকে পরিত্যাগ করিয়া ব্যবসায়ী মাত্রেই গোফুরকে চাহিতে লাগিলেন, ও গোফুরের হস্ত হইতে সমস্ত দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে লাগিল। এই ব্যাপার দেখিয়া গোফুরের মনিব নিজে আর কোন কার্যে হস্তক্ষেপ না করিয়া সমস্ত কার্যভারই গোফুরের উপর অর্পণ করিলেন, এবং পরিশেষে গোফুরকে একজন অংশীদার করিয়া লইলেন। গোরও সবিশেষ পারদর্শিতার সহিত কাৰ্য্য করিয়া ক্রমে যথেষ্ট উপার্জন করিতে আরম্ভ করিলেন।

এইরূপে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হইবার পর গোফুলের মনিব বা অংশীদার ইহলীলা সম্বরণ করিলেন; সুতরাং এখন সেই কার্যের সমস্ত অংশই গোফুরের হইল। গোফুরও সবিশেষ মনোযোগের সহিত আপন কাৰ্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিতে লাগিলেন। এইরূপে দুই একখানি করিয়া ক্রমে জমিদারী ক্রয় করিতে লাগিলেন। এইরূপে তিনি যে সকল জমিদারী ক্রমে ক্রয় করিয়াছিলেন, সেই সকল জমিদারীর আয় পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকায় দাঁড়াইল। সেই সময় গোফুর খাঁও ক্রমে বৃদ্ধ হইয়া পড়ায় আপনার ব্যবসা পরিত্যাগ করিলেন, এবং কেবলমাত্র তাহার জমিদারীতেই আপনার মন নিয়োগ করিবার মানস করিলেন।

গোফুর খাঁর কেবল একটামাত্র পুত্র জন্মিয়াছিল, তাহার নাম তিনি ওসমান রাখিয়াছিলেন। আপন পুত্র ওসমানকে প্রথমতঃ তিনি আপনার ব্যবসা কার্য শিখাইবার নিমিত্ত সবিশেষরূপ চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনরূপে আপন মনস্কামনা পূর্ণ করিতে পারেন নাই। বাল্যকালে গোফুর খাঁর যেরূপ প্রকৃতি ছিল, তাঁহার পুত্র ওসমানের প্রকৃতি বাল্যকাল হইতেই তাহার বিপরীত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। গোফুর খাঁ সৰ্ব্বদা আপন কার্যে মন নিয়োগ করিতেন, ওসমান কেবল অপরের সহিত মিলিয়া আমোদ-আহলাদ করিয়া দিন অতি বাহিত করিতে লাগিল।

গোফুরের চেষ্টা ছিল, কিরূপে আপনার কাৰ্য্যে তিনি সবিশেষরূপে উন্নীত হইতে পারেন।

ওসমান ভাবিতেন, অসৎ উপায় অবলম্বনে কিরূপে তিনি তাঁহার পিতার উপার্জিত অর্থ ব্যয় করিতে সমর্থ হন।

গোফুর সর্বদা সৎকার্যের দিকে দৃষ্টি রাখিতেন। কিরূপে দশজন প্রতিপালিত হয়, কিরূপে দশজনের উপকার করিতে পারেন, তাহার দিকে সর্বদা তিনি লক্ষ্য রাখিতেন।

ওমানের লক্ষ্য হইয়াছিল, কেবল অসৎ কার্যের দিকে। আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রগণের প্রতিপালনের পরিবর্তে কতকগুলি নীচজাতীয় বার-বনিতা তাহার দ্বারা প্রতিপালিত হইত।

ওসমানের এইরূপ অবস্থা সত্বেও একমাত্র সন্তান বলিয়া তাঁহার পিতা গোফুর খা তাহাকে কিছু বলিতেন না। সুতরাং ওসমারের অত্যাচার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস হইবার পরিবর্তে ক্রমে আরও বর্ধিত হইতে লাগিল।

গোফুর খাঁ নিতান্ত বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন বলিয়া, তিনি মনে করিয়াছিলেন, ব্যবসা কার্যের ভার তিনি তাহার পুত্র ওসমান খাঁর হস্তে প্রদান করিবেন; কিন্তু তাহার চরিত্র দেখিয়া আপনার ইচ্ছাপূর্ণ করিতে পারিলেন না। অথচ ব্যবসায়ীগণের অনুরোধ রক্ষা করিতে গিয়া, তিনি আপন কাৰ্য্য পরিত্যাগ পূর্বক আপন বাড়ীতে বসিয়া তাহার বৃদ্ধাবস্থায় যে কিছু দিবস বিশ্রাম করিবেন, তাহাতেও তিনি সমর্থ হইলেন না। তাহাকে সৰ্ব্বদা কানপুরেই থাকিতে হইত। এদিকে অবসর পাইয়া ওসমান জমিদারীর ভিতর যথেচ্ছ ব্যবহার করিত। তাহার অত্যাচারে প্রজাগণের মধ্যে কেহই শান্তিলাভ করিতে পারিত না। কিরূপে ওমানের হক হইতে আপনাপন স্ত্রী-কন্যার ধৰ্ম্ম রক্ষা করিতে সমর্থ হইবে, কেবল তাহার চিন্তাতেই তাহাদিগকে সর্বদা দিন অতিবাহিত করিতে হইত।

ওমানের এই সকল অত্যাচারের কথা ক্রমে তাহার পিতা গোফুর ধার কর্ণগোচর হইতে লাগিল; কিন্তু গোফুর খ তাহার প্রতিকারের কোনরূপ চেষ্টাও করিলেন না।

এইরূপ নানা কারণে, প্রজাগণ ক্রমে তাহাদিগের অবাধ্য হইয়া পড়িতে লাগিল। জমিদারীর খাজনা প্রায়ই তাঁহারা বাকী ফেলিতে লাগিল, বিনা-নালিশে খাজনা আদায় প্রায় একরূপ বন্ধ হইয়া গেল।

এই সকল অবস্থা দেখিয়াও ওসমানের অত্যাচারের কিছু মাত্র নিবৃত্তি হইল না। তাহার কতকগুলি অশিক্ষিত ও দুষ্টমতি পরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী সেই সকল অত্যাচার ক্রমে বৃদ্ধিই হইতে লাগিল। তাহাদিগের অত্যাচারে অনেককেই তাহার জমিদারী পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে হইল। বিশেষতঃ যাহাদিগের গৃহে সু যুবতী স্ত্রীলোক আছে, তাহাদিগের সেই স্থানে বাস করা একবারেই অসম্ভব হইয়া পড়িতে লাগিল।

এরূপ পাপে কতদিবস প্রজাগণ সন্তুষ্ট থাকে। বা ঈশ্বরই আর কতদিবস এ পাপ মার্জনা করেন। ওসমান একজন মধ্যবিদ জমিদারের পুত্র বইত নয়? এরূপ অত্যাচার করিয়া যখন নবাব সিরাজদ্দৌল্লা প্রভৃতিও নিষ্কৃতি পান নাই, তখন এই সামান্য জমিদার-পুত্র যে অনায়াসেই নিষ্কৃতি পাইবেন, তাহা কিছুতেই হইতে পারে না। সমস্ত কার্যেরই সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করিলে যে অবস্থা ঘটিয়া থাকে, ওসমানের অদৃষ্টে যে সেই অবস্থা না ঘটিবে, তাহা কে বলিতে পারে?

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

যে গ্রামে গোর খাঁর বাড়ী, সেই গ্রামের নিকটবর্তী একখানি গ্রামে পুলিসের থানা আছে; সেই থানার ভার প্রাপ্ত কর্ম্মচারী একজন মুসলমান দারোগা। দারোগা সাহেব একজন খুব উপযুক্ত কর্ম্মচারী। জেলার ভিতর তাঁহার খুব নাম আছে, সরকারের ঘরেও তাঁহার বেশ খাতির আছে। কিন্তু তাহার নিজের চরিত্র সাধারণত দারোগা-চরিত্রের বহিত নহে।

দারোগা সাহেবের বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসরের কম নহে, বরং দুই এক বৎসর অধিক হইবারই সম্ভাবনা। পুলিশ বিভাগে প্রথম প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে তাঁহার যেরূপ চরিত্ৰ-দোষ ছিল, এখন তাহা অপেক্ষা অনেক বর্ধিত হইয়া পড়িয়াছে, এবং দিন দিন বর্ষিত হইয়াই চলিয়া যাইতেছে।

কোন গ্রামে কোন একটী মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে গিয়া, একটা রূপবতী যুবতী তাঁহার মজয়ে পতিত হয়। পরিশেষে কোন-না-কোন উপায় অবলম্বন করিয়া, ক্রমে দারোগা সাহেব তাহাকে গৃহের বাহির করেন, এবং থানার সন্নিকটবর্তী কোন এক স্থানে একখানি বাড়ী প্রস্তুত করিয়া দিয়া, তাহাকে সেই স্থানে রাখিয়া দেন। সেই স্ত্রীলোকটা দুই বৎসরকাল সেই স্থানে বাস করিয়া দারোগা সাহেবের মনস্তুষ্টি সম্পাদিত করে।

সেই যুবতী যে সবিশেষ রূপবতী, এ কথা শোক-মুখে ক্রমে প্রকাশিত হইয়া পড়ে, এবং ক্রমে ওসমানের জনৈক পারিষদ এ কথা জানিতে পারিয়া, ওসমানের কর্ণগোচর করিয়া দেয়। যুবতী-রূপবতীর কথা শুনিয়া ওসমান আর তাহার মন স্থির করিতে পারিল না; কোন উপায় অবলম্বন করিলে, সে সেই যুবতীকে হস্তগত করিতে পারিবে, তাহারই চিন্তায় অতিশয় ব্যগ্র হইয়া পড়িল, ও ক্রমে আপন মনোভাব প্রকাশ করিয়া সেই যুবতীর নিকট তোক প্রেরণ করিল।

যুবতী তাহার প্রস্তাবে প্রথমে স্বীকৃত হইল না; কিন্তু ওসমানও তাহার আশা পরিত্যাগ করিল না। যে কোন উপায়েই হউক, তাহাকে আয়ত্ত করিবার নিমিত্ত সবিশেষ রূপ চেষ্টা করিতে লাগিল।

যে স্ত্রীলোক একবার তাহার কুলে জলাঞ্জলি দিয়া পর পুরুষের সহিত চলিয়া আসিয়াছে, এবং এতদিবস পর্যন্ত পরপুরুষেয় সহিত অনায়াসে কালযাপন করিতেছে, সেই স্ত্রীলোককে প্রলোভনে ভুলাইতে আর কতদিন অতিবাহিত হয়? দারোগা সাহেবের বয়ঃক্রম অধিক, ওসমানের বয়ঃক্রম তাহ অপেক্ষা অনেক অর। দারোগা সাহেব পরাধীন, ওসমান স্বাধীন। দারোগা সাহেবকে চাকরীর উপর নির্ভর করিয়া সমস্ত খরচ-পত্ৰ নিৰ্বাহ করিতে হয়, আর ওসমান জমিদার-পুত্র, গোফুর খাঁর মৃত্যুর পর সেই অগাধ জমিদারীর তিনি একমাত্র অধিকারী। যেস্থলে দারোগা সাহেবকে শত মুদ্রা খরচ করিতে হইলে তাহাকে অন্ধকার দেখিতে হয়, সেই স্থলে ওসমান সহস্র মুদ্রা অকাতরে ব্যয় করিতে সমর্থ। এরূপ অবস্থায় সেই স্ত্রীলোকটীকে ওসমানের করায়ত্ব করা নিতান্ত দুরূহ কাৰ্য্য নহে। বলা বাহুল্য, ক্রমে যুবতী ওমানের হস্তগত হইয়া পড়িল; দারোগা সাহেবকে পরি ঊ্যাগ করিয়া সে ওসমানের অনুবর্তিনী হইল। ওসমান তাহাকে সেই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিয়া, কোন লুকা য়িত স্থানে তাহাকে রাখিয়া দিল।

সুন্দরী যে কাহার সহিত কোথায় গমন করিল, এ কথা দারোগা সাহেব প্রথমত জানিতে পারিলেন না; কিন্তু ক্রমে এ সংবাদ জানিতে তাহার বাকী রহিল না। যখন তিনি জানিতে পারিলেন যে, ওসমান তাঁহার মুখের পথে কণ্টক হইয়া তাঁহার যকের ধন অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, তখন তিনি তাহার উপর যেরূপ ক্রোধান্বিত হইয়া পড়িলেন, তাহা বর্ণন করা এ লেখনীর কাৰ্য্য নহে। দারোগা সাহেব প্রথমত সেই সুন্দরীকে পুনরায় আপনার নিকট আনয়ন কয়বার নিমিত্ত সবিশেরূপ চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। এমন কি, দারোগা সাহেব এই কথা জমে ওসমানের পিতার কর্ণ গোচর পর্যন্ত করাইলেন। তাহাতেও কোনরূপ সুফল ফলিল না। ওসমানের পিতা এ বিষয়ে কোনরূপে দারোগা সাহেবকে সাহায্য নিলেন না।

এই সকল কারণে দারোগা সাহেবের প্রচণ্ড ক্রোধের সামান্যমাত্রও উপশম হইল না। কিরূপে তিনি ওসমান ও তাহার পিতাকে ইহার প্রতিশোধ দিতে পারিবেন, তাহার চেষ্টাতেই দিনরাত্রি অতিবাহিত করিতে লাগিলেন, এবং অনবরত প্রতিশোধের সুযোগ অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।

এইরূপে ক্ৰমে এক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল। এই এক বৎসরের মধ্যে দারোগা সাহেব সেই সুন্দরীর আশা পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না, বা প্রতিহিংসার প্রবল চিন্তাকেও হৃদয় হইতে তাড়িত করিতে সমর্থ হইলেন না।

এইরূপে আরও কিছু দিন অতিবাহিত হইয়া গেল। একদিবস প্রাতঃকালে দারোগা সাহেব থানায় বসিয়া আছেন, এরূপ সময়ে একটা লোক গিয়া থানায় উপস্থিত হইল, ও কাঁদিতে দিতে আমোগার সম্মুখীন হইয়া কহিল, বর্ষাবতার। আপনি আমাকে এই বিপদ হইতে রক্ষা করুন। আপনি রক্ষা না করিলে, আর কেই আমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না।

দারোগা। কি হইছে?

আগন্তুক। ওসমান আমার সর্বনাশ করিয়াছে।

দারোগা। ওসমান! কোন ওসমান, গোর ধীর পুত্র ওসমান?

আগন্তুক। মহাশয়!

দারোগা। সে তোমার কি করিয়াছে?

আগন্তুক। সে আমার একমাত্র কন্যাকে জোর করিয়া আমার ঘর হইতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।

দারোগা। কেন সে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গেল?

আগন্তুক। কু-অভিপ্রায়ে সে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।

দারোগা। তোমার কন্যার বয়ঃক্রম কত?

আগন্তুক। সে বালিকা, তাহার বয়ঃক্রম এখনও আঠার বৎসরের অধিক হয় নাই।

দারোগা। তাহার বিবাহ হয় নাই?

আগন্তুক। বিবাহ হইয়াছে বৈ কি। তাহার স্বামী এখনও বর্তমান আছে।

দারোগা। এ সংবাদ তাহার স্বামী শুনিয়াছে?

আগন্তুক। এ সংবাদ তাহার স্বামীকে আমরা দেই নাই। তাহার স্বামী বিদেশে থাকেন। সুতরাং এ সংবাদ তিনি এখনও জানিতে পারেন নাই। তিনি না জানিতে জানিতে যদি আমার কন্যাকে উদ্ধার করিয়া আনিতে পারি, তাহা হইলে এ লজ্জার কথা আমি তাহাকে আর জানিতে দিব না।

দারোগা। তোমার কন্যা ইচ্ছা করিয়া ওসমানের সহিত গমন করে নাই ত?

আগন্তুক। মা মহাশয়! তাহাকে জোর করিয়া ওসমান। ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।

দারোগা। তুমি ইহার প্রমাণ করিতে পারিবে।

আগন্তুক। খুব পারিব, গ্রামশুদ্ধ সব লোক দেখিয়াছে। তাঁহারা সকলেই সত্য কথা কহিবে। আপনি সেই স্থানে গমন করিলেই, দেখিতে পাইবেন, আমার কথা প্রকৃত কি না?

দারোগা। কতক্ষণ হইল, ওসমান তোমার কন্যাকে জোর করিয়া ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।

আগন্তুক। মহাশয় আজ ছয় দিবস হইল।

দারোগা। ছয় দিবস। মিথ্যা কথা। ছয় দিবস হইল, তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, আর আজ তুমি থানায় সংবাদ দিতে আসিলে; তোমার এ কথা কে বিশ্বাস করিবে?

আগন্তুক। মহাশয়! আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করুন, আর না করুন, আমি কিন্তু প্রকৃত কথা কহিতেছি। আমার অনুপস্থিতিতে এই কাৰ্য্য হইয়াছে। আমার বাড়ীতে আমার সেই একমাত্র কন্যা ব্যতীত আর কেহই ছিল না; সুতরাং সুযোগ পাইয়া দুবৃত্ত এই কাৰ্য্য করিয়াছে। তাহার ভয়ে পাড়ার লোক আমাকে পর্যন্ত সংবাদ দিতে সমর্থ হয় নাই। অঙ্গ আমি বাড়ীতে আসিয়া যেমন এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিলাম, অমনি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। এখন আপনি রক্ষা না করিলে, আমার আর উপায় নাই।

দারোগা। তোমার বাড়ী যে গ্রামে, সেই গ্রাম হইতে ওসমানের বাড়ী কতদুর?

আগন্তুক। খুব নিকটে, পার্শ্ববর্তী গ্রামে।

দারোগা। তোমার জমিদার কে।

আগন্তুক। সেই হতভাগাই আমার জমিদার।

দারোগা। জমিদারীর খাজানা তোমার কিছু বাকী আছে।

আগন্তুক। বাকী আছে। মিথ্যা কথা কহিব না, আমি আজ তিন বৎসর খাজানা দিতে পারি নাই।

দারোগা। ফি বৎসর তোমাকে কত টাকা করিয়া খাজান দিতে হয়?

আগন্তুক। সালিয়ানা আমাকে পনর টাকা করিয়া খাজানা দিতে হয়। পঁয়তাল্লিশ টাকা খাজানা আমার বাকী পড়িয়াছে।

দারোগা। সেই খাজানার নিমিত্ত তাঁহারা তাগাদা করে না?

আগন্তুক। তাগাদা কমে বৈ কি, কিন্তু দিয়া উঠিতে পারি না।

দারোগা। যখন তোমার কন্যাকে ওসমান ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল, সেই সময় তাহার সতে আর কোন লোক ছিল?

আগন্তুক। তাহার সহিত আরও চারি পাঁচজন লোক ছিল।

দারোগা। ওসমানের পিতা গোয় খ সেই সঙ্গে ছিলেন?

আগন্তুক। না মহাশয়। তিনি ছিলেন না।

দারোগা। তুমি জান না; তিনি না থাকিলে, কখনও এইরূপ কাৰ্য্য হইতে পারে না। গ্রামের যে সকল ব্যক্তি এই ঘটনা দেখিয়াছে, তাহাদিগকে তুমি ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছ কি?

আগন্তুক। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। কিন্তু কেই সে কথা কহে না। আরও ভাবিয়া দেখুন না কেন, পুল বদি কোন যুবতী রমণীর সতীত্ব নষ্ট করিবার চেষ্টা করে, পিতা কি কখনও তাহার সহায়তা করিয়া থাকেন?

দারোগা। ওসমান শেষে উহার সতীত্ব নষ্ট করিতে পারে; কিন্তু প্রথমতঃ সেই কাৰ্যের নিমিত্ত যে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহা তোমাকে কে বলিল? অপর কোন কারণে সে কি তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া যাইতে পারে না?

আগন্তুক। আর তা কোন কারণ দেখিতে পাইতেছি না, বা শুনিতেও পাইতেছি না।

দারোগা। ওমানের পিতা গোফুর খাঁ এখন কোথায় আছেন, বলিতে পার?

আগন্তুক। তিনি এখন বাড়ীতেই আছেন।

দারোগা। কানপুর হইতে তিনি কবে আসিয়াছেন।

আগন্তুক। পাঁচ ছয় দিবস হইবে।

দারোগা। তাহা হইলে যে দিবস ওসমান তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, সেই দিবস গোয় কান পুর হইতে বাড়ীতে আসিয়াছেন।

আগন্তুক। হাঁ মহাশয়! হয় সেই দিবসই আসিয়াছেন, না হয়, তাহার পরদিন আগমন করিয়াছেন।

দারোগা। তাহা হইলে ঠিক হইয়াছে। তোমার কন্যার ধর্ম নষ্ট করিবার নিমিত্ত ওসমান তোমার দুহিতাকে ধরিয়া লইয়া যায় নাই। গত তিন বৎসর পর্যন্ত তোমার নিকট হইতে খাজনা আদায় না হওয়ায়, সেই খাজনা আদায় করিবার মানসে ওমানের পিতা গোফুর খাঁ আপন পুত্র ওসমান ও তার কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া তোমার বাড়ীতে আগমন করেন। তুমি বাড়ীতে ছিলে না; সুতরাং তাঁহারা তোমাকে বাড়ীতে দেখিতে পান নাই। কিন্তু তুমি যে এতই বাড়ীতে নাই, ইহা না ভাবিয়া, খাজানা দিবার জয়ে তুমি লুকায়িত পাই, এই ভাবিয়া তোমাকে ভয় দেখাইয়া খাজনা আদায় করিয়া লইবার মানসে তোমার একমাত্র কন্যাকে ধরিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত গোফুর খাঁ তাঁহার পুত্রকে আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। পিতার আদেশ পাইয়া ওসমান কয়েকজন লোকের সাহায্যে তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। খাঁ সাহেবও তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিয়াছেন। কেমন, ইহাই প্রকৃত কথা কি না?

আগন্তুক। না মহাশয়। ইহা এত কথা নহে। ওসমানের পিতা সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন না, বা তিনি আদেশ প্রদান করেন নাই। আমার বাকী থানায় নিমিত্তও এটনা ঘটে নাই।

দারোগা। যা ব্যাটা, তবে তোর মোক গ্রহণ করিব। তুই বাড়ীতে হিলি নি, এত কথা যে কি, তাহার তুই কি জানি? আমরা ইতিপূর্বে সকল কথা জানিতে পারিয়াছি, কেবল কোন ব্যক্তি আমার নিকট আসিয়া নালিশ করে নাই বলিয়া, আমি এ পর্যন্ত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই নাই। আমি যেরূপ কহিলাম, সেইপের সাক্ষী সকল সংগ্রহ করিয়া রাখ গিয়া। আমি একজন মাদারকে সঙ্গে দিতেছি, যাহা তুই বুঝতে না পাবি, তিনি তাহা হতাকে বুঝাইয়া দিবেন। তাঁহারা আমি গিন্ধ আসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব।

আগন্তুক। দোহাই ধৰ্মবতায়! যাহাতে আমি আমার কাটীকে পাই, আপনাকে সেই উপায় করতে হবে।

দারোগা। তাহাই হইবে। এখন তুই আমার জমা দারের সহিত গমন করিয়া সাক্ষী-সাবুদের সংগ্রহ করিয়া দে। তুই লেখা-পড়া জানিস্ কি?  আগন্তুক। আমরা চাষার ছেলে, লেখাপড়া শিখি নাই।

দারোগা। নিজের নাম লিখিতে পারি?

আগন্তুক। না মহাশয়! আমি আমার নাম পর্যন্ত লিখিতে পারি না।

দারোগা। তোর নাম কি?

আগন্তুক। আমার নাম শেখ হেদায়েৎ।

দারোগা। আচ্ছা হেদায়েৎ, তুমি আমার জমাদারের সহিত তোমার গ্রামে গমন কর। আহারান্তে আমি নিজে গিয়া এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব। সাক্ষীগণ যেন উপস্থিত থাকে।

হেদায়েৎকে এই কথা বলিয়া, দারোগা সাহেব তাহার একজন সবিশেষ বিশ্বাসী জমাদারকে ডাকিলেন, এবং নির্জনে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাহার সহিত কি পরামর্শ করিয়া পরি শেষে তাহাকে কহিলেন, এই মোকদ্দমায় বিশেষরূপে তোমাকে আমার সাহায্য করিতে হইবে। যে সুযোগ পাইয়াছি, সে সুযোগ কিছুতেই পরিত্যাগ করিতে পারিব না। আমার কোন ক্ষমতা কাছে কি না, এবং আমার ঘর ওসমান ও তার পিতার কোনরূপ অনিষ্ট ঘটতে পারে কি না, তা তাহা তাহাদিগকে উত্তমরূপে দেখাইতে হইবে। যেরূপ উপায়েই হউক, উঁহাদিগের উভয়কেই জেলে দিয়া আমার এতদিসের মনের যন্ত্রণা নিবারণ করিতে হইবে।

দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া জমাদার কহিল, আপনি যত শীঘ্র হয়, আগমন করুন। আমি সেই স্থানে গমন করি মাত্রই সমস্ত ঠিক করিয়া ফেলিব। তাহার নিমিত্ত আপনাকে ভাবিতে হইবে না

এই বলিয়া হেদায়েৎকে সঙ্গে লইয়া জমাদার তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

জমাদার ও হেদায়েৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, দারোগা সাহেব প্রথমে এতেলা পুস্তক নিজ হস্তে গ্রহণ করিয়া, নিম্নলিখিতরূপে প্রথম এতেল ফরিয়াদীর অসাক্ষাতেই লিখিলেন।

আমার নাম সেখ হেদায়েৎ। আমার বাসস্থান * * * গ্রাম। গত আটদিবস হইতে আমি আমার বাড়ীতে ছিলাম না, * * * গ্রামে আমার কুটুম্ব * * *-র নিকট আমি আমার কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে গমন করিয়াছিলাম। আমার বাড়ীতে অপর কেহ নাই; কেবলমাত্র আমার যুবতী কন্যা * * *-কে আমি বাড়ীতে রাখিয়া গিয়াছিলাম। অন্য প্রাতঃকালে আমি বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়া, আমার কন্যাকে আমার বাড়ীতে দেখিতে পাইলাম না। পাড়া-প্রতিবাসীগণের নিকট অনুসন্ধান করিয়া আনিতে পারিলাম যে, আমাদিগের গ্রামের জমিদার গোফুর খাঁ তাহার পুত্র ওসমান এবং কয়েকজন কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া খাজনা আদায় করিবার নিমিত্ত আমাদিগের গ্রামে আগমন করেন, এবং গ্রামের এক স্থানে বসিয়া প্রজাগণকে ডাকাইয়া খাজানার তহবিল করিতে থাকেন। শুনিলাম, আমাকেও ডাকিবার নিমিত্ত তিনি একজন পাইক পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। আমি বাড়ী ছিলাম না। সুতরাং পাইক আমাকে দেখিতে পায় নাই। মে গিয়া জমিদার মহাশয়কে কহে, হেদায়েৎ বাড়ীতে নাই, কেবল তাহার কন্যা বাড়ীতে আছে। সে কহিল, তাহার পিতা অদ্য দুই দিবস হইল, কুটুম্ব বাড়ীতে গমন করিয়াছে। এই কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় অতিশয় ক্রোধাবিত হইলেন ও কহিলেন, হেদায়েৎ কোন স্থানে যায় নাই। অনেক টাকা খাজানা বাকী পড়িয়াছে, আমার নিকট আসিলে খাজনা দিতে হইবে, এই ভয়ে সে লুক্কায়িত আছে। যা হক তাহার কন্যাকে ধরিয়া আন, তাহা হইলে সে এখনই আসিয়া খাজনা মিটাইয়া দিবে। এই আদেশ পাইয়া জমিদারের পুত্র ওসমান কয়েকজন কর্ম্মচারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে আমার বাড়ী হইতে তার অনিচ্ছা-স্বত্বে জোর করিয়া তাহাকে ধরিয়া জমিদার মহাশয়ে নিকট লইয়া যায়। জমিদার মহাশ প্রায় দুই ঘণ্টা তাহাকে সেই স্থানে বসাইয়া রাখেন। যুবতী স্ত্রীলোকের এইরূপ অবমাননা দেখিয়া, গ্রামস্থ সমস্ত লোক আমার কন্যাকে ছাড়িয়া দিবার নিমিত্ত জমির মহাশয়কে বার বার অনুরোধ করেন; কিন্তু তিনি কাহারও কথায় কর্ণপাত না করিয়া, সেই স্থান হইতে গমন করিবার সময় তাঁর পুত্র ওসমান ও অপরাপর কৰ্ম্ম চারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে বাঁধিয়া তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগের বাড়ী পর্যন্ত লইয়া যান। বাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়া, তাঁহারা যে আমার কন্যার কি অবস্থা করিয়াছেন, তাহা আমি অবগত নহি। সেই পর্যন্ত আমার কন্যা আর প্রত্যাগমন করে নাই, বা গ্রামের কোন ব্যক্তি আর তাহাকে দেখে নাই। আমার অনুমান ও বিশ্বাস যে, জমিদার মহাশয় এবং তাহার পুত ওসমান আমার কন্যাকে তাহার বিনা-ইচ্ছায় তাহাদিগেয় বাড়ীর ভিতর অন্যায়রূপে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, বা তাহাকে হত্যা করিয়াছে। আমি আপন ইচ্ছায় আমার কন্যাকে পাইবার মানসে এই এজাহার দিতেছি। ইহাতে যেরূপ অনুসন্ধানের প্রয়োজন, সেইরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া আমার কন্যাকে বাহির করিতে, আজ্ঞা হয়। আমি যে এজাহার দিতেছি, গ্রামশুদ্ধ সমস্ত লোক তাহার সাক্ষী আছে। সেই স্থানে গমন করিলেই, আপনি জানিতে পারিবেন যে, আমার কথা সম্পূর্ণরূপ সত্য কি না আমি লেখা-পড়া জানি না, আমার এজাহার যায় আপনি লিখিয়া লইলেন, তাহা পাঠ করিয়া পুনরায় আমাকে আপনি শুনাইয়া দিলেন; আমি যেরূপ বলিয়াছি, ঠিক সেই রূপই লেখা হইয়াছে। আমি আমার এজাহার শুনিয়া, আমি এই স্থানে নিশানসহি করিলাম। ইতি–

নিশানসহি-সেখ হেদায়েৎ।

দারোগা সাহেব প্রথম এতো পুস্তকে এইরূপ এজাহার লিখিয়া উপযুক্তরূপ লোকজন সমভিব্যাহারে এই অনুসন্ধানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। তাহার সহিত গমন করিবার নিমিত্ত যে সকল লোকজনের উপর আদেশ হইল, তাঁহারাও আহারাদি করিয়া ক্ৰমে প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।

সন্ধ্যায় একটু পূর্বে দারোগা সাহেব তাহার লোকজন সমভিব্যাহারে হেদায়েতের গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। হেদায়েতের সমভিব্যাহারে জমাদার সাহেব পূর্বেই সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন। সুতরাং দারোগা সাহেব সেই স্থানে গমন করিলে তাহার যে সকল বিষয়ের প্রয়োজন হইবার সম্ভাবনা, তাহার সমস্তই তিনি সেই স্থানে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন; অর্থাৎ বসিবার স্থান, লোকজন, রাত্রিকালের আহারাদির বন্দোবস্ত সমস্তই ঠিক ছিল। তাহার উপর গ্রামস্থ প্রায় সমস্ত লোকই সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন।

দারোগা সাহেব সেই রাত্রি সেই গ্রামে আহারাদি করিয়া রাত্রিযাপন করিলেন মাত্র; কিন্তু যে বিষয় অনুসন্ধানের নিমিত্ত তিনি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান করা দূরে থাকুক, গ্রামস্থ কোন ব্যক্তিকে সে বিষয়ের কোন একটা কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। আহারাদি করিয়া রাত্রিকালে যখন দারোগা সাহেব শয়ন করিলেন, সেই সময় তাঁহার আদেশ গ্রহণ করিয়া, গ্রামস্থ সমস্ত লোক প্রস্থান করিলেন; কিন্তু গমন করিবার সময় দারোগা সাহেব তাহাদিগকে পরদিবস অতি প্রত্যুষে পুনরায় সেই স্থানে আসিতে কহিলেন। সমস্ত লোক গমন করিবার পর দারোগা সাহেব জমাদারের সহিত অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ করিয়া উভয়েই নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন।

পরদিবস অতি প্রত্যুষেই দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালিত হইল। সকলে আগমন করিবার পর একে একে তিনি সমস্ত লোককেই দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাদিগের কোন কথা এখন তিনি কাগজ-কলমে করিলেন না; তবে দেখা গেল, সেই সকল লোক যাহা কহিল, তাহার ছত্রে ছত্রে প্রথম এতেলার সহিত মিলিয়া গেল। দারোগা সাহেব নিজের ইচ্ছামত যেরূপ ভাবে প্রথম এতেলা লিখিয়াছিলেন, গ্রামস্থ সমস্ত লোকেই যখন সেইরূপ ভাবে তাহাদের এজাহার প্রদান করিল, তখন তিনি সেই সকল বিষয় কাগজপত্রে না লিখিয়া আর স্থির থাকিতে পারিলেন না।

গ্রামের প্রধান প্রধান চারি পাঁচজনের এজাহার দারোগা সাহেব লিখিয়া লইলেন। গ্রামের কোন লোক ওমানের উপর সন্তুষ্ট ছিল না। সুতরাং সকলেই ওসমান ও তাহার পিতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করিল। সকলেই কহিল যে, হেদায়েতের নিকট হইতে খাজনা আদায় করিবার নিমিত্তই এই গোলযোগ। হোয়েতের কন্যাকে লাইক করিয়া রাখিলেই খাজনা আদায় হইবে, এই ভাবিয়া গোরখা তাহাকে ধরিয়া আনিবার নিমিত্ত আদেশ প্রদান করেন। তাঁহার পুত্র ওসমান অপর কয়েকজন লোকের সাহায্যে এই আদেশ প্রতিপালন করে। পরিশেবে উহার কন্যাকে ধরিয়া তাঁহা দিগের বাড়ীতে লইয়া যায়।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

ওসমান ও তাহার পিতাকে বিপদাপন্ন করিবার মানসে দারোগা সাহেব যাহা মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন, কাৰ্য্যেও তাহা পরিণত হইতেছে দেখিয়া, মনে মনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন।

সেই স্থানে অনুসন্ধান আপাততঃ স্থগিত রাখিয়া হেদায়েৎ ও গ্রামের দুই চারিজন লোককে সঙ্গে লইয়া গোফুর খাঁন বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন।

গোফুর খাঁ সেই সময় বাড়ীতেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ওসমান সেই সময় বাড়ীতে ছিল না। গোফুর খাঁর সহিত দারোগা সাহেবের কিয়ৎক্ষণ কথাবার্তা হইলে পর, ওসমান আসিয়া সেই স্থানে কোথা হইতে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া দারোগা সাহেব কহিলেন, আপনার উপর একটা ভয়ানক নালিশ হইয়াছে। যে পর্যন্ত আমি অনুমতি প্রদান না করি, সেই পৰ্যন্ত আপনি আমার সম্মুখ হইতে গমন করিবেন না।–

ওসমান। আর যদি আমি চলিয়া যাই?

দারোগা। তাহা হইলে আপনার সহিত ভদ্রোচিত ব্যবহার করিতে আমি কোনরূপেই সমর্থ হইব না। সামান্য লোককে যেরূপ ভাবে আমরা রাখিয়া থাকি, বাধ্য হইয়া আপনাকেও সেইরূপ ভাবে আমাকে রাখিতে হইবে।

গোফুর। আমার উপর অভিযোগ কি?

দারোগা। আপনার আদেশ অনুযায়ী আপনার গ্রামবাসী আপনারই প্ৰজা হেদায়েতের যুবতী কন্যাকে অন্যায়রূপে আজ কয়েকদিবস হইতে আপনার বাটীতে আনিয়া আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে।

গোফুর। আমার আদেশ অনুযায়ী?

দারোগা। প্রমাণে সেইরূপ অবগত হইতে পারিতেছি।

গোফুর। আমি তাহাকে আবদ্ধ করিতে আদেশ প্রদান করিব কেন?

দারোগা। বাকী খাজানা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে।

গোফুর। মিথ্যা কথা।

দারোগা। সত্য মিথ্যা আমি অবগত নহি; প্রমাণে যাহা পাইতেছি, তাহাই আমি আপনাকে বলিতেছি। আর সেই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া আমাকে ইহার প্রতিবিধান করিতে হইবে।

গোফুর। আপনি প্রমাণ পাইতেছেন, আমার আদেশে এই কাৰ্য্য হইয়াছে?

দারোগা। হাঁ।

গোফুর। আমার আদেশ প্রতিপালন করিল কে? অর্থাৎ কে তাহাকে ধরিয়া আনিল?

দারোগা। আপনার পুত্র, এবং আর তিন চারিজন নোক।

গোফুর। সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আপনি এখন কি করিতে চাহেন?

দারোগা। আপনি যদি সহজে সেই স্ত্রীলোকটীকে বাহির করিয়া না দেন, তাহা হইলে প্রথমতঃ আপনার বাড়ী আমি উত্তমরূপে খানাতল্লাসি করিয়া দেখিব। দেখিব, উহার ভিতর সেই স্ত্রীলোকটা পাওয়া যায়, কি না।

গোফুর। আর যদি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে কি হইবে?

দারোগা। সে পরের কথা; যাহা হয়, পরে দেখিতে পাইবেন।

ওসমান। কার হুকুম মত আপনি আমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে চাহেন? বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করি বার কোন ওয়ারেন্ট আছে কি?

দারোগা। কাহার হুকুম মত আমি তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে চাই, তাহা তুমি বালক, জানিবে কি প্রকারে? আমি আমার নিজের হুকুমে তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিব।

ওসমান। যদি প্রবেশ করিতে না দি?

দারোগা। তোমার কথা শোনে কে?, আমি জোর করিয়া প্রবেশ করিব। তাহাতে যদি তুমি কোনরূপ প্রতি বন্ধকতা জন্মাও, তাহা হইলে তোমায় অপর আর এক মোকদ্দমায় আসামী হইতে হইবে।

ওসমান। যাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবেন, তাহাকে যদি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে জবাবদিহি কে করিবে? আপনি করিবেন কি?

দারোগা। যাহাকে জবাবদিহিতে আনিতে পারিবে, সে-ই জবাবদিহি করিবে।

ওসমান। আর যদি সে আপন ইচ্ছায় আমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া থাকে?

দারোগা। সে উত্তম কথা; সে আসিয়া আমাদিগের সম্মুখে সেই কথাই বলুক। তাহা হইলেই সকল গোলযোগ মিটিয়া যাইবে।

গোফুর। তবে কি স্ত্রীলোকটা আমাদের বাড়ীতে আছে?

ওসমান। না, সে আমাদের এখানে আসেও নাই, বা আমাদিগের এখানে নাইও।

দারোগা। মহাশয়! আমি আর অধিক বিলম্ব করিতে পারিতেছি না। এখন কি করিতে চাহেন, বলুন। স্ত্রীলোকটাকে কি আমার সম্মুখে আনিয়া দিবেন, না আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া থানাতল্লাসি করিতে আরম্ভ করিব?

গোফুর। আমি ত বলিতেছি, সেই স্ত্রীলোকটা আমা দিগের বাড়ীতে নাই। আমার কথায় আপনি বিশ্বাস না করেন, আপনার যাহা অভিরুচি হয়, তাহা আপনি করিতে পারেন। কিন্তু, আমি পূর্বেই আপনাকে সতর্ক করিয়া দিতেছি, যাহা করিবেন, ভবিষ্যৎ ভাবিয়া করিবেন।

দারোগা। আমার কাৰ্য আমি বুঝি, তাহার নিমিত্ত আমি আপনার নিকট উপদেশ গ্রহণ করিতে আসি নাই। আমি লোকজনের সহিত আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেছি, ইচ্ছা করেন যদি, তাহা হইলে আপনার বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগকে কোন একটা গৃহের ভিতর গমন করিবার নিমিত্ত বলিতে পারেন। আর ইচ্ছা না করেন, তাহাতে আমার কোনরূপ ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই।

এই বলিয়া দারোগা সাহেব আপনার সমভিব্যাহারী লোকজনের সহিত বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার অভিপ্রায়ে উথিত হইলেন। তখন অনন্যোপায় হইয়া গোফুর খাঁ, ওসমান, এবং সেই সময় সেই স্থানে গোফুরের বন্ধু-বান্ধব গণের মধ্যে যাহারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারাও সকলে দারোগা সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিবার নিমিত্ত উথিত হইলেন।

দারোগা সাহেব প্রথমেই অন্দরমহলের মধ্যে প্রবেশ করিলেন না। সদর বাড়ীর ভিতর যে সকল গৃহ ছিল, প্রথমেই সেই সকল গৃহের মধ্যে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এক একখানি করিয়া সৰ্ব্বপ্রথমে সমস্ত খোলা ঘরগুলি দেখিলেন। তাহার ভিতর কিছু দেখিতে না পাইয়া, পরি শেষে যে ঘরগুলিতে চাবি বদ্ধ ছিল, চাবি খুলিয়া সেই ঘর গুলিও একে একে দেখিতে লাগিলেন।

গোফুর খাঁর প্রকাণ্ড বাড়ী; সুতরাং সদরে ও অন্দরে অনেক ঘর। বাহিরের ঘরগুলি দেখিতে প্রায় দুই ঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইয়া গেল। এইরূপে তালাবদ্ধ কতকগুলি ঘর দেখিবার পর এক পার্শ্বের এক নির্জন গৃহের তালা খুলিলেন। সেই গৃহের ভিতর অপর দ্রব্য-সামগ্রী কিছুই ছিল না, কেবল গৃহের মধ্যে একখানি পালঙ্কের উপর একটা বিছানা আছে মাত্র।

সেই বিছানার সন্নিকটে গিয়া বা দেখিলেন, তাহাতে সমস্ত লোকেই একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। ইতি পূর্বে দারোগা সাহেব যাহা স্বপ্নেও একবার মনে ভাবেন নাই, তিনি তাহা দেখিয়াই যেন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণের নিমিত্ত যেন তাহার সংজ্ঞাও বিলুপ্ত হইল। একটু পরেই দারোগা সাহেব কহিলেন, কি মহাশয়। এ কি দেখিতেছি?

দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া আর কাহারও মুখে কোন কথা বাহির হইল না। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে দেখিতে লাগিলেন। কেবল হেদায়েৎ সেই বিছানার সঙ্গিক বৰ্ত্তী হইয়া কহিল, মহাশয়! এই আমার কন্যা।

এই বলিয়া হেদায়েৎ তাহার কন্যার গাত্রে হস্তাপণ করিয়া বার বার তাহাকে ডাকিতে লাগিল; কিন্তু সে নড়িল না, যা তাহার কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না। তখন সকলেই জানিতে পারিল যে, সে আর জীবিত নাই।

দারোগা। প্রথমতঃ বড় লম্বা লম্বা কথা কহিতেছিলে যে, এখন আর মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছে না কেন?

গোফুর। ইহার ব্যাপার আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

দারোগা। এখন ত কিছুই বুঝিতে পারিবেন না। এই স্ত্রীলোকের মৃতদেহ এই তালাবন্ধ গৃহের ভিতর কিরূপে আসিল?

গোফুর। আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।

দারোগা। (ওসমানের প্রতি) কিগো ওসমান মিঞা, আপনিও বোধ হয়, ইহার কিছুই জানেন না?

ওসমান। না মহাশয়! আমিও ইহার কিছুই অবগত নহি।

দারোগা। সদর বাড়ীর ভিতর তালাবদ্ধ গৃহে, পালঙ্কের। উপর মৃত স্ত্রীলোকের লাস রহিয়াছে। আর আপনারা বলিতেছেন যে, আপনারা কিছুই জানেন না। দ্বারে যে দ্বারবান বসিয়া আছে, সেও বলিবে, আমি কিছুই জানি না। কিন্তু কিরূপে এই স্থানে লাস আসিল, ইহার যদি সন্তোষ জনক প্রমাণ আমাকে আপনারা প্রদান করিতে না পারেন, তাহা হইলে জানিবেন, আপনাদিগের উভয়কেই আমি ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলাই।

দারোগার কথা শুনিয়া গোফুর খাঁ চতুর্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন, এবং এই অবস্থায় কি করিবেন, তাহার কিছুই স্থির করতে না পারিয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িলেন।

দারোগা। কি মহাশয়। আপনি চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন যে? এই লাস কিরূপে আপনার বাড়ীর ভিতর আসিল, সে সম্বন্ধে কোন কথা বলিতেছেন না কেন?

গোফুর। আপনার কথায় আমি যে কি উত্তর প্রদান করিব, তাহা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। যখন ইহার কিছুই আমি অবগত নহি, তখন আমি আপনাকে আর কি বলিব?

দারোগা। কিগো দ্বারবান্ সাহেব! এ সম্বন্ধে তুমি কি বলিতে চাই?

দ্বারবান্। দোহাই ধর্মাবতার! আমি ইহার কিছুই জানি না।

দারোগা। তুমি দ্বারবান, সর্বদা তুমি দরজায় বসিয়া থাক, অথচ তুমি বলিতেছ, তুমি ইহার কিছুই জান না। এ কথা কি কেহ সহজে বিশ্বাস করিতে পারে?

দ্বারবান্। আপনি বিশ্বাস করুন, আর না করুন, আমি প্রকৃত কথাই বলিতেছি। আমি প্রকৃতই জানি না যে, এই মৃতদেহ কিরূপে বা কাহা কর্তৃক এই বাড়ীর ভিতর আসিল।

গোফুর খাঁ, ওসমান ও দ্বারা যখন কোন কথা বলিল না, তখন সেই সময় দারোগা সাহেব তাহাদিগকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, নিজের ইচ্ছামত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন।

লাশের সুরতহাল করিয়া পরীক্ষার্থ উহ জেলার ডাক্তার সাহেবের নিকট প্রেরণপূর্বক ঘটনাস্থলে বসিয়া দারোগা সাহেব কয়েকদিবস পর্যন্ত অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এখনকার অনুসন্ধান আসামীগণকে লইয়া নহে; এখনকার অনুসন্ধান, ফরিয়াদী ও সেই স্থানের প্রজাগণের সাহায্যে এবং জমাদার সাহেবের আন্তরিক যত্নের উপর নির্ভর করিয়াই হইতে লাগিল। অর্থাৎ গোফুর খাঁ ও তাঁহার পুত্রের বিপক্ষে এই হত্যা সম্বন্ধে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইতে পারে, এখন সেই অনুসন্ধানই চলিতে লাগিল।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

পাঠকগণ পূর্ব হইতেই অবগত আছেন যে, গোফুর খাঁ একজন নিতান্ত সামান্য লোক নহেন। দেশের মধ্যে তাঁহার মান-সন্ত্রম যেরূপ থাকা আবশ্যক, তাহার কিছুরই অভাব নাই। অর্থও যথেষ্ট আছে। কিন্তু এই সকল থাকা স্বত্বেও প্রজাগণ কেহই তাহার উপর সন্তুষ্ট নহে; সকলেই তাঁহার বিপক্ষ। প্রজাগণ গোর খার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইবার একমাত্র কারণ, তাঁহার পুত্র ওসমান। ওসমানের অত্যাচারে সকলেই সবিশেষরূপ জ্বালাতন হইয়া পড়িয়াছে। যখন ওমামের অত্যাচার তাঁহারা সময় সময় সহ করিয়া উঠিতে সমর্থ হয় নাই, তখন তাঁহারা তাহার পিতা গোফুর খাঁর নিকট পর্যন্ত গমন করিয়া, ওসমানের অআচারের সমস্ত কথা তাহার নিকট বিবৃত করিয়াছে। তথাপি গোফুর তাহাদিগের কথায় কোনরূপ কর্ণপাত করেন নাই, বা তাহার প্রতিবিধানের কোনরূপ চেষ্টাও করেন নাই। এই সকল কারণে প্ৰজামাত্রেই পিতা-পুত্রের উপর অস। সুতরাং আজ তাঁহারা যে সুযোগ পাইয়াছে, সেই সুযোগ পরিত্যাগ করিবে কেন? তাহার উপর দারোগা সাহেব সহায়।

প্রজাগণ এক বাক্যে গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্র ওসমানের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতে লাগিল। অনুসন্ধান সমাপ্ত হইলে, দারোগা সাহেব দেখিলেন, নিম্নলিখিত বিষয় সম্বন্ধে উপস্থিত মোকদ্দমায় উত্তমরূপে প্রমাণ হইয়াছে।

১ম। সেখ হেদায়েতের যে গ্রামে বাড়ী, সেই গ্রামের প্রজাগণের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, গোফুর খাঁ ও ওসমান বকেয়া খাজানা আদায় করিতে সেই গ্রামে গমন করেন। হেদা য়েতের নিকট কয়েক বৎসরের খাজানা বাকী পড়ায়, এবং হেদায়েৎ সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত না থাকায়, ওসমান গোফুর খাঁর আদেশমত কয়েকজন পাইকের সাহায্যে, হেদা যেতের একমাত্র যুবতী কন্যাকে বলপূর্বক তাহার বাড়ী হইতে সৰ্ব্বসমক্ষে ধরিয়া আনে, এবং তাহার নিকট হইতে খাজানা আদায় করিবার মানসে গোফুর খাঁর আদেশমত সৰ্ব্ব সমক্ষে তাহাকে সবিশেষরূপে অবমানিত করে। কিন্তু তাহার নিকট হইতে খাজনা আদায় না হওয়ায়, গোয় খ ও ওসমান অপরাপর লোকের সাহায্যে তাহাকে সেই স্থান হইতে বলপূর্বক ধরিয়া আপন গৃহাভিমুখে লইয়া যান।

২য়। অপরাপর গ্রামের কতকগুলি প্ৰজার দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, হেদায়েতের কন্যাকে হেদায়েতের গ্রাম হইতে ধৃত অবস্থায় গোফুর খাঁর গ্রামে গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্র কর্তৃক লইয়া যাইতে অনেকেই দেখিয়াছে।

৩য়। গোফুর খাঁর গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী প্রজাবর্গের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, হেদায়েতের কন্যাকে গোয় খা ও ওসমান তাঁহাদিগের বাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়াছে।

৪র্থ। গোফুর খাঁর কয়েকজন ভৃত্য ও তাহার সেই পূর্ব বর্ণিত দ্বারবানের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, গোফুর খাঁর আদেশমত ওসমান হেদায়েতের সেই কন্যাকে আপনাদের গৃহের ভিতর আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, এবং যে পর্যন্ত সে জীবিত ছিল, তাহার মধ্যে ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় সে নিতান্ত অস্থির হইলেও, তাহাকে একমুষ্টি অন্ন বা এক গণ্ডুষ জল প্রদান করিতে বারণ করিয়াছিল। এমন কি, সাক্ষিগণের মধ্যে কেহ দয়াপরবশ হইয়া উহাকে এক গণ্ডষ পানীয় প্রদান করিতে উদ্যত হইলে, গোফুর ও তাঁহার পুত্র ওসমান খ। তাহাকেও উহা প্রদান করিতে দেন নাই।

এতদ্ব্যতীত আরও প্রমাণিত হইল যে, যে দিবস পুলিস কর্তৃক লাস বাহির হইয়া পড়ে, তাহার দুই কি তিন দিবস পূর্বে একজন ভৃত্য কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, ওসমান খার নিকট হইতে সেই গৃহের চাবি অপহরণ করে, এবং ওসমান ও গোফুর খাঁর অসাক্ষাতে সেই গৃহের চাবি খুলিয়া দেখিতে পায় যে, ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা এরূপ হইয়া পড়িয়াছে যে, তাহার আর বাঁচিবার কিছুমাত্র আশা নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই সামান্য ভৃত্যেরও অন্তরে দয়ার উদ্রেক হইল, এবং দ্বারধানের সহিত পরামর্শ করিয়া, সে ইহা স্থির করিল যে, তাহার অদৃষ্টে যাহাই হউক, সে আজ সেই হতভাগিনীকে কিছু আহারীয় ও পানীয় প্রদান করিবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সে কিছু আহারীয় ও পানীয় আনয়ন করিবার নিমিত্ত গমন করে। কিন্তু উহা সংগ্রহ করিয়া পুনরায় সেই স্থানে আসিয়া দেখিতে পায় যে, ওসমান খাঁ সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ভূতের অভি সন্ধির কথা জানিতে পারিয়া, ওসমান তাহার উপর সবিশেষ রূপ অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহার হস্ত হইতে আহাৰীয় ও পানীয় কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করেন। তৎপরে, সেই স্ত্রীলোকটী আহারীয় ও পানীয় প্রার্থনা করিয়াছে, এই ভাবিয়া ওসমান সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করেন, ও সেই মহা অপরাধের জন্য সেই সময় সেই স্থানে যে সকল ভৃত্যাদি উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের সম্মুখে সেই মৃত্যুশয্যা-শায়িত স্ত্রীলোকটীকে পদাঘাত করেন। সেই সময় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা এরূপ হইয়া পড়িয়াছিল যে, তাহার কথা কহিবার বা রোদন করিবার কিছুমাত্র ক্ষমতা ছিল না; সুতরাং সেই পদাঘাত সে বিনা-বাক্যব্যয়ে অনায়াসেই সহ করে। পরিশেষে ওসমান সেইরূপ অবস্থাতেই সেই স্ত্রীলোকটীকে সেই গৃহের ভিতর রাখিয়া, পুনরায় সেই গৃহের দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দৈন, এবং চাবি লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করেন। ভৃত্য গোয় খার নিকট গমন করিয়া তাহার নিকট এই সমস্ত ঘটনা বর্ণন করে। গোর খ ইহার প্রতিবিধানের পরিবর্তে, সেই ভৃত্যের উপরই বরং অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহাদিগের বিনা-অনুমতিতে সেই স্ত্রী লোকটীকে আহারীয় ও পানীয় দিতে উদ্যত হইয়াছিল বলিয়া, তাহাকে কটুক্তি করিয়া গালি প্রদান করেন, ও চাকরী হইতে তাহাকে বিতাড়িত করেন।

৫ম। পুলিসের সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর সেই যুবতী কন্যার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। আরও প্রমাণিত হইল যে, যে গৃহে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই গৃহের তালার চাবি গোফুর খাঁর নিদর্শনমত ওসমান খাঁর নিকট হইতে পাওয়া গিয়াছে।

৬ষ্ঠ। একজন পাইক,যে গোর খার পাইক বলিয়া পরিচয় প্রদান করিল,—তাহার দ্বারা এই ঘটনার আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা প্রমাণিত হইল; অর্থাৎ খাজানা আদায় করি বার নিমিত্ত হেদায়েতের বাড়ী হইতে সেই স্ত্রীলোককে আনয়ন হইতে, গোফুর খাঁন বাড়ীর ভিতর লাস পাওয়া পর্যন্ত যে সকল ঘটনা অপরাপর সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হইল, তাহার সমস্ত অংশেই এই পাইক সৰ্ব্বতোভাবে পোষকতা করিল।

৭ম। লাস পরীক্ষাকারী ডাক্তার সাহেবের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, অনাহারই সেই স্ত্রীলোকটীর মৃত্যুর কারণ।

৮ম। এই সকল প্রমাণ ব্যতীত অপর আর কোনরূপ প্রমাণের যাহা আবশ্যক হইল, তাহাও প্রজাগণের দ্বারা প্রমাণিত হইতে বাকী রহিল না।

এই মোকদ্দমায় গোফুর খা ও তাঁহার পুত্রের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইল, তাহা দেখিয়া গোফুর খাঁ বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, এই বৃদ্ধ বয়সে কোনরূপেই তাঁহার আর নিষ্কৃতি নাই। আরও বুঝিতে পারিলেন যে, দারোগা সাহেবের পূর্বোক্ত স্ত্রীলোকটীকে তাঁহার পুত্র বাহির করিয়া জানায়, এবং দারোগা সাহেব তাহার নিকট তাহার পুত্রের বিপক্ষে নালিশ করিলেও, তিনি তাহার কোনরূপ প্রতিবিধানের চেষ্টা করেন না বলিয়াই, দারোগা সাহেবের সাহায্যে তাঁহার এই সর্বনাশ উপস্থিত হইল। কিন্তু তিনি বড়ই আশ্চর্যান্বিত হইলেন যে, হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ তাঁহার বাড়ীর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর কিরূপে আসিয়া উপস্থিত হইল। যখন প্ৰজামাত্রই বলিতেছে যে, গোফুর খাঁ তাহার পুত্রের ন্যায়, সকলই অবগত আছেন, তখন গোফুর খাঁ এ সম্বন্ধে কিছুই অবগত নহেন, বা তাহার জ্ঞাতসারে এ কাৰ্য ঘটে নাই, এ কথা বলিলেই বা কোন বিচারক তাহা বিশ্বাস করিবেন?

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

গোফুর খাঁর একজন অতি বিশ্বাসী কর্ম্মচারী ছিলেন, তাহার নাম হোসেন। পুলিস যখন প্রথম অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করেন, বা যে সময় গোফুরের গৃহে হেদায়েতের কন্যার মৃত দেহ পাওয়া যায়, সেই সময় হোসেন সেই স্থানে উপস্থিত ছিল না; জমিদারীর কাৰ্য্য পৰ্যবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত তিনি স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার মনিবের এইরূপ বিপদ উপস্থিত হইয়াছে জানিতে পারিয়া, জমিদারী হইতে তিনি আপনার মনিবের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, মনিব ও মনিব-পুত্র উভয়েই হত্যাপরাধে ধৃত হইয়া ছেন। তাহাদিগের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা জানিতে পারিয়া, তিনি অতিশয় ভাবিত হইলেন। তখন এই বিপদ হইতে তাহার মনিবকে কোনরূপে উদ্ধার করিবার উপায় দেখিতে না পাইয়া, নির্জনে গিয়া তিনি একদিবস রাত্রি কালে দারোগা সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।

দারোগা সাহেব তাহাকে পূর্ব হইতেই চিনিতেন। তাহাকে দেখিবামাত্রই কহিলেন, কি হে হোসেনজি! কি মনে করিয়া?

হোসেন। আর মহাশয়! কি মনে করিয়া! কি মনে করিয়া আমি আপনার নিকট আসিয়াছি, তাহা আর আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না কি?

দারোগা। আপনি কি মনে করিয়া আসিয়াছেন, তাহা আমি কিরূপে বুঝিতে পারিব? আপনার অন্তরের কথা আমি কিরূপে জানিব?

হোসেন। সে যাহা হউক, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন আপনি কোনরূপে উঁহাদিগকে না বাঁচাইলে, আর বাঁচিবার উপায় নাই।

দারোগা। কাহাদিগকে বাঁচাইতে হইবে? তোমার মনিব ও মনিক-পুত্রকে?

হোসেন। তদ্ভিন্ন আমি এই সময় আর কাহার জন্য আপনার নিকট আসিব?

দারোগা। আগে যদি আপনি আসিতেন, তাহা হইলে উঁহাদিগকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতে পারিতাম, কিন্তু এখন সে চেষ্টা বৃথা। এখন আমার ক্ষমতার অতীত হইয়া পড়িয়াছে।, হোসেন। যে পর্যন্ত মোকমার চুড়ান্ত বিচার শেষ হইয়া না যায়, সে পর্যন্ত আপনার ক্ষমতার সীমা এড়াইতে পারে না। এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন। আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিতে, বা যাহা চাহিবেন, তাহাই প্রদান করিতে প্রস্তুত। এখন যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া হউক, উঁহাদিগের প্রাণ আপনাকে রক্ষা করিতেই হইবে।

দারোগা। দেখুন হোসেন সাহেব, এ পর্যন্তু ওসমান যেরূপ অত্যাচার করিয়া আসিতেছে, তাহাতে উহার প্রতি কাহার দয়া হইতে পারে? আপনি ত অনেক দিবস হইতে গোফুর খাঁর নিকট কৰ্ম্ম করিয়া আসিতেছেন; বলুন দেখি, তাঁহার প্রজাগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি ওসমানের অত্যাচারে প্রপীড়িত হইতে বাকী আছে। বলুন দেখি, কয়জন লোক আপনার জাতি-ধৰ্ম্ম বজায় রাখিয়া, তাহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিতে সমর্থ হইয়াছে। বলুন দেখি, কতগুলি স্ত্রীলোক তাহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিয়া তাহাদিগের সর্বপ্রধান-ধৰ্ম্ম সতীত্ব রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে। যাহার এই সকল কাৰ্য, তাহাকে আপনি এই বিপদ হইতে রক্ষা করিতে চাহেন। স্ত্রীলোকের ধর্ম নষ্ট করা ব্যতীত যাহার অপর আর কোন চিন্তা নাই, সুন্দরী স্ত্রীলোককে কোন গতিতে তাহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা বা স্বামীর নিকট হইতে অপহরণ করিবার যাহার সর্বদা মানস, আপনার পাশব বৃত্তি চরিতার্থ করিবার নিমিত্ত যে ব্যক্তি সকল কাৰ্য্যই অনায়াসে করিতে পারে, আপনি তাহার প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিবেন না। তাহাকে এই মোকদ্দমা হইতে বাচাই বার কথা দুরে থাকুক, তাহাকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত অতি সামান্য মাত্র চেষ্টা করিলেও, তাহাতে মহাপাতক হয়। তাই বলি, আপনি আমাকে এরূপ অনুরোধ করিবেন না। সহস্র সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেও, এ কাৰ্য্য আমার দ্বারা কোনরূপেই হইবে না।

হোসেন। আচ্ছা মহাশয়! ওসমানই যেন মহাপাতকী, কিন্তু তাহার বৃদ্ধ পিতার অপরাধ কি? পুত্রের অপরাধে পিতাকে দণ্ড দিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন কেন?

দারোগা। বৃদ্ধ পাপী নহে? আমার বিবেচনায় ওসমান অপেক্ষা বৃদ্ধ শতগুণ অধিক পাপ। যে পিতা পুত্রের দুস্কাৰ্য্য সকল জানিতে পারি, তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা না করেন, যাহার নিকট তাহার পুত্রের বিপক্ষে শত সহস্র নালিশ উপ স্থিত হইলেও, তিনি তাহার প্রতি কর্ণপাতও করেন না, সেরূপ পিতাকে সেই অত্যাচারকারী পুত্র অপেক্ষা শতগুণ অধিক পাপী বলিয়া আমার বিশ্বাস। এরূপ অবস্থায় যুবক বালকের বরং মাফ আছে, কিন্তু বৃদ্ধ পিতা কোনরূপেই ক্ষমার্হ নহে।

হোসেন। ওসমান যে অত্যাচারী, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহার অত্যাচারের সকল কথা যে গোফুর খাঁর কর্ণগোচর হয়, তাহা আমার বোধ হয় না। পুত্রের অত্যাচারের কথা শুনিতে পাইলে, তাহার নিবারণের চেষ্টা না করিবেন, সেরূপ পিতা গোফুর খাঁ নহেন। আমার বিশ্বাস যে, এই সকল অত্যাচারের কথা কখনই তাহার কর্ণগোচর হয় নাই। তিনি জানিতে পারিলে, ওসমান এতদুর অত্যাচার করিতে কখনই সমর্থ হইত না।

দারোগা। মিথ্যা কথা, বৃদ্ধ সমস্ত কথা অবগত আছে। জানিয়া শুনিয়া, সে তাহার পুত্রকে কোন কথা বলে না; বরং তাহার অত্যাচারের সাহায্য করে। ওসমান কর্তৃক এমন কোন ঘটনা ঘটিয়াছিল, যাহার সহিত আমার নিজের কোনরূপ সংস্রব ছিল। তাহার প্রতিবিধানের নিমিত্ত আমি নিজে কানপুর পর্যন্ত গমন করিয়া, সমস্ত কথা বৃদ্ধের কর্ণগোচর করি। কিন্তু কৈ, তিনি তাহার কি প্রতিবিধান করিয়াছিলেন?

হোসেন। আমি বুঝিতে পারিতেছি, যে কার্যের সহিত আপনার নিজের সংস্রব ছিল, সেই কাৰ্য্য তাহার কর্ণগোচর হইলেও, তিনি তাহার প্রতিবিধানের কোন চেষ্টা করেন নাই বলিয়া, আপনি অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন। কিন্তু আমার অনুরোধে এখন আপনাকে সেই ক্রোধ পরিত্যাগ করিতে হইবে। আপনার যে কাৰ্য্য তখন ওসমান বা তাঁহার পিতার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, সেই কাৰ্য এখন আমি সম্পন্ন করিয়া দিব। তদ্ব্যতীত আপনি আর যাহা প্রার্থনা করেন, তাহাও আমি প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। এখন আপনি একটু অনুগ্রহ করিলেই, আমাদিগের অনেক মঙ্গল হইতে পারিবে।

দারোগা। যে কাৰ্য্যের সহিত আমার সংশ্রব আছে, সে কাৰ্য্য আপনি সম্পন্ন করিয়া দিবেন কি প্রকারে? আপনি কি সেই ঘটনার বিষয় কিছু অবগত আছেন?

হোসেন। সেই সময় ছিলাম না; কিন্তু এখন সমস্তই জানিতে পারিয়াছি, এবং ওসমান তাহাকে কোথায় রাখিয়াছে, তাহাও আমি অনুসন্ধানে অবগত হইতে পারিয়াছি। ইচ্ছা করিলে, এখন তাহাকে অনায়াসেই আপনি পাইতে পারেন।

দারোগা। এই মোকদ্দমা সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণ হইয়া গিয়াছে, তাহা বোধ হয়, আপনি জানিতে পারিয়া ছেন। সমস্তই এখন কাগজ-পত্র হইয়া গিয়াছে। উর্দ্ধতন কর্ম্ম চারীগণ পৰ্য্যন্ত সকলেই এখন ইহার সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিয়াছেন। এখন আর আমার দ্বারা আপনাদিগের কি উপকার হইতে পারে?

হোসেন। প্রথম অবস্থায় আমি এখানে থাকিলে এই মোকদ্দমার অবস্থা কখনই এতদূর হইতে পারি না। কিন্তু এখন যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহার আর উপায় নাই। যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন ইহা অপেক্ষা আর যেন অধিক না ঘটে; আর সাক্ষি-সাবুদের যেন সংগ্রহ না হয়। আমি আপাততঃ আপনার নজর রূপ এই সহস্র মুদ্রা প্রদান করিতেছি। ঈশ্বর যদি অনুগ্রহ করেন, মোক হইয়া গেলে পুনরায় আপনার সহিত নির্জনে সাক্ষাৎ করিব। আর যাহার নিমিত্ত আপনি এতদুর ক্রোধান্বিত হইয়াছেন, আমার সহিত আপনি যখন গমন করিবেন, তখনই আমি তাহার নিকট আপনাকে লইয়া যাইব। তাহার পরে আপনি আপনার ইচ্ছানুযায়ী কর্ম্ম করিবেন। এখন আমাকে বিদায় দিন, আমাকে অনেক কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে হইবে। এখন আপনি আমাদিগের উপর প্রসন্ন হইলেন, কি না, বলুন।

দারোগা। প্রসঙ্গ না হইলেও, যখন আপনি এতদুর বলিতেছেন, তখন কাজেই আমাকে প্রসন্ন হইতেই হইবে। আমি ক্রোধের বশবর্তী হইয়া যতদূর করিবার, তাহা করিয়া ফেলিয়াছি। যাহা করিয়াছি, তাহার আর উপায় নাই। এখন আর অধিক কিছু করিব না।

হোসেন। ওসমান সহ দোষে দোষী, তাহার আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। গোরও পুত্র-মেহ বশতঃ সেই সকল দোষের প্রতিবিধান করিয়া উঠিতে পারেন নাই সত্য। কিন্তু

মহাশয়! এখন যেরূপ ভাবের মোকদম উপস্থিত হইয়াছে, সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণিত হইয়াছে, তাহার কণা মাত্রও প্রকৃত নহে। ইহা আপনি মুখে না বলুন, কিন্তু অন্তরে তাহ আপনাকে স্বীকার করিতে হইবে।

দারোগা। তোমার কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে গোফুর খাঁর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর হেদায়েতের কন্যার মৃত দেহ কিরূপে আসিল?

হোসেন। উহার প্রকৃত ব্যাপার আমি সমস্তই শুনিয়াছি। যদি জানিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি গোপনে আপনাকে সকল কথা বলিতে পারি।

দারোগা। গোপনে বলিতে চাহেন কেন?

হোসেন। মোকদ্দমার সময় আমরা সেই কথা স্বীকার করিব কি না, তাহা উপযুক্ত উকীল কৌলির পরামর্শ ব্যতীত বলিতে পারি না। সুতরাং আপনার নিকট গোপনে সেই সকল কথা না বলিলে যে কিরূপ দোষ ঘটিতে পারে, তাহা আপনিই কেন বিবেচনা করিয়া দেখুন না।

দারোগা। আমি ত কোন দোষ দেখিতেছি না।

হোসেন। মনে করুন, যে সকল কথা আমি প্রকৃত বলিয়া এখন বিশ্বাস করিতেছি, ও আপনি জানিতে চাহেন বলিয়া, আপনাকে যাহা বলিতে প্রবৃত্ত হইতেছি, সে সকল কথা আবশ্যকমত অস্বীকার করিলেও, আমি নিষ্কৃতি পাইব না।

দারোগা। আপনার নিষ্কৃতি না পাইবার কারণ কি?

হোসেন। আমি যদি অস্বীকার করি, তাহা হইলে যে সকল লোকের সম্মুখে আমি এখন সেই সকল কথা বলিতেছি, আবশ্যক হইলে সেই সকল লোকের দ্বারা আপনি উহা অনায়াসেই প্রমাণ করিতে সমর্থ হইবেন।

দারোগা। সেই সকল কথা আইনমত, ওরূপে প্রমাণ হইতে পারে না।

হোসেন। প্রমাণ হউক, বা না হউক, যদি আপনি নিতান্তই অবগত হইতে চাহেন, তাহা হইলে কাহারও সম্মুখে আমি সেই সকল কথা কহিব না। একাকী শুনিতে চাহেন, ত আমি বলিতে প্রস্তুত আছি।

দারোগা। আর যদি আমি আবশ্যকমত আপনাকে সাক্ষী স্থির করি, তাহা হইলে আপনি কি করবেন? আপনি এখন আমাকে যাহা বলিবেন, তখনও আপনাকে তাহাই বলিতে হইবে।

হোসেন। তাহা বলিব কেন? আবশ্যক হয়, সমস্ত কথা আমি অনায়াসেই অস্বীকার করিতে পারিব।

সম্পূর্ণ।

(অর্থাৎ পুলিসের অসৎ বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত!)
শ্রী প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত। All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। জ্যৈষ্ঠ।
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.

ঘর-পোড়া লোক।

(প্রথম অংশ)

প্রথম পরিচ্ছেদ।

অদ্য যে বিষয় আমি পাঠকগণকে উপহার দিতে প্রস্তুত হইয়াছি, তাহা অতি ভয়ানক ও লোমহর্ষণ-জনক ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার সহিত আমার নিজের কোনরূপ সংস্রব নাই, অর্থাৎ আমি নিজে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করি নাই; কিন্তু এই মোকদ্দমার সহিত যে পুলিস কর্ম্মচারীর সংস্রব ছিল, তিনি আমার পরিচিত। এই ঘটনার মধ্যে যেরূপ অস্বাভাবিক দুবুদ্ধির পরিচয় আছে, তাহা পাঠ করিয়া অনেক পাঠকেই মনে করিতে পারেন যে, এরূপ দুঃসাহসিক কাৰ্য মনুষ্য-বুদ্ধির অগোচর। কিন্তু যখন আমি এই ঘটনার আনুপূর্বিক সমস্ত ব্যাপার জানি, এবং অনুসন্ধানকারী পুলিস কর্ম্মচারীও, আমার পরিচিত, তখন এই ঘটনার সত্যাসত্য সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। পাঠকগণও ইহা সম্পূর্ণ। রূপ সত্য ঘটনা বলিয়া অনায়াসে বিশ্বাস করিতে পারেন।

এই ঘটনা আমাদিগের এই প্রদেশীয় ঘটনা নহে, পশ্চিম দেশীয় ঘটনা। হিন্দু পাঠকগণের মধ্যে সকলেই অবগত আছেন যে, নৈমিষারণ্য নামে একটা স্থান আছে, উহা আমাদিগের একটা প্রধান তীর্থ স্থান। পশ্চিমদেশবাসীগণ সেই স্থানকে নিমরণ কহিয়া থাকে।

কথিত আছে, ভগবান্ বেদব্যাস এই স্থানে বসিয়া ভগবদবাক্য সৰ্ব্বপ্রথমে মর্ত্যলোকে প্রকাশ করেন। যে বেদীর উপর উপবেশন করিয়া তিনি ভগবাক্য পাঠ করিয়াছিলেন, নিবিড় ও নিস্তব্ধ আয় কাননের ভিতর সেই বেদী এখন পর্যন্ত বর্তমান। সেই বেদীর কিছু দূর অন্তরে চক্রপাণি নামক প্রসিদ্ধ স্থান। প্রসিদ্ধি আছে যে, যে সময় ভগবান্ বেদব্যাস ভগব প্রকাশ করিতেন, সেই সময় দেবতাগণ ও ঋষি গণের আবির্ভাব হইত। সেই স্থানে তখন একটা সামান্য স্রোতস্বতী থাকা স্বত্বেও সেই স্থানে যাহারা আগমন করিতেন, তাঁহাদিগের প্রত্যেককেই অত্যাধিক জল-কষ্ট সহ করিতে হইত। ভগবান্ বিষ্ণু এই ব্যাপার দেখিয়া জল-কষ্ট নিবারণ করিবার মানসে আপনার চক্র দ্বারা পৃথিবী ভেদ করিয়া দেন, সেই স্থান হইতে সতেজে অনবরত জল উখিত হইয়া সকলের জল-কষ্ট নিবারণ করে। সেই সময় পৃথিবী ভেদ করিয়া যে স্থান হইতে জল উঠিয়াছিল, এবং এখন পর্যন্ত যে স্থান হইতে অনবরত জল উখিত হইয়া সন্নিকটবর্তী সেই ক্ষুদ্র স্রোতস্বতীতে গিয়া মিলিতেছে, সেই স্থানকে চক্রপাণি। কহে। নৈমিষারণ্য তীর্থে যাহারা গমন করিয়া থাকেন, তাহাদিগকে চক্রপাণি জলে স্নান করিতে হয়।

দশ বার বৎসর পূর্বে কোন সরকারী কাৰ্য্য উপলক্ষে আমাকে সেই নৈমিষারণ্যে গমন করিতে হইয়াছিল। যে কাৰ্য্যে আমি গমন করিয়াছিলাম, সেই কাৰ্য শেষ হইবার পর, একদিবস আমি সেই চক্রপাণি জলে স্নান করিতে যাই। সেই স্থানে আমি স্নান করিতেছি, এরূপ সময় একজন লোক আসিয়া স্নান করিবার মানসে সেই চক্রপাণি জলে অবতরণ করেন। কথায় কথায় তাহার সহিত আমার পরিচয় হয়। ইহার নাম আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম। কিন্তু ইহার সহিত আমার কখন চাক্ষুষ আলাপ পরিচয় ছিল না। ইহার নাম শুনিয়াই আমি কহিলাম, আপনি এই প্রদেশীয় পুলিস বিভাগে কর্ম্ম করিতেন না?

উত্তরে তিনি কহিলেন, হাঁ মহাশয়!

তখন আমি তাহার সম্বন্ধে যাহা যাহা অবগত ছিলাম, তাই তাহাকে কহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কেমন মহাশয়! এই অপ রাধের জন্য পুলিস বিভাগ হইতে আপনার চাকরী গিয়াছে না?

উত্তরে তিনি কহিলেন, আপনি এ সকল বিষয় কিরূপে অবগত হইতে পারিলেন?

আমি। আমি যেরূপেই অবগত হইতে পারি না কেন; কিন্তু ইহা প্রকৃত কি না?

যখন অনুসন্ধান করিয়া আমার দোষ সাব্যস্ত হইয়াছিল, এবং সেই দোষের উপর নির্ভর করিয়া সরকারী চাকরী হইতে আমাকে তাড়িত করা হইয়াছে, তখন উহা যে সম্পূর্ণরূপ মিথ্যা কথা, তাহাই বা আমি বলি কি প্রকারে?

আমি। সত্য হউক, আর মিথ্যা হউক, যে অপরাধের নিমিত্ত আপনার চাকরী গিয়াছে, সেই অপরাধ সম্বন্ধে আপনার কোন্ উর্দ্ধতন কর্ম্মচারী অনুসন্ধান করিছিলেন?

যে ইনস্পেক্টারের দ্বারা তাহার অপরাধের অনুসন্ধান করা হইয়াছিল, সেই ইম্পেক্টারের নাম তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরে বলিয়া দিলেন, এবং তিনি আজ কাল যে স্থানে আছেন, তাহাও আমাকে জানাইয়া দিলেন। আমি দেখিলাম, যে সরকারী কার্যের নিমিত্ত আমি সেই প্রদেশে গমন করিয়াছি, তাহার কোন কোন বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাকে তাঁহার নিকট গমন করিতেই হইবে। সুতরাং এই ঘটনার সমস্ত অবস্থা তাঁহার নিকট হইতে অনায়াসেই জানিয়া লইতে পারিব। যে ভূত-পূৰ্ব পুলিস-কর্ম্মচারীর সহিত আমার চক্রপাণিতে সাক্ষাৎ হইল, তিনিও আমার পরিচয় গ্রহণ করিলেন, এবং পরিশেষে তাহার বাসায় গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি বার নিমিত্ত আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন। আমিও তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিলাম; সেই দিবস সন্ধ্যার পূর্বে তাঁহার বাসায় গিয়া আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। সেই রাত্রি তাহার বাসায় অতিবাহিত করিবার নিমিত্ত তিনি আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন; কিন্তু জাতিভেদের প্রতিবন্ধকতা হেতু আমি কোনরূপেই তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিলাম না। তথাপি অনেক রাত্রি পর্যন্ত তাঁহার বাসায় বসিয়া নানারূপ প্রসঙ্গে সময় অতিবাহিত করিলাম। ইহার মধ্যে যতদূর সম্ভব, তাঁহার নিকট হইতে তাহার মোকদ্দমার বিষয় সকল উত্তমরূপে জানিয়া লইলাম।

ইনি অসৎ উপায়ে যে সকল অর্থ উপার্জন করিয়া ছিলেন, তাহার অধিকাংশই প্রায় ব্যয়িত হইয়া গিয়াছে। এই স্থানে বসিয়া এখন তিনি জমিদার-সরকারে যদি কোনরূপ একটী চাকরীর সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন, তাহারই চেষ্টা দেখিতেছেন।

নৈমিষারণ্যে আমার যে সকল অনুসন্ধানকার্য ছিল, তাহা শেষ করিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। দুর্গম ভয়ানক পথ অতিক্রম করিয়া, ও হত্যা-হরণ প্রভৃতি স্থান দর্শন করিয়া, ক্রমে আমি গিয়া সাণ্ডিল। ষ্টেশনে উপস্থিত হইলাম। পরে কয়েকটা ষ্টেশন অতিক্রম করিয়া যে স্থানে সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানকারী ইনস্পেক্টার থাকিতেন, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহার নিকট আমি আমার পরিচয় প্রদান করিলাম, এবং যে সরকারী কার্যের নিমিত্ত আমি তাহার নিকট গমন করিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত ব্যাপার আমি তাঁহার নিকট কহিলাম। তিনি তাঁহার সাধ্যমত আমাকে সাহায্য করিয়া, সেই স্থানের আমার আবশ্যক কাৰ্য্য সকল সম্পন্ন করিয়া দিলেন।

যে সময় তিনি আমার সাহায্যের নিমিত্ত আমার সহিত কার্যে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় একদিবস কথায় কথায় এই মোকদ্দমার বিষয় তাহার নিকট উত্থাপিত করিলাম। তিনিও সবিশেষ যত্নের সহিত ইহার সমস্ত ব্যাপার আমাকে বলিয়া দিলেন, এবং এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের যে সকল কাগজ, পত্র ছিল, তাহাও আমাকে দেখাইতে চাহিলেন। সময়মত আফিস হইতে সমস্ত নথি-পত্ৰ আনিয়া, দেখিবার নিমিত্ত আমার হস্তে প্রদান করিলেন; কিন্তু উহার সমস্তই উর্দ্দূ ভাষায় লিখিত বলিয়া, আমি নিজে তাহা পড়িয়া উঠিতে পারিলাম না। উর্দু ভাষাবিদ একজন মুসির সাহায্যে সেই সকল কাগজপত্রে যাহা লিখিত ছিল, তাহা জানিয়া লইলাম, এবং আবশ্যকমত কতক কৃতক লিখিয়াও লইলাম। এইরূপে

যে সকল বিষয় আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহাই অবলম্বন করিয়া এই বিবরণ লিখিত হইতেছে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

যে গ্রামে রামসেবকের বাড়ী, সেই গ্রামের জমিদার গোফুর খাঁ। গোফুর খাঁ যে একজন খুব বড় জমিদার, তাহা নহে; কিন্তু নিতান্ত ক্ষুদ্র জমিদার ও নহেন। ইহার জমি দারীর আয়, সালিয়ানা পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা হইবে। গোফুর খাঁ জমিদার, কিন্তু জমিদার-পুত্র নহেন। তাঁহার পিতা একজন মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ছিলেন। তিনি যাহা কিছু উপার্জন করিতেন, তাহার দ্বারা কোন গতিতে পরিবার প্রতিপালন করিতেন মাত্র; কিন্তু তাহা হইতে একটা কপর্দকও সঞ্চয় করিয়া রাখিতে পারিতেন না। গোফুর খাঁ তাঁহার পিতার প্রথম বা একমাত্র পুত্র। যে সময় তাঁহার পিতা পরলোক গমন করেন, সেই সময় গোফুরের বয়ঃক্রম পনর বৎসরের অধিক ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর অনন্যোপায় হইয়া গোফুর সামান্য চাকরীর উমেদারীতে প্রবৃত্ত হন, এবং আপন দেশ ছাড়িয়া কানপুরে গমন করেন। সেই সময় কানপুরে একজন মুসলমান বাস করিতেন। চামড়ার দালালী করিয়া তিনি শটাকার সংস্থান করিয়াছিলেন, এবং দেশের মধ্যে মান-সম ও একটু সবিশেষ প্রতিপত্তি স্থাপন করিতে পারিয়াছিলেন। গোফুর খাঁ কানপুরে জাসিয়া প্রথমে তাহারই আশ্রয় গ্রহণ করেন, এবং তাহারই নিকট অতি সামান্য বেতনে একটা চাকরী সংগ্রহ করিয়া লন। গোফুর খাঁ অতিশয় বুদ্ধিমান ও সবিশেষ কার্যক্ষম ছিলেন। সুতরাং অতি অল্পদিবসের মধ্যেই তিনি আপন মনিবের প্রিয়পাত্র হইয়া পড়েন, এবং ক্রমে তিনি তাঁহার মনিবের কাৰ্য্যে সবিশেষরূপে সাহায্য করিতে সমর্থ হন্। দিন দিন যেমন তিনি তাঁহার মনিবের প্রিয়পাত্র হইতে ছিলেন, সেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বেতনও ক্রমে বর্ধিত হইতেছিল।

সে যাহা হউক, যে সকল কাৰ্য্য করিয়া তাহার মনিব সেই দেশের মধ্যে প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, পরিশেষে সেই সমস্ত কাৰ্য গোফুর খাঁ নিজে সম্পাদন করিতে লাগিলেন। ইদানীং তাঁহার মনিবকে আর কোন কাৰ্যই দেখিতে হইত না, সকল কাৰ্য গোফুরের উপরেই নির্ভর করিত। গোফুরও প্রাণপণে এরূপ ভাবে কার্য সম্পন্ন করিয়া আসিতে লাগি লেন যে, তাহার মনিবের কার্য পূর্ব অপেক্ষা আরও অতি উত্তমরূপে চলিতে লাগিল। সৰ্বসাধারণে গোফুয়ের মনিবকে যেরূপ ভাবে বিশ্বাস করিতেন, গোফুরকে তাহা অপেক্ষা আরও অধিক বিশ্বাস করিতে লাগিলেন। এমন কি, সেই সময় গোফুরের মনিবকে পরিত্যাগ করিয়া ব্যবসায়ী মাত্রেই গোফুরকে চাহিতে লাগিলেন, ও গোফুরের হস্ত হইতে সমস্ত দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে লাগিল। এই ব্যাপার দেখিয়া গোফুরের মনিব নিজে আর কোন কার্যে হস্তক্ষেপ না করিয়া সমস্ত কার্যভারই গোফুরের উপর অর্পণ করিলেন, এবং পরিশেষে গোফুরকে একজন অংশীদার করিয়া লইলেন। গোরও সবিশেষ পারদর্শিতার সহিত কাৰ্য্য করিয়া ক্রমে যথেষ্ট উপার্জন করিতে আরম্ভ করিলেন।

এইরূপে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হইবার পর গোফুলের মনিব বা অংশীদার ইহলীলা সম্বরণ করিলেন; সুতরাং এখন সেই কার্যের সমস্ত অংশই গোফুরের হইল। গোফুরও সবিশেষ মনোযোগের সহিত আপন কাৰ্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিতে লাগিলেন। এইরূপে দুই একখানি করিয়া ক্রমে জমিদারী ক্রয় করিতে লাগিলেন। এইরূপে তিনি যে সকল জমিদারী ক্রমে ক্রয় করিয়াছিলেন, সেই সকল জমিদারীর আয় পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকায় দাঁড়াইল। সেই সময় গোফুর খাঁও ক্রমে বৃদ্ধ হইয়া পড়ায় আপনার ব্যবসা পরিত্যাগ করিলেন, এবং কেবলমাত্র তাহার জমিদারীতেই আপনার মন নিয়োগ করিবার মানস করিলেন।

গোফুর খাঁর কেবল একটামাত্র পুত্র জন্মিয়াছিল, তাহার নাম তিনি ওসমান রাখিয়াছিলেন। আপন পুত্র ওসমানকে প্রথমতঃ তিনি আপনার ব্যবসা কার্য শিখাইবার নিমিত্ত সবিশেষরূপ চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনরূপে আপন মনস্কামনা পূর্ণ করিতে পারেন নাই। বাল্যকালে গোফুর খাঁর যেরূপ প্রকৃতি ছিল, তাঁহার পুত্র ওসমানের প্রকৃতি বাল্যকাল হইতেই তাহার বিপরীত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। গোফুর খাঁ সৰ্ব্বদা আপন কার্যে মন নিয়োগ করিতেন, ওসমান কেবল অপরের সহিত মিলিয়া আমোদ-আহলাদ করিয়া দিন অতি বাহিত করিতে লাগিল।

গোফুরের চেষ্টা ছিল, কিরূপে আপনার কাৰ্য্যে তিনি সবিশেষরূপে উন্নীত হইতে পারেন।

ওসমান ভাবিতেন, অসৎ উপায় অবলম্বনে কিরূপে তিনি তাঁহার পিতার উপার্জিত অর্থ ব্যয় করিতে সমর্থ হন।

গোফুর সর্বদা সৎকার্যের দিকে দৃষ্টি রাখিতেন। কিরূপে দশজন প্রতিপালিত হয়, কিরূপে দশজনের উপকার করিতে পারেন, তাহার দিকে সর্বদা তিনি লক্ষ্য রাখিতেন।

ওমানের লক্ষ্য হইয়াছিল, কেবল অসৎ কার্যের দিকে। আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রগণের প্রতিপালনের পরিবর্তে কতকগুলি নীচজাতীয় বার-বনিতা তাহার দ্বারা প্রতিপালিত হইত।

ওসমানের এইরূপ অবস্থা সত্বেও একমাত্র সন্তান বলিয়া তাঁহার পিতা গোফুর খা তাহাকে কিছু বলিতেন না। সুতরাং ওসমারের অত্যাচার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস হইবার পরিবর্তে ক্রমে আরও বর্ধিত হইতে লাগিল।

গোফুর খাঁ নিতান্ত বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন বলিয়া, তিনি মনে করিয়াছিলেন, ব্যবসা কার্যের ভার তিনি তাহার পুত্র ওসমান খাঁর হস্তে প্রদান করিবেন; কিন্তু তাহার চরিত্র দেখিয়া আপনার ইচ্ছাপূর্ণ করিতে পারিলেন না। অথচ ব্যবসায়ীগণের অনুরোধ রক্ষা করিতে গিয়া, তিনি আপন কাৰ্য্য পরিত্যাগ পূর্বক আপন বাড়ীতে বসিয়া তাহার বৃদ্ধাবস্থায় যে কিছু দিবস বিশ্রাম করিবেন, তাহাতেও তিনি সমর্থ হইলেন না। তাহাকে সৰ্ব্বদা কানপুরেই থাকিতে হইত। এদিকে অবসর পাইয়া ওসমান জমিদারীর ভিতর যথেচ্ছ ব্যবহার করিত। তাহার অত্যাচারে প্রজাগণের মধ্যে কেহই শান্তিলাভ করিতে পারিত না। কিরূপে ওমানের হক হইতে আপনাপন স্ত্রী-কন্যার ধৰ্ম্ম রক্ষা করিতে সমর্থ হইবে, কেবল তাহার চিন্তাতেই তাহাদিগকে সর্বদা দিন অতিবাহিত করিতে হইত।

ওমানের এই সকল অত্যাচারের কথা ক্রমে তাহার পিতা গোফুর ধার কর্ণগোচর হইতে লাগিল; কিন্তু গোফুর খ তাহার প্রতিকারের কোনরূপ চেষ্টাও করিলেন না।

এইরূপ নানা কারণে, প্রজাগণ ক্রমে তাহাদিগের অবাধ্য হইয়া পড়িতে লাগিল। জমিদারীর খাজনা প্রায়ই তাঁহারা বাকী ফেলিতে লাগিল, বিনা-নালিশে খাজনা আদায় প্রায় একরূপ বন্ধ হইয়া গেল।

এই সকল অবস্থা দেখিয়াও ওসমানের অত্যাচারের কিছু মাত্র নিবৃত্তি হইল না। তাহার কতকগুলি অশিক্ষিত ও দুষ্টমতি পরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী সেই সকল অত্যাচার ক্রমে বৃদ্ধিই হইতে লাগিল। তাহাদিগের অত্যাচারে অনেককেই তাহার জমিদারী পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে হইল। বিশেষতঃ যাহাদিগের গৃহে সু যুবতী স্ত্রীলোক আছে, তাহাদিগের সেই স্থানে বাস করা একবারেই অসম্ভব হইয়া পড়িতে লাগিল।

এরূপ পাপে কতদিবস প্রজাগণ সন্তুষ্ট থাকে। বা ঈশ্বরই আর কতদিবস এ পাপ মার্জনা করেন। ওসমান একজন মধ্যবিদ জমিদারের পুত্র বইত নয়? এরূপ অত্যাচার করিয়া যখন নবাব সিরাজদ্দৌল্লা প্রভৃতিও নিষ্কৃতি পান নাই, তখন এই সামান্য জমিদার-পুত্র যে অনায়াসেই নিষ্কৃতি পাইবেন, তাহা কিছুতেই হইতে পারে না। সমস্ত কার্যেরই সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করিলে যে অবস্থা ঘটিয়া থাকে, ওসমানের অদৃষ্টে যে সেই অবস্থা না ঘটিবে, তাহা কে বলিতে পারে?

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

যে গ্রামে গোর খাঁর বাড়ী, সেই গ্রামের নিকটবর্তী একখানি গ্রামে পুলিসের থানা আছে; সেই থানার ভার প্রাপ্ত কর্ম্মচারী একজন মুসলমান দারোগা। দারোগা সাহেব একজন খুব উপযুক্ত কর্ম্মচারী। জেলার ভিতর তাঁহার খুব নাম আছে, সরকারের ঘরেও তাঁহার বেশ খাতির আছে। কিন্তু তাহার নিজের চরিত্র সাধারণত দারোগা-চরিত্রের বহিত নহে।

দারোগা সাহেবের বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসরের কম নহে, বরং দুই এক বৎসর অধিক হইবারই সম্ভাবনা। পুলিশ বিভাগে প্রথম প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে তাঁহার যেরূপ চরিত্ৰ-দোষ ছিল, এখন তাহা অপেক্ষা অনেক বর্ধিত হইয়া পড়িয়াছে, এবং দিন দিন বর্ষিত হইয়াই চলিয়া যাইতেছে।

কোন গ্রামে কোন একটী মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে গিয়া, একটা রূপবতী যুবতী তাঁহার মজয়ে পতিত হয়। পরিশেষে কোন-না-কোন উপায় অবলম্বন করিয়া, ক্রমে দারোগা সাহেব তাহাকে গৃহের বাহির করেন, এবং থানার সন্নিকটবর্তী কোন এক স্থানে একখানি বাড়ী প্রস্তুত করিয়া দিয়া, তাহাকে সেই স্থানে রাখিয়া দেন। সেই স্ত্রীলোকটা দুই বৎসরকাল সেই স্থানে বাস করিয়া দারোগা সাহেবের মনস্তুষ্টি সম্পাদিত করে।

সেই যুবতী যে সবিশেষ রূপবতী, এ কথা শোক-মুখে ক্রমে প্রকাশিত হইয়া পড়ে, এবং ক্রমে ওসমানের জনৈক পারিষদ এ কথা জানিতে পারিয়া, ওসমানের কর্ণগোচর করিয়া দেয়। যুবতী-রূপবতীর কথা শুনিয়া ওসমান আর তাহার মন স্থির করিতে পারিল না; কোন উপায় অবলম্বন করিলে, সে সেই যুবতীকে হস্তগত করিতে পারিবে, তাহারই চিন্তায় অতিশয় ব্যগ্র হইয়া পড়িল, ও ক্রমে আপন মনোভাব প্রকাশ করিয়া সেই যুবতীর নিকট তোক প্রেরণ করিল।

যুবতী তাহার প্রস্তাবে প্রথমে স্বীকৃত হইল না; কিন্তু ওসমানও তাহার আশা পরিত্যাগ করিল না। যে কোন উপায়েই হউক, তাহাকে আয়ত্ত করিবার নিমিত্ত সবিশেষ রূপ চেষ্টা করিতে লাগিল।

যে স্ত্রীলোক একবার তাহার কুলে জলাঞ্জলি দিয়া পর পুরুষের সহিত চলিয়া আসিয়াছে, এবং এতদিবস পর্যন্ত পরপুরুষেয় সহিত অনায়াসে কালযাপন করিতেছে, সেই স্ত্রীলোককে প্রলোভনে ভুলাইতে আর কতদিন অতিবাহিত হয়? দারোগা সাহেবের বয়ঃক্রম অধিক, ওসমানের বয়ঃক্রম তাহ অপেক্ষা অনেক অর। দারোগা সাহেব পরাধীন, ওসমান স্বাধীন। দারোগা সাহেবকে চাকরীর উপর নির্ভর করিয়া সমস্ত খরচ-পত্ৰ নিৰ্বাহ করিতে হয়, আর ওসমান জমিদার-পুত্র, গোফুর খাঁর মৃত্যুর পর সেই অগাধ জমিদারীর তিনি একমাত্র অধিকারী। যেস্থলে দারোগা সাহেবকে শত মুদ্রা খরচ করিতে হইলে তাহাকে অন্ধকার দেখিতে হয়, সেই স্থলে ওসমান সহস্র মুদ্রা অকাতরে ব্যয় করিতে সমর্থ। এরূপ অবস্থায় সেই স্ত্রীলোকটীকে ওসমানের করায়ত্ব করা নিতান্ত দুরূহ কাৰ্য্য নহে। বলা বাহুল্য, ক্রমে যুবতী ওমানের হস্তগত হইয়া পড়িল; দারোগা সাহেবকে পরি ঊ্যাগ করিয়া সে ওসমানের অনুবর্তিনী হইল। ওসমান তাহাকে সেই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিয়া, কোন লুকা য়িত স্থানে তাহাকে রাখিয়া দিল।

সুন্দরী যে কাহার সহিত কোথায় গমন করিল, এ কথা দারোগা সাহেব প্রথমত জানিতে পারিলেন না; কিন্তু ক্রমে এ সংবাদ জানিতে তাহার বাকী রহিল না। যখন তিনি জানিতে পারিলেন যে, ওসমান তাঁহার মুখের পথে কণ্টক হইয়া তাঁহার যকের ধন অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, তখন তিনি তাহার উপর যেরূপ ক্রোধান্বিত হইয়া পড়িলেন, তাহা বর্ণন করা এ লেখনীর কাৰ্য্য নহে। দারোগা সাহেব প্রথমত সেই সুন্দরীকে পুনরায় আপনার নিকট আনয়ন কয়বার নিমিত্ত সবিশেরূপ চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। এমন কি, দারোগা সাহেব এই কথা জমে ওসমানের পিতার কর্ণ গোচর পর্যন্ত করাইলেন। তাহাতেও কোনরূপ সুফল ফলিল না। ওসমানের পিতা এ বিষয়ে কোনরূপে দারোগা সাহেবকে সাহায্য নিলেন না।

এই সকল কারণে দারোগা সাহেবের প্রচণ্ড ক্রোধের সামান্যমাত্রও উপশম হইল না। কিরূপে তিনি ওসমান ও তাহার পিতাকে ইহার প্রতিশোধ দিতে পারিবেন, তাহার চেষ্টাতেই দিনরাত্রি অতিবাহিত করিতে লাগিলেন, এবং অনবরত প্রতিশোধের সুযোগ অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।

এইরূপে ক্ৰমে এক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল। এই এক বৎসরের মধ্যে দারোগা সাহেব সেই সুন্দরীর আশা পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না, বা প্রতিহিংসার প্রবল চিন্তাকেও হৃদয় হইতে তাড়িত করিতে সমর্থ হইলেন না।

এইরূপে আরও কিছু দিন অতিবাহিত হইয়া গেল। একদিবস প্রাতঃকালে দারোগা সাহেব থানায় বসিয়া আছেন, এরূপ সময়ে একটা লোক গিয়া থানায় উপস্থিত হইল, ও কাঁদিতে দিতে আমোগার সম্মুখীন হইয়া কহিল, বর্ষাবতার। আপনি আমাকে এই বিপদ হইতে রক্ষা করুন। আপনি রক্ষা না করিলে, আর কেই আমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না।

দারোগা। কি হইছে?

আগন্তুক। ওসমান আমার সর্বনাশ করিয়াছে।

দারোগা। ওসমান! কোন ওসমান, গোর ধীর পুত্র ওসমান?

আগন্তুক। মহাশয়!

দারোগা। সে তোমার কি করিয়াছে?

আগন্তুক। সে আমার একমাত্র কন্যাকে জোর করিয়া আমার ঘর হইতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।

দারোগা। কেন সে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গেল?

আগন্তুক। কু-অভিপ্রায়ে সে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।

দারোগা। তোমার কন্যার বয়ঃক্রম কত?

আগন্তুক। সে বালিকা, তাহার বয়ঃক্রম এখনও আঠার বৎসরের অধিক হয় নাই।

দারোগা। তাহার বিবাহ হয় নাই?

আগন্তুক। বিবাহ হইয়াছে বৈ কি। তাহার স্বামী এখনও বর্তমান আছে।

দারোগা। এ সংবাদ তাহার স্বামী শুনিয়াছে?

আগন্তুক। এ সংবাদ তাহার স্বামীকে আমরা দেই নাই। তাহার স্বামী বিদেশে থাকেন। সুতরাং এ সংবাদ তিনি এখনও জানিতে পারেন নাই। তিনি না জানিতে জানিতে যদি আমার কন্যাকে উদ্ধার করিয়া আনিতে পারি, তাহা হইলে এ লজ্জার কথা আমি তাহাকে আর জানিতে দিব না।

দারোগা। তোমার কন্যা ইচ্ছা করিয়া ওসমানের সহিত গমন করে নাই ত?

আগন্তুক। মা মহাশয়! তাহাকে জোর করিয়া ওসমান। ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।

দারোগা। তুমি ইহার প্রমাণ করিতে পারিবে।

আগন্তুক। খুব পারিব, গ্রামশুদ্ধ সব লোক দেখিয়াছে। তাঁহারা সকলেই সত্য কথা কহিবে। আপনি সেই স্থানে গমন করিলেই, দেখিতে পাইবেন, আমার কথা প্রকৃত কি না?

দারোগা। কতক্ষণ হইল, ওসমান তোমার কন্যাকে জোর করিয়া ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।

আগন্তুক। মহাশয় আজ ছয় দিবস হইল।

দারোগা। ছয় দিবস। মিথ্যা কথা। ছয় দিবস হইল, তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, আর আজ তুমি থানায় সংবাদ দিতে আসিলে; তোমার এ কথা কে বিশ্বাস করিবে?

আগন্তুক। মহাশয়! আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করুন, আর না করুন, আমি কিন্তু প্রকৃত কথা কহিতেছি। আমার অনুপস্থিতিতে এই কাৰ্য্য হইয়াছে। আমার বাড়ীতে আমার সেই একমাত্র কন্যা ব্যতীত আর কেহই ছিল না; সুতরাং সুযোগ পাইয়া দুবৃত্ত এই কাৰ্য্য করিয়াছে। তাহার ভয়ে পাড়ার লোক আমাকে পর্যন্ত সংবাদ দিতে সমর্থ হয় নাই। অঙ্গ আমি বাড়ীতে আসিয়া যেমন এই সকল ব্যাপার জানিতে পারিলাম, অমনি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। এখন আপনি রক্ষা না করিলে, আমার আর উপায় নাই।

দারোগা। তোমার বাড়ী যে গ্রামে, সেই গ্রাম হইতে ওসমানের বাড়ী কতদুর?

আগন্তুক। খুব নিকটে, পার্শ্ববর্তী গ্রামে।

দারোগা। তোমার জমিদার কে।

আগন্তুক। সেই হতভাগাই আমার জমিদার।

দারোগা। জমিদারীর খাজানা তোমার কিছু বাকী আছে।

আগন্তুক। বাকী আছে। মিথ্যা কথা কহিব না, আমি আজ তিন বৎসর খাজানা দিতে পারি নাই।

দারোগা। ফি বৎসর তোমাকে কত টাকা করিয়া খাজান দিতে হয়?

আগন্তুক। সালিয়ানা আমাকে পনর টাকা করিয়া খাজানা দিতে হয়। পঁয়তাল্লিশ টাকা খাজানা আমার বাকী পড়িয়াছে।

দারোগা। সেই খাজানার নিমিত্ত তাঁহারা তাগাদা করে না?

আগন্তুক। তাগাদা কমে বৈ কি, কিন্তু দিয়া উঠিতে পারি না।

দারোগা। যখন তোমার কন্যাকে ওসমান ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল, সেই সময় তাহার সতে আর কোন লোক ছিল?

আগন্তুক। তাহার সহিত আরও চারি পাঁচজন লোক ছিল।

দারোগা। ওসমানের পিতা গোয় খ সেই সঙ্গে ছিলেন?

আগন্তুক। না মহাশয়। তিনি ছিলেন না।

দারোগা। তুমি জান না; তিনি না থাকিলে, কখনও এইরূপ কাৰ্য্য হইতে পারে না। গ্রামের যে সকল ব্যক্তি এই ঘটনা দেখিয়াছে, তাহাদিগকে তুমি ভাল করিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছ কি?

আগন্তুক। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। কিন্তু কেই সে কথা কহে না। আরও ভাবিয়া দেখুন না কেন, পুল বদি কোন যুবতী রমণীর সতীত্ব নষ্ট করিবার চেষ্টা করে, পিতা কি কখনও তাহার সহায়তা করিয়া থাকেন?

দারোগা। ওসমান শেষে উহার সতীত্ব নষ্ট করিতে পারে; কিন্তু প্রথমতঃ সেই কাৰ্যের নিমিত্ত যে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহা তোমাকে কে বলিল? অপর কোন কারণে সে কি তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া যাইতে পারে না?

আগন্তুক। আর তা কোন কারণ দেখিতে পাইতেছি না, বা শুনিতেও পাইতেছি না।

দারোগা। ওমানের পিতা গোফুর খাঁ এখন কোথায় আছেন, বলিতে পার?

আগন্তুক। তিনি এখন বাড়ীতেই আছেন।

দারোগা। কানপুর হইতে তিনি কবে আসিয়াছেন।

আগন্তুক। পাঁচ ছয় দিবস হইবে।

দারোগা। তাহা হইলে যে দিবস ওসমান তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, সেই দিবস গোয় কান পুর হইতে বাড়ীতে আসিয়াছেন।

আগন্তুক। হাঁ মহাশয়! হয় সেই দিবসই আসিয়াছেন, না হয়, তাহার পরদিন আগমন করিয়াছেন।

দারোগা। তাহা হইলে ঠিক হইয়াছে। তোমার কন্যার ধর্ম নষ্ট করিবার নিমিত্ত ওসমান তোমার দুহিতাকে ধরিয়া লইয়া যায় নাই। গত তিন বৎসর পর্যন্ত তোমার নিকট হইতে খাজনা আদায় না হওয়ায়, সেই খাজনা আদায় করিবার মানসে ওমানের পিতা গোফুর খাঁ আপন পুত্র ওসমান ও তার কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া তোমার বাড়ীতে আগমন করেন। তুমি বাড়ীতে ছিলে না; সুতরাং তাঁহারা তোমাকে বাড়ীতে দেখিতে পান নাই। কিন্তু তুমি যে এতই বাড়ীতে নাই, ইহা না ভাবিয়া, খাজানা দিবার জয়ে তুমি লুকায়িত পাই, এই ভাবিয়া তোমাকে ভয় দেখাইয়া খাজনা আদায় করিয়া লইবার মানসে তোমার একমাত্র কন্যাকে ধরিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত গোফুর খাঁ তাঁহার পুত্রকে আদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। পিতার আদেশ পাইয়া ওসমান কয়েকজন লোকের সাহায্যে তোমার কন্যাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। খাঁ সাহেবও তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিয়াছেন। কেমন, ইহাই প্রকৃত কথা কি না?

আগন্তুক। না মহাশয়। ইহা এত কথা নহে। ওসমানের পিতা সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন না, বা তিনি আদেশ প্রদান করেন নাই। আমার বাকী থানায় নিমিত্তও এটনা ঘটে নাই।

দারোগা। যা ব্যাটা, তবে তোর মোক গ্রহণ করিব। তুই বাড়ীতে হিলি নি, এত কথা যে কি, তাহার তুই কি জানি? আমরা ইতিপূর্বে সকল কথা জানিতে পারিয়াছি, কেবল কোন ব্যক্তি আমার নিকট আসিয়া নালিশ করে নাই বলিয়া, আমি এ পর্যন্ত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই নাই। আমি যেরূপ কহিলাম, সেইপের সাক্ষী সকল সংগ্রহ করিয়া রাখ গিয়া। আমি একজন মাদারকে সঙ্গে দিতেছি, যাহা তুই বুঝতে না পাবি, তিনি তাহা হতাকে বুঝাইয়া দিবেন। তাঁহারা আমি গিন্ধ আসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব।

আগন্তুক। দোহাই ধৰ্মবতায়! যাহাতে আমি আমার কাটীকে পাই, আপনাকে সেই উপায় করতে হবে।

দারোগা। তাহাই হইবে। এখন তুই আমার জমা দারের সহিত গমন করিয়া সাক্ষী-সাবুদের সংগ্রহ করিয়া দে। তুই লেখা-পড়া জানিস্ কি?  আগন্তুক। আমরা চাষার ছেলে, লেখাপড়া শিখি নাই।

দারোগা। নিজের নাম লিখিতে পারি?

আগন্তুক। না মহাশয়! আমি আমার নাম পর্যন্ত লিখিতে পারি না।

দারোগা। তোর নাম কি?

আগন্তুক। আমার নাম শেখ হেদায়েৎ।

দারোগা। আচ্ছা হেদায়েৎ, তুমি আমার জমাদারের সহিত তোমার গ্রামে গমন কর। আহারান্তে আমি নিজে গিয়া এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব। সাক্ষীগণ যেন উপস্থিত থাকে।

হেদায়েৎকে এই কথা বলিয়া, দারোগা সাহেব তাহার একজন সবিশেষ বিশ্বাসী জমাদারকে ডাকিলেন, এবং নির্জনে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাহার সহিত কি পরামর্শ করিয়া পরি শেষে তাহাকে কহিলেন, এই মোকদ্দমায় বিশেষরূপে তোমাকে আমার সাহায্য করিতে হইবে। যে সুযোগ পাইয়াছি, সে সুযোগ কিছুতেই পরিত্যাগ করিতে পারিব না। আমার কোন ক্ষমতা কাছে কি না, এবং আমার ঘর ওসমান ও তার পিতার কোনরূপ অনিষ্ট ঘটতে পারে কি না, তা তাহা তাহাদিগকে উত্তমরূপে দেখাইতে হইবে। যেরূপ উপায়েই হউক, উঁহাদিগের উভয়কেই জেলে দিয়া আমার এতদিসের মনের যন্ত্রণা নিবারণ করিতে হইবে।

দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া জমাদার কহিল, আপনি যত শীঘ্র হয়, আগমন করুন। আমি সেই স্থানে গমন করি মাত্রই সমস্ত ঠিক করিয়া ফেলিব। তাহার নিমিত্ত আপনাকে ভাবিতে হইবে না

এই বলিয়া হেদায়েৎকে সঙ্গে লইয়া জমাদার তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

জমাদার ও হেদায়েৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, দারোগা সাহেব প্রথমে এতেলা পুস্তক নিজ হস্তে গ্রহণ করিয়া, নিম্নলিখিতরূপে প্রথম এতেল ফরিয়াদীর অসাক্ষাতেই লিখিলেন।

আমার নাম সেখ হেদায়েৎ। আমার বাসস্থান * * * গ্রাম। গত আটদিবস হইতে আমি আমার বাড়ীতে ছিলাম না, * * * গ্রামে আমার কুটুম্ব * * *-র নিকট আমি আমার কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে গমন করিয়াছিলাম। আমার বাড়ীতে অপর কেহ নাই; কেবলমাত্র আমার যুবতী কন্যা * * *-কে আমি বাড়ীতে রাখিয়া গিয়াছিলাম। অন্য প্রাতঃকালে আমি বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়া, আমার কন্যাকে আমার বাড়ীতে দেখিতে পাইলাম না। পাড়া-প্রতিবাসীগণের নিকট অনুসন্ধান করিয়া আনিতে পারিলাম যে, আমাদিগের গ্রামের জমিদার গোফুর খাঁ তাহার পুত্র ওসমান এবং কয়েকজন কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া খাজনা আদায় করিবার নিমিত্ত আমাদিগের গ্রামে আগমন করেন, এবং গ্রামের এক স্থানে বসিয়া প্রজাগণকে ডাকাইয়া খাজানার তহবিল করিতে থাকেন। শুনিলাম, আমাকেও ডাকিবার নিমিত্ত তিনি একজন পাইক পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। আমি বাড়ী ছিলাম না। সুতরাং পাইক আমাকে দেখিতে পায় নাই। মে গিয়া জমিদার মহাশয়কে কহে, হেদায়েৎ বাড়ীতে নাই, কেবল তাহার কন্যা বাড়ীতে আছে। সে কহিল, তাহার পিতা অদ্য দুই দিবস হইল, কুটুম্ব বাড়ীতে গমন করিয়াছে। এই কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় অতিশয় ক্রোধাবিত হইলেন ও কহিলেন, হেদায়েৎ কোন স্থানে যায় নাই। অনেক টাকা খাজানা বাকী পড়িয়াছে, আমার নিকট আসিলে খাজনা দিতে হইবে, এই ভয়ে সে লুক্কায়িত আছে। যা হক তাহার কন্যাকে ধরিয়া আন, তাহা হইলে সে এখনই আসিয়া খাজনা মিটাইয়া দিবে। এই আদেশ পাইয়া জমিদারের পুত্র ওসমান কয়েকজন কর্ম্মচারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে আমার বাড়ী হইতে তার অনিচ্ছা-স্বত্বে জোর করিয়া তাহাকে ধরিয়া জমিদার মহাশয়ে নিকট লইয়া যায়। জমিদার মহাশ প্রায় দুই ঘণ্টা তাহাকে সেই স্থানে বসাইয়া রাখেন। যুবতী স্ত্রীলোকের এইরূপ অবমাননা দেখিয়া, গ্রামস্থ সমস্ত লোক আমার কন্যাকে ছাড়িয়া দিবার নিমিত্ত জমির মহাশয়কে বার বার অনুরোধ করেন; কিন্তু তিনি কাহারও কথায় কর্ণপাত না করিয়া, সেই স্থান হইতে গমন করিবার সময় তাঁর পুত্র ওসমান ও অপরাপর কৰ্ম্ম চারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে বাঁধিয়া তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগের বাড়ী পর্যন্ত লইয়া যান। বাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়া, তাঁহারা যে আমার কন্যার কি অবস্থা করিয়াছেন, তাহা আমি অবগত নহি। সেই পর্যন্ত আমার কন্যা আর প্রত্যাগমন করে নাই, বা গ্রামের কোন ব্যক্তি আর তাহাকে দেখে নাই। আমার অনুমান ও বিশ্বাস যে, জমিদার মহাশয় এবং তাহার পুত ওসমান আমার কন্যাকে তাহার বিনা-ইচ্ছায় তাহাদিগেয় বাড়ীর ভিতর অন্যায়রূপে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, বা তাহাকে হত্যা করিয়াছে। আমি আপন ইচ্ছায় আমার কন্যাকে পাইবার মানসে এই এজাহার দিতেছি। ইহাতে যেরূপ অনুসন্ধানের প্রয়োজন, সেইরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া আমার কন্যাকে বাহির করিতে, আজ্ঞা হয়। আমি যে এজাহার দিতেছি, গ্রামশুদ্ধ সমস্ত লোক তাহার সাক্ষী আছে। সেই স্থানে গমন করিলেই, আপনি জানিতে পারিবেন যে, আমার কথা সম্পূর্ণরূপ সত্য কি না আমি লেখা-পড়া জানি না, আমার এজাহার যায় আপনি লিখিয়া লইলেন, তাহা পাঠ করিয়া পুনরায় আমাকে আপনি শুনাইয়া দিলেন; আমি যেরূপ বলিয়াছি, ঠিক সেই রূপই লেখা হইয়াছে। আমি আমার এজাহার শুনিয়া, আমি এই স্থানে নিশানসহি করিলাম। ইতি–

নিশানসহি-সেখ হেদায়েৎ।

দারোগা সাহেব প্রথম এতো পুস্তকে এইরূপ এজাহার লিখিয়া উপযুক্তরূপ লোকজন সমভিব্যাহারে এই অনুসন্ধানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। তাহার সহিত গমন করিবার নিমিত্ত যে সকল লোকজনের উপর আদেশ হইল, তাঁহারাও আহারাদি করিয়া ক্ৰমে প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।

সন্ধ্যায় একটু পূর্বে দারোগা সাহেব তাহার লোকজন সমভিব্যাহারে হেদায়েতের গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। হেদায়েতের সমভিব্যাহারে জমাদার সাহেব পূর্বেই সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন। সুতরাং দারোগা সাহেব সেই স্থানে গমন করিলে তাহার যে সকল বিষয়ের প্রয়োজন হইবার সম্ভাবনা, তাহার সমস্তই তিনি সেই স্থানে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন; অর্থাৎ বসিবার স্থান, লোকজন, রাত্রিকালের আহারাদির বন্দোবস্ত সমস্তই ঠিক ছিল। তাহার উপর গ্রামস্থ প্রায় সমস্ত লোকই সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন।

দারোগা সাহেব সেই রাত্রি সেই গ্রামে আহারাদি করিয়া রাত্রিযাপন করিলেন মাত্র; কিন্তু যে বিষয় অনুসন্ধানের নিমিত্ত তিনি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান করা দূরে থাকুক, গ্রামস্থ কোন ব্যক্তিকে সে বিষয়ের কোন একটা কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। আহারাদি করিয়া রাত্রিকালে যখন দারোগা সাহেব শয়ন করিলেন, সেই সময় তাঁহার আদেশ গ্রহণ করিয়া, গ্রামস্থ সমস্ত লোক প্রস্থান করিলেন; কিন্তু গমন করিবার সময় দারোগা সাহেব তাহাদিগকে পরদিবস অতি প্রত্যুষে পুনরায় সেই স্থানে আসিতে কহিলেন। সমস্ত লোক গমন করিবার পর দারোগা সাহেব জমাদারের সহিত অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ করিয়া উভয়েই নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন।

পরদিবস অতি প্রত্যুষেই দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালিত হইল। সকলে আগমন করিবার পর একে একে তিনি সমস্ত লোককেই দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাদিগের কোন কথা এখন তিনি কাগজ-কলমে করিলেন না; তবে দেখা গেল, সেই সকল লোক যাহা কহিল, তাহার ছত্রে ছত্রে প্রথম এতেলার সহিত মিলিয়া গেল। দারোগা সাহেব নিজের ইচ্ছামত যেরূপ ভাবে প্রথম এতেলা লিখিয়াছিলেন, গ্রামস্থ সমস্ত লোকেই যখন সেইরূপ ভাবে তাহাদের এজাহার প্রদান করিল, তখন তিনি সেই সকল বিষয় কাগজপত্রে না লিখিয়া আর স্থির থাকিতে পারিলেন না।

গ্রামের প্রধান প্রধান চারি পাঁচজনের এজাহার দারোগা সাহেব লিখিয়া লইলেন। গ্রামের কোন লোক ওমানের উপর সন্তুষ্ট ছিল না। সুতরাং সকলেই ওসমান ও তাহার পিতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করিল। সকলেই কহিল যে, হেদায়েতের নিকট হইতে খাজনা আদায় করিবার নিমিত্তই এই গোলযোগ। হোয়েতের কন্যাকে লাইক করিয়া রাখিলেই খাজনা আদায় হইবে, এই ভাবিয়া গোরখা তাহাকে ধরিয়া আনিবার নিমিত্ত আদেশ প্রদান করেন। তাঁহার পুত্র ওসমান অপর কয়েকজন লোকের সাহায্যে এই আদেশ প্রতিপালন করে। পরিশেবে উহার কন্যাকে ধরিয়া তাঁহা দিগের বাড়ীতে লইয়া যায়।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

ওসমান ও তাহার পিতাকে বিপদাপন্ন করিবার মানসে দারোগা সাহেব যাহা মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন, কাৰ্য্যেও তাহা পরিণত হইতেছে দেখিয়া, মনে মনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন।

সেই স্থানে অনুসন্ধান আপাততঃ স্থগিত রাখিয়া হেদায়েৎ ও গ্রামের দুই চারিজন লোককে সঙ্গে লইয়া গোফুর খাঁন বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন।

গোফুর খাঁ সেই সময় বাড়ীতেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ওসমান সেই সময় বাড়ীতে ছিল না। গোফুর খাঁর সহিত দারোগা সাহেবের কিয়ৎক্ষণ কথাবার্তা হইলে পর, ওসমান আসিয়া সেই স্থানে কোথা হইতে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া দারোগা সাহেব কহিলেন, আপনার উপর একটা ভয়ানক নালিশ হইয়াছে। যে পর্যন্ত আমি অনুমতি প্রদান না করি, সেই পৰ্যন্ত আপনি আমার সম্মুখ হইতে গমন করিবেন না।–

ওসমান। আর যদি আমি চলিয়া যাই?

দারোগা। তাহা হইলে আপনার সহিত ভদ্রোচিত ব্যবহার করিতে আমি কোনরূপেই সমর্থ হইব না। সামান্য লোককে যেরূপ ভাবে আমরা রাখিয়া থাকি, বাধ্য হইয়া আপনাকেও সেইরূপ ভাবে আমাকে রাখিতে হইবে।

গোফুর। আমার উপর অভিযোগ কি?

দারোগা। আপনার আদেশ অনুযায়ী আপনার গ্রামবাসী আপনারই প্ৰজা হেদায়েতের যুবতী কন্যাকে অন্যায়রূপে আজ কয়েকদিবস হইতে আপনার বাটীতে আনিয়া আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে।

গোফুর। আমার আদেশ অনুযায়ী?

দারোগা। প্রমাণে সেইরূপ অবগত হইতে পারিতেছি।

গোফুর। আমি তাহাকে আবদ্ধ করিতে আদেশ প্রদান করিব কেন?

দারোগা। বাকী খাজানা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে।

গোফুর। মিথ্যা কথা।

দারোগা। সত্য মিথ্যা আমি অবগত নহি; প্রমাণে যাহা পাইতেছি, তাহাই আমি আপনাকে বলিতেছি। আর সেই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া আমাকে ইহার প্রতিবিধান করিতে হইবে।

গোফুর। আপনি প্রমাণ পাইতেছেন, আমার আদেশে এই কাৰ্য্য হইয়াছে?

দারোগা। হাঁ।

গোফুর। আমার আদেশ প্রতিপালন করিল কে? অর্থাৎ কে তাহাকে ধরিয়া আনিল?

দারোগা। আপনার পুত্র, এবং আর তিন চারিজন নোক।

গোফুর। সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আপনি এখন কি করিতে চাহেন?

দারোগা। আপনি যদি সহজে সেই স্ত্রীলোকটীকে বাহির করিয়া না দেন, তাহা হইলে প্রথমতঃ আপনার বাড়ী আমি উত্তমরূপে খানাতল্লাসি করিয়া দেখিব। দেখিব, উহার ভিতর সেই স্ত্রীলোকটা পাওয়া যায়, কি না।

গোফুর। আর যদি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে কি হইবে?

দারোগা। সে পরের কথা; যাহা হয়, পরে দেখিতে পাইবেন।

ওসমান। কার হুকুম মত আপনি আমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে চাহেন? বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করি বার কোন ওয়ারেন্ট আছে কি?

দারোগা। কাহার হুকুম মত আমি তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে চাই, তাহা তুমি বালক, জানিবে কি প্রকারে? আমি আমার নিজের হুকুমে তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিব।

ওসমান। যদি প্রবেশ করিতে না দি?

দারোগা। তোমার কথা শোনে কে?, আমি জোর করিয়া প্রবেশ করিব। তাহাতে যদি তুমি কোনরূপ প্রতি বন্ধকতা জন্মাও, তাহা হইলে তোমায় অপর আর এক মোকদ্দমায় আসামী হইতে হইবে।

ওসমান। যাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবেন, তাহাকে যদি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে জবাবদিহি কে করিবে? আপনি করিবেন কি?

দারোগা। যাহাকে জবাবদিহিতে আনিতে পারিবে, সে-ই জবাবদিহি করিবে।

ওসমান। আর যদি সে আপন ইচ্ছায় আমাদিগের বাড়ীতে আসিয়া থাকে?

দারোগা। সে উত্তম কথা; সে আসিয়া আমাদিগের সম্মুখে সেই কথাই বলুক। তাহা হইলেই সকল গোলযোগ মিটিয়া যাইবে।

গোফুর। তবে কি স্ত্রীলোকটা আমাদের বাড়ীতে আছে?

ওসমান। না, সে আমাদের এখানে আসেও নাই, বা আমাদিগের এখানে নাইও।

দারোগা। মহাশয়! আমি আর অধিক বিলম্ব করিতে পারিতেছি না। এখন কি করিতে চাহেন, বলুন। স্ত্রীলোকটাকে কি আমার সম্মুখে আনিয়া দিবেন, না আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া থানাতল্লাসি করিতে আরম্ভ করিব?

গোফুর। আমি ত বলিতেছি, সেই স্ত্রীলোকটা আমা দিগের বাড়ীতে নাই। আমার কথায় আপনি বিশ্বাস না করেন, আপনার যাহা অভিরুচি হয়, তাহা আপনি করিতে পারেন। কিন্তু, আমি পূর্বেই আপনাকে সতর্ক করিয়া দিতেছি, যাহা করিবেন, ভবিষ্যৎ ভাবিয়া করিবেন।

দারোগা। আমার কাৰ্য আমি বুঝি, তাহার নিমিত্ত আমি আপনার নিকট উপদেশ গ্রহণ করিতে আসি নাই। আমি লোকজনের সহিত আপনার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেছি, ইচ্ছা করেন যদি, তাহা হইলে আপনার বাড়ীর স্ত্রীলোকদিগকে কোন একটা গৃহের ভিতর গমন করিবার নিমিত্ত বলিতে পারেন। আর ইচ্ছা না করেন, তাহাতে আমার কোনরূপ ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই।

এই বলিয়া দারোগা সাহেব আপনার সমভিব্যাহারী লোকজনের সহিত বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার অভিপ্রায়ে উথিত হইলেন। তখন অনন্যোপায় হইয়া গোফুর খাঁ, ওসমান, এবং সেই সময় সেই স্থানে গোফুরের বন্ধু-বান্ধব গণের মধ্যে যাহারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারাও সকলে দারোগা সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিবার নিমিত্ত উথিত হইলেন।

দারোগা সাহেব প্রথমেই অন্দরমহলের মধ্যে প্রবেশ করিলেন না। সদর বাড়ীর ভিতর যে সকল গৃহ ছিল, প্রথমেই সেই সকল গৃহের মধ্যে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এক একখানি করিয়া সৰ্ব্বপ্রথমে সমস্ত খোলা ঘরগুলি দেখিলেন। তাহার ভিতর কিছু দেখিতে না পাইয়া, পরি শেষে যে ঘরগুলিতে চাবি বদ্ধ ছিল, চাবি খুলিয়া সেই ঘর গুলিও একে একে দেখিতে লাগিলেন।

গোফুর খাঁর প্রকাণ্ড বাড়ী; সুতরাং সদরে ও অন্দরে অনেক ঘর। বাহিরের ঘরগুলি দেখিতে প্রায় দুই ঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইয়া গেল। এইরূপে তালাবদ্ধ কতকগুলি ঘর দেখিবার পর এক পার্শ্বের এক নির্জন গৃহের তালা খুলিলেন। সেই গৃহের ভিতর অপর দ্রব্য-সামগ্রী কিছুই ছিল না, কেবল গৃহের মধ্যে একখানি পালঙ্কের উপর একটা বিছানা আছে মাত্র।

সেই বিছানার সন্নিকটে গিয়া বা দেখিলেন, তাহাতে সমস্ত লোকেই একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। ইতি পূর্বে দারোগা সাহেব যাহা স্বপ্নেও একবার মনে ভাবেন নাই, তিনি তাহা দেখিয়াই যেন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণের নিমিত্ত যেন তাহার সংজ্ঞাও বিলুপ্ত হইল। একটু পরেই দারোগা সাহেব কহিলেন, কি মহাশয়। এ কি দেখিতেছি?

দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া আর কাহারও মুখে কোন কথা বাহির হইল না। পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে দেখিতে লাগিলেন। কেবল হেদায়েৎ সেই বিছানার সঙ্গিক বৰ্ত্তী হইয়া কহিল, মহাশয়! এই আমার কন্যা।

এই বলিয়া হেদায়েৎ তাহার কন্যার গাত্রে হস্তাপণ করিয়া বার বার তাহাকে ডাকিতে লাগিল; কিন্তু সে নড়িল না, যা তাহার কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না। তখন সকলেই জানিতে পারিল যে, সে আর জীবিত নাই।

দারোগা। প্রথমতঃ বড় লম্বা লম্বা কথা কহিতেছিলে যে, এখন আর মুখ দিয়া কথা বাহির হইতেছে না কেন?

গোফুর। ইহার ব্যাপার আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

দারোগা। এখন ত কিছুই বুঝিতে পারিবেন না। এই স্ত্রীলোকের মৃতদেহ এই তালাবন্ধ গৃহের ভিতর কিরূপে আসিল?

গোফুর। আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।

দারোগা। (ওসমানের প্রতি) কিগো ওসমান মিঞা, আপনিও বোধ হয়, ইহার কিছুই জানেন না?

ওসমান। না মহাশয়! আমিও ইহার কিছুই অবগত নহি।

দারোগা। সদর বাড়ীর ভিতর তালাবদ্ধ গৃহে, পালঙ্কের। উপর মৃত স্ত্রীলোকের লাস রহিয়াছে। আর আপনারা বলিতেছেন যে, আপনারা কিছুই জানেন না। দ্বারে যে দ্বারবান বসিয়া আছে, সেও বলিবে, আমি কিছুই জানি না। কিন্তু কিরূপে এই স্থানে লাস আসিল, ইহার যদি সন্তোষ জনক প্রমাণ আমাকে আপনারা প্রদান করিতে না পারেন, তাহা হইলে জানিবেন, আপনাদিগের উভয়কেই আমি ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলাই।

দারোগার কথা শুনিয়া গোফুর খাঁ চতুর্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন, এবং এই অবস্থায় কি করিবেন, তাহার কিছুই স্থির করতে না পারিয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িলেন।

দারোগা। কি মহাশয়। আপনি চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন যে? এই লাস কিরূপে আপনার বাড়ীর ভিতর আসিল, সে সম্বন্ধে কোন কথা বলিতেছেন না কেন?

গোফুর। আপনার কথায় আমি যে কি উত্তর প্রদান করিব, তাহা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। যখন ইহার কিছুই আমি অবগত নহি, তখন আমি আপনাকে আর কি বলিব?

দারোগা। কিগো দ্বারবান্ সাহেব! এ সম্বন্ধে তুমি কি বলিতে চাই?

দ্বারবান্। দোহাই ধর্মাবতার! আমি ইহার কিছুই জানি না।

দারোগা। তুমি দ্বারবান, সর্বদা তুমি দরজায় বসিয়া থাক, অথচ তুমি বলিতেছ, তুমি ইহার কিছুই জান না। এ কথা কি কেহ সহজে বিশ্বাস করিতে পারে?

দ্বারবান্। আপনি বিশ্বাস করুন, আর না করুন, আমি প্রকৃত কথাই বলিতেছি। আমি প্রকৃতই জানি না যে, এই মৃতদেহ কিরূপে বা কাহা কর্তৃক এই বাড়ীর ভিতর আসিল।

গোফুর খাঁ, ওসমান ও দ্বারা যখন কোন কথা বলিল না, তখন সেই সময় দারোগা সাহেব তাহাদিগকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, নিজের ইচ্ছামত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেন।

লাশের সুরতহাল করিয়া পরীক্ষার্থ উহ জেলার ডাক্তার সাহেবের নিকট প্রেরণপূর্বক ঘটনাস্থলে বসিয়া দারোগা সাহেব কয়েকদিবস পর্যন্ত অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। এখনকার অনুসন্ধান আসামীগণকে লইয়া নহে; এখনকার অনুসন্ধান, ফরিয়াদী ও সেই স্থানের প্রজাগণের সাহায্যে এবং জমাদার সাহেবের আন্তরিক যত্নের উপর নির্ভর করিয়াই হইতে লাগিল। অর্থাৎ গোফুর খাঁ ও তাঁহার পুত্রের বিপক্ষে এই হত্যা সম্বন্ধে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইতে পারে, এখন সেই অনুসন্ধানই চলিতে লাগিল।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

পাঠকগণ পূর্ব হইতেই অবগত আছেন যে, গোফুর খাঁ একজন নিতান্ত সামান্য লোক নহেন। দেশের মধ্যে তাঁহার মান-সন্ত্রম যেরূপ থাকা আবশ্যক, তাহার কিছুরই অভাব নাই। অর্থও যথেষ্ট আছে। কিন্তু এই সকল থাকা স্বত্বেও প্রজাগণ কেহই তাহার উপর সন্তুষ্ট নহে; সকলেই তাঁহার বিপক্ষ। প্রজাগণ গোর খার বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইবার একমাত্র কারণ, তাঁহার পুত্র ওসমান। ওসমানের অত্যাচারে সকলেই সবিশেষরূপ জ্বালাতন হইয়া পড়িয়াছে। যখন ওমামের অত্যাচার তাঁহারা সময় সময় সহ করিয়া উঠিতে সমর্থ হয় নাই, তখন তাঁহারা তাহার পিতা গোফুর খাঁর নিকট পর্যন্ত গমন করিয়া, ওসমানের অআচারের সমস্ত কথা তাহার নিকট বিবৃত করিয়াছে। তথাপি গোফুর তাহাদিগের কথায় কোনরূপ কর্ণপাত করেন নাই, বা তাহার প্রতিবিধানের কোনরূপ চেষ্টাও করেন নাই। এই সকল কারণে প্ৰজামাত্রেই পিতা-পুত্রের উপর অস। সুতরাং আজ তাঁহারা যে সুযোগ পাইয়াছে, সেই সুযোগ পরিত্যাগ করিবে কেন? তাহার উপর দারোগা সাহেব সহায়।

প্রজাগণ এক বাক্যে গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্র ওসমানের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতে লাগিল। অনুসন্ধান সমাপ্ত হইলে, দারোগা সাহেব দেখিলেন, নিম্নলিখিত বিষয় সম্বন্ধে উপস্থিত মোকদ্দমায় উত্তমরূপে প্রমাণ হইয়াছে।

১ম। সেখ হেদায়েতের যে গ্রামে বাড়ী, সেই গ্রামের প্রজাগণের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, গোফুর খাঁ ও ওসমান বকেয়া খাজানা আদায় করিতে সেই গ্রামে গমন করেন। হেদা য়েতের নিকট কয়েক বৎসরের খাজানা বাকী পড়ায়, এবং হেদায়েৎ সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত না থাকায়, ওসমান গোফুর খাঁর আদেশমত কয়েকজন পাইকের সাহায্যে, হেদা যেতের একমাত্র যুবতী কন্যাকে বলপূর্বক তাহার বাড়ী হইতে সৰ্ব্বসমক্ষে ধরিয়া আনে, এবং তাহার নিকট হইতে খাজানা আদায় করিবার মানসে গোফুর খাঁর আদেশমত সৰ্ব্ব সমক্ষে তাহাকে সবিশেষরূপে অবমানিত করে। কিন্তু তাহার নিকট হইতে খাজনা আদায় না হওয়ায়, গোয় খ ও ওসমান অপরাপর লোকের সাহায্যে তাহাকে সেই স্থান হইতে বলপূর্বক ধরিয়া আপন গৃহাভিমুখে লইয়া যান।

২য়। অপরাপর গ্রামের কতকগুলি প্ৰজার দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, হেদায়েতের কন্যাকে হেদায়েতের গ্রাম হইতে ধৃত অবস্থায় গোফুর খাঁর গ্রামে গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্র কর্তৃক লইয়া যাইতে অনেকেই দেখিয়াছে।

৩য়। গোফুর খাঁর গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী প্রজাবর্গের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, হেদায়েতের কন্যাকে গোয় খা ও ওসমান তাঁহাদিগের বাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়াছে।

৪র্থ। গোফুর খাঁর কয়েকজন ভৃত্য ও তাহার সেই পূর্ব বর্ণিত দ্বারবানের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, গোফুর খাঁর আদেশমত ওসমান হেদায়েতের সেই কন্যাকে আপনাদের গৃহের ভিতর আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, এবং যে পর্যন্ত সে জীবিত ছিল, তাহার মধ্যে ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় সে নিতান্ত অস্থির হইলেও, তাহাকে একমুষ্টি অন্ন বা এক গণ্ডুষ জল প্রদান করিতে বারণ করিয়াছিল। এমন কি, সাক্ষিগণের মধ্যে কেহ দয়াপরবশ হইয়া উহাকে এক গণ্ডষ পানীয় প্রদান করিতে উদ্যত হইলে, গোফুর ও তাঁহার পুত্র ওসমান খ। তাহাকেও উহা প্রদান করিতে দেন নাই।

এতদ্ব্যতীত আরও প্রমাণিত হইল যে, যে দিবস পুলিস কর্তৃক লাস বাহির হইয়া পড়ে, তাহার দুই কি তিন দিবস পূর্বে একজন ভৃত্য কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, ওসমান খার নিকট হইতে সেই গৃহের চাবি অপহরণ করে, এবং ওসমান ও গোফুর খাঁর অসাক্ষাতে সেই গৃহের চাবি খুলিয়া দেখিতে পায় যে, ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা এরূপ হইয়া পড়িয়াছে যে, তাহার আর বাঁচিবার কিছুমাত্র আশা নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই সামান্য ভৃত্যেরও অন্তরে দয়ার উদ্রেক হইল, এবং দ্বারধানের সহিত পরামর্শ করিয়া, সে ইহা স্থির করিল যে, তাহার অদৃষ্টে যাহাই হউক, সে আজ সেই হতভাগিনীকে কিছু আহারীয় ও পানীয় প্রদান করিবে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সে কিছু আহারীয় ও পানীয় আনয়ন করিবার নিমিত্ত গমন করে। কিন্তু উহা সংগ্রহ করিয়া পুনরায় সেই স্থানে আসিয়া দেখিতে পায় যে, ওসমান খাঁ সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ভূতের অভি সন্ধির কথা জানিতে পারিয়া, ওসমান তাহার উপর সবিশেষ রূপ অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহার হস্ত হইতে আহাৰীয় ও পানীয় কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করেন। তৎপরে, সেই স্ত্রীলোকটী আহারীয় ও পানীয় প্রার্থনা করিয়াছে, এই ভাবিয়া ওসমান সেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করেন, ও সেই মহা অপরাধের জন্য সেই সময় সেই স্থানে যে সকল ভৃত্যাদি উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের সম্মুখে সেই মৃত্যুশয্যা-শায়িত স্ত্রীলোকটীকে পদাঘাত করেন। সেই সময় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা এরূপ হইয়া পড়িয়াছিল যে, তাহার কথা কহিবার বা রোদন করিবার কিছুমাত্র ক্ষমতা ছিল না; সুতরাং সেই পদাঘাত সে বিনা-বাক্যব্যয়ে অনায়াসেই সহ করে। পরিশেষে ওসমান সেইরূপ অবস্থাতেই সেই স্ত্রীলোকটীকে সেই গৃহের ভিতর রাখিয়া, পুনরায় সেই গৃহের দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দৈন, এবং চাবি লইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করেন। ভৃত্য গোয় খার নিকট গমন করিয়া তাহার নিকট এই সমস্ত ঘটনা বর্ণন করে। গোর খ ইহার প্রতিবিধানের পরিবর্তে, সেই ভৃত্যের উপরই বরং অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহাদিগের বিনা-অনুমতিতে সেই স্ত্রী লোকটীকে আহারীয় ও পানীয় দিতে উদ্যত হইয়াছিল বলিয়া, তাহাকে কটুক্তি করিয়া গালি প্রদান করেন, ও চাকরী হইতে তাহাকে বিতাড়িত করেন।

৫ম। পুলিসের সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর সেই যুবতী কন্যার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। আরও প্রমাণিত হইল যে, যে গৃহে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই গৃহের তালার চাবি গোফুর খাঁর নিদর্শনমত ওসমান খাঁর নিকট হইতে পাওয়া গিয়াছে।

৬ষ্ঠ। একজন পাইক,যে গোর খার পাইক বলিয়া পরিচয় প্রদান করিল,—তাহার দ্বারা এই ঘটনার আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা প্রমাণিত হইল; অর্থাৎ খাজানা আদায় করি বার নিমিত্ত হেদায়েতের বাড়ী হইতে সেই স্ত্রীলোককে আনয়ন হইতে, গোফুর খাঁন বাড়ীর ভিতর লাস পাওয়া পর্যন্ত যে সকল ঘটনা অপরাপর সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হইল, তাহার সমস্ত অংশেই এই পাইক সৰ্ব্বতোভাবে পোষকতা করিল।

৭ম। লাস পরীক্ষাকারী ডাক্তার সাহেবের দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, অনাহারই সেই স্ত্রীলোকটীর মৃত্যুর কারণ।

৮ম। এই সকল প্রমাণ ব্যতীত অপর আর কোনরূপ প্রমাণের যাহা আবশ্যক হইল, তাহাও প্রজাগণের দ্বারা প্রমাণিত হইতে বাকী রহিল না।

এই মোকদ্দমায় গোফুর খা ও তাঁহার পুত্রের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইল, তাহা দেখিয়া গোফুর খাঁ বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, এই বৃদ্ধ বয়সে কোনরূপেই তাঁহার আর নিষ্কৃতি নাই। আরও বুঝিতে পারিলেন যে, দারোগা সাহেবের পূর্বোক্ত স্ত্রীলোকটীকে তাঁহার পুত্র বাহির করিয়া জানায়, এবং দারোগা সাহেব তাহার নিকট তাহার পুত্রের বিপক্ষে নালিশ করিলেও, তিনি তাহার কোনরূপ প্রতিবিধানের চেষ্টা করেন না বলিয়াই, দারোগা সাহেবের সাহায্যে তাঁহার এই সর্বনাশ উপস্থিত হইল। কিন্তু তিনি বড়ই আশ্চর্যান্বিত হইলেন যে, হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ তাঁহার বাড়ীর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর কিরূপে আসিয়া উপস্থিত হইল। যখন প্ৰজামাত্রই বলিতেছে যে, গোফুর খাঁ তাহার পুত্রের ন্যায়, সকলই অবগত আছেন, তখন গোফুর খাঁ এ সম্বন্ধে কিছুই অবগত নহেন, বা তাহার জ্ঞাতসারে এ কাৰ্য ঘটে নাই, এ কথা বলিলেই বা কোন বিচারক তাহা বিশ্বাস করিবেন?

