গৌরীকে দেখিতে খৰ্ব্বাকৃতি হইলেও আমার অনুমানে তাহার বয়স অন্ততঃ পনের বৎসর বলিয়া বোধ হইল। তাহার দেহ শীর্ণ কিন্তু তাহাতে যৌবনের চিহ্নগুলি ক্ৰমেই ফুটিয়া উঠিতেছে। গৌরীর আয়ত চক্ষু সদাই চঞ্চল, মুখখানি কাঁদ কাঁদ।
গৌরীর মুখের দিকে চাহিয়া আমি বলিলাম,–বল মা! কি জান বল?
কাঁদ কাঁদ হইয়া গৌরী উত্তর করিল—খুব ভোরে আমরা এখান হইতে বাহির হই। পথে লোক ছিল না বলিলেও অমন বাহির হইলাম বটে, কিন্তু দু-জনেরই গা কেমন ছমছম করিতে লাগিল। যখন আমরা পদ্মপুকুরের ধারে গিয়া উপস্থিত হই, দেখিলাম, এক বুড়ী যেন আমাদেরই দিকে আসিতেছে। কাছে অসিলে দেখিলাম, সে আমাদেরই দিকে কটমট করিয়া চাহিয়া রহিয়াছে। চারি চক্ষু মিলিত হইবা মাত্ৰ বুড়ী এক গাল হাসিয়া আমাদের নিকটে আসিল এবং নিমেষ মধ্যে দুই হাতে দুইটি জবা বাহির করিয়া আমাদের উভয়ের নাসিকার নিকট ধরিয়া বলিল,–দেখ দেখি, জবায় কেমন গোলাপ-গন্ধ? আর কখন এমন জবা দেখেছ কি?
সত্যসত্যই গোলাপের গন্ধ পাইলাম, জবাফুলে গোলাপ–গন্ধ পাইয়া কেমন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলাম। তখন উভয়েই সমস্ত কথু ভুলিয়া গেলাম। রূপসীর বিবাহের কথা ভুলিলাম, কোথায় যাইতেছিলাম ভুললাম, বাড়ী ভূলিলাম, এমন কি, আপনাদের অস্তিত্ব পৰ্য্যন্ত ভুলিলাম। রহিল কেবল সেই বৃদ্ধ। আমরা তাহার হাতের খেলনা স্বরূপ হইলাম। সে আমাদিগকে যাহা বলিতে লাগিল, আমরা অনায়াসে তাহা করিতে লাগিলাম। প্ৰথমে সে আমাদিগকে কিছুদূরে লইয়া গেল। সেখানে একখানি গাড়ী ছিল। আমরা তিনজনে গাড়ীতে উঠিলাম। কতক্ষণ পরে বনের ভিতর একটা ভাঙ্গা বাড়ীর দরজায় আসিয়া গাড়ী থামিয়া গেল। আমরা সকলেই গাড়ী হইতে নামিয়া সেই বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, একটা প্ৰকাণ্ড ঘরের মধ্যে তিনজন সন্ন্যাসী একদৃষ্টি সম্মুখের প্রজ্জলিত অগ্নির দিকে চাহিয়া রহিয়াছে। সন্ন্যাসী তিনজনের মধ্যে একজনকে দেখিতে অতি ভয়ানক, অপর দুইজনকে তাহার শিষ্য বলিয়াই বোধ হইল।
আমাদের পায়ের শব্দে সেই ভয়ানক সন্ন্যাসী উপরদিকে চাহিল এবং বুড়ীকে দেখিয়া ঈষৎ হাসিয়া নিকটস্থ দুইখানি কুশাসন ইঙ্গিত করিয়া দেখাইয়া দিল। বৃদ্ধাও তাহার সঙ্কেত বুঝিতে পারিয়া আমাদের দুইজনকে সেই দুইখানি আসনে বসিতে বলিয়া স্বয়ং নিকটে দাঁড়াইয়া রহিল।
কতক্ষণ এইরূপে কাটিল বলিতে পারি না। কিন্তু কিছু পরেই অপর দুই সন্ন্যাসী রূপসীর হাত ধরিয়া সেখান হইতে লইখা গেল, আমি চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলাম, কিন্তু আমার চীৎকারে কেহ ভ্রূক্ষেপও করিল না। আর ও কিছুক্ষণ এইরূপে অতিবাহিত হইল। তাহার পরে দেখিলাম, রূপসীর অচেতন দেহ সেই অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করিল। পরক্ষণেই বুড়ী আমার হাত ধরিয়া ঘর হইতে বাহিরে আনিল এবং কত পথ ঘুরাইয়া একটা বাগানের নিকট আমায় ছাড়িয়া দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।
