আমার কথায় শোভন সিং কাতর হইলেন। বলিলেন, আমার কন্যার মৃতদেহ পৰ্যন্ত পাইতেছি না। অগ্ৰে তাহার সন্ধান না করিয়া কেমন করিয়া থানায় সংবাদ দিব। যদি আপনার ইচ্ছা হয়, আপনি এখনই সংবাদ দিতে পারেন। আমি এক কোনদিক দেখিব?
কথা শুনিয়া আমার সন্দেহ আরও বৃদ্ধি পাইল। আমি তখনই সেখান হইতে বিদায় লইলাম এবং তৎক্ষণাৎ বরবেশ ত্যাগ করিয়া আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। এখন আপনিই আমার একমাত্র ভরসা। রূপসীকে পাই ভালই, নচেৎ আমার আটশত টুকো ফিরাইয়া চাই। আপনাকে ঐ টাকা আদায় করিয়া দিতে হইবে।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার নিবাস কোথায়? নামই বা কি?
তিনি বলিলেন, আমার নাম লাল সিং, বাড়ি শিয়ালদহের নিকট।
লালসিং–এর টাকার কথায় আমি কোন উত্তর করিলাম না দেখিয়া, তিনি পুনরায় ঐ কথা তুলিলেন। আমি বলিলাম, টাকা আদায় করিবার ক্ষমতা আমাদের নাই। আমি কেবল খুনের তদ্বির করিতে পারিব।
এই কথা শেষ হইতে না হইতে গাড়ীখানি একটী ক্ষুদ্র অট্টালিকার সম্মুখে থামিল। লালসিং অগ্ৰে গাড়ী হইতে অবতরণ করিলেন। আমিওঁ নামিয়া তাঁহার সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করিলাম।
কিছুদূর অগ্রসর হইয়া আমরা একটী ক্ষুদ্র প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, বিবাহোৎসব সম্পন্ন করিবার জন্য বাড়ীখানি বেশ সাজানো হইয়াছে। চারিদিকে বেলোয়ারি ঝাড় ঝুলিতেছে, একখানি চাঁদোয়া দ্বারা সমস্ত প্রাঙ্গন আচ্ছাদিত রহিয়াছে। তাহারই নিম্নে একটা ঢালা বিছানা পাড়া ছিল। সেই বিছানার এক পার্শ্বে পাত্রের বসিবার স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে। কিন্তু একজন লোককে ও সেই শয্যার উপর দেখিতে পাইলাম না। অন্দর হইতে রমণীদিগের রোদনশব্দ আমার কর্ণগোচর হইতে লাগিল। কিন্তু শোভনসিংকে দেখিতে পাইলাম না।
কিছুক্ষণ প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া আছি, এমন সময় লালসিং অঙ্গুলি নির্দেশ দ্বারা একজনকে দেখাইয়া বলিলেন, ইনিই শোভন সিং আমার ভাবী শ্বশুর।
শোভন সিং আমাকে দেখিয়া স্তম্ভিত হলেন। কিন্তু তখনই আত্মসংবরণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনিই কি আমার কন্যার মৃতদেহ দেখিতে আসিয়াছেন?
আমি লালসিংকে দেখাইয়া বলিলাম, ইনি বলেন, আপনার কন্যা খুন হইয়াছে। কিন্তু আপনি ইঁহাকে তাহার মৃতদেহ দেখাইতেছেন না। আমি ইঁহার মুখে সমস্তই শুনিয়াছি। এখন লাস কোথায় বলুন?
