তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
যে গ্রামে গোর খাঁর বাড়ী, সেই গ্রামের নিকটবর্তী একখানি গ্রামে পুলিসের থানা আছে; সেই থানার ভার প্রাপ্ত কর্ম্মচারী একজন মুসলমান দারোগা। দারোগা সাহেব একজন খুব উপযুক্ত কর্ম্মচারী। জেলার ভিতর তাঁহার খুব নাম আছে, সরকারের ঘরেও তাঁহার বেশ খাতির আছে। কিন্তু তাহার নিজের চরিত্র সাধারণত দারোগা-চরিত্রের বহিত নহে।
দারোগা সাহেবের বয়ঃক্রম চল্লিশ বৎসরের কম নহে, বরং দুই এক বৎসর অধিক হইবারই সম্ভাবনা। পুলিশ বিভাগে প্রথম প্রবৃত্ত হইবার পূর্বে তাঁহার যেরূপ চরিত্ৰ-দোষ ছিল, এখন তাহা অপেক্ষা অনেক বর্ধিত হইয়া পড়িয়াছে, এবং দিন দিন বর্ষিত হইয়াই চলিয়া যাইতেছে।
কোন গ্রামে কোন একটী মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে গিয়া, একটা রূপবতী যুবতী তাঁহার মজয়ে পতিত হয়। পরিশেষে কোন-না-কোন উপায় অবলম্বন করিয়া, ক্রমে দারোগা সাহেব তাহাকে গৃহের বাহির করেন, এবং থানার সন্নিকটবর্তী কোন এক স্থানে একখানি বাড়ী প্রস্তুত করিয়া দিয়া, তাহাকে সেই স্থানে রাখিয়া দেন। সেই স্ত্রীলোকটা দুই বৎসরকাল সেই স্থানে বাস করিয়া দারোগা সাহেবের মনস্তুষ্টি সম্পাদিত করে।
সেই যুবতী যে সবিশেষ রূপবতী, এ কথা শোক-মুখে ক্রমে প্রকাশিত হইয়া পড়ে, এবং ক্রমে ওসমানের জনৈক পারিষদ এ কথা জানিতে পারিয়া, ওসমানের কর্ণগোচর করিয়া দেয়। যুবতী-রূপবতীর কথা শুনিয়া ওসমান আর তাহার মন স্থির করিতে পারিল না; কোন উপায় অবলম্বন করিলে, সে সেই যুবতীকে হস্তগত করিতে পারিবে, তাহারই চিন্তায় অতিশয় ব্যগ্র হইয়া পড়িল, ও ক্রমে আপন মনোভাব প্রকাশ করিয়া সেই যুবতীর নিকট তোক প্রেরণ করিল।
যুবতী তাহার প্রস্তাবে প্রথমে স্বীকৃত হইল না; কিন্তু ওসমানও তাহার আশা পরিত্যাগ করিল না। যে কোন উপায়েই হউক, তাহাকে আয়ত্ত করিবার নিমিত্ত সবিশেষ রূপ চেষ্টা করিতে লাগিল।
যে স্ত্রীলোক একবার তাহার কুলে জলাঞ্জলি দিয়া পর পুরুষের সহিত চলিয়া আসিয়াছে, এবং এতদিবস পর্যন্ত পরপুরুষেয় সহিত অনায়াসে কালযাপন করিতেছে, সেই স্ত্রীলোককে প্রলোভনে ভুলাইতে আর কতদিন অতিবাহিত হয়? দারোগা সাহেবের বয়ঃক্রম অধিক, ওসমানের বয়ঃক্রম তাহ অপেক্ষা অনেক অর। দারোগা সাহেব পরাধীন, ওসমান স্বাধীন। দারোগা সাহেবকে চাকরীর উপর নির্ভর করিয়া সমস্ত খরচ-পত্ৰ নিৰ্বাহ করিতে হয়, আর ওসমান জমিদার-পুত্র, গোফুর খাঁর মৃত্যুর পর সেই অগাধ জমিদারীর তিনি একমাত্র অধিকারী। যেস্থলে দারোগা সাহেবকে শত মুদ্রা খরচ করিতে হইলে তাহাকে অন্ধকার দেখিতে হয়, সেই স্থলে ওসমান সহস্র মুদ্রা অকাতরে ব্যয় করিতে সমর্থ। এরূপ অবস্থায় সেই স্ত্রীলোকটীকে ওসমানের করায়ত্ব করা নিতান্ত দুরূহ কাৰ্য্য নহে। বলা বাহুল্য, ক্রমে যুবতী ওমানের হস্তগত হইয়া পড়িল; দারোগা সাহেবকে পরি ঊ্যাগ করিয়া সে ওসমানের অনুবর্তিনী হইল। ওসমান তাহাকে সেই স্থান হইতে স্থানান্তরিত করিয়া, কোন লুকা য়িত স্থানে তাহাকে রাখিয়া দিল।
