সে যাহা হউক, যে সকল কাৰ্য্য করিয়া তাহার মনিব সেই দেশের মধ্যে প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, পরিশেষে সেই সমস্ত কাৰ্য গোফুর খাঁ নিজে সম্পাদন করিতে লাগিলেন। ইদানীং তাঁহার মনিবকে আর কোন কাৰ্যই দেখিতে হইত না, সকল কাৰ্য গোফুরের উপরেই নির্ভর করিত। গোফুরও প্রাণপণে এরূপ ভাবে কার্য সম্পন্ন করিয়া আসিতে লাগি লেন যে, তাহার মনিবের কার্য পূর্ব অপেক্ষা আরও অতি উত্তমরূপে চলিতে লাগিল। সৰ্বসাধারণে গোফুয়ের মনিবকে যেরূপ ভাবে বিশ্বাস করিতেন, গোফুরকে তাহা অপেক্ষা আরও অধিক বিশ্বাস করিতে লাগিলেন। এমন কি, সেই সময় গোফুরের মনিবকে পরিত্যাগ করিয়া ব্যবসায়ী মাত্রেই গোফুরকে চাহিতে লাগিলেন, ও গোফুরের হস্ত হইতে সমস্ত দ্রব্যাদি ক্রয় করিতে লাগিল। এই ব্যাপার দেখিয়া গোফুরের মনিব নিজে আর কোন কার্যে হস্তক্ষেপ না করিয়া সমস্ত কার্যভারই গোফুরের উপর অর্পণ করিলেন, এবং পরিশেষে গোফুরকে একজন অংশীদার করিয়া লইলেন। গোরও সবিশেষ পারদর্শিতার সহিত কাৰ্য্য করিয়া ক্রমে যথেষ্ট উপার্জন করিতে আরম্ভ করিলেন।
এইরূপে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হইবার পর গোফুলের মনিব বা অংশীদার ইহলীলা সম্বরণ করিলেন; সুতরাং এখন সেই কার্যের সমস্ত অংশই গোফুরের হইল। গোফুরও সবিশেষ মনোযোগের সহিত আপন কাৰ্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিতে লাগিলেন। এইরূপে দুই একখানি করিয়া ক্রমে জমিদারী ক্রয় করিতে লাগিলেন। এইরূপে তিনি যে সকল জমিদারী ক্রমে ক্রয় করিয়াছিলেন, সেই সকল জমিদারীর আয় পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকায় দাঁড়াইল। সেই সময় গোফুর খাঁও ক্রমে বৃদ্ধ হইয়া পড়ায় আপনার ব্যবসা পরিত্যাগ করিলেন, এবং কেবলমাত্র তাহার জমিদারীতেই আপনার মন নিয়োগ করিবার মানস করিলেন।
গোফুর খাঁর কেবল একটামাত্র পুত্র জন্মিয়াছিল, তাহার নাম তিনি ওসমান রাখিয়াছিলেন। আপন পুত্র ওসমানকে প্রথমতঃ তিনি আপনার ব্যবসা কার্য শিখাইবার নিমিত্ত সবিশেষরূপ চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনরূপে আপন মনস্কামনা পূর্ণ করিতে পারেন নাই। বাল্যকালে গোফুর খাঁর যেরূপ প্রকৃতি ছিল, তাঁহার পুত্র ওসমানের প্রকৃতি বাল্যকাল হইতেই তাহার বিপরীত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। গোফুর খাঁ সৰ্ব্বদা আপন কার্যে মন নিয়োগ করিতেন, ওসমান কেবল অপরের সহিত মিলিয়া আমোদ-আহলাদ করিয়া দিন অতি বাহিত করিতে লাগিল।
গোফুরের চেষ্টা ছিল, কিরূপে আপনার কাৰ্য্যে তিনি সবিশেষরূপে উন্নীত হইতে পারেন।
ওসমান ভাবিতেন, অসৎ উপায় অবলম্বনে কিরূপে তিনি তাঁহার পিতার উপার্জিত অর্থ ব্যয় করিতে সমর্থ হন।
গোফুর সর্বদা সৎকার্যের দিকে দৃষ্টি রাখিতেন। কিরূপে দশজন প্রতিপালিত হয়, কিরূপে দশজনের উপকার করিতে পারেন, তাহার দিকে সর্বদা তিনি লক্ষ্য রাখিতেন।