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

গোফুর খাঁর একজন অতি বিশ্বাসী কর্ম্মচারী ছিলেন, তাহার নাম হোসেন। পুলিস যখন প্রথম অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করেন, বা যে সময় গোফুরের গৃহে হেদায়েতের কন্যার মৃত দেহ পাওয়া যায়, সেই সময় হোসেন সেই স্থানে উপস্থিত ছিল না; জমিদারীর কাৰ্য্য পৰ্যবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত তিনি স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। তাঁহার মনিবের এইরূপ বিপদ উপস্থিত হইয়াছে জানিতে পারিয়া, জমিদারী হইতে তিনি আপনার মনিবের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, মনিব ও মনিব-পুত্র উভয়েই হত্যাপরাধে ধৃত হইয়া ছেন। তাহাদিগের উপর যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা জানিতে পারিয়া, তিনি অতিশয় ভাবিত হইলেন। তখন এই বিপদ হইতে তাহার মনিবকে কোনরূপে উদ্ধার করিবার উপায় দেখিতে না পাইয়া, নির্জনে গিয়া তিনি একদিবস রাত্রি কালে দারোগা সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।

দারোগা সাহেব তাহাকে পূর্ব হইতেই চিনিতেন। তাহাকে দেখিবামাত্রই কহিলেন, কি হে হোসেনজি! কি মনে করিয়া?

হোসেন। আর মহাশয়! কি মনে করিয়া! কি মনে করিয়া আমি আপনার নিকট আসিয়াছি, তাহা আর আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না কি?

দারোগা। আপনি কি মনে করিয়া আসিয়াছেন, তাহা আমি কিরূপে বুঝিতে পারিব? আপনার অন্তরের কথা আমি কিরূপে জানিব?

হোসেন। সে যাহা হউক, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন আপনি কোনরূপে উঁহাদিগকে না বাঁচাইলে, আর বাঁচিবার উপায় নাই।

দারোগা। কাহাদিগকে বাঁচাইতে হইবে? তোমার মনিব ও মনিক-পুত্রকে?

হোসেন। তদ্ভিন্ন আমি এই সময় আর কাহার জন্য আপনার নিকট আসিব?

দারোগা। আগে যদি আপনি আসিতেন, তাহা হইলে উঁহাদিগকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতে পারিতাম, কিন্তু এখন সে চেষ্টা বৃথা। এখন আমার ক্ষমতার অতীত হইয়া পড়িয়াছে।, হোসেন। যে পর্যন্ত মোকমার চুড়ান্ত বিচার শেষ হইয়া না যায়, সে পর্যন্ত আপনার ক্ষমতার সীমা এড়াইতে পারে না। এখন আমাকে কি করিতে হইবে বলুন। আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিতে, বা যাহা চাহিবেন, তাহাই প্রদান করিতে প্রস্তুত। এখন যেরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া হউক, উঁহাদিগের প্রাণ আপনাকে রক্ষা করিতেই হইবে।

দারোগা। দেখুন হোসেন সাহেব, এ পর্যন্তু ওসমান যেরূপ অত্যাচার করিয়া আসিতেছে, তাহাতে উহার প্রতি কাহার দয়া হইতে পারে? আপনি ত অনেক দিবস হইতে গোফুর খাঁর নিকট কৰ্ম্ম করিয়া আসিতেছেন; বলুন দেখি, তাঁহার প্রজাগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি ওসমানের অত্যাচারে প্রপীড়িত হইতে বাকী আছে। বলুন দেখি, কয়জন লোক আপনার জাতি-ধৰ্ম্ম বজায় রাখিয়া, তাহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিতে সমর্থ হইয়াছে। বলুন দেখি, কতগুলি স্ত্রীলোক তাহার জমিদারীর মধ্যে বাস করিয়া তাহাদিগের সর্বপ্রধান-ধৰ্ম্ম সতীত্ব রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে। যাহার এই সকল কাৰ্য, তাহাকে আপনি এই বিপদ হইতে রক্ষা করিতে চাহেন। স্ত্রীলোকের ধর্ম নষ্ট করা ব্যতীত যাহার অপর আর কোন চিন্তা নাই, সুন্দরী স্ত্রীলোককে কোন গতিতে তাহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা বা স্বামীর নিকট হইতে অপহরণ করিবার যাহার সর্বদা মানস, আপনার পাশব বৃত্তি চরিতার্থ করিবার নিমিত্ত যে ব্যক্তি সকল কাৰ্য্যই অনায়াসে করিতে পারে, আপনি তাহার প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিবেন না। তাহাকে এই মোকদ্দমা হইতে বাচাই বার কথা দুরে থাকুক, তাহাকে সাহায্য করিবার নিমিত্ত অতি সামান্য মাত্র চেষ্টা করিলেও, তাহাতে মহাপাতক হয়। তাই বলি, আপনি আমাকে এরূপ অনুরোধ করিবেন না। সহস্র সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেও, এ কাৰ্য্য আমার দ্বারা কোনরূপেই হইবে না।

হোসেন। আচ্ছা মহাশয়! ওসমানই যেন মহাপাতকী, কিন্তু তাহার বৃদ্ধ পিতার অপরাধ কি? পুত্রের অপরাধে পিতাকে দণ্ড দিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন কেন?

দারোগা। বৃদ্ধ পাপী নহে? আমার বিবেচনায় ওসমান অপেক্ষা বৃদ্ধ শতগুণ অধিক পাপ। যে পিতা পুত্রের দুস্কাৰ্য্য সকল জানিতে পারি, তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা না করেন, যাহার নিকট তাহার পুত্রের বিপক্ষে শত সহস্র নালিশ উপ স্থিত হইলেও, তিনি তাহার প্রতি কর্ণপাতও করেন না, সেরূপ পিতাকে সেই অত্যাচারকারী পুত্র অপেক্ষা শতগুণ অধিক পাপী বলিয়া আমার বিশ্বাস। এরূপ অবস্থায় যুবক বালকের বরং মাফ আছে, কিন্তু বৃদ্ধ পিতা কোনরূপেই ক্ষমার্হ নহে।

হোসেন। ওসমান যে অত্যাচারী, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহার অত্যাচারের সকল কথা যে গোফুর খাঁর কর্ণগোচর হয়, তাহা আমার বোধ হয় না। পুত্রের অত্যাচারের কথা শুনিতে পাইলে, তাহার নিবারণের চেষ্টা না করিবেন, সেরূপ পিতা গোফুর খাঁ নহেন। আমার বিশ্বাস যে, এই সকল অত্যাচারের কথা কখনই তাহার কর্ণগোচর হয় নাই। তিনি জানিতে পারিলে, ওসমান এতদুর অত্যাচার করিতে কখনই সমর্থ হইত না।

দারোগা। মিথ্যা কথা, বৃদ্ধ সমস্ত কথা অবগত আছে। জানিয়া শুনিয়া, সে তাহার পুত্রকে কোন কথা বলে না; বরং তাহার অত্যাচারের সাহায্য করে। ওসমান কর্তৃক এমন কোন ঘটনা ঘটিয়াছিল, যাহার সহিত আমার নিজের কোনরূপ সংস্রব ছিল। তাহার প্রতিবিধানের নিমিত্ত আমি নিজে কানপুর পর্যন্ত গমন করিয়া, সমস্ত কথা বৃদ্ধের কর্ণগোচর করি। কিন্তু কৈ, তিনি তাহার কি প্রতিবিধান করিয়াছিলেন?

হোসেন। আমি বুঝিতে পারিতেছি, যে কার্যের সহিত আপনার নিজের সংস্রব ছিল, সেই কাৰ্য্য তাহার কর্ণগোচর হইলেও, তিনি তাহার প্রতিবিধানের কোন চেষ্টা করেন নাই বলিয়া, আপনি অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন। কিন্তু আমার অনুরোধে এখন আপনাকে সেই ক্রোধ পরিত্যাগ করিতে হইবে। আপনার যে কাৰ্য্য তখন ওসমান বা তাঁহার পিতার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, সেই কাৰ্য এখন আমি সম্পন্ন করিয়া দিব। তদ্ব্যতীত আপনি আর যাহা প্রার্থনা করেন, তাহাও আমি প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। এখন আপনি একটু অনুগ্রহ করিলেই, আমাদিগের অনেক মঙ্গল হইতে পারিবে।

দারোগা। যে কাৰ্য্যের সহিত আমার সংশ্রব আছে, সে কাৰ্য্য আপনি সম্পন্ন করিয়া দিবেন কি প্রকারে? আপনি কি সেই ঘটনার বিষয় কিছু অবগত আছেন?

হোসেন। সেই সময় ছিলাম না; কিন্তু এখন সমস্তই জানিতে পারিয়াছি, এবং ওসমান তাহাকে কোথায় রাখিয়াছে, তাহাও আমি অনুসন্ধানে অবগত হইতে পারিয়াছি। ইচ্ছা করিলে, এখন তাহাকে অনায়াসেই আপনি পাইতে পারেন।

দারোগা। এই মোকদ্দমা সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণ হইয়া গিয়াছে, তাহা বোধ হয়, আপনি জানিতে পারিয়া ছেন। সমস্তই এখন কাগজ-পত্র হইয়া গিয়াছে। উর্দ্ধতন কর্ম্ম চারীগণ পৰ্য্যন্ত সকলেই এখন ইহার সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিয়াছেন। এখন আর আমার দ্বারা আপনাদিগের কি উপকার হইতে পারে?

হোসেন। প্রথম অবস্থায় আমি এখানে থাকিলে এই মোকদ্দমার অবস্থা কখনই এতদূর হইতে পারি না। কিন্তু এখন যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহার আর উপায় নাই। যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন ইহা অপেক্ষা আর যেন অধিক না ঘটে; আর সাক্ষি-সাবুদের যেন সংগ্রহ না হয়। আমি আপাততঃ আপনার নজর রূপ এই সহস্র মুদ্রা প্রদান করিতেছি। ঈশ্বর যদি অনুগ্রহ করেন, মোক হইয়া গেলে পুনরায় আপনার সহিত নির্জনে সাক্ষাৎ করিব। আর যাহার নিমিত্ত আপনি এতদুর ক্রোধান্বিত হইয়াছেন, আমার সহিত আপনি যখন গমন করিবেন, তখনই আমি তাহার নিকট আপনাকে লইয়া যাইব। তাহার পরে আপনি আপনার ইচ্ছানুযায়ী কর্ম্ম করিবেন। এখন আমাকে বিদায় দিন, আমাকে অনেক কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে হইবে। এখন আপনি আমাদিগের উপর প্রসন্ন হইলেন, কি না, বলুন।

দারোগা। প্রসঙ্গ না হইলেও, যখন আপনি এতদুর বলিতেছেন, তখন কাজেই আমাকে প্রসন্ন হইতেই হইবে। আমি ক্রোধের বশবর্তী হইয়া যতদূর করিবার, তাহা করিয়া ফেলিয়াছি। যাহা করিয়াছি, তাহার আর উপায় নাই। এখন আর অধিক কিছু করিব না।

হোসেন। ওসমান সহ দোষে দোষী, তাহার আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। গোরও পুত্র-মেহ বশতঃ সেই সকল দোষের প্রতিবিধান করিয়া উঠিতে পারেন নাই সত্য। কিন্তু

মহাশয়! এখন যেরূপ ভাবের মোকদম উপস্থিত হইয়াছে, সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণিত হইয়াছে, তাহার কণা মাত্রও প্রকৃত নহে। ইহা আপনি মুখে না বলুন, কিন্তু অন্তরে তাহ আপনাকে স্বীকার করিতে হইবে।

দারোগা। তোমার কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে গোফুর খাঁর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর হেদায়েতের কন্যার মৃত দেহ কিরূপে আসিল?

হোসেন। উহার প্রকৃত ব্যাপার আমি সমস্তই শুনিয়াছি। যদি জানিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি গোপনে আপনাকে সকল কথা বলিতে পারি।

দারোগা। গোপনে বলিতে চাহেন কেন?

হোসেন। মোকদ্দমার সময় আমরা সেই কথা স্বীকার করিব কি না, তাহা উপযুক্ত উকীল কৌলির পরামর্শ ব্যতীত বলিতে পারি না। সুতরাং আপনার নিকট গোপনে সেই সকল কথা না বলিলে যে কিরূপ দোষ ঘটিতে পারে, তাহা আপনিই কেন বিবেচনা করিয়া দেখুন না।

দারোগা। আমি ত কোন দোষ দেখিতেছি না।

হোসেন। মনে করুন, যে সকল কথা আমি প্রকৃত বলিয়া এখন বিশ্বাস করিতেছি, ও আপনি জানিতে চাহেন বলিয়া, আপনাকে যাহা বলিতে প্রবৃত্ত হইতেছি, সে সকল কথা আবশ্যকমত অস্বীকার করিলেও, আমি নিষ্কৃতি পাইব না।

দারোগা। আপনার নিষ্কৃতি না পাইবার কারণ কি?

হোসেন। আমি যদি অস্বীকার করি, তাহা হইলে যে সকল লোকের সম্মুখে আমি এখন সেই সকল কথা বলিতেছি, আবশ্যক হইলে সেই সকল লোকের দ্বারা আপনি উহা অনায়াসেই প্রমাণ করিতে সমর্থ হইবেন।

দারোগা। সেই সকল কথা আইনমত, ওরূপে প্রমাণ হইতে পারে না।

হোসেন। প্রমাণ হউক, বা না হউক, যদি আপনি নিতান্তই অবগত হইতে চাহেন, তাহা হইলে কাহারও সম্মুখে আমি সেই সকল কথা কহিব না। একাকী শুনিতে চাহেন, ত আমি বলিতে প্রস্তুত আছি।

দারোগা। আর যদি আমি আবশ্যকমত আপনাকে সাক্ষী স্থির করি, তাহা হইলে আপনি কি করবেন? আপনি এখন আমাকে যাহা বলিবেন, তখনও আপনাকে তাহাই বলিতে হইবে।

হোসেন। তাহা বলিব কেন? আবশ্যক হয়, সমস্ত কথা আমি অনায়াসেই অস্বীকার করিতে পারিব।

সম্পূর্ণ।

» ঘর-পোড়া লোক – ২য় বা মধ্যম অংশ

ঘর-পোড়া লোক (মধ্যম অংশ) (দারোগার দপ্তর ৭৫ম সংখ্যা)
(অর্থাৎ পুলিসের অসৎ বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত!)
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। আষাঢ়।
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.

ঘর-পোড়া লোক।
 (মধ্যম অংশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ।

হোসেনের কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব কহিলেন, আপনি কি অবস্থা শুনিয়াছেন বলুন দেখি, আমিও শ্রবণ করি।

বোগা সাহেবের কথার উত্তরে হোসেন কহিল, ওসমানের চরিত্র আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন, এবং তাহার চরিত্র সম্বন্ধে আপনি যাহা কহিলেন, তাহার একবিন্দুও মিথ্যা নহে। যে মৃতদেহ গোফুর খাঁর বাড়ীতে পাওয়া গিয়াছে, তাহা যে হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। শুনিয়াছি, সেই কন্যাটা বেশ রূপবতী ছিল। তাহার রূপের কথা জমে ওসমানের কর্ণগোচর হইল। যুবতী রূপবতী স্ত্রীলোকের কথা শুনিয়া তিনি আর কোনরূপে স্থির থাকিতে পারিলেন না, তাহার নিকট ক্রমে লোকের উপর লোক পাঠাইয়া, তাহাকে কুপথগামিনী করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ওসমানের প্রস্তাবে সে কোনরূপেই প্রথমে স্বীকৃত হয় নাই; কিন্তু অনেক চেষ্টার পর অর্থের লোভে ক্রমে সে আপন ধৰ্ম্ম বিক্রীত করিতে সম্মত হইল। যে সময় হেদায়েৎ কাৰ্যোপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়া

ছিলেন, সেই সময় একরাত্রিতে ওসমান একখানি পাকী পাঠাইয়া তাহাকে আপন বাড়ীতে আনয়ন করেন। প্রায় সমস্ত রাত্রি তাহাকে আপনার বৈঠকখানায় মাখিয়া, অতি অলমাত্র রাত্রি অবশিষ্ট থাকিতে, সেই পাল্কী করিয়া তাহাকে পুনরায় আপন বাড়ীতে পাঠাইয়া দেন। পরদিবস রাত্রিতে পুনরায় পাল্কী করিয়া

তাহাকে আপন বৈঠকখানায় আনয়ন করেন। সেই সময় গোফুর খাঁ বাড়ীতে ছিলেন না, কানপুরে ছিলেন। যে সময় ওসমান সেই স্ত্রীলোকটাকে লইয়া আপন বৈঠকখানায় আমোদ প্রমোদে উন্মত্ত ছিলেন, সেই সময় হঠাৎ গোফুর খাঁ বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হন। পাছে পিতা তাঁহার এই সকল বিষয় জানিতে পারেন, এই ভয়ে ওসমান তাঁহার বৈঠকখানার সম্মুখে একটা কুঠারীর ভিতর উহাকে লুকায়িত ভাবে রাখিয়া দিয়া সেই গৃহের তালাবদ্ধ করিয়া দেন। তৎপরে তাহার একজন অনুচরকে কহেন যে, তাঁহার পিতা যেমন এদিক ওদিক করিবেন, বা বাড়ীর ভিতর গিয়া শয়ন করিবেন, সেই সময় সেই স্ত্রী লোকটীকে সেই গৃহ হইতে বাহিরে আনিয়া, পাক্কী করিয়া তাহার বাড়ীতে যেন পাঠাইয়া দেওয়া হয়, এবং পাঠাইবার সময় সেই স্ত্রীলোকটাকে যেন বলিয়াও দেওয়া হয় যে, বৃদ্ধ কানপুরে গমন করিলে পুনরায় তাহাকে আনয়ন করা বাইবে।

অনুচর ওসমানের প্রস্তাবে সম্মত হন, এবং কহেন যে, একটু অবকাশ পাইলেই তিনি তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিবেন। অনুচর ওসমানের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন বটে, কিন্তু কাৰ্যে তাহা করিয়া উঠিলেন না। পরদিবস প্রাতঃকালে ওসমান তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি মিথ্যা কথা কহিলেন।

তিনি যে তাহাকে পাঠাইতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন, এ কথা না। ধলিয়া, কহিলেন যে, গত রাত্রিতেই তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অনুচর যে তাহার কোনরূপ অভিসন্ধি বশতঃ এইরূপ মিথ্যা কথা কহিলেন, তাহা নহে; মনে করিলেন, উহাকে পাঠাইয়া দেওয়া হয় নাই, এই কথা জানিতে পারিলে, পাছে ওসমান তাহার উপর অসন্তুষ্ট হন। এই ভয়ে তিনি মিথ্যা কথা কহিলেন। তখন তিনি মনে মনে স্থির করিলেন যে, যেরূপ উপায়ে হউক, এখনই তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিবেন। সেই সময় ওসমান অপর একটী কাৰ্য্যোপলক্ষে তাহাকে স্থানান্তরে প্রেরণ করেন। তিনিও সেই কাৰ্যোপলক্ষে এ দিকের কাৰ্য একবারে ভুলিয়া যান। অথচ ওসমানের বিশ্বাস যে, সেই স্ত্রীলোকটী তাহার বাড়ীতে গমন করিয়াছে; সুতরাং সেই স্ত্রীলোকটী গৃহের ভিতর যে বদ্ধ আছে, এ কথা আর কাহারও মনে হয় নাই, বা সেই ঘর খুলিবারও কোন প্রয়োজন উপস্থিত হয় নাই। এইরূপে অনাহারে এবং তৃষ্ণায় উহার মৃত্যু ঘটে। পরিশেষে আপনি বাড়ীর সমস্ত স্থান অনুসন্ধান করিতে করিতে, যখন সেই ঘরের দরজা খোলেন, তখন সেই মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়ে। এই ব্যাপার দেখিয়া তখন ওমানের সমস্ত কথা স্মরণ হয়, এবং বুঝিতে পারেন যে, তাহার অনুচরের মিথ্যা কথার নিমিত্ত তাহার কি সর্বনাশ ঘটিল! গোফুর খাঁ ইহার ভাল মন্দ কিছুই জানেন না; সুতরাং এই অবস্থা দেখিয়া তিনি একবারে হতজ্ঞান হইয়া পড়েন। আমি যতদুর শুনিয়াছি, ইহাই প্রকৃত ঘটনা। আমি অকপটে আপনার নিকট যাহা বলিলাম, তাহা কিন্তু এখন অন্যরূপ ঘটনা হইয়া পড়িয়াছে।

দারোগা। ইহাই যদি প্রকৃত ঘটনা হয়, তাহা হইলে এখন যেরূপ ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহা কি?

হোসেন। তাহা যে কি, তাহা আপনি আপন মনে বেশ অবগত আছেন, আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?

দারোগা। এই মোকদ্দমার যেরূপ প্রমাণ হইয়াছে, তাহা আপনি সমস্ত অবগত হইতে পারিয়াছেন কি?

হোসেন। তাহা সমস্তই জানিতে না পারিলে, আর আপনার নিকট আসিব কেন?

দারোগা। আপনি আমাকে যে সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেন, তাহার পরিবর্তে আমি এখন যে কোন উপকার করিতে পারি, তাহা বোধ হয় না।

হোসেন। মনে করিলে এখনও বিস্তর উপকার করিতে পারেন।

দারোগা। এরূপ অবস্থায় আমার দ্বারা আর কি উপকার হইবার সম্ভাবনা আছে, বলুন। আমি বিবেচনা করিয়া দেখি, সেই উপকার করিতে আমি কত দুর সমর্থ।

হোসেন। সময় মত বলিব। তখন আপনার যতদূর সাধ্য, সেইরূপ উপকার করিবেন; কিন্তু এখন যাহাতে অন্য কোন সাক্ষীর যোগাড় না হয়, তাহা করিলেই যথেষ্ট হইবে। আরও একটা বিষয়ের অনুরোধের নিমিত্ত আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। যে সমস্ত ব্যক্তি আমাদিগের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাঁহারা ওসমানের জ্বালায় সবিশেষ জ্বালাতন হইয়া, এইরূপে আমাদিগের সর্বনাশ করিতে বসিয়াছে। তাঁহারা যে কথা বলিয়াছে, পুনরায় যে তাহার অন্যথাচরণ করিবে, তাহা আমার বোধ হয় না। তথাপি অর্থ প্রলোভনে আমরা একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব, যদি কোনরূপে কৃতকার্য হইতে পারি। আপনি তাহাতে প্রতিবন্ধকতাচরণ করিবেন না, ইহা আমার একটা প্রধান অনুরোধ।

দারোগা। তাহা কিরূপে হইবে? সাক্ষিগণ একবার যেরূপ কথা বলিয়াছে, এখন যদি তাহার অন্যথাচরণ করে, তাহা হইলে তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে বিপদে পড়িতে হইবে, তাহা কি তাঁহারা জানে না? বিশেষতঃ একথা যদি তাঁহারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তাহা হইলে আমি কখনই বলিতে পারিব না যে, তোমরা পূর্বে যেরূপ বলিয়াছ, এখন অনায়াসেই তাহার বিপরীত বলিতে পার। আর সাক্ষীগণ যদি এখন অন্যরূপ বলে, তাহা হইলে তাহাদিগের ত বিপদ হইবেই; তদ্ব্যতীত আমাদিগের উপরও নানারূপ সন্দেহ উপস্থিত হইবে, আর হয় ত আমাকেও বিপদাপন্ন হইতে হইবে।

হোসেন। যাহাতে আপনাকে বিপদাপন্ন হইতে হইবে, এরূপ কাৰ্যে আমি কখনই হস্তক্ষেপ করিব না। আর যাহা কিছু করিতে হইবে, আপনার সহিত পরামর্শ করিয়া, এবং সেই বিষয়ে আপনার মত লইয়া সেই কাৰ্য্য করিব। আপনার অমতে কোন কাৰ্য্য করিব না।

এই বলিয়া হোসেন, সেই দিবস দারোগা সাহেবের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।

হোসেন চলিয়া গেলে, দয়োগা সাহেব মনে মনে স্থির করিলেন, যাহা কিছু পাইয়াছি, তাহা গ্রহণ করিয়াছি। আরও যদি কিছু পাই, তাহাও লইব। অধিকন্তু হোসেনের সাহায্যে সেই স্ত্রীলোকটীকেও পুনরায় আনাইয়া লইব। কিন্তু আসল কাৰ্য কোনরূপেই ছাড়িব না; যাহাতে গোফুর এবং ওসমানকে ফঁসি কাষ্ঠে ঝুলাইতে পারি, বিধিমতে তাহার চেষ্টা করিব।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

হেদায়েতের কন্যাকে হত্যার অপরাধে, গোফুর খাঁ এবং তাহার পুত্র ওসমান খাঁ মাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরিত হইলেন। দারোগা সাহেবও প্রাণপণে সেই মোকদ্দমার আয়োজন করিতে লাগিলেন। পিতা পুত্র উভয়েই হাজতে রহিলেন। পুলিসের নিকট যে সকল সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিল, যাহাতে তাঁহারা মাজিস্ট্রেটের নিকট অন্যরূপ সাক্ষ্য প্রদান করে, তাহার নিমিত্ত হোসেন অনেক অর্থ ব্যয় করিয়া, অনেক চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। বরং পুলিসের নিকট তাঁহারা যেরূপ বলিয়াছিল, মাজিষ্ট্রেটের নিকট তাহা অপেক্ষা আরও অনেক অধিক কথা কহিল।

সমস্ত সাক্ষীর এজাহার হইয়া যাইবার পর, মাজিষ্ট্রেট সাহেব দেখিলেন যে, আসামীদ্বয়ের বিরুদ্ধে হত্যাকরা অপরাধ উত্তমরূপে প্রমাণিত হইয়াছে। সুতরাং চুড়ান্ত বিচারের নিমিত্ত তিনি এই মোকদ্দমা দায়রায় প্রেরণ করিলেন।

এই মোকদ্দমার বিচারের নিমিত্ত যখন দায়রায় দিন স্থির হইল, সেই সময় বিচারক মফঃস্বল পরিভ্রমণ উপলক্ষে, জেলা হইতে সুদূর মফঃস্থলে অবস্থান করিতেছিলেন। যখন যে গ্রামে বিচারক উপস্থিত হইতেছিলেন, সেই সময় সেই গ্রামেই আপন কাছারি করিয়া মোকদ্দমার বিচারও করিয়া আসিতেছিলেন।

যে দিবস গফুর খাঁ এবং তাঁহার পুত্র ওসমানের এই হত্যাপরাধ-বিচার আরম্ভ হইল, সে দিবস একটা নিতান্ত ক্ষুদ্র পলিগ্রামের ভিতর জজসাহেবের তাম্বু পড়িয়াছিল। সুতরাং সেই স্থানেই এই মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইল।

এলাহাবাদ হাইকোর্ট হইতে উকীল কৌন্সলি আনাইয়া এই মোকদ্দমায় দোষ-ক্ষালনের যতদূর উপায় হইতে পারে, হোসেন প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কিছুতেই আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইলেন না। সরকারী উকীল মোকর্দমার অবস্থা জজসাহেবকে উত্তমরূপে সর্বপ্রথম বুঝাইয়া দিবার পর হইতেই, জজসাহেবের মনে কেমন এক বিশ্বাস হইয়া গেল যে, আসামী পক্ষীয় উকীল কৌশলি অনেক চেষ্টা করিলেও, তাহার মন হইতে সেই বিশ্বাস অপনোদন করিতে পারিলেন না। তিন দিবস পৰ্য্যন্ত এই মোকদ্দমার সাক্ষিগণের এজাহার গৃহীত হইল। তাহাদিগের উপর যথেষ্ট জেরা হইল। উভয় পক্ষীয় উকীল কৌন্সলিগণ স্বপক্ষে সাধ্যমত বক্তৃতাদি করিতে ক্রটি করিলেন না; কিন্তু কিছুতেই আসামীদ্বয়ের পক্ষে কোনরূপ উদ্ধারের উপায় লক্ষিত হইল না।

জজসাহেব এই মোকদ্দমার রায় প্রদান করিবার কালীন কহিলেন, আসামীগণ! তিন দিবস পর্যন্ত বিশেষ যত্ন ও মনো–যোগের সহিত, এই মোকদ্দমার সমস্ত ব্যাপার আমি উত্তম রূপে শ্রবণ করিয়াছি, এবং তোমাদিগের পক্ষীয়, সুশিক্ষিত উকীল কৌন্সলিগন সবিশেষ যত্নের সহিত তোমাদিগের পক্ষসমর্থন করিয়া, তোমাদিগের স্বপক্ষে যাহা কিছু বলিবার আছে, তাহা অপেক্ষাও অনেক কথা বলিয়াছেন; কিন্তু উভয় পক্ষের সমস্ত ব্যাপার শ্রবণ করিয়া এবং সাক্ষিগণের সাক্ষ্য দিবার কালীন, তাহাদিগের ভাব-ভঙ্গি দেখিয়া আমার স্পষ্টই প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, তোমাদিগের বিপক্ষে তাঁহারা বিন্দুমাত্রও মিথ্যা কথা কহে নাই। অবশ্য, অনেক সাক্ষ্যের অনেক স্থান অপর সাক্ষিগণের সাক্ষ্যের সহিত এক মিল হয় নাই। কিন্তু তাহা বলিয়া তাঁহারা যে, একবারে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, এ কথা আমি কখনই স্বীকার করিতে পারিব না। তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর তালা বন্ধ গৃহের মধ্যে হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ যে পাওয়া গিয়াছে, সে সম্বন্ধে কোন আপত্তি উত্থাপিত হয় নাই। বিশেষতঃ তোমাদিগের বিরুদ্ধে যে সকল ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাঁহারা সকলেই তোমাদিগের জমিদারীর প্রজা। প্রজাগণ তাহা দিগের জমিদারের বিপক্ষে কখনই মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিতে সম্মত হয় না। আর নিতান্ত সত্যের অনুরোধে যদি কোন প্রজাকে তাহার জমিদারের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতে হয়, তাহা হইলেও সেই প্রজা যতদূর সম্ভব, তাহার জমিদারকে বাঁচাইয়া যাইতে চেষ্টা করে, ইহাই এদেশীয় নিয়ম। তোমাদের প্রজাগণ তোমাদিগের বিপক্ষে যে সকল সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, আমার বিশ্বাস, তাঁহারা তাহা অপেক্ষাও অনেক অধিক কথা অবগত আছে। কোনরূপে যদি আপনাদের জমিদারের উপকার করিতে পারে, এই ভাবিয়া সকল কথা তাঁহারা বলে নাই। সেই সকল সাক্ষী ওসমানের অত্যাচারে অত্যাচারিত হইয়া, তোমাদিগকে বিপদাপন্ন করিবার মানসে মিথ্যা কথা কহিতেছে, এ কথা সময় সময় মোদিগের কৌন্সলি উখাপিত করিলেও, তাঁহারা সেই সকল কথা একবারে অস্বীকার করে। অথচ তোমরাও তাহার সত্যাসত্য প্রমাণ করতে সমর্থ হও নাই, বা তাহার চেষ্টাও কর নাই। এইরূপ নানা কারণে আমি সাক্ষিগণের সাক্ষ্য কোনরূপেই একবারে অবিশ্বাস করিতে পারি না।

সাক্ষিগণের দ্বারায় বেশ প্রমাণিত হইয়াছে যে, হেদায়েতের নিকট হইতে খাজানা আদায় করিবার মানসে, তাহার অবর্ত মানে তাহার যুবতী কন্যাকে তোমরা বলপূৰ্ব্বক তাহার পরদার বাহিরে আনিয়া সৰ্ব্বসমক্ষে তাহাকে যেরূপ অবমাননা করিয়াছ, সেরূপ কাৰ্য ভদ্রবংশীয় কোন লোকের দ্বারা কোনরূপেই সম্ভব না। কেবল মাত্র সামান্য খাজানা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে তোমরা সেই যুবতীর উপর কেবল যে এইরূপ ভয়ানক অত্যাচার করিয়াছ, তাহা নহে। আমার অনুমান হয় যে, তোমাদিগের এরূপ কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার অপর কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। এইরূপে যুবতীর উপর ভয়ানক অত্যাচার করিয়াই যে, তোমরা তাহাকে নিষ্কৃতি দিয়াছ, তাহা নহে। সৰ্বসমক্ষে সেই অবলাকে বিনাদোয়ে ধৃত করিয়া, বিশেষরূপে অবমাননার সহিত কয়েক খানি গ্রামের মধ্য দিয়া তোমরা তোমাদিগের বাটী পৰ্যন্ত তাহাকে লইয়া গিয়াছ। এ কথা গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিত সকলেই একবাক্যে কহিতেছে। অবলা স্ত্রীলোকের উপর বিনা দোষে এরূপ অত্যাচার করা নিতান্ত পিশাচের কাৰ্য ভিন্ন আর কিছুই বলিতে পারা যায় না। এইরূপ অত্যাচার করিয়াই কি তোমরা তাহাকে নিষ্কৃতি লিয়াছ? তোমাদিগের নিজের অনুচর এবং ভৃত্যরর্গের দ্বারা প্রমাণিত হইতেছে যে, সেই হতভাগিনীকে অনশনে রাখিয়া হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে তাহাকে তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর একটা নির্জন গৃহের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলে। অনশনে যে লোকের মৃত্যু ঘটে, তাহা কি তোমরা জান না? ক্ষুৎপিপাসা সন্থ করিতে কোন্ ব্যক্তি কয়দিবস সমর্থ হয়, তাহা কি তোমাদিগের মনে একবারের নিমিত্তও উদয় হয় নাই? কেবল তাহাই নহে, তোমাদিগের নিজের পরিচারক কি বলিতেছে, তাহা একবার শোন। এক দিবস কোন গতিতে আমি সেই গৃহের চাবি সংগ্রহ করিয়া ঘর খুলিয়া দেখিলাম যে, ক্ষুধায় এবং তৃষ্ণায় যুবতী মৃত্যুশয্যায় শায়িতা। এই অবস্থা দেখিয়া আমার কঠিন হৃদয়েও দয়ার উদ্রেক হইল। ঘরবানের সহিত পরামর্শ করিয়া আমি কিছু আহারীয় এবং পানীয় আনিয়া উহাকে দিবার উদ্যোগ করিতেছি, এরূপ সময়ে ওসমান সাহেব তাহা জানিতে পারিয়া, সেই সকল দ্রব্য আমার হস্ত হইতে কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন, ও আমাকে যৎপয়োনান্তি গালি দিয়া পুনরায় সেই গৃহের তালা বন্ধ করিয়া দিলেন। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে নিতান্ত কষ্ট হইল। আমি গিয়া গোফুর মিঞার নিকট এই কথা বলিলে, কোথায় তিনি তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা করিবেন, না তাঁহার পরিবর্তে আমাকে সহস্র গালি প্রদান করিয়া, তাঁহাদিগের বিনা, অনুমতিতে আমি সেই গৃহের দরজা খুলিয়াছিলাম বলিয়া আমাকে চাকরী হইতে জবাব দিলেন, এবং তদখেই আমাকে তাঁহা, লিগের বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দিলেন।

কি ভয়ানক! কি পৈশাচিক ব্যবহার! এই ব্যক্তি ও তাহার পোষকতাকারী ঘরবানের সাক্ষ্য যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সেই যুবতীকে অনশনে রাখিয়া, ইচ্ছা-পূৰ্ব্বক তাহাকে যে হত্যা করিয়াছ, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যাহাদিগের দ্বারা এরূপ কাৰ্য্য হইতে পারে, তাঁহারা কোনরূপেই দয়ার পাত্র নহে। আমার বিবেচনায় এরূপ প্রকৃতি-বিশিষ্ট লোকের উপর দয়া প্রকাশ করিলে ঈশ্বর তাহার উপর অসন্তুষ্ট হন। গোফুর খাঁ! তোমার বৃদ্ধ বয়স দেখিয়া, এবং তোমার পূর্ব-চরিত্র শ্রবণ করিয়া আমি পূর্বে মনে করিয়াছিলাম, এরূপ মোকদ্দমায় যদি কেহ দয়ার পাত্র হয়, তাহা তুমি। কিন্তু এখন আমি দেখিতেছি, দস্যু তস্করকে দয়া করা যাইতে পারে, মনুষ্য হত্যাই যাহাদিগের জীবিকা, তাহাদিগকেও দয়া করা যাইতে পারে, তথাপি তোমার উপর সে দয়া প্রকাশ করিতে নাই। তোময়া ইচ্ছা করিয়া যেরূপ ভয়ানক অপরাধ করিয়াছ, তাহার প্রকৃত দণ্ড আমাদিগের আইনে নাই। তোমাদিগের জাতীয় রাজার রাজত্বকালে যেরূপ কুকুর দিয়া খাওয়াইয়া ও ক্ষতস্থানে লবণ নিক্ষিপ্ত করিয়া মারিয়া ফেলিবার নিয়ম ছিল, আমার বিবেচনায় তোমরা সেইরূপ দণ্ডের উপযুক্ত। কিন্তু সেরূপ দণ্ড যখন আমাদিগের আইনে নাই, তখন আমাদিগের আইনের চরম দণ্ড আমি তোমাদিগের উপর বিধান করিলাম। যে পর্যন্ত তোমরা না মরিবে, সেই পৰ্য্যন্ত তোমাদিগের উভয়কেই ফাঁসিকাষ্ঠে লটুকাইয়া রাখা হইবে।

জজসাহেবের মুখে বিষম দণ্ডের কথা শুনিয়া গোফুর খাঁ আর দাড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না, মূর্হিত অবস্থায় সেই স্থানে পড়িয় গেলেন। প্রহরীগণ তাঁহার মুখে জল সিঞ্চন করাতে তাঁহার সংজ্ঞা হইলে, তাঁহারা তাঁহাকে সেই স্থান হইতে বাহির করিয়া লইয়া গেল। ওসমান স্থিরভাবে এই দণ্ডাজ্ঞা সহ করিলেন, কোন কথা কহিলেন না; কেবল দারোগা সাহেবের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন মাত্র।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

এই ভয়ানক দণ্ডাজ্ঞা শুনিয়া হোসেনের মুখ দিয়া আর কোন কথা বাহির হইল না। অপূর্ণ-লোচনে তিনি আদালতের বাহিরে আসিলেন। যে সময় এই মোকদ্দমার বিচার শেষ হইয়া গেল, তখন অপরাহ চারিটা। জজসাহেবের সঙ্গে একজন কোর্ট-ইনস্পেক্টার ছিলেন; যে আসামীদ্বয়ের উপর প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, তাহাদিগকে লইয়া তিনি বিষম বিপদে পড়িলেন। কিরূপে সেই আসামীদ্বয়কে তিনি জেলায় পাঠাইয়া দিবেন, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সেই স্থান হইতে পদব্রজে আসামীগণকে পাঠাইয়া দিলে, তিন চারিদিবসের কম তাঁহারা সরে গিয়া উপস্থিত হইতে পারিবে না। বিশেষতঃ গোফুর খাঁর আর চলিবার ক্ষমতা নাই; তাহার উপর পয়ে বিপদের সম্ভাবনাও আছে।

কোর্ট-ইন্‌স্পক্টার সাহেব এইরূপ গোলযোগে পড়িয়া হোসেনকে তাকাইয়া পাঠাইলেন ও কহিলেন, আপনার মনিবদ্বয়ের অদৃষ্ট্রে যাহা ছিল, তাহা ঘটিয়াছে; কিন্তু যে পর্যন্ত তাহাদিগের জীবন শেষ না হয়, সে পর্যন্ত তাহাদিগকে কষ্ট দেওয়া কোনরূপেই কৰ্তব্য নহে। এখন, ইহাদিগকে অনেকদূর পর্যন্ত হাঁটিয়া যাইতে হইবে; কিন্তু আমি দেখিতেছি যে, হটিবার শক্তি ওসমানের থাকিলেও থাকিতে পারে, কিন্তু গোফুর খাঁর সে শক্তি নাই। আর উঁহাদিগকে কোন যানে আরোহণ করাইয়া লইয়া যাইবার খরচার ব্যবস্থাও সরকার হইতে নাই। এরূপ অবস্থায় যদি আপনি কিছু অর্থ প্রদান করেন, তাহা হইলে যাহাতে উঁহারা কষ্ট না পান, কোনরূপে আমি সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া উহা দিগকে এই স্থান হইতে পাঠাইতে পারি।

হোসেন। আমাকে কিরূপ অর্থ সাহায্য করিতে হইবে?

ইনস্পেক্টার। অধিক অর্থের সাহায্য করিতে হইবে না। ইহারা দুইজন, এবং ইহাদিগের সহিত যে কয়জন প্রহরী গমন করিবে, তাহাদিগকে সদর পর্যন্ত লইয়া যাইতে হইলে গাড়ি প্রভৃতির যাহা কিছু খরচ পড়িবে, তাহাই কেবল তোমাকে দিতে হইবে।

হোসেন। তাহা আমি দিতে সম্মত আছি, যদি আমাকেও উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে দেন।

ইনস্পেক্টার। আপনিও উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে পারেন। কিন্তু একত্র নহে। উঁহারা যে গাড়িতে গমন করি বেন, আপনি সেই গাড়িতে গমন করিতে পারিবেন না। অপর গাড়ি লইয়া উঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলে, কেহ আপত্তি করিবে না। কিন্তু কেন আপনি উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে চাহেন?

হোসেন। আমি যে কয়দিবস উঁহাদিগের সহিত থাকিতে পারিব, সেই কয়দিবস যাহাতে উঁহাদিগের কোনরূপ আহারাদিন কষ্ট না হয়, তাহা আমি দেখিতে পারিব তথ্যতীত যখন উভয়েই ফঁসি খাইতেছেন, তখন ইহাদিগের এই অগাধ জমিদারীর কিরূপ বন্দোবস্ত করিব, বা তাঁহারা ইহা কাহাকে প্রদান করিয়া যাইবেন, এবং পরিবারবর্গেরই বা কিরূপ বন্দোবস্ত হইতে পারে, প্রভৃতি আবশ্যক বিষয় সকল সম্বন্ধে যতদূর সম্ভব, তাহাদিগের নিকট হইতে জানিয়া বা লিখাইয়া লইব।

ইনস্পেক্টার। আপনি উঁহাদিগের সহিত এখন গমন করিতে পারেন, আর তাহাদিগের আহারাদি সম্বন্ধীয় বন্দোবস্ত করিতেও কিছুমাত্র নিষেধ নাই। কিন্তু বিষয়-আদি-সম্বন্ধীয় বন্দোবস্ত করিবার সময় এখন নহে। জেলায় গমন করিবার পর জেলের মধ্যে উঁহারা যে কয়দিবস পাকিবেন, তাহার মধ্যে জেল কর্ম্মচারীর সম্মুখে সে সমস্ত বন্দোবস্ত আপনারা করিয়া লইতে পারিবেন।

হোসেন। জেলায় গমন করিতে উঁহাদিগের কয়দিবস লাগিবে?

ইনস্পেক্টার। তাহা আমি এখন বলিতে পারিতেছি না। ইহাদিগের সহিত যে সকল প্রহরী গমন করিবে, তাঁহারা যে কয়দিবসে সুবিধা বিবেচনা করিবে, সেই কয়দিবসে তাঁহারা উঁহাদিগকে লইয়া যাইবে।

হোসেন। মহাশয়! আর একটা কথা। রাত্রিকালে উহার যে যে স্থানে অবস্থিতি করিবে, সেই সেই স্থানে রাত্রিযাপন উপযোগী কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে হইবে কি?

ইনস্পেক্টার। না, রাত্রিযাপন সম্বন্ধে কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়াজন নাই। কারণ, থানা ভিন্ন অপর কোন স্থানে উঁহারা রাত্রিযাপন করিবেন না। সমস্ত দিবস গমন করিয়া সন্ধ্যার পূর্বে যে থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারিবেন, সেই থানাতেই রাত্রিযাপন করিবেন, ও পরদিন প্রত্যুষে সেই থানা হইতে প্রস্থান করিবেন। এইরূপে গমন করিয়া যে কয়দিবসে সম্ভব, সদরে গিয়া উপস্থিত হইবেন।

কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের সহিত এই সকল কথাবার্তা হইবার পর, তাহাদিগকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কিছু ব্যয় হইবে, তাহার সমস্ত ভার হোসেন গ্রহণ করিলেন। সেই দিবস অপরাহ হইয়া আসিয়াছিল বলিয়া, ইনস্পেক্টার সবিশেষরূপ পাহারার বন্দোবস্ত করিয়া আসামীদ্বয়কে সেই স্থানেই রাখিয়া দিলেন। আর ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, পরদিবস অতি প্রত্যুষে আসামী দ্বয়কে সেই স্থান হইতে পাঠাইয়া দিবেন। আসামীদ্বয় এবং প্রহরীগণকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কয়েকখানি, একার প্রয়োজন হইল, তাহাও সেই রাত্রিতে বন্দোবস্ত করিয়া রাখা হইল। হোসেন এবং তাহার দুইজনমাত্র ভৃত্যও সেই সঙ্গে গমন করিতে প্রস্তুত হইল। তাঁহারাও নিজের গমনোপোযোগী একা বন্দোবস্ত করিয়া রাখিলেন।

পরদিবস অতি প্রত্যুষে প্রহরীগণ আসামীদ্বয়কে লইয়া একারােহণে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন। হোসেনও তাঁহার অনুচরদ্বয়ের সহিত অপর এক্কায় আরোহণ করিয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। প্রহরী গণের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্ব প্রধান ছিল, সেই স্থান হইতে বহির্গত হইবার পূর্বে কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেব তাহাকে হোসেনের সহিত পরিচয় করিয়া দিয়াছিলেন ও বলিয়া দিয়াছিলেন, হোসেন তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিবে। যে স্থানে যে কোন খরচের প্রয়োজন হইবে, তাহা হোসেনই দিবেন। আসামীদ্বয়কে আহারাদি করাইবার নিমিত্ত যে কোন সাহায্যের প্রয়োজন হইবে, হোসেন তৎক্ষণাৎ সেই সকল সাহায্য করিবেন। একা প্রভৃতির যখন যেরূপ ভাড়া লাগিবে, হোসেনকে বলিলে তৎক্ষণাৎ তিনি তাহা প্রদান করিবেন।

কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের আদেশ পাইয়া, প্রহরী আর কোন কথা কহিল না। কারণ, সে উত্তমরূপে অবগত ছিল যে, যদি হোসেন বা অপর কোন ব্যক্তি এক্কা প্রভৃতির ভাড়া প্রদান না করে, তাহা হইলে যে কয়দিবসে হউক, তত পথ তাহা দিগকে পদব্রজে গমন করিতে হইবে।

প্রহরী-সর্দারের মনে মনে একটু দুরভিসন্ধি ছিল। কোর্ট ইনস্পেক্টারের সম্মুখে কিন্তু সে তাহা প্রকাশ করিল না। তখন তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া আসামীদ্বয় ও হোসেনের সমভিব্যাহারে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইল।

কিয়দ্দূর গমন করিবার পর, পথের এক স্থানে একটা জলাশয় দৃষ্টিগোচর হইল। প্রহরী-সর্দ্দার সেই স্থানে একা থামাইতে আদেশ প্রদান করিলেন। আদেশ প্রতিপালিত হইল। একা হইতে অবতরণ করিয়া সকলে সেই স্থানে একটু বিশ্রাম করি লেন, এবং প্রহরীগণ একে একে আপনাপন হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করিয়া লইলেন। তাঁহাদিগের সকলের হস্তমুখাদি প্ৰক্ষালিত হইলে, প্রহরী-সর্দ্দার হোসেনকে কহিলেন, মহাশয়! আসামী স্বয়কে লইয়া সদরে উপস্থিত হইতে এক্কা-ভাড়া প্রভৃতি যে সকল খরচ পড়িরে, তাহা আমাদিগকে মিটাইয়া দিন।

হোসেন। একা-ভাড়া প্রভৃতির জন্য আপনার ব্যস্ত হইবার কোন প্রয়োজন নাই। যখন আমি আপনাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতেছি, তখন সমস্তই আমি প্রদান করিব।

সর্দ্দার-প্রহরী। আপনি যে উহা প্রদান করিবেন, তাহা কোর্ট ইনস্পেক্টার সাহেব বলিয়াই দিয়াছেন; কিন্তু বারে বারে আপনার নিকট চাহিয়া লওয়া অপেক্ষা একবারেই উহা আমাদিগকে প্রদান করা উচিত নহে কি?

হোসেন। যখন আমাকে দিতে হইবে, তখন আপনি একবারেই লউন, বা বারে বারেই লউন, তাহাতে আমার কিছুমাত্র ক্ষতি নাই।

সঃ প্রহরী। তাহা হইলে উহা আমাকে অগ্ৰেই প্রদান করুন।

হোসেন। কত খরচ পড়িবে, তাহা আমি এখন পর্যন্ত জানিতে পারিতেছি না; সুতরাং অগ্রে আমি আপনাকে উহা কি প্রকারে প্রদান করিতে পারি? আপনাদিগের সহিত যে সকল একা আছে, উঁহারা কি একবারে সদর পর্যন্ত গমন করিতে পারিবে?

সঃ প্রহরী। উঁহারা এতদূর কিরূপে গমন করিবে? এক এক থানায় গমন করিবার পর উঁহাদিগকে ছাড়িয়া দিব ও সেই স্থান হইতে অন্য এক্কা গ্রহণ করিব।

হোসেন। তাহা হইলে আপনাদিগকে কত টাকা গাড়িভাড়া দিতে হইবে, তাহা আমি এখন কিরূপে জানিতে পারিব? যেমন যে একা ছাড়িয়া দিবেন, অমনি তাহার ভাড়া মিটাইয়া দিলে চলিবে না?

সঃ প্রহরী। তাহা কিরূপে হইবে? সে সময় যদি আপনি উপস্থিত না থাকেন, তাহা হইলে কিরূপে ভাড়া প্রদান করিবেন?

হোসেন। আমি ত আপনাদিগের সহিত উপস্থিত আছি। যখন যাহা বলিবেন, তখনই তাহা প্রদান করিব।

সর্দ্দার-প্রহরী। এখন ত উপস্থিত আছেন দেখিতেছি; কিন্তু রাস্তা হইতে যদি আপনি চলিয়া যান, তাহা হইলে তখন আমি কি করিব? ও সকল গোলযোগেরই এখন প্রয়োজন নাই। আমার নিকট কিছু অর্থ আপনি প্রদান করুন, তাহা হইতে আমি ভাড়া প্রদান করিব। খরচ-পত্র বাদে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা পরিশেষে আমি আপনাকে ফিরাইয়া দিব।

হোসেন। আচ্ছা মহাশয়, তাহাই হউক। যদি আপনারা আমাকে অবিশ্বাস করেন, তাহা হইলে এই কুড়িটী টাকা আপনার নিকট রাখিয়া দিন।

সঃ প্রহরী। আমি আপনার নিকট ভিক্ষা করিতে বসি নাই! এখন যদি আপনি পঞ্চাশ টাকা প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি উহা গ্রহণ করিব; নতুবা আমি আসামীদ্বয়কে হাঁটাইয়া লইয়া যাইব।

হোসেন। হাঁটাইয়া লইয়া যাইবার প্রয়োজন নাই। আমি পঞ্চাশ টাকাই আপনাকে প্রদান করিতেছি, তাহা হইতে আপাততঃ যে সকল খরচ-পত্রের প্রয়োজন হয়, আপনি করুন। পরে যদি আরও কিছু আবশ্যক হয়, তাহাও আমি প্রদান করিব।

এই বলিয়া হোসেন পঞ্চাশটী টাকা বাহির করিয়া সেই সর্দ্দার প্রহরীর হস্তে প্রদান করিলেন। তিনি উহা গ্রহণ করিয়া আপনার নিকট রাখিয়া দিলেন, ও অপর প্রহরীগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, চল ভাই! আর দেরী করিবার প্রয়োজন নাই।

সর্দ্দার-প্রহরীর এই কথা শুনিয়া হোসেন কহিলেন, মহাশয়। আপনারা হস্ত মুখ প্রক্ষালনাদি সকল কার্য শেষ করিয়া লইলেন; কিন্তু ইহারা হস্ত মুখাদি ধুইবে কি না, তাহা ত কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন।

সর্দ্দার-প্রহরী। সে কথা জিজ্ঞাসা করিবার আমাদিগের কোন প্রয়োজন নাই। কোন বিষয়ের আবশ্যক হইলে ইহারা আপনারাই আমাদিগকে বলিবেন। তখন বিবেচনা করিয়া দেখা যাইবে যে, উঁহাদিগের প্রার্থনা শ্রবণ-যোগ্য কি না।

হোসেন। আপনারা যদি কোন কথা তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা না করেন, তাহা হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি।

সঃ প্রহরী। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার তোমার কোন অধিকার নাই। হত্যাপরাধে যাহাদিগের প্রাদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, তাহাদিগের সহিত কথা কহিয়া, তুমি আমাদিগের চাকরী লইতে চাও?

হোসেন। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিলে, আপনাদিগের চাকরী যাইবে কি প্রকারে, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না।

সঃ প্রহরী। চাকরী যাউক, আর না যাউক, উঁহাদিগের সহিত আমি কোনরূপে তোমাকে কথা কহিতে দিব না।

হোসেন। আপনার অনভিমতেই আমি কথা কহিব কেন? কিন্তু আমি ইহাদিগকে যদি কোন কথাই বলি, তাহা মন্দ কথা নহে। তাহাতে আপনাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই।

সঃ প্রহরী। আমাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হউক, বা না হউক, তাহা দেখিবার তোমার কিছুমাত্র আবক নাই। মূল কথা, তুমি উঁহাদিগের সহিত কোন কথা কহিতে পারিবে না।

হোসেন। যদি আমি ইহাদিগের সহিত কোন কথা কহিতেই না পারিব, তাহা হইলে আপনাদিগের সহিত আমার আসিবার কি প্রয়োজন ছিল?

সর্দ্দার-প্রহরী। প্রয়োজন ত আমি কিছুই দেখি না। না আসিলেই পারিতে।

হোসেন। আমি না আসিলে, আপনাদিগকে কে গাড়ির ভাড়া প্রদান করিত?

সঃ প্রহরী। গাড়ি ভাড়া কিছু আমাদিগের উপকারের নিমিত্ত দেও নাই। তোমারই মনিবদ্বয় হাঁটিয়া যাইতে অপারক, তাই তাঁহাদিগের নিমিত্ত গাড়ির ভাড়া প্রদান করিয়াছ। গাড়ি ভাড়া প্রদান না করিলে, আমরা অনায়াসেই উঁহাদিগকে আঁটাইয়া লইয়া যাইতে পারিতাম।

হোসেন। বলি, জমাদার সাহেব! ও সকল কথা থাক, এখন আপনাদিগের মনের কথা কি বলুন দেখি। আপনারা যাহা বলিবেন, আমি তাহাতেই প্রস্তুত আছি।

সঃ প্রহরী। খুনী আসামীর সহিত কথা কহিতে দেওয়া যে কতদুর ঝুঁকির কাৰ্য, তাহা ত আপনারা জানেন না। যদি আমাদের কোনরূপ সাধ্য না থাকে, তাহা হইলে আমরা সেই ঝুকি কেন গ্রহণ করিব? আপনি বুদ্ধিমান, আপনাকে অধিক আর কি বলিব?

হোসেন। আমাকে আর বলিতে হইবে না, এ কথা আমাকে পূর্বে বলিলেই পারিতেন। আপনারা কিছু প্রার্থনা করেন, বুঝিয়াছি। বলুন, এখন আমাকে কি দিতে হইবে।

সঃ প্রহরী। আপনি বড় মানুষ, আপনাকে আমরা আর কি বলিব? আপনি আপনার বিবেচনামত কাৰ্য্য করিলেই চলিবে।

হোসেন। এখন আর আমার বুদ্ধি-মুদ্ধি কিছুই নাই, ভাল মন্দ বুঝিবার ক্ষমতা এখন দুর হইয়া গিয়াছে। এই সামান্য কাৰ্য্যের নিমিত্ত আমাকে কয়টা টাকা দিতে হইবে, তাহা স্পষ্ট করিয়া আমাকে বলুন। আমার সাধ্য হয়, আমি প্রদান করি। আর আমার ক্ষমতার অতীত হয়, তাহা হইলে এই স্থান হইতেই আমি ধীরে ধীরে প্রস্থান করি।

সর্দ্দারপ্রহরী। আপনাকে কিছু অধিক প্রদান করিতে হইবে। আমরা পাঁচজন বই আর নয়। আমাকে কুড়ি টাকা ও অপর চারিজনকে দশ টাকা করিয়া চল্লিশ টাকা প্রদান করিলেই হইবে। আপনার পক্ষে ইহা অতি সামান্য টাকা, কেবল ষাট টাকা বৈত নয়!

হোসেন। আপনার পক্ষে ইহা অতি সামান্য টাকা; কিন্তু আমার পক্ষে ইহা খুব অধিক হইতেছে। আমি অত টাকা দিতে পারি না। আমি আপনাদিগের সম্মান রক্ষার নিমিত্ত ত্রিশ টাকা প্রদান করিতেছি।

সঃ প্রহরী। এ কাৰ্য ত্রিশ টাকায় হইতে পারে না। আপনার ইচ্ছা হয়, ষাট টাকা দিন, ইচ্ছা না হয়, এক টাকা দিবারও প্রয়োজন নাই। আমি অধিক করিয়া বলি নাই, আমি যেরূপ:এক কথার লোক, সেইরূপ এক কথাই বলিয়াছি।

হোসেন। আচ্ছা মহাশয়! আমি ষাট টাকাই প্রদান করিতেছি। ইহার পর আমাকে ত আর কিছু প্রদান করিতে হইবে না?

সঃ প্রহরী। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার নিমিত্ত আপ নাকে আর কিছু প্রদান করিতে হইবে না। কিন্তু আমাদিগের কাহারও সম্মুখে ব্যতীত নির্জনে আপনি উঁহাদিগের সহিত কোন রূপ কথা বলিতে পারিবেন না।

এইরূপ কথাবার্তার পর হোসেন ষাট টাকা প্রদান করিয়া তাঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার আদেশ পাইলেন। কিন্তু সেই সময় সবিশেষ কোনরূপ কথা কহিবার অবকাশ পাইলেন না। তাহাদিগকে তৎক্ষণাৎ এক্কার উপর আরোহণ করিতে হইল। হোসেনও আপন একায় গিয়া আরোহণ করিলেন। এক্কায় আরোহণ করিবার সময় হোসেন কেবলমাত্র তাহাদিগকে কহিলেন, জজসাহেব আপনাদিগের প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করিয়াছেন বলিয়া যে, আপনাদিগের প্রাণদণ্ড হইবেই, তাহা আপনারা মনে করিবেন না। আপনার উপার্জিত বিষয়ের এক পয়সামাত্র অবশিষ্ট থাকিতে, কোনরূপেই আমি আপনাদিগের প্রাণদণ্ড হইতে দিব না। টাকাব যথেষ্ট সংগ্রহ করিয়া আমি সঙ্গেই রাখিয়াছি। হাইকোর্ট হইতে যেরূপ উপায়ে হউক, এই হুকুম রদ করাইবু। ঈশ্বর যদি একান্তই বিমুখ হন, হাইকোর্ট হইতে যদি কিছু করিয়া উঠিতে না পারি, তাহা হইলে ছোট লাটকে ধরিয়া হউক, বড় লাটকে ধরিয়া হউক, বিলাত পর্যন্ত গড়িয়া হউক, কোন না কোনরূপে আপনাদিগকে অব্যাহতি প্রদান করাইব।

হোসেনের কথা শুনিয়া গোফুর ও ওসমান কেবল এইমাত্র কহিলেন, দেখুন, ভরসার মধ্যে ঈশ্বর?

ইহার পরেই এক্কা সকল সেই স্থান হইতে চলিল। একা, চালক অশ্বগণকে সবলে কষাঘাত করিতে লাগিল। প্রহারের ভয়ে অশ্বগণ দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিল। দুই ঘণ্টার পথ একঘণ্টায় চলিতে লাগিল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, এক্কা সকল একটী সরাইয়ের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলে, আসামীদ্বয়ের সহিত প্রহরীগণ সেই স্থানে অবতরণ করিয়া সেই সরাইয়ের ভিতর প্রবেশ করিল। সেই স্থানে কোন দ্রব্যেরই অভাব ছিল না। সরাইয়ের মধ্যেই শীতল জল-পূর্ণ একটা প্রকাণ্ড ইদারা। সরাইয়ের মধ্যস্থিত একখানি ঘরের মধ্যেই বেনিয়ার দোকান; উহাতে আটা, চাউল, ধৃত ও তরকারি প্রভৃতি আবশ্যক আহারীয় দ্রব্য এবং হড়ী, কাষ্ট, কঁচা সালপাতা প্রভৃতি সমস্তই পাওয়া যায়। প্রহরীগণ সরাইয়ের ভিতর প্রবেশ করিয়াই তাহার মধ্যে যে সকল সারি সারি ঘর ছিল, তাহার একখানির মধ্যে আসামীদ্বয়কে রাখিয়া দিল। সেই ঘরের কেবলমাত্র একটী দরজা ভিন্ন অপর জানালা দরজা আর কিছুই ছিল না; সুতরাং সেই ঘরকে একরূপ হাজত-গৃহ বলিলেও চলে। সেই ঘরের সম্মুখে দৌড় বারান্দার উপর সারি সারি পাচ খানি চারিপায়া আসিয়া পড়িল। প্রহরীগণ সেই স্থানে আপনাপন পোষাক পরিচ্ছদাদি রাখিয়া, সেই চারিপায়ার উপর উপবেশন করিল; কেহ বা লম্বা হইয়া শয়ন করিল। প্রহরীগণকে শয়ন করিতে দেখিয়া, দুই জন নাপিত (নাউ) আসিয়া তাহাদিগের পদসেবায় প্রবৃত্ত হইল, এবং দুইজন বারকনিতা আসিয়া সেই স্থানে দণ্ডায়মান হইল। উঁহারা এইরূপ সমাগত পথিকগণের সেবা-সুশ্রুষা করিয়া আপনাপন উদরান্নের সংস্থান করিয়া থাকে। নাপিতগণের থাকিবার স্থান সেই সরাইয়ের ভিতর না থাকিলেও, দিনরাত্রি তাঁহারা সকলেই প্রায় সেই স্থানে অবস্থিতি করে; কিন্তু বার-বনিতাগণ সেই সরাইয়ের ভিতরেই একটা একটা ঘর লইয়া, তাহাতেই অবস্থিতি করিয়া থাকে।

আসামীদ্বয়ের সহিত প্রহরীগণ যেস্থানে অবস্থান করিল, তাহার পার্শ্ববর্তী অপর আর একটা কামরাতে হোসেন এবং তাহার ভৃত্যদ্বয় স্থান করিয়া লইলেন।

হোসেন একজন প্রহরীকে কহিলেন, আসামীদ্বয়কে যদি দুইখানি চারিপায়া আনাইয়া দেওয়া হয়, তাহাতে আপনাদিগের কোনরূপ আপত্তি আছে কি?

প্রহরী। আসামী! তাহাতে খুনী মোকদ্দমার আসামী। তাঁহারা চারিপায়ার উপর উপবেশন বা শয়ন করিবে! একথা ইতিপূর্বে আমরা আর কাহারও নিকট শ্রবণ করি নাই, দর্শন করা ত দূরের কথা!

হোসেন। আসামীদ্বয়কে চারিপায়ার উপর বসিতে দিবার নিয়ম নাই বলিতেছেন; কিন্তু যদি চারিপায়া দেওয়া যায়, তাহাতে কোনরূপ ক্ষতি আছে কি?

প্রহরী। ক্ষতি থাক বা না থাক, যদি ইহাদিগকে চারি পায়া দেওয়া যায়, তাহার ভাড়া কে দিবে?

হোসেন। চারিপায়ার ভাড়া যাহা লাগিবে, তাহা আমি দিব।

প্রহরী। আর আমাদিগকে?

হোসেন। ইহার নিমিত্ত আপনাদিগকে কিছু দিতে হইবে কি?

প্রহরী। না দিলে চারিপায়া দিতে দিব কেন?

হোসেন। আচ্ছা তাহাই হইবে। এই অনুগ্রহের নিমিত্ত আমি আপনাদিগকে একটা টাকা প্রদান করিতেছি।

প্রহরী। এক টাকায় হইবে না, যদি আমাদিগের প্রত্যেক কেই একটী করিয়া টাকা দেন, তাহা হইলে উঁহাদিগকে চারি পায়ার উপর বসিতে অনুমতি দিতে পারি।

হোসেন। আচ্ছা, তাহাই দিতেছি।

গোফুর। হোসেন! তুমি এরূপ ভাবে অনর্থক অর্থ ব্যয় করিতেছ কেন?

হোসেন। এ ব্যয় অনর্থক নহে। বলুন দেখি, ইতিপূর্বে আর কখনও আপনার মৃত্তিকায় বসিয়াছেন কি?

গোফুর। এখন আর আমি সেই জমিদার গোফুর খাঁ নহি যে, চারিপায় ভিন্ন বসিতে পারি না।

হোসেন। আপনি এখনও সেই গোফুর খাঁ আছেন, ইহা বেশ জানিবেন।

গোফুর। তাহা হইলে আমাদিগকে এই মিথ্যা মোকদ্দমায় আর ফাঁসি যাইতে হইত না।

হোসেন। আপনি ভাবিবেন না। উপরে কি ভগবান নাই? আপনাদিগকে কখনই ফাঁসি যাইতে হইবে না। আপনার মনকে স্থির করুন, দেখুন, আপনাদিগকে বাঁচাইয়া লইয়া যাইতে পারি কি না। দুই তিন দিবস আপনাদিগের স্নান হয় নাই, আজ স্নান করিবেন কি?

গোঁফুর। আর স্নান করিয়াই বা কি হইবে?

হোসেন। স্নান করিয়া অনেক ফল হইবে। স্নান করিলে শরীরের অনেক গ্লানি দূর হইবে, মস্তিষ্ক শীতল হইবে, তখন একমনে ঈশ্বরকে ডাকিতে সমর্থ হইবেন। এক মনে ঈশ্বরকে ডাকিতে পারিলে কোন বিপদ হয় কি?

গোফুর। প্রহরীরা আমাদিগকে স্নান করিতে দিবে কি?

হোসেন। সে ভার আমার উপর। মেরূপে হয়, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিয়া লইতেছি। কেমন গো প্রহরীসাহেব। আপনা দিগের আসামীদ্বয় যদি স্নান করেন, তাহাতে আপনাদিগের, বোধ হয়, কোনরূপ আপত্তি নাই।

প্রহরী। আসামীদ্বয় স্নান করিবে! তাহা কি কখনও হইতে পারে?

হোসেন। কেন হইতে পারিবে না? এখানে আর কে তাহা দেখিতে পাইবে বা কেই বা তাহা শুনিতে পাইবে? ইহার জন্য আপনাদিগের প্রত্যেককে আট আনা এবং স্নানের পরে কিছু জল খাইরার নিমিত্ত, আট আনা করিয়া আমি প্রদান করিতেছি। ইহাতে, এখন বোধ হয়, আপনাদিগের আর কোনরূপ আপত্তি হইবে না।

প্রহরী। কোথায় স্নান করিবে? ইদারার নিকট ইহাদিগকে লইয়া যাইতে দিব না। কারণ, কি জানি যদি ইহার ইদারার ভিতর আত্ম-বিসর্জন করে, তাহা হইলে আমাদিগকে কয়েদ হইতে হইবে।

হোসেন। না, ইহাদিগকে ইদারার নিকট লইয়া যাইব না। যে স্থানে বলিবেন, সেই স্থানে বসিয়াই উঁহারা গান করিবেন।

প্রহরী। জল কোথায় পাইকেন, বা কে আনিয়া দিবে?

হোসেন। আমার সহিত দুইজন পরিচালক রহিয়াছে, এবং আমি নিজে আছি। তদ্ব্যতীত দুই চারি পয়সা দিলেই জল আনিয়া দেওয়ার লোকও পাওয়া যায়। এরূপ অবস্থায় যেস্থানে বলিবেন, সেই স্থানে জল আনাইয়া দিয়া, উঁহাদিগকে স্নান করাইয়া দিব।

প্রহরী। আর আমাদিগকে যাহা দিতে চাহিলেন, তাহা কখন দিবেন?

তাহা আমি এখনই দিতেছি, হোসেন এই বলিয়া চারিপায়া পাইবার, স্নান করিবার এবং কিছু জল খাবার খাইতে পাইবার অনুমতির নিমিত্ত প্রহরীর হস্তে দশ টাকা প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য, ইহার পর উক্ত কয়েকটা বিষয়ের নিমিত্ত প্রহরীগণ আর কোনরূপ আপত্তি করিল না। ভৃত্যগণ ইদারা হইতে জল উঠাইয়া আনিয়া প্রহরীগণের সম্মুখে তাহাদিগকে স্নান করাইয়া দিল। স্নান করিবার পর হোসেন কিছু জল খাবার আনাইলেন; কিন্তু প্রহরীগণ সে জল খাবার উঁহাদিগকে খাইতে না দিয়া কহিল, ইহার ভিতর আপনারা কোনরূপ বিষ প্রদান করিয়াছেন কি না, আমরা তাহা জানি না। সুতরাং আপনাদিগের আনীত জল খাবার ইহাদিগকে কখনই আহার করিতে দিব না। যাহা আনিতে হইবে, তাহা আমাদিগকে বলিয়া দিন এবং তাহার মূল্য আমাদিগকে প্রদান করুন। আমরা নিজে তাহা খরিদ করিয়া আনিয়া, আসামীদ্বয়কে প্রদান করিব।

প্রহরীগণের প্রস্তাবে হোসেন সম্মত হইলেন, এবং জল খাবার আনিবার নিমিত্ত, উঁহাদিগের একজনের হস্তে একটী টাকা প্রদান করিলেন। তাহাতে যে কিছু আহারীয় দ্রব্য আনিয়া আসামীদ্বয়কে প্রদান করা হইল, আসামীদ্বয় তাহা হইতে অতি অল্পই আহার করিলেন। অবশিষ্ট আহারীয় ও পূর্ব-আনীত আহারয় সমুদায়ই প্রহরীদিগের হইল। সেই সকল দ্রব্য আহার করিবার সময়, বিষের কথা আর প্রহরীদিগের মনে উদিত হইল না।

আমি পূর্বেই বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি যে, যে পাঁচজন প্রহরী আসামীদ্বয়কে লইয়া যাইতেছিল, তাঁহারা সকলেই মুসলমান।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

প্রহরীগণ যেরূপ ভাবে সেই সরাইতে বিশ্রাম করিতে লাগিল, তাহাতে তাঁহারা যে শীঘ্র সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবে, এরূপ অনুমান হইল না। একা-চালকগণ তাহাদিগের একার ঘোড়া একা হইতে খুলিয়া দিয়া ঘাস-দানার বন্দোবস্ত করিতে লাগিল।

এই ব্যাপার দেখিয়া হোসেন সেই সর্দ্দার-প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আজ কি আপনারা এই স্থানে অবস্থান করিবেন?

প্রহরী। রাত্রিযাপন আমরা এই স্থানে করিব না। এই স্থান হইতে দুই ক্রোশ ব্যবধানে একটা খানা আছে, রাত্রিকালে সেই স্থানেই অবস্থিতি করিতে হইবে।

হোসেন। এক-চালকগণ যেরূপ ভাবে একা চালাইয়া আসি তেছে, তাহাতে দুই ক্রোশ পথ গমন করিতে অতি অল্প সময়েরই প্রয়োজন হইবে।

প্রহরী। এই স্থান হইতে বাহির হইলে, একঘণ্টার মধ্যেই আমরা সেই থানায় গিয়া অনায়াসেই উপস্থিত হইতে পারি।

হোসেন। আপনারা এই স্থান হইতে কখন রওনা হইতে চাহেন?

প্রহরী। একটু বিশ্রাম করিবার পরই, আমরা এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব।

হোসেন। আপনাদিগের আহারাদির বন্দোবস্ত কোথায় হইবে?

প্রহরী। থানায় গিয়া উপস্থিত হইবার পর, সেই স্থানেই আহারাদি করিব, এরূপ বিবেচনা করিতেছি।

হোসেন। এই স্থানে দেখিতেছি, সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়। এই স্থান হইতে আহারাদি করিয়া, থানায় গমন করিলে হইত না কি?

প্রহরী। তাহা হইলে আমরা কখন থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারি?

হোসেন। আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিয়া যদি আমরা এই স্থান হইতে রওনা হই, তাহা হইলে সন্ধ্যার পূৰ্বেই দুই ক্রোশ পথ অনায়াসেই অতিক্রম করিতে পারি। সন্ধ্যার পূর্বেই যদি আপনারা আসামীর সহিত থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারেন, তাহা হইলে বোধ হয়, কোনরূপ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা নাই।

প্রহরী। ক্ষতি কিছুই নাই; কিন্তু এখানে থাকিয়া আমা দিগের লাভ কি?

হোসেন। লাভ আর কিছুই নহে, কেবল সময় মত আহার করিয়া লইতে পারিবেন।

প্রহরী। এখানে আহারাদি করিবার কি সুবিধা হইবে?

হোসেন। না হইবে কেন? এখানে দেখিতেছি, সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়।

প্রহরী। এখানে আহারাদি প্রস্তুত করার পক্ষে নিতান্ত অসুবিধা হইবে।

হোসেন। কিসে?

প্রহরী। মোটে আমরা পাঁচজন বই প্রহরী নই। আমরা সকলেই এখন পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি। ইহার মধ্যে আসামী দ্বয়কে পাহারাই বা কে দিবে, আহারাদির আয়োজনই বা কে করিবে?

হোসেন। আপনি যদি অনুমতি করেন, তাহা হইলে আমরাই সমস্ত আয়োজন করিয়া দিতে প্রস্তুত আছি।

প্রহরী। কে রন্ধন করিবে?

হোসেন। আমি আছি, আমার দুইজন পরিচারকও রহি আছে। অনুমতি পাইলে আহারীয় প্রস্তুত করিতে আর কত বিলম্ব হইবে?

প্রহরী। তোমাদিগের প্রস্তুত করা আহারীয় দ্রব্য আমরা কিরূপে আহার করিতে পারি?

হোসেন। কেন?

প্রহরী। আমি শুনিয়াছি, বহুদিবস হইল, এইরূপ একটী ঘটনা ঘটিয়াছিল। একজন কয়েদী-আসামীকে লইয়া দুইজন প্রহরী গমন করিতেছিল। যাইতে যাইতে পথে অপর আর একজন লোক আসিয়া তাহাদিগের সহিত মিলিত হয়। সেই ব্যক্তি সেই আসামীর দলস্থিত একজন; কিন্তু এ পরিচয় সে পূর্বে সেই প্রহরীদ্বয়ের নিকট প্রদান করে নাই। ক্রমে তাঁহারা এইরূপ একটী সরাইতে আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং সেই ব্যক্তিই সকলের আহারীয় প্রস্তুত করে। প্রথমে আসামীকে আহার করান হয়, কিন্তু তাহাতে তাহার কোনরূপ অসুখ হয় না। পরিশেষে প্রহরীদ্বয় আহার করিতে বসে, কিন্তু আহার করা শেষ হইতে না হইতেই উভয়েই হতজ্ঞান হইয়া পড়ে। পরে সরাইয়ের লোজন যখন জানিতে পারে যে, দুইজন প্রহরী অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে, তখন তাঁহারা সেই স্থানে গমন করে; কিন্তু সেই কয়েদী-আসামী এবং আহার-প্রস্তুতকারীকে আর তাঁহারা দেখিতে পায় না। এই সংবাদ ক্ৰমে থানায় গিয়া উপ স্থিত হয়। প্রহরীদ্বয়কে হাসপাতালে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। থানাদার নিজে আসিয়া এই ঘটনার সবিশেষ অনুসন্ধান করেন। কিন্তু অনুসন্ধানে কোন ফলই পাওয়া যায় না। উভয় ব্যক্তির মধ্যে কেহই ধৃত হয় না। অধিকন্তু প্রহরীগণ চৈতন্য লাভ করিলে জানিতে পারা যায় যে, তাহাদিগের নিকট যে সকল টাকা-পয়সা ছিল, তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে। ইহা যখন প্রকৃত ঘটনা বলিয়া সকলেই অবগত আছেন, তখন বলুন দেখি, আমরা কিরূপে আপনাদিগকে বিশ্বাস করিয়া আপনাদিগকে রন্ধন করিতে অনুমতি প্রদান করিতে পারি?

হোসেন। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। কিন্তু আপনারা আমাকে পূর্ব হইতে জানেন কি না, বলিতে পারি না। যদি আমাকে পূর্ব হইতে জানিতেন, তাহা হইলে আপ

আমাকে বোধ হয়, এতদূর অবিশ্বাস করিতে পারিতেন না। সে যাহা হউক, আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস করিতেই

পারেন, তাহা হইলে অপর আর কোনরূপ বন্দোবস্ত হইতে পারে না কি? অপর যেরূপ বন্দোবস্ত করিতে বলেন, আমরা সেইরূপ করিতেই প্রস্তুত আছি।

প্রহরী। আর কি বন্দোবস্ত হইতে পারে?

হোসেন। আমরা আর সমস্ত ঠিক করিয়া দিতেছি, আপনা দিগের এক ব্যক্তি অনায়াসেই পাক করিয়া লইতে পারেন।

প্রহরী। আমরা সকলেই অতিশয় ক্লান্ত। সুতরাং আমা দিগের মধ্যে কাহারও দ্বারা সেই কাৰ্য যে সম্পন্ন হইতে পারিবে, তাহা আমি বোধ করি না।

হোসেন। যদি এ কাৰ্য্য আপনাদিগের দ্বারা না হয়, তাহা হইলে আপনাদিগের মধ্যে একজন যদি রন্ধনশালার নিকট উপস্থিত থাকিতে পারেন, তাহা হইলে আমার সমভিব্যাহারী একজন লোকের দ্বারা আমি কাৰ্য্য করাইয়া লইতে পারি। আপনাদিগের সম্মুখে যদি আহারীয় প্রস্তুত হয়, তাহা হইলে আমরা উহাতে কিরূপে বিষ মিশ্রিত করিতে পারিব?

প্রহরী। অত গোলযোগে কায নাই। আমরা একরূপ জলযোগ করিয়াছি, এখন আর আহার করিবার ইচ্ছা নাই। সুতরাং আহারীয় প্রস্তুত করিবার আর প্রয়োজন কি? আপ নারা ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আহারাদি প্ৰস্তুত করিয়া অনায়াসেই আহার করিতে পারেন।

হোসেন। আমি আমাদিগের আহারের নিমিত্ত বলিতেছি না। আপনারা যে আসামীদ্বয়ের সহিত আসিয়াছেন, তাঁহাদিগের আজ কয়েকদিবস হইতে আহার হয় নাই; কোন দিন অনাহারে, কোন দিন জলাহারে, দিন অতিবাহিত করিয়া আসিতেছেন। ইহাদিগের অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা পরে হইবে; কিন্তু এখন আমাদিগের ইচ্ছ, উঁহাদিগকে কিছু আহার করাই। এই নিমিত্ত আপনাদিগকে এত অনুরোধ করিতেছি।

প্রহরী। উঁহারা ত এখনই আহার করিলেন?

হোসেন। বাজারের মিষ্ট দ্রব্যাদি ভোজন করিয়া কোন্ ব্যক্তি কয় দিবস জীবনধারণ করিতে পারে?

প্রহরী। যখন আপনারা আহারাদি প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত এতই ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, তখন আমার সম্মুখে আপনারা আমা দিগের সকলের আহারীয় প্রস্তুত করুন। আহারীয় প্রস্তুত করি বার সময় আমি অনায়াসেই বুঝিতে পারি যে, ইহাতে আপনা দিগের কোনরূপ দুরভিসন্ধি আছে কি না।

হোসেন। এ উত্তম কথা।

উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, হোসেন নিজের অর্থ ব্যয় করিয়া সকলের আহারাদির উদ্যোগ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

একজন প্রহরীর তত্ত্বাবধানে সময়মত আহারীয় দ্রব্য সকল প্রস্তুত হইল। তখন হোসেন কহিলেন, এখন আহারীয় প্রস্তুত হইয়াছে, অনুমতি হইলে সকলেই ভোজন করিয়া লইতে পারেন।

প্রহরী। সকলের ভোজন একবারে হইতে পারে না। প্রথমে তোমরা ভোজন কর, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।

হোসেন। আমরা অগ্রে ভোজন করিব কেন? আপনাদিগের আহারাদি হইয়া গেলে, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।

প্রহরী। তাহা হইতে পারিবে না। তোমরা অগ্রে ভোজন করিলে, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।

হোসেন। যদি আপনারা নিতান্তই অগ্রে ভোজন না করেন, তাহা হইলে সকলেই এক সময় ভোজন করা যাউক। আপনারা থাকিতে আমরা কিরূপে অগ্রে খাইতে পাক্সি?

প্রহরী। তাহাও হইতে পারে না।

হোসেন। কেন?

প্রহরী। তোমরা ভোজন করিলে, তাহার পর তোমাদিগের কিরূপ অবস্থা হয়, তাহা অগ্রে দেখিয়া, পরিশেষে আমরা ভোজন করিব।

হোসেন। আপনার এ কথার অর্থ ত আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।

প্রহরী। বুঝিতে না পারিয়া থাকেন, আমি বুঝাইয়া দিতেছি। আমাদিগের তত্ত্বাবধানে আপনারা আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত করিয়াছেন সত্য; কিন্তু আমাদিগের অলক্ষিতে আপনারা উহার সহিত অনায়াসেই বিষ মিশ্রিত করিয়া দিতে পারেন। প্রথমে আপনারা আহার করিলেই, আমরা জানিতে পারি যে, সেই সকল আহারীয় দ্রব্যের সহিত কোনরূপ বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত আছে কি না। আহারান্তে যদি আপনাদিগের কোনরূপ বৈলক্ষণ না ঘটে, তাহা হইলে আমরা সহজেই অনুমান করিতে পারিব যে, উহার সহিত কোনরূপ বিষাক্ত ব্য মিশ্রিত নাই। ইহার পর আর আপনাদিগকে আহারীয় দ্রব্যের নিকট গমন করিতে দিব না। আমরা নিজ হস্তে সেই সকল দ্রব্য পরিবেশন করিয়া আহার করিব।

হোসেন। আপনার এ কথায় আমাদিগের কোন উত্তর নাই। আমরা আহারীয় দ্রব্যর নিকট আর গমনই করিব না। আপনারা উহা হইতে কিছু কিছু আমাদিগকে প্রদান করুন, আমরা দূরে বসিয়া আহার করি। আমরা আপনাদিগের আদেশ প্রতিপালন করিব মাত্র। কিন্তু আপনাদিগকে এবং মনিবদ্বয়কে পরিত্যাগ করিয়া, পরিতুষ্টির সহিত কখনই আহার করিয়া উঠিতে পারিব না।

ইহার পর হোসেনের প্রস্তাব-মতই কাৰ্য্য হইল। হোসেন ও তাহার পরিচারকদ্বয় দূরে আহার করিতে বসিলেন; একজন প্রহরী তাহাদিগকে পরিবেশন করিলেন। প্রহরীগণ যখন দেখিল, হোসেন বা তাহার পরিচারকদ্বয় সেই সকল দ্রব্য আহার করিয়া সুস্থ শরীরে রহিলেন, তখন তাঁহারা তাহাদিগের নিজের আহারের উদ্যোগ করিতে লাগিল। কিন্তু আসামীদ্বয় আহার করিবে কি না, সে সম্বন্ধে কোন কথাই কহিল না। তখন হোসেন কহিলেন, আপনাদিগের আহারের উদ্যোগ হইতেছে; কিন্তু আসামীদ্বয় কখন আহার করিবেন?

প্রহরী। আসামীদ্বয়েরও কি আহারীয় প্রস্তুত করিয়াছেন?

হোসেন। উঁহারাই আহার করিবেন বলিয়া, সকলের নিমিত্ত আহারীয় আমরা প্রস্তুত করিয়াছি। নতুবা আমাদিগের আহারীয় প্রস্তুত করিবার কোনরূপ প্রয়োজনই ছিল না।

প্রহরী। উহার ফাঁসি যাইবার আসামী। উঁহাদিগকে আমরা কিরূপে আহার করিতে অনুমতি দিতে পারি?

হোসেন। যাহাদিগকে ফাঁসি দিবার হুকুম হয়, ফাঁসির পূর্বে যে কয় দিবস তাঁহারা বাঁচিয়া থাকে, সে কয় দিবস কি তাহাদিগকে আহার করিতে দেওয়া হয় না। যদি সরকারের এরূপ কোন নিয়ম থাকে, তাহা আমি অবগত নহি। বরং লোক-পরম্পরায় শুনিতে পাওয়া যায়, ফঁসি যাইবার পূর্বে ফাঁসির আসামী যাহা খাইতে চাহে, সরকার হইতে তাহাই তাহাকে খাইতে দেওয়া হয়। সে যাহা হউক, এত পরিশ্রম করিয়া যখন আমরা আহারীয় প্রস্তুত করিয়াছি, তখন উঁহাদিগকে কিছু আহার করিতে দিয়া আমাকে সবিশেষরূপ অনুগৃহীত করুন।

প্রহরী। উঁহারা আহার করুন, বা না করুন, তাহাতে আপনার ক্ষতি-বৃদ্ধি কি?

হোসেন। ক্ষতি নাই? খুব ক্ষতি আছে। যিনি আমার অন্নদাতা, তিনি আহার করিতে পাইবেন না, আর আমরা আহার করিয়া বসিয়া আছি! ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে? আমি আপনাদিগকে সবিশেষরূপ অনুবোধ করি তেছি, উঁহাদিগের আহার করিতে দিবার পক্ষে কোনরূপ প্রতি। বন্ধক হইবেন না। উঁহারা যেরূপ মনঃকষ্টে আছেন, তাহাতে যে আহার করিতে পারিবেন, সে ভরসা আমার নাই; তবে আহার করিতে বসিয়াছেন, ইহা দেখিলেই আমার মনটা একটু সন্তুষ্ট হইবে, এই মাত্র। এই অনুগ্রহের নিমিত্ত যদি আপনাদিগের আরও কিছু লইবার প্রত্যাশা থাকে, তাহাও আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারেন।

প্রহরী। যখন আপনি এরূপ ভাবে অনুরোধ করিতেছেন, তখন আপনার অনুবোধই বা রক্ষা না করি কি প্রকারে? তবে জানেন কি, আমরা পেটের দায়ে চাকুরী করিতে আসিয়াছি, তাই আপনাকে বলিতেছি।

হোসেন। ইহার জন্য এত গোলযোগ করিবার প্রয়োজন কি? আপনারা যখন যাহা চাহিতেছেন, আমি তখনই তাহা আপনা দিগকে প্রদান করিতেছি। প্রথমেই এ কথা আমাকে বলিতে পারিতেন! আপনাদিগের প্রস্তাবে যদি আমি সম্মত হইতে পারি তাম, তাহা হইলে উঁহাদিগের নিমিত্ত আহারীয় প্রস্তুত করিতাম, আর যদি সেই প্রস্তাব আমার সাধ্যাতীত হইত, তাহা হইলে আপনাদিগকে সেলাম করিয়া আমি ধীরে ধীরে প্রস্থান করিতাম। আচ্ছা, এখন বলুন দেখি, উঁহাদিগকে আহার করিবার অনুমতি দিবার নিমিত্ত আপনারা কি প্রার্থনা করেন?

প্রহরী। পঁচিশ টাকা।

হোসেন। আপনারা পাচজন আছেন, আপনাদিগের প্রত্যেক কেই পঁচিশ টাকা করিয়া আমাকে প্রদান করিতে হইবে?

প্রহরী। না, মোট পচিশ টাকা প্রদান করিলেই হইবে।

হোসেন। পঁচিশ টাকা আমি প্রদান করিতে পারিব না। আপনারা পাঁচজন আছেন, প্রত্যেককে দুই টাকা হিসাবে মোট আপনাদিগকে আমি দশ টাকা প্রদান করিতেছি। ইহাতে আপ নারা সম্মত হইয়া আসামীদ্বয়কে আহার করিবার নিমিত্ত অনুমতি প্রদান করেন ভালই, নতুবা আমি এ স্থান হইতে প্রস্থান করি তেছি, আপনাদিগের মনে যাহা উদয় হয়, তাহা করিবেন।

প্রহরী। আপনাকে আর প্রস্থান করিতে হইবে না। দশ টাকা নিতান্ত অল্প হইতেছে, আর পাঁচটী টাকা বাড়াইয়া দিন।

হোসেন। পাঁচ টাকা ত দূরের কথা, দশ টাকার উপর আমি আর পাঁচটা পয়সাও, বাড়াইয়া দিতে পারিব না। ইহাতে আপনা দিগের যাহা অভিরুচি হয়, তাহা করিতে পারেন।

প্রহরী। যে কাৰ্যে আপনারা অসন্তুষ্ট হন, সে কাৰ্য্য আমা দিগের কোনরূপেই কৰ্তব্য নহে। আচ্ছা, আপনার প্রস্তাবেই আমরা সম্মত হইলাম। টাকা দশটী কথন প্রদান করিবেন?

হোসেন। যখন আপনাদিগের আবশ্যক হইবে, তখনই আপনারা লইতে পারেন। এখনই চাহেন, তাহাও আমাকে বলুন, এখনই আমি উহা আপনাদিগের হস্তে প্রদান করিতেছি।

প্রহরী। সেই ভাল। আমি একাকী নহি, পাঁচজনের কাৰ্য্য, অগ্রে দেওয়াই ভাল।

প্রহরীর কথা শুনিয়া হোসেন আর কোন কথা কহিলেন, দশটী টাকা বাহির করিয়া তৎক্ষণাৎ সেই প্রহরীর হস্তে প্রদান করিলেন।

হোসেন টাকা প্রদান করিলেন সত্য; কিন্তু মনে মনে বড়ই অসন্তুষ্ট হইলেন। মনে করিলেন, এরূপ অত্যাচার করিয়া টাকা লওয়া নিতান্ত অন্যায়। আসামীর সহিত কথা কহিবার প্রয়োজন হইলে টাকা ভিন্ন হইতে পারিবে না! স্নানের নিমিত্ত টাকা, জলপানের নিমিত্ত টাকা, আহারের নিমিত্ত টাকা, এবং বিশ্রাম করিবার নিমিত্ত একখানি চারিপায়া প্রদান করিতে হইলেও টাকা! কি ভয়ানক অত্যাচার! এই সকল অত্যাচারের নিমিত্তই পুলিসের এত দুর্নাম।

হোসেন মনে মনে এইরূপ ভাবিতে লাগিলেন সত্য; কিন্তু প্রকাশ্যে কোন কথা কহিতে পারিলেন না।

গোফুর খাঁ ও ওসমান, প্রথমতঃ কিছুতেই আহার করিতে সম্মত হইলেন না। কিন্তু কোন প্রকারেই হোসেনের অনুরোধ লম্বন করতে না পারিয়া, আহার করিবার নিমিত্ত একবার বসিলেন মাত্র; ফলতঃ আহার করিতে পারিলেন না, চক্ষু-জলে আহারীয় ভাসিয়া যাইতে লাগিল।

আহারান্তে প্রহরীগণ আপনাপন চারিপায়ার উপর শয়ন করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিল। কেবল একজন মাত্র প্রহরী আসামীদ্বয়কে পাহারা দিতে লাগিল। আসামীদ্বয় সেই গৃহের ভিতর কয়েদী অবস্থায় বিষন্ন মনে বসিয়া রহিলেন।

এইরূপে প্রায় সমস্ত দিবস সেই স্থানে অতিবাহিত হইয়া গেল। সন্ধ্যা হইতে অতি অল্পমাত্র বাকী আছে, সেই সময় একজন প্রহরী এক্কা-চালকগণকে ডাকিল ও কহিল, বেলা প্রায় অবসন্ন হইয়া আসিয়াছে। এখনও অনেকদূর আমাদিগকে গমন করিতে হইবে, আর বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই। একা সকল শীঘ্র প্রস্তুত করিয়া আন, আমরা এখনই এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব।

প্রহরীর কথা শুনিয়া এক্কা-চালকগণ তখনই এ প্রস্তুত করিয়া আনিল। প্রহরীগণ আসামীদ্বয়ের সহিত উহাতে আরোহণ করিল, হোসেনও আপনার দুইজন পরিচারকের সহিত আপন একায় আরোহণ করিয়া তাহাদিগের এক্কার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। এক্কা-চালকগণ অখে কষাঘাত করিতে করিতে বেগে একা চালাইতে আরম্ভ করিল।

সন্ধ্যার অল্প পরেই সকলে একটী থানায় গিয়া উপস্থিত হইল। সেই স্থানে সকলে একা হইতে অবতরণ করিয়া থানার ভিতর প্রবেশ করিলেন। থানায় সেই সময় দারোগা উপস্থিত ছিলেন না, কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে তিনি স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। অনুসন্ধানে হোসেন জানিতে পারিলেন যে, সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী অর্থাৎ দারোগাও একজন মুসলমান বংশ-সম্ভূত।

যে সকল এক্কায় আরোহণ করিয়া আমাশয়, প্রহরীগণ ও হোসেন প্রভৃতি গমন করিয়াছিলেন, এখন সেই সকল এক বিদায় করিয়া দিবার প্রয়োজন হইল। কারণ, তাঁহারা অনেকদূর আগমন করায়, তাহাদিগের অশ্বগণ সবিশেষরূপ ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। তদ্ব্যতীত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় সেই স্থানে যতগুলি একার প্রয়োজন হইবে, ততগুলিই অনায়াসে পাওয়া যাইবে।

এইরূপ বন্দোবস্ত দেখিয়া, যে এক্কায় হোসেন তাহার ভৃত্য দ্বয়ের সহিত আগমন করিয়াছিলেন, তাহাকে ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন। সেই এক্কা-চালককে যে পরিমিত ভাড়া দিবার নিমিত্ত প্রহরীগণ বলিয়া দিল, হোসেন তাহাতে দ্বিরুক্তি না করিয়া তাহাই দিয়া দিলেন। একা-চালক আপনার ভাড়া পাইয়া থানার বাহিরে গিয়া উপবেশন করিল।

কেবলমাত্র একখানি এক্কার ভাড়া দিতে দেখিয়া একজন প্রহরী কহিল, আপনি কেবলমাত্র একখানি একার ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন দেখিতেছি। আর অপর এক্কা তিনখানি, যাহাতে আপনার মনিবদ্বয় এবং আমরা আসিয়াছি, তাহার ভাড়াও ওই সঙ্গে দিলেন না কেন?

হোসেন। আপনাদিগের একা-ভাড়া প্রভৃতি যাহা কিছু ব্যয় হইবে, তাহার নিমিত্ত আমি এককালীন আপনাদিগকে পঞ্চাশ টাকা প্রদান করিয়াছি। তাহা হইতে একা-ভাড়া প্রদান করিতে আপনাদিগের কোনরূপ আপত্তি আছে কি?

প্রহরী। আপত্তি আর কিছুই নাই, তবে এখন আপনি দিয়া দিলেও কোন ক্ষতি নাই।

হোসেন। আমি একবার প্রদান করিয়াছি। বলেন না হয়, আর একবার প্রদান করি। যখন আমরা সম্পূর্ণরূপে আপনাদিগের হাতে পড়িয়াছি, তখন যাহা বলিবেন, তাহাই করিতে হইবে।

প্রহরী। আপনি অসন্তুষ্ট হইবেন না। একা-ভাড়া এখন আপনি প্রদান করুন, বা আমরা প্রদান করি, তাহাতে কোনরূপ ক্ষতি নাই। কারণ, আমাদিগের নিকট আপনার যে পঞ্চাশ টাকা আছে, খরচ-পত্ৰ বাদে তাহা হইতে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা আপনারই। আর যদি উহাতে সমস্ত খরচের সঙ্কুলান না হয়, তাহা হইলে আর যাহা লাগিবে, তাহা আপনাকে দিতে হইবে। এরূপ অবস্থায় সামান্য একা-ভাড়ার নিমিত্ত এত গোলযোগ করিতেছেন কেন?

হোসেন। আমি কোনরূপ গোলযোগই করিতেছি না। যে টাকা আপনাদিগের নিকট আছে, তাহা হইতে এক্কা-ভাড়া প্রদান করিতে যদি আপনাদিগের কোনরূপ অসুবিধা হয়, তাহা হইলে এখনই আমি উহা প্রদান করিতেছি।

প্রহরী। অসুবিধা আর কিছুই নয়। তবে টাকাগুলি যেরূপ ভাবে বাঁধিয়া রাখা আছে, তাহা হইতে কিছু টাকা বাহির করিয়া লইতে হইলে অনেক সময়ের প্রয়োজন। তাই যাহাতে এক্কা ওয়ালাগণের আর বিলম্ব না হয়, সেই নিমিত্ত ভাড়াটা এখন আপ, নাকে দিতে বলিয়াছিলাম। ইহাতে আমাদিগের কোনরূপ দুরভিসন্ধি নাই।

হোসেন। সামান্য টাকার নিমিত্ত আর অধিক কথার প্রয়ো জন নাই। আমি এখন উহা প্রদান করিতেছি, যেরূপ ভাল বিবেচনা হয়, পরিশেষে আপনারা তাহা করিবেন।

এই বলিয়া হোসেন আর তিনখানি একার ভাড়াও আপনার নিকট হইতে উঁহাদিগকে দিয়া দিলেন।

আপনাপন ন্যায্য মজুরি বুঝিয়া লইয়া একাওয়ালাগণ সেই স্থান হইতে তখনই প্রস্থান করিল।

প্রহরীগণের ব্যবহার দেখিয়া হোসেন মনে মনে ভাবিলেন, উঁহাদিগের খরচের নিমিত্ত যে পঞ্চাশ টাকা দেওয়া হইয়াছে, তাহা পাইবার আর কোনরূপ উপায় নাই। অথচ আরও যাহা কিছু খরচ হইবে, তাহার সমস্তই তাঁহাকে বহন করিতে হইবে।

এই সময় গোফুর খাঁ হোসেনকে তাহার নিকট ডাকিলেন। হোসেন তাহার নিকট গমন করিলে তিনি কহিলেন, হোসেন। আমি দেখিতেছি, তুমি নিরর্থক অনেক অর্থ নষ্ট করিতেছ।

হোসেন। আপনাদিগের জীবন অপেক্ষা কি অর্থের মূল্য অধিক? যে আপনাদিগের নিমিত্ত আমি সেই অর্থ ব্যয় করিব না?

গোফুর। আমাদিগের জীবন রক্ষার নিমিত্ত অর্থ ব্যয় করিতে আমাদিগের কিছুমাত্র আপত্তি নাই। কিন্তু এইরূপ নিরর্থক অর্থ ব্যয় করিয়া কি আমাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারিবে?

হোসেন। এরূপ ভাবে অর্থ ব্যয় করিয়া, আপনাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারি না সত্য; কিন্তু আপাততঃ আপনাদিগের কষ্টের অনেক লাঘব করিতে সমর্থ হইব।

গোফুর। যাহাদিগের জীবনের আর কিছুমাত্র আশা নাই, দুই চারিদিবসের নিমিত্ত তাহাদিগের শারীরিক কষ্ট নিবারণ করিয়া ফল কি? মানসিক কষ্টের নিকট শারীরিক কষ্ট কিছুই নহে। যে ব্যক্তি সর্বদা মানসিক কষ্ট ভোগ করিতেছে, তাহার যতই কেন শারীরিক কষ্ট হউক না, তাহার দিকে তাহার লক্ষ্যই হয় না।

হোসেন। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। কিন্তু আমাদিগের সম্মুখে আপনি শারীরিক কষ্ট ভোগ করিবেন, অর্থ থাকিতে আমরা কিরূপে উহা দেখিতে সমর্থ হইব? আর আপনাদিগের জীবনের আশা নাই, এ কথাই বা আপনারা কিরূপে অনুমান করিলেন?

গোফুর। যাহার ফাঁসির হুকুম হইয়াছে, তাহার আর জীবনের আশা কি?

হোসেন। এখনও অনেক আশা আছে। যে বিচারালয় হইতে আপনাদিগের ফাঁসির হুকুম হইয়াছে, তাহার উপর বিচারালয় আছে। সেখানে আপীল করিব, যেরূপ ভাবে ও যত অর্থ ব্যয় করিয়া চেষ্টা করিতে হয়, তাহা করিব। ইহাতে কি কোনরূপ ফল প্রাপ্ত হইব না? ঈশ্বর না করুন, যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে ছোট লাটকে ধরিব; আবশ্যক হইলে বড় লাটের নিকট পর্যন্ত গমন করিব। পরিশেষে বিলাত পর্যন্ত চেষ্টা করিব। ইহাতেও কি সুবিচার হইবার সম্ভাবনা নাই? যদি ইহাতেও না পারি, তাহ হইলে অর্থ ব্যয় করিয়া, আপনাদিগের জীবনের নিমিত্ত অসৎ উপায় অবলম্বন করিতে ক্রটি করিব না। আপনি আপনার মনকে স্থির করিয়া রাখুন। দেখিবেন, যেরূপ উপায়েই হউক, কখনই আপনাদিগকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিতে দিব না।

গোফুর। তুমি যাহা মনে করিতেছ, তাহা সম্পূর্ণরূপ অসম্ভব। ইহা কখনই হইতে পারে না।

হোসেন। জগতে অসম্ভব কিছুই নাই; অর্থে না হইতে পারে, এরূপ কোন কাৰ্য্যই নাই। দেখিবেন, যাহা মুখে বলিতেছি, কাৰ্যে তাহা পরিণত করিতে পারি কি না!

গোফুর। আমার বিবেচনায় তুমি আর নিরর্থক অর্থ ব্যয় করিও না। আমাদিগের নিমিত্ত এইরূপ ভাবে যে অর্থ ব্যয় করিবে, তাহা আমাদিগের নামে দরিদ্র ব্যক্তিকে দান করিও। তাহা হইলে আমাদিগের পরকালের অনেক উপকার করা হইবে। ইহকালে যাহা হইবার, তাহা হইল।

হোসেন। গরিব-দুঃখীকে আপনারা যেরূপ ভাবে অর্থ দান করিতে কহিবেন, তাহা আমরা করিব। তদ্ব্যতীত আপনাদিগের জীবন-রক্ষা করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে চেষ্টা করিতে ক্রটি করিব না। বিশেষ–

গোফুর। বিশেষ কি?

হোসেন। এরূপ ভাবে অর্থ আমি যে নিজের ইচ্ছামত ব্যয় করিতেছি, তাহা নহে। আপনার বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ সকলেই আপনাদিগের জীবনের নিমিত্ত তাহাদিগের সঞ্চিত সমস্ত অর্থ ও তাঁহাদিগের সমস্ত অলঙ্কার-পত্র পর্যন্ত আমার হস্তে প্রদান করিতে উদ্যত হইয়াছেন, এবং বলিতেছেন, যদি কোনরূপে আমি আপনা দিগের জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ না হই, তাহা হইলে তাঁহারা সকলেই বিষপান করিয়া আপনাপন জীবন নষ্ট করিবেন। আমি যদিচ এখন তাঁহাদিগের নিকট হইতে কোন অর্থ গ্রহণ করি নাই, তথাপি যদি আমি এইরূপ ব্যয় করিয়া আপনাদিগের জীবন রক্ষার কোনরূপ উপায় না করি, তাহা হইলে কি সর্বনাশ ঘটিবে, একবার মনে করিয়া দেখুন দেখি? : গোফুর। বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ যখন আমাদিগের জীবনের নিমিত্ত এত উৎসুক, তাঁহাদিগের নিমিত্ত কিরূপ বন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন?

হোসেন। সে সম্বন্ধে আমি এ পর্যন্ত কিছুই মনে ভাবি নাই। কারণ, আমার বিশ্বাস, এ সম্বন্ধে আমার কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে না!

গোফুর। কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে না কেন?

হোসেন। যখন আমার বিশ্বাস যে, যেরূপে পারি, আপনা দিগের জীবন রক্ষা করিব, তখন আমার সেই সকল দিকে এখন দৃষ্টি করিবার কোনরূপ প্রয়োজন নাই। যেরূপ ভাবে এ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে, এখন সেইরূপ ভাবেই চলুক। পরিশেষে আপনারা নিষ্কৃতি লাভ করিয়া যখন বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করিবেন, সেই সময় আপনার যেরূপ অভিরুচি হয়, সেইরূপ করিবেন।

গোফুর। সে বহুদূরের কথা।

হোসেন। আমি দিব্য চক্ষে দেখিতে পাইতেছি, উহা দূরের কথা নহে।

গোফুর। সে পরের কথা। আমাদিগকে বাঁচাইতে পারিবে, এরূপ লুব্ধ আশ্বাসের উপর একবারে নির্ভর করিয়া থাকিও না। আমাদিগকে খালাস করিবার যতদূর চেষ্টা করিতে হয়, কর; অথচ অপরাপর বন্দোবস্তের দিকেও সবিশেষরূপ দৃষ্টি রাখিও। কারণ, যদি আমাদিগের জীবন রক্ষাই না হয়, তাহা হইলে আমি বাঁচিয়া থাকিতে থাকিতে আমার ইচ্ছামত বিষয়-আদির বন্দোবস্ত করার আবশ্যক। জমিদারী সম্বন্ধে কিরূপ বন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছা করিতেছ?

হোসেন। এখনও কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার চেষ্টা করি নাই। যেরূপ আদেশ করিবেন, সেইরূপ ভাবেই বন্দোস্ত করিব।

গোফুর। মোকদ্দমা খরচের নিমিত্ত যে টাকা সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছ, সেই টাকার নিমিত্ত জমিদারীর কোন অংশ নষ্ট করিতে হইয়াছে কি?

হোসেন। টাকার নিমিত্ত জমিদারীর কোন অংশ আমি নষ্ট করি নাই, বা উহা বন্ধক দিতেও হয় নাই। সরকারী তহবিলের যে যে স্থানে যে যে টাকা মজুত ছিল, তাহাই সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছি মাত্র। যদি কিছু দেনা হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার নিমিত্ত বিষয়-আদি কিছুই বন্ধক দিতে হইবে না। সমস্ত জমিদারী এ পর্যন্ত যেরূপ ভাবে ছিল, এখনও সেইরূপ ভাবেই আছে।

হোসেন ও গোফুর খাঁর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময়ে একজন প্রহরী আসিয়া আসামীদ্বয়কে হাজতের ভিতর বদ্ধ করিয়া দিল। সুতরাং উভয়ের কথাবার্তা সেই সময়ের নিমিত্ত শেষ হইয়া গেল। আসামীদ্বয় সবিশেষ দুঃখিত অন্তঃকরণে হাজতের ভিতর প্রবেশ করিলেন।

সম্পূর্ণ।

(দারোগার দপ্তর ৭৫ম সংখ্যা)
(অর্থাৎ পুলিসের অসৎ বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত!)
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। আষাঢ়।
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.

ঘর-পোড়া লোক।
 (মধ্যম অংশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ।

হোসেনের কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব কহিলেন, আপনি কি অবস্থা শুনিয়াছেন বলুন দেখি, আমিও শ্রবণ করি।

বোগা সাহেবের কথার উত্তরে হোসেন কহিল, ওসমানের চরিত্র আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন, এবং তাহার চরিত্র সম্বন্ধে আপনি যাহা কহিলেন, তাহার একবিন্দুও মিথ্যা নহে। যে মৃতদেহ গোফুর খাঁর বাড়ীতে পাওয়া গিয়াছে, তাহা যে হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। শুনিয়াছি, সেই কন্যাটা বেশ রূপবতী ছিল। তাহার রূপের কথা জমে ওসমানের কর্ণগোচর হইল। যুবতী রূপবতী স্ত্রীলোকের কথা শুনিয়া তিনি আর কোনরূপে স্থির থাকিতে পারিলেন না, তাহার নিকট ক্রমে লোকের উপর লোক পাঠাইয়া, তাহাকে কুপথগামিনী করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ওসমানের প্রস্তাবে সে কোনরূপেই প্রথমে স্বীকৃত হয় নাই; কিন্তু অনেক চেষ্টার পর অর্থের লোভে ক্রমে সে আপন ধৰ্ম্ম বিক্রীত করিতে সম্মত হইল। যে সময় হেদায়েৎ কাৰ্যোপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়া

ছিলেন, সেই সময় একরাত্রিতে ওসমান একখানি পাকী পাঠাইয়া তাহাকে আপন বাড়ীতে আনয়ন করেন। প্রায় সমস্ত রাত্রি তাহাকে আপনার বৈঠকখানায় মাখিয়া, অতি অলমাত্র রাত্রি অবশিষ্ট থাকিতে, সেই পাল্কী করিয়া তাহাকে পুনরায় আপন বাড়ীতে পাঠাইয়া দেন। পরদিবস রাত্রিতে পুনরায় পাল্কী করিয়া

তাহাকে আপন বৈঠকখানায় আনয়ন করেন। সেই সময় গোফুর খাঁ বাড়ীতে ছিলেন না, কানপুরে ছিলেন। যে সময় ওসমান সেই স্ত্রীলোকটাকে লইয়া আপন বৈঠকখানায় আমোদ প্রমোদে উন্মত্ত ছিলেন, সেই সময় হঠাৎ গোফুর খাঁ বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হন। পাছে পিতা তাঁহার এই সকল বিষয় জানিতে পারেন, এই ভয়ে ওসমান তাঁহার বৈঠকখানার সম্মুখে একটা কুঠারীর ভিতর উহাকে লুকায়িত ভাবে রাখিয়া দিয়া সেই গৃহের তালাবদ্ধ করিয়া দেন। তৎপরে তাহার একজন অনুচরকে কহেন যে, তাঁহার পিতা যেমন এদিক ওদিক করিবেন, বা বাড়ীর ভিতর গিয়া শয়ন করিবেন, সেই সময় সেই স্ত্রী লোকটীকে সেই গৃহ হইতে বাহিরে আনিয়া, পাক্কী করিয়া তাহার বাড়ীতে যেন পাঠাইয়া দেওয়া হয়, এবং পাঠাইবার সময় সেই স্ত্রীলোকটাকে যেন বলিয়াও দেওয়া হয় যে, বৃদ্ধ কানপুরে গমন করিলে পুনরায় তাহাকে আনয়ন করা বাইবে।

অনুচর ওসমানের প্রস্তাবে সম্মত হন, এবং কহেন যে, একটু অবকাশ পাইলেই তিনি তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিবেন। অনুচর ওসমানের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন বটে, কিন্তু কাৰ্যে তাহা করিয়া উঠিলেন না। পরদিবস প্রাতঃকালে ওসমান তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি মিথ্যা কথা কহিলেন।

তিনি যে তাহাকে পাঠাইতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন, এ কথা না। ধলিয়া, কহিলেন যে, গত রাত্রিতেই তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অনুচর যে তাহার কোনরূপ অভিসন্ধি বশতঃ এইরূপ মিথ্যা কথা কহিলেন, তাহা নহে; মনে করিলেন, উহাকে পাঠাইয়া দেওয়া হয় নাই, এই কথা জানিতে পারিলে, পাছে ওসমান তাহার উপর অসন্তুষ্ট হন। এই ভয়ে তিনি মিথ্যা কথা কহিলেন। তখন তিনি মনে মনে স্থির করিলেন যে, যেরূপ উপায়ে হউক, এখনই তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিবেন। সেই সময় ওসমান অপর একটী কাৰ্য্যোপলক্ষে তাহাকে স্থানান্তরে প্রেরণ করেন। তিনিও সেই কাৰ্যোপলক্ষে এ দিকের কাৰ্য একবারে ভুলিয়া যান। অথচ ওসমানের বিশ্বাস যে, সেই স্ত্রীলোকটী তাহার বাড়ীতে গমন করিয়াছে; সুতরাং সেই স্ত্রীলোকটী গৃহের ভিতর যে বদ্ধ আছে, এ কথা আর কাহারও মনে হয় নাই, বা সেই ঘর খুলিবারও কোন প্রয়োজন উপস্থিত হয় নাই। এইরূপে অনাহারে এবং তৃষ্ণায় উহার মৃত্যু ঘটে। পরিশেষে আপনি বাড়ীর সমস্ত স্থান অনুসন্ধান করিতে করিতে, যখন সেই ঘরের দরজা খোলেন, তখন সেই মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়ে। এই ব্যাপার দেখিয়া তখন ওমানের সমস্ত কথা স্মরণ হয়, এবং বুঝিতে পারেন যে, তাহার অনুচরের মিথ্যা কথার নিমিত্ত তাহার কি সর্বনাশ ঘটিল! গোফুর খাঁ ইহার ভাল মন্দ কিছুই জানেন না; সুতরাং এই অবস্থা দেখিয়া তিনি একবারে হতজ্ঞান হইয়া পড়েন। আমি যতদুর শুনিয়াছি, ইহাই প্রকৃত ঘটনা। আমি অকপটে আপনার নিকট যাহা বলিলাম, তাহা কিন্তু এখন অন্যরূপ ঘটনা হইয়া পড়িয়াছে।

দারোগা। ইহাই যদি প্রকৃত ঘটনা হয়, তাহা হইলে এখন যেরূপ ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহা কি?

হোসেন। তাহা যে কি, তাহা আপনি আপন মনে বেশ অবগত আছেন, আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?

দারোগা। এই মোকদ্দমার যেরূপ প্রমাণ হইয়াছে, তাহা আপনি সমস্ত অবগত হইতে পারিয়াছেন কি?

হোসেন। তাহা সমস্তই জানিতে না পারিলে, আর আপনার নিকট আসিব কেন?

দারোগা। আপনি আমাকে যে সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেন, তাহার পরিবর্তে আমি এখন যে কোন উপকার করিতে পারি, তাহা বোধ হয় না।

হোসেন। মনে করিলে এখনও বিস্তর উপকার করিতে পারেন।

দারোগা। এরূপ অবস্থায় আমার দ্বারা আর কি উপকার হইবার সম্ভাবনা আছে, বলুন। আমি বিবেচনা করিয়া দেখি, সেই উপকার করিতে আমি কত দুর সমর্থ।

হোসেন। সময় মত বলিব। তখন আপনার যতদূর সাধ্য, সেইরূপ উপকার করিবেন; কিন্তু এখন যাহাতে অন্য কোন সাক্ষীর যোগাড় না হয়, তাহা করিলেই যথেষ্ট হইবে। আরও একটা বিষয়ের অনুরোধের নিমিত্ত আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। যে সমস্ত ব্যক্তি আমাদিগের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাঁহারা ওসমানের জ্বালায় সবিশেষ জ্বালাতন হইয়া, এইরূপে আমাদিগের সর্বনাশ করিতে বসিয়াছে। তাঁহারা যে কথা বলিয়াছে, পুনরায় যে তাহার অন্যথাচরণ করিবে, তাহা আমার বোধ হয় না। তথাপি অর্থ প্রলোভনে আমরা একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব, যদি কোনরূপে কৃতকার্য হইতে পারি। আপনি তাহাতে প্রতিবন্ধকতাচরণ করিবেন না, ইহা আমার একটা প্রধান অনুরোধ।

দারোগা। তাহা কিরূপে হইবে? সাক্ষিগণ একবার যেরূপ কথা বলিয়াছে, এখন যদি তাহার অন্যথাচরণ করে, তাহা হইলে তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে বিপদে পড়িতে হইবে, তাহা কি তাঁহারা জানে না? বিশেষতঃ একথা যদি তাঁহারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তাহা হইলে আমি কখনই বলিতে পারিব না যে, তোমরা পূর্বে যেরূপ বলিয়াছ, এখন অনায়াসেই তাহার বিপরীত বলিতে পার। আর সাক্ষীগণ যদি এখন অন্যরূপ বলে, তাহা হইলে তাহাদিগের ত বিপদ হইবেই; তদ্ব্যতীত আমাদিগের উপরও নানারূপ সন্দেহ উপস্থিত হইবে, আর হয় ত আমাকেও বিপদাপন্ন হইতে হইবে।

হোসেন। যাহাতে আপনাকে বিপদাপন্ন হইতে হইবে, এরূপ কাৰ্যে আমি কখনই হস্তক্ষেপ করিব না। আর যাহা কিছু করিতে হইবে, আপনার সহিত পরামর্শ করিয়া, এবং সেই বিষয়ে আপনার মত লইয়া সেই কাৰ্য্য করিব। আপনার অমতে কোন কাৰ্য্য করিব না।

এই বলিয়া হোসেন, সেই দিবস দারোগা সাহেবের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।

হোসেন চলিয়া গেলে, দয়োগা সাহেব মনে মনে স্থির করিলেন, যাহা কিছু পাইয়াছি, তাহা গ্রহণ করিয়াছি। আরও যদি কিছু পাই, তাহাও লইব। অধিকন্তু হোসেনের সাহায্যে সেই স্ত্রীলোকটীকেও পুনরায় আনাইয়া লইব। কিন্তু আসল কাৰ্য কোনরূপেই ছাড়িব না; যাহাতে গোফুর এবং ওসমানকে ফঁসি কাষ্ঠে ঝুলাইতে পারি, বিধিমতে তাহার চেষ্টা করিব।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

হেদায়েতের কন্যাকে হত্যার অপরাধে, গোফুর খাঁ এবং তাহার পুত্র ওসমান খাঁ মাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরিত হইলেন। দারোগা সাহেবও প্রাণপণে সেই মোকদ্দমার আয়োজন করিতে লাগিলেন। পিতা পুত্র উভয়েই হাজতে রহিলেন। পুলিসের নিকট যে সকল সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিল, যাহাতে তাঁহারা মাজিস্ট্রেটের নিকট অন্যরূপ সাক্ষ্য প্রদান করে, তাহার নিমিত্ত হোসেন অনেক অর্থ ব্যয় করিয়া, অনেক চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। বরং পুলিসের নিকট তাঁহারা যেরূপ বলিয়াছিল, মাজিষ্ট্রেটের নিকট তাহা অপেক্ষা আরও অনেক অধিক কথা কহিল।

সমস্ত সাক্ষীর এজাহার হইয়া যাইবার পর, মাজিষ্ট্রেট সাহেব দেখিলেন যে, আসামীদ্বয়ের বিরুদ্ধে হত্যাকরা অপরাধ উত্তমরূপে প্রমাণিত হইয়াছে। সুতরাং চুড়ান্ত বিচারের নিমিত্ত তিনি এই মোকদ্দমা দায়রায় প্রেরণ করিলেন।

এই মোকদ্দমার বিচারের নিমিত্ত যখন দায়রায় দিন স্থির হইল, সেই সময় বিচারক মফঃস্বল পরিভ্রমণ উপলক্ষে, জেলা হইতে সুদূর মফঃস্থলে অবস্থান করিতেছিলেন। যখন যে গ্রামে বিচারক উপস্থিত হইতেছিলেন, সেই সময় সেই গ্রামেই আপন কাছারি করিয়া মোকদ্দমার বিচারও করিয়া আসিতেছিলেন।

যে দিবস গফুর খাঁ এবং তাঁহার পুত্র ওসমানের এই হত্যাপরাধ-বিচার আরম্ভ হইল, সে দিবস একটা নিতান্ত ক্ষুদ্র পলিগ্রামের ভিতর জজসাহেবের তাম্বু পড়িয়াছিল। সুতরাং সেই স্থানেই এই মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইল।

এলাহাবাদ হাইকোর্ট হইতে উকীল কৌন্সলি আনাইয়া এই মোকদ্দমায় দোষ-ক্ষালনের যতদূর উপায় হইতে পারে, হোসেন প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কিছুতেই আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইলেন না। সরকারী উকীল মোকর্দমার অবস্থা জজসাহেবকে উত্তমরূপে সর্বপ্রথম বুঝাইয়া দিবার পর হইতেই, জজসাহেবের মনে কেমন এক বিশ্বাস হইয়া গেল যে, আসামী পক্ষীয় উকীল কৌশলি অনেক চেষ্টা করিলেও, তাহার মন হইতে সেই বিশ্বাস অপনোদন করিতে পারিলেন না। তিন দিবস পৰ্য্যন্ত এই মোকদ্দমার সাক্ষিগণের এজাহার গৃহীত হইল। তাহাদিগের উপর যথেষ্ট জেরা হইল। উভয় পক্ষীয় উকীল কৌন্সলিগণ স্বপক্ষে সাধ্যমত বক্তৃতাদি করিতে ক্রটি করিলেন না; কিন্তু কিছুতেই আসামীদ্বয়ের পক্ষে কোনরূপ উদ্ধারের উপায় লক্ষিত হইল না।

জজসাহেব এই মোকদ্দমার রায় প্রদান করিবার কালীন কহিলেন, আসামীগণ! তিন দিবস পর্যন্ত বিশেষ যত্ন ও মনো–যোগের সহিত, এই মোকদ্দমার সমস্ত ব্যাপার আমি উত্তম রূপে শ্রবণ করিয়াছি, এবং তোমাদিগের পক্ষীয়, সুশিক্ষিত উকীল কৌন্সলিগন সবিশেষ যত্নের সহিত তোমাদিগের পক্ষসমর্থন করিয়া, তোমাদিগের স্বপক্ষে যাহা কিছু বলিবার আছে, তাহা অপেক্ষাও অনেক কথা বলিয়াছেন; কিন্তু উভয় পক্ষের সমস্ত ব্যাপার শ্রবণ করিয়া এবং সাক্ষিগণের সাক্ষ্য দিবার কালীন, তাহাদিগের ভাব-ভঙ্গি দেখিয়া আমার স্পষ্টই প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, তোমাদিগের বিপক্ষে তাঁহারা বিন্দুমাত্রও মিথ্যা কথা কহে নাই। অবশ্য, অনেক সাক্ষ্যের অনেক স্থান অপর সাক্ষিগণের সাক্ষ্যের সহিত এক মিল হয় নাই। কিন্তু তাহা বলিয়া তাঁহারা যে, একবারে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, এ কথা আমি কখনই স্বীকার করিতে পারিব না। তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর তালা বন্ধ গৃহের মধ্যে হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ যে পাওয়া গিয়াছে, সে সম্বন্ধে কোন আপত্তি উত্থাপিত হয় নাই। বিশেষতঃ তোমাদিগের বিরুদ্ধে যে সকল ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাঁহারা সকলেই তোমাদিগের জমিদারীর প্রজা। প্রজাগণ তাহা দিগের জমিদারের বিপক্ষে কখনই মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিতে সম্মত হয় না। আর নিতান্ত সত্যের অনুরোধে যদি কোন প্রজাকে তাহার জমিদারের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতে হয়, তাহা হইলেও সেই প্রজা যতদূর সম্ভব, তাহার জমিদারকে বাঁচাইয়া যাইতে চেষ্টা করে, ইহাই এদেশীয় নিয়ম। তোমাদের প্রজাগণ তোমাদিগের বিপক্ষে যে সকল সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, আমার বিশ্বাস, তাঁহারা তাহা অপেক্ষাও অনেক অধিক কথা অবগত আছে। কোনরূপে যদি আপনাদের জমিদারের উপকার করিতে পারে, এই ভাবিয়া সকল কথা তাঁহারা বলে নাই। সেই সকল সাক্ষী ওসমানের অত্যাচারে অত্যাচারিত হইয়া, তোমাদিগকে বিপদাপন্ন করিবার মানসে মিথ্যা কথা কহিতেছে, এ কথা সময় সময় মোদিগের কৌন্সলি উখাপিত করিলেও, তাঁহারা সেই সকল কথা একবারে অস্বীকার করে। অথচ তোমরাও তাহার সত্যাসত্য প্রমাণ করতে সমর্থ হও নাই, বা তাহার চেষ্টাও কর নাই। এইরূপ নানা কারণে আমি সাক্ষিগণের সাক্ষ্য কোনরূপেই একবারে অবিশ্বাস করিতে পারি না।

সাক্ষিগণের দ্বারায় বেশ প্রমাণিত হইয়াছে যে, হেদায়েতের নিকট হইতে খাজানা আদায় করিবার মানসে, তাহার অবর্ত মানে তাহার যুবতী কন্যাকে তোমরা বলপূৰ্ব্বক তাহার পরদার বাহিরে আনিয়া সৰ্ব্বসমক্ষে তাহাকে যেরূপ অবমাননা করিয়াছ, সেরূপ কাৰ্য ভদ্রবংশীয় কোন লোকের দ্বারা কোনরূপেই সম্ভব না। কেবল মাত্র সামান্য খাজানা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে তোমরা সেই যুবতীর উপর কেবল যে এইরূপ ভয়ানক অত্যাচার করিয়াছ, তাহা নহে। আমার অনুমান হয় যে, তোমাদিগের এরূপ কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার অপর কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। এইরূপে যুবতীর উপর ভয়ানক অত্যাচার করিয়াই যে, তোমরা তাহাকে নিষ্কৃতি দিয়াছ, তাহা নহে। সৰ্বসমক্ষে সেই অবলাকে বিনাদোয়ে ধৃত করিয়া, বিশেষরূপে অবমাননার সহিত কয়েক খানি গ্রামের মধ্য দিয়া তোমরা তোমাদিগের বাটী পৰ্যন্ত তাহাকে লইয়া গিয়াছ। এ কথা গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিত সকলেই একবাক্যে কহিতেছে। অবলা স্ত্রীলোকের উপর বিনা দোষে এরূপ অত্যাচার করা নিতান্ত পিশাচের কাৰ্য ভিন্ন আর কিছুই বলিতে পারা যায় না। এইরূপ অত্যাচার করিয়াই কি তোমরা তাহাকে নিষ্কৃতি লিয়াছ? তোমাদিগের নিজের অনুচর এবং ভৃত্যরর্গের দ্বারা প্রমাণিত হইতেছে যে, সেই হতভাগিনীকে অনশনে রাখিয়া হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে তাহাকে তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর একটা নির্জন গৃহের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলে। অনশনে যে লোকের মৃত্যু ঘটে, তাহা কি তোমরা জান না? ক্ষুৎপিপাসা সন্থ করিতে কোন্ ব্যক্তি কয়দিবস সমর্থ হয়, তাহা কি তোমাদিগের মনে একবারের নিমিত্তও উদয় হয় নাই? কেবল তাহাই নহে, তোমাদিগের নিজের পরিচারক কি বলিতেছে, তাহা একবার শোন। এক দিবস কোন গতিতে আমি সেই গৃহের চাবি সংগ্রহ করিয়া ঘর খুলিয়া দেখিলাম যে, ক্ষুধায় এবং তৃষ্ণায় যুবতী মৃত্যুশয্যায় শায়িতা। এই অবস্থা দেখিয়া আমার কঠিন হৃদয়েও দয়ার উদ্রেক হইল। ঘরবানের সহিত পরামর্শ করিয়া আমি কিছু আহারীয় এবং পানীয় আনিয়া উহাকে দিবার উদ্যোগ করিতেছি, এরূপ সময়ে ওসমান সাহেব তাহা জানিতে পারিয়া, সেই সকল দ্রব্য আমার হস্ত হইতে কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন, ও আমাকে যৎপয়োনান্তি গালি দিয়া পুনরায় সেই গৃহের তালা বন্ধ করিয়া দিলেন। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে নিতান্ত কষ্ট হইল। আমি গিয়া গোফুর মিঞার নিকট এই কথা বলিলে, কোথায় তিনি তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা করিবেন, না তাঁহার পরিবর্তে আমাকে সহস্র গালি প্রদান করিয়া, তাঁহাদিগের বিনা, অনুমতিতে আমি সেই গৃহের দরজা খুলিয়াছিলাম বলিয়া আমাকে চাকরী হইতে জবাব দিলেন, এবং তদখেই আমাকে তাঁহা, লিগের বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দিলেন।

কি ভয়ানক! কি পৈশাচিক ব্যবহার! এই ব্যক্তি ও তাহার পোষকতাকারী ঘরবানের সাক্ষ্য যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সেই যুবতীকে অনশনে রাখিয়া, ইচ্ছা-পূৰ্ব্বক তাহাকে যে হত্যা করিয়াছ, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যাহাদিগের দ্বারা এরূপ কাৰ্য্য হইতে পারে, তাঁহারা কোনরূপেই দয়ার পাত্র নহে। আমার বিবেচনায় এরূপ প্রকৃতি-বিশিষ্ট লোকের উপর দয়া প্রকাশ করিলে ঈশ্বর তাহার উপর অসন্তুষ্ট হন। গোফুর খাঁ! তোমার বৃদ্ধ বয়স দেখিয়া, এবং তোমার পূর্ব-চরিত্র শ্রবণ করিয়া আমি পূর্বে মনে করিয়াছিলাম, এরূপ মোকদ্দমায় যদি কেহ দয়ার পাত্র হয়, তাহা তুমি। কিন্তু এখন আমি দেখিতেছি, দস্যু তস্করকে দয়া করা যাইতে পারে, মনুষ্য হত্যাই যাহাদিগের জীবিকা, তাহাদিগকেও দয়া করা যাইতে পারে, তথাপি তোমার উপর সে দয়া প্রকাশ করিতে নাই। তোময়া ইচ্ছা করিয়া যেরূপ ভয়ানক অপরাধ করিয়াছ, তাহার প্রকৃত দণ্ড আমাদিগের আইনে নাই। তোমাদিগের জাতীয় রাজার রাজত্বকালে যেরূপ কুকুর দিয়া খাওয়াইয়া ও ক্ষতস্থানে লবণ নিক্ষিপ্ত করিয়া মারিয়া ফেলিবার নিয়ম ছিল, আমার বিবেচনায় তোমরা সেইরূপ দণ্ডের উপযুক্ত। কিন্তু সেরূপ দণ্ড যখন আমাদিগের আইনে নাই, তখন আমাদিগের আইনের চরম দণ্ড আমি তোমাদিগের উপর বিধান করিলাম। যে পর্যন্ত তোমরা না মরিবে, সেই পৰ্য্যন্ত তোমাদিগের উভয়কেই ফাঁসিকাষ্ঠে লটুকাইয়া রাখা হইবে।

জজসাহেবের মুখে বিষম দণ্ডের কথা শুনিয়া গোফুর খাঁ আর দাড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না, মূর্হিত অবস্থায় সেই স্থানে পড়িয় গেলেন। প্রহরীগণ তাঁহার মুখে জল সিঞ্চন করাতে তাঁহার সংজ্ঞা হইলে, তাঁহারা তাঁহাকে সেই স্থান হইতে বাহির করিয়া লইয়া গেল। ওসমান স্থিরভাবে এই দণ্ডাজ্ঞা সহ করিলেন, কোন কথা কহিলেন না; কেবল দারোগা সাহেবের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন মাত্র।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

এই ভয়ানক দণ্ডাজ্ঞা শুনিয়া হোসেনের মুখ দিয়া আর কোন কথা বাহির হইল না। অপূর্ণ-লোচনে তিনি আদালতের বাহিরে আসিলেন। যে সময় এই মোকদ্দমার বিচার শেষ হইয়া গেল, তখন অপরাহ চারিটা। জজসাহেবের সঙ্গে একজন কোর্ট-ইনস্পেক্টার ছিলেন; যে আসামীদ্বয়ের উপর প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, তাহাদিগকে লইয়া তিনি বিষম বিপদে পড়িলেন। কিরূপে সেই আসামীদ্বয়কে তিনি জেলায় পাঠাইয়া দিবেন, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সেই স্থান হইতে পদব্রজে আসামীগণকে পাঠাইয়া দিলে, তিন চারিদিবসের কম তাঁহারা সরে গিয়া উপস্থিত হইতে পারিবে না। বিশেষতঃ গোফুর খাঁর আর চলিবার ক্ষমতা নাই; তাহার উপর পয়ে বিপদের সম্ভাবনাও আছে।

কোর্ট-ইন্‌স্পক্টার সাহেব এইরূপ গোলযোগে পড়িয়া হোসেনকে তাকাইয়া পাঠাইলেন ও কহিলেন, আপনার মনিবদ্বয়ের অদৃষ্ট্রে যাহা ছিল, তাহা ঘটিয়াছে; কিন্তু যে পর্যন্ত তাহাদিগের জীবন শেষ না হয়, সে পর্যন্ত তাহাদিগকে কষ্ট দেওয়া কোনরূপেই কৰ্তব্য নহে। এখন, ইহাদিগকে অনেকদূর পর্যন্ত হাঁটিয়া যাইতে হইবে; কিন্তু আমি দেখিতেছি যে, হটিবার শক্তি ওসমানের থাকিলেও থাকিতে পারে, কিন্তু গোফুর খাঁর সে শক্তি নাই। আর উঁহাদিগকে কোন যানে আরোহণ করাইয়া লইয়া যাইবার খরচার ব্যবস্থাও সরকার হইতে নাই। এরূপ অবস্থায় যদি আপনি কিছু অর্থ প্রদান করেন, তাহা হইলে যাহাতে উঁহারা কষ্ট না পান, কোনরূপে আমি সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া উহা দিগকে এই স্থান হইতে পাঠাইতে পারি।

হোসেন। আমাকে কিরূপ অর্থ সাহায্য করিতে হইবে?