সুন্দরী যে কাহার সহিত কোথায় গমন করিল, এ কথা দারোগা সাহেব প্রথমত জানিতে পারিলেন না; কিন্তু ক্রমে এ সংবাদ জানিতে তাহার বাকী রহিল না। যখন তিনি জানিতে পারিলেন যে, ওসমান তাঁহার মুখের পথে কণ্টক হইয়া তাঁহার যকের ধন অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, তখন তিনি তাহার উপর যেরূপ ক্রোধান্বিত হইয়া পড়িলেন, তাহা বর্ণন করা এ লেখনীর কাৰ্য্য নহে। দারোগা সাহেব প্রথমত সেই সুন্দরীকে পুনরায় আপনার নিকট আনয়ন কয়বার নিমিত্ত সবিশেরূপ চেষ্টা করিলেন। কিন্তু কোনরূপেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। এমন কি, দারোগা সাহেব এই কথা জমে ওসমানের পিতার কর্ণ গোচর পর্যন্ত করাইলেন। তাহাতেও কোনরূপ সুফল ফলিল না। ওসমানের পিতা এ বিষয়ে কোনরূপে দারোগা সাহেবকে সাহায্য নিলেন না।
এই সকল কারণে দারোগা সাহেবের প্রচণ্ড ক্রোধের সামান্যমাত্রও উপশম হইল না। কিরূপে তিনি ওসমান ও তাহার পিতাকে ইহার প্রতিশোধ দিতে পারিবেন, তাহার চেষ্টাতেই দিনরাত্রি অতিবাহিত করিতে লাগিলেন, এবং অনবরত প্রতিশোধের সুযোগ অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন।
এইরূপে ক্ৰমে এক বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল। এই এক বৎসরের মধ্যে দারোগা সাহেব সেই সুন্দরীর আশা পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না, বা প্রতিহিংসার প্রবল চিন্তাকেও হৃদয় হইতে তাড়িত করিতে সমর্থ হইলেন না।
এইরূপে আরও কিছু দিন অতিবাহিত হইয়া গেল। একদিবস প্রাতঃকালে দারোগা সাহেব থানায় বসিয়া আছেন, এরূপ সময়ে একটা লোক গিয়া থানায় উপস্থিত হইল, ও কাঁদিতে দিতে আমোগার সম্মুখীন হইয়া কহিল, বর্ষাবতার। আপনি আমাকে এই বিপদ হইতে রক্ষা করুন। আপনি রক্ষা না করিলে, আর কেই আমাকে রক্ষা করিতে পারিবে না।
দারোগা। কি হইছে?
আগন্তুক। ওসমান আমার সর্বনাশ করিয়াছে।
দারোগা। ওসমান! কোন ওসমান, গোর ধীর পুত্র ওসমান?
আগন্তুক। মহাশয়!
দারোগা। সে তোমার কি করিয়াছে?
আগন্তুক। সে আমার একমাত্র কন্যাকে জোর করিয়া আমার ঘর হইতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।
দারোগা। কেন সে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গেল?
আগন্তুক। কু-অভিপ্রায়ে সে তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।