স। কেমন করিয়া জানিব? সমস্ত দিনের পর এই আমি চক্ষু চাহিতেছি।
দআ। বৃদ্ধ যে দুইটী বালিকাকে এখানে আনিয়াছিল তাহার সাক্ষী আছে। যে গাড়ীতে করিয়া তাহারা তোমার নিকট আসিয়া ছিল, সেই গাড়ীর কোচমান আমার সঙ্গেই আছে।
স। হইতে পারে—আপনার কথা যথার্থ হইতে পারে। কিন্তু আমি আজ সমস্ত দিনই ধ্যানে নিমগ্ন।
কথায় কথায় রাত্রি অনেক হইয়া গেল দেখিয়া, আমি তাহাকে বলিলাম, বিচার পরে হইলে, এখন তোমরা তিনজন আমাদের সঙ্গে আইস।
দ্বিরুক্তি না করিয়া সেই সন্ন্যাসী অপর দুইজনের ধ্যান ভঙ্গ করিল। তখন তিনজনে মিলিয়া আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাহির হইল এবং বাগান পার হইয়া সেই ভাঙ্গা ফটকের নিকট উপস্থিত হইল। ফটকের সম্মুখেই গাড়ী ছিল। আমি সন্ন্যাসী তিনজনকে তাহাতে উঠিতে বলিলাম। সকলে গাড়ীতে উঠিলে, কোচমান শকট চালনা করিল।
বাসায় ফিরিতে রাত্রি একটা বাজিয়া গেল। তখন সন্ন্যাসী তিনজনকে আটক করিতে বলিয়া আমি বিশ্ৰাম লাভ করিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
পরদিন প্ৰাতঃকালে সমস্ত কাৰ্য্য ত্যাগ করিয়া অগ্ৰে সেই সন্ন্যাসীত্রিয়কে দেখিতে গেলাম। যে ঘরে তাহাদিগকে আবদ্ধ করিয়া রাখিতে বলিয়ছিলাম, তাহার দ্বারে দুইজন প্রহরী ছিল। সন্ন্যাসীদিগের কাৰ্য্য লক্ষ্য করিতে এবং তাহদের কথোপকথন শুনিবার জন্য আমি তাহাদিগকে পূর্ব রাত্রে নিযুক্ত করিয়াছিলাম। প্রহরীদ্বয়ের মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে তাহাদিগের উপর কোনরূপ সন্দেহ করা যায় না। তাহারা বলিল, সন্ন্যাসীগণ কোন কথা কহে নাই, যেখানে বসিতে বলা হইয়াছিল সমস্ত রাত্রি সেই–স্থানে চক্ষু মুদিত করিয়া বসিয়াছিল। ঘরে এক সামান্য আলোক দেয়া হইয়াছিল কিন্তু একমুহূর্ত্তের জন্যেও চক্ষু উন্মীলন করে নাই, কথা কহা দূরে থাক, কেহ একটী শব্দও করে নাই। অথচ গৌরীর মুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে ত তাহাদিগের উপরই ভয়ানক সন্দেহ হয়। এ কি রহস্য!
একজন সন্ন্যাসীর মুখে শুনিলাম, শোভন সিং তাহার পরিচিত। শোভন সিং বলিয়াছিলেন, ঐ সন্ন্যাসী তাহার পরম শক্রি। এত দিন সুবিধা পায় নাই বলিয়া কোন অপকার করিতে পারে নাই। সন্ন্যাসী। কিন্তু সে কথা স্বীকার করিল না। তবে কি সন্ন্যাসীত্রয় নির্দোষী? আমি কি অন্যায় সন্দেহ করিয়া তাহাদিগকে অবরুদ্ধ করিয়াছি। যদি তাঁহাই হয়, তাহা হইলে আমার যথেষ্ট পাপ সঞ্চয় হইল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু গৌরীর কথাই বা কেমন করিয়া মিথ্যা বলি। গৌরীর বয়স চৌদ্দ–পনের বৎসরের অধিক হইবে না। এ বয়সে সে যদি এত মিথ্যা কথা সাজাইয়া বলিতে পারে, তাহা হইলে বড় হইলে সে কি করিবে বলা যায় না। এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি সন্ন্যাসীদিগের নিকট গমন করিলাম। দেখিলাম, তখনও তাঁহাদের চক্ষু মুদিত। একবার তাহাদের জিনিষপত্রগুলি দেখিবার ইচ্ছা হইল। কিন্তু সন্ন্যাসীদিগের আবার কি জিনিষ থাকিবে? যাহারা সংসার ত্যাগ করিয়াছে, যাহারা মন হইতে বাসনা দূর করিয়াছে, তাহারা আবার সঞ্চয় করিবে কি? তবে যদি ভণ্ড হয়, তাহা হইলে কিছু পাইলেও পাইতে পারি। এই ভাবিয়া আমি তাহদের পরিচ্ছদ, কমণ্ডলু প্রভৃতি দ্রব্য গুলি অন্বেষণ করিতে আদেশ করিলাম।
যে দুইজন কনষ্টেবল প্রহরী ছিল, তাহারা তখনই আমার আদেশ পালন করিল, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সফল হইল না। ভাবিয়াছিলাম, যদি দুই একখানা গহনা বাহির করিতে পারি, তাহা হইলে তাহারা নিশ্চয়ই রূপসীকে খুন করিয়াছে। কিন্তু সেরূপ কোন? নিদর্শন পাওয়া গেল না।
