লাল সিং কিছুকাল কোন উত্তর করিলেন না; একমনে কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। পরে ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন,–রূপবতী পত্নী সত্ত্বেও, শুনিয়াছি, শোভন সিং অপর এক বেশ্যার প্রেমে মুগ্ধ হইয়াছিল। সে তাহারই সমবয়স্ক, দেখিতে নিতান্ত মন্দ নহে, কিন্তু তাঁহার স্ত্রীর সহিত কোন বিষয়েই তাহার তুলনা হয় না। এ ছাড়া, আমি আর কোন রমণীর সহিত শোভন সিংএর ঘনিষ্টতা আছে কি না জানি না। একে বেশ্য, তাহাতে বয়স হইয়াছে, তাহার উপর তাহার অবস্থাও এখন হীন হইয়া পড়িয়াছে। সুতরাং তাহাকে যে বুড়ীর মত দেখাইবে, আশ্চর্য্য কি? কিম্বা সে হয় ত বৃদ্ধার ছদ্মবেশ করিয়া থাকিবে। কেন না, গোপনে বালিকা ভুলাইয়া লইয়া যাওয়া বড় সহজ ব্যাপার নহে। যে সে লোকের উপর এমন কাজের ভার দেওয়া যায় না। আমার বোধ হয়, সেই মাগীরই এই কাজ।
অ্যা। আপনি তাহার বাড়ী জানেন?
লা। চেষ্টা করিয়া বাহির করিব। শুনিয়াছিলাম, মেছুয়া বাজারে তাহার বাসা। তাহার নাম কামিনী।
আমি সন্তুষ্ট হইলাম। তাঁহাকে কামিনীর সন্ধান করিতে বলিলাম। লাল সিং তখনই বিদায় লইলেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
বেলা প্ৰায় চারিটার সময় লাল সিং পুনরায় আমার নিকট আগমন করিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়াই আমি বুঝতে পারিলাম যে, তিনি কাৰ্য্যে সফল হইয়াছেন।
লাল সিং আমার নিকটে বসিয়া বলিলেন, তিনি কামিনীর সন্ধান পাইয়াছেন। বয়স অধিক না হইলেও বাতে তাহাকে বৃদ্ধা করিয়াছে। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি কামিনীর পরিচিত কি না? লাল সিং বলিলেন, বহুদিন পূর্বে একবার মাত্র তিনি কামিনীর বাড়ীতে গিয়াছিলেন। সেই অবধি আর তাহাদের সাক্ষাৎ হয় নাই।
লাল সিংএর কথা শুনিয়া আমি তখনই ছদ্মবেশ পরিধান করিলাম এবং তাঁহাকে লইয়া একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ীতে আহোরণ করিয়া, কামিনীর বাসা হইতে কিছুদূরে আমরা গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম এবং ধীরে ধীরে সেইদিকে যাইতে লাগিলাম।
যখন বাড়ীর নিকট উপস্থিত হইলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা। সেদিন শনিবার। আমি বেশ বাবু সাজিয়া গিয়াছিলাম। একে শনিবার সন্ধ্যাকাল, তাহার উপর আমি একজন নব্য বাবু, তাহাতে আবার আমি অতি ধীরে ধীরে একটী বাড়ীর বারান্দার দিকে দেখিতে দেখিতে যাইতেছি। এতগুলি কারণ যখন একত্রিত হইল, তখন কাৰ্য্য না হইয়া আর যায় কোথায়? একজন আধা বাবুগোচ লোক তখনই আমাদের নিকট আগমন করিয়া বলিল,–বাবু! ঐ বাড়ীতে যাবেন? আমি নিয়ে যাচ্ছি, আসুন, আমার সঙ্গে আসুন।
আন্তরিক সন্তুষ্ট হইয়া আমি হাসিয়া বলিলাম,–ও বাড়ীতে মানুষের মত কে আছে? ঐ ত সব বসে আছে?