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আমার কথা শুনিয়া শোভন সিং চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। পরে কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, মহাশয়। আমার একমাত্ৰ সন্তান–ঐ কন্যা ভিন্ন আমার আর কোন সন্তানাদি হয় নাই। তাহার বিয়োগে আমি যে অত্যন্ত কাতর হইয়াছি এ কথা বলাই বাহুল্য।
শোভন সিংএর অবস্থা দেখিয়া এবং তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়া আমার কেমন সন্দেহ হইল। তাহার বয়স প্ৰায় বিয়াল্লিশ বৎসর; কিন্তু এই বয়সেই তাহার দেহের মাংস শিথিল হইয়াছে, সম্মুখের, উপর–পাটীর দুইটী দাঁত পড়িয়া গিয়াছে। গোঁপ শ্মশ্রু ও মস্তকের কেশ পাক ধরিয়াছে। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ, তাঁহার দেহ দীর্ঘ ও শীর্ণ, হস্ত প্ৰায় আজানুলম্বিত, চক্ষু ক্ষুদ্র ও কোটরগ্ৰস্ত নাসিক উন্নত এবং ললাট প্রশস্ত। মুখ দেখিয়াই কেমন ক্রূর প্ৰকৃতি বলিয়া বোধ হইল।
অপর কথায় সময় নষ্ট করিতেছেন দেখিয়া আমি বিরক্ত হইলাম। বলিলাম,–আমি আপনার দুঃখের কথা শুনিতে আসি নাই। কন্যাবিয়োগে আপনি যে কাতর হইবেন, ইহাতে আর আশ্চর্য্য কি? এখন আমি যাহা জিজ্ঞাসা করি, তাহার উত্তর দিন; আপনার কন্যার লাস কোথায় বলুন?
আত্ম সংবরণ করিয়া শোভন সিং বলিলেন,–সেই কথাই বলিতেছি,–রূপসীর লাস পাওয়া যাইতেছে না।
আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–সে কি! লাস পাওয়া যাইতেছে না কি?
কাঁদ কাঁদ হইয়া শোভন সিং বলিলেন,–এখান হইতে কিছু দূরে আমার এক আত্মীয় বাস করেন, রূপসী আজি প্রাতে তাঁহাদের বাড়ীতে গিয়াছিল। বাছা আমার সেই অবধি আর ফিরে নাই।
তবে খুন হইয়াছে বলিতেছেন কেন? আপনার কন্যা নিরুদেশ হইয়াছে। হয় সে নিজে পলায়ন করিয়াছে, নচেৎ কোন লোক তাহাকে লইয়া পলায়ন করিয়াছে।
না মহাশয়! সকল কথা শুনিলে বুঝিতে পরিবেন। রূপসী আর এ জগতে নাই।
এই বলিয়া শোভন সিং আবার চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। কন্যাবিয়োগে তিনি বড়ই কাতর হইয়া পড়িলেন। কিছুক্ষণ পরে শান্ত হইয়া আবার বলিতে লাগিলেন,–প্ৰাতে রূপসী একজন সঙ্গিনী লইয়া এ বাড়ী হইতে বাহির হয়। পথে এক বৃদ্ধা তাহার সহিত আলাপ করে এবং উভয়কেই ভুলাইয়া লইয়া যায়। যে রূপসীর সঙ্গে গিয়াছিল, অনেকক্ষণ পরে সে ফিরিয়া আসিয়াছে, কিন্তু রূপসী আর ফিরে নাই। গৌরীর মুখে যাহা যাহা এখন শুনিতেছি, তাহা বড়ই ভয়ানক।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম,–গৌরী কে?
গৌরী আমার ভাগিনেয়ী, রূপসীর বিবাহ উপলক্ষে এখানে আসিয়াছে। গৌরীই রূপসীর সহিত প্ৰাতে আমার আত্মীয়ের বাড়ীতে নিমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়াছিল।
আ। সে কি বলে?
শো। আমি তাহাকে ডাকিয়া আনিতেছি, আপনি তাহার মুখেই সকল কথা শুনুন। এমন ইংরাজ রাজত্বে এখনও যে এই লোমহর্ষণ কাণ্ড ঘটিতে পারে, আমার এমন ধারণা ছিল না।
এই বলিয়া আমার উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া তিনি অন্দরে প্ৰবেশ করিলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই এক খৰ্বীকৃতি বালিকার হস্তধারণ করিয়া পুনরায় তথায় উপস্থিত হইলেন। পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন–এই বালিকার নাম গৌরী, আপনি ইহার মুখেই সমস্ত শুনতে পারবেন। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, গৌরী যখন ফিরিয়া আইসে, তখন তাহার কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না। সে যেন পাগলের মত হইয়া গিয়াছিল।