হোসেন। আচ্ছা মহাশয়! ওসমানই যেন মহাপাতকী, কিন্তু তাহার বৃদ্ধ পিতার অপরাধ কি? পুত্রের অপরাধে পিতাকে দণ্ড দিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন কেন?
দারোগা। বৃদ্ধ পাপী নহে? আমার বিবেচনায় ওসমান অপেক্ষা বৃদ্ধ শতগুণ অধিক পাপ। যে পিতা পুত্রের দুস্কাৰ্য্য সকল জানিতে পারি, তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা না করেন, যাহার নিকট তাহার পুত্রের বিপক্ষে শত সহস্র নালিশ উপ স্থিত হইলেও, তিনি তাহার প্রতি কর্ণপাতও করেন না, সেরূপ পিতাকে সেই অত্যাচারকারী পুত্র অপেক্ষা শতগুণ অধিক পাপী বলিয়া আমার বিশ্বাস। এরূপ অবস্থায় যুবক বালকের বরং মাফ আছে, কিন্তু বৃদ্ধ পিতা কোনরূপেই ক্ষমার্হ নহে।
হোসেন। ওসমান যে অত্যাচারী, সে বিষয়ে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহার অত্যাচারের সকল কথা যে গোফুর খাঁর কর্ণগোচর হয়, তাহা আমার বোধ হয় না। পুত্রের অত্যাচারের কথা শুনিতে পাইলে, তাহার নিবারণের চেষ্টা না করিবেন, সেরূপ পিতা গোফুর খাঁ নহেন। আমার বিশ্বাস যে, এই সকল অত্যাচারের কথা কখনই তাহার কর্ণগোচর হয় নাই। তিনি জানিতে পারিলে, ওসমান এতদুর অত্যাচার করিতে কখনই সমর্থ হইত না।
দারোগা। মিথ্যা কথা, বৃদ্ধ সমস্ত কথা অবগত আছে। জানিয়া শুনিয়া, সে তাহার পুত্রকে কোন কথা বলে না; বরং তাহার অত্যাচারের সাহায্য করে। ওসমান কর্তৃক এমন কোন ঘটনা ঘটিয়াছিল, যাহার সহিত আমার নিজের কোনরূপ সংস্রব ছিল। তাহার প্রতিবিধানের নিমিত্ত আমি নিজে কানপুর পর্যন্ত গমন করিয়া, সমস্ত কথা বৃদ্ধের কর্ণগোচর করি। কিন্তু কৈ, তিনি তাহার কি প্রতিবিধান করিয়াছিলেন?
হোসেন। আমি বুঝিতে পারিতেছি, যে কার্যের সহিত আপনার নিজের সংস্রব ছিল, সেই কাৰ্য্য তাহার কর্ণগোচর হইলেও, তিনি তাহার প্রতিবিধানের কোন চেষ্টা করেন নাই বলিয়া, আপনি অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন। কিন্তু আমার অনুরোধে এখন আপনাকে সেই ক্রোধ পরিত্যাগ করিতে হইবে। আপনার যে কাৰ্য্য তখন ওসমান বা তাঁহার পিতার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই, আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, সেই কাৰ্য এখন আমি সম্পন্ন করিয়া দিব। তদ্ব্যতীত আপনি আর যাহা প্রার্থনা করেন, তাহাও আমি প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি। এখন আপনি একটু অনুগ্রহ করিলেই, আমাদিগের অনেক মঙ্গল হইতে পারিবে।
দারোগা। যে কাৰ্য্যের সহিত আমার সংশ্রব আছে, সে কাৰ্য্য আপনি সম্পন্ন করিয়া দিবেন কি প্রকারে? আপনি কি সেই ঘটনার বিষয় কিছু অবগত আছেন?
