বাহিরেও যেমন অন্ধকার, ভিতরেও ততোধিক, যতক্ষণ বাহিরে ছিলাম, চোরা লণ্ঠনটি হাতে ছিল, তাহারই মৃদু আলোকে কিছু? কিছু দেখিতে পাইতেছিলাম না। কিন্তু ভিতরে যাইয়া লণ্ঠনটীপকেটে রাখিলাম। ভাবিলাম, যদি কেহ দেখিতে পায়, এখনই পলায়ন করিবে, তাহা হইলে সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে কাহকেও খুঁজিয়া বাহির করা বড় সহজ হইবে না।
কিছুদূর অগ্রসর হইয়া একটা প্ৰকাণ্ড ঘরের দরজার সম্মুখে আসিলাম। বাহির হইতে দেখিলাম, ভিতরে তিনজন প্ৰশান্তমূৰ্ত্তি সন্ন্যাসী একমনে ধ্যানে নিমগ্ন। সকলেরই চক্ষু মুদিত; সকলেই নাভীর নিম্নে করন্থয় মিলিত করিয়া একাগ্ৰচিত্তে ঈশ্বরোপাসনায় নিযুক্ত। সম্মুখে প্ৰজ্বলিত অগ্নি ধুধু শব্দে জ্বলিতেছিল।
তাহাদের গভীর ও প্ৰশান্ত মূৰ্ত্তি দেখিয়া আমার ভক্তির উদ্রেক হইল। যে কাৰ্য্যে গিয়াছিলাম, সহসা তাহা করিতে পারিলাম না। ভাবিলাম, এমন শান্তমূৰ্ত্তি যাহাঁদের, তাহারা নারীহত্যা করিবে কেন? কিন্তু পরিক্ষণেই দেখিলাম, তিনজনের ললাটদেশে সিন্দুরের দীর্ঘফোটা, গলে রুদ্রাক্ষ মালা, হস্তেও অনেকগুলি রুদ্রাক্ষ, পরিধানে রক্তবর্ণ পট্টবাস, গলে যজ্ঞোপবীত। বেশ দেখিয়াই বোধ হইল, তাহারা কাপালিক। শক্তি–উপাসক। শুনিয়াছি, কাপালিকগণ সিদ্ধ হইবার জন্য নরহত্যা করিতেও পশ্চাৎপদ হয় না। এরূপ ঘটনা অনেক শোনা গিয়াছিল। কিন্তু তাহদের দ্বারা নারীহত্য এক প্রকার অসম্ভব বলিয়া বোধ হইল। যে শক্তির উপাসনার জন্য তাহারা সেই কঠোর নিয়ম প্ৰতিপালন করিতেছে, ইচ্ছা! করিয়া কেন তাহারা সেই শক্তিকে খুন করিবে, বুঝলাম না।
যাহাই হউক, দ্বার সমীপে গিয়া যখন দেখিলাম, তিনজন মাত্র সন্ন্যাসী—আর কোন লোক নাই, তখন আমার সাহস হইল। আমি বাহির হইতে জুতার শব্দ করিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, সে শব্দে তাহাদের ধ্যান ভঙ্গ হইবে। কিন্তু আমার অনুমান মিথ্যা হইল। তাহাদের কেহই চক্ষু উল্মীলন করিল না, সকলেই পূর্বের মত ধ্যানে নিমগ্ন রহিল।
আমি আর বিলম্ব করিতে পারিলাম না। কোচমানকে ৰাহিরে রাখিয়া আনি একাই ভিতরে যাইলাম এবং চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলাম। অনেক ডাকাডাকির পর সর্বাপেক্ষা কনিষ্ঠ চক্ষু চাহিল, কিন্তু সম্মুখে আমাকে দেখিয়া পুনরায় চক্ষু মুদিত করিল। আমি বিষম ফাপরে পড়িলাম। কাহারও নাম জানি না. সুতরাং কি বলিয়া ডাকিব স্থির করিতে না পারিয়া, পুনরায় চিৎকার করিতে লাগিলাম। প্ৰায় আধা ঘণ্টা পরে বয়োজ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসী চক্ষু উন্মীলন করিল, আমাকে পরিষ্কার বাঙ্গালা ভাষায় জিজ্ঞাসা করিল, কেন বাপু! এখানে এত গোলযোগ করিতেছি? গোলমালের ভয়ে আমরা লোকালয় ছাড়িয়া এই নির্জন বনের মধ্যে আশ্ৰয় লইয়াছি। আর তুমি কি না। স্বচ্ছন্দে এখানে আসিয়া আমাদের ধ্যান ভঙ্গ করিতেছ। আকৃতি দেখিয়া তোমায় জ্ঞানবান বলিয়া বোধ হইতেছে, কিন্তু এ কি কাজ তোমার!