এইরূপ গোলযোগে সন্ন্যাসীগণের ধ্যান ভঙ্গ হইল। আমি তখন অপর সকলকে সেখান হইতে দূর করিয়া। গত রাত্রে যাহার সাহিত কথা কহিয়াছিলাম, তাহাকে বললাম, শোভন সিং তোমার নামে যে দোষারোপ করিয়াছেন, তাহাতে তোমাকে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে। যদি নিজের মঙ্গল চাও, তাহা হইলে যাহা জানি সত্য করিয়া প্ৰকাশ কর। শোভন সিং বলেন যে, তুমি তাহার পরম শত্রু এবং আর কোন উপায়ে প্ৰতিশোধ লইতে না পারিয়া অবশেষে তাহার এক কাত্ৰ কন্যাকে হত্যা করতঃ তাহার গাত্রের প্ৰায় দুই সহস্র টাকার অলঙ্কার অপহরণ করিয়াছ। শোভন সিংএর মুখে শুনিয়াছিলাম, সেই সন্ন্যাসীর নাম ভজন সিং। সত্য মিথ্যা জানিবার জন্য আমি সন্ন্যাসীকে নাম জিজ্ঞাসা করিলাম। সন্ন্যাসী উত্তর করিল, সত্যই তার নার নাম ভজন সিং।
আমার কথা শুনিয়া ভজন সিং হাসিয়া উঠিল। বলিল, আমি তাহার শত্রু? না মহাশয়, সংসার-বিরাগী সন্ন্যাসী কাহারও শত্রুতাচরণ করে না। এ জগতে আমারও শত্রু কেহ নাই, আমিও কাহার শত্রু নয়। যেরূপ করিলে আপনার বিশ্বাস হয়, আপনি স্বচ্ছন্দে তাঁহাই করুন, আমার তাহাতে কোন প্ৰকার ক্ষতি বৃদ্ধি হইবে না। জীবন ক্ষণস্থায়ী, আজ হউক বা দুদিন পরেই হউক, কোন না কোন দিন আমাকে মরিতেই হইবে।
আ। আমি শুনিয়াছি, তুমি অতি অল্পদিনেই বিবাগী হইয়াছ, এখনকার কথা বলিতেছি না, পূর্বে যখন তুমি সংসারাশ্রমে ছিলে, তখনকার কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি। শোভন সিংএর সহিত তোমার কিরূপ সম্পর্ক আছে? কেনই বা তুমি সংসার ছাড়িয়া সন্ন্যাসী হইলে?
স। সমস্তই বলিতেছি—যদি একান্তই শুনিতে চান, শুনুন। পূৰ্বেই বলিয়াছি, আমার নাম ভজন সিং, আমি পিতার একমাত্র পুত্র। অল্প বয়সেই মাতৃহীন হওয়ায় আমি পিতার বড় আদরের সামগ্ৰী ছিলাম। আমার এক জ্ঞাতি ভগ্নী ছিল, পিতৃমাতৃহীন হওয়ায় সে আমাদের বাড়ীতেই প্ৰতিপালিতা। তাহার সহিত শোভন সিংহের বিবাহ হয়। শোভন সিং সম্পর্কে ভগ্নীপতি। ভগ্নীপতি হইলেও শোভন সিং আমাকে দেখিতে পারিত না। আমিও তাতার সহিত মিশিতাম না। ক্ৰমে এই মনোবিধাদের বুদ্ধি হইতে লাগিল, আমি তাহার ছায়াও স্পর্শ করিতাম না। শোভন সিং কিন্তু আমার অপকারের চেষ্টা করিতে লাগিল। সুবিধা পাইলেই আমার অনিষ্ট করিতে লাগিল। এই সময়ে হঠাৎ হৃদরোগে আমার পিতার মৃত্যু হয়। যখন আমি তাহার সমম্ভ সম্পত্তির অধিকারী হইলাম, তখন হইতে শোভন সিংহের মতিগতি ফিরিতে লাগিল। উপযাচক হইয়া আমার সহিত দেখা করিল, কত মিষ্ট কথায় আমাকে সান্ত্বনা করিল, আপনার অসদাচরণের জন্যবারম্বার ক্ষমা প্রার্থনা করিল। শোভন সিংহের তৎকালীন অবস্থা ও কথাবাৰ্ত্তা শুনিয়া আমার মনে কেমন বিশ্বাস হইল। আমি তাহার বশীভূত হইলাম। ক্রমে ঘনিষ্টতা হইল। উভয়ে মিলিয়া জুয়ার দলে মিশিলাম। তাহার পর যাহা ঘটিল তাহা আর বলিবার নয়। অল্প দিনের মধ্যে আমি নিঃসম্বল হইয়া পড়িলাম। পিতার বহু কষ্টে সঞ্চিত প্ৰায় লক্ষাধিক টাকা জুয়া খেলিয়া জলে ফেলিয়া দিলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহার অধিকাংশই শোভন সিংএর উদর পূর্ণ করিয়াছিল। আমাকে নিঃস্ব করিয়াও শোভন সিংএর তৃপ্তি হইল না, সে আমাকে চোর বলিয়া ধরাইয়া দিল। সৌভাগ্যক্রমে দুইজন, ভদ্রলোক সাক্ষী ছিলেন বলিয়াই সে যাত্ৰা অব্যাহিত পাই। এইরূপে নানা কারণে মনে কেমন বৈরাগ্য উপস্থিত হইল, আমি সংসার ছাড়িয়া গুরুর নিকট যাইলাম। সেখানে দীক্ষা লইয়া সেই নির্জন বনে সাধনা করিতে থাকি। কিছুদিন হইল, এই দুইজনের ইচ্ছায় আমাকে এখানে আসিতে হইয়াছে। কিন্তু এখানেও নিস্তার নাই—শোভন সিং আমাকে প্ৰাণে মারিবার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু তাহাতে সন্ন্যাসীর কি করিবে?