দারোগা। যা ব্যাটা, তবে তোর মোক গ্রহণ করিব। তুই বাড়ীতে হিলি নি, এত কথা যে কি, তাহার তুই কি জানি? আমরা ইতিপূর্বে সকল কথা জানিতে পারিয়াছি, কেবল কোন ব্যক্তি আমার নিকট আসিয়া নালিশ করে নাই বলিয়া, আমি এ পর্যন্ত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই নাই। আমি যেরূপ কহিলাম, সেইপের সাক্ষী সকল সংগ্রহ করিয়া রাখ গিয়া। আমি একজন মাদারকে সঙ্গে দিতেছি, যাহা তুই বুঝতে না পাবি, তিনি তাহা হতাকে বুঝাইয়া দিবেন। তাঁহারা আমি গিন্ধ আসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব।
আগন্তুক। দোহাই ধৰ্মবতায়! যাহাতে আমি আমার কাটীকে পাই, আপনাকে সেই উপায় করতে হবে।
দারোগা। তাহাই হইবে। এখন তুই আমার জমা দারের সহিত গমন করিয়া সাক্ষী-সাবুদের সংগ্রহ করিয়া দে। তুই লেখা-পড়া জানিস্ কি? আগন্তুক। আমরা চাষার ছেলে, লেখাপড়া শিখি নাই।
দারোগা। নিজের নাম লিখিতে পারি?
আগন্তুক। না মহাশয়! আমি আমার নাম পর্যন্ত লিখিতে পারি না।
দারোগা। তোর নাম কি?
আগন্তুক। আমার নাম শেখ হেদায়েৎ।
দারোগা। আচ্ছা হেদায়েৎ, তুমি আমার জমাদারের সহিত তোমার গ্রামে গমন কর। আহারান্তে আমি নিজে গিয়া এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব। সাক্ষীগণ যেন উপস্থিত থাকে।
হেদায়েৎকে এই কথা বলিয়া, দারোগা সাহেব তাহার একজন সবিশেষ বিশ্বাসী জমাদারকে ডাকিলেন, এবং নির্জনে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাহার সহিত কি পরামর্শ করিয়া পরি শেষে তাহাকে কহিলেন, এই মোকদ্দমায় বিশেষরূপে তোমাকে আমার সাহায্য করিতে হইবে। যে সুযোগ পাইয়াছি, সে সুযোগ কিছুতেই পরিত্যাগ করিতে পারিব না। আমার কোন ক্ষমতা কাছে কি না, এবং আমার ঘর ওসমান ও তার পিতার কোনরূপ অনিষ্ট ঘটতে পারে কি না, তা তাহা তাহাদিগকে উত্তমরূপে দেখাইতে হইবে। যেরূপ উপায়েই হউক, উঁহাদিগের উভয়কেই জেলে দিয়া আমার এতদিসের মনের যন্ত্রণা নিবারণ করিতে হইবে।
দারোগা সাহেবের কথা শুনিয়া জমাদার কহিল, আপনি যত শীঘ্র হয়, আগমন করুন। আমি সেই স্থানে গমন করি মাত্রই সমস্ত ঠিক করিয়া ফেলিব। তাহার নিমিত্ত আপনাকে ভাবিতে হইবে না
এই বলিয়া হেদায়েৎকে সঙ্গে লইয়া জমাদার তৎক্ষণাৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
জমাদার ও হেদায়েৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, দারোগা সাহেব প্রথমে এতেলা পুস্তক নিজ হস্তে গ্রহণ করিয়া, নিম্নলিখিতরূপে প্রথম এতেল ফরিয়াদীর অসাক্ষাতেই লিখিলেন।
আমার নাম সেখ হেদায়েৎ। আমার বাসস্থান * * * গ্রাম। গত আটদিবস হইতে আমি আমার বাড়ীতে ছিলাম না, * * * গ্রামে আমার কুটুম্ব * * *-র নিকট আমি আমার কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে গমন করিয়াছিলাম। আমার বাড়ীতে অপর কেহ নাই; কেবলমাত্র আমার যুবতী কন্যা * * *-কে আমি বাড়ীতে রাখিয়া গিয়াছিলাম। অন্য প্রাতঃকালে আমি বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়া, আমার কন্যাকে আমার বাড়ীতে দেখিতে পাইলাম না। পাড়া-প্রতিবাসীগণের নিকট