আমি। সত্য হউক, আর মিথ্যা হউক, যে অপরাধের নিমিত্ত আপনার চাকরী গিয়াছে, সেই অপরাধ সম্বন্ধে আপনার কোন্ উর্দ্ধতন কর্ম্মচারী অনুসন্ধান করিছিলেন?
যে ইনস্পেক্টারের দ্বারা তাহার অপরাধের অনুসন্ধান করা হইয়াছিল, সেই ইম্পেক্টারের নাম তিনি আমার প্রশ্নের উত্তরে বলিয়া দিলেন, এবং তিনি আজ কাল যে স্থানে আছেন, তাহাও আমাকে জানাইয়া দিলেন। আমি দেখিলাম, যে সরকারী কার্যের নিমিত্ত আমি সেই প্রদেশে গমন করিয়াছি, তাহার কোন কোন বিষয়ের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাকে তাঁহার নিকট গমন করিতেই হইবে। সুতরাং এই ঘটনার সমস্ত অবস্থা তাঁহার নিকট হইতে অনায়াসেই জানিয়া লইতে পারিব। যে ভূত-পূৰ্ব পুলিস-কর্ম্মচারীর সহিত আমার চক্রপাণিতে সাক্ষাৎ হইল, তিনিও আমার পরিচয় গ্রহণ করিলেন, এবং পরিশেষে তাহার বাসায় গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি বার নিমিত্ত আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন। আমিও তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিলাম; সেই দিবস সন্ধ্যার পূর্বে তাঁহার বাসায় গিয়া আমি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। সেই রাত্রি তাহার বাসায় অতিবাহিত করিবার নিমিত্ত তিনি আমাকে বার বার অনুরোধ করিলেন; কিন্তু জাতিভেদের প্রতিবন্ধকতা হেতু আমি কোনরূপেই তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইতে পারিলাম না। তথাপি অনেক রাত্রি পর্যন্ত তাঁহার বাসায় বসিয়া নানারূপ প্রসঙ্গে সময় অতিবাহিত করিলাম। ইহার মধ্যে যতদূর সম্ভব, তাঁহার নিকট হইতে তাহার মোকদ্দমার বিষয় সকল উত্তমরূপে জানিয়া লইলাম।
ইনি অসৎ উপায়ে যে সকল অর্থ উপার্জন করিয়া ছিলেন, তাহার অধিকাংশই প্রায় ব্যয়িত হইয়া গিয়াছে। এই স্থানে বসিয়া এখন তিনি জমিদার-সরকারে যদি কোনরূপ একটী চাকরীর সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন, তাহারই চেষ্টা দেখিতেছেন।
নৈমিষারণ্যে আমার যে সকল অনুসন্ধানকার্য ছিল, তাহা শেষ করিয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। দুর্গম ভয়ানক পথ অতিক্রম করিয়া, ও হত্যা-হরণ প্রভৃতি স্থান দর্শন করিয়া, ক্রমে আমি গিয়া সাণ্ডিল। ষ্টেশনে উপস্থিত হইলাম। পরে কয়েকটা ষ্টেশন অতিক্রম করিয়া যে স্থানে সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধানকারী ইনস্পেক্টার থাকিতেন, সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তাঁহার নিকট আমি আমার পরিচয় প্রদান করিলাম, এবং যে সরকারী কার্যের নিমিত্ত আমি তাহার নিকট গমন করিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত ব্যাপার আমি তাঁহার নিকট কহিলাম। তিনি তাঁহার সাধ্যমত আমাকে সাহায্য করিয়া, সেই স্থানের আমার আবশ্যক কাৰ্য্য সকল সম্পন্ন করিয়া দিলেন।
যে সময় তিনি আমার সাহায্যের নিমিত্ত আমার সহিত কার্যে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় একদিবস কথায় কথায় এই মোকদ্দমার বিষয় তাহার নিকট উত্থাপিত করিলাম। তিনিও সবিশেষ যত্নের সহিত ইহার সমস্ত ব্যাপার আমাকে বলিয়া দিলেন, এবং এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের যে সকল কাগজ, পত্র ছিল, তাহাও আমাকে দেখাইতে চাহিলেন। সময়মত আফিস হইতে সমস্ত নথি-পত্ৰ আনিয়া, দেখিবার নিমিত্ত আমার হস্তে প্রদান করিলেন; কিন্তু উহার সমস্তই উর্দ্দূ ভাষায় লিখিত বলিয়া, আমি নিজে তাহা পড়িয়া উঠিতে পারিলাম না। উর্দু ভাষাবিদ একজন মুসির সাহায্যে সেই সকল কাগজপত্রে যাহা লিখিত ছিল, তাহা জানিয়া লইলাম, এবং আবশ্যকমত কতক কৃতক লিখিয়াও লইলাম। এইরূপে