গৌরীর মুখে যাহা শুনিয়াছিলাম, তাহাতে তাহদের উপর কিছুমাত্র ভক্তির উদ্রেক হয় নাই। বরং তাহার মুখে ঐ কথা শুনিয়া আমার ক্ৰোধ হইল। রাগ সম্বরণ করিয়া ঈষৎ কর্কশ স্বরে বলিলাম, আর তোমার সাধুগিরিতে কাজ নাই। এখন ওঠ, আমার সঙ্গে থানায় চল।
থানার নাম শুনিয়া সন্ন্যাসীর কিছুমাত্র ভয় হইল না। সে হাসিয়া উঠিল, পরে বলিল, চল, আমাদিগকে যেখানে লইয়া যাইবে সেইখানেই যাইব। কিন্তু সেখানে যেন একটু নির্জন স্থান পাই, আমরা যেন নির্বিবাদে ধ্যান করিতে পারি।
আমি হাসিয়া উঠিলাম। হাসিতে হাসিতে বলিলাম, এখন বুজরুকি রাখ ঠাকুর! সকালে যে কাণ্ড করেছ, তাহাতে শীঘ্রই চিরধ্যানে নিমগ্ন হতে হবে। আগে উঠ, পরে এই দুই জনকে নিয়ে শীঘ্র আমার সঙ্গে এস।
সন্ন্যাসী গম্ভীরভাবে বলিল, সত্যই কি আমাদিগকে তোমার সহিত যাইতে হইবে? সকালে কি কাণ্ড করেছি বাবা?
আ। এখনও বলিতেছি, বুজরুকি রাখ, সকালে কি করেছ জান না কি?
স। ধৰ্ম্মই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। আমি সেই ধৰ্ম্মের দোহাই দিয়ে বলিতেছি যে, সত্যই আমি তোমার কথা কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।
আমি বিস্মত হইলাম। বলিলাম, সে কি! শোভন সিংহের কন্যাকে খুন করিয়া আবার মিথ্যা কথা বলিতেছ? তুমি কেমন সন্ন্যাসী? শক্তির উপাসক হইয়া শক্তিকে খুন?
আমার কথা শুনিয়া সন্ন্যাসী হাসিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পরে বলিল, বাবা! তোমার ভুল হইয়াছে। কোথায় আসিতে কোথায় আসিয়াছ, আমরা শোভন সিংএর কন্যাকে আজ দেখিও নাই।
আ। আজ দেখ নাই, তবে কি আর কখনও দেখিয়াছিলে?
স। সে অনেক দিনের কথা।
আ। তবে তুমি শোভন সিংকে চেন?
স। বেশ চিনি, আমারই এক আত্মীয়ের নাম শোভন সিং। রূপসী নামে তার এক কন্যা ছিল। কিন্তু জানি না, সে এখন ও জীবিত কাছে কি না?
আ। তোমার আত্মীয়ের নিবাস কোথায়?
স। নিকটেই–এই ভবানীপুরেই তাহার বাড়ী।
আ। আর তোমার?
স। তাহারই বাড়ীর নিকটে ছিল; কিন্তু এখন আর নাই। এখন _____ সেই আমার বাড়ী।
আ। কত দিন হইল তুমি এই বেশ ধরিয়াছ?
স। প্ৰায় দুই বৎসর হইল।
আ। সংসার ত্যাগ করিলে কেন?
স। সে অনেক কথা।
আ। শোভন সিং কি তোমার শত্রু।
স। না–এ জগতে আমার শত্রু ও কেহ নাই, মিত্ৰও কেহ নাই।
সন্ন্যাসীর কথা শুনিয়া আমার সন্দেহ বৃদ্ধি হইল। ভাবিলাম, সে নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা বলিতেছে। পাছে শোভন সিংকে শক্ৰ বলিয়া প্ৰকাশ করিলে আমার মনে সন্দেহ হয়, এই মনে করিয়া সে বোধ হয় কথাটা লুকাইল। এইরূপ চিন্তা করিয়া বলিলাম, আজি প্ৰাতে কি কোন বৃদ্ধা তোমার নিকট দুইজন বালিকা আনিয়া ছিল?