ইনস্পেক্টার। অধিক অর্থের সাহায্য করিতে হইবে না। ইহারা দুইজন, এবং ইহাদিগের সহিত যে কয়জন প্রহরী গমন করিবে, তাহাদিগকে সদর পর্যন্ত লইয়া যাইতে হইলে গাড়ি প্রভৃতির যাহা কিছু খরচ পড়িবে, তাহাই কেবল তোমাকে দিতে হইবে।

হোসেন। তাহা আমি দিতে সম্মত আছি, যদি আমাকেও উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে দেন।

ইনস্পেক্টার। আপনিও উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে পারেন। কিন্তু একত্র নহে। উঁহারা যে গাড়িতে গমন করি বেন, আপনি সেই গাড়িতে গমন করিতে পারিবেন না। অপর গাড়ি লইয়া উঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলে, কেহ আপত্তি করিবে না। কিন্তু কেন আপনি উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে চাহেন?

হোসেন। আমি যে কয়দিবস উঁহাদিগের সহিত থাকিতে পারিব, সেই কয়দিবস যাহাতে উঁহাদিগের কোনরূপ আহারাদিন কষ্ট না হয়, তাহা আমি দেখিতে পারিব তথ্যতীত যখন উভয়েই ফঁসি খাইতেছেন, তখন ইহাদিগের এই অগাধ জমিদারীর কিরূপ বন্দোবস্ত করিব, বা তাঁহারা ইহা কাহাকে প্রদান করিয়া যাইবেন, এবং পরিবারবর্গেরই বা কিরূপ বন্দোবস্ত হইতে পারে, প্রভৃতি আবশ্যক বিষয় সকল সম্বন্ধে যতদূর সম্ভব, তাহাদিগের নিকট হইতে জানিয়া বা লিখাইয়া লইব।

ইনস্পেক্টার। আপনি উঁহাদিগের সহিত এখন গমন করিতে পারেন, আর তাহাদিগের আহারাদি সম্বন্ধীয় বন্দোবস্ত করিতেও কিছুমাত্র নিষেধ নাই। কিন্তু বিষয়-আদি-সম্বন্ধীয় বন্দোবস্ত করিবার সময় এখন নহে। জেলায় গমন করিবার পর জেলের মধ্যে উঁহারা যে কয়দিবস পাকিবেন, তাহার মধ্যে জেল কর্ম্মচারীর সম্মুখে সে সমস্ত বন্দোবস্ত আপনারা করিয়া লইতে পারিবেন।

হোসেন। জেলায় গমন করিতে উঁহাদিগের কয়দিবস লাগিবে?

ইনস্পেক্টার। তাহা আমি এখন বলিতে পারিতেছি না। ইহাদিগের সহিত যে সকল প্রহরী গমন করিবে, তাঁহারা যে কয়দিবসে সুবিধা বিবেচনা করিবে, সেই কয়দিবসে তাঁহারা উঁহাদিগকে লইয়া যাইবে।

হোসেন। মহাশয়! আর একটা কথা। রাত্রিকালে উহার যে যে স্থানে অবস্থিতি করিবে, সেই সেই স্থানে রাত্রিযাপন উপযোগী কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে হইবে কি?

ইনস্পেক্টার। না, রাত্রিযাপন সম্বন্ধে কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়াজন নাই। কারণ, থানা ভিন্ন অপর কোন স্থানে উঁহারা রাত্রিযাপন করিবেন না। সমস্ত দিবস গমন করিয়া সন্ধ্যার পূর্বে যে থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারিবেন, সেই থানাতেই রাত্রিযাপন করিবেন, ও পরদিন প্রত্যুষে সেই থানা হইতে প্রস্থান করিবেন। এইরূপে গমন করিয়া যে কয়দিবসে সম্ভব, সদরে গিয়া উপস্থিত হইবেন।

কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের সহিত এই সকল কথাবার্তা হইবার পর, তাহাদিগকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কিছু ব্যয় হইবে, তাহার সমস্ত ভার হোসেন গ্রহণ করিলেন। সেই দিবস অপরাহ হইয়া আসিয়াছিল বলিয়া, ইনস্পেক্টার সবিশেষরূপ পাহারার বন্দোবস্ত করিয়া আসামীদ্বয়কে সেই স্থানেই রাখিয়া দিলেন। আর ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, পরদিবস অতি প্রত্যুষে আসামী দ্বয়কে সেই স্থান হইতে পাঠাইয়া দিবেন। আসামীদ্বয় এবং প্রহরীগণকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কয়েকখানি, একার প্রয়োজন হইল, তাহাও সেই রাত্রিতে বন্দোবস্ত করিয়া রাখা হইল। হোসেন এবং তাহার দুইজনমাত্র ভৃত্যও সেই সঙ্গে গমন করিতে প্রস্তুত হইল। তাঁহারাও নিজের গমনোপোযোগী একা বন্দোবস্ত করিয়া রাখিলেন।

পরদিবস অতি প্রত্যুষে প্রহরীগণ আসামীদ্বয়কে লইয়া একারােহণে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন। হোসেনও তাঁহার অনুচরদ্বয়ের সহিত অপর এক্কায় আরোহণ করিয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। প্রহরী গণের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্ব প্রধান ছিল, সেই স্থান হইতে বহির্গত হইবার পূর্বে কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেব তাহাকে হোসেনের সহিত পরিচয় করিয়া দিয়াছিলেন ও বলিয়া দিয়াছিলেন, হোসেন তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিবে। যে স্থানে যে কোন খরচের প্রয়োজন হইবে, তাহা হোসেনই দিবেন। আসামীদ্বয়কে আহারাদি করাইবার নিমিত্ত যে কোন সাহায্যের প্রয়োজন হইবে, হোসেন তৎক্ষণাৎ সেই সকল সাহায্য করিবেন। একা প্রভৃতির যখন যেরূপ ভাড়া লাগিবে, হোসেনকে বলিলে তৎক্ষণাৎ তিনি তাহা প্রদান করিবেন।

কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের আদেশ পাইয়া, প্রহরী আর কোন কথা কহিল না। কারণ, সে উত্তমরূপে অবগত ছিল যে, যদি হোসেন বা অপর কোন ব্যক্তি এক্কা প্রভৃতির ভাড়া প্রদান না করে, তাহা হইলে যে কয়দিবসে হউক, তত পথ তাহা দিগকে পদব্রজে গমন করিতে হইবে।

প্রহরী-সর্দারের মনে মনে একটু দুরভিসন্ধি ছিল। কোর্ট ইনস্পেক্টারের সম্মুখে কিন্তু সে তাহা প্রকাশ করিল না। তখন তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া আসামীদ্বয় ও হোসেনের সমভিব্যাহারে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইল।

কিয়দ্দূর গমন করিবার পর, পথের এক স্থানে একটা জলাশয় দৃষ্টিগোচর হইল। প্রহরী-সর্দ্দার সেই স্থানে একা থামাইতে আদেশ প্রদান করিলেন। আদেশ প্রতিপালিত হইল। একা হইতে অবতরণ করিয়া সকলে সেই স্থানে একটু বিশ্রাম করি লেন, এবং প্রহরীগণ একে একে আপনাপন হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করিয়া লইলেন। তাঁহাদিগের সকলের হস্তমুখাদি প্ৰক্ষালিত হইলে, প্রহরী-সর্দ্দার হোসেনকে কহিলেন, মহাশয়! আসামী স্বয়কে লইয়া সদরে উপস্থিত হইতে এক্কা-ভাড়া প্রভৃতি যে সকল খরচ পড়িরে, তাহা আমাদিগকে মিটাইয়া দিন।

হোসেন। একা-ভাড়া প্রভৃতির জন্য আপনার ব্যস্ত হইবার কোন প্রয়োজন নাই। যখন আমি আপনাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতেছি, তখন সমস্তই আমি প্রদান করিব।

সর্দ্দার-প্রহরী। আপনি যে উহা প্রদান করিবেন, তাহা কোর্ট ইনস্পেক্টার সাহেব বলিয়াই দিয়াছেন; কিন্তু বারে বারে আপনার নিকট চাহিয়া লওয়া অপেক্ষা একবারেই উহা আমাদিগকে প্রদান করা উচিত নহে কি?

হোসেন। যখন আমাকে দিতে হইবে, তখন আপনি একবারেই লউন, বা বারে বারেই লউন, তাহাতে আমার কিছুমাত্র ক্ষতি নাই।

সঃ প্রহরী। তাহা হইলে উহা আমাকে অগ্ৰেই প্রদান করুন।

হোসেন। কত খরচ পড়িবে, তাহা আমি এখন পর্যন্ত জানিতে পারিতেছি না; সুতরাং অগ্রে আমি আপনাকে উহা কি প্রকারে প্রদান করিতে পারি? আপনাদিগের সহিত যে সকল একা আছে, উঁহারা কি একবারে সদর পর্যন্ত গমন করিতে পারিবে?

সঃ প্রহরী। উঁহারা এতদূর কিরূপে গমন করিবে? এক এক থানায় গমন করিবার পর উঁহাদিগকে ছাড়িয়া দিব ও সেই স্থান হইতে অন্য এক্কা গ্রহণ করিব।

হোসেন। তাহা হইলে আপনাদিগকে কত টাকা গাড়িভাড়া দিতে হইবে, তাহা আমি এখন কিরূপে জানিতে পারিব? যেমন যে একা ছাড়িয়া দিবেন, অমনি তাহার ভাড়া মিটাইয়া দিলে চলিবে না?

সঃ প্রহরী। তাহা কিরূপে হইবে? সে সময় যদি আপনি উপস্থিত না থাকেন, তাহা হইলে কিরূপে ভাড়া প্রদান করিবেন?

হোসেন। আমি ত আপনাদিগের সহিত উপস্থিত আছি। যখন যাহা বলিবেন, তখনই তাহা প্রদান করিব।

সর্দ্দার-প্রহরী। এখন ত উপস্থিত আছেন দেখিতেছি; কিন্তু রাস্তা হইতে যদি আপনি চলিয়া যান, তাহা হইলে তখন আমি কি করিব? ও সকল গোলযোগেরই এখন প্রয়োজন নাই। আমার নিকট কিছু অর্থ আপনি প্রদান করুন, তাহা হইতে আমি ভাড়া প্রদান করিব। খরচ-পত্র বাদে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা পরিশেষে আমি আপনাকে ফিরাইয়া দিব।

হোসেন। আচ্ছা মহাশয়, তাহাই হউক। যদি আপনারা আমাকে অবিশ্বাস করেন, তাহা হইলে এই কুড়িটী টাকা আপনার নিকট রাখিয়া দিন।

সঃ প্রহরী। আমি আপনার নিকট ভিক্ষা করিতে বসি নাই! এখন যদি আপনি পঞ্চাশ টাকা প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি উহা গ্রহণ করিব; নতুবা আমি আসামীদ্বয়কে হাঁটাইয়া লইয়া যাইব।

হোসেন। হাঁটাইয়া লইয়া যাইবার প্রয়োজন নাই। আমি পঞ্চাশ টাকাই আপনাকে প্রদান করিতেছি, তাহা হইতে আপাততঃ যে সকল খরচ-পত্রের প্রয়োজন হয়, আপনি করুন। পরে যদি আরও কিছু আবশ্যক হয়, তাহাও আমি প্রদান করিব।

এই বলিয়া হোসেন পঞ্চাশটী টাকা বাহির করিয়া সেই সর্দ্দার প্রহরীর হস্তে প্রদান করিলেন। তিনি উহা গ্রহণ করিয়া আপনার নিকট রাখিয়া দিলেন, ও অপর প্রহরীগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, চল ভাই! আর দেরী করিবার প্রয়োজন নাই।

সর্দ্দার-প্রহরীর এই কথা শুনিয়া হোসেন কহিলেন, মহাশয়। আপনারা হস্ত মুখ প্রক্ষালনাদি সকল কার্য শেষ করিয়া লইলেন; কিন্তু ইহারা হস্ত মুখাদি ধুইবে কি না, তাহা ত কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন।

সর্দ্দার-প্রহরী। সে কথা জিজ্ঞাসা করিবার আমাদিগের কোন প্রয়োজন নাই। কোন বিষয়ের আবশ্যক হইলে ইহারা আপনারাই আমাদিগকে বলিবেন। তখন বিবেচনা করিয়া দেখা যাইবে যে, উঁহাদিগের প্রার্থনা শ্রবণ-যোগ্য কি না।

হোসেন। আপনারা যদি কোন কথা তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা না করেন, তাহা হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি।

সঃ প্রহরী। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার তোমার কোন অধিকার নাই। হত্যাপরাধে যাহাদিগের প্রাদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, তাহাদিগের সহিত কথা কহিয়া, তুমি আমাদিগের চাকরী লইতে চাও?

হোসেন। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিলে, আপনাদিগের চাকরী যাইবে কি প্রকারে, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না।

সঃ প্রহরী। চাকরী যাউক, আর না যাউক, উঁহাদিগের সহিত আমি কোনরূপে তোমাকে কথা কহিতে দিব না।

হোসেন। আপনার অনভিমতেই আমি কথা কহিব কেন? কিন্তু আমি ইহাদিগকে যদি কোন কথাই বলি, তাহা মন্দ কথা নহে। তাহাতে আপনাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই।

সঃ প্রহরী। আমাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হউক, বা না হউক, তাহা দেখিবার তোমার কিছুমাত্র আবক নাই। মূল কথা, তুমি উঁহাদিগের সহিত কোন কথা কহিতে পারিবে না।

হোসেন। যদি আমি ইহাদিগের সহিত কোন কথা কহিতেই না পারিব, তাহা হইলে আপনাদিগের সহিত আমার আসিবার কি প্রয়োজন ছিল?

সর্দ্দার-প্রহরী। প্রয়োজন ত আমি কিছুই দেখি না। না আসিলেই পারিতে।

হোসেন। আমি না আসিলে, আপনাদিগকে কে গাড়ির ভাড়া প্রদান করিত?

সঃ প্রহরী। গাড়ি ভাড়া কিছু আমাদিগের উপকারের নিমিত্ত দেও নাই। তোমারই মনিবদ্বয় হাঁটিয়া যাইতে অপারক, তাই তাঁহাদিগের নিমিত্ত গাড়ির ভাড়া প্রদান করিয়াছ। গাড়ি ভাড়া প্রদান না করিলে, আমরা অনায়াসেই উঁহাদিগকে আঁটাইয়া লইয়া যাইতে পারিতাম।

হোসেন। বলি, জমাদার সাহেব! ও সকল কথা থাক, এখন আপনাদিগের মনের কথা কি বলুন দেখি। আপনারা যাহা বলিবেন, আমি তাহাতেই প্রস্তুত আছি।

সঃ প্রহরী। খুনী আসামীর সহিত কথা কহিতে দেওয়া যে কতদুর ঝুঁকির কাৰ্য, তাহা ত আপনারা জানেন না। যদি আমাদের কোনরূপ সাধ্য না থাকে, তাহা হইলে আমরা সেই ঝুকি কেন গ্রহণ করিব? আপনি বুদ্ধিমান, আপনাকে অধিক আর কি বলিব?

হোসেন। আমাকে আর বলিতে হইবে না, এ কথা আমাকে পূর্বে বলিলেই পারিতেন। আপনারা কিছু প্রার্থনা করেন, বুঝিয়াছি। বলুন, এখন আমাকে কি দিতে হইবে।

সঃ প্রহরী। আপনি বড় মানুষ, আপনাকে আমরা আর কি বলিব? আপনি আপনার বিবেচনামত কাৰ্য্য করিলেই চলিবে।

হোসেন। এখন আর আমার বুদ্ধি-মুদ্ধি কিছুই নাই, ভাল মন্দ বুঝিবার ক্ষমতা এখন দুর হইয়া গিয়াছে। এই সামান্য কাৰ্য্যের নিমিত্ত আমাকে কয়টা টাকা দিতে হইবে, তাহা স্পষ্ট করিয়া আমাকে বলুন। আমার সাধ্য হয়, আমি প্রদান করি। আর আমার ক্ষমতার অতীত হয়, তাহা হইলে এই স্থান হইতেই আমি ধীরে ধীরে প্রস্থান করি।

সর্দ্দারপ্রহরী। আপনাকে কিছু অধিক প্রদান করিতে হইবে। আমরা পাঁচজন বই আর নয়। আমাকে কুড়ি টাকা ও অপর চারিজনকে দশ টাকা করিয়া চল্লিশ টাকা প্রদান করিলেই হইবে। আপনার পক্ষে ইহা অতি সামান্য টাকা, কেবল ষাট টাকা বৈত নয়!

হোসেন। আপনার পক্ষে ইহা অতি সামান্য টাকা; কিন্তু আমার পক্ষে ইহা খুব অধিক হইতেছে। আমি অত টাকা দিতে পারি না। আমি আপনাদিগের সম্মান রক্ষার নিমিত্ত ত্রিশ টাকা প্রদান করিতেছি।

সঃ প্রহরী। এ কাৰ্য ত্রিশ টাকায় হইতে পারে না। আপনার ইচ্ছা হয়, ষাট টাকা দিন, ইচ্ছা না হয়, এক টাকা দিবারও প্রয়োজন নাই। আমি অধিক করিয়া বলি নাই, আমি যেরূপ:এক কথার লোক, সেইরূপ এক কথাই বলিয়াছি।

হোসেন। আচ্ছা মহাশয়! আমি ষাট টাকাই প্রদান করিতেছি। ইহার পর আমাকে ত আর কিছু প্রদান করিতে হইবে না?

সঃ প্রহরী। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার নিমিত্ত আপ নাকে আর কিছু প্রদান করিতে হইবে না। কিন্তু আমাদিগের কাহারও সম্মুখে ব্যতীত নির্জনে আপনি উঁহাদিগের সহিত কোন রূপ কথা বলিতে পারিবেন না।

এইরূপ কথাবার্তার পর হোসেন ষাট টাকা প্রদান করিয়া তাঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার আদেশ পাইলেন। কিন্তু সেই সময় সবিশেষ কোনরূপ কথা কহিবার অবকাশ পাইলেন না। তাহাদিগকে তৎক্ষণাৎ এক্কার উপর আরোহণ করিতে হইল। হোসেনও আপন একায় গিয়া আরোহণ করিলেন। এক্কায় আরোহণ করিবার সময় হোসেন কেবলমাত্র তাহাদিগকে কহিলেন, জজসাহেব আপনাদিগের প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করিয়াছেন বলিয়া যে, আপনাদিগের প্রাণদণ্ড হইবেই, তাহা আপনারা মনে করিবেন না। আপনার উপার্জিত বিষয়ের এক পয়সামাত্র অবশিষ্ট থাকিতে, কোনরূপেই আমি আপনাদিগের প্রাণদণ্ড হইতে দিব না। টাকাব যথেষ্ট সংগ্রহ করিয়া আমি সঙ্গেই রাখিয়াছি। হাইকোর্ট হইতে যেরূপ উপায়ে হউক, এই হুকুম রদ করাইবু। ঈশ্বর যদি একান্তই বিমুখ হন, হাইকোর্ট হইতে যদি কিছু করিয়া উঠিতে না পারি, তাহা হইলে ছোট লাটকে ধরিয়া হউক, বড় লাটকে ধরিয়া হউক, বিলাত পর্যন্ত গড়িয়া হউক, কোন না কোনরূপে আপনাদিগকে অব্যাহতি প্রদান করাইব।

হোসেনের কথা শুনিয়া গোফুর ও ওসমান কেবল এইমাত্র কহিলেন, দেখুন, ভরসার মধ্যে ঈশ্বর?

ইহার পরেই এক্কা সকল সেই স্থান হইতে চলিল। একা, চালক অশ্বগণকে সবলে কষাঘাত করিতে লাগিল। প্রহারের ভয়ে অশ্বগণ দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিল। দুই ঘণ্টার পথ একঘণ্টায় চলিতে লাগিল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, এক্কা সকল একটী সরাইয়ের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলে, আসামীদ্বয়ের সহিত প্রহরীগণ সেই স্থানে অবতরণ করিয়া সেই সরাইয়ের ভিতর প্রবেশ করিল। সেই স্থানে কোন দ্রব্যেরই অভাব ছিল না। সরাইয়ের মধ্যেই শীতল জল-পূর্ণ একটা প্রকাণ্ড ইদারা। সরাইয়ের মধ্যস্থিত একখানি ঘরের মধ্যেই বেনিয়ার দোকান; উহাতে আটা, চাউল, ধৃত ও তরকারি প্রভৃতি আবশ্যক আহারীয় দ্রব্য এবং হড়ী, কাষ্ট, কঁচা সালপাতা প্রভৃতি সমস্তই পাওয়া যায়। প্রহরীগণ সরাইয়ের ভিতর প্রবেশ করিয়াই তাহার মধ্যে যে সকল সারি সারি ঘর ছিল, তাহার একখানির মধ্যে আসামীদ্বয়কে রাখিয়া দিল। সেই ঘরের কেবলমাত্র একটী দরজা ভিন্ন অপর জানালা দরজা আর কিছুই ছিল না; সুতরাং সেই ঘরকে একরূপ হাজত-গৃহ বলিলেও চলে। সেই ঘরের সম্মুখে দৌড় বারান্দার উপর সারি সারি পাচ খানি চারিপায়া আসিয়া পড়িল। প্রহরীগণ সেই স্থানে আপনাপন পোষাক পরিচ্ছদাদি রাখিয়া, সেই চারিপায়ার উপর উপবেশন করিল; কেহ বা লম্বা হইয়া শয়ন করিল। প্রহরীগণকে শয়ন করিতে দেখিয়া, দুই জন নাপিত (নাউ) আসিয়া তাহাদিগের পদসেবায় প্রবৃত্ত হইল, এবং দুইজন বারকনিতা আসিয়া সেই স্থানে দণ্ডায়মান হইল। উঁহারা এইরূপ সমাগত পথিকগণের সেবা-সুশ্রুষা করিয়া আপনাপন উদরান্নের সংস্থান করিয়া থাকে। নাপিতগণের থাকিবার স্থান সেই সরাইয়ের ভিতর না থাকিলেও, দিনরাত্রি তাঁহারা সকলেই প্রায় সেই স্থানে অবস্থিতি করে; কিন্তু বার-বনিতাগণ সেই সরাইয়ের ভিতরেই একটা একটা ঘর লইয়া, তাহাতেই অবস্থিতি করিয়া থাকে।

আসামীদ্বয়ের সহিত প্রহরীগণ যেস্থানে অবস্থান করিল, তাহার পার্শ্ববর্তী অপর আর একটা কামরাতে হোসেন এবং তাহার ভৃত্যদ্বয় স্থান করিয়া লইলেন।

হোসেন একজন প্রহরীকে কহিলেন, আসামীদ্বয়কে যদি দুইখানি চারিপায়া আনাইয়া দেওয়া হয়, তাহাতে আপনাদিগের কোনরূপ আপত্তি আছে কি?

প্রহরী। আসামী! তাহাতে খুনী মোকদ্দমার আসামী। তাঁহারা চারিপায়ার উপর উপবেশন বা শয়ন করিবে! একথা ইতিপূর্বে আমরা আর কাহারও নিকট শ্রবণ করি নাই, দর্শন করা ত দূরের কথা!

হোসেন। আসামীদ্বয়কে চারিপায়ার উপর বসিতে দিবার নিয়ম নাই বলিতেছেন; কিন্তু যদি চারিপায়া দেওয়া যায়, তাহাতে কোনরূপ ক্ষতি আছে কি?

প্রহরী। ক্ষতি থাক বা না থাক, যদি ইহাদিগকে চারি পায়া দেওয়া যায়, তাহার ভাড়া কে দিবে?

হোসেন। চারিপায়ার ভাড়া যাহা লাগিবে, তাহা আমি দিব।

প্রহরী। আর আমাদিগকে?

হোসেন। ইহার নিমিত্ত আপনাদিগকে কিছু দিতে হইবে কি?

প্রহরী। না দিলে চারিপায়া দিতে দিব কেন?

হোসেন। আচ্ছা তাহাই হইবে। এই অনুগ্রহের নিমিত্ত আমি আপনাদিগকে একটা টাকা প্রদান করিতেছি।

প্রহরী। এক টাকায় হইবে না, যদি আমাদিগের প্রত্যেক কেই একটী করিয়া টাকা দেন, তাহা হইলে উঁহাদিগকে চারি পায়ার উপর বসিতে অনুমতি দিতে পারি।

হোসেন। আচ্ছা, তাহাই দিতেছি।

গোফুর। হোসেন! তুমি এরূপ ভাবে অনর্থক অর্থ ব্যয় করিতেছ কেন?

হোসেন। এ ব্যয় অনর্থক নহে। বলুন দেখি, ইতিপূর্বে আর কখনও আপনার মৃত্তিকায় বসিয়াছেন কি?

গোফুর। এখন আর আমি সেই জমিদার গোফুর খাঁ নহি যে, চারিপায় ভিন্ন বসিতে পারি না।

হোসেন। আপনি এখনও সেই গোফুর খাঁ আছেন, ইহা বেশ জানিবেন।

গোফুর। তাহা হইলে আমাদিগকে এই মিথ্যা মোকদ্দমায় আর ফাঁসি যাইতে হইত না।

হোসেন। আপনি ভাবিবেন না। উপরে কি ভগবান নাই? আপনাদিগকে কখনই ফাঁসি যাইতে হইবে না। আপনার মনকে স্থির করুন, দেখুন, আপনাদিগকে বাঁচাইয়া লইয়া যাইতে পারি কি না। দুই তিন দিবস আপনাদিগের স্নান হয় নাই, আজ স্নান করিবেন কি?

গোঁফুর। আর স্নান করিয়াই বা কি হইবে?

হোসেন। স্নান করিয়া অনেক ফল হইবে। স্নান করিলে শরীরের অনেক গ্লানি দূর হইবে, মস্তিষ্ক শীতল হইবে, তখন একমনে ঈশ্বরকে ডাকিতে সমর্থ হইবেন। এক মনে ঈশ্বরকে ডাকিতে পারিলে কোন বিপদ হয় কি?

গোফুর। প্রহরীরা আমাদিগকে স্নান করিতে দিবে কি?

হোসেন। সে ভার আমার উপর। মেরূপে হয়, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিয়া লইতেছি। কেমন গো প্রহরীসাহেব। আপনা দিগের আসামীদ্বয় যদি স্নান করেন, তাহাতে আপনাদিগের, বোধ হয়, কোনরূপ আপত্তি নাই।

প্রহরী। আসামীদ্বয় স্নান করিবে! তাহা কি কখনও হইতে পারে?

হোসেন। কেন হইতে পারিবে না? এখানে আর কে তাহা দেখিতে পাইবে বা কেই বা তাহা শুনিতে পাইবে? ইহার জন্য আপনাদিগের প্রত্যেককে আট আনা এবং স্নানের পরে কিছু জল খাইরার নিমিত্ত, আট আনা করিয়া আমি প্রদান করিতেছি। ইহাতে, এখন বোধ হয়, আপনাদিগের আর কোনরূপ আপত্তি হইবে না।

প্রহরী। কোথায় স্নান করিবে? ইদারার নিকট ইহাদিগকে লইয়া যাইতে দিব না। কারণ, কি জানি যদি ইহার ইদারার ভিতর আত্ম-বিসর্জন করে, তাহা হইলে আমাদিগকে কয়েদ হইতে হইবে।

হোসেন। না, ইহাদিগকে ইদারার নিকট লইয়া যাইব না। যে স্থানে বলিবেন, সেই স্থানে বসিয়াই উঁহারা গান করিবেন।

প্রহরী। জল কোথায় পাইকেন, বা কে আনিয়া দিবে?

হোসেন। আমার সহিত দুইজন পরিচালক রহিয়াছে, এবং আমি নিজে আছি। তদ্ব্যতীত দুই চারি পয়সা দিলেই জল আনিয়া দেওয়ার লোকও পাওয়া যায়। এরূপ অবস্থায় যেস্থানে বলিবেন, সেই স্থানে জল আনাইয়া দিয়া, উঁহাদিগকে স্নান করাইয়া দিব।

প্রহরী। আর আমাদিগকে যাহা দিতে চাহিলেন, তাহা কখন দিবেন?

তাহা আমি এখনই দিতেছি, হোসেন এই বলিয়া চারিপায়া পাইবার, স্নান করিবার এবং কিছু জল খাবার খাইতে পাইবার অনুমতির নিমিত্ত প্রহরীর হস্তে দশ টাকা প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য, ইহার পর উক্ত কয়েকটা বিষয়ের নিমিত্ত প্রহরীগণ আর কোনরূপ আপত্তি করিল না। ভৃত্যগণ ইদারা হইতে জল উঠাইয়া আনিয়া প্রহরীগণের সম্মুখে তাহাদিগকে স্নান করাইয়া দিল। স্নান করিবার পর হোসেন কিছু জল খাবার আনাইলেন; কিন্তু প্রহরীগণ সে জল খাবার উঁহাদিগকে খাইতে না দিয়া কহিল, ইহার ভিতর আপনারা কোনরূপ বিষ প্রদান করিয়াছেন কি না, আমরা তাহা জানি না। সুতরাং আপনাদিগের আনীত জল খাবার ইহাদিগকে কখনই আহার করিতে দিব না। যাহা আনিতে হইবে, তাহা আমাদিগকে বলিয়া দিন এবং তাহার মূল্য আমাদিগকে প্রদান করুন। আমরা নিজে তাহা খরিদ করিয়া আনিয়া, আসামীদ্বয়কে প্রদান করিব।

প্রহরীগণের প্রস্তাবে হোসেন সম্মত হইলেন, এবং জল খাবার আনিবার নিমিত্ত, উঁহাদিগের একজনের হস্তে একটী টাকা প্রদান করিলেন। তাহাতে যে কিছু আহারীয় দ্রব্য আনিয়া আসামীদ্বয়কে প্রদান করা হইল, আসামীদ্বয় তাহা হইতে অতি অল্পই আহার করিলেন। অবশিষ্ট আহারীয় ও পূর্ব-আনীত আহারয় সমুদায়ই প্রহরীদিগের হইল। সেই সকল দ্রব্য আহার করিবার সময়, বিষের কথা আর প্রহরীদিগের মনে উদিত হইল না।

আমি পূর্বেই বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি যে, যে পাঁচজন প্রহরী আসামীদ্বয়কে লইয়া যাইতেছিল, তাঁহারা সকলেই মুসলমান।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

প্রহরীগণ যেরূপ ভাবে সেই সরাইতে বিশ্রাম করিতে লাগিল, তাহাতে তাঁহারা যে শীঘ্র সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবে, এরূপ অনুমান হইল না। একা-চালকগণ তাহাদিগের একার ঘোড়া একা হইতে খুলিয়া দিয়া ঘাস-দানার বন্দোবস্ত করিতে লাগিল।

এই ব্যাপার দেখিয়া হোসেন সেই সর্দ্দার-প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আজ কি আপনারা এই স্থানে অবস্থান করিবেন?

প্রহরী। রাত্রিযাপন আমরা এই স্থানে করিব না। এই স্থান হইতে দুই ক্রোশ ব্যবধানে একটা খানা আছে, রাত্রিকালে সেই স্থানেই অবস্থিতি করিতে হইবে।

হোসেন। এক-চালকগণ যেরূপ ভাবে একা চালাইয়া আসি তেছে, তাহাতে দুই ক্রোশ পথ গমন করিতে অতি অল্প সময়েরই প্রয়োজন হইবে।

প্রহরী। এই স্থান হইতে বাহির হইলে, একঘণ্টার মধ্যেই আমরা সেই থানায় গিয়া অনায়াসেই উপস্থিত হইতে পারি।

হোসেন। আপনারা এই স্থান হইতে কখন রওনা হইতে চাহেন?

প্রহরী। একটু বিশ্রাম করিবার পরই, আমরা এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব।

হোসেন। আপনাদিগের আহারাদির বন্দোবস্ত কোথায় হইবে?

প্রহরী। থানায় গিয়া উপস্থিত হইবার পর, সেই স্থানেই আহারাদি করিব, এরূপ বিবেচনা করিতেছি।

হোসেন। এই স্থানে দেখিতেছি, সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়। এই স্থান হইতে আহারাদি করিয়া, থানায় গমন করিলে হইত না কি?

প্রহরী। তাহা হইলে আমরা কখন থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারি?

হোসেন। আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিয়া যদি আমরা এই স্থান হইতে রওনা হই, তাহা হইলে সন্ধ্যার পূৰ্বেই দুই ক্রোশ পথ অনায়াসেই অতিক্রম করিতে পারি। সন্ধ্যার পূর্বেই যদি আপনারা আসামীর সহিত থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারেন, তাহা হইলে বোধ হয়, কোনরূপ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা নাই।

প্রহরী। ক্ষতি কিছুই নাই; কিন্তু এখানে থাকিয়া আমা দিগের লাভ কি?

হোসেন। লাভ আর কিছুই নহে, কেবল সময় মত আহার করিয়া লইতে পারিবেন।

প্রহরী। এখানে আহারাদি করিবার কি সুবিধা হইবে?

হোসেন। না হইবে কেন? এখানে দেখিতেছি, সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়।

প্রহরী। এখানে আহারাদি প্রস্তুত করার পক্ষে নিতান্ত অসুবিধা হইবে।

হোসেন। কিসে?

প্রহরী। মোটে আমরা পাঁচজন বই প্রহরী নই। আমরা সকলেই এখন পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি। ইহার মধ্যে আসামী দ্বয়কে পাহারাই বা কে দিবে, আহারাদির আয়োজনই বা কে করিবে?

হোসেন। আপনি যদি অনুমতি করেন, তাহা হইলে আমরাই সমস্ত আয়োজন করিয়া দিতে প্রস্তুত আছি।

প্রহরী। কে রন্ধন করিবে?

হোসেন। আমি আছি, আমার দুইজন পরিচারকও রহি আছে। অনুমতি পাইলে আহারীয় প্রস্তুত করিতে আর কত বিলম্ব হইবে?

প্রহরী। তোমাদিগের প্রস্তুত করা আহারীয় দ্রব্য আমরা কিরূপে আহার করিতে পারি?

হোসেন। কেন?

প্রহরী। আমি শুনিয়াছি, বহুদিবস হইল, এইরূপ একটী ঘটনা ঘটিয়াছিল। একজন কয়েদী-আসামীকে লইয়া দুইজন প্রহরী গমন করিতেছিল। যাইতে যাইতে পথে অপর আর একজন লোক আসিয়া তাহাদিগের সহিত মিলিত হয়। সেই ব্যক্তি সেই আসামীর দলস্থিত একজন; কিন্তু এ পরিচয় সে পূর্বে সেই প্রহরীদ্বয়ের নিকট প্রদান করে নাই। ক্রমে তাঁহারা এইরূপ একটী সরাইতে আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং সেই ব্যক্তিই সকলের আহারীয় প্রস্তুত করে। প্রথমে আসামীকে আহার করান হয়, কিন্তু তাহাতে তাহার কোনরূপ অসুখ হয় না। পরিশেষে প্রহরীদ্বয় আহার করিতে বসে, কিন্তু আহার করা শেষ হইতে না হইতেই উভয়েই হতজ্ঞান হইয়া পড়ে। পরে সরাইয়ের লোজন যখন জানিতে পারে যে, দুইজন প্রহরী অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে, তখন তাঁহারা সেই স্থানে গমন করে; কিন্তু সেই কয়েদী-আসামী এবং আহার-প্রস্তুতকারীকে আর তাঁহারা দেখিতে পায় না। এই সংবাদ ক্ৰমে থানায় গিয়া উপ স্থিত হয়। প্রহরীদ্বয়কে হাসপাতালে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। থানাদার নিজে আসিয়া এই ঘটনার সবিশেষ অনুসন্ধান করেন। কিন্তু অনুসন্ধানে কোন ফলই পাওয়া যায় না। উভয় ব্যক্তির মধ্যে কেহই ধৃত হয় না। অধিকন্তু প্রহরীগণ চৈতন্য লাভ করিলে জানিতে পারা যায় যে, তাহাদিগের নিকট যে সকল টাকা-পয়সা ছিল, তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে। ইহা যখন প্রকৃত ঘটনা বলিয়া সকলেই অবগত আছেন, তখন বলুন দেখি, আমরা কিরূপে আপনাদিগকে বিশ্বাস করিয়া আপনাদিগকে রন্ধন করিতে অনুমতি প্রদান করিতে পারি?

হোসেন। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। কিন্তু আপনারা আমাকে পূর্ব হইতে জানেন কি না, বলিতে পারি না। যদি আমাকে পূর্ব হইতে জানিতেন, তাহা হইলে আপ

আমাকে বোধ হয়, এতদূর অবিশ্বাস করিতে পারিতেন না। সে যাহা হউক, আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস করিতেই

পারেন, তাহা হইলে অপর আর কোনরূপ বন্দোবস্ত হইতে পারে না কি? অপর যেরূপ বন্দোবস্ত করিতে বলেন, আমরা সেইরূপ করিতেই প্রস্তুত আছি।

প্রহরী। আর কি বন্দোবস্ত হইতে পারে?

হোসেন। আমরা আর সমস্ত ঠিক করিয়া দিতেছি, আপনা দিগের এক ব্যক্তি অনায়াসেই পাক করিয়া লইতে পারেন।

প্রহরী। আমরা সকলেই অতিশয় ক্লান্ত। সুতরাং আমা দিগের মধ্যে কাহারও দ্বারা সেই কাৰ্য যে সম্পন্ন হইতে পারিবে, তাহা আমি বোধ করি না।

হোসেন। যদি এ কাৰ্য্য আপনাদিগের দ্বারা না হয়, তাহা হইলে আপনাদিগের মধ্যে একজন যদি রন্ধনশালার নিকট উপস্থিত থাকিতে পারেন, তাহা হইলে আমার সমভিব্যাহারী একজন লোকের দ্বারা আমি কাৰ্য্য করাইয়া লইতে পারি। আপনাদিগের সম্মুখে যদি আহারীয় প্রস্তুত হয়, তাহা হইলে আমরা উহাতে কিরূপে বিষ মিশ্রিত করিতে পারিব?

প্রহরী। অত গোলযোগে কায নাই। আমরা একরূপ জলযোগ করিয়াছি, এখন আর আহার করিবার ইচ্ছা নাই। সুতরাং আহারীয় প্রস্তুত করিবার আর প্রয়োজন কি? আপ নারা ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আহারাদি প্ৰস্তুত করিয়া অনায়াসেই আহার করিতে পারেন।

হোসেন। আমি আমাদিগের আহারের নিমিত্ত বলিতেছি না। আপনারা যে আসামীদ্বয়ের সহিত আসিয়াছেন, তাঁহাদিগের আজ কয়েকদিবস হইতে আহার হয় নাই; কোন দিন অনাহারে, কোন দিন জলাহারে, দিন অতিবাহিত করিয়া আসিতেছেন। ইহাদিগের অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা পরে হইবে; কিন্তু এখন আমাদিগের ইচ্ছ, উঁহাদিগকে কিছু আহার করাই। এই নিমিত্ত আপনাদিগকে এত অনুরোধ করিতেছি।

প্রহরী। উঁহারা ত এখনই আহার করিলেন?

হোসেন। বাজারের মিষ্ট দ্রব্যাদি ভোজন করিয়া কোন্ ব্যক্তি কয় দিবস জীবনধারণ করিতে পারে?

প্রহরী। যখন আপনারা আহারাদি প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত এতই ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, তখন আমার সম্মুখে আপনারা আমা দিগের সকলের আহারীয় প্রস্তুত করুন। আহারীয় প্রস্তুত করি বার সময় আমি অনায়াসেই বুঝিতে পারি যে, ইহাতে আপনা দিগের কোনরূপ দুরভিসন্ধি আছে কি না।

হোসেন। এ উত্তম কথা।

উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, হোসেন নিজের অর্থ ব্যয় করিয়া সকলের আহারাদির উদ্যোগ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

একজন প্রহরীর তত্ত্বাবধানে সময়মত আহারীয় দ্রব্য সকল প্রস্তুত হইল। তখন হোসেন কহিলেন, এখন আহারীয় প্রস্তুত হইয়াছে, অনুমতি হইলে সকলেই ভোজন করিয়া লইতে পারেন।

প্রহরী। সকলের ভোজন একবারে হইতে পারে না। প্রথমে তোমরা ভোজন কর, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।

হোসেন। আমরা অগ্রে ভোজন করিব কেন? আপনাদিগের আহারাদি হইয়া গেলে, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।

প্রহরী। তাহা হইতে পারিবে না। তোমরা অগ্রে ভোজন করিলে, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।

হোসেন। যদি আপনারা নিতান্তই অগ্রে ভোজন না করেন, তাহা হইলে সকলেই এক সময় ভোজন করা যাউক। আপনারা থাকিতে আমরা কিরূপে অগ্রে খাইতে পাক্সি?

প্রহরী। তাহাও হইতে পারে না।

হোসেন। কেন?

প্রহরী। তোমরা ভোজন করিলে, তাহার পর তোমাদিগের কিরূপ অবস্থা হয়, তাহা অগ্রে দেখিয়া, পরিশেষে আমরা ভোজন করিব।

হোসেন। আপনার এ কথার অর্থ ত আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।

প্রহরী। বুঝিতে না পারিয়া থাকেন, আমি বুঝাইয়া দিতেছি। আমাদিগের তত্ত্বাবধানে আপনারা আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত করিয়াছেন সত্য; কিন্তু আমাদিগের অলক্ষিতে আপনারা উহার সহিত অনায়াসেই বিষ মিশ্রিত করিয়া দিতে পারেন। প্রথমে আপনারা আহার করিলেই, আমরা জানিতে পারি যে, সেই সকল আহারীয় দ্রব্যের সহিত কোনরূপ বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত আছে কি না। আহারান্তে যদি আপনাদিগের কোনরূপ বৈলক্ষণ না ঘটে, তাহা হইলে আমরা সহজেই অনুমান করিতে পারিব যে, উহার সহিত কোনরূপ বিষাক্ত ব্য মিশ্রিত নাই। ইহার পর আর আপনাদিগকে আহারীয় দ্রব্যের নিকট গমন করিতে দিব না। আমরা নিজ হস্তে সেই সকল দ্রব্য পরিবেশন করিয়া আহার করিব।

হোসেন। আপনার এ কথায় আমাদিগের কোন উত্তর নাই। আমরা আহারীয় দ্রব্যর নিকট আর গমনই করিব না। আপনারা উহা হইতে কিছু কিছু আমাদিগকে প্রদান করুন, আমরা দূরে বসিয়া আহার করি। আমরা আপনাদিগের আদেশ প্রতিপালন করিব মাত্র। কিন্তু আপনাদিগকে এবং মনিবদ্বয়কে পরিত্যাগ করিয়া, পরিতুষ্টির সহিত কখনই আহার করিয়া উঠিতে পারিব না।

ইহার পর হোসেনের প্রস্তাব-মতই কাৰ্য্য হইল। হোসেন ও তাহার পরিচারকদ্বয় দূরে আহার করিতে বসিলেন; একজন প্রহরী তাহাদিগকে পরিবেশন করিলেন। প্রহরীগণ যখন দেখিল, হোসেন বা তাহার পরিচারকদ্বয় সেই সকল দ্রব্য আহার করিয়া সুস্থ শরীরে রহিলেন, তখন তাঁহারা তাহাদিগের নিজের আহারের উদ্যোগ করিতে লাগিল। কিন্তু আসামীদ্বয় আহার করিবে কি না, সে সম্বন্ধে কোন কথাই কহিল না। তখন হোসেন কহিলেন, আপনাদিগের আহারের উদ্যোগ হইতেছে; কিন্তু আসামীদ্বয় কখন আহার করিবেন?

প্রহরী। আসামীদ্বয়েরও কি আহারীয় প্রস্তুত করিয়াছেন?

হোসেন। উঁহারাই আহার করিবেন বলিয়া, সকলের নিমিত্ত আহারীয় আমরা প্রস্তুত করিয়াছি। নতুবা আমাদিগের আহারীয় প্রস্তুত করিবার কোনরূপ প্রয়োজনই ছিল না।

প্রহরী। উহার ফাঁসি যাইবার আসামী। উঁহাদিগকে আমরা কিরূপে আহার করিতে অনুমতি দিতে পারি?

হোসেন। যাহাদিগকে ফাঁসি দিবার হুকুম হয়, ফাঁসির পূর্বে যে কয় দিবস তাঁহারা বাঁচিয়া থাকে, সে কয় দিবস কি তাহাদিগকে আহার করিতে দেওয়া হয় না। যদি সরকারের এরূপ কোন নিয়ম থাকে, তাহা আমি অবগত নহি। বরং লোক-পরম্পরায় শুনিতে পাওয়া যায়, ফঁসি যাইবার পূর্বে ফাঁসির আসামী যাহা খাইতে চাহে, সরকার হইতে তাহাই তাহাকে খাইতে দেওয়া হয়। সে যাহা হউক, এত পরিশ্রম করিয়া যখন আমরা আহারীয় প্রস্তুত করিয়াছি, তখন উঁহাদিগকে কিছু আহার করিতে দিয়া আমাকে সবিশেষরূপ অনুগৃহীত করুন।

প্রহরী। উঁহারা আহার করুন, বা না করুন, তাহাতে আপনার ক্ষতি-বৃদ্ধি কি?

হোসেন। ক্ষতি নাই? খুব ক্ষতি আছে। যিনি আমার অন্নদাতা, তিনি আহার করিতে পাইবেন না, আর আমরা আহার করিয়া বসিয়া আছি! ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে? আমি আপনাদিগকে সবিশেষরূপ অনুবোধ করি তেছি, উঁহাদিগের আহার করিতে দিবার পক্ষে কোনরূপ প্রতি। বন্ধক হইবেন না। উঁহারা যেরূপ মনঃকষ্টে আছেন, তাহাতে যে আহার করিতে পারিবেন, সে ভরসা আমার নাই; তবে আহার করিতে বসিয়াছেন, ইহা দেখিলেই আমার মনটা একটু সন্তুষ্ট হইবে, এই মাত্র। এই অনুগ্রহের নিমিত্ত যদি আপনাদিগের আরও কিছু লইবার প্রত্যাশা থাকে, তাহাও আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারেন।

প্রহরী। যখন আপনি এরূপ ভাবে অনুরোধ করিতেছেন, তখন আপনার অনুবোধই বা রক্ষা না করি কি প্রকারে? তবে জানেন কি, আমরা পেটের দায়ে চাকুরী করিতে আসিয়াছি, তাই আপনাকে বলিতেছি।

হোসেন। ইহার জন্য এত গোলযোগ করিবার প্রয়োজন কি? আপনারা যখন যাহা চাহিতেছেন, আমি তখনই তাহা আপনা দিগকে প্রদান করিতেছি। প্রথমেই এ কথা আমাকে বলিতে পারিতেন! আপনাদিগের প্রস্তাবে যদি আমি সম্মত হইতে পারি তাম, তাহা হইলে উঁহাদিগের নিমিত্ত আহারীয় প্রস্তুত করিতাম, আর যদি সেই প্রস্তাব আমার সাধ্যাতীত হইত, তাহা হইলে আপনাদিগকে সেলাম করিয়া আমি ধীরে ধীরে প্রস্থান করিতাম। আচ্ছা, এখন বলুন দেখি, উঁহাদিগকে আহার করিবার অনুমতি দিবার নিমিত্ত আপনারা কি প্রার্থনা করেন?

প্রহরী। পঁচিশ টাকা।

হোসেন। আপনারা পাচজন আছেন, আপনাদিগের প্রত্যেক কেই পঁচিশ টাকা করিয়া আমাকে প্রদান করিতে হইবে?

প্রহরী। না, মোট পচিশ টাকা প্রদান করিলেই হইবে।

হোসেন। পঁচিশ টাকা আমি প্রদান করিতে পারিব না। আপনারা পাঁচজন আছেন, প্রত্যেককে দুই টাকা হিসাবে মোট আপনাদিগকে আমি দশ টাকা প্রদান করিতেছি। ইহাতে আপ নারা সম্মত হইয়া আসামীদ্বয়কে আহার করিবার নিমিত্ত অনুমতি প্রদান করেন ভালই, নতুবা আমি এ স্থান হইতে প্রস্থান করি তেছি, আপনাদিগের মনে যাহা উদয় হয়, তাহা করিবেন।

প্রহরী। আপনাকে আর প্রস্থান করিতে হইবে না। দশ টাকা নিতান্ত অল্প হইতেছে, আর পাঁচটী টাকা বাড়াইয়া দিন।

হোসেন। পাঁচ টাকা ত দূরের কথা, দশ টাকার উপর আমি আর পাঁচটা পয়সাও, বাড়াইয়া দিতে পারিব না। ইহাতে আপনা দিগের যাহা অভিরুচি হয়, তাহা করিতে পারেন।

প্রহরী। যে কাৰ্যে আপনারা অসন্তুষ্ট হন, সে কাৰ্য্য আমা দিগের কোনরূপেই কৰ্তব্য নহে। আচ্ছা, আপনার প্রস্তাবেই আমরা সম্মত হইলাম। টাকা দশটী কথন প্রদান করিবেন?

হোসেন। যখন আপনাদিগের আবশ্যক হইবে, তখনই আপনারা লইতে পারেন। এখনই চাহেন, তাহাও আমাকে বলুন, এখনই আমি উহা আপনাদিগের হস্তে প্রদান করিতেছি।

প্রহরী। সেই ভাল। আমি একাকী নহি, পাঁচজনের কাৰ্য্য, অগ্রে দেওয়াই ভাল।

প্রহরীর কথা শুনিয়া হোসেন আর কোন কথা কহিলেন, দশটী টাকা বাহির করিয়া তৎক্ষণাৎ সেই প্রহরীর হস্তে প্রদান করিলেন।

হোসেন টাকা প্রদান করিলেন সত্য; কিন্তু মনে মনে বড়ই অসন্তুষ্ট হইলেন। মনে করিলেন, এরূপ অত্যাচার করিয়া টাকা লওয়া নিতান্ত অন্যায়। আসামীর সহিত কথা কহিবার প্রয়োজন হইলে টাকা ভিন্ন হইতে পারিবে না! স্নানের নিমিত্ত টাকা, জলপানের নিমিত্ত টাকা, আহারের নিমিত্ত টাকা, এবং বিশ্রাম করিবার নিমিত্ত একখানি চারিপায়া প্রদান করিতে হইলেও টাকা! কি ভয়ানক অত্যাচার! এই সকল অত্যাচারের নিমিত্তই পুলিসের এত দুর্নাম।

হোসেন মনে মনে এইরূপ ভাবিতে লাগিলেন সত্য; কিন্তু প্রকাশ্যে কোন কথা কহিতে পারিলেন না।

গোফুর খাঁ ও ওসমান, প্রথমতঃ কিছুতেই আহার করিতে সম্মত হইলেন না। কিন্তু কোন প্রকারেই হোসেনের অনুরোধ লম্বন করতে না পারিয়া, আহার করিবার নিমিত্ত একবার বসিলেন মাত্র; ফলতঃ আহার করিতে পারিলেন না, চক্ষু-জলে আহারীয় ভাসিয়া যাইতে লাগিল।

আহারান্তে প্রহরীগণ আপনাপন চারিপায়ার উপর শয়ন করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিল। কেবল একজন মাত্র প্রহরী আসামীদ্বয়কে পাহারা দিতে লাগিল। আসামীদ্বয় সেই গৃহের ভিতর কয়েদী অবস্থায় বিষন্ন মনে বসিয়া রহিলেন।

এইরূপে প্রায় সমস্ত দিবস সেই স্থানে অতিবাহিত হইয়া গেল। সন্ধ্যা হইতে অতি অল্পমাত্র বাকী আছে, সেই সময় একজন প্রহরী এক্কা-চালকগণকে ডাকিল ও কহিল, বেলা প্রায় অবসন্ন হইয়া আসিয়াছে। এখনও অনেকদূর আমাদিগকে গমন করিতে হইবে, আর বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই। একা সকল শীঘ্র প্রস্তুত করিয়া আন, আমরা এখনই এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব।

প্রহরীর কথা শুনিয়া এক্কা-চালকগণ তখনই এ প্রস্তুত করিয়া আনিল। প্রহরীগণ আসামীদ্বয়ের সহিত উহাতে আরোহণ করিল, হোসেনও আপনার দুইজন পরিচারকের সহিত আপন একায় আরোহণ করিয়া তাহাদিগের এক্কার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। এক্কা-চালকগণ অখে কষাঘাত করিতে করিতে বেগে একা চালাইতে আরম্ভ করিল।

সন্ধ্যার অল্প পরেই সকলে একটী থানায় গিয়া উপস্থিত হইল। সেই স্থানে সকলে একা হইতে অবতরণ করিয়া থানার ভিতর প্রবেশ করিলেন। থানায় সেই সময় দারোগা উপস্থিত ছিলেন না, কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে তিনি স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। অনুসন্ধানে হোসেন জানিতে পারিলেন যে, সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী অর্থাৎ দারোগাও একজন মুসলমান বংশ-সম্ভূত।

যে সকল এক্কায় আরোহণ করিয়া আমাশয়, প্রহরীগণ ও হোসেন প্রভৃতি গমন করিয়াছিলেন, এখন সেই সকল এক বিদায় করিয়া দিবার প্রয়োজন হইল। কারণ, তাঁহারা অনেকদূর আগমন করায়, তাহাদিগের অশ্বগণ সবিশেষরূপ ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। তদ্ব্যতীত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় সেই স্থানে যতগুলি একার প্রয়োজন হইবে, ততগুলিই অনায়াসে পাওয়া যাইবে।

এইরূপ বন্দোবস্ত দেখিয়া, যে এক্কায় হোসেন তাহার ভৃত্য দ্বয়ের সহিত আগমন করিয়াছিলেন, তাহাকে ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন। সেই এক্কা-চালককে যে পরিমিত ভাড়া দিবার নিমিত্ত প্রহরীগণ বলিয়া দিল, হোসেন তাহাতে দ্বিরুক্তি না করিয়া তাহাই দিয়া দিলেন। একা-চালক আপনার ভাড়া পাইয়া থানার বাহিরে গিয়া উপবেশন করিল।

কেবলমাত্র একখানি এক্কার ভাড়া দিতে দেখিয়া একজন প্রহরী কহিল, আপনি কেবলমাত্র একখানি একার ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন দেখিতেছি। আর অপর এক্কা তিনখানি, যাহাতে আপনার মনিবদ্বয় এবং আমরা আসিয়াছি, তাহার ভাড়াও ওই সঙ্গে দিলেন না কেন?

হোসেন। আপনাদিগের একা-ভাড়া প্রভৃতি যাহা কিছু ব্যয় হইবে, তাহার নিমিত্ত আমি এককালীন আপনাদিগকে পঞ্চাশ টাকা প্রদান করিয়াছি। তাহা হইতে একা-ভাড়া প্রদান করিতে আপনাদিগের কোনরূপ আপত্তি আছে কি?

প্রহরী। আপত্তি আর কিছুই নাই, তবে এখন আপনি দিয়া দিলেও কোন ক্ষতি নাই।

হোসেন। আমি একবার প্রদান করিয়াছি। বলেন না হয়, আর একবার প্রদান করি। যখন আমরা সম্পূর্ণরূপে আপনাদিগের হাতে পড়িয়াছি, তখন যাহা বলিবেন, তাহাই করিতে হইবে।

প্রহরী। আপনি অসন্তুষ্ট হইবেন না। একা-ভাড়া এখন আপনি প্রদান করুন, বা আমরা প্রদান করি, তাহাতে কোনরূপ ক্ষতি নাই। কারণ, আমাদিগের নিকট আপনার যে পঞ্চাশ টাকা আছে, খরচ-পত্ৰ বাদে তাহা হইতে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা আপনারই। আর যদি উহাতে সমস্ত খরচের সঙ্কুলান না হয়, তাহা হইলে আর যাহা লাগিবে, তাহা আপনাকে দিতে হইবে। এরূপ অবস্থায় সামান্য একা-ভাড়ার নিমিত্ত এত গোলযোগ করিতেছেন কেন?

হোসেন। আমি কোনরূপ গোলযোগই করিতেছি না। যে টাকা আপনাদিগের নিকট আছে, তাহা হইতে এক্কা-ভাড়া প্রদান করিতে যদি আপনাদিগের কোনরূপ অসুবিধা হয়, তাহা হইলে এখনই আমি উহা প্রদান করিতেছি।

প্রহরী। অসুবিধা আর কিছুই নয়। তবে টাকাগুলি যেরূপ ভাবে বাঁধিয়া রাখা আছে, তাহা হইতে কিছু টাকা বাহির করিয়া লইতে হইলে অনেক সময়ের প্রয়োজন। তাই যাহাতে এক্কা ওয়ালাগণের আর বিলম্ব না হয়, সেই নিমিত্ত ভাড়াটা এখন আপ, নাকে দিতে বলিয়াছিলাম। ইহাতে আমাদিগের কোনরূপ দুরভিসন্ধি নাই।

হোসেন। সামান্য টাকার নিমিত্ত আর অধিক কথার প্রয়ো জন নাই। আমি এখন উহা প্রদান করিতেছি, যেরূপ ভাল বিবেচনা হয়, পরিশেষে আপনারা তাহা করিবেন।

এই বলিয়া হোসেন আর তিনখানি একার ভাড়াও আপনার নিকট হইতে উঁহাদিগকে দিয়া দিলেন।

আপনাপন ন্যায্য মজুরি বুঝিয়া লইয়া একাওয়ালাগণ সেই স্থান হইতে তখনই প্রস্থান করিল।

প্রহরীগণের ব্যবহার দেখিয়া হোসেন মনে মনে ভাবিলেন, উঁহাদিগের খরচের নিমিত্ত যে পঞ্চাশ টাকা দেওয়া হইয়াছে, তাহা পাইবার আর কোনরূপ উপায় নাই। অথচ আরও যাহা কিছু খরচ হইবে, তাহার সমস্তই তাঁহাকে বহন করিতে হইবে।

এই সময় গোফুর খাঁ হোসেনকে তাহার নিকট ডাকিলেন। হোসেন তাহার নিকট গমন করিলে তিনি কহিলেন, হোসেন। আমি দেখিতেছি, তুমি নিরর্থক অনেক অর্থ নষ্ট করিতেছ।

হোসেন। আপনাদিগের জীবন অপেক্ষা কি অর্থের মূল্য অধিক? যে আপনাদিগের নিমিত্ত আমি সেই অর্থ ব্যয় করিব না?

গোফুর। আমাদিগের জীবন রক্ষার নিমিত্ত অর্থ ব্যয় করিতে আমাদিগের কিছুমাত্র আপত্তি নাই। কিন্তু এইরূপ নিরর্থক অর্থ ব্যয় করিয়া কি আমাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারিবে?

হোসেন। এরূপ ভাবে অর্থ ব্যয় করিয়া, আপনাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারি না সত্য; কিন্তু আপাততঃ আপনাদিগের কষ্টের অনেক লাঘব করিতে সমর্থ হইব।

গোফুর। যাহাদিগের জীবনের আর কিছুমাত্র আশা নাই, দুই চারিদিবসের নিমিত্ত তাহাদিগের শারীরিক কষ্ট নিবারণ করিয়া ফল কি? মানসিক কষ্টের নিকট শারীরিক কষ্ট কিছুই নহে। যে ব্যক্তি সর্বদা মানসিক কষ্ট ভোগ করিতেছে, তাহার যতই কেন শারীরিক কষ্ট হউক না, তাহার দিকে তাহার লক্ষ্যই হয় না।

হোসেন। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। কিন্তু আমাদিগের সম্মুখে আপনি শারীরিক কষ্ট ভোগ করিবেন, অর্থ থাকিতে আমরা কিরূপে উহা দেখিতে সমর্থ হইব? আর আপনাদিগের জীবনের আশা নাই, এ কথাই বা আপনারা কিরূপে অনুমান করিলেন?

গোফুর। যাহার ফাঁসির হুকুম হইয়াছে, তাহার আর জীবনের আশা কি?

হোসেন। এখনও অনেক আশা আছে। যে বিচারালয় হইতে আপনাদিগের ফাঁসির হুকুম হইয়াছে, তাহার উপর বিচারালয় আছে। সেখানে আপীল করিব, যেরূপ ভাবে ও যত অর্থ ব্যয় করিয়া চেষ্টা করিতে হয়, তাহা করিব। ইহাতে কি কোনরূপ ফল প্রাপ্ত হইব না? ঈশ্বর না করুন, যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে ছোট লাটকে ধরিব; আবশ্যক হইলে বড় লাটের নিকট পর্যন্ত গমন করিব। পরিশেষে বিলাত পর্যন্ত চেষ্টা করিব। ইহাতেও কি সুবিচার হইবার সম্ভাবনা নাই? যদি ইহাতেও না পারি, তাহ হইলে অর্থ ব্যয় করিয়া, আপনাদিগের জীবনের নিমিত্ত অসৎ উপায় অবলম্বন করিতে ক্রটি করিব না। আপনি আপনার মনকে স্থির করিয়া রাখুন। দেখিবেন, যেরূপ উপায়েই হউক, কখনই আপনাদিগকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিতে দিব না।

গোফুর। তুমি যাহা মনে করিতেছ, তাহা সম্পূর্ণরূপ অসম্ভব। ইহা কখনই হইতে পারে না।

হোসেন। জগতে অসম্ভব কিছুই নাই; অর্থে না হইতে পারে, এরূপ কোন কাৰ্য্যই নাই। দেখিবেন, যাহা মুখে বলিতেছি, কাৰ্যে তাহা পরিণত করিতে পারি কি না!

গোফুর। আমার বিবেচনায় তুমি আর নিরর্থক অর্থ ব্যয় করিও না। আমাদিগের নিমিত্ত এইরূপ ভাবে যে অর্থ ব্যয় করিবে, তাহা আমাদিগের নামে দরিদ্র ব্যক্তিকে দান করিও। তাহা হইলে আমাদিগের পরকালের অনেক উপকার করা হইবে। ইহকালে যাহা হইবার, তাহা হইল।

হোসেন। গরিব-দুঃখীকে আপনারা যেরূপ ভাবে অর্থ দান করিতে কহিবেন, তাহা আমরা করিব। তদ্ব্যতীত আপনাদিগের জীবন-রক্ষা করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে চেষ্টা করিতে ক্রটি করিব না। বিশেষ–

গোফুর। বিশেষ কি?

হোসেন। এরূপ ভাবে অর্থ আমি যে নিজের ইচ্ছামত ব্যয় করিতেছি, তাহা নহে। আপনার বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ সকলেই আপনাদিগের জীবনের নিমিত্ত তাহাদিগের সঞ্চিত সমস্ত অর্থ ও তাঁহাদিগের সমস্ত অলঙ্কার-পত্র পর্যন্ত আমার হস্তে প্রদান করিতে উদ্যত হইয়াছেন, এবং বলিতেছেন, যদি কোনরূপে আমি আপনা দিগের জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ না হই, তাহা হইলে তাঁহারা সকলেই বিষপান করিয়া আপনাপন জীবন নষ্ট করিবেন। আমি যদিচ এখন তাঁহাদিগের নিকট হইতে কোন অর্থ গ্রহণ করি নাই, তথাপি যদি আমি এইরূপ ব্যয় করিয়া আপনাদিগের জীবন রক্ষার কোনরূপ উপায় না করি, তাহা হইলে কি সর্বনাশ ঘটিবে, একবার মনে করিয়া দেখুন দেখি? : গোফুর। বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ যখন আমাদিগের জীবনের নিমিত্ত এত উৎসুক, তাঁহাদিগের নিমিত্ত কিরূপ বন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন?

হোসেন। সে সম্বন্ধে আমি এ পর্যন্ত কিছুই মনে ভাবি নাই। কারণ, আমার বিশ্বাস, এ সম্বন্ধে আমার কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে না!

গোফুর। কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে না কেন?

হোসেন। যখন আমার বিশ্বাস যে, যেরূপে পারি, আপনা দিগের জীবন রক্ষা করিব, তখন আমার সেই সকল দিকে এখন দৃষ্টি করিবার কোনরূপ প্রয়োজন নাই। যেরূপ ভাবে এ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে, এখন সেইরূপ ভাবেই চলুক। পরিশেষে আপনারা নিষ্কৃতি লাভ করিয়া যখন বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করিবেন, সেই সময় আপনার যেরূপ অভিরুচি হয়, সেইরূপ করিবেন।

গোফুর। সে বহুদূরের কথা।

হোসেন। আমি দিব্য চক্ষে দেখিতে পাইতেছি, উহা দূরের কথা নহে।

গোফুর। সে পরের কথা। আমাদিগকে বাঁচাইতে পারিবে, এরূপ লুব্ধ আশ্বাসের উপর একবারে নির্ভর করিয়া থাকিও না। আমাদিগকে খালাস করিবার যতদূর চেষ্টা করিতে হয়, কর; অথচ অপরাপর বন্দোবস্তের দিকেও সবিশেষরূপ দৃষ্টি রাখিও। কারণ, যদি আমাদিগের জীবন রক্ষাই না হয়, তাহা হইলে আমি বাঁচিয়া থাকিতে থাকিতে আমার ইচ্ছামত বিষয়-আদির বন্দোবস্ত করার আবশ্যক। জমিদারী সম্বন্ধে কিরূপ বন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছা করিতেছ?

হোসেন। এখনও কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার চেষ্টা করি নাই। যেরূপ আদেশ করিবেন, সেইরূপ ভাবেই বন্দোস্ত করিব।

গোফুর। মোকদ্দমা খরচের নিমিত্ত যে টাকা সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছ, সেই টাকার নিমিত্ত জমিদারীর কোন অংশ নষ্ট করিতে হইয়াছে কি?

হোসেন। টাকার নিমিত্ত জমিদারীর কোন অংশ আমি নষ্ট করি নাই, বা উহা বন্ধক দিতেও হয় নাই। সরকারী তহবিলের যে যে স্থানে যে যে টাকা মজুত ছিল, তাহাই সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছি মাত্র। যদি কিছু দেনা হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার নিমিত্ত বিষয়-আদি কিছুই বন্ধক দিতে হইবে না। সমস্ত জমিদারী এ পর্যন্ত যেরূপ ভাবে ছিল, এখনও সেইরূপ ভাবেই আছে।

হোসেন ও গোফুর খাঁর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময়ে একজন প্রহরী আসিয়া আসামীদ্বয়কে হাজতের ভিতর বদ্ধ করিয়া দিল। সুতরাং উভয়ের কথাবার্তা সেই সময়ের নিমিত্ত শেষ হইয়া গেল। আসামীদ্বয় সবিশেষ দুঃখিত অন্তঃকরণে হাজতের ভিতর প্রবেশ করিলেন।

সম্পূর্ণ।

 ঘর-পোড়া লোক – ৩য় বা শেষ অংশ

ঘর-পোড়া লোক  (শেষ অংশ) (দারোগার হয় ৭৬ম সংখ্যা)
(অর্থাৎ পুলিসের অসৎ বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত।)
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে শ্রী বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
Al Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। শ্রাবণ
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.

ঘর-পোড়া লোক।
(শেষ অংশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ।

আসামীদ্বয় থানায় উপস্থিত হইলে পর, সেই সময় থানায় যে কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তিনি আসামীদ্বয়কে হাজত গৃহে বন্ধ করিয়া রাখিলেন।

থানায় হাজত-গৃহ কিরূপ, তাহা পাঠকগণ অবগত আছেন কি? থানার ভিতর থানার কর্ম্মচারীগণ যে স্থানে বসিয়া সৰ্ব্বদা কাষ-কৰ্ম্ম বা লেখা-পড়া করিয়া থাকেন, তাহার দুই পার্শ্বে বা তাহার সন্নিকটে ছোট ছোট দুইটী গৃহ প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়; উহাই থানার হাজত-গৃহ। উহার একটা পুরুষ-কয়েদী এবং অপরটা স্ত্রী-কয়েদীর নিমিত্ত প্রায়ই ব্যবহৃত হইয়া থাকে। সেই সকল গৃহে কেবল একটামাত্র দরজা ভিন্ন অপর জানালা দরজা প্রায়ই থাকে না। চোর বলুন, মাতাল বলুন, হত্যাকারী বলুন, বা যে কোন অপরাধের আসামী বলুন, সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে যাহারা ধৃত হইয়া থানায় আইসে, তাহাদিগের সকলকেই একত্র সেই গৃহের ভিতর থাকিতে হয়। বিছানার নিমিত্ত উহার মধ্যে একখানি কম্বল থাকে মাত্র।

গোফুর খাঁ ও ওসমান সেইরূপ একটী হাজত-গৃহের ভিতর আবদ্ধ হইলেন। সেই সময় হোসেন আঁহাদিগের সহিত কথাবার্তা কহিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলে, তাহার সমভিব্যাহারী সেই প্রহরী কহিল, যে পর্যন্ত আসামী থানার ভিতর থাকিবে, সেই পৰ্য্যন্ত আসামী সম্বন্ধে কোন কথা বলা আমাদিগের ক্ষমতার অতীত। এখন যদি আপনি আসামীদ্বয়কে কিছু বলিতে চাহেন, বা উঁহারা আপনাকে কিছু বলিতে চাহেন, তাহা হইলে এখন এই থানায় কে কর্ম্মচারী উপস্থিত আছেন, ভাহার আদেশ লইবার প্রয়োজন। কারণ, যে পর্যন্ত আসামী দ্বয় থানার ভিতর থাকিবেন, সেই পৰ্যন্ত সেই আসামীদ্বয়ের সহিত আমাদিগের কোনরূপ সংস্রক নাই। এখন সেই আসামীদ্বয় সম্বন্ধে যাহা কিছু জবাবদিহি, তাহা এই থানার উপস্থিত কর্ম্মচারীকে করিতে হইবে।

প্রহরীর নিকট হইতে এই কথা শুনিয়া হোসেন ভাবি লেন, এ বড় মন্দ কথা নহে। আসামীদ্বয়ের সহিত কথা কহিবার নিমিত্ত আমি একবার উঁহাদিগকে অর্থ প্রদান করিয়াছি; কিন্তু এখন দেখিতেছি, আমি সেই অর্থ বৃথা নষ্ট করিয়াছি। ইহাদিগের সহিত যদি আবার কথা কহিবার ইচ্ছা প্রকাশ করি, তাহা হইলে এই থানায় এখন যে কর্ম্মচারী উপস্থিত আছেন, তিনি যে আবার কত অর্থ প্রার্থনা করিবেন, তাহাই বা এখন কে বলিতে পারে? এরূপ ভাবে নিরর্থক কতবার অর্থ নষ্ট করা যাইতে পারে? ইহাদিগের সহিত এখন আর কোন কথাই কহিব না।

কল্য প্রাতঃকালে প্রহরীগণ যখন উঁহাদিগকে থানা ইতে ঘর-পোড়া লোক।

বাহির করিয়া লইয়া যাইবে, সেই সময় সুযোগমত পথের মধ্যে উঁহাদিগের সহিত কথা কহিলেই হইতে পারিবে।

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া হোসেন আপনার ভৃত্যদ্বয়ের সহিত সেই থানার ভিতর এক স্থানে শয়ন করিলেন।

সেই সময় থানায় যে কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাহার হাতের কার্য সম্পন্ন করিয়া, একবার তিনি তাহার আফিস হইতে বাহির হইয়া আসামীদ্বয়কে দেখিবার নিমিত্ত সেই হাজত-গৃহের নিকট গমন করিলেন। সেই হাজত-গৃহের চাবি যে প্রহরীর নিকট ছিল, কর্ম্মচারীর আদেশমত সে সেই হাজত-গৃহ খুলিয়া দিল। কর্ম্মচারী হাজত-গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন। আসামীদ্বয়ের একটু শুভদৃষ্ট বলিতে হইবে যে, সেই দিবস সেই হাজত-গৃহের ভিতর সেই দুইটী আসামী ভিন্ন আর কোন আসামী ছিল না।

কর্ম্মচারী হাজত-গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার নাম কি?

গোফুর। আমার নাম গোফুর খাঁ।

কর্ম্মচারী। তোমার কত দিবসের নিমিত্ত কারাদণ্ডের হুকুম হইয়াছে?

গোফুর। আমার কারাদণ্ডের আদেশ হয় নাই, জীবন দণ্ডের আদেশ হইয়াছে।

কর্ম্মচারী। (ওসমানের প্রতি) আর তোমার?

ওসমান। আমারও তাহাই।

কর্ম্মচারী। তোমরা কি করিয়াছিলে, হত্যা করিয়াছিলে কি?

ওসমান। হত্যা না করিলে আর আমাদের জীবনদণ্ডের আদেশ হইবে কেন?

কর্ম্মচারী। তোমাদিগকে এই স্থানে রাত্রিযাপন করিতে হইবে। ওই কম্বল লইয়া তোমরা অনায়াসে তাহার উপর শয়ন করিতে পার।

এই বলিয়া কর্ম্মচারী সেই হাজত-গৃহ হইতে বাহির হইলেন। প্রহরী সেই গৃহ পুনরায় তালাবদ্ধ করিয়া দিল।

বাহিরে আসিয়াই কর্ম্মচারী দেখিতে পাইলেন, একটু দুরে তিনজন লোক শয়ন করিয়া আছে। উঁহাদিগকে দেখিয়া তিনি তাহাদিগের নিকট গমন করিলেন ও কহিলেন, তোমরা কে এখানে শয়ন করিয়া আছ?

হোসেন। আমরা।

কর্ম্মচারী। আমরা কে?

হোসেন। আমি ও আমার দুইজন পরিচারক।

কর্ম্মচারী। তুমি কে?

হোসেন। আমার নাম হোসেন।

কৰ্ম্মচারী। তোমরা কোথায় থাক?

হোসেন। আমাদিগের বাসস্থান এখানে নহে।

কর্ম্মচারী। তবে তোমরা এখানে কি নিমিত্ত আসিয়াছ?

হোসেন। আমরা ওই আসামীদিগের সহিত আসিয়াছি।

কর্ম্মচারী। কোন্ আসামী?

হোসেন। যাঁহারা হাজতে আছেন।

কর্ম্মচারী। তাই বল না কেন, তোমরা প্রহরী; সেই আসামীদ্বয়কে এখানে আনিয়াছ।

হোসেন। না মহাশয়! আমরা প্রহরী নহি। প্রহরীগণ। আসামীদ্বয়কে লইয়া আসিয়াছে, আমরা তাহাদিগের সঙ্গে আসিয়াছি মাত্র।

কর্ম্মচারী। তোমাদিগের সঙ্গে আসিবার প্রয়োজন?

হোসেন। সঙ্গে আসিবার প্রয়োজন আছে বলিয়াই আসিয়াছি। উঁহারা আমাদিগের মনিব।

কর্ম্মচারী। কি! আসামীদ্বয় তোমাদিগের মনিব?

হোসেন। হাঁ মহাশয়!

কর্ম্মচারী। তোমার মনিবদ্বয় চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছে, এরূপ অবস্থায় তাহাদিগের সহিত তোমাদিগকে একত্র গমন করিতে কে আদেশ প্রদান করিয়াছে? কাহার হুকুমে তোমরা তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছ?

হোসেন। কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের আদেশমত আমরা ইহাদিগের সহিত গমন করিতেছি।

কর্ম্মচারী। কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেব আসামীদ্বয়ের সমভি ব্যাহারে তোমাদিগকে গমন করিতে যে আদেশ করিয়াছেন, তাহা আসামীদ্বয়ের সমভিব্যাহারী প্রহরীগণ অবগত আছে কি?

হোসেন। তাঁহারা অবগত আছে। তদ্ব্যতীত ইহাদিগকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কোন অর্থের প্রয়োজন হইতেছে, তাহা আমাকে প্রদান করিতে বলিয়া দিয়াছেন, আমিও তাহা দিয়া আসিতেছি।

কর্ম্মচারী। কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেব আসামীদ্বয়ের সহিত গমন করিবার আদেশ দিয়াছেন সত্য; কিন্তু থানার ভিতর রাত্রিকালে শুইয়া থাকিবার নিমিত্ত আদেশ দিয়াছেন কি?

হোসেন। এরূপ কথা কিছু বিশেষ করিয়া বলেন নাই।

কর্ম্মচারী। এরূপ অবস্থায় আমি আপনাদিগকে এই স্থানে শয়ন করিয়া থাকিবার নিমিত্ত কোন প্রকারেই আদেশ

প্রদান করিতে পারি না।

হোসেন। আমাদিগের অপরাধ?

কর্ম্মচারী। তোমাদিগের অপরাধ না থাকিলেও তোমরা যখন খুনী আসামীর সঙ্গের লোক, তখন তোমরা এক রূপ অপরাধী।

হোসেন। স্বীকার করিলাম আমরা অপরাধী। তাহাতেই বা ক্ষতি কি?

কর্ম্মচারী। তোমাদিগের মনে কি আছে, তাহা তোমরাই বলিতে পার। রাত্রিকালে সকলে শয়ন করিলে যদি কোনরূপে তোমর আসামীদ্বয়কে পলাইবার উপায় করিয়া দেও, তাহা হইলে কি হইবে বল দেখি?

হোসেন। না মহাশয়! আমরা সেরূপ চেষ্টা কখনই করিব না। এরূপ কথা আমাদিগের মনে এ পর্যন্ত উদয় হয় নাই। আর যদি এখন আমাদিগের সেইরূপ ইচ্ছাই হয়, তাহা হইলে আমাদিগের সে ক্ষমতা কোথায়?

কর্ম্মচারী। সে যাহা হউক, রাত্রিকালে তোমাদিগকে আমি কোনরূপেই থানার ভিতর থাকিতে দিব না।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

হোসেনের সহিত থানার সেই উপস্থিত কর্ম্মচারীর এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময়ে থানার দারোগা, যিনি অপর কাৰ্য্য উপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন, তিনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও কর্ম্মচারীকে কহিলেন, কি হে। কিসের গোলযোগ?

কর্ম্মচারী। গোলযোগ অপর কিছুই নহে। খুনী মোক দমায় প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, এইরূপ দুইটী আসামী এখানে আসিয়াছে। আমি তাহাদিগকে হাজত-গৃহে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি। আসামীদ্বয়ের সমভিব্যাহারে প্রহরীগণ ব্যতীত অপর আরও তিনজন লোক আসিয়াছে। তাঁহারা কে, এবং কি চরিত্রের লোক, তাহা আমরা অবগত নহি। কিন্তু তাহার এই থানার ভিতর রাত্রিবাস করিতে চাহে। তাই আমি তাহাদিগকে এখান হইতে তাড়াইয়া দিতেছি। অপর গোলযোগ আর কিছুই নহে।

দারোগা। অপর যে সকল লোক আসিয়াছে, তাঁহারা কোথায়?

কর্ম্মচারী। তাঁহারা এই শয়ন করিয়া আছে।

দারোগা। উঁহাদিগকে আমার নিকট ডাক দেখি।

দারোগা সাহেবের এই কথা শুনিবামাত্র হোসেন এবং তাহার সমভিব্যাহারী দুই ব্যক্তি আসিয়া দারোগা সাহেবের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। তাহাদিগকে দেখিয়াই দারোগা সাহেব কহিলেন, আপনি হোসেন মিঞা মহেন?

হোসেন। আজ্ঞা, আমি হোসেন।

দারোগা। আপনি এখানে কেন?

হোসেন। মনিবদিগের সঙ্গে।

দারোগা। মনিবদিগের সঙ্গে? আপনার মনিব ত একজন ছিলেন, আপনি গোফুর খাঁর নিকট কৰ্ম্ম করিতেন না?

হোসেন। আজ্ঞা হাঁ, এখনও আমি তাহার কর্ম্ম করিতেছি।

দারোগা। তবে মনিবগণ পাইলেন কোথায়?

হোসেন। গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্র।

দারোগা। তাহার কোথায়?

হোসেন। তাঁহারা আপনার হাজতেই আছেন।

দারোগা। তাঁহারা একটী মোকদ্দমায় পড়িয়াছেন, এ কথা আমি পূর্বেই শুনিয়াছিলাম। তাহাদিগের সেই মোক দ্দমার বিচার কি শেষ হইয়া গিয়াছে?

হোসেন। আজ্ঞা হাঁ, জজসাহেবের বিচার শেষ হইয়া গিয়াছে।

দারোগা। বিচারে কি হইয়াছে?

হোসেন। তা আমাদিগের সর্বনাশ হইয়াছে। বিচারে জজসাহেব উভয়কেই চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইবার আদেশ প্রদান করিয়াছেন।

দারোগা। কি সর্বনাশ! উভয়কেই ফাঁসির আদেশ দিয়া ছেন?তাঁহারাই কি এখন আমার এই থানার হাজতে আছেন?

হোসেন। হাঁ মহাশয়! তাহাদিগের সহিতই আমরা আসিয়াছি।

দারোগা। আচ্ছা, আপনারা থানাতেই থাকুন, আপনা, দিগের এখান হইতে গমন করিবার প্রয়োজন নাই।

হোসেন। মহাশয়! আমাকে মাপ করিবেন। আপনি দেখিতেছি, আমাদিগের সমস্ত অবস্থা অবগত আছেন; কিন্তু জামি এ পর্যন্ত চিনিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

দারোগা। আমি আমার পোষাক-আদি পরিবর্তন করিয়া এখনই আসিতেছি, আমাকে ভাল করিয়া দেখিলেই চিনিতে পারিবেন। আপনাদিগের জমিদারীর ভিতর গাজিনগর নামক একখানি গ্রাম আছে না?

হোসেন। আছে।

দারোগা। সেই গ্রামের কতকগুলি জমী লইয়া অপর একজন জমিদারের যে সময় বিবাদ হয়, সেই সময় আমাকে দেখিয়াছেন।

এই বলিয়া দারোগা সাহেব আপনার পোষাক পরিচ্ছদ পরিবর্তন করিবার মানসে আপনার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন।

দারোগা সাহেব সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে পর, দারোগা সাহেব সম্বন্ধীয় সমস্ত কথা হোসেনের মনে হইল। তখন মনে হইল, যে সময় গাজিনগর লইয়া গোফুর খাঁর সহিত অপর একজন জমিদারের বিবাদ উপস্থিত হয়, এবং পরিশেষে উভয় পক্ষে ভয়ানক দাঙ্গা হইয়া যায়, সেই সময় ইনিই সেই স্থানের দারোগা ছিলেন। দাঙ্গার সংবাদ ইঁহার নিকট প্রেরিত হইলে, ইনিই আসিয়া তাহার অনুসন্ধান করেন। সেই সময় ইনি গোফুর খাঁর বাড়ীতে গিয়াও কয় দিবসকাল অতিবাহিত করেন। ইনি সেই সময় গোফুর খাঁর নিকট হইতে সহস্র মুদ্রা গ্রহণ করিয়াছিলেন। সে সময় ইহারই সাহায্যে সেই মোকদ্দমায় গোফুর খাঁ জয়লাভ করেন, ও গাজিনগর গ্রাম সেই সময় হইতে সুচারুরূপে শাসন করিতে প্রবৃত্ত হন। তাহার পর হইতে এ পর্যন্ত সেই গ্রাম লইয়া আর কোনরূপ গোলযোগ ঘটে নাই। এই সময় হইতে দারোগা সাহেব সর্বদা গোফুরের নিকট গমন করি তেন, এবং আবশ্যক হইলে দুই একদিবস তথায় অবস্থানও করিতেন। কিন্তু যে পর্যন্ত তিনি সেই থানা হইতে বদলি হইয়া গিয়াছেন, সেই পর্যন্ত তিনি আর গোফুর খাঁর নিকট গমন করেন নাই, বা তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে সমর্থ হন নাই। গাজিনগর উপলক্ষে যে সময় দারোগা সাহেবের সহিত গোফুর খাঁর আলাপ পরিচয় হয়, হোসেনও সেই সময় ইতে তাঁহার নিকট পরিচিত। ইহার পর অনেক দিবস পর্যন্ত হোসেনের সহিত তাহার সাক্ষাৎ না হওয়ায়, প্রথমেই হোসেন দারোগা সাহেবকে চিনিয়া উঠিতে পারেন নাই। সেই কারণে তিনি মনে মনে একটু লজ্জিত হইলেন। যাহা হউক, তখন তিনি মনে করিলেন, থানার বাহিরে গিয়া আর তাহাকে রাত্রিযাপন করিতে হইবে না।

হোসেন সেই স্থানে বসিয়া বসিয়া দারোগা সাহেব সম্বন্ধীয় পুরাতন কথা সকল মনে করিতেছেন, এমন সময়ে একজন প্রহরী আসিয়া কহিল, দারোগা সাহেব আপনাকে সেলাম দিয়াছেন।

হোসেন। দারোগা সাহেব কোথায়?

প্রহরী। তিনি তাঁহার বাসায়।

হোসেন। তাহা হইলে আমাকে এখন কোথায় যাইতে হইবে? কোথায় গমন করিলে তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে?

প্রহরী। তাঁহার বাসায় আপনাকে ডাকিয়াছেন, সেই স্থানে গমন করিলেই, তাহার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইবে।

হোসেন। কোন্ সময় আমাকে সেই স্থানে গমন করিতে হইবে?

প্রহরী। এখনই। আপনি আমার সহিত আসুন, তিনি হায় বাহিরের গৃহে আপনার প্রতীক্ষায় বসিয়া আছেন।

হোসেন। চল।

এই বলিয়া : হোসেন সেই স্থান হইতে গাত্রোখান করিয়া সেই প্রহরীর পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। যাইবার সময় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি এই থানায় কতদিবস পর্যন্ত আছ?

প্রহরী। প্রায় আট নয় বৎসর।

হোসেন। দারোগা সাহেব এখানে কতদিবস আসিয়াছেন? প্রহরী। এক বৎসরের কম হইবে না, বরং কিছু বেশী হইবে।

হোসেন। তোমাদিগের দারোগা সাহেব কেমন লোক?

প্রহরী। খুব ভাল লোক; গরিবের মা-রাপ। আমরা সবিশেষ সুখ-সচ্ছনে তাহার নিকট কৰ্ম্ম করিতেছি।

হোসেন। দারোগা সাহেবের বাসায় তাহার পরিবারগণ কেহ আছেন, কি তিনি একাকীই এই স্থানে বাস করিতেছেন?

প্রহরী। তাঁহার পরিবার ও পুত্র কন্যাগণ এই স্থানেই ছিলেন; অদ্য আন্দাজ একমাস হইল, কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে তিনি তাঁহাদিগকে আপনার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিয়াছেন। এখন কেহই এখানে নাই, কেবল দারোগা সাহেব একাকী এখানে আছেন।

প্রহরীর সহিত এইরূপ নানাপ্রকার কথা কহিতে কহিতে হোসেন দারোগা সাহেবের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, দারোগা সাহেব একাকী হোসেনের অপেক্ষায় তাঁহার বাহিরের গৃহে বসিয়া রহিয়াছেন।

এইরূপ অবস্থায় দারোগা সাহেবকে একাকী বসিয়া থাকিতে দেখিয়া, হোসেন একটু বিস্মিত হইলেন। কারণ, ইতিপূর্বে অনেকবার তিনি দারোগা সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন, কিন্তু কখনই তাঁহাকে একাকী দেখিতে পান নাই। অপর কেহ উপস্থিত না থাকিলেও, অভাবপক্ষে দুই চারিজন পরিচারকও সর্বদা তাহার নিকট থাকি।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

দারোগা সাহেবের নিকট হোসেন গমন করিলে, তিনি হোসেনকে সেই স্থানে বসিতে বলিলেন। হোসেন তাহার সন্নিকটবর্তী এক স্থানে উপবেশন করিলে, তিনি কহিলেন,

আপনি আমাকে চিনিতে পারেন নাই?

হোসেন। আপনাকে আর চিনিতে পারি না, খুব চিনিতে পারিয়াছি। কিন্তু প্রথমতঃ আপনাকে চিনিতে পারি নাই বলিয়া, ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি, মাফ করিবেন।

দামোগা। আপনার মনিব ও মনিব-পুত্র যে একটা মোক জমায় পড়িয়াছেন, এ কথা আমি পূৰ্বে শুনিয়াছিলাম; কিন্তু তাঁহাদিগের যে এই অবস্থা ঘটিবে, তাহা আমি একবারের নিমিত্তও মনে করি নাই।

হোসেন। মনে না করিবারই কথা। ইহারা যে একবারে চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন, তাহা আমরা একবারের নিমিত্তও মনে করি নাই, বা আমাদিগের উকীল কৌশলীগণও কখন এরূপ ভাবেন নাই।

দারোগা। আপনি বহুদর্শী ও একজন পুরাতন কর্ম্মচারী। জমিদারী-বুদ্ধি আপনার যথেষ্ট আছে। প্রথমতঃ এই মোক দমার নিমিত্ত যদি একটু চেষ্টা করিতেন, তাহা হইলে বোধ হয়, এরূপ অবস্থা কখনই ঘটিত না।

হোসেন। আমার সাধ্যমত চেষ্টা করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করি নাই; কিন্তু সেই সকল চেষ্টাতেও কোন ফলই দর্শিল না।

দারোগা। প্রথমে কি চেষ্টা করিয়াছিলেন। অনুসন্ধান কারী দারোগার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন কি?

হোসেন। এই মোক প্রথমে যে সময় রুজু হয়, সেই সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না; জমিদারীর কাৰ্য্য উপলক্ষে মফঃস্বলে গমন করিয়াছিলাম। মোকমার সংবাদ যেমন আমি শুনিতে পাইলাম, অমনি আমি চলিয়া আসিলাম।

আসিয়াই অনুসন্ধানকারী দারোগাকে কিঞ্চিৎ প্রণামী দিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। সেই সাক্ষাতের ফল আপনি এই দেখিতেই পাইতেছেন।

দারোগা। প্রণামীর পরিমাণটা, বোধ হয়, কম হইয়াছিল; তাই তাহার দ্বারা সবিশেষরূপ উপকার প্রাপ্ত হন নাই।

হোসেন। তাহার পক্ষে সামান্য হইতে পারে, কিন্তু আমার পক্ষে কম নহে। আমি তাঁহাকে সহস্র মুদ্রা প্রদান করিয়াছিলাম।

দারোগা। তাহা হইলে তিনি কোনরূপ তোমাদিগের সাহায্য করিলেন না কেন?

হোসেন। সে অনেক কথা। এই মোকদ্দমা যেরূপ ভাবে সাজান হইয়াছিল, প্রকৃত পক্ষে তাহার কিছুই ঘটে নাই, সমস্তই মিথ্যা।

দারোগা। দারোগা তোমাদিগের নিকট হইতে সহস্র মুদ্রা গ্রহণ করিলেন, এবং তোমাদিগের উপরই মিথ্যা মোকদ্দমা সাজাইলেন, এ কথা শুনিতে কেমন কেমন বোধ হয়।

হোসেন। তাহার কারণ আছে।

দারোগা। এমন কি কারণ হইতে পারে?

হোসেন। লজ্জার কথা বলিব কি! দারোগা সাহেব কোথা হইতে একটী সুরূপা স্ত্রীলোককে বাহির করিয়া আনিয়াছিলেন, এবং তাহার সমস্ত খরচ-পত্ৰ দিয়া একখানি বাড়ীতে তাহাকে রাখিয়াছিলেন। আমার মনিব-পুত্র ওসমানের চরিত্র নিতান্ত মন্দ হইয়া পড়ে। এমন কি, কোন সুশ্রী রমণীর প্রতি লোভ হইলে তাহাকে তাহা হইতে নিবৃত্ত করিবার ক্ষমতা কাহারও ছিল না। এই নিমিত্তই প্রজাদের মধ্যে সকলেই তাহার শক্ত হইয়া পড়ে। যে রমণীকে দারোগা সাহেব রাখিয়াছিলেন, সেই রমণীর কথা ওসমান কিরূপে জানিতে পারে। পরিশেষে কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া তাহাকে আয়ত্ব করে। দারোগা সাহেব এই কথা জানিতে পারিয়া, প্রথমতঃ ওমানের নিকট সংবাদ পাঠাইয়া সেই রমণীকে যথাস্থানে পুনরায় রাখিয়া আসিতে কহেন; কিন্তু ওসমান তাহার এই অনুরোধে কর্ণপাতও করেন না। তখন দারোগা সাহেব তাহার উপর সবিশেষরূপ অসন্তুষ্ট হন, এবং তাহার চরিত্রের কথা তাহার পিতা গোফুর খাঁর নিকট গিয়া বলেন। গোফুর খাঁও পুত্র-স্নেহ বশতঃ তাহার প্রতিবিধানের কোনরূপ চেষ্টাও করেন না। কাজেই দারোগা সাহেব উভয়ের প্রতি অন্তরের সহিত চটিয়া যান, এবং কিরূপে উভয়কেই সবিশেষরূপে বিপদাপন্ন করিতে সমর্থ হইবেন, কেবল তাহারই ছিদ্র অনুসন্ধান করিতে থাকেন। সেই সময় একটা সুযোেগ উপস্থিত হয়। হেদায়েৎ নামক এক ব্যক্তি আসিয়া নালিশ করে যে, সে তাহার যুবতী কন্যাকে পাইতেছে না, এবং শুনিতেছে যে, ওসমান তাহার কন্যাকে লইয়া গিয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া দারোগা সাহেব তিলকে তাল করিয়া ফেলি লেন। পিতা-পুত্র উভয়কেই জড়াইয়া তাহার নিকট হইতে এজাহার লইলেন, ও যেরূপ ভাবে সাক্ষি-সাবুদের সংগ্রহ করিবার প্রয়োজন, তাহার সমস্তই ঠিক করিয়া আপনার প্রতিহিংসা সাধুন পূর্বক মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিলেন। লাভের মধ্যে আমাদিগের আরও সহস্র মুদ্রা নিরর্থক নষ্ট হইল।

দারোগা। এতদুর ঘটিয়াছিল, এ কথা আমাকে পূর্বে বলেন নাই কেন? অনুসন্ধানকারী দারোগা সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কোন না কোনরূপে আমি ইহার প্রতিবিধানের চেষ্টা করিতাম। আপনার কি মনে নাই যে, অনেক সময় গোফুর খাঁর নিকট আমি অনেক উপকার প্রাপ্ত হইয়াছি।

হোসেন। আপনার কথা সেই সময় আমাদিগের মনে এক বারেই পড়ে নাই। বিশেষতঃ মনে পড়িলেই বা কি হইত? আপনি যে এই থানায় আছেন, তাহা আমরা কেহ অবগত ছিলাম না। আপনি গোফুর খাঁর নিকট অনেক সময় উপকার পাইয়াছেন বলিতেছেন বটে; কিন্তু এখন আপনার নিকটেই বা কিরূপে উপকারের প্রত্যাশা করা যাইতে পারে?

দারোগা। আপনার এ কথার অর্থ কি?

হোসেন। অর্থ যে কি, তাহা আর আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না? আজ কালকার যেরূপ নিয়ম হইয়া পড়ি তেছে, তাহা ত আপনি বেশ জানেন। আপনি যাহার উপকার করিবেন, সে কিসে সেই উপকারকারীর অনিষ্ট করিতে সমর্থ হইবে, তাহারই চেষ্টা সর্বদা করিয়া থাকে।

দারোগা। আপনার কি বিশ্বাস যে, জগতের সকলেই সেই চরিত্রের লোক?

হোসেন। সকলে না হইতে পারেন; কিন্তু পনর আনা লোকের চরিত্র যে সেইরূপ, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

দারোগা। আমি যদি পূৰ্ব্বে ইহার অণুমাত্রও জানিতে পারিতাম, তাহা হইলে বোধ হয়, আমি সবিশেষরূপে আপনাদিগের উপকার করিতে পারিতাম।

হোসেন। যাহার সময় উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, তাহার আর উপায় নাই! এখন বলুন দেখি, আপীলে কোনরূপ ফল পাইবার উপায় আছে কি?

দারোগা। আমার বোধ হয়, আপীলে এ মোকদ্দমার কিছু হইবে না।

হোসেন। এই মোকদ্দমার কাগজ-পত্ৰ ত আপনি কিছুই দেখেন নাই, তবে আপনি কিরূপে বলিতেছেন যে, আপীলে কোনরূপ ফল পাওয়া যাইবে না?

দারোগা। কাগজ-পত্র না দেখিলেও আমার জানিবার বিশেষ কারণ আছে। যে জজসাহেব এই মোক দমার বিচার করিয়াছেন, তাঁহাকে আমি অনেক দিবস হইতে উত্তমরূপে অবগত আছি। তাঁহার মত বুদ্ধিমান কর্ম্মচারী অতি অল্পই দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার উপর মোকদ্দমার রায় লিখিবার ক্ষমতা তাঁহার যেরূপ আছে, সেরূপ ক্ষমত। এই প্রদেশীয় বর্তমান কর্ম্মচারীগণের মধ্যে আর কাহারও আছে কি না সন্দেহ। এ পর্যন্ত তাহার বিচারিত যত মোকদ্দমার আপীল হইয়াছে, হাইকোর্ট হইতে তাহার একটীও মোকদ্দমার রায় পরিবর্তিত হয় নাই। বরং তাহার রায় দেখিয়া, সকলেই তাহার প্রশংসা করিয়াছেন।

হোসেন। যে আশায় আমি উঁহাদিগকে এতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত রাখিয়াছি, তবে কি আমাদিগের সে আশা নাই?

দারোগা। আপীলের আশা ছাড়িয়া দিয়া যদি আর কোনরূপ উপায় থাকে, তাহার চেষ্টা দেখুন। আপীলে কিছু হইবে না।

হোসেন। আর উপায় কি দেখিব? এমন উপায় আর কি হইতে পারে, যাহাতে উঁহাদিগের উভয়ের প্রাণরক্ষা হয়?

দারোগা। কোনরূপ যোগাড়যন্ত্র করিয়া যদি লাটসাহেবের নিকট হইতে উঁহাদিগের জীবন-ভিক্ষা লইতে পারেন, তাহা হইলেই হইতে পারে।

হোসেন। সেরূপ যোগাড় কিরূপে হইতে পারে? সে ক্ষমতা আমাদিগের নাই।

দারোগা। কেন থাকিবে না, যাহার প্রচুর অর্থ আছে, তাহার সমস্ত ক্ষমতাই আছে। তবে যোগাড় চাই, পরিশ্রম চাই, তাহার উপর অর্থ ব্যয় করিবার ইচ্ছা চাই।

হোসেন। আমাদিগের যতদূর সম্ভব, অর্থ সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি; কিন্তু যোগাড় করিবার ক্ষমতা আমাদিগের নাই। গোফুর খাঁর উপর যদি আপনার এতদূর দয়া হইয়াছে, তাহা হইলে অনুগ্ৰহ করিয়া বলিয়া দিন, কিরূপ ভাবে যোগাড় করিলে, বা কাহার সাহায্য গ্রহণ করিলে, আমার মনিবদ্বয়ের জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ হইব।

দারোগা। এখন আপনি উঁহাদিগের জীবনের নিমিত্ত কত অর্থ ব্যয় করিতে প্রস্তুত আছেন?

হোসেন। আমাদিগের যতদুর সাধ্য, তাহা অপেক্ষা আরও অধিক অর্থ ব্যয় করিতে আমি প্রস্তুত আছি।

দারোগা। আপনাদিগের কি ক্ষমতা আছে, তাহা আমি জানি না। কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিতে পারিবেন, তাহা আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলুন, তাহা হইলে আমি বুঝিতে পারি যে, উঁহাদিগের জীবন রক্ষা হইতে পারিবে কি মা! তাহা হইলে আমার যেরূপ বুদ্ধি, সেইরূপ একটা সামান্য উপায় বলিয়া দিব, বা আবশ্যক হয়, আমি নিজে উহাতে হস্তক্ষেপ করিব।

হোসেন। দেখুন দারোগা সাহেব! জীবনের অপেক্ষা অর্থ কিছু অধিক মুল্যবান্ নহে। যদি ইহারা জীবন প্রাপ্ত হন, তাহা হইলে আমার বিশ্বাস, উঁহাদিগের নিকট যাহা কিছু সঞ্চিত অর্থ আছে, এবং চেষ্টা করিয়া আরও যতদূর অর্থের সাহায্য হইতে পারে, তাহার সমস্তই উঁহারা ব্যয় করিতে প্রস্তুত আছেন।

দারোগা। ওরূপ গোলযোগের কথা আমি বুঝি না। আমাকে পরিষ্কার করিয়া বলুন দেখি, পাঁচ লক্ষ টাকা উঁহারা ব্যয় করিতে প্রস্তুত আছেন কি?

হোসেন। পাঁচ লক্ষ টাকা। এখন ব্যয় করিবার ক্ষমতা উঁহাদিগের নাই।

দারোগা। তবে কয় লক্ষ টাকা ব্যয় করিবার ক্ষমতা উঁহাদিগের আছে?

হোসেন। উঁহাদিগের সহিত পরামর্শ না করিয়া, আমি এ কথার ঠিক উত্তর দিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হয়, যদি উঁহাদিলের জীবন রক্ষা করিতে পারেন, তাহা হইলে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত উঁহারা ব্যয় করিতে সমর্থ হইবেন। তাহার অধিক যে পারিবেন, তাহা আমার বোধ হয় না।  দারোগা। আচ্ছা, আপনি গমন করুন, এবং হাজত গৃহের বাহির হইতে উঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসুন; দেখুন, উঁহারা কি বলেন। দুই লক্ষ মুদ্রার কম এ কাৰ্য্য কখনই সম্পন্ন হইতে পারে না। যদি উঁহারা আমার প্রস্তাবে সম্মত হন, তাহা হইলে আপনি সময় নষ্ট না করিয়া, শী আমার নিকট আগমন করিবেন। আমি আপনার অপেক্ষায় এই স্থানে বসিয়া রহিলাম।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া হোসেন সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় মনে মনে ভাবিতে লাগি লেন, অর্থ ব্যয় করিয়া দারোগা সাহেব কিরূপে ইহাদিগের প্রাণ রক্ষা করিতে সমর্থ হইবেন? আপীল করিলে যখন বলিতেছেন, কিছুই হইবে না, লাট সাহেবের নিকট কোন রূপ চেষ্টা করিবার ক্ষমতা যখন আমাদিগের বা দারোগা সাহেবের নাই, তখন কিরূপে ইনি ইহাদিগের জীবন বাঁচাইতে সমর্থ হইবেন? তবে কি ইহারও ইচ্ছা, অনুসন্ধানকারী দারোগা সাহেবের সদৃশ আমাদিগের নিকট হইতে ফঁাকি দিয়া কিছু অর্থ গ্রহণ করা? অনুসন্ধানকারী দারোগা সাহেব কেবলমাত্র সহস্র মুদ্রা গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইদার, দেখিতেছি, আশা অতিরিক্ত। ইতিপূর্বে ইনি আমাদিগকে অনেক মোকদ্দমায় সাহায্য করিয়াছেন ও আমাদিগের নিকট হইতে সময় সময় অনেক অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু এ পর্যন্তু কখনও বিশ্বাসঘাতকের কার্য করেন নাই। যখন যাহা করিবেন বলিয়াছেন, কার্যে ঠিক তাহাই করিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় ইহার কথায় একবারে অবিশ্বাসও করিতে পারি না। আর অনেক টাকা দিয়া একবারেই বা বিশ্বাস করি কি প্রকারে? এতদিবস সভাবে কাৰ্য্য করিয়াছেন বলিয়াই যে, এখন অসভাবে কাৰ্য্য না করিবেন, তাহারই বা প্রমাণ কি? গোফুর ও ওসমান উভয়েই জীবন পরিত্যাগ করিতে বসিয়াছেন, তাহাদিগের নিকট হইতে শেষ অবস্থায় এইরূপ অর্থ গ্রহণ করিলে, উহার প্রতিবিধানের আর কোন উপায়ও থাকিবে না। উঁহাদিগের উভয়েরই জীবন শেষ হইলে উঁহাদিগের পরিবারবর্গ যে অর্থ সাহায্যে অনায়াসেই জীবনযাপন করিতে সমর্থ হইতেন, সেই অর্থও কি অতঃপর এইরূপে নষ্ট করিব? বড়ই গোলযোগের কথা।

মনে মনে এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে যে স্থানে গোফুর খাঁ ও ওসমান খ আবদ্ধ অবস্থায় ছিলেন, সেই স্থানে গমন করিলেন; কিন্তু সেই হাজত-গৃহের আসামীদ্বয়কে যে ব্যক্তি পাহারা দিতেছিল, সে তাহাকে উঁহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে, বা কথা কহিতে দিল না। তখন হোসেন অনন্যোপায় হইয়া পুনরায় দারোগা সাহেবের নিকট আগমন করিলেন ও তাঁহাকে কহিলেন, যাহার পাহারা আছে, সেই প্রহরী আমার মনিবদ্বয়ের সহিত আমাকে কোনরূপে কথা কহিতে, বা তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে কোনরূপে দিল না।

হোসেনের এই কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব সেই প্রহরীকে জাকাইলেন ও তাহাকে বলিয়া দিলেন, আসামীদ্বয়ের সহিত এই ব্যক্তিকে সাক্ষাৎ করিতে দেও, এবং বাহির হইতে যদি কোন কথা উঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতে চাহে, তাহাও করিতে দেও; কিন্তু ইহাকে ফটকের ভিতর প্রবেশ করিতে দিও না।

প্রহরী দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালন করিল। হোসেন হাজতের নিকট গমন করিলে, সে হাজতের দরজা খুলিয়া দিল; কিন্তু হোসেনকে তাহার ভিতর প্রবেশ করিতে দিল না। নিজেও সেই স্থানে দণ্ডায়মান রহিল।

উভয়কেই সম্বোধন করিয়া হোসেন কহিল, আমি এখন একটা কোন সবিশেষ প্রয়োজনের নিমিত্ত আপনাদিগের নিকট আগমন করিয়াছি, সবিশেষরূপে মনঃস্থির করিয়া কথাগুলি শুনিতে হইবে।

পূর্বে যে একটী মুসলমান দারোগা অনেক সময় আমা দিগের উপকার করিয়াছিলেন, এবং অনেক সময় যিনি আমাদিগের বাড়ীতে গমন করিয়া সময় সময় দুই তিনদিবস পর্যন্ত অতিবাহিত করিতেন, তাহাকে এখন আপনাদের মনে হয় কি?

গোফুর। তাহাকে বেশ মনে হয়। তিনি অতি ভদ্র লোক। যখন যাহা করিবেন বলিয়াছেন, তখনই ঠিক তাহাই করিয়াছেন। তাহার কথা এ সময়ে জিজ্ঞাসা করিতেছ কেন?

হোসেন। যে থানায় এখন আপনারা আবদ্ধ, তিনি সেই থানার দারোগা।

গোফুর। তিনি এই থানার দারোগা! তাহার সহিত এই শেষ সময় একবার সাক্ষাৎ হয় না কি?

হোসেন। আমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছে। আপনাদিগের সম্বন্ধে অনেক কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করিয়া, অনেক দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন, এবং অনেক কথা আমাকে বলিয়াছেন। তাহারই কথা মত এখন আমি আপনাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি।

গোফুর। তিনি কি বলেন?

হোসেন। তিনি বলেন, উপযুক্ত পরিমিত অর্থ ব্যয় করিতে পারিলে, তিনি আপনাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারেন।

গোফুর। কিরূপে? আপীল করিয়া?

হোসেন। না। তিনি বলেন, আপীলে কিছু হইবে না। তবে লাট সাহেবের নিকট কোনরূপ চেষ্টা করিতে পারিলে, যদি তিনি দয়া করেন, তাহা হইলেই জীবনের পুনরায় আশা করা যাইতে পারে।

গোফুর। টাকায় লাট সাহেবের নিকট কোনরূপ চেষ্টা হইবে না, অপর কোন উপায়ও আমাদিগের নাই।

হোসেন। সে কথা আমি পূৰ্বেই তাহাকে বলিয়াছি। তাহা শুনিয়াও তিনি বলেন, যদি অধিক পরিমাণে টাকা ব্যয় করিতে সমর্থ হন, তাহা হইলে তিনি জীবনদানের উপায় করিবার চেষ্টা করেন।

গোফুর। কত টাকার আবশ্যক, তাহা তিনি কিছু বলিয়াছেন কি?

হোসেন। প্রথম বলিয়াছিলেন, পাঁচ লক্ষ টাকার আবশ্যক; কিন্তু আমি যখন তাঁহাকে কহিলাম, এত টাকা কোনরূপেই সংগ্রহ হইবার সম্ভাবনা নাই। তখন তিনি কহিলেন, দুই লক্ষ টাকার কম এ কাৰ্য কোনরূপেই হইতে পারে না।

গোফুর। কিরূপ উপায়ে তিনি আমাদিগের প্রাণ বাঁচা ইতে সমর্থ হইবেন, তাহা কিছু বলিয়াছেন কি?

হোসেন। কি উপায়ে বাঁচাইবেন, তাহার কোন কথা বলেন নাই। কেবল বলিয়াছেন, টাকার যোগাড় করিতে পারিবে কি না দেখ।

গোফুর। দেখ হোসেন! আমার জীবনের আশা নাই, বাঁচিবারও আর সাধ নাই। তবে যদি ওসমানকে কোন রূপে বাঁচাইতে পার, তাহার চেষ্টা কর। আমার জন্য কোনরূপ চেষ্টা করিবার প্রয়োজন নাই।

হোসেন। তবে আমি দুই লক্ষ টাকা দিতে স্বীকার করিব?

গোফুর। পুল-স্নেহ যে কি, তাহা তুমি যে না জান, তাহা নহে। আমার পুত্রের জীবনের নিকট দুই লক্ষ টাকা অতি অল্প।

হোসেন। এত টাকা এখন আমি সংগ্রহ করি কি প্রকারে? এ পর্যন্ত যোগাড় করিয়া অনেক কষ্টে প্রায় দুই লক্ষ টাকা সংগ্রহ করিয়াছিলাম, মোকদ্দমায় এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয় হইয়া গিয়াছে, অবশিষ্ট এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা আমার নিকট আছে। ভাবিয়াছিলাম বে, এই মোকদ্দমায় আপনাদিগের যতই অর্থদণ্ড হউক না কেন, সেই টাকা হইতে তাহা প্রদান করিয়া আপনাদিগকে বাড়ীতে লইয়া যাইব। কিন্তু যাহা ভাবিয়াছিলাম তাহা হইল না।

গোফুর। দুইটা জীবনের জন্য যখন তিনি দুই লক্ষ টাকা চাহিতেছেন, তখন একটা জীবনের জন্য যে টাকা তোমার নিকট আছে, তাহা তাহাকে প্রদান কর, তাহাতে যদি তিনি সম্মত না হন, তাহা হইলে অবশিষ্ট টাকা পরে সংগ্রহ করিয়া তাহাকে প্রদান করিও।

হোসেন। এই সময় এত টাকা উহার হস্তে প্রদান করিব, আর উনি যদি কিছু না বলিয়া, কেবলমাত্র টাকাগুলি হস্তগত করেন, তাহা হইলে উপায়?

গোফুর। উপায় কিছুই নাই। আমার পুত্রের জীবনের সঙ্গে মা হয়, সেই টাকাও নষ্ট হইবে। দারোগা যেরূপ চরিত্রের লোকই হউক না কেন, আমাদিগের এরূপ অবস্থায় প্রতারিত করিয়া, এইরূপ ভাবে আমাদিগের জীবনের সহিত এত অর্থ গ্রহণ করিতে পারে, এরূপ বিশ্বাসঘাতক বোধ হয়, আজও জন্মগ্রহণ করে নাই। বিশেষতঃ যে দারোগার কথা তুমি বলিতেছ, সেই দারোগা আমার সহিত কখনও অবিশ্বাসের কাৰ্য করেন নাই।

হোসেন। আচ্ছা, তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া দেখি, ইহাতে আমাদিগের অদৃষ্টে যাহাই কেন হউক না।

এই বলিয়া হোসেন সেই স্থান হইতে উঠিয়া পুনরায় দারোগা সাহেবের নিকট গমন করিলেন। প্রহরী হাজতের দরজা পুনরায় বন্ধ করিয়া দিল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

হোসেন দারোগা সাহেবের নিকট প্রত্যাবর্তন করিলে, তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, গোফুর খাঁর সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইয়াছিল কি?

হোসেন। হাঁ মহাশয়। সাক্ষাৎ হইয়াছিল।

দারোগা। তিনি কি বলিলেন?

হোসেন। তিনি আপনার প্রস্তাবে সাত আছেন, কিন্তু অত টাকা এখন দিয়া উঠিতে পারিবেন না।

দারোগা। কত টাকা এখন তিনি প্রদান করিতে সমর্থ হইবেন?

হোসেন। এখন এক লক্ষ টাকা তিনি প্রদান করিতে সমর্থ আছেন।

দারোগা। এত অল্প টাকায় ত আমি এই কাৰ্য শেষ করিতে পারিব না।

হোসেন। দুই লক্ষ টাকা এখন আমাদিগের হস্তে নাই। এখন আমি এক লক্ষ টাকা প্রদান করিতেছি, আসামীদ্বয় মুক্তিলাভ করিবার একমাস পরে বক্রী এক লক্ষ টাকা যেরূপে পারি, সেইরূপে সংগ্রহ করিয়া আপনাকে নিশ্চয়ই প্রদান করিব। তাহার কোন অস্থা হইবে না।

দারোগা। এখন কি এক লক্ষ টাকার অধিক আর কিছুই দিতে পারিবেন না?

হোসেন। নিতান্ত আবশ্যক হয়, আরও কিছু দিতে পারি। আপনার নিকট আমি কোন কথা গোপন করিতেছি না, আমার নিকট এখন এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা আছে, ইহার মধ্যে আপাততঃ আবশ্যক উপযোগী যে কয় হাজার টাকার প্রয়োজন, তাহা রাখিয়া অবশিষ্ট সমস্তই আমি আপনাকে প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। কাৰ্য শেষ হইয়া গেলে, অবশিষ্ট টাকাগুলি আপনাকে আমি প্রদান করিয়া যাইব।

দারোগা। আবশ্যক খরচ-পত্রের নিমিত্ত আপাততঃ আপনি পাঁচ হাজার টাকা আপনার নিকট রাখিয়া দিন। অবশিষ্ট এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা আমাকে প্রদান করুন। আমি আপনার মনিবদ্বয়ের জীবন রক্ষা করিতেছি। অবশিষ্ট টাকা আমাকে সময় মত দিয়া যাইবেন।

হোসেন। সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন। আপনি কি উপায়ে উঁহাদিগের জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ হইবেন, তাহা আমরা এখন জানিতে পারিব কি?

দারোগা। জানিতে পারিবেন বৈ কি। আমি উহা দিগের জীবন রক্ষা করিব বটে; কিন্তু কিছুদিবস উঁহাদিগকে সবিশেষ কষ্ট সহ্ করিতে হইবে।

হোসেন। কিরূপ কষ্ট সহ করিতে হইবে, তাহা আমাকে বলিয়া. দিন।

দারোগা। কেবলমাত্র আপনাকে বলিলে চলিবে না। গোফুর ও ওসমামকে আমি এই স্থানে আনাইতে পাঠাইতেছি; তাঁহারা আসিলে তাহাদিগকে আমি আমার মনের কথা বলিব, তাহাতে যদি উঁহারা সম্মত হন, তাহা হইলে আমি এই কার্যে হস্তক্ষেপ করিব, এবং আমাকে যে অর্থ প্রদান করিতে চাহিতেছেন, তাহা গ্রহণ করিব। নতুবা সেই অর্থে আমি হস্তক্ষেপ করিব না।

হোসেনকে এই কথা বলিয়া দারোগা সাহেব একজন প্রহরীকে ডাকিলেন ও তাহাকে কহিলেন, হাজতের ভিতর যে দুইজন আসামী আছে, তাহাদিগকে আমার নিকট লইয়া আইস।

দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া প্রহরী সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল, এবং অবিলম্বেই গোফুর খাঁ ও তাহার পুত্রকে আনিয়া তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইল। দারোগা সাহেব তাহা দিগকে সেই স্থানে বসিতে বলিলে, অশ্রুপূর্ণ-লোচনে উভয়েই সেই স্থানে উপবেশন করিলেন।

দারোগা। এখন আর রোদন করিবার সময় নাই। আমি আপনাদিগকে যে সকল কথা বলিতেছি, তাহা সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করুন। পরে সবিশেষ বিবেচনা করিয়া তাহার উত্তর প্রদান করুন। আমি আপনাদিগের জীবন রক্ষা করিতে চাহি। ইহাতে আপনাদিগের অভিমত কি?

গোফুর। ইহাতে আমাদিগের আর অভিমত কি হইতে পারে? যখন মৃত্যু নিশ্চয় হইবেই, তখন বাঁচিতে পারিলে আর কে না বাঁচিতে চাহে! আপীলে কিছু হইবে কি?

দারোগা। আপীলে আপনাদিগের জীবন রক্ষা কিছুতেই হইবে না।

গোফুর। তবে কি কোনরূপ যোগাড়যন্ত্র করিয়া লাট সাহেবকে ধরিবেন?

দারোগা। সেরূপ যোগাড়যন্ত্র করিবার ক্ষমতা আমার নাই। করিলেও তাহার নিকট হইতে ক্ষমা পাইবার আশা নাই।

গোফুর। তবে কি আপনি বিলাত আপীলে কিছু করিতে পারিবেন?

দারোগা। সে স্বপ্নেও ভাবিবার কথা নহে। বিলাতের আপীলে কিছু হইবে না, তাহার চেষ্টাও করিব না।

গোফুর। তবে কিরূপে আমাদিগকে বাঁচাইবেন?

দারোগা। উপায় অপর আর কিছুই নহে, উপায়ের মধ্যে কেবল এই আছে যে, যদি আমি আপনাদিগকে ছাড়িয়া দি, তাহা হইলেই আপনাদিগের জীবন রক্ষা হইতে পারে; নতুবা জীবন রক্ষার আর কোন উপায় নাই। যাহা দিগকে ফাঁসি দিবার হুকুম হইয়াছে, তাহাদিগকে অনুসন্ধান করিয়া যদি না পাওয়া যায়, তাহা হইলে আর ফাঁসি হইবে কাহার?

গোফুর। আমাদিগকে যদি ছাড়িয়া দেন, তাহা হইলে আমাদিগকে ধরিয়া আনিয়া ফাঁসি দিবে। তাহা হইলে আমা দিগের জীবন রক্ষা হইল কি প্রকারে?

দারোগা। সেই নিমিত্তই আমি আপনাদিগকে এখানে আনিয়াছি। আপনাদিগকে ছাড়িয়া দিলে, আপনাদিগকে একবারে দেশ পরিত্যাগ করিয়া গমন করিতে হইবে। যে স্থানে আপনাদিগের পরিচিত কোন লোক আছে, সে স্থানে, আপনারা থাকিতে পারিবেন না; বহু দূরবর্তী কোন স্থানে গমন করিয়া আপনাপন নাম পরিবর্তন করিয়া সেই স্থানে আপনাদিগকে বাস করিতে হইবে। আপনার জীবিত আছেন, এ কথা জানিতে পারিলে, আপনাদিগের বড়ই অমঙ্গল হইবে। তাহা হইলে গবর্নমেন্ট পুনরায় আপনাদিগকে ধরিয়া আনিয়া ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইয়া দিবে। এইরূপে স্বদেশ পরিত্যাগ করিয়া কোন স্থানে আপনাপন পরিবারবর্গ লইয়া গিয়া বাস করুন, তাহাতে কিছুমাত্র আপত্তি নাই। কিন্তু যত দিবস আপনারা বাঁচিবেন, ততদিবস না হউক, কিছু দিবস পর্যন্ত আপনাদিগকে লুক্কায়িত অবস্থায় থাকিতে হইবে। বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখুন, এরূপ প্রস্তাবে যদি আপ নারা সম্মত হইতে চাহেন, তাহা হইলে আমাকে বলুন, আমি আপনাদিগকে মুক্তি প্রদান করি।

গোফুর। এ বিষম কথা। এরূপ অবস্থায় আমরা কিরূপে জীবনধারণ করিতে সমর্থ হইব?

হোসেন। অপর কোন উপায়ে যখন আপনাদিগের বাঁচিবার সম্ভাবনা নাই, তখন এই উপায় অবলম্বন না করিলে, আর উপায় কি? আপনি বৃদ্ধ হইয়াছেন, আপনার নিজের জীবনের মায়া তত না থাকিলেও থাকিতে পারে; কিন্তু ইহা ভিন্ন ওসমানের জীবন আর কিরূপে রক্ষা হইতে পারে। যে সকল দেশে এতদিবস বাস করিয়াছেন, সেই সকল দেশে না হয়, আর নাই থাকিলেন। অপর স্থানে গমন করিয়া সেই স্থানে পরিবারগণের সহিত বাস করুন। আমি নিজে পারি, বা অপর কোন লোক রাখিয়া পারি, জমিদারীর বন্দোবস্ত করিব। আবশ্যক হইলে সময় সময় আপনার নিকট গমন করিয়া পরামর্শ গ্রহণ করিব। আপনারা সেই স্থানে বসিয়া বসিয়া জমিদারীর উপসহ ভোগ করিতে থাকিবেন।

গোফুর। এরূপ স্থান আমরা কোথায় পাইব?

হোসেন। এরূপ স্থানের অভাব নাই। অনুসন্ধান করিয়া এত বড় পৃথিবীর ভিতর ওরূপ স্থান আর বাহির করিতে পারিব না?

দারোগা। যদি আপনারা এরূপ প্রস্তাবে সম্মত হন, তাহা হইলে ওরূপ স্থান অনেক পাওয়া যাইবে। আপাততঃ আপনারা কোন প্রধান সহরে গমন করিয়া তথায় বাস করুন। পরিশেষে উপযুক্তরূপ স্থান ঠিক হইলে সেই স্থানে গমন করিবেন।

গোফুর। এমন কোন্ সহর আছে যে, সেই স্থানে আমরা অপরের অজ্ঞাত ভাবে বাস করিতে পারিব?

দারোগা। হয় কলিকাতায় গমন করুন, না হয় বোম্বাই সহরে গিয়া একটা বাড়ী ভাড়া লইয়া আপনাপন নামের ও বাসস্থানের পরিবর্তন করিয়া বাস করুন। কোন কাৰ্য্যের নিমিত্ত আপনারা বাড়ীর বাহিরে গমন করিবেন না, বা পরিচিত কোন লোকের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন না। তাহা হইলে আপনাদিগকে কেহই জানিতে পারিবে না। ইচ্ছা করিলে পরিবারবর্গের সহিতও সেই স্থানে বাস করিতে পারেন। কৈবল দেশ হইতে চাকর-চাকরাণী সঙ্গে গ্রহণ করিবেন না। নূতন স্থানে গমন কর য়। সেই প্রদেশীয় নুতন, চাকর-চাকরাণী নিযুক্ত করিবেন। তাহা হইলে তাঁহারা আপনা দিগের প্রকৃত পরিচয় জানিতে পারিবে না। এইরূপে দুই পাঁচ বৎসর অতিবাহিত করিতে পারিলে, আর সবিশেষ কোনরূপ ভয়ের কারণ থাকিবে না।

গোফুর। তাহা ত হইল, আমরা যেন এইরূপ উপায়ে জীবন রক্ষা করিলাম! কিন্তু দুই দুইটা প্রাণদণ্ডের আসামী ছাড়িয়া দেওয়া অপরাধে আপনার কি হইবে? অবশ্যই তাহার জন্য আপনাকে দণ্ড গ্রহণ করিতে হইবে?

দারোগা। রাজদণ্ডে আমি দণ্ডিত হইতে পারি। এই অপরাধে আমার কারাদণ্ড হইবে, কিন্তু আমার প্রাণদণ্ড হইবে না। আমি কারাবাসে গমন করিয়া যদি দুইজনের জীবন রক্ষা করিতে পারি, তাহা হইলে আমার হাতে কোনরূপ কষ্ট হইবে না। আপনার নিকট হইতে আমি যে অর্থ গ্রহণ করিতেছি, তাহা হইতে আমাকে কুড়ি পঁচিশ হাজার টাকা ব্যয় করিতে হইবে। অবশিষ্ট যাহা থাকিবে, আমার জেল হইলে, তাহার দ্বারা আমার স্ত্রী-পুত্র সকলে জীবনধারণ করিতে পারিবে। অথচ আপনাদিগের কিরূপ উপকার করিতে সমর্থ হইব, একবার তাহা মনে করিয়া দেখুন দেখি।

গোফুর। আমাদিগের জীবন রক্ষা করিবার নিমিত্ত আপ নাকে কারাদণ্ড ভোগ করিতে হইবে, এরূপ উপকার আমি প্রার্থনা করি না। কিন্তু আপনার পরোপকারিতার নিমিত আমি আপনাকে ধন্যবাদ না দিয়া থাকিতে পারিলাম না, ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করি, আপনার মঙ্গল হউক।

দারোগা। আমার নিমিত্ত আপনাকে ভাবিতে হইবে না। সহজে আমাকে কেহ জেলে দিতে পারিবে না। তবে ঈশ্বর

করুন, যদি আমি কোনরূপ গোযোগে পতিত হই, তাহা হইলে হোসেনকে বলিয়া দিন, তিনি যেন আমাকে সবিশেষরূপ সাহায্য করেন, লোকের দ্বারাই হউক, বা অর্থের দ্বারাই হউক।

হোসেন। হোসেন এরূপ নীচ-প্রকৃতিবিশিষ্ট লোক নহে যে, আপনাকে এইরূপ সাহায্য করিবার প্রয়োজন হইলে, মনিবের আদেশ গ্রহণ করিতে হইবে।

দারোগা। এখন আপনাদিগের এখানে আর অধিক বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই। শীঘ্র আপনারা এখান হইতে প্রস্থান করুন। রাত্রির ভিতরেই আপনাদিগকে এতদূরে গিয়া উপস্থিত হইতে হইবে যে, অনুসন্ধান করিয়াও পুনরায় যেন আপনাদিগকে আর পাওয়া না যায়।

হোসেন। আমরা এখন কিরূপ উপায়ে এই স্থান হইতে গমন করিব?

দারোগা। আমি তাহারও বন্দোবস্ত করিয়া দিতেছি।

এই বলিয়া দারোগা সাহেব তাঁহার বিশ্বাসী দুইজন এক্কাওয়ালাকে ডাকাইতে কহিলেন। একজন প্রহরী গিয়া তাহাদিগকে ডাকিয়া আনিলে, দারোগা সাহেব তাহাদিগকে কহিলেন, তোমাদিগের খুব দ্রুতগামী ঘোড় আছে?

এক্কাচালক। আছে।

দারোগা। সমস্ত রাত্রিতে কত ক্লোশ পথ অতিবাহিত করিতে পারিবে?

এক্কাচালক। ত্রিশ ক্রোশের কম নহে। চল্লিশ ক্রোশ যাইলেও যাইতে পারি।

দারোগা। এখান হইতে * * * রেলওয়ে ষ্টেশন পঁয়তাল্লিশ ক্রোশ হইবে, বেলা নয়টার ভিতর সেই ষ্টেশনে ইহাদিগকে পৌছিয়া দিতে হইবে।

এক্কাচালক। ভাড়া কত দিবেন?

দারোগা। কত চাহ?

এক্কাচালক। দুইখানি এক্কায় পনর টাকা করিয়া ত্রিশ টাকা লই।

দারোগা। তাহাই হইবে। তদ্ব্যতীত তোমরা যে কোথায় গিয়াছিলে, কাহাকে লইয়া গিয়াছিলে, এবং কাহার আদেশে গিয়াছিলে, এ কথা কিছুতেই কাহাকেও বলিবে না। ইহার নিমিত্ত তোমাদিগের প্রত্যেককে পঞ্চাশ টাকা করিয়া আরও এক শত টাকা প্রদান করিতেছি। তোমরা তোমাদিগের এক্কা এখনই লইয়া আইস।

দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া একাওয়ালাগণ তাহা দিগের একা আনিবার নিমিত্ত আপন স্থানে গমন করিল। হোসেন এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা দারোগা সাহেবের হন্তে প্রদান করিলেন। দেখিতে দেখিতে এক্কা-চালকগণ আপনাপন একা আনিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। দারোগা সাহেবের আদেশমত হোসেন তাহাদিগের হতে এক শত ত্রিশ টাকা প্রদান করিয়া গোফুর খাঁ, ও ওসমান খাঁ এবং দুইজন পরিচারকের সহিত সেই এক্কায় আরোহণ করিয়া দ্রুতগতি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় ভোগা সাহেব উভয়ের হস্ত হইতে হাতকড়ি খুলিয়া লইয়া হোসেনকে বলিয়া দিলেন, ইহাদিগকে কোন স্থানে রাখিয়া দিয়া, দুই চারিদিবস পরে একবার এখানে আসিয়া এদিকের কিরূপ অবস্থা ঘটে, তাহার সংবাদ লইয়া যাইবেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

গোর খাঁ প্রভৃতি সকলে সেই স্থান হইতে গমন করিলে পর, যে পাঁচজন প্রহরী আসামীদ্বয়কে আনয়ন করিয়াছিল, দারোগা সাহেব তাহাদিগকে ডাকাইলেন। তাঁহারা তাহার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলে, তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, তোমরা যে খুনী মোকদ্দমার আসামীদ্বয়কে আমার থানায়, আনিয়াছ, তাঁহারা কি সমস্ত রাত্রি এই থানায় থাকিবে?

প্রহরী। হাঁ। কল্য প্রত্যুষে আমরা উঁহাদিগকে লইয়া যাইব। দারোগা। তোমরা আসামীদ্বয়কে নিজ জিম্মায় হাজতে রাখিয়াছ, কি আমাদিগের জিম্ম করিয়া দিয়াছ?

প্রহরী। আপনাদিগের জিম্ম করিয়া দিয়াছি। বাবোগা। যে সময় তোময়া আসামীদ্বয়কে এখানে আনিয়াছিলে, সেই সময় আমি থানায় উপস্থিত ছিলাম না; জমাদার সাহেব ছিলেন। তিনি আসামীদ্বয়কে থানার ডায়েরী ভুক্ত করিয়া লইয়াছেন কি?

প্রহরী। বোধ হয়, লইয়া থাকিবেন।

দারোগা। আসামীদ্বয়কে ভালো যে আমাদিগের জিম্মা করিয়া দিয়াছ, তাহার নিমিত্ত তোমরা রসিদ পাইয়াছ কি?

প্রহরী। না।

প্রহরীর এই কথা শুনিয়া জানোপা সাহেব জমাদার সাহেবকে ডাকাইলেন, এবং তাহাকে কহিলেন, খুনী মোকদ্দমার আসামীদ্বয়কে ডায়েরীভূক্ত করিয়া লইয়াছ কি?

জমাদার। লইয়াছি।

দারোগা। তবে সেই আসামীদ্বয়ের নিমিত্ত উঁহাদিগকে রসিদ দাও নাই কেন?

জমাদার সাহেব এখনই রসিদ দিতেছি। এই বলিয়া দারোগা সাহেবের সম্মুখেই একখানি রসিদ লিখিয়া প্রহরী গণকে প্রদান করিলেন।

রসিদ প্রদান করিবার পর দারোগা সাহেব প্রহরীগণকে কহিলেন, তোমরা এখন আসামীর রসিদ পাইয়াছ, আসামী দ্বয়ের নিমিত্ত এখন আর তোমাদিগের জবাবদিহি নাই। এখন তোমরা সন্নিকটবর্তী বাজারে বা সরাইয়ে গমন করিয়া অনায়াসেই সেই স্থানে আহারাদি ও বিশ্রাম লাভ করিতে পার। কল্য প্রাতঃকালে আগমন করিয়া এই রসিদ মামাকে প্রত্যর্পণ পূর্বক তোমাদিগের আসামীদ্বয়কে লইয়া যাইও।

প্রহরী। থানার ভিতর আমাদিগের থাকিতে কোন আপত্তি আছে কি?

দারোগা। আপত্তি কিছুই নাই। তবে আমার থানায় স্থান অতি সঙ্কীর্ণ, নিরর্থক কষ্ট সহ্ করিয়া এই স্থানে থাকি বার কোন প্রয়োজন নাই। বাজারে থাকিবার উত্তম স্থান আছে। এই থানায় একজন প্রহরীকে সঙ্গে লইয়া যাও। সে তোমাদিগকে উৎকৃষ্ট স্থানে রাখিয়া আসিবে। ইহাতে তোমাদিগের কোনরূপ ব্যয় হইবে না, অথচ সুখে থাকিতে পারিবে।

এই বলিয়া নোগা সাহেব তাহার থানার একজন প্রহরীকে ডাকিলেন, এবং তাহার সমভিব্যাহারে সেই প্রহরী পাঁচজনকে বাজারে পাঠাইয়া দিলেন ও বলিয়া দিলেন, ইহাদিগের আহারাদি করিতে যাহা কিছু ব্যয় হইবে, তাহা যেন দোকানদার প্রহরীগণের নিকট হইতে গ্রহণ না করিয়া আমার নিকট হইতে লইয়া যায়।

প্রহরীগণ সেই স্থান হইতে গমন করিলে পর, দারোগা সাহেব জমাদার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমাদিগের এই থানায় প্রহরীর সংখ্যা দশজন, তাঁহারা সকলেই থানায় উপস্থিত আছে কি?

জমাদার। না; তিনজন আজ দুইদিবস হইল, দুইজন আসামী লইয়া সদরে গমন করিয়াছে।

দারোগা। তাহাদিগের ফিরিয়া আসিতে কয় দিবস হইবে?

জমাদার। চারি পাঁচদিবসের কম তাঁহারা ফিরিয়া আসিতে পারিবে না।

দারোগা। আর সাতজন? : জমায়। তাহাদিগের মধ্যে তিনজন উপস্থিত আছে। একজন আপনার সহিত গমন করিয়াছিল, সেও এখন থানায় উপস্থিত আছে; কিন্তু উপস্থিত বলিতে পারিতেছি না।

কারণ, আপনি বা আপনার সঙ্গিবাহারী সেই প্রহরী ফিরিয়া আসিয়াছেন, তা এখনও জায়েরীভূক্ত হয় নাই।

দারোগা। আমি প্রহরীর সহিত সফল হইতে ফিরি আসিয়াছি, ইহা ডায়েরীভূক্ত করিয়া লও, এবং তোমার নিকট থানার চার্জ ছিল, তাহা আমাকে দেওয়া হইল, ইহাও চায়েরীতে লিখিয়া লও।আরও লিখি ক্লখ যে, থানায় যে দুইজন খুনী মোকদ্দমার আসামী আছে, তাহাও থানার চার্জের সহিত আমার জিম্মায় দেওয়া হইল।

জাবোগা সাহেবের কথা শুনিয়া জমাদার সাহেব তাহাই লিখিয়া ডায়েরী পুস্তক আনিয়া তাহাকে দেখাইলেন। তিনিও দেখিয়া আসামীর সহিত খাবার চার্জ পুনঃ প্রাপ্তিস্বীকার লিখিয়া দিলেন; এবং জমাদার সাহেবকে কহিলেন, তিন জন কনষ্টেবলের সহিত তুমি রোদগন্তে গক্ষন কর। ইহা ষ্টেশন ডায়েরীতে লিখিয়া রাখিয়া তোমরা এখনই খানা হইতে বহির্গত হইয়া যাও। অবশিষ্ট চারিজন প্রহরী কেবল মাত্র পানায় আমার সহিত অবস্থিতি করুক।

দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালিত হইল। জমাদার সাহে তিনজন কনষ্টেবলের সহিত আপনাকে ষ্টেশন ডায়েরীতে খরচ লিখিয়া থানা হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন।

জমাদার সাহেব থানা হইতে কহির্গত হইয়া যাইব কিয়ৎক্ষণ পরেই, আমোগা সাহেব, যে প্রহরী চারিজন থানায় উপস্থিত ছিল, তাহাদিগকে তাকাইলেন, তাহাদিগের মধ্যে যে অল্পদিবসের চাকর, তাহাকে কহিলেন,  তোমার কয় বৎসর চাকরী হইয়াছে?