আগন্তক ঠকিবার পাত্র নয়। সেও হাসিয়া বলিল,–আপনি রসিক বটে। কিন্তু এই সাঁঝের আঁধারে এতদূর থেকে কি ভাল দেখা যায়? বাড়ীর ভিতর চলুন।
আমি বুঝিলাম, আগন্তুক দালাল। কিছু পাইবার প্রত্যাশায় আমাকে লইয়া যাইতে চায়। বাড়ীর ভিতর যাওয়া যুক্তিসিদ্ধ নহে মনে করিয়া আমি বাহিরেই কামিনী সহ দেখা করিতে ইচ্ছা করিলাম। লোকটাকে বলিলাম,–বাপু, তুমি আমাকে যা মনে ক’রেছ, আমি তা নয়। তবে যখন আমার কাছে এসেছ, তখন যদি আমার একটা কাজ করা, আমি তোমায় সন্তুষ্ট করিব।
শশব্যস্তে সে বলিয়া উঠিল,–কি কাজ বলুন?
আমি বলিলাম, ঐ বাড়ীতে কামিনী নামে একটা মেয়েমানুষ আছে জান?
সে যেন মুখ বিকৃত করিল। কিন্তু তখনই আত্মসংবরণ করিয়া বলিল, আজ্ঞে হাঁ, জানি বই কি। আগে ছিল ভাল—এখন বাতে পক্ষু।
আমি বলিলাম, কামিনীকে কোনরূপে আমার কাছে আনিতে পার? আমি বাড়ীর ভিতর গিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিতে পারিব না।
লোকটা কিছু কালা, আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। পরে বলিল, কি বলিয়া ডাকিয়া আনিব? আপনাকে সে কি চেনে?
আ। আমাকে সে চেনে না, কোন রকম কৌশল করিয়া তাহাকে আনিতে হইবে।
লো। কোথা দেখা করিবেন? এই রাস্তায়?
আ। না, তাহারও উপায় তোমায় করিতে হইবে।
লো। কি উপায় করি?
আ। তোমাদের কোন ঘর এখানে নাই?
লো। আছে, কিন্তু সেখানে নিয়ে গেলে সকলকে অংশ দিতে হইবে। আমরা চারিজনে ঘরটী ভাড়া লইয়াছি।
আ। ভাল, আমি তাহাদিগকেও স্বতন্ত্র দিব, তুমি কামিনীকে সেইখানে লইয়া যাইও। আপাততঃ সেই ঘরটা আমাদিগকে দেখাইয়া দাও।
তাহাদের আড্ডা নিকটেই ছিল। লাল সিংকে লইয়া আমি সেই ঘরের ভিতর বসিলাম। যাহার সহিত আমার দেখা হইয়াছিল, তাঁহাকেই কৰ্ত্তা বলিয়া বোধ হইল। সে সকলকে চুপি চুপি আমাদের সেখানে যাইবার কারণ বুঝাইয়া দিল–পুরষ্কারের কথাও ভুলিল না। লাভের আশা পাইয়া সকলেই আনন্দিত হইল এবং আমাদিগকে যথেষ্ট সম্মান প্ৰদৰ্শন করিতে লাগিল।
অৰ্দ্ধ ঘণ্টা মধ্যেই কামিনীকে লইয়া পূৰ্ব্বোক্ত ব্যক্তি ফিরিয়া আসিল। তখন অপরাপর লোক সকল এক একটী অছিল করিয়া সেখান হইতে বিদায় লইল। অবশেষে যে কামিনীকে আনিয়াছিল, সেও তামাক আনিবার নাম করিয়া সরিয়া পড়িল।
আমি দেখিলাম, কামিনীর বয়স প্ৰায় চল্লিস বৎসর হইলে ও তাহাকে বৃদ্ধ বলা যায়। যে কারণেই হউক, সে সোজা হইয়া দাঁড়াইতে পারে না। কোমর বঁকিয়া শরীরের উপরদ্ধি নত কারিয়াছে। তাহার মাথার চুল অধিকাংশ কটা। শরীরের মাংস শিথিল হইয়া পড়িয়াছে, চক্ষু কোটরে প্রবেশ করিয়াছে।
অনেক কষ্টে আমার দিকে মুখ তুলিয়া কামিনী জিজ্ঞাসা করিল, কি বাবা, তুমিই ডেকে পাঠিয়েছিলে?
আমি বলিলাম, ছেলে মেয়ে ধরা ব্যবসা কবে থেকে আরম্ভ করেছ?