হোসেন। সেই সময় ছিলাম না; কিন্তু এখন সমস্তই জানিতে পারিয়াছি, এবং ওসমান তাহাকে কোথায় রাখিয়াছে, তাহাও আমি অনুসন্ধানে অবগত হইতে পারিয়াছি। ইচ্ছা করিলে, এখন তাহাকে অনায়াসেই আপনি পাইতে পারেন।
দারোগা। এই মোকদ্দমা সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণ হইয়া গিয়াছে, তাহা বোধ হয়, আপনি জানিতে পারিয়া ছেন। সমস্তই এখন কাগজ-পত্র হইয়া গিয়াছে। উর্দ্ধতন কর্ম্ম চারীগণ পৰ্য্যন্ত সকলেই এখন ইহার সমস্ত ব্যাপার জানিতে পারিয়াছেন। এখন আর আমার দ্বারা আপনাদিগের কি উপকার হইতে পারে?
হোসেন। প্রথম অবস্থায় আমি এখানে থাকিলে এই মোকদ্দমার অবস্থা কখনই এতদূর হইতে পারি না। কিন্তু এখন যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহার আর উপায় নাই। যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, এখন ইহা অপেক্ষা আর যেন অধিক না ঘটে; আর সাক্ষি-সাবুদের যেন সংগ্রহ না হয়। আমি আপাততঃ আপনার নজর রূপ এই সহস্র মুদ্রা প্রদান করিতেছি। ঈশ্বর যদি অনুগ্রহ করেন, মোক হইয়া গেলে পুনরায় আপনার সহিত নির্জনে সাক্ষাৎ করিব। আর যাহার নিমিত্ত আপনি এতদুর ক্রোধান্বিত হইয়াছেন, আমার সহিত আপনি যখন গমন করিবেন, তখনই আমি তাহার নিকট আপনাকে লইয়া যাইব। তাহার পরে আপনি আপনার ইচ্ছানুযায়ী কর্ম্ম করিবেন। এখন আমাকে বিদায় দিন, আমাকে অনেক কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে হইবে। এখন আপনি আমাদিগের উপর প্রসন্ন হইলেন, কি না, বলুন।
দারোগা। প্রসঙ্গ না হইলেও, যখন আপনি এতদুর বলিতেছেন, তখন কাজেই আমাকে প্রসন্ন হইতেই হইবে। আমি ক্রোধের বশবর্তী হইয়া যতদূর করিবার, তাহা করিয়া ফেলিয়াছি। যাহা করিয়াছি, তাহার আর উপায় নাই। এখন আর অধিক কিছু করিব না।
হোসেন। ওসমান সহ দোষে দোষী, তাহার আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই। গোরও পুত্র-মেহ বশতঃ সেই সকল দোষের প্রতিবিধান করিয়া উঠিতে পারেন নাই সত্য। কিন্তু
মহাশয়! এখন যেরূপ ভাবের মোকদম উপস্থিত হইয়াছে, সাক্ষি-সাবুদের দ্বারা যেরূপ প্রমাণিত হইয়াছে, তাহার কণা মাত্রও প্রকৃত নহে। ইহা আপনি মুখে না বলুন, কিন্তু অন্তরে তাহ আপনাকে স্বীকার করিতে হইবে।
দারোগা। তোমার কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে গোফুর খাঁর তালাবদ্ধ গৃহের ভিতর হেদায়েতের কন্যার মৃত দেহ কিরূপে আসিল?
হোসেন। উহার প্রকৃত ব্যাপার আমি সমস্তই শুনিয়াছি। যদি জানিতে চাহেন, তাহা হইলে আমি গোপনে আপনাকে সকল কথা বলিতে পারি।
দারোগা। গোপনে বলিতে চাহেন কেন?
হোসেন। মোকদ্দমার সময় আমরা সেই কথা স্বীকার করিব কি না, তাহা উপযুক্ত উকীল কৌলির পরামর্শ ব্যতীত বলিতে পারি না। সুতরাং আপনার নিকট গোপনে সেই সকল কথা না বলিলে যে কিরূপ দোষ ঘটিতে পারে, তাহা আপনিই কেন বিবেচনা করিয়া দেখুন না।