১ম প্রহরী। বার বৎসর হইবে।

দারোগা। তোমার বয়ঃক্রম এখন কত হইয়াছে?

১ম প্রহরী। চলিশ বৎসর হইবে।

দারোগা। তবে তুমি আরও পনর বৎসর চাকরী করিবে।

১ম প্রহরী। যদি শরীর ভাল থাকে, বা আপনারা যদি অনুগ্রহ করেন।

দারোগা। তোমার বেতন এখন কত?

১ম প্রহরী। সাত টাকা।

দারোগা। আর কত বাড়িতে পারে, আশা কর? ১ম প্রহরী। আর কতই বাড়িবে, জোর আট টাকা হইবে।

দারোগা। আট টাকার হিসাবে, তোমার এক বৎসরের বেতন হইতেছে-ছিয়ানব্বই টাকা।

১ম প্রহরী। যাহা হয়।

দারোগা। তাহা হইলে তোমার পনর বৎসরের বেতন হইতেছে, এক হাজার চারি শত চল্লিশ টাকা।

১ম প্রহরী। হিসাবে যাহা হয়।

দারোগা। আর পনর বৎসর পরে যদি তুমি পে নাও, এবং সেই সময় যদি তোমার বেতন আট টাকা হয়, তাহা হইলে তুমি মাসিক চারি টাকা হিসাবে পেন্‌সন পাইতে পারিবে।

১ম প্রহরী। তাহাই হইবে।

দারোগা। তাহা হইলে বৎসরে তোমার পেন্ন্ হইবে আটচল্লিশ টাকা কেমন?

১ম প্রহরী। হ মহাশয়!

দারোগা। যখন তোমার বয়স পঞ্চান্ন বৎসর হইবে, সেই সময় তোমার পেন্‌সন হইবে। পেন্‌সন হইবার পর, তুমি আর কতদিবস বাঁচিবে।

১ম প্রহরী। তাহা কে বলিতে পারে। দশ বৎসরও বচিতে পারি।

দারোগা। দশ বৎসর কেন, যদি তুমি পনের বৎসরও বাঁচ, তাহা হইলে পেন্‌সন-বাবুদ তুমি সাত শত কুড়ি টাকা পাইতে পার। কেমন না?

১ম প্রহরী। হাঁ মহাশয়।

দারোগা। তাহা হইলে আজ হইতে তুমি যে পর্যন্ত বাঁচিবে, তাহাতে তুমি দুই হাজার এক শত ষাট টাকা বেতন বা পেন্‌সন পাইবে।

১ম প্রহরী।

দারোগা। এখন তোমাদিগকে একটা কাৰ্য্য করিতে হইবে। সেই কাৰ্য্য করিলে হয় ত তোমাদিগের চাকরী যাইলেও যাইতে পারে; কিন্তু আমি যেরূপ ভাবে কাৰ্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাহাতে চাকরী না যাইবারই সম্ভাবনা। তথাপি তাহা অগ্ৰেই ধরিয়া লও। ধরিয়া লও, এই কাৰ্যে তোমাদিগের চাকরী গেলে, তোমাদিগের প্রত্যেকের দুই হাজার এক শত ষাট টাকার অধিক ক্ষতি হইবে না, কেমন?

সকল প্রহরী। উহার অধিক আর কি করিয়া ক্ষতি হইবে?

দারোগা। সেই টাকা আমি তোমাদিগকে এখনই এক বারে প্রদান করিতেছি, গ্রহণ কর। তদ্ব্যতীত আমার কাৰ্য্যের নিমিত্ত তোমাদিগকে আরও কিছু আমি প্রদান করিতেছি, অর্থাৎ তোমাদিগের প্রত্যেককে আমি তিন হাজার করিয়া টাকা প্রদান করিতেছি, গ্রহণ করিয়া আমার কাৰ্য্যে হত্যার্পণ কর।

এই বলিয়া দারোগা সাহেব প্রত্যেককে তিন হাজার করিয়া চারিজনকে মোট বার হাজার টাকা প্রদান করিলেন এবং কহিলেন, কেমন, এখন তোমরা আমার কাৰ্য্য করিতে প্রস্তুত আছ?

প্রহরীগণ। আমরা সকল সময়েই আপনার কাৰ্য্য করিতে প্রস্তুত। এখন আমাদিগকে কি করিতে হইবে বলুন।

দারোগা। আর কিছুই করিতে হইবে না। এখন তোমরা গোরস্থানে গমন করিয়া আজ যে সকল মৃতদেহ মাটি দেওয়া হইয়াছে, তাহার মধ্য হইতে দুইটী দেহ উঠাইয়া আন। কেমন পারিবে ত?

প্রহরীগণ। এই সামান্য কাৰ্য্য আর পারিব না?

দারোগা। এ কাৰ্য্য সামান্য নহে। কারণ, এই কার্যের নিমিত্ত তোমরা অপর কাহারও সাহায্য গ্রহণ করিতে পারিবে না। নিজ হন্তে খনন করিয়া তোমাদিগকে সেই স্থান হইতে মৃতদেহ উঠাইতে হইবে, এবং নিজেই উহা বহন করিয়া আনিতে হইবে।

প্রহরীগণ। আমরা চারিজন আছি। সুতরাং এ কার্যের নিমিত্ত আমাদিগকে আর কাহারও সাহায্য গ্রহণ করিতে হইকেনা; অনায়াসেই এ কাৰ্য আমরা সম্পন্ন করিতে পারি। স্ত্রীলোকের মৃতদেহ না, পুরুষের মৃতদেহ আবশ্যক?

দারোগা। স্ত্রীলোকের মৃতদেহ আবশ্যক নহে, পুরুষের মৃতদেহের প্রয়োজন।

প্রহরী। ইহার জন্য আর ভাবনা নাই। আজ দিবা ভাগে আমি একবার গোরস্থানে গিয়াছিলাম, আমার সম্মুখ চারিটী পুরুষের মৃতদেহ মাটি দেওয়া হইয়াছে। উহা হইতে অনায়াসেই আমরা দুইটা উঠাইয়া আনিতে পারি।

দারোগা। যে কবর হইতে মৃতদেহ উঠাইয়া লইবে, মৃত্তিকা দিয়া সেই কবর পুনরায় পূর্ণ করিয়া দেওয়া আবশ্যক।

৩য় প্রহরী। এ কথা কি আর আমাদিগকে আপনার বলিয়া দিতে হইবে?

দারোগা। তোমরা বুদ্ধিমান, তাহা আমি জানি। তথাপি যদি ভুলিয়া যাও, এই নিমিত্ত পূর্ব হইতেই তোমাদিগকে সতর্ক করিয়া দিতেছি।

৪র্থ প্রহরী। সেই মৃতদেই আমরা কোথায় আনিব?

দারোগা। এই স্থানেই আনিবে, এই থানার ভিতরেই আনিবে।

এই কথা শুনিয়া সকলে টাকাগুলি আপন আপন বাক্সে বন্ধ করিয়া দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালনার্থ গমন করিল। যাইবার সময় দারোগা সাহেব কহিলেন, তোমরা তোমাদিগের যে সকল টাকা আপনাপন বাক্সে বন্ধ করিয়া রাখিলে, মৃতদেহ আনিবার পর সেই টাকা সেই স্থানে রাখিও না; বাক্স হইতে বাহির করিয়া আপনাদিগের সঙ্গেই রাখিও। রাখিবার সুবিধা হইবে বলিয়াই, নগদ টাকার পরিবর্তে আমি তোমাদিগকে নোট প্রদান করিয়াছি।

প্রহরীগণ থানা হইতে প্রস্থান করিলে পর, অনেকক্ষণ পৰ্য্যন্ত দারোগা সাহেব বসিয়া বসিয়া; নানারূপ ভাবিতে লাগিলেন। পরিশেষে নিজেও থানা হইতে বহির্গত হইয়া সেই গোন অভিমুখে গমন করিলেন।

সেই স্থানে গমন করিয়া দেখিলেন, তাঁহার প্রেরিত প্রহরীগণ প্রায় কাৰ্য শেষ করিয়া আনিয়াছে। একটা মৃতদেহ কবর হইতে বাহির করিয়া উপরে রাখিয়াছে, অপরটী কয়ে ভিতরেই আছে। কিন্তু তাহার মৃত্তিকা খনন করা হইয়াছে।

এই অবস্থা দেখিয়া ফারোগা সাহেব পুনরায় থানায় প্রত্যা বৰ্তন করিলেন। তাঁর আসিবার কিয়ৎক্ষণ পরেই প্রহরীগণ দুইট মৃতদেহের সহিত উপস্থিত হইল। আসিয়া দারোগা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিল, এই মৃতদেহ কোথায় রাখিয়া দিব?

উত্তরে দারোগা সাহেব কহিলেন, উভয় মৃতদেহই হাজতের ভিতর রাখিয়া দেও! প্রহরীগণ তাহাই করিল। তখন তিনি তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কবর হইতে মৃতদেহ উঠাইবার সময় বা উহা বহন করিয়া থানায় আনিবার সময়, অপর আর কেহ দেখিয়াছে কি?

উত্তরে প্রহরীগণ কহিল, না মহাশয়! কেহই দেখে নাই। দেখিলেও, যেরূপ ভাবে আমরা উঁহাদিগকে আনিয়াছি, তাহাতে কেহই কোনরূপ সন্দেহ করিতে পারিবে না।

দারোগা। যাহা হউক, আমরা পাঁচজন ব্যতীত এই মৃতদেহের কথা আর কেহই অবগত নহে। সাবধান! এ কথা কোনরূপে যেন কেহই জানিতে না পারে। অপরে জানিতে পারিলে, আমারও চাকরী থাকিবে না, তোমাদিগেরও চাকরী থাকিবে না। অধিকন্তু জেলে যাইতে হইবে।

প্রহরীগণ। না মহাশয়। এ কথা কেহই জানিতে পারিবে না। আমাদিগের বুকে বাঁশ দিয়া ডলিলেও আমরা এ কথা কিছুতেই প্রকাশ করি না।

ইহার পর দারোগা সাহেব গোফুর খাঁ ও ওসমানের হস্তে যে হাতকড়ি ছিল, এবং উহা প্রস্থান করিবার সময় তিনি যে হাতকড়ি খুলিয়া রাখিয়াছিলেন, সেই হাতকড়ি লইয়া হাজত-গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলেন, এবং মৃতদেহদ্বয়ের দুই হতে সেই হাতকড়ি লাগাইয়া দিলেন। পরিশেষে হাজতের বাহিরে আসিয়া হাজত-গৃহের তালা বাহির হইতে বন্ধ করিয়া দিলেন। আসামীদ্বয় হাজিত-গৃহে থাকিবার সময় সেই হাজত গৃহের বাহিরে যেরূপ ভাবে প্রহরীর পাহারা ছিল, সেই চারিজন প্রহরীকেই সেইরূপ ভাবে পাহারায় নিধুক্ত করিয়া রাখিলেন। এই সকল কাৰ্য শেষ করিতে রাত্রি বারটা বাজিয়া গেল।

রাত্রি আন্দাজ তিনটার সময়, থানার বাটীর দুই তিন স্থানে একবারে ধু ধু করিয়া আগুন জ্বলিয়া উঠিল, হাজত গৃহ জ্বলিতে লাগিল। তিনজন প্রহরী সেই সময় থানার ভিতর শয়ন করিয়াছিল, কেবলমাত্র একজন প্রহরী হাজতের সম্মুখে পাহারায় নিযুক্ত ছিল। কিরূপে থানার চতুর্দিকে এক বারে অগ্নিময় হইল, তাহা সেই প্রহরী কিছুমাত্র জানিতে না পারিয়া যেমন চীৎকার করিয়া উঠিল, অমনি সম্মুখে দারোগা সাহেবকে দেখিতে পাইল।

দারোগা তাহাকে কহিলেন, চুপ কর। অপর প্রহরী গণকে শীঘ্র উঠাইয়া দেও, এবং আফিসের কাগজপত্র যদি কি বাহির করিতে পার, তাহার চেষ্টা কর। হাজত-গৃহের চাবি আমাকে প্রদান কর। ইহার পর চাবি-সম্বন্ধে যদি কোন কথা উঠে, তাহা হইলে এইমাত্র বলিও, থানায় আগুন লাগিতে দেখিয়াই আমি দ্রুতপদে দারোগা সাহেবকে সংবাদ দিতে গিয়াছিলাম, সেই সময় হাজতের চাবু আমার হস্ত হইতে সে কোথায় পড়িয়া যায়, তাহার কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। পরিশেষে আমি ও দারোগা সাহেব হাজতের দরজা ভাঙ্গিয়া আসামীদ্বয়কে বাহির করিবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিলাম; কিন্তু কোনরূপেই সেই দরজা ভাঙ্গিয়া উঠিতে পারিলাম না। দেখিতে দেখিতে থানার সহিত হাজত গৃহ ভষ্মে পরিণত হইয়া গেল। অপর প্রহরীগণ তাহাদিগের সাধ্যমত সরকারী কাগজ-পত্র অনেকগুলি বাহির করিয়াছিল, কিন্তু সমস্ত বাহির করিয়া উঠিতে পারে নাই।

থানা গ্রামের বাহিরে। গ্রাম হইতে লোকজন আসিতে আসিতে হাজত-গৃহের সহিত সেই থানা ভস্মে পরিণত হইয়া গেল। দশ পনর মিনিটের মধ্যে সেই থানার আর কিছু মাত্র চিহ্নও রহিল না।

থানায় হঠাৎ আগুন লাগিয়া, দুইজন আসামীর সহিত উহা ভস্মে পরিণত হইয়াছে এই সংবাদ উর্ধতন কর্ম্মচারী গণের কর্ণগোচর হওয়ায়, তাঁহারা আসিয়া ইহার অনুসন্ধান করিলেন। কিরুপে থানায় অগ্নি লাগিল, তাহার কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না। কিন্তু ইহা সাব্যস্ত হইল যে, কোন ব্যক্তি উহাতে অগ্নি প্রদান করিয়াছে। তাঁহারা সেই দগ্ধাবশিষ্ট মৃতদেহদ্বয়কে হাতকড়ির দ্বারা আবদ্ধ দেখিয়া, ইহাই স্থির করিলেন যে, গোফুর খাঁ ও তাঁহার পুত্র ওসমান অগ্নিদাহে প্রাণত্যাগ করিছে। প্রমাণে আসল কথা কিছু বাহির হইল না। কেবল দারোগা সাহেব এবং সেই সময় যে সকল প্রহরী থানীয় উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের অসাবধানতা বশতঃ থানায় আগুন লাগিয়াছে, এই অপরাধে তাঁহারা কৰ্ম্মচ্যুত হইল মাত্র। এদিকে গোফুর খাঁ ও ওসমান দূরদেশে লুক্কায়িত অবস্থায় কালযাপন করিতে শাগিলেন। কিন্তু কিছু দিবস পরে লোকমুখে প্রকাশ হইয়া পড়িল যে, তাঁহারা পুড়িয়া মরেন নাই, এখনও জীবিত আছেন। অনুসন্ধানে তাহার কতক প্রমাণও হইল, কিন্তু কর্ম্মচারীগণ জেলে যাইতে পারে, এরূপ কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না।

 ছেলে-ভুল

ছেলে-ভুল (অর্থাৎ অপহৃত বালক উদ্ধারের অদ্ভুত রহস্য!)
DETECTIVE STORIES No. 79. দারোগার দপ্তর ৭৯ম সংখ্যা।
ছেলে-ভুল
(অর্থাৎ অপহৃত বালক উদ্ধারের অদ্ভুত রহস্য!)
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে শ্রী বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। কার্তিক।
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta,

ছেলে-ভুল।
প্রথম পরিচ্ছেদ।

ছেলে-ভুল, এই কথা শুনিয়া পাঠকগণ ত একবারেই চমকাইয়া উঠিবেন, পাঠিকাগণের ত কথাই নাই। ছেলে কুল, কি ভয়ানক কথা! যাহার পুত্র আছে, যাহার হৃদয়ে পুত্রস্নেহ একদিবসের নিমিত্তও প্রবেশ লাভ করিয়াছে, তাহাকেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে, ছেলেকে কি কখন ভুল হইতে পারে? আপন পুত্রকে পিতামাতা কি কখনও ভুল করিতে পারেন। তবে এক কথা এই হইতে পারে যে, কোন পিতামাতার পুত্র নিতান্ত শৈশবকালে যদি কাহারও দ্বারা অপহৃত হয়, বা সংসারচক্রের দুষ্পরিহার্য ঘটনাবলীর মধ্যে পড়িয়া, যদি কেহ আপনার প্রাণের রত্নকে হারান, এবং বহু বৎসর পরে যদি সেই পুত্রকে হঠাৎ দেখিতে পান, তাহা হইলে হয় ত পিতামাতা আপনার সেই প্রাণধনকে সহজে চিনিয়া উঠিতে পারেন না। কিন্তু একবারেই যে চিনিয়া উঠিতে পারেন না, তাহাও আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতে সাহসী হই না। যে ছেলে-ভুলের বৃত্তান্ত আজ আমি পাঠকগণের সম্মুখে উপস্থিত করিতেছি, উহা কি তবে সেই প্রকারের ছেলে-ভুল? না, তাহা নহে। এ ছেলে-ভুলের অবস্থা যেরূপ, তাহা পাঠক-পাঠিকাগণ সহজে বিশ্বাস করিতে চাহিবেন না, টিটকারী দিয়া আমার কথা উড়াইয়া দিবেন, এবং আপনা দিগের মধ্যে পরস্পর বলাবলি করিবেন, ইহা কখনই হইতে পারে না; সম্পূর্ণরূপে ইহা অসম্ভব।

ইহা সম্ভবপর হউক, বা না হউক, পাঠক-পাঠিকাগণ আমার কথায় বিশ্বাস করুন, বা না করুন, যাহা ঘটিয়াছে, যাহা দেখিয়াছি, যাহা অনুসন্ধান করিয়াছি, তাহাই আজ সকলের সম্মুখে বলিতেছি। যাহার ইচ্ছা হয়, বিশ্বাস করিবেন, যাহার ইচ্ছা না হয়, তিনি বিশ্বাস না করিতে পারেন; কিন্তু যাহারা এই ঘটনা বিশ্বাস না করিবেন, তাঁহাদিগের নিকট আমার একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে। তিনি বাল্যকাল হইতে এ পর্যন্তু বর্তমান মানব-চরিত্র অধ্যয়ন করি। আসিতেছেন কি? বিশেষতঃ এতদঞ্চলের মানবগণের আচার কবহার, কাৰ্য-কলাপ প্রভৃতি আপনি বাল্যকালে যেরূপ দেখিয়া আসিয়াছিলেন, এখন আপনি তাহার কিছুমাত্র পরিবর্তন বুঝিয়া উঠিতে পারিয়াছেন কি? বলুন দেখি, পূর্বকালে সন্তান প্রতিপালনের ভার কাহার উপর ছিল? সন্তান জন্ম গ্রহণের পর হইতে তাহার মনুষ্যত্ব প্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত, কাহার দ্বারা সে লালিত-পালিত হইত? কাহার যত্নে বর্জিত হইত? যতদিবস পৰ্য্যন্ত বালক স্তনদুগ্ধ পান করিত, ততদিবস পৰ্য্যন্ত মাতা কি তাহাকে আপন ক্রোড়ের বহির্ভাগে গমন করিতে দিতেন? অপরের স্তনদুগ্ধ কোন্ মাতা শিগুগণের উদরে সহজে প্রবেশ করাইতে সম্মত হইতেন? সে সময়ের জননীমাত্রেই অশিক্ষিত ছিলেন, পাশ্চাত্য-শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাদিগের হৃদয়ে পাশ্চাত্যভাব তখন প্রবেশ করিয়াছিল না। সুতং তাঁহারা অশিক্ষিতা ছিলেন, তাহাদিগের বুদ্ধির লেশমাত্রও ছিল না, তাই তাঁহারা সামান্য ধাত্রীর কাৰ্য করিয়া, আপন আপন পুত্রকে প্রতিপালন করিতেন; তাই তাঁহারা আপন সন্তানকে ক্রোড়ের বাহির হইতে দিতেন না; তাই তাঁহারা দাসদাসীগণের উপর বিশ্বাস করিয়া, তাহাদিগের হস্তে আপন আপন বহুমূল্য রত্ন কখনই প্রদান করিতে সাহসী হইতেন না। সুতরাং ছেলে-ভুল এ কথা কখনও শুনিতে পাওয়া যাইত না।

আর এখন পাশ্চাত্য-সভ্যতা আমাদিগের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছে। স্ত্রীগণ শিক্ষিত (?) হইয়া, বা শিক্ষিত হইয়াছেন এই ভান করিয়া দেশের মুখোজ্জল করিতেছেন! তাই মধ্যে মধ্যে এখন ছেলে-ভুল হইয়া থাকে। তাহাদিগের বিবেচনায় এখন গর্ভধারণের অন্যরূপ ব্যবস্থা হইলেই ভাল হইত; কিন্তু স্বভাবের নিয়ম একবারে পরিবর্তিত হইবার সম্ভাবনা নাই বলিয়াই, এই ভয়ানক যন্ত্রণা হা দিগকে সহ্য করিতে হইতেছে! তবে সন্তান প্রসুত হইবার পর, আর তাঁহাদিগের কোনরূপ কষ্ট থাকে না। সন্তান ভূমিষ্ট হইল, তিনিও তাহাকে চাকর-চাকরাণীর হস্তে সৰ্পণ করিয়া, যাহাতে নিজের মনকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারেন, তাহার চেষ্টায় নিযুক্ত হইলেন। ভৃত্যগণই সন্তানের লালনপালনে নিযুক্ত হইল। মাতৃ-স্তনদুগ্ধের পরিবর্তে গর্দভীদুগ্ধে তাহাদের জীবন রক্ষা হইতে লাগিল। মাতৃ স্নেহের পরিবর্তে নীচ-বংশোদ্ভাবা অসচ্চরিত্রা পরিচারিকার স্নেহের সন্তান পরিবর্ধিত হইতে লাগিল। এরূপ অবস্থায় স্নেহময়ী জননী, তাঁহার স্নেহময় পুত্রকে ভুল না করিবেন ত কাহাকে ভুল করিবেন? অবশ্য এরূপ অবস্থা এখন পর্যন্ত সকলের গৃহে প্রবেশ করে নাই। পূৰ্বে নিয়মানুসারে এখনও কোন কোন প্রসূতি আপন আপন সন্তান প্রতিপালন করিয়া থাকেন সত্য; কিন্তু আরও কিছুদিবস পরে, বা তাহাদের অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আরও যে কি হইবে, তাহা ভাবিয়া উঠিতে পারি না। এখন যাঁহাদের অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে, যাহারা পাশ্চাত্য-শিক্ষার অভিমানে অভিমানী হইয়াছেন, কমলা যাহার উপর কৃপানেত্রে দৃষ্টি করিয়াছেন, এক কথায় আজকাল যাঁহারা সভ্য এবং বড়মানুষ, তাহাদিগের মধ্যে অধিকাংশের গৃহেই এইরূপ ঘটনা ঘটিতেছে। তাহাদিগের ছেলে যদি ভুল না হইবে, তবে আর কাহাদিগের হইবে?

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

একদিবস বৈকালে আমাদিগের পুলিসের সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর স্বহস্তলিখিত একখানি পত্ৰ আসিয়া আমার হস্তে পতিত হইল। তাঁহারই একজন চাপরাশী সেই পত্রখানি আনিয়া, আমার হস্তে প্রদান করিয়া চলিয়া গেল। খামখানি খুলিয়া দেখিলাম, উহার ভিতর একখানি টেলিগ্রাম। সেই টেলিগ্রামের উপর সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর আদেশ,—ইহা পাঠমাত্র কলিকাতার যে ঘাটে তমলুকের জাহাজ আসিয়া উপস্থিত হয়, সেই ঘাটে, গমন করিয়া, টেলিগ্রামে লিখিত বালকের অনুসন্ধান কর, এবং কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যায় কি না, তাহা সন্ধ্যার পর আমাকে রিপোর্ট করিও।

টেলিগ্রামের উপর সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর আদেশ পাঠ করিয়া, তাহার পরে টেলিগ্রামখানি পাঠ করিলাম। দেখিলাম, কলিকাতার একজন সম্রান্ত লোক মফঃসল হইতে এই টেলিগ্রাম পুলিসের সর্ব প্রধান কর্ম্মচারীর নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। সেই টেলিগ্রামের মৰ্ম্ম এইরূপ —আমরা সপরিবারে একখানি জাহাজে তমলুক হইতে উলুবেড়িয়ায় আসিয়া উপস্থিত হই। জাহাজ হইতে নামিবার পর দেখিলাম, আমার এক বৎসর বয়স্ক পুত্রকে জাহাজে ভ্ৰম ক্রমে ফেলিয়া আসিয়াছি। সেই সময় জাহাজও উলুবেড়িয়া হইতে ছাড়িয়া দিয়াছিল। সুতরাং সেই জাহাজ ধরিয়া আমরা আমার পুত্রকে কোনরূপে আনিতে সমর্থ হইলাম না। আমার পুত্রটীর অঙ্গে প্রায় দুই সহস্র মূল্যের অলঙ্কার আছে। কোনরূপ সুযোগ করিয়া আমি এই টেলিগ্রামখানি আপনার নিকট পাঠাইতেছি, জাহাজে অনুসন্ধান করিলেই, আমার বালকটীর অনুসন্ধান হইবার সম্ভাবনা। আমরাও যতশীঘ্র পারি, কলিকাতায় গিয়া উপস্থিত হইয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।

টেলিগ্রামের মর্ম অবগত হইয়া আমি আর কিছুমাত্র বিলম্ব করিতে পারিলাম না। একখানি গাড়ি আনাইয়া তৎক্ষণাৎ আর মানি ঘাটাভিমুখে প্রস্থান করিলাম। ঘাটে উপস্থিত হইয়া জানিতে পারিলাম, এখন পর্যন্ত তমলুকের জাহাজ আসিয়া কলিকাতায় উপস্থিত হয় নাই।

আমি আরও কয়েকজন লোক সংগ্রহ করিয়া আরমানিঘাটে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। জাহাজ সম্বন্ধীয় কর্ম্মচারীগণ যাহারা সেই সময় সেই ঘাটে উপস্থিত ছিল, তাঁহারাও আমার সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

ক্রমে জাহাজ আসিয়া উপস্থিত হইল। জেটিতে জাহাজ ভিড়া ইয়া নঙ্গর করা হইলে, আমরা সর্বাগ্রে গিয়া জাহাজে উঠিলাম। জাহাজে যে সকল আরোহী ছিল, তাঁহারাও ক্রমে জাহাজ হইতে অব তরণ করিতে আরম্ভ করিল। যে সকল আরোহীর সহিত ছোট ছোট বালক ছিল, তাহাদিগকে প্রথমে আমরা জাহাজ হইতে অবতরণ করিতে দিলাম না। যাহাদিগের সহিত কোন শিশুসন্তান ছিল না, তাঁহারাই প্রথমে জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়া গেল। উঁহাদিগকে যতদূর সম্ভব অলঙ্কার-ভূষিত সেই বালকের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু কেহই কোনরূপ সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে পারিল না। এইরূপে যাহাদিগের নিকট শিশুসন্তান ছিল না, তাহার জাহাজ হইতে প্রস্থান করিলে পর, যাহাদিগের সহিত শিশুসন্তান ছিল, তাহাদিগকে এক এক করিয়া যাইতে দেওয়া হইল। তাহাদের গমন করিবার সময় তাহাদিগের সমভিব্যাহারে যে সকল শিশুসন্তান ছিল, তাহাদিগের সম্বন্ধে যতদূর জানিয়া লইবার সম্ভাবনা, তাহা জানিয়া লইয়া, এবং উঁহারা উঁহাদিগের যে সকল থাকিবার ঠিকানা প্রদান করিল, তাহা লিখিয়া লইয়া উঁহাদিগকেও যাইতে দিলাম। এক এক করিয়া তাঁহারা সকলেই প্রস্থান করিল। কিন্তু যে বালকের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি সেই স্থানে গমন করিয়া ছিলাম, সেই বালক সম্বন্ধে কোন ব্যক্তিই কোন কথা বলিতে পারিল না, বা যে সকল বালককে লইয়া তাহাদিগের পিতামাতা আমাদিগের সম্মুখে জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়া চলিয়া গেল, তাহাদিগের কোন শিশুর অঙ্গে কোনরূপ মূল্যবান্ অলঙ্কারও দেখিতে পাইলাম না।

এইরূপে সমস্ত আরোহী জাহাজ হইতে প্রস্থান করিলে পর, আমরা জাহাজের সমস্ত স্থান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরার ভিতর খুঁজিয়া দেখিলাম, যে সকল স্থানে জাহাজের খালাসিদিগের জিনিষপত্র থাকে, বা জাহাজের যে সকল স্থানে তাহাদিগের যাতায়াত আছে, সেইসকল স্থানওউত্তমরূপে অ সন্ধান করিলাম; কিন্তু কোন স্থানে সেই এক বৎসর বয়স্ক বালকের বা তাহার পরিহিত অলঙ্কারের কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না। তখন আর কি করি, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে না পারিয়া, জাহাজের সারেংকে ডাকাইলাম। সে আমাদিগের নিকট আগমন করিলে, তাহাকে সেই টেলিগ্রাম দেখাইলাম, এবং তাহাকে সমস্ত কথা বুঝাইয়া বলিলাম। বৃদ্ধ সারেং জাতিতে মুসলমান হইলেও, তাহাকে বেশ ভদ্রলোক বলিয়া অনুমান হইল। সে তাহার অধীনস্থ সমস্ত খাসি বা জাহাজের অপরাপর ভৃত্যগণকে একত্র করিয়া আমাদিগের সম্মুখেই অনুসন্ধান আরম্ভ করিল। তাহার অনুসন্ধানে আমরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অবগত হইতে পারিলাম।

১ম। দাসদাসী ও পরিবারবর্গ লইয়া দুই তিনটী ভদ্রলোক তমলুকে এই জাহাজে আরোহণ করেন।

২য়। তাঁহাদিগের সহিত একটী পরিচারিকার ক্রোড়ে একটা এক বৎসর বয়স্ক বালক ছিল।

৩য়। উহার অঙ্গে অনেকগুলি অলঙ্কার ছিল।

৪র্থ। তাঁহারা প্রথম শ্রেণীর একখানি কামরা ভাড়া করেন।

৫ম। সেই কামরার ভিতর স্ত্রীলোকগণ ছিলেন।

৬ষ্ঠ। চাকর-চাকরাণী কয়েকজন সেই কামরার বাহিরে ছিল।

৭ম। বাবুরা সকলে প্রথম শ্রেণীর খোলা জায়গায় এক এক খানি চেয়ার ও মোড়া লইয়া বসিয়াছিলেন।

৮ম। তাঁহারা কে, কোথা হইতে আসিতেছেন, তাহা কেহই অবগত নহে। কেবল এইমাত্র জানিতে পারা গেল যে, উঁহারা তমলুকে জাহাজে উঠিয়াছিলেন।

৯ম। তাঁহারা সকলে উলুবেড়িয়ার ঘাটে অবতরণ করেন।

১০ম। সেই সময় তাঁহারা অলঙ্কার-ভূষিত বালকটীকে লইয়া জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়াছিলেন কি না, কেহ বলিতে পারেনা।

জাহাজের সারেংয়ের সাহায্যে এই কয়েকটামাত্র বিষয় অবগত হইয়া, ক্ষুণ্ণ মনে আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম; এবং আদেশমত আমার সর্বপ্রধান কৰ্মচারীর নিকট গমন করিয়া, যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহা তাহার নিকট আদ্যোপান্ত বর্ণন করিলাম। আমার কথা শুনিয়া তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, সেই বালকের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই, এবং যেরূপ অবস্থা, তাহাতে সহজে যে উহার কোনরূপ অনুসন্ধান হইবে, তাহার সম্ভাবনাও নিতান্ত অল্প। তথাপি যাহাতে আমি সেই বালকের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি, এবং তাহার পরি হিত বহুমূল্য অলঙ্কারগুলির কোনরূপ উদ্ধার করিতে যাহাতে আমি সমর্থ হই, তাহার নিমিত্ত আমার উপর আদেশ প্রদান করিলেন। আমিও তাহার আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া, সেই স্থান হইতে নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করিলাম। আসিবার সময় তাহাকে কেবলমাত্র ইহাই বলিয়া আসিয়াছিলাম যে, টেলিগ্রাম পাঠে যেরূপ বুঝিতে পারা যাইতেছে, তাহাতে বোধ হয়, যাহার পুত্র পাওয়া যাইতেছে  না, তিনি যতশীঘ্র পারেন, কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইবেন। প্রথমতঃ, তিনি যদি আপনার নিকটে আসিয়া উপস্থিত হন, তাহা হইলে অনুগ্রহ পূর্বক তাঁহাকে যেন আমার নিকট প্রেরণ করা হয়। প্রধান কর্ম্মচারী মহাশয় আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন ও কহিলেন, আসিবামাত্রই তাঁহাকে আমি তোমার নিকট পাঠাইয়া দিব। তিনি আরও কহিলেন, কেহ যে আপনার শিশুসন্তানকে কখন ভুলক্রমে পরিত্যাগ করিতে পারে, তাহা কিন্তু আমি ইতিপূৰ্বে আর কখনও দেখি নাই, বা শুনিও নাই। না জানি, ইনি কিরূপ পিতা?

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

সে রাত্রিতে আর কোনরূপ অনুসন্ধান হইল না। পরদিবস প্রত্যূষে আমি সেই বালকের অনুসন্ধান করিবার মানসে খানা হইতে বাহির হইতেছি, এমন সময় একখানি পত্র-সহ এক ব্যক্তি একথানি জুড়ি গাড়িতে আমার থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গাড়ি হইতে নামিয়াই তিনি আমার অনুসন্ধান করিলেন। সম্মুখে আমি উপস্থিত ছিলাম, একজন প্রহরী আমাকে দেখাইয়া দিল। আমাকে দেখিয়া তিনি আমার নিকট আগমন করিলেন, এবং পত্রখানি বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি পত্রখানি খুলিলাম; দেখিলাম, উহা আমার সেই সৰ্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর স্বহস্তলিখিত। লেখাও অধিক নহে, দুইটী ছত্র মাত্র। উহাতে লেখা ছিল,-আপনি যে বালকের অনুসন্ধান করিতেছেন, এই পত্রবাহক সেই বালকের পিতা।

তাঁহার পোষাক-পরিচ্ছদ, গাড়ি-ঘোড়া দেখিয়া এবং তাহার কথাবার্তা শুনিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম, তিনি একজন বড় মানুষ। পাশ্চাত্য-শিক্ষায় ইনি উত্তমরূপে শিক্ষিত। ইনি আসিয়া হঠাৎ উপস্থিত হওয়ায়, সেই সময় আর আমাকে বাহিরে যাইতে হইল না। তাঁহার সমভিব্যাহারে আমি আমার আফিস গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম, এবং সেই স্থানে নির্জনে উভয়ে উপবেশন করিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনিই কি একখানি টেলি গ্রাম করিয়াছিলেন?

বড়লোক। হাঁ মহাশয়।

আমি। দেখুন দেখি, এই টেলিগ্রাম কি?

বড়লোক। হাঁ মহাশয়। আমিই এই টেলিগ্রাম পঠাইয়াছিলাম।

আমি। এই টেলিগ্রামে যে বালকের কথা উল্লেখ আছে, সে কি আপনার পুত্র?

বড়লোক। হুঁ, সেই শিশু আমার সন্তান। আপনার সাহেবের নিকট হইতে অবগত হইলাম, আপনিই সেই শিশুর অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছেন; ইহা কি প্রকৃত?

আমি। উহার অনুসন্ধানের ভার আমারই উপর ন্যস্ত হইয়াছে।

বড়লোক। উহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিয়া ছেন কি?

আমি। না, এ পর্যন্ত আমি উহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। আজ উহার সন্ধানে গমন করিতেছিলাম, এমন সময় আপনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

বড়লোক। উহার সন্ধান পাইবার কোনরূপ আশা আছে কি?

আমি। আশা না থাকিলে কি কখনও এই জগতের অস্তিত্ব থাকিত? আশা নাই, এ কথা আমি বলিতে পারি না। ৪

বড়লোক। আপনি অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত গমন করিতে ছিলেন; চলুন, আমিও আপনার সহিত গমন করি।

আমি। আমার সহিত আপনার গমন করিবার প্রয়োজন এখন নাই। যখন প্রয়োজন হইবে, তখন আপনি আমার সহিত গমন করিবেন। এখন কতকগুলি কথা আপনার নিকট আমার জিজ্ঞাস্য আছে, সেইগুলির যথাযথ উত্তর প্রদান করুন; তাহা হইলে কিরূপ ভাবে কোথায় ইহার অনুসন্ধান করিতে হইবে, তাহা বুঝিতে পারিব।

বড়লোক। আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?

আমি। টেলিগ্রামে যে নাম আছে, সেই নামই বোধ হয়, আপনার নাম? :

বড়লোক। হাঁ উহাই আমার নাম।

আমি। আপনার বাসস্থান কোথায়?

বড়লোক। এই শহরেই আমার বাসস্থান।

আমি। আপনি যে কলিকাতাবাসী, তাহা আমি পূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছি; কিন্তু কলিকাতার কোন্ স্থানে আপনার বাসস্থান, তাহা আমাকে বলিয়া দিবেন কি? কারণ, যখন আপনাকে আবশ্যক হইবে, তখন আমি আপনাকে কোথায় পাইব?

আমার কথার উত্তরে তিনি তাঁহার প্রকৃত পরিচয় আমাকে প্রদান করিলেন, এবং যে স্থানে তাহার বাসস্থান তাহাও আমাকে বলিলেন। আমি কিন্তু তাহার নাম ও পরিচয় পাঠকগণের নিকট সবিশেষ কোন কারণ বশতঃ প্রকাশ করিতে পারিলাম না।

আমি। কিরূপ অবস্থায় আপনি আপনার শিশুসন্তানটীকে হারাইয়াছেন, তাহার আদ্যোপান্ত বৃত্তান্ত আমার নিকট সবিশেষ করিয়া বলুন দেখি।

বড়লোক। আমি পূৰ্বেই বলিয়াছি, আমার বাসস্থান এই কলিকাতায়; কিন্তু আমার শ্বশুরালয় কলিকাতায় নহে। মেদিনী পুর জেলার মধ্যে একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে আমার শ্বশুরালয়। সেই স্থানে গমন করিতে হইলে, ষ্টীমারে তমলুক পৰ্য্যন্ত গমন করিতে হয়। তমলুক হইতে আমার শ্বশুরালয় কয়েকখানি গ্রাম ব্যবধান। তমলুক হইতে সেই স্থানে গমন করিতে হইলে পাল্কী বা শকট ভিন্ন গমন করিবার আর কোন উপায় নাই। আমার বিবাহের পর আমার স্ত্রী কেবলমাত্র একবার তাহার পিত্রালয়ে গমন করিয়া ছিলেন; তাহা বহুদিবসের কথা। আমার শ্বশুরের অবস্থা ভাল নহে বলিয়া, আমি আমার স্ত্রীকে সেই স্থানে যাইতে দেই না। আমার শ্বশুর মহাশয় আসিয়া মধ্যে মধ্যে, তাহাক আবাকে দেখিয়া যান। কিন্তু পাড়াগাঁয়ের নিয়ম-অনুসারে আমার শ্বাশুড়ীঠাকুরাণী আমাদিগের বাটীতে আসিতে পারেন না। সুতরাং তাহার কন্যার সহিত প্রায় একরূপ দেখা-সাক্ষাৎ নাই। আমার স্ত্রী বহুদিবস হইতে তাহার মাতাকে দেখিতে না পাইয়া, বড়ই দুঃখিতা থাকিতেন, এবং সেই স্থানে গমন করিয়া একবার তাহার মাতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিবেন, এই ইচ্ছা মধ্যে মধ্যে প্রকাশ করিতেন। সুযোগ মত আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া তাহার মাতার সহিত সাক্ষাৎ করা ইয়া আনিব, এই কথা মধ্যে মধ্যে বলিয়া তাহাকে সান্ত্বনা করিতাম।

ক্রমে আমার সেই পুত্ৰটী জন্মগ্রহণ করিল। সেই পুত্র জন্মাইবার পর হইতে আমার স্ত্রী তাহার পিত্রালয়ে অভাবপক্ষে দুই একদিবসের নিমিত্তও গমন করিবার জন্য আমাকে সবিশেষরূপে অনুরোধ করিতে লাগিল। আমি প্রথমতঃ তাহার প্রস্তাবে অসম্মত হইলাম; কিন্তু কোনরূপেই তাহাকে শান্ত করিতে পারিলাম না। অনোপায় হইয়া ক্রমে তাহার মতে আমাকে মত দিতে হইল, এবং শ্বশুরালয়ে গমন করিবার দিন স্থির করিয়া শ্বশুর মহাশয়কে পত্র লিখিলাম। সেই স্থানে গমন করিতে হইলে, যে স্থানে যেরূপ করিবার প্রয়োজন, তাহার সমস্তই ঠিক হইল। প্রায় এক সপ্তাহ হুইল, আমি আমার স্ত্রী ও পুত্রের সহিত আমার শ্বশুর বাড়ী গমন করিবার নিমিত্ত কলি কাতা পরিত্যাগ করিলাম। আমাদিগের সঙ্গে আমার দুইজন বন্ধু, একজন পাচক ব্রাহ্মণ, দুইটী দ্বারবান, চারিজন পরিচারক এবং দুইজন পরিচারিকামাত্র গমন করিল। আমার শ্বশুরের অবস্থা ভাল নহে, এ কথা আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি; সুতরাং সেই স্থানে গমন করিয়া, সেই নে অনহিতি করিবার ও সেই স্থান হইতে প্রত্যা বৰ্তন করিবার কে সকল ব্যর এবং যেরূপ বন্দোবস্তের প্রয়োজন, তাহা সমস্ত আমিই নির্ব্বাহ করিলাম।

কলিকাতার আরমানিঘাট হইতে জাহাজে আরোহণ করিয়া আমরা তমলুকে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে পাল্কীর বন্দোবস্ত ছিল। সুতরাং শশুরবাড়ী পৌঁছিতে আমার বা আমার সমভিব্যাহার সমস্ত লোকের কোনরূপ কষ্ট হইল না। সেই স্থানে। কয়েকদিবসকাল অতিবাহিত করিয়া গত পরশু তারিখে আমরা তমলুকে আসিয়া উপস্থিত হই। সেই স্থানে রাত্রিযাপন করিয়া, পরদিবস জাহাজে আমোহণ করি। আমাদিগের ইচ্ছা ছিল, তমলুক হইতে আমরা একবারে কলিকাতায় আগমন করিব না; উলুবেড়িয়ার কয়েকখানি গ্রাম ব্যবধানে আমার স্ত্রীর এক ভগিনীর শ্বশুরবাড়ী আছে। ইচ্ছা ছিল, উলুবেড়িয়ায় নামিয়া, আমরা সেই স্থানে গমন করিব; সেই স্থানে দুই একদিবস থাকিয়া, আমরা কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিব। মনে মনে আমরা যেরূপ স্থির করিয়াছিলাম, কাৰ্যেও আমরা সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছিলাম। সেই স্থানে গমন করিবার সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক ছিল, জাহাজ উলুবেড়িয়ায় আসিয়া উপস্থিত হইলে, আমরা সকলে সেই স্থানে অবতরণ করিলাম। জাহাজ জেটিতে থাকিয়া নিয়মিত সময়ে কলিকাতা অভিমুখে প্রস্থান করিল।

জাহাজ ছাড়িয়া যাইবার পর দেখিলাম, আমার সমভি বাহারী লোজন ও দ্রব্যসামগ্রী সমস্তই জাহাজ হইতে নামাইয়া আনা হইয়াছে, কেবল আমায় শিশুসন্তানটীকে দেখিতে পাইলাম না। তাহাকে দেখিতে না পাইয়া, প্রথমত আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলাম; তিনি কহিলেন, আমার নিকটে তামার সন্তান নাই, কোন না কোন চাকর-চাকরাণীর কাছে থাকিবে। তখন এক এক করিয়া চাকর-চাকরাণী, দ্বারা ব্ৰাহ্মণ প্রতি যে সফল ব্যক্তি আমাদিগের সঙ্গে ছিল; তাহাদিগের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করি লাম। সকলেই কহিল, তাঁহারা কেহই জাহাজ হইতে বালককে নামাইয়া আনে নাই। অধিকন্তু প্রত্যেকে প্রত্যেকের সহিত বিবাদ আরম্ভ করিল, পরিচারিকাদ্বয়ের মধ্যে মহাগোলযোগ উপস্থিত হইল।

একজন কহিল, বালক তোর জিম্মায় ছিল, তুই আনিস নাই কেন? অপর আর একজন কহিল, জাহাজের ভিতর তুই বালককে ক্রোড়ে করিয়া রাখিয়াছিলি, তোরই নিকট সেই বালক ছি, তুই তাহাকে কিরূপে পরিত্যাগ করিয়া আসিলি! চাকর গণের মধ্যে পরস্পর হাতাহাতি আরম্ভ হইল। একজন কহিল, তোর দোষ। আর একজন কহিল, তোর দোষ। একজন কহিল, জাহাজ হইতে নামিবার সময় তোক বলিয়াছিলাম, কোন স্ত্রব্য ভুল ক্রমে ফেলিয়া আসিয়াছি কি না, দেখিয়া আয়। অপর ন্যূক্তি কহিল, এ কার্যের ভার তোর উপর ছিল, তুই আপন কাৰ্য্য করিস্ নাই বলিয়াই ত এই সর্বনাশ ঘটিল। আমার সমভিব্যাহারে অপর যাহারা ছিলেন, তাঁহারা চুপ করিয়া এদিক ওদিক অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, আমার স্ত্রী উচ্চৈঃস্বরে কাদিতে আরম্ভ করিল। এই সকল ব্যাপার দেখিয়া আমি যে কি করিব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। ওদিকে দেখিলাম, জাহাজখানি আর ঘাটে নাই, কলিকাতা অভিমুখে প্রস্থান করিতেছে; আর এত দূরবর্তী হইয়া পড়িয়াছে যে, জাহাজের কোন লোক আমাদিগের উচ্চরবও শুনিতে পায় না।

তখন অনন্যোপায় হইয়া, কি করিব, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আপনাদিগের সাহেবের নিকট টেলিগ্রাম করিলাম, এবং অপর যে সকল স্থানে সেই জাহাজ পড়াইবার সম্ভাবনা আছে, সেইসকল স্থানে অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত লোজন সমভিব্যাহারে আমি নিজেই রওনা হইলাম। স্থানীয় পুলিসকেও সেই সময় সংবাদ দেওয়া হইয়াছিল, তাঁহারাও আমাদিগকে সবিশেষরূপ সাহায্য করিলেন; কিন্তু কোন স্থানেই তাহার কোনরূপ সন্ধান করিতে পারিলাম না।

আমি। যখন আপনারা তমলুক হইতে জাহাজে আরোহণ করেন, সেই সময় বালকটীকে জাহাজে আনা হইয়াছিল ত?

বড়লোক। সে সময় ভুল হয় নাই।

আমি। জাহাজের উপর আপনি আপনার পুত্রটীকে নিজ চক্ষে দেখিয়াছিলেন কি?

বড়লোক। জাহাজের মধ্যে আমি যে তাহাকে নিজ চক্ষে দেখিয়াছি ইহা কিন্তু আমার ঠিক স্মরণ হয় না; কিন্তু বালকটীকে যে জাহাজে আনা হইয়াছিল, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

আমি। আপনি কিরূপে বলিতেছেন যে, জাহাজে তাহাকে আনা হইয়াছিল? কারণ, আপনি নিজে ত তাহাকে দেখেন নাই।

বড়লোক। আমি নিজে দেখি নাই সত্য। কিন্তু পরিশেষে এ বিষয়ে আমি অনুসন্ধান করিয়াছিলাম। যে চাকরাণী ক্রোড়ে করিয়া তাহাকে জাহাজে উঠাইয়াছিল, সে-ই আমাকে বলিয়াছে। তদ্ব্যতীত আমার স্ত্রীও তাহাকে জাহাজের ভিতর দেখিয়াছেন।

আমি। যে সময় উলুবেড়িয়ায় আপনারা সকলে জাহাজ হইতে অবতরণ করেন, সেই সময় সেই বালক কাহার নিকট ছিল, তাহার কিছু অনুসন্ধান করিয়াছেন কি?

বড়লোক। করিয়াছি, সেই সময় সেই বালক কাহারও ক্রোড়ে ছিল না। জাহাজ হইতে অবতরণ করিবার কিছু পূর্বেই সে নিদ্রিত হইয়া পড়ে, কামরার মধ্যে একখানি বেঞ্চের উপর তাহাকে শোয়াইয়া রাখা হয়। পরিশেষে নামিবার সময় ভুলক্রমে আর কেহই তাহাকে লইয়া নাবেন নাই। নিদ্রিত অবস্থায় বালক আমার সেই স্থানেই রহিয়া যায়।

আমি। আমি বিস্তর বিস্তর ভুল দেখিয়াছি; কিন্তু এরূপ মহা ভুল আমি কখনও দেখি নাই; দেখা ত দূরের কথা, কখনও শুনি নাই।

বড়লোক। নিদ্রিত অবস্থায় বালক আমার এই কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হয় নাই ত?

আমি। জাহাজ ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইবার পূর্বেই আমি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম। আমার সম্মুখেই জাহাজ আসিয়া ঘাটে উপস্থিত হয়। জাহাজের ভিতর ও আরোহীগণের মধ্যে আমি নিজে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছি। বালক কলি কাতা পর্যন্ত আসিয়া উপস্থিত হয় নাই।

বড়লোক। জাহাজের কোন লোক সেই বালক সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে পারে নাই?

আমি। তাহাও আমি প্রায় প্রত্যেকেকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি; কিন্তু সেই বালক যে কোথায় গেল, বা কে তাহাকে লইয়া গেল, এ সংবাদ আমাকে কেহই প্রদান করিতে পারিল না। কেবল জাহাজের খালাসিগণের নিকট হইতে এইমাত্র অবগত হইতে পারি লাম যে, আপনারা তমলুকে উঠিয়াছিলেন, এবং উলুবেড়িয়ায় নামিয়া গিয়াছেন।

বড়লোক। মহাশয়। এখন উপায় কি বলুন দেখি?

আমি। উপায় ঈশ্বরের হস্ত। আমরা বালকের সন্ধান করিবার নিমিত্ত সাধ্যমত চেষ্টা করি মাত্র। সেই বালকের অঙ্গে কি কি অলঙ্কার ছিল বলিতে পারেন কি?

বড়লোক। কি কি অলঙ্কার ছিল, ঠিক তাহা আমি বলিতে পারি না। কেবল এইমাত্র বলিতে পারি যে, বালকের অঙ্গে সোণার যে সকল অলঙ্কার থাকিতে পারে, তাহার সমস্তই ছিল। আবশ্যক হয়, তাহার একটা বিস্তারিত তালিকা আমি পরে পাঠাইয়া দিব।

আমি। আমি একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি,–যে সকল চাকর-চাকরাণী বা লোজন আপনার সহিত ছিল, তাহা দিগের মধ্যে কাহাকেও কোনরূপে আপনার সন্দেহ হয় কি?

বড়লোক। সকলেই পুরাতন চাকর। তাহাদিগের কাহারও দ্বারা যে কোনরূপ অনিষ্ট হইবে, কিন্তু আমার মনে স্থান পায় না; তবে বলিতে পারি না। কিন্তু তাঁহারা সকলেই ত আমাদিগের সহিত ছিল, কাহাকেই সেই সময় অনুপস্থিত পাই নাই।

আমি। অলঙ্কারের লোভ, ভয়ানক লোভ। এ লোভ সম্বরণ করা সামান্য লোকের পক্ষে বড়ই কঠিন।

বড়লোক। উঁহাদিগের মধ্যে কেহ যদি অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিত, তাহা হইলে অলঙ্কার-শূন্য বালকটাকে ত কোন প্রকারে পাওয়া যাইত?

আমি। পাওয়া ত উচিত ছিল; কিন্তু যদি অলঙ্কারগুলি অপ হরণ করিয়া বালককে গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করিয়া থাকে, তাহা হইলে কিরূপে বালককে পাওয়া যাইতে পারে।

বড়লোক। যখন আমরা সকলেই সেই স্থানে উপস্থিত, তখন চাকর-চাকরাণীগণের মধ্যে কাহারও কি এতদুর সাধ্য হইতে পারে? যদি তাহাই হইয়া থাকে, তাহা হইলে আপনার বিবেচনায় বালককে কি হত্যা করিয়া তাহার অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়াছে বুলিয়া, আপনার অনুমান হয়?

আমি। অনুমান হয় না। চাকর-চাকরাণীগণ কর্তৃক শিশু হত্যা না হইবারই খুব সম্ভাবনা। এ কথা আমি তচ্ছলে বলিতেছি মাত্র। আমি আপনাকে আরও দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।

বড়লোক। কি?

আমি। যে কামরার ভিতর আপনার স্ত্রী ও আপনার শিশু সন্তান ছিল, আপনিও কি সেই কামরার ভিতর ছিলেন?

বড়লোক। না মহাশয়! আমি সেই স্থানে ছিলাম না, অপর স্থানে ছিলাম।

আমি। সেই কামরার ভিতর আপনার স্ত্রী ব্যতীত অপর আর কে ছিল?

বড়লোক। দুইজন পরিচারিকা ছিল।

আমি। তাঁহারা এখন কোথায়?

বড়লোক। তাঁহারা এখন আমার বাড়ীতেই আছে।

আমি। আমি তাহাদিগকে দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।

বড়লোক। উত্তম, আপনি আমার সহিত আমাদিগের বাড়ীতে চলুন। সেই স্থানে চাকর-চাকরাণীগণ যাহারা আমাদিগের সহিত ছিল, সকলেই উপস্থিত আছে, আপনি যাহাকে যাহা ইচ্ছা হয়, তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া লইতে পারেন।

আমি। সে-ই ভাল, চলুন আমি আপনার সহিত গমন করি তেছি। আপনাকে আরও একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।

বড়লোক। কি?

আমি। আপনার অবস্থা দেখিয়া ও আপনার কথাবার্তা শুনিয়া আমার বেশ অনুমান হইতেছে, আপনি বড়লোক, এবং আপনার বিষয়-আশয় যথেষ্ট আছে।

বড়লোক। আপনি যাহা বলিতেছেন, সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার এই মহৎ কাৰ্য্য যদি আপনার দ্বারা সাধিত হয়, তাহা হইলে আপনার খরচপত্র ত দূরের কথা, যাহাতে আপনি সন্তুষ্ট হন, এরূপ পুরস্কার আমি আপনাকে প্রদান করিব।

আমি। আমি পুরস্কার বা খরচপত্রের কথা বলিতেছি না। আমি যাহা বলিতেছি, তাহা অগ্ৰে শুনিয়া তাহার উত্তর প্রদান করুন। আমি যাহা অনুমান করিতেছি, তাহা ত প্রকৃত? আপনার যথেষ্ট বিষয় আছে কি? আমার এ জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য, আপনাকে পরে বলিতেছি।

বড়লোক। হাঁ, কিছু আছে।

আমি। আপনার পুত্রের জীবনের উপর আপনার বিষয় উপ লক্ষে কাহারও শুভাশুভ কিছু নির্ভর করে কি?

বড়লোক। আমি আপনার এ কথার ঠিক প্রকৃত অর্থ বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।

আমি। আপনার যদি সেই পুত্র জন্মগ্রহণ না করিত, বা সেই পুত্রের কোনরূপে যদি মৃত্যু হয়, তাহা হইলে আপনার মৃত্যুর পর আপনার অগাধ বিষয়ের স্বত্বাধিকারী অপর কেহ হইতে পারে কি?

বড়লোক। না, আমি সেরূপ দেখিতেছি না। আমার এই পুত্রের মৃত্যুতে আমার এই বিষয়ের কোনরূপ ক্ষতি-বৃদ্ধি হইবে না। কারণ, এই বিষয় এখন আমার নহে, আমার পিতার। তিনি এখনও বর্তমান; তদ্ব্যতীত আমিই কেবল তাহার একমাত্র পুত্র নহি।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

সেই বড়লোকের সহিত আমার এই সকল কথাবার্তা হইবার পর, আমি তাহার সহিত তাহার গাড়িতেই আরোহণ করিয়া তাহার বাড়ীতে গমন করিলাম। তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া যে পরিচারিকাদ্বয় তাহার স্ত্রীর সহিত গমন করিয়াছিল, তাহাদিগকে ডাকাইলাম; ডাকিবামাত্রই তাঁহারা আমার সম্মুখে আসিল। তাহা দিগের মধ্যে প্রথমে যে আমার নিকট আগমন করিল, আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তমলুক হইতে যখন তোমরা জাহাজে উঠিয়াছিলে, তখন বালকটীকে তোমরা ক্রোড়ে করিয়া আনিয়াছিলে ত?

১ম পরিচারিকা। আমি তাহাকে ক্রোড়ে করিয়া জাহাজে উঠিয়াছিলাম।

আমি। এ কথা তোমার বেশ মনে আছে?

১ম পরিচারিকা। বেশ মনে আছে। তদ্ব্যতীত জাহাজে উঠিয়া আমি সেই বালককে একবার তাহার মাতার ক্রোড়ে দিয়াছিলাম। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই আপনি জানিতে পারিবেন যে, আমার কথা প্রকৃত কি না।

আমি। উলুবেড়িয়ায় নামিবার সময় বালকটীকে নামাইতে ভুল হইল কি প্রকারে?

১ম পরিচারিকা। তাহার মাতার ক্রোড় হইতে অপর ওই চাকরাণী সেই বালককে গ্রহণ করে, এবং তাহার ক্রোড়েই ক্রমে সেই বালক নিদ্রিত হইয়া পড়ে। নিদ্রিত হইবার পর সেই কামরার মধ্যে একখানি বেঞ্চের উপর একটা ছোট বিছানা করিয়া বালকটীকে সেই বিছানার উপর শয়ন করাইয়া রাখে। পরিশেষে উলুবেড়িয়ার ঘাটে জাহাজ আসিয়া উপস্থিত হইলে, আমি প্রথমেই আমার কর্তৃঠাকুরাণীর সঙ্গে জাহাজ হইতে অবতরণ করি। কারণ, তাঁহার সহিত আমাদিগের মধ্যে কোন পরিচারিকা না থাকিলে তিনি জাহাজ হইতে একাকী অবতরণ করিতে কখনই সমর্থ হইতেন না বলিয়াই, আমি তাঁহার সহিত গমন করি। যে সময় আমি ও আমার কর্তৃ ঠাকুরাণী জাহাজ হইতে নামিয়া আসি, সেই সময় অপর চাকরাণী জাহাজের উপরেই ছিল। আমরা ভাবিয়াছিলাম, সে জাহাজ হইতে অবতরণ করিবার সময় বালকটীকে ক্রোড়ে করিয়া আনিবে; কিন্তু পরে দেখিতে পাইলাম, সে তাহা করে নাই, ভুল করিয়া বালকটীকে জাহাজেই পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছে।

তখন আমি দ্বিতীয় পরিচারিকাকে সম্বোধন করিয়া বলিলাম, এ বড় বিষম ভুল! তুমি বালকটীকে জাহাজে পরিত্যাগ করিয়া আসিলে কেন?

২য় পরিচারিকা। কঠাকুরাণীর গহনা ও অপরাপর জিনিষ পত্র আমি পূর্বেই গুছাইয়া রাখিয়াছিলাম। অপর চাকরাণীর সহিত কর্তৃঠাকুরাণীকে জাহাজ হইতে বহির্গত হইতে দেখিয়া সেই সকল দ্রব্যাদি লইয়া আমিও তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ জাহাজ হইতে অবতরণ করি। আমি ভাবিয়াছিলাম, কর্তৃঠাকুরাণী বা অপর পরিচারিকা বালকটীকে নিশ্চয় ক্রোড়ে করিয়া লইয়া গিয়াছেন। কারণ, আমি সেই সময় ভাবিয়াছিলাম, যখন গহনা ও জিনিষপত্র নামাইবার ভার আমার উপর পড়িয়াছে, তখন নিশ্চয়ই তাঁহারা বালকটাকে লইয়া গিয়াছেন। আমার কেবলমাত্র দোষ যে, দ্রব্যাদির সহিত দ্রুতপদে জাহাজ হইতে বাহির হইবার সময় আমি সবিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখি নাই যে, বালকটীকে লইয়া গিয়াছে, কি তখন পর্যন্ত সে সেই স্থানেই শয়ন করিয়া আছে।

আমি। তোমরা জাহাজ হইতে বাহিরে আসিলে পর, সেই কামরার ভিতর কোন দ্রব্য পরিত্যক্ত হইয়াছে কি না, তাহা দেখি বার নিমিত্ত তোমাদিগের কোন লোক সেই কামরার ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল কি?

২য় পরিচারিকা। তাহা আমি বলিতে পারি না। আমার বোধ হয়, কেহই যায় নাই। কারণ, কেহ যদি উহার ভিতর গমন করিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই সে সেই বালকটীকে বেঞ্চের উপর নিদ্রিত অবস্থায় দেখিতে পাইত।

আমি। তোমরা যে কামরার ভিতর ছিলে, তাহার ভিতর অপর আর কোন লোক ছিল?

২য় পরিচারিকা। আমরা দুইজন পরিচারিকা ও আমাদিগের কর্তৃঠাকুরাণী ভিন্ন অপর আর কেহই সেই কামরার ভিতর ছিল না।

আমি। যে সময় তোমরা জাহাজ হইতে অবতরণ কর, সেই সময় তোমাদিগের সেই কামরার সম্মুখে আর কোন ব্যক্তি বসিয়াছিল?

২য় পরিচারিকা। না, অপর কোন ব্যক্তিকে সেই স্থানে বসিতে দেখি নাই। তবে দুই একজন লোক সেই স্থান দিয়া যাতায়াত করিতেছিল, তাহা আমি দেখিয়াছি।

আমি। সেই লোক কে? ২য় পরিচারিকা। তাহা আমি জানি না।

আমি। উঁহারা জাহাজের খালাসি প্রভৃতি, কি আবোহী? ২য় পরিচারিকা। দুই একজন খালাসিকেও দেখিয়াছি, এবং অপর আরোহীগণের মধ্যেও দুই একজন সেই স্থান দিয়া যাতায়াত করিয়াছে।

আমি। তুমি তাহাদিগকে দেখিলে চিনিতে পারিবে? ২য় পরিচারিকা। না।

আমি। কেন?

২য় পরিচারিকা। তাহাদিগকে কেবল একবার দেখিয়াছি মাত্র, তাহাও সবিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখি নাই।

আমি। যে কামরায় তোমরা ছিলে, তাহার পার্শ্ববর্তী কামরায় আর কোন আরোহী ছিল কি?

২য় পরিচারিকা। ছিল, আমাদিগের কামরার ঠিক পার্শ্বের কামরায় কয়েকটী স্ত্রীলোক ছিল দেখিয়াছি।

আমি। সেই স্ত্রীলোকদিগকে দেখিয়া কি মনে হয়? উঁহারা কি কোন গৃহস্থের পরিবার?

২য় পরিচারিকা। উঁহাদিগকে দেখিয়া কোন ভদ্র-বংশীয় স্ত্রীলোক বলিয়াই বোধ হয়।

আমি। উঁহাদিগের সহিত অপর আর কোন পুরুষ মানুষ ছিল কি?

২য় পরিচারিকা। সেই কামরার ভিতর কোন পুরুষ মানুষকে দেখি নাই; কিন্তু কয়েকজন পুরুষ মানুষ আসিয়া মধ্যে মধ্যে উহা দিগের খোজ-তল্লাস লইয়া গিয়াছে, তাহা আমি দেখিয়াছি।

আমি। তুমি জান, উঁহারা কাহারা?

২য় পরিচারিকা। না, তাহা আমরা জানি না।

আমি। উঁহারা কোথায় নামিয়া গিয়াছে?

২য় পরিচারিকা। তাহা বলিতে পারি না। কারণ, যখন আমরা জাহাজ হইতে উলুবেড়িয়ায় অবতরণ করি, সেই সময় তাঁহারা জাহাজেই ছিলেন। পরে কোথায় নামিয়াছেন, তাহা আমি জানি না।

আমি। তাহাদিগকে দেখিলে তুমি চিনিতে পারিবে?

২য় পরিচারিকা। তাহা আমি এখন ঠিক বলিতে পারিতেছি না। দেখিলে বুঝিতে পারি, চিনিতে পারি কি না।

আমি। তোমাদিগের সহিত পরিচারক ও দ্বারবান্ প্রভৃতি যাহারা ছিল, তাঁহারা তোমাদিগের কামরার ভিতর কখনও কোন কাৰ্য্যের নিমিত্ত প্রবেশ করিয়াছিল কি?

২য় পরিচারিকা। অপর কেহই আমাদিগের কামরায় প্রবেশ করে নাই। এমন কি, বাবু নিজেও সেই কামরার ভিতর প্রবেশ করেন নাই।

আমি। তুমি জাহাজ হইতে অবতরণ করিবার পূৰ্ব্বে, তোমা দিগের সমভিব্যাহারী কোন্ কোন্ ব্যক্তি জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়াছিল?

২য় পরিচারিকা। তাহা আমি সবিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখি নাই।

আমি। তুমি নামিবার পর কে নামিয়াছিল, তাহা বলিতে পার?

২য় পরিচারিকা। তাহাও আমি বলিতে পারি না। সেই গোলযোগের ভিতর কে অগ্রে নামিল, কে পশ্চাৎ নামিল, তাহা আমি লক্ষ্য করিয়া দেখি নাই।

পরিচারিকাদ্বয়ের নিকট হইতে এই কয়টী কথা জিজ্ঞাসা করিয়া লইবার পর, আমি সেই বাবুটীকে কহিলাম, আপনি আপনার স্ত্রীকে একবার জিজ্ঞাসা করিয়া আসুন, আপনার পরিচারিকাদ্বয় যাহা কহিল, তাহা প্রকৃত কি না। যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সেই পরিচারিকাদ্বয়ের মধ্যে কেহ বালকটীকে লইয়া কোনও সময় জাহাজের বাহিরে আসিয়াছিল কি না? যদি আসিয়া থাকে, তাহা হইলে জিজ্ঞাসা করিবেন, কোন্ চাকরাণী বাহিরে আসিয়াছিল, এবং কেনই বা আসিয়াছিল।

আমার কথা শুনিয়া বাবুটী অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলেন, ও কিয়ৎক্ষণ পরে বাহিরে আসিয়া কহিলেন, চাকরাণীদ্বয় যাহা বলিয়াছে, তাহা প্রকৃত। উঁহারা যে পর্যন্ত জাহাজে ছিল, সেই পর্যন্ত কেহই কামরার বাহিরে যায় নাই।

এই সকল কথা অবগত হইয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। যাইবার সময় বাবুকে বলিয়া গেলাম, অনুসন্ধান করিয়া আমি যাহা যাহা অবগত হইতে পারিব, পরে তাহার সমস্ত ব্যাপার আপনাকে বলিব।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া গমন করিবার পর দুইটা বিষয় আমার মনে উদিত হইল।

১ম। বালকটীকে পরিত্যাগ করিয়া তাহার পিতামাতা গমন করিলে পর, যদি সেই বালক জাহাজের কোন দুশ্চরিত্র খালাসি বা আরোহীগণের মধ্যে কোন অসচ্চরিত্র লোকের নয়নগোচর হইয়া থাকে, তাহা হইলে অর্থলোভে তাহাকে বিনষ্ট করিয়া অনায়াসেই তাহার দেহ সে গঙ্গার্গর্ভে নিক্ষেপ করিতে পারে। যদি আমার এই অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে বালকের অনু সন্ধান ত দূরের কথা, অলঙ্কার গুলিরও অনুসন্ধান হওয়া নিতান্ত সহজ হইবে না।

২য়। উলুবেড়িয়া ও কলিকাতার মধ্যবর্তী কোন স্থানে কোন আবোহী যদি সেই বালকটীকে লইয়া জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়া চলিয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে বালক ও তাহার অলঙ্কারের কিছু না কিছু সন্ধান হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। এরূপ অবস্থায় সেই পন্থাই অবলম্বন করিয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া এক্ষণে আমার কর্তব্য।

মনে মনে এইরূপ অনুমান করিয়া, আমি চাদপালঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে একখানি ডিঙ্গি ভাড়া করিয়া প্রথমে মেটিয়াব্রুজে এবং পরিশেষে বজবজে গিয়া সেই বালক সম্বন্ধে সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু সেই দুই স্থানে সেই বালকের কোনরূপ অনুসন্ধান না পাইয়া, রাজগঞ্জ ও অপরাপর কয়েকস্থানে গমন করিলাম। সেই সকল স্থানেও বালকের কোন রূপ অনুসন্ধান না পাইয়া, তিন চারিদিবস পরে নিতান্ত ক্ষুণ্ণ মনে কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিলাম। আমার উর্দ্ধতন কর্ম্মচারী ও বালকের পিতামাতা প্রভৃতি সকলেই জানিতে পারিলেন যে, আমার দ্বারা সেই বালকের অনুসন্ধান হইবার আর কোনরূপ সম্ভাবনা নাই। তথাপি আমি যে সেই বালকের অনুসন্ধান একবারে পরিত্যাগ করিলাম, তাহাও নহে।

যে কামরার ভিতর বালকটীকে ভ্ৰম-ক্রমে পরিত্যাগ করিয়া আসা হইয়াছিল, তাহার পার্শ্ববর্তী কামরার ভিতরে আরও একজন ভদ্রলোক তাঁহার পরিবারকে লইয়া আসিয়াছিলেন, এ কথার একটু আভাস পাঠকগণ ইতিপূৰ্ব্বে পাইয়াছেন। আর ইহাও জানিতে পারিয়াছেন যে, তাঁহারা কলিকাতা পৰ্যন্ত আগমন করেন নাই। কলিকাতার বন্দরে জাহাজ আসিবার পূর্বেই অপর কোন স্থানে তাঁহারা অবতরণ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। সবিশেষ কষ্ট ও পরিশ্রম স্বীকার করিয়া এক সপ্তাহকাল পরে আমি সেই ভদ্র পরিবারের অনুসন্ধান পাইলাম, এবং তাহাদিগের গ্রাম পর্যন্ত গমন করিয়া জানিতে পারিলাম, তাঁহারা সেই বালক সম্বন্ধে কোন কথা অবগত নহেন, বা তাঁহারা সেই বালককে তাহাদিগের সঙ্গে আনেন নাই। সুতরাং নিতান্ত নিরাশ হইয়া আমাকে সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করিতে হইল। ক্রমে সেই অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিয়া আমি অন্য কার্যে নিযুক্ত হইলাম। বালকের পিতামাতাও ক্রমে আপনাপন হৃদয় হইতে তাঁহাদিগের সেই সন্তানের মায়া পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।

এই ঘটনার প্রায় একমাস পরে একখানি নোটের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমাকে রাজগঞ্জে গমন করিতে হয়। যে মোক জমা সম্বন্ধে আমি নোটের অনুসন্ধান করিতে গিয়াছিলাম, সেই মোকদ্দমার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই স্থানে প্রদান করা আমি তত আবশ্যক মনে করি না। কারণ, এরূপ মোকদ্দমা সম্বন্ধে একটী ঘটনা ডিটেকটিভ পুলিস দ্বিতীয় কাও পুস্তকে আমি প্রকাশ করি, ইহাও ঠিক সেইরূপ ঘটনা। সেইরূপ উপায়ে জুয়াচেরগণ জুয়াচুরি করিয়া কুমারটুলির জনৈক দোকানদারের নিকট হইতে একখানি পাঁচশত টাকার নোট গ্রহণ করে; কিন্তু সেই দিবস করেসি আফিস খোলা না থাকায়, তাঁহারা সেই নোট করেনসি আফিসে বদলাইয়া লইবার অবকাশ পায় নাই। পরদিবস প্রাতঃকালেই প্রতারিত ব্যক্তি জানিতে পারে যে, সে জুয়াচোরগণ কর্তৃক প্রতারিত হইয়াছে। সুতরাং প্রথমেই সে করেসি আফিসে গিয়া সেই নোটের নম্বর প্রদান করে, এবং সেই স্থানে এইরূপ লিখাইয়া আইসে যে, তাহার গৃহ হইতে একখানি পাঁচশত টাকার নোট চুরি গিয়াছে।

এদিকে জুয়াচারগণ যখন জানিতে পারে যে, করেসি অফিসে সেই নোট ভাঙ্গাইতে গেলে তাঁহারা ধৃত হইবে, তখন তাঁহারা করেসি আফিসে নোট ভাঙ্গাইবার আশা পরিত্যাগ করিয়া অপর আর এক উপায় অবলম্বন করে। শালিখার কোন ধান্তের আড়তে গমন করিয়া তাঁহারা পাঁচশত টাকা মূল্যের ধান্য খরিদ করে, ও তাহার মূল্যস্বরূপ উঁহারা সেই পাঁচশত টাকার নোট প্রদান করে। ধান্যের মহাজন সেই নোট অপরকে প্রদান করেন, সে পুনরায় উহা আর এক ব্যক্তিকে প্রদান করেন। এইরূপে ক্রমে সেই নোট বেঙ্গল ব্যাঙ্কে আসিয়া উপস্থিত হয়। বেঙ্গল ব্যাঙ্ক হইতে সেই নোট করেসি আফিসে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। করেসি অফিসের হস্তে সেই নোট গিয়া উপস্থিত হইলে, তাঁহারা জানিতে পারেন, সেই নোট পূৰ্বে অপহৃত হইয়াছিল। সুতরাং তাঁহারা পুলিসে এই সংবাদ প্রদান করেন, এবং সেই সময় হইতে ইহার অনুসন্ধান আরম্ভ হয়। অনুসন্ধানের ভার আমার হস্তে পতিত হইলে, আমি ইহার সমস্ত ব্যাপার অবগত হইতে পারি; কিন্তু কোন্ কোন্ ব্যক্তি যে ধান্য খরিদ করিয়া লইয়া গিযাছে, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া, অত টাকার ধান্য যে কোথায় গেল, তাহারই অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হই। পরে জানিতে পারিলাম, পূৰ্ব্ব-কথিত আড়তদারের আড়ত হইতে ধান্য সকল প্রথমতঃ বাহির করিয়া একখানি নৌকা মেটিয়াব্রুজের নিকট লইয়া গিয়া, অপর দুইখানি পাসিতে সেই সকল ধান্য পাল্টাইয়া লওয়া হয়, এবং সেই স্থান হইতে বড় নৌকাখানিকে বিদায় করিয়া দেওয়া হয়। জুয়াচোরগণ সেই ধান্য গুলি সেই ছোট নৌকা দুইখানিতে করিয়া রাজগঞ্জের বাজারে লইয়া যায়। সেই স্থানে সেই সকল ধান্য অল্প মূল্যে বিক্রয় পূৰ্ব্বক যতদূর সম্ভব অর্থ সংগ্রহ করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে।

আমিও সন্ধানে সন্ধানে ক্রমে রাজগঞ্জের বাজারে গিয়া উপ স্থিত হই, এবং সেই স্থানে অনুসন্ধান করিয়া, এই সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারি। যে সকল ব্যক্তি সেই ধান্য ক্রয় করিয়াছিল, তাহাদিগের অনেককে খুঁজিয়া বাহির করিয়া, পরিশেষে জুয়াচোর গণের অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হই। এই অনুসন্ধান উপলক্ষে পাঁচ সাতদিবস আমাকে রাজগঞ্জের বাজারে অবস্থিতি করিতে হয়।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

রাজগঞ্জের বাজারের মধ্যে একটা দোকানে আমার বাসা। অবশ্য সেই সময়ে অনেকেই অবগত নহেন যে, আমি পুলিস কর্ম্মচারী। কারণ, সেই সময় পুলিসের পরিচ্ছদাদি কিছুই আমার সহিত ছিল না, বা আমিও পুলিসকর্ম্মচারী বলিয়া কাহারও নিকট আমার পরিচয় প্রদান করিয়াছিলাম না।

একদিবস সন্ধ্যার সময় আমি সেই দোকানে বসিয়া আছি, এমন সময় একটী স্ত্রীলোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল, এবং সেই দোকান হইতে কিছু দ্রব্যাদি খরিদ করিবার মানসে সেই স্থানে উপবেশন করিল। কিয়ৎক্ষণ পরে আর একটী স্ত্রীলোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল ও পূৰ্ব্ব-কথিত স্ত্রীলোকটীকে দেখিয়া তাহার নিকট আসিয়া উপবেশন করিল, এবং উভয়ে নানারূপ গল্প করিতে আরম্ভ করিল। তাহাদিগের কথাবার্তার ভাবে অনুমান হইল, উঁহারা উভয়েই নিকটবর্তী কোন গ্রামে বাস করে, এবং দ্রব্যাদি খরিদ করিবার নিমিত্ত উভয়েই, সেই বাজারে আগমন করিয়াছে।

উভয়ের মধ্যে সেই স্থানে নানারূপ গল্প আরম্ভ হইল। নিজের কথা, সংসারের কথা, গ্রামের কথা প্রভৃতি কত কথার যে অব তারণা ও আলোচনা হইল, তাহার সংখ্যা নাই। সেই সকল কথা বাৰ্তার বিবরণ এই স্থানে লিপিবদ্ধ করা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু আমার আবশ্যক যে দুই চারিটী কথা আমি জানিতে পারিলাম, তাহারই সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই স্থানে প্রদত্ত হইতেছে মাত্র।

১ম স্ত্রীলোক। কেমন ভাই উহার মা বাপ, তাহার কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। এরূপ শিশুসন্তানের নিমিত্ত কেহ এক বার অনুসন্ধান ও করিল না!

২য় স্ত্রীলোক। আমিও তাই দেখিতেছি; কিন্তু ভাই বালকটীর চেহারা দেখিয়া বোধ হয়, সে যেন কোন বড় ঘরের সন্তান।

১ম স্ত্রীলোক। চেহারা সেইরূপই বটে।

২য় স্ত্রীলোক। আচ্ছা ভাই! ও কিরূপে সেই বালকটা পাইল?

১ম স্ত্রীলোক। তাহা ঠিক করিয়া সে কিছু বলে না। কখন বলে, সে রাস্তায় পড়িয়াছিল, সেইখানে উহাকে পাইয়াছে; কখন বলে, উহার মা বাপ নিতান্ত দরিদ্র বলিয়া, তাহাকে প্রতিপালন করিতে অসমর্থ, তাই তাঁহারা উহাকে অর্পণ করিয়া উহার নিকট হইতে কিছু অর্থ গ্রহণ করিয়াছে; কখন বলে, সে তাহার কোন আত্মীয়ের পুল, উহাকে প্রতিপালন করিবার নিমিত্ত সেই আত্মীয় তাহাকে প্রদান করিয়াছে। এইরূপে উহার মনে যখন যেরূপ কথার উদয় হইতেছে, তখনই সে সেইরূপ বলিতেছে। প্রকৃত কথা যে কি, তাহা কিন্তু কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারা যাইতেছে না।

২য় স্ত্রীলোক। আমরা যতদূর অবগত আছি, তাহাতে জানি যে, উহার এরূপ কোন আত্মীয় নাই যে, সে তাহার পুত্রের প্রতি পালনের ভার উহার উপর ন্যস্ত করিতে পারে, বা উহার এরূপ সঙ্গতিও নাই যে, তাহার দ্বারা সে এই বালকটীকে ক্রয় করিয়া লইয়া নিজে উহাকে প্রতিপালন করিতে সমর্থ হয়।

১ম স্ত্রীলোক। আমারও বিশ্বাস তাহাই। আমিও ভাই ইহার কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

স্ত্রীলোকদ্বয়ের কথাগুলি শ্রবণ করিয়া আমার মনে জাহাজে পরিত্যক্ত সেই বালকের কথা উদয় হইল। আমি তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, হ্যাঁ গা! তোমরা কোন্ বালকের কথা বলিতেছ?

১ম স্ত্রীলোক। আমাদিগের গ্রামের একটী স্ত্রীলোক একটা বালক পাইয়াছে, তাহারই কথা বলিতেছি।

আমি। যে বালকটী পাইয়াছে, তাহার নাম কি গা?

১ম স্ত্রীলোক। তাহার নাম সোনা।

আমি। সোনা সেই বালকটীকে কোথায় পাইয়াছে, তাহা কিছু বলিতে পার কি?

১ম স্ত্রীলোক। না মহাশয়! আপনি সেই বালকটীর কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?

আমি। আমার একটী বালক হারাইয়া গিয়াছে, তাই আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি।

১ম স্ত্রীলোক। আপনার ব্রলকটী কোথা হইতে হারাইয়া গিয়াছে?

আমি। সে আমার সহিত এই স্থানেই আসিয়াছিল, সেই সময় গোলমালে যে কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। অনেক স্থানে আমি তাহার অনু সন্ধান করিয়াছি, কিন্তু এ পর্যন্ত তাহার সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। এখন তোমাদের কথা শুনিয়া মনে আশা হইতেছে। তোমাদিগের সন্ধান মতে আমি যদি সেই বালকটীকে পাইতে পারি, তাহা হইলে আমি তোমাদিগকে একশত টাকা পারি তোষিক দিতে প্রস্তুত আছি।

২য় স্ত্রীলোক। সেই বালকটাকে যদি আমরা দেখাইয়া দিতে পারি, তাহা হইলে আমাদিগকে একশত টাকা আপনি প্রদান করিবেন?

আমি। সেই বালকটী যদি তোমরা আমাকে দেখাইয়া দেও, তাহা হইলেই যে আমি একশত টাকা প্রদান করিব, তা নয়। সেই বালকটা যদি আমার হয়, তাহা হইলে তৎক্ষ ২ জাম তোমাদিগকে একশত টাকা প্রদান করিব।

১ম স্ত্রীলোক। আর যদি সেই বালকটী আপনার ন, তাহা হইলে আমরা কি কিছুই পাইব না?

আমি। তোম যে একবারেই কিছু পাইবে না, তাহা আমি বলিতে পারি না। যদি সেই বালকটী আমার হয়, তাহা হইলে তোমাদিগকে একশত টাকা নিশ্চয়ই প্রান করিব। আর যদি সেই বালকটা আমার না-ও হয়, তাহা হইলেও সেই বালকটাকে দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত আমি তোমাদিগকে পাঁচ টাকা করিয়া প্রদান করিতেছি।

এই বলিয়া আমি উভয় স্ত্রীলোকের হস্তে পাঁচ টাকা প্রদান করিলাম। বিনা-পরিশ্রমে পাঁচ টাকা পাইয়া তাঁহারা অতিশয় সন্তুষ্ট হইল ও কহিল, আপনি সেই বালকটীকে দেখিবার নিমিত্ত কোন্ সময় গমন করিবেন?

আমি। যখন বলিবে, আমি সেই সময়ই গমন করিব। এখনই আমি তোমাদিগের সহিত গমন করিতে প্রস্তুত আছি।

স্ত্রীলোকদ্বয়। সে-ই উত্তম; আপনি এখনই আমাদিগের সহিত আগমন করুন। আমরা এখনই সেই বালকটীকে, এবং যে সেই বালকটীকে আনিয়াছে, তাহাকে, দেখাইয়া দিতেছি।

স্ত্রীলোকদ্বয়ের কথা শুনিয়া আমি আর কোনরূপ দ্বিরুক্তি করিলাম না। কেবলমাত্র একটী লোক সমভিব্যাহারে তাহা দিগের সহিত তখনই প্রস্থান করিলাম।

বাজার হইতে বহির্গত হইয়া একটী ময়দান দেখিলাম। সেই ময়দানের মধ্য দিয়া এক ক্রোশ পথ গমন করিবার পর, একখানি গ্রাম দেখিতে পাইলাম। সেই গ্রাম অতিক্রম করিয়া অপর আর একখানি গ্রামে উপস্থিত হইলে সেই স্ত্রীলোক আমাকে কহিল, এই গ্রামেই সেই স্ত্রীলোকের বাস। আরও কহিল, আপনারা এই স্থানে একটু অপেক্ষা করুন। আমরা গিয়া দেখিয়া আসি, সেই স্ত্রীলোকটা এখন বাড়ীতে আছে কি না, এবং সেই বালকটীই বা এখন কোথায়। তাহাদিগের প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম, উঁহারা উভয়েই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। অতি অল্প ক্ষণ পরেই উঁহাদিগের একজন প্রত্যাবর্তন করিয়া কহিল, আসুন মহাশয়! আমার সহিত আসুন, সেই স্ত্রীলোকটী এবং বালকটী এখন বাড়ীতেই আছে। আমি তাহাদিগকে স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি, ও আমার সমভিব্যাহারী সেই স্ত্রীলোকটীকে আমি সেই স্থানে রাখিয়া আসিয়াছি।

আমি তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া, তাহার নির্দেশমত তাহার সহিত গমন করিলাম। কিয়দ্দূর গিয়া সে আমাকে একখানি সামান্য খড়ের ঘর দেখাইয়া দিয়া কহিল, ইহাই সেই স্ত্রীলোকটীর বাড়ী, এবং এই বাড়ীতে সেই বালকটীও আছে। আপনি এখন এই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেই সেই বালকটীকে দেখিতে পা ইবেন। তখন আপনি জানিতে পারিবেন যে, সেই বালকটী আপনার কি না।

সেই স্ত্রীলোকটীর কথা শুনিয়া আমি আস্তে আস্তে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, একটী স্ত্রীলোক একটী বালককে ক্রোড়ে করিয়া তাহার ঘরের দাওয়ায় বসিয়া আছে। তাহার সম্মুখে, আমার সহিত যে স্ত্রীলোকদ্বয় গমন করিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে অপর স্ত্রীলোকটী বসিয়া তাহার সহিত গল্প করিতেছে।

আমি ও আমার সমভিব্যাহারী লোকটী একবারে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলে, আমাদিগকে দেখিয়া সেই স্ত্রীলোকটী যেন একটু ভীত হইল।

আমি দেখিলাম, যে বালকটী উহার নিকট রহিয়াছে, তাহার আকৃতি প্রকৃতি সমস্তই সেই জাহাজে-ভুল-ক্রমে পরিত্যক্ত বালকের সদৃশ। এক কথায় আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, এই বালকটাই কলিকাতার সেই বড়লোকটীর পুত্র।

সেই স্ত্রীলোক কোন কথা বলিতে না বলিতেই আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এ বালকটীকে তুমি কোথায় পাইলে?

স্ত্রীলোক। ইটি আমার পুত্র।

আমি। তোমার নিজের সন্তান?

স্ত্রীলোক। না, আমার নিজের সন্তান নহে; আমার ভগিনীর সন্তান। কিন্তু যখন আমি উহাকে প্রতিপালন করিতেছি, তখন আমারই সন্তান নয় ত কি?

আমি। আমি ওসকল মিথ্যা কথা শুনিতে চাহি না। তুমি জান আমি কে? তোমাকে আমি পূৰ্বেই সতর্ক করিয়া দিতেছি, তুমি মিথ্যা কথা কহিও না। মিথ্যা বলিলে তোমার সবিশেষরূপ অনিষ্ট ভিন্ন কখনই ইষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই। আমি পুর্বে সকল কথা জানিতে পারিয়াছি, তাঁহার পর তোমার নিকট আগমন করিয়াছি। প্রকৃত কথা না বলিলে, আমি তোমাকে ধরিয়া লইয়া যাইব।

স্ত্রীলোক। আপনি কে?

আমি। আমি পুলিস-কর্ম্মচারী। তুমি এই বালকটীকে অপ হরণ করিয়া লইয়া আসিয়াছ। তোমার নামে বালক-চুরির নালিশ হইয়াছে, তাই আমি তাহার অনুসন্ধান করিতে আসিয়াছি, এবং মাল, আসামী, উভয়ই পাইয়াছি। এখন তুমি আমার নিকট প্রকৃত কথা বলিবে কি?

স্ত্রীলোক। আমি প্রকৃতই বলিতেছি, আমি এই বালককে চুরি করিয়া আনি নাই।

আমি। যদি চুরি করিয়া না আনিলে, তাহা হইলে তুমি ইহাকে পাইলে কোথায়?

স্ত্রীলোক। কোন স্থানে পড়িয়াছিল, দেথিয়া আমি উহাকে উঠাইয়া আনিয়া যত্নে প্রতিপালন করিতেছি। আমি চুরি করিয়া আনিব কেন?

আমি। যদি তুমি ইহাকে অপহরণ করিয়া আন নাই, তাহা হইলে ইহার পিতামাতার নিকট তুমি ইহাকে লইয়া যাও নাই কেন?

স্ত্রীলোক। আমি জানি না উহার পিতামাতা কে?

আমি। থানায় গিয়া ইহাকে জমা দেও নাই কেন?

স্ত্রীলোক। বালক পাইলে যে থানায় গিয়া জমা দিতে হয়, তাহা আমি জানি না। আমি মনে করিয়াছিলাম, যাহার বালক, সে আসিয়া লইয়া যাইবে।

আমি। এই বালকটী পড়িয়াছিল, আর তুমি যে ইহাকে পাইয়াছ, এই কথা কাহাকেও বলিয়াছ?

স্ত্রীলোক। না।

আমি। কেন বল নাই?

স্ত্রীলোক। ভয়ে বলি নাই।

আমি। তুমি এই বালকটীকে কোথায় পাইয়াছিলে?

স্ত্রীলোক। যে স্থানে পাইয়াছিলাম, সেই স্থানের নাম আমি অবগত নহি। আমার সহিত চলুন, আমি দেখাইয়া দিব।

আমি। কোন্ স্থানে পড়িয়াছিল?

স্ত্রীলোক। একটী ময়দানের মধ্যে।

আমি। মিথ্যা কথা। তুমি ইহাকে ময়দানের মধ্যে পাইয়াছ, তাহা আর কে অবগত আছে?

স্ত্রীলোক। আর কেহই জানে না।

আমি। এখন আর মিথ্যা কথা বলিও না। কোন একখানি জাহাজের মধ্য হইতে তুমি ইহাকে উঠাইয়া আনিয়াছ, আর এখন মিথ্যা করিয়া বলিতেছ, একটী ময়দানে এ পড়িয়াছিল।

স্ত্রীলোক। না, আমি জাহাজ হইতে আনি নাই। আমি জাহাজে কি করিতে যাইব?

আমি। ইহার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার ছিল, সেই সকল অলঙ্কার কোথায়?

স্ত্রীলোক। ইহার অঙ্গে কোন অলঙ্কার ছিল না।

আমি। আমি তোমাকে এখনও সতর্ক করিয়া দিতেছি যে, তুমি এখনও প্রকৃত কথা বল। অলঙ্কারের সহিত তুমি ইয়াকে জাহাজ হইতে আনিয়াছ কি না?

স্ত্রীলোক। না মহাশয়! আমি ইহাকে জাহাজ হইতে আনি নাই।

আমি। আমি এখনই তোমার ঘর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিব। তোমার ঘর হইতে যদি কোন অলঙ্কার বাহির হয়, তাহা হইলে তুমি জানি যে, কোনরূপেই তোমার নিষ্কৃতি নাই।

স্ত্রীলোক। অনায়াসেই আপনি আমার ঘর অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে পারেন।

স্ত্রীলোকের শেষ কথাটী শুনিয়া আমার মনে একটু সন্দেহ হইল। একবার ভাবিলাম, হয় ত প্রকৃতই এ অলঙ্কারের সহিত জাহাজ হইতে এই বালকটীকে আনয়ন করে নাই। অপর কোন ব্যক্তি জাহাজ হইতে ইহাকে আনিয়া উহার অঙ্গ হইতে অলঙ্কার গুলি অপহরণ করিয়া ইহাকে কোন স্থানে নিক্ষেপ করিয়া চলিয়া গিয়াছিল। পরিশেষে এই স্ত্রীলোকটী ইহাকে সেই অবস্থায় দেখিতে পাইয়া উঠাইয়া আনিয়াছে।

মনে মনে এইরূপ একবার ভাবিলাম সত্য; কিন্তু উহার কথায় আমি একবারে বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। উহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া উহার ঘর অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।

সেই স্ত্রীলোকটী যখন দেখিল যে, আমি উহার ঘর অনু সন্ধান করিতে কোনরূপেই নিবৃত্ত হইলাম না, তখন সে আমার দুইখানি পা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, আমি প্রকৃত কথা বলিতেছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আর মিথ্যা কথা বলিব না, আমি জাহাজ হইতে ইহাকে আনয়ন করিয়াছি।

আমি। অলঙ্কারগুলি?

স্ত্রীলোক। আমার ঘরে আছে।

আমি। বাহির করিয়া আন।

আমার কথা শুনিয়া সেই স্ত্রীলোকটী আপন ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল ও মৃত্তিকা নির্মিত একটী পুরাতন হাঁড়ির মধ্য হইতে কতকগুলি মূল্যবান্ অলঙ্কার বাহির করিয়া আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল। সেই বালকের অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহার একটা তালিকা তাহার পিতা পূৰ্বেই আমাকে প্রদান করিয়াছিলেন, এবং তালিকার নকল আমার পকেট বহিতে লেখা ছিল। তাহার সহিত আমি গহনাগুলি মিলাইয়া দেখিলাম। দেখিলাম, কেবলমাত্র একখানি ছোট গহনা ব্যতীত আর সমস্ত গুলিই উহাতে আছে। সেই গহনাখানির কথা জিজ্ঞাসা করায়, সে কহিল, ওই গহনাখানি উহার অঙ্গে ছিল না, আমি উহা পাই নাই। যখন আমি সমস্ত গহনাই বাহির করিয়া দিতে পারিলাম, তখন সেই সামান্য গহনাখানি লইয়া আমি কি করিব?

সেই স্ত্রীলোকের এ কথা কিন্তু আমি বিশ্বাস করিলাম না। আমার মনে সন্দেহ হইল, সেই ছোট গহনাখানি সে কোথায় বিক্রয় করিয়া তাহার দ্বারা নিজের ও বালকের আহারের খরচের সংস্থান করিতেছে। সুতরাং সেই সামান্য একখানি গহনার নিমিত্ত আমি তাহাকে লইয়া আর সবিশেষ পীড়াপীড়ি করিলাম না। গহনা গুলি ও বালকটীকে সঙ্গে লইয়া আমি পূর্ব-কথিত সেই বাজারে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে দুইটী স্ত্রীলোকের নিকট হইতে আমি এই সন্ধান প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, যাইবার সময় তাহাদিগকে বলিয়া গেলাম যে, তৎপরদিবস বৈকালে তাঁহারা যেন আমার সহিত সেই বাজারে সাক্ষাৎ করে। সেই সময় তাহাদিগের প্রাপ্য পারিতোষিকের টাকা তাহাদিগকে প্রদান করিব। উঁহারা আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমিও সেই স্থান হইতে বালক, অলঙ্কার প্রভৃতি লইয়া বাজারে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বাজারে পৌঁহুছিয়া সেই বালকের পিতা সেই বড় মানুষটীকে তথায় আনিবার নিমিত্ত দ্রুতগতি একটী লোক পাঠাইয়া দিলাম।

পরদিবস অতি প্রত্যূষেই বালকের পিতা লোকজনের সহিত তোয় আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং বালকটীকে দেখিয়াই ক্ৰন্দন করিয়া ফেলিলেন। পূৰ্ব্ব-কথিত স্ত্রীলোকদ্বয়কে আমি যে পারিতোষক প্রদান করিতে স্বীকার করিয়াছিল, তাহা তাঁহার নিকট বলিবা মাত্র তিনি সেই টাকা আমার হস্তে প্রদান করিলেন। পূর্বদিনের কথামত বৈকালে সেই স্ত্রীলোকদ্বয় আগমন করিলে, আমি সেই অর্থ তাহাদিগকে প্রদান করিলাম। বালকের পিতা উভয়কে আরও পঞ্চাশ টাকা প্রদান করিলেন, এবং বে স্ত্রীলোকটীর নিকট হইতে বালকটী ও গহনাগুলি পাওয়া গিয়াছিল, তাহার পারিতোধিক স্বরূপ তিনি দুইশত টাকা আমার হস্তে প্রদান করিলেন। কিন্তু আমি কহিলাম, এই স্ত্রীলোকটী যে অপরাধ করিয়াছে, তাহার নিমিত্ত ইহার দণ্ড হইবে, কি ইহাকে পারি তোযিক প্রদান করা যাইবে? উত্তরে তিনি কহিলেন, ও যে অপরাধ করিয়াছে, আইনে তাহার দও থাকিলে, উহার দণ্ড হওয়া উচিত; কিন্তু আমার পুত্রীকে যে জীবিত অবস্থায় রাখিয়া এ পর্যন্ত উহাকে খাওয়াইয়াছে, পরাইয়াছে, তাহার নিমিত্ত উহাকে দুইশত টাকা পারিতোষিক প্রদান করিতেছি।

তাঁহার নিকট হইতে আমি সেই দুইশত টাকা গ্রহণ করি লাম সত্য; কিন্তু এরূপ অবস্থায় আমার সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর আদেশ ব্যতীত আমি তাহাকে অব্যাহতি প্রদান করিতে সাহসী হইলাম না।

যে একখানি সামান্য অলঙ্কার পাওয়া গেল না, বালকের পিতামাতা, চাকর-চাকরাণী প্রভৃতি কেহই স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারিল না, যে সময় ভুল-ক্রমে বালকটীকে পরিত্যাগ করা হইয়া ছিল, সেই সময় সেই অলঙ্কারখানি তাহার অঙ্গে ছিল কি না?

কিরূপে সেই স্ত্রীলোকটী বালককে পাইল, তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল যে, কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে দুই তিনদিবস পূর্বে সে উলুবেড়িয়ায় গমন করিয়াছিল। সেই স্থান হইতে প্রত্যা বৰ্তন করিবার সময় যে জাহাজ হইতে বড়লোকটী সপরিবারে উলুবেড়িয়ায় অবতরণ করেন, সে উলুবেড়িয়া হইতে সেই জাহাজে উঠিয়া আপনার গ্রামে আগমন করিতেছিল। জাহাজে উঠিয়া যে কামরায় ওই বালকটী ছিল, সে সেই দিকে গমন করে, এবং দেখিতে পায়, সেই কামরায় একখানি বেঞ্চের উপর ওই বালকটিী অলঙ্কার-ভূষিত হইয়া নিদ্রিত রহিয়াছে। বালকটীর এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, কিয়ৎক্ষণ সে সেই স্থানে অপেক্ষা করে; কিন্তু সেই স্থানে উহার কোন লোকজনকে দেখিতে না পাইয়া, ভুল-ক্রমে কেহ তাহাকে ফেলিয়া গিয়াছে, এই ভাবিয়া তাহাকে আপন বাড়ীতে লইয়া যায়।

বালক, বালকের পিতা, অলঙ্কার ও সেই স্ত্রীলোকটীকে লইয়া আমি কলিকাতায় আসিলাম, এবং আমার সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর নিকট উপস্থিত হইয়া তাহাকে সকল কথা বললাম। সেই স্ত্রীলোকের উপর মোকদ্দমা চালান যাইতে পারে, আইনে এরূপ কোন বিধান না পাওয়ায়, তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল, এবং বালকের পিতার ইচ্ছানুযায়ী প্রদত্ত পূৰ্ব্ব-কথিত দুইশত টাকাও তাহাকে প্রদান করা হইল। সে হাসিতে হাসিতে আপন গৃহাভি মুখে প্রস্থান করিল।

বলা বাহুল্য যে, এই বালকের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমিও আমার সমস্ত খরচ-পত্রাদি ও উপযুক্ত পারিতোষিক যথাসময়ে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম।

। সম্পূর্ণ ।

দায়ে খুন

দায়ে খুন (অর্থাৎ যেমন জুয়াচুরি তেমনই সাজা!)
DETECTIVE STORIES No, ৪3. দারোগার দপ্তর ৮৩ম সংখ্যা।
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে এবাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। ফাল্গুন।
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.

দায়ে খুন।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

একদিবস প্রাতঃকালে কেবলমাত্র আমি আমার আফিসে আসিয়া বসিয়াছি, এরূপ, সময়ে একজন মাড়োয়ারী আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। ইহার বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের অনধিক। ইহাকে দেখিয়া, বেশ একজন চালাক ব্যবসায়ী লোক বলিয়া অনুমান হয়। আমাকে দেখিয়া তিনি কহিলেন, মহাশয়! আমি আপনার সহিত একটী সবিশেষ পরামর্শ করিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছি। যে বিষয় জিজ্ঞাসা করিবার নিমিত্ত আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি, তাহা অতি সামান্য বিষয় হইলেও, আমি তাহার কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না বলিয়া, আমি আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। যদি অনুগ্রহপূর্ব্বক আপনি আমার কথা গুলি শ্রবণ করেন, এবং আমার কি করা কৰ্তব্য, সে সম্বন্ধে একটু পরামর্শ প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি সবিশেষরূপ বাধিত হইব।

মাড়োয়ারীর কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, আপনি যাহা বলিতে চাহেন, অনায়াসেই তাহা আমাকে বলিতে পারেন। আপনার সমস্ত কথা শ্রবণ করিয়া, যদি বুঝিতে পারি, আমার দ্বারা কোনরূপে আপনার উপকার হইবার সম্ভাবনা, তাহা আমি করিতে প্রস্তুত আছি।

আমার কথা শুনিয়া সেই মাড়োয়ারী বলিতে আরম্ভ করিল, মহাশয়! আমার নাম বালমুকুন্। আমি বাল্যকাল হইতে ব্যবসা-কাৰ্য ব্যতীত অপর কোন কাৰ্য শিক্ষা করি নাই। এ পৰ্য্যন্ত ব্যবসা-কাৰ্যেই নিজের দিন অতিবাহিত করিয়া আসি তেছি; কিন্তু আপন দুরদৃষ্ট বশতঃ এ পর্যন্ত নিজে কোনরূপ কারবার করিতে সমর্থ হই নাই, চিরকালই পরের অধীনেই কাৰ্য্য করিয়া আসিয়াছি। এই কলিকাতা সহরে অনেক দিবস হইতে অবস্থিতি করিয়া কোন একটা প্রধান মাড়োয়ারীর সমস্ত কাৰ্য আমি নিজে নির্বাহ করিয়া আসিতেছিলাম। আমি যতদিন পর্যন্ত তাঁহার কাৰ্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, সেই পৰ্যন্ত কোনরূপেই তাহার একটামাত্র পয়সাও লোকসান হয় নাই; বরং দিন দিন আমি তাহার কাৰ্য্যের উন্নতি করিয়াই আসিতে ছিলাম। আমি কলিকাতায় থাকিতাম সত্য; কিন্তু ভারতবর্ষের নানাস্থানে তাহার এক একটী ফারম ছিল। আমি কলিকাতায় থাকিয়া, সেই সমস্ত ফারমের কার্য নির্বাহ করিয়া আসিতে ছিলাম। এই সকল ফারম হইতে আমার মনিব যথেষ্ট অর্থ সংগ্রহ করিয়া তাহার দেশে তিনি এখন একজন বড়মানুষের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছেন। তিনি অর্থের যথেষ্ট সংস্থান করিয়া ছেন সত্য; কিন্তু তাহার অবর্তমানে সেই অর্থ ভোগ করিতে পারিবে, তাহার এরূপ আর কেহই নাই। একমাত্র পুত্র ছিল, তিনি বড় হইয়া ইদানীং মধ্যে মধ্যে নিজের ব্যবসায়ের তত্ত্বাবধান করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। কিন্তু আজ কয়েকমাস হইল, হঠাৎ তাঁহারও মৃত্যু হইয়াছে। এই কারণে আমার মনিব মনের দুঃখে তাহার যে স্থানে যে কোন কারবার ছিল, তাহার সমস্ত কাৰ্য্য উঠাইয়া দিয়াছেন। যখন আমার মনিব তাহার সমস্ত ব্যবসা বন্ধ করিয়া দিলেন, তখন আর আমার চাকরী থাকিবে কি প্রকারে? পারিতোষিক বলিয়া, আমাকে নগদ দুই সহস্র মুদ্রা প্রদান করিয়া আমাকে তাঁহার চাকরী হইতে জবাব দিলেন।

নগদ দুই সহস্র মুদ্রা হস্তে পাইয়া আমি একবার মনে করি লাম, এতদিবস পরের নিকট চাকরী করিয়া দিন যাপন করি য়াছি, এখন আর কাহার নিকট পুনরায় উমেদারী করিয়া বেড়াইব? এই মূলধন অবলম্বন করিয়া কোন একটা কারবার আরম্ভ করি, তাহাতেই কোনরূপে আপনার দিন অতিবাহিত করিব। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, কারবারে প্রবৃত্ত হইবার উদ্যোগ করিতেছি, এরূপ সময় জানিতে পারিলাম যে, বোম্বাই সহরের কোন একটা প্রধান মাড়োয়ারী ফারমের মনিব গোমস্তার হঠাৎ মৃত্যু হওয়ায়, সেই চাকরী খালি হইয়াছে। বোম্বাই সহরের সেই ফারমের নাম আমি পূৰ্ব্ব হইতেই অবগত ছিলাম। আমার পূর্ব্বতন মনিবের ফারমের সহিত সেই ফারমের সৰ্ব্বদা কারবার চলিত; কিন্তু আমাদিগের পরস্পরের মধ্যে কাহারও সহিত কাহারও চাক্ষুষ দেখা-শুনা ছিল না। আমি জানিতাম, বোম্বায়ের সেই ফারম অতিশয় পুরাতন, কারবার বহু-বিস্তৃত ও সর্বজনবিদিত।

সেই ফারমের মনিব-গোমস্তার পদ শূন্য হইয়াছে জানিতে পারিয়া, সেই পদ-প্রার্থী হইয়া, আমি সেই স্থানে একখানি দরখাস্ত করিলাম। আমি যে ফারমে কাৰ্য্য করিতাম, এবং যে কারণে এখন আমার কৰ্ম্ম নাই, দরখাস্তে তাহারও সমস্ত অবস্থা আমি বিস্তৃতরূপে লিখিয়া দিলাম। যে পদের প্রার্থী হইয়া আমি দরখাস্ত করিলাম, সেই পদ যে আমি প্রাপ্ত হইব, সে আশা আমার অতি অল্পই ছিল। কারণ, বোম্বাই-প্রদেশে সেই কার্যের উপযোগী অনেক লোক বর্তমান থাকিতে তাঁহারা একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে কেন সেই পদে নিযুক্ত করিবেন? সে যাহা হউক, আমার মনে যতদূর আশা ছিল, তাহার অধিক কাৰ্য্যে পরিণত হইল। দরখাস্ত প্রেরণ করিবার এক সপ্তাহ পরেই আমি সেই ফারম হইতে একখানি পত্ৰ পাইলাম। পত্রখানি পাঠ করিয়া আমি অতিশয় বিস্মিত হইলাম। দেখিলাম, আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হইয়াছে, বাৎসরিক ছয়শত টাকা বেতনে আমাকে সেই কার্যে নিযুক্ত করা হইয়াছে। উহাতে আরও লেখা আছে যে, এই পত্র পাইবার পর দশদিবসের মধ্যেই সেই স্থানে গমন করিয়া আমাকে আমার নূতন কার্যে নিযুক্ত হইতে হইবে।

সেই পত্র পাইয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। ইতিপূর্বে যাহার নিকট আমি কাৰ্য্য করিতাম, তাহার নিকট হইতে আমি বাৎসরিক চারিশত আশী টাকা বেতন পাইতাম। এখন তাহা অপেক্ষা আমার একশত কুড়ি টাকা অধিক বেতন হইল। সুতরাং নূতন চাকরী সম্বন্ধে আমি আর কোনরূপ ইতস্ততঃ না করিয়া ব্যবসা করিবার যে ইচ্ছা করিতেছিলাম, তাহা পরিত্যাগ করিয়া বোম্বাই সহরে গমন করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম।

যে দিবস আমি কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া বোম্বাইয়ে গমন করিবার মনস্থ করিয়াছিলাম, তাহার তিন চারিদিবস পূৰ্বে একটী লোক আসিয়া হঠাৎ আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। তিনি যে কি করিয়া আমার বাসা চিনিলেন, তাহা আমি বলিতে পারিলাম, বা বুঝিতেও পারিলাম না। ইতিপূর্বে আর কখনও যে আমি তাঁহাকে দেখিয়াছি, তাহাও আমার বোধ হইল না। তিনি হঠাৎ আমার নিকট উপস্থিত হইয়াই কহিলেন, মহাশয়ের নামই কি বালমুকুন্?

আমি। হ মহাশয়! আমারই নাম বালমুকুন্। আগন্তুক। আপনি যে ফারমে কাৰ্য্য করিতেন, সেই ফারম এখন উঠিয়া গিয়াছে?

আমি। ধনী ইচ্ছা করিয়া তাহার দেনা-পাওনা মিটাইয়া দিয়া তাহার কারবার উঠাইয়া দিয়াছেন।

আগন্তুক। তাহা হইলে বোধ হয়, আপনি এখন বেকার বসিয়া আছেন?

আমি। বেকার বসিয়াছিলাম বটে; কিন্তু এখন বেকার বসিয়া আছি, তাহা আর বলিতে পারি না।

আগন্তুক। আপনার একথার অর্থ আমি বেশ বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।

আমি। চাকরী যাওয়ার পর, আমি কিছুদিবস বসিয়াছিলাম বটে; কিন্তু সম্প্রতি একটী চাকরীর যোগাড় হইয়াছে। এই নিমিত্তই আমি বলিতেছি, এখন আর আমি বেকার অবস্থায় বসিয়া নাই। কেন মহাশয়! আপনি আমাকে এ সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?

আগন্তুক। জিজ্ঞাসা করিবার সবিশেষ কারণ আছে বলিয়াই, জিজ্ঞাসা করিতেছি। আপনাকে একটা চাকরীতে নিযুক্ত করি বার মানসেই আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছিলাম।

আমি। আমাকে একটী চাকরী প্রদান করিবার মানসেই আপনি আমার নিকট আগমন করিয়াছেন, একথার অর্থ আমি সবিশেষরূপে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

আগন্তুক। ইহার অর্থ এমন সবিশেষ কিছু নহে যে, আপনি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। আমি যে মহাজনের অধীনে কৰ্ম্ম করি, তিনি একজন প্রসিদ্ধ ধনী। তিনি জাতিতে মাড়োয়ারী ব্রাহ্মণ; কিন্তু কেবল বঙ্গদেশ ব্যতীত এমন কোন স্থান নাই যে, সেই সকল স্থানে তাহার ফারম বা কারবার নাই। মাদ্রাজ হইতে হিমালয়, বোম্বাই, এবং গুজরাট হইতে বেনারস প্রভৃতি স্থানের মধ্যে যে যে স্থানে প্রধান প্রধান নগর আছে, সেই সেই স্থানেই তাঁহার একটী একটী শাখা ফারম আছে। আমার বোধ হয়, বঙ্গদেশ ব্যতীত এক ভারতবর্ষের মধ্যে অল্প-বিস্তর তিনশত স্থানে তাহার কারবার হইয়া থাকে। এখন তাঁহার নিতান্ত ইচ্ছা যে, তিনি বঙ্গদেশের মধ্যেও আপনার কারবার বিস্তৃত ভাবে স্থাপন করেন, এই নিমিত্তই আমি কলিকাতায় আসিয়াছি। কলিকাতার মধ্যে একটী প্রধান ফারম স্থাপন করিয়া, ক্রমে বঙ্গদেশের প্রধান প্রধান সমস্ত নগরীতে তাহার এক একটী শাখা ফারম স্থাপন করিয়া আমি আমার স্থানে অর্থাৎ মান্দ্রাজ সহরে গমন করিব। কলিকাতার ফারমের অধীনে অনেকগুলি শাখা ফারম থাকিবে; সুতরাং কলিকাতার নিমিত্ত একজন অতি উপযুক্ত লোকের প্রয়োজন। আমি আমার একজন বন্ধুর পত্রে অবগত হইতে পারিয়াছি যে, যেরূপ কাৰ্য্যের নিমিত্ত আমি উপযুক্ত লোকের অনুসন্ধান করিতেছি, আপনি সেই কাৰ্য্যের ঠিক উপযুক্ত লোক।

তাহার এই কথা শুনিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আমার সম্বন্ধে আপনাকে কে বলিয়াছে, তাহা আমি জানিতে পারি কি?

উত্তরে তিনি আমাদিগের দেশস্থ এক ব্যক্তির নাম করিলেন। দেখিলাম, তাঁহার সহিত আমার সবিশেষরূপ আলাপ-পরিচয় না থাকিলেও, তিনি যে একবারে আমার নিকট অপরিচিত, তাহা নহে। সুতরাং আমি মনে ভাবিয়াছিলাম, তাহা হইলে হয় ত প্রকৃতই তিনি আমার কথা বলিয়া থাকিবেন।

তাহার পর তিনি কহিলেন, মহাশয়! এখন আমি আপনার নিকট কি নিমিত্ত আগমন করিয়াছি, তাহা এখন বোধ হয়, বেশ বুঝিতে পারিলেন?

আমি। তাহা ত বুঝিয়াছি, কিন্তু আপনি যে প্রকার কার্যের কথা আমাকে কহিলেন, সেই সকল কাৰ্য্য আমার দ্বারা কোন প্রকারেই সম্পন্ন হওয়া সম্ভবপর নহে। সমস্ত বঙ্গদেশের প্রধান প্রধান নগরীতে এক একটী কাৰ্য্যস্থান স্থাপন করিয়া, সেই সকল কার্যের উত্তমরূপে তত্ত্বাবধান করিতে হইলে, আমাদিগের সদৃশ বুদ্ধিজীবি লোকের দ্বারা সে কাৰ্য্য হইবার সম্ভাবনা নিতান্ত অল্প। আপনি যদি আমার পরামর্শ শ্রবণ করেন, তাহা হইলে আমা-অপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান ও কার্যক্ষম অপর কোন ব্যক্তির অনুসন্ধান করুন।

আগন্তুক। সে অনুসন্ধান করিবার আমার আর কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। যদি আমার বিশ্বাস না হইত, বা অপরের নিকট হইতে আমি উত্তমরূপে অবগত হইতে না পারিতাম যে, আপনার দ্বারা আমাদিগের প্রস্তাবিত কাৰ্য্য সকল সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা নাই, তাহা হইলে বোধ হয়, আমি কখনই আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইতাম না। সেই কাৰ্য্য আপনার দ্বারা নির্বাহ হইবে না, একথা আপনি ত বলিবেনই। কারণ, যে ব্যক্তির কোন কাৰ্যে উত্তমরূপে পারদর্শিতা থাকে, তিনি কখনই আপনার গুণ আপন মুখে স্বীকার করেন না; অধিকাংশ সময়ে বরং তিনি তাহার বিপরীতই বলিয়া থাকেন। সে যাহা হউক, সেই কাৰ্য্য আপনার দ্বারা সুচারুরূপে নিৰ্বাহ হইতে পারুক আর না পারুক, তাহা আমরা বুঝিতে পারিব। আপনি কোন সময় হইতে আমাদিগের কাৰ্যে নিযুক্ত হইবেন, তাহা এখন আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিন।

আমি। আমি যদি আপনাদিগের কার্য সম্পন্ন করিয়া উঠিতে পারি, তাহা হইলেও কি আপনি সেই কাৰ্য্যে আমাকে নিযুক্ত করিতে চাহেন?

আগন্তুক। তাহা হইলেও চাহি।

আমি। এরূপ অবস্থাতেও যদি আপনি আপনাদিগের কাৰ্য্যে নিযুক্ত করিতে চাহেন, তাহা হইলে আমাকে সবিশেষ দুঃখের সহিত বলিতে হইতেছে যে, এখন আমি অপর কোন স্থানে চাকরী গ্রহণ করিতে অসমর্থ।

আগন্তুক। কেন?

আমি। আমি ইতিপূর্বে অপর আর এক স্থানে চাকরী, স্বীকার করিয়াছি, এবং সেই স্থানে শীঘ্রই গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতেছি।

আগন্তুক। সে কোথায়?

আমি। বোম্বাই সহরে। এরূপ অবস্থায় বলুন দেখি মহাশয়! আমি কিরূপে আপনার চাকরী করিতে সম্মত হইতে পারি?

আগন্তুক। আপনি একটী কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন মাত্র; কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই স্থানে গমন বা সেই কাৰ্য্য করিতে আরম্ভ করেন নাই। বাল্যকাল হইতে আরম্ভ করিয়া পরের নিকট চাকরী করিতে করিতে আপনি এখন এত বড় হইয়া ছেন। বলুন দেখি, কোন লোক কোন স্থানে কৰ্ম্ম করিতে করিতে যদি অপর কোন স্থানে কিছু সুবিধা বিবেচনা করেন, তাহা হইলে তিনি সেই কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া অপর কোন কাৰ্য্যে গমন করেন কি না? আমার বোধ হয়, আপনার পরি চিত যত লোক এইরূপ ভাবে এক স্থান হইতে কৰ্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া অপর স্থানে গমন করিয়াছেন, তাহার একটী দুইটা তালিকা আপনি এখন হঠাৎ প্রস্তুত করিয়া দিতে পারেন। মূল কথা, এরূপ লোকের সংখ্যা জগতে এত অধিক যে, তাহা ঠিক করা সহজ নহে। আপনি যখন অপর কাৰ্য্য করিতে প্রবৃত্ত হন নাই, তখন সেই কাৰ্য্যে আপনাকে যে গমন করিতেই হইবে, তাহার অর্থ নাই। যে স্থানে আপনি আপনার নুতন চাকরী প্রাপ্ত হইতেছেন, সেখানে তাঁহারা আপনাকে কিরূপ বেতন দিতে স্বীকার করিয়াছেন, তাহা আমি জানিতে পারি কি?

আমি। তাহা বলিতে আমার কিছুমাত্র প্রতিবন্ধক নাই। তাঁহারা আমাকে যে বেতন দিতে সম্মত হইয়াছেন, তাহা কিছু অধিক নহে; বরং একরূপ সামান্য। বাৎসরিক তাঁহারা আমাকে ছয়শত টাকা প্রদান করিবেন।

আগন্তুক। একথা আপনাকে আমার পূর্বে বলা উচিত ছিল। কারণ, তাহা হইলে এতগুলি বাজে কথা লইয়া আমাদিগের সময় নষ্ট করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন হইত না। যখন চাকরীই আপনার উপজীবিকা, তখন আপনাকে চাকরী করিতেই হইবে। যখন চাকরীই করিতে হইল, তখন ভাল ঘরে অধিক বেতন পাইলে সে সুযোগ কে পরিত্যাগ করিতে চাহে?

আমি। আপনারা আপনাদিগের প্রস্তাবিত কৰ্ম্মের নিমিত্ত যে লোক নিযুক্ত করিতে ইচ্ছা করিতে চাহিতেছেন, তাহার নিমিত্ত তাহাকে কিরূপ বেতন দিতে ইচ্ছা করিতেছেন?

আগন্তুক। আমি নিজে ধনী নহি, বা আমার নিজের কারবার নহে। আমার মনিব আছে, আমিও আমার মনিবের একজন বেতন-ভোগী চাকর। আমাদিগের মনিবের নিয়ম আছে, তিনি তেঁাহার কোন লোকজনকে বাৎসরিক হিসাবে বেতন প্রদান করেন না। কারণ, তিনি বেশ জানেন, যিনি যেরূপ বেতনের চাকরই হউন না কেন, সেই বেতন হইতে তাহাকে তাহার পরিবার প্রতিপালন করিতে হয়। সুতরাং বৎসরান্তে বেতন পাইলে, কোন ব্যক্তিই তাঁহার পরিবারবর্গকে প্রতিপালন করিতে সমর্থ হন না। এই নিমিত্ত আমার মনিবের আদেশ যে, তাহার চাকমাত্রেই মাসিক হিসাবে বেতন প্রত্যেক মাসের প্রথম সপ্তাহের ভিতরেই পাইবে। আপনার নিমিত্ত প্রথমেই আমার মনিবের সহিত কথা হইয়াছিল। তিনি আমাকে বলিয়া দিয়া ছিলেন যে, সেই কার্য্যের নিমিত্ত যদি তিনি কোন একজন ভাল লোক প্রাপ্ত হন, তাহা হইলে তাহার মাসিক বেতন তিনি তিনশত টাকা পর্যন্ত ক্রমে প্রদান করিবেন। এখন কিন্তু একশত টাকার অধিক দিবেন না। ভাল করিয়া তাহার মনোমত কাৰ্য্য করিতে পারিলে, প্রত্যেক বৎসরে পচিশ টাকা হিসাবে বাড়াইয়া দিবেন। এইরূপে ক্রমে তাঁহার বেতন মাসিক তিনশত টাকায় আসিয়া উপস্থিত হইবে, তাহার পর তাহার বেতন আর অধিক বাড়িবে না। এখন মহাশয়! দেখুন দেখি, মাসিক একশত টাকা হিসাবে বেতন হইলেও, বাৎসরিক হিসাবে আপনার বেতন হইল—বারশত টাকা, অর্থাৎ যাহা এখন আপনি পাইবেন বলিয়া ঠিক হইয়াছিল, তাহার দ্বিগুণ। এরূপ অবস্থায়ও আপনি আমার প্রস্তাবিত বিষয়ে সম্মত হইতে পারিবেন কি না, সেই বিষয়ে একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন।

তাহার এই কথা শুনিয়া আমি মনে করিলাম, এই ব্যক্তি যাহা বলিতেছে, তাহা ত প্রকৃতই। যখন পরাধীনতা স্বীকার করিয়া চাকরী করিতেই প্রবৃত্ত হইয়াছি, তখন যে স্থানে অধিক অর্থ পাওয়া যাইতেছে, সেই স্থান পরিত্যাগ করি কেন? বিশেষতঃ যে ব্যক্তি আমার বাড়ীতে আসিয়া আমাকে তোমোদ করিয়া, অধিক বেতনে আমাকে একটী চাকরী প্রদান করিতেছে, তখন সেই চাকরীই বা আমি হেলায় পরিত্যাগ করি কেন? মাসিক পঞ্চাশ টাকার পরিবর্তে একশত টাকাই বা গ্রহণ না করি কেন? আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, এরূপ অবস্থায় এরূপ সুযোগ পরিত্যাগ করা, কোন ক্রমেই যুক্তিসঙ্গত নহে।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি সেই ব্যক্তিকে কহিলাম, মনে করুন, আমি যদি আমার চাকরী পরিত্যাগ করিয়া আপনা দিগের কাৰ্য্য করিতেই প্রবৃত্ত হই, তাহা হইলে কোন্ তারিখ হইতে আমাকে সেই কার্যে নিযুক্ত হইতে হইবে?।

আগন্তুক। এখন হইতেই আমি আপনাকে নিযুক্ত করিব, আজ হইতেই আপনি আমাদিগের কাৰ্য্য করিতে আরম্ভ করিবেন।

আমি। দেখুন মহাশয়! আমি যে ফারমে চাকরী স্বীকার করিয়াছি, সেই ফারম জগদ্বিখ্যাত ও বহুদিবসের পুরাতন ফারম। আপনার পরামর্শে সেই স্থান হইতে চাকরী পরিত্যাগ করিয়া অন্য স্থানে গমন করা কি যুক্তিসঙ্গত?

আগন্তুক। আমাদিগের ফারম যদি সামান্য ফারম হইত, তাহা হইলে আপনার চাকরী পরিত্যাগ করিতে আমি কখনই পরামর্শ প্রদান করিতাম না। আপনি যে কারমের কথা বলিতে ছেন, সেই ফারম অপেক্ষা ধনবান্ ও উৎকৃষ্ট ফারম এ দেশে যদি কাহারও থাকে, তাহা আমাদিগের। যে ফারমের শাখা ভারতবর্ষের সমস্ত প্রধান প্রধান নগরীতে আছে, সেই স্থানে চাকরী করা শ্লাঘার বিষয়। বিশেষতঃ আপনি আমাদিগের ফরমের নিয়ম প্রভৃতি অবগত নহেন বলিয়াই, এইরূপ কথা বলিতেছেন। আমাদিগের ফারমের কর্ম্মচারীগণ তাহাদের কার্যদক্ষতা দেখাইয়া আপনাদের কাৰ্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে পারিলে, মূল ফারমের লভ্য অংশ হইতে কমিশন বলিয়া বাৎসরিক একটী অংশও পাইয়া থাকেন। সে অংশ শুনিতে অতি সামান্য হইলেও, কাৰ্য্যে কিন্তু সামান্য নহে। এমন কি, এক একজন কর্ম্মচারী বৎসর বৎসর তাহার বেতনাদি বাদে পাঁচ ছয় সহস্র পৰ্য্যন্ত টাকা পাইয়া থাকেন। তদ্ব্যতীত আমাদিগের কাৰ্য্যের আর একটী প্রধান সুবিধা আছে, যে সুবিধা কেবলমাত্র আমাদিগের ফারম ব্যতীত এ পর্যন্ত অপর কোন স্থানেই পরিলক্ষিত হয় নাই। যিনি যে স্থানেই চাকরী করুন না কেন, একমাস চাকরী পূর্ণ না হইলে সেই মাসের বেতন কেহই প্রাপ্ত হন না; কিন্তু আমাদিগের নিয়ম সেরূপ নহে। আমরা সকলেই অগ্রিম বেতন পাইয়া থাকি, অর্থাৎ যেমন মাস পড়িবে, অমনি আমরা সেই মাসের বেতন অগ্রিম প্রাপ্ত হইব। এরূপ অবস্থায় আপনি সবিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখুন যে, আপনি আমাদিগের সরকারে কাৰ্য্য করিতে প্রস্তুত আছেন কি না? যদি আপনি আমাদিগের প্রস্তাবিত চাকরী গ্রহণ করিতে সম্মত হন, তাহা হইলে আপনি কল্য আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। এখন আমি আপন স্থানে প্রস্থান করিতেছি।

এই বলিয়া তিনি প্রত্যাগমন করিতে উদ্যত হইলে, আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, মহাশয়! আমি কল্য আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়া, কাহার অনুসন্ধান করিব? মহাশয়ের নাম ত আমি এ পর্যন্ত জানিতে পারি নাই।

আগন্তুক। আমার নাম মাণিক চাঁদ। আপনি আমার নাম করিয়া অনুসন্ধান করিলেই আমাকে দেখিতে পাইবেন।

আমি। কোন্ স্থানে গমন করিলে, আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে সমর্থ হইব?

মাণিক। আমার বাসায়।—না, আমার বাসায় যাইবার প্রয়োজন নাই, বেলা দশটা হইতে পাঁচটা পর্যন্ত আমি আমার বাসায় থাকিব না। নির্জনে একটী ঘর লইয়াছি, সেই স্থানে বসিয়া আমি কি প্রণালীতে কার্যের বন্দোবস্ত করিব, তাহাই ঠিক করিতেছি। আপনি সেই স্থানে গমন করিবেন, সেই স্থানেই আমার সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইবে।

আমি। সে স্থান কোথায়?

মাণিক। বড়বাজার রাজার কারা। রাজার কাটরায় দোতালার উপর পচিশ ছাব্বিশ নম্বরের ঘর।

আমি। আচ্ছা মহাশয়অদ্য আমি এ বিষয় একটু সবিশেষ রূপে বিবেচনা করিয়া দেখি, এবং আমার দুই একজন বন্ধু-বান্ধবের সহিত পরামর্শ করিয়া দেখি। পরামর্শ করিয়া আমি যেরূপ সাব্যস্ত করিব, তাহা আমি আপনার নিকট গমন করিয়া বলিয়া আসিব। যদি আপনাদিগের নিকট চাকরী করি, তাহাও গিয়া বলিয়া আসিব, আর না করি, তাহাও আপনাকে জানাইব।

আমার সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, মাণিকবাবু আমার বাড়ী হইতে প্রস্থান করিলেন। সেই চাকরী গ্রহণ করা আমি একরূপ স্থিরই করিয়াছিলাম। তথাপি দুই একজন বন্ধু বান্ধবকে একবার জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য মনে করিলাম।

সেই দিবস রাত্রিতেই আমি আমার দুই একজন বন্ধু-বান্ধবের সহিত পরামর্শ করিলাম, সকলেই আমাকে মাণিকচাঁদের প্রস্তাবিত কাৰ্যে প্রবৃত্ত হইতে পরামর্শ প্রদান করিলেন। আমিও তাহাই স্থির করিয়া পরদিবস মাণিকবাবুর নিকট গমন করিয়া তাহাদিগের ফারমেই কাৰ্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইব, মনে মনে এইরূপ স্থির করিলাম।

পরদিবস বেলা আন্দাজ এগারটার সময় আমি রাজার কাটুরায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। রাজার কাটার প্রত্যেক ঘরই আমি পূৰ্ব্ব হইতে জানিতাম। দোতালার উপর গমন করিয়া পঁচিশ ছাব্বিশ নম্বরের গৃহের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই দুইটা ঘর অনেকদিবস হইতে খালি ছিল। সেখানকার প্রত্যেক ঘরেরই বারান্দার দিকে দুইটী করিয়া দরজা আছে মাত্র। কোন কোন ঘরের মধ্যে এক ঘর হইতে অপর ঘরে যাতায়াত করিবার নিমিত্ত একটী একটী দরজা আছে। কোন ব্যক্তি দুইটী ঘর একত্র গ্রহণ করিলে উভয় ঘরের মধ্য দিয়া যাতায়াতের নিমিত্ত প্রায়ই সেই দরজা খুলিয়া রাখেন। আর যদি কেবলমাত্র একটী ঘর গ্রহণ করেন, তাহা হইলে সেই দরজা বন্ধ থাকে।

আমি পঁচিশ নম্বরের ঘরের সম্মুখে গিয়া দেখিলাম, উহার বাহিরের দুইটী দরজাই ভিতর হইতে বন্ধ। ছাব্বিশ নম্বরের ঘরেরও একটী দরজা ভিতর হইতে বন্ধ; কিন্তু একটা দরজা খোলা। সেই দরজার উপর একখানি পরদা বোলান আছে। সেই পরদার বাহিরে দ্বারবান সদৃশ একটী লোক বসিয়া আচ্ছে। আমি সেই স্থানে গমন করিয়া প্রথমেই সেই দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করিলাম, মাণিকচাঁদ বাবু নামে কোন ব্যক্তি এই স্থানে আছেন কি? তখন সেই দ্বারবান্ সেই ঘর দেখাইয়া দিয়া উত্তরে আমাকে কহিল, হ মহাশয়! বাবুসাহেব এই ঘরেই থাকেন, তিনি এখন ইহার ভিতরেই আছেন।

দ্বারবানের এই কথা শুনিয়া সেই পরদা ঠেলিয়া আমি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, মাড়োয়ারীগণ সর্বদা যেরূপ স্থানে বা যেরূপ ভাবে বসিয়া আপন আপন কার্য নির্বাহ করিয়া থাকেন, ইনি কিন্তু সেরূপ ভাবে বসিয়া আপন কার্যে প্রবৃত্ত নহেন। ঘরের মেঝের উপর কোনরূপ বিছানা বা যেরূপ ভাবে মাড়োয়ারীগণ গদি বিছাইয়া তাহার উপর উপবেশন করেন, সেই ঘরের ভিতর সেইরূপ ভাবের কোন দুবাই নাই। যাহা আছে, তাহা মাড়োয়ার-পদ্ধতির সম্পূর্ণরূপ বিপরীত। সেই ঘরের ঠিক মধ্যস্থলে একখানি টেবিল রহিয়াছে, একখানি চেয়ারে বসিয়া মাণিকচাঁদ সেই টেবিলের উপর কাগজ-পত্র বিছাইয়া লেখাপড়া করিতেছেন, এবং তাহার বাম ও দক্ষিণ দুই পার্শ্বে দুইখানি খালি চেয়ার রাখা আছে।

টেবিলের উপর যে সকল কাগজ-পত্ৰ ছড়ান রহিয়াছে, তাহার মধ্যে মাডােয়রীদিগের ব্যবহার-উপযোগী কোনরূপ খাতা পত্র নাই, কতকগুলি সাদা ও লেখা ফুলিকেপ কাগজ।

আমি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই মাণিকচাঁদ বাবুর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। তখন তিনি সবিশেষ অভ্যর্থনা করিয়া আমাকে তাঁহার বামপার্শ্বের চেয়ারের উপর বসাইলেন। তাহার নির্দেশানুসারে আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কতক্ষণ এখানে আগমন করিয়াছেন?

আমি। এখনই আসিতেছি।

মাণিক। আমার এই স্থান অনুসন্ধান করিয়া লইতে আপনার সবিশেষ কোনরূপ কষ্ট হয় নাই ত?

আমি। কোন কষ্ট হয় নাই; কারণ, এই স্থান আমি উত্তমরূপে চিনি। সুতরাং আপনার এই স্থান অনুসন্ধান করিয়া লইতে আমার কিছুমাত্র কষ্ট হয় নাই।

মাণিক। আপনি এ পর্যন্ত কিছু ঠিক করিয়া উঠিতে পারিয়াছেন কি?

আমি। আমার চাকরী করা সম্বন্ধে?

মাণিক। হাঁ।

আমি। স্থির না করিলে আর আমি এ স্থানে আসিব কেন?

মাণিক। কি স্থির করিলেন, আমাদিগের নিকট চাকরী করা স্থির করিলেন, কি পূৰ্ব্ব হইতে যে স্থানে চাকরী পাইয়াছেন, সেই স্থানেই গমন করাই স্থির হইল?

আমি। না মহাশয়! আমি আর সেই স্থানে গমন করিতেছি। আপনাদিগের অধীনেই চাকরী করাই আমি স্থির করি য়াছি। এখন কোন্ সময় হইতে এবং কোথায় আমাকে কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইতে হইবে, তাহা আপনি আমাকে বলিয়া দিন, আমি সেই স্থানে গমন করিয়া কৰ্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হই।

মাণিক। আমি পূৰ্বেই বলিয়াছি, কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া আপাততঃ আপনাকে কোন স্থানেই গমন করিতে হইবে না। এই স্থান হইতেই সমস্ত কাৰ্য্য নিৰ্বাহ হইবে; কেবলমাত্র মফঃস্বলের যখন যে স্থানে আমাদিগের মনিব একটী করিয়া শাখা-ব্যবসায় স্থাপন করিবেন, সেই সময় কেবলমাত্র একবার সেই স্থানে গমন করিলেই চলিবে। তৎপরে সেই স্থানের কার্যের বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া, পুনরায় আপনি এই কলিকাতায় আগমন করিবেন।

আমি। কোন্ তারিখ হইতে আমি এই কার্যে নিযুক্ত হইব?

মাণিক। অদ্য হইতেই আপনি আমাদিগের কার্যে নিযুক্ত হইলেন। বেতন অদ্য হইতে আপনি পাইবেন; কিন্তু নিয়োগ পত্র আজ আমি আপনাকে প্রদান করিতেছি না। আপনি কল্য এই সময় একবার এখানে আগমন করিবেন, সেই সময়ে আমাদিগের কার্যের নিয়ম অনুসারে আমি আপনাকে একমাসের অগ্রিম বেতন সহ আপনার নিয়োগ-পত্র আপনাকে প্রদান করিব, এবং আপাততঃ আপনাকে কি কি কাৰ্য্য করিতে হইবে, তাহাও আপনাকে বলিয়া দিব। বোম্বাই সহরের যে মহাজনের নিকট আপনি চাকরী পাইয়াছিলেন, তাহার লিখিত যে সকল চিঠিপত্র আপনার নিকট আছে, এবং নূতন কার্যে নিযুক্ত হইবার যে নিয়োগ-পত্ৰ আপনি প্রাপ্ত হইয়াছেন, কল্য যে সময় আপনি আমার নিকট আগমন করিবেন, সেই সময় সেই সকল আপনার সঙ্গে করিয়া আনিবেন।

আমি। সে গুলিতে আপনার প্রয়োজন?