অনুসন্ধান করিয়া আনিতে পারিলাম যে, আমাদিগের গ্রামের জমিদার গোফুর খাঁ তাহার পুত্র ওসমান এবং কয়েকজন কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া খাজনা আদায় করিবার নিমিত্ত আমাদিগের গ্রামে আগমন করেন, এবং গ্রামের এক স্থানে বসিয়া প্রজাগণকে ডাকাইয়া খাজানার তহবিল করিতে থাকেন। শুনিলাম, আমাকেও ডাকিবার নিমিত্ত তিনি একজন পাইক পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। আমি বাড়ী ছিলাম না। সুতরাং পাইক আমাকে দেখিতে পায় নাই। মে গিয়া জমিদার মহাশয়কে কহে, হেদায়েৎ বাড়ীতে নাই, কেবল তাহার কন্যা বাড়ীতে আছে। সে কহিল, তাহার পিতা অদ্য দুই দিবস হইল, কুটুম্ব বাড়ীতে গমন করিয়াছে। এই কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় অতিশয় ক্রোধাবিত হইলেন ও কহিলেন, হেদায়েৎ কোন স্থানে যায় নাই। অনেক টাকা খাজানা বাকী পড়িয়াছে, আমার নিকট আসিলে খাজনা দিতে হইবে, এই ভয়ে সে লুক্কায়িত আছে। যা হক তাহার কন্যাকে ধরিয়া আন, তাহা হইলে সে এখনই আসিয়া খাজনা মিটাইয়া দিবে। এই আদেশ পাইয়া জমিদারের পুত্র ওসমান কয়েকজন কর্ম্মচারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে আমার বাড়ী হইতে তার অনিচ্ছা-স্বত্বে জোর করিয়া তাহাকে ধরিয়া জমিদার মহাশয়ে নিকট লইয়া যায়। জমিদার মহাশ প্রায় দুই ঘণ্টা তাহাকে সেই স্থানে বসাইয়া রাখেন। যুবতী স্ত্রীলোকের এইরূপ অবমাননা দেখিয়া, গ্রামস্থ সমস্ত লোক আমার কন্যাকে ছাড়িয়া দিবার নিমিত্ত জমির মহাশয়কে বার বার অনুরোধ করেন; কিন্তু তিনি কাহারও কথায় কর্ণপাত না করিয়া, সেই স্থান হইতে গমন করিবার সময় তাঁর পুত্র ওসমান ও অপরাপর কৰ্ম্ম চারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে বাঁধিয়া তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগের বাড়ী পর্যন্ত লইয়া যান। বাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়া, তাঁহারা যে আমার কন্যার কি অবস্থা করিয়াছেন, তাহা আমি অবগত নহি। সেই পর্যন্ত আমার কন্যা আর প্রত্যাগমন করে নাই, বা গ্রামের কোন ব্যক্তি আর তাহাকে দেখে নাই। আমার অনুমান ও বিশ্বাস যে, জমিদার মহাশয় এবং তাহার পুত ওসমান আমার কন্যাকে তাহার বিনা-ইচ্ছায় তাহাদিগেয় বাড়ীর ভিতর অন্যায়রূপে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, বা তাহাকে হত্যা করিয়াছে। আমি আপন ইচ্ছায় আমার কন্যাকে পাইবার মানসে এই এজাহার দিতেছি। ইহাতে যেরূপ অনুসন্ধানের প্রয়োজন, সেইরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া আমার কন্যাকে বাহির করিতে, আজ্ঞা হয়। আমি যে এজাহার দিতেছি, গ্রামশুদ্ধ সমস্ত লোক তাহার সাক্ষী আছে। সেই স্থানে গমন করিলেই, আপনি জানিতে পারিবেন যে, আমার কথা সম্পূর্ণরূপ সত্য কি না আমি লেখা-পড়া জানি না, আমার এজাহার যায় আপনি লিখিয়া লইলেন, তাহা পাঠ করিয়া পুনরায় আমাকে আপনি শুনাইয়া দিলেন; আমি যেরূপ বলিয়াছি, ঠিক সেই রূপই লেখা হইয়াছে। আমি আমার এজাহার শুনিয়া, আমি এই স্থানে নিশানসহি করিলাম। ইতি–