এই বলিয়া সন্ন্যাসী স্থির হইল। সে যে ভাবে কথা গুলি বলিল, তাহাতে তাহার কথা অবিশ্বাস করিতে পারিলাম না। তাহার কথাবার্ত্তায় তাহাকে বিদ্বান ও মহাশয় ব্যক্তি বলিয়া বোধ হইল এবং এতক্ষণ যে তাহার প্রতি উপযুক্ত সন্মান প্ৰদৰ্শন করা হয় নাই, তজ্জন্য অনুতপ্ত হইলাম। আমি তখন অতি বিনীতভাবে বলিলাম—শোভন সিং আপনাকেই তাঁহার কন্যার হত্যাকারী বলিয়া সন্দেহ করিয়াছে এবং তাঁহারই কথামত আমি আপনাদিগকে গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইয়াছি। এখন আপনার মুখে যে সকল কথা শুনিলাম, তাহাতে আমার অবিশ্বাস নাই। কিন্তু তাহা হইলেও আমি এখন আপনাকে মুক্তি দিতে পারিব না। যতদিন না। আপনার বিচার হয়, ততদিন এরূপে থাকিতে হইবে। শোভন সিংয়ের ভাগীনেয়ী আপনাকে দেখিয়াছিল। আমি এখনই তাহাকে এখানে ডাকিয়া আনাইতেছি। যদি সে সনাক্ত করে, তাহা হইলে বিচারে কি হয় বলা যায় না।
সন্যাসী ভজন সিং ঈষৎ হাসিয়া বলিল—মৃত্যুর জন্য ভয় করি না–যদি অদৃষ্ট থাকে তবে আমার এই অপঘাত মৃত্যুও কেহ রোধ করিতে পরিবে না। কিন্তু দেখিতেছি, আপনি ব্ৰাহ্মণ সন্তান। দেখিবেন, যেন ভ্ৰমক্রমে একজন নিরীহ ব্ৰাহ্মণের মৃত্যুর উপলক্ষ না হন।
আমি সাগ্রহে উত্তর করিলাম,–আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিব। যাহাতে প্ৰকৃত দোষীকে গ্রেপ্তার করিয়া আপনাকে মুক্ত করিতে পারি, তজ্জন্য প্ৰাণপণে চেষ্টা করিব। তবে ভবিতব্যের কথা বলিতে পারি, এমন ক্ষমতা আমার নাই।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
সন্ন্যাসী ভজন সিংএর নিকট বিদায় লইয়া আমি তখনই একজন লোককে শোভন সিংএর বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলাম, দুইজন উপযুক্ত লোককে সন্ন্যাসীদিগের আড্ডায় গিয়া সেই ঘরটি বিশেষ করিয়া অন্বেষণ করিতে আদেশ করিলাম এবং অপর একজনকে লাল সিংএর নিকট প্রেরণ করিলাম।
সন্ন্যাসী গ্ৰেপ্তার হইয়াছে শুনিয়া, শোভন সিং ভাগিনেয়ীকে লইয়া কিছুক্ষণ পরেই আমার নিকটে আসিলেন। আমি গৌরীকে সেই সন্ন্যাসিদিগের নিকট লইয়া গেলাম। গৌরী তাহাদিগকে দেখিয়াই চীৎকার করিয়া সেখান হইতে পলায়ন করতঃ শোভন সিংএর পশ্চাতে গমন করিল। তাঁহার ভাব-গতিক দেখিয়া অমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, সে ঐ সন্ন্যাসী তিনজনকেই দেখিয়াছিল।
শোভন সিং আমার নিকট যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিলেন। এক রাত্রের মধ্যে হত্যাকারীকে গ্ৰেপ্তার করিয়াছি বলিয়া আমার যথেষ্ট সুখ্যাতি করিলেন। কিন্তু আমার সে সকল বড় ভাল বোধ হইল না। আমিও মিষ্ট কথায় তাহাকে বিদায় দিয়া বলিলাম, প্ৰয়োজন হইলে সংবাদ দিব।