মাণিক। প্রয়োজন আছে বলিয়াই বলিতেছি। আনিলেই দেখিতে পাইবেন।

আমি। আচ্ছা, তাহাই হইবে।

এই বলিয়া আমি সে দিবস সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া, আপন স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। একবার মনে করিলাম, আমার নিয়োগ-পত্ৰ বা চিঠিপত্রে উহার প্রয়োজন কি? কেন আমি সেই সকল দ্রব্য তাহার নিকট লইয়া যাইব। আবার ভাবিলাম, আমি যে অপর স্থানে চাকরী সংগ্রহ করিতে পারি য়াছি, তাহা হয় ত তিনি আমার কথায় বিশ্বাস করেন নাই, এই নিমিত্তই সেই কাগজ দেখিতে চাহিয়াছেন। আমি তাঁহার নিকট যে সকল কথা বলিয়াছি, তাহা প্রকৃত, কি মিথ্যা, তাহাই মাণিকচাঁদ বাবু, বোধ হয়, জানিতে চাহেন। সে যাহাই হউক, সেই সকল কাগজ-পত্র তাহাকে দেখাইতে আমি কোনরূপ অনিষ্ট-জনক বলিয়া বুঝিতে পারিতেছি না।

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া পরদিবস আমি আমার নিয়োগ পত্রের সহিত পুনরায় সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, দ্বারবান্ সেইরূপ ভাবেই বসিয়া আছে, মাণিকচাঁদ বাবু সেই স্থানে সেইরূপ ভাবে বসিয়া সবিশেষ মনোযোগর সহিত আপন কাৰ্যে নিযুক্ত আছেন।

পূৰ্ব দিবসের ন্যায় আমি মাণিকচাঁদ বাবুর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলে, তিনি আমাকে সেই চেয়ারের উপর উপবেশন করিতে কহিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে, তিনি তাহার হস্তস্থিত লেখনী সেই টেবিলের উপর রাখিয়া আমার দিকে একটু ঘূরিয়া বসিলেন ও আমাকে কহিলেন, কেমন মহাশয়! আপনি আমাদিগের কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন ত?।

আমি। হাঁ মহাশয়! সে কথা আমি গত কল্যই ত আপনাকে বলিয়াছি।

মাণিক। আমি যে সকল কাগজ-পত্ৰ আনিতে বলিয়া ছিলাম, তাহা আপনি সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন, না ভুল-ক্রমে আপনার বাসায় রাখিয়া আসিয়াছেন?

আমি। না মহাশয়! আমি ভুল-ক্রমে উহা রাখিয়া আসি নাই, সঙ্গে করিয়াই আনিয়াছি। উহা আমি আপনার হস্তে এখনই প্রদান করিব কি?

মাণিক। না, এখন নয়, একটু অপেক্ষা করুন। যখন আমার প্রয়োজন হইবে, তখনই আপনি উহা আমাকে প্রদান করিবেন। এখন আপনি আপনার অগ্রিম বেতন গ্রহণ করিয়া আপনার কাৰ্যে নিযুক্ত হউন।

এই কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদ তাহার টেবিলের দেরাজ হইতে দশখানি দশ টাকা হিসাবের নোট বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন ও কহিলেন, এই নিন্ মহাশয়! আপনার অগ্রিম বেতন।

আমি। নোট দশখানি আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া কহিলাম, ইহার নিমিত্ত আমার কোনরূপ রসিদ দিতে হইবে কি?

মাণিক। না, বেতনের টাকা পাইলেন, তাহার আর রসিদ কি? দেখি, আপনি কি কাগজ-পত্ৰ আনিয়াছেন।

মাণিকচাঁদের এই কথা শুনিয়া আমার নিয়োগ-পত্ৰখানি ও একখানি চিঠি যাহা আমি বোম্বাই হইতে কয়েকদিবসমাত্র অগ্রে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহা তাহার হস্তে প্রদান করিলাম।

মাণিকচাঁদ নিয়োগ-পত্রখানি ও চিঠিখানি একবার পড়িয়া দেখিলেন ও পরিশেষে কহিলেন, আপনি এই পত্রের উত্তর লিখিয়াছেন কি?

আমি। না।

মাণিক। নিয়োগ-পত্রখানি পাইবার পর, কোন পত্র লিখিয়াছেন?

আমি। না, সর্বপ্রথমে আমি যে একখানি দরখাস্ত করিয়া ছিলাম, তদ্ব্যতীত আমি আর কোন পত্রাদি সেই স্থানে লিখি নাই।

মাণিক। এখন এই পত্রের উত্তর আপনাকে প্রদান করা। কৰ্ত্তব্য।

আমি। উত্তর আর কি লিখিব?

মাণিক। কেন, আপনি সেই চাকরী গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক নহেন, একথা লিখিয়া দেওয়া উচিত নয় কি?

আমি। না লিখিলেই বা ক্ষতি কি? আমি সেই স্থানে গমন না করিলেই, তাঁহারা জানিতে পারিবেন যে, আমি সেই কাৰ্য করিতে প্রস্তুত নহি। তখন তাঁহারা অপর লোকের বন্দোবস্ত করিয়া লইতে পারিবেন।

মাণিক। না, উহা কৰ্তব্য বা ভদ্রোচিত ব্যবহার নহে। কাগজ, কলম প্রভৃতি সমস্তই আপনার সম্মুখে পড়িয়া রহিয়াছে, এখনই একখানি পত্র লিখিয়া ডাকে ফেলিয়া দিন। আপনার পত্র পাইয়া যখন তাঁহারা জানিতে পারিবেন যে, আপনি তাহাদিগের চাকরী করিতে অভিলাষী নহেন, তখন তাঁহারা অপর লোকের বন্দোবস্ত করিতে সমর্থ হইবেন। নতুবা তাহাদিগের কার্যের সবিশেষ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা।

মাণিকচাঁদের কথা শুনিয়া ভাবিলাম, তিনি যাহা বলিতে ছেন, তাহা নিতান্ত যুক্তিসঙ্গত। সুতরাং এ সম্বন্ধে তাহাকে আর কিছু না বলিয়া, তাহারই টেবিলের উপর হইতে একখানি কাগজ লইয়া, সেই স্থানেই বসিয়া আমি একখানি পত্র লিখিলাম। সেই পত্রে অধিক কোন কথা লিখিলাম না, কেবল এইমাত্র লিখিলাম, আপনারা অনুগ্ৰহ করিয়া আপনাদিগের ফারমে যে একটী চাকরী প্রদান করিয়াছিলেন, আমি আপাততঃ সেই চাকরীতে প্রবৃত্ত হইতে পারিতেছি না। আপনারা আমাকে যে বেতন প্রদানে সম্মত আছেন, তাহায় দ্বিগুণ বেতনে আমি এই স্থানেই একটা চাকরী প্রাপ্ত হইয়াছি। সুতরাং আপনা দিগের প্রদত্ত চাকরী গ্রহণ করিতে পারিলাম না বলিয়া, আমার অপরাধ মার্জনা করিবেন।

পত্র লেখা সমাপ্ত হইলে মাণিকষ্টাদ একখানি অর্ধ আনা মূল্যের খাম আমার হস্তে প্রদান করিলেন। সেই খামের ভিতর আমার লিখিত পত্রখানি পূরিয়া উহাতে শিরোনাম লিখিয়া সেই টেবিলের উপর রাখিলাম। টেবিলের উপর একটা পাত্রে একটু জল রাখাছিল, মাণিকচাঁদ নিজে তাঁহার অঙ্গুলিতে একটু জল লইয়া আমার সম্মুখে উহা বন্ধ করিয়া দিলেন, এবং আমাকে কিছু না বলিয়া তাহার দ্বারকে ডাকিলেন। সে পূর্ব্ব হইতে সেই ঘরের বাহিরে বসিয়াছিল, ডাকিবামাত্র সে সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। মাণিকচাঁদ বাবু আমাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সেই পত্রখানি সেই দ্বারবানের হস্তে প্রদান করিলেন ও কহিলেন, এই পত্রখানি এখনই তুমি ডাকঘরে দিয়া আইস।

দ্বারবান্ দ্বিরুক্তি না করিয়া, সেই পত্র হস্তে দ্রুতপদে সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। সে দিবস আর যতক্ষণ আমি সেই স্থানে ছিলাম, তাহার মধ্যে সেই দ্বারবানকে আমি আর দেখিতে পাইলাম না।

দ্বারবান্ প্রস্থান করিলে পর, মাণিকচঁদ বাবু আমার প্রদত্ত সেই নিয়োগ-পত্র ও বোম্বাইয়ের যে পত্রখানি আমি তাহার হস্তে প্রদান করিয়াছিলাম, তাহা তিনি তাঁহার টেবিলের দেরাজের ভিতর বন্ধ করিয়া রাখিলেন, এবং আমাকে কহিলেন, এগুলি এখন আমার নিকট রহিল।

মাণিকচাঁদ বাবুর এই কথার কোনরূপ উত্তর দিবার পূর্বেই তিনি কহিলেন, এখন আমি অতিশয় ব্যস্ত; আপনি এখন আপনার বাসায় গমন করিতে পারেন। আপনাকে আমি একটা কাৰ্য্য প্রদান করিতেছি, যে কয়দিবসে পারেন, সেই কাৰ্য্যটা আপনি সম্পন্ন করুন। চারিদিবস পরে একবার আপনি এই স্থানে আসিয়া আমাকে বলিয়া যাইবেন যে, সেই কাৰ্য কতদূর পর্যন্ত আপনি সম্পন্ন করিতে পারগ হইয়াছেন। সবিশেষ তাড়াতাড়ি করিবার প্রয়োজন নাই।

আমি। কি কাৰ্য্য করিতে হইবে?

মাণিক। বঙ্গদেশের মধ্যে কোন্ কোন্ নগরে আমাদিগের শাখা-কাৰ্য্যস্থান করিবার প্রয়োজন, তাহারই একটা তালিকা প্রস্তুত করুন। তাহার পর আর যাহা যাহা করিতে হইবে, তাহা আমি পরে বলিব।

আমি। আমি কিরূপে সেইরূপ তালিকা প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইব?

মাণিক। কেন, আপনি বহুদিবস পৰ্য্যন্ত কলিকাতায় থাকিয়া। একটী ভাল ফারমেই কৰ্ম্ম করিয়া আসিতেছিলেন। সেই ফারমের সহিত বঙ্গদেশের যে যে স্থানের ফারমের কাৰ্য্য ছিল, তাহা আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন। সুতরাং একটু চিন্তা করিয়া, আপনি সেই সকল স্থানের একটা তালিকা অনায়াসেই প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইবেন। তদ্ব্যতীত এই কলিকাতায় আরও অনেক ফারমের কর্ম্মচারীগণের সহিত যে আপনার সবিশেষরূপ আলাপ পরিচয় আছে, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আবশ্যক হইলে আপনি তাহাদিগকেও জিজ্ঞাসা করিয়া লইতে পারেন।

আমি। আচ্ছা তাহাই হইবে। আপনার আদেশানুযায়ী একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া, চারিদিবস পরে আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।

মাণিক। আমি আপনার উপর যে কাৰ্য করিবার ভার অর্পণ করিলাম, তাহা শুনিতে যেরূপ সহজ বোধ হইতেছে, কার্যে কিন্তু ততদূর সহজ নহে। চারিদিবসের মধ্যেই যে আপনি সেই কাৰ্য্য শেষ করিতে পারিবেন, তাহা আমার বোধ হয় না। তথাপি যতদূর সম্ভব, সেই কাৰ্য্য করিয়া, চারিদিবস পরে পুনরায় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। অপর আর কোন্ কোন্ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিবার আপাততঃ প্রয়োজন হইবে, তাহাও আমি সেইদিবস আপনাকে বলিয়া দিব।

এই বলিয়া মাণিকচাঁদ আপন কার্যে তাঁহার মন নিযুক্ত করিলেন।

তাঁহার অবস্থা দেখিয়া আমি মনে মনে ভাবিলাম, এ সম্বন্ধে তিনি এখন আর অধিক সময় নষ্ট করিতে ইচ্ছুক নহেন। সুতরাং তাঁহাকে আর কিছু না বলিয়া, আমি আস্তে আস্তে সেইদিবস সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম, এবং ক্রমে আপন বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

চারিদিবসকাল অনবরত ভাবিয়া-চিন্তিয়া এবং অপর ফারমের আমার পরিচিত অপরাপর কর্ম্মচারীগণের সহিত পরামর্শ করিয়া বঙ্গদেশের যতগুলি প্রধান প্রধান নগরের নাম সংগৃহীত হইবার সম্ভাবনা, তাহা সংগ্রহ করিয়া, তাহার একটী তালিকা প্রস্তুত করি লাম। চারিদিবস পরে, অর্থাৎ পঞ্চমদিবসে আমি সেই তালিকা সহ পুনরায় রাজার কাটুরায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে ইতিপূর্বে মাণিকচাঁদকে আমি যেরূপ অবস্থায় দেখিতে পাইয়া ছিলাম, আজও দেখিলাম, তিনি সেই স্থানে সেইরূপ অবস্থায় বসিয়া কাৰ্য্য করিতেছেন। তাহার দ্বারবানও সেইরূপে ঘরের বাহিরে বসিয়া রহিয়াছে।

আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই তিনি আমাকে সেই স্থানে বসিতে বলিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, তিনি কহিলেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আমার হাতের কাৰ্যটী শেষ করিয়া, আপনার সহিত কথোপকথনে নিযুক্ত হইতেছি। এই বলিয়া তিনি আপনার কাৰ্য্যে মনোনিবেশ করিলেন, আমি সেই স্থানে স্থিরভাবে বসিয়া রহিলাম। এইরূপে প্রায় একঘণ্টাকাল অতিবাহিত হইলে পর, তিনি আপনার হস্তস্থিত কলম সেই স্থানে রাখিয়া আমার দিকে চাহিলেন ও কহিলেন, এখন আমি আপনার কথায় মনোনিবেশ করিতে প্রস্তুত; বলুন, এখন আমাকে কি করিতে হইবে?

আমি। আপনাকে এখন কিছুই করিতে হইবে না। আপনি আমাকে একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া আনিতে বলিয়াছিলেন, তাই আমি অদ্য আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি।

মাণিক। বঙ্গদেশের মধ্যে কোন্ কোন্ স্থানে আমাদিগের শাখা-কাৰ্যালয় খুলিতে হইবে, তাহারই তালিকা?

আমি। হাঁ।

মাণিক। প্রস্তুত হইয়াছে?

আমি। একরূপ প্ৰস্তুত করিয়া আনিয়াছি।

মাণিক। এত অল্প সময়ের মধ্যে এরূপ একটী কাৰ্য্য আপনি সম্পন্ন করিয়া উঠিতে পারিয়াছেন? অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া না দেখিলে, এরূপ তালিকা সহজে কোনরূপে প্রস্তুত হইতে পারে না। সেই তালিকা প্রস্তুত করিতে আমি আপনাকে দশদিবস সময় প্রদান করিয়াছিলাম না?

আমি। না মহাশয়! আপনি আমাকে চারিদিবসমাত্র সময় প্রদান করিয়াছিলেন। তাহারই মধ্যে যতদূর সম্ভব, আমি একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছি। আপনি একবার দেখিলেই জানিতে পারিবেন যে, সেই তালিকা প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইতে পারিয়াছি কি না?

এই বলিয়া আমার আনীত তালিকাখানি মাণিকদের হস্তে প্রদান করিলাম।

মাণিকচাঁদ সেই তালিকাখানি একবার আদ্যোপান্ত দেখিয়া কহিলেন, এই তালিকায় আপনি অনেকগুলি নাম লিখিয়াছেন সত্য; কিন্তু আমার বিশ্বাস, বঙ্গদেশের মধ্যে ইহা অপেক্ষাও কারবারের অনেক ভাল ভাল স্থান আছে, সেই স্থানগুলিও আপনি যদি সন্ধান করিয়া বাহির করিতে পারেন, তাহা হইলেই ভাল হয়। আমি আপনাকে আরও দশদিবসের সময় প্রদান করিতেছি, একটু সবিশেষ চেষ্টা করিয়া সেই দশদিবসের মধ্যে যাহাতে আপনি এই কাৰ্যটী সম্পন্ন করিতে পারেন, তাহার চেষ্টা করিবেন। আর অন্য হইতে একাদশ দিবসের দিন আপনি পুনরায় আমার নিকট আগমন করিয়া, আপনার প্রস্তুত করা তালিকাখানি আমাকে প্রদান করিবেন। সেইদিবস হইতেই সেই সকল স্থানে শাখা-কাৰ্য্যালয় সকল স্থাপন করিতে যেরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে, তাহা আমি করিব। কোন্ কোন্ স্থানে শাখা কাৰ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে, তাহা স্থির করিবার নিমিত্ত আর যেন অধিক সময় ব্যয় না হয়। এই দশদিবসের মধ্যেই যেন সমস্ত কাৰ্য শেষ হয়।

আমি। কোন্ কোন্ স্থানে শাখা-কাৰ্যালয় স্থাপন করিলে চলিতে পারে, অনেক ভাবিয়া এবং অনেক অনুসন্ধান কধিয়া, তাহা ত আমি একরূপ স্থিরই করিয়াছি। তদ্ব্যতীত আর যে সকল কারবার-উপযোগী স্থান আছে, তাহা জানিয়া লইতে দশদিবসের প্রয়োজন হইবে না, দুই চারিদিবসের মধ্যেই আমি উহা স্থির করিয়া লইতে পারি।

মাণিক। সে উত্তম কথা। যে কাৰ্য্য আপনি আর চারিদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করিতে পারিবেন বলিয়া আপনার বিশ্বাস, সেই কাৰ্য্য দশদিবসের মধ্যে যে সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে পারিবেন, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি এত কার্যে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি যে, দশদিবসের মধ্যে আমি কোনরূপেই অপর কার্যে হস্তক্ষেপ করিতে সমর্থ হইব না। একাদশ দিবসে ঠিক এই সময় আপনি এখানে আগমন করিবেন, সেইদিবস আমি সমস্ত স্থির করিয়া লইব।

যেরূপ আদেশ পাইলাম, কাৰ্যেও আমি সেইরূপ করিলাম। দেখিয়া শুনিয়া আরও কতকগুলি ভাল ভাল স্থানের নাম বাহির করিয়া দুই তিনদিবসের মধ্যে একটী তালিকা প্রস্তুত করিলাম। তালিকাখানি সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হইয়া গেলে, আমি ভাবিলাম, একবার রাজার কাটুরায় গিয়া মাণিকচাঁদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসি। দেখি, তিনি সেই তালিকা সম্বন্ধে আর কোনরূপ নূতন কথা বলেন কি না?

এই ভাবিয়া আমি পঞ্চমদিবসের দিন পুনরায় সেই রাজার কায় গমন করিলাম; কিন্তু সে দিবস মাণিকচাঁদ বা তাহার দ্বারবানকে দেখিতে পাইলাম না। দেখিলাম, ঘর তালাবদ্ধ। পুনরায় তাহার পরদিবস গমন করিলাম, সে দিবসেও সেইরূপ তালাবন্ধ দেখিলাম। এইরূপে দশমদিবস পর্যন্ত প্রত্যহ একবার করিয়া সেই স্থানে গমন করিতে লাগিলাম; কিন্তু একদিবসের নিমিত্তও মাণিকচাঁদ বা তাহার দ্বারবানের সহিত সাক্ষাৎ হইল না। এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া মনে করিলাম, কোন কাৰ্যবশতঃ হয় ত মাণিকা স্থানান্তরে গমন করিয়াছেন, অথবা তাঁহার কোনরূপ শারীরিক অসুস্থতা উপস্থিত হইয়াছে।

একাদশ দিবসের দিন পুনরায় সেই স্থানে গমন করিলাম। পূর্বে যেরূপ ভাবে মাণিকচাঁদ এবং তাহার দ্বারবানকে দেখিতে পাইয়াছিলাম, আজ উভয়কেই সেইরূপ ভাবে দেখিলাম। দেখি লাম, দ্বারবান্ সেই ঘরের দরজায় বসিয়া আছে, আর মাণিকচাঁদ ঘরের ভিতর বসিয়া লেখাপড়ায় নিযুক্ত আছেন।

আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই মাণিকচাঁদ পূর্বের ন্যায় আমাকে বসিবার স্থান প্রদান করিলেন। আমি সেই স্থানে উপ বেশন করিলে, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন মহাশয়! আপনার উপর আমি যে কাৰ্যের ভার অর্পণ করিয়াছিলাম, তাহা শেষ করিতে পারিয়াছেন কি?

উত্তরে আমি কহিলাম, সে কাৰ্য্য আমার অনেকদিবস শেষ হইয়া গিয়াছে। আমি তাহার একটা সম্পূর্ণ তালিকাও প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছি। এই বলিয়া আমি যে তালিকাখানি প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছিলাম, তাহা তাহার হস্তে প্রদান করিলাম। তিনি উহা আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া একবার আদ্যোপান্ত উত্তমরূপে দেখিলেন ও পরিশেষে কহিলেন, আমার বোধ হইতেছে, আপনি যে তালিকা প্রস্তুত করিয়াছেন, তাহাতেই আপাততঃ আমাদিগের কাৰ্য্য চলিতে পারিবে। অছ এই তালিকাখানি আমার নিকট থাকুক, সময়মত আমি উহা একবার আদ্যোপান্ত দৈখিয়া রাখিব। আপনি কল্য পুনরায় আগমন করিবেন, সেই সময় উভয়ে পরামর্শ করিয়া, যে যে স্থানে শাখা-কাৰ্যালয় স্থাপন করা বিবেচনা-সিদ্ধ হয়, সেই সেই স্থানে কাৰ্যালয় স্থাপন করিবার বন্দোবস্ত করা যাইবে। এই বলিয়া, সেই তালিকাখানি মাণিক্তচাদ আপনার নিকট রাখিয়া দিলেন। আমিও আপন স্থানে প্রত্যাবর্তন করিলাম।

পরদিবস পুনরায় রাজার কাটায় গমন করিয়া দেখিলাম, মাণিকটা পূর্বের ন্যায় আপন আফিসে বসিয়া কৰ্ম্ম-কাৰ্য্য করিতেছেন। আমাকে দেখিয়া তিনি নিতান্ত দুঃখভাব প্রকাশ করিয়া কহিলেন, আমি বড়ই দুঃখের সহিত আপনাকে বলিতেছি যে, আপনি এত পরিশ্রম ও এত সময় নষ্ট করিয়া যে তালিকাখানি প্রস্তুত করিয়াছেন, এবং যাহা গত কল্য আমার নিকট রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহা যে আমি কোথায় ফেলিয়াছি, আমি তাহার কিছুই সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হই তেছে, আপনাকে পুনরায় সেইরূপ আর একখানি তালিকা প্রস্তুত করিতে হইবে।

মাণিকদের কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, তালিকাখানি দৈবাৎ হারাইয়া গিয়াছে বলিয়া আপনাকে সবিশেষ চিন্তিত হইতে হইবে না। আমি যে তালিকাখানি আপনাকে প্রদান করিয়া ছিলাম, তাহার একখানি নকল আমার নিকট আছে; যদি অনু মতি করেন, তাহা হইলে এখনই আনিয়া আমি উহা আপনাকে প্রদান করিতে পারি।

আমার কথার উত্তরে মাণিকচাঁদ কহিলেন, আপনি যে সেই তালিকার একটী নকল রাখিয়াছেন, ইহা শুনিয়া আমি সবিশেষ রূপে সন্তুষ্ট হইলাম। আপনাকে পরিশ্রম করিয়া উহা এখনই আনি বার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, কল্য আপনি উহা লইয়া আমার নিকট এই সময় আসিবেন। এই বলিয়া মাণিকচাঁদ, সেই দিবসও আমাকে সেই স্থান হইতে বিদায় করিলেন।

আমার নিকটে যে তালিকাখানি ছিল, তাহার একটী নকল প্রস্তুত করিয়া মাণিকচাঁদের আদেশ-অনুযায়ী সেই তালিকাখানি সঙ্গে লইয়া পরদিবস পুনরায় তাহার নিকট গিয়া উপস্থিত হই লাম। সেই দিবস তিনি আমার সহিত উত্তমরূপে কোন কথা কহিলেন না, কেবলমাত্র আমার নিকট হইতে তালিকাখানি গ্রহণ করিলেন, এবং এইমাত্র কহিলেন, অন্ত আমার শরীর একটু

অসুস্থ বোধ হইতেছে। তালিকাখানি এখন আমার নিকট থাকিল, আমি সময়মত উহা দেখিয়া রাখিব। আপনি চারিদিবস পরে পুনরায় আসিবেন, সেই দিবস সমস্ত কাৰ্য্যের বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া দিব।

আমি তাহারই আদেশ-অনুযায়ী চারিদিবস পরে, অর্থাৎ গত কল্য তাহার নিকট পুনরায় গমন করিয়াছিলাম। কল্যও তিনি আমাকে এই বলিয়া বিদায় করিয়া দিয়াছেন, আমি সেই তালিকাখানি এখন পর্যন্তও উত্তমরূপে দেখিয়া উঠিতে পারি নাই। আপনি পরশ তারিখে পুনরায় আগমন করিবেন, সেই দিবস উল্লিখিত কাৰ্য্যের সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করিয়া ফেলিব।

মহাশয়! আমি আমার এই চাকরীর অবস্থা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আমি প্রতিদিন মাণিকচাঁদ কর্তৃক কার্যে নিযুক্ত হইতেছি, বা কোনরূপ জুয়াচোরের হস্তে পতিত হইয়া কোনরূপ বিপদগ্রস্ত হইবার পথ প্রসারিত করিতেছি; তাহার কিছুই আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এই নিমিত্ত মামি আপনার পরামর্শ লইবার মানসে আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, এবং এ পর্যন্ত যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা যতদূর সম্ভব আমি মনে করিতে পারিয়াছি, তাহা আপনার নিকট আমি বিবৃত করিলাম। এখন মাণিকচাঁদের আদেশ আমাকে প্রতিপালন করিতে হইবে, অর্থাৎ আগামী কল্য পুনরায় আমাকে সেই স্থানে যাইতে হইবে। এরূপ অবস্থায় আপনি আমাকে যেরূপ উপদেশ প্রদান করিবেন, সেই উপদেশই আমি শিরোধার্য করিয়া, আপনার আদেশমত কাৰ্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইব।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

বালমুকুনের কথাগুলি আমি সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলাম। তাহার কথাগুলি শেষ হইয়া গেলে, আমি সমস্ত অবস্থাগুলি একবার উত্তমরূপে ভাবিয়া দেখিলাম; কিন্তু ভাবিয়া চিত্তিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। একবার ভাবিলাম, যে ব্যক্তি অগ্রিম বেতন একশত টাকা প্রদান করিয়াছে, অথচ বালমুকুনের নিকট হইতে একটামাত্র পয়সাও গ্রহণ করে নাই, সে যে উহার সহিত জুয়াচুরি করিতেছে, একথা কিরূপেই বা বিশ্বাস করিতে পারি? অথচ যে ব্যক্তি নিজ হইতে অগ্রিম বেতন দিয়া বালমুকুনকে তাহার কার্যে নিযুক্ত করিয়াছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহাকে কোন কার্যে নিযুক্ত না করিয়া সামান্য সামান্য কাৰ্য্যের ভান করিয়া কেবলমাত্র সময় অতিবাহিত করি তেছেন, তাঁহার মনে একবারেই যে কোনরূপ দুরভিসন্ধি নাই, তাহাও সহজে বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা করে না। অথচ ইহার ভিতর একটী নূতন কথাও শুনিতেছি। এ পর্যন্ত আমি কখন শুনি নাই যে, সরকারী বা ব্যবসাদারী কোন আফিসে কি কোন ফারুমে প্রত্যেকমাসে অগ্রিম বেতন দেওয়ার নিয়ম আছে। এরূপ অগ্রিম বেতন প্রদান করার অর্থই বা কি, তাহাও বুঝিয়া উঠা নিতান্ত সহজ নহে। যে ব্যক্তি মাণিকচাঁদ নামে আত্ম-পরিচয় প্রদান করিতেছে, সে লোকটাই বা কে, তাহা একবার দেখিলে কোন ক্ষতি নাই। তাহাকে স্বচক্ষে দেখিলে ও তাহার সহিত দুই চারিটী কথা কহিলেও, সে যে কি চরিত্রের লোক, অথবা ইহার মধ্যে তাহার কোন দুরভিসন্ধি আছে কি না, তাহাও বোধ হয়, অনেকটা অনুমান করিয়া লওয়া যাইতে পারিবে।

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি বালমুকুকে কহিলাম, আপনি যাহা যাহা কহিলেন, তাহার সমস্ত আমি শ্রবণ করিয়াছি। কিন্তু কি নিমিত্ত যে, এইরূপ বন্দোবস্ত হইতেছে, তাহার কিছুই আমি স্থির করিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হয়, আমি যদি স্বচক্ষে তাহাকে একবার দেখিতে পাই, এবং তাহার সহিত দুই চারিটী কথাবার্তা কহিতে পাই, তাহা হইলে তাহার সম্বন্ধে আমি অনেকটা মতামত প্রকাশ করিতে সমর্থ হইব।

বালমুকুন্। আমি ত কল্য পুনরায় সেই স্থানে গমন করিব। আপনি কেন একবার সেই সময় আমার সহিত চলুন না? তাহা হইলে ত তাহার সহিত আপনার অনায়াসেই সাক্ষাৎ হইতে পারিবে?

আমি। আমি কি বলিয়া সেই স্থানে গমন করিব? আর যদি আমাকে তাহার সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে না দেয়?

বালমুকুন। প্রবেশ করিতে না দিবার ত কোন কারণ দেখি তেছি না। আজকাল আমি বিনা-সংবাদে যেমন একবারে তাহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করি, কল্যও সেইরূপ ভাবে একবারে তাহার সেই ঘরের ভিতর চলিয়া যাইব। আপনিও কাহাকেও কিছু বলিয়া, আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবেন। তাহা হইলেই তাহার সেই ঘরে প্রবেশ করিবার নিমিত্ত নিষেধ করিতে সে আর কোনরূপে সময় পাইবে না। সুতরাং অনায়াসেই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে।

আমি। আচ্ছা, যেন তাহাই হইল, আমি আপনার পশ্চাৎ পশ্চাৎ মাণিকচাঁদের ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। তাহার পর, যখন সে জিজ্ঞাসা করিবে, আমি কে, এবং কি নিমিত্তই সেই স্থানে গমন করিয়াছি, তখন আমি তাহাকে কি উত্তর প্রদান করিব?

বালমুকুন্। উত্তর করিবার আর ভাবনা কি? আপনাকে কোন কথা কহিতে হইবে না, আমিই তাহার কথার উত্তর প্রদান করিব। আমি কহিব, ইনি আমার একজন বিশ্বাসী বন্ধু। তাই ইনি আমার নূতন মনিবের সহিত আলাপ-পরিচয় করিবার মানসে আমার সহিত আগমন করিয়াছেন।

আমি। এরূপ পরিচয় প্রদান করিলে চলিবে না। কারণ, তাহার মনে যদি প্রকৃতই কোনরূপ দুরভিসন্ধি থাকে, এবং আমার সহিত কথাবার্তা কহিতে তাহার আন্তরিক ইচ্ছা না থাকে, তাহা হইলে এক কথাতেই তিনি আমাকে বিদায় করিয়া দিতে পারেন। তাহা হইলে আমরা কিরূপে আমাদিগের অভিসন্ধি পূর্ণ করিতে সমর্থ হইব?

বালমুকুন্। এক কথায় তিনি আমাদিগকে কিরূপে বিদায় করিবেন?

আমি। তিনি অনায়াসেই বলিতে পারেন, এখন আমি নানানরূপ কাৰ্যগতিতে অতিশয় ব্যস্ত; সুতরাং এই সময় আপনার বন্ধুর সহিত যে দুইদণ্ডকাল কথাবার্তা কহিব, বা তাহার সহিত আলাপ-পরিচয় করিব, সে সময় ত এখন আমার নাই। আমার অবকাশমত সংবাদ পাঠাইয়া দিলে, তিনি যেন অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক একবার আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। সেই সময় আমি অনেকক্ষণ পৰ্য্যন্ত ইহার সহিত আলাপ-পরিচয় করিতে সমর্থ হইব। এরূপ প্রথমেই যদি তিনি বলিয়া ফেলেন, তাহা হইলে বলুন দেখি, আমি আর কতক্ষণ সেই স্থানে দাড়াইতে পারিব? তখনই আমাকে তাহার সেই ঘর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে হইবে।

বালমুকুন্। তাহা ত প্ৰকৃত। তাহা হইলে এখন অন্য কি উপায় অবলম্বন করিলে, আপনাকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে পারি? আপনি সে বিষয়ে কিরূপ পরামর্শ দেন?

আমি। আমার বোধ হয়, এক উপায় অবলম্বন করিলে, তাহার সহিত দুই চারিটী কথা হইলেও হইতে পারে।

বালমুকু! কি উপায়?

আমি। আপনি যেরূপ কহিলেন, সেইরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, আমি আপনার সহিত তাহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিব। আমি কে, জিজ্ঞাসা করিলে, আপনি তাহাকে এই বলিতে পারেন, ইনি আমার একজন বন্ধু, এবং ব্যবসা-কাৰ্যে ইনি অতিশয় পারদর্শী; কিন্তু আজকাল ইনিও বেকার অবস্থায় বসিয়া আছেন। বঙ্গদেশের নানাস্থানে যে সকল শাখা-কাৰ্যালয় স্থাপন করিতে হইবে, তাহার নিমিত্ত যে অনেক লোকের প্রয়োজন হইবে, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাহারই নিমিত্ত আমি ইহাকে আপনার নিকট আনয়ন করিয়াছি, ইহাকে আপনি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখুন, এবং ইহার দ্বারা কাৰ্যনিৰ্বাহ হইতে পারিবে, এরূপ যদি আপনি বিবেচনা করেন, তাহা হইলে ইহাকে আপনি অনায়াসেই নিযুক্ত করিতে পারেন। ইহাকে বিশ্বাস করা, বা ইহার হস্তে অর্থাদি প্রদান করা সম্বন্ধে কোনরূপ চিন্তা করিবার প্রয়োজন নাই, সে সম্বন্ধে আমি নিজেই উহার জামিন থাকিতে প্রস্তুত আছি।

আমার বিবেচনায় যদি আপনি তাহাকে এইরূপে আমার পরিচয় প্রদান করেন, তাহা হইলে হয় ত তিনি আমার সহিত দুই চারিটী কথা কহিলেও কহিতে পারেন। আর যদি ইহাতেও তিনি আমার সহিত কোনরূপ আলাপ-পরিচয় না করেন, তাহা হইলে তখন উপস্থিত মত যেরূপ বিবেচনা হয়, সেইরূপই করা যাইতে পারিবে।

আমার কথা শুনিয়া বালমুকুন্ কহিল, আচ্ছা মহাশয় তাহাই হইবে; আপনি যেরূপ বলিলেন, আমি সেইরূপই করিব। এখন অনুগ্রহ করিয়া আপনাকে কল্য আমার সহিত গমন করিতেই হইবে। কল্য যে সময় আমি তাহার নিকট গমন করিব, তাহার পূর্বে আমি আপনার নিকট আসিয়া, আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। আপনার ন্যায় কোন ব্যক্তি যদি এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য না করেন, তাহা হইলে ইহার প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়া লওয়া আমাদিগের ন্যায় ব্যক্তির কাৰ্য্য নহে।

এরূপ কাৰ্য যদিও আমাদিগের কর্তব্য কাৰ্যের মধ্যে পরিগণিত নহে; তথাপি ইহার ভিতর কোন দুরভিসন্ধি আছে কি না, তাহা জানিয়া লইবার নিমিত্ত আমারও ইচ্ছা হইল। যাহা হউক, পরদিবস তাহার সহিত গমন করিয়া, তাহাকে যতদূর সম্ভব সাহায্য করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলাম।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

পরদিবস সময় মত বালমুকুন্ আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন, আমিও তাঁহার সহিত রাজার কাটায় গমন করিলাম। বালমুকুন পূর্বে আমার নিকট যেরূপ বর্ণনা করিয়াছিলেন, সেই স্থানে গমন করিয়া আমিও সেইরূপ দেখিতে পাইলাম। দেখি লাম, বাস্তবিকই তাহার ঘরের সম্মুখে পরদার বাহিরে দ্বারবান্ বেশী একটী লোক বসিয়া রহিয়াছে। বালমুকুন পূর্বের পরামর্শানু যায়ী সেই দ্বারবানকে কিছু না বলিয়া, সেই পরদা উঠাইয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘরের ভিতর গমন করিলাম। ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখি, যে ব্যক্তি মাণিকচঁদ বলিয়া পূর্বে বালমুকুনকে আত্ম-পূরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, তিনি সেই গৃহের মধ্যে পূৰ্ব্ব-বর্ণিত অবস্থায় আপন কার্যে অতি মনোযোগের সহিত রত রহিয়াছেন। টেবিলের উপর কতকগুলি কাগজ-পত্ৰ ছড়ান রহিয়াছে; কিন্তু তিনি সেই সকল কাগজ-পত্র সইয়া যে কোনরূপ কাৰ্য্য করিতেছেন, তাহা আমার বোধ হইল না। আমার বোধ হইল, তিনি একখানি পত্র লিখিতেছেনমাত্র। পত্র লিখিতেছেন সত্য; কিন্তু মধ্যে মধ্যে তাঁহার সম্মুখস্থিত একখানি সংবাদপত্রের দিকে এক একবার লক্ষ্য করিতেছেন। সংবাদপত্রখানি দেখিয়া বোধ হইল, উহা এদেশীয় সংবাদপত্র নহে, বোম্বাই প্রদেশের কোন একখানি সংবাদপত্র; কিন্তু ইংরাজীতে লেখা।

আমরা সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই, যে পত্রখানি তিনি লিখিতেছিলেন, তাহা নিতান্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে ছিড়িয়া সেই স্থানে ফেলিয়া দিলেন, এবং সংবাদপত্রখানির উপর অপর কতক গুলি কাগজ-পত্র স্থাপিত করিয়া আমাদিগের দিকে একবার লক্ষ্য করিলেন ও কহিলেন, কে? বালমুকুন্ আসিয়াছ? তোমার সঙ্গে এই যে বাবুটী আসিয়াছেন, ইনি কে?

মাণিকদের কথার উত্তর করিবার পূর্বেই বালমুকুন্ সেই স্থানে একখানি চৌকির উপর উপবেশন করিলেন, এবং আমাকে আর একখানি চৌকি দেখাইয়া দিয়া, সেই স্থানে আমাকে বসিতে কহিলেন। আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, বালমুকুন্ মাণিকচাঁদের কথার উত্তরে কহিলেন, আমি ইহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি, ইনি আমার একজন বিশ্বাসী বন্ধু, এবং ব্যবসা-কার্যে ইনি সবিশেষ নিপুণ; কিন্তু আজকাল ইনিও বেকার অবস্থায় বসিয়া আছেন, ইহার হস্তে কোন কৰ্ম্ম-কাৰ্য নাই। বঙ্গদেশের নানাস্থানে আমাদিগের শাখা-কাৰ্যালয় খুলিতে হইলে, অনেক লোকের প্রয়োজন হইবে, তাই আমি ইহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি। আমি ত ইহাকে সবিশেষ উপযুক্ত লোক বলিয়া জানি। এখন আপনি ইহার সহিত প্রয়োজন মত কথাবার্তা কহিয়া দেখুন, আপনার বিবেচনায় যদি ইনি আমাদিগের কার্যোপযোগী মনে করেন, তাহা হইলে ইহাকেও আপনাদিগের কার্যে নিযুক্ত করিতে পারেন।

বালমুকুনের এই কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদ আমার প্রতি লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, কেমন মহাশয়! আপনি আমাদিগের ব্যবসা কাৰ্য্যে আমাদিগের সহিত মিলিত হইতে ইচ্ছা করেন কি?

মাণিকচাঁদ আমাকে এই কয়েকটী কথা কহিলেন সত্য; কিন্তু আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি তাঁহার অন্তরের ভাব আমার নিকট প্রকাশ করিতে সমর্থ হইলেন না। তাঁহার মুখ দিয়া তাহার কথা বেশ স্পষ্টরূপে বাহির হইতেছে না, মুখশ্রী যেন বিবর্ণ হইয়া আসিয়াছে, চক্ষুতে যেন স্বাভাবিক জ্যোতিঃ নাই, হস্তপদ যেন অল্প অল্প কাঁপিতেছে। মাণিকচাঁদের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমার বেশ প্রতীয়মান হইল, তাহার অন্তরে যেন কোন একটী ভয়ানক ভাবের উদয় হইয়াছে। তিনি মনের সেই ভাব গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু কোনরূপে পারিয়া উঠিতেছেন না।

মাণিকচাঁদের কথার উত্তরে আমি কহিলাম, যখন অনুগ্রহ করিয়া আপনি আমাকে প্রতিপালন করিতে ইচ্ছুক হইয়াছেন, তখন আপনাদিগের নিকট কাৰ্য্য না করিব কেন? আমাকে কি কাৰ্য্য করিতে হইবে আদেশ করুন, অদ্য হইতেই আমি আপনা দিগের কৰ্ম্মে নিযুক্ত হই।

আমার কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদ কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। বোধ হইল, যেন তিনি আমাকে কিছু বলিতে চাহিতেছেন, অথচ বলিতে পারিতেছেন না; তাহার মুখ দিয়া তাহার মনের এরূপ ভাব বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে।

একটু চিন্তা করিয়া পরিশেষে তিনি আমাকে কহিলেন, আচ্ছা, আপনি যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে এখন আপনি গমন করিতে পারেন। কোন্ কোন্ স্থানে আমাদিগের কাৰ্যালয় স্থাপিত করিতে হইবে, তাহা স্থির হইবামাত্রই আমি বালমুকুনের দ্বারা আপনাকে সংবাদ প্রদান করিব। সেই সময় আপনি আসিয়া আমাদিগের কার্যে নিযুক্ত হইতে পারিবেন। কেমন বালমুকুন! ইহাই উত্তম পরামর্শ নহে?

বালমুকুন্। আপনি যেমন বিবেচনা করেন।

মাণিক। অদ্য আমি আপনাকে গোপনে দুই চারিটী কথা কহি।

বালমুকুন্। তাহা বলিতে পারেন। ইহার নিকট আমার কোন কথা গোপনীয় নাই, ইনি আমার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু। ইহার সম্মুখেই আমাকে সমস্ত কথা বলিতে পারেন।

মাণিক। ইনি আপনার অতিশয় বিশ্বাসী সত্য; কিন্তু আমার সহিত ইহার সবিশেষরূপ পরিচয় নাই। সুতরাং অদ্য প্রথম দিবসের আলাপের পরই, আমি ইহার সম্মুখে আমাদিগের ব্যবসার সকল কথা বলিতে পারি না।

বালমুকুন্। ইহার সম্মুখে যদি আপনি একান্তই কোন কথা বলিতে সম্মত না হন, তাহা হইলে ইনি একটু এই স্থানে অপেক্ষা করুন, আমি আপনার সহিত কোন নির্জন স্থানে গমন করিতেছি, সেই স্থানে সকল কথা হইতে পারিবে। আপনার পার্শ্বের এই ঘরের ভিতর চলুন না কেন?

এই বলিয়া বালমুকুন্ তাহার কথার উত্তর পাইবার অগ্রেই সেই ঘরের ভিতর গমন করিলেন। মাণিকচাঁদ আমাকে সেই স্থানে বসিতে বলিয়াই তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন।

মাণিকচাঁদকে দেখিয়াই তাহার উপর অনেক বিষয়ে আমার পূৰ্বেই সন্দেহ হইয়াছিল; আমরা সেই ঘরের ভিতর প্রথম প্রবেশ করিবার সময় সংবাদপত্রখানি লুকাইয়া রাখায় আমার মনে আরও সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়। তিনি বালমুকুনের সহিত অপর ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবামাত্রই, আমি তাহার টেবিলের উপর হইতে তাহার সেই লুক্কায়িত সংবাদপত্রখানি বাহির করিলাম, এবং উহার দুই একস্থানে লক্ষ্য করিবামাত্রই একটা বিষয়ের উপর আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল।

সংবাদপত্রের এই স্থানটী পাঠ করিয়াই আমার মস্তক ঘূরিয়া গেল, আমি যেন চতুর্দিক অন্ধকার দেখিলাম। মনে হইল— আমি যাহার সহিত এই স্থানে আসিয়াছি, তাহার নামই ত বানমুকুন, তিনিই বোম্বাই সহরে সেই প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ীর কৰ্ম্মে প্রথমে নিযুক্ত হন। কিন্তু মাণিকচাঁদের কথায় ভুলিয়া তিনি সেই কাৰ্য পরিত্যাগ করেন। আমার আরও মনে হইল, বোম্বাই সহরের এই ভয়ানক চুরি ও হত্যাকাণ্ডের সহিত মাণিক চাদের কোনরূপ সংস্রব নাই ত?

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি যেস্থানে বসিয়াছিলাম, সেই স্থান হইতে নিঃশব্দে গাত্ৰোথান করিলাম, এবং যে ঘরের ভিতর মাণিকচাঁদ ও বালমুকুন্ প্রবেশ করিয়াছিলেন, যতদূর সম্ভব সেই ঘরের নিকটে গমন করিয়া তাঁহাদের মধ্যে কিরূপ কথোপকথন হইতেছিল, তাহা শুনিবার মানসে তাহাদিগের অলক্ষিতে দ্বারের অন্তরালে দণ্ডায়মান হইলাম।

আমি যেস্থানে দাড়াইলাম, সেই স্থান হইতে উহাদের কথোপকথন উত্তমরূপে শুনা যাইতে লাগিল। উভয়ের কথোপকথন আমি যতদূর শুনিতে পাইলাম, তাহার সারমর্ম এইরূপ;–

মাণিক। তুমি আমাকে কেন মিথ্যা বলিতেছ? উনি আমাকে চিনুন বা না চিনুন, আমি উহাকে চিনি; উনি ডিটেকটিভ-পুলিসের একজন কর্ম্মচারী।

বালমুকুন্। না মহাশয়! আমি মিথ্যা বলিব কেন, উনি ডিটেকটিভ-পুলিসের কর্ম্মচারী নহেন; কিন্তু অনেক পুলিস কর্ম্মচারীর সহিত উহার আলাপ-পরিচয় আছে, এবং অনেক সময় উনি তাহাদিগের নিকট গমন করিয়া থাকেন। কোন সময় তাহা দেখিয়া বোধ হয়, আপনার এইরূপ ধারণা হইয়াছে।

মাণিক। আমি বুঝিতে পারিতেছি, তুমি প্রকৃত কথা বলিবে, এবং তোমাদিগের মনে যে কি দুরভিসন্ধি আছে, তাহাও প্রকাশ করিবে না। দেখ বালমুকুন্! আমি তোমাকে বিশ্বাস করিয়াছি, আমার সাধ্যমত কিছু উপকারও করিয়াছি, এবং যাহাতে তোমার ভাল হয়, সে বিষয়ও চেষ্টা করিতেছি। এরূপ অবস্থায় ইহা তোমার কর্তব্য কাৰ্য্য যে, আমার নিকট কোন কথা গোপন করিবে না।

বালমুকুন্। আমি আপনার নিকট কি কথা গোপন করিব? আমি আপনার কোন কথাই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আপনি আমার অন্নদাতা, আপনি আমাকে আপনাদিগের অধীনে একটী কৰ্ম্ম করিয়া দিয়া আমাকে যেরূপ উগকৃত করিয়া ছেন, তাহা কি আমি সহজে ভুলিয়া গিয়া আপনার অনিষ্ট করিতে প্রবৃত্ত হইব? আর যাহাতে আপনার কোনরূপ অনিষ্ট হয়, তাহার নিমিত্তই বা আমি কিরূপে চেষ্টা করিতেছি? যে ব্যক্তি কৰ্ম্ম-প্রার্থী, তাহাকে আমি সঙ্গে করিয়া আপনার নিকট আনয়ন করিয়াছি। বিশেষতঃ আপনি অনেক লোকও নিযুক্ত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। এরূপ অবস্থায় আপনার মনে যদি কোনরূপ সন্দেহের উদয় হয়, তাহা হইলে আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলুন, এখনই আমি উহাকে এই স্থান হইতে বিদায় করিয়া দিতেছি, এবং উহাকে বলিয়া দিতেছি, এই স্থানে আপনার চাকরী হইবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই।

মাণিক। তুমি এখনও আমাকে এই বলিয়া বুঝাইতে চাই যে, উনি ডিটেকটিভ-পুলিসের একজন কর্ম্মচারী নহেন, এবং আমার কোনরূপ অনিষ্ট করিবার মানসে এখানে আগমন করেন নাই? আমি কিন্তু তাহা বুঝিতে পারি না।

বালমুকুন। ডিটেকটিভ-পুলিস-কর্ম্মচারীগণের সহিত উহার আলাপ-পরিচয় আছে, তাহা আমি জানি; কিন্তু উনি স্বয়ং কৰ্ম্ম চারী কি না, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি যে, আপনার কোনরূপ অনিষ্ট-সাধন করিবার মানসে উনি এখানে আগমন করেন নাই। আর যদিই উনি ডিটেটিভ-কর্ম্মচারী হয়েন, তাহা হইলে আপনি এমন কি দুষ্কাৰ্য্য করিয়াছেন যে, উহার দ্বারা আপনার কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা?

মাণিক। আচ্ছা, আপনিআপনার বন্ধুর সহিত ক্ষণকাল অপেক্ষা করুন, আমি এখনই আসিতেছি।

মাণিকচাঁদের এই শেষ কথা শুনিয়া, আমি নিঃশব্দে আসিয়া আপন স্থানে উপবেশন করিলাম। বসিবামাত্রই বালমুকুন সেই ঘর হইতে বাহির হইয়া যেমন আমার নিকট আগমন করিলেন, অমনি আমি তাহাকে কহিলাম, ইহারা হত্যাকারী। আমি মাণিকচাঁদকে যেমন ধৃত করিব, অমনি আপনি দ্বারবানকে ধরিবেন, কোনরূপে যেন আপনার হাত ছাড়াইয়া সে পলায়ন করিতে না পারে। ইহার সমস্ত ব্যাপার পরে আমি আপনাকে বলিতেছি।

বালমুকুনকে এই কথা বলিয়াই আমি সেই গৃহ হইতে দ্রুতপদে বাহির হইলাম। দেখিলাম, আমি মনে যাহা ভাবিয়াছিলাম, মাণিকচাঁদ ঠিক তাহাই করিতেছে। পূৰ্ব্ব-কথিত ঘর, যাহার দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ ছিল, তাহার একটী দরজা খুলিয়া মাণিকচাঁদ সেই স্থান হইতে সবেগে প্রস্থান করিবার উদ্যোগ করিতেছে। ইহা দেখিয়াই দ্রুতবেগে আমি গিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিলাম, এবং আমার অঙ্গস্থিত উড়ানিদ্বারা তাহাকে উত্তমরূপে বাঁধিয়া তাহারই আফিস-ঘরের ভিতর তাহাকে আনিলাম। বালমুকুনের সাহায্যে দ্বারবানও ধৃত হইল, তাহাকেও উত্তমরূপে বাঁধিয়া তাহার মনিবের নিকট রাখিলাম।

তখন উভয়কেই উত্তমরূপে বাঁধিয়া আমি মাণিকচাঁদকে কহি, লাম, দেখ মাণিকচাঁদ! তুমি যাহা অনুমান করিয়াছিলে, তাহা প্রকৃত; আমি তোমাকে প্রকৃতই ধৃত করিতে আসিয়াছি। সুতরাং এখুন যে কেন তোমাকে ধৃত করিলাম, তাহা তুমি এখন বেশ বুঝিতে পারিয়াছ। এখন তুমি আমাকে সমস্ত প্রকৃত কথা বলিতে প্রস্তুত আছ কি না?

মাণিক। আমি আপনার কথা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি তেছি না, এবং কেনইবা আপনি আমাদিগকে এরূপে ধৃত করি লেন, তাহারও কিছু অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

আমি। যে ব্যক্তি হত্যা করিবার সহায়তা করিতে পারে, ও চুরি করিবার নিমিত্ত নানাবিধ উপায় উদ্ভাবন করিয়া অপরের দ্বারা সেই কাৰ্য্য সমাধা করিয়া লইতে পারে, সে যে কেন ধৃত হইল, তাহা তাহার বুঝিতে না পারিবারই কথা। সে যাহা হউক, তুমি এখন প্রকৃত কথা বলিবে, কি না?

আমার এই প্রকার কথা শুনিয়া বালমুকুন কেবল আমার মুখের দিকেই একদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার ভাবগতি দেখিয়া অনুমান হইতে লাগিল, আমার এই অবস্থা দেখিয়া বালমুকুন যেন একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িয়াছেন, ভালমন্দ কিছুই যেন বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। বালমুকুনের এই অবস্থা দেখিয়া আমি তাহাকে কহিলাম, আপনি এরূপ বিস্মিত হইতেছেন কেন? ইহারা আপনাকে মধ্যে রাখিয়া একটী ভয়ানক চুরি করিয়াছে, এবং আপন প্রাণ লইয়া পলায়ন করিবার মানসে একটী হত্যা করিতেও পরাজুখ হয় নাই।

মাণিক। এ মিথ্যা কথা। ইহা আপনাকে কে বলিল?

আমি। আমাকে অপরে যাহা কিছু বলুক, বা অপর কোন স্থান হইতে আমি যেরূপে সংবাদ পাই, আর না পাই, তোমারই

সংবাদপত্রে কি সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাই কেন একবার পড়িয়া দেখ না। তাহা হইলেই ত আমাকে তোমার আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হইবে না। এই বলিয়া মাণিক চাদের টেবিলের উপর যে সংবাদ-পত্ৰখানি আমি প্রাপ্ত হইয়া পাঠ করিয়াছিলাম, সেই সংবাদপত্র হইতে সেই বিষয়টা আমি পাঠ করিলাম। উহার সারমর্ম এইরূপ —

ভয়ানক হত্যা ও অদ্ভুত চুরি।

অপরাধী ধৃত হইয়াছে; কিন্তু কে যে তাহার এই বিষয়ে সবিশেষরূপে সাহায্য করিয়াছে, তাহার সন্ধান এখনও পর্যন্ত হয় নাই।

বালমুকুন নামক এক ব্যক্তি কোনরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, বোম্বাই সহরের একজন প্রধান ধনীর অধীনে একটী কার্যে নিযুক্ত হয়। চাকরী করা তাহার উদ্দেশ্য ছিল না, তাহার ইচ্ছা, চাকরের ভানে কিছুদিবস সেই স্থানে কাৰ্য্য করিয়া, ধনীর ধনভাণ্ডার প্রভৃতির উত্তমরূপ অনুসন্ধান লয়। এইরূপে সেই মহাজনের কোন্ কোন্ স্থানে কিরূপ অর্থ আছে, তাহা যেমন জানিতে পারিল, অমনি সুযোগমত ক্রমে ক্রমে সেই সকল স্থান যে সকল তালার দ্বারা বন্ধ থাকে, একে একে তাহার সমস্ত চাবি প্রস্তুত করিয়া লয়, এবং সুযোগমত একদিবস রাত্রিকালে সেই সমস্ত তালা খুলিয়া নোট, টাকা, সুবর্ণ-অলঙ্কার ও জহরত আদিতে প্রায় লক্ষাধিক টাকা অপহরণ করিয়া সমস্ত তালা পুনরায় আবদ্ধ-পূৰ্ব্বক যেমন বাহির হইবার চেষ্টা করে, সেই সময় একজন দ্বারবান্ উহা জানিতে পারিয়া বালমুকুনকে ধরিবার চেষ্টা করে, এবং চোর চোর বলিয়া ভয়ানক গোলযোগ করে। বালমুকুন সেই সময় অনন্যোপায় হইয়া আপনার প্রাণ লইয়া পলায়ন করিবার মানসে সেই দ্বারবানের উপর সবিশেষরূপ বলপ্রয়োগ করে; কিন্তু যখন কোনরূপেই তাহার হস্ত হইতে পরিত্রাণ না পায়, সেই সময় একখানি অস্ত্র দ্বারা বালমুকুন্ তাহাকে সাংঘাতিকরূপ আঘাত করিয়া পলায়নের চেষ্টা করে। সেই অস্ত্রখানি বোধ হয়, বালমুকুন সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিল। দ্বারবান সেই অস্ত্রাঘাতেই হতজ্ঞান হইয়া সেই স্থানে পতিত হয়, এবং পরিশেষে ইহজীবন সম্বরণ করে। দ্বারবানকে হত্যা করিয়াও বালমুকুন্ সেই স্থান হইতে পলায়ন করিতে সমর্থ হয় নাই, অপরাপর কতকগুলি লোক সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াছিল, পরিশেষে বালমুকুন তাহাদিগের দ্বারা ধৃত হইয়াছে। বালমুকুন যে কে, তাহা এ পর্যন্ত সবিশেষরূপে স্থিরীকৃত হয় নাই। পুলিস সবিশেষরূপ যত্নসহকারে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছেন। কেহ কেহ বলিতেছেন, বালমুকুন অপর আর কেহই নহে; বোধ হয়, মধ্যপ্রদেশীয় সেই ভয়ানক দস্যু হীরালাল। যাহা হউক, এ বিষয়ের সমস্ত রহস্য বাহির হইয়া পড়িলে, ইহার আনুপূর্বিক সংবাদ আমরা পাঠকগণকে প্রদান করিতে চেষ্টা করিব।

সংবাদপত্রখানি পাঠ করা সমাপ্ত হইলে আমি মাণিকচাঁদকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কেমন মাণিকচাঁদ! তোমার এখন আর কোন কথা জিজ্ঞাস্য আছে?

তখন মাণিকচাঁদ আমার কথার আর কোনরূপ উত্তর প্রদান করিতে পারিল না; মস্তক নত করিয়া কেবলমাত্র একটী দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিল।

বালমুকুন কহিলেন, কি মহাশয়! আমি এই হত্যা করি আছি? দোহাই মহাশয়! আমি সেই স্থানে গমন করি নাই, এই কলিকাতা আমি পরিত্যাগ করি নাই। সেই ফারমে আমার কৰ্ম্ম হইয়াছিল সত্য; কিন্তু সেই কৰ্ম্ম আমি পরিত্যাগ করিয়াছি। যখন আমি সেই স্থানে গমন করি নাই, তখন সেই চুরি ও হত্যা আমার দ্বারা সম্পন্ন হইবে কি প্রকারে?

আমি। বালমুকুন্! ইহাতে তোমার ভীত হইবার কোন কারণ নাই। যে ব্যক্তি তোমার নাম গ্রহণ করিয়া, সেই স্থানে কৰ্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, তাহার প্রকৃত নাম বোধ হইতেছে হীরালাল। মাণিকচাঁদ এখন সমস্ত কথা পরিষ্কার করিয়া আমাদিগকে বলিবে, এবং তাহারই বা প্রকৃত নাম কি, তাহাও বোধ হয়, এখন আর সে গোপন করিবে না।

আমার কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদ কহিল, মিথ্যা আপনি আমাকে লইয়া পীড়াপীড়ি করিতেছেন। হীরালাল যে কে, তাহা আমি জানি না, বা এই সংবাদপত্রে বর্ণিত চুরি বা হত্যার বিষয় আমি কিছুমাত্র অবগত নহি।

অবগত আছ কি না, তাহা পরে জানিতে পারিবে। এই বলিয়া আমি সেই গৃহের দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দিলাম, এবং মাণিকচাঁদ ও দ্বারবানকে লইয়া আমি আমার থানায় গমন করি লাম। থানা হইতে একটী পাহারার বন্দোবস্ত করিয়া পাঠাইয়া দিলাম। যে পর্যন্ত সমস্ত গোলযোগ মিটিয়া না গেল, সেই পৰ্য্যন্ত সেই গৃহের উপর পাহারা রহিল।

থানায় গিয়া মাণিকচাঁদ ও সেই দ্বারবানকে আবদ্ধ অবস্থায় রাখিলাম, এবং সমস্ত বিষয় সবিশেষরূপে বিবৃত করিয়া বোম্বাই পুলিসের নিকট একখানি জরুরি টেলিগ্রাম পাঠাইয়া দিলাম। পরদিবস সেই টেলিগ্রামের উত্তর আসিল; তাহার সারমর্ম এইরূপ :–

আপনার টেলিগ্রাম পাইয়াছি। যে বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমরা এখানে অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, এবং কিরূপ উপায়ে হীরালাল বালমুকুন পরিচয়ে এই স্থানে কৰ্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হয়, তাহার কিছুই এ পর্যন্ত ঠিক করিয়া উঠিতে পারিতে ছিলাম না। আপনা-কর্তৃক তাহার সমস্তই প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে, এবং আপনি হীরালালের সহায়তাকারীগণকে ধৃত করিয়া আমাদিগের যে কি উপকার করিয়াছেন, তাহা বলিতে পারি না। আপনি তাহাদিগকে যেন কোনরূপেই ছাড়িয়া দিবেন না। আমরা আপনার নিকট গমন করিতেছি, সাক্ষাৎ হইলে সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিবেন। আমরা অদ্যই মেল ট্রেণে রওনা হইব।

এই সংবাদ পাইয়া মনে মনে অতিশয় আনন্দিত হইলাম। কেবলমাত্র সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া যে কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলাম, দেখিলাম, তাহার সুফলই ফলিয়াছে।

সময় মত দুইজন পুলিস-কর্ম্মচারী বোম্বাই হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা সেই চোর ও হত্যাকারী হীরা লালকেও তাঁহাদিগের সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় আনিলেন। হীরালাল প্রথমতঃ কোন কথাই বলিয়াছিল না; কিন্তু কলি কাতায় আসিয়া মাণিকচাঁদ ও দ্বারবানকে বন্ধনাবস্থায় দেখিতে পাইবার পরই সমস্ত কথা স্বীকার করিল। সে যাহা কহিল, বোম্বাই-পুলিস-কর্ম্মচারীদ্বয় তাহা লিখিয়া লইলেন। উহা আমার লিখিবার প্রয়োজন না থাকিলেও, আমার অভ্যাসের দোষে আমি তাহা লিখিয়া লইলাম। হীরালাল যাহা বলিয়াছিল, তাহার সারমর্ম এইরূপ :–

আমার নাম হীরালাল। আমার জন্মস্থান মধ্য ভারতে; কিন্তু আমার থাকিবার নির্দিষ্ট কোন স্থান নাই। ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান সহরমাত্রেই আমার একটা না একটী আজ্ঞা আছে। যখন যে স্থানে গমন করি, তখন সেই স্থানেই দুই চারিদিবস অতিবাহিত করিয়া থাকি। আমি বাল্যকালেই আমাদিগের ভাষায় একরূপ শিক্ষিত হইয়াছিলাম, এবং সকল প্রকার কৰ্ম্ম কাৰ্য্যই আমি করিতে জানি। কিন্তু চুরি ভিন্ন কখনও অপর কোন কাৰ্য্য করি নাই। চুরি করিয়াই এতকাল কাটাইয়া আসি মাছি, ও অনেকবার ধরা পড়িয়া জেলেও গিয়াছি সত্য; কিন্তু কখনও কোন গরিবের দ্রব্য অপহরণ করি নাই, বা অল্প মূল্যের দ্রব্যে কখনও হস্তাৰ্পণ করি নাই। যখন যে স্থানে যে কাৰ্য্যে হস্তাৰ্পণ করিয়াছি, তখন সেই কাৰ্যে দশ বিশ হাজারের কম লইয়া সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করি নাই; কিন্তু একটামাত্র পয়সাও কখনও রাখিতে পারি নাই। যেরূপ ভাবে আয় করি য়াছি, ব্যয় করিয়াছিও সেইরূপে।

বোম্বাইয়ের যে মহাজনের গদিতে আমি চুরি করিয়া ধৃত হইয়াছি, অনেকদিবস হইতে সেই গদিতে চুরি করিবার আমার মিতান্ত ইচ্ছা ছিল; কিন্তু এ পর্যন্ত কোনরূপেই সুযোগ করিয়া উঠিতে পারিতেছিলাম না। কিরূপ অবস্থায় ও কোথায় যে উহার ধনভাণ্ডার স্থাপিত, তাহা এ পর্যন্ত জানিতে পারিয়া ছিলাম না বলিয়াই, এতদিবস আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারি নাই। যে সময় উহার গদিতে একজন গোমন্তার প্রয়ো জন হইল, সেই সময় আমি অন্তরালে থাকিয়া, যাহাকে আপনার এখন মাণিকচাঁদ বলিয়া জানিতে পারিয়াছেন, তাহাকে সেই কার্যে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত অনেকরূপ চেষ্টা করিয়া ছিলাম; কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারি নাই। লাভের মধ্যে মাণিকচাঁদ সেই স্থানে দুই চারির যাতায়াত করাতে তাঁহারা উহাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন। নতুবা আমি নিজে প্রকাশ্যরূপে এই কাৰ্যে কখনই খাকিতাম না। মাণিকচাঁদ যে কাৰ্য্য করিয়াছিল, আমি তাহাই করিতাম, আমার কাৰ্য মাণিকদের দ্বারা সম্পন্ন হইত।

যখন মাণিকচাঁদকে কোনরূপেই সেই কাৰ্য্যে নিযুক্ত করা ইতে পারিলাম না, তখন সেই কার্ষে যে নিযুক্ত হইতেছে, তাহারই অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম, এবং পরিশেষে জানিতে পারিলাম যে, কলিকাতা হইতে বালমুকুন নামক এক ব্যক্তি সেই কার্যে নিযুক্ত হইয়াছেন, ও শীঘ্রই তিনি কলিকাতা হইতে আগমন করিয়া সেই কাৰ্যে প্রবৃত্ত হইবেন। কর্ম্মচারী হইয়া উঁহাদিগের কার্যের মধ্যে প্রবেশ করিতে না পারিলে, কোন্ স্থানে উঁহাদিগের অর্থাদি রক্ষিত হয়, তাহা জানিতে পারিবার কোনরূপ সম্ভাবনা নাই দেখিয়া, সেই দিবসেই মাণিক চাদকে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলাম। কলিকাতায় আসিয়া তাহার প্রধান কাৰ্য্য এই হইল যে, যেরূপ উপায়েই হউক, বালমুকুনের সন্ধান করিয়া তাহাকে হস্তগত করিতে হইবে, এবং যাহাতে বালমুকুন সেই কার্যে নিযুক্ত হইতে না পারে, বিধিমতে তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। অথচ এদিকে যে পর্যন্ত আমি আপন কাৰ্য উদ্ধার করিয়া না লইতে পারি, সেই পর্যন্ত বালমুকুনকে আপন হস্তে রাখিয়া যাহাতে সে বোম্বাই সহরে আসিতে পারে, তাহার বন্ধোবস্তও করিতে হইবে। মাণিক চাদকে এইরূপ উপদেশ দিয়া, তাহাকে দ্রুতগতি কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলাম। মাণিকটা বড় বুদ্ধিমান ও সবিশেষ কৌশলী। তিনি কলিকাতায় আসিয়া অনায়াসেই বালমুকুনকে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিলেন, এবং তাহাকে অধিক বেতন প্রদান পূর্ব্বক প্রলোভিত করিয়া যে কার্যে তিনি নিযুক্ত হইয়াছিলেন, সেই কাৰ্যে প্রবৃত্ত হইতে তাঁহাকে স্থগিত করিলেন। তিনি সেই কাৰ্য্য পরিত্যাগ করিতেছেন, এই মর্মে একখানি পত্র তাঁহার নিকট হইতে লিখাইয়া লইয়া মাণিকচাঁদ সেই ফারমে পাঠাইয়া দিবার ভানে কোনরূপে হস্তগত করিয়া পরিশেষে উহা আমার নিকট প্রেরণ করিলেন। যে টেলিগ্রামে বালমুকুন তাহার কাৰ্য্যে নিয়োজিত হইবার আদেশ পাইয়াছিলেন, সেই টেলিগ্রাম খানি পর্যন্ত হস্তগত করিয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দিলেন, এবং কোন না কোন কৌশল অবলম্বন করিয়া বালমুকুন যাহাতে বোম্বাই সহরে আসিয়া উপস্থিত হইতে না পারেন, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এদিকে আমি সেই টেলিগ্রাম দেখা ইয়া, আমাকে বালমুকুন নামে পরিচয় দিয়া, অনায়াসেই সেই কার্যে নিযুক্ত হইয়া সবিশেষ মনোযোগের সহিত নির্দিষ্ট কাৰ্য্য করিতে লাগিলাম। এইরূপে ক্রমে দশ বারদিবস অতি বাহিত হইতে না হইতেই যে যে স্থানে অর্থাদি বা বহুমূল্য অলঙ্কারাদি রক্ষিত থাকে, তাহা জানিতে পারিলাম, এবং সুযোগ মত ক্রমে ক্রমে সেই সকল স্থান যে সকল তালা দ্বারা আবদ্ধ ছিল, তাহার চাবি প্রস্তুত করাইয়া লইলাম। আমার ইচ্ছা ছিল, সুযোগমত একদিবস রাত্রিতে চাবি খুলিয়া সমস্ত অর্থাদি, অপহরণ করিব, এবং পূর্বের ন্যায় তালাবদ্ধ করিয়া দিয়া সেই স্থানেই কাৰ্য করিতে প্রবৃত্ত থাকি। চুরির বিষয় প্রকাশ হইয়া পড়িলে, এবং পুলিসের অনুসন্ধান ক্রমে শেষ হইয়া গেলে, চাকরী পরিত্যাগ করিয়া আপন ইচ্ছানুযায়ী স্থানে গমন করিব ও সেই স্থানে সেই সকল অর্থ ব্যয় করিয়া কিছুদিবস বাবুগিরি করিয়া কাটাই। আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, ঈশ্বর কিন্তু তাহা হইতে দিলেন না। চুরি করিয়া বহির্গত হইবার কালীনই সমস্ত অপহৃত দ্রব্যের সহিত ধৃত হইলাম, এবং পরিশেষে আত্মরক্ষা করিবার মানসে নরহত্যা পর্যন্ত করিতেও কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হইলাম না! এখন আমার অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা হইবেই হইবে। তাহার নিমিত্ত আমি কিছুমাত্র দুঃখিত নহি, বা আমার প্রধান সঙ্গী, যিনি এখন আপনাদিগের নিকট মাণিকচাঁদ নামে পরিচিত, তাহার নিমিত্তও আমি দুঃখিত নহি। কারণ, আমরা উভয়ে পরামর্শ করিয়া যেরূপ কাৰ্য্যে হস্তাৰ্পণ করিয়াছি, তাহার ফল ভোগ করাই আমাদিগের কর্তব্য। কিন্তু এই দ্বারবানের নিমিত্ত আমি আন্তরিক দুঃখিত। কারণ, এ ব্যক্তি আমাদিগের সহিত কখনও কোন অসৎ কাৰ্যে প্রবৃত্ত হয় নাই, বা এ আমাদিগের নিকট পরিচিতও নহে। সামান্য অর্থের লোভে যে এইবার এই ব্যক্তি মাণিকচাঁদকে কিছু সাহায্য করিয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই; কিন্তু সে যে ইহার ভিতরের বিষয় অবগত আছে, তাহা আমার বোধ হয় না।

দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, মহাশয়! আমি পূর্ব্ব হইতে মাণিকচাঁদকে বা এখন যিনি বোম্বাই সহর হইত ধৃত হইয়া আসিয়াছেন, উঁহাদিগের কাহাকেও চিনিতাম না। মধ্য ভারতে বা বোম্বাই সহরে আমি কখনও গমন করি নাই। আমার বাসস্থান আরা জেলার অন্তর্গত কোন একখানি ক্ষুদ্র পল্লীতে। আমি কয়েকবার আয় গিয়াছিলাম, এবং পরিশেষে পেটের দায়ে কলিকাতায় আসিয়াছি। এই দুইটী স্থান ব্যতীত অপর কোন সহরে আমি আর গমন করি নাই। মাণিকচাঁদের সহিত এই কলিকাতা সহরেই আমার প্রথম পরিচয় হয়। তিনি আট টাকা। বেতনে আমাকে চাকুরী প্রদান করেন, এবং আমাকে এক মাসের বেতনও অগ্রিম দেন। তিনি যে জুয়াচোর, তাহা আমি জানিতাম না। আমাকে যখন যেরূপ কাৰ্য্য করিতে তিনি আদেশ প্রদান করিতেন, আমি সেই আদেশ অনুযায়ী সমস্ত কাৰ্য্য নিৰ্বাহ করিয়া যাহাতে আপন মনিবকে সর্বদা সন্তুষ্ট রাখিতে পারি, কেবল তাহারই চেষ্টা করিতাম। আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।

দ্বারবান্ এবং হীরালালের এই কথা শুনিয়া মাণিকচাঁদও পরিশেষে সমস্ত কথা স্বীকার করিল। বোম্বাইয়ের কর্ম্মচারীদ্বয়, এখানকার আর যে সকল অনুসন্ধান করিবার বাকী ছিল, তাহা সম্পন্ন করিয়া, সেই তিনজনকেই সঙ্গে লইয়া বোম্বাই সহরে প্রস্থান করিলেন।

সেই স্থানে বিচারে হীরালালের যাবজ্জীবন, এবং মাণিক চাদের দশ বৎসরের নিমিত্ত কারাবাসের আজ্ঞা হয়; দ্বারবান পরিত্রাণ পায়।

সম্পূর্ণ।

বেওয়ারিশ লাস

বেওয়ারিশ লাস (দারোগার দপ্তর ৭৩ম সংখ্যা)
(অর্থাৎ পথ-পার্শ্বস্থ পুলিন্দার ভিতরে প্রাপ্ত লাসের অদ্ভুত রহস্য!)
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিফদারবাগান বান্ধর পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে শ্রী বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। বৈশাখ।
Prvited By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.

প্রকাশকের মন্তব্য।

আজ দারোগার দপ্তর সপ্তম বৎসরে পদার্পণ করিল। এদেশে সাময়িক পত্র নিয়মিতরূপে এত অধিক দিন একাদি ক্রমে প্রচলিত থাকা বড় অনেকের ঘটেনা; সুতরাং ইহা গৌরবের কথা, তাহার আর সন্দেহ নাই। গ্রাহকগণের উপরেই সাময়িক পত্রের জীবন ও উন্নতি নির্ভর করে। আমাদের সেইরূপ অনুগ্রাহক গ্রাহক, যথেষ্ট আছেন বলিয়া, আজ আমরা গৌরবান্বিত হইতেছি। আজ তাই এই আনন্দের দিনে নুতন বর্ষারম্ভে সেই সকল গ্রাহকের নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইতে আসিয়াছি। তাহাদের এইরূপ অনুগ্রহ ও সাহায্য পাইলে অন্ততঃ আমাদের জীবনকাল পর্যন্ত এই দারোগার দপ্তরের অস্তিত্ব থাকিবে।

কেহ কেহ এইরূপ বলিয়া থাকেন যে, এই দারোগার দপ্তরের দ্বারা জুয়াচোর, বদমায়েদিগের নূতন জুয়াচুরি বুদ্ধির পথ প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু জানি না, ইহা দ্বারা জুয়াচোর গণ সাহায্য প্রাপ্ত হয়, কিম্বা সাধারণ লোকে সেই জুয়াচোর গণ-কৃত কাৰ্য্যের বিপক্ষে বাধা দিবার জন্য উপায় শিক্ষা প্রাপ্ত হয়। কারণ, আমরা কল্পনার অতিরঞ্জিত কোন চিত্র এই পুস্তকে দিই না; যাহা বাস্তবিক ঘটনা, এ দেশীয় জুয়াচুরি বুদ্ধির আয়ত্বাধীন, তাহাই ইহাতে লেখা হইয়া থাকে। তাহার পর সামান্য জুয়াচোর, বয়েস লোক পুস্তক পাঠ করে না; শিক্ষিত জুয়াচোরগণ পুস্তক পাঠ করে বটে, কিন্তু এরূপ পুস্তক দ্বারা তাহাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিশেষ সাহায্য হইয়া থাকে, তাহা যদি মানিয়া লওয়া হয়, তবে আমাদের দারোগার দপ্তর অপেক্ষা ভয়ানক ঘটনা-পূর্ণ বিলাতী ডিটেকটিভ গল্প পুস্তকহইতে তাঁহারা অনেক অধিক সাহায্য পাইতে পারে। ইহা ত গেল, প্রতিদিন-ঘটিত এ দেশীয় ঘটনার কথা। কিন্তু যখন কল্পনার অতিরঞ্জিত ঘটনা-পূর্ণ নভেলাদি পড়িয়া এ দেশীয় স্ত্রী-বালকগণ বিকৃত-বুদ্ধি ও বিজাতীয় প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়, তখন ত কেহ কোন কথা কহেন না, সেরূপ নভেলাদি সম্বন্ধে এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেন না! ইহার কারণ কি, কেহ কি বলিতে পারেন?

দারোগার দপ্তর একবারে সম্পূর্ণরূপ নূতন ধরণের পুস্তক। এরূপ পুস্তক ইতিপূর্বে বাঙ্গালা ভাষায় প্রচারিত হয় নাই। সুতরাং ইহা কোন্ শ্রেণীর পুস্তক, ইহা কাব্য বা উপন্যাস তাহা অনেকে ঠিক করিতে পারেন না। তবে ইহা গল্প ধরণে লেখা হইলেও, ইহাকে কাল্পনিক ঘটনা-পূর্ণ উপন্যাস বলা যাইতে পারে না। এরূপ স্থলে ইহার লেখক উপন্যাসিক পদবাচ্য কিরূপে হইবেন, বলিতে পারি না। আর বোধ হয়, এ পর্যন্ত সে কথা কেহ বলেন নাই। তবে কোন লেখক দারোগার দপ্তরের গল্প-লেখককে কবি-উপন্যাসিক বলিয়া, বিদ্রূপ-বাণ বর্ষণ করিলেন কেন বুঝিতে পারিলাম না। অবশ্য ইহা স্বীকার্য যে, কোন কোন সমালোচক দারোগার দপ্তরের ঘটনা-সমাবেশের বৈচিত্র্য ও পুস্তক-গত ভাষা সম্বন্ধে প্রশংসা করিয়াছেন।

আর একটা গুরুতর কথা এখানে না বলিয়া থাকিতে পারিলাম না। গত বৎসর বৈশাখ মাসে দারোগার দপ্তরে মাংস ভোজন নামে য়ে পুস্তকখানি বাহির হইয়াছিল, সেই সম্বন্ধে পূর্ণিমা পত্রিকায় শ্রদ্ধাস্পদ বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় আমাকে সমাজ-দ্রোহী বলিয়া প্রচার করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন। তবে যদি মাংস ভোজন পুস্তকের ঘটনার যথার্থ নামধামাদি এবং কাৰ্য-কলাপ যথার্থ বলিয়া অক্ষয় বাবুর নিকট প্রমাণ করিয়া দিতে পারি, তবে আমার উক্ত কলঙ্কের ক্ষালন হইবে। কিন্তু বিজ্ঞ, ভূতপূর্ব সাধারণী পরে উপযুক্ত সম্পাদক মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করি যে, আমরা যে সকল সমাজ-কালিমার প্রচার করি, সেই কালিমার প্রকৃত নিয়োক্তার নাম ধাম প্রভৃতি প্রকাশ করা কি আমাদের কর্তব্য? বিশেষতঃ উক্ত ঘটনার নায়ক, একজন সম্রান্ত উচ্চপদস্থ ব্যক্তি (বোধ হয় (!) মুন্সেফ)। আর অক্ষয় বাবু যে সময় সংবাদ পত্র পরিচালন করিতেন, বোধ হয়, উক্ত ঘটনা সেই সময়ে বাঙ্গালা দেশের মধ্যেই ঘটিয়াছিল। (অবশ্য কলিকাতার লোকে সে স্থানকে বাঙ্গাল দেশ বলিয়া থাকেন)। অতএব অক্ষয় বাবুর পক্ষে উক্ত ঘটনাকে কাল্পনিক বলিয়া ধারণা করা কি বিজ্ঞতার কাৰ্য্য হইয়াছে? অপর লোক হইলে আমরা এ বিষয়ে কিছুমাত্র উল্লেখই করিতাম না।

যাহা হউক, পরিশেষে পরম কারুণিক ভগবানের নিকট প্রার্থনা করি, যেন তাহার অনুকম্পায় পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্ব বৎসরের ন্যায় এ বৎসরেও গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি হইয়া, দারোগার দপ্তর আরও উন্নতি পথে অগ্রসর হয়, এবং ইহার জীবনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপিত হয়। ইতি—

শ্ৰীবাণীনাথ নন্দী,
প্রকাশক।
সিকদারবাগান-বান্ধব-পুস্তকালয় ও সাধারণ-পাঠাগার।

বেওয়ারিশ লাস

প্রথম পরিচ্ছেদ।

একদিবস প্রাতঃকালে থানার সম্মুখে বেড়াইতেছি, এরূপ সময়ে একটা লোকের মুখে শুনিতে পাইলাম যে, রাস্তার ধারে পুলিন্দার ভিতর একটা মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। যাহার, নিকট হইতে আমি উহা শুনিতে পাইলাম, তাহাকে ডাকিয়া দুই একটা কথা জিজ্ঞাসাও করিলাম; কিন্তু তাহার নিকট হইতে কোনরূপ সন্তোষজনক উত্তর প্রাপ্ত হইলাম না। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি মৃতদেহ কি নিজ চক্ষে দেখিয়া আসিয়াছেন?

পথিক। না।

আমি। তবে আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন যে, রাস্তার ধারে পুলিন্দার ভিতর একটী লাস পাওয়া গিয়াছে?

পথিক। আমি শুনিয়াছি।

আমি। কাহার নিকট হইতে আপনি শুনিয়াছেন?

পথিক। তাহার নাম ধাম জানি না। রাস্তা দিয়া একটা লোক অপর আর একজনকে বলিতে বলিতে যাইতেছিল, তাই আমি শুনিয়াছি।

আমি। কোন্ স্থানে এবং কোন্ রাস্তায় লাস পাওয়া। গিয়াছে, তাহার কিছু শুনিয়াছেন?

পথিক। না, তাহা শুনি নাই।

আমি। কবে পাওয়া গিয়াছে, তাহা কিছু শুনিয়াছেন?

পথিক। আজ পাওয়া গিয়াছে।

পথিকের এই কথা শুনিয়া একবার মনে হইল, হয় ত প্রকৃতই কোন স্থানে রাস্তার কিনারায় পুলিন্দার ভিতর একটা লাস পাওয়া গিয়া থাকিবে। ইহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে ইহার সত্যাসত্য জানিতে অধিক বিলম্ব হইবে না, কোন না কোনরূপে এখনই তাহার সংবাদ আসিয়া উপস্থিত হইবে। আবার মনে হইল, কলিকাতা সহরে মধ্যে মধ্যে যেমন এক একটা মিথ্যা সংবাদ প্রচারিত হইয়া পড়ে, ইহাও হয় ত সেই প্রকারের কথা।

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই পথিককে কহিলাম, যান মহাশয়। আপনি এখন প্রস্থান করুন; কিন্তু সবিশেষ রূপ না জানিয়া এরূপ কোন কথা জনসাধারণের মধ্যে কখন প্রকাশ করিবেন না। কারণ, আপনি সবিশেষরূপে নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, কলিকাতা সহরের মধ্যে মত প্রকার গুজব উঠে, তাহার এক তৃতীয়াংশও সত্য হয় না।

আমার কথা শুনিয়া পথিক সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন, আমিও সেই স্থানে বেড়াইতে লাগিলাম।

ইহার দশ মিনিট পরেই সংবাদ আসিল, চটমোড়া একটা লাস একটা বাক্সের ভিতর বেওয়ারিশ অবস্থায় যোড়াবাগান থানায় পাওয়া গিয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া, পূর্বের সংবাদকে আর মিথ্যা গুজব বলিতে পারিলাম না। আমাদিগের যেরূপ নিয়ম আছে, সেইরূপ ভাবে যোড়াবাগানের থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। তথায় বুঝিলাম যে, যে সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া ছিলাম, তাহার একবর্ণও মিথ্যা নহে।

আমি থানায় গিয়া দেখিলাম, সেই লাসের পুলিন্দা সম্পূর্ণ রূপে খোলা হয় নাই। আমি সেই স্থানে গমন করিবামাত্রই যে খোলা হইল, তাহাও নহে। আমি সেই স্থানে উপস্থিত হইলে পর, ক্ৰমে ঊর্ধ্বতন কৰ্ম্মচারীগণ আসিয়া সেই স্থানে একত্র হইলেন। তাঁহারা আসিলেও বাক্সের ভিতর হইতে সেই লাস বাহির করা হইল না। ডাক্তার সাহেবকে সংবাদ প্রেরণ করা হইল, এবং করোনার সাহেবের নিকট একখানি পত্র সহ একজন কর্মচারী প্রেরিত হইল। ক্রমে ডাক্তার সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ও কয়েকজন জুরি সমভি ব্যাহারে করোনার সাহেবও আগমন করিলেন।

এইরূপে সকলে সেই স্থানে সমবেত হইলে, যে বাক্সের ভিতর সেই মৃতদেহ রক্ষিত হইয়াছিল, তাহা সকলের সম্মুখে আনীত হইল। উহ ডবল টিনের একটা বেশ মজবুত বাক্স; কিন্তু নুতন নহে, পুরাতন। দেখিলে বোধ হয়, বহুদিবস হইতে সেই বাক্সটী অব্যবহাৰ্য্যরূপে কোন স্থানে রক্ষিত ছিল।

শুনিলাম, যে সময় বাক্সটী থানায় আনিয়া জমা দেওয়া হয়, সেই সময় উহাতে চাবি বন্ধ ছিল, এবং খুব মজবুত। দড়িতে উহা বাঁধা ছিল। আমরা সেই স্থানে উপস্থিত হইবার পূৰ্বেই, যে দড়ি দিয়া বাক্সটা বাঁধা ছিল, তাহা সম্পূর্ণরূপে খুলিয়া, বাক্সটীর চাবি ভাঙ্গিয়া ফেলা হইয়াছিল।

কিরূপে বাক্সটী থানায় আসিয়া উপস্থিত হইল, কিরূপ সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া উহার দড়ি খুলিয়া ফেলা হইল, ও বাক্সের চাবি ভাঙ্গিয়া ফেলা হইল, প্রথমে তাহাই জানিবার প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া একজন ঊর্ধ্বতন কর্মচারী জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন কর্মচারীর সম্মুখে এই বাক্সটী প্রথম থানার ভিতর আনীত হয়?

থানার দারোগা নিতান্ত ভীত অন্তঃকরণে উত্তর প্রদান করিলেন, আমারই সম্মুখে প্রথমে এই বাক্স থানার ভিতর আনয়ন করে।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। কে এই বাক্স থানায় আনিয়া জমা দেয়?

দারোগা। পোর্ট কমিশনরের একজন চাপরাশি দুইজন কুলির সাহায্যে এই বাক্সটী থানার ভিতর আনয়ন করে।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। পোর্টকমিশনরের সেই চাপরাশিকে তুমি চিন?

দারোগা। তাহাকে চিনি বৈ কি।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। সে এখন কোথায়?

দারোগা। তাহাকে আমি থানাতেই রাখিয়াছি, এই সে উপস্থিত আছে।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। উহার সঙ্গে যে দুইজন কুলি ছিল?

দারোগা। তাঁহারাও এখানে উপস্থিত আছে। উঃ কঃ। (চাপরাশির প্রতি) এ বাক্স তুমি কোথায় পাইলে?

চাপরাশি। রাত্রি দুইটার পর আমি পাহারা দিবার নিমিত্ত গঙ্গার ধারে গমন করি। সেই স্থানে এই বাক্সটা মামি দেখিতে পাই।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। গঙ্গার ধারে কোন্ স্থানে এই বাক্সটা ছিল?

চাপরাশি। গঙ্গার ধারে যে সকল খোলা মালগুদাম আছে, তাহারই একটী গুদামের ভিতর এই বাক্সটী রক্ষিত ছিল।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। যে স্থানে বাক্সটা ছিল, সেই স্থানে আর কোন্ কোন্ ব্যক্তি ছিল?

চাপরাশি। আর কেহই ছিল না, বেওয়ারিশ অবস্থায় কেবল বাক্সটীই ছিল মাত্র।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। উহা যে বেওয়ারিশ, তাহা তুমি কিরূপে বুঝিতে পারিলে?

চাপরাশি। আমি প্রথমতঃ ভাবিয়াছিলাম যে, যাহার বাক্স, সে সেই স্থানে রাখিয়া অপর কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছে, কাৰ্য শেষ হইলে যখন আসিবে, সেই সময় তাহার বাক্স লইয়া যাইবে। কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা। করিয়া যখন দেখিলাম, সেই বাক্স লইবার নিমিত্ত কেহই আসিল না, তখন সহজেই আমি উহাকে বেওয়ারিশ মনে করিয়া আমার প্রধান কর্মচারীর নিকট সংবাদ প্রেরণ করিলাম। তিনি সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া ওই বাক্স বেওয়ারিশ বলিয়া থানায় জমা দিবার নিমিত্ত আমাকে অনুমতি প্রদান করিলেন। তাই আমি এই বাক্স আনিয়া থানায় জমা দিয়াছি।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। তোমার সঙ্গে যে দুইজন কুলি আসি আছে, উহারা কাহারা?

চাপরাশি। উহারা মুটিয়ার কাৰ্য্য করে, এবং নিকটবর্তী এক স্থানে থাকে। যখন আমি দেখিলাম যে, এই বাক্সী

অতিশয় ভারি, দুইজন লোক ব্যতীত কোনরূপেই উহা থানায় আনা যাইতে পারে না, তখন এই দুইজন কুলিকে আমি ইহাদিগের গৃহ হইতে ডাকাইয়া আনি, ও ইহাদিগের সাহায্যে এই বাক্সটা আমি থানায় আনিয়া উপস্থিত করি।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। এই বাক্সটী থানায় জমা দিবার সময় উহার ভিতর কি আছে, তাহা তোমরা দেখিয়াছিলে কি?

চাপরাশি। না মহাশয়! তাহা আমরা দেখি নাই। উহার ভিতর কি আছে, তাহা খুলিয়া দেখিবার নিয়ম আমা দিগের নাই। যেরূপ অবস্থায় যে কোন বেওয়ারিশ দ্রব্য পাওয়া যায়, সেইরূপ অবস্থায় তাহা আনিয়া আমরা থানায় জমা দিয়া থাকি।

ঊর্ধ্বতন কৰ্ম্মচারী। তোমরা যদি এই বাক্স না খুলিয়া থাক, তাহা হইলে ইহা খুলিল কে?

চাপরাশি। থানায় আনিবার পর দারোগা মহাশয় উহা খুলিয়াছেন। দোহাই ধর্মাবতার। আমরা উহা খুলি নাই।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। যে সময় দারোগা মহাশয় এই বাক্স থােলেন, সেই সময় তুমি সেই স্থানে উপস্থিত ছিলে?

চাপরাশি। আজ্ঞা হাঁ, আমি সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিলাম। আমার সম্মুখেই এই বাক্স খোলা হয়।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। (দারোগার প্রতি) কেমন, তুমিই এই বাক্স প্রথমে খুলিয়াছিলে?

দারোগা। আজ্ঞা হাঁ, আমি উহা খুলিয়াছিলাম।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। এই বাক্স খুলিবার তোমার কি প্রয়োজন হইয়াছিল?

.

দারোগা। এই বাক্স যখন জমা করিয়া দিবার নিমিত্ত থানায় আনা হয়, তখন উহার ভিতর কি দ্রব্য আছে, তাহা না জানিয়া উহা কিরূপে জমা করিয়া লইতে পারি? মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া যে দড়ি দিয়া এই বাক্স জড়াইয়া বাঁধা ছিল, তাহা প্রথমে খুলিয়া ফেলি। তাহার পর দেখিতে পাই, বাক্সের চাবি বন্ধ আছে। সুতরাং এই চাবিও আমাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিতে হয়। চাবি ভাঙ্গিয়া বাক্সের ডালা উঠাইয়া দেখিতে পাই যে, উহার ভিতর যে দ্রব্য আছে, তাহা আবার চটে মোড়া। তখন সেই চটের এক পার্শ্বে অতি অল্পমাত্র ফাঁক করিয়া দেখি, উহার ভিতর মৃতদেহ রহিয়াছে। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি তৎক্ষণাৎ আমার ঊর্ধ্বতন কর্মচারীকে সংবাদ প্রদান করি। তিনি উপর হইতে তৎক্ষণাৎ নীচে আগমন করেন, এবং স্বচক্ষে এই ব্যাপার দর্শন করিয়া পরিশেষে আপনাদিগের নিকট সংবাদ প্রদান করেন।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। থানার কেতাবে ভুমি এই বাক্স জমা করিয়া লইয়াছ?

দারোগা। না।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী। কেন?

দারোগা। বাক্সের ভিতর যখন কোন দ্রব্য পাইলাম না, অথচ লাস বাহির হইয়া পড়িল, তখন আর কি জমা করিয়া লইব?

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

থানার দারোগা ও চাপরাশির নিকট এই সকল কথা অবগত হইয়া ঊর্ধ্বতন কর্মচারী সেই বাক্স সৰ্ব্ব সমক্ষে সেই স্থানে খুলিতে কহিলেন। আদেশ প্রদান করিবামাত্র তাহার সেই আদেশ প্রতিপালিত হইল।

বাক্সের ডালা খুলিবামাত্র আমরা সকলেই দেখিতে পাই লাম যে, সেই বাক্সের ভিতর চটে মোড়া ও উপরে দড়ি দিয়া উত্তমরূপে জড়াইয়া সেই মৃতদেহটী বাধা আছে। সেইরূপ অবস্থায় সেই চট-জড়ান মৃতদেহ সেই বাক্সের ভিতর হইতে বাহির করা হইল, এবং যে দড়ি দিয়া উহা জড়াইয়া বাঁধা ছিল, সেই দড়ি ও চট খুলিয়া দিলে, দেখিতে পাওয়া গেল, উহার ভিতর যে মৃতদেহ ছিল, তাহা একটা পুরুষের দেহ। উহার হাত পা দোমড়াইয়া যাহাতে অল্প স্থানের ভিতর স্থান হইতে পারে, সেইরূপ ভাবে বাঁধা হইয়াছিল।

সেই মৃতদেহ দেখিয়া অনুমান হইল, যে ব্যক্তি মরিয়া গিয়াছে, তাহার বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের কম হইবে না। জাতিতে মুসলমান। মৃতদেহ উত্তমরূপে পরীক্ষা করা হইল; কিন্তু উহার কোন স্থানে কোনরূপ জখম বা অপর কোনরূপ আঘাতের চিহু দেখিতে পাওয়া গেল না। কেবল অনুমান হইল যে, উহার বাম গণ্ডে যেন একটু সামান্য কাল দাগ পড়িয়াছে।

ডাক্তার সাহেব সেই স্থানেই উপস্থিত ছিলেন। তিনিও সেই মৃতদেহ উত্তমরূপে দেখিয়া কহিলেন, যদি ইহাকে কোন স্থানে আঘাত করা হইয়া থাকে, তাহা হইলে বাম গণ্ডে ব্যতীত যে অপর কোন স্থানে আঘাত করা হইয়াছে, তাহা অনুমান করা যায় না।

তিনি আরও কহিলেন যে, তাঁহার বিবেচনায় সেই ব্যক্তির মৃত্যু চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর হইয়াছে বলিয়া অনুমান হয় না। তিনি তখন এই সকল বিষয় সম্বন্ধে তাঁহার ঠিক মত প্রকাশ করিতে পারিলেন না, ও কহিলেন যে, এখন তিনি যাহা, বলিতেছেন, তাহা কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া বলিতেছেন মাত্র। যে পর্যন্ত সেই শব ছেদন করিয়া তিনি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া না দেখিতে পারিবেন, সেই পৰ্যন্ত তিনি তাঁহার ঠিক মত প্রকাশ করিতে সমর্থ হইবেন না।

ডাক্তার সাহেবের এই কথা শুনিয়া, সেই মৃতদেহ যে স্থানে ছেদন করিলে, পরীক্ষা হইতে পারে, সেই স্থানে উহা তৎক্ষণাৎ পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত ঊর্ধ্বতন কর্মচারী সাহেব আদেশ প্রদান করিলেন।

এই আদেশ সম্বন্ধে তাহার মতের সহিত আমাদিগের কাহারও মতের ঐক্য হইল না। তখন আমরা সকলে মিলিয়া তাঁহাকে কহিলাম, এই মৃতদেহ এখনই পাঠাইয়া দিবার সম্বন্ধে আপনি যে আদেশ প্রদান করিতেছেন, তাহা এখনই প্রতিপালন করা আমাদিগের কর্তব্য কৰ্ম্ম; কিন্তু এই মৃত দেহ যে কাহার, এ পর্যন্ত তাহার কিছুই, নির্ণয় হয় নাই। অতএব যে পর্যন্ত উহা স্থিরীকৃত না হইবে, সেই পর্যন্ত এই

হত্যার কোনরূপ উদ্ধার হইবে না, বা প্রকৃত অপরাধীও ধৃত হইবে না। এরূপ অবস্থায় আমাদিগের নিতান্ত ইচ্ছা যে, এই মৃতদেহ পরীক্ষার নিমিত্ত উহাকে কোন প্রকাশ্য স্থানে অনাবৃত ভাবে রাখিয়া দেওয়া কর্তব্য। কারণ, তাহা হইলে এই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত সেই স্থানে বিলক্ষণ জনতা হইবে, ও অনেক লোকে এই মৃতদেহ দেখিতে পাইবে। এইরূপ অবস্থায় যদি কেহ এই মৃতদেহ চিনিতে পারে, তাহা হইলে আমাদিগের অভিলাষ অনেকটা পূর্ণ হই বার সম্ভাবনা।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী সাহেব আমাদিগের মনের ভাব বুঝিতে পারিলেন, এবং ডাক্তার সাহেবের সহিত পরামর্শ করিয়া কহিলেন, আচ্ছা তাহাই ঠিক; কিন্তু দিবা বারটার পর এই মৃতদেহ যেন আর রাখা না হয়। কারণ, তাহা হইলে উহা একবারে পচিয়া যাইবে। মৃতদেহ পচিয়া গেলে ডাক্তার সাহেব তাহা উত্তমরূপে পরীক্ষা করিতে সমর্থ হইবেন না।

তিনি আরও কহিলেন, আমি এখনই প্রত্যেক থানায় সংবাদ প্রদান করিতেছি। সেই সকল থানার এলাকায় প্রত্যেক পল্লীতে যে সকল লোক বাস করে, তাহাদিগের মধ্যে কোন না কোন লোককে আনিয়া যেন এই মৃতদেহ দেখান হয়। তাহা হইলে সেই সকল লোকের মধ্য হইতে কোন না কোন লোক এই মৃতদেহ চিনিলেও চিনিতে পারিবে।

এই বলিয়া ঊর্ধ্বতন কর্মচারী সাহেব, ডাক্তার সাহেব এবং করোণার সাহেবের সহিত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

তাঁহারা চলিয়া যাইবার পর আমরা সেই মৃতদেহটা চটের ভিতর হইতে বাহির করিয়া একটী প্রকাশ্য স্থানে অনাবৃত অবস্থায় রাখিয়া দিলাম। সেই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত সেই স্থান লোকে লোকারণ্য হইয়া পড়িল। কয়েকজন উচ্চ ও নিম্নপদস্থ বুদ্ধিমান্ কর্মচারীকে পুলিশের পোক না পরাইয়া সেই ভিড়ের মধ্যে রাখিয়া দেওয়া হইল। সেই মৃতদেহ দেখিয়া কোন্ ব্যক্তি কি বলে, কেহ উহাকে চিনিতে পারিলে আপনাদিগের মধ্যে কি কথা বলাবলি করে, তাহা জানিয়া লইবার ভার তাহাদিগের উপরই অর্পিত হইল।

এদিকে উর্ধতন কর্মচারী মহাশয়ের আদেশ প্রচারিত হইবামাত্র প্রত্যেক থানার এলাকা হইতে রাশি রাশি লোক আসিয়া সেই স্থানে সমবেত হইয়া সেই মৃতদেহ দেখিতে লাগিল। কিন্তু তাহা যে কাহার দেহ, তাহা কেহ চিনিতে পারিল না, বা চিনিয়াও কেহ বলিল না। এইরূপে প্রায় দিবা এগারটা বাজিয়া গেল।

ঊর্ধ্বতন কর্মচারী সাহেব সেই স্থান হইতে প্রস্থান করি বার পর, যে চটে সেই মৃতদেহ মোড়া ছিল, সেই চটটা আমরা উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম, তাহাতে এরূপ কোন কথা লেখা নাই, বা এরূপ কোন চিহু নাই যে, যাহার দ্বারা, সেই চট যে কোথা হইতে আনীত হইয়াছে, বা তাহা কাহার, তাহার কিছুমাত্র সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে।

যে টিনের বাক্সের ভিতর সেই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেই টিনের বাক্সটীর মধ্যে উত্তমরূপে দেখাতে, দেখিতে পাইলাম, তাহার ভিতর একটা পুরাতন ও নিতান্ত ক্ষুদ্র শিশি রহিয়াছে। সেই শিশিটা নিজের হাতে করিয়া উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, প্রায় পাঁচ ছয় বৎসর পূৰ্বে সেই শিশিতে করিয়া ব্যাথগেট কোম্পানির ঔষধালয় হইতে একজন সাহেবের নিমিত্ত ঔষধ আসিয়াছিল। এরূপ শিশি প্রায় সকল গৃহেই পাওয়া যায়। বিশেষতঃ সাহেব দিগের গৃহের শিশি, বোতল প্রভৃতি তাহাদিগের খানসামা। বাবুর্চিরা প্রায়ই বিক্ৰীওয়ালাদিগের হস্তে বিক্রয় করিয়া ফেলে। বিক্ৰীওয়ালারা সেই সকল শিশি-বোতল আনিয়া শিশি-বোতল-ব্যবসায়ী দোকানদারের হস্তে বিক্রয় করে।, তাহাদিগের দোকান হইতে যাহাদিগের প্রয়োজন হয়, তাঁহারা ক্রয় করিয়া লইয়া যায়। এরূপ অবস্থায় সেই ঔষধের শিশি উপলক্ষ করিয়া অনুসন্ধান করিলে যে কোন রূপ সবিশেষ ফল লাভের সম্ভাবনা, তাহা বিবেচনা করি লাম না। যে স্থানের শিশি সেই স্থানে রাখিয়া দিয়া, অন্য কোন উপায় চিন্তা করিতে লাগিলাম। কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া কোন উপায়ই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।

এদিকে নানা স্থান হইতে নানা লোক আসিয়া সেই মৃতদেহ দর্শন করিতে লাগিল। কেহ বা তাহার অবস্থা দেখিয়া দুঃখ প্রকাশ, কেহ বা হত্যাকারীর উদ্দেশে গালি প্রদান, প্রভৃতি যাহার মনে যাহা আসিতে লাগিল, সে তাহাই বলিতে বলিতে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিতে লাগিল। তাহাদিগের কথার ভাবে স্পষ্টই অনুমান হইতে লাগিল যে, সেই মৃতদেহ তাহাদিগের মধ্যে কেহই চিনিয়া উঠিতে পারে নাই।

যে স্থানে সেই মৃতদেহ রক্ষিত হইয়াছিল, আমি সেই স্থানে গমন করিয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত দণ্ডায়মান রহিলাম, এবং যে সকল ব্যক্তি সেই মৃতদেহ দর্শন করিতে লাগিল, তাহাদিগের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি যে কি বলে, তাহার দিকে সবিশেষরূপ লক্ষ্য রাখিলাম।

সেই সময় হঠাৎ একটী লোকের উপর আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। সেই ব্যক্তি আর একজন লোকের নিকট কি কথা বলিতেছিল। তখন উহার ভাবগতি দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইল যে, সেই মৃতদেহ সম্বন্ধেই সে কোন কথা বলিতেছে। আমার আরও অনুমান হইল যে, সেই-  মৃতব্যক্তি যেন তাহার পরিচিত।

এই ব্যাপার দেখিয়া আমি আর কালবিলম্ব না করিয়া ধীরে ধীরে তাহার পশ্চাৎ ভাগে গিয়া দণ্ডায়মান হইলাম, ইচ্ছা যদি তাহার মুখের কোন কথা শুনিতে পাই।

সেই সময় অপর ব্যক্তি কহিল, কেমন, তুমি বেশ চিনিতে পারিতেছ?

উত্তরে সেই ব্যক্তি কহিল, আমার বেশ বোধ হইতেছে, এ সে-ই ব্যক্তি।

এই সময় আমি আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলাম না, তাহাকে তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করিলাম, এ কোন্ ব্যক্তির মৃতদেহ?

দর্শক। আমার বোধ হইতেছে, ইহা হকদারের মৃতদেহ।

আমি। হুকদার কে?

দর্শক। সে ব্রাউন কোম্পানির একজন কোচমান।

আমি। তাহার আর কে আছে, বলিতে পার?

দর্শক। তাহার ভাই আছে।

আমি। তাহার ভাইয়ের নাম কি?

দর্শক। নাম আমি জানি না।

আমি। কোথা থাকে বলিতে পার?

দর্শক। সেও ব্রাউন কোম্পানির আফিসে কোচমানের কাৰ্য্য করে, এবং সেই স্থানেই থাকে।

আমি। তুমি একবার আমার সঙ্গে গিয়া তাহার ভাইকে দেখাইয়া দিতে পার?

দর্শক। আমি যাইতে পারিতাম, কিন্তু এখন আমি আমার মনিবের কাৰ্যে গমন করিতেছি। এরূপ অবস্থায় আমি কিরূপে আপনার সঙ্গে গমন করিব? আমার মনিব জানিতে পারিলে, তিনি আমাকে চাকরি হইতে জবাব দিবেন।

আমি। তুমি আমাদিগের সহিত গমন করিয়া যদি এই কাৰ্যে আমাদিগের সাহায্য কর, তাহা হইলে তোমার মনিব তোমার উপর কোনরূপেই অসন্তুষ্ট হইবেন না, প্রত্যুত সবিশেষ সন্তুষ্টই হইবেন। তদ্ব্যতীত তোমার বাক্যানুসারে যদি আমা দিগের কাৰ্য উদ্ধার হয়, তাহা হইলে যাহাতে তুমি গবর্ণমেন্ট হইতে কিছু পারিতোষিক পাও, তাহার বন্দোবস্ত করিয়া দিব।

আমার কথায় সেই ব্যক্তি পরিশেষে সম্মত হইল, এবং আমাদিগকে সঙ্গে করিয়া সেই আড়গড়ায় গিয়া উপস্থিত হইল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

সেই ব্যক্তিকে সঙ্গে করিয়া আমরা যখন আড়গড়ার ভিতর প্রবেশ করিলাম, সেই সময় দেখিতে পাইলাম যে, আড়গড়া হইতে একটা লোক বাহির হইয়া আসিতেছে। তাহাকে দেখিয়াই সেই ব্যক্তি কহিল, মহাশয়! আপনি যাহার অনুসন্ধান করিতেছেন, সে ওই বাহির হইয়া আমা দের দিকে আসিতেছে, দেখুন।

এই কথা শুনিয়া আমি তাহাকে ডাকিলামসে নিকটে আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তোমর নাম কি? উত্তরে সে কহিল, আমার নাম সুবেদার

আমি। হকদার তোমার কে হয়?

সুবেদার। সে আমার ভাই।

আমি। সে এখন কোথায়?

সুবেদার। দেশে যাইব বলিয়া আজ দুই দিবস হইল, সে এই স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছে।

আমি। দেশে যাইবার সময় সে মূল্যবান্ দ্রব্যাদি কিছু লইয়া গিয়াছে কি?

সুবেদার। সবিশেষ মুল্যবান দ্রব্য কিছুই লইয়া যায় নাই; কিন্তু এত দিবস পর্যন্ত এই স্থানে চাকরি করিয়া যাহা কিছু নগদ অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিল, কেবল তাহাই লইয়া গিয়াছে।

আমি। কত টাকা লইয়া গিয়াছে, বলিতে পার?

সুবেদার। সে যে কত টাকা লইয়া গিয়াছে, তাহা ঠিক আমি বলিতে পারি না; কিন্তু আমার বোধ হয়, এক শত টাকার কম হইবে না।

আমি। তোমার ভাই দেশে চলিয়া গিয়াছে, ইহা তুমি ঠিক বলিতে পার কি?

সুবেদার। না, আমি তাহা ঠিক বলিতে পারি না। তবে এইমাত্র বলিতে পারি যে, দেশে যাইব বলিয়া টাকা কড়ি, পরিধেয় বস্ত্রাদি লইয়া যখন এই স্থান হইতে চলিয়া গিয়াছে, তখন তাহার দেশে যাওয়াই সম্পূর্ণরূপে সম্ভব।

আমি।আমার বোধ হইতেছে, তোমার ভাই দেশে যায় নাই। এই কলিকাতার ভিতর কোন একটা মোক ব্দমায় জড়ীভূত হইয়া পড়িয়াছে। আমি যাহার কথা বলিতেছি, সে যে তোমার ভাই, এ কথা আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি না। কিন্তু আমার যতদুর বিশ্বাস, তাহাতে সেই ব্যক্তি তোমার ভাই হওয়াই সম্পূর্ণ সম্ভব।

সুবেদার। কি মোকদ্দমায় আমার ভাই জড়ীভূত হইয়াছে, এবং কোথায় ও কিরূপ মোকদ্দমায় পড়িয়াছে, অনুগ্রহ করিয়া তাহা যদি আমাকে বলিয়া দেন, তাহা হইলে আমি বড়ই উপকৃত হইব।

আমি। আমার বলিয়া দিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন দেখি না। তুমি আমার সহিত আইস, যে স্থানে তোমার ভাই আছে, আমি এখনই সেই স্থানে লইয়া গিয়া তোমার ভাইয়ের সহিত সাক্ষাৎ করাইয়া দিব।

আমার প্রস্তাবে সুবেদার সম্মত হইল, কিন্তু কহিল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন। এই স্থানে আমার একজন আত্মীয় আছেন, তাহাকে ডাকিয়া আনিয়া আমরা উভয়ে এখনই আপনার সহিত গমন করিতেছি।

এই বলিয়া সুবেদার সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমরা সেই স্থানে তাহার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করিতে লাগি লাম। অতি অল্প সময় মধ্যেই অপর আর ব্যক্তিকে সঙ্গে করিয়া সুবেদার আমাদিগের নিকটে আসিয়া কহিল, চলুন মহাশয়! কোথায় যাইতে হইবে?

সুবেদার ও তাহার আত্মীয়কে সঙ্গে লইয়া যে স্থানে সেই মৃতদেহ ছিল, সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং সেই মৃতদেহী সুবেদারকে দেখাইয়া দিয়া কহিলাম, দেখ দেখি, এই মৃতদেহ কাহার, তাহা তুমি চিনিতে পার কি?

সুবেদার অনেকক্ষণ পর্যন্ত সেই মৃতদেহটী স্থির নেত্রে দর্শন করিয়া কহিল, ইহা আমার ভ্রাতা হকদারের মৃতদেহ বলিয়া বোধ হইতেছে। ইহাকে এইরূপে কে হত্যা করিল মহাশয়?

আমি। যে ব্যক্তি যেরূপে ইহাকে হত্যা করিয়াছে, ও যেরূপ অবস্থায় এই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা তুমি এখনই জানিতে পারিবে; কিন্তু তুমি অগ্রে উত্তমরূপে দেখ, ইহা তোমার ভ্রাতার মৃতদেহ কি না?

সুবেদার। আমি বেশ করিয়া দেখিয়াছি, ইহা যে আমার ভাই হকদারের মৃতদেহ, তাহাতে আর কোন সন্দেহ নাই।

আমি। মনুষ্য মরিয়া যাওয়ার পর, তাহার আকৃতি প্রায় বিকৃত হইয়া পড়ে। সুতরাং মৃতদেহ দেখিয়া উহা যে কাহার মৃতদেহ তাহা ঠিক নির্ণয় করা সময় সমন সবিশেষ কঠিন হইয়া উঠে। আর ইহাও প্রায় দেখিতে পাওয়া যায় যে, কোন কোন মৃতদেহ যাহার বলিয়া প্রথমে নির্ধারিত হয়, পরিশেষে তাহাকে জীবিতাবস্থাতেও পাওয়া গিয়া থাকে। এই নিমিত্ত আমি তোমাকে বলিতেছি, এই মৃতদেহ সম্বন্ধে যদি তোমার মনে কোনরূপ সন্দেহ থাকে, তাহা হইলে এই সময় আমাকে পরিষ্কার করিয়া বল। ইহা প্রকৃতই যদি তোমার ভ্রাতার মৃতদেহ হয়, তাহা হইলে বাঁহার দ্বারা এই ঘটনা ঘটিয়াছে, অনুসন্ধান করিয়া আমরা তাহা বাহির করিতে সবিশেষরূপে চেষ্টা করিব। আর এই মৃতদেহ তোমার ভ্রাতার কি না, এ সম্বন্ধে যদি কোনরূপ সন্দেহ হয়, তাহাও এখনই আমাকে বলতে পার, তাহা হইলে আমরা তাহার অপর উপায় দেখি।

সুবেদার। আমি বেশ করিয়া দেখিয়াছি, এবং আমার বেশ প্ৰতীতি হইতেছে, ইহা আমার ভ্রাত হকদারের দেহই হইবে। ইহার নিকট টাকাকড়ি কিছু পাওয়া গিয়াছে মহাশয়?

আমি। না, ইহার নিকট একটী পয়সাও পাওয়া যায় নাই।

সুবেদার। তাহা হইলে টাকার লোভেই কেহ ইহাকে মারিয়া ফেলিয়াছে।

আমি। যদি এই মৃতদেহ তোমার ভ্রাতার হয়, তাহা হইলে অর্থই যে এই ঘটনার মূল, তদ্বিষম্বে আমার কিছু মাত্র সন্দেহ নাই।

সুবেদার। ইহা নিশ্চয়ই আমার ভ্রাতার মৃতদেহ।

সুবেদারের কথায় অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ নাই। কারণ, সে যদি তাহার ভ্রাতার মৃতদেহ চিনিতে না পারিবে, তাহা হইলে আর কে চিনিতে পারিবে? যাহা হউক, সুবেদারের কথা যদি প্রকৃত হয়, সেই মৃতদেহ যদি তাহার ভ্রাতা হকদারের হয়, তাহা হইলে কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা স্থির করা নিতান্ত সহজ হইবে না। কারণ, অনুমান হইতেছে যে, অর্থের নিমিত্ত এই ঘটনা ঘটিয়া থাকিবে; এরূপ হইলে, এইরূপ কার্যে পরিপক্ক কোন লোকের দ্বারা নিশ্চয়ই এই কাৰ্য্য হইয়াছে। সেইরূপ লোকের দ্বারা এই কাৰ্য্য হইলে দেখা যায় যে, সে তোক প্রায়ই সহজে ধৃত হয় না। তথাপি এ বিষয়ে আমাদিগকে বিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া দেখিতে হইবে।

সেই সময় আমার মনে হইল, সুবেদারের সমভিব্যাহারে, তাহার আত্মীয় যে ব্যক্তি আগমন করিয়াছে, সেই ব্যক্তিও যে হকদারকে উত্তমরূপে চিনিতে পারিবে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাহাকেও সেই মৃতদেহ দেখান সর্বতোভাবে কর্তব্য।, মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সুবেদারের আত্মীয়কেও সেই মৃতদেহ দেখাইলাম, সে কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, না মহাশয়! ইহা কাহার মৃতদেহ, তাহা আমি চিনিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

আমি। তুমি সুবেদারের ভাই হকদারকে চেন?

আত্মীয়। খুব চিনি।

আমি। এই যে মৃতদেহ দেখিতেছ, তাহা হকদারের মৃতদেহ কি না?

আত্মীয়। ইহা দেখিতে অনেকটা হকদারের দেহের মত বটে; কিন্তু আমার বোধ হয় এই মৃতদেহ হকদারের মৃতদেহ নহে।

আমি। সুবেদার বলিতেছে, ইহা তাহার ভাই হকদারের মৃতদেহ।

আত্মীয়। আমার বোধ হয়, সুবেদার ঠিক চিনিতে পারিতেছে না। ইহার আকৃতির সহিত হকদারের আকৃতির অনেকটা সৌসাদৃশ্য থাকিলেও, ইহার অপেক্ষা হকদার একটু মোটা ও একটু লম্বা।

আমি। হকদার এখন কোথায়?

আত্মীয়। সে দেশে গিয়াছে।

আমি। দেশে যাইতে তাহাকে কে দেখিয়াছে?

আত্মীয়। কেহ দেখিয়াছে কি না, জানি না; কিন্তু খাইবার সময় আমি দেখি নাই।

আমি। রেলে উঠাইয়া দিবার নিমিত্ত কেহ তাহার সঙ্গে গমন করে নাই?

আত্মীয়। কেহ গমন করিয়াছিল কি না, জানি না; কিন্তু তাহার সঙ্গে আমানতের গমন করিবার কথা ছিল।

আমি। আমানত কে?

আত্মীয়। যে গ্রামে হকদারের বাড়ী, আমানতের বাড়ী ও সেই গ্রামে।

আমি। এখানে আমানত কোথায় থাকিত? আত্মীয়। কলিগঞ্জে।

আমি। বালিগঞ্জের কোথায়?

আত্মীয়। বালিগঞ্জে একটী আড়গড়া আছে; সে সেই স্থানেই থাকিত।

আমি। সে কাহার আড়গড়া?

আত্মীয়। সাহেবের আড়গড়া। সাহেবের নাম জানি না।

আমি। সেই স্থানে সে কি কাৰ্য্য করিত?

আত্মীয়। সহিসের কাৰ্য্য করিত।

আমি। তুমি সেই আড়গড়া আমাকে দেখাইয়া দিতে পারিবে কি?

আত্মীয়। কেন পারিব না? আমার সহিত আসুন, আমি তাহাকে এখনই দেখাইয়া দিব।

সুবেদার কর্তৃক মৃতদেহ সেনাক্ত হইয়াছে, অর্থের লোভে তাহার ভাই হকদারকে মারিয়া ফেলিয়া বাক্সের ভিতর পূরিয়া ফেলিয়া দিয়াছে, এই কথা বিদ্যুৎবেগে সহরের সর্ব স্থানে প্রচারিত হইয়া পড়িল। যে সকল কর্মচারী, কাহার মৃতদেহ, এই সংবাদ পাইবার প্রত্যাশায় স্থানে স্থানে গমন করিয়াছিলেন, এবং যে সকল কর্মচারী অপর কার্যে নানাস্থানে চলিয়া গিয়াছিলেন, এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া তাহার সকলে আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইতে লাগিলেন।

যাহা হউক, অনন্তর একখানি দ্রুতগামী গাড়ি লইয়া আমি, সুবেদার ও তাহার আত্মীয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া বালিগঞ্জে গমন করিলাম।

কথিত আড়গড়ার সম্মুখে উপস্থিত হইলে, আমাদিগকে সেই স্থানে রাখিয়া সেই আত্মীয় আমানতের সংবাদ আনিবার নিমিত্ত আড়গড়ার ভিতর গমন করিল, এবং কিয়ৎক্ষণ পরে প্রত্যাবর্তন করিয়া কহিল, আমানত ও হকদার কেহই এ পর্যন্ত দেশে যায় নাই, আজ সন্ধ্যার সময় যাইবে।

আমি। হকদার দেশে যায় নাই; কিন্তু সে এখন কোথায়, তাহ আমানত কিছু বলিতে পারিল?

আত্মীয়। আমানত আর আমাকে কি বলিবে?. হকদার যে স্থানে আছে, তাহা আমি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি।

আমি। সে এখন কোথায়?

আত্মীয়। সে এখন আমানতের বাসায় বসিয়া রহিয়াছে।

আমি। তুমি নিজ চক্ষে দেখিয়া আলিয়াছ?

আত্মীয়। হ মহাশয়! আমি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিতেছি। বিশ্বাস না করেন, বলুন, আমি তাহাকে ডাকিয়া আপনার সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিতেছি।

আমি। সে-ই ভাল, তাহাকে একবার ডাকিয়া আমার সম্মুখে আনয়ন কর।

আমার কথা শুনিয়া সেই আত্মীয় পুনরায় সেই আড়গড়ার ভিতর প্রবেশ করিল, এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই হকদারকে আনিয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত করিল। তাহাকে দেখিয়া সুবেদার কহিল, হা মহাশয়! এ-ই আমার ভাই। এখন দেখিতেছি, সেই মৃতদেহ দেখিয়া আমি ঠিক চিনিতে পারি নাই।

হকদারকে সঙ্গে লইয়া আমি প্রত্যাবর্তন করিলাম। হক দাকে জীবিত দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

অনুসন্ধানের এক অধ্যায় শেষ হইল। আমি বালিগঞ্জ হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া সেই মৃতদেহ আর থানায় দেখিতে পাইলাম না। যে স্থানে শব পরীক্ষা হয়, সেই স্থানে সেই শব তখন প্রেরিত হইয়াছিল।

সেই স্থানে গমন করিয়া দেখিলাম, সেই স্থানেও সেই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত অনেক লোকের সমাগম হইয়াছে।

যে বাক্সের ভিতর মৃতদেহ পাওয়া যায়, সেই বাকের ভিতর ঔষধের একটা ছোট শিশি পাওয়া গিয়াছিল, তাহা পাঠকগণ পূর্ব হইতে অবগত আছেন। সেই শিশির উপরকার লেভেলে ব্যাথগেট কোম্পানির নাম লেখা ছিল। একজন কৰ্মচারী সেই শিশিটা লইয়া ব্যাথগেট কোম্পানির বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন।

লাস পরীক্ষার স্থানে আমরা গিয়া উপস্থিত হইবার পর, সেই কর্মচারী ব্যাথগেট কোম্পানির ঔষধালয় হইতে প্রত্যা বৰ্তন করিলেন ও কহিলেন, এই শিশিতে যাহা লেখা আছে, ব্যাথগেট কোম্পানি তাহাদিগের খাতা-পত্ৰ দেখিয়া, তাহা অপেক্ষা আর অধিক কোন সংবাদ প্রদান করিতে পারি লেন না।

অনেকে মনে করিয়াছিলেন, সেই ঔষধের শিশি হইতে এই অনুসন্ধানের কোন না কোন সুত্র বাহির হইয়া পড়িবে; কিন্তু সেই কর্মচারীর কথা শুনিয়া সকলেই একবারে নীরব হইয়া পড়িলেন। পুনরায় কোন্ উপায় অবলম্বন করিয়া, সকলে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইবেন, তাহাই ভাবিতে লাগিলেন।

যে একটী সূত্র পাইয়া আমি এই মোকদ্দমার উদ্ধার করিতে পারিব বলিয়া আশা করিয়াছিলাম, এখন আমার সে আশাও দূর হইয়াছে। পুনরায় আবার কোন্ উপায় অবলম্বন করিব, মনে মনে এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে যে স্থানে সেই মৃতদেহ রক্ষিত ছিল, সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া সদর রাস্তার উপর আসিয়া দাড়াইলাম। আমার সম্মুখ দিয়া কত লোক যে সেই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত সেই স্থানে প্রবেশ করিতে লাগিল, এবং কত লোক মৃতদেহ দেখিয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া যে চলিয়া যাইতে লাগিল, তাহার সংখ্যা করা নিতান্ত সহজ নহে।

আমি সেই রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ক্রমে ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম। সেই রাস্তার ধারে একটা চাউলের দোকান ছিল, ক্ৰমে গিয়া আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলাম। আমার সম্মুখ দিয়া তখন পর্যন্ত অনেক লোক সেই স্থানে গমন ও তথা হইতে প্রস্থান করিতে লাগিল। আমি বসিয়া বসিয়া কেবল তাহাদিগকে দেখিতে লাগিলাম, এবং তাহাদের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি কি বলে, তাহা সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিতে লাগিলাম।

এইরূপে কিয়ৎক্ষণ বসিয়া থাকিবার পর, একটা কথা হঠাৎ আমার কর্ণে প্রবেশ করিল। একজন মুসলমান অপর একজন মুসলমানকে বলিতেছে, এই মৃতদেহ কাহার, তাহা চিনিতে পারিলে কি?

উত্তরে অপর ব্যক্তি কহিল, না, আমি কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না; কিন্তু এই ব্যক্তি যে আমার পরিচিত, বা ইহাকে যেন কোথায় দেখিয়াছি, ইহা আমার বেশ মনে হইতেছে।

প্রথম ব্যক্তি। এই ব্যক্তি মেহের আলির জামাই নয় কি?

দ্বিতীয় ব্যক্তি। ঠিক কথা বলিয়াছ। এখন আমার বেশ মনে হইতেছে, এ মেহের আলির জামাই বটে।

এই কথা শুনিয়া আমি উভয়কেই ডাকিলাম। তাঁহারা আমার নিকটে আসিলে, আমি তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কহিলাম, ওই মৃতদেহ দেখিয়া তোমরা কিছু চিনিতে পারিলে কি, যে ওই মৃতদেহ কাহার?

১ম ব্যক্তি। না মহাশয়! আমরা কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।

অমি। মেহের আলিকে তুমি চেন নাকি?

১ম ব্যক্তি। কোন্ মেহের আলি?

আমি। কোন মেহের আলি।

১ম ব্যক্তি। না মহাশয়! আমি কোন মেহের আলিকে চিনি না।

আমি। (দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য করিয়া) কেমন, তুমিও বোধ হয়, মেহের আলিকে চিন না?

২য় ব্যক্তি। আমি এক মেহের আলিকে চিনি।

আমি। সে মেহের আলি কে? .

২য় ব্যক্তি। সে থাকে তালতলায়। সে কোন সাহেব বাড়ীতে খানসামার কাৰ্য্য করে।

আমি। তাহার জামাইকে তুমি চিন কি?

২য় ব্যক্তি। তাহার একটী জামাই ছিল জানি।

আমি। সে জামাই এখন কোথায়?

২য় ব্যক্তি। তাহা আমি বলিতে পারি না।

আমি। তাহার নাম কি?

২য় ব্যক্তি। তাহার নামটা যে কি, তাহা আমার স্মরণ নাই।

আমি। তুমি যে মৃতদেহ দেখিয়া আসিলে, উহা মেহের আলির জামাতার মৃতদেহ বলিয়া বোধ হয় না কি?

২য় ব্যক্তি। সেইরূপই বোধ হয়; কিন্তু আমি ঠিক চিনিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

আমি। (প্রথম ব্যক্তির প্রতি) কেমন, তোমার কি বোধ হয়? যে মৃতদেহ দেখিয়া আসিলে, তাহা মেহের আলির জামাতার মৃতদেহ বলিয়া বোধ হয় কি?

১ম ব্যক্তি। আমি মেহের আলিকেই চিনি না, তাহার জামাতাকে চিনিব কি প্রকারে?

আমি। তোমার মত মিথ্যাবাদী মুসলমান জাতির ভিতর আর আছে কি না, জানি না। এখনই তুমি তোমার এই সঙ্গীকে বলিতেছিলে যে, ওই মৃতদেহ মেহের আলির জামাতার। আর আমি তোমাকে যেমন জিজ্ঞাসা করিলাম, অমনি সকল কথা অস্বীকার করিলে! তোমার মত নির্বোধ লোক আমি আর দেখি নাই। এই মৃতদেহ যে কাহার, এই সংবাদ যে বলিয়া দিতে পারিবে, সে পঞ্চাশ টাকা পারিতোষিক পাইবে, এই কথা তুমি শুন নাই কি?

১ম ব্যক্তি। শুনিয়াছি; কিন্তু আমি যখন চিনিতে পারি নাই, তখন কাহার নাম করিব?

আমি। তোমার মিথ্যা কথা আর আমি শুনিতে চাহি না। তুমি যেরূপ প্রকৃতির লোক, তোমার সহিত সেইরূপ ভাবে ব্যবহার না করিলে, তোমার নিকট হইতে কোন কথা পাইবার প্রত্যাশা নাই। যাহাতে তুমি প্রকৃত কথা সহজে বলিতে সক্ষম হও, আমি এখনই তাহার উপায় করিতেছি। তুমি একটু অপেক্ষা কর, তোমার সমভিব্যাহারী ব্যক্তিকে আর দুই চারিটী কথা আমি অগ্রে জিজ্ঞাসা করিয়া লই; তাহার পর আমার বিবেচনা মত ব্যবহার আমি তোমার প্রতি করিতেছি।

এই বলিয়া আমি সেই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, মেহের আলির জামাতা কোথায় থাকে, তাহা তুমি বলিতে পার কি?

২য় ব্যক্তি। না মহাশয়! আমি তাহার বাড়ী জানি না।

আমি। মেহের আলির বাড়ী জান?

২য় ব্যক্তি। তাহা জানি।

আমি। তুমি আমাকে সেই বাড়ী দেখাইয়া দিতে পার?

২য়। সবিশেষ আবশ্যক হয়, ত কাজেই দেখাইয়া দিতে হইবে; কিন্তু এখন একটু প্রয়োজন বশতঃ আমাকে স্থানান্তরে গমন করিতে হইতেছে। পরে যখন বলিবেন, সেই সময় আমি আসিয়া আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়া মেহের আলির বাড়ী দেখাইয়া দিব।

আমি। তুমি এখন অপর কার্যে গমন করিতেছ, কিন্তু ইহাও সবিশেষ কাৰ্য্য। কারণ, তোমার সংবাদ যদি ঠিক হয়, অর্থাৎ এই মৃতদেহ যদি মেহের আলির জামাতার হয়, তাহা হইলে সরকার হইতে তুমি একবারে পঞ্চাশ টাকা পাইবে, তদ্ব্যতীত সরকারী কাৰ্য্যে আমাদিগের সাহায্য করাও হইবে। তুমি এখনই আমার সঙ্গে আইস, এবং মেহের আলির ঘর আমাকে দেখাইয়া দেও। তাহা হইলে সেই স্থান হইতে আমি অনায়াসেই সন্ধান লইতে পারি যে, তাহার জামাতা কোথায় থাকে।

আমার কথায় দুই একবার আপত্তি উত্থাপন করিয়া, পরি শেষে সেই ব্যক্তি আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল। আমি তাহাকে সঙ্গে লইয়া তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। অপর ব্যক্তি জনৈক প্রহরীর সহিত সেই স্থানে বসিয়া রহিল।

সেই ব্যক্তি আমাকে সঙ্গে করিয়া তালতলায় মেহের আলির বাড়ীতে লইয়া গেল। অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম, মেহের আলি বাড়ীতে নাই। অতি প্রত্যুষে সে আপন কাৰ্য্যে গমন করিয়াছে। মেহের আলির একমাত্র কন্যা, সে সেই সময় মেহের আলির বাড়ীতেই ছিল।

আমরা মেহের আলির বাড়ীর সম্মুখে গমন করিলেই, পাড়ার অনেক লোক আসিয়া সেই স্থানে ভিড় করিয়া ফেলিল। উহাদিগের একজনকে মেহের আলির আত্মীয় বলিয়া অনুমান হইল। তাহাকে মেহের আলির জামাতার নাম জিজ্ঞাসা করায়, সে নিজে তাহা বলিতে পারিল না; কন্তু মেহের আলির বাড়ীর ভিতর গমন করিয়া তাহার নাম জানিয়া আসিয়া আমাকে কহিল, মেহের আলির জামাতার নাম রব্বানি।

যে বাড়ীতে মেহের আলি বাস করে, তাহা মেহের আলির নিজের বাড়ী। উহা একখানি সামান্য খোলার ঘর। রাস্তার উপর সদর দরজা, উহা খোলা রহিয়াছে; কিন্তু সেই দরজার উপর একখানি চটের পরদা ঝুলিতেছে। সেই পরদাটী নিতান্ত পুরাতন, এবং স্থানে স্থানে ছিড়িয়া গিয়াছে।

যে ব্যক্তি বাড়ীর ভিতর গমন করিয়া মেহের আলির জামাতার নাম জানিয়া আসিল, সে ভিতর হইতে আমাদিগের নিকট আসিবার পরেই কয়েকটী স্ত্রীলোক সেই পরদার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। আমাদিগের প্রেরিত ব্যক্তি রানির নাম আমাকে বলিবার পরই পরদার অন্তরাল হইতে একটা স্ত্রীলোক কহিল, কেন গা কি হইয়াছে?

আমি। রব্বানি কোথায়, তাহাই জানিবার নিমিত্ত এখানে আসিয়াছি।

পরদার অন্তরালবর্তী স্ত্রীলোক। কেন মহাশয়! কেন তাহার অনুসন্ধান করিতেছেন? অন্য তিন দিবস হইতে তিনি যে কোথায় গিয়াছেন, তাহার কিছুই আমরা স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

আমি। একটা মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, কেহ কেহ বলিতেছে, উহা মেহের আলির জামাতার দেহ। তাই আমরা জানিতে আসিয়াছি যে, তাহার জামাতা এখন কোথায়।

আমার এই কথা শুনিৰামাত্র সেই পরদার অন্তরালবর্তী স্ত্রীলোকদিগের মধ্য হইতে একটী স্ত্রীলোক হঠাৎ পরদ। ঠেলিয়া বহির্গত হইয়া পড়িল, এবং সেই রাস্তার উপর আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া কহিল, আমি বুঝিতে পারিতেছি, আমারই সর্বনাশ হইয়াছে! চলুন, মহাশয়? আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া চলুন, আমি এখনই গিয়া সেই মতদেহ দেখিয়া আসি।

আমি নিজে যে প্রস্তাব করিব মনে করিয়াছিলাম, সেই স্ত্রীলোকটী আপনা হইতেই সেই প্রস্তাব করিল। সুতরাং বিনা-বাক্যব্যয়ে আমি তাহাতে সম্মত হইলাম, এবং আমার সমভিব্যাহারে যে গাড়ি ছিল, সেই গাড়িতে উঠিতে কহি লাম। রোদন করিতে করিতে সেই স্ত্রীলোকটী তিন চারিটী ছোট ছোট বালক-বালিকার সহিত সেই গাড়িতে গিয়া উপবেশন করিল। আমি তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া সেই মৃতদেহ যে স্থানে রক্ষিত ছিল, সেই স্থান অভিমুখে প্রস্থান করিলাম। গাড়িতে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি কি মেহের আলির কন্যা?

স্ত্রীলোক। হাঁ মহাশয়!

আমি। তোমরা কয় সহোদরা?

স্ত্রীলোক। আমি ভিন্ন আমার পিতার পুত্র কন্যা আর কেহই নাই।

আমি। রব্বানি কি তোমার স্বামী?

স্ত্রীলোক। হাঁ।

আমি। রানি কি তোমার পিতার বাড়ীতেই থাকে?

স্ত্রীলোক। না।

আমি। সে কোথায় থাকে?

স্ত্রীলোক। যে স্থানে পিতার বাড়ী, তাহার সম্নিকটে অপরের বাড়ীতে আমরা বাসা করিয়া থাকি।

আমি। এ পুত্র কন্যা কয়েকটা কাহার?

স্ত্রীলোক। এ কটী সকলই আমার।

আমি। তোমাদের থাকিবার স্থান আছে শুনিতেছি, তবে তুমি তোমার পিতার বাড়ীতে রহিয়াছ কেন?

স্ত্রীলোক। আমি আমার পিতার বাড়ীতে থাকি না, কেবল আমার স্বামীর অনুসন্ধান করিবার নিমিত্তই পিতার বাড়ীতে আসিয়াছিলাম।

আমি। তোমার স্বামীর অনুসন্ধান করিতেছ কেন?

স্ত্রীলোক। তিনি বাড়ী ছাড়া হইয়া কখনও কোন স্থানে থাকেন না; কিন্তু দুই রাত্রি বাড়ীতে না আসায়, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না যে, তিনি কোথায় গেলেন। তাহার যদি কোনরূপে সন্ধান হয়, তাই জানিবার নিমিত্ত পিতার নিকট আগমন করিয়াছিলাম।

আমি। তিনি কবে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গিয়াছেন?

স্ত্রীলোক। পরশ্ব সন্ধ্যার কিছু পূর্বে তিনি বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছেন।

আমি। কি জন্য, ও কোথায় যাইতেছেন, তাহার কিছু বলিয়া গিয়াছিলেন কি?

স্ত্রীলোক। হাঁ, একরূপ বলিয়াছিলেন। আমাদিগের অবস্থা ভাল নহে; সামান্য যাহা তিনি উপার্জন করেন, তাহার দ্বারা কায়ক্লেশে কোনরূপে এই কয়েকটা বালক-বালিকাকে লইয়া জীবন ধারণ করিয়া থাকি। গত পরশ্ব তারিখে কোন স্থানে কাৰ্য হয় নাই। সুতরাং সে দিবস কিছু উপার্জনও হয় নাই। গৃহে অতি সামান্যই চাউল ছিল, তাহাই বন্ধন করিয়া বালক-বালিকা কয়টাকে দিয়া, অবশিষ্ট যাহা ছিল, তাহাই আমরা উভয়ে আহার করিলাম। বলা বাহুল্য, তাহাতে আমাদিগের অর্ধাশনও হইল না। পরে রাত্রিকালের নিমিত্ত গৃহে আর কিছুই ছিল না। পূর্বে কয়েক বৎসর তিনি কায করিয়াছিলেন, তাহার জন্য কয়েক স্থানে তাহার কিছু পাওনা ছিল, যদি তাহার মধ্যে কাহারও নিকট হইতে কিছু আদায় করিয়া আনিতে পারেন, তাহা হইলে রাত্রির একরূপ সংস্থান হয়, এই আশায় তিনি বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া যান।

আমি। তিনি কি কাৰ্য্য করিতেন?