ওমানের লক্ষ্য হইয়াছিল, কেবল অসৎ কার্যের দিকে। আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রগণের প্রতিপালনের পরিবর্তে কতকগুলি নীচজাতীয় বার-বনিতা তাহার দ্বারা প্রতিপালিত হইত।
ওসমানের এইরূপ অবস্থা সত্বেও একমাত্র সন্তান বলিয়া তাঁহার পিতা গোফুর খা তাহাকে কিছু বলিতেন না। সুতরাং ওসমারের অত্যাচার বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস হইবার পরিবর্তে ক্রমে আরও বর্ধিত হইতে লাগিল।
গোফুর খাঁ নিতান্ত বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন বলিয়া, তিনি মনে করিয়াছিলেন, ব্যবসা কার্যের ভার তিনি তাহার পুত্র ওসমান খাঁর হস্তে প্রদান করিবেন; কিন্তু তাহার চরিত্র দেখিয়া আপনার ইচ্ছাপূর্ণ করিতে পারিলেন না। অথচ ব্যবসায়ীগণের অনুরোধ রক্ষা করিতে গিয়া, তিনি আপন কাৰ্য্য পরিত্যাগ পূর্বক আপন বাড়ীতে বসিয়া তাহার বৃদ্ধাবস্থায় যে কিছু দিবস বিশ্রাম করিবেন, তাহাতেও তিনি সমর্থ হইলেন না। তাহাকে সৰ্ব্বদা কানপুরেই থাকিতে হইত। এদিকে অবসর পাইয়া ওসমান জমিদারীর ভিতর যথেচ্ছ ব্যবহার করিত। তাহার অত্যাচারে প্রজাগণের মধ্যে কেহই শান্তিলাভ করিতে পারিত না। কিরূপে ওমানের হক হইতে আপনাপন স্ত্রী-কন্যার ধৰ্ম্ম রক্ষা করিতে সমর্থ হইবে, কেবল তাহার চিন্তাতেই তাহাদিগকে সর্বদা দিন অতিবাহিত করিতে হইত।
ওমানের এই সকল অত্যাচারের কথা ক্রমে তাহার পিতা গোফুর ধার কর্ণগোচর হইতে লাগিল; কিন্তু গোফুর খ তাহার প্রতিকারের কোনরূপ চেষ্টাও করিলেন না।
এইরূপ নানা কারণে, প্রজাগণ ক্রমে তাহাদিগের অবাধ্য হইয়া পড়িতে লাগিল। জমিদারীর খাজনা প্রায়ই তাঁহারা বাকী ফেলিতে লাগিল, বিনা-নালিশে খাজনা আদায় প্রায় একরূপ বন্ধ হইয়া গেল।
এই সকল অবস্থা দেখিয়াও ওসমানের অত্যাচারের কিছু মাত্র নিবৃত্তি হইল না। তাহার কতকগুলি অশিক্ষিত ও দুষ্টমতি পরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী সেই সকল অত্যাচার ক্রমে বৃদ্ধিই হইতে লাগিল। তাহাদিগের অত্যাচারে অনেককেই তাহার জমিদারী পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে হইল। বিশেষতঃ যাহাদিগের গৃহে সু যুবতী স্ত্রীলোক আছে, তাহাদিগের সেই স্থানে বাস করা একবারেই অসম্ভব হইয়া পড়িতে লাগিল।
এরূপ পাপে কতদিবস প্রজাগণ সন্তুষ্ট থাকে। বা ঈশ্বরই আর কতদিবস এ পাপ মার্জনা করেন। ওসমান একজন মধ্যবিদ জমিদারের পুত্র বইত নয়? এরূপ অত্যাচার করিয়া যখন নবাব সিরাজদ্দৌল্লা প্রভৃতিও নিষ্কৃতি পান নাই, তখন এই সামান্য জমিদার-পুত্র যে অনায়াসেই নিষ্কৃতি পাইবেন, তাহা কিছুতেই হইতে পারে না। সমস্ত কার্যেরই সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করিলে যে অবস্থা ঘটিয়া থাকে, ওসমানের অদৃষ্টে যে সেই অবস্থা না ঘটিবে, তাহা কে বলিতে পারে?