যে সকল বিষয় আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহাই অবলম্বন করিয়া এই বিবরণ লিখিত হইতেছে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
যে গ্রামে রামসেবকের বাড়ী, সেই গ্রামের জমিদার গোফুর খাঁ। গোফুর খাঁ যে একজন খুব বড় জমিদার, তাহা নহে; কিন্তু নিতান্ত ক্ষুদ্র জমিদার ও নহেন। ইহার জমি দারীর আয়, সালিয়ানা পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা হইবে। গোফুর খাঁ জমিদার, কিন্তু জমিদার-পুত্র নহেন। তাঁহার পিতা একজন মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ছিলেন। তিনি যাহা কিছু উপার্জন করিতেন, তাহার দ্বারা কোন গতিতে পরিবার প্রতিপালন করিতেন মাত্র; কিন্তু তাহা হইতে একটা কপর্দকও সঞ্চয় করিয়া রাখিতে পারিতেন না। গোফুর খাঁ তাঁহার পিতার প্রথম বা একমাত্র পুত্র। যে সময় তাঁহার পিতা পরলোক গমন করেন, সেই সময় গোফুরের বয়ঃক্রম পনর বৎসরের অধিক ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর অনন্যোপায় হইয়া গোফুর সামান্য চাকরীর উমেদারীতে প্রবৃত্ত হন, এবং আপন দেশ ছাড়িয়া কানপুরে গমন করেন। সেই সময় কানপুরে একজন মুসলমান বাস করিতেন। চামড়ার দালালী করিয়া তিনি শটাকার সংস্থান করিয়াছিলেন, এবং দেশের মধ্যে মান-সম ও একটু সবিশেষ প্রতিপত্তি স্থাপন করিতে পারিয়াছিলেন। গোফুর খাঁ কানপুরে জাসিয়া প্রথমে তাহারই আশ্রয় গ্রহণ করেন, এবং তাহারই নিকট অতি সামান্য বেতনে একটা চাকরী সংগ্রহ করিয়া লন। গোফুর খাঁ অতিশয় বুদ্ধিমান ও সবিশেষ কার্যক্ষম ছিলেন। সুতরাং অতি অল্পদিবসের মধ্যেই তিনি আপন মনিবের প্রিয়পাত্র হইয়া পড়েন, এবং ক্রমে তিনি তাঁহার মনিবের কাৰ্য্যে সবিশেষরূপে সাহায্য করিতে সমর্থ হন্। দিন দিন যেমন তিনি তাঁহার মনিবের প্রিয়পাত্র হইতে ছিলেন, সেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বেতনও ক্রমে বর্ধিত হইতেছিল।
সে যাহা হউক, যে সকল কাৰ্য্য করিয়া তাহার মনিব সেই দেশের মধ্যে প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, পরিশেষে সেই সমস্ত কাৰ্য গোফুর খাঁ নিজে সম্পাদন করিতে লাগিলেন। ইদানীং তাঁহার মনিবকে আর কোন কাৰ্যই দেখিতে হইত না, সকল কাৰ্য গোফুরের উপরেই নির্ভর করিত। গোফুরও প্রাণপণে এরূপ ভাবে কার্য সম্পন্ন করিয়া আসিতে লাগি লেন যে, তাহার মনিবের কার্য পূর্ব অপেক্ষা আরও অতি উত্তমরূপে চলিতে লাগিল। সৰ্বসাধারণে গোফুয়ের মনিবকে যেরূপ ভাবে বিশ্বাস করিতেন, গোফুরকে তাহা অপেক্ষা আরও অধিক বিশ্বাস করিতে লাগিলেন। এমন কি, সেই সময় গোফুরের মনিবকে পরিত্যাগ করিয়া ব্যবসায়ী মাত্রেই গোফুরকে চাহিতে লাগিলেন, ও গোফুরের হস্ত হইতে সমস্ত দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে লাগিল। এই ব্যাপার দেখিয়া গোফুরের মনিব নিজে আর কোন কার্যে হস্তক্ষেপ না করিয়া সমস্ত কার্যভারই গোফুরের উপর অর্পণ করিলেন, এবং পরিশেষে গোফুরকে একজন অংশীদার করিয়া লইলেন। গোরও সবিশেষ পারদর্শিতার সহিত কাৰ্য্য করিয়া ক্রমে যথেষ্ট উপার্জন করিতে আরম্ভ করিলেন।