স্ত্রীলোক। ঘরামীর কাৰ্য্য করিয়া থাকেন। উহার উপর নির্ভর করিয়া আমরা এতগুলি প্রাণী জীবন ধারণ করিয়া থাকি।

আমি। কাহার নিকট তাহার পয়সা পাওনা আছে, ও কাহার নিকটেই বা পয়সার নিমিত্ত গমন করিবে, তাহার কিছু বলিয়াছিল কি?

স্ত্রীলোক। এমন কিছু বলেন নাই, কেবলমাত্র এই বলিয়াছিলেন যে, তিনি প্রথমে আমার পিতার নিকট গমন করিবেন, সেই স্থান হইতে যদি কিছু পান, তাহা লইয়া অপর স্থানে গমন করিবেন, এবং সন্ধ্যার পরই বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করিবেন।

আমি। তোমার পিতার নিকট গমন করিবে কেন?

স্ত্রীলোক। তাহার নিকট কিছু পাওনা আছে, তাহারই নিমিত্ত।

আমি। তোমার পিতার নিকট কিসের পাওনা?

স্ত্রীলোক। আমার পিতা যে স্থানে চাকরী করেন, সেই সাহেবের বাড়ীতে একখানি ছোেট চালাঘর বাঁধা হয়। পিতা সেই সাহেবের খানসামা; তিনি সাহেবের নিকট হইতে সেই ঘর বাঁধিবার কন্ট্রাক্ট গ্রহণ করেন, এবং পরিশেষে নিজে কিছু লাভ রাখিয়া পুনরায় আমার স্বামীকে উহার কন্ট্রাক্ট দেন। আমার স্বামী দিনরাত্রি পরিশ্রম করিয়া কয়েক দিবসের মধ্যে সেই ঘর প্রস্তুত করিয়া দেন। আমার স্বামীকে যে টাকা দিবার কথা ছিল, তাহার সকল টাকা আমার পিতা এখনও তাহাকে প্রদান করেন নাই, কয়েকটা টাকা বাকী আছে। কিন্তু পিতা সমস্ত টাকা সাহেবের নিকট হইতে শোধ করিয়া লইয়াছেন।

আমি। তোমার পিতার নিকট তোমার স্বামীর কত টাকা বাকী আছে?

স্ত্রীলোক। ঠিক জানি না; শুনিয়াছি, অতি সামান্য। বোধ হয়, দুই তিন টাকার অধিক নহে। পাঁচ সাত টাকা বাকী ছিল; দুই আনা, চারি আনা করিয়া প্রায়ই দিয়াছেন, এখন দুই তিন টাকা বাকী আছে মাত্র।

আমি। তোমার পিতার নিকট তিনি প্রথমে গমন করিবে, বলিয়া গিয়াছিল; কিন্তু কোন্ স্থানে গিয়া তোমার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিবে, তাহার কিছু বলিয়া গিয়াছিলেন কি? তোমার পিতার বাড়ীতে যাইবে, কি যে স্থানে তিনি চাকরী করে, সেই স্থানে যাইবে?

স্ত্রীলোক। দিবাভাগে পিতাকে প্রায়ই বাড়ীতে দেখিতে পাওয়া যায় না। পিতা যে সাহেব বাড়ীতে চাকরী করেন, সেই স্থানে গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন, এই কথা বলিয়া তিনি বাড়ী হইতে গমন করিয়াছিলেন।

আমি। তোমার পিতা কোন্ সাহেব বাড়ীতে কর্ম করে, তাহা তুমি অবগত আছ কি?

স্ত্রীলোক। না, তাহা আমি জানি না।

আমি। ইহার পর তোমার পিতার সহিত তোমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল কি?

স্ত্রীলোক। হইয়াছিল।

আমি। তাহাকে তুমি জিজ্ঞাষ করিয়াছিলে যে, তোমার স্বামী তাহার নিকট গমন করিয়াছিল কি না?

স্ত্রীলোক। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম।

আমি। তাহাতে সে কি বলিয়াছিল?

স্ত্রীলোক। জিজ্ঞাসা করায়, পিতা যেন আমার উপর বিরক্ত হন, এবং কহেন যে, তিনি তাহার নিকট গমন করেন নাই।

আমি। তোমার পিতার বিরক্ত হইবার কারণ?

স্ত্রীলোক। কারণ যে কি, তাহার কিছুই বুঝিতে পারি নাই।

আমি। তোমার পিতার সহিত কখন তোমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল?

স্ত্রীলোক। শেষ রাত্রিতে।

আমি। শেষ রাত্রিতে তোমার পিতার সহিত কোথায় তোমার সাক্ষাৎ হয়?

স্ত্রীলোক। তাঁহারই বাড়ীতে।

আমি। শেষ রাত্রিতে তাহার বাড়ীতে তুমি কি করিতে গিয়াছিলে?, স্ত্রীলোক। শেষ রাত্রিতে আমি তাঁহার বাড়ীতে যাই নাই।

আমি। তবে কখন গিয়াছিলে?

স্ত্রীলোক। পরশ্ব রাত্রিতে যখন দেখিলাম, আমার স্বামী বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করিলেন না, তখন কি করিতে হইবে, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, পরদিবস প্রাতঃকালে আমি আমার পিতার বাড়ীতে গমন করিলাম। কিন্তু সে সময়ে পিতার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় না। মাতার নিকট জানিতে পারিলাম যে, রাত্রিতে পিতাও বাড়ীতে আসেন নাই। মাতার নিকট এই ব্যাপার জানিতে পারিয়া মনে করিলাম, তিনি পিতার নিকট গমন করিয়াছিলেন, কোন কার্যের নিমিত্ত পিতা তাঁহাকে তাহার নিকট রাখিয়াছেন, সে জন্য তিনিও বাড়ীতে আসেন নাই, পিতাও বাড়ীতে আসেন নাই। মাতা আর আমাকে সে দিবস আসিতে দিলেন না, আমি সেই স্থানেই থাকিলাম; কিন্তু সমস্ত দিবসের মধ্যে পিতা বাড়ীতে আসিলেন না। ক্রমে রাত্রিও অতিবাহিত হইয়া যাইবার যোগাড় হয়, তথাপি তিনি আগমন করিলেন না। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইবার অতি অল্পমাত্র বাকী আছে, এরূপ সময় পিতা একাকী আসিয়া বাড়ীতে উপস্থিত হন, এবং অতি অল্পক্ষণ মাত্র বাড়ীতে থাকিয়াই তিনি আপন কাৰ্য্যে গমন করেন। সেই সময় পিতাকে আমার স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি আমার কথায় একটু বিরক্তিভাব প্রকাশ করিয়া কহিলেন, না, তোমার স্বামী আমার নিকট গমন করে নাই, বা আজ কয়েক দিবস আমি তাহাকে দেখিও নাই। এই বলিয়া তিনি বাড়ী হইতে বহির্গত। হইয়া যান। যাইবার সময় আমি তাহাকে পুনরায় কহিলাম, তিনি কোথায় গেলেন, কিরূপে আমি তাহার অনুসন্ধান করিব? ইহার উত্তরে পিতা কহেন, সে বালক নহে, তাহার নিমিত্ত আবার কি অনুসন্ধান করিতে হইবে? কোন স্থানে গমন করিয়া থাকিবে; কাৰ্য শেষ হইয়া গেলে, পুনরায় সে আপনা হইতেই আগমন করিবে। তোমার সহিত ঝগড়া করিয়া সে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া যায় নাই ত? এই বলিতে বলিতে পিতা বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন, আমার আর কোন কথা শুনিলেন না।

সেই স্ত্রীলোকটীর সহিত এই সকল কথাবার্তা হইতে হইতে, যে স্থানে সেই মৃতদেহ ছিল, তাহার সন্নিকটে আমা দিগের পাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

আমি গাড়ি হইতে অবতরণ করিলে সঙ্গে সঙ্গে বালক বালিকা কয়েকটীর সঙ্গে স্ত্রীলোকটীও গাড়ি হইতে নামিল, এবং আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ভিড়ের ভিতর প্রবেশ করিল। _ যে স্থানে মৃতদেহটী রক্ষিত ছিল, সেই স্থানে গমন করিয়া সেই মৃতদেহটা আমি তাহাকে দেখাইয়া দিলাম ও কহিলাম, দেখ দেখি, তুমি উহাকে চিনিতে পার কি না?

স্ত্রীলোকটা মৃতদেহের নিকট গমন করিয়া একটু স্থির হইয়া দাঁড়াইল, এবং অনিমিষ-লোচনে অতি অল্পক্ষণ মাত্র নিরীক্ষণ করিয়া বিনা-বাক্যব্যয়ে সেই স্থানে বসিয়া পড়িল।

সেই সময় সেই স্ত্রীলোকটীর অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, আমার সহিত যে স্ত্রীলোকটী আসিয়াছে, এ সে স্ত্রীলোক নহে; এ যেন অপর আর কোন স্ত্রীলোক। এত অল্প সময়ের মধ্যে মনুষ্যের বর্ণ, মুখশ্রী প্রভৃতির যে এত পরিশ বৰ্ত্তন হইতে পারে, ইহা আমি এই প্রথম দেখিলাম; ইহার পূর্বে এরূপ দৃশ্য আমি আর কখনও দেখি নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই স্থানে যে কোন ব্যক্তি উপস্থিত ছিল, সকলেই বুঝিতে পারিল যে, ইহার অন্তরে বিষম আঘাত লাগিয়াছে।

সেই সময় আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই মৃত দেহ কাহার, তাহা কি তুমি চিনিতে পারিয়াছ?

আমার কথায় স্ত্রীলোকটী কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না।

আমি পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ইহা কি তোমার স্বামীর মৃতদেহ?

এ কথারও কোন উত্তর পাইলাম না।

সেই স্ত্রীলোকটীর সহিত যে কয়েকটা বালক-বালিকা। আসিয়াছিল, তাহাদিগের মাতার এই অবস্থা দেখিয়া, তাঁহারাও যেন হতবুদ্ধি হইয়া সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল। কেবল একটী নিতান্ত ছোট বালিকা তাহার মাতার মুখ ধরিয়া কহিল, মা,বাবা?

বালিকার এই কথা সকলেরই হৃদয়ে শেলসম প্রবেশ করিল। তখন সকলেই বুঝিতে পারিলেন, সেই মৃতদেহ তাহার পিতার।

সেই বালক-বালিকাগণের মধ্যে য়েটী সকলের বড়, তাহাকে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এই কি তোমার পিতা?

উত্তরে সে কহিল, ইনিই আমার পিতা।

আমি। ইহারই নাম কি রব্বানি?

বালক। হাঁ।

আমি। মেহের আলি তোমার কে হয়?

বালক। নানা।

আমি। তুমি জান, তিনি কোথায় কার্য করেন?

বালক। জানি।

আমি। সে সাহেবের নাম কি?

বালক। তাহা জানি না।

আমি। কোন্ স্থানে, কোন্ রাস্তায়?

বালক। তাহাও জানি না। সেটা একটা স্কুল।।

আমি। যেখানে তোমার নানা কায করেন, সেটা স্কুল?

বালক। হুঁ।

আমি। সে স্কুল তুমি চিন? বা

লক। চিনি।

আমি। কিরূপে চিনিলে?

বালক। আমি অনেকবার নানার সঙ্গে ও বাবার সঙ্গে সেই স্থানে গিয়াছি।

আমি। তুমি আমাকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে পারিবে?

বালক। পারিব, কিন্তু এখান হইতে আমি চিনিতে পারিব না।

আমি। কোথা হইতে চিনিতে পারিবে?

বালক। আমি আমাদিগের বাড়ী হইতে চিনিয়া সেই স্থানে গমন করিতে পারি।

আমি। আমি যদি তোমাকে সঙ্গে লইয়া তোমার নানার বাড়ীতে লইয়া যাই, তাহা হইলে তুমি সেই স্থান হইতে তোমার নানা যে স্কুলে কায করে, সেই স্কুলে লইয়া যাইতে পারিবে?

বালক। পারিব।

আমি। তবে আমার সঙ্গে আইস।

বালক। আমার মা?

আমি। তিনি এখন এখানে থাকুন, আমরা এখনই ফিরিয়া আসি।।

এই বলিয়া আমি বালকটীকে সঙ্গে লইয়া গাড়িতে গিয়া উঠিলাম। রব্বানির স্ত্রী একরূপ অন্ধ-অচেতন অবস্থায় সেই স্থানে বসিয়া রহিল। সেই স্থানে আরও অনেক কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাহাদিগের মধ্যে কেহব সেই স্ত্রীলোকটীর নিকটেই রহিলেন, কেহবা বালক-বালিকাগণের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন, আর কেহবা আমার সহিতই গমন করিলেন।

গাড়িতে উঠিয়া গাড়িবানকে দ্রুতগতি চালাইতে কহিলাম। ক্রমে গাড়ি আসিয়া মেহের আলির বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইল।

মেহের আলির বাড়ীর সম্মুখে গিয়া গাড়ি উপস্থিত হইলে,। সেই বালকটী কহিল, আমি গাড়ির ভিতর বসিয়া রাস্তা ঠিক পাইব না, গাড়ির উপর গিয়া বসিলে যে রাস্তা দিয়া আমি সর্বদা গমন করিয়া থাকি, সেই রাস্তা দিয়া অনায়াসেই এই গাড়ি সেই স্কুলে লইয়া যাইতে পারিব।।

বালকের কথায় আমি সম্মত হইলাম। বালক গাড়ি হইতে বহির্গত হইয়া কোচবাক্সের উপর গিয়া উপবেশন করিল।

বালকের নির্দেশ মত গাড়ি চলিতে লাগিল। ক্রমে দেখিলাম, গাড়ি গিয়া পার্ক স্ট্রীটের একটা প্রকাণ্ড বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। সেই প্রকাণ্ড বাড়ী আমরা চিনিতাম। উহা প্রকৃতই একটী প্রকাণ্ড স্কুল। ইহাতে ইংরাজ বালকের সংখ্যাই অধিক, এবং তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই সেই স্কুলের ভিতর রাত্রিদিন বাস করিয়া থাকেন।

সেই স্থানে বালকটী গাড়ি হইতে অবতরণ কারয়া আমাকে কহিল, আমার সঙ্গে আসুন, এই স্কুলে আমার নানা কর্ম করিয়া থাকেন।

বালকের কথা শুনিয়া আমরা সেই গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম, এবং বালকের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই প্রকাণ্ড বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম।

সেই স্কুলে যে সকল চাকর কৰ্ম্ম করিত, উহার এক পার্শ্বে তাহাদিগের থাকিবার উপযোগী কয়েকটা ঘর আছে। মেহের আলির থাকিবার নিমিত্ত উহার মধ্যে একটা ঘর নির্দিষ্ট ছিল।

বালক আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া একবারে সেই ঘরের ভিতর গিয়া উপস্থিত হইল। দেখিলাম, ঘরের সম্মুখে

একটী লোক বসিয়া রহিয়াছে, তাহাকে দেখিয়াই বালবটী কহিল, নানা! ইহারা তোমাকে খুঁজিতেছেন। বাবা মরিয়া গিয়াছেন।

বালকের কথা শুনিয়া মেহের আলি আমাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, আপনারা কাহার অনুসন্ধান করিতেছেন?

আমি। মেহের আলির। তোমারই নাম কি মেহের আলি?

মেহের আলি। হাঁ, আমার নামই মেহের আলি। আপ নার যে একবারে এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, এ কথা আমাদিগের বড় সাহেব জানেন কি?

আমি। না, তোমাদের বড় সাহেব কে?

মেহের আলি। তিনি এই কুঠীতেই থাকেন, তাঁহার অনুমতি ব্যতীত বাহিরের কোন লোকের এই কুঠীর ভিতর প্রবেশ করিবার অধিকার নাই। তিনি না দেখিতে দেখিতে, আপনারা এখনই বাহিরে গমন করুন।

আমি। আচ্ছা, তাহাই হইবে, আমরা এখনই বাহিরে গমন করিব; কিন্তু তোমাকে দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া যাইতে পারি না। তোমাকে যাহা যাহা আমরা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি তাহার উত্তর প্রদান কর, আমরা এখনই তোমার সাহেবের কুঠী হইতে বাহির হইয়া যাইতেছি।

মেহের আলি সাহেবের অনুমতি না লইলে আমি আপনাদিগের কোন কথার উত্তর দিতে পারিব না।

আমি। ইচ্ছা হয় ত তোমার সাহেবকে সংবাদ প্রদান কর, বা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাও যে, পুলিশের কয়েকজন লোক এখানে আসিয়াছে, তাঁহারা আমাকে কোন কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, আমি তঁহাদিগের কথার উত্তর প্রদান করিব কি না?

মেহের আলি। লাহেবকে জিজ্ঞাসা করিবার আমায় কোন প্রয়োজন নাই। ইচ্ছা হয়, আপনারা গিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতে পারেন।

মেহের আলির কথা শুনিয়া আমার অতিশয় ক্রোধের উদ্রেক হইল, এবং সর্বশরীর যেন কাঁপিতে লাগিল। এক বার মনে করিলাম যে, ও যেরূপ ভাবে আমাদিগের সহিত কথা কহিতেছে, তাহাতে উহার সহিত আমাদিগের সেইরূপ ব্যবহার করাই কর্তব্য। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, সাহেব দিগের কুঠীর ভিতর কোনরূল্প গোযোগ করিলে আমার কার্যের সুবিধা হইবার সম্ভাবনা নাই। কারণ, তিনি ক্রোধান্বিত হইলে তাহার চাকদিগের নিকট হইতে আমা দিগের অধিক কোন কথা পাইবার সম্ভাবনা থাকিবে না কিন্তু যদি তিনি ইচ্ছা করিয়া আমাদিগের সহায়তা করেন, তাহা হইলে তাহার ভৃত্যগণ তাঁহার নিকট কোন কথা গোপন করিতে পারিবে না, বা যদি কেহ গোপন করে, তাহা হইলে অপরের নিকট হইতেও তাহা প্রকাশ হইয়া পড়িবে। এরূপ অবস্থায় মেহের আলির উপর ক্রোধান্বিত হইয়া, তাহার মনিবের সহিতই আমার প্রথম দেখা করা কৰ্ত্তব্য। বিশেষতঃ, আমি বিলক্ষণরূপে অবগত আছি যে, ভাল ভাল ইংরাজগণের নিকট সরকারী কাৰ্য্য উপলক্ষে যদি কোনরূপ সাহায্য প্রার্থনা করা যায়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তাঁহারা তাহাদের সাধ্যমত সাহায্য প্রদান করিয়া থাকেন।

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া একজন কর্মচারীকে সেই স্থানে রাখিয়া আমি সেই স্কুলের সর্ব প্রধান সাহেবের উদ্দেশে গমন করিলাম। যে গৃহে সাহেব থাকেন, সেই গৃহের সম্মুখে তাহার চাপরাশি বসিয়াছিল। একখানি কার্ডে আমার নাম, আমি কে, এবং কি নিমিত্ত আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহি, তাহা সেই কার্ডে লিখিয়া চাপরাশির হাতে প্রদান করিলাম, ও আমি যে কে, তাহা চাপরাশিকেও বলিয়া দিলাম। চাপরাশি কার্ড লইয়া ভিতরে প্রবেশ করি বার অতি অল্পক্ষণ পরেই, সেই কার্ড হন্তে সাহেব বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও কহিলেন, আমি আপনাকে কিরূপ, সাহায্য করিতে পারি?

আমি। আপাততঃ অপর সাহায্যের কিছু প্রয়োজন নাই, কেবলমাত্র আপনার খানসামাকে আমি একবার চাহি। এক ঘণ্টার নিমিত্ত আমি তাহাকে লইয়া যাইব মাত্র।

সাহেব। তাহাকে প্রয়োজন?

আমি। আমরা একটা ভয়ানক হত্যার অনুসন্ধান করি তেছি। যে ব্যক্তি হত হইয়াছে, এখন বোধ হইতেছে যে, সে আপনার খানসামার জামাতা। এই নিমিত্ত তাহাকে লইয়া গিয়া একবার সেই মৃতদেহ দেখাইব। তাহা হইলে সেই ব্যক্তি তাহার জামাতা কি না, তাহা অনায়াসেই সে চিনিতে পারিবে। তখন কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়াছে, তাহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, এবং আপনার সাহায্যের আবশ্যক হইলে, পুনরায় আপনার নিকট আগমন করিব।

সাহেব। কিরূপে খানসামার জামাতা হত হইয়াছে?

আমি। কিরূপে হত হইয়াছে, বা কে হত্যা করিয়াছে, তাহা এখনও স্থির হয় নাই। সেই মৃতদেহ যে কাহার, এখন তাহারই অনুসন্ধান চলিতেছে।

সাহেব। সেই মৃতদেহ কোথায় পাওয়া গেল?

আমি। বড় একটা টীনের বাক্সের মধ্যে একখানি চটের দ্বারা আবৃত সেই মৃতদেহ রাস্তার ধারে পাওয়া গিয়াছে।।

সাহেব। আচ্ছা বাবু! আপনি আমার খানসামাকে লইয়া যান। আপনার কাৰ্য শেষ হইয়া গেলে, অমনি তাহাকে ছাড়িয়া দিবেন। ও আমাকে এই বলিয়া সাহেব তাহার চাপরাশিকে কহি লেন, আমার খানসামাকে আমার নিকট ডাকিয়া আন।

সাহেবের আদেশ পাইবামাত্র, চাপরাশি দ্রুতগতি গমন করিয়া মেহের আলিকে তাঁহার সম্মুখে ডাকিয়া আনিল। তাহাকে দেখিধামাত্রই সাহেব কহিলেন, তুমি এই বাবুর সহিত গমন কর, এবং ইহারা তোমার নিকট হইতে যেরূপ সাহায্য প্রার্থনা করেন, সেইরূপ সাহায্য প্রদান কর।

সাহেবের কথা শুনিয়া মেহের আলি আর কোন কথা কহিল না; স্থিরভাবে অথচ নিতান্ত ক্ষুন্ন মনে আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আগমন করিতে লাগিল।

আমি মেহের আলিকে সেই স্থানে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সেই বাড়ী হইতে তাহাকে বাহিরে আনিলাম। কিন্তু তাহাকে আমার গাড়িতে তুলিবার পূর্বে তাহাকে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করা কর্তব্য মনে করিলাম।

আমি। রব্বানি তোমার জামাতা?

মেহের আলি। হাঁ মহাশয়! রব্বানি আমার জামাতা হয়।

আমি। রব্বানি এখন কোথায়? মেহের আলি। তাহা আমি জানি না।

আমি। তোমার সহিত তাহার কয়দিবস সাক্ষাৎ হয় নাই?

মেহের আলি। এক সপ্তাহের মধ্যে তাহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় নাই।

আমি। তোমার বেশ মনে আছে যে, এক সপ্তাহকাল তোমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয় নাই?

মেহের আলি। আমার বেশ মনে আছে।

আমি। তোমার মনিবের কুঠীতে সে কতদিবস আইসে নাই?

মেহের আলি। প্রায় পূনর দিবস হইল, সে এখানে আইসে নাই।

আমি। অদ্য তিন দিবস হইল, সে এখানে আসিয়াছিল যে?

মেহের আলি। মিথ্যা কথা, এ কথা আপনাকে কে বলিল?

আমি। যেই আমাকে বলুক না কেন, তোমাকে আমি যে কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি, তুমি তাহারই উত্তর প্রদান কর?

মেহের আলি। আমি ত তাহা বলিয়াছি যে, সে এখানে পনর দিবসের মধ্যে আইসে নাই।

মেহের আলির কথা শুনিয়া আমার মনে কেমন একটু সন্দেহ হইল। অপর একজন কর্মচারীর নিকট তাহাকে রাখিয়া আমি পুনরায় সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতেই সম্মুখে বড় সাহেবের সেই চাপরাশিকে দেখিতে পাইলাম। আমাকে পুনরায় বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে দেখিয়া, চাপরাশি আমার নিকট আগমন করিল ও কহিল, কি মহাশয়! পুনরায় ফিরিয়া আসিলেন যে?

আমি। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব বলিয়া, ফিরিয়া আসিয়াছি।

চাপরাশি। আমাকে?

আমি। হাঁ। চাপরাশি। আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহা অনায়াসেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।

আমি। মেহের আলি তোমার নিকট কত দিবস হইতে পরিচিত?

চাপরাশি। প্রায় দুই বৎসর হইল, আমি আমার সাহেবের নিকট কৰ্ম্ম করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি, সেই সময় হইতেই আমি মেহের আলিকে চিনি।

আমি। তাহার একটা জামাতা আছে, তাহা তুমি জান?

চাপরাশি। জানি, তাহার নাম রব্বানি। সম্প্রতি খোলার ওই ছোট ঘরখানি সে বাঁধিয়াছিল।

আমি। তুমি তাহাকে কয়দিবস হইতে দেখ নাই?

চাপরাশি। তিন চারি দিবস হইল, আমি তাহাকে দেখিয়াছি। কি পাওনা টাকার নিমিত্ত সে তাহার শ্বশুরের সহিত বকাবকি করিতেছিল।

আমি। কোথায়?

চাপরাশি। এই কুঠীর ভিতর তাহার শ্বশুর যে ঘরে থাকে, সেই ঘরের সম্মুখে।

আমি। সে যে তিন চারি দিবসের ঘটনা, তাই তোমার বেশ মনে আছে কি?

চাপরাশি। আমার বেশ মনে হইতেছে যে, উহা চারি দিবসের অধিক কোনরূপেই হইবে না।

আমি। পাওনা টাকার নিমিত্ত উহারা কতক্ষণ পর্যন্ত বকাবকি করিয়াছিল?

চাপরাশি। তাহা আমি জানি না। কোন কাৰ্য বশতঃ আমি সেই স্থানে গিয়াছিলাম, তাহাতেই জানি। আমি তখনই সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিয়াছিলাম।

আমি। তখন বেলা কত?

চাপরাশি। বৈকালে; কিন্তু বেলা তখন অতি অল্পই ছিল।

আমি। তাহার পর, রব্বানি কখন চলিয়া গিয়াছে, তাহা বলিতে পার?

চাপরাশি। আমি তাহাকে চলিয়া যাইতে দেখি নাই।

আমি। তুমি আমার সহিত একবার গমন করিতে পার কি? কারণ, যে লাসটী পাওয়া গিয়াছে, তাহাকে দেখিলে, তুমি বেশ চিনিতে পারিবে, সেই লাসটা রব্বানির কি না?

চাপরাশি। আপনি এই স্থানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতেছি। তাঁহার আদেশ পাইলে, আমি এখনই আপনার সহিত গমন করিতেছি।

এই বলিয়া চাপরাশি আমাকে সেই স্থানে রাখিয়া সে তাহার সাহেবের নিকট গমন করিল, এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রত্যাবর্তন করিয়া কহিল, চলুন, সাহেব অনুমতি দিয়াছেন।

চাপরাশিকে আর কোন কথা না বলিয়া, তাহার সহিত আমি বাহিরে আসিলাম, ও মেহের আলির সহিত আপন গাড়িতে উঠি লাম। সেই বালকটীও গাড়ির উপর উঠিয়া বসিল।

চাপরাশি আমাকে যে সকল কথা বলিয়াছিল, তাহা আমি মেহের আলিকে কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া মেহের আলি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, এবং পরিশেষে কহিল, চাপরাশি কখনই এ কথা বলে নাই। আর যদি বলিয়াই থাকে, তাহা হইলে সে মিথ্যা কথা বলিয়াছে। পনর দিবসের মধ্যে রব্বানি এ কুঠীতে আইসে নাই।

মেহের আলির কথা শুনিয়া চাপরাশি কহিল, আমি মিথ্যা বলিতেছি, না তুই মিথ্যা বলিতেছিস্? তিন চারিদিবস হইল, সন্ধ্যার পূর্বে যে সে আসিয়া টাকার জন্য, তোর সহিত বকাবকি করিয়াছিল, সে কথা তোর মনে নাই কি?

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

চাপরাশি ও মেহের আলির সহিত এইরূপ কথা হইতে হইতে আমাদিগের গাড়ি আসিয়া যে স্থানে মৃতদেহ রক্ষিত ছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইল।

আমরা গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া, মেহের আলি এবং চাপরাশিকে সঙ্গে লইয়া সেই মৃতদেহের সন্নিকটে গমন করিলাম। সেই মৃতদেহ দেখিবার নিমিত্ত তাহাদিগকে কহিলাম। মেহের আলি সেই মৃতদেহের দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়াই কহিল, না মহাশয়! এ কাহার দেহ, তাহা আমি চিনিতে পারিতেছি না।

চাপরাশি। তাহা আর চিমিতে পারিবে কেন? তোমার জামাতাকে যে কখনও দেখিয়াছে, সে-ই এই মৃতদেহ চিনিতে পারিবে। কিন্তু তুমি চিনিতে পারিতেছ না, ইহা অপেক্ষা আশ্চর্যের বিষয় আর কি হইতে পারে?

যে স্থানে মৃতদেহটা ছিল, তাহার সন্নিকটেই সেই টিনের বাক্সটী রক্ষিত ছিল। সেই বাক্সটী দেখিয়া চাপরাশি কহিল,

ওই বাক্সটী কিসের মহাশয়?

আমি। এই বাক্সের ভিতর পূরিয়া এই মৃতদেহটী কোন ব্যক্তি গঙ্গার ধারে রাখিয়া দিয়াছিল।

চাপরাশি। তবে এই বাক্সের ভিতর ওই লাস পাওয়া যায়?

আমি। হাঁ।

চাপরাশি। মেহের আলি যে ঘরে থাকে, সেই ঘরে ঠিক এইরূপ একটা বাক্স ছিল। তাই এখন সেই স্থানে আছে কি না, তাহা মেহের আলিকে জিজ্ঞাসা করুন দেখি।

আমি। কি হে মেহের আলি! তুমি যে ঘরে থাক, সেই ঘরে এইরূপ একটা টিনের বাক্স ছিল, তাহা এখন কোথায়? উহা এখন সেই স্থানে আছে কি?

মেহের আলি। চাপরাশি কেবল মিথ্যা কথা কহিতেছে। যে ঘর আমার দ্বারা অধিকৃত, তাহার ভিতর এরূপ টিনের বাক্স কখনও ছিল না, এখনও নাই।।

চাপরাশি। আমি মিথ্যা কথা কহিতেছি? তোমার ঘরে যে টিনের বাক্স ছিল, তাহা কে না জানে? কুঠীর সমস্ত চাকরই তাহা দেখিয়াছে। তাহাদিগের মধ্যে যাহাকে জিজ্ঞাসা করিবেন, সে-ই এ কথা বলিবে। চাকর-বাকরের কথাই বা জিজ্ঞাসা করিতেছি কেন? মনিব-সাহেব স্বয়ং ইহা বলিতে পারিবেন। একদিবস তিনি নিজে ওই বাক্স দেখিয়া, মেহের আলিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, এ বাক্স কাহার?

আমি। হাতে মেহের আলি কি উত্তর করিয়াছিল?

চাপরাশি। তাহাতে মেহের আলি এই কথা কহে যে, অনেক দিবস হইতে এই বাক্স এই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে।

আমি। কেমন মেহের আলি! এই কথা কি প্রকৃত?

মেহের আলি। না মহাশয়। ইহার সমস্তই মিথ্যা কথা।

আমি। চাপরাশির সমস্ত কথা যদি মিথ্যা হয়, তাহা হইলে তোমার মঙ্গল। আর যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে জানিও, এই হত্যা তোমা-ব্যতীত আর কাহারও দ্বারা হয় নাই।

মেহের। সেকি মহাশয়! তাহা হইলে আমি আমার জামাতাকে কি হত্যা করিয়াছি। আপনারা এইরূপ বিশ্বাস করেন?

আমি। কাজেই বিশ্বাস করিতে হইতেছে। তোমার নিজের কথার ভাবেই বেশ অনুমান হইতেছে, এই হত্যাকাণ্ডে তুমি সম্পূর্ণরূপে অপরাধী। তুমি এখন প্রকৃত কথা কি, তাহা বল দেখি। তাহা হইলে তুমি কতদুর অপরাধে অপরাধী, তাহা আমরা অনায়াসেই বুঝিতে পারিব, ও জানিতে পারিব, এই কাৰ্য্য তুমি ইচ্ছা করিয়া করিয়াছ, কি ক্রোধের বশবর্তী হওয়ায়, এই কাৰ্য্য হঠাৎ তোমার দ্বারা হইয়া গিয়াছে।

মেহের আলি আমার কথায় আর কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িল।

মেহের আলির কন্যা তখন সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, আমা দিগের এই সকল কথা শুনিয়া সে কহিল, বাবা! এ কাৰ্য্য তুমিই করিয়াছ? তা বেশ করিয়াছ, নিজের কন্যাকে বিধবা করিয়া পিতার উপযুক্ত কাৰ্য্যই করিয়াছি! এই বলিয়া সে সেই স্থান হইতে একটু দূরে গিয়া ক্ৰমন করিতে লাগিল।

মেহের আলির কথা শুনিয়া ও তাহার অবস্থা দেখিয়া, আমা দিগের মনে স্পষ্টই প্রতীতি জন্মিল যে, মেহের আলি ব্যতীত এই কাৰ্য্য আর কাহারও দ্বারা হয় নাই। তবে লাস স্থানান্তরিত করিবার সময় অপর কোন ব্যক্তি সাহায্য করিলেও করিতে পারে।

মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই বাক্স ও উহার ভিতর যে ঔষধের শিশি পাওয়া গিয়াছিল, তাহা লইয়া মেহের আলি এবং চাপরাশির সহিত পুনরায় সেই স্কুলে গিয় উপস্থিত হইলাম।

সেই স্থানে গিয়া সেই সর্বপ্রধান সাহেবের সহিত প্রথমে সাক্ষাৎ করিলাম এবং যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত ব্যাপার তাহার নিকট খুলিয়া বলিলাম। সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া তিনি আমাদিগের সহিত মেহের আলির থাকি বার স্থানে গমন করিলেন ও কহিলেন, এইরূপ একটী বাক্স আমি এই স্থানে পূর্বে দেখিয়াছিলাম। কিন্তু এখন উহা দেখিতে পাইতেছি না।

যে স্থানে সেই বাক্সটী পূৰ্ব্ব হইতে রক্ষিত ছিল বলিয়া জানা গেল, সেই স্থানটী আমরা উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিয়া স্পষ্টই বোধ হইল, সেই স্থানে অতবড় একটা বাক্স রক্ষিত ছিল, তাহার চিন্তু এখন পর্যন্তও বৰ্তমান রহিয়াছে।

ঔষধের শিশি দেখিয়া সাহেব কহিলেন, উহাতে যে নাম লেখা আছে, সেই নামের একটী বালক এই স্কুলে পূৰ্ব্বে পাঠ করিত; কিন্তু এখন স্থানান্তরে গমন করিয়াছে। আবশ্যক হইলে তাহার অনুসন্ধান পাওয়া যাইতে পারিবে।

অতঃপর সেই স্থানে অপর চাকরগণের বাসস্থান অনুসন্ধান করিলাম। সাহেব সেই অনুসন্ধানে নিজে আমাদিগকে সাহাব) করিতে লাগিলেন। এইরূপে কিছুক্ষণ অনুসন্ধান করিতে করিতেই অল্পে অল্পে আসল কথা বাহির হইয়া পড়িল।

মেহের আলি যখন দেখিল যে, সকল কথা প্রকাশ হইয়া গেল, তখন সেও সমস্ত কথা স্বীকার করিল। সে যাহা কহিল, তাহার সার মৰ্ম্ম এইরূপ :

রব্বানি আমার জামাতা। এই স্কুলের ভিতর একখানি ক্ষুদ্র খোলার ঘন সে বাঁধিয়া দেয়, তাহাতে আমার নিকট তাহার কিছু পাওনা থাকে। সেই পাওনা টাকার নিমিত্ত সে আমাকে সৰ্ব্বদা বিরক্ত করিত, সময় অসময় কিছুই না মানিয়া সৰ্ব্বদা সে আমার নিকট সেই টাকার তাগাদা করিত, এবং সময় সময় আমাকে কটুবাক্যও কহিত।

গত পরশ্ব তারিখের সন্ধ্যার পূর্বে সে এই স্থানে আসিয়া আমার নিকট পুনরায় সেই টাকার তাগাদা করে। আমার নিকট সেই সময় টাকা না থাকায়, আমি উহা তাহাকে দিতে পারি নাই। সুতরাং সে আমার উপর অতিশয় অসন্তুষ্ট হইল, এবং আমাকে গালি প্রদান করিল। আমারও অত্যন্ত ক্রোধের উদ্রেক হওয়াতে আমি তাহাকে কহিলাম, তুমি আমার ঘরের ভিতর আইস, আমি হিসাব করিয়া তোমার সমস্ত টাকা পরিশোধ করিয়া দিতেছি। আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া সে যেমন ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল, অমনি আমি তাহার,কর্ণমুলে সজোরে এক চপেটা ঘাত করিলাম। চড় মারিবামাত্র সে সেই স্থানে পড়িয়া গেল। তাহার উপর আমি তাহাকে দুই চারিটী পদাঘাতও করিয়াছিলাম। পরে দেখিলাম, সে মরিয়া গিয়াছে। তখন আর কোন উপায় না দেখিয়া একখানি চটে উহাকে উত্তমরূপে জড়াইয়া বাঁধিলাম, এবং পরিশেষে এই বাক্সের ভিতর পূরিয়া আমার এই ঘরের ভিতরেই রাখিয়া দিলাম। কিন্তু কোন উপায়ে সেই বাক্স আমি ঘর হইতে বাহির করিয়া লইবার অবকাশ পাইলাম না। ক্রমে রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল। সমস্ত দিবস সেই বাক্স আমার ঘরের ভিতরেই ছিল। পরদিবস রাত্রি হইলে একটা কুলীর সাহায্যে আমি সেই বাক্সল স্কুল হইতে বাহির করিয়া একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ি আনিয়া তাহার উপর রাখিয়া দিলাম, এবং সেই গাড়িতে করিয়া উহা আমি গঙ্গার ধারে লইয়া গেলাম। সেই স্থানে খোেলা জেটির ভিতর সেই বাক্সটা রাখিয়া দিয়া, আমি সেই গাড়ি বিদায় করিয়া দিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল যে, কোন গতিতে সেই বাটী গঙ্গাগর্ভে নিক্ষেপ করিব; কিন্তু তাহার সুযোগ করিয়া উঠিবার পূর্বেই একজন চাপরাশি সেই বাক্সটা দেখিতে পাইয়া তাহার নিকট গমন করিল। আমিও ভীত হইয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

মেহের আলি এইরূপে যাহা আমাদিগের নিকট কহিল, সে আর সে কথার পরিবর্তন করিল না। অনুসন্ধানে যে সকল প্রমাণের সংগ্রহ হইল, তাহাদিগের সাক্ষ্যে এবং মেহের আলির স্বীকারেই দায়রার বিচারে তাহার ফাঁসি হইয়া গেল।

সম্পূর্ণ।

যেমন তেমনি

যেমন তেমনি
(দারোগার দপ্তর ২৯ম সংখ্যা)
যেমন তেমনি (অর্থাৎ চতুর পালিত-পুত্রের বিদ্যা প্রকাশ!!)
শ্রী প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়-প্রণীত
সিকদার বাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে শ্রী বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
All Rights Reserved.
তৃতীয় বর্ষ। সন ১৩০১ সাল। ভাদ্র।
PRINTED BY HARIDAS DEY, AT THE VINDU PRESS, 61, Aheeritollah Street, Calcutta

যেমন তেমনি!

প্রথম পরিচ্ছেদ।

আমি যে দিবস পুলিস বিভাগে প্রথম নিযুক্ত হই কৰ্ম্ম কাৰ্য্য শিখিবার নিমিত্ত সেইদিবসেই আমাকে *** বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট প্রেরণ করা হয়। বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় একজন বহুদর্শী পুরাতন কর্ম্মচারী, সহরের মধ্যে তাঁহার বেশ নাম-ডাক আছে। কাজ-কৰ্ম্মে তাহার যশ যথেষ্ট হইয়াছে, ও তিনি অনেক অসাধ্য সাধন করিয়াছেন। পুলিস বিভাগে কিরূপে কৰ্ম্মকাৰ্য্য করিতে হইবে, কোন্ পন্থা অবলম্বন করিয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইবে, সর্বসাধারণের সহিত সৰ্ব্বদা কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে, এই সকল উপদেশ আমি তাহারই নিকট সর্ব প্রথম প্রাপ্ত হই; এবং তাহারই নিকট পুলিসের কৰ্ম্ম কাৰ্য্য শিক্ষা করি বলিয়াই, তাহাকে আমি গুরু বলিয়া মানিয়া থাকি।

যতদিবস তিনি এই বিভাগে কৰ্ম্ম করিতেন, ততদিবস তিনি আমাকে শিষ্য বলিয়া বিশেষ স্নেহ করিতেন, এবং যখন যে স্থানে যে অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইতেন, দূরে থাকিলেও আমার সাহায্য লইবার নিমিত্ত তিনি আমাকে ডাকাইয়া লইতেন। যে অনুসন্ধানে আমি একাকী নিযুক্ত হইতাম, তাহার ভিতর যদি ঘটনাচক্রের কোনরূপ গোলযোগ বাধিত, তাহা হইলে তাহারই সহিত পরামর্শ করিয়া সেই গোলযোগ হইতে উত্তীর্ণ হইতাম।

এখন আর তিনি পুলিস বিভাগে নাই, বহুদিবস হইল, পেন্‌সন লইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিয়াছেন, এবং জীবনের অবশিষ্টাংশ সেইস্থানে বসিয়া সুখে অতিবাহিত করিতেছেন। সুতরাং পরামর্শের আবশ্যক হইলে, হঠাৎ তাঁহার সাহায্য পাইবার আর কোনরূপ সম্ভাবনা নাই।

যাহা হউক, প্রায় ১৫ বৎসর অতীত হইল, একদিবস প্রাতঃকালে ছয়টার সময় আমি থানায় বসিয়া আছি, এমন সময় বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট হইতে একখানি পত্র পাইলাম; তাহাতে লেখা ছিল–একটী ভয়ানক মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি নিযুক্ত হইয়াছি। মোকদ্দমার অবস্থা যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে এই অনুসন্ধান শেষ করা একজনের কৰ্ম্ম নহে। আশা করি, পত্ৰ পাইবামাত্র পত্রবাহক সমভিব্যাহারে তুমি এখানে আসিবে, এবং আমার সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হইবে। আমি ঘটনাস্থানে তোমার অপেক্ষা করিব। পত্রবাহক সেইস্থান চেনে, সে অনায়াসেই তোমাকে ঘটনাস্থান দেখাইয়া দিতে পারিবে।

একে সরকারী কাৰ্য, তাহাতে গুরুর আদেশ, সুতরাং কালবিলম্ব না করিয়া সেই পত্রবাহক সমভিব্যাহারে থানা হইতে বহির্গত হইলাম। পথে একখানি গাড়িভাড়া করিয়া যত শীঘ্র পারি, ঘটনাস্থলে গিয়া উপস্থিত হইলাম।

কোথায় যে ঘটনাস্থল, তাহা আমি স্পষ্ট করিয়া বলিব না। কিন্তু এইমাত্র বলিব যে, বিডন ষ্ট্রীট হইতে সেইস্থান বহুদুর নহে, ইহাতে যে পাঠকগণ জানেন, তাঁহারা বুঝিয়া লইবেন। অপরে যদি বুঝিতে না পারেন, তাহা হইলে তাঁহারা আমাদিগকে ক্ষমা করিবেন।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমার পূর্বেই সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। তিনি আমাকে দেখিবামাত্র কহিলেন আসিয়াছ, ভাল হইয়াছে। পূর্বে ঐ গৃহের অবস্থা স্বচক্ষে দেখিয়া আইস, তাহার পর যাহা কিছু জানিতে পারিয়াছি, তাহা তোমাকে বলিব। এই বলিয়া সম্মুখস্থিত একটা গৃহ আমাকে দেখাইয়া দিলেন।

কলিকাতা সহরের ভিতর হইলেও, পল্লীগ্রামে যেরূপ অধিকাংশ বাড়ী দেখিতে পাওয়া যায়, ইহা সেই প্রকারের একটা পাকা বা ইষ্টকনিৰ্মিত একতলা বাড়ী। সেই বাড়ীর ভিতর একটা ভিন্ন গৃহ নাই। গৃহটী বেশ বৃহৎ, এবং পরিসর; তাহার সম্মুখে একটা বারান্দা বা দরদালান। সেই গৃহের চতুঃপার্শ্বেই অনাবৃত ভূমিখণ্ড আছে, সেই ভূমিখণ্ড ইষ্টক প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত।

গৃহের দক্ষিণে প্রাচীরের গাত্রে কেবল একটামাত্র দ্বার আছে। সেই দ্বারের দুইপার্শ্বে দুইটা জানালা, পশ্চিমদিকের প্রাচীরে কেবল একটীমাত্র দ্বার ভিন্ন আর কিছুই নাই, এবং উত্তরে তিনট, এবং পূর্বে একটা জানালা আছে, দরজা নাই। জানালাগুলি সমস্তই বিলক্ষণ পরিসর, এমন কি দ্বারের প্রায় সম-আয়তন বিশিষ্ট বলিলেও হয়। উক্ত জানালাগুলি সূল লৌহ গরাদিয়া দ্বারা সংবদ্ধ।

গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, উহার দুইপার্শ্বে অর্থাৎ গৃহের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশে দুইখানি পালঙ্ক। একখানি বহু পুরাতন, এবং তাহার উপরিস্থিত বিছানা-পত্র নিতান্ত অপরিষ্কার। অপরখানি নিতান্ত জীর্ণ নহে, এবং তদুপরি যে বিছানা আছে, তাহা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। দুই পালঙ্কের মধ্যস্থলে যে স্থান আছে, তাহার উত্তরাংশে কয়েকটা কাষ্ঠনির্মিত আমারি, সিন্ধুক, এবং বাক্স সারি সারি সাজান আছে। সেই সকল আমারি প্রভৃতির পূর্ব দিকে, অথচ সেই বহু পুরাতন পালঙ্কের নিকট লোহার একটী সিন্দুক আছে। আরও দেখিলাম, কাষ্ঠনিৰ্ম্মিত আলমারি প্রভৃতি সমস্তই ভগ্নাবস্থায় রহিয়াছে, এবং তাহার মধ্যস্থিত দ্রব্যাদি সেই গৃহের ভিতর ছড়ান আছে। লোহার সিন্দুক ভাঙ্গা নহে—খোলা; কিন্তু তাহার চাবি সেইস্থানে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না। উহার ভিতরেও যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহার অধিকাংশই মেজের উপর গড়াগড়ি যাইতেছে। সিন্দুকের ভিতরস্থিত কাপড়ের কতক অংশ সিন্দুকের ভিতর,রহিয়াছে, কতক বাহিরে রহিয়াছে; সেই কাপড় রাশীর উপর একটী ক্লক ঘড়ী পড়িয়া রহিয়াছে। ক্লকটী দেখিয়া বোধ হয়, উহা বহু পুরাতন নহে, উহার বার্নিস এখনও নষ্ট হইয়া যায় নাই। ক্লকটা কিন্তু চলিতেছে না, বন্ধ আছে। দেখিয়া বোধ হয়, চলিতে চলিতে হঠাৎ পড়িয়া যাওয়ায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে।

জানালাগুলি উত্তমরূপে দেখিলাম, কিন্তু তাহার ভিতর দিয়া লোক-যাতায়াতের কোনরূপ চিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। পশ্চিমদিকের দ্বারের অর্গল অস্ত্র ব্যবহারে উন্মুক্ত করা হইয়াছে বোধ হইল, কিন্তু সম্মুখ দরজার কোনস্থানে কোন রূপ চিহ্ন লক্ষিত হইল না।

যখন আমি গৃহের ভিতর প্রবেশ করি, সেই সময় গৃহের সম্মুখে দালানের উপর জনৈক প্রহরীর পাহারা ছিল। গৃহের অবস্থা দেখিয়া যখন আমি বহির্গত হইতেছিলাম, সেই সময়ে সেই প্রহরী আমার সম্মুখে আসিয়া আমার হস্তে দুইখানি নুতন সাদা রুমাল, এবং একটা ছোট শিশি প্রদান করিয়া কহিল, এই তিনটা দ্রব্যও সেই গৃহের ভিতর পাওয়া যায়, এখন আমার জিম্মায় রহিয়াছে। আরও কহিল, এই শিশিটী এবং একখানি রুমাল ছিল, সেই পরিষ্কার বিছানার উপর, এবং এই রুমালখানি ছিল, অপরিষ্কার বিছানার উপর।

রুমাল দুইখানি হস্তে লইয়া উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম, দুইখানিই সম্পূর্ণ মূইন, কোনস্থানে কোনরূপ চিহু নাই। কিন্তু উহা হইতে এখনও এক প্রকার বিকট দুর্গন্ধ বাহির হইতেছে, সেই গন্ধ আমার নাসিকার ভিতর প্রবিষ্ট হইবামাত্র আমার মস্তক ঘুরিয়া উঠিল। আমি তখনই উহা প্রহরীর হস্তে প্রদান করিয়া কহিলাম, দূরে ইহা দিগকে এখন রাখিয়া দেও। প্রহরী তাহাই করিল।

শিশিটী পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, উহার ভিতর এখনও এক প্রকার তরল পদার্থের অতি সামান্য অবশেষ রহিয়াছে। ছাপান অক্ষরে উহার গাত্রে ইংরাজী অক্ষরে লেখা আছে ক্লোরাফরম। কিন্তু উহা যে কোন্ ডাক্তারখানা হইতে আনীত, বা কাহার নিমিত্ত বিক্রীত হইয়াছে, তাহার কিছুমাত্র লেখা নাই। শিশিটী না খুলিয়া উহা যেরূপ অবস্থায় ছিল, সেইরূপ অবস্থাতেই সেই প্রহরীর হস্তে প্রদান করিয়া আমি গৃহের বাহিরে আসিলাম। পরিশেষে বাড়ীর চতুর্দিক একবার উত্তমরূপে দেখিলাম, কোনস্থানে সন্দেহ সুচক কোন দ্রব্যই দেখিতে পাইলাম না। বিশেষ মনঃ সংযোগ করিয়া সেই বাটীর চতুর্দিকে বেষ্টিত সেই ইষ্টকনিৰ্ম্মিত প্রাচীরের উপরিভাগ ক্রমে ক্রমে সমস্তই দেখিলাম, কিন্তু কোনস্থানে কোন লোকের পদচিহু বা অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয় অপর কিছুই দেখিতে পাইলাম না। বাড়ীর প্রাঙ্গনের কোনস্থানই উত্তমরূপে দেখিতে বাকী রাখিলাম না। কিন্তু সে দেখায় কোনফলই পাইলাম না; এমন কোন বিষয়ই চক্ষুতে পড়িল না যে, এই অনুসন্ধান উপলক্ষে অভাবপক্ষে সেইদিকে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করি। যাহা হউক, এইরূপে সমস্তস্থান দেখিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট গিয়া উপবেশন করিলাম।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

উক্ত বাটীর প্রাঙ্গনের মধ্যে একস্থানে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বসিয়াছিলেন, সেইস্থানে আরও কয়েকজন ইংরাজ এবং দেশীয় কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন। বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে তাঁহার নিকট বসিতে কহিলেন, আমি সেইস্থানে উপবেশন করিলে, তিনি কহিতে লাগিলেন :

অদ্য প্রত্যুষে ৫টার সময় আমি সংবাদ পাই যে, এই বাড়ীর একটী স্ত্রীলোক, এবং একটী পুরুষ অচৈতন্য অবস্থায় তাহাদিগের গৃহের ভিতর পড়িয়া রহিয়াছে, ও তাহাদিগের গৃহস্থিত সিন্দুক বাক্স প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্যই ভগ্নাবস্থায় আছে। এই সংবাদ পাইয়া আমি আর কালবিলম্ব করিতে পারিলাম না, দ্রুতপদে ঘটনাস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, বাড়ীর সদর দরজা খোলা। গৃহের দরজা দুইটাই ভালো, জিনিস পত্র এখন যেরূপ অবস্থায় দেখিলে, সেইরূপ অবস্থাতেই পড়িয়া আছে। গৃহের ভিতর যে দুইখানি পালঙ্ক দেখিয়াছ, তাহার একখানিতে একটা প্রবীণা স্ত্রীলোক, অপরখানিতে একটী অষ্টাদশ বৎসর বয়স্ক যুবক অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়া আছে। যুবকের নিকট ক্লোরাফরমের একটী শিশি পাইলাম। আরও দেখিলাম, দুইজনের মন্তকের নিকট দুইখানি সাদা রুমাল রহিয়াছে, বুঝিলাম, উহাতেও ক্লোরাফরম মিশ্রিত। এই সকল অবস্থা দেখিয়া কালবিলম্ব না করিয়া প্রথমেই, উঁহাদিগকে মেডিকেল কলেজে পাঠাইয়া দিলাম। তাঁহারা এখনও মরে নাই, সেইস্থানে চিকিৎসাধীনে আছে, কিন্তু এখনও জ্ঞানশূন্য। সুতরাং তাহাদিগের নিকট হইতে এখন কোন কথা জানিবার উপায় নাই। উঁহাদিগকে হাসপাতালে পাঠাইয়া পরিশেষে অনুসন্ধানে এইমাত্র জানিতে পারিলাম যে, উঁহাদিগের একটী পরিচারিকা আছে, তাহার নাম যাহাই হউক, হরর মা বলিয়া সে সকলের নিকট পরিচিত। সে এই বাড়ীতে থাকে না, তাহার পৃথক্ বাসা আছে; সকাল বৈকাল দুইবেলা আসিয়া আবশ্যক কাৰ্য্য সমাপন করিয়া যায়। কল্য সন্ধ্যার পর যখন সে আপনার কাৰ্য্য সমাপন করিয়া গমন করিয়াছিল, তখন বৃদ্ধা তাহার গৃহের সম্মুখে দালানে বসিয়াছিল, যুবক সেই সময়ে বাড়ীতে ছিল না। অদ্য প্রাতঃকালে যখন সে আপনার কাৰ্যে আগমন করে, তখন সে প্রথমেই দেখিতে পায়, বাড়ীর সদর দরজা খোলা, গৃহের দরজা খোলা, দ্রব্যাদির অবস্থা এইরূপ, এবং বৃদ্ধা ও যুবক অচৈতন্য অবস্থায় আপন-আপন বিছানার উপর পড়িয়া আছে। এই অবস্থা দেখিয়া সে গোলযোগ করিয়া উঠে, তাহাতে দুই একজন করিয়া পাড়ার অনেকেই আসিয়া উপস্থিত হয়। তৎপরে পাড়ার লোকের উপদেশ অনুযায়ী হরর মা থানায় গিয়া এই সংবাদ প্রদান করে। সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র প্রথমেই আমি আগমন করি, এবং যাহা স্বচক্ষে দর্শন করি, তাহা পূৰ্বেই তোমাকে বলিয়াছি।

হরর মা এবং পাড়ার অপরাপর লোকদিগের নিকট হইতে আরও অবগত হইতে পারিয়াছি, সেই বৃদ্ধার নাম ভব। সে গোপাল বোসের বিধবা স্ত্রী। গোপাল বোস এই স্থানের একজন পুরাতন অধিবাসী ছিলেন; হাটখোলায় তাহার একখানি ভূষিমালের দোকান ছিল। তিনি যতদিবস জীবিত ছিলেন, সেই দোকানের উপস্বত্ব হইতেই স্বচ্ছন্দে দিনপাত করিতেন। পরিবারের মধ্যে তাঁহার স্ত্রী এই ভব ভিন্ন অপর আর কেহই ছিল না। এরূপ শুনা যায়, তিনি তাহার মৃত্যুকালে ভবর পরিধেয় অলঙ্কার প্রভৃতি ব্যতিরেকে নগদ অর্থও অনেক রাখিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর হইতেই সেই দোকান উঠিয়া যায়, কিন্তু সঞ্চিত অর্থ হইতেই ভব এতদিবস বিনাকেশে দিনযাপন করিয়া আসি তেছেন। হিন্দু বিধবার সতত আচরণীয় ব্রতনিয়ম প্রভৃতি সেই অর্থের দ্বারাই তিনি এ কাল পর্যন্ত সমাপন করিয়া আসিতেছিলেন। আমার বোধ হয়, সােণা ও রূপার অলঙ্কার প্রভৃতি বন্ধক রাখিয়া সুদ প্রভৃতিতে যে অর্থ তিনি প্রাপ্ত হইতেন, তাহার কিয়দংশের দ্বারাই তাঁহার বর্তমান সংসার খরচ নিৰ্বাহ হইত, অধিকন্তু মাস মাস কিছু জমাও হইত। বৃদ্ধার বয়ঃক্রম ক্রমে অধিক হইয়া আসিতেছে, তাহার বয়ঃক্রম এখন বোধ হয়, ৫৫ বৎসরের কম হইবে না।

যুবকের নাম রসিকলাল ঘোষ, তাহার বয়ঃক্রম এখন অষ্টাদশ বৎসরের কম হইবে বলিয়া বোধ হয় না। রসিক লাল যে কে, কাহার পুত্র, তাহা পাড়ার অপর কেহই বলিতে পারেন না। কিন্তু বৃদ্ধা যে নিশ্চয়ই বলিতে পারেন, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। রসিকলালকে উত্তম রূপে না জানিলেও, পাড়ার কেহই কিন্তু তাহার বিপক্ষে কোন কথা বলেন না, বরং সকলেই কহেন, রসিক বড় ভাল ছোরা, তাহার স্বভাব চরিত্র উত্তম। প্রায় দশ বৎসর পূর্বে যখন রসিকের বয়ঃক্রম আট বৎসর ছিল, সেই সময় হইতে সকলেই রসিককে এইস্থানে দেখিতে পাইতেছেন। বৃদ্ধাই তাহাকে লালন-পালন করিয়া এত বড়টা করিয়াছে, লেখাপড়া শিখাইবার নিমিত্ত বৃদ্ধা বিশেষ যত্নও করিয়াছিল। কিন্তু সে ভালরূপ লেখাপড়া শিখিয়া উঠিতে পারে নাই, বৃদ্ধার আর কেহই নাই। বিশেষ সে রসিককে প্রাণের সহিত ভালবাসে, একদণ্ডের নিমিত্তও কোনরূপে তাহাকে চক্ষুর অন্তরাল করিতে চাহে না। তাহার ইচ্ছা সে যতদিবস বাঁচিবে, এইরূপেই তাহাকে প্রতিপালন করিবে। মৃত্যুকালে তাহার যাহা কিছু আছে, সমস্তই রসিকের হস্তে অৰ্পণ করিয়া যাইবে। যাহারা জানেন না, তাহাদিগের মধ্যে কেহই বলিতে পারেন না, যে রসিক তাহার পুত্র নহে। মাতা পুত্রকে যেরূপভাবে সৰ্ব্বদা দেখিয়া থাকেন, বৃদ্ধাও সেইরূপে রসিককে মেহচক্ষে দেখেন। রসিকের আহার না হইলে, বৃদ্ধার আহার হয় না, রসিক শয়ন না করিলে, বৃদ্ধার নিদ্রা আসে না। যদি রসিক কোনদিবস অসুস্থ হয়, তাহা হইলে বৃদ্ধা যে কিরূপ কষ্ট অনুভব করিয়া থাকেন, তাহা যিনি দেখিয়াছেন, তিনিই বুঝিতে পারেন। সম্প্রতি রসিকের বিবাহ দিবার নিমিত্ত বৃদ্ধা একেবারে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, একটী সুপাত্রীর অনুসন্ধানের নিমিত্ত তিনি যে কত লোকের তোষামোদ করিতেছেন, তাহা কে বলিবে?

যে দুইজন এখন অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে পড়িয়া আছেন, তাহাদিগের অবস্থা ত এই। এই দুইজন ব্যতীত বাড়ীতে অপর কেহই থাকেন না, অপর লোকের মধ্যে এক হরর মা। সে রাত্রিদিন যদিও এই বাড়ীতে থাকে, তথাপি সে অনেকদিবস পর্যন্ত এই বাড়ীতে কর্ম্ম করিতেছে। তাহার চরিত্র সম্বন্ধে কোন দোষের বিষয় এ পর্যন্ত কেহই বলিতে পারেন না।

গৃহের অবস্থা দেখিয়া বিলক্ষণ বোধ হইতেছে, বৃদ্ধার যাহা কিছু সংস্থান ছিল, তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়া গিয়াছে। কিন্তু তাহার কি ছিল, তাহার মধ্যে কি আছে, এবং কোন্ কোন্ দ্রব্যই যে অপহৃত হইয়াছে, তাহা যে পৰ্যন্ত বৃদ্ধা অচৈতন্য অবস্থায় থাকে, সেই পৰ্য্যন্ত স্থির হইতে পারে না। কিন্তু এরূপ বিষ-প্রয়োগের উদ্দেশ্য যে চুরি, তাহাতে আর কিছুমাত্র ভ্ৰম নাই।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া স্থির-অন্তঃকরণে কিছুক্ষণ আমি সেইস্থানে বসিয়া রহিলাম। পরিশেষে তাহাকে কহিলাম, বৃদ্ধার গৃহ হইতে অনেক টাকার দ্রব্যাদি যে অপহৃত হইয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু এই দুরূহকাৰ্য কাহার দ্বারা সম্পন্ন হইল? বৃদ্ধা এখন অচৈতন্য অবস্থায় হাসপাতালে আছে, তাহা ত দেখিতে পাইতেছি। আর ইহাও বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, তিনি ব্যতীত অপহৃত দ্রব্যের তালিকা প্রদানে আর কেহই সমর্থ নহেন। কিন্তু যখন আপনি প্রথম এখানে আগমন করেন, সেই সময়ে যদি তাহাকে মৃতাবস্থায় প্রাপ্ত হইতেন, বা ঈশ্বর না করুন, এখনও যদি এইরূপ অচৈতন্য অবস্থায় তিনি ইহজীবন পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে কি আমাদের অনুসন্ধান বন্ধ করিতে হইবে?

আমার কথা শুনিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কহিলেন, অনুসন্ধান বন্ধ হইতে পারে না, তুমি যাহা কহিতেছ, তাহা যথার্থ। বৃদ্ধা মরিয়া গিয়াছে, এই বিবেচনা করিয়াই, এখন আমাদিগের অনুসন্ধান করা কর্তব্য। দেখ দেখি, হরর মা, পাড়া-প্রতিবেশী প্রভৃতি লোকদিগের নিকট হইতে বৃদ্ধার অপহৃত দ্রব্যাদির কতদূর তালিকা প্রস্তুত করিতে পার।

বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া সেইস্থানে অপরাপর যে সকল কর্ম্মচারী ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে একজন ইংরাজ-কর্ম্মচারী কহিলেন, কি কি দ্রব্য চুরি হইয়াছে, তাহার তালিকা প্রস্তুত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। কিন্তু চোর কি প্রকারে বাড়ীর ভিতর আগমন করিল, কিরূপে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল, এবং কোন্ সময়েই না এই ভয়ানক কাণ্ড সম্পাদন করিয়া প্রস্থান করিল, আমার বিবেচনায় তাহাও অগ্রে স্থির করা কর্তব্য।

বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্য সে সকল বিষয় স্থির করিবাব উপায় কিছুমাত্র নাই, অবস্থা দেখিয়া অনুমানে যতদূর স্থির হইতে পারে। আপনার বিবেচনায় চোর কিরূপে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল?

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। সদর দরজার অবস্থা দেখিয়া এমন কিছুই বুঝিতে পারা যায় না, যাহাতে অনুমান করা যাইতে পারে, সেই দরজা ভাঙ্গিয়া বা বাহির হইতে কোনরূপে দরজা খুলিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছে। আমার বোধ হয়, প্রাচীর উল্লম্বন করিয়া প্রবেশ করিয়া থাকিবে।

আমি। সমস্ত প্রাচীর আমি উত্তমরূপে দেখিয়াছি; কিন্তু উহার কোনস্থানে কোনরূপ চিহু নাই, যাহা দেখিলে অনুমান করা যাইতে পারে যে, অপহরণকারী সেইস্থান দয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছে।

বন্দ্যোপাধ্যায়। হয় ত হইতে পারে, বাহির হইতে দরজা ভাঙ্গিয়া বা খুলিয়া কেহই ভিতরে আইসে নাই। অথবা প্রাচীর উল্লম্বন করিয়াও কেহ বাড়ীর ভিতর প্রবিষ্ট হয় নাই, কোন ব্যক্তি ভিতর হইতে দরজা খুলিয়া দিয়া থাকিবে। নিয়মিত সময়ে সদর দরজা বন্ধ হইবার অগ্রে কোন ব্যক্তি অনায়াসেই বাড়ীর ভিতর কোন না কোন স্থানে লুক্কায়িত থাকিতে পারে। অথবা দৈবক্রমে সদর দরজা বন্ধ করিতে ভুলিয়া গিয়া থাকিবে। অথবা এরূপ কোন অবস্থা ঘটিয়াছিল, যাহা এখন আমরা অনুমান করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। কিন্তু কত রাত্রিতে এই ঘটনা ঘটিয়াছে বলিয়া বোধ হয়?

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। আমার বোধ হয়, রাত্রি বারটা কি একটার সময়।

আমি। আমার বিবেচনায় ভোর চারিটা হইতে পাঁচটার মধ্যে।

বন্দ্যোপাধ্যায়। রাত্রি সাড়ে দশটার সময় এই ঘটনা ৩ ঘটিয়াছে। আপনারা এরূপ বিভিন্ন বিভিন্ন সময়ের অনুমান কিরূপে করিতেছেন?

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। আমার অনুমান করিবার বিশেষ কোন কারণ নাই। কিন্তু এতদ্দেশীয় মনুষ্যগণের রীতি-নীতি একাল পর্যন্ত আমি যতদুর শিক্ষা করিয়াছি, তাহাতে আমার বিশ্বাস, এরূপ ঘটনা বারটা কি একটার সময়ে হওয়াই সম্ভাবনা। কারণ এদেশীয় লোকদিগের আহার ও শয়ন করিতে প্রায় রাত্রি ১০/১১টা অতিবাহিত হইয়া যায়। তাহার পর প্রথমে যেরূপভাবে নিদ্রা আসিয়া উপস্থিত হয়, সেরূপ গাঢ়নিদ্রায় শেষ রাত্রিতে অনেকেই অভিভূত থাকেন না। অতি সামান্য শব্দে শেষ রাত্রির নিদ্রা ভাঙ্গিয়া যায়, কিন্তু প্রথম নিদ্রা সহজে ভঙ্গ হয় না। প্রগাঢ় নিদ্রায় যে সময়ে সকলে অচেতন থাকে, তস্করের পক্ষে সেই সময় বড় সুবিধাজনক। একাল পর্যন্ত আমি যত সিদচুরি প্রভৃতির অনুসন্ধান করিয়াছি, তাহার অধিকাংশ-স্থানেই আমি দেখিতে পাইয়াছি, সেই সময়কেই চোরেরা প্রশস্ত মনে করিয়াছে।

বন্দ্যোপাধ্যায়। আপনি যে অনুমান করিয়াছেন, তাহা নিতান্ত অযুক্তিসঙ্গত নহে। বর্তমান স্থলে যদি আমি বিশেষরূপ জানিতে না পারিতাম, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমি আপনার মতের অনুমোদন করিতাম। কিন্তু ইহা প্রাতে ৪৫টার সময় হইয়াছে, একথা আমি কোনরূপেই বলিতাম না।

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। এরূপ বিশেষ অবস্থা আপনি কি জানিতে পারিয়াছেন যে, আপনি একেবারে স্থির-নিশ্চয় করিতেছেন, এই ঘটনা রাত্রি দশটা বাজিয়া ত্রিশ মিনিটের সময় ঘটিয়াছে? মিনিটের পর যে কয়েক সেকেণ্ড হইয়া ছিল, তাহাও বোধ হয়, আপনি বলিতে পারেন?

বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন পারিব না, তাহাও বোধ হয় পারি। আপনার ন্যায় স্কুলদৃষ্টিতে, অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলে, একথা বলা সহজ নহে স্বীকার করি। কিন্তু যদি আপনার সূক্ষ্মদৃষ্টি থাকিত, গৃহের সমস্ত অবস্থা যদি আপনি বিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিতেন, তাহা হইলে আপনাকে নিশ্চয়ই আমার মতে মত দিতে হইত।

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। আপনি এত রাগ করিতেছেন কেন? ভাল, বুঝাইয়া দিউন না, বুঝিতে পারিলে আমি কোন কথা বলিব না, চুপ করিয়া আপনার কথাই মানিয়া লইব।

বন্দ্যোপাধ্যায়। (আমাকে লক্ষ্য করিয়া) কি হে! তুমি ত অনেকক্ষণ পর্যন্ত গৃহের অবস্থা উত্তমরূপে দৃষ্টি করিয়াছ। তবে তুমিই বা কি প্রকারে বলিতেছ, প্রাতঃকাল চারি বা পাঁচটার সময় এই ঘটনা ঘটিয়াছে?

আমি। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা আমি সম্পূর্ণ রূপে বুঝিতে পারিয়াছি, কিন্তু একই বস্তু দেখিয়া ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতি বিশিষ্ট লোকের ভিন্ন ভিন্ন অনুমান আসিয়া উপস্থিত হয়। আপনি ইংরাজ-কর্ম্মচারীকে যাহা বলিতে চাহেন, তাহা বলিতে পারেন। আপনার কথা শুনিয়া যদি আমার মতের পরিবৰ্ত্তন হয়, ভালই, নচেৎ আমার অনুমানের কারণ পরিশেষে আপনাকে কহিব।

বন্দ্যোপাধ্যায়। (ইংরাজ-কর্ম্মচারীর প্রতি) আপনি গৃহের ভিতরের অবস্থা উত্তমরূপে দেখিয়াছেন ত?

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। দেখিয়াছি। বন্দ্যোপাধ্যায়। গৃহের ভিতর একটা ক্লকঘড়ী আছে দেখিয়াছেন?

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। দেখিয়াছি, কতকগুলি কাপড়ের উপর উহা পড়িয়া রহিয়াছে।

বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ঘড়ী দেখিয়া আপনার কি অনুমান হয়, উহা কি নিতান্ত পুরাতন?

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। নিতান্ত পুরাতন বলিয়া বোধ হয় না, তবে একেবারে নূতনও নহে।

বন্দ্যোপাধ্যায়। যেরূপ অবস্থায় এখন ঘড়িটা পড়িয়া আছে, তাহাতে উহা চলিতেছে বলিয়া বোধ হয়?

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। না, বন্ধ হইয়া আছে।

বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার বোধ হয়, সেইস্থানের কোন বাক্স বা সিন্ধুকের উপর সেই ঘড়িটী রাখা ছিল। দস্যুগণ অসাবধানতার সহিত বাক্স, পেটরা প্রভৃতি খুলিবার সময় সেই ঘড়িটা পড়িয়া গিয়াছে, এবং যে অবস্থায় পড়িয়াছে, সেই অবস্থায় বন্ধ হইয়া আছে। কি বলেন, একথা আপনি স্বীকার করেন কি না?

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। আপনার একথা আমি মানি। আমারও বিশ্বাস, ঘড়িটা পড়িয়াই বন্ধ হইয়া গিয়াছে।

বন্দ্যোপাধ্যায়। যদি আমার একথা আপনার মনের সহিত মিলিয়া যায়, তাহা হইলে এখন পুনরায় গমন করিয়া দেখিয়া আসুন—কত বাজিয়া সেই ঘড়ী বন্ধ হইয়া আছে। যে সময়ে উহা পড়িয়া গিয়াছে, সেই সময়েই যে উহা বন্ধ হইয়াছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আর যে সময়ে উহা পড়িয়া গিয়াছে, সেই সময়ে যে দগণ গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারও কোন সংশয় নাই। আমি যখন প্রথমে গৃহের ভিতর প্রবেশ করি, সেই সময়েই ঘড়ীর এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, সেইস্থানেই আমি উহাকে সােজা করিয়া বসাই, এবং চালাইয়া দেখি। প্রায় এক মিনিট কাল সেই ঘড়ী চলিলে যেরূপ অবস্থায় পড়িয়াছিল, সেইরূপ অবস্থায় পুনরায় আমি ইহা রাখিয়া দেই। এখন সেই ঘড়ী দেখিলেই আপনি বেশ বুঝিতে পারিবেন, দশটা বাজিয়া প্রায় একত্রিশ মিনিট হইয়া বন্ধ হইয়া আছে। এখন আপনি বুঝিতে পারিলেন, আমি কি প্রকারে অনুমান করিলাম যে, রাত্রি সাড়ে দশটার সময় এই ঘটনা ঘটিয়াছে?

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। বুঝিয়াছি; আমার অনুমানে ভ্রম হইয়াছে। আরও বুঝিয়াছি, আপনি ঠিক অনুমান করিতে সমর্থ হইয়াছেন। আপনার যদি এতদুর সূক্ষ্মদৃষ্টি না থাকিবে, তাহা হইলেই বা আপনার নাম এতদুর প্রচারিত হইবে কেন?

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া আমি কোনকথাই কহিলাম না, চুপ করিয়া সেইস্থানে বসিয়া রহিলাম। আমার এইরূপ অবস্থা দেখিয়া তিনি কহিলেন, তুমি এ সম্বন্ধে কোন কথা বলিতেছ না কেন? আমার অনুমান প্রকৃত বলিয়া কি তোমার ধারণা হইতেছে না?

আমি। না মহাশয়! আমি আপনার মতের অনুমোদন করিতে পারিতেছি না। যে সকল সিন্ধুক, বাক্স ভগ্নাবস্থায় এখনও গৃহের ভিতর রহিয়াছে, তাঁহারা গৃহের উত্তর অংশে দেওয়ালের কোলে যে সারি সারি সাজান ছিল, তাহাতে কি কোন সন্দেহ আছে?

বন্দ্যোপাধ্যায়। না তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

আমি। যদি তাই হয়, তাহা হইলে উঁহাদিগের প্রত্যেকের খুলিবার মুখ অর্থাৎ সম্মুখভাগ কোনদিকে থাকা সম্ভব বলিয়া বোধ হয়?

বন্দ্যোপাধ্যায়। মেজের দিকে বা দক্ষিণ মুখ করিয়া রাখাই সম্ভব, যে মুখে এখন রাখা আছে।

আমি। উঁহাদিগের মধ্যে যদি কোনটার উপর এই ঘড়ী স্থাপিত থাকিত, তাহা হইলে তাহার সম্মুখভাগই বা কোনদিকে থাকা উচিত?

বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্মুখে, অর্থাৎ যে দিকে সিন্ধুক বাকের সন্মুখ, ঘড়ীর সম্মুখও সেইদিকে থাকিবে।

আমি। সন্মুখ হইতে যদি সিন্ধুক বা বাক্সের ডাল খোলা যায়, তাহা হইলে তাহার উপরিস্থিত ঘড়ী উপুড় হইয়া সন্মুখে, না চিৎ হইয়া পশ্চাতে, পড়ার অধিক সম্ভাবনা?

বন্দ্যোপাধ্যায়। সেরূপ অবস্থায় বাক্স প্রভৃতির পশ্চা দিকে পড়ারই সম্ভাবনা অধিক। কিন্তু যদি কেহ সেই সিন্ধুক বা বাক্স ভাঙ্গিবার পূর্বে সেই ঘড়ী হাতে উঠাইয়া সম্মুখে ফেলিয়া দেয়। তাহা হইলে বর্তমান অবস্থায় কি উহা পড়িতে পারে না?

আমি। তাহা পারে, কিন্তু এরূপ হইলে আপনি যেরূপ বলিতেছেন, সেরূপ হইতে পারে না; অর্থাৎ সিন্ধুক বাক্স ভাঙ্গিবার সময় আপনা হইতেই উহা সম্মুখদিকে কোনরূপেই পড়িতে পারে না। যাহা হউক, মিথ্যা বাকৃবিতণ্ডা করিয়া সময় নষ্ট করা অপেক্ষা আমি যাহা বুঝিয়াছি, তাহা এখন আপনাদিগের নিকট বল কর্তব্য। ঘড়ীর যেরূপ অবস্থা আপনি বর্ণন করিলেন, সেইরূপ অবস্থা আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি, এবং আপনারই মত আমারও প্রথম অনুমান হইয়াছিল, এই ঘটনা রাত্রি সাড়ে দশটার সময় সম্পন্ন হইয়াছে। কিন্তু পরিশেষে দেখিলাম, আমার সেই অনুমান ঠিক নহে। কেন ঠিক নহে, তাহাও এখন আমি আপনা দিগকে বলিব না, অর্ধঘণ্টা পরে সমস্ত বলিব। এখন আপনারা এক কৰ্ম্ম করুন, যে ঘড়িটা লইয়া আমাদিগের মধ্যে এত গণ্ডগোল উপস্থিত হইয়াছে, সেই ঘড়িটা বাহিরে আনিয়া একস্থানে স্থাপন করুন, ও চালাইয়া দিউন। অর্ধঘণ্টা চলিবার পর অর্থাৎ এখন ঘড়ীর সাড়ে দশটার দাগে কাঁটা রহিয়াছে দেখা যাইতেছে, সেই কাটা যখন ঘুরিয়া এগারটার উপর আসিবে, এবং ঠং ঠং করিয়া এগারটা বাজিয়া যাইবে, তখন আমার মনের কথা আপনাদিগের নিকট প্রকাশ করিব। সেই সময় বলিলে সকলে যেমন সহজে বুঝিতে পারিবেন, এখন তত সহজে কেহই বুঝিতে পারিবেন না। কিন্তু আমার এক নিবেদন—এই ঘড়ীর কাঁটার উপর আপনার বিশেষ দৃষ্টি রাখিবেন। এগারটার ঘরে কাটা আসিলে সেই সময়ে ঠিক এগারটা বাজে, কি অপর কিছু বাজে, তাহা আপনারা বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিবেন। ইত্যবসরে আমি মালের তালিকা যতদূর পারি, প্রস্তুত করিবার চেষ্টা দেখি।

বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে উত্তমরূপে জানিতেন, সুতরাং আমার কথা শুনিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ আমার প্রস্তাবিত কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন। গৃহ হইতে সেই ঘড়ী আনাইয়া তাহার নিজের সম্মুখে স্থাপিত করিলেন, চালাইয়া দিলে টক টক করিয়া ঘড়ী চলিতে লাগিল।

আমিও অপহৃত দ্রব্যের যতদুর তালিকা প্রস্তুত করিতে পারি, তাহা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। হরর মা, এবং প্রতিবেশীবর্গকে জিজ্ঞাসা করিয়া একটা তালিকা আরম্ভ করিলাম। যিনি যে সকল দ্রব্য পুৰ্বে বৃদ্ধার গৃহে দেথিয়া ছিলেন, তিনি তাহাই বলিয়া দিতে লাগিলেন। ক্রমে অর্ধঘণ্টা অতীত হইয়া গেল।

অর্ধঘণ্টা পরে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে ডাকাইলেন এবং কহিলেন, এখন দেখিতেছি, তোমার অনুমান সত্য।

কিন্তু তুমি যে বলিয়াছিলে, চারিটা হইতে পাঁচটার ভিতর এই ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা নহে। পাচটা হইতে ছয়টার মধ্যে এই ঘটনা ঘটিয়া থাকিবে।

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। আপনাদিগের কথা ত আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। এই বুঝিলাম, সাড়ে দশটার সময় এই ঘটনা ঘটিয়াছে। আবার বলিতেছেন, পাঁচটা হইতে ছয়টার মধ্যে এই ঘটনা সম্পাদিত হইয়াছে, ইহার কোন্ কথা আমি বিশ্বাস করি?

বন্দ্যোপাধ্যায়। পূর্বে আমি যেরূপ বুঝিয়াছিলাম, আপনাকে সেইরূপই বুঝাইয়াছিলাম। এখন আবার যেরূপ বুঝিতেছি, সেইরূপই আপনাকে বলিতেছি। ঘড়ীর কাটা উল্টাদিকে ঘুরাইয়া দিলে, অর্থাৎ ঘড়ীর বড় কাঁটাটা ধরিয়া নীচু হইতে উপরদিক দিয়া দক্ষিণ হইতে বামভাগে পাঁচ ছয়বার ঘুরাইয়া দিলে সহজেই লোকের চক্ষুতে ধূলি প্রদান করা যাইতে পারে, অথচ পূর্বে যে কয়েক ঘণ্টা বাজিয়া গিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র ব্যতিক্রম হয় না। এখন আমার বোপ হইতেছে, অনুসন্ধানকারীগণকে প্রতারিত করিবার মানসে অপরাধকারী সেই উপায় অবলম্বন করিয়াছে, পলাইবার সময় ঘড়ীর কাঁটাকে উল্টা করিয়া ঘুরাইয়া সাড়ে দশটার চিহ্নের উপর রাখিয়া গিয়াছে। ইহা নিতান্ত সামান্য চোরের কৰ্ম্ম নহে। কিন্তু তুমি ইহা বুঝিতে পারিলে কিরূপে?

আমি। আপনি যেরূপ বুঝিয়াছিলেন, আমিও প্রথমে সেইরূপ বুঝিয়াছিলাম। কিন্তু যখন স্মরণ হইল, রাত্রি সাড়ে দশটা হইতে যে ব্যক্তি ক্লোরাফমের গুণে অচেতন হয়, তাহার পক্ষে প্রাতঃকাল ছয়টা পর্যন্ত বাঁচিয়া থাকা অসম্ভব। সম্ভব অসম্ভব যদিও আমি তাহা ঠিক জানি না, কারণ আমি ডাক্তারী বিদ্যা কখনও অধ্যয়ন করি নাই। কিন্তু আমার মনে যে ভাবের উদয় হইয়াছিল, আমি তাহারই অনুসরণ করিলাম। ঘড়ীর ভিতরে যে কাঁটাটী একটু উপরের দিকে উঠাইয়া ধরিলে ঘড়িটী বাজিতে থাকে, তাহাই একবার উঠাইয়া ধরিলাম; দেখিলাম, ঠং ঠং করিয়া পাঁচটা বাজিয়া গেল। তখন আমার মনে বেশ বিশ্বাস হইল, এই ঘটনা চারিটা বাজিবার পর এবং পাঁচটা বাজিবার পূর্বেই সম্পন্ন হইয়াছে। আরও ভাবিলাম, ঘড়ীর কাঁটা ধরিয়া উল্টাদিকে কয়েকবার শীঘ্ন শীঘ্ন ঘুরাইয়া দেওয়া নিতান্ত সহজ। কারণ সেই বিষয়ে অপর কাহারও জানিবার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু যদি পূৰ্ব্বকথিত কাঁটা উঠাইয়া এক এক করিয়া এগারটা, বাটা, একটা, দুইটা, তিনটা, চারিটা এত বাজাইয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে সেই শব্দ নিকটবর্তী কোন লোকের শ্রবণ-পথে আকৃষ্ট হইতে পারে, অথচ এত বড় একটা ভয়ানক কাৰ্য্য সম্পাদনের পর, সেইরূপভাবে এইস্থানে দাঁড়াইয়া ঘড়ী বাজান নিতান্ত সহজ কৰ্ম্ম নহে, কারণ সেই সময় মনের প্রায় স্থির থাকে না। অধিকন্তু শীঘ্র শীঘ্র সেই গৃহ পরিত্যাগ করিয়া গমন করিবার চেষ্টা চোরমাত্রেই করিয়া থাকে। এই মহাশয়। আমার সময়-নিরূপণের কারণ। এই নিমিত্তই আমি বলিতে ছিলাম, এই ঘটনা রাত্রি চারিটা ও পাঁচটার ভিতর সম্পন্ন হইয়াছে।

দেখিলাম, আমার কথা শুনিয়া সকলেই পরিশেষে আমার মতে অনুমোন করিলেন।

সেই সময় বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আরও কহিলেন, এ ত হল, কিন্তু চোর কি প্রকারে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল?

ইংরাজ-কর্ম্মচারী। পশ্চিমদিকের দরজা দিয়া প্রবেশ করিয়াছে। দেখিতে পাইতেছেন না, উহাতে অস্ত্রের চিহ্ন এখনও পর্যন্ত বর্তমান আছে।

বন্দ্যোপাধ্যায়। তোমার কি বোধ হয়?

আমি। আমার বোধ হয়, সেই দরজা দিয়া কোন চোর গৃহের মধ্যে প্রবেশ করে নাই, বা গৃহের দক্ষিণ দিকের অর্থাৎ সম্মুখের দরজা দিয়া বহির্গত হইয়াও যায় নাই।

বন্দ্যোপাধ্যায়। তোমার এরূপ অনুমানের কারণ কি?

আমি। কারণ বিশেষ কিছুই নয়। পশ্চিমদিকের দরজার গাত্রে যদিচ অস্ত্রের দাগ দৃষ্টিগোচর হইতেছে সত্য, কিন্তু আমার বিবেচনায় সেই দাগ বাহির হইতে হয় নাই, ভিতর হইতে হইয়াছে। সুতরাং সেই দরজা দিয়া কোন লোক যে গৃহের ভিতর প্রবেশ করে নাই, ইহা স্থির। দরজার বহির্ভাগ যদি আপনারা বিশেষরূপে দর্শন করেন, তাহা হইলে স্পষ্টই বুঝিতে পারিবেন, সেই দরজা সর্বদা খোলা হইত না, প্রায়ই বন্ধ থাকিত। এবং ইহাও দেখিতে পাইবেন, উহাতে উর্ণনাভের পুরাতন সূত্র সকল এখনও বর্তমান আছে। সেই দরজার ভিতর দিয়া কোন লোক গৃহের ভিতর প্রবেশ বা গৃহ হইতে বহির্গত হইলে, সেই সুরাশি নিশ্চয়ই যে বিচ্ছিন্ন হইত, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি তোমার অনুমানের সম্পূর্ণরূপ পোষকতা করি। কিন্তু তোমার বিবেচনায় চোর কিরূপে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল?

আমি। আমার বিবেচনায় চোর সম্মুখের দরজা দিয়া প্রবেশ করিয়াছে। কিন্তু গৃহের ভিতস্থিত সেই বৃদ্ধা, বা যুবকের মধ্যে কেহ দরজা যে খুলিয়া দিয়াছে, তাহা যখন সহজে অনুমান করিতে পারি না, তখন হয় উহা দিগের শয়ন করিবার পূর্বে চোর গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া লুকাইয়াছিল, এবং সময়মত আপন কাৰ্যসাধন করিয়া চলিয়া গিয়াছে, নতুবা অনবধানতাবশতঃ রাত্রিকালে গৃহের দরজা খোলাই ছিল, সুযোগ পাইয়া সেই মুক্তপথে চোর প্রবেশ করিয়াছিল।

আমার কথা শুনিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় চুপ করিয়া বহিলেন। তাঁহার যে কি অনুমান, তাহার কিছুমাত্র আভাষ আমাদিগকে প্রদান করিলেন না।

পুলিসের প্রয়োজনীয় কাৰ্য সকল তখন সম্পন্ন হইতে লাগিল। পরের মুখে শুনিয়া যতদূর হইতে পারে, সেইখানে মালের একটা তালিকা প্রস্তুত হইল। হরর মা সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান বাকি থাকিল না; কোন্ কোন্ স্থানে তাহার যাতায়াত, কোন্ কোন্ ব্যক্তির সহিত তাহার আলাপ পরিচয়, সেই সমস্ত লোকের মধ্যে কোনরূপ কুচরিত্রের লোক আছে কি না, প্রভৃতি তাহার সম্বন্ধে যাহা কিছু অনুসন্ধানের প্রয়োজন, তাহার সমস্তই শেষ হইল।

বৃদ্ধার বাড়ীতে কোন্ কোন্ ব্যক্তির যাতায়াত আছে, তাহাদিগের মধ্যে কে কি চরিত্রের লোক, তাহাও বিশেষ রূপে দেখা হইল।

এইরূপভাবে চুরি করা যে সকল চোরের ব্যবসা, কলিকাতার সর্বস্থানের সেই সকল জানিত চোরের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান হইল, কিন্তু কোনফলই ফলিল না।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

পূৰ্বরূপ অনুসন্ধান করিতে করিতে ক্রমে দুইদিবস অতীত হইয়া গেল, কিন্তু কাৰ্য্যে কিছুই হইল না। তৃতীয় দিবসে বৃদ্ধা ভব, এবং রসিকলাল ঘোষ উভয়েই সম্পূর্ণরূপ আবোগ্যলাভ করিয়া হাসপাতাল হইতে বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। উঁহাদিগকে দেখিয়া আমাদিগের মনে সাহস হইল। ভাবিলাম, ইহাদিগের নিকট হইতে এখন অনেক কথা জানিতে পারিব, সুতরাং মোক দমার অনুসন্ধানেও বিশেষ সুবিধা হইবে। দোষী ব্যক্তি ধরা পড়িলেও পড়িতে পারিবে, এবং অপহৃত দ্রব্যের অনুসন্ধান হইলেও হইতে পারিবে। কিন্তু যখন তাহাদিগের সমস্ত কথা উত্তমরূপে শুনিলাম,

তখন আমাদিগের সে আশা দুর হইল।

তাহাদিগের নিকট হইতে জানিতে পারিলাম, যে দিবস এই ঘটনা ঘটিয়াছিল, সেইদিবস সন্ধ্যার পর চাকরাণ হরর মা বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া ভবর সম্মুখেই গমন করে।

সেই সময় রসিকলাল বাহিরে ছিলেন, রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটার সময় তিনি প্রত্যাগমন করিয়া আহারাদি পূর্বক শয়ন করেন, এবং দেখিতে দেখিতে নিদ্রিত হইয়া পড়েন।

রসিকলাল নিদ্রিত হইবার অনেকক্ষণ পরে, ভব আপনার হস্তে দরজা বন্ধ করেন, এবং যে দরজা পূর্ব হইতে বন্ধ ছিল, তাহাও নিজহস্তে পরীক্ষা করিয়া শয়ন করেন। রাত্রি দুই প্রহরের পর ভব নিদ্রিত হন, তাহার পর আর যে কি অবস্থা ঘটিয়াছিল, তাহা তাঁহারা কিছুই অবগত নহেন। পরিশেষে যখন তাহাদিগের চৈতন্য হয়, তখন তাঁহার বুঝিতে পারেন যে, তাঁহারা হাসপাতালে রহিয়াছেন। ইহা ব্যতীত ইহারা আর কিছুই বলিতে পারেন না, কোন লোকের উপর তাহাদিগের সন্দেহ হয় না; এবং সম্প্রতি কোন অপরিচিত লোক তাঁহাদিগের বাড়ীতে আগমন করে নাই।

যে সকল দ্রব্য চুরি গিয়াছে, ভবর কথামত তাহার আর একটী তালিকা প্রস্তুত করিলাম। এখন সকলেই জানিতে পারিলেন, অলঙ্কার নগদ প্রভৃতিতে প্রায় ছয় হাজার টাকা ভবর গৃহ হইতে অপহৃত হইয়াছে।

লোহার সিন্ধুকের চাবি একটী কাষ্ঠ সিন্ধুকের ভিতর ছিল, তাহাতে কাপড় ভিন্ন অপর আর কোন দ্রব্য থাকিত না। সেই বাক্স যদিও ভগ্নাবস্থায় পাওয়া যায়, তথাপি তাহার মধ্যস্থিত কোন দ্রব্য অপহৃত হয় নাই, কেবল লোহার সিন্ধুকের চাবি পাওয়া গেল না।

এই সকল অবস্থা দেখিয়া এবং শ্রবণ করিয়া আমরা কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না, এমন সময়

একখানি বেনামা পত্র ডাকে আসিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের হন্তে পড়িল। তিনি সেই পত্র উত্তমরূপে পাঠ করিয়া, পরিশেষে আমার হস্তে প্রদান করিলেন, আমিও সেই পত্র পাঠ করিলাম। উহাতে লেখা ছিল–ভব এবং রসিককে বিষ খাওয়াইয়া তাহাদিগের গৃহ হইতে যে সকল দ্রব্য অপহরণ করা হইয়াছে, তাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনারা বিশেষ ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, ইহা আমি কয়েকদিবস হইতে দেখিতেছি। কিন্তু যখন আমি তৎসম্বন্ধে কোন কথা জানিতে পারিয়াছি, তখন আমার কর্তব্য সেই কথা আপনাদিগকে বলিয়া দেওয়া। কারণ আপনারা সেই অবস্থা জানিতে পারিলে, আমার বোধ হয়—অথবা বোধ কেন নিশ্চয়ই আপনা দিগের কষ্টের লাঘব হইবে। কিন্তু আপনাদিগের যে সুযশ শুনিতে পাই, কেহ আপনাদিগকে কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিলে তাহাকে লইয়া আপনারা সর্বদা যেরূপ টানাটানি করিয়া থাকেন, তাহাতে আপনাদিগকে কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে গিয়া কে আপনার নাম প্রকাশ করিতে সাহসী হয়? সুতরাং আমি আমার নিজের নাম গোপন করিলাম। ইচ্ছা হয়, আমার কথায় বিশ্বাস করিবেন, ইচ্ছা না হয়, বিশ্বাস করিবেন না; কারণ ইহাতে আমার কোনরূপ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। একবার আপনারা দেখিবেন, ভবর মৃত্যুর পর যে তাহার উত্তরাধিকারী হইবে, সেই অতুলের সহিত ইহার কোনরূপ সংস্রব আছে কি না? অতুলের নিকট হইতে যদি প্রকৃত কথা বাহির করিতে পারেন, তাহা হইলেই আপনাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে। অতুলের বাসস্থান যোড়াবাগান। একটু অনুসন্ধানেই তাহাকে বাহির

করিতে পারিবেন। ইতি।

পত্রপাঠ করা সম্পন্ন হইলে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,এই পত্র সম্বন্ধে তোমার কি বিবেচনা হয়?

আমি। আমার বোধ হইতেছে, এ পত্রের কথা প্রকৃত হইলেও হইতে পারে।

বন্দ্যোপাধ্যায়। কি কারণে তুমি এই পত্রের কথা বিশ্বাস করিতেছ?

আমি। এই পত্রের কথা বিশ্বাস করিবার আমার কয়েকটা কারণ আছে। প্রথমতঃ অতুল যদি প্রকৃতই ভবর উত্তরাধিকারী হয়, তাহা হইলে অতুলের দ্বারা এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হওয়া নিতান্ত অসম্ভব নহে। কারণ সে বেশ বুঝিতে পারিতেছে, ভবর যাহা কিছু আছে, তাহার সমস্তই সে রসিককে দিয়া যাইবে, তাহার আর কিছুমাত্র ভ্ৰম নাই। দ্বিতীয়তঃ-যোড়াবাগানের এক অতুলকে আমি জানি, সে কোন ডাক্তারখানায় কম্পাউণ্ডারের কর্ম্ম করেন। সেই যদি এই অতুল হয়, তাহা হইলে তাহার দ্বারা ক্লোরাফরম সংগ্রহ করা নিতান্ত সহজ; কিন্তু অপরের পক্ষে সেরূপ সহজ নহে। তৃতীয়তঃ-আমাদিগের দেশে যে সকল চোর সৰ্ব্বদা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই অশিক্ষিত। ক্লোরাফরম যে কি, ও তাহার গুণই বা কি, তাহা তাহাদিগের বোধ হয়, কেহই অবগত নহে। এ সকল চুরি-হয় শিক্ষিত লোকের দ্বারা সম্পন্ন হইতে পারেন হয়, যাহাদিগের সহিত ডাক্তারখানার সংস্রব আছে, তাহাদিগের দ্বারাই সম্পন্ন হয়। অপর কাহারও দ্বারা এরূপ কাৰ্য্য হওয়া একেবারেই অসম্ভব।

বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি তোমার যুক্তির পোষকতা করি, কিন্তু তোমার মতের অনুমোদন করি না। এ পত্ৰ আমি বিশ্বাস করি না, আমার বিশ্বাস এই পত্রের মূলে সত্যের লেশমাত্র নাই। অতুলের সহিত কাহারও মনান্তর আছে, সেই তাহাকে বিপদগ্রস্ত করিবার মানসে এই শক্রতাসাধন করিয়াছে। কিন্তু তুমি যে অতুলের কথা বলিতেছ, সেই যদি এই অতুল হয়, তাহা হইলে একটু সন্দেহের কারণ হয় বটে। যাহা হউক, এ সম্বন্ধে একবার উত্তমরূপে দেখা উচিত।

বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া প্রথমে ভবর সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় জানিতে পারিলাম যে, বাস্তবিকই অতুল ভবর দুর সম্পর্কে উত্তরাধিকারী। যদি ভব তাহার বিষয় অপর কাহাকেও প্রদান না করিয়া যায়, তাহা হইলে পরিশেষে সমস্তই অতুলের হইবে।

ভবর নিকট হইতে এই অবস্থা জানিতে পারিয়া, ঘোড়া বাগানে গমন করিলাম, সন্ধানে অতুলকেও পাইলাম। পুর্বে যাহা ভাবিয়াছিলাম, দেখিলাম, কাৰ্য্যে ও তাহাই ঘটিল। যে অতুল আমার পূর্বপরিচিত, যে ডাক্তারখানায় কম্পাউণ্ডারের কৰ্ম্ম করে, এ সেই অতুল। অতুল আমাকে দেখিবামাত্র কহিল, এখানে কি নিমিত্ত আপনার আগমন হইয়াছে?

উত্তরে আমাকে হঠাৎ একটা মিথ্যা কথা বলিতে হইল; অনুসন্ধানের সময় এরূপ মিথ্যা কথা বাধ্য হইয়া আমা দিগকে প্রায়ই বলিতে হয়। ইহা যেন আমাদিগের এক রূপ কৰ্ত্তব্য কর্মের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছে। ঈশ্বর যে আর কতদিবস পরে এই পাপ হইতে মুক্ত করিবেন, তাহা তিনিই বলিতে পারেন। আমি কহিলাম, তোমার মনিবের সহিত আমার সাক্ষাৎ করিবার বিশেষ প্রয়োজন আছে। আমার কথা শুনিয়া সে তাহার মনিবকে সংবাদ প্রদান করিল। সংবাদ পাইবামাত্র ডাক্তার আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

যে ডাক্তারখানায় আমি এই অনুসন্ধান করিতে গমন করিয়াছিলাম, তাহা এখন একটি পুরাতন ঔষধালয় হইলেও সেই সময়ে কিন্তু নিতান্ত নূতন ঔষধালয় ছিল। এই সন্ধানের দুই বৎসর পূর্বে এই ঔষধালয় প্রথম স্থাপিত হয়।

ডাক্তারের নিকট আমি আমার মনের কথা গোপন করিলাম, এবং কহিলাম, এই ঔষধালয় সৃষ্টি হওয়ার পর আপনি কয় শিশি ক্লোরাফরম খরিদ করেন, তাহার কয় শিশি বিক্রয় হইয়াছে, এবং কয় শিশিই বা এখনও মজুত আছে, তাহার একটী হিসাবের প্রয়োজন।

আমার কথা শুনিয়া ডাক্তারবাবু নিজেই খাতাপত্র দেখিতে আরম্ভ করিলেন, এবং পরিশেষে কহিলেন, কেবল দুইশিশিমাত্র ক্লোরাফরম খরিদ করা হয়, তাহা আমার বেশ স্মরণ আছে, এবং কাগজেও তাহাই পাইতেছি। দুই শিশির মধ্যে একশিশি বিক্রয় করা হয়, অপর আর এক শিশি বোধ হয়, মজুতই আছে।

ডাক্তারবাবুর কথা শুনিয়া মজুত শিশিটা একবার দেখিতে চাহিলাম। ডাক্তারবাবু সেই শিশিটী আনিবার নিমিত্ত অতুলকে বলিলেন।

প্রায় অর্ধঘণ্টা পরে অতুল ফিরিয়া আসিয়া কহিল, কই মহাশয়! অনুসন্ধানে ক্লোরাফরমের শিশি আর ত পাইতেছি না!

অতুলের উপর পূর্বেই আমার কিঞ্চিৎ সন্দেহ হইয়াছিল, এই কথা শুনিয়া সেই সন্দেহ আরও বদ্ধমূল হইল। কিন্তু তাহাকে স্পষ্ট করিয়া কোন কথা না বলিয়া, সেইস্থান হইতে তাহাকে সঙ্গে করিয়া আপনস্থানে গেলাম, এবং বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে আদ্যোপান্ত সমস্ত কথা কহিলাম। দেখিলাম, অতঃপর তিনিও ক্রমে আমার অনুমান সম্পূর্ণ অনুসরণ করিলেন, এবং অতুলকে লইয়া অনেক রূপ জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

অতুলকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, সে স্থিরভাবে তাহার উত্তর প্রদান করিতে লাগিল। তাহার কথা যিনিই শ্রবণ করিতে লাগিলেন, তিনিই কহিলেন, এরূপ অবস্থায় অতুলের উপর কোনরূপ সন্দেহ হইতে পারে না, তথাপি আমরা অতুলকে ছাড়িতে পারিলাম না। ডাক্তারখানা হইতে যখন একশিশি ক্লোরাফরম চুরি গিয়াছে, তখন অতুলকে কি প্রকারে পরিত্যাগ করিতে পারি? অতুলকে লইয়া যথেষ্ট অনুসন্ধান হইল, তাহার বাসা পুরু পুঙ্খরূপে অন্বেষণ করা হইল। তাহার দেশের বাড়ী গৃহ প্রভৃতি উত্তমরূপে খানা-তল্লাসী হইতে বাকি থাকিল না, কিন্তু অপহৃত কোন দ্রব্য পাওয়া গেল না।

অতুলের নিকট হইতে কোন দ্রব্য পাওয়া যাইতেছে না, অথচ তাহাকে ছাড়িয়া দিতেও পারিতেছি না। তাহাকে লইয়া একরূপ বিপদেই পড়িলাম। কেহ কহিলেন, ইহারই দ্বারা এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে; কেহ কহিলেন, ইহার দ্বারা হয় নাই, ক্লোরাফরমের শিশি অন্য কোনরূপে গোলযোগ হইয়া গিয়াছে; আমাদিগের মধ্যে এইরূপ মতভেদ হইতে লাগিল।

ক্রমে এইরূপে পাঁচদিবস অতীত হইয়া গেল। ষষ্ঠদিবসে দেখিলাম, একটী লোক আসিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে কি বলিয়া গেল। তিনি আমাকে ডাকাইয়া কহিলেন, যে সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া অতুলের বিরুদ্ধে আমরা অনুসন্ধান করিতেছি, সেই অপরাধে অতুল অপরাধী নহে। তাহাকে এখনই ছাড়িয়া দেও, সেই ক্লোরাফরমের শিশি অপহৃত হয় নাই। অতুলের পূর্বে যে ব্যক্তি সেই ডাক্তার খানায় কৰ্ম্ম করিত, সেই শিশি বিক্রয় করে। কিন্তু ভ্ৰম ক্রমেই হউক, বা ইচ্ছা করিয়াই হউক, সে সেই টাকা, খাতায় জমা দেয় নাই। যাহার নিকট সে উহা বিক্রয় করে, তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইয়াছে, এবং সেই পুরাতন কম্পাউণ্ডার আমার নিকট সকল কথা স্বীকার করিয়াছে। এখন বুঝিতে পারিতেছি, অতুল কোন দোষে দোষী নহে, এই কয়েকদিবস পর্যন্ত তাহাকে মিথ্যা কষ্ট সহ করিতে হইয়াছে।

বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া সেই মুহূর্তেই অতুলকে ছাড়িয়া দিলাম। অতুল হাসিতে হাসিতে আমা দিগকে সহস্র গালিবর্ষণ করিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিল। বিনাদোষে একজন লোককে নিরর্থক কষ্ট দিয়াছি বলিয়া, আমার মনেও কষ্ট হইতে লাগিল। আমার হৃদয় এখন যেরূপ কঠিন হইয়াছে, তখন সেইরূপ কঠিন হইয়াছিল না বলিয়াই বোধ হয়, কষ্ট হইল।

অতুল চলিয়া যাইবার পর আমার মনে কয়েকটা চিন্তার উদয় হইল।

১ম চিন্তা-ভবর যে সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে বলিয়া অভিযোগ হইয়াছে, উহা প্রকৃতই অপহৃত হইয়াছে কি না? এই বিষয় অনেকক্ষণ পর্যন্ত চিন্তা করিলাম। ভব মিথ্যা অভিযোগ করিয়াছে, ইহা আপনার মনকে বুঝাইবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিলাম। কিন্তু সে কথা মন আমার কোন রূপেই বুঝিল না।

দ্বিতীয় চিন্তা—যদি প্রকৃতই চুরি হইয়া থাকে, তাহা হইলে কাহার দ্বারা এই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইল? বাহিরের কোনও চোর আসিয়া এই কাৰ্য্য করিয়া গেল, কি রসিকের সহায়তায় এই কাৰ্য্য হইল?

তৃতীয় চিন্তা-রসিকের সহায়তায় এ কাৰ্য্য কিরূপে সম্পন্ন হইবে? যদি রসিকের সহায়তায় এই কাৰ্য্য হয়, তাহা হইলে সেই বা অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া থাকিবে কেন? আর ডাক্তারই বা কেন বলিবে, রোফরমেই রসিককে অজ্ঞান করিয়াছিল?

চতুর্থ চিন্তা—যদি রসিকের দ্বারা বা তাহার সহায়তায় এই কাৰ্য্য সম্পন্ন না হইয়া থাকে, তাহা হইলে বাহিরের লোক ভিতরে আসিল কি প্রকারে?

পঞ্চম চিন্তা-যে দরজায় অস্ত্রের চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইতেছে, সেই দরজা দিয়াই যদি অপহরণকারী গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া থাকে, তাহা হইলে উহার বহির্ভাগের পুরাতন উর্ণজাল ছিন্ন হইল না কেন?

ষষ্ঠ চিন্তা—সেই দরজায় যে সকল চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইতেছে, তাহা যে বাহির হইতে হইয়াছে, তাহা ত বোধ হইতেছে না। ভিতর হইতে যদি অস্ত্রের চিহ্ন হইয়া থাকে, তাহা হইলে দগণ ভিতরে আসিবে কি প্রকারে?

সপ্তম চিন্তা–গৃহের সম্মুখ দরজা যদি ভিতর হইতে না খুলিয়া দেওয়া হইবে, তাহা হইলেই বা দস্যুগণ প্রবেশ করিবে কিরূপে?

অষ্টম চিন্তা-যে সিন্ধুকের ভিতর লোহার সিন্ধুকের চাবি ছিল, সেই সিন্ধুক কেবল চাবির নিমিত্তই ভাঙ্গিয়াছে বলিয়া বোধ হইতেছে। কারণ তাহার মধ্যে মূল্যবান্ কোন দ্রব্য থাকিত না। অথচ বস্ত্রাদি যাহা কিছু ছিল, তাহার একখানিও অপহৃত হয় নাই।

নবম চিন্তা–গৃহের লোক না হইলে দস্যুগণকে এই চাবির সন্ধান আশ্র কে প্রদান করিতে পারে?

দশম চিন্তা–গৃহের ভিতরে যে দুইজন ছিলেন, তাহার মধ্যে বৃদ্ধা ভব কি নিমিত্ত নিজের দ্রব্য অপরের দ্বারা অপহরণ করাইবে?

একাদশ চিন্তা-গৃহের ভিতরস্থিত অপর ব্যক্তি রসিক। সেই, গৃহের সমস্ত অবস্থা জানে, কিন্তু সেই বা অপরের দ্বারা চুরি করাইবে কেন? সে বেশ কানে, ভবর মৃত্যুর পর সবই তাহার, এখনও তাহার কোন কষ্ট নাই। তাহার মনে যাহা উদয় হইতেছে, ভবব পয়সায় সে তাহাই করিতেছে। তাহার বিবাহের নিমিত্ত ভব বিশেষরূপ চেষ্টা করিতেছে। এরূপ অবস্থায় রসিকই বা চুরি করিবে কেন?

যাহা হউক, যে দিবস অতুলকে ছাড়িয়া দিলাম, সেইদিবস দেখিলাম, বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এবং সেই ইংরাজ-কৰ্মচাৰী ভবর বাড়ীতে পুনরায় গমন করিতেছেন। কি নিমিত্ত তাঁহারা যে পুনরায় গমন করিতেছেন, তাহা কিন্তু আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না; তাঁহারাও ভাঙ্গিয়া চুরিমা আমাকে কোন কথা বলিলেন না, কিন্তু আমাকে ডাকিয়া–দিগের সঙ্গে লইলেন। আমিও বিনাবাক্য-ব্যযে তাঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম।

বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, এবং ইংরাজ-কৰ্মচাৰী উভয়েই গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া উপবেশন করিলেন। বসিক ও ভবকে সম্মুখে ডাকিয়া তাহাদিগকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। যে সকল কথা তাহাদিগকে বার বার জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে, যে সকল কথা অনেকবার অনেক ৰূপে লিখিয়া লওয়া হইয়াছে, সেই সকল পুরাতন কথা আবার তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া লিখিয়া লইতে আরম্ভ কবিলেন।

যে সকল বিষয় অনেকবার শ্রবণ করিযাছি, যাহা অনেকবার লিখিয়া লইয়াছি, সেই সকল বিষয় শ্রবণ করিতে আমার আর ভাল লাগিল না। কিন্তু পুরাতন ও বহুদর্শী কর্ম্মচারীগণ যাহা করিতেছেন, তাহার কোনরূপ প্রতিবাদ করিতেও আমি সাহসী হইলাম না। ভাবিলাম, ইহাদিগের কোনরূপ গূঢ় অভিসন্ধি না থাকিলে, ইহার পুনরায় এরূপকার্যে কেন প্রবৃত্ত হইবেন?

উঁহারা যখন পূর্বোক্তরূপে কথােপকথন করিতে লাগিলেন, আমি তখন সেই গৃহের ভিতর বসিয়া বসিয়াই এদিক ওদিক চতুর্দিক দেখিতে লাগিলাম। কি দেখিতেছি, তাহার স্থির নাই, কোনদিকে বিশেষ লক্ষ্য নাই; তথাপি দেখিতে লাগিলাম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

সেই গৃহ মধ্যে দেখিতে দেখিতে একটা চিঠির ফাইল আমার দৃষ্টিপথে পড়িল। দেখিলাম, দেওয়ালের এক কোণে একটী পেরেকের উপর উহা ঝুলিতেছে। সেইস্থান হইতে ফাইলটী আপনার নিকটে আনিলাম, ও উহাতে যে সকল কাগজপত্র ছিল,তাহা এক এক করিয়া পড়িতে লাগিলাম।

সেই ফাইলের কাগজগুলি যে কেন পড়িতে লাগিলাম, তাহার কারণ অন্যের জানা পরের কথা, আমি নিজেই জানিতে পারিলাম না। কৌতুহল-পরবশ হইয়াই হউক, বা অভ্যাসের দোষেই হউক, আমি কিন্তু উহা পাঠ করিতে লাগিলাম।

উহার ভিতর অনেক পত্র ছিল, এক এক করিয়া প্রায় সমস্তগুলিই মোটামুটি দেখিয়া লইলাম। কোনখানি বৃদ্ধা ভবর নামে, কোনখানি রসিকের নামে, কোনখানি বা অপর আর কাহারও নামে।

যখন আমি এইরূপভাবে সেই পত্রগুলি পাঠ করিতে লাগিলাম, তখন সেই ইংরাজ-কর্ম্মচারী আমার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া একটু হাসিলেন ও কহিলেন, তোমার বিবেচনায় কি এই স্থির হইয়াছে যে, যাহারা এই দস্যুবৃত্তিতে পরিলিপ্ত, তাঁহারা অগ্রে পত্র লিখিয়া, পরিশেষে এই অসমসাহসিক কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছে? নতুবা এত আগ্রহের সহিত এই পত্রগুলি তুমি পাঠ করিতেছ কেন? অনাবশ্যক কর্মে মিথ্যা সময় নষ্ট না করিয়া ইহারা পুনরায় যাহা বলিতেছে, আমার মতে তাহা শ্রবণ কর তোমার কর্তব্য।

ইংরাজ-কর্ম্মচারীর কথায় আমি কোনরূপ উত্তর প্রদান করিলাম না। কিন্তু বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কহিলেন, এদিকের কাৰ্য্য আমরা করিতেছি, ও যাহা করে, তাহা উহাকে করিতে দেও। ইহারা এখন যাহা বলিতেছে, তাহা শুনিয়া যাহা করিতে হয়, তাহা আমরাই করিব। উহাকে সে বিষয় দেখিতে হইবে না।

বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কথা শুনিয়া ইংরাজ-কর্ম্মচারী আর কোন কথা কহিলেন না। আমিও যে কাৰ্যে নিযুক্ত ছিলাম, তাহাই আপন ইচ্ছামত দেখিতে লাগিলাম।

এক এক করিয়া অনেক পত্র পড়িলাম, কিন্তু উহার একখানির মধ্যেও আমার আবশ্যক কোন কথা দেখিতে পাইলাম না। পরিশেষে একখানি পত্রের উপর আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল, মনে যেন কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই পত্রখানি একবার দুইবার করিয়া চারি পাঁচবার পড়িলাম। কিন্তু পরিশেষে বুঝিলাম, এই মোকদ্দমার সহিত এই পত্রের কোনরূপ সংস্রব নাই। এই ভাবিয়া পত্রখানি যে স্থানে ছিল, সেইস্থানে রাখিয়া দিলাম।

সেই পত্রখানি চারি পাঁচবার আমাকে পড়িতে দেখিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কহিলেন, এত মনঃ-সংযোগ করিয়া তুমি যে পত্রখানি পড়িতেছিলে, দেখি উহাতে কি লেখা আছে। এই বলিয়া পত্ৰখানি নিজহস্তে গ্রহণ করিয়া পাঠ করিলেন। সেই পত্রে লেখাছিল, কল্যাণবরেষু—

তোমার কথার কেন এরূপ গোলযোগ হইল? আময়া কয়জনেই তোমার অপেক্ষায় বাগানে প্রায় সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিলাম। কিন্তু যখন দেখিলাম, তুমি আসলেও না, বা কোনরূপ সংবাদও পাঠাইয়া দিলে না, তখন কাজেই পরদিবস প্রাতঃকালে আমাদিগকে সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া আসিতে হইল। কি অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহার সমস্ত ব্যাপার, হয়-পত্ৰযোগে আমাকে লিখিবে, না হয়,-সময়মত একদিবসের নিমিত্ত আসিয়া বলিয়া যাইবে। তোমার সহিত সাক্ষাৎ হওয়ার পর যেরূপ বন্দোবস্ত হইবে, সেইরূপভাবে কাৰ্য্য করিব। ইতি তারিখ * * *

আশীর্বাদকারী
তারণচন্দ্র ঘোষ

এই পত্রপাঠ করিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এই পত্র পাঠ করিয়া তোমার মনে কোনরূপ সন্দেহ উপস্থিত হইয়াছিল কি?

আমি। হাঁ, কিন্তু পরে সে সন্দেহ দূর হইয়াছে।

বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে কি সন্দেহ উদয় হইয়াছিল?

আমি। আমার মনে এই সন্দেহ উদয় হইয়াছিল যে, রসিক, তারণচন্দ্র প্রভৃতি কয়েকজন লোকের সহিত পরামর্শ করিয়া এইরূপ করিবার অভিসন্ধি করিয়াছিল, এবং চুরি করিবার নিমিত্তই উঁহারা সকলে আসিয়া বাগানে রসিকের অপেক্ষায় বসিয়াছিল। কিন্তু কাৰ্যগতিতে রসিক তাহাদিগের নিকট গমন করিয়া কোনরূপ সংবাদ প্রদান করিতে পারে নাই। সুতরাং সমস্ত রাত্রি তাহাদিগকে বাগানের ভিতর বসিয়া থাকিতে হয়, ও সঙ্কল্পিত কাৰ্য শেষ করিতে না পারিয়া, পরদিবস প্রাতঃকালে তাঁহারা সেইস্থান পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক প্রস্থান করে। পত্রপাঠ করিয়া প্রথমে আমার মনে এই প্রকার সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়। আরও আমার মনে হয়, এই ঘটনার পর আর একটা দিন স্থির হব, ও সেইদিবসেই উঁহারা এই কাৰ্য্য সম্পন্ন করে।

বন্দ্যোপাধ্যায়। তোমার মনে যে সন্দেহ প্রথমে উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা নিতান্ত অযুক্তিযুক্ত নহে। কিন্তু পরিশেষে সে সন্দেহ দূর হইল কিসে?

আমি। যখন আমি সেই পত্রের তারিখ দেখিলাম, তখন আমার সেই সন্দেহ দূর হইল। দেখিলাম, চুরির প্রায় দেড়বৎসর পূর্বে যে পত্র লেখা হইয়াছে, সেই পত্রের সহিত বৰ্তমান চুরির যে কোনরূপ সংস্রব আছে, তাহা আমার মনে লয় না। সুতরাং পত্রের তারিখ দেখিয়া, আমার সেই সন্দেহ দূর হইয়াছে।

বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় আমার কথা শুনিয়া আর আমাকে কিছু বলিলেন না। রসিকল সেইস্থানেই উপস্থিত ছিল। তাহার হন্তে সেই পত্রখানি প্রদান করিয়া কহিলেন, এই পত্রখানি পড় দেখি রসিকলাল!

পত্রখানি হন্তে লইয়া রসিকলাল পাঠ করিতে আরম্ভ করিল, কিন্তু তাহা সুস্পষ্টরূপে পাঠ করিতে পারিল না। কথা যেন জড়াইয়া জড়াইয়া বাহির হইতে লাগিল। তাহার অবস্থা দেখিয়া সকলেই মনে করিতে লাগিলেন, রসিকলের অন্তরে যেন পাপ আছে।

পত্রপাঠ শেষ হইলে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, এই পত্ৰলেখক তারণচন্দ্র কে?

প্রথমে একটু ইতস্ততঃ করিয়া পরিশেষে রসিকলাল উত্তর দিল, তারণচন্দ্র তাহার খুড়া।

এ পত্রের অর্থ কি?

অর্থ আর কিছুই নহে, যে দিবস তাঁহারা আসিয়া বাগানে আমার অপেক্ষায় বসিয়াছিলেন, সেইদিবস থিয়েটার দেখিতে যাওয়ার কথা ছিল, আরও কথা ছিল, আমি গিয়া তাহাদিগের সহিত মিলিত হইলে সকলে একসঙ্গে গমন করিব। কিন্তু হঠাৎ আমার একটু অসুখবোধ হওয়ায়, আমি সে সময় তাহাদিগের নিকট যাইতে পারি নাই, বা অপর কাহারও দ্বারা সংবাদ পাঠাইতেও সমর্থ হই নাই। কাজেই তাঁহারা আমার অপেক্ষায় বসিয়া বসিয়া সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করিয়াছিলেন, এবং পরিশেষে বাড়ী গিয়া আমাকে এই পত্র লিখিয়াছিলেন।

তুমিই যেন যাইতে পারিলে না, বা অপর কাহারও দ্বারা সংবাদ পাঠাইতে সমর্থ হইলে না, কিন্তু তাহাদিগের মধ্যে কেহ না কেহ আসিয়া অনায়াসেই সংবাদ লইয়া যাইতে পারিত। আর থিয়েটার দেখা কিছু এমন দুষ্কৰ্ম্ম নহে যে, তাঁহারা তোমার বাড়ীতে না আসিয়া তোমার অপেক্ষায় চোরের মত বাগানের ভিতর বসিয়াছিলেন?

আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত; কিন্তু তাহা দিগের মধ্যে কেহই আমার বাড়ী জানিতেন না বলিয়া পূৰ্ব্বের বন্দোবস্ত মত তাঁহারা বাগানের ভিতর বসিয়া ছিলেন; তাঁহারা চোর নহেন। সকলেই সম্রান্তবংশীয় ও আমার আত্মীয়; সুতরাং তাহাদিগের দ্বারা কোনরূপ অনিষ্টের আশঙ্কা করা যাইতে পারে না। বিশেষ এ ঘটনা আজিকার নহে, বহুদিবসের।

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

রসিকের কথাগুলি আমরা বিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলাম। তাহার কথায় যদিও আমার কতক বিশ্বাস হইল; কিন্তু বুঝিলাম, বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তাহার কথা একেবারে বিশ্বাস করেন নাই। তখন তিনি ক্রমে রসিককে নানাকথা জিজ্ঞাসা করিয়া তাহার খুড়ার বাসস্থান কোথায়, তাহার সঙ্গে আর কে কে আসিয়াছিল, তাহাদিগের বা বাড়ী কোথায় প্রভৃতি সমস্ত ব্যাপার জানিয়া লইলেন। সেই সকল বিষয়ে এরূপভাবে রসিককে প্রশ্ন করিলেন, যাহাতে রসিক কিছুমাত্রই বুঝিতে পারিল না যে, পুলিসের সন্দেহ এতক্ষণ পরে তাহাদিগের উপর পতিত হইয়াছে।

রসিক ও ভবকে তাহাদিগের বাড়ীতে রাখিয়া সময়মত আমরা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। পথে আসিয়া দ্রুতগামী একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া তারণচন্দ্রের গ্রামাভি মুখে চলিলাম। সেই গ্রাম হাবড়া হইতে বহুদূরে নহে, কয়েক ক্রোশের মধ্যেই স্থাপিত।

গ্রামে গমন করিয়া তারণকে তাহার বাড়ীতেই পাইলাম। প্রথমে কোন কথা না বলিয়া উহাকে একেবারে বন্ধন করিলাম। তারণ নিতান্ত বিস্মিতের ন্যায় জিজ্ঞাসা করিল, কেন মহাশয় কি হইয়াছে, হঠাৎ আমাকে এরূপে বন্ধন করিতেছেন কেন?

কেন বন্ধন করিতেছি, তাহা তুমি জিজ্ঞাসা করিতেছ? কলিকাতায় কি কাৰ্য্য করিয়া আসিয়াছ, তাহা তোমার স্মরণ নাই? তোমার সমস্ত মন্ত্রণা বিফল হইয়াছে, রসিক সকল কথা বলিয়া দিয়াছে। বুঝিতেই ত পারিতেছ, রসিক যদি সকল কথা না বলিয়া দিবে, তাহা হইলে আমরা তোমার নাম কি প্রকারে জানিতে পারিব? এবং তোমার বাসা কিরূপে সন্ধান করিয়া লইব?

আমাদিগের কথা শুনিয়া তারণচন্দ্র একেবারে যেন মৃতবৎ হইয়া পড়িল। কিয়ৎক্ষণ তাহার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হইল, কোনরূপ বানিষ্পত্তি না করিয়া সেইস্থানেই বসিয়া পড়িল।

তারণের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমাদিগের মনে আরও সাহস হইল। তখন পুনরায় তাহাকে কহিলাম, দেখ তারণ! যখন সমস্ত কথা প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে, তখন তুমি আমাদিগকে আর মিথ্যা কষ্ট দিও না। অপহৃত দ্রব্যাদি সমস্ত এখনই আমাদিগের সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত কর। নতুবা তোমার অদৃষ্টে যে কিরূপ দুঃখ আছে, তাহা আমি এখন কল্পনা করিয়াও ভাবিতে পারিতেছি না। আমাদিগের কথা শুনিয়া তারণচন্দ্র প্রথম প্রথম দুই একবার বলিল, আমি ইহার কিছুই জানি না, রসিক মিথ্যা করিয়া আমার নাম বলিয়া দিয়াছে। পরিশেষে কিন্তু ইচ্ছা করিয়া হউক, বা অনিচ্ছাসত্বেই হউক, তারণকে সকল কথা বলিতে হইল; তাহার সঙ্গে অপর কোন্ কোন্ ব্যক্তি ছিল, তাহাদিগের নামও করিয়া দিতে হইল। আর অপহৃত দ্রব্যাদি যাহা যেখানে রাখিয়াছিল, এক এক করিয়া তাহার সমস্তই বাহির করিয়া দিতে হইল। সেই সকল দ্রব্যের অধিকাংশই গ্রামের বাহিরে ময়দানের মধ্যে প্রােথিত করিয়া রাখা হইয়াছিল।

অপরাপর আসামীগণকে ধৃত করিয়া এবং অপহৃত সমস্ত দ্রব্য সঙ্গে লইয়া আমরা কলিকাতায় আসিলাম। আমা দিগের কাৰ্য দেখিয়া উৰ্দ্ধতম-কর্ম্মচারীরা, এবং পাড়া-প্রতি বেশী সকলে যেমন সন্তুষ্ট হইলেন, রসিকের মুখে তেমনি ভয় ও বিষাদের ছায়া পড়িল।

রসিক প্রথমে সমস্ত কথা অস্বীকার করিল। কিন্তু পরিশেষে কহিল, আমি কি করিব? খুড়া মহাশয়ের কুপরামর্শে পড়িয়াই আমি এই কাৰ্য্য করিয়াছি। এই কাৰ্য সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত প্রায় দুই বৎসর হইতে আমরা ক্রমাগত চেষ্টা করিয়া আসিতেছি। কিন্তু এই বৃদ্ধার সাবধানতার নিমিত্ত কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারিতেছি না। যে যে রাত্রিতে চুরি করিবার বন্দোবস্ত হইয়াছে, যখন যখন আমি আমার শয্যাত্যাগ করিবার বাসনা করিয়াছি, তখনই বৃদ্ধা জাগরিত হইয়াছে; অমনি আমা দিগের কার্যে ব্যাঘাতও পড়িয়াছে। যখন দেখিলাম, কোনরূপেই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারিলাম না, তখন বাধ্য হইয়া আমাদিগকে এই শেষ উপায় উদ্ভাবন করিতে হইল। এই নিমিত্তই এই তৃতীয় সংখ্যক আসামীকে আমাদিগের দলে প্রবিষ্ট করাইতে হয়। ইনি ডাক্তারখানায় কৰ্ম্ম করেন, সুতরাং ইহার দ্বারা সহজেই ক্লোরাফরমের সংগ্রহ হইল। যখন দেখিলাম, বৃদ্ধা অচেতনবৎ নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছে। তখন শিশি হইতে কিয়ৎ পরিমাণ ক্লোরা ফরম লইয়া একখানি পূৰ্বসঞ্চিত রুমালে ঢালিয়া বৃদ্ধার নাসিকার নিকট রাখিলাম; ক্রমে বৃদ্ধা অজ্ঞান হইয়া পড়িল। তখন আমি গৃহের দরজা খুলিয়া বাহিরে গেলাম, সদর দরজা খুলিয়া যেখানে সকলে আমার অপেক্ষায় বসিয়াছিল, সেইস্থানে গমন করিলাম। আমার নিকট সমন্ত অবস্থা শুনিয়া উঁহারা আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। যে স্থানে লোহার সিন্ধুকের চাবি থাকিত, তাহা আমি জানিতাম; সেই বাক্স আমি উঁহাদিগকে দেখাইয়া দিলাম। পরিশেষে উঁহাদিগের সাধ্যমত সমস্ত দ্রব্য বাহির করিয়া প্রস্থান করিল। অপর রুমালখানিতে অতি সামান্য মাত্ৰ ক্লোরাফরম ঢালিয়া আমার নিকটে ফেলিয়া রাখিলাম, ইচ্ছা—যাহাতে আমারও সামান্য নেশা হয়। কারণ আমি ও ভব যদি একই ভাবে পড়িয়া থাকি, তাহা হইলে আমার উপর সন্দেহ হইবে না। আমার যতটা নেশা হইয়াছিল বলিয়া আপনারা স্থির করিয়াছিলেন, বাস্তবিক ততটা নেশা আমার হইয়াছিল না।

উহাবা চুরি করিলে তোমার কি লাভ ছিল?

আমাদিগের মধ্যে এই বন্দোবস্ত ছিল, যে পর্যন্ত গোলযোগ না মিটিবে, ততদিবস পৰ্যন্ত সমস্ত দ্রব্যই লুক্কায়িত থাকিবে। গোলযোগ মিটিয়া গেলে, আমরা সকলে মিলিয়া উহা বণ্টন করিয়া লইব। আমি লইব অর্ধেক, এক চতুর্থাংশ লইবেন খুড়া মহাশয়, অবশিষ্ট অপর কয়েক জনেব মধ্যে বিভক্ত হইবে।

যাহা হউক,কত রাত্রিতে এই কাৰ্য্য তোমরা করিয়াছিলে? প্রাতঃকাল চারিটা হইতে পাচটার মধ্যে। গৃহের ঘড়ীর অবস্থা সেরূপ হইয়াছিল কেন?

তাহার কারণ ছিল। পাড়ার দুই একজন লোক সাড়ে দশটার সময় ভর সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিল; তাহাদিগের উপর সন্দেহ পড়িবে, এবং আমাদের উপর একেবারে পড়িবে না বলিষা, ঘড়ীর কাটা ঘুরাইয়া সেইরূপে রাখিয়াছিলাম।

সেই সময় পাড়ার কোন লোক যে এখানে আসিয়া ছিল, একথা ত তোমর কেহই এ পর্যন্ত বল নাই।

ভয়েতে কেহ বলে নাই, কি ভুলিয়া গিয়া থাকিবে।

ভব সেইস্থানে উপস্থিত ছিল, সে তখন কহিল, রসিক যাহা বলিল, তাহা সত্য; একথা আমার মনেই ছিল না।

গৃহের পশ্চিমদিকের দরজায় অস্ত্রের চিন্তু ছিল কেন?

বাহিরের লোক অস্ত্রদ্বারা সেই দরজা খুলিয়া গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছে, ইহাই সাধারণকে দেখাইবার নিমিত্ত।

এইরূপে অনুসন্ধান শেষ করিয়া আসামীগণকে মাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করা হইল। সেইস্থান হইতে মোকদ্দমা দায়রায় গেল। দায়রায় জুরির বিচারে রসিক, তারণ, এবং অপর দুই ব্যক্তি রসময় ও প্রিয়নাথ, সকলেই সাত সাত বৎসরের নিমিত্ত কারাগারে প্রেরিত হইল। বৃদ্ধা তাহার সমস্ত, দ্রব্য সামগ্রী লইয়া আপনার গৃহে প্রস্থান করিল। রসিক যেমন করিল, তাহার ফল ও তেমনি পাইল!

সম্পূর্ণ।

রকম রকম

রকম রকম (অর্থাৎ জুয়াচুরির অদ্ভুত অদ্ভুত বৃত্তান্ত!)
Detective Stories No.82, দারোগার দপ্তর ৮২ম সংখ্যা।
রকম রকম (অর্থাৎ জুয়াচুরির অদ্ভুত অদ্ভুত বৃত্তান্ত!)
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে শ্রীবাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। মাঘ।
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.

দারোগার দপ্তর।
রকম রকম।

সূচনা।

এই কলিকাতা সহর জুয়াচোরে পূর্ণ, একথা প্রায়ই সর্বদা সকলের মুখেই শুনিতে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে কলিকাতা একবারে জুয়াচোরে পরিপূর্ণ না হইলেও, ইহা যে অনেক জুয়া চোরের আবাস স্থল, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এখানে অনেক জুয়াচার অনেকরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া নিত্য যে কত নিরীহ লোকগণকে প্রতারিত করিতেছে, তাহার সংখ্যা কে করে? কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, যে সকল পুরাতন জুয়াচুরির কৌশল অবলম্বন করিয়া জুয়াচোরগণ নিত্য লোকগণকে ঠকাইয়া থাকে, সেই সকল পুরাতন কৌশল-জালে এখনও নিত্য অনেক লোক পতিত হইতেছেন। আপনা হইতে সতর্ক হইতে না পারিলে, জুয়াচারগণ কর্তৃক প্রতারিত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। এই নিমিত্তই আমি মধ্যে মধ্যে বিস্তর জুয়াচুরির বিবরণ এই দারোগার দপ্তরে বর্ণন করিয়া সৰ্বসাধারণকে সতর্ক করিয়া দিয়া থাকি। আমার লিখিত জুয়াচুরির বিষয় পাঠ করিয়া, অনেক পাঠক মধ্যে মধ্যে জুয়াচোরগণের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইয়া থাকেন, একথাও অনেক সময় আমি সেই সমস্ত পাঠকগণের প্রমুখাৎ শ্রবণ করিয়াছি। তথাপি নিরীহ মফঃস্বল-বাসীগণের মধ্যে অনেকেই কলিকাতায় আসিয়া জুয়াচোরগণ কর্তৃক এখনও প্রতারিত হইতেছেন! তাহাদিগকে সতর্ক করিয়া দিবার অভিলাষে, যে সকল জুয়াচুরি সর্বক্ষণ কলিকাতায় চলিতেছে, তাহার মধ্য হইতে কয়েকটীমাত্র এই স্থানে বর্ণনা করিলাম। এই সকল বিষয় সবিশেষরূপ সুখ-পাঠ্য না হইলেও, আশা করি, পাঠক মহাশয়গণ জুয়াচোরগণের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইবার মানসেই অন্ততঃ একবার ইহা সবিশেষ মনোযোগের সহিত পাঠ করিবেন। কেবল এগুলিই বা কেন, এ পর্যন্ত আমি জুয়াচুরির যে সকল কৌশল ইতিপূৰ্বে বর্ণন করিয়াছি, এবং ভবিষ্যতে আরও যে সকল বর্ণন করিব, সেই সকল বিষয় উত্তমরূপে অবগত থাকিলে জুয়াচোরগণ সহজে তাহাদিগের নিকট আসিতে সমর্থ হইবে না। অথচ এই সকল বিষয় পাঠ করিয়া যত লোক জুয়াচোরের হস্ত হইতে পরিত্রাণ লাভ করিবেন, আমি ততই আমার পরিশ্রম সার্থক মনে করিব।

(১) ডাকের চুরি।

ডাকঘরে আজকাল অনেক প্রকারের চুরি ও জুয়াচুরি আরম্ভ হইয়াছে, তাহার মধ্যে এই প্রবন্ধে আমি দুইটা বিষয় আজ পাঠকগণকে উপহার প্রদান করিতেছি। এই দুইটী বিষয় আইন অনুসারে চুরি হইলেও, ইহাকে জুয়াচুরির শ্রেণীভুক্ত করাই কৰ্ত্তব্য। উভয়কেই এক কথায় ডাকের চিঠি চুরি বলা যাইতে পারে; কিন্তু আমি উহার নাম এইরূপ প্রভেদ করিলাম যথা;—(ক) চিঠিতে জুয়াচুরি। (খ) হুণ্ডিতে জুয়াচুরি।

(ক) চিঠিতে জুয়াচুরি।

গোবিন্দচন্দ্র একজন পুরাতন জুয়াচোর। অনেক সময় অনেক জুয়াচুরি ব্যবসা অবলম্বন করিয়া সে মফঃস্বলের অনেক লোককে একাল পর্যন্ত ঠকাইয়া আসিয়াছিল; কিন্তু নিজে কিছুমাত্র সংস্থান করিয়া উঠিতে পারে নাই। সে অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া যাহা কিছু উপার্জন করে, তাহার ব্যয়ও প্রায় সেই রূপেই হইয়া থাকে। তবে তাহার লাভের মধ্যে কেবল এইমাত্র দেখিতে পাই যে, কোন কোন সময় দুই বেলা অন্নের সংস্থান হয়; কিন্তু কোন কোন সময় আবার তাহাও হয় না। কখন কখন গাড়ি ঘোড়ায় চড়িয়া, কথন বা টমটম হাঁকাইয়া, কলিকাতার রাস্তায় সে ছুটাছুটী করিয়া থাকে, কখন বা মলিন বস্ত্রে শরীর আবৃত করিয়া চটিজুতা পরিয়া রাস্তায় গমন করিবার কালীন, পূর্ব্ব নিয়োজিত সহিস-কোচবানগণের বেতন বাকী থাকা প্রযুক্ত, তাহাদের নিকট সুমধুর বাক্য শ্রবণ করিয়া থাকে, বা কখন কখন তাহাদিগের আদরের চড় চাপড় সহ্য করিয়া ধীরে ধীরে আপন পৃষ্ঠে হস্ত বুলাইতে থাকে। কখন বা বেশ্যা-পল্লীর ভিতর গমন করিয়া সুরাদেবীর প্রকট-শিষ্য হইয়া বার-নারীদিগের সুমধুর আদরের প্রেম-সাগরে সন্তরণ করিয়া থাকে, কখন বা তাহা দিগের দেনা পরিশোধ করিতে না পারিয়া হাসিতে হাসিতে তাহাদিগের আদর-মিশ্রিত পাদুকার ধূলি সকল আপন মস্তক হইতে ঝাড়িতে বাড়িতে স্থানান্তরে প্রস্থান করে। গোবিন্দ চন্দ্র এইরূপে কলিকাতার ভিতর অনেক দিবস পর্যন্ত আপনার লীলা খেলা করিয়া আসিতেছে। তাহার এইরূপ লীলা খেলা করিতে যে সকল অর্থ ব্যয়িত হয়, তাহার সমস্তই জুয়াচুরি-লব্ধ। সে অনেকরূপ জুয়াচুরির নূতন উপায় বাহির করিয়া অনেক লোককে ঠকাইয়াছে, এবং ক্রমে সেই সকল জুয়াচুরির বিষয় অনেকে অবগত হইবার সঙ্গে সঙ্গে তাহা পরিত্যাগ করিয়া অপর উপায় অবলম্বন করিয়াছে। আজকাল সে যে জুয়াচুরির উপায় অবলম্বন করিয়া আপনার খরচ-পত্রের সংস্থান করিতেছে, তাহার বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল।

গোবিন্দ যে স্থানে বাস করে, সেই স্থানে পোষ্টাফিসের বে পিয়ন চিঠি-পত্র বিলি করিয়া থাকে, তাহার সহিত একটু আলাপ করিবার মানসে সে প্রথমতঃ সুযোগ অনুসন্ধান করে। ক্রমে ক্রমে এক একজন করিয়া দুইজন পিয়নের সহিত উত্তমরূপ আলাপ করিয়া লয়। কোন স্থান হইতে তাহার পত্ৰ আসিলে যে পিয়ন সেই পত্র তাহাকে প্রদান করিতে যাইত, তাহাকে প্রায়ই দুই চারি আনা পারিতোষিক না দিয়া গোবিন্দ ছাড়িত না। তদ্ব্যতীত পূজা-পার্বণে প্রায়ই তাহাদিগকে ডাকিয়া বসি বলিয়া কিছু না কিছু প্রদান করিত। এইরূপে কিছু দিবসের মধ্যেই পিয়নদ্বয়কে এরূপ ভাবে আপনার বশীভূত করিয়া লইল যে, গোবিন্দ যাহা বলিত, তাঁহারা তাহাই শুনিত। পিয়নদ্বয় কোন পত্রাদি তাহার নিকট বিলি করিতে আসিলে, তখন প্রায়ই তাহাদিগের নিকট অপরের যে সকল পত্ৰ থাকিত, তাহার শিরোনামা, ও পোষ্টকার্ড হইলে তাহাতে যাহা লেখা থাকিত, গোবিন্দ তাহা পড়িয়া লইত। কেন যে সে এইরূপ ভাবে চিঠি পত্র পড়িয়া দেখিত, ডাকপিয়নদ্বয় তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিত না। পাঠ সমাপ্ত হইলে কিছু পারিতোষিকের সহিত সেই সকল পত্র পুনরায় ডাকপিয়নের হস্তে প্রদান করিত। তাঁহারা সেই সকল পত্ৰ লইয়া, যে যে স্থানে বিলি করা আবশ্যক, পরে সেই সেই স্থানে তাহা বিলি করিত। এইরূপে কিছু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেলে, একদিবস গোবিন্দ উঁহাদিগের একজন পিয়নকে জিজ্ঞাসা করিল, তোমরা যে সকল পত্র বিলি করিয়া থাক, তাহাদের মধ্যে যদি কোন পত্ৰ তোমাদিগের হস্ত হইতে হারাইয়া যায়, তাহা হইলে তোমাদিগকে কি কোনরূপ দণ্ড গ্রহণ করিতে হয়?

