নিশানসহি-সেখ হেদায়েৎ।
দারোগা সাহেব প্রথম এতো পুস্তকে এইরূপ এজাহার লিখিয়া উপযুক্তরূপ লোকজন সমভিব্যাহারে এই অনুসন্ধানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। তাহার সহিত গমন করিবার নিমিত্ত যে সকল লোকজনের উপর আদেশ হইল, তাঁহারাও আহারাদি করিয়া ক্ৰমে প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।
সন্ধ্যায় একটু পূর্বে দারোগা সাহেব তাহার লোকজন সমভিব্যাহারে হেদায়েতের গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। হেদায়েতের সমভিব্যাহারে জমাদার সাহেব পূর্বেই সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন। সুতরাং দারোগা সাহেব সেই স্থানে গমন করিলে তাহার যে সকল বিষয়ের প্রয়োজন হইবার সম্ভাবনা, তাহার সমস্তই তিনি সেই স্থানে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন; অর্থাৎ বসিবার স্থান, লোকজন, রাত্রিকালের আহারাদির বন্দোবস্ত সমস্তই ঠিক ছিল। তাহার উপর গ্রামস্থ প্রায় সমস্ত লোকই সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন।
দারোগা সাহেব সেই রাত্রি সেই গ্রামে আহারাদি করিয়া রাত্রিযাপন করিলেন মাত্র; কিন্তু যে বিষয় অনুসন্ধানের নিমিত্ত তিনি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান করা দূরে থাকুক, গ্রামস্থ কোন ব্যক্তিকে সে বিষয়ের কোন একটা কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না। আহারাদি করিয়া রাত্রিকালে যখন দারোগা সাহেব শয়ন করিলেন, সেই সময় তাঁহার আদেশ গ্রহণ করিয়া, গ্রামস্থ সমস্ত লোক প্রস্থান করিলেন; কিন্তু গমন করিবার সময় দারোগা সাহেব তাহাদিগকে পরদিবস অতি প্রত্যুষে পুনরায় সেই স্থানে আসিতে কহিলেন। সমস্ত লোক গমন করিবার পর দারোগা সাহেব জমাদারের সহিত অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ করিয়া উভয়েই নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন।
পরদিবস অতি প্রত্যুষেই দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালিত হইল। সকলে আগমন করিবার পর একে একে তিনি সমস্ত লোককেই দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাদিগের কোন কথা এখন তিনি কাগজ-কলমে করিলেন না; তবে দেখা গেল, সেই সকল লোক যাহা কহিল, তাহার ছত্রে ছত্রে প্রথম এতেলার সহিত মিলিয়া গেল। দারোগা সাহেব নিজের ইচ্ছামত যেরূপ ভাবে প্রথম এতেলা লিখিয়াছিলেন, গ্রামস্থ সমস্ত লোকেই যখন সেইরূপ ভাবে তাহাদের এজাহার প্রদান করিল, তখন তিনি সেই সকল বিষয় কাগজপত্রে না লিখিয়া আর স্থির থাকিতে পারিলেন না।
গ্রামের প্রধান প্রধান চারি পাঁচজনের এজাহার দারোগা সাহেব লিখিয়া লইলেন। গ্রামের কোন লোক ওমানের উপর সন্তুষ্ট ছিল না। সুতরাং সকলেই ওসমান ও তাহার পিতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করিল। সকলেই কহিল যে, হেদায়েতের নিকট হইতে খাজনা আদায় করিবার নিমিত্তই এই গোলযোগ। হোয়েতের কন্যাকে লাইক করিয়া রাখিলেই খাজনা আদায় হইবে, এই ভাবিয়া গোরখা তাহাকে ধরিয়া আনিবার নিমিত্ত আদেশ প্রদান করেন। তাঁহার পুত্র ওসমান অপর কয়েকজন লোকের সাহায্যে এই আদেশ প্রতিপালন করে। পরিশেবে উহার কন্যাকে ধরিয়া তাঁহা দিগের বাড়ীতে লইয়া যায়।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
ওসমান ও তাহার পিতাকে বিপদাপন্ন করিবার মানসে দারোগা সাহেব যাহা মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন, কাৰ্য্যেও তাহা পরিণত হইতেছে দেখিয়া, মনে মনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন।
সেই স্থানে অনুসন্ধান আপাততঃ স্থগিত রাখিয়া হেদায়েৎ ও গ্রামের দুই চারিজন লোককে সঙ্গে লইয়া গোফুর খাঁন বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন।
গোফুর খাঁ সেই সময় বাড়ীতেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ওসমান সেই সময় বাড়ীতে ছিল না। গোফুর খাঁর সহিত দারোগা সাহেবের কিয়ৎক্ষণ কথাবার্তা হইলে পর, ওসমান আসিয়া সেই স্থানে কোথা হইতে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া দারোগা সাহেব কহিলেন, আপনার উপর একটা ভয়ানক নালিশ হইয়াছে। যে পর্যন্ত আমি অনুমতি প্রদান না করি, সেই পৰ্যন্ত আপনি আমার সম্মুখ হইতে গমন করিবেন না।–
ওসমান। আর যদি আমি চলিয়া যাই?
দারোগা। তাহা হইলে আপনার সহিত ভদ্রোচিত ব্যবহার করিতে আমি কোনরূপেই সমর্থ হইব না। সামান্য লোককে যেরূপ ভাবে আমরা রাখিয়া থাকি, বাধ্য হইয়া আপনাকেও সেইরূপ ভাবে আমাকে রাখিতে হইবে।
গোফুর। আমার উপর অভিযোগ কি?
দারোগা। আপনার আদেশ অনুযায়ী আপনার গ্রামবাসী আপনারই প্ৰজা হেদায়েতের যুবতী কন্যাকে অন্যায়রূপে আজ কয়েকদিবস হইতে আপনার বাটীতে আনিয়া আবদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে।
গোফুর। আমার আদেশ অনুযায়ী?
দারোগা। প্রমাণে সেইরূপ অবগত হইতে পারিতেছি।
গোফুর। আমি তাহাকে আবদ্ধ করিতে আদেশ প্রদান করিব কেন?
দারোগা। বাকী খাজানা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে।
গোফুর। মিথ্যা কথা।
দারোগা। সত্য মিথ্যা আমি অবগত নহি; প্রমাণে যাহা পাইতেছি, তাহাই আমি আপনাকে বলিতেছি। আর সেই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া আমাকে ইহার প্রতিবিধান করিতে হইবে।
গোফুর। আপনি প্রমাণ পাইতেছেন, আমার আদেশে এই কাৰ্য্য হইয়াছে?
দারোগা। হাঁ।
গোফুর। আমার আদেশ প্রতিপালন করিল কে? অর্থাৎ কে তাহাকে ধরিয়া আনিল?
দারোগা। আপনার পুত্র, এবং আর তিন চারিজন নোক।
গোফুর। সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আপনি এখন কি করিতে চাহেন?
দারোগা। আপনি যদি সহজে সেই স্ত্রীলোকটীকে বাহির করিয়া না দেন, তাহা হইলে প্রথমতঃ আপনার বাড়ী আমি উত্তমরূপে খানাতল্লাসি করিয়া দেখিব। দেখিব, উহার ভিতর সেই স্ত্রীলোকটা পাওয়া যায়, কি না।