আমিও চীৎকার করিতে লাগিলাম, কিন্তু যে স্থানে সেই বৃদ্ধ অ্যামকে ছাড়িয়া দিয়াছিল, সেখানে লোকজন নাই বলিলে ও চলে; এত চীৎকার করিলাম, এত কাঁদিলাম, কেহই আমার সাহায্যের জন্য আসিল না। এই সময় হইতে আমার আর কিছুই মনে নাই। আমি তাহার পর কি করিলাম, কেমন করিয়া এখানে ফিরিয়া আসিলাম, এখানে আসিয়াই বা কি করিলাম, কিছুই জানি না। যখন রাত্ৰি হইল, বর আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন আমার জ্ঞান হইল; তখন আমি সমস্ত কথা প্ৰকাশ করিলাম।
এই বলিয়া গৌরী স্থির হইল এবং একদৃষ্টি আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া শোভন সিংকে জিজ্ঞাসা করিলাম,–আপনার কন্যার গাত্রে কোন অলঙ্কার ছিল কি?
শো। আজ্ঞে হ্যাঁ, প্ৰায়; দুই সহস্র টাকার অলঙ্কার রূপসীর গাত্রে ছিল।
আ। আপনার ভাবী জামাতার মুখে শুনিলাম, আপনার আর্থিক অবস্থা বড় ভাল নহে। আপনি এত টাকার গহনা কোথায় পাইলেন?
শো। আমার ভাবী জামাতা সত্য সত্যই বলিয়াছেন। আমি অত্যন্ত দরিদ্র। কিন্তু বিবাহের দুই দিন পূর্বে আমার আত্মীয়গণ এখানে আসিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই ধন্যবানের পত্নী। তাঁহারাই জোর করিয়া তাহদের অলঙ্কারগুলি রূপসীকে পরাইয়া দিয়াছিল। আমি এখন ধনে প্ৰাণে মারা গেলাম।
আ। এ অঞ্চলে আপনার কেহ শত্ৰু আছে কি?
শোভন সিং কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন। পরে বলিলেন, আমারই এক আত্মীয় আমার ঘোর শত্রু ছিলেন। তাঁহারও নিবাস এই গ্রামে ছিল। কিন্তু এক বৎসর হইল, ভজন সিং কোথায় নিরুদেশ হইয়া গিয়াছেন। শুনিয়াছিলাম, তিনি না কি সন্ন্যাসী হইয়া দেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন।।
আ। তাহা হইলে যে সন্ন্যাসী রূপসীকে খুন করিয়াছে সেই হয় তা ভজন সিং–আপনার পুর্ব শত্ৰু। এতদিন কোনরূপ সুবিধা করিতে না পারায় আপনার উপর কোনরূপ প্ৰতিহিংসা লইতে পারে নাই। আজ আপনার কন্যার গাত্রে অনেক টাকা গহনা দেখিয়া কৌশলে সেই বুড়িকে পাঠাইয়া দিয়াছিল।
শো। আপনার অনুমান সত্য হইলেও হইতে পারে।
আ। আপনার আর কোন আত্মীয় আছে?
শো। আত্মীয়ের মধ্যে ভগ্নী—গৌরি তাহারই কন্যা।
আ। গহনাগুলিও কি তাঁহারই?
শো। আজ্ঞে না—সেও আমার মত দরিদ্রা, অত টাকা গহনা সে কোথায় পাইবে?
আ। তাঁহার নিবাস কোথায়?
শো। শিয়ালদহ ষ্টেশন হইতে কিছু দূরে।
আ। সধবা না বিধবা?
শো। আজ্ঞে সধবা–এই যে আমার ভগ্নিপতি আপনার সম্মুখেই দণ্ডায়মান।
এই বলিয়া শোভন সিং একজন বলিষ্ঠ যুবককে দেখাইয়া দিলেন।