পিয়ন। পোষ্টকার্ড বা যে সকল পত্রে টিকিট দেওয়া আছে, তাহা হারাইয়া গেলে, আমাদিগকে কোনরূপ দণ্ড লইতে হয় না; কারণ, সেই সকল পত্রের কোনরূপ হিসাব থাকে না। উহাদের মধ্যে কোন পত্র যদি আমরা হারাইয়া ফেলি, তাহা হইলে আমরা উহা হারাইয়া ফেলিয়াছি, কি বিলি করিয়াছি, তাহা। কিরূপে জানিতে পারা যাইবে? কারণ, সে সকল বিলি হইলে, তাহার জন্য কেহ সহিও করেন না, বা কেহ পয়সাও দেন না।

গোবিন্দ। আর যে সকল পত্ৰ বেয়ারিং?

পিয়ন। তাহা হারাইয়া গেলেও সবিশেষ কোনরূপ ক্ষতি হয় না। সেই পত্রের মাশুল চারি পয়সা ঘর হইতে দিলেই সকল গোল মিটিয়া যায়।

গোবিন্দ। এরূপ অবস্থায় একজনের পত্র অনায়াসেই তোমরা অপরকে প্রদান করিতে পার?

পিয়ন। পারি। দুই একখানা অপরকে বিলি করিলে, সবিশেষ কোনরূপ ক্ষতি হয় না। ধরা পড়িলে, এই বলিয়া বুঝাইতে পারি যে, ভুল-ক্রমে একজনের পত্ৰ অপরের নিকট বিলি করা হইয়াছে।

গোবিন্দ। অনেক হইলে?

পিয়ন। তাহাতে আমাদিগের সবিশেষ বিপদের সম্ভাবনা। এই  সকল কথা যদি কোন গতিতে আমাদিগের উপরওয়াল জানিতে পারেন, তাহা হইলে তাঁহারা আমাদিগের নাম কাটিয়া দিতে পারেন, এবং ইচ্ছা করিলে, আমাদিগকে জেলেও পাঠা ইতে পারেন।

গোবিন্দ। যাহাতে এরূপ বিপদের সম্ভাবনা, সেইরূপ কার্যে কোন কোন পিয়ন হস্তক্ষেপ করিতে কিরূপে সমর্থ হয়, তাহা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারি না।

পিয়ন। কেন মহাশয়! আপনি এ সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?

গোবিন্দ। তোমরা যে সকল চিঠি বিলি কর, সেই সকল চিঠি আমি মধ্যে মধ্যে যেরূপ দেখিয়া লই, ইতিপূর্বে একজন পিয়নের নিকট হইতে আমি সেইরূপে চিঠি সকল দেখিয়া লই তাম, এবং তাহার মধ্যে আমার আবশ্যক মত দুই একখানি পত্র গ্রহণও করিতাম। তাহার পরিবর্তে প্রত্যেক পত্রের নিমিত্ত আমি তাহাকে চারি আনা করিয়া প্রদান করিতাম। এইরূপে সময়ে সময়ে সে আমার নিকট হইতে প্রত্যহ এক টাকা দুই টাকার কার্য করিয়া যাইত।

পিয়ন। সেই সকল পত্র লইয়া আপনি কি করিতেন?

গোবিন্দ। আমি প্রথমে উহা পড়িয়া দেখিয়া পরিশেষে ছিড়িয়া ফেলিয়া দিতাম।

পিয়ন। সেইরূপ পত্র আপনার নিকট দুই একখানি আছে কি?

গোবিন্দ। আমার নিকট এখন আর উহা কোথা হইতে থাকিবে? উহা আমি সেই সময়েই পড়িয়া ছিড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছি।

পিয়ন। আপনার কাৰ্য শেষ হইয়া গেলে, যদি আপনি উহা ছিড়িয়া ফেলিয়া দেন, তাহা হইলে অনায়াসেই আপনাকে ওরূপ পত্র আমরাও প্রদান করিতে পারি। কারণ, সেই পত্র আপনি লইলে পরে যদি অপর কাহারও হস্তে পতিত না হয়, তাহা হইলে তাহা লইয়া কোন গোলযোগের সম্ভাবনা বা আমাদিগের আর কোনরূপ বিপদের আশঙ্কা থাকে না।

গোবিন্দ। সে ভাবনা আর তোমাদিগকে ভাবিতে হইবে। আমার কাৰ্য শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে আমি সেই পত্র নষ্ট করিয়া ফেলিব। যে কাৰ্য্যের নিমিত্ত আমি সেই সকল পত্র গ্রহণ করিব, সেই কাৰ্য্য শেষ করিতে অধিক বিলম্বও হইবে না। সেই পত্রগুলি একবার উত্তমরূপে পড়িয়া লইতে বোধ হয়, অর্ধ ঘণ্টার অধিক সময় লাগিবে না। অর্ধঘণ্টার মধ্যেই আমি সেই পত্র নষ্ট করিয়া ফেলিব।

পিয়ন। তাহা হইলে আপনার যে সকল পত্রের প্রয়োজন হইবে, তাহা সেই পিয়নের ন্যায় আমরাও আপনাকে প্রদান করিব। কিন্তু সাবধান! সঙ্গে সঙ্গে পত্রগুলি বিনষ্ট করিয়া ফেলিবেন।

গোবিন্দ। তাহার আর কোনরূপ সন্দেহ আছে? আমার কাৰ্য শেষ হইবামাত্রই আমি উহা নষ্ট করিয়া ফেলিব। তুমি এই বিষয় অপর পিয়নকেও বলিয়া দিও। বিলি করিবার নিমিত্ত পত্র পাইলেই প্রথমতঃ পত্র গুলি আমাকে দেখাইয়া লইয়া যাইও। উহার মধ্যে যে কোন পত্র আমি লইবার প্রয়োজন বিবেচনা করিব, তাহা লইয়া, তখন আমি প্রত্যেক পত্রের নিমিত্ত, চারি আনা হিসাবে প্রদান করিব।

গোবিন্দের কথায় পিয়ন সম্মত হইল, এবং সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, সমস্ত কথা অপরাপর পিয়নকেও বলিয়া দিল। সেই দিবস হইতেই বিলি করিবার নিমিত্ত উঁহারা যে সকল পত্র ডাকঘর হইতে প্রাপ্ত হইত, তাহার একখানিও বিলি

করিয়া, সর্বপ্রথমে সেই পত্রগুলি লইয়া গোবিন্দের নিকট গিয়া উপস্থিত হইত। উহার মধ্য হইতে যদি কোন পত্র গোবিন্দ গ্রহণ করিত, তাহা হইলে তাহাদের প্রত্যেক পত্রের নিমিত্ত চারি আনা হিসাবে গ্রহণ করিয়া অবশিষ্ট পত্রগুলি যে যে স্থানে বিলি করা আবশ্যক, সেই সেই স্থানে বিলি করিত।

গোবিন্দ যে কেন এইরূপ অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া অপরের পত্র গ্রহণ করিত, তাহার কিছু অর্থ পাঠকগণ বুঝিতে পারিয়াছেন কি? যদি না পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমি আপনাদিগকে বুঝাইয়া দিতেছি।

কলিকাতা সহর আজকাল ঔষধের বিজ্ঞাপনে পরিপূর্ণ। ইহার মধ্যে সকলই যে নিতান্ত অসার ঔষধ, তাহা নহে; তাহার মধ্যে কতকগুলি ঔষধ ভাল বলিয়া লোকে অবগত আছে, এবং সেই সকল ঔষধ একরূপ বিক্রয়ও হইয়া থাকে। পাঠকগণ ইহাও অবগত আছেন যে, মফঃস্বলের লোকই সেই সকল ঔষধ অধিক পরিমাণে ক্রয় করিয়া থাকেন। আরও অবগত আছেন, যে নামে ও ঠিকানায় সেই সকল ঔষধের বিজ্ঞাপন বাহির হয়, সেই সকল নামে ও ঠিকানায় মফঃস্বলের গ্রাহকগণ সেই সকল ঔষধ ভেলুপেয়েবল পোষ্টে পাঠাইবার নিমিত্ত অনুবোধ করিয়া পত্র লিখিয়া থাকেন।

যে সকল পত্রে উক্তরূপে ঔষধ পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত লেখা থাকিত, গোবিন্দচন্দ্র সেই সকল পত্র অন্যান্য পত্রের মধ্য হইতে বাছিয়া বাছিয়া প্রত্যহ দুই চারিখানি গ্রহণ করিত, এবং মফঃস্বল বাসী সেই সকল নিরীহ পোকদিগের নামে সেই ঔষধ বলিয়া অন্য কিছু ভেলুপেয়েবল ডাকে পাঠাইয়া দিয়া তাহার যথেষ্ট মূল্য আদায় করিয়া লইত। বলা বাহুল্য, যিনি প্রকৃত মূল্য দিয়া সেই ঔষধ গ্রহণ করিতেন, তাহার রীতিমত অর্থ ব্যয় হইত; কিন্তু ঔষধের উপকার কিছুমাত্র প্রাপ্ত হইতেন না। সুতরাং অর্থ নষ্টই হইত মাত্র। এইরূপে গোবিন্দচন্দ্র মফঃস্বলবাসী অনেক লোকের সর্বনাশ করিয়া অনেক অর্থ উপার্জন করিয়াছে, এবং এখনও সময় সময় কিছু কিছু করিতেছে।

তিন চারি বৎসর অতীত হইল, এই জুয়াচুরি-কাণ্ড আমা কর্তৃক প্রকাশিত হইয়া পড়ে, এবং অপরের পত্র চুরি করা অপরাধে কয়েকজন পিয়নকেও শ্রীঘরে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু সেই জুয়াচুরি কলিকাতা সহর হইতে যে একবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে, তাহা পাঠকগণ মনে করিবেন না। বিশেষতঃ যে সকল মফঃস্বলের লোক ভেলুপেয়েবল পোষ্টে ঔষধাদি গ্রহণ করিয়া থাকেন, তাঁহারা একটু বিশেষ সতর্ক হইবেন, ইহাই এই প্রবন্ধ-লেখকের প্রধান উদ্দেশ্য; এবং তজ্জন্যই এই ঘটনা-বৰ্ণনার অবতারণা।

.

(খ) হুণ্ডিতে জুয়াচুরি।

যেরূপ ভাবে চিঠি লইয়া পূর্ব্ব-বর্ণিত জুয়াচুরি হইয়া থাকে, হুণ্ডির জুয়াচুরি তাহা অপেক্ষা অধিক ভয়ানক। কিরূপ ভাবে হুণ্ডির জুয়াচুরি হয়, তাহা পাঠকগণকে বলিবার পূর্বে হুণ্ডি যে কি, তাহা বোধ হয়, অনেক পাঠককে বুঝাইয়া দেওয়ার প্রয়োজন হইবে। হুণ্ডি একরূপ বরাতচিঠি মাত্র। মনে করুন, আপনার এলাহাবাদে একটা ব্যবসার স্থান আছে, এবং কলিকাতাতেও একটা স্থান আছে। অপর এক ব্যক্তির এলাহাবাদ হইতে দুই হাজার টাকা কলিকাতায় পাঠাইতে হইবে। মনি-অর্ডার বা অপর কোন উপায়ে সেই টাকা কলিকাতায় পাঠাইতে হইলে, কিছু অধিক পরিমাণে অর্থ ব্যয় করিবার প্রয়োজন হইয়া পড়ে। কিন্তু ইণ্ডির দ্বারা পাঠাইতে হইলে ব্যয় অপেক্ষাকৃত অনেক অল্প হয়। এই নিমিত্ত যে দুই হাজার টাকা তাহার কলিকাতায় পাঠাইয়া দিবার প্রয়োজন, সেই টাকা লইয়া গিয়া তিনি আপনার এলাহাবাদস্থিত গদিতে জমা করিয়া দিলেন, এবং নিয়মিত কমিশনও প্রদান করিলেন। সেই টাকা গ্রহণ করিয়া, আপনি আপনার কলি কাতার গদির নামে একখানি হুণ্ডি লিখিয়া তাহার হস্তে প্রদান করিলেন। আপনি যেমন তাহাকে এলাহাবাদে হুণ্ডি প্রদান করিলেন, অমনি আপনি এই সংবাদ আপনার কলি কাতার গদিতে লিখিয়া পাঠাইলেন। এদিকে যাহার নিকট টাকা পাঠাইবার প্রয়োজন, তাহার নামীয় একখানি পত্রের ভিতর সেই হুণ্ডিখানি তিনি পূরিয়া তাহার নামে কলিকাতায় পাঠাইয়া দিলেন। যাহার নামে সেই হুণ্ডিখানি:আসিল, তিনি সেই হুণ্ডিসহ আপনার কলিকাতার গদিতে গমন করিবামাত্র হুণ্ডির লেখা অনুযায়ী টাকা গুলি তিনি প্রাপ্ত হইলেন। হুণ্ডি সম্বন্ধে আরও অনেক কথা বলিবার আছে; কিন্তু এস্থানে মোটামুটি যাহা বলা হইল, তাহাতেই পাঠকগণ, আলোচ্য ঘটনার অবস্থা উত্তমরূপে বুঝিতে পারিবেন।

যাহা হউক, কিরূপ ভাবে সেই হুণ্ডি সম্বন্ধে নিত্য জুয়াচুরি হইতেছে, তাহাই এখন পাঠকবর্গকে বলিব।

গোবিন্দচন্দ্র যেরূপ ভাবে জুয়াচুরি করিয়া ডাকপিয়নের যোগে জুয়াচুরি ব্যবসা চালাইয়া আসিতেছিল, বড়বাজারের ভিতর সেই প্রকার কয়েকজন লোক আছে, তাঁহারা প্রায় হুণ্ডির জুয়াচুরি ব্যবসা করিয়া, আপন আপন সংসার প্রতিপালন ও বাবুগিরি করিয়া থাকে, মধ্যে মধ্যে জেলে গিয়াও বাস করিয়া থাকে।

বড়বাজার অঞ্চলে যে সকল পিয়ন পত্র বিলি করিয়া থাকে, সেই সকল পিয়নের সহিত উঁহাদিগের প্রণয় অধিক। কারণ, এমন দিনই নাই, যে দিবস সেই অঞ্চলে শত শত হুণ্ডি সম্বলিত পত্র বিলি না হয়। গোবিন্দচন্দ্র যেমন সামান্য চারি আনা দিয়া অপরের পত্র গ্রহণ করে, ইহারা পিয়নদিগকে সেইরূপ ভাবে সামান্য অর্থ প্রদান করে না। গোবিন্দের লভ্য অংশের সহিত তুলনায় ইহাদিগের লভ্য অংশ অনেক অধিক। সুতরাং ইহা দিগের সহিত যে সকল পিয়ন মিলিত আছে, তাহাদিগের উপার্জনও অনেক অধিক।

যে পিয়নের সহিত উঁহাদিগের পরামর্শ আছে, সে বিলি করিবার নিমিত্ত ডাকঘর হইতে পত্র পাইবার পরই, একটা নির্দিষ্ট স্থানে গমন করে। সেই স্থানে তাহাদিগের দলস্থিত কোন

কোন ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ হইলে, তাহার হস্তে সেই পিয়ন তাহার নিজের নির্বাচন অনুসারে দুই একখানি পত্ৰ দিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে।

যাহার হস্ত দিয়া প্রত্যহ শত শত হুণ্ডি সম্বলিত পত্র বিলি হয়, তাহার হস্তে হুণ্ডি-পূরিত ধাম আসিয়া উপস্থিত হইলেই, সে অনায়াসেই অনেকটা উপলব্ধি করিয়া লইতে পারে যে, ইহার ভিতর হুণ্ডি আছে, কি না। সুতরাং সেইরূপ ভাবের দুই তিনখানি পত্র বাছিয়া লইয়া পূর্বোক্ত দলস্থিত কোন ব্যক্তির হস্তে প্রদান করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে। পিয়ন সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে পর, সেই ব্যক্তি সেই পত্র গুলি সবিশেষ সতর্কতার সহিত খুলিয়া দেখে যে, উহার ভিতর প্রকৃতই হুণ্ডি আছে কি না, এবং যদি হুণ্ডি থাকে, তাহা হইলে যে গদি হইতে উহার টাকা আনিতে হইবে, সেই স্থান হইতে সেই টাকা সহজেই প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা কি না। এ সকল বিষয় বিবেচনা করা, আমাদিগের পক্ষে যেরূপ দুরূহ বলিয়া অনুমান কইতেছে, উঁহাদিগের পক্ষে কিন্তু সেরূপ নহে। কারণ, বড় বাজারের ভিতর যত মহাজনের হুণ্ডির কারবার আছে, তাহাদের সমস্তই তাঁহারা অবগত আছে, এবং কাহার গদিতে তাহাদিগের পরিচিত লোক আছে, ও কাহার গদি হইতে সহজেই সেই টাকা বাহির হইবার সম্ভাবনা, তাহাও তাঁহারা অনায়াসেই বুঝিতে পারে। পিয়ন প্রদত্ত পত্র খুলিয়া যদি তাহার ভিতর তাহাদিগের মনের মত হুণ্ডি প্রাপ্ত হয়, তাহা হইলে তাহা উঁহারা গ্রহণ করিয়া সেই পত্র নষ্ট করিয়া ফেলে। অন্যথা সেই সকল পত্র পূর্বের ন্যায় বন্ধ করিয়া পরিশেষে সেই পিয়নের হস্তেই প্রত্যর্পণ করে। তৎপরে পিয়নও সেই পত্র গুলি যথাস্থানে বিলি করিয়া দেয়।

পূৰ্ব্ব-কথিত উপায়ে একখানি হুণ্ডি বাছিয়া লইতে পারিলেই, তাহাদিগের একমাস বা সময় সময় দুই তিনমাসের কার্য্য হইয়া যায়। সুতরাং সেই সময়ের মধ্যে তাহাদিগকে সেইরূপ কার্যে আর হস্তক্ষেপ করিতে হয় না।

পূর্ব্ব-কথিত উপায়ে একখানি হুণ্ডি তাহাদিগের হস্তগত হইলে সেই হুণ্ডি যে কত টাকার, কেবল যে তাহাই তাহার অবগত হইতে পারে, তাহা নহে। কারণ, সেই হুণ্ডির সহিত বে পুত্ৰ থাকে, তাহা পড়িয়া উহা কে পাঠাইতেছে, কোথা হইতে আসিতেছে, কোন্ স্থানে ও কয়দিবস পরে ইহার টাকা পাওয়া যাইবে, তাহার সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া সেই দলস্থিত একটা লোক সেই হুণ্ডিসহ সেই গদিতে গিয়া উপস্থিত হয়। পরে সেই জুণ্ডি সেই স্থানে প্রদান করিলে, তথাকার নিয়ম অনুযায়ী যে টাকা পাইবার কথা, তাহা অনায়াসেই পাইয়া থাকে। এইরূপ উপায়ে একখানি হুণ্ডির টাকা প্রাপ্ত হইতে পারিলে, তাহাদিগের মনো বা উত্তমরূপে পূর্ণ হইয়া থাকে। কারণ, এক একখানি হুণ্ডিতে সময় সময় দশ হাজার পর্যন্ত টাকাও পাওয়া যায়। এইরূপে অসৎ উপায়ে জুয়াচোরগণ যে টাকা বাহির করিয়া লয়, তাহা তাহাদিগের মধ্যে নিয়ম অনুসারে সকলে মিলিয়া বণ্টন করিয়া লয়। ডাকঘরের পিয়নের অংশ, প্রায় অপর সকলের অংশ হইতে অধিক পরিমাণে হইয়া থাকে। এইরূপে একখানি হুণ্ডির টাকা তাহার হস্তগত করিলে পর, কিছু দিবস পৰ্য্যন্ত আর এরূপ কাৰ্যে হস্তক্ষেপ করে না। যে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে হুণ্ডি পাঠাইয়াছেন, যখন তিনি জানিতে পারেন, তাঁহার মুণ্ডির টাকা বাহির হইয়া গিয়াছে, অথচ যাহার পাইবার কথা, তিনি পান নাই, তখন ইহার অনুসন্ধান আরম্ভ হয়, এবং ক্রমে এই জুয়াচুরির বিষয় প্রকাশিত হইয়া পড়ে। কিন্তু প্রায়ই প্রকৃত দোষী ধরা পড়ে না। এইরূপে হুণ্ডির জুয়াচোর কয়েকজন, কয়েকজন পিয়নের সহিত কয়েকবার আমা কর্তৃক ধৃত হয়, এবং দীর্ঘকালের নিমিত্ত কারা বাসে প্রেরিত হইয়াছে; কিন্তু অদ্যাপিও এই জুয়াচুরি বন্ধ হয় নাই।

.

নিলামে জুয়াচুরি।

মফঃস্বলবাসী প্রায় সমস্ত লোকেরই বিশ্বাস যে, সময় সময় কলিকাতায় নিলামে অত্যন্ত সুলভ মূল্যে অনেক মাল বিক্রীত হইয়া থাকে। বাস্তবিক সময়ে সময়ে কোন কোন দ্রব্য নিলামে প্রকৃতই সুলভ মূল্যে বিক্রীত হয়!

জুয়াচুরিই যাহাদিগের ব্যবসা, তাঁহারা কি উপায়ে লোক ঠকাইতে পারিবে, রাত্রিদিন কেবল সেই চিন্তাতেই ঘূরিয়া বেড়ায়। সুলভ মূল্যে নিলামে মাল বিক্রয় হয়, ইহাই মফঃস্বলবাসীগণের বিশ্বাস। এই কথা যেমন জুয়াচোরগণ জানিতে পারিল, অমনি তাঁহারা সহরের মোড়ে মোড়ে এক একটী নিলামের দোকান খুলিয়া বসিল। এইরূপ নিলামের দোকান সহরের মধ্যে এক সময় অনেক গুলি স্থাপিত হইয়াছিল; আজকাল যে সে সমস্ত গুলি একবারে অন্তর্হিত হইয়াছে, তাহা নহে। এই সহরের স্থানে স্থানে এখনও সেইরূপ এক একটী নিলামের দোকান বর্তমান আছে, এবং প্রায়ই তাঁহারা মফঃস্বলবাসী কোন ব্যক্তিকে দেখিতে পাইলে, তাহার নিকট হইতে কিছু না কিছু গ্রহণ করিয়া থাকে। উঁহাদিগের কার্যপ্রণালী এইরূপ;–

রাস্তার ধারে একটা দোকানের মধ্যে অনেকরূপ উত্তম উত্তম দ্রব্যাদি সজ্জিত থাকে। সেই দোকানের সম্মুখে একজন বসিয়া অনবরত ঘণ্টাধ্বনি করিতেছে। দোকানের মধ্যে এক ব্যক্তি সেই সকল দ্রব্যের মধ্যস্থিত কোন একটা দ্রব্য হস্তে লইয়া অপরে যে মূল্য বলিয়াছে, সেই মূল্য বারে বারে উচ্চারণ করিয়া উহার মূল্য-বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করিতেছে। অর্থাৎ একজন কহিল, এক টাকা যে ব্যক্তি সেই দ্রব্য বিক্রয় করিতে বসিয়াছে, সে উহার দাম এক টাকা এক টাকা বলিয়া, যে পর্যন্ত অপর কোন ব্যক্তি উহার অধিক দাম না বলিল, সেই পৰ্য্যন্ত অনবরত সেইরূপেই চীৎকার করিতে লাগিল। অপর কোন ব্যক্তি যেমন তাহার দাম কিছু বাড়াইয়া বলিল, বিক্রেতার সুরও সেইরূপ পরি বর্তিত হইল। এইরূপে যাহার দরের উপর অপর আর কেহ অধিক দাম প্রদান করিতে স্বীকৃত না হয়, সেই দ্রব্য তখন সেই ব্যক্তি তাহার কথিত মূল্যেই পাইয়া থাকে। ইহাই নিলামের পদ্ধতি। কিন্তু এ নিলাম সেই প্রকারের হইলেও, ইহার উদ্দেশ্য স্বতন্ত্র। এই স্থানে প্রকৃত ক্রেতা একজনও নাই, ক্রেতারূপে যে সকল ব্যক্তি দোকানের ভিতর দাঁড়াইয়া বিক্রেয় দ্রব্যের দাম বর্ধিত করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাঁহারা সকলেই একদল-ভুক্ত-জুয়াচোর, কেহবা জুয়াচোরের চাকর। উঁহারা যেমন দেখিল, একজন পল্লীগ্রাম-নিবাসী নিরীহ লোক সেই দোকানের সম্মুখ দিয়া গমন করিতেছে, অমনি তাঁহারা চীংকারস্বরে নিলাম আরম্ভ করিয়া দিল। সেই আগন্তুক ব্যক্তি নিলামের প্রলোভনে ভুলিয়া যেমন দোকানের ভিতর প্রবেশ করিল, অমনি দেখিতে পাইল, একটী লোক প্রয়োজনীয় দ্রব্য—যাহার দাম পাঁচ টাকার কম নহে, তাহা পচ পয়সায় বিক্রয় করিতে বসিয়াছে। এক ব্যক্তি ডাকিল, ছয় পয়সা, অপরে কহিল, নয় পয়সা আগন্তুক ডাকিল, দশ পয়সা। তাহার পর হয় ত আর কেহই ডাকিল না, যদি ডাকিল, কেবল উহার দাম আর এক পয়সা বাড়াইয়া দিল। সেই ব্যক্তি যেমন বার পয়সা ডাকিল, অমনি সকলে চুপ করিল। সুতরাং সেই দ্রব্য যিনি সৰ্বশেষে ডাকিয়াছেন, তাহারই হইল। আগন্তুক সবিশেষ হৃষ্ট অন্তঃকরণে সেই দ্রব্যটী আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া তাহার ব্যাগ হইতে বারটা পয়সা বাহির করিয়া দিল। ব্যাগ হইতে সেই পয়সা বাহির করিবার কালীন জুয়াচোরগণ দেখিয়া লইল, তাহার নিকট আর কত গুলি টাকা আছে। তাহার পরই উহার সহিত গোলযোগ আরম্ভ করিল, যদি উহার নিকট আর সাত টাকা থাকে, তাহা হইলে সেই দ্রব্য-বিক্রেতা বলিয়া উঠিল, কি মহাশয়! কেবল পয়সা বারটী দিলেন, টাকা কয়েকটা দিলেন না? আগন্তুক বিস্মিত হইয়া কহিল, সে কি মহাশয়। টাকা কিসের? উত্তরে বিক্রেতা কহিল, কেন, ওই দ্রব্য যে আট টাকা তিন আনায় বিক্রীত হইয়া গেল। আপনি কি ভাবি তেছেন যে, কেবল তিন আনায় আপনি ওই দ্রব্য প্রাপ্ত হইলেন? দোকানদারের এই কথা শুনিয়া, আগন্তুক একবারে বিস্মিত হইয়া পড়িল। দেখিল, ক্রেতারূপী জুয়াচোরগণও সেই দোকানদারে কথা সমর্থন করিয়া কহিল, দোকানদার মহাশয় যাহা কহিতেছেন, তাহা প্রকৃত। ওই দ্রব্যের বিট প্রথমেই আটটাকা হইতে আরম্ভ হইয়া আট টাকা তিন আনায় বিক্রীত হইয়াছে।

এই কথা শুনিয়া আগন্তুক চতুর্দিক অন্ধকার দেখিল, এবং উঁহাদিগের সকলের ভাব-গতি দেখিয়া অনন্যোপায় হইয়া সেই দ্রব্য গ্রহণ করিতে অসম্মত হই; কিন্তু যখন দেখিল, সেই দ্রব্য গ্রহণ না করিলে তাহার আর উপায় নাই, তখন তাহার নিকট যে সাত টাকা ছিল, তাহা প্রদান করিয়া পরিশেষে অব্যাহতি পাইল। আর যদি সে একটু উগ্রমূর্তি ধারণ করিয়া সেই টাকা প্রদান করিতে অসম্মত হইলে, তাহা হইল সেই দোকানের সমস্ত লোক একত্র হইয়া বল-পূৰ্ব্বক তাহার নিকট যে কিছু অর্থ পাইল, তাহা কাড়িয়া লইয়া তাহাকে সেই স্থান হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিল। অনন্যোপায় হইয়া সে তখন আস্তে আস্তে আপন দেশ অভিমুখে প্রস্থান করিল। আর এইরূপে ঠকিয়া কোন ব্যক্তি যদি কলিকাতাবাসী কোন লোকের পরামর্শ মত থানায় গিয়া নালিশ করিলেন, তাহা হইলে পুলিস-কর্ম্মচারীও তাহার অভিযোগ শ্রবণ করিয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলেন বটে; কিন্তু কাৰ্যে কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সেই পল্লীগ্রাম-নিবাসী লোকটীর সপক্ষে একটীমাত্র ও প্রমাণ সংগৃহীত হইল না। অধিকন্তু জুয়াচোরগণ এক মিলিত হইয়া সেই নিলাম-কার জুয়াচোরের পক্ষ সমর্থন করিয়া, ফরিয়াদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিল, ও ইহাই প্রতিপন্ন করিয়া দিল যে, দোকানদারের কিছুমাত্র অপরাধ নাই; সমস্ত দোষই সেই মফঃস্বল-বাসীর।

এইরূপে কত নিরীহ মফঃস্বলবাসী-লোক সুলভ মূল্যে নিলামে দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে গিয়া নিত্য যে কত জুয়াচোরের হস্তে পড়িতে ছেন, তাহার আর সংখ্যা নাই।

ইহা ব্যতীত মফঃস্বলবাসীগণকে ঠকাইয়া লইবার নিমিত্ত কোন কোন জুয়াচার নিলামের ন্যায় আর এক প্রকার জুয়াচুরির দোকান খুলিয়া বসিয়া আছে, এবং দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়া নিত্য কত লোককে যে ঠকাইতেছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। এই দোকানও নিলামের দোকান-সদৃশ; দোকানের সম্মুখে নিলামের ন্যায় ঘন্টা বাজিয়া থাকে। সেই দোকানে নিলাম হইতেছে ভাবিয়া, মফঃস্বলবাসীগণ প্রায়ই সেই দোকানে প্রবেশ করিয়া থাকেন। সেই দোকানের মধ্যভাগে পাতিত একটা টেবিলের উপর বা দোকানের মধ্যস্থিত গ্লাসকেসের মধ্যে নানা প্রকারের বহুমূল্য দ্রব্য সকল সাজান আছে। উঁহাদিগের কোন দ্রব্যেরই দাম পচিশ টাকার কম নহে, বরং একশত দুইশত টাকা পর্যন্ত হইতে পারে। সেই সকল দ্রব্যের প্রত্যেকগুলিরই উপর কাগজের টিকিটে একটী একটী নম্বর লেখা আছে। যিনি দোকানের অধিকারী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়া থাকেন, তাহার সম্মুখে একটী খোলা বাক্সের মধ্যে কতকগুলি সাদা কার্ড আছে, উহাতেও একটী একটী নম্বর লেখা আছে। তাহার সম্মুখে পূৰ্ব্ব-বর্ণিত নিলামের দোকানের ন্যায় সেই দলের অপর কতকগুলি জুয়াচোর ক্রেতারূপে দণ্ডায়মান হয়। ইহাদিগের মধ্যে আছে-এমন জাতিই নাই। সাহেব আছেন, ইহুদি আছেন, মুসলমান আছেন, বাঙ্গালি আছেন, এক কথায় অনেক জাতির অনেক লোক সেই স্থানে এরূপ ভাবে দেখিতে পাওয়া যায় যে, তাহাদিগের অবস্থা বা চালচলন দেখিয়া, তাহাদিগের সহিত আলাপ পরিচয় করিয়া, কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারেন না যে, উহার জুয়াচোর।

আগন্তুক দোকানের মধ্যে প্রবেশ করিবামাত্রই একজন নিজের পকেট হইতে একটী টাকা বাহির করিয়া সেই দোকানদারের হস্তে প্রদান করিল। দোকানদার তাহার সম্মুখস্থিত সেই খোলা কার্ডের বাক্সটী দেখাইয়া দিয়া কহিল, উহার ভিতর হইতে আপনি একখানি কার্ড বা টিকিট গ্রহণ করুন। তিনি তাহার ভিতর হইতে একখানি টিকিট গ্রহণ করিয়া সেই দোকানদারের হতে প্রদান করিলেন। দোকানদার সেই টিকিটের দিকে একবার লক্ষ্য করিয়া কহিল, আপনার টিকিটের নম্বর এক হাজার দুইশত দুই। এই নম্বর সংযুক্ত যে দ্রব্য এই দোকানে সাজান আছে, তাহা আপনার। এই কথা শুনিয়া তিনি দোকানের ভিতর অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে লাগিলেন, কোন্ দ্রব্যের উপর এক হাজার দুইশত দুই নম্বর আছে। অমনি দোকানদারের আর একজন সাহায্যকারী সেই টেবিলের উপর হইতে একটা সুবর্ণ-নির্মিত একটী ঘড়ি বাহির করিয়া দিল ও কহিল, ইহাই এক হাজার দুইশত দুই নম্বরের দ্রব্য। এই কথা বলিয়া সেই ঘড়িটী তাহার হস্তে প্রদান করিল ও কহিল, আপনার অদৃষ্ট খুব ভাল, এক টাকায় আপনি দুইশত টাকা মূল্যের ঘড়িটা পাইলেন।

ইহার পরই আর একজন আর একটা টাকা দিয়া একখানি টিকিট ক্রয় করিল। সেও একখানি বড়গোছের গেলাস বা আয়না পাইল; তাহার মূল্যও চল্লিশ টাকার কম নহে।

আগন্তুক ব্যক্তি ইহা দেখিয়া, এবং মধ্যে মধ্যে ক্রেতারূপী জুয়াচোরগণের প্রলোভন-যুক্ত বাক্য শুনিয়া তিনিও একটী টাকা বাহির করিয়া একখানি টিকিট ক্রয় করিলেন; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, তিনি মূল্যবান্ দ্রব্যের পরিবর্তে এক পয়সা মূল্যের একটা পেসিল পাইলেন। জুয়াচোরগণের প্রতারণায় পড়িয়া পুনরায় আর একটী টাকা বাহির করিলেন, সে বারে-পাইলেন এক বাণ্ডিল সুচি। তাহার নিকট আঠারটী টাকা ছিল, এইরূপে তাহার অনিচ্ছাসত্বে, অথচ জুয়াচোরগণের প্রতারণায় পড়িয়া ক্রমে ক্রমে তিনি তাহার সেই আঠার টাকাই সেই স্থানে অর্পণ করিলেন; কিন্তু তাহার পরিবর্তে তিনি আঠার পয়সা মূল্যের দ্রব্য পাইলেন কি না, সন্দেহ। যে দোকানে এইরূপ কাণ্ড সকল অহরহ চলিতেছে, জুয়াচোরগণ সেই দোকানের নাম দিয়াছে–মনোরম সখের বাজার। (Fancy Bazar.)।

এইরূপে মফঃস্বলের কত লোক কলিকাতায় আসিয়া যে জুয়া চোরগণের হস্তে পতিত হইতেছে, তাহার সংখ্যা করা নিতান্ত সহজ নহে।

.

বিবাহে জুয়াচুরি।

আজকাল ব্রাহ্মণ ও কায়স্থগণের মধ্যে কন্যার বিবাহ যে কি ভয়ানক ব্যাপার হইয়া দাড়াইয়াছে, তাহা আমার সবিশেষ করিয়া বর্ণন করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। কারণ, পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই এ বিষয়ে সবিশেষরূপে ভুক্ত-ভোগী।

একটী কন্যার বিবাহ দিতে হইলে সময় সময় কন্যা-কর্তাকে তাহার ভদ্রাসন বাটী পৰ্যন্ত বিক্রয় করিতে হয়। সমাজের এরূপ অবস্থা যে পূর্বাপর ছিল, তাহা নহে; পাশ্চাত্য-শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে যে ইহা আমাদিগের দেশে প্রচারিত হইতেছে, তাহা কেহ কেহ অনুমান করিয়া থাকেন। পাশ্চাত্যগণের কন্যার বিবাহে একটী পন্থসামাত্রও ব্যয় নাই, ইহা যখন সৰ্ব্ব-বিদিত, তখন পাশ্চাত্য-শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কেন এরূপ প্রথা আমাদের দেশে প্রচলিত হইল, ইহাই আশ্চর্য্য!

যাহারা পাশ্চাত্য-শিক্ষায় শিক্ষিত, তাঁহার সেইরূপ বা ততোধিক শিক্ষিত ব্যক্তির হস্তে তাহাদিগের কন্যাগণকে প্রদান করিতে যত্নশীল হন। সুতরাং যে সকল বালক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি প্রাপ্ত হন, সেই সকল বালকের উপরই তাহাদিগের প্রধান লক্ষ্য হয়। এইরূপে দুই চারিজনের লক্ষ্য একটী বালকের উপর পতিত হইলেই সেই বালকের পিতা মাতাও সেই সুযোেগ অবলম্বন করিয়া আপনাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া থাকেন। এরূপ অবস্থায় অর্থের প্রতিযোগিতা ভিন্ন কেহই সেই বালককে হস্তগত করিতে পারেন না। এই সকল কারণেই যে বালক বিশ্ববিদ্যালয়ের যেরূপ উচ্চ পদবী প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহার বিবাহে সেইরূপ পরিমাণে অর্থ গ্রহণ করা হইয়া থাকে। এইরূপ অবস্থা হইতেই ক্রমে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সকল বালকেরই প্রায় একরূপ মূল্য (?) স্থির হইয়া পড়িয়াছে, এবং সময় সময় ইহার মধ্যে অনেক প্রকার জুয়াচুরি হইতেও আরম্ভ হইয়াছে। এ সম্বন্ধে পাত্র ও কন্যা উভয় পক্ষেরই একটা একটী জুয়াচুরির বিষয়, পাঠকগণকে সতর্ক করিবার নিমিত্ত নিম্নে বর্ণিত হইল।

(ক) কন্যাপক্ষের জুয়াচুরি।

কন্যার পিতা রামরতন, এই কলিকাতার একজন গৃহস্থ। টাকা-কড়ি অধিক নাই, কোনরূপে সংসারযাত্রা নির্বাহ করিয়া থাকেন মাত্র। নিজের একখানি বাড়ী আছে, তাহার কন্যার বয়ঃক্রম প্রায় বার বৎসর হইল; কিন্তু এ পর্যন্ত তাহার বিবাহের কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারেন নাই। অথচ তাহার ইচ্ছা যে, একটী শিক্ষিত, বা পিতামাতার কিছু সংস্থান আছে, এরূপ একটী পাত্রের হস্তে তাহাকে অর্পণ করেন। তিনি অনেক দিবস পর্যন্ত এইরূপ একটী পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া নিতান্ত জালাতন হইয়া পড়িয়াছিলেন। কারণ, সুবিধা মত সেরূপ পাত্র তিনি জুটাইতে পারিতেছিলেন না। যদিও দুই একটীর সন্ধান পাইতেছিলেন, কিন্তু অর্থাভাবে তাহার পিতামাতার নিকট তিনি অগ্রসর হইতে সমর্থ হইতেছিলেন না। সেইরূপ পাত্রের পিতা মাতার নিকট গমন করিয়া বিবাহের কথা পাড়িতেন সত্য; কিন্তু টাকার ফর্দ দেখিয়া আস্তে আস্তে তিনি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিতেন। পাত্রের পিতামাতা যে পরিমিত অর্থ প্রার্থনা করিতেন, তাহার ভদ্রাসন বাটী পৰ্যন্ত বিক্রয় করিয়া দিলেও, তাহাতে কুলাইত না।

রামরতন যখন বুঝিতে পারিলেন, সৎপথ অবলম্বন করিয়া কোনরূপেই আপন কন্যার নিমিত্ত পাত্রের সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিলেন না, তখন অসৎপথ অবলম্বন করিতেও তিনি আর কোনরূপে কুণ্ঠিত না হইয়া একটা ভাল পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।

এইরূপে দিন কয়েক অনুসন্ধানের পর, তিনি জানিতে পারি লেন যে, তিনি যেরূপ একটী পাত্রের অনুসন্ধান করিতেছেন, তাহা অপেক্ষাও একটী উৎকৃষ্ট পাত্র এক স্থানে আছে; কিন্তু সেই পাত্রের পিতামাতা যেরূপ ভাবে অলঙ্কার-পত্র প্রার্থনা করিয়া থাকেন, তাহাতে কোন পাত্রীরই পিতামাতা সেই অলঙ্কারাদি দিতে স্বীকৃত হইতে পারেন না। সেই জন্যই আজ পৰ্য্যন্ত তাহার বিবাহ হয় নাই।

রামরতন এই সংবাদ পাইয়া সেই পাত্রের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তাহার পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাহার কন্যার বিবাহের কথার উল্লেখ করিয়া কহিলেন, আমি শুনি আছি, আপনি আপনার পুত্রের বিবাহের নিমিত্ত একটী সুরূপা পাত্রীর অনুসন্ধান করিতেছেন। আমার একটী কন্যা আছে, আমার ইচ্ছ, আমি আমার সেই কন্যাটীকে আপনার পুত্রের হস্তে প্রদান করি।

পিতা। উত্তম কথা। আপনার কন্যাটী কেমন? কারণ, আমি সুরূপা কন্যা না পাইলে, আমার পুত্রের বিবাহ দিতে অভিলাষী নহি।

রামরতন। একথা আমি পূৰ্বেই শুনিয়াছি। তাই আমি সাহস করিয়া আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। পিতার নিকট তাহার কন্যামাত্রই সুশ্রী; আমার মেয়ে ভাল একথা সকলেই বলিয়া থাকেন। অতএব আপনি আমার কন্যাটীকে একবার স্বচক্ষে দর্শন করুন, তাহা হইলে আপনি বুঝিতে পারিবেন যে, আমার কন্যা আপনার পুত্রের উপযুক্ত কি না?

পিতা। দেখুন মহাশয়! কন্যা দেখিতে দেখিতে আমি জ্বালাতন হইয়া পড়িয়াছি। সকলেই আসিয়া বলেন, তাঁহার কন্যা খুব সুশ্রী; কিন্তু যখন দেখিতে যাই, তখন দেখি তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা কহিয়াছেন। এইরূপে এ পর্যন্ত আমি যত কন্যা দেখিয়াছি; তাহাদের একটীও প্রায় আমার মনোমত হয় নাই। দুই একটী যাহা মনোমত হয়, তাহার পিতামাতা আমার পুত্রের উপযুক্ত অর্থ প্রদান করিতে চাহেন না। এত ব্যয় করিয়া আমি আমার পুত্রের লেখা পড়া শিখাইয়াছি, সে এবার বি-এ, পাস করিয়া এম-এ, পড়িতেছে। তদ্ব্যতীত এই কলিকাতা শহরে আমার এত বড় বাড়ী, চাকরী না করিলেও রাজার হালে তাহার দিন অতিবাহিত হইবে। এরূপ পাত্রের হস্তে কন্যা দান করা কি যাহার তাহার অদৃষ্টে ঘটিয়া উঠে? কন্যার যে কখনই কষ্ট হইবে না, রাণীর মত সে দিন অতিবাহিত করিতে পারিবে, ইহা কি কন্যার পিতামাতার কম আনন্দের বিষয়? এরূপ অবস্থা অবগত হইয়াও তাঁহারা কিছুমাত্র খরচ করিয়া কন্যা দান করিতে চাহেন না, ইহা কি কম দুঃখের বিষয়!

রামরতন। আপনার কথা প্রকৃত; কিন্তু সকলে কি অর্থের সংকুলান করিয়া উঠিতে পারে?

পিতা। আমি কাহারও নিকট এরূপ অধিক অর্থ চাহি নাই যে, তিনি তাহা দিতে না পারেন। মূল কথা, আজকাল সকলেই ফাকি দিয়া আপন আপন কাৰ্য উদ্ধার করিতে চাহেন। তাহ কি কখন হয়? কিছু খরচ না করিলে, বড় মানুষের বাড়ীতে কি কন্যার বিবাহ দেওয়া যায়?

রামরতন। আপনি কত টাকা প্রার্থনা করিয়াছিলেন?

পিতা। অতি সামান্য। আমি নগদ এক পয়সাও চাহি নাই, তবে কি না, বিবাহে আমাকে যে কিছু সামান্য খরচ করিতে হইবে, তাহা আমি আপন ঘর হইতে করিব কেন? কেবল মাত্র সেই খরচের টাকাটা প্রদান করিলেই হইতে পারিত। তবে গহনা, তাহা ত তাহার কন্যারই থাকিবে।

রামরতন। খরচের নিমিত্ত কত টাকা হইলে হইতে পারে? পি। চারি হাজার টাকার অধিক নহে। রামরতন। অলঙ্কার বলিয়া কি দিতে হইবে?

পিতা। আমি হীরামতি চাহিতেছি না। কন্যাটীর গাত্রে যাহা কিছু সোণার অলঙ্কার পরিবে, তাহার সমস্তই দিতে হইবে।

রামরতন। কত ভরি সোণা হইলে সেই সমস্ত গহনা প্রস্তুত হইতে পারে?

পিতা। অধিক নহে। বোধ হয়, তিনশত ভরি সোেণা হইলেই সকল গহনা হইয়া যাইবে।

রামরতন। মহাশয়! আমি আপনার মনোভাব কতক পরিমাণে অবগত হইলাম। এখন আপনি অনুগ্ৰহ করিয়া একবার আমার কন্যাটীকে অগ্রে স্বচক্ষে দর্শন করুন। কন্যাটী দেখিয়া যদি আপনার মনোনীত হয়, তাহা হইলে তখন দেনা পাওনার বন্দোবস্ত করিব; কিন্তু আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহার মধ্যে কোন কোন বিষয় কিছু কিছু বিবেচনা করিতে হইবে।

পিতা? আপনি কি করিয়া থাকেন? রামতন। সামান্য চাকরী। পিতা। সামান্য চাকরী করিয়া আপনি কিরূপে এত টাকা প্রদান করিতে সমর্থ হইবেন?

রামরতন। সে ভাবনা আমার। যে ব্যক্তি সামান্য চাকরী করে, তাহার কি পৈত্রিক বা অন্য কোন উপায়ে প্রাপ্ত কোন রূপ অর্থ থাকিতে নাই?

পিতা। আচ্ছা মহাশয়! আপনি কল্য প্রাতঃকালে এখানে আগমন করিবেন। আপনার সহিত গমন করিয়া আমি আপনার কন্যাটীকে দেখিয়া আসি।

পাত্রের পিতার কথা শুনিয়া রামরতন বাবু তাহাতে সম্মত হইলেন, এবং পরদিবস প্রাতঃকালে তিনি আসিয়া তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবেন, এইরূপ স্থির করিয়া সেই দিবস সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

রামরতন বাবুর কন্যাটী বেশ সুরূপা। এই নিমিত্তই তাহার মনে মনে বিশ্বাস ছিল যে, কোন বড়লোক তাহার কন্যাটী পাইলে অর্থ না চাহিয়াই তাহাকে গ্রহণ করিবে। এই নিমিত্তই তিনি ভাল পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছিলেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল যে, একটী ভাল পাত্র পাইলে, তাহার নিমিত্ত তিনি সর্বপ্রকারে দুই তিন সহস্র পর্যন্ত টাকা প্রদান করিবেন। এই টাকা যে তিনি সহজে অর্পণ করিতে পারিবেন তাহা নহে, তাহার নিমিত্ত তাহাকে ঋণ-জালে আবদ্ধ হইতে হইবে।

পরদিবস অতি প্রত্যূষে রামরতন বাবু সেই পাত্রের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন; এবং তাহার পিতাকে সঙ্গে করিয়া আপন বাড়ীতে আনিলেন। বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ পূর্ব্ব হইতেই কন্যাটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়া সাজাইয়া রাখিয়াছিলেন। গাত্রের পিতার সহিত আরও দুই তিন জন লোক আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহারা সকলেই কন্যাটীকে উত্তম রূপে দেখিলেন, কন্যা দেখিয়া সকলেই সন্তুষ্ট হইলেন, সকলেরই মনোমত হইল। তাহার মধ্যে একজন প্রকাশ্যে পাত্রের পিতাকে বলিয়াও ফেলিলেন, আমরা আপনার পুত্রের নিমিত্ত এ পর্যন্ত যত পাত্রী দেখিয়াছি, তাহার মধ্যে একটী ও এরূপ সুশ্রী নহে। এই পাত্রীটীর সহিত আপনার পুত্রের বিবাহ দিতে হইবেই হইবে। আপনি অর্থের নিমিত্ত এই পাত্রীকে যেন কোন রূপেই হস্তান্তর করিবেন না।

কন্যা দেখা সমাপ্ত হইলে সকলেই প্রস্থান করিলেন। যাইবার সময় পাত্রের পিতা বলিয়া গেলেন, কল্য বৈকালে আপনি আমার নিকট গমন করিবেন। সেই সময় দেনা পাওনা সম্বন্ধে কথা বার্তা হইবে। পাত্রী আমার মনোনীত হইয়াছে। ইনি খুব সুরূপা না হউন, ইহাকে আমার পুত্রবধূ করিতে আমার কোনরূপ আপত্তি নাই।

পরদিবস কথিত সময়ে রামরতন পাত্রের পিতার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন; এবং তাহাকে কহিলেন, মহাশয়ের যদি পাত্রীটী পসন্দ হইয়া থাকে এবং আমার কন্যার সহিত আপনার পুত্রের বিবাহ দিবার মতও যদি আপনার পরিবারবর্গের হইয়া থাকে, তাহা হইলে আমাকে কি কি আয়োজন করিতে হইবে, তাহা আমাকে বলিয়া দিন; যদি আমার বাধ্য হয়, তাহা হইলে আমি তাহার চেষ্টায় নিযুক্ত হই।

রামরতনের কথা শুনিয়া পাত্রের পিতা কহিলেন, আমি আপ নাকে ত একরূপ পূৰ্বেই বলিয়া দিয়াছি। যদি চাহেন, তাহা হইলে আমি একটী ফর্দ করিয়া আপনাকে দিতেছি। আপনি যদি তাহাতে সম্মত হন, তাহা হইলে আপনি যাহা জানিতে চাহিতেছেন, তাহার সমস্তই স্থির হইয়া যাইবে।

এই বলিয়া তিনি তাহার বাক্স হইতে একটা ফর্দ বাহির করিয়া রামরতনের হস্তে প্রদান করিলেন। সেই ফর্দখানির মৰ্ম্ম এইরূপ;

বরাভরণ–

সোণার ঘড়ি একটী – ৩০০টাকা
সোণার চেন এক ছড়া – ৩০০টাকা
হীরার আংটী একটী – ৫০০টাকা
গার্ডচেন এক ছড়া ২৫ ভরি – ৬২৫টাকা
বেণারসী চেলী এক জোড় – ১০০টাকা

কন্যাভরণ–

সুবৰ্ণ ৩০০ ভরি ২৫টাকা হিসাবে – ৭৫০০ টকা
রৌপ্য ১০০ ভরি – ১০০টাকা
দানসামগ্রী পিত্তল-কাসা এক প্রস্থ – ১০০টাকা
ঐ চাঁদির এক প্রস্থ ১০০০ ভরি – ১০০০টাকা
খাট বিছানা – ২০০টাকা
ফুলশয্যা, নমস্কারী ইত্যাদি – ৫০০টাকা
নগদ – ৪০০১টাকা

মোট – ১৫২২৬টাকা

ফর্দখানি হস্তে পাইবামাত্রই রামরতন বাবু একবারে অবাক্‌। যদি তিনি তাহার যথাসর্বস্ব বিক্রয় করিয়া ফেলেন, তাহা হইলে তিনি উহার অর্ধেক টাকার সংগ্রহ করিতে পারেন, কি না সন্দেহ। কিন্তু এবার রামরতন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই পাত্রের সহিত তিনি তাহার কন্যার বিবাহ দিবেনই, মনে মনে তাঁহার এই প্রতিজ্ঞা।

রামরতন বাবু সেই ফর্দখানি হস্তে করিয়া পাত্রের পিতাকে কহিলেন, মহাশয়! ফর্দটী কিছু অধিক হইয়াছে। আমি আপনাকে যেরূপ বলিতেছি, সেইরূপ নগদ ও সুবর্ণ আদি প্রদান করিতে সম্মত আছি; ইহাতে যদি আপনি সম্মত হয়েন, দেখুন; নতুবা আমাকে আপনার আশা পরিত্যাগ করিতে হয়।

বরাভরণের নিমিত্ত আপনি যে তিনশত টাকা মূল্যের ঘড়ি চাহিয়াছেন, তাহা আমি প্রদান করিতে সম্মত আছি।

সোণার চেন এক ছড়া তিনশত টাকা মুল্যের, তাহাও দিব।

হীরার আংটী পাঁচশত টাকা মুল্যের তাহাও আমি দিতে প্রস্তুত আছি।

গার্ডচেন এক ছড়া পঁচিশ ভরি ওজনের কমে যদি না হয়, তাহা হইলেও উহা আমাকে প্রদান করিতে হইবে। কিন্তু বেনারসী চেলী আমি প্রদান করিতে পারিব না।

কন্যাভরণের নিমিত্ত সুবর্ণ তিনশত ভরি আমি প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। উহাতে যে যে অলঙ্কার প্রস্তুত করিতে হইবে, তাহা আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিবেন, আমি সেই সকল গহনা প্রস্তুত করিয়া দিব। কেবল সুবর্ণ বা তাহার মূল্য বলিয়া নগদ কোন অর্থ আমি আপনাকে প্রদান করিব না।

রৌপ্য একশত ভরি আমি প্রদান করিব না। চল্লিশ ভরি দিয়া কেবলমাত্র মল প্রস্তুত করিয়া দিব।

পিত্তল-কাসার দানসামগ্রী এক প্রস্থ আমি প্রদান করিব; কিন্তু তাহার মূল্য চল্লিশ পঞ্চাশ টাকার অধিক হইবে না।

চাঁদির বাসন এক প্রস্থ এক হাজার ভরি প্রদান করা আমার পক্ষে অসম্ভব। তবে যদি আপনি একান্তই না ছাড়েন, তাহা হইলে কাজেই আমাকে উহা প্রদান করিতে হইবে।

খাট বিছানা আমি প্রদান করিতে পারিব না। উহা দিবার রীতি আমাদিগের নাই।

নমস্কারী ও ফুলশয্যার নিমিত্ত পাঁচশত টাকা প্রদান করা আমার পক্ষে একবারে অসম্ভব। সেই সকল খরচের নিমিত্ত জোর আমি একশত টাকা প্রদান করিতে পারি।

নগদ যে চারি হাজার এক টাকা চাহিয়াছেন, উহা আমাকে একবারেই ছাড়িয়া দিতে হইবে। নগদ টাকা আমি একবারেই প্রদান করিতে পারিব না। নিতান্ত না ছাড়েন, চারিশত এক টাকা প্রদান করিব।

বরের পিতা দেখিলেন, তিনি যাহা যাহা চাহিয়াছিলেন, রামরতন প্রায় তাহাতেই স্বীকৃত হইলেন, অপরাপর দ্রব্যের মধ্য হইতে কেবল কমাইলেন—একশত টাকা মূল্যের চেলী, রৌপ্য ষাট টাকা, পিত্তল-কাসা পঞ্চাশ টাকা, খাট বিছানা দুইশত টাকা ও নমস্কারী প্রভৃতি চারিশত টাকা, মোট আটশত দশ টাকা। কিন্তু নগদ টাকা প্রায় দিতে চাহিতেছেন না। অপরাপর দ্রব্যের নিমিত্ত তিনি একরূপ সম্মত হইলেন। কিন্তু নগদ টাকা একবারে পরিত্যাগ করিতে কিছুতেই সম্মত হইলেন না। অনেক কসা-মাজার পর চারি হাজার এক টাকার পরিবর্তে এক হাজার পাঁচশত এক টাকায় তিনি সম্মত হইলেন।

দেনা-পাওনার বিষয় স্থির হইয়া গেলে, কত ওজনের কি কি অলঙ্কার প্রস্তুত করিতে হইবে, রামরতন তাহার একটী তালিকা লইয়া আপন স্থানে প্রস্থান করিলেন। বিবাহের দিন স্থির হইল। উভয়পক্ষেই বিবাহের উদ্যোগ আরম্ভ হইল। রামরতন অলঙ্কার-পত্ৰ সকলের বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন।

যাহার এত টাকার সঙ্গতি নাই, তিনি কিরূপে এই সকল অলঙ্কার-পত্রের সংগ্রহ করিলেন, তাহা কি পাঠকগণ অবগত হইতে চাহেন?

সোণার ঘড়ির পরিবর্তে চল্লিশ টাকা মূল্যের একটী রৌপ্য ঘড়ি ক্রয় করিয়া তাহাতে সুবর্ণের গিটি করিয়া লইলেন। চেন, গার্ডচেন, অলঙ্কার প্রভৃতি যাহা যাহ, সুবর্ণের দ্রব্য দেওয়ার কথা ছিল, তাহার সমস্তই পিত্তলের ক্রয় করিয়া, তাহা ভাল করিয়া সোণার গিলটি করাইলেন। হীরার আংটীর পরিবর্তে একটী উৎকৃষ্ট পোকরাজের বা নকল হীরার আংটী ক্রয় করি লেন। রৌপ্যের দানসামগ্রীর বন্দোবস্তও সেইরূপ করিলেন, কম মূল্যে জৰ্ম্মণ সিভারের বাসন সকল প্রস্তুত করিয়া লইলেন। প্রকৃত দ্রব্যের মধ্যে কেবল প্রদান করিলেন, চল্লিশ ভরির মল, চল্লিশ টাকা মুল্যের পিত্তল-কাঁসা, এবং নগদ এক হাজার ছয়শত এক টাকা। পিত্তলের দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া তাহাতে গিটি প্রভৃতি করাইতেও প্রায় তাহার দুইশত টাকা ব্যয়িত হইল। ইহার উপর বরযাত্রীদিগকে আহার-আদি করাইতে তাহার যে টাকা ব্যয়িত হইল, তাহার সৰ্ব্বশুদ্ধ হিসাব করিলে, একুশ শত কি বাইশ শত টাকার মধ্যেই তাহার সমস্ত খরচ সম্পন্ন হইয়া গেল।

দেখিতে দেখিতে শুভ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া গেল। বিবাহের পর নববধূ লইয়া বরের পিতা আপন স্থানে গমন করিলেন। ক্রমে তাঁহার সাধ্যমত পাকস্পর্শ প্রভৃতি কাৰ্য্য সকলও শেষ হইয়া গেল। এই সকল কাৰ্য শেষ হইয়া যাইবার প্রায় একমাস পরে বরের পিতা জানিতে পারিলেন যে, রামরতন বাবু তাহাকে সম্পূর্ণরূপে ঠকাইয়াছেন। এই ব্যাপার জানিতে পারিয়াই তিনি ক্রোধে একবারে অধীর হইয়া পড়িলেন, ও রামরতন বাবুকে ডাকাইয়া তাঁহাকে কহিলেন, এরূপ ভাবে আমাকে প্রতারণা করা কি আপনার কর্তব্য হইয়াছে? উত্তরে রামরতন বাবু কহিলেন, এরূপ প্রতারণা না করিলে, আপনার পুত্রের সহিত আমার কন্যার বিবাহ কি কোনরূপে সম্পন্ন হইতে পারিত? অত টাকা আমি কোথায় পাইব যে, কন্যার সহিত অত টাকা আমি আপনাকে প্রদান করিতে পারি? আপনার সহিত এরূপ জুয়াচুরি করিয়াও, আমাকে যে টাকা ব্যয় করিতে হইয়াছে, তাহাতেও আমি অপরের নিকট ঋণগ্রস্ত। এখন যাহা হইবার হই আছে, যাহা করিবার করিয়াছি! এখন আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যে আপনাকে আর একটীমাত্র পয়সাও এখন প্রদান করিতে পারি, সে ক্ষমতা আমার নাই। এখন অনুগ্রহ করিয়া আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, এই আমার প্রার্থনা।

উত্তরে পাত্রের পিতা কহিলেন, ক্ষমা! তাহা আমার দ্বারা কখনই হইবে না। আমার প্রাপ্য টাকাগুলি এখন আপনি আমাকে প্রদান করুন, তাহা হইলে আমি আপনাকে ক্ষমা করিতে পারি। নতুবা কখনই আমি আপনাকে ক্ষমা করি না।

রামরতন। আমি ত আপনাকে পূর্বেই বলিয়াছি যে, আর একটা মাত্র পয়সাও আমি আপনাকে প্রদান করিতে পারি না। ইহাতে চাই আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আর নাই করুন।

উত্তরে বৈবাহিক পুনরায় কহিলেন, ক্ষমা ত কিছুতেই আম। হইতে হইবে না। আমার প্রাপ্য টাকা প্রদান না করিলে আপনার উপর নালিশ করিয়া, আমি আপনাকে কারাগারে প্রেরণ করিব; এবং পরিশেষে আপনার কন্যাকে পরিত্যাগ করিয়া আমার পুত্রের পুনরায় বিবাহ দিব।

আপনার যাহা ইচ্ছা হয়, তাহা আপনি করিতে পারেন। এই বলিয়া রামরতন সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

বরের পিতা বড় মানুষ হইলেও, অর্থ-লালসা তাঁহার অতিশয় বলবতী। সুতরাং তিনি সেই অর্থের আশা একবারে পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না। মুখে যাহা বলিয়াছিলেন, কার্যেও তাহাই করিলেন। রামরতন বাবু তাহাকে প্রতারণা করিয়াছেন বলিয়া, তিনি তাহার নামে এক ফৌজদারী মোকদ্দমা আরম্ভ করিলেন। রামরতন বাবু কন্যার বিবাহের নিমিত্ত একে ত জুয়াচুরি করিয়া ছিলেন; যখন দেখিলেন, তাহার বিপক্ষে ফৌজদারী মোকদ্দমা উপস্থিত করা হইয়াছে, তখন তিনি মিথ্যা বলিতে আরম্ভ করিলেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তিনি কহিলেন, ধর্মাবতার! আমি আমার যথা-সৰ্বস্ব বিক্রয় করিয়া স্বর্ণ-অলঙ্কার প্রভৃতি যাহা কিছু আমার দিবার কথা ছিল, তাহা আমি সমস্তই প্ৰদান করিয়াছি। বিবাহের পর দিবস আমার বাড়ী হইতে আমার কন্যাকে লইয়া যাইবার পূর্বে, আমার বৈবাহিক মহাশয় আমার প্রদত্ত সমস্ত অলঙ্কার গুলি উত্তম রূপে স্বচক্ষে দেখিয়া লন; কিন্তু তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া পরিশেষে একজন স্বর্ণকারকে ডাকাইয়া সকলের সম্মুখে গহনাগুলি ওজন ও যাচাই করিয়া লন। সেই স্বর্ণকার এখন পর্যন্ত বর্তমান আছে। বিশেষতঃ যাহাদিগের সম্মুখে সেই সকল গহনা যাচান হইয়াছিল, তাঁহারাও এখন পর্যন্ত বর্তমান। আবশ্যক হইলে তাঁহারা সকলেই আপনার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সাক্ষ্য প্রদান করিতে প্রস্তুত। মহাশয়! দুঃখের কথা বলিব কি, আমার বৈবাহিক মহাশয় আমার নিকট হইতে আরও কিছু অর্থ প্রার্থনা করেন। সেই অর্থ প্রদানে আমি অসমর্থ হওয়ায়, আমার সহিত উহার মনান্তর উপস্থিত হয়; এবং পরিশেষে আমি আমার মেজাজ ঠিক রাখিতে না পারিয়া, অনেকের সম্মুখে উহাকে গালি প্রদান করি। উহার প্রতিশোধ লইবার মানসে, আজ তিনি আপনার নিকট আমার নামে এই মিথ্যা অভিযোগ আনয়ন করিয়াছেন।

রামরতন বাবু মুখে যাহা কহিলেন, কাৰ্যেও তাহাই করিলেন। আর কিছু অর্থ ব্যয় করিয়া একজন স্বর্ণকার ও অপর কয়েকজন ভদ্রবেশী লোক দিয়া, সেইরূপ ভাবেই সাক্ষ্য প্রদান করাইলেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবও তাহার কথা বিশ্বাস করিয়া তাহাকে অব্যা হতি প্রদান করিলেন। রামরতন হাসিতে হাসিতে আপন গৃহে গমন করিলেন।

রামরতন বাবুর বৈবাহিক মোকদ্দমা হারিয়া নিতান্ত দুঃখিত মনে আপন বাড়ীতে গমন করিলেন, এবং মনে মনে স্থির করি লেন, রামরতন বাবু যদি তাঁহাকে সেই সকল অর্থ প্রদান না করেন, তাহা হইলে তিনি তাহার কন্যাকে আর আনিবেন না; এবং পুনরায় অন্য স্থানে আপনার পুত্রের বিবাহ দিবেন।

মনে মনে এই কথা স্থির করিয়া, একদিবস তিনি তাঁহার মনের ভাব তাহার স্ত্রীর নিকট কহিলেন। কিন্তু বালিকাটী অতিশয় সুরূপা ছিল বলিয়া, তাঁহার স্ত্রী তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। ক্রমে সেই কথা তাহার পুত্রেরও কর্ণগোচর হইল; পুত্রীও পুনরায় বিবাহ করিতে অসম্মত হইলেন। কাজেই তাহার মনের দুঃখ মনেই রাখিয়া রামরতন বাবুর কন্যাকে পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করিতে হইল। এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইলে পর, রামরতন বাবু আপন বৈবাহিকের সহিত কিছুদিবস পর্যন্ত তোমোদ করিয়া চলিতে লাগিলেন। পরিশেষে সকল গোলযোগ মিটিয়া গেল। রামরতন বাবু এইরূপে জুয়াচুরি করিয়া আপন কাৰ্য্য উদ্ধার করিয়া লইয়াছিলেন।

(খ) বরপক্ষের জুয়াচুরি।

সনাতন বাবু দালালী করিয়া চিরকাল আপন জীবিকা নিৰ্বাহ করিয়া আসিয়াছেন। এখন তাহার বয়স একটু অধিক হওয়া-প্রযুক্ত, আর অধিক পরিশ্রম করিতে পারেন না। সুতরাং তাঁহার আয় পূর্ব্ব হইতে অনেক কমিয়া আসিয়াছে। তাহার তিন পুত্র। প্রথমটীর বয়ঃক্রম প্রায় ত্রিশ বৎসর হইবে, তাহার বিবাহ হইয়া গিয়াছে, একটী পুত্র ও জন্মিয়াছে। কোন একটা সওদাগরি আফিসে মাসিক সত্তর টাকা বেতনে তিনি কৰ্ম্ম করিয়া থাকেন। অধিক পরিমাণে লেখাপড়া শিক্ষা করা তাহার ভাগ্যে পটিয়া উঠে নাই। এন্টেন্স পাস করিয়া কিছুদিবস এল-এ, পৰ্য্যন্ত পড়িয়াছিলেন। কিন্তু কোন কারণ বশতঃ লেখাপড়া পরিত্যাগ করিয়া তাহাকে চাকরীতে প্রবৃত্ত হইতে হয়।

সনাতন বাবুর দ্বিতীয় পুত্রের নাম সতীন্দ্রনাথ। তাহার বয়ঃক্রম প্রায় সাতাশ বৎসর। লেখাপড়া কিছুমাত্র শিক্ষা করে নাই। কোন কাষ কৰ্ম্মের চেষ্টা যে করিতে হয়, তাহা তাহার মনে একদিবসের নিমিত্তও কখন উদিত হয় নাই। বাড়ী হইতে কোনরুপে অর্থ সংগ্রহ করিয়া সুরাপান ও বেশ্যালয়ে গমন করাই তাহার জীবনের একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য। তাহার বিবাহ হয় নাই। সনাতন বাবু তাহার বিবাহের নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিয়া ছিলেন; কিন্তু তাহার চরিত্র দেখিয়া, বা তাহার বিষয় লোক মুখে শুনিয়া এ পর্যন্ত কেহই তাহাকে আপন কন্যা প্রদান করিতে সম্মত হন নাই। সতীন্দ্রের গুণের মধ্যে এই ছিল যে, সে অতিশয় মিষ্টভাষী, সকলের সহিত বেশ মিলিতে পারিত, ও ভদ্ৰ-বাবহারে সকলকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিত।

সনাতনের তৃতীয় পুত্রের নাম শচীন্দ্রনাথ। অতিশয় বুদ্ধিমান্, এখনকার কালে লেখাপড়ায় যতদূর উৎকৃষ্ট হইতে হয়, তাহা হইয়াছে। এণ্টেন্স হইতে আরম্ভ করিয়া, এল-এ, বি-এ, এম-এ প্রভৃতিতে সর্বোচ্চ হইয়া আসিয়াছে। এবার স্টুডেন্টশিপ পরীক্ষায় পাস হওয়াতে, তাহাকে দশ হাজার টাকা পারিতোষিক দিবার জন্য শিক্ষা বিভাগ আদেশ প্রদান করিয়াছেন।

এই সংবাদ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইবার পরই শচীন্দ্রের সহিত নিজ নিজ কন্যার বিবাহ দিবার নিমিত্ত চারিদিক হইতে কন্যাকৰ্ত্তাগণ সনাতনের বাটীতে আসিতে আরম্ভ করিলেন। কেহবা বংশের প্রলোভন দেখাইয়া, কেহবা অর্থের প্রলোভন দেখাইয়া, এবং কেহ সুশ্রী বালিকার প্রলোভন দেখাইয়া, সনাতন বাবুর নিকট শচীন্দ্রের বিবাহের কথা উত্থাপন করিতে লাগিলেন। সনাতন বাবু পুরাতন দালাল। তিনি কাহাকেও কোনরূপে অসন্তুষ্ট না করিয়া, বা কাহাকেও কোনরূপ পরিষ্কার উত্তর না দিয়া, সকলকেই হাতে রাখিলেন।

পূর্বে তিনি সতীন্দ্রনাথের বিবাহের নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিয়া ছিলেন; কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। এখন শচীন্দ্রনাথের বিবাহের উপলক্ষে তাহার মনে নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। প্রথম চিন্তা, এই সময় পুনৰ্বার সতীন্দ্রনাথেরও বিবাহের চেষ্টা করেন। একটী বড় বালিকার সহিত তাহার বিবাহ দিতে না পারিলে, উহার চরিত্র সংশোধনের আর কোনরূপ উপায় নাই। দ্বিতীয় চিন্তা, শচীন্দ্র নাখের বিবাহের সময় উপস্থিত হইয়াছে। এই সময়ে তাহার বিবাহ দেওয়াও সম্পূর্ণরূপে কৰ্তব্য; কিন্তু তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সতীন্দ্রনাথের বিবাহ অগ্রে না হইলে কনিষ্ঠের বিবাহই বা হিন্দু হইয়া কিরূপে প্রদান করিতে পারেন।

এইরূপ ও অন্যান্য নানা চিন্তায় তিনি একবারে অধীর হইয়া পড়িলেন; কিন্তু আপনার মনের ভাব কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া, কোন্ উপায় অবলম্বন করিলে, চারিদিক বজায় রাখিতে পারেন, কোন দিকে কোন গোলযোগ না হইয়া, সুশৃঙ্খলার সহিত তাহার মনের অভিলাষ সফল করিতে পারেন, কেবল সেই চিন্তাতেই আপন মন নিযুক্ত করিলেন।

সনাতন অনেকরূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিলেন যে, জুয়াচুরি ভিন্ন কোনরূপেই তিনি সতীন্দ্রনাথের বিবাহ দিতে পারেন না। সুতরাং পুত্রের বিবাহের নিমিত্ত জুয়াচুরি-ব্যবসা অবলম্বন করিতেও তিনি কোন প্রকারেই কুষ্ঠিত হইলেন না। বিশেষতঃ তিনি মনে মনে যেরূপ জুয়াচুরির উপায় স্থির করিলেন, তাহা কাৰ্য্যে পরিণত করিতে পারিলে যে, কেবলমাত্র তিনি তাঁহার দুশ্চরিত্র পুত্র সতীন্দ্রনাথের বিবাহ দিতে পারিবেন, তাহা নহে; সেই সঙ্গে সঙ্গে কন্যাপক্ষীয় লোকের নিকট হইতে তিনি কিছু অর্থও সংগ্রহ করিতে পারিবেন। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, এখন হইতে যে কোন ব্যক্তি শচীন্দ্রনাথের বিবাহের প্রস্তাব করিতে তাঁহার নিকট আগমন করিতে লাগিলেন, তাহাদিগের মধ্যে কন্যাকৰ্ত্তার অবস্থা ও বুদ্ধিমত্তার অভাব বিবেচনায় শচীন্দ্রনাথের পরিবর্তে সতীন্দ্রনাথকে দেখাইয়া, তাহারই বিবাহের কথা ঠিক করিতে লাগিলেন।

বিবাহের কথাবার্তা ঠিক করিবার পূর্বে সনাতন যে কন্যাকর্তা দিগকে একটু চালাক-চতুর বিবেচনা করিলেন, বা যাহারা আইন-কানুন অবগত আছেন, এরূপ বুঝিলেন, এবং যে সকল ব্যক্তিকে বড়লোক বলিয়া জানিতে পারিলেন, তাহা দিগের নিকট তাহার স্থিরীকৃত জুয়াচুরি-সংশ্লিষ্ট বিবাহের প্রস্তাব করিতে সাহসী হইলেন না। যে মধ্যবিত্ত লোকদিগকে নিতান্ত নিরীহ বলিয়া তাহার বিশ্বাস হইল, তাহাদিগের সহিতই সেই জুয়াচুরি-বিবাহের কথাবার্তা ঠিক করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

সনাতন মনে মনে যেরূপ ভাবিতেছিলেন, কার্যেও ঠিক সেইরূপ জুটিয়া গেল। একদিবস তিনি আপন বাড়ীতে বসিয়া আছেন, এরূপ সময় একটী লোক আসিয়া তাহার বাড়ীতে উপ স্থিত হইলেন। সনাতনকে দেখিয়া তিনি কহিলেন, মহাশয়! আপনার একটী পুত্র এবার ষ্টুডেন্টশিপ পরীক্ষায় পাস হইয়াছে, একথা কি প্রকৃত?

সনাতন। হাঁ। কেন মহাশয়!!

আগন্তুক। আপনি নাকি তাহার বিবাহের নিমিত্ত চেষ্টা করিতেছেন?

সনাতন। হাঁ, অনেকেই তাহার বিবাহের নিমিত্ত আমার নিকট আসিতেছেন।

আগন্তুক। আপনার সেই পুত্রের নাম কি?

সনাতন। শচীন্দ্রনাথ।

আগন্তুক। আপনি বলিলেন, শচীন্দ্রনাথের বিবাহের নিমিত্ত অনেকেই আপনার নিকট আগমন করিতেছেন; কিন্তু তাহার বিবাহের স্থির হইতেছে না কেন?

সনাতন। আমি মনোমত কন্যা পাইতেছি না বলিয়া, এ পর্যন্ত বিবাহের ঠিক হয় নাই।

আগন্তুক। আপনি কিরূপ কন্যা চাহেন? সনাতন। কন্যাটী বড় চাহি, এবং বেশ সুশ্রী চাহি।

আগন্তুক। পুত্রবধূ করিতে সুশ্রী কন্যা পিতা মাত্রই অনু সন্ধান করিয়া থাকেন; কিন্তু বড় কন্যা চাহিতেছেন কেন?

সনাতন। আমার পুত্রটীর বয়ঃক্রম একটু অধিক হইয়াছে, তাহাতেই একটী বড়গোছের বালিকার অনুসন্ধান করিতেছি। নতুবা মানাইবে কেন?

আগন্তুক। আপনার পুত্রটীর বয়ঃক্রম কত হইয়াছে?

সনাতন। পঁচিশ বৎসর।

আগন্তুক। এ অধিক বয়স কি? আপনি কত বড় বালিকা চাহেন?

সনাতন। হিন্দুর ঘরে যত বড় সেয়ানা কন্যা থাকিতে পারে।

আগন্তুক। বার বৎসরের অধিক বয়স্কা কন্যা হিন্দুর ঘরে কখনই আপনি পাইবেন না।

সনাতন। বার বৎসর হইলেই যথেষ্ট হইল; কিন্তু কন্যাটা বেশ সুশ্রী হওয়া আবশ্যক। কেন মহাশয়! আপনি এত কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন?

আগন্তুক। আমি কন্যাদায়গ্রস্ত বলিয়াই আপনার নিকট আসিয়াছি।

সনাতন। আপনার কন্যাটা কেমন? এবং তাহার বয়সই বা এখন কত হইয়াছে?

আগন্তুক। আপনি যেরূপ চাহিতেছেন, তাহাই। আমার কন্যা এগার বৎসর অতিক্রম করিয়া, বার বৎসরে উপনীত হই আছে। দেখিলে জানিতে পারিবেন, এরূপ সুশ্রী কন্যা এক হাজার কন্যার মধ্যে একটী পাওয়া যায় কি না। এই নিমিত্ত আমার প্রার্থনা, আপনি আমার সেই কন্যাটীকে একবার স্বচক্ষে দর্শন করুন।

সনাতন। আপনার নিবাস কোথায়?

আগন্তুক। বর্ধমান জেলার অন্তর্গত * * গ্রামে।

সনাতন। আচ্ছা মহাশয়! আপনি কল্য আমার নিকট আগমন করিবেন, হয় আমি নিজে আপনার সহিত গমন করিব, হয়, অপর কোন এক ব্যক্তিকে আপনার সহিত যাইতে বলিব, তিনি গিয়া দেখিয়া আসিলেই হইবে।

আগন্তুক। আমি সাহস করিয়া বলিতে পারি, আমার কন্যা যিনি দেখিবেন, তাহারই মনোনীত হইবে। কিন্তু পূর্বে একবার দেনা-পাওনার কথাটী বলিলে হইত না? তাহা হইলে আমি জানিতে পারিতাম, সেই পরিমিত টাকার সংস্থান করিবার ক্ষমতা আমার আছে কি না।

সনাতন। কন্যা মনোনীত হইলে, দেনা-পাওনার নিমিত্ত ততটা বাধা রহিবে না। তবে কি না, যেরূপ বিদ্বান্ বালকের হস্তে আপনি কন্যাদান করিতে প্রবৃত্ত হইতেছেন, তাহাতে একবারেই যে কিছু লাগিবে না, তাহা নহে। অগ্রে কন্যা মনোনীত হউক, তাহার পর সকল বিষয় সহজেই মিটিয়া যাইবে।

আগন্তুক। আচ্ছা মহাশয়? তাহাই হইবে। আমি কল্য অতি প্রত্যূষে আপনার নিকট আগমন করিব; কিন্তু আমার ইচ্ছা, আপনি নিজে গিয়া আমার কন্যাটীকে স্বচক্ষে দর্শন করেন।

সনাতন। আচ্ছা দেখিব, পারি যদি আমি নিজেই যাইব।

আগন্তুক। মহাশয়! আমি আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।

সনাতন। কি?

আগন্তুক। আপনার পুত্রটী এখন কোথায়?

সনাতন। বাড়ীতেই আছে।

আগন্তুক। তাহাকে একবার আমি দেখিতে পাই কি?

সনাতন। কেন পাইবেন না? আপনি যাহাকে জামাতা করিতে চাহিতেছেন, তাহাকে দেখিতে পাইবেন না, একথা কি হইতে পারে? আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি তাহাকে আপনার সম্মুখে এখনই আনিতেছি।

এই বলিয়া সনাতন বাটীর ভিতর প্রবেশ করিলেন, এবং কিছু পরেই তাঁহার সেই মূখ ও বেশ্যাসক্ত পুত্র সতীন্দ্রনাথকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া, তাহাকে কহিলেন, মহাশয়! ইনিই আমার পুত্র। আমি অনেক কষ্টে ইহাকে লেখা পড়া শিখাইয়াছি। ইনিই এবার দশ হাজার টাকা পারিতোষিক পাইয়াছেন।

সনাতনের এই কথা শুনিয়া আগন্তুক একবার তাহার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করিলেন, এবং তাহাকে কহিলেন, বাবা! তোমার নাম কি?

সতীন্দ্রনাথ অবলীলাক্রমে কহিল, আমার নাম শচীন্দ্রনাথ। সে যে এই মিথ্যা কথা আপনার ইচ্ছানুযায়ী কহিল, তাহা নহে। পিতার শিক্ষামতই সে তাহার মিথ্যা নাম বলিয়া আপনার পরিচয় প্রদান করিল।

আগন্তুক পাত্র দেখিয়া সন্তুষ্ট হইলেন ও কহিলেন, বেশ ছেলে। সনাতনকে কহিলেন, আপনি বলিতেছিলেন, আপনার পুত্রের বয়স কিছু অধিক হইয়াছে। কৈ, আমার বিবেচনায় ইহার বয়ঃক্রম কিছুমাত্র অধিক হয় নাই; বিবাহের উপযুক্ত বয়সই এখন হইয়াছে। আমার কন্যার সহিত ইহাকে বেশ মানাইবে। এই বলিয়া তিনি সতীন্দ্রকে কহিলেন, যাও বাবা। তুমি এখন বাড়ীর ভিতর গমন কর। সতীন্দ্রনাথ সেই স্থান হইতে উঠিয়া অন্য স্থানে প্রস্থান করিল।

সতীন্দ্রনাথ দেখিতে নিতান্ত মন্দ ছিল না। তাহাকে দেখিয়া আগন্তুকের বেশ পসন্দ হইল। তাহার উপর সে যেরূপ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত শুনিলেন, তাহাতে এরূপ পাত্রকে কে পসন্দ না করিয়া থাকিতে পারে?

পরদিবস সনাতন কন্যার পিতার সহিত বর্ধমানে গমন করিয়া কন্যাটী দেখিয়া আসিলেন। দেখিলেন, কন্যাটী অতি সুরূপা, ও বয়ঃক্রম প্রায় তের বৎসর। কন্যাটা দেখিয়া সনাতন তাহার পিতাকে কহিলেন, আপনার কন্যাটী সুশ্রী, ইহাকে আমি আমার পুত্রবধূ করিতে পারি। কিন্তু এখন দেনা-পাওনার বিষয়টা কি হইবে?

কন্যার পিতা। আমার অবস্থা ত আপনি স্বচক্ষে দেখিয়া গেলেন। আপনাকে এখানে আনিবার আমার প্রধান উদ্দেশ্য, আমার অবস্থা আপনাকে দেখান। এখন বিবেচনা-মত আপনি যাহা কহিবেন, তাহাই আমি আপনাকে প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। কারণ, আপনার পুত্রের সদৃশ বিদ্বান্ পাত্রের হস্তে কন্যা সমৰ্পণ করিতে কোন ব্যক্তি পরাজুখ হয়েন? তবে আমার প্রতি একটু অনুগ্রহ করিবেন, এই প্রার্থনা।

সনাতন। দেখুন মহাশয়। আমার পুত্র নিজেই দশ হাজার টাকা পারিতোষিক পাইয়াছে। কনটী যখন আমার একরূপ পসন্দ হইয়াছে, তখন টাকার নিমিত্ত আমি তত পীড়াপীড়ি করিব না। তবে এখন বিবেচনা মত আপনি নিজেই বলিয়া দিন, আপনি অলঙ্কার-পত্র প্রভৃতি সমস্ত দ্রব্যের জন্য মোট আমাকে কত টাকা দিতে পারিবেন?

কন্যার পিতা। মহাশয়! সৰ্ব্ব শুদ্ধ আমি এক হাজার পাঁচশত টাকা আপনাকে প্রদান করিব। ইহাতেই অনুগ্রহ করিয়া আমার উপর আপনাকে সদয় হইয়া, কন্যাদায় হইতে আমাকে উদ্ধার করিতে হইবে।

সনাতন। অত কম টাকায় কিরূপে আপনি এইরূপ সুপাত্র পাইতে পারেন? আমি অধিক টাকা চাহিতেছি না, সর্ব শুদ্ধ আমাকে দুই হাজার পাঁচশত টাকা প্রদান করিবেন।

সনাতনের এই কথা শুনিয়া কন্যার পিতা অনেক তোষামোদ করিয়া পরিশেষে সনাতনকে দুই হাজার টাকায় সম্মত করাইলেন।

ক্রমে বিবাহের সমস্ত ঠিক হইয়া গেল। সনাতন কন্যাকর্তার জাতি-কুল সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলেন, জাত্যাদির বিষয়ে কোনরূপ গোলযোগ নাই। কন্যার পিতাও  সে সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করিলেন, তিনিও জাতি-কুল সম্বন্ধে কোনরূপ দোষ বাহির করিতে পারিলেন না। কন্যাপক্ষীয়গণ আরও একটু অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারি লেন যে, সেই বৎসর সনাতনের পুত্র শচীন্দ্রনাথ প্রকৃতই স্টুডেন্টশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া দশ হাজার টাকা পারিতোষিক পাইয়াছে।

উভয় পক্ষের ভিতরের অনুসন্ধান শেষ হইয়া গেল। তখন উভয় পক্ষের মতানুসারে বিবাহের দিন স্থিরীকৃত হইল। সনাতন উদ্যোগ করিয়া যাহাতে অতি শীঘ্র এই বিবাহ দেওয়াইতে পারেন, তাহাই করিয়া আসিতেছিলেন। কারণ, বিলম্ব হইলে, পাছে তাহার জুয়াচুরির কথা প্রকাশ হইয়া পড়ে; সেই ভয়ে, তিনি বত নিকটে বিবাহের দিন পাইলেন, তত নিকটেই দিনস্থির করিলেন। দুইদিন পরেই দিন হইল। বিবাহের পূৰ্ব্ব-দিবসেই আয়ুবৃদ্ধান্ন প্রভৃতি সমস্ত কাৰ্য শেষ হইয়া গেল। বিবাহের দিবস সকাল সকাল বর লইয়া গিয়া বিবাহ-কাৰ্য্য সম্পন্ন করাই লেন। দূর-পথের ভান করিয়া সনাতন নিজের নিতান্ত নিকট অর্ক্সীয় অর্থাৎ যাহাদের না পাইলে কাৰ্য উদ্ধার হইবে না, তাহাদের দুই চারিজনমাত্রকে বরযাত্রী স্বরূপে লইয়া গিয়াছিলেন। যাহা হউক, যথানিয়মে বিবাহ শেষ হইয়া গেল।

এখানে বলা বাহুল্য যে, সনাতনের তৃতীয় পুত্র ষ্টুডেন্টশিপ পরীক্ষোত্তীর্ণ শচীন্দ্রনাথের সহিত এ বিবাহ হইল না; সেই দুশ্চরিত্র মধ্যম পুত্র সতীন্দ্রনাথের সহিত হইয়া গেল।

এখন পাঠক! বুঝিতে পারিলেন যে, এইরূপ জুয়াচুরি করিয়া সনাতন আপনার মূখ, লম্পট ও সুরাপায়ী পুত্রের বিবাহ দিয়া দুই সহস্র টাকা গ্রহণ করিলেন।

বিবাহের সময় কন্যার পিতা প্রকৃত কথা কিছুই জানিতে পারিলেন না। বিবাহের প্রায় দুই তিনমাস পরে তিনি যে কিরূপ জুয়াচোরের হস্তে পতিত হইয়া চিরদিবসের নিমিত্ত আপন কন্যার সর্বনাশ-সাধন করিয়াছেন, তাহা অবগত হইতে পারি লেন। কিন্তু হিন্দুর বিবাহ! সুতরাং সমস্তই তাহাকে সহ করিয়া থাকিতে হইল।

সনাতনের ভাগ্যবলেই হউক, বা কন্যার পিতার মনোকষ্টের নিমিত্তই হউক, অথবা সুকুমারী বালিকার অদৃষ্টক্রমেই হউক, বিবাহের পর হইতেই সতীন্দ্রনাথের চরিত্রের পরিবর্তন আরম্ভ হইল। সে সুরা পরিত্যাগ করিল, বেশ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করিয়া বৈষয়িক কার্যে আপনার মন নিযুক্ত করিল, এবং একটা ব্যবসা। আরম্ভ করিয়া তাহা হইতেই বেশ দশ টাকা উপার্জন করিতে লাগিল।

কিছুদিবস পরে প্রকৃত শচীন্দ্রনাথেরও বিবাহ হইয়া গেল। এই বিবাহে কন্যার্তার নিকট হইতে সনাতন প্রায় ছয় সাত হাজার টাকা গ্রহণ করিলেন।

———-
* ষ্টুডেন্টশিপ পরীক্ষার পারিতোষিক, কোম্পানীর কাগজের সুদ কমিয়া যাওয়ার নিমিত্ত এখন আট হাজার টাকা হইয়াছে; কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় উক্ত পরীক্ষার পারিতোষিক দশ হাজার টাকা ছিল।

সম্পূর্ণ।

 রাণী না খুনি? (প্রথম অংশ)

রাণী না খুনি? (প্রথম অংশ)
(অর্থাৎ অপরিচিত ব্যক্তিকে বিশ্বাস করিবার চুড়ান্ত ফল!)
Detective STORIES Vol, 80. দারোগার দপ্তর ৮০ম সংখ্যা।
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ । সন ১৩০৫ সাল। অগ্রহায়ণ।
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.

দারোগার দপ্তর।
রাণী না খুনি?

প্রথম পরিচ্ছেদ।

একদিবস সন্ধ্যার সময় আমাদিগের সদর আফিস হইতে কাগজ পত্র আসিবার পর দেখিলাম, অপরাপর কাগজ-পত্রের সহিত একখানি দরখাস্ত আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। সেই দরখাঙ্কের সত্যাসত্যের বিষয় অনুসন্ধান করিবার তার আমার উপর ন্যস্ত আছে। দরখাস্তখানি আমি আদ্যোপান্ত পাঠ করিলাম। দেখি লাম, বড়বাজারের একজন প্রধান জহরত-ব্যবসায়ী এই দরখাস্ত করিতেছেন। সেই দরখাস্তের মৰ্ম্ম এইরূপ–

আজ কয়েকদিবস অতীত হইল, কতকগুলি জহরত খরিদ করিকার নিমিত্ত, একজন রাণী আমাদিগের দোকানে আগমন করিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত কালীবাবু নামক একজন লোক ছিল, তিনি জহরতের দালাল, কি রাণীজির লোক, তাহা আমরা অবগত নহি। দালালি করিতে ইতিপূর্বে আমরা কখন তাহাকে দেখি নাই, অথচ রাণীজির সহিত তাহাকে কথা কহিতে শুনি আছি। রাণীজি একখানি গাড়িতে করিয়া আমাদিগের দোকানে আগমন করিয়াছিলেন সত্য; কিন্তু তিনি গাড়ি হইতে অবতরণ করেন নাই, বা আমাদিগের সহিত কোনরূপ কথাবার্তাও কহেন নাই। তাহার যাহা কিছু বলিবার প্রয়োজন হইয়াছিল, তাহার সমভিব্যাহারী সেই কালীবাবুর প্রমুখাৎই তিনি সমস্ত বলিয়াছিলেন। রাণীজি আমাদিগের দোকানে আসিয়া কতকগুলি জহরত খরিদ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, এবং কতকগুলি জহরতও দেখিতে চাহেন। সেই সকল জহরতের মধ্য হইতে প্রায় দশ হাজার টাকার মূল্যবান্ কয়েকখানি জহরত পসন্দ করিয়া বলিয়া যান, সেই সকল জহরত যেন তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। সেই স্থানে জহরত লইয়া কোন ব্যক্তি গমন করিলে, তিনি সেই সকল দ্রব্য নগদ মুল্যে গ্রহণ করিবেন, এবং আরও যদি কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হয়, এরূপ মনে করেন, তাহাও তাহাকে বলিয়া দিবেন। এই কথা বলিয়া রাণীজি প্রস্থান করেন। কিন্তু তাঁহার সহিত কালীবাবু নামক যে লোকটা আগমন করিয়াছিলেন, তিনি আমাদিগের ললাকে রাণীজির বাড়ীতে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবার মানসে সেই স্থানেই অপেক্ষা করেন। আমাদিগের দোকানের অতিশয় বিশ্বাসী রামজী লাল নামক যে একজন বহু পুরাতন কৰ্মচারী ছিলেন, তিনি সেই জহরত লইয়া কালীবাবুর সহিত একখানি গাড়িতে প্রস্থান করেন। সেই সময় হইতে আর রামজীলাল প্রত্যাবর্তন করেন নাই, বা জহরত কি তাহার মূল্যও এ পর্যন্ত পাঠাইয়া দেন নাই। আমরা এ পর্যন্ত নানা স্থানে রামজীলালের অনুসন্ধান করিয়াছি, তাঁহার্য দেশে পৰ্য্যন্ত টেলিগ্রাফ করিয়াছি; কিন্তু কোন স্থান হইতেই তাহার কোনরূপ সংবাদ প্রাপ্ত হই নাই। এখন আমরা বুঝিতে পারিতেছি না যে, রামজীলালের ও তাহার নিকটস্থিত সেই বহুমূল্য জহরতগুলির অবস্থা এখন কি হইয়াছে। এই নিমিত্ত এই আবেদনপত্রের দ্বারা সরকারের সাহায্য গ্রহণ করিতেছি, তাঁহারা অনুসন্ধান করিয়া, যাহাতে রামজীলাল ও জহরতগুলির অনুসন্ধান হয়, তাহার চেষ্টা করুন। বলা বাহুল্য, এই অনুসন্ধান করিতে যে সকল খরচ-পত্রের প্রয়োজন হইবে, তাহা আমরা প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি।

এই দরখাস্তের অনুসন্ধানের ভার আমার উপর ন্যস্ত হইলে, আমি কিন্তু সেই রাত্রিতে উহার অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম না। পরদিবস হইতে উহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, মনে মনে এইরূপ স্থির করিলাম; কিন্তু কালীবাবু ও রামজীলাল সম্বন্ধে নানাপ্রকার তর্ক আসিয়া মনে উপস্থিত হইতে লাগিল।

একবার ভাবিলাম, রামজীলাল নিশ্চয়ই একজন সামান্য বেতনের কৰ্ম্মচারী হইবেন, দশ হাজার টাকা মূল্যের জহরত তাহার হস্তে একবারে পতিত হইয়াছে, এ লোভ সম্বরণ করা তাহার পক্ষে কতদুর সম্ভব? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, রামজীলাল যে ধনীর কাৰ্য করিয়া থাকেন, তিনি নিজেই বলিতেছেন যে, রামজীলাল একজন। বহু পুরাতন ও অতি বিশ্বাসী কর্ম্মচারী। যদি তাহার কথা প্রকৃত হয়, তাহা হইলে অনেক সময় তাহার হস্তে যে অনেক অর্থ আসিয়া পড়ে, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। এরূপ অবস্থায় এই সকল জহরত বা তাহার মুল্য গ্রহণ করিয়া পলায়ন করা রামজীলালের পক্ষে কতদুর সম্ভব, তাহা স্থির করিয়া উঠা নিতান্ত সহজে নহে।

দ্বিতীয়ত, যে রাণীজি জহরত খরিদ করিতে আগমন করিয়া ছিলেন, তিনিই বা কে? এবং তাঁহার সমভিব্যাহারে কালীবাবু নামক যে ব্যক্তি আগমন করিয়াছিলেন, তিনিই বা কে? রাণীজি যদি প্রকৃতই রাণীজি হইবেন, তাহা হইলে তিনি নিজে বাজারে জহরত খরিদ করিতেই বা আসিবেন কেন? বাড়ীতে বসিয়া সংবাদ পাঠাইলেই ত অনেক বড় বড় জহুরী তাহার নিকট জহরত লইয়া যাইত। আর যদি তিনি নিজেই জহরত খরিদ করিবার মানসে বাজারে আসিলেন, তাহা হইলে কেবলমাত্র এক কালীবাবু ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি তাহার সহিত আগমন করিল না কেন? আর কালীবাবু তাহার নিজের লোক, কি বাজারের দালাল, তাহারই বা ঠিকানা কি? কালীবাবু যদি তাহার নিজের লোকই হইবেন, তাহা হইলে তাহাকে দোকানে পরিত্যাগ করিয়া তিনি কেবলমাত্র সহিস-কোচবানের সঙ্গেই বা গমন করিলেন কিরূপে? আর যদি কালীবাবু বাজারের দালালই হইবেন, তাহা হইলে রাণীজি তাহার সহিত বাজারে আসিতে কিরূপে সাহসী হইলেন? এরূপ অবস্থায় ইহার ভিতরের কথা অনুমান করা নিতান্ত সহজ ব্যাপার নহে। তবে রাণীজি যদি কোন রাজবংশীয়া দুশ্চরিত্রা স্ত্রীলোক হন, তাহা হইলে এইরূপ ভাবে অনায়াসেই তিনি বাজারে আদিতে সমর্থ হইবেন; কিন্তু প্রকৃত রাণী এরূপ ভাবে বাজারে আসিতে কখনই সাহসী হইতে পারেন না। আরও এক কথা, রামজীলাল যদি প্রকৃতই জহরতগুলি বিক্রয় করিয়া প্রস্থান করিয়া পাকেন, এবং কালীবাবু যদি তাহার সহিত এই অসৎকার্যে মিলিত না থাকেন, অথচ কালীবাবু যদি প্রকৃতই একজন দালাল হন, তাহা হইলে দালালী লইবার প্রত্যাশায় কালীবাবু সেই জহরতের দোকানে এ পর্যন্ত আর প্রত্যাবর্তন করিলেন না কেন? আবার মনে হইল, আজকাল রাজা বা রাণী সাজিয়া যে সকল ভয়ানক ভয়ানক জুয়াচুরি হইয়া থাকে, ইহা সেই প্রকারের কোন একরূপ জুয়াচুরি নয় ত? যদি তাই হয়, যদি সেইরূপ ভাবে কোনরূপ জুয়াচুরি হইয়া থাকে, তাহা হইলে রামজীলাল কোথায় গমন করিল? ইহার অনুসন্ধানের ভিতর বড়ই গোলযোগ আসিয়া উপস্থিত হইতেছে; এক কথা ভাবিতে গেলে, অপর আর একটা কথা মনে আসিয়া সমস্ত চিন্তাকেই সন্দেহে পরিণত করিয়া দিতেছে। এ সম্বন্ধে আর কোন কথা ভাবিব না, কল্য প্রাতঃ কাল হইতে ইহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব। অনুসন্ধানে যে সকল বিষয় অবগত হইতে পারিব, তখন তাহার উপর নির্ভর করিয়া সবিশেষরূপ বিবেচনা করিয়া দেখিব, এই অনুসন্ধান আমার দ্বারা সুচারুরূপে সম্পন্ন হইতে পারে কি না। যদি কৃতকার্য হইব মনে করি, তাহা হইলে ইহাতে সম্পূর্ণরূপে হস্তক্ষেপ করিব। নতুবা উৰ্দ্ধতন কর্ম্মচারীগণকে বলিয়া, এই অনুসন্ধানের ভার অপরের  হস্তে প্রদান করিব। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সেই রাত্রিতে এ সম্বন্ধে আর কোন বিষয় চিন্তা করিব না, ইহা স্থির করিলাম; কিন্তু কাৰ্য্যে তাহা পরিণত করিতে পারিলাম না।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

পরদিবস প্রত্যূষেই আমি এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম। থানা হইতে বহির্গত হইয়া, প্রথমেই দরখাস্তকারী জহরত-ব্যবসায়ীর দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সময় আমি দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় যাহার দোকান, তিনি দোকানে উপস্থিত ছিলেন না। কয়েকজন কর্ম্মচারী কেবল মাত্র দোকানে উপস্থিত ছিলেন। আমি কে, এবং কি নিমিত্ত সেই স্থানে গমন করিয়াছি, তাহা অবগত হইবার পর, দোকানের একজন কর্ম্মচারী আমাকে সঙ্গে করিয়া সেই দোকানের স্বত্বাধি কারীর নিকট লইয়া গেলেন। সেই সময় তিনি আপনার বাড়ীতে উপস্থিত ছিলেন। আমার পরিচয় ও সেই স্থানে আমার গমনের কারণ অবগত হইয়া, সবিশেষ যত্নের সহিত তিনি আমাকে বসা ইলেন, এবং তাহার দোকানের যে কর্ম্মচারী আমার সহিত সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহাকে তাঁহার দোকানে প্রত্যাবর্তন করিতে কহিলেন। আদেশমাত্র কর্ম্মচারী সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। কর্ম্মচারী প্রস্থান করিবার পর, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, যে কাৰ্য্যের নিমিত্ত আমি দরখাস্ত করিয়াছিলাম, সেই কাৰ্যের অনুসন্ধানের ভার কি আপনার উপর অর্পিত হইয়াছে?

আমি। তাহারই অনুসন্ধান করিবার মানসে আমি এই স্থানে আগমন করিয়াছি।

ধনী। আমি যে সকল কথা দরখাস্তে লিখিয়াছি, তাহা আপনি উত্তমরূপে পড়িয়া দেখিয়াছেন কি?

আমি। আমি উহা বেশ করিয়া পড়িয়া দেখিয়াছি, এবং বরখাস্তখানি আমার সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি।

এই বলিয়া আমার পকেট হইতে সেই দরখাস্তখানি বাহির করিয়া, আমার সম্মুখে রাখিয়া দিলাম, এবং তাঁহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি দরখাস্তে যে সকল বিষয় লিখিয়াছেন,

তদ্ব্যতীত আর কোন কথা আমাকে বলিতে চাহেন কি?

ধনী। যাহা কিছু আমার বলিবার, তাহা আমি এই দরখাস্তে ব্যক্ত করিয়াছি। তদ্ব্যতীত আর কোন বিষয় যদি আপনি অবগত হইতে চাহেন, তাহা আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি যতদূর জানি, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি।

আমি। যে সময় রাণীজি জহরত খরিদ করিবার মানসে কালী বাবুর সমভিব্যাহারে আপনার দোকানে আগমন করিয়াছিলেন, সেই সময় আপনি নিজে বোধ হয়, দোকানে উপস্থিত ছিলেন না?

ধনী। সেই সময় আমি নিজে দোকানে উপস্থিত ছিলাম। যাহা কিছু হইয়াছিল, তাহার সমস্তই আমার সম্মুখে হইয়াছিল।

আমি। রাণীজিকে কি আপনি দেখিয়াছিলেন?

ধনী। তাহাকে আমরা কেহই দর্শন করি নাই। তিনি গাড়ির ভিতরে ছিলেন, গাড়ি হইতে তিনি বহির্গত হন নাই, বা গাড়ির আবরণও উন্মুক্ত করা হয় নাই।

আমি। যে গাড়ির ভিতর রাণীজি ছিলেন বলিতেছেন, সেই গাড়ির ভিতর কোন লোক যে ছিল, তাহা আপনারা কোনরূপে ভাল করিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলেন কি?

ধনী। গাড়ির ভিতর যে লোক ছিল, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। যদিও আমরা তাহাকে স্পষ্ট দেখি নাই; কিন্তু তাহার পরিহিত বস্ত্রাদির কিয়দংশ মধ্যে মধ্যে আমরা দেখিয়াছিলাম, এবং তাঁহার বেশ স্পষ্ট স্পষ্ট কথাও আমরা শুনিতে পাইয়াছিলাম।

আমি। আপনারা তাহার কথা শুনিয়া, তাহাকে স্ত্রীলোক বলিয়াই অনুমান করিয়াছিলেন?

ধনী। তিনি যে স্ত্রীলোক, তদ্বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

আমি। তাহার কথা শুনিয়া তাহাকে কোন্ দেশীয় স্ত্রীলোক বলিয়া অনুমান হয়?

ধনী। তাহা আমরা স্থির করিতে পারি নাই। কারণ, তাহার সমভিব্যাহারী সেই কালীবাবুর সহিত যখন তিনি কথা বলিয়াছিলেন, তখন বাঙ্গালা কথাই বলিয়াছিলেন; কিন্তু আমরা তাহাকে যে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তাহার উত্তরে, এবং মধ্যে মধ্যে আমাদিগকে যে দুই একটী অপর কোন জহরত দেখাইতে বলিয়াছিলেন, তাহা হিন্দী ভাষায় বলিয়াছিলেন। কিন্তু সে হিন্দী বেশ পরিষ্কার হিন্দী নহে, যেন বাঙ্গালার সহিত মিশ্রিত বলিয়া আমার অনুমান হইয়াছিল।

আমি। রাণীজি যে গাড়িতে ছিলেন, সেই গাড়ির ভিতর অপর আর কেহ ছিল?

ধনী। তাহা আমরা বুঝিতে পারি নাই। সেই গাড়ির ভিতর অপর আর কাহাকেও দেখি নাই, বা অপর আর কোন ব্যক্তির কোনরূপ কথাও শুনিতে পাই নাই।

আমি। তিনি কোন স্থানের রাণী, তাহা কিছু আপনাকে বলিয়াছিলেন কি?

ধনী। তিনি আমাকে বলেন নাই; কিন্তু কালীবাবু বলিয়া ছিলেন। যে স্থানের নাম তিনি উল্লেখ করিয়াছিলেন, তাহা আমায় মনে নাই, সেই স্থানের নাম ইতিপূৰ্বে আর কখনও শুনি নাই। সেই নামটী মনে করিবার নিমিত্ত সবিশেষরূপ চেষ্টাও করিয়াছি। কিন্তু কিছুতেই মনে করিয়া উঠিতে পারি নাই।

আমি। রাণীজি যে গাড়িতে আগমন করিয়াছিলেন, কালী বাবুও কি সেই গাড়িতে আসিয়াছিলেন?

ধনী। না, রাণীজি একখানি জুড়িগাড়িতে আসিয়াছিলেন। কালীবাবু আসিয়াছিলেন-একখানি কম্পাস গাড়িতে।

আমি। উহা কি ঘরের গাড়ি বলিয়া অনুমান হয়?

ধনী। না, আমার বোধ হয়, উহা ঘরের গাড়ি নয়; আড়গোড়ার গাড়ি।

আমি। আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন যে, উহা আড়গোড়ার গাড়ি?

ধনী। সেই গাড়ির সহিস-কোচবানের পোষাক ও পরিচ্ছদ দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইতেছে যে, সেই গাড়ি নিশ্চয়ই কোন এক আড়গোড়ার।

আমি। দুইখানি গাড়িই কি আড়গোড়ার গাড়ি বলিয়া অনু মান হয়?

ধনী। দুইখানিই এক আড়গোড়ার গাড়ি। দুইখানি গাড়ির সহিস-কোচবানদিগের পোষাক-পরিচ্ছদ একই প্রকারের।

আমি। রামজীলাল আপনার কে?

ধনী। রামজীলাল সম্পর্কে আমার কেহই হন না; কিন্তু তিনি আমার জহরতের দোকানের সর্বপ্রধান কর্ম্মচারী।

আমি। কতদিবস হইতে তিনি আপনার দোকানে কল্প করিতেছেন?

ধনী। রামজীলাল আমার একজন বহু পুরাতন কর্ম্মচারী; প্রায় ত্রিশ বৎসর তিনি আমার দোকানে কৰ্ম্ম করিতেছেন।

আমি। তাঁহার স্বভাব-চরিত্র কিরূপ?

ধনী। তাঁহার স্বভাব-চরিত্রও যেরূপ ভাল, তিনি বিশ্বাসীও সেইরূপ। আমার বোধ হয়, আমি আমাকে যতদূর বিশ্বাস করিতে না পারি, তাহা অপেক্ষা অধিক তাহাকে বিশ্বাস করিতে পারি। আমার দোকানের লক্ষ লক্ষ টাকার দ্রব্যাদি সমস্তই তাহার হস্তে, তিনি মনে করিলে ইহার সমস্তই অনায়াসেই আত্মসাৎ করিতে পারেন। কিন্তু তিনি এতদূর বিশ্বাসী যে, আজ পর্যন্ত একটা পয়সাও তাঁহা কর্তৃক অপহৃত হয় নাই।

আমি। রামজীলাল যদি আপনার এতদূর বিশ্বাসী কর্ম্মচারী, তাহা হইলে সেই দশ হাজার টাকার জহরত লইয়া তিনি কিরূপে প্রস্থান করিলেন?

ধনী। রামজীলাল যে সেই জহরত লইয়া পলায়ন করিয়া ছেন, তাহা কখনই সম্ভব হইতে পারে না। এরূপ কথা আমি কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে পারি না।

আমি। তবে রামজীলাল কোথায় গমন করিলেন?

ধনী। আমিও তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হয়, রামজীলাল কোনরূপে বিপদগ্রস্ত হইয়াছেন বলিয়া প্রত্যাবর্তন করিতে পারিতেছেন না।

আমি। সে যাহা হউক, রামজীলাল যে সকল জহরত লইয়া গিয়াছেন, তাহার কোনরূপ তালিকা প্রস্তুত করিয়াছেন কি?

ধনী। না, তাহা করি নাই। যদি আবশ্যক হয়, তাহা হইলে এখনই আমি উহা প্রস্তুত করিয়া দিতে পারি।

আমি। তাহা হইলে অনুগ্রহপূর্বক একটী সবিশেষ বিবরণ যুক্ত তালিকা প্রস্তুত করিয়া এখনই আমাকে প্রদান করুন।

আমার কথা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ জহরতগুলির সবিশেষ বিবরণ যুক্ত একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া কর্ম্মচারী আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি সেই তালিকা আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আচ্ছা, সেই সকল জহরত যদি অপরাপর জহরতের সহিত একত্র পুনরায় আপনাকে দেখাই, তাহা হইলে চিনিতে পারিবেন ত?

ধনী। জহরতগুলি যেরূপ অবস্থায় আমার এই স্থান হইতে লইয়া গিয়াছে, সেইরূপ অবস্থায় যদি উহা না থাকে, তাহা হইলে উহার প্রত্যেক পাথরের মতি প্রভৃতি পৃথক পৃথক অবস্থায় অপর প্রস্তর প্রভৃতির সহিত মিশ্রিত করিয়া আমার সম্মুখে আনিবেন, দেখিবেন, আমার দ্রব্য আমি তাহার ভিতর হইতে অনায়াসেই বাছিয়া লইতে সমর্থ হইব।

জহরত-বিক্রেতার নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া সেইদিবস আমি তাহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় আমার মনে হইল, দোকানদার রামজীলালের চরিত্র সম্বন্ধে যেরূপ ভাবে বর্ণন করিলেন, তাহাতে রামজীলালের উপর এই সকল জহরত অপহরণ করা সম্বন্ধে কিরূপে সন্দেহ করিতে পারি? যে ব্যক্তি লক্ষ লক্ষ টাকা লইয়া আপন ইচ্ছানুযায়ী সমস্ত কাৰ্য্যের বন্দোবস্ত করেন, অথচ যাহার কার্যের নিমিত্ত মনিব কখনও একবারেরও নিমিত্ত দৃষ্টিপাত করেন না, সেই ব্যক্তি কেবলমাত্র যে দশ হাজার টাকা মূল্যের জহরত লইয়া পলায়ন করিবে, তাহা কিন্তু সহজে মনে স্থান দিতে পারা যায় না।

যাহা হউক, দোকানদারের নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া আমি থানায় প্রত্যাবর্তন করিলাম। ভাবিলাম, একটু পরেই পুনরায় এই অনুসন্ধানে বহির্গত হইয়া যাইব; কিন্তু কার্যে তাহা ঘটিল না। সেই সময় কোন একটী সবিশেষ প্রয়োজনীয় রাজ্য-সম্বন্ধীয় সরকারী কাৰ্য আসিয়া আমার হস্তে উপস্থিত হইল। সুতরাং বর্তমান কার্যের অনুসন্ধান সেই সময় আমাকে পরিত্যাগ করিতে হইল। আমি সেই কাৰ্য্যের অনুসন্ধান সেই সময় পরিত্যাগ করিলাম সত্য; কিন্তু সেই অনুসন্ধান একবারে বন্ধ হইল না। অপর আর একজন কর্ম্মচারীর হস্তে এই অনুসন্ধানের ভার অর্পণ করিয়া, যতদূর আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত বিবরণ আমি তাহাকে বুঝাইয়া দিলাম। তিনি তাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত বহির্গত হইলেন, আমিও সেই সবিশেষ প্রয়োজনীয় সরকারী কার্যের অনুসন্ধানে বহির্গত হইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে লাগিলাম।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

গবর্ণমেন্টের যে কাৰ্য্য সম্বন্ধে আমাকে নিযুক্ত হইতে হইয়াছিল, সেই কাৰ্য শেষ করিতে আমার প্রায় দুই তিনদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। সেই কাৰ্য্য সমাপনান্তে আমি থানায় প্রত্যাবর্তন করিয়া, যে কর্ম্মচারীর হস্তে রামজীলাল সম্বন্ধীয় অনুসন্ধানের ভার অৰ্পণ করিয়া গিয়াছিলাম, তাহাকে ডাকিলাম। ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আমি যে কাৰ্য্যের ভার আপনার হস্তে অৰ্পণ করিয়া গিয়াছিলাম, সেই কাৰ্য্য আপনি কতদূর সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইয়াছেন?

কর্ম্মচারী। অনুসন্ধান প্রায় আমি একরূপ শেষই করিয়া রাখিয়াছি, এখন আসামীকে ধরিতে পারিলেই হইল।

আমি। আসামী কে?

কর্ম্মচারী। রামজীলাল।

আমি। তার অপরাধ?

কর্ম্মচারী। অপরাধ, তাহার মনিবের টাকা আত্মসাৎ করা।

আমি। তাহা হইলে ইহাই সাব্যস্ত হইয়াছে যে, রামজীলাল সেই সকল জহরত লইয়া পলায়ন করিয়াছে?

কর্ম্মচারী। না, সেই সকল জহরত লইয়া রামজীলাল পলায়ন করে নাই। সেই সকল জহরত বিক্রয় করিয়া তাহার মূল্য লইয়া রামজীলাল পলায়ন করিয়াছে।

আমি। এ সম্বন্ধে বেশ প্রমাণ পাইয়াছেন?

কর্ম্মচারী। তাহার বিপক্ষে বেশ প্রমাণ আছে; মাজিষ্ট্রেট সাহেবও তাহার কতক প্রমাণ গ্রহণ করিয়া রামজীলালের নামে

ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া দিয়াছেন।

আমি। ভালই হইয়াছে। সেই ওয়ারেন্ট এখন কোথায়?

কর্ম্মচারী। আমার নিকটেই আছে।

আমি। সেই ওয়ারেন্ট আমাকে প্রদান করিবেন। তাহাকে ধরিবার নিমিত্ত আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব; আপনিও আপনার চেষ্টার ত্রুটি করিবেন না।

কর্ম্মচারী। সেই ওয়ারেন্টখানি এখনই আমি আপনাকে প্রদান করিব কি?

আমি। এখনই আমাকে প্রদান করিতে হইবে না; কিন্তু আপনি কিরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন, এবং রামজীলালের বিপক্ষে কিরূপ প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা আমি পূর্বে একবার জানিতে ইচ্ছা করি।

কর্ম্মচারী। উত্তম কথা। আমি যাহা যাহা করিয়াছি, তাহা আপনাকে বলিতেছি। আমি প্রথমতঃ কালীবাবুর নিকট সমস্ত কথা শুনিয়া তাহার পর অপরাপর লোকের নিকট অনুসন্ধান করি।

আমি। কালীবাবুর সন্ধান করিয়া, তাহাকে কিরূপে বাহির করিতে সমর্থ হইলেন?

কর্ম্মচারী। কালীবাবুর অনুসন্ধান করিতে আমার কিছুমাত্র কষ্ট হয় নাই। আমি প্রথমতঃ দরখাস্তকারীর দোকানে গমন করি। কালীবাবুকে দেখিলে চিনিতে পারিবে, এইরূপ একটী লোক সঙ্গে করিয়া কালীবাবুর অনুসন্ধান করিবার মানসে, সেই স্থান হইতে আসিতেছিলাম, সেই সময় পথিমধ্যে হঠাৎ কালীবাবুকে দেখিতে পাইয়া সেই ব্যক্তি আমাকে দেখাইয়া দেয়।

আমি। কালীবাবু কি কাৰ্য্য করিয়া থাকেন?

কর্ম্মচারী। তাহা আমি জানি না, জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিয়াছিলেন যে, তিনি দালালী কাৰ্য্য করিয়া থাকেন।

আমি। কালীবাবু প্রকৃতই দালালী কাৰ্য্য করেন কি না, সে সম্বন্ধে আপনি কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়াছেন কি?

কর্ম্মচারী। না।

আমি। তিনি থাকেন কোথায়?

কর্ম্মচারী। তিনি যেখানে থাকেন, তাহা আমি জানি; আমি নিজে গিয়া তাঁহার বাড়ী দেখিয়া আসিয়াছি।

আমি। কিরূপ বাড়ীতে তিনি থাকেন?

কর্ম্মচারী। দোতালা পাকা বাড়ী।

আমি। তিনি সেই বাড়ীতে একাকী বাস করিয়া থাকেন কি?

কর্ম্মচারী। না, সেই বাড়ীতে অনেকগুলি স্ত্রীলোক থাকে, তাহাদিগের মধ্যে একখানি ঘরে তিনিও বাস করেন।

আমি। সেই স্ত্রীলোক কি প্রকারের, গৃহস্থ, না বেশ্যা?

কৰ্ম্মচারী। বেশ্যা।

আমি। তাহা হইলে যে গৃহে কালীবাবু থাকেন, সেই গৃহেও বোধ হয়, একজন বেশ্যা বাস করিয়া থাকে?

কর্ম্মচারী। হাঁ, একটী বেশ্যাকে লইয়া কালীবাবু সেই বার্সীতেই থাকেন।

আমি। কালীবাবুর সহিত আপনার সাক্ষাৎ হইলে তিনি আপনাকে কি বলিলেন?

কর্ম্মচারী। আমি তাঁহাকে দেখিয়াই তাহাকে একবারে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি রামজীলাল নামক এক ব্যক্তির মারফত যে সকল জহরত আনিয়াছিলেন, তাহা এখন আপনার নিকট আছে, কি বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছেন? উত্তরে তিনি কহিলেন, যাহার নিমিত্ত সেই সকল জহরত আনা হইয়াছিল, তিনি তৎক্ষণাৎ সেই সকল জহরত গ্রহণ করিয়াছেন, এবং সেই প্রেরিত লোক মারফত সমস্ত টাকাও প্রদান করিয়াছেন। টাকা লইয়া রামজীলাল তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছেন। সেই সকল জহরত বিক্রয় করিয়া আমার ন্যায্য যে কিছু দালালী প্রাপ্য হয়, তাহার কিয়দংশ তিনি আমাকে প্রদান করিয়া গিয়াছেন, এবং বলিয়া গিয়াছেন, দুই একদিবসের মধ্যে আরও কতকগুলি জহরত লইয়া তিনি আসিবেন, সেই সময় আমার দালালীর অবশিষ্ট যাহা প্রাপ্য আছে, তাহা প্রদান করিয়া যাইবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি আর প্রত্যাবর্তন করিলেন না, বা আমার ন্যায্য পাওনাগুলিও পাঠাইয়া দিলেন না; আমিও নানা ঝঞ্চাটে আর সেই দোকানে গমন করিতে পারি নাই।

আমি। আপনি কালীবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন কি যে, সেই সকল জহরত কালীবাবু নিজে খরিদ করিয়াছিলেন, কি অপর কোন লোক খরিদ করিয়াছিল?

কর্ম্মচারী। জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। উত্তরে কালীবাবু আমাকে এই বলিয়াছিলেন যে, রাজার মত কোন একজন জমিদার সেই জহরত খরিদ করিয়াছেন।

আমি। সেই রাজা বা জমিদার কে?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু তাহা আমাকে বলেন নাই।

আমি। তিনি যে বাড়ীতে থাকেন, সেই বাড়ী আপনাকে দেখাইয়া দিয়াছিলেন কি?

কর্ম্মচারী। না, তাঁহার বাড়ীও আমাকে দেখাইয়া দেন নাই।

আমি। তাহা হইলে জহরতগুলি কোন্ স্থানে তিনি গ্রহণ করেন, এবং উহার মূল্যই বা কোন্ স্থানে তিনি প্রদান করেন?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু আমাকে কেবল ইহাই বলেন যে, যে বাড়ীতে কালীবাবু থাকেন, সেই বাড়ীর কোন একটী স্ত্রীলোকের গৃহে সেই জমিদার মহাশয় আগমন করিতেন। সেই স্থানে কালী বাবুর সহিত তাহার পরিচ হয়, এবং কতকগুলি জহরত আনিবার নিমিত্ত সেই স্থানে বসিয়াই কালীবাবুকে আদেশ করেন। তাঁহারই আদেশ মত কতকগুলি জহরত আনা হয়। সেই সকল জহরতের সঙ্গে রামজীলাল আগমন করেন, এবং সেই স্ত্রীলোকের গৃহে বসিয়াই তিনি সেই সকল জহরত খরিদ করেন, ও রামজীলালের হস্তে উহার মূল্য প্রদান করেন।

আমি। একজন রাণী যে জহরত খরিদ করিতে গিয়াছিলেন, তাহা হইলে সেই রাণী কে?

কর্ম্মচারী। রাণী যে কে, তাহা কালীবাবু আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলেন নাই। কেবল তিনি আমাকে এইমাত্র বলিয়াছিলেন, যে স্ত্রীলোকটার গৃহে তিনি আগমন করিতেন, সেই স্ত্রীলোকটীকে সঙ্গে লইয়া তিনি জহরত খরিদ করিতে বাজারে গমন করেন। তিনি যে জুড়িতে ছিলেন, সেই স্ত্রীলোকটীও সেই জুড়িতে ছিলেন বলিয়া, লাক-লজ্জার ভয়ে তিনি গাড়ির ঘেরাটোপ ফেলিয়া সেই স্ত্রী লোকটীর সহিত বাজারে আগমন করেন। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, তিনি নিজে দোকানে বসিয়া জহরতগুলি দেখিয়া শুনিয়া পসন্দ করিয়া লইবেন; কিন্তু দোকানে গমন করিয়া, গাড়ি হইতে বাহির হইবার সময় দেখিতে পান, সেই দোকানে একটী লোক বসিয়া আছেন। বোজ হয়, সেই লোকটীই সেই দোকানের মালিক। সেই লোকটীকে তিনি পূর্ব হইতে চিনিতেন। কারণ, সেই ব্যক্তির সহিত তাঁহার পিতার সবিশেষরূপ পরিচয় আছে। তিনি পাছে তাহার চরিত্রের কথা তাঁহার পিতার নিকট বলিয়া দেন, এই ভয়ে তিনি আর গাড়ি হইতে নামিতে সাহসী হন নাই, এবং সেই স্থানে আত্মপ্রকাশ হইয়া পড়িবে, এই ভয়ে সেই স্ত্রীলোকটীকে রাণী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতে কালীবাবুকে বলিয়া দেন, ও তাহাকেই জহরতগুলি দেখা ইয়া খরিদ করিতে বলেন। কালীবাবু, নামে জহরতগুলি রাণীজিকে দেখান; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সেই জমিদার-পুত্রই সেই গাড়ির ভিতর হইতে জহরতগুলি দেখিয়া পসন্দ করেন, এবং পুনরায় ভাল করিয়া দেখিয়া উহার মূল্য প্রদান করিবেন, বিবেচনা করিয়া, জহরতগুলি কালীবাবুর বাসায় লইয়া যাইবার নিমিত্ত কালীবাবুকে সেই স্থানে রাখিয়া তাঁহারা প্রস্থান করেন। কালীবাবু সেই সকল জহরত রামজীলালের মারফত তাহার বাড়ীতে লইয়া যান। সেই স্থানে জমিদার-পুত্র পুনরায় জহরতগুলি ভাল করিয়া দেখেন, এবং পরিশেষে রামজীলালের হস্তে উহার মূল্য প্রদান করিয়া জহরতগুলি গ্রহণ করেন।

আমি। কালীবাবু যে সকল কথা বলেন, তাহাদের পোষকতায় আর কোন প্রমাণ পাইয়াছিলেন কি?

কর্ম্মচারী। পাইয়াছিলাম।

আমি। কি?

কর্ম্মচারী। যাহার গৃহে বসিয়া সেই সকল জহরত গ্রহণ করা হয়, এবং তাহার মূল্য প্রদান করা হয়, সেই স্ত্রীলোকটীও ঠিক সেই কথাই বলে।

আমি। সেই স্ত্রীলোকটী কে?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু যে গৃহে থাকেন, সেই স্ত্রীলোকটীও সেই গৃহে থাকে।

আমি। তাহা হইলে কালীবাবু যে স্ত্রীলোকটীর গৃহে থাকেন, সেই স্ত্রীলোকটীই কালীবাবুর কথার পোষকতা করিতেছে?

কর্ম্মচারী।

আমি। রাণীজিও বোধ হয়, তিনিই হইয়াছিলেন?

কর্ম্মচারী। হাঁ।

আমি। সেই স্ত্রীলোকটীর নাম কি?

কর্ম্মচারী। তাহার নাম ত্রৈলোক্য।

আমি। বাড়ীর অপরাপর ভাড়াটিয়াগণ কি বলে?

কর্ম্মচারী। তাঁহারা সবিশেষ কিছুই বলিতে পারে না। তাঁহারা কেবল এইমাত্র বলে যে, কাহার গৃহে কে আসিতেছে, কে যাইতেছে, তাহার খবর কে রাখে? বিশেষতঃ এরূপ সংবাদ রাখা তাহাদিগের নীতি-বিরুদ্ধ।

আমি। পশ্চিমদেশীয় একটী লোক যে সেই বাড়ীতে কতক গুলি জহরত লইয়া গমন করিয়াছিল, তাহা কেহ বলে?

কর্ম্মচারী। সবিশেষ কিছু বলিতে পারে না, তবে এইমাত্র বলে যে, কালীবাবুর সহিত সময় সময় বঙ্গদেশীয়, পশ্চিমদেশীয় প্রভৃতি অনেক লোক প্রায়ই তাঁহার গৃহে আসিয়া থাকে, এরূপ তাঁহারা দেখিতে পায়।

আমি। কত টাকার জহরত খরিদ করা হয়?

কর্ম্মচারী। কালীবাবু কহেন, দশ হাজার টাকায় সেই সকল জহরত খরিদ করা হইয়াছিল।

আমি। টাকাগুলি কিরূপ অবস্থায় রামজীলালকে প্রদান করা হয়,নগদ টাকা দেওয়া হয়, না নোট দেওয়া হয়?

কর্ম্মচারী। সমস্তই নোট, নয়খানি হাজার টাকার হিসাবে নয় হাজার, এবং একশতখানি দশ টাকা হিসাবে এক হাজার টাকা।

আমি। সেই হাজার টাকা হিসাবের নোটগুলির নম্বর পাই বার কোনরূপ উপায় আছে কি?

কর্ম্মচারী। সমস্ত নম্বরই আমি পাইয়াছি।

আমি। কিরূপে সেই সকল নোটের নম্বর পাইলেন?

কর্ম্মচারী। কালীবাবুর নিকট হইতে। যে সময় নোটগুলি রামজীলালকে দেওয়া হয়, সেই সময় কালীবাবু সেই সকল নোটের নম্বর টুকিয়া রাখিয়াছিলেন। তিনি আমাকে সেই সকল নম্বর

প্রদান করিয়াছেন।

আমি। সেই নোটগুলি সম্বন্ধে করেনসি আফিসে একবার অনুসন্ধান করা উচিত।

কৰ্ম্মচারী। সে অনুসন্ধানও আমি করিয়াছি। সেই সকল নোটের টাকা দেওয়া স্থগিত (Stop) করিবার মানসে করেসি আফিসের বড় সাহেবের নামে একখানি পত্র লেখা হয়। সেই পত্রের জবাবে তিনি যাহা বলিয়াছেন, তাহাতেই রামজীলালের উপর আরও সবিশেষরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।

আমি। পত্রের উত্তরে তিনি কি লিখিয়াছেন?

কর্ম্মচারী। তিনি লিখিয়াছেন যে, সমস্ত নোটগুলিই রামজী লাল নামক এক ব্যক্তি সেই স্থানে প্রদান করিয়া তাহার পরিবর্তে দশ টাকার হিসাবে নোট বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছে।

আমি। এটী সবিশেষ সন্দেহের কথা?

কর্ম্মচারী। এই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া তাহার নামে ওয়ারেন্ট বাহির করিয়াছি।

আমি। সেই জমিদার-পুত্ৰটী কে, তাহার কিছু অবগত হইতে পারিয়াছেন কি?

কর্ম্মচারী। তাহা আমি এ পর্যন্ত কিছুই জানিতে পারি নাই। কালীবাবু কোনরূপেই তাহার নাম বলিতে সম্মত নহেন, বা তাঁহার বাড়ী দেখাইয়া দিতে বলায়, তিনি বলেন যে, কোথায় যে তাহার বাড়ী, তাহা তিনি অবগত নহেন। বাড়ীর ঠিকানা তিনি কখনও কাহারও নিকট প্রকাশ করেন নাই, নামও বলেন নাই; রাজাসাহেব বলিয়াই সকলে তাহাকে ডাকিয়া থাকেন।

আমি। জহরত খরিদ করিবার পর, রাজাসাহেব ত্রৈলোক্যের গৃহে আর আগমন করিয়াছিলেন কি?

কর্ম্মচারী। তাহার পর দুই একদিবস আসিয়াছিলেন মাত্র; কিন্তু আজ কয়েকদিবস পর্যন্ত আর তিনি সেই স্থানে আগমন করেন নাই।

আমি। কেন আসেন নাই, সেই সম্বন্ধে কেহ কোন কথা বলিতে পারে না কি?

কর্ম্মচারী। ত্রৈলোক্য ও কালীবাবু ইহাই বলেন যে, রাজা সাহেব শেষদিবস যখন সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন, সেই সময় তিনি বলিয়া যান যে, কোন সবিশেষ কাৰ্য্য উপলক্ষে তাহাকে তাহার দেশে গমন করিতে হইতেছে। বোধ হয়, সেই স্থানে তাহাকে মাসাবধি অবস্থান করিতে হইবে। সুতরাং এক মাসের মধ্যে তিনি আর এখানে আগমন করিবেন না।

আমি। রামজীলাল সম্বন্ধে আপনি কি অনুসন্ধান করিয়াছেন?

কৰ্ম্মচারী। সবিশেষ কোনরূপ অনুসন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। কেবল কলিকাতার ভিতর যে যে স্থানে তাহার দেশের লোক বা আত্মীয়-স্বজন আছে, কেবল তাহারই কোন কোন স্থানে রামজীলালের অনুসন্ধান করিয়াছি মাত্র; কিন্তু এখন পর্যন্ত সকল স্থানে গমন করিতে পারি নাই। আমার বোধ হয়, রামজীলাল কলিকাতায় নাই। কারণ, কোন দিক হইতে তাহার কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না। আমার বোধ হয়, সে কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিয়াছে।

আমি। নিতান্ত অসম্ভব নহে; কিন্তু রামজীলাল তাহার মনিবের এতদুর বিশ্বাসপাত্র হইয়া এরূপ অবিশ্বাসের কাৰ্য্য করিবে? যাহা হউক, এ বিষয় একবার উত্তমরূপে দেখা আবশ্যক। অর্থের লোভে সময় সময় মনুষ্যগণ যে কি না করিতে পারে, তাহা বলা সহজ নহে। অর্থই যে অনর্থের মূল তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

কর্ম্মচারী। এখন এ সম্বন্ধে আমাকে আর কিছু করিতে হইবে কি?

আমি। হইবে বৈকি?

কর্ম্মচারী। কি?

আমি। রামজীলালকে সবিশেষরূপে অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে ধরিতে হইবে।

কর্ম্মচারী। আর কিছু?

আমি। সেই জমিদার-পুত্র যে কে, অনুসন্ধান করিয়া তাহার ঠিকানা করিতে হইবে।

কর্ম্মচারী। এই সকল বিষয় অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি এখন প্রস্তুত হইতে পারি কি?

আমি। এই সকল বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আপনি এখন যে স্থানে ইচ্ছা সেই স্থানে গমন করিতে পারেন। কিন্তু আপনি বহির্গত হইয়া যাইবার পূর্বে আর একটা কাৰ্য্য আপনাকে করিতে হইবে।

কর্ম্মচারী। কি?