শোভন সিং চলিয়া গেলেন। প্ৰায় একঘণ্টা পরে যে দুইজন লোককে সন্ন্যাসীর সেই বাসস্থানে অন্বেষণ করিতে পাঠাইয়াছিলাম, তাহারাও ফিরিয়া আসিল এবং একছড়া স্বৰ্ণ-হার আমার হস্তে দিয়া বলিল যে, তাহারা সেই ঘরাটী তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিয়াছে কিন্তু ঐ একছড়া হার ভিন্ন আর কোন গহনা দেখিতে পায় নাই।
হারছড়া পরে একমনে ঐ সকল বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, সন্ন্যাসীর কথা কোনরূপেই অবিশ্বাস করা যায় না। তিনি শোভন সিং সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, তাহাও সত্য বলিয়া বোধ হইল। লোকটা তাহাকে উৎপীড়ন করিতে প্ৰাণপণে চেষ্টা করিয়াছে এবং এখনও যে করিবে, তাহাতে আর আশ্চৰ্য্য কি? কিন্তু এই হারছড়া কোথা হইতে আসিল? গত রাত্রে আমি স্বয়ং অন্বেষণ করিয়াছিলাম। কিন্তু কই, তখন ত কিছুই দেখিতে পাই নাই। অতি সামান্য সময়ের মধ্যেই যখন হারছড়া খুঁজিয়া পাইয়াছে, তখন ইহা বিশেষ লুকান ছিল এমন বোধ হয় না। একি রহস্য? তবে কি সত্যসত্যই সন্ন্যাসী হইয়া বালিকা হত্যা করিল?
কিছুক্ষণ এইরূপ চিন্তা করিয়া স্থির করিলাম, সন্ন্যাসী নিশ্চয়ই সত্য বলিয়াছেন। শোভন সিং লাল সিংএর সহিত যেমন ব্যবহার করিয়াছে, তাহাতে তাহাকেই শঠ ও প্রতারক বলিয়া বোধ হইতেছে। এরূপ অনেক দেখা গিয়াছে যে, প্ৰকৃত দোষী অপরের স্কন্ধে দোষারোপ করিবার জন্য অনেক প্রকার উপায় অবলম্বন করিয়াছে। শোভন সিং যেরূপ প্রকৃতির লোক, তাহাতে তাহার পক্ষে উহা নিতান্ত অসম্ভব নহে।
এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে লাল সিং সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমি তাহাকে সমস্ত কথা প্ৰকাশ করিলাম। তিনি শুনিয়া অত্যন্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। বলিলেন,–আপনি যাহা অনুমান করিয়াছেন, তাহাই সম্পূর্ণ সত্য। শোভন সিং অত্যন্ত চতুর—তিনি না পারেন এমন কাজ অতি অল্প। সেই গত রাত্রে আপনার ফিরিয়া আসিবার পর কোনরূপে ঐ হারছাড়াটী সেখানে রাখিয়া আসিয়াছে। যদি তাহা না হইবে, তাহা হইলে আপনি কালই রাত্রে ঐ হার পাইতেন।
আ। যদিও আমি ভালরূপ অন্বেষণ করিবার অবকাশ পাই নাই, তত্রাপি যখন দুই ব্যক্তি এত অল্প সময়ের মধ্যে এই হার বাহির করিতে পারিল, তখন আমি যে একেবারেই উহা দেখিতে পাইলাম না, ইহাও বিশ্বাসযোগ্য নহে। হারছড়া নিশ্চয়ই তখন সেখানে ছিল না, পরে রক্ষিত হইয়াছিল।
লা। ঠিক বলিয়াছেন–আমার বিশ্বাস রূপসী এখনও জীবিত আছে। কেবল আমাকে ফাঁকি দিবার জন্যই ঐ মিথ্যা কথা রাষ্ট্র করিয়াছে। বিবাহ না দিলে পাছে আমার টাকা ফেরৎ দিতে হয়, এই ভয়ে আপনার কন্যার মৃত্যু সংবাদ রাষ্ট্র করিয়াছে।
আ। আমারও সেইরূপ মনে হয়। কিন্তু যে বৃদ্ধ গৌরী ও রূপসীকে ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছিল, সে কে? তাহাকে ধরিতে না পারিলে এ রহস্য ভেদ করা অতীব দুরূহ হইবে। আপনি সে বুড়ীকে চেনেন? কোন প্রকার অনুমান করিতে পারেন?