আমি। আমার সহিত কালীবাবুর বাড়ীতে একবার গমন করিয়া কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে আমাকে দেখাইয়া দিতে হইবে। কারণ, তাঁহারা যে কে, এবং কি চরিত্রের পোক, সেই সম্বন্ধে আমি সময় মত একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখি; এবং সেই বাড়ীর অপর ভাড়াটিয়াগণের মধ্যে যদি কেহ সেই জমিদার-পুত্রের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারেন, তাহারও সবিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া দেখিব।

আমার কথায় কর্ম্মচারী মহাশয় সম্মত হইলেন। আমার অবকাশ মত তিনি আমার সহিত গমন করিয়া, কালীবাবু ও তাহার উপপত্নী ত্রৈলোক্যকে আমাকে দেখাইয়া দিবেন, ইহাই স্থিরীকৃত হইল।

আমি অতিশয় ক্লান্ত ছিলাম; সুতরাং সেই দিবসেই আমি আর কালীবাবুর বাড়ীতে গমন করিতে পারিলাম না।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

পরদিবস অতি প্রত্যূষে সেই কর্ম্মচারীকে সঙ্গে করিয়া আমি কালীবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। কালীবাবু এবং ত্রৈলোক্য উভয়েই সেই সময় তাহাদিগের গৃহে উপস্থিত ছিল। কালীবাবু আমাকে দেখিয়া, সম্পূর্ণরূপে চিনিতে পারিলেন কি না, তাহা বলিতে পারি না; কিন্তু আমি তাঁহাকে অতি উত্তমরূপে চিনিতে পারিলাম। কালীবাবু যে চরিত্রের লোক, ত্রৈলোক্যের সহিত মিলিত হইয়া নিতান্ত অসৎবৃত্তি অবলম্বন করিয়া সে একাল পর্যন্ত তাহাদের উভয়ের জীবিকা নির্বাহ করিয়া আসিতেছিল, তাহা অতি উত্তমরূপেই অবগত ছিলাম। আমি জানিতাম, দশ হাজার টাকার মূল্যের জহরত খরিদ করিবার ক্ষমতা কালীবাবুর নাই। আরও জানিতাম, কালীবাবুকে যে জানিত, সে দশ হাজার টাকা ত দূরের কথা, দশ পয়সাও দিয়া কালীবাবুকে সহজে বিশ্বাস করিত না।

আমি কালীবাবুর বাড়ীতে গমন করিয়া কেবল রামজীলাল সম্বন্ধে দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিলাম মাত্র। সবিশেষ কোন কথা তাহার নিকট ভাঙ্গিলাম না, বা তাহার মনে কোনরূপ সন্দেহ হইতে পারে, এরূপ কোন কথাও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম না। আমার কথায় কালীবাবু, যে কোন উত্তর প্রদান করিলেন, তাহাতেই যেন আমি সন্তুষ্ট হইয়া, রামজীলালের অনুসন্ধান করি বার ভান করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

যে সময় কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যের সহিত আমার দুই চারিটী কথা হইয়াছিল, সেই সময় উঁহারা যদি সবিশেষ মনোযোগের সহিত আমার দিকে লক্ষ্য রাখিত, তাহা হইলে উঁহারা সেই সময় আমার কথার উত্তর প্রদান করিতে পারিত কি না, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, সেই সময় যেরূপ সতর্কতার সহিত আদি উহা দিগের আপাদমস্তক দর্শন করিতেছিলাম, উঁহারা যদি ঘূণাক্ষরেও আমার সেই সূক্ষ্ম দর্শনের অর্থ বুঝিতে পারি, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি যে, সেই সময় উঁহারা আমার সম্মুখীন হইয়া কখনই আমার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইতে পারি?

না। তাহাদিগের পাপরাশীর ভয়ানক অবস্থা আমি বুঝিতে পারিয়াছি, সেই ভাবিয়া কখনই তাঁহারা কোন পুলিস-কর্ম্মচারীর সম্মুখীন হইতে সাহসী হইত না।

আমার অভিসন্ধির বিষয় যদিও তাঁহারা পূৰ্ব্বে কিছুমাত্র বুঝিতে পারিয়াছিল না; কিন্তু পরিশেষে তাঁহারা আমার সেই সূক্ষ্ম দর্শনের অথ সবিশেষরূপে বুঝিতে সমর্থ হইয়াছিল।

উঁহাদিগকে যে দুই চারিটী কথা আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এবং তাহার উত্তরে উঁহারা আমাকে যাহা কিছু বলিয়াছিল, তাহার কোন কথাই আমি বিশ্বাস করিতে সমর্থ হইলাম না। অধিকন্তু উঁহাদিগের উপর নানারূপ সন্দেহ আসিয়া আমার মনে উদয় হইল। বস্তুতঃ আমার সমভিব্যাহারী কর্ম্মচারী যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া রামজীলালের উপর ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া রাখিয়াছিলেন, সেই অনুসন্ধানে আমি সন্তুষ্ট হইতে পারিলাম না।

এ সম্বন্ধে আরও একটু সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করা আবশ্যক, মনে মনে এইরূপ বিবেচনা করিলাম। কিন্তু কোন উপায় অব লম্বন করিলে, সেইরূপ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে পারি, ভাবিয়া। চিন্তিয়া তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আমরা উভয়েই থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

থানায় আসিবার প্রায় দুই তিনঘন্টা পরে হঠাৎ একটা বিষয় জানিবার ইচ্ছা আমার মনে উদয় হইল। এ সম্বন্ধে আমি কাহাকেও কিছু না বলিয়া, সেই কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া করেপি আফিসে গিয়া উপস্থিত হইলাম। ইতিপূর্বে যে কয়েকখানি নম্বরি নোট করেনসি আফিসে ভাঙ্গাইয়া লইয়া রামজীলাল প্রস্থান করিয়াছে—সাব্যস্ত হইয়াছিল, করেসি অফিসের বড় সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, সেই নোট কয়েকখানি একবার দেখিতে চাহিলাম। তিনি তাহার অধীনস্থ কর্ম্মচারীকে আদেশ প্রদান করিলেন, সেই কৰ্ম্মচারী অনুসন্ধান-পূৰ্ব্বক সেই নোট কয়েকখানি বাহির করিয়া আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। সেই নোট দেখিয়া আমি যে কতদুর বিস্মিত হইলাম, তাহা বলিতে পারি না। কারণ, যে সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া, আমি সেই নোটগুলি দেখিবার ইচ্ছা করিয়াছিলাম, এখন দেখিলাম, সেই সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হইল। ইতিপূর্বে অনুসন্ধানে আমি অবগত হইতে পারিয়াছিলাম যে, রামজীলাল একজন পশ্চিমদেশীয় লোক, বঙ্গদেশে থাকিয়া ব্যবসা-কাৰ্য্য করিয়া থাকেন বটে; কিন্তু বঙ্গ ভাষার সহিত তাহার কিছুমাত্র সংশ্রব নাই। তিনি না পারেন বাঙ্গালা কহিতে-না পারেন বাঙ্গালা লিখিতে। এখন দেখিলাম, সেই নোটগুলির উপর রামজীলালের নাম স্বাক্ষর আছে সত্য; কিন্তু উহা হিন্দীভাষায় নাই, বাঙ্গালা ভাষায়। রামজীলাল যখন বাঙ্গালা ভাষা একবারেই অবগত নহেন, তখন তিনি বাঙ্গালা ভাষায় আপনার নাম কিরূপে স্বাক্ষর করিলেন, তাহার কিছুই বুঝি উঠিতে পারিলাম না। আরও ভাবিলাম, রামজীলাল যখন সেই সকল অর্থ অপহরণ করিয়া পলায়ন করিতেছে, তখন সে যে আপনার নাম ও ঠিকানা স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া দিয়া তাহার বিপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া রাখিয়া যাইবে, তাহাই বা সহজে বিশ্বাস করি কি প্রকারে?

মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য; কিন্তু কাহাকেও কিছু না বলিয়া, সেই নোটগুলি করেনসি আফিসে প্রত্যর্পণ-পূৰ্ব্বক আস্তে আস্তে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।

কালীবাবুর অবস্থা আমি উত্তমরূপে জানিতাম। তাহার নিজের গাড়ি-ঘোড়া নাই, অথচ আড়গোড়া হইতে গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহাতে চড়িবার ক্ষমতাও তাহার নাই। এরূপ অবস্থায় কাহার গাড়িতে চড়িয়া সে বাজারে আগমন করিয়াছিল, ক্রমে তাহা জানি বার প্রয়োজন হইয়া পড়িল। রাণীজিই বা কে? সেই জুড়িই বা কাহার? এবং কেইবা সেই জুড়ি আড়গোড়া হইতে ভাড়া করিয়া চড়িয়াছিল, তাহা জানিতে পারিলেই কালীবাবুর কথা যে কতদূর সত্য, তাহা অনায়াসেই অনুমান করা যাইতে পারে। কালীবাবু যে জমিদার-পুত্রের কথা বলিতেছে, তিনি যে কে, তাহা কালীবাবুর জানিতে না পারার কোনরূপ অসম্ভাবনা দেখিতেছি না। যে ব্যক্তি তাহারই রক্ষিতা স্ত্রীলোকের গৃহে আসিয়া আমোদ প্রমোদ করে, যে ব্যক্তি তাহারই গৃহে বসিয়া এত টাকা মূল্যের জহরতাদি খরিদ করে, তাহার পরিচয় কালীবাবু যে একবারেই জানে না, ইহা কিছুতেই বিশ্বাস হইতে পারে না। অন্ততঃ তিনি যে কোথায় থাকেন, তাহা কালীবাবু বা ত্রৈলোক্য যে একবারেই অবগত নহে, তাহাও আমি কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে সমর্থ নহি। আমার অনুমান হইতেছে, কালীবাবু যে সকল কথা আমাদিগকে বলিয়াছে, তাহার অধিকাংশই মিথ্যা কথা। সুতরাং এ সম্বন্ধে আমাকে আরও একটু সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করিতে হইবে।

এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে আমি আমার থানায় প্রত্যাবর্তন করিলাম। থানার মধ্যে সেই সময় যে সকল ডিটেকটিভ-কর্ম্মচারী উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্য হইতে পশ্চিমদেশীয় এরূপ এক কর্ম্মচারীকে আমি আমার সঙ্গে লইলাম যে, তাঁহাকে সহিসের বেশ পরিধান করাইলে, ঠিক সহিসের মতই বোধ হয়।

সেই কর্ম্মচারীকে আমি সামান্য সহিসের বেশে সজ্জিত হইয়া আমার সহিত আসিতে কহিলাম। তিনি আমার আদেশ মত সহিসের বেশ ধরিয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

বড়বাজারের যে দোকানে রাণীজির জুড়ি এবং কালীবাবুর কম্পাস পাড়ি গমন করিয়াছিল, সেই দোকানের লোজনদিগের নিকট হইতে সেই গাড়ির সহিস-কোচবানগণের পোযাকের বিবরণ শুনিয়া আমি সেই সময়েই স্থির করিয়াছিলাম যে, সেই দুইখানি গাড়ি কোন আড়গোড়া হইতে আনীত হইয়াছে। কারণ, কলিকাতার পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই অবগত আছেন যে, কলিকাতার প্রত্যেক আড়গোড়ার সহিস-কোচবানদিগের পরিচ্ছদ এক এক প্রকার।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া আমি থানা হইতে বহির্গত হইলাম। সহিস-কোচবানের পোষাক পরিচ্ছদের বিবরণ শুনিয়া আমি মনে মনে যে আড়গোড়া স্থির করিয়াছিলাম, সেই আড়গোড়ায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমি সেই আড়গোড়ার ভিতর একটী ঘোড়া ক্রয় করিবার ছলে প্রবেশ করিয়া আড়গোড়ায় যে সকল ঘোড়া ছিল, তাহাই দেখিবার ভানে এদিক ওদিক বেড়াইতে লাগিলাম; কিন্তু সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারীর দৃষ্টিপথের বাহির হইলাম না। অধিকন্তু অপরাপর সহিস-কোচবানদিগের সহিত সেই কৰ্মচারীর যে সকল কথা হইতে লাগিল, তাহার দিকেও সবিশেষরূপ লক্ষ্য রাখিলাম।

সহিস-বেশধারী কর্ম্মচারী আমার উপদেশ মত আড়গোড়ার ভিতর প্রবেশ করিয়া যে স্থানে কয়েকজন সহিস-কোচবান বসিয়া ছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন, এবং আপনাকে একজন সহিস বলিয়া পরিচয় দিয়া তাহাদিগের নিকট উপবেশন করিলেন। তাহাকে দেখিয়া একজন কোচবান্ জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কাহার অনুসন্ধান করিতেছ?

কৰ্ম্মচারী। কাহারও অনুসন্ধান করিতেছি না।

কোচবান্। তবে এখানে আসিয়াছ কেন?

কর্ম্মচারী। আমি বরাবর সহিসী কৰ্ম্ম করিতাম; কিন্তু আজ কয়েকমাস হইল, আমি আমার দেশে গমন করিয়াছিলাম, এবং কিছু দিন পূর্বে আমি দেশ হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়াছি। এখন কোন স্থানে কোনরূপ চাকরী যোগাড় করিতে না পারায়, সবিশেষরূপ কষ্ট পাইতেছি। তাই একটা চাকরীর অনুসন্ধানে আপনাদিগের এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি।

কোচবান। এখানে তোমার চাকরী হইতে পারে, একথা তোমাকে কে বলিল?

কর্ম্মচারী। একথা আমাকে কেহ বলে নাই। আড়গোড়ায় অনেক সহিস কাৰ্য্য করে; সুতরাং সময় সময় অনেক চাকরী প্রায়ই খালি খাকার সম্ভাবনা। তাই আপনাদিগের এখানে আগমন করিয়াছি। এখন বলুন, কিরূপ উপায়ে আমি একটা চাকরী যোগাড় করিতে সমর্থ হই?

কোচবান্। আমাদিগের এখানে যদি কোন কৰ্ম্ম খালি থাকিত, তাহা হইলে আমাদিগের সাহেবকে বলিয়া যাহাতে তুমি কোন একটী কৰ্ম্ম পাইতে পারিতে, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিতাম; কিন্তু আজকাল সহিসের কাৰ্য খালি থাকা দূরে থাকুক, দুই একজন সহিস আমাদিগের এখানে ফালতু পড়িয়া আছে।

কর্ম্মচারী। এখানে বড় আশা করিয়া আসিয়াছিলাম, কিন্তু এখন দেখিতেছি, আমার সে আশা এখন কার্যে পরিণত হওয়া কঠিন হইয়া দাঁড়াইল।

কোচবান্। এখানে মধ্যে মধ্যে প্রায়ই সহিসী কাৰ্য্য খালি হইয়া থাকে। তুমি দুই একদিবস অন্তর এক একবার আসিও, খালি হইলেই আমি তোমার জন্য একটী যোগাড় করিয়া দিব।

কর্ম্মচারী। তাহাই হইবে। আমি মধ্যে মধ্যে আসিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব। আজ কয়েকদিবস হইল, বড়বাজারে একখানি জুড়ি গাড়ি এবং একখানি কম্পাস গাড়ি আপনাদিগের এখান হইতে গিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে কোন সহিস কোচবানের সহিত একবার সাক্ষাৎ হয় কি?

কোচবান্। কেন?

কর্ম্মচারী। তাহা হইলে বোধ হয়, আমার একটী চাকরীর যোগাড় হইতে পারে।

কোচবান্। সেই সহিস কোচবানের নাম কি?

কর্ম্মচারী। আমি তাহাদিগের কাহারও নাম অবগত নহি।

কোচবান্। নাম না জানিলে, তুমি কাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবে?

কর্ম্মচারী। দুইজন কোচবান্ এবং তিনজন সহিস দুইখানি গাড়িতে ছিল। তাহাদিগের মধ্যে একজনের সহিত সাক্ষাৎ হইলেই আমার কাৰ্য শেষ হইতে পারে।

রাণী না খুনী?

কোচবান্। প্রত্যহই গাড়ি ভাড়ায় যাইতেছে; বড়বাজারে কে গিয়াছিল, তাহা এখন কিরূপে স্থির করিব?

কর্ম্মচারী। দুইখানি গাড়ি গিয়াছিল। একখানি জুড়ি গাড়ি, তাহাতে একজন রাণী ছিলেন। সেই রাণী বড়বাজারে একজন জহরত-বিক্রেতার দোকানে গমন করিয়া অনেকগুলি জহরত খরিদ করিয়াছিলেন। আর একখানি কম্পাস গাড়ি; বড়বাজারে গমন করিবার সময় উহাতে কেবলমাত্র একটী লোক গমন করিয়াছিল, কিন্তু আসিবার সময় তাহাতে দুইজন আগমন করেন, এবং তাহাদের সহিত সেই জহরতের বাক্সও আনা হয়। এরূপ অবস্থায় যদি আপনি এইখানকার সহিস-কোচবানগণকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে বোধ হয়, তাহাদিগের সন্ধান নিশ্চয়ই অনা মাসে হইতে পারে।

কোচবান্। সে আজ কয়দিবসের কথা?

কর্ম্মচারী। প্রায় আট দশদিবস হইবে।

কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া সেই কোচবান সেই স্থানে যে সকল সহিস-কোচবান্ উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করিলেন। উঁহাদিগের মধ্যে একজন সহিস কহিল, আজ আট দশদিবস হইল, কোন রাণীকে সোয়ারী দিবার নিমিত্ত লাল বড় জুড়িতে হোসেনী কোচবান্ যেন গমন করিয়াছিল, এইরূপ আমার মনে হইতেছে।

কোচবান্। হোসেনী, কোন্ হোসেনী?

সহিস। বড় লাল জুড়ি যে হোসেনী হাঁকাইয়া থাকে।

কোচবান। দেখ দেখি, হোসেনী এখন আছে, কি সোয়ারীতে বাহির হইয়া গিয়াছে।

সহিস। সে এখন নাই। অনেকক্ষণ হইল, সে সেই জুভি লইয়া বাহির হইয়া গিয়াছে।

কোচবান্। তাহার সহিত যে দুইজন সহিস ছিল, তাহাদের মধ্যে কেহ আছে কি?

সহিস। না, তাঁহারাও হোসেনীর সহিত বাহির হইয়া গিয়াছে বলিয়া বোধ হইতেছে। যাহা হউক, আমি গিয়া আস্তাবলের ভিতর তাহাদিগের একবার অনুসন্ধান করিয়া আসিতেছি। উহা দিগের মধ্যে যদি কেহ থাকে, তাহা হইলে আমি তাহাকে সঙ্গে লইয়া আনিতেছি।

এই বলিয়া সেই সহিদ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল, এবং অতি অল্পক্ষণ মধ্যেই আর একজন লোককে সঙ্গে করিয়া সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, জুড়ি গাড়ির কোচবান্ ও সহিসগণ সকলেই বাহির হইয়া গিয়াছে। সেই জুড়ির সহিত যে একখানি কম্পাস গাড়ি গমন করিয়াছিল, তাহার কোচবান্ এই–আবদুল।

কোচবান্। আবদুল! তুমিই কি কম্পাস গাড়ি লইয়া হোসেনীর জুড়ির সহিত কোন রাণীকে লইয়া বড়বাজারে গমন করিয়াছিলে?

আবদুল। আমি গাড়ি চড়াইয়া রাণীকে লইয়া যাই নাই। রাণী গিয়াছিলেন-জুড়িতে; আমি জুড়ির পিছু পিছু গিয়াছিলাম।

কর্ম্মচারী। আচ্ছা, রাণী জুড়িগাড়িতে করিয়া গিয়াছিলেন; কিন্তু তোমার গাড়ি ত খালি যায় নাই, তাহাতে একটী বাবু গমন করিয়াছিলেন না?

২য় কোচবান্। হাঁ।

কর্ম্মচারী। আসিবার সময় দুইজন বাবু তোমার গাড়িতে আসিয়াছিলেন?

২য় কোচবান্। হাঁ।

কর্ম্মচারী। যে বাবু তোমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করিয়া ছিলেন, তাহার সহিত বড়বাজারে আমার সহিত সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন, তুমি আমার বাড়ীতে যাইও, সেই স্থানে গেলে, আমি তোমাকে একটা চাকরীর যোগাড় কুরিয়া দিব। তাহার নাম ও ঠিকানা পর্যন্ত আমাকে বলিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু ভাই, দুঃখের কথা আর কি বলিব, আমি তাঁহার নাম ও ঠিকানা উভয়ই ভুলিয়া গিয়াছি বলিয়া, আর সেই স্থানে গমন করিতে পারি নাই, এবং এখন কোন স্থানে চাকরীর ও যোগাড় করিয়া উঠিতে পারি নাই। তাহার নাম ও ঠিকানা ভুলিয়া যাইবার পরে, এই কয়দিবস পৰ্য্যন্ত যে কত স্থানে চাকরীর উমেদারীতে ঘূরিয়া বেড়াইয়াছি, তাহার আর তোমাকে কি বুলিব?

সহিস। আমাকে এখন কি করিতে হইবে?

কর্ম্মচারী। ভাই, অনেক কষ্ট করিয়া যখন আমি তোমার অনুসন্ধান করিতে সমর্থ হইয়াছি, তখন আর আমি তোমাকে সহজে ছাড়িতেছি না; এখন তোমার প্রতি আমার এই অনুরোধ যে, হয় কোন স্থানে আমার একটী চাকরীর যোগাড় করিয়া দেও, না হয়, সেই বাবুর বাড়ী, যাহা তোমার দেখা আছে, একটু কষ্ট স্বীকার করিয়া তাহা আমাকে দেখাইয়া দিয়া আমাকে সবিশেষরূপে উপকৃত কর।

সহিস। আমার হাতের কাৰ্য আমি এখন পর্যন্ত শেষ করিয়া উঠিতে পারি নাই। এরূপ অবস্থায় আমি কিরূপে আপনার সঙ্গে এখন গমন করিতে পারি?

কর্ম্মচারী। আমার যতদূর সাধ্য, আমি না হয়, তোমার কার্য্যের কতক সাহায্য করিতেছি, তাহা হইলে তোমার কাৰ্য্য শীঘ্রই সম্পন্ন হইয়া যাইবে। তাহা হইলে ত তুমি আমার সহিত গমন করিতে পারিবে?

ছদ্মবেশী-কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া সেই কোচ প্রথমতঃ তাঁহার সহিত যাইতে অস্বীকার করিল। পরিশেষে অনেক তোষামোদের পর তাহার সহিত যাইতে স্বীকৃত হইয়া শীঘ্র শীঘ্র আপনার নিয়মিত কৰ্ম্ম সমাধা করিয়া লইবার মানসে সেই ছদ্ম বেশী-কর্ম্মচারীকে নানারূপ ফরমাইস আরম্ভ করিল। কখন বা তাহাকে ঘোড়ার সাজ সরাইয়া দিতে কহিল, কখন বা ঘোড়ার থাকিবার স্থানে পাতিয়া দিবার খড় গুলি যাহা রৌদ্রে শুখাইতে দেওয়া হইয়াছিল, তাহা সেই স্থান আনিতে কহিল। এইরূপে তাহাকে নানারূপ ফরমাইস আরম্ভ করিল। ছদ্মবেশী-কর্ম্মচারী কি করেন, কোন গতিতে তাঁহার কাৰ্য-উদ্ধার করিতেই হইবে; সুতরাং সেই কোচবানকে তিনি সর্ব প্রকার সাহায্য করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে তামাক সাজিয়াও তাহাকে খাওয়াইতে হইল। এইরূপে প্রায় দুইঘণ্টাকাল অতীত হইলে আবদুল সেই কর্ম্মচারীর সহিত বহির্গত হইল। আমিও ঘোড় দেখা শেষ করিয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎসেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম।

যষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

আড়গোড়া হইতে বাহির হইয়া কর্ম্মচারী আবদুলের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। আমিও একটু দুরে থাকিয়া তাহাদের অনুসরণ করিতে লাগিলাম।

গমন করিতে করিতে কর্ম্মচারী আবদুলকে জিজ্ঞাসা করি লেন, কেমন ভাই, তোমার গাড়িতে যে বাবুটী বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন, তিনি একাকী গমন করিয়াছিলেন, কি তাহা সহিত অপর আর কোন ব্যক্তি ছিল?

আবদুল। তিনি একাকীই আমার গাড়িতে গমন করিয়া ছিলেন।

কর্ম্মচারী। বড়বাজার হইতে যখন প্রত্যাবর্তন করেন, তখনও কি তিনি একাকী ছিলেন?

আবদুল। না, বড়বাজার হইতে আসিবার সময় অপর আর একটা লোক তাঁহার সহিত আগমন করিয়াছিলেন।

কর্ম্মচারী। যে ব্যক্তি তোমার গাড়িতে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহাকে কোন্ দেশীয় লোক বলিয়া তোমার অনুমান হয়?

আবদুল। তিনি বাঙ্গালি।

কর্ম্মচারী। আর যে ব্যক্তি বড়বাজার হইতে তাহার সহিত আগমন করিয়াছিলেন, তিনিও কি বাঙ্গালি?

আবদুল। না, তিনি বাঙ্গালি নহেন। তাহাকে মাড়োয়ারী বা ক্ষেত্র বলিয়া আমার অনুমান হয়। তিনি বাঙ্গালি নহে, ইহা আমি বেশ বলিতে পারি।

কর্ম্মচারী। যিনি তোমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করেন, তিনি যে বাড়ী হইতে গমন করিয়াছিলেন, বড়বাজার হইতে ফিরিয়া আসিয়াও কি তিনি সেই বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন, কি অপর কোন বাড়ীতে গিয়াছিলেন?

আবদুল। অপর কোন বাড়ীতে তিনি গমন করেন নাই। যে বাড়ী হইতে আসিয়াছিলেন, পুনরায় সেই বাড়ীতেই গমন করিয়াছিলেন।

কর্ম্মচারী। তোমার গাড়ি ও জুড়িগাড়ি, উভয় গাড়িই কি এক সময় যাইয়া সেই বাড়ীতে উপস্থিত হয়?

আবদুল। আমাদিগের উভয় গাড়িই এক সময় সেই বাড়ীতে গিয়াছিল, এবং সেই স্থান হইতে উভয় গাড়িই একত্র বড়বাজার গমন করে।

কর্ম্মচারী। আর বড়বাজার হইতে যখন তোম প্রত্যাবর্তন কর, সেই সময়েও বোধ হয়, তোমাদের উভয় গাড়িই একত্র ফিরিয়া আইসে?

আবদুল। না, জুড়িগাড়ি অগ্রে চলিয়া আইসে; আমার গাড়ি তাহার অনেক পশ্চাৎ আসিয়াছিল।

কর্ম্মচারী। জুড়িগাড়িতে কে ছিল?

আবদুল। কে ছিল তাহা আমি জানি না। কেবল একটী মাত্র স্ত্রীলোককে সেই গাড়িতে উঠিতে দেখিয়াছিলাম।

কর্ম্মচারী। সেই স্ত্রীলোকটীর পোয়াক-পরিচ্ছদ কিরূপ ছিল?

আবদুল। পোষাক-পরিচ্ছদ খুব ভাল ছিল। শুনিয়াছি, উনি নাকি কোন স্থানে যাণী। তা রাণীর পোষাক আর ভাল হইবে না?

কর্ম্মচারী। যে বাড়ী হইতে সেই বাবুটা তোমার গাড়িতে উঠিয়াছিলেন, এবং পরিশেষে বড়বাজার হইতে ফিরিয়া আসিয়া যে বাড়ীতে গমন করেন, সেই রাণীও কি সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া জুড়িতে আরোহণ করিয়াছিলেন?

আবদুল। হাঁ, তিনিও সেই বাড়ী হইতে বাহির হইয়া জুড়িতে উঠিয়াছিলেন, ইহা আমি দেখিয়াছি; কিন্তু কোন্ বাড়ীতে যে তিনি নামিয়া গিয়াছেন, তাহা আমি বলিতে পারি না।

কর্ম্মচারী। কয়দিবসের নিমিত্ত উঁহারা গাড়ি দুইখানি ভাড়া করিয়াছিলেন?

আবদুল। কেবলমাত্র একদিবসের জন্য। যে দিবস উঁহারা বড়বাজার গমন করিয়াছিলেন, কেবলমাত্র সেই দিবসই আমরা আসিয়াছিলাম, উহার পূর্বে বা পরে আর কখনও আমরা তাঁহাদিগের নিকট গাড়ি লইয়া যাই নাই।

কর্ম্মচারী। তোনরা কি সেই বাবুকে, কি রাণীকে পূর্ব হইতে চিনিতে।

আবদুল। না।

কর্ম্মচারী। তাহাদিগের বাড়ী?

আবদুল। তাহাও আমরা পূর্ব হইতে জানিতাম না।

কর্ম্মচারী। তাহা হইলে কিরূপে তোমরা তোমাদিগের গাড়ি লইয়া তাহাদিগের বাড়ীতে যাইতে পারিলে?

আবদুল। আমাদিগের আফিসের সাহেবগণের সহিত উহা দিগের কিরূপ বন্দোবস্ত ছিল, তাহা আমি জানি না; কিন্তু সে দিবস আমরা গাড়ি লইয়া গিয়াছিলাম, সেই দিবস যে বাবু আমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন, তিনিই আমাদিগের আফিসে আসিয়াছিলেন, এবং তিনিই আমার গাড়িতে চড়িয়া আড়গোড়া হইতে আমাদিগের গাড়ি তাঁহার সেই বাড়ীতে লইয়া যান। পরিশেষে তিনিই আমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করেন, এবং সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করেন।

কর্ম্মচারী। তোমাদিগের গাড়ির যে ভাড়া হইয়াছিল, তাহা তাঁহারা তোমাদিগের নিকট প্রদান করিয়াছিলেন কি?

আবদুল। না, ভাড়া আমাদিগের হস্তে প্রদান করিবেন কেন?

কৰ্ম্মচারী। তবে কি গাড়ির ভাড়া পরিশেষে তাহার নিকট হইতে আদায় করিয়া লওয়া হয়? আবদুল। গাড়ির ভাড়া পূৰ্ব্বে জমা দিয়া গাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়, কি পরিশেষে তাহাদিগের নিকট হইতে ভাড়া আদায় করা হয়, কি একবারেই ভাড়া লওয়া হয় নাই, তাহার কিছুমাত্র আমি অবগত নহি।

আবদুলের সহিত এইরূপে কর্ম্মচারীর কথাবার্তা হইতে হইতে উভয়েই গিয়া একখানি দ্বিতল বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। সেই স্থানে গমন করিয়াই, আবদুল সেই রাড়ী দেখাইয়া দিয়া কহিল, এই বাড়ী। আবদুলের এই কথা শুনিয়াই কর্ম্মচারী সেই স্থানে একটু দাড়াইলেন; দেখিলেন, উহা বড়গোছের একটী দ্বিতল বাটী; কিন্তু সেই বাটীর দরজা খোলা নাই। বাহির হইতে সদর দরজা তালাবদ্ধ। সেই বাটর অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, উহা একখানি খালি বাড়ী। সেই বাড়ীর দরজায় একখানি কাগজ মারা ছিল, উহাতে লেখাছিল, এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে। সম্মুখের মুদীর দোকানে অনুসন্ধান করিলে, এই বাড়ীর অবস্থা অবগত হইতে পারিবেন।

আমাদিগের উদ্দেশ্য কিয়ৎ পরিমাণে সিদ্ধ হইল। তখন কর্ম্মচারী আবদুলকে কহিলেন, ভাই, তুমি আমার নিমিত্ত যে এত পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করিলে, কিন্তু তাহার ফল কিছুই ফলিল না।

আবদুল। কেন?

কর্ম্মচারী। আমার আজকাল এমনই দুরদৃষ্ট হইয়াছে যে, যে ব্যক্তি নিজে আমাকে একটী চাকরী দিবেন বলিয়া, আমাকে তাঁহার বাড়ীতে আসিতে কহিলেন, আমার দুর্ভাগ্য বশতঃ তিনি সেই বাটী পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছেন! যাহা হউক ভাই, তোমাকে আমি আর অধিক কষ্ট দিতে চাহি না, তুমি এখন আপন স্থানে গমন কর। কিন্তু ভাই, সবিশেষ চেষ্টা করিয়া দেখিও, যদি তোমাদিগের ওখানে আমার একটী কাৰ্য্যের যোগাড় হয়। আমি মধ্যে মধ্যে গিয়া তোমার এবং কোচবানজির সহিত সাক্ষাৎ করিব।

কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া আবদুল সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। কৰ্ম্মচারীও অপর আর একটী গলির ভিতর প্রবেশ করিলেন।

এ পর্যন্ত আমি তাহাদিগের সন্নিকটেই ছিলাম। আবদুল সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে পর, কর্ম্মচারী আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও কহিলেন, এ পর্যন্ত সহিসের সহিত আমার যে সকল কথা হইয়াছে, তাহার আদ্যোপান্ত আপনি শুনিয়াছেন ত?

আমি। সমস্তই শুনিয়াছি।

কর্ম্মচারী। উঁহারা যে বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, সে বাড়ীও দেখিয়াছেন?

আমি। তাহাও দেখিয়াছি। উহা এখন তালাবদ্ধ।

কর্ম্মচারী। এখন আর কি করিতে হইবে?

আমি। এখন দেখিতে হইবে, এই বাড়ী ভাড়া কে লইয়া ছিল। যে রাণী এই বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তাহার যদি কোন রূপ সন্ধান করিতে পারি, তাহা হইলে অনেক কথা বাহির হই বার সম্ভাবনা।

কর্ম্মচারী। কিরূপ উপায়ে রাণীর সন্ধান পাওয়া যাইতে পারিবে?

আমি। যাহার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তিনি যদি কোনরূপ সন্ধান বলিয়া দিতে পারেন।

কর্ম্মচারী। তবে চলুন, কাহার বাড়ী, অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা যাউক।

আমি। অদ্য রাত্রি হইয়া আসিয়াছে, রাত্রিকালে এ কার্যের সুবিধা হইবে না; কল্য প্রাতঃকালে ইহার বন্দোবস্ত করিব। তদ্ব্যতীত আরও একটী কাৰ্য্য আমাদিগের বাকী থাকিল, যে ব্যক্তি আড়গোড়া হইতে গাড়ি ভাড়া করিয়া এই বাড়ীতে আসিয়া ছিল, সেই ব্যক্তি কালীবাবু কি না। তাহাও আবদুল প্রভৃতির নিকট হইতে আমাদিগকে জানিয়া লইতে হইবে।

এইরূপ পরামর্শ করিয়া আমরা সে দিবস আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিলাম।

সপ্তম পরিচ্ছেদ।

সেই রাত্রিতে এ সম্বন্ধে আর কোনরূপ অনুসন্ধান করিলাম না। পরদিবস অতি প্রত্যূষে উঠিয়া যে বাড়ী রাণীজি ভাড়া করিয়াছিলেন, সেই বাড়ীর উদ্দেশে গমন করিলাম। দিবাভাগে সেই বাড়ীটী আর একবার দেখিয়া লইলাম, দরজার উপর যে কাগজ লাগান ছিল, তাহা হইতে বাড়ীর অধিকারীর নাম এবং তাঁহার ঠিকানা লিখিয়া লইলাম। সেই বাড়ীর সন্নিকটে যে একটা মুদীর দোকান ছিল, সেই মুদী এই বাড়ী সম্বন্ধে কোন কথা অবগত আছে কি না, তাহা জানিবার জন্য তাঁহার নিকটেও একবার গমন করিলাম, এবং তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এই বাড়ীটী কি ভাড়া দেওয়া যাইবে?

মুদী। এই বাড়ীতে প্রায়ই ভাড়াটিয়া থাকে, যদি উহা খালি থাকে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই উহা ভাড়া দেওয়া হইবে।

মামি। সেই বাড়ী এখন খালি আছে, কি অপর কোন ব্যক্তি উহা গ্রহণ করিয়াছে, তাহা আপনি অবগত আছেন কি?

মুদী। আমার বোধ হয়, এই বাড়ী খালি নাই, উহা ভাড়া হইয়া গিয়াছে।

আমি। আপনি জানেন, কে উহা ভাড়া লইয়াছে?

মুদী। তাহা আমি জানি না।

আমি। তবে আপনি কিরূপে জানিলেন যে, সেই বাড়ী ভাড়া হইয়া গিয়াছে?

মুদী। আজ কয়েকদিবস হইল, আমি এই বাড়ীর দরজা খোলা দেখিতে পাই। আরও দেখিতে পাই, সেই দরজার সম্মুখে একখানি জুড়িগাড়ি ও একখানি কম্পাস গাড়ি দাড়াইয়াছিল। তাহাতেই আমি অনুমান করিতেছি, কোন বড়লোক এই বাড়ী ভাড়া লইয়া থাকিবে।

আমি। আমি এই বাড়ীর সম্মুখে গিয়াছিলাম, দেখিলাম, উহার দরজায় লেখা আছে, এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে। এবং সদর দরজা তালা দ্বারা বন্ধ করাও আছে।

মুদী। তাহা হইলে বোধ হয়, এই বাড়ী এখনও খালি আছে।

আমি। আপনি জানেন, এই বাড়ীর ভাড়া কত?

মুদী। না মহাশয়! তাহা আমি অবগত নহি।

আমি। এই বাড়ীর চাবি কাহার নিকট থাকে, তাহা আপনি বলিতে পারেন কি?

মুদী। না মহাশয়! তাহা আমি জানি না। দরজায় যে কাপজ মারা আছে, তাহাতে লেখা নাই?

আমি। যে স্থানে এই বাড়ী সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে হইবে, তাহা লেখা আছে; কিন্তু কোন্ স্থানে এই বাড়ীর চাবি আছে, তাহা লেখা নাই। তাহাই আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ছিলাম।

মুদী। তাহা হইলে মালিকের বাটীতে গমন করিলেই সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারিবেন, এবং বাড়ীর চাবিও পাইবেন।

আমি। সেই ভাল, তাহা হইলে আমি সেই স্থানেই গমন করি।

এই বলিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিয়া সেই বাটীর মালিকের উদ্দেশে চলিলাম। বাটীর দরজার উপর যে ঠিকানা লেখা ছিল, সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া একটু অনুসন্ধান করাতেই সেই বাটীর মালিকের সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি তাহার বাটী হইতে বাহিরে আসিয়াই আমাকে জিজ্ঞাসা করি লেন, আপনি কি নিমিত্ত আমার অনুসন্ধান করিতেছেন?

আমি। আপনার যে একখানি বাটী খালি আছে, তাহা আপনি ভাড়া দিবেন কি?

মালিক। হাঁ, আমার বাটী খালি আছে, এবং উহা ভাড়াও দেওয়া যাইবে; কিন্তু আজকাল নহে। দিনকতক পরে আসিলেই সেই বাটী আপনি পাইতে পারিবেন।

আমি। আপনার সেই বাটীর ভাড়া কত? মালিক। পঞ্চাশ টাকা।

আমি। এখন সেই বাটী ভাড়া দিতে আপনার সবিশেষ কোনরূপ প্রতিবন্ধক আছে কি?

মালিক। না থাকিলে আর আমি আপনাকে বলিব কেন?

আমি। কি প্রতিবন্ধক আছে, তাহা আমি জানিতে পারি কি?

মালিক। অপর কোনরূপ প্রতিবন্ধক নাই। আজ কয়েক দিবস হইল, একটী বাবু, একমাসের অগ্রিম ভাড়া দিয়া একমাসের নিমিত্ত সেই বাটী ভাড়া লন, এবং আমার নিকট হইতে সেই বাটীর চাবি লইয়া যান। যখন তিনি সেই বাটী ভাড়া লন, তখন তিনি বলিয়াছিলেন, পশ্চিমদেশ হইতে একজন রাণী কলি কাতা দেখিবার নিমিত্ত আগমন করিবেন, এবং তিনিই সেই বাড়ীতে দশ বারদিন থাকিবেন মাত্র। সেই বাবুটী আমাকে এই কথা বলিয়া আমার বাড়ী ভাড়া লন, এবং বাড়ীর চাবি লইয়া যান। দুই তিনদিবস পরেই সেই বাড়ীর চাবি তিনি আমাকে ফিরাইয়া দিয়া যান, ও বলিয়া যান যে, রাণীজির বোধ হয়, এখন আসা হইল না। তবে যদি ইহার মধ্যে তিনি আইসেন, তাহা হইলে আমি আসিয়া পুনরায় চাবি লইয়া যাইব। একমাসের মধ্যে যদি তিনি আসেন, তাহা হইলে সেই বাড়ী আপনি অপরকে একমাস পরে অনায়াসেই ভাড়া দিতে পারেন। এখন বলুন দেখি মহাশয়! একমাসের মধ্যে আমি সেই বাড়ী অপরকে কিরূপে ভাড়া দিতে পারি? প্রকৃত প্রস্তাবে বলিতে হইলে, সেই বাড়ী আমার হইলেও একমাসের মধ্যে উহাতে হস্তক্ষেপ করিবার ক্ষমতা আমার নাই।

আমি। একমাস পরে সেই বাড়ী ভাড়া দিতে আপনার বোধ হয়, আর কোনরূপ আপত্তি হইবে না।

মালিক। কিছু না। একমাস কেন, একমাসের প্রায় অর্ধেক গত হইয়া গেল, যে কয়দিবস বাকী আছে, তাহার পরে সেই বাড়ী ভাড়া দিতে আর কোনরূপ আপত্তি নাই।

আমি। এই কয়দিবসের মধ্যে আপনি বাড়ী ভাড়া না দিন। কিন্তু উহা একবার দেখিতে বোধ হয়, আপনার কোনরূপ আপত্তি নাই?

মালিক। তাহাতে আর আপত্তি কি? আপনার যখন ইচ্ছা হয়, তখনই আপনি গিয়া আমার বাড়ী দেখিতে পারেন।

আমি। আপনার যদি কোনরূপ আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে এখনই গিয়া আমি আপনার বাড়ী দেখিয়া আসিতে পারি। বাটী দেখিয়া যদি আমার মনমত হয়, তাহা হইলে সেই বাট ভাড়া লইয়া কথাবার্তা শেষও হইয়া যাইতে পারে।

মালিক। আপনাকে বাটী দেখাইতে আমার কিছুমাত্র আপতি নাই; কিন্তু আপনার সহিত গমন করিতে পারে, এরূপ কোন লোক এখন এ স্থানে উপস্থিত নাই। আমারও কোন একটা সবিশেষ প্রয়োজনে এখনই বাহির হইয়া যাইতেছি। সুতরাং আমিও এখন আপনার সহিত গমন করিতে পারিতেছি না। আপনি অনুগ্রহপূর্বক অপর কোন সময়ে আগমন করিবেন, সেই সময় হয় আমি নিজে আপনার সহিত গমন করিব, না হয়, অপর কোন লোককে আপনার সঙ্গে পাঠাইয়া দিব। আমি এখনই সেই বাটীর চাবি আপনার হস্তে প্রদান করিতাম; কিন্তু মহাশয়! মার্জনা করি বেন, আপনি আমার নিকট একবারে অপরিচিত বলিয়া, সেই বাটীর চাবি আপনার হস্তে প্রদান করিতে পারিলাম না। কলি কাতা সহর, অনেক দেখিয়া শুনিয়া চলিতে হয়।

আমি। আচ্ছা মহাশয়! তাহাই হইবে। অপর আর এক সময় আসিয়া আমি আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এবং সেই সময় চাবি লইয়া গিয়া আপনার বাটী দেখিয়া লইব।

মালিক। তাহা হইলে আমি এখন আমার কাৰ্য্যে গমন করিতে পারি?

আমি। আর একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।

মালিক। আর কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?

আমি। যে বাবুটা আপনার নিকট হইতে একমাসের জন্য বাটী ভাড়া লইয়াছিল, তাহাকে আপনি চিনেন কি?

মালিক। তিনি আমার নিকট পরিচিত নহেন।

আমি। তিনি কোথায় থাকেন, তাহা আপনি বলিতে পারেন?

মালিক। না।

আমি। আমি যদি অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে আপনার নিকট আনিতে পারি, এবং এখন হইতে আমাকে সেই বাটী ভাড়া দিতে যদি তাঁহার কোনরূপ আপত্তি না থাকে, তাহা হইলে সেই বাটী আপনি আমাকে ভাড়া দিতে পারিবেন কি?

মালিক। তাহা পারিব না কেন, তাহার কোনরূপ আপত্তি না থাকিলেই হইল।

সেই বাটীর মালিকের সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, অপর আর কোন সময়ে পুনরায় তাহার নিকট আগমন করিব, এই বলিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম; তিনিও আপন কার্যে গমন করিলেন।

প্রথম অংশ সম্পূর্ণ।

রাণী না খুনি? (শেষ অংশ)

রাণী না খুনি? (শেষ অংশ)
(অর্থাৎ অপরিচিত ব্যক্তিকে বিশ্বাস করিবার চূড়ান্ত ফল!)
Detective Stories No, ৪1. দারোগার দপ্তর ৮১ম সংখ্যা
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে শ্রীবাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত
All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। পৌষ

রাণী না খনি?
(শেষ অংশ)

প্রথম পরিচ্ছেদ।

বাড়ীওয়ালার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া আমি প্রথমতঃ আমার খানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থান হইতে পূৰ্ব-কথিত কর্ম্মচারীদ্বয়কে সঙ্গে লইয়া পুনরায় কালীবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সময় আমরা কালীবাবুর নিকট গিয়া উপ স্থিত হইলাম, সেই সময় কালীবাবু ও ত্রৈলোক্য উভয়েই তাহা দিগের গৃহে বসিয়াছিল। আমাদিগকে দেখিয়া ত্রৈলোক চিনিতে পারিল, এবং সেই স্থানে উপবেশন করিতে কহিল। আমরা তিনজনেই সেই স্থানে উপবেশন করিলাম। আমাদিগকে দেখিয়া কালীবাবু কহিল, কি মহাশয়! পুনরায় কি মনে করিয়া? আসামী ধরা পড়িয়াছে না কি?

আমি। আসামী এখনও ধরা পড়ে নাই, ধরিবার চেষ্টাতেই খুরিয়া বেড়াইতেছি। যে মোকদ্দমায় রামজীলালের নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে, সেই মোকদ্দমার বিষয় আমি এখনও সম্পূর্ণরূপে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। তাই পুনরায় আপনার নিকট আসিয়াছি।

কালী। বলুন, আমাকে কি সাহায্য করিতে হইবে। আমাকে যেরূপ ভাবে সাহায্য করিতে বলিবেন, আমি সেইরূপ ভাবে সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি।

আমি। সবিশেষ কোনরূপ সাহায্য করিবার সময় এখনও সময় উপস্থিত হয় নাই। যখন বুঝিতে পারি, আপনার সাহায্যের সবিশেষ প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে, তখন আপনার সাহায্য প্রার্থনা করিব। এখন কেবল দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি মাত্র।

কালী। আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহা আপনি অনায়াসেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।

আমি। আপনি ঠিক বলুন দেখি, সেই জহরতগুলি কাহার নিমিত্ত আপনি দোকান হইতে খরিদ করিয়া আনিয়াছিলেন?

কালী। সেই সকল জহরত আমি আমার নিজের জন্য খরিদ করিয়াছিলাম না। যাঁহার নিমিত্ত খরিদ করিয়াছিলাম, সে কথা ত আমি পূৰ্বেই আপনাদিগকে বলিয়াছি। যাহার নিমিত্ত, জহরত খরিদ করা হইয়াছিল, তাঁহাকে রামজীলালও স্বচক্ষে দেখিয়া গিয়াছিল।

আমি। তাহাকে রামজীলাল দেখিয়াছিল, তুমি দেখিয়াছিলে, এবং ত্রৈলোক্যও দেখিয়াছিল, এ কথা ত আমরা পূর্বেই শুনিয়াছি। এখন ত আর রামজীলালকে পাইতেছি না যে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিব। সেই নিমিত্তই তোমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, যে ব্যক্তি জহরত খরিদ করিয়াছিলেন, তিনি কে?

রাণী না খুনী?

কালী। তিনি একজন জমিদার। একথাও পূর্বে আমরা আপনাকে বলিয়াছি।

আমি। পূৰ্ব্বে যাহা বলিয়াছ, তাহাও শুনিয়াছি, এখন যাহা বলিবে তাহাও শুনিব। তিনি কোন্ দেশীয় জমিদার?

কালী। পশ্চিমদেশীয় জমিদার।

আমি। তুমি পূর্বে বলিয়াছিলে, তিনি বাঙ্গালি। এখন বলিতেছ, তিনি পশ্চিমদেশীয়। তোমার কোন কথা প্রকৃত, তাহা এখন আমাকে সবিশেষ করিয়া বলিতে হইতেছে। তুমি জানিও, আমি জানিতে পারিয়াছি, সেই জমিদার কে?

কালী। যদি আপনি জানিতে পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাকে আর জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন কি?

আমি। প্রয়োজন সবিশেষরূপ আছে বলিয়াই জিজ্ঞাসা করি তেছি। এখন তুমি আমার কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে কি না?

কালী। প্রকৃত কথা কেন বলিব না? আপনি আমাকে প্রতারণা করিতেছেন কেন? আমি এত চেষ্টা করিয়া পরিশেষে যাহার আর সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই, তাহাকে আপনি সন্ধান করিয়া বাহির করিবেন কি প্রকারে?

আমি। আমি কিরূপে তাহার সন্ধান করিয়াছি, তাহা তুমি জানিতে চাও?

কালী। যদি অনুগ্রহ করিয়া বলেন।

আমি। কালীবাবু! তুমি মনে করিতেছ যে, তোমার সদৃশ চতুর লোক আর কেহই নাই; কিন্তু তোমার মনে করা কর্তব্য যে, তোমা অপেক্ষা অধিক চতুর লোক, বোধ হয়, অনেক থাকিতে পারে। আচ্ছা আমি কিরূপে সেই জমিদারের অনুসন্ধান করিয়াছি, তাহা তোমাকে বলিতেছি; একটু মনোযোগ দিয়া শুনিলেই অনা য়াসেই তাহা বুঝিতে পারিবে। তুমি রামজীলালকে যে সকল নোট প্রদান করিয়াছিলে, সেই সকল নোট তুমি সেই জমিদার অর্থাৎ যে ব্যক্তি সেই সকল জহরত গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহার নিকট হইতে পাইয়াছ, কেমন একথা প্রকৃত কি না?

কালী। তদ্ভিন্ন সেই সকল নোট আর আমি কোথায় পাইব?

আমি। সেই সকল নোটের মধ্যে অনেকগুলি নম্বরী-নোট আছে?

কালী। আছে, তাহার নম্বর ত আমি আপনাদিগকে দিয়াছি।

আমি। আমাদিগের দেশে যাহার হাতে নম্বরী-নোট পড়ে, তিনি সেই সকল নম্বরী-নোটের নম্বর রাখিয়া থাকেন, একথা বোধ করি তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করিবে?

কালী। নতুবা আমি আপনাকে সেই সকল নোটের নম্বর কিরূপে দিতে পারিলাম?

আমি। তুমি জান, যে সকল নোট সরকার বাহাদুর এদেশে চালাইতেছেন, তাহা কোথা ছাপা হয়, এবং কোথা হইতে প্রথম আমাদিগের দেশে প্রচারিত হয়?

কালী। শুনিয়াছি, সমস্ত নোট বিলাত হইতে ছাপা হইয়া এদেশে আইসে, এবং করেসি আফিস হইতে প্রথমতঃ সেই নোট বাহির হইয়া, ক্ৰমে এদেশীয় লোকের নিকট গিয়া উপস্থিত হয়।

আমি। করেসি আফিস হইতে যে সকল নোট বাহির হয়, তাহার নম্বর করেসি আফিসে থাকে কি না, তাহা তুমি বলিতে

কালী। করেনসি আফিসে নিশ্চয়ই নম্বর রাখিয়া থাকে।

আমি। আর যে সকল নম্বরী-নোট সেই স্থান হইতে যাহাকে দেওয়া হয়, তাহার নাম ও ঠিকানা সেই স্থানে লেখা থাকে; তাহাও বোধ হয়, তুমি অবগত আছ?

কালী। তাহাও রাখিবার খুব সম্ভাবনা।

আমি। তাহা হইলে এখন তুমি বুঝিতে পারিলে যে, আমি তোমার সেই জমিদারের ঠিকানা করিতে পারিয়াছি কি না?

কালী। না মহাশয়! আপনার এই কথায় আমি কিরূপে জানিতে পারি যে, আপনি কিরূপে জমিদার মহাশয়ের ঠিকানা করিতে পারিয়াছেন?

আমি। আমি যাহা বলিলাম, তাহা অপেক্ষা আরও স্পষ্ট করিয়া না বলিলে যে তুমি বুঝিতে পারিবে না, ইহাই আশ্চর্য্য। যাহা হউক, আরও স্পষ্ট করিয়া আমি তোমাকে বলিতেছি। তোমার সেই জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে তুমি যে সকল নোট পাই মাছ, তাহার নম্বর তুমিই আমাদিগকে প্রদান করিয়াছ। ইহার পরই আমি করেসি আফিসে গিয়া জানিতে পারি, কোন তারিখে সেই সকল নোট সর্বপ্রথমে করেসি আফিস হইতে বাহির হয়, এবং কাহাকে প্রদান করা হয়। পরে তাহার নিকট গিয়া জানিতে পারি, সেই নোট তিনি কাহাকে প্রদান করেন। এইরূপে অ সন্ধান করিতে করিতে সেই সকল নোট তুমি যাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছ, তাহার নিকট গিয়া উপস্থিত হই, এবং তাহার প্রমুখাৎ জানিতে পারি, যাহা যাহা ঘটিয়াছিল। তিনি আমাকে আরও বলিয়াছেন, যে সকল জহরতের পরিবর্তে তোমাকে সেই সকল নোট প্রদান করা হয়, আবশ্যক হইলে সেই সকল জহরতও তিনি আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিবেন। এখন বুঝিতে পারিলে, অনুসন্ধানের কোন্ উপায় অবলম্বন করিয়া এই সকল বিষয় আমি জানিয়া লইয়াছি?

কালী। তাহা এখন বুঝিতে পারিয়াছি।

আমি। এখনও তুমি আমাদিগের নিকট মিথ্যা কথা বলিতেছ কি না, তাহাই জানিবার নিমিত্ত তোমাকে আমি জিজ্ঞাসা করি তেছি, সেই জমিদার কে? কারণ, ইতিপূর্বে তুমি আমাদিগের নিকট কয়েকটা কথা মিথ্যা বলিয়াছ।

কালী। আমি সেই জমিদার মহাশয়ের নাম জানি না।

আমি। তিনি কোন্ দেশীয় লোক?

কালী। পশ্চিমদেশীয়।

আমি। পূর্বে কেন বলিয়াছিলে যে, তিনি একজন বঙ্গদেশীয় জমিদার-পুত্র?

কালী। একথা কি আমি পূর্বে বলিয়াছিলাম?

আমি। বলিয়াছিলে।

কালী। যদি বলিয়া থাকি, তাহা হইলে ভুল-ক্রমে বলিয়া থাকিব।

আমি। তুমি যে সময় তাঁহার বাসায় গিয়া জহরত সকল প্রদান কর, সেই সময় সেই স্থানে আর কে ছিল?

কালী। আর কেহ ছিল বলিয়া, আমার মনে হয় না।

আমি। রামজীলাল?

কালী। রামজীলাল ত ছিলই। কিন্তু মহাশয়! রামজীলাল ঠিক সেই সময় তাহার নিকট গমন করেন নাই, তিনি বাহিরে ছিলেন।

আমি। রামজীলালকে বাহিরে রাখিয়া তুমি একাকীই বাড়ীর ভিতর গমন করিয়াছিলে?

কালী। হাঁ।

আমি। জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে টাকা আনিয়া তুমিই রামজীলালের হস্তে প্রদান কর?

কালী। হাঁ। আমি। জমিদার মহাশয় এখন সেই বাড়ীতে আছেন কি?

কালী। আজ কয়েকদিবস পর্যন্ত আমি সেদিকে যাই নাই। বোধ হয়, থাকিতে পারেন।

আমি। সেই বাড়ীটা তুমি এখন আমাকে দেখাইয়া দিতে পার?

কালী। পারিব না কেন? তবে জিজ্ঞাসা করি, যখন আপনার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছে, তখন আপনি ত তাহার সেই বাড়ী জানেন।

আমি। আমার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয় নাই। অপর আর একজন কর্ম্মচারীকে আমি তাঁহার নিকট পাঠাইয়াছিলাম। সেই কর্ম্মচারীকে তিনি যাহা বলিয়াছেন, কেবল তাহাই আমি অবগত আছি মাত্র। আমি নিজে সেই বাড়ী চিনি না, এই নিমিত্তই সেই বাড়ী দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত আমি তোমাকে বলিতেছি। যে কর্ম্মচারী সেই বাড়ী দেখিয়া আসিয়াছিলেন, তিনিও এখন এখানে নাই। অপর কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছেন।

কালী। তাহা হইলে চলুন, আমি আপনার সহিত গমন করিয়া সেই বাড়ী আমি আপনাকে দেখাইয়া দিতেছি।

কালীবাবুর কথা শুনিয়া আমি সেই স্থানে আর কালবিলম্ব করিলাম না। তাহাকে লইয়া তখনই সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আমি মনে করিয়াছিলাম, আড়গোড়ার সহিসের সাহায্যে আমরা যে বাড়ীর অনুসন্ধান পাইয়াছিলাম, কালীবাবু সেই বাড়ীই আমাদিগকে দেখাইয়া দিবেন; কিন্তু পরে দেখিলাম, আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, কালীবাবু সেই বাড়ী আমাদিগকে দেখাইয়া না দিয়া, অন্য স্থানে অপর একখানি বাড়ী দেখাইয়া দিল। সেই বাড়ীর দরজায় একজন দ্বারবান্ বসিয়া আছে দেখিয়া, তাহাকে দুই একটী কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তাহার নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, তাহার মনিব পশ্চিমদেশীয় একজন জমিদার সেই বাড়ীতে ছিলেন; কিন্তু কয়েকদিবস হইল, তাঁহার দেশে গমন করিয়াছেন। আরও জানিতে পারিলাম যে, কালীবাবু সেই দ্বারবানের নিকট পরিচিত। দ্বারবান তাহার মনিবের নিকট অনেকবার কালীবাবুকে দেখিয়াছে। দ্বারবান্ ইহাও বলিল যে, কালীবাবুর নিকট হইতে তাহার মনিব অনেকগুলি মূল্যবান, কাপড় ও জহরত খরিদ করিয়াছেন।

দ্বারবানের নিকট আমি এই সকল কথা অবগত হইয়া আমি পুনরায় কালীবাবুর সঙ্গে তাহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

কালীবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া আমি পুনরায় তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কালীবাবু! তুমি পূর্ব হইতে এ সম্বন্ধে এত মিথ্যা কথা বলিয়া আসিতেছ কেন?

কালী। কেন মহাশয়! আমি কি মিথ্যা কথা কহিলাম?

আমি। আবার বলিতেছ, আমি কি মিথ্যা কথা কহিলাম? যে ব্যক্তি জহরত খরিদ করিয়াছেন, তিনি পূর্বে বঙ্গদেশীয় একজন জমিদার-পুত্র ছিলেন। কিন্তু এখন দেখিতে দেখিতে তিনি একজন পশ্চিমদেশীয় জমিদার হইয়া পড়িলেন?

কালী। উনি বাঙ্গালি কি পশ্চিমদেশীয় লোক, তাহা আমি সেই সময় ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।

আমি। ভাল, ইহাই যেন বুঝিতে না পারিয়াছিলে; কিন্তু যাহার বাড়ী তুমি পূৰ্ব্বে জানিতে না, এখন তাহার বাড়ী তুমি কিরূপে আমাকে দেখাইয়া দিতে সমর্থ হইলে?

কালী। তাহার বাড়ী আমি চিনি না, একথা যদি পূর্বে আমি আপনাকে বলিয়া থাকি, তাহাও ভুল-ক্রমে বলিয়া থাকিব।

আমি। ইহাও যদি তুমি ভুল-ক্রমে বলিয়া থাক, তাহা হইলে তুমি পূর্বে কিরূপে বলিয়াছিলে যে, জহরতগুলি সেই জমিদার মহাশয় রামজীলালের নিকট হইতে ত্রৈলোকের ঘরে বসিয়া খরিদ করেন, অথচ এখন দেখিতেছি, তুমি তাহার বাড়ীতে গিয়া তাহার নিকট সেই জহরতগুলি বিক্রয় করিয়া আসিয়াছ? ইহার কোন কথা প্রকৃত?

কালী। ইহার উভয় কথাই প্রকৃত। আমি পূর্বেও বলিয়া ছিলাম, এখনও বলিতেছি যে, আমার কথা সমস্তই প্রকৃত। ইহার মধ্যে একটীও মিথ্যা কথা নাই। আমি জহরতগুলি সেই জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া বিক্রয় করিয়া আসি সত্য; কিন্তু টাকা গুলি ত্রৈলোক্যের এই গৃহে বসিয়া আমি রামজীলালের হস্তে প্রদান করি। তিনি উহা উত্তমরূপে গণিয়া-গাথিয়া লইয়া সেই স্থান হইতে চলিয়া যান।

আমি। একথা ত ঠিক নহে, তুমি প্রথমে বলিয়াছিলে, জমিদার-পুত্র ত্রৈলোকের গৃহে বসিয়া সেই সকল জহরত খরিদ করেন, এবং সেই স্থানেই তিনি তাহার মূল্য রামজীলালের হস্তে প্রদান করেন।

কালী। এরূপ কথা বলিয়াছি বলিয়া ত এখন আমার স্মরণ হইতেছে না।

আমি। তাহা হইলে আমাদিগের শুনিবারই ভুল হইয়া থাকিবে। সে যাহা হউক, রাণীজির কথাটা কি?

কালী। রাণীজি আবার কে?

আমি। যে রাণীজি জুড়িগাড়ি করিয়া বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন?

কালী। আমার জানিত কোন রাজি জুড়িগাড়ি করিয়া বড়বাজারে গমন করেন নাই। জমিদার মহাশয় গিয়াছিলেন, সে কথা ত আমি পূর্বেই আপনাদিগকে বলিয়াছি।

আমি। জমিদার মহাশয় বলেন, তিনি জহরত খরিদ করি বার নিমিত্ত বড়বাজারে একবারেই গমন করেন নাই। ইহাতে বোধ হইতেছে, জমিদার মহাশয় মিথ্যা কথা কহিতেছেন?

কালী। তিনি মিথ্যা কথা বলিতেছেন, একথা আমি বলিতে পারি না; তিনি ভুলিয়া গিয়াছেন। বড় মানুষের সকল সময় সকল কথা মনে থাকে না।

আমি। জমিদার মহাশয় যে জুড়িতে করিয়া বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন, সেই জুড়ি তুমি আড়গোড়া হইতে ভাড়া করিয়া আনিয়াছিলে কেন?

কালী। আমি জুড়িগাড়ি ভাড়া করিয়া আনিব কেন?

আমি। কেবল জুড়িগাড়ি নহে, একখানি কম্পাস গাড়িও যে তুমি ভাড়া করিয়া আনিয়াছিলে?

কালী। মিথ্যা কথা।

আমি। মিথ্যা কি সত্য, তাহা পরে জানিতে পারিবে। যে বাড়ীটী তুমি একমাসের নিমিত্ত ভাড়া করিয়াছিলে, তাহাতে কোন রাণীজি আসিয়া বাস করিয়াছিল?

কালী। আমি বাড়ী ভাড়া করি কেন?

আমি। কেন বাড়ী ভাড়া করিবে, তাহা তুমিই জান। তোমার বাড়ী ভাড়া করিবার কারণ আমি জানি না বলিয়াই আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।

কালী। আপনারা এ সকল নূতন মিথ্যা কথা কোথা হইতে বাহির করিলেন? মহাশয়! আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি; আপনি আমার কথায় রাগ করিবেন না। আপনাদিগের তদারকের গতিই কি এইরূপ? কাজের কথার দিকে আপনারা একবারের নিমিত্ত দৃষ্টিপাত না করিয়া, কেবল বাজে বিষয় অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছেন। কোথায় আপ

ফেরারী আসামীর অনুসন্ধান করিবেন, তাহা না করিয়া কেবল কতক বাজে বিষয় লইয়া মিথ্যা মিথ্যা ঘূরিয়া বেড়াইতেছেন। এরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিলে, এতক্ষণ ত আসামী ধরা পড়িল!

আমি। আমার কথায় তুমি রাগ করিও না। এই কার্যে যে আমি নূতন ব্রতী, তাহা বোধ হয়, তুমি অবগত আছ। সেই কারণেই সকল কথা সহজে আমি বুঝিয়া উঠিতে পারি না বলিয়াই, ইহার ব্যাপার উত্তমরূপে জানিয়া লইবার নিমিত্তই তোমাকে এতগুলি কথা জিজ্ঞাসা করিলাম, এবং আরও দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছাও আছে। এই সকল বিষয় প্রথমতঃ আমি ভালরূপ অবগত হইয়া, তাহার পর, আসামীর অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, ইহা আমার সম্পূর্ণরূপ ইচ্ছা। এতগুলি টাকা লইয়া রামজীলাল যে এখনও কলিকাতায় আছে, তাহা আমার বোধ হয় না। আমার বিশ্বাস, সে তাহার নিজের দেশে প্রস্থান করিয়াছে। সে বাহা হউক, আমিও তাহাকে অল্পে ছাড়িতেছি না। তাহার নিমিত্ত যদি তাহার দেশে পর্যন্তও আমাকে গমন করিতে হয়, তাহাতেও আমি প্রস্তুত আছি।

আমার এই কথা শুনিয়া কালীবাবু মুখে অতিশয় সন্তোষের ভাব প্রকাশ করিয়া আমাকে কহিলেন, আপনার যদি আর কোন কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন থাকে, তাহা একটু শীঘ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া লউন। কারণ, কোন কাৰ্যান্তরে এখনই গমন কারবার আমার সবিশেষ প্রয়োজন আছে।

কালীবাবু আমাকে এই কথাগুলি বলিল সত্য; কিন্তু সেই সময় তাহার অবস্থা এরূপ পরিবর্তিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হইতে লাগিল যে, যেন সে কোনমতেই আমার সম্মুখে দাড়াইতে আর সমর্থ হইতেছে না।

আমি। তোমাকে আমি এখন কেবলমাত্র একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।

কালী। কি?

আমি। যে পশ্চিমদেশীয় জমিদার তোমার নিকট হইতে জহরত গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহার সমভিব্যাহারে তুমি আর কোন বাড়ীতে গমন করিয়াছিলে কি?

কালী। গিয়াছিলাম বৈকি। ত্রৈলোকের গৃহে তাহাকে কয়েকবার সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলাম। ত্রৈলোক্য ত আপনার সম্মুথেই বসিয়া আছে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করুন না কেন; তাহা হইলেই ত জানিতে পারিবেন, আমার কথা সত্য কি না।

আমি। ত্রৈলোক্যকে আমি আর কি জিজ্ঞাসা করিব? তুমি যাহা বলিতেছ, সেও তাহাই বলিবে। তুমি যদি সেই জমিদারকে অপর কোন বাড়ীতে লইয়া না গিয়া থাক, তাহা হইলে আর এক খানি বাড়ী কাহার নিমিত্ত এবং কিসের জন্য ভাড়া করিয়াছিলে?

আমার এই কথা শুনিবামাত্রই ত্রৈলোকের যেন হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। সে একবার আমার মুখের দিকে তাকাইয়া কালীবাবুর মুখের দিকে তাকাইতে লাগিল। দেখিলাম, ত্রৈলোকের সঙ্গে সঙ্গে কালীবাবুরও মুখ শুখাইয়া উঠিয়াছে। আরও তাহার মুখ দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম, সে তাহার মনের ভাব গোপন করিতে বিধিমতে চেষ্টা করিতেছে; কিন্তু কোনরূপেই যেন কৃতকার্য হইতে পারিতেছে না।

আমার কথা শুনিয়া কালীবাবু যেন একটু রাগ ভাব প্রকাশ করিল ও কহিল, কি মহাশয়! আপনি আমার সহিত ঠাট্টা করিতেছেন, না বসিয়া বসিয়া স্বপ্ন দেখিতেছেন?

আমি। একরূপ স্বপ্নই বটে; নূতন বাড়ী ভাড়া করার নাম শুনিয়া তোমরা একবারেই চমকাইয়া উঠিলে যে! কোন রাণীজি আসিয়া একমাসকাল বাস করিবেন বলিয়া, একমাসের জন্য কোন বাড়ী তুমি ভাড়া কর নাই?

কালী। না।

আমি। আমি যদি সেই বাড়ী তোমাদিগকে দেখাইয়া দিতে পারি?

কালী। যখন আমি বাড়ী ভাড়া করি নাই, তখন আপনি আমাকে কিরূপে দেখাইয়া দিবেন? আর অপর কোন ব্যক্তির নিমিত্ত যদি একখানি বাড়ী ভাড়াই করিতাম, তাহা হইলেই বা কি ক্ষতি হইত? অপরের নিমিত্ত আমি বাড়ী ভাড়া করিয়াছিলাম, কি না করিয়াছিলাম, তাহার সহিত এ মোকদ্দমার কি সংব আছে, তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

আমি। এই মোকদ্দমার সহিত বাড়ী ভাড়ার কোনরূপ সংস্রব থাকুক, আর না থাকুক, তুমি অপর কোন বাড়ী ভাড়া করিয়াছিলে কি না, তাহাই আমি জানিতে চাই।

কালী। না।

আমি। তাহা হইলে তুমি ও ত্রৈলোক্য, তোমরা উভয়েই আমার সহিত আগমন কর। তুমি আমাকে দেখাইয়া দেও, আর না দেও, আমি সেই বাড়ী তোমাদিগকে দেখাইয়া দিতেছি।

কালী। আমার একটী সবিশেষ প্রয়োজন আছে, এখন আমি আপনার সহিত গমন করিতে পারিব না।

আমি। আমার সহিত যাইতেই হইবে। সহজে তুমি আমার সহিত না যাও, অসহজে যাইবে।

এই বলিয়া আমি কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। তাঁহারা উভয়েই আমার সহিত গমন করিতে অস্বীকৃত হইয়াছিল; কিন্তু আমি তাহা না শুনিয়া একরূপ বলপ্রয়োগ করিয়াই তাহাদিগকে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আমার সমভিব্যাহারী কেবল একজন কর্ম্মচারী সেই স্থানে রহিলেন মাত্র।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

যাহার নিকট হইতে কালীবাবু বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলেন, তাহাকে সেই বাড়ীতে আনিবার নিমিত্ত আমি পূৰ্ব্ব হইতেই বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছিলাম। কালীবাবু এবং ত্রৈলোক্যকে একখানি গাড়িতে করিয়া লইয়া, যখন আমি সেই বাড়ীর সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন আমার বেশ অনুমান হইল যে, উভয়েরই হিতাহিত জ্ঞান যেন তিরোহিত হইয়াছে, এবং উহার আমাকে কি বলিবার নিমিত্ত যেন প্রস্তুত হইতেছে। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁহারা তাহাদিগের মনের ভাব কতক পরি মাণে পরিবর্তিত করিয়া লইল; যাহা বলিতে যাইতেছিল, তাহা আর বলিল না।

আমাদিগের সেই স্থানে উপস্থিত হইবার একটু পরেই আর একখানি গাড়ি আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। উহার মধ্য হইতে দুইজন আরোহী বহির্গত হইলেন। একজন আমারই অধীনস্থ কর্ম্মচারী; অপর ব্যক্তি সেই বাড়ীর অধিকারী। তিনি কালীবাবুকে দেখিয়াই কহিলেন, এই বাবুটাই একমাসের নিমিত্ত আমার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলেন। কালীবাবুকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, কেমন মহাশয়! এখন আমি এই বাড়ী অপর আর কাহাকেও ভাড়া দিতে পারি?

কালীবাবু তাহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া নিতান্ত স্থিরভাবে সেই স্থানে দাঁড়াইয়া রহিল।

বাড়ীর অধিকারী চাবি হস্তে সেই বাড়ীর দরজা খুলিতে গিয়া দেখেন, সেই বাড়ীর সম্মুখে দ্বারবানবেশে একটী লোক বসিয়া রহিয়াছে। তাহাকে দেখিয়াই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে? আমার বাড়ীর দরজায় রসিয়া রহিয়াছ? সেই ব্যক্তি তাহার কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান না করিয়া, আমার ইঙ্গিত অনুসারে সেই স্থান হইতে উঠিয়া একটু দূরে গিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। বলা বাহুল্য, সেই ব্যক্তিও আমাদিগের একজন কর্ম্মচারী। আমাদিগের অবর্তমানে কেহ সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে না পারে, এই নিমিত্তই তাঁহাকে সেই স্থানে পূর্ব হইতেই রাখা হইয়াছিল।

বাড়ীর অধিকারী সেই বাড়ীর চাবি খুলিয়া দিলেন। আমরা সকলেই সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম।

আমরা সকলে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়া প্রথমতঃ উপরের, এবং পরিশেষে নীচের সমস্ত ঘরগুলি উত্তমরূপে দেখি লাম। দেখিলাম, সমস্ত ঘরগুলিই খালি, কোন ঘরে কিছুই নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া সকলেই সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইবার উদ্যোগ করিতেছেন, এরূপ সময়ে নিম্নের একখানি ঘরের দিকে

আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। বলা বাহুল্য, সেই ঘরের ভিতর আমরা পূৰ্বেই গমন করিয়াছিলাম। আমি পুনরায় সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, সেই গৃহের মেয়ের প্রস্তরের একস্থানে কতকগুলি মক্ষিকা ঘন ঘন বসিতেছে। এই ব্যাপার দেখিয়া সেই বাড়ীর অপরাপর গৃহগুলি পুনরায় সবিশেষরূপ লক্ষ্য করিয়া দেখিলাম; কিন্তু আর কোন স্থানে মক্ষিকা বসিতে দেখিতে পাইলাম না। সেই বাড়ীটী নুতন প্রস্তুত হইয়াছিল, উহাতে বে সকল নর্দমা বা ময়লা জল প্রভৃতি ফেলিবার স্থান আছে, সেই সকল স্থানও উত্তমরূপে দেখিলাম; কিন্তু আর কোন স্থানেই মক্ষিকা প্রভৃতি বসিতে দেখিতে পাইলাম না। তখন স্বভাবতই আমার মনে কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হইল। আমি আমার মনের ভাব অপরাপর কর্ম্মচারীগণকেও কহিলাম। সকলেই আমার মতে মত দিয়া কহিলেন, এই স্থানটী একবার ভাল করিয়া দেখি বার প্রয়োজন হইয়াছে। সুতরাং সেই স্থানের প্রস্তর কয়েকখানি একবারে উঠাইয়া ফেলিবার প্রয়োজন হইল।

সেই বাড়ীর অধিকারী মহাশয়কে সেই কথা বলাতে তিনি প্রথমতঃ আমাদিগের প্রস্তাবে অসম্মত হইয়া গৃহের প্রস্তর গুলি উঠাইয়া ফেলিতে নানারূপ আপত্তি করিতে লাগিলেন; কিন্তু আমরা কেহই তাহার আপত্তিতে কর্ণপাত না করিয়া, কোদালি ও সাবল প্রভৃতি সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। সেই সকল দ্রব্য সংগ্রহ করিতেও আমাদিগের কোনরূপ কষ্ট হইল না। সেই বাড়ীর একটী গৃহের ভিতর কতকগুলি চুন, সুরকি, বালী এবং সাবল, কোদালি প্রভৃতি রাখা ছিল। সেই স্থান হইতে সাবল ও কোদালি প্রভৃতি আনাইয়া, সেই স্থানের প্রস্তর উঠাইয়া ফেলা হইল। উঠাইবার সময় বেশ অনুমান হইল, উহা যেন একটু আঙ্গা ভাবে বসান রহিয়াছে, এবং যেন নূতন বসান বলিয়া বোধ হইল। সেই স্থানের দুই তিনখানি প্রস্তর উঠাইতে উঠাইতে সেই স্থান হইতে প্রথমে অল্প, এবং পরিশেরে অধিক পরিমাণে দুর্গন্ধ বাহির হইতে আরম্ভ হইল। যখন সেই স্থান হইতে ক্রমে পচাগন্ধ বাহির হইতে লাগিল, সেই সময় আমাদিগের মনে নানারূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। সেই সময় আমরা সকলে মিলিয়া শীঘ্র শীঘ্র সেই স্থানের মাটী ক্ৰমে উঠাইয়া ফেলিতে লাগিলাম। সেই স্থানের মৃত্তিকা খনন করিতে আমাদিগের সবিশেষ কোনরূপ কষ্ট হইল না; মাটী যতই উঠাইতে লাগিলাম, ততই যেন উহা আপ্পা বোধ হইতে লাগিল।

কালীবাবু ও ত্রৈলোক্য আমাদিগের সহিত সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল। সেই স্থানের মৃত্তিকা খনন করিতে দেখিয়া তাহাদিগের বাক্যালাপ বন্ধ হইল, মুখ কালিমা বর্ণ ধারণ করিল, চক্ষু যেন ঈষৎ রক্তিমবর্ণ ধারণ করিতে লাগিল। সেই স্থানে কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া, আর তাঁহারা দাড়াইতে পারিল না; নিতান্ত চিন্তিত অন্তঃকরণে সেই স্থানে বসিয়া পড়িল।

সেই স্থান হইতে অধিকাংশ মাটী এইরূপে উঠাইতে উঠা ইতে ক্রমে একটী গলিত মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়িল। সেই মৃতদেহ দেখিয়া স্পষ্টই অনুমান হইতে লাগিল, উহা কোন পুরুষের মৃতদেহ। কিন্তু উহা এতদূর বিকৃত ভাব ধারণ করিয়া ছিল যে, উহা কাহার দেহ, তাহা চিনিতে পারা গেল না; কিন্তু আমরা সকলেই অনুমান করিয়া লইলাম, সেই দেহ রামজীলালের দেহ ভিন্ন আর কাহারও দেহ নহে।

মৃত্তিকাগৰ্ভ হইতে সেই মৃতদেহী আমরা সবিশেষ সতর্কতার সহিত উঠাইলাম; দেহ হইতে গলিত মাংস ঋলিত হইতে দিলাম না। সেই দেহ গলিত অবস্থা ধারণ করিয়াছিল সত্য; কিন্তু তাহার পরিধানে যে সকল বস্ত্রাদি ছিল, তাহার একখানিও কোনরূপে নষ্ট হইয়াছিল না।

সেই স্থান হইতে মৃতদেহ বাহির করিবার পর, কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যের অবস্থা যে কিরূপ ধারণ করিয়াছিল, তাহার যথাযথ বর্ণনার ক্ষমতা আমার নাই। উঁহাদিগকে দেখিয়া, সেই সময় সহজে অনুমান করা কঠিন হইল যে, উঁহারা জীবিত কি মৃত। দশ বিশ ডাকের কম উঁহাদিগের মুখ হইতে প্রায়ই বাক্য উচ্চারিত হইল না, সহজে কোন কথার উত্তর আর একবারেই পাইলাম না। আমাদিগের প্রশ্নের উত্তরে কেবল উঁহারা বলিতে লাগিল যে, আমরা ইহার কিছুই অবগত নহি। সেই সময়ে আমাদিগের মধ্যে কোন কোন কর্ম্মচারী ত্রৈলোক্যকেই রাণীজি বলিয়া সম্বোধন করিতে লাগিল; কিন্তু ত্রৈলোক্য সেই সকল কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না।

সেই মৃতদেহ বাহির করিবার পরই একজন কর্ম্মচারীকে বড় বাজারে পাঠাইয়া দেওয়া হইল। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি রামজীলালের মনিব এবং তাহার দোকানের আর কয়েকজন কৰ্ম্ম চারীর সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করিলেন। মৃতদেহ দেখিয়া তাঁহারা রামজীলালের দেহ বলিয়া কোনরূপেই চিনিতে পারিলেন না; কিন্তু তাহার পরিহিত বস্ত্রাদি দেখিয়া তাঁহাদিগের আর চিনিতে বাকী থাকিল না। সকলেই একবাক্যে বলিয়া উঠিলেন, এই মৃতদেহ রামজীলালের।

যখন সেই মৃতদেহ রামজীলালের বলিয়া স্থিরীকৃত হইল, তখন যেরূপ ভাবে আমরা এ পর্যন্ত কালীবাবু ও ত্রৈলোক্যকে রাখিয়াছিলাম, এখন আর তাহাদিগকে সেইরূপে রাখিলাম না। এখন তাঁহারা খুনী মোকদ্দমার আসামীরূপে পরিগণিত হইল। এখন উভয়কেই আমরা বন্ধনাবস্থায় রাখিলাম, এবং উভয়কে পৃথক পৃথক স্থানে রাখিয়া পৃথক পৃথকরূপে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু ত্রৈলোকের নিকট হইতে কোন কথা প্রাপ্ত হইলাম না। যাহা জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহারই উত্তরে সে কহিল, আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

কালীবাবুকে আমরা অতিশয় চতুর বলিয়া মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু পরিশেষে দেখিলাম, কালীবাবু অপেক্ষা ত্রৈলোক্যই অতিশয় চতুর। তাহাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিয়া তাহার কোন রূপই উত্তর পাইলাম না; কিন্তু কালীবাবু পরিশেষে আমাদিগের নিকট সমস্ত কথা স্বীকার করিল। আমি তাহাকে কহিলাম, দেখ কালীবাবু! যেরূপ অবস্থায় তোমরা এখন পতিত হইয়াছ, ইহাতে আর তোমাদিগের কোনরূপেই নিষ্কৃতি নাই। তোমার বিপক্ষে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহাতে তুমি নিশ্চয়ই বেশ বুঝিতে পারিতেছ যে, এ যাত্রা তোমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। এখন ও তুমি আমার পরামর্শ শুন, এখনও তুমি প্রকৃত কথা-বল। তাহা হইলে তুমি কতদুর দোষী, তাহার যথার্থ অবস্থা আমরা অবগত হইব। নতুবা নিতান্ত অন্ধকারে থাকিয়া আমাদিগকে এই মোকদ্দমা চালাইতে হইবে। দায়ে পড়িয়া এরূপ অনেক বিষয়ের প্রমাণ হয় ত আমাদিগকে করিতে হইবে যে, বাস্তবিক তুমি হয় ত তাহা কর নাই, বা জান না। এই নিমিত্ত আমি তোমাকে বার বার বলিতেছি, তুমি যাহা যাহা করিয়াছ, তাহা আমাদিগকে স্পষ্ট করিয়া বল।

কালী। আচ্ছা মহাশয়! যখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, এ যাত্রা যখন কোনরূপেই আমার নিষ্কৃতি নাই, যে কোন উপায়েই হউক, আপনারা আমাদিগকে ফাঁসিতে ঝুলাইবেন, তখন আমি এই ঘটনার প্রকৃত অবস্থা প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ পর্যন্ত বলিতেছি।

আমি। এ নিতান্ত ভাল কথা।

কালী। কিছু দিবস অতীত হইল, পশ্চিমদেশীয় সেই জমিদার মহাশয় কলিকাতায় আগমন করেন।

আমি। কোন্ জমিদার?

কালী। যে জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে আমি আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম।

আমি। তাহার পর?

কালী। আমি শুনিয়াছিলাম, তাহার বাড়ীতে একটা বিবাহ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইবে। সেই বিবাহের নিমিত্ত কতকগুলি ভাল ভাল কাপড় এবং কিছু জহরত ক্রয় করিবার মানসে এবার তিনি কলি, কাতায় আসিয়া উপস্থিত হন। সেই সকল দ্রব্যাদি ক্রয় করিবার মানসে উপযুপরি কয়েকদিবস পর্যন্ত তিনি নিজেই বাজারে গমন করেন, এবং বাজারে ঘূরিয়া ঘূরিয়া তিনি নিতান্ত তক্ত হইয়া পড়েন। বাজারে গমন করিলেই, বাজারে যে সকল দালাল আছে, তাঁহারা আসিয়া তাহার সহিত মিলিত হয়, ও তিনি যে দ্রব্য ক্রয় করিতে চাহেন, সেই দ্রব্য ক্রয় করিয়া দেওয়াইবার মানসে তাহাদিগের পরিচিত যে সকল দোকানে সেই সকল দ্রব্য পাওয়া যায়, সেই সকল দোকানে তাঁহাকে লইয়া গিয়া তাহাকে সেই সকল দ্রব্য দেখায়। সেই সকল দ্রব্যের মধ্যে তাহার যে কোন দ্রব্য পসন্দ হয়, তাহার মূল্য চতুগুণ করিয়া বলিয়া দেয়। এইরূপে কয়েকদিবস পর্যন্ত অনবরত তিনি দালাল গণের সহিত বাজারে বাজারে ঘুরিয়া বেড়ান; কিন্তু কোন দ্রব্যই তিনি খরিদ করিয়া উঠিতে পারেন না।

আমি এই সংবাদ জানিতে পারিয়া একদিবস তাঁহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং তাহার সহিত আমি সাক্ষাৎ করি লাম। আমি বড়বাজারের একজন প্রধান দোকানদার এই কথা বলিয়া আমি সঁহার নিকট আমার পরিচয় প্রদান করিলাম ও কহিলাম, আজ কয়েকদিবস পৰ্য্যন্ত দেখিতেছি, আপনি কতক গুলি দ্রব্যাদি ক্রয় করিবার মানসে দালালগণের সহিত দোকানে দোকানে ঘূরিয়া বেড়াইতেছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কোন দ্রব্যই আপনি ক্রয় করিয়া উঠিতে পারেন নাই। আমার বিশ্বাস, যে পৰ্য্যন্ত সেই দালালগণ আপনাকে পরিত্যাগ না করিবে, সেই পৰ্যন্ত আপনি কোন দ্রব্য ক্রয় করিতে পারিবেন না। কারণ, উঁহারা আপনাকে সঙ্গে করিয়া যে কোন দোকানে লইয়া যাইবে, দোকানদার আপনার নিকট তাহারই চতুগুণ মূল্য চাহিয়া বসিবে। কারণ, সেই দ্রব্য যদি আপনার ক্রয় করা হয়, তাহা হইলে যে সকল দালাল আপনার সহিত সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, তাহাদিগের প্রত্যেককেই পৃথক পৃথক্‌রূপ দালালী সেই দোকানদারকে দিতে হইবে। দোকানদার পূর্বেই সেই অর্থ যদি আপনার নিকট হইতে গ্রহণ না করিবেন, তাহা হইলে তিনি দালালগণকে সন্তুষ্ট করিবেন কোথা হইতে?

আমার নিজের সকল প্রকার দ্রব্যের দোকান আছে বলিয়াই, আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। আমি যেরূপ অল্প মূল্যে আপনাকে দ্রব্যাদি দিতে পারিব, বাজারের অপর কোন ব্যক্তিই তাহা পারিবে না। আমার কথায় যদি আপনার বিশ্বাস

হয়, তাহা হইলে দুই একটী দ্রব্যের ফরমাইস আমাকে দিন, সেই দ্রব্য আনিয়া আমি আপনাকে প্রদান করি। আপনি বাজারে যাচাইয়া দেখুন, সেই দ্রব্যের মূল্য কত। তখন আপনি উহার মূল্য আমাকে প্রদান করিবেন। দেখিবেন, বাজার হইতেও কত কম মূল্যে আমি আমার দ্রব্যাদি বিক্রয় করিয়া থাকি।

আমার কথায় তিনি প্রথমতঃ সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিলেন বলিয়া অনুমান হইল। কিন্তু পরিশেষে আমাকে কহিলেন, আচ্ছা, আপনি আমার নিমিত্ত এক থান ভাল কিংখাপ কাপড় আনিবেন।

জমিদার মহাশয়ের এই কথা শুনিয়া আমি সেই দিবস আমার বাসায় চলিয়া আসিলাম; এবং কিছু অর্থ সহ বড়বাজারে গমন করিয়া এক থান অতি উৎকৃষ্ট কিংখাপ কাপড় ক্রয় করিয়া সেই দিবস সন্ধ্যার সময় পুনরায় সেই জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমার আনীত কিংখাপ দেখিয়া তাহার বেশ পসন্দ হইল, তিনি উহার দাম জিজ্ঞাসা করিলেন।

উত্তরে আমি কহিলাম, এ কাপড়ের দাম আমি এখন বলিব না। এই কাপড় অদ্য আপনার নিকট রহিল, আপনি ইহা একবার বাজার যাচাইয়া দেখুন, দোকানদারগণ ইহার কি দাম বলিয়া দেয়। আমি কল্য সন্ধ্যার সময় পুনরায় আপনার নিকট আসিব, সেই সময় ইহার দাম আপনাকে বলিব।

আমার প্রস্তাবে জমিদার মহাশয় সম্মত হইলেন, আমিও সেই কাপড় সেই স্থানে রাখিয়া আপনার বাসায় প্রত্যাবর্তন করিলাম।

পরদিবস বৈকালে আমি পুনরায় জমিদার মহাশয়ের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া সেই কাপড়ের দাম জিজ্ঞাসা করিলেন।

তাহার কথার উত্তরে আমি কহিলাম, মহারাজ! ইহার দাম আমি প্রথমে বলিব না, পশ্চাতে বলিব। এই কাপড় বাজারে যাচাইয়া ইহার কি দাম আপনি জানিয়াছেন, বা আপ নিইবা ইহার কি দাম দিতে ইচ্ছা করেন, তাহা আমি পূৰ্বে জানিতে ইচ্ছা করি। আপনি ইহা মনে করিবেন না যে, আপনি ইহার দাম আমার ন্যায্য দাম অপেক্ষা অধিক প্রদান করিলে, আমি গ্রহণ করিব। সেই কাপড়ের দাম এই কাগজে লিখিয়া আমি এই স্থানে রাখিয়া দিলাম, আমার ন্যায্য দাম অপেক্ষা যদি আপনি অধিক দাম প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি অধিক গ্রহণ করিব না। আমার ন্যায্য দামই আমাকে আপনি প্রদান করিবেন।

এই বলিয়া যে দামে আমি সেই কিংখাপ ক্রয় করিয়া আনিয়া ছিলাম, তাহার অর্ধেক দাম একখানি কাগজে লিখিয়া আমি সেই স্থানে রাখিয়া দিলাম। আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। তাঁহার কথার ভাবে অনুমান হইল, কি করে সেই কাপড় লওয়া যাইতে পারে, তাহা তিনি যাচাইয়া রাখিয়াছেন। তিনি আমার কথায় আর কোনরূপ দ্বিরুক্তি না করিয়া যে দরে তিনি সেই কাপড় ক্রয় করিতে পারেন, তাহা আমাকে বলিলেন। আমি দেখিলাম, যে দরে আমি উহা ক্রয় করিয়াছিলাম, তাহার অপেক্ষাও প্রায় এক-চতুর্থ অংশ কম করিয়া উহার দাম বলিলেন।

তাহার কথা শুনিয়া আমি একটু কপট আনন্দ প্রকাশ করিলাম ও কহিলাম, আমি আজ প্রকৃতই একজন খরিদ্দার পাইছি। যে ব্যক্তি দ্রব্যের উপযুক্ত দাম না জানেন, তাহার সহিত কেনা-বেচা করা যে কতদুর কষ্টকর কাৰ্য্য, তাহা যিনি করিয়া ছেন, তিনিই বলিতে পারেন। আপনি যে দাম বলিয়াছেন, তাহা এই বন্ত্রের প্রকৃত দাম; কিন্তু এই দ্রব্য কোন কারণ বশতঃ আমার কিছু কম মূল্যে ক্রয় করা ছিল বলিয়াই, আমি আপনাকে আরও কম মূল্যে দিতে পারিতেছি।

এই বলিয়া যে কাগজে আমি উহার খরিদ মূল্যের অর্ধেক দাম লিখিয়া রাখিয়াছিলাম, সেই কাগজখানি তাহার হস্তে প্রদান করিলাম। আমার লিখিত দর দেখিয়া তিনি অতিশয় সন্তুষ্ট হই লেন, এবং আমার লিখিত মত সেই দ্রব্যের মূল্য তিনি তৎক্ষণাৎ আমাকে প্রদান করিলেন। তদ্ব্যতীত গাড়ি ভাড়া বলিয়া আর দুই টাকা আমাকে দিয়া, অন্য আর একটা দ্রব্যের ফরমাইস দিলেন। পরদিবস সেই দ্রব্য বাজার হইতে ক্রয় করিয়া তাহার নিকট লইয়া গেলাম, এবং আমার খরিদ মূল্য অপেক্ষাও কিছু কম মূল্যে উহা আমি তাহার নিকট বিক্রয় করিলাম। ইহাতে তিনি আমার উপর আরও সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, আপনি কেবলই কি বস্ত্রের কারবার করিয়া থাকেন, না জহরত-আদিও বিক্রয় করেন?

উত্তরে আমি কহিলাম, বস্ত্রাদি আমি অতি অল্প পরিমাণেই বিক্রয় করিয়া থাকি। আমার অধিক কারবার জহরতের। কেন মহাশয় আপনি আমাকে একথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?

জমিদার। আমার কিছু জহরতের প্রয়োজন হইয়াছে; সেই নিমিত্তই আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।

আমি তাহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার কত টাকার জহরতের প্রয়োজন হইবে? তাহার উত্তরে তিনি কহি লেন, প্রায় দশ হাজার টাকার জহরতের প্রয়োজন।

আমি কহিলাম, এ অতি সামান্য কথা। আপনার কি কি দ্রব্যের প্রয়োজন, তাহার একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া আপনি আমাকে প্রদান করুন, আমি সেই তালিকা অনুযায়ী জহরত আনিয়া আপনাকে প্রদান করিব। আপনি সেই সকল জহরত প্রথমে যাচাই করিয়া দেখিবেন, এবং পরিশেষে তাহার মূল্য আমাকে প্রদান করিবেন।

আমার এই কথা শুনিয়া কি মূল্যের কি কি জহরতের প্রয়োজন, তাহার একটা তালিকা প্রস্তুত করিয়া জমিদার মহাশয় আমাকে প্রদান করিলেন। আমি সেই তালিকা গ্রহণ করিয়া তাঁহার একজন কর্ম্মচারীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলাম। সেই কর্ম্মচারী সর্বদা জমিদার মহাশয়ের নিকট থাকিতেন, এবং তিনি যাহা বলিতেন, তাহা প্রায়ই তিনি শুনিতেন। আমি বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি, জমিদার মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ হইবার পূর্বেই আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাঁহার সহিত একরূপ বন্ধুত্ব স্থাপন করিয়াছিলাম। যে দিবস জমিদার মহাশয়ের নিকট কোন দ্রব্য বিক্রয় করিয়া কিছু অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিতাম, সেই দিবস তাহা হইতে তাহাকেও কিছু অর্থ প্রদান করিতাম। সুতরাং জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে সৰ্ব্বদা যাহাতে আমি কিছু প্রাপ্ত হই, তিনি তাহাই করিতেন।

জমিদার মহাশয় আমাকে জহরতের ফরমাইস দিলে পরই, তিনি জমিদার মহাশয়কে কহিলেন, যে ব্যক্তি এত টাকার জহরত আপনার নিকট আনয়ন করিবেন, তাঁহাকে উহার নিমিত্ত কিছু অগ্রিম টাকা দেওয়া কর্ত্তব্য। কারণ, অগ্রিম কিছু টাকা প্রদান করিলে যতশীঘ্ন পারিবেন, জহরত লইয়া ইনি আপনার নিকট উপস্থিত হইবেন।

কর্ম্মচারীর কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় একখানি হাজার টাকার নোট বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য, সেই স্থান হইতে আসিবার সময় আমি কর্ম্মচারীকে কিছু প্রদান করিয়া আসিলাম। সেই কৰ্ম্মচারীকে আমি মধ্যে মধ্যে কিছু কিছু প্রদান করিতাম বলিয়াই যে তিনি আমার উপর এতদুর অনুগ্ৰহ করিতেন, তাহা নহে। সময় সময় তাহাকে সঙ্গে করিয়া আমার বাসায় আনিতাম ও তাহাকে লইয়া আমি ও ত্রৈলোক্য নানারূপ আমোদ-আহলাদ করিতাম।

সেই টাকা লইয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম, এবং আপন বাসায় আসিয়া সেই টাকা ত্রৈলোক্যের হস্তে প্রদান করিলাম। এতগুলি টাকা আমি একবারে কোথায় পাইলাম, জিজ্ঞাসা করায়, আমি ত্রৈলোক্যকে আদ্যোপান্ত সমস্ত ব্যাপার বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া ত্রৈলোক্য কহিল, তাহা হইলে সেই জমিদার মহাশয়ের নিকট আর গমন করিবার প্রয়োজন কি? এই হাজার টাকায় এখন অনেক দিবস আমাদিগের চলিবে।

ত্রৈলোক্যের কথার উত্তরে আমি কহিলাম, তাহা কি কখনও হইতে পারে। কারণ, জমিদার মহাশয়ের কর্ম্মচারী আমাদিগের বাসা পর্যন্ত অবগত আছেন। বিশেষতঃ যখন তাঁহারই কথায় বিশ্বাস করিয়া জমিদার মহাশয় আমাকে এই টাকা প্রদান করিয়াছেন, তখন তাহাদিগের নিকট আর গমন না করিলে, সেই কর্ম্মচারীই নিতান্ত বিপদগ্রস্ত হইবেন। সুতরাং তাঁহাকে অবমানিত করিয়া আমার সবিশেষ কোন ফল লাভ হইবে না। অধিকন্তু যদি তাহাদিগের সহিত প্রণয় রাখিয়া চলিতে পারি, তবে এক সহস্র কেন, এরূপ কত সহস্র টাকা আমি তাহাদিগের নিকট হইতে ক্ৰমে গ্রহণ করিতে সমর্থ হইব। তুমি যেরূপ প্রস্তাব করিতেছ, সেই প্রস্তাবে আমি কোনরূপেই সম্মত হইতে পারি না। কিন্তু আমি এক উপায় মনে মনে স্থির করিয়াছি। যাহা ভাবিতেছি, তাহা যদি কার্যে পরিণত করিতে পারি, তাহা হইলে আমাদিগের লাভও যথেষ্ট হইবে, এবং সেই কৰ্ম্ম চারী প্রভৃতি কাহার কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা থাকিবে না। অথচ সেই জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে আমার খুব পসার থাকিবে।

এই বলিয়া আমি মনে মনে যাহা স্থির করিয়াছিলাম, তাহা ত্রৈলোক্যকে বলিলাম। আমার কথা শুনিয়া ত্রৈলোক্য প্রথমতঃ একবারে হতবুদ্ধি হইয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িল ও কহিল, এরূপ কাৰ্য আমার দ্বারা কখনই হইবে না। কিন্তু সে কি করিবে? আমার প্রস্তাবে পরিশেষে তাহাকে সম্মত হইয়া আমাকে সৰ্ব্বতোভাবে সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইতে হইল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ।

পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি আমার বাসা হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। সহরের ভিতর নানাস্থানে অনুসন্ধান করিয়া সুবিধা মত একটা বাড়ী দেখিতে পাইলাম। কোন গতিতে সেই বাড়ী ভাড়া করিতে পারিলে, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে পারিব, এই ভাবিয়া খুঁজিয়া খুঁজিয়া সেই বাড়ীর মালিককে বাহির করিলাম। তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া কেবলমাত্র সাতদিবসের নিমিত্ত সেই বাড়ী ভাড়া লইতে চাহিলাম। কিন্তু সামান্য দিবসের নিমিত্ত সেই বাড়ী ভাড়া দিতে তিনি অসম্মত হওয়ায়, পরিশেষে একমাসের নিমিত্তই আমাকে সেই বাড়ী ভাড়া লইতে হইল। কিন্তু যাঁহার বাড়ী, তিনি যে ইহাতেও ন্যায্য ভাড়া গ্রহণ করিলেন, তাহা নহে; নিয়মিত ভাড়া অপেক্ষা প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া আমার নিকট হইতে অগ্রিম গ্রহণ করিয়া, তাহার পর তিনি আমার হস্তে সেই বাড়ীর চাবি অর্পণ করিলেন। চাবি আনিয়া আমি সেই বাড়ী খুলিলাম, এবং কতকগুলি আসবাব ভাড়া করিয়া সেই দিবসেই উহার বৈঠকখানা সাজাইয়া ফেলিলাম। গৃহ সাজান হইয়া গেলে, আমি আড়গোড়ায় গমন করিলাম। সেই স্থানে একখানি জুড়িগাড়ি ও একখানি কম্পাস গাড়ি একদিবসের নিমিত্ত ভাড়া করিয়া তাহার অগ্রিম ভাড়া তাহা দিগকে প্রদান করিলাম। তাহাদিগের সহিত আমার এইরূপ বন্দোবস্ত রহিল যে, পরদিবস আমি আড়গোড়ায় গমন করিয়া গাড়ি দুইখানি সঙ্গে করিয়া আনিব।

এই সকল কার্য সম্পন্ন করিতে আমার সমস্ত দিবস অতীত হইয়া গেল। সমস্ত দিবসের মধ্যে আমি আমার বাসায় আর ফিরিতে পারিলাম না। ক্রমে সন্ধ্যা হইল, দেখিতে দেখিতে ক্রমে রাজি নয়টাও বাজিয়া গেল। রাত্রি নয়টার পর আমি আমার বাসায় ফিরিয়া গেলাম, এবং ত্রৈলোক্যকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, আমি যে কাৰ্য্যের নিমিত্ত অদ্য প্রাতঃকালে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছিলাম, তাহার সমস্তই ঠিক করিয়া আসিয়াছি। ঘর ভাড়া হইয়া গিয়াছে, এই দেখ তাহার চাবি। ঘর দ্রব্যাদিতে সুসজ্জিত করিয়া রাখিয়াছি। এই বলিয়া আমার পকেট হইতে সেই বাড়ীর চাবি বাহির করিয়া তৈলোক্যের হস্তে প্রদান করিলাম।

আমার কথার উত্তরে ত্রৈলোক্য কহিল, চাবি ত দেখিলাম; কিন্তু কিরূপ স্থান ঠিক করিয়াছেন, চলুন একবার যাইয়া দেখিয়া আসি।

ত্রৈলোক্যের সেই কথায় আমি তখন সম্মত হইলাম না, তাহাকে সেই রাত্রিতে আমি সেই স্থানে লইয়া গেলাম না। কহিলাম, আজ রাত্রি অধিক হইয়াছে। বিশেষতঃ সেই স্থান নিকটেও নহে, অনেক দূরে। সে স্থানে গিয়া ফিরিয়া আসিতে আজ রাত্রি কাটিয়া যাইবে, অতএব এখন আর সে স্থানে যাইবার প্রয়োজন নাই। কল্য প্রাতঃকালে একবারে সুসজ্জিত হইয়া আমার সহিত গমন করিও, সেই স্থানে তোমাকে রাখিয়া আমি গাড়ি প্রভৃতি আনিবার নিমিত্ত গমন করিব।

আমার কথায় ত্রৈলোক্য সম্মত হইল, এবং আমার পূর্ব পরামর্শ অনুসারে সে যাহাতে উত্তমরূপে সজ্জিত হইতে পারে, তাহার নিমিত্ত উত্তম উত্তম অলঙ্কার ও বস্ত্রাদি সংগ্রহ করিতে তখন প্রবৃত্ত হইল।

পরদিবস অতি প্রত্যূষে উঠিয়া স্নান আহারের কাৰ্য্য শীঘ্র শীঘ্র সমাধা করিয়া লইলাম। অন্য স্থান হইতে বস্ত্র-অলঙ্কার প্রভৃতি যে সকল উত্তম উত্তম দ্রব্য ত্রৈলোক্য চাহিয়া আনিয়া ছিল, তাহার দ্বারা সেও উত্তমরূপে সজ্জিত হইল। তাহার পর আমি একখানি ঠিকা গাড়ি ডাকাইয়া আনিলাম, এবং আমরা উভয়েই উহাতে আরোহণ করিয়া আমাদিগের বাসা হইতে বহির্গত হইলাম। নানাপথ ও গলির ভিতর দিয়া অনেক দূর গমন করি বার পর, একটী গলির ভিতর আমি যে নূতন বাড়ী ভাড়া করিয়া ছিলাম, সেই বাড়ীর দরজায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। দরজার সম্মুখে গাড়ি লাগিলে, আমরা সেই গাড়ি হইতে অবতরণ করি লাম। উহার ভাড়া মিটাইয়া দিলে, গাড়িবান্ তাহার গাড়ি লইয়া

প্রস্থান করিল। আমার নিকট সেই বাড়ীর যে চাবি ছিল, তাহার দ্বারা সেই বাড়ীর দরজা খুলিয়া আমরা উভয়েই তাহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। বাড়ীর অবস্থা এবং সুসজ্জিত গৃহের অবস্থা দেখিয়া, ত্রৈলোক্য অতিশয় সন্তুষ্ট হইল। পরিশেষে ত্রৈলোক্য সেই বাড়ীর সদর দরজা ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিয়া সেই সুসজ্জিত গৃহের একখানি চেয়ারের উপর বসিয়া রহিল। আমি গাড়ি আনিবার মানসে সেই আড়গোড়ায় গমন করিলাম।

আড়গোড়ার গমন করিবামাত্রই একখানি প্রকাণ্ড জুড়ি ও একখানি অতিশয় দ্রুতগামী কম্পাস গাড়ি আমি প্রাপ্ত হইলাম। সেই কম্পাস গাড়িতে উপবেশন করিয়াই জুড়ির সহিত আমি পূর্বোক্ত বাড়ীর দরজায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আমরা সেই স্থানে আগমন করিবামাত্রই ত্রৈলোক্য ভিতর হইতে সেই বাড়ীর দরজা খুলিয়া দিলে আমি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। গাড়ি দুইখানি বাড়ীর সম্মুখেই দাড়াইয়া রহিল।

আমি বাড়ীর ভিতর গিয়া প্রথমতঃ ত্রৈলোক্যের সহিত উত্তমরূপে পরামর্শ আঁটিয়া লইলাম। কিরূপ ভাবে আমাদিগকে কি কি করিতে হইবে, তাহার সমস্ত ঠিক হইয়া গেলে, আমি জুড়িগাড়ির সহিসদ্বয়কে সেই গাড়ির পরদা উত্তমরূপে ঢাকিয়া দিতে কহিলাম। সহিসদ্বয় আমার কথা শুনিয়া উহার পরদা সকল এরূপ ভাবে ফেলিয়া দিল যে, উহার ভিতর বসিলে বাহিরের কোন লোক যে আরোহীকে কোনরূপে দেখিতে পাইবে তাহার আর কোনরূপ সম্ভাবনা রহিল না। ইহার পরই ত্রৈলোক্য বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া সেই জুড়িগাড়ির ভিতর গিয়া উপ বেশন করিল। আমি বাড়ীর চাবি বন্ধ করিয়া দিয়া সেই চাবি ত্রৈলোক্যের হস্তে প্রদান করিলাম। আমিও সেই কম্পাস গাড়িতে উঠিয়া বড়বাজার অভিমুখে উঁহাদিগকে গমন করিতে বলিলাম। আমার নির্দেশ মত উভয় গাড়িই একত্র বড়বাজার অভিমুখে গমন করিল।

ক্রমে গাড়ি গিয়া বড়বাজারে উপস্থিত হইল, এবং রামজী লাল যে দোকানের কর্ম্মচারী ছিল, সেই দোকানের সম্মুখে গিয়া উভয় গাড়িই থামিল। আমি গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া দোকানের ভিতর প্রবেশ করিলাম, ত্রৈলোক্য গাড়ির ভিতরেই বসিয়া রহিল।

আমি দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়া দোকানদারকে কহিলাম, একজন রাণী কতকগুলি জহরত ক্রয় করিবেন, আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি, তিনি দোকানের সম্মুখে গাড়ির ভিতর বসিয়া আছেন। তাঁহাকে ভাল ভাল কতকগুলি জহরত দেখাও, যদি কোন জহরত তাহার পসন্দ হয়, তাহা হইলে উনি তাহা নিশ্চয়ই গ্রহণ করিবেন। ইহার নিকট কিছু বেচিতে পারিলে, আপনাদিগের বেশ দুই পয়সা লাভ হইবে, আমারও কিছু উপার্জন হইবে। আমার বোধ হয়, উনি নিজে কোন দ্রব্যের মূল্য আপনাদিগকে জিজ্ঞাসা করিবেন না, কেবল দ্রব্য পসন্দ করিয়া দিবেন। দ্রব্য পসন্দ হইলে আমরা তাহার মূল্য যাহা বলিব, তাহাতেই উনি তাহা গ্রহণ করিবেন। কিন্তু আপনাকে আমি পূর্ব হইতেই সতর্ক করিয়া দিতেছি যে, যদি কোন দ্রব্যের মূল্য উনি জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে উহার মূল্য সেই সময় যেন খুব অধিক করিয়া বলা হয়।

দোকানদারকে এইরূপ শিখাইয়া দিয়া তাহাকে সঙ্গে লইয়া আমি দোকানের বাহিরে আসিলাম, এবং সেই জুড়িগাড়ির নিকট দাঁড়াইয়া কহিলাম, এই গাড়িতে রাণীজি আছেন, তিনি অনেকগুলি জহরত ক্রয় করিবেন। আপনি এক একটী করিয়া জহরতের বাক্স তাহার হস্তে প্রদান করুন, ইহার মধ্যে যদি কোন দ্রব্য রাণীজির পসন্দ হয়, তাহা হইলে তাহার দর স্থির করিয়া দিয়া উহার মূল্য গ্রহণ করিবেন। আমার প্রস্তাবে দোকানদার সম্মত হইলেন, এবং এক একটী করিয়া নানা প্রকার জহরতের বাক্স রাণীজির হস্তে প্রদান করিতে লাগিলেন। সেই সকল জহরতের মধ্যে যে সকল জহরত রাণীজি পসন্দ করিলেন, বা যে সকল জহরত আমাদিগের লইয়া যাইবার পরামর্শ ছিল, সেই সকল জহরত ত্রৈলোক্য একটা একটা করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিতে লাগিল। এইরূপে কতকগুলি জহরত আমার হস্তে প্রদান করিবার পর আমাদিগের পূর্ব পরামর্শ অনুযায়ী ত্রৈলোক্য আমাকে কহিল, আমি এখন বাসায় যাইতেছি। আপনি এই সকল জহরতের উপযুক্ত দাম দোকানদারের সহিত স্থির করিয়া আমার বাসায় লইয়া আসিবেন। আর হয় দোকানদারকে, না হয় তাহার দোকানের অপর কোন একজন লোককে সেই সঙ্গে লইয়া যাই বেন। আমার বাসায় গেলেই, আমি হয় ইহার নগদ মূল্য প্রদান করিব, না হয় কোন ব্যাঙ্কের উপর একখানি চেক প্রদান করিব। আমার বোধ হয়, এই সকল জহরতের মূল্য আট দশ হাজার টাকার অধিক হইবে না। সুতরাং এই সকল সামান্য দ্রব্যের মূল্য বাকী রাখিবার কোনরূপ প্রয়োজন দেখি না। আমাদিগকে কেবল এই মাত্র বলিবার পরই রাণীজি তাহার গাড়ি চালাইতে কহিলেন। দেখিতে দেখিতে সেই প্রকাণ্ড জুড়ি বড়বাজার অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল।

ত্রৈলোক্য গমন করিবার পর আমি সেই দোকানদারের সহিত একত্র বসিয়া যে সকল দ্রব্য ত্রৈলোক্য পসন্দ করিয়া গিয়াছিল, তাহার মূল্যের একটী তালিকা প্রস্তুত করিলাম। তালিকা প্রস্তুত হইলে, সেই জহরতগুলি লইয়া দোকানদারকে রাণীজির বাসায় গমন করিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিলাম; কিন্তু তিনি নিজে না আসিয়া তাঁহার একজন অতিশয় বিশ্বাসী কর্ম্মচারী রামজীলালকে আমার সহিত পাঠাইয়া দিলেন। তিনি সেই সকল গহনার সহিত আমার গাড়িতে আসিয়া উপবেশন করিলেন।

ত্রৈলোক্য বড়বাজার হইতে প্রত্যাগমন করিলে প্রায় একঘণ্টা পরে আমি জহরতগুলির সহিত রামজীলালকে সঙ্গে করিয়া আমাদিগের সেই নূতন বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াই আমি আমার সেই গাড়ি বিদায় করিয়া দিলাম। ইতিপূর্বে ত্রৈলোক্যও প্রত্যাবর্তন করিবার পর তাহার জুড়ি বিদায় করিয়া দিয়াছিল।

রামজীলালকে সঙ্গে করিয়া আমি একবারে উপরে উঠিলাম। যে ঘরটী উত্তমরূপে সাজান ছিল, সেই গৃহে তাহাকে বসাইয়া তাহার সহিত দুই চারিটী কথা কহিতেছি, এরূপ সময় রাণীজি বা তৈলোক অন্য ঘর হইতে আসিয়া সেই গৃহে প্রবেশ করিল। আমি রামজীলালের সম্মুখে ত্রৈলোক্যকে কহিলাম, সমস্ত জহরতের দাম প্রায় দশ হাজার টাকা হইয়াছে। দোকানদার মহাশয় নিজে আসিতে পারেন নাই, তিনি তাঁহার এই বিশ্বাসী লোককে জহরতের সহিত আপনার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন; কিন্তু ইহার মনিব ইহাকে বলিয়া দিয়াছেন যে, অগ্রে টাকা না পাইলে এই সকল জহরত যেন কাহারও হস্তে প্রদান করা না হয়। কারণ, কলিকাতা জুয়াচোরে পরিপূর্ণ।

আমার এই কথা শুনিয়া রাণীজি সেই স্থানে উপবেশন করিয়া রামজীলালের সহিত কথাবার্তা কহিতে লাগিল। সেই অব কাশে আমি একবার নিয়ে গমন করিয়া বাড়ীর ভিতর দিক হইতে সদর দরজা তালাবদ্ধ করিয়া দিয়া পুনরায় উপরে উঠিলাম। পরে যে স্থানে রামজীলাল বসিয়াছিলেন, তাহার এক পার্শ্বে গিয়া উপবেশন করিলাম।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

আমি সেই স্থানে উপবেশন করিলে পর, ত্রৈলোক্য ওরফে বাণীজি, রামজীলালের নাম জিজ্ঞাসা করিল। উত্তরে রামজী লাল কহিল, রাণজি! আমার নাম রামজীলাল।

ত্রৈলোক্য। আমি যে সকল জহরত পসন্দ করিয়া দিয়া ছিলাম, তুমি সেই সকল জহরতই আনিয়াছ ত?

রামজীলাল। আমি তাহাই আনিয়াছি।

ত্রৈলোক্য। উহার দাম কত হইয়াছে?

রামজীলাল। প্রায় দশ হাজার টাকা।

ত্রৈলোক্য। তুমি কি কি দ্রব্য আনয়ন করিয়াছ দেখি? রামজীলাল। রাণীজি! আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমার মনিবের আদেশ আছে যে, অগ্রে দাম না পাইলে এই সকল দ্রব্য কাহারও হস্তে প্রদান করিতে পারিব না।

ত্রৈলোক্য। এত সামান্য টাকার নিমিত্ত তোমার মনিবের এত অবিশ্বাস।

রামজীলাল। আপনাকে আমার কিছুমাত্র অবিশ্বাস নাই। আমার অপরাধ লইবেন না, আমাকে ক্ষমা করিবেন। আমি সামান্য চাকর হইয়া কিরূপে মনিবের আদেশ লঙ্ঘন করিব?

ত্রৈলোক্য। তোমার মনিবের এত অবিশ্বাস করিবার কারণ?

রামর্জীলাল। কয়েকবার জুয়াচোরের হস্তে পড়িয়া তিনি ঠকিয়াছেন, তাহাতেই আমাকে এইরূপ আদেশ প্রদান করিয়াছেন। আপনি ত সবিশেষ জানেন যে, কলিকাতা সহর জুমাচোরগণের দ্বারা পরিপূর্ণ।

আমি এতক্ষণ পর্যন্ত স্থির ভাবে সেই স্থানে বসিয়াছিলাম, রামজীলালের এই সকল কথা শুনিয়া আমি আর স্থির থাকিতে পারিলাম না। রাগের ভাব প্রকাশ করিয়া রামজীলালকে কহিলাম, তুমি জান না, কাহার সহিত কিরূপ ভাবে তুমি কথা কহিতেছ। তুমি জান, রাণীজি একটু রাগ করিলে তোমার মস্তক সহ এই বাটী হইতে প্রস্থান করা কঠিন হইবে?

আমার এই কথা শুনিয়া রামজীলাল যেন একটু ভীত হইল; কিন্তু মনের ভাব গোপন করিয়া মুখে একটু সাহস দেখাইয়া কহিল, কেন, আমি কি অন্যায় কথা বলিয়াছি যে, আমার এই বাটী হইতে মস্তক সহ বাহির হওয়া কঠিন হইয়া উঠিবে? আমি কি চোর? ইহা কি ইংরাজের রাজত্ব নহে? অরাজকের মুলক যে, যাহার যাহা ইচ্ছা হইবে, অনায়াসেই তিনি তাহা করিবেন? দশ হাজার টাকার জহরত বিক্রয় না হইলে আমার মনিব এক বারে গরিব হইয়া যাইবেন না! আমি জহরত বিক্রয় করিব না, চলিলাম। এই বলিয়া রামজীলাল উঠিয়া দাঁড়াইল। এক

রামজীলালের কথা শুনিয়া এবং তাহার অবস্থা দর্শন পুলিস আমি নিতান্ত রাগের ভাব দেখাইয়া বলিলাম, কি! ছোট মুরিবে, কথা! রাণীজিকে এইরূপ ভাবে অবমাননা! এ অবমাননা হবে। স্বচক্ষে দেখিয়া কোনরূপেই সহ করিতে পারি না। এই বলিয়া আমার জুতা সহিত রামজীলালের বক্ষে সবলে এক পদাঘাত করিলাম। আমার লাথি খাইয়া হতভাগ্য রামজীলাল চতুর্দিক অন্ধকার দেখিল, এবং সেই স্থানেই পড়িয়া গেল। পড়িবামাত্রই আমি দ্রুতগতি তাহার বুকের উপর উঠিয়া বলপূর্বক তাহাকে ধরিলাম।

আমি তখন কি করিলাম? আপনারা যাহা কখনও স্বপ্নেও ভাবেন নাই, আজ আমি তাহাই করিলাম। কেবলমাত্র একজন শ্রীলোকের সাহায্যে যে কাৰ্য্য কখনও হইতে পারে বলিয়া আপ নারা একবারও মনে স্থান দেন নাই, আজ আমি তাহাই করিলাম। জন্য বা তস্করেরাও যে কাৰ্যে হস্তক্ষেপ করিতে মনে মনে ঘৃণা বোধ করে, আজ আমি তাহাই করিলাম। রাক্ষস বা পিশাচ গণও যে কার্যের কথা শুনিলে আপনাপন কর্ণে অঙ্গুলি প্রদান করে, আমি আজ তাহাই করিলাম। উঃ! যে কথা বলিতে এখন আমার কণ্ঠবোধ হইয়া আসিতেছে, যে কথা বলিতে এখন আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে, যে কথা বলতে কোনরূপেই এখন আমি আমার চক্ষুজল সম্বরণ করিতে পারিতেছি না, সেই সময় আমি তাহাই কাৰ্যে পরিণত করিয়াছিলাম। যে মহাপাপের আদি নাই, অন্ত নাই, যে মহাপাপের কথা শুনিলেও মহাপাপ না, আমি সেই সময় সেই মহাপাপে লিপ্ত হইতে কোনরূপেই জুখ হইলাম না। বিনা-কারণে ও বিনা-দোষে সেই নিরীহ, প, নিঃসহায় ব্যক্তির উপর সবলে পা দিয়া দাড়াইলাম, য পৰ্য্যন্ত তাহার প্রাণবায়ু একবারে শেষ না হইয়া গেল,–পৰ্যন্ত আর পা উঠাইলাম না। ত্রৈলোক্যও বলপূর্বক তাহার পা দুইখানি চাপিয়া ধরিয়া আমার এই মহাপাপের সম্পূর্ণরূপে সহায়তা করিল। সামান্য টাকার লোভে দেখিতে দেখিতে এই ভয়ানক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সমাধা করিলাম।

এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সমাধা হইবার পর, রামজীলালের মৃতদেহের উপর আমার দৃষ্টি একবার পতিত হইল। সেই দৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষণকালের নিমিত্ত আমার মনের ভাবও সবিশেষরূপে পরিবর্তিত হইয়া গেল। চক্ষু দিয়া বিন্দুপাত হইল, সামান্য টাকার উপর ঘৃণা জন্মিল; পরকালের ভীষণ ভাবনা আসিয়া হৃদয় অধিকার করিল। কিন্তু অধিকক্ষণ পর্যন্ত এভাব আমার হৃদয়ে স্থান পাইতে দিলাম না। পরক্ষণেই আবার সে ভাব দূরে পলায়ন করিল। রামজীলালের সমভিব্যাহারে যে সকল জহরত ছিল, তাহার সমস্তগুলি তখন আমরা অপহরণ করিলাম।

রামজীলালের মৃতদেহ লইয়া তখন আমরা কি করিব, মনে সেই ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। একবার ভাবিলাম, রাত্রি কালে উহার মৃতদেহ টানিয়া রাস্তায় ফেলিয়া দিব; কিন্তু তাহা বিপদ-জনক বলিয়া মনে হইল। পুনরায় ভাবিলাম, একমাস পর্যন্ত খালি-বাড়ীর ভিতর এই মৃতদেহ আবদ্ধ থাকিলেই সকল গোল মিটিয়া যাইবে; একমাস পরে উহা দেখিয়া কেহই বুঝিতে পারিবে না যে, উহা কাহার মৃতদেহ। সুতরাং আমাদিগের বিপদের সম্ভাবনা অতি অল্পই থাকিবে। কিন্তু পরিশেষে মনে হইল, দুই চারিদিবসের মধ্যেই এই মৃতদেহ পচিয়া যখন ভয়ানক দুর্গন্ধ চতুর্দিকে বহির্গত হইতে আরম্ভ হইবে, তখন পুলিস আসিয়া নিশ্চয়ই এই বাড়ী খুলিয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবে, এবং সম্মুখেই মৃতদেহ দেখিতে পাইয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবে। এরূপ অবস্থায় সকল কথা প্রকাশ হইয়া পড়িষরই সম্পূর্ণরূপ সম্ভাবনা। মনে মনে এইরূপ নানা বিষয়ের কল্পনা করিয়া পরি শেষে একটা উপায় বাহির করিলাম। আমি ও ত্রৈলোক্য উভয়ে মিলিয়া রামজীলালের মৃতদেহ উপর হইতে নীচে নামাইলাম, এবং নীচের একখানি গৃহের মেঝের উপর যে সকল পাথর বসান ছিল, অনেক কষ্টে তাহার তিন চারিখানি উঠাইয়া ফেলি লাম। পরে সেই স্থান হইতে মৃত্তিকা উঠাইয়া ক্ৰমে একটা প্রশস্ত গহ্বর খনন করিলাম। তখন রামজীলালের মৃতদেহ সেই গর্তের ভিতর উত্তমরূপে পুতিয়া ফেলিলাম। তাহার উপর যতদুর মৃত্তিকা ধরিতে পারে, তাহা উত্তমরূপে দুরমুস করিয়া বসাইয়া দিয়া, যে প্রস্তর চারিখানি উঠাইয়া ফেলিয়াছিলাম, তাহাও উত্তমরূপে তাহার উপর বসাইয়া দিলাম। এই সকল কার্য সম্পন্ন করিতে আমাদিগের অতিশয় পরিশ্রম হইল সত্য; কিন্তু এই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিবার উপযোগী দ্রব্যাদির নিমিত্ত আমাদিগের কোনরূপ কষ্ট পাইতে হইল না। চুন, সুরকি, সাবল, কোদালী, দুরমুস প্রভৃতি আমাদিগের যে কোন দ্রব্যের প্রয়োজন হইল, তাহার সমস্তই আমরা সেই বাড়ীর একখানি গৃহের ভিতর প্রাপ্ত হইলাম। সেই বাড়ী প্রস্তুত করিবার সময় যে সকল যন্ত্রাদি ব্যবহৃত হইয়াছিল, এবং চুন, সুরকি, বালী প্রভৃতি যে সকল দ্রব্য উদ্বৃত্ত হইয়াছিল, তাহার সমস্তই সেই গৃহের ভিতর রক্ষিত ছিল। কলেও সমস্ত দিবস জল ছিল। সুতরাং কোন দ্রব্যই আমাদিগের অপর কোন স্থান হইতে সংগ্রহ করিতে হইল না। কিন্তু সেই কাৰ্য্য সমাধা করিতে করিতে আমাদিগের সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। মৃতদেহ প্রােথিত হইবার পর, যে সকল মৃত্তিকা প্রভৃতি উদ্বৃত্ত হইয়াছিল, তাহা সেই গৃহ হইতে বাহির করিয়া স্থানান্তরে রাখিয়া দিলাম। সেই গৃহখানি এরূপ ভাবে পরিষ্কার করিয়া রাখিলাম যে, উহার অবস্থা দেখিয়া কাহারও মনে কোনরূপ সন্দেহ না হয়।

রামজীলালের মৃতদেহ এইরূপে মৃত্তিকার ভিতর প্রােথিত করিয়া, ঘর সাজাইবার যে সকল দ্রব্য যে স্থান হইতে ভাড়া করিয়া আনা হইয়াছিল, সেই সকল দ্রব্য ভাড়া সমেত সেই স্থানে পাঠাইয়া দিলাম, এবং সেই বাড়ীর সদর দরজায় তালাবদ্ধ করিয়া একখানি ঠিকা গাড়ি আনিয়া আমরা সে দিবস সেই স্থান হইতে আপন বাসায় ফিরিয়া আসিলাম। বলা বহুল্য, যে সকল জহরত আমরা রামজীলালের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম, তাহা আমাদিগের সঙ্গে আনিতে ভুলিলাম না।

পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি সেই জহরতগুলি এবং সেই বাড়ীর চাবি লইয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেলাম। যাহার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিলাম, তাহাকে যাহা বলিয়া চাবি ফিরাইয়া দিয়া আসিয়াছিলাম, তাহা আপনি পূৰ্বেই সেই বাড়ীওয়ালার নিকট হইতে অবগত হইয়াছেন। বাড়ীর চাবি ফিরাইয়া দিয়া সেই জহরতগুলি সেই পশ্চিমদেশীয় জমিদার মহাশয়ের নিকট লইয়া গেলাম। তিনি যেরূপ ভাবের জহরত আনিবার নিমিত্ত আমাকে ফরমাইস করিয়া ছিলেন, ঠিক সেই মত জহরত দেখিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। সমস্ত দ্রব্যই তাঁহার পসন্দ হইল। তিনি সেই সকল দ্রব্য গ্রহণ করিয়া তাহার দাম আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার কথার উত্তরে আমি কহিলাম, এই সকল দ্রব্য দশ বার হাজার টাকার কম আমরা কাহারও নিকট বিক্রয় করি না; কিন্তু আপনার নিকট আমাদিগের অনেক দ্রব্য বিক্রয় হইবার আশা আছে, অথচ কোন্ দ্রব্যের কি মূল্য, তাহাও আপনি উত্তমরূপে বুঝিতে পারেন। এরূপ অবস্থায় এ সামান্য বিষয় লইয়া আমার আর কিছুই বলিবার আবশ্যক নাই। বিবেচনা করিয়া আপনি আমাকে যে মূল্য বলিয়া দিবেন, আমি সেই মূল্যেই উহা আপনাকে প্রদান করিব।

আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় সেই জহরতগুলি আর একবার উত্তমরূপে দেখিলেন ও কহিলেন, আমার বিবেচনায় এই সকল দ্রব্যের মূল্য নয় হাজার টাকার অধিক বলিয়া অনু মান হয় না।

তাহার কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, আপনি যে দাম বলিয়া ছেল, তাহা প্রায় ঠিকই হইয়াছে। এই সকল দ্রব্য আমার নয় হাজার টাকায় খরিদ। সেই মূল্যেও আমি উহা আপনাকে বিক্রয় করিতে পারি। ইহাতে আমার আর এক পয়সাও লাভ হয় না।

আমার কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় আর কোন কথা কহিলেন না। আমাকে এক হাজার টাকা পূর্বেই প্রদান করিয়া ছিলেন, এখন বক্ৰী আট হাজার টাকার নোট আনিয়া আমার হস্তে সেই দ্রব্যের মূল্য বলিয়া প্রদান করিলেন। তদ্ব্যতীত আমার লাভ ও পারিশ্রমিক বলিয়া আরও দুইশত টাকা আমাকে দিলেন।

তিনি আমাকে যাহা প্রদান করিলেন, তাহা নগদ টাকা নহে; নম্বরী-নোট। কতকগুলি হাজার টাকা করিয়া, ও কতক গুলি একশত টাকার হিসাবে। আমি সেই নোটগুলি গ্রহণ করিয়া সেই স্থান হইতে চলিয়া আসিলাম, এবং সমস্তই ত্রৈলোকের হস্তে প্রদান করিলাম। সে দিবস আর কোন স্থানে গমন করিতে বা অপর কোন কার্যে হস্তক্ষেপ করিতে ইচ্ছা হইল না। মনে কেমন একরূপ দুর্ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইল। এই সকল কথা যদি কোনরূপে প্রকাশ হইয়া পড়ে, তাহা হইলে আমাকে কি বলিতে হইবে, বা কোন উপায়ই বা অবলম্বন করিতে হইবে। এইরূপে নানা প্রকার পরামর্শ করিতে করিতে সেই রাত্রি অতিবাহিত করিলাম।

পরদিবস দিবা দশটার সময় সেই নোটগুলি সঙ্গে লইয়া, পুনরায় আমি আমার বাসা হইতে বহির্গত হইলাম, এবং করেনসি আফিসে গমন করিয়া সেই স্থানে সেই নোট গুলি প্রদান করিয়া, তাহার পরিবর্তে কতকগুলি দশ টাকার নোট ও কতক গুলি নগদ টাকা গ্রহণ করিলাম। নোটের পৃষ্ঠে নাম লিখিয়া দিতে বলায়, আমি রামজীলালের নাম ও বড়বাজারের ঠিকানা লিবিয়া দিলাম। বলা বাহুল্য, আমি আমার নাম ও ঠিকানা না দিয়া রামজীলালের নামেই সেই নোট ভাঙ্গাইয়া আনিয়াছিলাম। যাহা হউক, উক্ত সমস্ত টাকাই ত্রৈলোকের হস্তে প্রদান করিলাম।

আমি। ত্রৈলোক্য সেই সকল টাকা কোথায় রাখিয়াছে?

কালী। তাহা আমি বলিতে পারি না। সেই সকল টাকা একটা পিত্তলের কলসীর মধ্যে পুরিতে আমি দেখিয়াছি; কিন্তু পরিশেষে উহা যে কোথায় রাথিয়াছে, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু আমি শুনিয়াছিলাম যে, ত্রৈলোক্য উহা কোন স্থানে মৃত্তিকার মধ্যে পুতিয়া রাখিয়াছে।

আমি। তাহার পর?

কালী। ইহার পর কয়েকদিবস পর্যন্ত আর কোনরূপ গোল যোগ শুনিতে পাইলাম না। তাহার পর পুলিসের লোক আসিয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগকে আমি যাহা বলিয়া ছিলাম, তাহা আপনি পূৰ্বেই জানিতে পারিয়াছেন। যে সকল নোট আমি জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে পাইয়া, করেসি আফিস হইতে ভাঙ্গাইয়া আনিয়াছিলাম, সেই সকল নোট রামজীলাল লইয়া প্রস্থান করিয়াছে, এই কথাই কৰ্মচারী গণকে বলিয়াছিলাম। তাহাও করেনসি আফিসে অনুসন্ধান করিয়া আপনারা অবগত হইতে পারিয়াছিলেন যে, রামজীলালই সেই নোট ভাঙ্গাইয়া লইয়া গিয়াছে। ইহার পরই রামজীলালের নামে ওয়ারেন্ট বাহির হয়।

যে মাজিষ্ট্রেট সাহেব রামজীলালের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট বাহির করিবার আদেশ প্রদান করেন, তিনি কেবলমাত্র আমার সাক্ষ্য ও করেসি অফিসের একটী বাবুর সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়াই সন্তুষ্ট হন, অপর কোন বিষয় অনুসন্ধান না করিয়াই ওয়ারেন্ট প্রদান করেন। তাহার পর আর যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা আপনি স্বহস্তেই করিয়াছেন।

কালীবাবুর কথা শুনিয়া এই মোকদ্দমার অবস্থা আমরা অতি পরিষ্কাররূপে বুঝিতে পারিলাম। তখন আমরা কালীবাবু ও ত্রৈলোক্য উভয়কেই এই মোকদ্দমার আসামী করিলাম। পূর্বোক্ত সেই সকল টাকা ত্রৈলোক্য কালীবাবুর নিকট হইতে গ্রহণ করিয়া যে কোথায় রাখিয়াছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত ত্রৈলোক্যকে লইয়া সবিশেষরূপে পীড়াপীড়ি করিলাম, তাহার ঘর বাড়ী খুড়িয়া উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোনরূপেই সেই টাকা বাহির করিতে পারিলাম না। কালীবাবুও সেই সম্বন্ধে আর কোন কথা বলিতে পারিল না, বা বলিল না।

মোকদ্দমা প্রথমতঃ মাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরিত হইল। কেবলমাত্র কালীবাবুর কথা ব্যতীত ত্রৈলোক্যের বিপক্ষে আর কোনরূপ প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারিলাম না। কালীবাবু যে বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তাহার অধিকারীকে যখন বলিলাম, আপনি আপনার এই ভাড়াটিয়া বাটীতে এই ত্রৈলোক্যকে কখনও আসিতে দেখিয়াছিলেন? তখন তিনি তাহার কিছুই বলিতে পারিলেন না। কেবলমাত্র ইহাই বলিলেন, আমার নিকট হইতে কালীবাবু আমার বাটীর চাবি লইয়া আসিলে, আমার বাটীতে কেহ আসিয়া বাস করিয়াছিল কি না, তাহা জানি না, বা দেখি নাই। জহরতের দোকানেরও কোন ব্যক্তিই রাণীজিকে দেখে নাই; সুতরাং কেহই ত্রৈলোক্যকে সেনাক্ত করিতে পারিল না। সহিস-কোচবান্ দোকানদার প্রভৃতিও কেহই ত্রৈলোক্যকে রাণীজি বলিয়া চিনিতে পারিল না। সুতরাং মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট হইতে সে যাত্রা ত্রৈলোক্য নিষ্কৃতি লাভ করিল।

কালীবাবুর নিষ্কৃতির উপায় রহিল না। প্রথমতঃ কালী বাবু বাড়ীওয়ালার নিকট একমাসের বন্দোবস্তে বাটী ভাড়া লইয়া চাবিটা লইয়া আসিয়াছিল বটে; কিন্তু দুই তিনদিবসের মধ্যেই বাটীর প্রয়োজন হইল না বলিয়া, সেই চাবি প্রত্যর্পণ করিয়াছিল। সেই দুই তিনদিবসের মধ্যেই সেই বীভৎস-কাণ্ড সকলের অজ্ঞাত সারে কালীবাবু কর্তৃক সম্পাদিত হইয়াছিল, একথা ত দোষী নিজ মুখেই ব্যক্ত করিয়াছিল। অধিকন্তু বাড়ীওয়ালা, সহিস-কোচবান। প্রভৃতির সাক্ষ্যে ও সেনাক্তে তাহা একরূপ প্রমাণীকৃত হইল; চাক্ষুষ প্রমাণ না থাকিলেও, ঘটনা-পরম্পরায় অবিবোধী সমবায়ত্ব প্রমাণে কালীবাবু দোষ-মুক্ত হইতে সমর্থ হইল না। আড়গোড়ায় গিয়া যাহার নিকট গাড়ি ভাড়া করিয়া ভাড়ার টাকা জমা দিয়া ছিল, কালীবাবু তাহা কর্তৃকও পরিচিত হইল; সহিস-কোচবান্ ত চিনিয়াই ছিল। জহরতের দোকানের মালিক ও আমলাগণ কালীবাবুকে সবিশেষরূপেই চিনিয়াছিলেন; করেসি অফিসে তাঁহার নিকট হইতে নম্বরী-নোট বাইয়া কালীবাবু খুচরা নোট ও নগদ টাকা লইয়া রামজীলালের নাম ও ঠিকানা লিখিয়া দিয়া ছিল, তিনিও কালীবাবুকে ভাল করিয়া দেখিয়া বলিলেন যে, এই ব্যক্তিই রামজীলালের নাম ও ঠিকানা লিখিয়া আট হাজার টাকার নম্বরী-নোট ভাঙ্গাইয়া লইয়াছিল। এইরূপে বিধাতার চক্রে পড়িয়া আজ কালীবাবু আর উদ্ধার পাইল না।

যথাক্রমে কালীবাবুর মোকদ্দমা মাজিষ্ট্রেট সাহেব দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। সেই স্থানে জুরির বিচারে কালীবাবু হত্যাপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইল, এবং তাহার কাৰ্য্যের উপযুক্ত দণ্ডই প্রাপ্ত হইল। বিচারে তাহার ফাঁসির হুকুম হইল।

[সম্পূর্ণ]

Exit mobile version